কাল তুমি আলেয়া – ৭

সাত

ওষুধের দোকানে ম্যানেজারের অভ্যর্থনা কি রকম হতে পারে ধীরাপদ সেটা আঁচ করেই এসেছিল। পর পর দু দিনের সঞ্চিত রাগ তাঁর। ভিতরে ভিতরে ধৈর্যচ্যুত বলেই বাইরে কিছুটা শান্ত দেখালো তাঁকে। ইস্কুল-পালানো ছেলেকে আওতার মধ্যে পেয়ে কড়া মাস্টার খানিকক্ষণ নির্বিকার থেকে যে ভাবে ছাত্রের শঙ্কাটুকু উপভোগ করেন, অনেকটা তেমনি নির্বিকার। কিন্তু অপরাধী ছাত্রের ভাব-ভঙ্গিতে উল্টে ঔদ্ধত্যের আভাস পেলে কতক্ষণ আর ধৈর্য থাকে?

দু-দিন বাদে এসেও বাবু একবার মুখ কাঁচুমাচু করে সামনে এসে দাঁড়াল না। প্রথম দিন না বলে-কয়ে, ডিউটি কখন না জেনে চলে যাওয়াটাই বেশ অপরাধ। গতকাল দুপুরের দিকে একবার ঢুঁ দিয়ে চলে গেছে। তারপর আজকের এই বেলা পাঁচটায় হাজিরা। এখানে একসঙ্গে এতগুলো অপরাধের বিচার এর আগে আর তাঁকে কখনো করতেও হয়নি বোধ হয়। তার ওপর কাউকে একটিও কথা না বলে চুপচাপ ওই বেঞ্চিতে বসে থাকা।

শুধু ম্যানেজারই ক্রুদ্ধ নয়, ধীরাপদর মনে হল তার আচরণে কর্মচারীরাও বিস্মিত। রমেন হালদারের সশঙ্ক দৃষ্টিনিক্ষেপে তার প্রতি নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ, কাছে এসে উপদেশ দেওয়া সম্ভব নয় বলে তার চাপা অস্বস্তি।

খদ্দের বেশি ছিল না। আর একটু হালকা হতেই স্থূল-বপু ম্যানেজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। -এই যে বাবু, আপনি এসে গেছেন দেখছি! কাজ করবেন তা হলে?

এর পরেও উঠে না দাঁড়ানোটা ধীরাপদর ইচ্ছাকৃত নয়। মজার আভাস পেলে মজা দেখাটা বহুকালের অভ্যাস। ঘুরে বসে নিরীহ চোখ দুটো তাঁর ব্যঙ্গ-তপ্ত ভারী মুখখানির ওপর স্থাপন করল শুধু।

     ম্যানেজার ফেটে পড়লেন। কাঁচা-পাকা ঝাঁকড়া-চুল মাথাটা শূন্যের ওপর সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে তাল ঠুকতে লাগল। গোল চোখ দুটো ড্যাব ড্যাব করে উঠল। —এটা কোনো মাতুল-সম্পর্কিত বিশ্রামের জায়গা নয়, বেঞ্চিতে বসে দেখার জন্যে থিয়েটারের স্টেজও নয়, এখানে নিয়মকানুন বলে কিছু কথা আছে, এখানে ঘড়ি বলে একটা জিনিস আছে, এখানে ডিউটি বলে একটা ঝামেলা আছে, ওর মত লোক দিয়ে এখানে কাজ চলবে না সেটা আজ তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেবেন, বেঞ্চিতে বসে হাওয়া খেতে হলে গড়ের মাঠ এর থেকে ভালো জায়গা—ইত্যাদি ইত্যাদি। 

আরো চলত হয়ত কিছুক্ষণ। কিন্তু ধীরাপদ এক কাণ্ড করে বসল। এখানে ওর জোর সম্বন্ধে অমিতাভ ঘোষের গতকালের আশ্বাস বা চারুদির কথার প্রতিক্রিয়া কিনা নিজেও জানে না। প্রথম পশলার পর দম নেবার জন্য ম্যানেজার একটু থামতেই হাত দিয়ে বেঞ্চির খালি জায়গাটা দেখিয়ে নিরুদ্বেগ আপ্যায়ন জানালো, বসুন—

ম্যানেজারের গোল চোখ দুটো মুখের ওপর থমকালো। সেই চোখে কালোর থেকে সাদার অংশ বেশি। ওদিকে কর্মচারীদেরও এক-একটা চকিত চাউনি।

সত্যিই ভদ্রলোক বসবেন আশা করে বসতে বলেনি ধীরাপদ। যেজন্যে বলেছে তা সফল। বেশ ঠাণ্ডা অথচ স্পষ্ট করেই ধীরাপদ বলল, আমার কাজের জন্যে আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমি এখানে বসে নাটক দেখব কি হাওয়া খাব, কি আর কিছু করব, তার দায়ও বোধ হয় আপনার ঘাড়ে পড়বে না।

বলার ধরনে উম্মা না, বিদ্রূপ না, বরং হাল্কা প্রীতির সুরই ছিল। তবু নির্বাক প্রতিক্রিয়াটুকু উপভোগ্য। ম্যানেজারের দুই চোখের সাদা অংশ আরো একটু বিস্ফারিত, কার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই বিভ্রম আর সেই বিশ্লেষণ।

হুঁশ ফিরতে ত্বরিত প্রস্থান। একেবারে ডিসপেনসিং রুমের ওধারে। ব্যাপারটা ঠিকমত ভেবে দেখার জন্য আড়াল দরকার বোধ হয়। খানিক বাদে কাজে বেরিয়ে এলেন যখন তখনো গোটা মুখে আহত গাম্ভীর্য। কর্মনিয়ন্ত্রণের স্বর ও সুর থমথমে মৃদু। কাজ চলছে। লোক আসছে, যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও পরিবেশ আর জমজমাট নয় তেমন। কর্মব্যস্ততার মধ্যেও একটা নীরবতা থিতিয়ে আছে।

ভদ্রলোককে আদৌ অপদস্থ করার ইচ্ছে ছিল না। লোকটি কাজ জানেন, নিজের কাজ ছাড়া অন্য সকলের কাজ আদায় করাও কাজ তাঁর। দরদ দিয়ে দায়িত্ব পালন করেন বলেই মেজাজ বিগড়েছিল। অবশ্য মেজাজ এমনিতেই একটু চড়া। কিন্তু তাঁর দিক থেকে বিচার করতে গেলে ধীরাপদর অপরাধ স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়েই পড়ে বই কি। অথচ ওটুকু না বলে উপায়ও ছিল না, আত্মরক্ষার তাগিদে বলা।

ম্যানেজার আপাতত এখানকার কর্ত্রীটির আগমনের প্রতীক্ষায় আছেন বোধ হয়। সে আসার আগে ধীরাপদ আজকের মত চাকরি-পর্ব শেষ করে সরে পড়বে কিনা ভাবছে। সেদিন রাতে লাবণ্য সরকার তাঁর হাতে ওকে সঁপে দিয়েছিল সে কথা মনে হতে আবারও না বোঝাপড়ায় এগিয়ে আসেন ভদ্রলোক।

আবারও এলেন বটে, তবে বোঝাপড়া করতে নয়। মুখভার শুকনো আর বিব্রত। জানালেন, বড় সাহেব টেলিফোনে এক্ষুনি একবার তাকে বাড়িতে দেখা করতে বলেছেন।

বড় সাহেব মানে হিমাংশু মিত্র। দোকানসুদ্ধ কর্মচারীর কাছে এ ধরনের আহ্বান অভিনব ব্যাপার। একটু আগেই ম্যানেজারের সঙ্গে যে বচন-বিনিময় হয়ে গেছে, তেমন চতুর হলে ধীরাপদর এরপর মুখে নিস্পৃহ গাম্ভীর্যের পালিশ চড়িয়ে উঠে আসার কথা। তার বদলে সে নিজেও হকচকিয়ে গেল। একটা নীরব প্রহসনের মধ্যে নীরবে গাত্রোত্থান।

বড় সাহেব ডাকলে ট্যাক্সিতে ছোটার রীতি জানে না, ধীরাপদ ট্রামে উঠল। …এই ডাকের পিছনে চারুদির তাগিদ বোধ হয়। অমিতাভ ঘোষও বলে থাকতে পারে। বলবে বলেছিল। ধীরাপদর হাসি পাচ্ছে। ভাত নাকি পেট খোঁজে না, ওর বেলায় তাই খুঁজছে যেন।

মানকে নিচেই ছিল। একগাল হেসে জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে আনত হল। -বাবু ভালো আছেন? চলুন, ওপরে চলুন, বড় সাহেব ঘরেই আছেন— আপনি এলে সটান নিয়ে যেতে বলেছেন।

ধীরাপদ সিঁড়ির দিকে এগোলো। মানকে সবিনয়ে অনুগামী। আপ্যায়নের বিনিময়ে একটা কুশল প্রশ্ন করা উচিত, ধীরাপদ জিজ্ঞাসা করল, তুমি ভালো তো?

বিগলিত। ছিচরণের আশীব্বাদে ভালই বাবু। গলার স্বর নামল একটু, আপনি চলে যেতে কেয়ার্-টেক বাবু সেদিন আর আমাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেনি, দোষ তো আসলে তেনারই। আপনি এ-বাড়িতে থাকতে পারেন বলে তেনাকে সেদিন ঘাবড়ে দিতে বাসনা করেছিলেন, তাই না বাবু? খুব জব্দ-

হি হি শব্দে চাপা হাসি। বড় সাহেবের সামনে উপস্থিত হতে চলেছে মনে মনে সেই প্রস্তুতির একটু অবকাশও পেল না ধীরাপদ। বাসনা করা শুনে হেসে ফেলল। মানকের এই ফুর্তিও খুব স্বতোৎসারিত মনে হল না। যথার্থ কি ‘বাসনা করেছে’ এই স্বল্প সুযোগেও সেটুকুই উপলব্ধির চেষ্টা হয়ত।

ওপরে উঠে আজ আর বাঁয়ে নয়, ডাইনের অন্দরমহলে এনে হাজির করা হল তাকে। একটা বড় ঘরের দোরগোড়ায় বিনয়-নম্র মূর্তিতে কেয়ার-টেক বাবু দাঁড়িয়ে। প্রথম তৎপর আহ্বান তারই। আসুন, সাহেব ভিতরে আছেন।

সঙ্গে করে ভিতরে নিয়ে এলো। অন্দরমহলের বসবার ঘর এটি। সেই ঘরের ভিতর দিয়ে আরো গোটাকতক ঘরের আভাস। এ-ঘরে দামী সোফাসেটি, ডেকচেয়ার, পুরু গদীর সাময়িক বিশ্রাম-শয্যা, দেয়ালে বড় বড় অয়েলপেন্টিং ছবি।

হিমাংশু মিত্র ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে খবরের কাগজ দেখছিলেন। কাগজ সরালেন। – বসো।

ইজিচেয়ারের হাতলের ওপর থেকে পাইপটা নিয়ে দাঁতে চাপলেন। কেয়ারটেক বাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে পাইপে অগ্নিসংযোগ করে দিল। পাইপ ধরতে একবার তিনি তার দিকে তাকালেন শুধু। সেটুকু নির্দেশ কিছু, সঙ্গে সঙ্গে কেয়ার-টেক বাবুর প্রস্থান।

ধীরাপদর, অস্বস্তি এক ধরনের, এইটুকু থেকে মনোভাব বুঝে নিতে আর এ-রকম আনুগত্য রপ্ত হতে কতদিন লাগে?

তুমি কাজের জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছ শুনলাম…

অমিতাভ নয়, চাবি তাহলে চারুদি ঘুরিয়েছেন! ধীরাপদ নিরুত্তর। নীরবতা নিরাপদ।

কাজের জন্য চিন্তা নেই—হিমাংশু মিত্র অত্যুৎসাহের রাশ টানার মত করে বললেন, একবার কাজে লাগলে কাজের শেষ নেই। আমাদের মেডিক্যাল হোম, ফ্যাক্টরী—সব দেখেছ?

ঘাড় নাড়ল, দেখেছে।

হিমাংশু মিত্র ভাবলেন একটু। যোগ্যতার দিকটাই স্মরণ করার চেষ্টা সম্ভবত। এতদিন কি করেছে না করেছে আবারও সেই প্রশ্ন দুই-একটা। কবিরাজি ওষুধ আর বইয়ের বিজ্ঞাপন লিখেছে শুনে হেসে মন্তব্য করলেন, ওই বিদ্যে এখানেও কাজে লাগতে পারে, তবে তার জন্য কিছু অভিজ্ঞতা আর কিছু পড়াশুনা দরকার।

এটা-সেটা দু-চার কথা আরো। কথা উপলক্ষ মাত্র। মোটা চশমার ওধার থেকে ঈষৎ কৌতুক-প্রচ্ছন্ন একটা যাচাইয়ের দৃষ্টি সরাসরি ধীরাপদর মুখের ওপর পড়ে আছে সেই থেকে। শেষে জানালেন, মাসের এই বাকি বারো-চৌদ্দ দিন মেডিক্যাল হোমেই বসতে হবে ওকে। সেখানে কিভাবে কাজ চলছে না চলছে সব বুঝে নেওয়া ব্যবসা আর অ্যাডমিনিস্ট্রেশান দুইই। এই ব্যাপারে মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার লাবণ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার নির্দেশ দিলেন। ও-দিকটা মোটামুটি জানা হয়ে গেলে আগামী মাসের গোড়া থেকে তাকে ফ্যাক্টরীতে আনা হবে বলে আশ্বাস দিলেন। আসল কাজ সেখানেই, তবু ব্যবসায়ের গোটা পরিস্থিতি চোখের ওপর থাকা দরকার।

লেবার নিয়ে মাথা ঘামিয়েছ কখনো? আই মিন, পার্টি-টার্টি করেছ?

যেন প্রশ্ন নয় কিছু, হঠাৎ মনে এলো। ধীরাপদ মাথা নাড়ল, করেনি।

তাহলে কি আর করলে, কাজ না থাকলে ওটাই তো কাজ। পাইপ-চাপা মুখে হাসির আভাস। -সব ফ্যাক্টরীতেই কিছু-না-কিছু লেবার প্রবলেম লেগে থাকে …প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

কতবার ঘাড় নাড়বে ধীরাপদ? প্রেসের কথায় প্রথমেই গণুদার মুখখানা মনে এলো। নতুন পুরনো বইয়ের দোকানের দে-বাবুর প্রয়োজনে গণুদাই যথেষ্ট মুরুব্বী, কিন্তু এখানে তাঁর উল্লেখও একেবারে নির্বোধের মতো হবে। জবাব দিল, যোগাযোগ করে নিতে পারি।

কি করে? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন।

কোম্পানীর নামের জোরে আর বিজ্ঞাপনের জোরে। ক্ষণিকের দ্বিধা, তাছাড়া গোড়ার দিকে অমিতবাবু যদি একটু সাহায্য করেন, তিনি প্রেসরিলেশান মেনটেন করতেন শুনেছি….

ধীরাপদর মনে হল, জবাবের প্রথম অংশটুকু যুৎসই হয়েছিল, শেষের কথায় দৃষ্টির স্পষ্ট পরিবর্তন। -তার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?

কাল ফ্যাক্টরীতে আলাপ হয়েছিল—

সে প্রেস-রিলেশান মেনটেন করত কে বলল তোমাকে?

এবারে কোণঠাসা। ধীরাপদ মনে মনে নিজেকে রজক-পালিত জীব বলে গালাগাল করে নিল প্রথমে। জবাব দিল, চারুদি গল্প করেছিলেন…

চারুদি কি গল্প করেছিলেন সেটা যেন ওর মুখে লেখা, আর হিমাংশু মিত্র নীরবে কয়েক মুহূর্ত তাই পাঠ করলেন। ধীরাপদর ফাঁড়া কাটল কি একটা ফাঁড়া তৈরী হয়ে থাকল বোঝা গেল না। পাইপটা হাতে নিয়ে হাসলেন তিনি। লঘু কৌতুকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে তার সাহায্য পাবে আশা করছ?

অর্থাৎ ভাগ্নে যদি সত্যি সাহায্য করে ওকে, সেটা যথার্থ হাতযশ বলতে হবে। ধীরাপদর মুখ সেলাই এবারে।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সাক্ষাৎ-পর্ব শেষ। হাতের পাইপ দাঁতে গেল আবার। —আচ্ছা, এ-সব পরে ভাবা যাবে, এ-মাসটা মেডিক্যাল হোম অ্যাটেন্ড করো। কোনো অসুবিধে হলে বা কিছু বলার থাকলে আমাকে জানিও, কাম স্ট্রেইট—গুড বাই।

লঘু পদক্ষেপে সামনের ঘরের ভিতর দিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে গেলেন। সেদিকে চেয়ে ধীরাপদ বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল খানিক। তাঁর শেষের এই আন্তরিকতা চাপা বিদ্রূপের মত লাগল কানে।

মেডিক্যাল হোম।

আজ আর সেখানে না ফিরলেও চলত। কারো কাছে জবাবদিহিও করতে হত না। তবু বাইরে এসে আবার সেখানেই ফেরার তাগিদ অনুভব করেছিল ধীরাপদ। খোদ বড় সাহেবের পরোয়ানা জাহির করার জন্য নয়। কিন্তু এই পরোয়ানার জোর ছিল একটু। কাল আবার ম্যানেজার আর কর্মচারীদের নাকের ডগায় সঙের মত বসে থাকার চেয়ে আজই গিয়ে দাঁড়ানো ভালো। হিমাংশু মিত্র লাবণ্য সরকারের সঙ্গেই আলোচনা করতে বলেছেন।

রোগীর ভিড় এড়ানোর জন্যে বেশ খানিকক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে একটু রাত করেই দোকানে এসে ঢুকল। দোকানের ভিড় কিছুটা হাল্কা তখন, বেঞ্চিতে রোগীর সংখ্যাও নামমাত্র। ম্যানেজার এক নজরে যতটুকু দেখা সম্ভব দেখলেন, তারপর কাজে মন দিলেন। কর্মচারীরা কাজের ফাঁকে ফিরে ফিরে তাকালো। রমেন হালদার তার সামনের খদ্দের ভুলে হাঁ করে চেয়ে রইল তার দিকে।

রোগী ডাকতে এসে লাবণ্য সরকারও দেখল।

সেই দেখা থেকে ধীরাপদর অনুমান, ম্যানেজার তার কাছে যতটুকু নিবেদন করার করেছেন।

শেষ রোগীটি বিদায় হবার পর আলোচনার জন্যে ধীরাপদকে এগোতে হল না, তারই ডাক পড়ল। বেয়ারা এসে মেমসাহেবের তলব জানালো। ধীরাপদর নিজে থেকে সামনে এসে দাঁড়ানোর সঙ্কোচ গেল।

লাবণ্য সরকার চেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। একটু অবসন্ন। এতক্ষণের ধকলের পর একটু শ্রান্তি স্বাভাবিক। টেবিলের ওপর স্টেথোস্কোপটা সাপের মত কুণ্ডলী পাকানো। এধারে সেই মোটা ব্যাগটা।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে লাবণ্যর শিথিল দৃষ্টি ওর মুখের ওপর আটকালো। মুখ দেখে তার আজকের ব্যবহারের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টাটা লক্ষণ দেখে রোগ বোঝার চেষ্টার মত।

কি ব্যাপার বলুন তো? ম্যানেজারকে নাকি আপনি আজ কি সব বলেছেন শুনলাম।

সামনে দুটো খালি চেয়ার, অথচ বসতে বলেনি। আগের দিনও বলেনি। ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা না-ও হতে পারে, অধস্তনদের এখানে এসে বসাটা রীতি নয় হয়ত। কিন্তু আজ ধীরাপদ চেয়ার দুটোর এই শূন্যতার বিদ্রুপ বরদাস্ত করল না। একটা চেয়ার টেনে বসল, আর একটা চেয়ারের কাঁধে একখানা বাহু ছড়িয়ে দিল। তারপর হাসিমুখে জবাব দিল, ম্যানেজারবাবু হয়ত অসন্তুষ্ট হয়েছেন, কিন্তু আমি তাঁকে একটুও অসম্মান করতে চাইনি, আমার কাজের দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে না-এই শুধু বলেছি।

লাবণ্য সরকার তার বসাটা লক্ষ্য করেছে, অন্য চেয়ারে হাত ছড়ানো লক্ষ্য করেছে, তার জবাবের অকুণ্ঠ ভঙ্গীও লক্ষ্য করেছে। এরই সামনে সেদিন ফ্যাক্টরীর কন্ট্রোল রুমে অমিতাভ ঘোষের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে নিজের বিড়ম্বিত পরিস্থিতিটাও এরই মধ্যে ভোলেনি বোধ হয়।

আপনার কাজের দায়িত্ব কে নেবেন তাহলে?

তা তো জানি না। ধীরাপদকে যেন জব্দ করা হয়েছে, মুখে-চোখে সেই রকমই সরল ব্যঞ্জনা।—আপনিই নিন না?

প্রতিক্রিয়া যাই হোক, ওজন না বোঝা পর্যন্ত কর্ত্রীস্থানীয়া মহিলাটির সংযমের ওপর দখল আছে। হিমাংশু মিত্র টেলিফোনে ওকে বাড়িতে দেখা করতে বলেছেন ম্যানেজার সেই খবরও জানিয়েছেন নিশ্চয়, কিন্তু প্রথমেই সে প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞাসা করলে পাছে মর্যাদা দেওয়া হয় তাই হয়ত ম্যানেজারের অভিযোগটাই প্রথম উত্থাপন করেছিল।

মিস্টার মিত্র আপনাকে ডেকেছিলেন কেন?

প্রশ্নটা চাপা আনন্দের কারণ। জবাব দিল, এখানে কি ভাবে কাজ চলছে সব দেখে রাখতে বললেন, আর আপনার সঙ্গেও আলোচনা করতে বললেন—

কি আলোচনা?

কি দেখব, কিভাবে কাজ শুরু করব সেই সম্বন্ধে—মাসের এই বাকি ক’টা দিন মাত্র সময় দিয়েছেন।

তারপর কী?

তারপর অন্য কাজ দেবেন বোধ হয়।

হেঁয়ালির মধ্যে পড়ে লাবণ্য সরকারের মুখে বিরক্তির কুঞ্চন স্পষ্ট হয়ে উঠল এবারে। বলল, কি জানি, কি ব্যাপার আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সেটুকুই কাম্য ছিল ধীরাপদর। নিজের সহজতায় নিজেই পরিতুষ্ট। মহিলার বিরক্তির জবাবে নিরীহ কুণ্ঠা প্রকাশেও ভেজাল নেই, বুঝতে না পারার অপরাধ যেন ওরই। তারপর সাদাসিধে একটা প্রস্তাব করল, টেলিফোনে মিস্টার মিত্রের সঙ্গে একবার কথা বলে নেবেন?

কথা এরপর বড় সাহেবের সঙ্গে বলবে কি কার সঙ্গে বলবে ধীরাপদ ভালই জানে। সে-কথা যে তার দিক থেকে খুব অনুকূল হবে না সে সম্বন্ধেও প্রায় নিঃসংশয়। কিন্তু প্রস্তাবনার আপাত প্রতিক্রিয়া রসোত্তীর্ণ। কি করবে না করবে সেটা এখানকার কারো মুখে শুনতে অভ্যস্ত নয়, কয়েক মুহূর্তের নিষ্পলক দৃষ্টি-গাম্ভীর্যে লাবণ্য সরকার সেটুকুই ভালোকরে বুঝিয়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা টেনে নিয়ে তার মধ্যে স্টেথোসকোপ রাখার ফাঁকে আবারও তাকালো।

সকলের চোখের ওপর দিয়ে সকলের আগেই ধীরাপদ দোকান ছেড়ে বাইরে চলে এলো। ফুটপাত ঘেঁসে লাবণ্য সরকারের জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে, কোম্পানীর সেই ছোট স্পেশাল ওয়াগন। ধীরাপদ পা চালিয়ে এগিয়ে গেল। এভাবে বেরিয়ে আসাটা ঠিক হল না হয়ত, কিন্তু বসে থেকেই বা করত কি? লাবণ্য সরকার ছাড়াও আর যারা আছে সেখানে, এই নাটকের পর তাদের জন্য অন্তত খানিকটা রিলিফ দরকার। কাল আবার আসতে হবে সেই চিন্তাও অলক্ষ্য অস্বস্তির মত।

কালকের কথা কাল।

আজকের সমস্ত ব্যাপারটা রসিয়ে রোমন্থন করার মত। ম্যানেজারের মুখ বন্ধ করা, হিমাংশু মিত্রের ডেকে পাঠানো, লাবণ্য সরকারের কর্তৃত্বের মুখোমুখি দাঁড়ানো। পরে যাই হোক, আজ অন্তত সকলকে ভাবিয়ে আসতে পেরেছে—এই ক’টা দিনের অবহেলার জবাব দিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু স্নায়ুজ প্রগলভতা ঠাণ্ডা হবার সঙ্গে সঙ্গে তুষ্টির বদলে একটা অস্বাচ্ছন্দ্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কোথায়। মনে হচ্ছে, আগাগোড়াই ছেলেমানুষি করে এলো। আসলে মনের অগোচরের একটা সুপ্ত বাসনায় আঁচ লেগেছিল, সেই আঁচে পুরুষকারের রঙ ধরেছিল—তাই নিজেকে এভাবে জাহির করার তাগিদ। নইলে কেই বা তাকে অবহেলা দেখাতে গেছে, আর কার সঙ্গেই বা তার রেষারেষি!

আগে পথ চলতে প্রায় প্রতিটি লোকের মুখের রেখা চোখে পড়ত। সেই রেখা ধরে প্রবৃত্তি-বৈচিত্র্যের অনেক হিজিবিজি নকশা আঁকত। এঁকে নিরাসক্ত দ্রষ্টার মত দেখত চেয়ে চেয়ে। চারুদির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে এই দেখার আনন্দে ছেদ পড়েছে। আজ নতুন সূচনার চতুষ্পথে এসে সকলকে ছেড়ে ধীরাপদর নিজের দিকেই চোখ গেল।

ধীরাপদ থমকালো একটু

আজও একটু জ্বর উঠেছে আবার। থার্মোমিটার লাগিয়েছিলেন বুঝি? আমি একটা ভালো প্রেসকৃপশান দিতে পারি, ফলো করবেন? থার্মোমিটারটা রাস্তায় ফেলে দিন, তারপর যেমন খুশি সেইভাবে চলুন, যা খুশি তাই খান, অসুখ বলে একটা কথা আছে তাই ভুলে যান। বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা যা বললাম করে দেখুন, খারাপ কিছু হলে দায়িত্ব আমার। ডাঃ লাবণ্য সরকার রোগী সম্বন্ধে নিশ্চিত এবং নিশ্চিন্ত।

ওষুধটা নিয়মমত খাননি? কেন? ঠেলে উঠে আসতে চায়? আসেই যদি সে ভাবনা তো আমার, আপনি খাবেন না কেন? দেখি হাত! সাড়া নেই কিছুক্ষণ, হাত দেখার পরে বোধ হয় বুক দেখার নীরবতা।—ওষুধ তো দেব, কিন্তু দিয়ে লাভ কি, গোলাপ জল আর লিমনস্কোয়াশ মিশিয়ে তো আর ওষুধ দিতে পারি না। বেল টিপে বেয়ারাকে তলব, একটা ইনজেকশান এনে দেওয়ার নির্দেশ।—ওষুধ বদলে দিচ্ছি, আর একটা ইনজেকশান দেব, লাগবে না, ভয় নেই। এই ওষুধটা ওঁকে দিনে তিনবার নিয়ম করে খাওয়াবেন, রোগিণীর স্বামীর প্রতি গম্ভীর নির্দেশ, আর দু’বেলা খাবার আগে এই টনিক দু চামচ করে খিদেও হবে, ওজনও বাড়বে। এবারে অনিয়ম হলে ভয়ানক রাগ করব কিন্তু, দিনের পর দিন এভাবে ভুগলে আমার বদনাম না। রোগিণীর কারণে ডাঃ লাবণ্য সরকারের দুশ্চিন্তাভরা অভিযোগ।

-ঘুম হয় না? ভালই তো, অনেক সময় পাচ্ছেন দিব্যি। আমি তো নিজের জন্যে ঘুম না হওয়ার ওষুধ খুঁজছি। অনিদ্রা প্রসঙ্গে লঘু বিশ্লেষণ। —ঘুম না হওয়ার জন্য তত ক্ষতি হয় না, যত হয় ঘুম হল না সেই চিন্তা থেকে। সদয় প্রশ্ন, ঘুম হচ্ছে না কেন, খুব ভাবেন বুঝি? আপনার আবার ভাবনা-চিন্তা কি? পেট কেমন? খিদে? পিঠের সেই ক্রনিক ব্যথাটা একেবারে গেছে তাহলে? যা ভাবিয়েছিলেন…

আচ্ছা, ঘুমের ওষুধও দিচ্ছি,, কিন্তু আপনি চেষ্টা না করলে শুধু ওষুধে কিছু হবে না। রোজ সকালে উঠে খোলা বাতাসে বেশ খানিকক্ষণ হাঁটতে হবে। মনোযোগী রোগীর প্রতি ডাঃ লাবণ্য সরকারের মুক্ত-বাতাসে প্রাতভ্রমণের উপযোগিতা বিশ্লেষণ।

–আপনি দিনকতক এখন ঘুমোন দেখি বেশ করে, সব অবসাদ কেটে যাবে, আপনার শরীর ঘুম চাইছে। প্রেসার দেখেছিলেন শীগগির? আচ্ছা আমি দেখে দিচ্ছি, ওই বেড-এ যান। প্রেসার তো লো, কত বয়েস? তাহলে তো খুবই লো! তা বলে ভাববেন না যেন, এই একটা রোগই সব রোগী পছন্দ করেন। ওষুধ যাই দিই, আসল চিকিৎসা খাওয়া আর ঘুমোনো। ওষুধ আর ইনজেকশানের উল্লেখসহ ডাঃ লাবণ্য সরকারের রসনা-উসকানো খাদ্য তালিকা বিস্তার।

—কি খবর? যেতে হবে? এক্ষুণি যাব কি করে, কাল সকালে যাব’খন তাহলে তো মুশকিল! আচ্ছা রাত ন’টার পরে যাব। কিন্তু এরই মধ্যে এত ছটফট করার মত কি হল, এই তো কাল দেখে এলাম! ব্লাডপ্রেসার বেড়েছে মনে হচ্ছে? কার মনে হচ্ছে, আপনার না আপনার স্ত্রীর? ডাক্তার না দেখলে উনি সুস্থ হবেন না যখন যাব, কিন্তু এই যন্ত্রটার অস্তিত্ব আপনার স্ত্রীর মাথা থেকে না তাড়ালে রোগ ছাড়বে না। ওটাই ওঁকে পেয়ে বসেছে- সিসটলিক দশ-বিশ উঠতে বসতে কমে বাড়ে, ওটা গোটাগুটি মানসিক একেবারে। আপনার বা আপনার স্ত্রীর মত অত যারা লেখাপড়া জানে না তারা ব্লাডপ্রেসারও জানে না। রক্তচাপ প্রসঙ্গে ডাঃ লাবণ্য সরকারের মন্তব্য।

ক্যাশ কাউন্টারের ওধারে ডাক্তারের চেম্বার পার্টিশনের ঠিক পিছনটিতে ধীরাপদর টেবিল-চেয়ার। কান পাতলে ভিতরের প্রতিটি কথা কানে আসে। ধীরাপদ কান পেতে শোনে। শুধু তাই নয়, এই একজনের চিকিৎসা-পর্ব শোনার প্রতীক্ষায় বসে থাকে রোজই। বিকেল ছটার পরের দু-তিন ঘণ্টা কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরও পায় না। যে লাবণ্য সরকার কর্মচারীদের কাছে এমন, সে-ই আবার নিজের পেশার ক্ষেত্রে কেমন—নিজের কানে না শুনলে ধীরাপদ ভাবতেও পারত না। এমন চিকিৎসকের পসার হবে না তো কার হবে! আর যে ক’টি চিকিৎসক আসেন তাঁরা শুধু চিকিৎসাই করেন। তাঁদের ওষুধের মতই নীরস তাঁরা। কিন্তু ডক্টরিং ইজ অ্যান আর্ট চিকিৎসা চিকিৎসা-কলাও বটে। পেশার ক্ষেত্রে সেই কলা লাবণ্য সরকার ভালোমত রপ্ত করেছে। অবশ্য এর পিছনে প্রকৃতিগত আনুকূল্য আছে কিছু। আছে যখন তার ফলও আছেই। প্রকৃতির বশ নয় কোন মানুষ? লাবণ্য সরকারের ওষুধে রোগ না ছাড়লে কথায় ছাড়ে, কথায় না ছাড়লে হাসিতে ছাড়ে। ছাড়ুক না ছাড়ুক, এই চিকিৎসা-কলাকুশলিনীর হাতে রোগী হতে সাধ যায়।

ওইখানে বসে বসে আর একটা আবিষ্কার করেছে ধীরাপদ। যার যার অল্পস্বল্প রোগের প্রতি রোগীর বেশ একটু মমতা আছে। শোক লালন করতে দেখেছে, এখানে এসে রোগ লালন করা দেখল। নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সদয়-মর্যাদা লাভে বঞ্চিত মনে হলে ভদ্রগোছের ছোটখাটো একটা রোগ সংগ্রহ করে দেখো, মর্যাদা পাবে। তুমি যে ঘটা করে বিরাজ করছ সেই তুষ্টি উপলব্ধি করানোর দোসর পাবে।

লাবণ্য সরকার সেদিক থেকে অন্তরঙ্গ দোসর। প্রত্যেককে সে বিভিন্ন ভাবে মর্যাদা দিতে জানে, প্রত্যেকের জন্য বিভিন্ন ভাবে উতলা হতে জানে। সাধারণ চিকিৎসাক্ষেত্রে এ যে কম জানা নয় সেটা ধীরাপদ এরই মধ্যে উপলব্ধি করেছে।

এই দু-তিন ঘণ্টা বাদ দিলে সারাক্ষণের ক্লান্তি। কাজ নেই বললেই চলে। অলস সময় যাপনে অনভ্যস্ত নয় ধীরাপদ। কিন্তু ছকে বাঁধা কর্মচঞ্চলতার মধ্যে এমন নিষ্ক্রিয় আলস্যের বোঝা আর কখনো টানেনি। না চলে চোখ, না মন। সেকেণ্ড গুনে মিনিট গুনে ঘণ্টা পার করার মত। এখন যা-ও করছে প্রথম দু দিন তাও জোটেনি। কাউন্টারে দাঁড়ানো ছাড়া আর কি করা যেতে পারে সে-সম্বন্ধে যিনি হদিস দিতে পারতেন, তিনি বিমুখ। পুরো সাত ঘণ্টার মধ্যে ম্যানেজার সাত বারও ওর দিকে তাকান কিনা সন্দেহ। দুপুরের নিরিবিলিতে সেই রমেন হালদারই শুধু কাছে আসে। কিন্তু বিস্ময়ে নিজেই ফাটো-ফাটো, সে আর কাজের হদিস কি দেবে?

দাদা আপনি যে সাংঘাতিক লোক দেখি, এমনিতে কিচ্ছুটি বোঝা যায় না।

কি হল আবার…?

কেন,

কি হল? রমেন হালদারের বিস্ময় উপচে ওঠার দাখিল, ম্যানেজার কুপোকাত, টেলিফোনে বড় সাহেবের তলব, তারপর চেম্বার থেকে কাল আপনি বেরিয়ে যাবার পর মিস সরকারেরও দেখি পিসিমা-পিসিমা মুখ! বলুন না দাদা, শুনব বলে সেই থেকে হাঁসফাঁস করছি আমি-

ওর কৌতূহল জিইয়ে রেখেই ধীরাপদ কাজের কথায় আসতে চেষ্টা করছিল। —এখানকার সব কাজ-কর্ম বুঝিয়ে দেবার জন্য পাছে তোমাকে চেয়ে বসি সেই রাগে অমন মুখ করে ছিলেন বোধ হয়।

ছেলেটার বড় বড় দুই চোখ মুখের ওপর এক চক্কর ঘুরে শেষে থেমেছিল। – যাঃ, আপনি ঠাট্টা করছেন। সলজ্জ হাসি, কিন্তু এখানে কাজ-কর্ম বোঝার কি আছে আবার।

বলো তো দেখি কি আছে?

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওষুধ বেচা ছাড়া আর কিছু নেই। নিজের দোকান হলে দেখিয়ে দিতাম কত রকম প্ল্যান করা যায়।

নিজের দোকান বলেই ভাবো না।

এই দোকানকে। এও ঠাট্টা কিনা বুঝে নিতে চেষ্টা করল।—হুঃ, এর দশ ভাগের এক ভাগের কথাই ভাবতে পারিনে। তারপরেই সমস্ত মুখে আলগা উত্তেজনা একগ্রন্থ, বড় আলো যেমন ছোট আলো ঢেকে দেয় তেমনি একটা বড় আগ্রহের ছটায় রমেনের ছোট কৌতূহল চাপা পড়ে গিয়েছিল।-একটা দোকান করবেন দাদা? আজ থেকে ভাবলে একদিন না একদিন ঠিক হবে, আসুন না আমাতে আপনাতে ভাবি-

ওর নিজস্ব একটা দোকানের আকাঙ্ক্ষার কথা ধীরাপদ আগেই শুনেছিল। মাত্র এই কটা দিনের পরিচয়ে তাকেই সেই আকাঙ্ক্ষার দোসর করে নেবার চেষ্টা দেখে হাসি পেয়েছে।

ভাবা যাবে, কিন্তু এখন আপাতত—

এখনই কে বলছে, এখন টাকাই বা কোথায়? কিন্তু এখন থেকে একটা প্ল্যান তো মাথায় থাকা দরকার। আপনাতে আমাতে ভাবলে দোকান হবেই একদিন, আপনাকে প্রথম দিন দেখেই আমার অন্যরকম মনে হয়েছে, আপনি ঠিক এখানকার সকলের মত ইয়ে—মানে চাকরি-সর্বস্ব ধরনের নন।

প্রশংসার জাল ছাড়িয়ে ধীরাপদর নিজের সমস্যায় পৌঁছনোর অবকাশ মেলেনি। ম্যানেজারের পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে রমেন মুখের আশার আলো এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিয়ে কাউন্টারের ওধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

যা-হোক কিছু কাজের হদিস শেষে লাবণ্য সরকারই দিয়েছে ধীরাপদকে। দিন দুই একটা লোককে এমন গো-বেচারার মত বসে থাকতে দেখে নিজেই আবার ডেকেছিল। ডেইলি সেলস রিপোর্ট স্টাডি করতে বলেছে, পুরনো রিপোর্ট দেখে এক- একটা সিজনে বিশেষ বিশেষ কয়েকটা ওষুধের গড়পড়তা চাহিদার ওঠা-নামার চার্ট তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া স্টক না রাখার ফলে যে-সব প্রেসক্রিপশান রোজ ফেরত যাচ্ছে এখান থেকে, তারও একটা খসড়া তৈরি করতে পরামর্শ দিয়েছে- এ-রকম খসড়া চোখের ওপর থাকলে স্টক সম্বন্ধে ভাবার অনেক সুবিধে হয় নাকি।

আগের দিনের মত সেদিন আর আত্মাভিমানী সুপ্ত তাড়নাটাকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেয়নি ধীরাপদ। লাবণ্য বসতে বলেনি, সে-ও চেয়ার টেনে বসেনি আগের দিনের মত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছে, হাই তুলে সাত ঘণ্টা কাটানোর চক্ষুলজ্জা কিছুটা কাটল ভেবে মনে মনে একটু কৃতজ্ঞতাও বোধ করেছে, আর ফিরে এসে নির্দেশমতই কাজে মন দিতে চেষ্টা করেছে।

কিন্তু কাজ করলে এই বা কতক্ষণের কাজ? দু ঘণ্টাও লাগে না। ধীরাপদ এই সঙ্গে আরও একটা কাজ আবিষ্কার করেছে। ওষুধের লিটারেচার পড়া, কোন্ কোন্ অসুখে কোন্ ওষুধ অব্যর্থ সেই ফিরিস্তি। সূক্ষ্মবিচারে অম্বিকা কবিরাজের কবিরাজী ওষুধের বিজ্ঞানের সঙ্গে তফাত নেই খুব। সুক্ষ্মতাটুকুই তফাত। বেশ লাগে পড়তে, এই দেহযন্ত্রটি যেন অগণিত রোগ-তৈরীর কারখানা বিশেষ। এত রোগ থাকতে মানুষ আবার নীরোগ হয় কেমন করে।

কিন্তু তবু হাই ওঠে। পাঁচটার পর থেকেই ঘড়ির দিকে ঘনঘন চোখ ছোটে, এই ছ’টা বাজতে বাকি কত। ফুটপাত ঘেঁষে স্টেশান ওয়াগানটা এসে দাঁড়ালেই টের পায় এখন। নড়েচড়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে। যেন এতক্ষণের শ্রান্ত প্রতীক্ষার পর দিনের কাজ শুরু। লাবণ্য সরকার চেম্বারে ঢুকে পড়লে এক-একদিন উঠে এসে বাইরে প্রতীক্ষারত রোগীর ভিড় দেখে যায়। ভিড় যত বেশি তত খুশি। যাত্রা দেখতে এসে অপরিণত মন বড় প্রোগ্রাম দেখলে যেমন খুশি হয়।

সেদিন ধীরাপদর দিনের কাজেও অপ্রত্যাশিত বৈচিত্র্যের সূচনা ঘটল একটা। সবে বিকেল চারটে তখন। ম্যানেজার এসেছেন। কাউন্টারে কর্ম-তৎপরতার আভাস জাগেনি তখনো। ঝিমুনি কাটানোর জন্য ধীরাপদ বাইরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। চুপচাপ রাস্তা দেখছিল আর ভাবছিল একটু চা খেয়ে আসবে কিনা।

কোথা থেকে ভুইফোঁড়ের মত এসে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়াল কোম্পানির সেই স্টেশান-ওয়াগন, লাবণ্য সরকার যার একচ্ছত্র আরোহিণী। ড্রাইভার দরজা খুলে দিতে একটা ফাইল-সহ ব্যাগ হাতে সে-ই নামল। ধীরাপদকে দেখল একবার, তার পর সুষ্ঠু গান্ধীর্ষে পাশ কাটিয়ে দোকানে প্রবেশ করল।

গাড়িটা চলে গেল।

অসময়ে এই কর্ত্রীটির আবির্ভাবে দোকানের আর সকলে অভ্যস্ত কিনা ধীরাপদর জানা নেই। এ-সময়ে সে এই প্রথম দেখল তাকে। ম্যানেজারের কাছে গিয়ে কি বলল, অনুমান করা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার এবং আর সকলেরও মুখে চকিত ভাবাস্তুর একটু। লাবণ্য সরকার কয়েকটা ওষুধ চেয়ে নিয়ে ব্যাগে পুরল, তারপর ভিতরে ঢুকে গেল। ম্যানেজার কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে নিজে হাতে চেয়ার বা বেঞ্চিগুলি ঠিক করে রাখলেন। তাঁর ইঙ্গিতে বেয়ারা আর একপ্রস্থ ঝাড়ামোছা করে দিয়ে গেল সেগুলো।

এই প্রচ্ছন্ন ব্যস্ততার মধ্যে ছবির মত দাঁড়িয়ে থাকাটা বিসদৃশ। ধীরাপদ এগিয়ে এসে দেখে তার টেবিল-চেয়ার লাবণ্য সরকারের দখলে। গম্ভীরমুখে ফাইল ঘাঁটছে, জায়গায় জায়গায় কাগজের নিশানা আঁটছে। এই ফাইলটাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। অন্য অ্যাটেন্ডিং ফিজিসিয়ান এসে যেতে পারেন ভেবেই হয়ত ওখানে বসেছে।

ধীরাপদ সরে এলো।

দশ মিনিটের মধ্যে ফুটপাত ঘেঁষে আর একখানা গাড়ি এসে থামল।

হিমাংশু মিত্রের সেই গাঢ় লাল গাড়ি।

বাজনার মত হর্ন বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে উৎকর্ণ দোকানটার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ। ব্যাগ আর ফাইল হাতে লাবণ্য সরকার বেরিয়ে এলো। হাসি-হাসি মুখ, লঘু চরণে তৎপর ছন্দ। ড্রাইভার সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিতে হিমাংশু মিত্রের পাশে উঠে বসল সে।

রীতিনীতি ভুলে ধীরাপদ সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখছিল, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ির দিকে এগোলো। লাবণ্য সরকারের পাশ থেকে দোকানের দিকে ঝুঁকে বড় সাহেব ইশারায় ওকেই ডাকছেন।

ইঙ্গিতে ড্রাইভারের পাশটা দেখিয়ে দিলেন—অর্থাৎ ওঠো।

কোথায় চলেছে কি ব্যাপার, ধীরাপদ ভাবতেও পারছে না। তাকে সঙ্গে নেওয়াটা পূর্বকল্পিত নয় নিশ্চয়, কিন্তু চলল কোথায়? পিছনের কথাবার্তা থেকে মনে হল, বড় সাহেব ব্যবসায় সংক্রান্ত কোনো কাজেই চলেছেন। একটা ওষুধ নিয়ে আলোচনা, কাগজ-পত্র কি রেডি আছে না আছে সেই কথা দু-চারটে।

ধীরাপদর কিছুই বোধগম্য হল না!

বুঝতে চেষ্টাও করল না। প্রথমে সহজ হয়ে বসতেই সময় লেগেছে, তারপর চকিতে চারুদির কথা মনে পড়েছে তার। চারুদির সেদিনের সেই প্রগলভ কৌতৃক। ধীরাপদর ঘুরে বসে দেখতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু নিরুপায়। ড্রাইভারের সামনে ছোট আয়নার ওপর চোখ পড়ল—পাইপ মুখে বড় সাহেব গাড়ির কোণে গা এলিয়ে বসে আছেন। লাবণ্যর পরিপুষ্ট কণ্ঠস্বর কান পেতে শোনার মত, ধীরাপদ রোজ শোনে। কিন্তু এখন শোনার মত কিছু বলছে না, টুকরো টুকরো কথা আর সংক্ষিপ্ত জবাব দুই-একটা। কিন্তু সেও কি একটু বেশী পরিপুষ্ট লাগছে কানে, একটু বেশী মিষ্টি লাগছে?

ধীরাপদ কাজ-কর্ম দেখছে কেমন?

হঠাৎ বড় সাহেবের লঘু প্রশ্ন। সেই থেকে সামনের দিকে চেয়ে মূর্তির মত বসে আছে দেখেও হতে পারে। প্রশ্ন ওকে নয়, পার্শ্ববর্তিনীকে, তবু এরপর সেই একভাবে বসে থাকা চলে না।

ধীরাপদ বিনয়-নম্র হাসি-হাসি মুখ করে ঘাড় ফেরাল। এ-রকম প্রসঙ্গ পরিবর্তন লাবণ্য সরকারও আশা করেনি, কিন্তু এ ধরনের প্রশ্নের জবাব না দিলেও চলে। ধীরাপদ মুখের ওপর দু চোখ স্থাপন করল একবার, তারপর বড় সাহেবের দিকে চেয়ে হাসল একটু। ওইটুকু থেকে যতটুকু বোঝা যায়।

ধীরাপদর ভিতরে ভিতরে আঁচড় পড়ল একটা। হাসির আঁচড়। বড় সাহেব পাঠিয়েছেন বলেই সে যেন তারও অনুগৃহীত শিক্ষানবিশ।

যেখানে আগমন সেটা একটা অফিস-বাড়ি এবং যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার তিনিও একজন পদস্থ ব্যক্তিই হবেন। কোন অফিসে এলো বা কার কাছে এলো ধীরাপদর অজ্ঞাত। ভদ্রলোক পরিচিত বোঝা গেল, সাদর আপ্যায়নে বসতে বললেন সকলকে। হিমাংশু মিত্র নতুন করে পাইপ ধরাতে ধরাতে মৃদু হেসে ভদ্রলোককে সতর্ক করলেন, আমার মেডিক্যাল অফিসার আজ আপনার সঙ্গে ঝগড়া করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে এসেছেন।

ঝগড়ার ত্রাসে অফিসারটিকে বেশ প্রসন্ন মনে হল ধীরাপদর। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, চকচকে চেহারা। ঝগড়া যে করবে তার দিকে ফিরে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন, আপনাদের কোনো খবর পাননি বুঝি এখনো?

বেশ, সে খবরও রাখেন না। লাবণ্য সরকারের কণ্ঠস্বরে আহত বিস্ময়, তিন মাস ধরে অপেক্ষা করে করে না এসে পারা গেল না, স্যাম্পল পাঠিয়েছি তারও দু মাস আগে—এভাবে আর কতকাল বসে থাকব?

ধীরাপদ রমণীমুখের কারুকার্য দেখছে চেয়ে চেয়ে। হিমাংশু মিত্রের নিজের কিছু যেন বক্তব্য নেই, যোগাযোগ ঘটিয়ে খালাস। আলোচনা থেকে এখানে আসার উদ্দেশ্য বোঝা গেছে। কোম্পানীর একটা নতুন ওষুধের সরকারী অনুমোদন মিলছে না, সরকারী পরীক্ষার রিপোর্টও কিছু আসছে না। ভদ্রলোকের মারফৎ ত্বরিত এবং অনুকূল নিষ্পত্তির সুপারিশ। অফিসারটি বিলম্বের কারণ জ্ঞাপন করলেন, ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ বাজারে হামেশা এত বেরুচ্ছে যে সতর্ক যাচাইয়ের দরকার, সুতরাং মতামত প্রকাশে দেরি না হয়ে উপায় নেই।

জবাবে লাবণ্য সরকার হাতের ফাইল খুলেছে, মোটা ব্যাগ থেকে কতকগুলি চালু ওষুধের স্যাম্পল বার করে সেগুলির উপকরণ তালিকার সঙ্গে নিজেদের ওষুধের উপকরণের তুলনামূলক বৈশিষ্ট্যগুলো দেখিয়েছে, ফাইল থেকে একে একে নিজেদের ল্যাবরেটরীর পরীক্ষার আশাতীত সাফল্যের রিপোর্টগুলো দাখিল করেছে। প্রথমে গিনিপিগের ওপর প্রয়োগের ফলাফল, তারপর বেড়ালের ওপর, তারপর বাঁদরের ওপর সবশেষে মানুষের ওপর। – জেনারেল বিহেভিয়ার প্রেসার কাউন্ট ড্রাগ এফিক্যাসি বায়লজিকাল অ্যাসপেক্ট সেরেব্রাম নারিশমেন্ট ব্লাড-অ্যাসিমিলেশান সেনসরি সেন্টার মেন্টাল আরমিসটিস-

ধীরাপদর কানের পরদায় দুর্বোধ্য শব্দতরঙ্গের ঠাসাঠাসি ভিড়। কিন্তু ধীরাপদ শুনছে না কিছুই, হাঁ করে দেখছে শুধু। ভাবে-ভঙ্গিতে কণ্ঠস্বরে বিশ্লেষণের আগ্রহে, বাহুর মৃদু চাঞ্চল্যে, আঙুলের সুতৎপর সংকেতে লাবণ্য সরকারের ভেষজ-বক্তব্যটুকু এক পশলা দুর্বোধ্য কাব্যের মত লাগল ধীরাপদর। যাঁর কাছে আবেদন, তিনি কে বা কতটা পারেন জানে না, কিন্তু এই সপ্রতিভ মাধুর্যের বন্যায় ধীরাপদ নিজে ঘায়েল হয়েছে। ধীরাপদর হাতে ক্ষমতা থাকলে এই লাবণ্য-দর্শন আর ফলশ্রুতির বিনিময়ে ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ ছেড়ে বিষের ওপর অমৃতের পরোয়ানা লিখে দিতেও বাধত না হয়ত।

বড় সাহেবের মুখে হালকা গাম্ভীর্য, নীরবে পাইপ টানছিলেন তিনি। উপসংহারে জানালেন, নিজে তিনি ক্রনিক ব্লাডপ্রেসারের রোগী, নির্দ্বিধায় নিজের ওপর এই ওষুধ যাচাই করেছেন এবং ফল পেয়েছেন।

অফিসার ভদ্রলোকটি আশ্বাস দিলেন, সরকারী বিবেচনার ফলাফল যাতে শীগগির বেরোয় সে-রকম আন্তরিক চেষ্টা তিনি করবেন এবার। হিমাংশু মিত্র ধীরাপদকে বললেন ভদ্রলোককে ভাল করে চিনে রাখতে, এই ব্যাপারে অতঃপর যোগাযোগ রক্ষা এবং তাগিদ দিয়ে কাজ আদায় করার দায়িত্ব তার।

বাইরে এসে ইশারায় তিনি একটা চলতি ট্যাক্সি আহ্বান করলেন। ওদের ট্যাক্সিতে যেতে বলে নিজে লাল গাড়ির দিকে এগোলেন। তিনি অন্যত্র যাবেন।

ট্যাক্সি সামনে এসে দাঁড়াতে লাবণ্য উঠে বসল। ধীরাপদর দুই-এক মুহূর্তের দ্বিধা, সামনে ড্রাইভারের সঙ্গে বসবে, না পিছনে মহিলার পাশে। নিজে উঠে বসার পর লাবণ্যেরই ডাকা উচিত ছিল তাকে, কিন্তু ডাকবে না জানা কথা। একসঙ্গে এক গাড়িতে

গেলেও সঙ্গিনী নয়, পদমর্যাদার সচেতন গাম্ভীর্যে সে নীরব এবং নির্বিকার।

দরজা খুলে ধীরাপদ পাশে বসল।

লাবণ্য সরকার ঘাড় ফিরিয়ে অলস চোখে শুধু তাকালো একবার। তারপর সামান্য সরে বসল। সামনেই বসবে ভেবেছিল বোধ হয়। নির্দেশ নিয়ে ড্রাইভার গাড়ি ছুটিয়েছে। ধীরাপদর এই কদিনের সংযমের মুখটা আজ আবার আলগা হয়ে গেল কেন জানি। পুরুষকারের নামে সেই অদৃশ্য বিরোধের প্রতিক্রিয়া শুরু হল ভিতরে ভিতরে। আরো একটু সরে বসলে ওর সুবিধে হত, ওধারে জায়গা আছে। এও এক ধরনের অবজ্ঞাই। ধীরাপদ এ-ধারের দরজার সঙ্গে মিশে আছে। খানিক আগে এই মেয়ে সুষমার জাল বিছিয়ে বসেছিল কে বলবে। নারীর তূণে অনেক বাণ, পণ্যের তাগিদে তারই গোটাকতক অকাতরে খরচ করে এসেছে। অমিতাভ ঘোষের বেলায়ও তাই করেছিল বোধ হয়…। চারুদির ইঙ্গিতটা বিরূপতাপ্রসূত প্রেরণার মত কাজ করছে এখন। ওই দুজনের প্রতি তার যেন কর্তব্য আছে কিছু, আর সেই কর্তব্যবোধেই যেন ভিতরটা উস্-খুস করছে ধীরাপদর।

মাঝামাঝি পথে এসে লাবণ্য সরকার ব্যাগ-সংলগ্ন ফাইলটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু গম্ভীর নির্দেশ দিল, এটা আপনার কাছে রাখুন, সাবধানে রাখবেন—সামনের সপ্তাহে এসে একবার তাগিদ দিয়ে যাবেন।

ফাইলটা হাতে নিয়ে ধীরাপদ তক্ষুনি নিজের সম্বন্ধে দ্বিধান্বিত সংশয় জ্ঞাপন করল, আমি কি আপনার মত অমন করে বলতে পারব…

লাবণ্য সরকারের ঠাণ্ডা চোখ দুটো ওর মুখের ওপর এসে থমকালো। নিরীহ পশ্চাৎ-অপসারণের চেষ্টা ধীরাপদর। মানে, আমার পক্ষে এ-সব টেকনিকাল ব্যাপার আপনার মত করে বোঝানো শক্ত-

আপনাকে কিছু বোঝাতে হবে না, কণ্ঠস্বর ঈষৎ রূঢ়, আপনি শুধু ফাইল নিয়ে গিয়ে মনে করিয়ে দিয়ে আসবেন, তার কি হল না হল খবর নেবেন।

ধীরাপদ মাথা নাড়ল, দায়িত্ব লঘুকরণের ফলে প্রায় নিশ্চিত্ত যেন। মনে মনে হাসছিল, কিন্তু আর এক কথা মনে হতেই হাসি উবে গেল। তুষ্টির শুরুতেই পুরুষকার হোঁচট খেল একদফা। পকেটে চার-ছ’আনাও আছে কিনা সন্দেহ, ট্যাক্সির মিটার উঠবে দেড় টাকা দু টাকা। গাড়ি থেকে নেমে পুরুষের বদলে রমণীর মত সরে দাঁড়াতে হবে। পকেটে টাকা থাকলে পুরুষের মতই ভাড়াটা দিয়ে দিত সে। এ-রকম পরিস্থিতিতে টাকা না থাকার মানসিক বিড়ম্বনা কম নয়। টাকা থাকবে কোথা থেকে? টিউশন ছেড়েছে, নতুন-পুরনো বইয়ের দোকানে দে-বাবু আর অম্বিকা কবিরাজের কাছ থেকেও গা-ঢাকা দিয়ে আছে। সোনাবউদি কুকার কেনার জন্যে যে-কটা টাকা ফেরত দিয়েছিল তাই ভাঙিয়ে চলছে। কিন্তু কলসীর তোলা জল গড়িয়ে খেলে ক’দিন আর, ধীরাপদর পুরুষের উদ্যমে বিমর্ষ ছায়া পড়ল।

না ভাবলেও চলত, চক্ষুলজ্জা এড়ানোর রাস্তা ওপরঅলাই করে রেখেছিলেন। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সী মেদবহুল গোলাকার একটি চকচকে বাবু রমেন হালদারের সঙ্গে আলাপে মগ্ন। ট্যাক্সি থামার শব্দে তিনি ফিরে তাকালেন, তারপর চাঁচাছোলা ফরসা মুখখানা হাসির রসে ভিজিয়ে গাড়ির দিকে এগোলেন। কোঁচানো কাঁচি ধুতি, গিলে- পাঞ্জাবির নিচে ধপধপে জালি গেঞ্জি, পায়ে চেকনাই-ছোটানো হলদে নিউকাট, হাতে সোনার ঘড়ি, সোনার ব্যাণ্ড, বুক থেকে গলা পর্যন্ত মিনেকরা সোনার বোতাম, মাথার চুলে কলপ-ঠকানো সাদর কৌতুক। শৌখিনতার সচল বিজ্ঞাপনটি সামনে এসে দাঁড়ানোর পর ধীরাপদর গাড়ি থেকে নামার কথা মনে পড়ল।

অনেকক্ষণ নাকি? ভদ্রলোকের উদ্দেশে লাবণ্য সরকার। মুখে তারও হাসির আভাস একটু।

এই কিছুক্ষণ। কখন আবার তোমার সময় হবে না হবে, ভাবলাম ধরে নিয়ে যাই—এখনই যাবে তো?

লাবণ্য সরকার ঘড়ি দেখল, আসুন—আবার ছটার মধ্যে ফিরতে হবে!

ভদ্রলোক শশব্যস্তে উঠে গেলেন, ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল, ধীরাপদ বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। ফিরে দেখে রমেন তার দিকে চেয়ে দিব্যি হাসছে। হাসি গিলে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছেন দাদা?

ভদ্রলোক কে?

সর্বেশ্বরবাবু—

ধীরাপদর প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল- কার সর্বেশ্বর? সামলে নিল, এমনিতেই ছেলেটার সমস্ত মুখে বাচালতা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আর প্রশ্ন হল না দেখে রমেন নিজে থেকেই বলল, মিস সরকারের নিকট-আত্মীয়, একেবারে নিজের ভগ্নীপতি – বেশ ভালো সম্পর্ক, না দাদা?

-বেশ ভালো

ধীরাপদ দোকানের দিকে পা বাড়াবার উদ্যোগই করল শুধু, এগোলো না। শোনার লোভ ষোল আনা, এই ভগ্নীপতিই তাহলে লাবণ্য সরকারের ডাক্তারি পড়ার খরচ যুগিয়েছেন, আর তার বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা নিয়ে বসে আছেন! প্রত্যাশা সফল হবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ভ্রভঙ্গি করে চারুদি ওকে নীরেট বলেছিলেন। রমেন হালদার উপচে-ওঠা হাসিটুকুর ওপর চট করে সহানুভূতির প্রলেপ চড়িয়ে জানালো, ভদ্রলোকের একটি ছেলে আর একটি মেয়ের অসুখ, ডবল চিন্তা-মিস সরকারের সাড়ে চারটেয় যাবার কথা ছিল, দেরি দেখে উনি ফ্যাক্টরীতে টেলিফোন করেছিলেন, সেখানে না পেয়ে এখানে এসেছেন। সর্বেশ্বরবাবুর প্রশংসাও করল রমেন, খুব অমায়িক ভদ্রলোক, আর ওকে বেশ স্নেহ করেন। অনেকদিনের আলাপ রমেনের সঙ্গে, মাসের মধ্যে দুই-একদিন অন্তর দোকানে আসতে হয় তাঁকে। না এসে করবেন কি, ছেলেমেয়েগুলো বড় ভোগে যে। একটি দুটি তো নয়, পাঁচটা না ছটা—মাসির হাতের ওষুধ না পড়া পর্যন্ত একটাও এমনিতে সেরে উঠবে না। মাসি-অন্ত প্রাণ সব—দুধের শিশুরা মা হারালে যা হয় আর কি। কিন্তু মাসি তো আর সবসময়ে এখানে বসে থাকবে না, যখন অপেক্ষা করতে হয় রমেনের সঙ্গেই ভদ্রলোক গল্পসল্প করেন।

আর একটু দাঁড়ালে ভদ্রলোকের গল্পসল্পেরও কিছু নমুনা শোনা যেত হয়ত, কিন্তু ফাজিল ছেলেটার দরদ-মাখানো মুখে দুষ্টুমি টাপুরটুপুর। অসুস্থ ছেলে-মেয়ের বাপের মুখখানা মনে পড়তে ধীরাপদর নিজেরই হাসি পাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে অব্যাহতি।

কিন্তু ধীরাপদ সেদিন সত্যিই অবাক হয়েছিল।

অফিস-সংক্রান্ত জরুরী কোনো কাজে না আটকালে লাবণ্য সরকারের দোকানের চেম্বারে আসতে ছ’টার দু-দশ মিনিটের বেশি দেরি হয় না।

সেদিন সাড়ে সাতটা হয়েছিল।

সেই থেকে ধীরাপদ মনে মনে মাসকাবারের প্রতীক্ষায় ছিল। মাসটা শেষ হলে তাকে ফ্যাক্টরীতে টেনে নেবার কথা। মাসকাবারের পরেও দু দিন কাবার। ধীরাপদ ভাবছিল, হিমাংশু মিত্রের সঙ্গে একবার দেখা করে প্রতিশ্রুতিটা তাঁকে মনে করিয়ে দেবে কিনা। কিন্তু ধীরাপদ ভাবলই শুধু, গিয়ে উঠতে পারল না। যাক আর দুটো দিন।

তার আগেই শনিবার উপস্থিত। সকলের মুখেই একটুখানি প্রসন্নতার আমেজ দেখা গেল সেদিন। মাসের প্রথম শনিবারে মেডিক্যাল হোমের কর্মচারীদের মাইনে হয়। আজ সেই শনিবার। দুটো-আড়াইটের মধ্যে লাবণ্য সরকার টাকা নিয়ে আসবে — সে-ই মাইনে দিয়ে থাকে।

খবরটা শুনে একমাত্র ধীরাপদই খুশি হল না, উল্টে তাকে বিমর্ষ দেখা গেল একটু। মনে মনে আশা করতে লাগল, তার সম্বন্ধে হিমাংশু মিত্র ভুলে গিয়ে থাকলেই ভালো হয়, তার মাইনেটা না হলেই ভালো হয়। এখানকার সকলের মাইনে কি-রকম রমেনের মুখে শুনেছে। ভাঙা মাসে তারও সামান্যই প্রাপ্য হবে হয়ত। কিন্তু ধীরাপদর আপত্তি সেই কারণে নয়, তার আপত্তি আর সকলের মত মুখ বুজে ওই সামান্য ক’টি টাকা লাবণ্য সরকারের হাত থেকে নিতে হবে ভেবে। সেটাই অবাঞ্ছিত। নইলে টাকার দরকার খুব, গোটা মাস টাকা না পেলে নতুন-পুরনো বইয়ের দোকানের বাবুর কাছেই গিয়ে হয়ত ধরনা দিতে হবে আবার।

প্রত্যাশিত সময়ে লাবণ্য সরকার এলো। ভিতর দিয়ে চেম্বারে ঢোকার আগে ধীরাপদর দিকে যেন বিশেষ মনোযোগেই তাকালো একবার। সে দৃষ্টি সহানুভূতির কি অনুকম্পার কি আর কিছুর, সঠিক বোঝা গেল না। ধীরাপদ মনে মনে আশান্বিত হয়ত তার তবিলে ওর মাইনেটা নেই বলেই এ-ভাবে দেখে গেল।

প্রথমে ম্যানেজার ঢুকলেন মাইনে নিতে। তাঁর বেরুতে সময় লাগল একটু। সকলের মাইনে-পত্র ঠিক আছে কিনা দেখছিলেন বোধ হয়। কিন্তু বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখে চোখ পড়তে ধীরাপদই ভড়কে গেল। দুই চোখ ভরা নির্বাক বিস্ময় তাঁর। ধীরাপদ ভেবে পায় না, এই দিনে কারো মাইনে না হওয়াটা এমনই অবাক ব্যাপার কিছু নাকি!

একে একে সকলের মাইনে হতে সময় মন্দ লাগল না। সব ব্যাচের সব কর্মচারী হাজির। দারোয়ান বেয়ারা সুইপার পর্যন্ত। কিন্তু শুধু ম্যানেজার নয়, কর্মচারীদেরও অনেকের বিভ্রান্ত দৃষ্টির ঘা এসে পড়ল ধীরাপদর মুখের ওপর। মানুষটাকে যেন আবার নতুন করে দেখছে তারা।

সকলের মিটে যেতে লাবণ্য সরকার নিজেই উঠে এসে সুইংডোর ঠেলে ডাকল, এবারে আপনি আসুন একটু।

এলো।

এ আবার কি কণ্ঠস্বর। কর্ত্রীর কণ্ঠও নয়, কর্তৃত্বের কণ্ঠও নয়। ধীরাপদ উঠে এলো।

লাবণ্য সরকার নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে তাকে বলল, বসুন—

ধীরাপদ স্বপ্ন দেখছে না দিনে-দুপুরে কল্পনার ডানা মেলে দিয়েছে? নিজে উঠে ডেকে আনা, তার ওপর প্রায় মিষ্টি করে বসতে বলা!

বসল।

লাবণ্য সরকার দুই হাত টেবিলের ওপর রেখে সামনের দিকে ঝুঁকল একটু, মুখে সঙ্কোচ-তাড়ানো হাসির আভাস। দেখুন, এখানকার কাণ্ডই আলাদা, আপনি কি পোস্ট-এ এসেছেন, কি ব্যাপার, কেউ কিছু বলেনি, আপনিও কিছু বলেননি – আজ পে-অর্ডারে দেখলাম… মিঃ মিত্রের সঙ্গেও অবশ্য তারপর কথা হয়েছে।

এরই মধ্যে ফাল্গুনের গা-জুড়ানো বাতাস দিয়েছে কোথায়। দূর, এটা শীতকাল! ধীরাপদ অপেক্ষা করছে আর নিজের মুখের ওপর সহজতার রেখা বুনতে চেষ্টা করছে।

সই করার জন্য লাবণ্য সরকার অ্যাকুইট্যান্স রোল বাড়িয়ে দিল তার দিকে। একটা আলাদা শীট-এ ধীরাপদর একার নাম। নাম আর পদমর্যাদা। কিন্তু লেখাগুলো যেন চোখের সামনে স্থির হয়ে বসছে না কিছুতে।

রোসো ধীরাপদ চক্রবর্তী রোসো, এত বড় কোম্পানীর জেনারাল সুপারভাইজার তুমি, এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থেকো না— মাসে ছ’শ টাকা মাইনে হিসেবে ষোল দিনে তিন’শ কুড়ি টাকা প্রাপ্য তোমার, বুকের দাপাদাপি থামাও। এখানে নয়, এই মুহূর্তে নয়, এর সামনে নয়, সব বাইরে-বাইরে গিয়ে বিস্ময়ের ঘূর্ণিতে দিশেহারা হয়ো, হাবুডুবু খেয়ো, সাঁতার দিয়ে সিন্ধু পার হয়ো। এখানে শুধু ওই টাকার অঙ্কের পাশে, ওই রেভিনিউ স্ট্যাম্পটার ওপর বেশ সহজ শাস্ত্র মুখে স্পষ্ট করে একটা নামের স্বাক্ষর বসিয়ে দাও।

কলমটা টেবিলেই ফেলে এসেছে। লাবণ্য নিজের কলম এগিয়ে দিল, আর টাকার খাম। স্বাক্ষরাস্তে কলম আর অ্যাকুইট্যান্স রোল ফেরত নিয়ে লাবণ্য আলাপের সুরে জিজ্ঞাসা করল এর আগে আপনি কোথায় ছিলেন?

অভিজ্ঞতা অন্যথায় যোগ্যতা প্রসঙ্গে অম্বিকা কবিরাজের আখড়া আর দে-বাবুর নতুন পুরনো বইএর দোকানের নাম করবে? ধীরাপদ সত্যি জবাব দিল, আগে কোথাও ছিলাম না, কাজ-কর্ম বলতে গেলে এই প্রথম-

কিছু না করেও এমন পদমর্যাদা লাভের রহস্যটা লাবণ্য সরকার ওর মুখ থেকেই আবিষ্কার করে নিতে চেষ্টা করল দুই-এক মুহূর্ত। কৌতূহল স্বাভাবিক, অন্যদিকের রোজগার এখন যাই হোক, নিজে সে তিনশ টাকায় এসেছিল—তাও অমিতাভ ঘোষের খাতিরে। এতদিনে সেটা ছ’শ টাকায় দাঁড়িয়েছে। মালিকদের বাদ দিলে তার সমান মাইনে আর কারো ছিল না।

এ-রকম পদ-গৌরবে অধিষ্ঠিত হবার মত কোনো প্রতিশ্রুতি আগে তো চোখে পড়েইনি, আজও পড়ল না।— আপনি সোমবার থেকে ফ্যাক্টরীতে আসুন, এখানে মাঝেসাঝে সন্ধ্যের দিকে এসে দেখাশুনা করে গেলেই হবে—মিঃ মিত্রই সব বলে দেবেন আপনাকে, সোমবার ফ্যাক্টরীতে আসতে বলেছেন।

ধীরাপদ বাইরে এসে দাঁড়াতে বহুক্ষণের একটা রুদ্ধ নিঃশ্বাস মুক্তি পেয়ে বাঁচল। দোকানে আর এক মুহূর্তও ভালো লাগছিল না। এমন কি বিকেলে লাবণ্য সরকারের পেশেন্ট দেখার বৈচিত্র্যে মন ডোবানোর আগ্রহও নেই আজ। সে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়েছে। ঘড়িতে সবে চারটে তখন।

বুক-পকেটে টাকার খামটা পকেট ছাড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে আছে। স্পর্শটা জামার ভিতর দিয়ে বুকের চামড়ায় লাগছে। মাসে ছ’শ ষোল দিনে তিনশ’ কুড়ি। আশ্চর্য! খুলে দেখবে একবার? একবারও তো দেখল না! থাক, ঠিকই আছে। উদবেগ গেছে, উত্তেজনা গেছে, সেইটুকু শান্তি। বড় বড় পা ফেলে সেই শান্তিটুকু উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছে। জীবন এক-একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে থাকে এক-একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। যত ঘোরো আর যতই মাথা খোঁড়ো—ওরই মধ্যে। ধীরাপদ মাথা না খুঁড়ক, তাই ঘুরছিল। হঠাৎই বৃত্ত-বদল হয়ে গেল। এই বৃত্তটা বড়ই বোধ হয়।

চারুদির ওখানে যাবে কিনা ভাবছে। যাওয়া উচিত, কিন্তু আজ অন্তত যেতে মন সরে না। এই বৃত্ত-বদল সহজ হোক আর একটু, চারুদি মনে মনে ভাবতে পারেন, প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই আনন্দে আটখানা হয়ে ছুটে এসেছে। ওর মুখের দিকে চেয়ে আশার দারিদ্র্য আবিষ্কার করবেন হয়ত। সুলতান কুঠির দিকেই পা টানছে, অনেকগুলো দিন একটা মানসিক বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে কেটেছে। সোনাবউদি ঠাট্টা করেছিল, সাত মণ তেল পুড়েছে, রাধা শেষ পর্যন্ত নাচবে কিনা। ধীরাপদ হাসছে আপনমনে, এমন নাচ সেও কল্পনা করেনি। নোটভরা খামটা বড় বেশি মাথা উঁচিয়ে আছে মনে হচ্ছে। তুলে নিয়ে দু ভাঁজ করে আবার পকেটে ফেলেই থমকে দাঁড়াল।

মনের তারে ঠিক সময় ঠিক সুরটি এভাবে বেজে ওঠে কি করে? এতদিন তো মনে পড়েনি।

….হাসিমুখে সোনাবউদি রণুর কাণ্ডর কথা গল্প করেছিল একদিন। রণু ষাট টাকা মাইনের কি একটা চাকরিতে ঢুকেছিল একবার। প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই সোনাবউদিকে ভালো একখানা গরদের শাড়ি কিনে দেবে ঠিক করেছিল। সোনাবউদির একখানা গরদের শাড়ির শখ ছিল জানত। কিন্তু দশ দিন কাজ করার পরেই অসুখে পড়ে চাকরি শেষ। অসুখ হল চাকরি গেল সেটা কিছু না, শাড়ি কেনা হল না সেই দুঃখে রণু মনমরা। শেষে সোনাবউদির ধমক খেয়ে ঠাণ্ডা, সোনাবউদি বলেছে, গরদের শাড়ি পরে সেজেগুজে চিতায় উঠবে তাই শাড়িটা এক্ষুণি দরকার।

ধীরাপদ – মার্কেটের পথে পা চালিয়ে দিল।

কিন্তু ফেরার পথে আবারও থামতে হল। নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। না, ঠিকই দেখছে। ধীরাপদর দুই চোখে পলক পড়ে না।

ফুটপাথ ঘেঁষে আধুনিক কায়দার খোলা রেস্তরাঁ একটা। খোলা বলতে ক্যাবিন অথবা পরদার বালাই নেই! অবাঙালী অভিজাত নারী-পুরুষের ভিড় বেশি। বাইরে দরজার দিকের টেবিলে একটি মেয়ে দুটি ছেলে। ট্রাউজারের ওপর শার্ট ঝোলানো ছেলে দুটোকে পাড়ার অনেক রকে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জটলা করতে দেখেছে ধীরাপদ। মেয়েটি রমণী পণ্ডিতের মেয়ে কুমু—বাপের জ্যোতিষী-মতে হাতে যার বিদ্যাস্থান বড় শুভ। রমণী পণ্ডিতের চোদ্দ বছরের সেই প্রায় বোবা ভোঁতা মেয়েটার এরই মধ্যে এতখানি বিদ্যালাভ। অবশ্য চোদ্দ বছর হয়ত সতেরোয় ঠেকেছে এখন, আর ঋতুরাজের বিচারে ও-বয়সটা ফেলনা নয় একটুও। তবু সোনাবউদির জন্য ঘর খালি করার তাগিদে ধীরাপদ প্রায় মরীয়া হয়ে যে মেয়েটাকে আকাশ বাতাস মেঘ জল গাছপালা আর মজাপুকুরের শ্যাওলা-প্রসঙ্গে অকাতরে পাঠদান করেছে, সেই কুমুর এরই মধ্যে এমন উন্নতি চমকপ্রদ। এই দু বছর আড়াই বছর ধীরাপদ কি অন্ধ হয়ে বসেছিল?

ছেলে দুটোর একজনকে রমণী পণ্ডিতের কোণা-ঘরের বারান্দায়ও এক-আধদিন দেখেছে মনে পড়ল। এদের দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় খুব সম্ভব। ফুটপাথে একটা লোককে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সে-ই প্রথম তাকিয়েছিল। তারপর চট্‌ করে মুখ নামিয়ে নিয়ে না দেখার ভান করেছে। পরক্ষণে ওদের ছোট টেবিলে নিঃশব্দ আলোড়ন, দ্বিতীয় ছেলেটারও মুখ নীচু। আর কুমু? আচমকা আলোর ঘায়ে ভীত-এস্ত শশকের যেমন বিড়ম্বনা।

ধীরাপদ এগিয়ে গেল। নিজের স্বভাবটার ওপরেই বিরক্ত। দিলে ওদের আনন্দটুকু পণ্ড করে!… সুলতান কুঠির বাসিন্দাদের চোখে এই কলকাতা অনেক দূর বলে জানত। ভাবছে, প্রকৃতি নিরপেক্ষ কর্মকুশলিনী বটে, ওরা যতই তুচ্ছ করুক আর অবহেলা করুক, তার কাজে খুঁত নেই।

দূর থেকে কদমতলার শূন্য বেঞ্চি দেখে ধীরাপদ মনে মনে খুশি একটু। হাতের বস্তুটি নিয়ে কারো দৃষ্টি-বিশ্লেষণে হোঁচট খেতে খেতে ঘরে পৌঁছুতে হবে না। শকুনি ভটচায আর একাদশী শিকদারের অন্তরঙ্গতায় চিড় খেল নাকি, সন্ধ্যা না হতেই বেঞ্চি ফাঁকা কেন?

উঠোন পেরিয়ে আসার আগেই কচি গলার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ কানে আসতে ধীরাপদ হকচকিয়ে গেল। গণুদার ন’বছরের মেয়ে উমারাণীর গলা, মেয়েটাকে যেন মেরেই ফেলেছে কেউ। ঘরে ঢোকা হল না, পাশের দরজায় এসে দাঁড়াল।

ভিতরের দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত।

মেয়ের এক হাত ধরে গদা টানাটানি করে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে আর শুকনো মুখে শ্মসাচ্ছে, ভালো হবে না— খবরদার — ছাড়ো বলছি। মেয়ের অপর হাতটি সোনাবউদির করায়ত্ত, অন্য হাতের ভাঙা-পাখার বাঁট মেয়ের হাতে-পায়ে গায়ে-মাথায় ফটাফট পড়ছে তো পড়ছেই। মেয়েটার সর্বাঙ্গ দাগড়া-দাগড়া হয়ে গেল বোধ হয়। তার চিৎকার আর কাকুতিতে- কানে তালা লাগার উপক্রম—আর করব না মাগো, আর কক্ষনো চাইব না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আর মেরো না, মরে গেলাম— স্বামীর শাসানিতে ভ্রূক্ষেপ নেই, অস্ফুট গর্জনে মেয়ে পিটছে সোনাবউদি। আর চাইবি কি করে, যমের বাড়িই তো পাঠাবো তোকে আজ—

হাতের কাগজের বাক্সটা দরজার পাশের ছোট আলমারিটার মাথায় রেখে গায়ের জোরেই ধীরাপদ উমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে সোনাবউদির হাত থেকে পাখাটা এক ঝটকায় টেনে নিয়ে দরজা দিয়ে ছুঁড়ে বারান্দায় ফেলে দিল।

সোনাবউদি নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে তাকালো তার দিকে, হাঁপাচ্ছে রীতিমতো। গণুদাও নির্বাক কয়েক মুহূর্ত, তার আহত পুরুষচিত্ত তৃতীয় ব্যক্তির ওপরেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল বুঝি। গম্ভীর মুখে বলে উঠল, এর মধ্যে তোমাকে কে আসতে বলেছে—

আমার বদলে পুলিশ আসা উচিত ছিল! ঠাস করে মুখের ওপর কথা ক’টা বলে উমাকে দু হাতে আলতো করে তুলে নিয়ে ধীরাপদ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

মেয়েটার হেঁচকি থামতে আধ ঘণ্টা। অনেক তোয়াজের পর আর অনেকগুলো লোভনীয় প্রতিশ্রুতির পর উমারাণীর মুখে কথা ফুটল। ধীরাপদ অবাক, এত বড় মারটা কেন খেল তা মেয়েটা এখনো ভালো করে জানে না। দুপুরে মা-বাবাতে কি নিয়ে একটু ঝগড়ার মত হয়েছিল। বিকেল পর্যন্ত সে কি আর কারো মনে থাকে, উমারাণীরও মনে ছিল না। বাবার কাছে রিবন চেয়ে বসেছিল, বাবা ওকে রিবন এনে দেবে কথা দিয়েছিল। সেই রিবন চেয়ে বসতে বাবা ঠাস করে ওর গালে এক চড় — মা তখন উনুনে পাখা দিয়ে বাতাস করছিল, উঠে এসে সপাসপ ওকে পিটতে আরম্ভ করে দিল। ধীরুকা না এসে গেলে মা যে ওকে মেরেই ফেলত সে-সম্বন্ধে উমারাণীর একটুও সন্দেহ নেই।

রাগটা আসলে কার ওপর ওই মার দেখেই ধীরাপদ অনুমান করেছে। তবু ক্ষমা করা শক্ত। ছেলেমেয়েগুলোকে একটুও ভালবাসে না সোনাবউদি, ভালবাসলে এত নির্দয় হতে পারত না। কিন্তু গণদার ওপর আজ আবার এমন চণ্ডাল রাগের হেতু কী?

উমার তাগিদে একটা গল্প শুরু করতে হয়েছিল, দরজার কাছে সোনাবউদিকে দেখে থেমে গেল। তার হাতে ওর বিকেলের আনা সেই প্যাকেটটা। দরজার ওধার থেকে মেয়েকে একবার দেখে নিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়াল। নরম মুখ করে বলল, একে তো পুলিসের ভয়, তার ওপর আবার এটা ঘরে ফেলে এসেছিলেন—দুই চোখে নীরবে বাঙ্গ ছড়ালো একটু, দেখে-টেখে রাখুন, কি থেকে আবার কি ফ্যাসাদে পড়ব কে জানে!

শাড়ি ছাড়া ওতে যে আর কিছু থাকা সম্ভব নয়, শৌখিন প্যাকেটের ছাপেই সেটুকু সুস্পষ্ট। শ্লেষ গায়ে না মাখলেও ধীরাপদ অবাক একটু, ও কার জন্যে শাড়ি এনে তার ঘরে ফেলে এসেছে বলে সোনাবউদির ধারণা? অবশ্য তারই জন্য যে তাই বা ভাববে কি করে?

কিভাবে শাড়িটা এনে হাতে দেবে বা কি বলবে, এই পরিস্থিতিতে পড়ে সেই সমস্যা গেল। খুব সাদাসিধে ভাবে বলল, আমি ওটা ফেলে আসিনি।… আপনি ইচ্ছে করলে ফেলে দিতে পারেন।

সোনাবউদির মুখে পরিবর্তনের রেখা পড়তে লাগল। থতমত খেয়ে গেল কেমন, তারপর নিজের অগোচরেই কাগজের বাক্সর ওপরকার ফিতের বাঁধন খুলে শাড়িটা হাতে তুলে নিল।

বাজারের সব থেকে সেরা গরদের শাড়িই এনেছিল ধীরাপদ।

দু চোখ ভরা নিবিড় বিস্ময় সোনাবউদির। শাড়ি থেকে সেই বিহ্বল দৃষ্টি ধীরাপদর মুখের ওপর ফিরে এলো আবার। ধীরাপদও হঠাৎ স্থান-কাল ভুলেছে, কোলের কাছে ছোট মেয়েটা হাঁ করে চেয়ে আছে খেয়াল নেই। বিচারকের শেষ রায় শোনার মত তারও দুই চোখে নিষ্পলক প্রতীক্ষা।

সোনাবউদি দেখছে। দেখছে না, শুধু চেয়ে আছে। চেয়ে চেয়ে কোন্ এক স্মৃতি- দূতের পায়ের শব্দ শুনছে যেন। পরক্ষণে তার সর্বাঙ্গ জোড়া একটা চকিত শিহরণের আভাস দেখল বুঝি ধীরাপদ — গরদের শাড়ি ধরা দুই হাতে, বাহুতে, মুখের রেখায় রেখায়, চোখের পাতায়…।

কাগজের বাক্স আর গরদের শাড়ি হাতে সোনাবউদি ত্রস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গল্পের মাঝখানে অনেকক্ষণ মুখ বুজে বসেছিল উমারাণী। মা চলে যেতে নিশ্চিন্ত। তাগিদ দিল, ধীরুকা বলো-

গল্পে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টায় ধীরাপদ বার-দুই গলাখাঁকারি দিয়ে নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *