ছয়
স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং পুরুষস্য ভাগ্যং, স্ত্রীলোকের চরিত্র আর পুরুষের ভাগ্য…
মানুষ কোন্ ছার, দেবতাদেরও বোধের অগম্য নাকি।
বচনটি জানা ছিল। তা বলে ভাগ্যের সিঁড়ি রাতারাতি ঊর্ধ্বমুখ হতে পারে কোনোদিন, এমন আশা ধীরাপদর ছিল না। আর রমণী-চরিত্র প্রসঙ্গে উক্তিটা একমাত্র সোনাবউদির বেলাতেই প্রযোজ্য বলে বিশ্বাস করত। কিন্তু চারুদির বাড়ি এসে প্রাজ্ঞ বচনের নিগূঢ় ইঙ্গিত অনেকটাই প্রসারিত মনে হল। নিজের ভাগ্যের ওপরকার পুরু পরদাটা একদফা নড়েচড়ে উঠল। চারুদির মধ্যেও জটিল নারী-রীতির বৈচিত্র্য দেখল একটু। শুধু চারুদি নয়, ধীরাপদর মনে হল, ওই পাহাড়ী মেয়ে পার্বতীরও ভিতরে ভিতরে অনাবৃত রহস্যের বুনুনি চলেছে একটা।
বাইরের ঘরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ধীরাপদ কাউকে দেখতে পায়নি। মালী ওকে দেখে খবর দিয়েছে তারপর ফিরে এসে ভিতরে যেতে বলেছে।
এসো, তোমার আবার বাইরে থেকে খবর পাঠানোর দরকার কি, সোজা চলে এলেই পারো।
দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ানোর আগেই চারুদির আহ্বান। ধীরাপদ বুঝল না, সে-ই এসেছে চারুদি জানল কি করে! মালীর নাম বলতে পারার কথা নয়। বাইরে স্যাণ্ডেল জোড়া খুলে ঘরে ঢুকে বেশ একটু সঙ্কোচে পড়ে গেল। তকতকে মেঝেয় বসে চারুদি একটা মোটা চিরুনি হাতে পার্বতীর কেশবিন্যাসে মগ্ন। তাঁর কোলের ওপর কালো ফিতে। ধপধপে ফরসা এক হাতে পার্বতীর চুলের গোছা টেনে ধরা, অন্য হাতে বেশ জোরেই চিরুনি চালিয়ে চুলের জট ছাড়াচ্ছেন। ধীরাপদর মনে হল পার্বত্য রমণীটি শক্তহাতে বন্দিনী।
বোসো—। যেন ও আসবে জানাই ছিল। চারুদি পার্বতীর চুলের গোছা আরো একটু টেনে ধরলেন। – তোর আবার লজ্জার কি হল, বোস ঠিক হয়ে, মাথা নয়তো আস্ত একখানা জঙ্গল।
ধীরাপদ আগের দিনের মতই অদূরে একটা মোড়ায় বসেছে। জঙ্গল-কেশিনীর মুখে লজ্জার আভাস কিছু চোখে পড়ল না। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে হয়ত, অথবা ঝুঁকতে চাইছে, চারুদির কেশাকর্ষণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এটুকু ছাড়া মুখভাবে আর কোনো তারতম্য নেই। ওর লজ্জার লক্ষণ চারুদিই ভালো জানেন। তাঁর অগোচরে ধীরাপদ মেয়েটার দিকে দুই-একবার চোখ না চালিয়ে পারল না। পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল বসে আছে … সামান্য ব্যতিক্রমে আঁটবসনের বাধা ভেঙে তনু-তরঙ্গ উপচে ওঠার সম্ভাবনা। পরিচারিকার প্রতি কর্ত্রীর এই বাৎসল্যটুকুও মিষ্টি।
এরই মধ্যে ছাড়া পেলে, কোথা থেকে আসছ? দ্রুত হাত চলেছে চারুদির।
ফ্যাক্টরী থেকে।
চারুদি উৎসুক নেত্রে তাকালেন, অমিতের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
ধীরাপদ মাথা নেড়ে জানালো, হয়েছে।
এলো না কেন, আজ আসবে ভেবেছিলাম, টেলিফোনে বলেও ছিল আসবে, তোমার সঙ্গে আলাপসালাপ হয়েছে ভালোমত?
আজই হল। ধীরাপদর দু চোখ পার্বতীর মুখের ওপর আটকালো কেন নিজেও জানে না। অন্তস্তলের রসিক মনটির অনুভূতির কারিগরি আরো বিচিত্র। একজনের আসার সম্ভাবনার সঙ্গে চারুদির এই বাৎসল্যের একটা যোগ উকিঝুঁকি দেয় কেন, তাই বা কে জানে?
চটপট চুল বাঁধা শেষ করে চারুদি যেন মুক্তি দিলেন মেয়েটাকে। বললেন, কি আছে মামাবাবুকে তাড়াতাড়ি এনে দে, খেটেখুটে এসেছে-
খেটে আসুক আর না আসুক ধীরাপদর খিদে পেয়েছে। পার্বতীর প্রস্থান। চারুদি উঠে ভিজে তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে তাকালেন ওর দিকে। ধীরাপদর চোখ তখনো দোড়গোড়া থেকে ফেরেনি, আপনমনে হাসছিল একটু একটু। চারুদির চোখে চোখ পড়তে কৈফিয়তের সুরে বলল, মনিব ভালো পেয়েছে—
তোয়ালে রেখে চারুদি খাটে বসলেন।— তুমি কেমন মনিব পেলে শুনি, সেদিন এসেও ওভাবে চলে গেলে কেন? পার্বতী বলছিল—
ধীরাপদ অপ্রস্তুত। তার সেদিনের আসাটা কেউ টের পেয়েছে একবারও ভাবেনি। কিন্তু পেলেও এ প্রসঙ্গ চারুদির অন্তত উত্থাপন করার কথা নয়। এসেও ওভাবে ফিরে গেল কেন সেটা তাঁর থেকে ভালো আর কে জানে।
ওকে স্থূল বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে কৌতুক উপভোগ করাটাই চারুদির উদ্দেশ্য বলে মনে হল না। চারুদি যেন বলতে চান, লাল গাড়ি দেখে তুমি পালিয়েছ, কিন্তু পালাবার কোনো দরকার ছিল না।… সঙ্কোচের ব্যাপারটা গোড়া থেকেই কাটিয়ে দিতে চান হয়ত।
জবাব এড়িয়ে বলল, তোমার পার্বতী পাহারাদারও কড়া দেখি।
খুব। এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করলেন না চারুদি। চিঠি খোলার খবরটা হিমাংশু মিত্র বলে গেছেন কিনা, তাও বোঝা গেল না। জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল বলো, কাজ করছ?
কি কাজ?
ওমা, সে আমি কি জানি? কাজে লাগোনি?
ধীরাপদ মাথা নাড়ল। তারপর হেসে বলল, শুধু তুমি কেন, কেউ জানে না—
চারুদি অবাক। এই যে বললে ফ্যাক্টরী থেকে আসছ?
গেছলাম একবার। হালকা করেই বলল, তুমি এভাবে আমার মত একটা লোককে ওঁদের মধ্যে ঠেলেঠুলে ঢোকাতে চাইছ কেন? ও থাকগে—
ভালো লাগছে না? চারুদি হঠাৎ বিমর্ষ একটু। বিরক্তও। তাঁর কিছু একটা প্ল্যান যেন বরবাদ হতে চলেছে।—এখনও তো কাজই শুরু করোনি, এরই মধ্যে এ-কথা কেন?
কাজের জন্যে নয়, ওঁরা ঠিক-
ওঁরা কারা?
ধীরাপদ আর কিছু বলে উঠতে পারল না। অভিযোগ করতে চায়নি, অভিযোগ করার নেইও কিছু। যাওয়া মাত্র সকলে তাকে সাদর অভ্যর্থনায় গ্রহণ করবে এমন প্রত্যাশাও ছিল না। এই দু দিন ঘোরাঘুরি করে নিজেকে একেবারে বাইরের লোক আর বাড়তি লোক মনে হয়েছে বলেই কথাটা তুলেছিল।
কিন্তু চারুদি আমল দিলেন না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই দুটো দিনের খবর শুনলেন। তারপর একটু আশ্বস্ত হয়ে বললেন, কাজে না ঢুকেই পালাতে চাইছ। এক নম্বরের কুঁড়ে তুমি, দুটো দিন সবুর করো সব ঠিক হয়ে যাবে। ওঁরা সত্যিই এখন ব্যস্ত খুব-
একটু থেমে আবার বললেন, আর একটা কথা, ওখানে কাজ করতে গেছ বলে নিজেকে কারো অনুগ্রহের পাত্র ভাবার দরকার নেই, তুমি তো যেতে চাওনি, আমিই তোমাকে জোর করে পাঠিয়েছি।
তাঁর জোর করে পাঠানোর জোরটা কোথায় সঠিক না জানলেও ধীরাপদর আবারও মনে হল, জোর কোথাও আছেই। সেটা শুধু কোনো এক পুরুষের ওপর কোনো এক রমণীর জোর নয়। ব্যক্তিগত প্রভাব নয় কারো ওপর, ওই গোটা ব্যবসায়- প্রতিষ্ঠানটির ওপরই কিছু যেন একটা স্বার্থগত প্রভাব আছে। তার চাকরির ব্যাপার নিয়ে তা না হলে এমন অ-রমণীসুলভ মাথা ঘামাতেন না তিনি, অত আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। চারুদির লোক বলেই তার জোরটা যে ঠুনকো নয় সে-রকম একটা স্পষ্ট আভাস বিকেলে অমিতাভও দিয়েছিল। বলেছিল, যাঁর কাছ থেকে এসেছে
—কারো মেজাজের ধার ধারতে হবে না।
ধীরাপদর আরো কাছে এসে আরো ভালো করে আরো নিরীক্ষণ করে দেখতে ইচ্ছে করছিল চারুদিকে। দেখছিল কি না কে জানে। হেসে বলল, অর্থাৎ পার্বতীর মত আমারও আসল মনিবটি এখানে তুমিই?
চারুদিও হাসলেন। প্রায় স্বীকারই করে নিলেন যেন। হাসির সঙ্গে সঙ্গে বৈষয়িক গাম্ভীর্যটুকু গেল। বললেন, আগে তো এই মনিবের টানে-টানেই পাশ ছেড়ে নড়তে না, এখন বয়স হয়ে গেছে, আর তেমন পছন্দ হবে না বোধ হয়।
আঠারো বছর বাদে দেখা হওয়া সত্ত্বেও সেদিন চারুদির বয়েসটা ধীরাপদর চোখে পড়েনি। আজও পড়ল না।… কারো কি পড়েছে? সেদিন হিসেব করে বলেছিলেন চুয়াল্লিশ। যাই বলুন, ধীরাপদর এখনো মনে হয়, চারুদির সব বয়েস ওই লালচে চুল আর লাল রঙের মধ্যে হারিয়ে গেছে। ফিরে ঠাট্টা করতে যাচ্ছিল, পছন্দ এখনো কম নয়, কিন্তু মনিবের কাছে সেটা অপ্ৰকাশ্য।
বলা হল না। খাবার হাতে পার্বতী ঘরে ঢুকেছে।
ধীরাপদ আড়চোখে খাবারের থালাটা দেখল। এত খাবার কেউ আসবে বলে তৈরি করা হয়েছিল বোধ হয়। কে করেছে, পার্বতী না চারুদি? কি দেওয়া হয়েছে চারুদি লক্ষ্য করলেন না, অন্য কিছু ভাবছিলেন তিনি। পার্বতী চলে যেতে সকৌতুকে তাকালেন তার দিকে। – তার পর, এখানে মেম-ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল?
মেম-ডাক্তার! কার মুখে শুনেছিল? মনে পড়ল হিমাংশু মিত্রের বাড়ির মানকেকে বলতে শুনেছিল।… মানকের সঙ্গে চারুদির যোগাযোগ আছে তাহলে। হঠাৎ এ প্রসঙ্গ আশা করেনি ধীরাপদ। আরো কিছু শোনার আশায় নিরুত্তর।
হাঁ করে চেয়ে আছ কি, লাবণ্য সরকারকে দেখোইনি এ পর্যন্ত? তুমি সত্যিই ওখানে চাকরি করবে কি করে তাহলে?
ও! ধীরাপদ হাসল এবার, আমি নগণ্য ব্যক্তি তাঁর কাছে।
চারুদি উৎফুল্ল মুখে সায় দিলেন, তা সত্যি—দেখো চেষ্টাচরিত্র করে একটু-আধটু গণা হতে পারো কি না, সেই তো বলতে গেলে কর্ত্রী ওখানকার।
আমারও? ধীরাপদ ঘাবড়েই গেছে যেন।
চারুদির খুশির মাত্রা বাড়ল আরো। – তুমি না চাইলে তোমার নাও হতে পারে। কেন, পছন্দ নয়?
তেমনি নিরীহ মুখে ধীরাপদ পাল্টা প্রশ্ন করল, পছন্দ হলেও চাকরিটা থাকবে বলছ?
চারুদি চোখ পাকালেন, বেড়ালের মত মুখ করে থাকো, কথায় তো কম নও দেখি! পরমুহূর্তে উচ্ছ্বসিত হাসি। – তাও থাকবে, চেষ্টা করে দেখতে পারো।
প্রথম দিন এ-বাড়ি এসে পার্বতীর বডি-গার্ড প্রসঙ্গে চারুদিকে এমনি হাসতে দেখে ধীরাপদর মনে হয়েছিল, অত হাসলে চারুদিকে ভালো দেখায় না। আজও তেমনি মনে হল। চারুদির অত হাসি খুব সহজ মনে হয় না। এত হাসি অস্তস্তলের কিছু গোপন প্রতিক্রিয়ার দোসর যেন।
এই দিনও ধীরাপদ ছাড়া পেয়েছে অনেক রাতে। কথায় কথায় এত রাত হয়েছে সেও খেয়াল করেনি। সন্ধ্যার ওই জলযোগের পর রাতের আহারের তাগিদ ছিল না। তবু না খাইয়ে ছাড়েননি চারুদি, বলেছেন, এত রাতে কে আর তোমার জন্যে খাবার সাজিয়ে বসে আছে? ছদ্ম-সংশয়ও প্রকাশ করেছেন, নাকি আছে কেউ?
ফেরার সময় অন্যান্য বারের মতই তাকে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন।
…চারুদি অনেক গল্প করেছেন আজ। এই দিনের গল্প বেশ নিবিষ্ট আগ্রহে শুনেছে ধীরাপদ। যাদের সঙ্গে ওর নতুন যোগাযোগ, কথা বেশির ভাগ তাদের নিয়েই। বলার উদ্দেশ্য নিয়ে বলা নয় চারুদির, এক-একটা হাল্কা সূচনা থেকে গভীরতর বিস্তার।
ওই ছোড়াই তো হুট করে এনে বসিয়েছিল মেয়েটাকে, কারো কথা তো শোনে না কোনদিন, কারো কাছে জিজ্ঞাসাও করে না কিছু—নিজে যা ভালো বুঝবে তাই করবে।
ছোঁড়া বলতে অমিতাভ ঘোষ, আর মেয়েটা লাবণ্য সরকার।
-শুধু নিয়ে এসেছে। এনে ভেবেছে, ভারী দামী একটা আবিষ্কারই করে ফেলেছে।
…আমি একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলাম, সব ঝিনুকে মুক্তো নেই জানিস তো? শুনে সে কি রাগ ছেলের। যা নয় তাই বলে বসল আমায়, সবাই নাকি তা বলে আমার মতও নয়। খুব হেসেছিলেন চারুদি, সেই হাসি আবারও প্রাঞ্জল মনে হয়নি ধীরাপদর, খুব ভালো লাগেনি। হাসি থামতে বলেছেন, আসলে ওই বয়েস আর ওই সাদা নরম মন—চটক দেখে মাথা ঘুরে গেছল, বুঝলে না?
চারুদির কথা সত্য হলে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লাবণ্য সরকারের যোগাযোগ বেশ রোমান্টিকই বটে। … যোগসূত্র ‘সপ্তাহের খবর’। পরীক্ষার খাতার সাইজের ছোট আট পাতার কাগজ একটা। সপ্তাহে সপ্তাহে বেরোয়, ফেলে দিলে ঠোঙা বানানোর কাজেও লাগে না, এমনি চেহারা-পত্র তার। কিন্তু নিয়মিত পড়ুক না পড়ুক, সেই কাগজের নাম জানে আধা শিক্ষিতজনেরাও। চারুদির মুখে নাম শোনার আগে ধীরাপদও জানত। এখনো জানে। সপ্তাহের খবরে খবরের মত খবর থাকে এক-একটা। চমকপ্রদ চটকদার খবর সব। কাগজখানা অনেক সময়েই ওপরের মহলের ভীতি অস্বস্তি বা চক্ষুলজ্জার কারণ। আর সব সময়েই নিচের মহলের রোমাঞ্চ আর বিস্ময়ের খোরাক। সাধারণ লোক প্রয়োজনীয় একটা ঝাঁটার মতই মনে করে কাগজটাকে। রাজনীতি রাষ্ট্রনীতি সমাজনীতি অর্থনীতি আর হোমরাচোমরা অনেক ব্যক্তিনীতির অনেক অজ্ঞাত জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে এনে ফলাও করে স্তূপীকৃত করা হয় ওখানে।
‘সপ্তাহের খবর’-এর ভিত্তিতে প্রাদেশিক এমন কি কেন্দ্রীয় আইন সভারও প্রতিপক্ষ দলের হুলফোটানো জেরায় সরকারী পক্ষ অনেক সময় নাজেহাল। এই ধরনের খবর যদিও উপেক্ষার গহ্বরেই বিলীন হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, তবু এর সাময়িক প্রভাব বড় কম নয়। শিকার যাঁরা তাঁরা অন্তত এই সাময়িক আলোড়নটুকুতে বেশ পর্যুদস্ত বোধ করেন। অন্ধকারের জীব হঠাৎ আলোর ঘা খেলে যেমন গোলমেলে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে যায়, অনেকটা তেমনি।
বহুরূপীর ভোল বদলানোর মত এ পর্যন্ত অনেকবারই নাম বদলাতে হয়েছে কাগজখানার। শুধু নাম বদলেছে, ভোল বদলায়নি। অনেকবার কোর্টকাছারি করতে হয়েছে, ছোটখাটো খেসারত দিতে হয়েছে একাধিকবার, গুরুদণ্ড বা গুরু খেসারতেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু নাম? নামে কি আসে যায়? গোলাপ ফুল নাম- চাপা পড়ে কখনো। ভিন্ন নামে আর ভিন্ন নামের সম্পাদনায় রাতারাতি সেই গোলাপই ফুটেছে আবার। অজ্ঞজনের কৌতূহল, এ বাজারে ওই কাগজ চালানোর খরচ পোষায় কোথা থেকে? ছয় নয়া পয়সা ছাপার খরচও তো ওঠার কথা নয়। বিজ্ঞজনের অভিমত, খরচের ঘানি ভয় যাদের তারাই টানে—আট পাতার কাগজে এক-একবার চার পাতা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না? আর দায়ে ঠেকলে সব সময়ে যে চোখে পড়ার বিজ্ঞাপনই দেবে সকলে, তারই বা কি মানে?
বছর কতক হল ‘সপ্তাহের খবর’ নাম-ভূষণে চলছে কাগজখানা। যে-নামে বা যে-নামের সম্পাদনায়ই চলুক, এর আসল মালিক আর সম্পাদকের নামটিও বলতে গেলে সর্বসাধারণের পরিচিত। তিনি বিভূতি সরকার। কীর্তিমান পুরুষ।
এই বিস্তৃতি সরকার লাবণ্য সরকারের দাদা। অনেক বড় দাদা, বছর পঁয়তাল্লিশ বয়েস।
এখান থেকে লাবণ্য-প্রসঙ্গ শুরু চারুদির। -গেল বন্যায় বিনি পয়সায় কোম্পানীর বাক্স বাক্স ওষুধ পাঠানো হয়েছিলো অসুস্থ বন্যার্তদের জন্যে। অনেক জায়গায় মহামারী লেগেছিল। ওষুধ সাহায্য করে প্রতিষ্ঠান নাম কিনেছিল বেশ। কাগজে কাগজে সাহায্যের খবর বেরিয়েছিল, প্রশংসা বেরিয়েছিল।
কিন্তু ‘সপ্তাহের খবর’-এর এক ফলাও খবরে সব প্রশংসা কালি। দুর্গত অঞ্চলের ডাক্তারদের বিবেচনায় সাহায্যপ্রাপ্ত ওষুধের নাকি মান খারাপ বলে প্রকাশ। যে ওষুধে অবধারিত কাজ হওয়ার কথা, সেই ওষুধেও আশাপ্রদ ফল দেখা যাচ্ছে না। সপ্তাহের খবরে বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছে ‘উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ। ‘ তার নিচে আসল সংবাদ আর সম্পাদকীয় সংশয়, টীকাটীপ্পনী, মন্তব্য।
অমিতাভ ঘোষ তার দিনকতক আগে বিলেত থেকে ট্রেনিং নিয়ে চীফ কেমিস্ট হয়ে বসেছে। সব ক-টা কাগজের সঙ্গে প্রচারের যোগাযোগ তখন সে-ই রাখত, বিজ্ঞাপনও সেই পাঠাতো। দুর্গতদের সাহায্যের জন্য কোন লট-এর কি ওষুধ পাঠানো হয়েছে, ভালো করে জানেও না। এদিকে ফ্যাক্টরী তছনছ, ওলট-পালট করল, অসহিষ্ণু সন্দেহে কত চলনসই ওষুধও নষ্ট করল ঠিক নেই—অন্যদিকে কাগজের মুখ চাপা দেবার দায়ও তারই।
বিভূতি সরকার সবিনয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন।
কিন্তু পরের সপ্তাহেই আবার আক্রমণ। প্রচারের লোভে অপরিচিত ওষুধ দান করার নৃশংসতা, নরম-গরম কটু-কাটব্য, উঁচু মহলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অর্থাৎ হিমাংশু মিত্রের অন্তরঙ্গ যোগাযোগ প্রসঙ্গে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ।
অমিতাভ ঘোষ আর যেত কিনা সন্দেহ, কিন্তু হিমাংশু মিত্রই আবার তাকে পাঠিয়েছেন। দরকার হলে একসঙ্গে ছ-মাসের বিজ্ঞাপনও বুক করে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবারেও বিভূতি সরকার অমায়িক ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জনসাধারণ যে তদন্ত দাবী করে সম্পাদকীয় লেখার জন্য চাপ দিচ্ছে তাঁকে, সেকথাও বলেছেন। মামার কথা ভেবেই অমিতাভ ঠাণ্ডা মেজাজে বসেছিল। যাই হোক, বাঙালী প্রতিষ্ঠানের প্রতি এবারে সহযোগিতার আশা এবং আশ্বাস দিয়ে সাদামাটা একটা ব্যক্তিগত সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন বিভূতি সরকার। তাঁর বোনটি সেবারে ডাক্তারী পাস করেছে, ভালো যোগাযোগ কিছু হয়ে উঠছে না- সেই বোন এখন দাদাকে ধরেছে ওদের কোম্পানীতে কিছু সুবিধে হয় কিনা। বোনকে ডেকে তখুনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ব্যস, চারুদি হেসে উঠেছিলেন, ছেলে ওখানেই কাত। বি-এসসি পাস ডাক্তার শুনে আরো খুশি—শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে কেমিস্টের কাজেও সাহায্য করতে পারবে ওকে। সটান গাড়িতে তুলে একেবারে মামার কাছে এনে হাজির!
চারুদি আরো মজার কথা বলেছেন, তার পর ক’টা মাস সে কি আনন্দ আর উৎসাহ ছেলের! ওকে পেয়ে লাভটা শেষ পর্যন্ত ওদের হল। বিভূতি সরকার বোনের হিল্লে করে দিয়েই চুপ হয়ে গেছল নাকি? অমন পাত্রই নয়, নিজের স্বার্থের কাছে বোনটোন কিছু নয়— অতটা খোলাখুলি না হলেও মাঝে-মধ্যে খোঁচা দিতে ছাড়ত না কাগজে—তাই নিয়ে এক-একদিন অমিতের সামনেই বোনের সঙ্গে ভাইয়ের ঝগড়া।
এদিকে মাসির কাছে অর্থাৎ চারুদির কাছে লাবণ্য সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ অমিতাভ ঘোষ। সঙ্গে করে নিয়েও এসেছে অনেক দিন। আই এসসি পাস করেই লাবণ্যর নাকি ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে ছিল, পয়সার অভাবে পারেনি—সকাল-বিকেল মেয়ে পড়িয়ে তো পড়া চালাতো। বি-এসসি পাস করার পর অবস্থাপন্ন ভগ্নীপতি ডাক্তারি পড়বার খরচ চালাতে রাজী হন। ভগ্নীপতির মস্ত মুদির দোকান, মোটা রোজগার মাসে। তাঁর এত উদারতার পিছনে আসল লক্ষ্যটিও অমিতাভ ঘোষ বার করে নিতে পেরেছিল লাবণ্যর কাছ থেকে। ভগ্নীপতিটি বিপত্নীক, পাঁচ-ছটি ছেলেপুলে। ভগ্নীপতির আশা বুঝেও লাবণ্য তাঁর সাহায্য গ্রহণ না করে পারেনি। ঋণ পরিশোধের জন্যে তাঁকে যদি বিয়ে করতে হয় তাও করবে, তবু নিজের পায়ে দাঁড়াবে সে—ডাক্তার হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে।
চারুদি ঠাট্টা করেছিলেন, খুব প্রতিষ্ঠা হোক, কিন্তু মেয়েটার এত সব ঘরোয়া খবরে তোর এত মাথা ব্যথা কেন?
তাতেও রাগ, মেয়েরা নাকি মেয়েদের ভালো শুনতে পারে না, একটা মেয়ের অমন মনের জোর দেখে ছেলে তখন মুগ্ধ। সব মেয়ে এমন হলে এই দেশটাই নাকি অন্যরকম হত। চারুদির হাসি।
গল্পের মাঝে এইখানে ধীরাপদ ছন্দপতন ঘটিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, উনি ভগ্নীপতিকেই বিয়ে করবেন তাহলে?
চারুদির হাসিভরা দুই চোখ ওর মুখের ওপর আটকে ছিল খানিকক্ষণ। তারপর মন্তব্য করেছেন, তুমি একটি নিরেট।
চারুদির মতে অমিতাভ’ ঠিকই বলেছিল— প্রতিষ্ঠা লাভের ব্যাপারে লাবণ্য সরকারের আর কোনো কিছুর সঙ্গেই আপস নেই। সেই লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে কাকে ধরতে হবে, কাকে ছাড়তে হবে, কোন্ পথে চলতে হবে, কি ভাবে চলতে হবে, সেটা ভালো করে বুঝে নিতে তার নাকি ছ’ মাসও লাগেনি। প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি ধরে এখনো তাই চড়চড়িয়ে উঠেই চলেছে।
ফাঁকা রাস্তায় ঘুম-চোখে ড্রাইভার খুশিমত স্পীড চড়িয়েছে। ধীরাপদর খেয়াল নেই। ভাবছে। চারুদির অমন নিটোল হাসি-কৌতুক-উদ্দীপনার ফাঁকে ফাঁকে ও তখন কোন্ ফাটল খুঁজছিল? প্রতিষ্ঠার সিঁড়ির খোঁজে কাকে ছেড়ে কাকে ধরতে হবে লাবণ্য সরকার ছ’ মাস যেতে না যেতে বুঝে নিয়েছে— সেটাই খবর? না খবর আর কিছু? তার ছাড়াটা খবর, না অন্য কাউকে ধরাটা? এভাবে ঠেলেঠুলে চারুদি ওকে এর মধ্যে ঢোকাতে চান কেন? ব্যবসায়ের নাড়ি-নক্ষত্রের খবরই বা রাখেন কেন? ধীরাপদ ভাবছে। কথা উঠলেই চারুদি নিজের বয়সের কথা বলেন কেন? বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, নিশ্চিত্ত দিন-যাপনের টাকাও বোধ হয় আছে—তবু ঘণ্টায় ঘণ্টায় চোখে-মুখে জল দিতে হয় কেন চারুদির?
চারুদি ওকে পাহারায় বসাবেন? নড়েচড়ে ধীরাপদ সোজা হয়ে বসল। লাবণ্য সরকার সিঁড়ি ধরে উঠছে, না কারো সিঁড়ি দখল করেছে?
স্বভাব অনুযায়ী এবারে এই প্রগলভ বিশ্লেষণে গা ভাসানোর কথা ধীরাপদর। কিন্তু কোনো কৌতুক প্রহসন দেখে আসার পর শিথিল অবকাশে অলক্ষ্যের গভীরতর আবেদনটুকু যেমন ভিতর থেকে ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ায়, তেমনি সকলকে ঠেলেঠুলে ওর মনের মুখোমুখি যে এসে দাঁড়াল সে অমিতাভ ঘোষ। পরিহাসতরল অনর্গল কথাবার্তার মধ্যে নিজের অগোচরে চারুদি এই একজনকে কেমন করে ভারী কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
-আমার কোনো কথা শোনে নাকি। আমাকে মানুষ বলেই গণ্য করে না ছেলে, যা মুখে আসে তাই বলে। অমিতাভ -প্রসঙ্গে নিরুপায় অভিযোগ চারুদির। কিন্তু চারুদির মুখে খেদ দেখেনি ধীরাপদ, তৃপ্তি দেখেছে। মা যেমন দুরস্ত অবুঝ ছেলে নিয়ে নাচার, তেমনি নিভৃত প্রশ্রয়ের তুষ্টি। ধীরাপদ র ভালো লেগেছিল, মিষ্টি লেগেছিল।
-ভয়ানক রাগ সকলের উপর? এরি মধ্যে কি করে বুঝলে তুমি? চারুদির আলাপের বিস্তারও আর লঘু শোনায়নি। -ওই রকমই মেজাজ হয়েছে আজকাল। রাগ সব থেকে ওর মামার উপরেই বেশি, অথচ দু বছর বয়েস থেকেই তাঁর কাছে মানুষ, কি ভালই না বাসত মামাকে—এখনো বাসে, অথচ ধারণা, মামা ভিতরে ভিতরে ওকে আর চায় না।
সত্যি নাকি? ধারাপদ সাগ্রহে বিবৃতিটুকু জিইয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল।
একেবারেই সত্যি নয় শুনেছে। এম-এসসি অমন ভালো পাস করতে হিমাংশু মিত্রই আগ্রহ করে তাকে বিলেত থেকে ট্রেনিং দিয়ে এনেছেন, ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাক্টরীতে অত বড় কাজে বসিয়ে দিয়েছেন, আর গোটা ব্যবসায়ের দু’আনার অংশও তার নামে লেখা-পড়া করে দিয়েছেন।
শেষের খবরটা অবাক হবার মতই। এতখানি ভাগনে বাৎসল্য দুর্লভ। তাহলে এমন হয় কেমন করে? খুব অল্পবয়সে মা-বাপ হারানো স্নেহ-বঞ্চিত ছেলেমেয়ের অনেক রকমের জটিল অনুভূতি-বিপর্যয় দেখা দেয় নাকি। চিকিৎসকরা যাকে বলেন ইমোশনাল ক্রাইসিস। চারুদির কথা থেকে সেই গোছেরই কিছু মনে হল।
মামাতো ভাইটি চার-পাঁচ বছরের ছোট, সে আসার পর থেকে নিজের সঙ্গে তার অনেক তফাত দেখেছে ছেলেটা। যে তফাত দেখলে এক শিশুর প্রতি আর এক শিশুর মনে শুধু বিদ্বেষই পুষ্ট হতে থাকে সেই তফাত। তফাতটা দেখিয়েছেন অমিতের মামী, সিতাংশুর মা। বাইরে থেকে সেই তফাতেই সে অভ্যস্ত হয়েছিল, বড় হয়েছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার প্রতিক্রিয়া ছিলই। চারুদির সেই রকমই বিশ্বাস। নইলে একজন আর একজনকে এখনো বরদাস্ত করতে পারে না কেন? সেই দশ-এগারো বছর বয়সে ছেলেটা প্রথম আসে চারুদির কাছে, তার পর থেকে একবার আসতে পেলে আর সহজে যেতে চাইত না–টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হত।
হিমাংশু মিত্র নিজের ছেলেকে কোনো দিন নিয়ে এসেছেন কিনা চারুদি উল্লেখও করেননি। চারুদির কথা শুনতে শুনতে মনে মনে ধীরাপদ ছোট একটা হিসেবে মগ্ন হয়েছিল। অমিতাভ ঘোষের বয়স এখন বড় জোর তেত্রিশ আর চারুদির চুয়াল্লিশ। এগারো বছরের ছোট। ছেলেটার দশ-এগারোর সময় চারুদির একুশ-বাইশ। অমিত ঘোষের মাসি-প্রাপ্তিটা তাহলে চারুদির শ্বশুরবাড়িতে, তাঁর স্বামী বেঁচে থাকতে।
অমিত ঘোষ মা না পাক, জ্ঞানাবধি মামাকে পেয়ে বাবা পেয়েছিল। সেই পাওয়ায় অনেককাল পর্যন্ত কোনো সংশয় ছিল না। যখন এম-এসসি পড়ে তখনো না। কিন্তু সেই সংশয় দেখা দিতেই নাকি যত সংকট। অবশ্য চারুদির মত, সবই ছেলের মনগড়া। সেই সময় মামী চোখ বুজেছেন। হিমাংশু মিত্র তখন প্রকাশ্যেই মা-হারা ছেলের দিকে বেশি ঝুঁকেছিলেন। অস্বাভাবিক নয়, ছেলে তখন স্কুলের গণ্ডী পেরোয়নি। মামাতো ভাইয়ের প্রতি এম-এসসি পড়া ভাগ্নের প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষের আভাস পেয়ে অনেক সময় ভাগ্নেকে রুক্ষ শাসনও করেছেন তিনি।
—সেই থেকেই ছেলে একেবারে অন্যরকম …আর কি যে এক অসুখ বাধিয়ে বসল তারপর, ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়।
চারুদি সত্যি শিউরে উঠেছিলেন। -সেই ধকলই আজ পর্যন্ত গেল না ওর। ওই অসুখেই মাথাটা গেছে।
নিজের অগোচর সেই রোগ-সংকটের দৃশ্যটা ধীরাপদ কল্পনা করছিল। মনের উপাদান দিয়ে ভাবতে গেলে মর্মান্তিকই বটে। রোগ-যন্ত্রণার থেকেও মানসিক যাতনার ছটফটানি বেশি ছেলেটার। অসুখে হাসপাতালে এনে ফেলা হয়েছে সেটাই এক মর্মচ্ছেদী বিস্ময়। হাসপাতাল নয়, অনেক ব্যয়সাপেক্ষ নামকরা নার্সিংহোম। আরামের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা, বড় বড় ডাক্তারের আনাগোনা। কিন্তু বিশ-বাইশ বছরের ছেলেটার চোখে সেটাও হাসপাতাল। আগে কখনো কোনো হাসপাতালের অভ্যন্তরে পা দেয়নি। যে ব্যবস্থা রোগী মাত্রেরই প্রায় ঈর্ষার বস্তু, ওর চোখে তাই তখন নির্বান্ধব, নিরাশ্রয় রোগশয্যা মাত্র। মামা পাঠিয়েছে তাকে এখানে। মামা পাঠালো। যতক্ষণ জ্ঞান ততক্ষণ আচ্ছন্ন প্রতীক্ষা। মামা আসে না কেন
? মামা কই?
তখন আবার হিমাংশু মিত্রের বিদেশ যাত্রার দিন আসন্ন। অনেক আগে থেকেই সকল ব্যবস্থা সারা। শেষ সময়ে যাওয়া বন্ধ করলে সব দিকের সব আয়োজন পশু। চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে তার দরকারও বোধ করেন নি-ভাগ্নেকে এত বড় নার্সিংহোমে রেখেই অনেকটা নিশ্চিন্ত তিনি।
কিন্তু ছেলেটার মনের দিকটা চারুদি উপলব্ধি করেছিলেন। নিষ্প্রভ চোখের চকিত দৃষ্টি কার জন্য প্রতীক্ষার বুঝেছিলেন। আশ্বাস দিয়েছেন, আসবেন’খন… কাল বাদে পরশু বেরুবেন, ব্যস্ত তো খুব, ফাঁক পেলেই আসবেন।
আশ্বাস দিয়ে চারুদি নিজেই শঙ্কিত। মামা বেরোচ্ছেন কোথাও তা যে মনেও ছিল না, দুই চোখের বেদনা-ভা বিস্ময়ে সেটুকু স্পষ্ট। অবুঝকে বোঝানোর চেষ্টা আবারও। -কতদিন আগে থাকতেই তো বেরুনোর সব ঠিক, তুই ভুলে গেলি? এখন কি না গেলে চলে? তাছাড়া তোর কি এমন হয়েছে, আমি তো আছি—
কিন্তু হঠাৎ সেই উদভ্রান্ত উত্তেজনা দেখে চারুদির ত্রাস একেবারে। -সত্তুর হলে মামা যেতে পারত? তাকে হাসপাতালে দেওয়া হত?
হিমাংশু মিত্র পরদিন ভাগ্নেকে দেখতে এসেছিলেন, আবার যাবার দিনও। কিন্তু তিনি একাই দেখেছেন, ও ফিরেও তাকায়নি। সকলেরই ধারণা, রোগে বেহুঁশ। কিন্তু তিনি ঘর থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে রোগী রক্তবর্ণ দু চোখ মেলে চারুদির দিকে তাকিয়েছে। বিশ্বাস আর কাউকেও করা চলে কিনা তাই দেখেছে চেয়ে চেয়ে। তার পর ছোট্ট শিশুর মত দুই হাতে চারুদিকে আঁকড়ে ধরেছে। তারপর সত্যিই বেহুঁশ।
যমে-মানুষে টানাটানি গোটা একটা মাস। পালা করে হয় চারুদি নয় পার্বতী বসে সমস্ত দিন আর সমস্ত রাত। চোখ মেলে দুজনের একজনকে না দেখলে বিষম বিপদ। … জ্বর আর জ্বর, খই-ফোটা জ্বর–তাই থেকে মেনিনজাইটিস না কি বলেছে ডাক্তাররা। তারা হিমসিম, চারুদি দুর্ভাবনায় অস্থির, পার্বতী পাথর। শেষে জ্বর নামল, মাথার সেই মারাত্মক ব্যামোও ছাড়ল, অথচ ছেলেটা আর সেই ছেলেই নয় যেন। সব সময় অসহিষ্ণু সন্দেহ একটা। অবাঞ্ছিত কিনা কুরে কুরে শুধু সেই ভাবনা আর সেই সন্দেহ। ভালো হবার পর তিন মাস চারুদির কাছেই ছিল—ফিরে এসে হিমাংশু মিত্র চেষ্টা করেও ওকে নিতে পারেননি। দিনরাতের বেশির ভাগ তখনো হয় চারুদিকে নয়তো পার্বতীকে কাছে বসে থাকতে হত। এক ডাকে সামনে এসে না দাঁড়ালে তার জের সামলাতে তিন ঘণ্টা। চারুদি জানেন, ভিতরে ভিতরে ছেলেটা সেই রোগই পুষছে এখনো—মামার প্রতি অভিমান। যুক্তি দিয়ে বোঝালেও ভিতরে ভিতরে প্রতিকূল আবেগ একটা। কখন কোন কারণে যে ওতে নাড়া পড়ে বোঝা ভার। ওই থেকেই যত গণ্ডগোল, ওই থেকে অমন মেজাজ।
অমিতাভ ঘোষের জন্য চারুদির স্নেহার্দ্র দুশ্চিন্তাটুকু ধীরাপদ উপলব্ধি করেছে। ওকে বলেছেন, ভালো করে আলাপসালাপ করতে, ভালো করে মিশতে। অন্তরঙ্গ হবার রাস্তাও বাতলে দিয়েছেন। – একবার যদি ওর ধারণা হয় তুমি ভালবাসো ওকে, তুমি আপনজন—দেখবে তোমার জন্যে ও না করতে পারে এমন কাজ নেই। ব্যবহারে টের পাবে না, বরং উল্টো দেখবে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও তোমার কেনা হয়ে থাকবে।
ধীরাপদর মনে হল চারুদি সেই কেনাই কিনেছেন। আপনজন হয়ে উঠতে খুব বেগ পেতে হবে না, সেটা লোকটির আজ বিকেলের আচরণ থেকে আশা করা যেতে পারে। সেটুকু চারুদির কল্যাণেই। যেটুকু হবার তাও চারুদির কল্যাণেই হবে। নৈশ নিরিবিলিতে আর একটা দৃশ্যও মনে পড়ছে ধারাপদর। চারুদির ড্রইংরুমে সেদিন পার্বতীর, উদ্দেশে অমিত ঘোষের সেই পাঁচদফা হাঁকডাক, শেষে চোখের নাগালে রমণীটি-র অবস্থানে রমণীয় নিবৃত্তি।
চারুদির কাহিনী-বিস্তার থেকে অমিত ঘোষের জীবনে পার্বতীর আবির্ভাবের একটুখানি হদিশ মিলেছে।
অমিতাভ ঘোষকে চারুদি একাই কিনেছেন?
গাড়িতে ঝাঁকানি লাগতে ধীরাপদ ঝুঁকে বাইরের দিকে তাকালো। আর একটু এগোলেই সুলতান কুঠির এবড়োখেবড়ো এলাকায় ঢুকে পড়বে। তাড়াতাড়ি গাড়ি থামিয়ে সেখানেই নেমে পড়ল। আগের বারের অন্যমনস্কতায় গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ার ফলটা সেদিন রমণী পণ্ডিতের চোখেমুখে উছলে উঠতে দেখেছে।
সুলতান কুঠিতে অনেকক্ষণ ঘুম নেমেছে। পায়ে পায়ে শুকনো পাতার সামান্য শব্দও মড়মড় করে ওঠে। বাতাসে এরই মধ্যে ঝিঁঝির ডাক। আলো বলতে দুই-একটা জোনাকির দপদপানি। পা-দুটো অভ্যস্ত বলেই হোঁচট খেতে হয় না। ধীরাপদ নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। বারান্দাটা অন্ধকার। কতদিন ভেবেছে ছোট টর্চ কিনবে একটা। কেনা হয়নি। পকেটে একটা দিয়াশলাই রাখলেও হয়। দিনের বেলায় তাও মনে থাকে না। চাবির খোঁজে পকেটে হাত ঢুকিয়ে লক্ষ্য করল, দূরে রমণী পণ্ডিতের কোণা ঘর দুটোর একটা ঘরে আলো জ্বলছে তখনো। কারো ভবিষ্যতের ছক তৈরি করছেন, নয়তো বিয়ের কোষ্ঠী মেলাচ্ছেন। কিন্তু রাত জেগে ঘরে আলো জ্বেলে কাজ করতে হয়, পণ্ডিতের এত কাজের চাপ কবে থেকে হল?
শুধু হাতটাই পকেটে বিচরণ করছে ধীরাপদর, চাবি উঠছে না। এ পকেটে না, এ পকেটেও নেই। বুক পকেটেও নেই। আচ্ছা ফ্যাসাদ চাবি? বন্ধ দরজার আংটায় তালা তো দিব্যি ঝুলছে। দরজাটা ঠেলে দেখল একবার। না, তালাও বন্ধ। চাবিটা আবার কোথায় ফেলল তাহলে?
অসহায় মূর্তিতে ধীরাপদ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। তালাটা ভাঙবে? ভাঙবেই বা কি দিয়ে? এই রাতে আর এই অন্ধকারে তালা ভাঙতে গেলে লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌড়ে আসবে সব। এ-তল্লাটে চোরের উপদ্রবে ঘুমের মধ্যেও গৃহস্থ সচেতন। আবার তালা না ভাঙলে ঘরে ঢুকবেই বা কি করে? সারারাত ঠায় দাঁড়িয়ে কাটাতে হয় তাহলে, নয়তো কদমতলার বেঞ্চি ভরসা। শীতের রাতে সে ভরসাও মারাত্মক।
সচকিত হয়ে ধীরাপদ ফিরে তাকালো।
পাশের ঘরের দরজা খোলার শব্দ। কুপি হাতে সোনাবউদি। সামনে এসে চাবিটা এগিয়ে দিল। ও চাবি যেন তার কাছেই থাকে।
অবাক হলেও ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। -এটা আপনি পেলেন কি করে?
তালার সঙ্গে লাগানো ছিল।
ধীরাপদ অপ্রস্তুত। এতটাই অন্যমনস্ক ছিল নাকি? এ-রকম সংক্ষিপ্ত জবাব বা নীরবতা থেকে সোনাবউদির মেজাজ কিছুটা আঁচ করা যায়। ঘরের তালা খুলে ফিরে তাকালো। সোনাবউদির চোখেমুখে ঘুমের চিহ্ন নেই। জেগেই ছিল বোঝা যায়। হাসতে চেষ্টা করলেও ধীরাপদর মুখে অপরাধীর ভাব একটু। -বাঁচা গেল, এমন মুশকিলেই পড়েছিলাম …
সোনাবউদি চুপচাপ চেয়ে আছে। আপনি ঘুমোননি এখনো?
ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালবেন, না এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব?
ধীরাপদ শশব্যস্তে ঘরে ঢুকে গেল। কোণ থেকে হারিকেনটা মাঝখানে নিয়ে এলো। বালিশের নিচ থেকে দিয়াশলাই। সোনাবউদি দরজার বাইরে থেকেই কুপিটা একটু এদিকে বাড়িয়ে ধরেছে। ধীরাপদ বলতে পারত আলোর আর দরকার নেই, কিন্তু বলতে ইচ্ছে করল না। ভরসাও পেল না বোধ হয়। চাবি-ভুলের এই বিড়ম্বনাটাও খারাপ লাগছে না খুব। এমন কি হারিকেনটাও ইচ্ছে করলে হয়ত আর একটু তাড়াতাড়ি
ধরাতে পারত।
অগ্নি-সংযোগ করে চিমনিটা ঠিক করে বসাতে বসাতে কিছু একটা বলার জন্যেই জিজ্ঞাসা করল, গণুদার নাইট-ডিউটি বুঝি? জবাব না পেয়ে ফিরে তাকালো তার দিকে।
হলে সুবিধে হয়? নিরুত্তাপ পাল্টা প্রশ্ন সোনাবউদির।
নিজেরই হাতের ঠেলা লেগে হারিকেনটা নড়ে উঠল। ফলে সোনাবউদির মুখভাব বদলালো একটু। মনের মত টিপ্পনী কেটে বা খোঁচা দিয়ে কাউকে জব্দ করতে পারলে এর থেকে অনেক রূঢ় নিস্পৃহতাও তরল হতে দেখা গেছে।
ঘাড় ফিরিয়ে পিঠের কাছের দরজার আড়ালটা একবার দেখে নিয়ে সোনাবউদি হাতের কুপি নিবিয়ে দিল। তারপর ঈষৎ বিদ্রূপের সুরে নিজে থেকেই বলল, মনের অবস্থা তো চাবির ভুল দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চোখেরও হয়ে এসেছে নাকি, গণৎকারের ঘরের আলো দেখেননি?
ধীরাপদ অবাক, গণুদা ওঁর ওখানে নাকি?
খোলা দরজার গায়ে সোনাবউদি ঠেস দিয়ে দাঁড়াল, ভয় করছে?
আমার আর ভয়টা কি, কিন্তু এত রাতে গণুদার ওখানে কী?
সবই। নিস্পৃহ জবাব। -মাইনে বাড়লে কি হবে, প্রুফ রীডার প্রুফ রীডারই— এবারে সাব-এডিটার হবেন। বরাতের যেমন জোর শুনছি, কালে এডিটার হয়ে বসাও বিচিত্র নয়। ওখানে বরাতের জট ছাড়ানো হচ্ছে, বরাতে থাকলে কি না হয়?
যাবার জন্য দরজা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সোনাবউদি। নিরীক্ষণ করে দেখল একটু। -আপনারও তো দেখি একই ব্যাপার, সাত মন তেল পুড়ছে, রাধা নাচবে না তো শেষ পর্যন্ত। দাদার গলা ধরে ওই গণৎকারের কাছেই না হয় যান একবার-
সোনাবউদি চলে যাবার পরেও ধীরাপদ অনেকক্ষণ বসে কাটালো। শেষের এই ঠেসটুকু প্রাপ্য বটে। কিন্তু রাধা যে তার বেলায় সত্যি সত্যি নাচতে চলেছে সেটা আর বলা হল না। বললে বেশ হত। সমস্ত দিনটাই ভালো কাটল আজ, সেই গোছের তৃপ্তি একটু। চারুদি ঠাট্টা করেছিলেন, এত রাতে কে আর ওর জন্যে খাবার সাজিয়ে বসে আছে? অন্তত কম লাগছে না ধীরাপদর।
কি এক বিপরীত ইশারায় ভাবনার লাগাম টেনে ধরতে চাইল। একটা চকিত অস্বস্তি মনের তলায় ঠেলে দিয়ে ধীরাপদ উঠে দরজা বন্ধ করে আলো নিবিয়ে বিছানায় এসে বসল। অনভিলষিত ইঙ্গিতটা অর্গলবদ্ধ হল না তবু, অন্ধকারে ডুবল না।
—চারুদি বলেছিলেন একটুখানি স্নেহ দিয়ে অমিতাভ ঘোষকে কিনে রাখা যায়। অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে কোথায় যেন ওর বড় রকমের মিল একটা। প্রার্থীর পক্ষে এটুকু জানা নিজের দেউলে মূর্তিটা নিজে চেয়ে চেয়ে দেখার মতই।