পাঁচ
উদ্যমেন হি সিধ্যন্তি কার্যাণি ন মনোরথৈঃ।
ন হি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশন্তি মুখে মৃগাঃ।।
রমণী পণ্ডিতের উক্তি। সিংহও ঘুমিয়ে থাকলে তার মুখে হরিণ গিয়ে ঢোকে না। নিশ্চেষ্ট ভাবনায় কোন সমস্যারই বা সুরাহা হয়? চেষ্টা থাকা চাই। চেষ্টাই আসল। উদ্যমই আসল।
ধীরাপদর ব্যস্ততা দেখে অন্তরঙ্গ শুভানুধ্যায়ীর মত রমণী পণ্ডিত বলেছিলেন কথাগুলো। মজা-পুকুরের ধার দিয়ে ধীরাপদ একটু পা চালিয়েই শর্ট-কাট করছিল। তাড়া ছিল। গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগে হোটেলে খেয়ে নিতে হবে। এখানে এ- মূর্তির অবস্থান জানলে সোজা পথ ধরত। প্রাজ্ঞবচন শিরোধার্য করেই পাশ কাটিয়েছে। কিন্তু মনে মনে অবাক একটু, চেষ্টার কি দেখলেন এঁরা? বিগত ক’টা দিন ধরে ওকে ঘিরে সুলতান কুঠিতে একটা রহস্যের বুননি চলছে, আজ এই একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ধীরাপদ তার আভাস পেল। চিঠি আসা, চারুদির গাড়ি আসা, চারুদির আসা—এতগুলো আসার ধাক্কায় আলোড়ন একটু হবারই কথা। কিন্তু তা বলে সিংহ জাগতে চলেছে ভদ্রলোকের এ-রকম অনুমান কেন?
চেষ্টার প্রথম ফল, হোটেল থেকে অভুক্ত ফিরতে হল। অফিস-টাইমের ভিড়ের সঙ্গে এতকাল পরিচয় ছিল না। নিয়মিত বেলা-শেষের আগন্তুক সে। এ দৃশ্য দেখে চক্ষুস্থির। তাড়া না থাকলে বসে দেখার মত। ভোজন-পর্বে এমন তাড়া আর দেখেনি। টেবিলে থালা ফেলার ঠাঁই নেই। প্রত্যেকের পিছনে পিছনে পরের ব্যাচে যাঁরা বসবেন তাঁরা অসহিষ্ণু প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে।
প্রত্যাবর্তন। ভাতের আশায় থাকলে কম করে আরো এক ঘণ্টা।
চেষ্টার দ্বিতীয় ফল, নির্দিষ্ট বাড়ির নির্দিষ্ট হলঘরে এসে দেখে জনমানবশূন্য। আব্ছা অন্ধকার, জানালাগুলো পর্যন্ত তখনো খোলা হয়নি। হাফ- দরজার ওধারে উঁকি দিয়ে দেখে সেখানেও কেউ নেই। সিঁড়ির ওপাশে নিচের তলার মতই একসারি ঘর। ধীরাপদর অনুমান এ বাড়ির ওটাই অন্দরমহল। কাজেই সেদিকে বেশি উঁকিঝুঁকি দেওয়া সমীচীন বোধ করল না। হলঘরেই ফিরে এলো আবার। নিজেই দুটো জানালা খুলে দিয়ে আর একটা আলো জ্বেলে বসল। একটা থমকানো শূন্যতা কিছুটা হালকা হল যেন।
ধীরাপদ বসে আছে। বসেই আছে।
ভূতুড়ে নেমন্তন্নের রসিকতার মত লাগছে। সেজেগুজে এসে দেখে হানাবাড়ি। এর মধ্যে নিচের তলায় ঘুরে এসেছে একবার, সাহসে ভর করে অন্দরমহলের কড়া নেড়েছে বারকতক, তার পর আবার এসে বসেছে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। যাঁর প্রবেশ তিনিও অপরিচিত। ছেঁড়া জুতো, মলিন ধুতি, কালচে কোট চড়ানো একজন প্রৌঢ়। ধীরাপদর প্রতীক্ষার কারণ শুনে একটু বিস্মিত- আজ থেকে কাজে লাগার কথা আপনার? তা এখানে কী? এখানে দেখা করতে বলেছেন?
কোথায় দেখা করতে হবে নির্দেশ না থাকায় ধীরাপদর ধারণা এখানেই। মাথা নাড়ল বটে কিন্তু প্রশ্ন শুনে নিজেরই খটকা লাগছে একটু।
বসুন তাহলে। হাফ- দরজার কাছাকাছি হল-এর এক কোণে টাইপরাইটারের দিকে এগোলেন। চেয়ারের কাঁধে কোট ঝুলিয়ে টাইপরাইটারের ঢাকনা খুলে বসলেন তিনি।
বসে বসে ধীরাপদর ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। বড় দেয়াল-ঘড়ির কাঁটা আরো দু’পাক ঘুরেছে। টাইপের অতি-মন্থর খটখটও এবার বোধ হয় থেমেই গেল। দু ঘণ্টায় পুরো এক পাতাও টাইপ করা হয়েছে কিনা সন্দেহ। চেয়ার ছেড়ে ভদ্রলোক কাছে এলেন, পরে তাকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কই কেউ এলেন না তো?
ধীরাপদর মনে হল তার নির্জীব প্রতীক্ষা দেখে পান খাওয়া ঠোটের কোণে উল্টো হাসির আভাসের মত দেখা গেল। অর্থাৎ কেউ এলে সেটাই বিস্ময়ের কারণ হত।
কোটটা আবার গায়ে উঠেছে আর টাইপরাইটারের ওপরেও ঢাকনা পড়েছে। ভদ্রলোকের কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে বোঝা গেল।
হলঘরে একা আবার। এতক্ষণ ভাবছিল, দুপুরের খাবার সময় হলে সাহেবদের আবির্ভাব ঘটবে। এখন সে সম্ভাবনাও দেখছে না। ধীরাপদ উঠে পড়বে কিনা ঠিক করার আগেই আর এক মূর্তির আবির্ভাব। কালকের সেই পরিচারক গোছের লোকটি, ঘুমের তাড়ায় যে তাকে ওপরে ঠেলে পাঠিয়েছিল। এসেই কৈফিয়তের সুরে বলল, টাইপবাবু বলে গেলেন আপনি সেই সকাল থেকে বসে আছেন, কলিং বেল টেপেননি, আমি কি করে জানব বলুন—
যেন তার জন্যেই ধীরাপদ এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে আর সে সেটা জানে না বলে অনুতপ্ত। কথাবার্তায় আজ আর লোকটাকে তেমন বাকবিমুখ মনে হল না ধারাপদর, মাঝে-মধ্যে একটা-আধটা প্রশ্ন করে অসংলগ্ন অনেক তথ্য আহরণ করা গেল। যেমন, ‘সকালোয়’ বাড়িতে তো কাউকে দেখা করতে বলা হয় না, বাবুকে বড় সাহেব ফ্যাক্টরীতেই যেতে বলেছেন বোধ হয়-না, সাহেবদের বাড়িতে খাবার পাট নেই, দু’বেলাই সকলে বাইরে খান-মাঝে-সাজে ডাল- চচ্চড়ি-সুক্তোর ঝোল খেতে ইচ্ছে জাগলে ভাগ্নেবাবু আগে থাকতে ওকে খবর দেন, ও-ই তখন সব ব্যবস্থা করে রাখে, কিন্তু ভাগ্নেবাবুর কাছে সব কিছু করবার বাহাদুরি নিতে চেষ্টা করে কেয়ার টেক বাবু—দু টাকা বাজার করে দশ টাকা লিখে রাখে, বড় সাহেবের তো আর কেয়ার-টেক বাবুর লেখা উল্টে দেখার সময় নেই, মাসকাবারে টাকা ফেলে দিয়েই খালাস! কিন্তু, এই মানকে মুখ্য হলেও বোঝে সব, বুঝেও মুখ বুজে থাকে, জলে নিবাস করে তো আর কুমীরের সঙ্গে ঝগড়া করা চলে না।
খেই হারিয়ে মানকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের মুখটাই আলগা হয়ে গেল। কে ভাগ্নেবাবু বা কে কেয়ার-টেক বাবু ধারাপদর বোধগম্য হল না।
সাহেবেরা ফেরেন কখন? এক্কেবারে সেই রাত্তিরে। কেউ এখন কেউ ত্যাখন। শুধু ভাগ্নেবাবু মাঝে-সাজে ইদিক-সিদিক চলে যান। সাহেবরা দুজন রোজই ফেরেন, কখন দোরের কড়া নড়ে উঠবে বা গাড়ির শব্দ শোনা যাবে সেই পিত্যেশে কান খাড়া করে এই মানকেকেই ঠায় জেগে বসে থাকতে হয়—কেয়ার-টেক বাবুর তখন ‘কুম্ভকন্বের’ নিদ্রা, আর ‘সকালোয়’ উঠেই সাহেবদের কাছে এমন ‘মুর্তি’ দেখাবেন যেন মাঝরাত অবধি তিনিই জেগে বসে ছিলেন।
ফ্যাক্টরীতে গেলে কার সঙ্গে দেখা হতে পারে? সকলের সঙ্গেই—বড় সাহেব ছোট সাহেব ভাগ্নেবাবু মেম-ডাক্তার— মেম-ডাক্তারকে অবিশ্যি ‘বিকেলোয়’ ওষুধের দোকানেও পাওয়া যাবে, তেনার সঙ্গে দেখা হলে তিনিও সব ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন – ব্যবস্থাপত্রের ভার তো সব মেম-ডাক্তারেরই হাতে। সঙ্গে সঙ্গে কি মনে হতে রোগাটে মুখের কোটরগত চোখ দুটো চকচক করে উঠেছে একটু। গলার স্বর নামিয়ে বলেছে, টাইপবাবু বললেন আপনার চাকুরি হয়েছে এখানে, আপনি তো এখন ঘরের লোক, বলতে দোষ কি সুযোগ-সুবিধে হলে মেম-ডাক্তারকে একটু বলে-কয়ে দেবেন কারখানায় যদি চাপরাসীর কাজটা দ্যান, বাড়ির কাজ করেই ‘কত্তে’ পারব—আমি নিজেই একবার সাহসে ‘নির্ভর’ করে মেম-ডাক্তারকে বলেছিলাম, তা তিনি ভুলেই গেছেন বোধ হয়—এতকাল কাজ কচ্ছি, এটুকু না হলে আর আশা কি বলুন? এখানে কেয়ার- টেক বাবুটি তো সব্বক্ষণ বুকে পা দিয়েই আছেন, যেন তেনারই খাস-তালুকের প্রজা আমি!
নদীর গতি সমুদ্রে, মানকের সব কথার বিরাম কেয়ার টেক বাবুতে এসে। মুরুববী ধরা দেখে ধীরাপদর হাসি চাপা শক্ত হচ্ছিল। সকল ব্যবস্থাপত্রের কর্ত্রী মেম-ডাক্তারটি কে অনুমান করা যাচ্ছে। সেই মেয়েটিই হবে। আর কেয়ার-টেক বাবু কেয়ার-টেকার বাবু হবেন। তবু এবার জিজ্ঞাসা করল, কেয়ার-টেক বাবুটি কে?
কেয়ার-টেক বাবু বুঝলেন না? ইঞ্জিরীতে বলে—নিজেই নিজের নাম দিয়েছে, আসলে ও হল বাজার সরকার, বুঝলেন? গিন্নিমায়ের বাপের দেশের লোক কিনা তাই পো বারো—গিন্নিমা চোখ বুজতে এখন তো সব্বেসব্বা ভাবেন নিজেকে, দু হাতে সব ফাঁক করে দিলে, ইদিকে আমি সোরা থেকে জল গড়াতে গেলিও সন্দোয় সন্দোয় ইঁদুর ধরা বেড়ালের চোখ করে তাকাবে—যেন বাসকো ভেঙে টাকা সরাচ্ছি! কাউকে তো বলা যাবে না কিছু, কথাটি কওয়াই দায়, এক ভাগ্নেবাবুকে বলা যায়—তিনি লোক ভালো। কিন্তু তেনাকেও আগেভাগেই হাত করে বসে আছে, বাপের পিসীর মত দরদ দেখায়। তবু তেনাকে বললে শুনবেন, ডেকে ধমক-ধামকও করবেন—কিন্তু তারপর? ভাগ্নেবাবু তো সব্বক্ষণ নিজের তালে থাকেন, নিজের তালে ঘোরেন—কেয়ার-টেক বাবু তখন আমার কলজে ছিঁড়ে কালিয়া বানিয়ে খাবে না?
ধীরাপদর হাসিও পাচ্ছে, দুঃখও হচ্ছে। যেন সে-ই ওকে ভাগ্নেবাবুর কাছে কেয়ার- টেক বাবুর বিরুদ্ধে নালিশের পরামর্শটা দিয়েছিল। ভাগ্নেবাবুটি কে ধীরাপদ এখনো জানে না। কিন্তু আঁচ করতে পারছে। সেই লোকটাই হবে—সেই অমিতাভ ঘোষ। মানকের মুখে ভাগ্নেবাবুর স্বভাব আর আচরণের আভাসে সেই রকমই মনে হয়। শুধু তাই নয়, গতকাল হিমাংশু মিত্র ছেলেকে যার সঙ্গে দেখা হলে ঘড়ি ধরে তাঁর দু ঘণ্টা অপেক্ষা করার কথা জানাতে বলে দিয়েছিলেন, ধারাপদর এখন ধারণা সে-ও ওই একই লোকের প্রসঙ্গে।
মানকের হাবভাব হঠাৎ বদলাতে দেখে ধীরাপদ ফিরে তাকালো। আধময়লা ধুতির ওপর ফটফটে সাদা গেঞ্জি গায়ে যে লোকটা সামনে এসে দাঁড়াল, তাকে দেখামাত্র ধীরাপদ বুঝল, ইনিই কেয়ার-টেক বাবু। মানকের মতই লম্বা, রোগা—ফর্সা মুখে তামাটে ছোপ। অনাবৃত বাহু দুটিতে যেন আগাগোড়া তামাটে ছিটের কাজ করা। মাথা-জোড়া তেলচকচকে টাকের ওপর গোটাকতক মাত্র কাঁচা-পাকা চুল মাথার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো। এক নজরে তাকে দেখে নিয়ে গম্ভীর প্রশ্ন করল, টাইপবাবু বলে গেলেন আপনি নাকি সাহেবের জন্য তিন ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন!
সম্ভাব্য অপরাধীকে যেভাবে জেরা করা হয়, অনেকটা সেই সুর। তার আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে ধীরাপদ জবাব দিল, তার বেশিই হবে—
মানকে।
দ্বিতীয় ব্যক্তিটির দিকে ঘুরে হাতেনাতে এবারে আসামীই গ্রেপ্তার করা হল যেন। কিন্তু ধীরাপদ লক্ষ্য করল, ওই এক ডাক শুনেই মানকের এতক্ষণেরই নিরীহ মুখে রুক্ষ ছাপ পড়ে গেছে একটা। অভিযোগ সম্বন্ধে ঠিক সচেতন নয় বলেই মুখেই ঈষৎ উদ্ধত প্রতীক্ষা এবং জবাবের প্রস্তুতি।
কেয়ার-টেক্ বাবুর ঝাঁজালো অনুশাসনে মানকের অপরাধ বোঝা গেল। ভদ্রলোক তিন ঘণ্টা ধরে বসে আছেন আর তুই কোথায় যেতে হবে কি করতে হবে বলে দিসনি, আমাকেও ডাকিসনি। উনি যদি সাহেবদের সে-কথা বলেন, আমার মুখ থাকবে কোথায়?
ধীরাপদ তাজ্জব। এদিকে মানকেরও সমান ওজনের জবাব, বাবু তিন ঘণ্টা ধরে বসে আছেন আমি কি গুনে জানব? উনি কি বেল টিপেছিলেন—জিজ্ঞেস করুন তো!
ও…কেউ এলে ঘণ্টা বাজিয়ে শাঁখ বাজিয়ে তোমাকে জানাতে হবে আর তা না হলে পালঙ্কে শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে সারাক্ষণ তুমি চুরির মতলব ভাঁজবে, কেমন? আসুক আজ সাহেবরা, দূর দূর করে না তাড়াই তো কি বললাম—
সাহেবের নামে মানকের সুর বদলালো একটু কিন্তু গলা নামলো না। ধীর পদকেই একটা জাজ্বল্যমান অত্যাচারের সাক্ষী মানলে সে।—দেখলেন? যা নয় তাই বললে, দেখলেন? আচ্ছা আমার কি দোষ বলুন তো, এত বড় বাড়ি, হাতি গললে টের পাওয়া যায় না, আপনি তো মানুষ—তাও বেল টেপেননি
ফের টকটকিয়ে কথা?
একটা থাপ্পড়ের মতই ঠাস করে কানে লাগল। মানকের মুখ বন্ধ। রাগে গজগজ করলেও আর মুখ খুলতে ভরসা পেল না। কেয়ার টেক বাবু এবারে দুই চোখে ধীরাপদকে ওজন করে নিল একটু। – আপনি কোথায় কাজে লেগেছেন, ওষুধের দোকানে না ফ্যাক্টরীতে?
ধীরাপদ ভাবছে, কাজে লাগার কথাটা টাইপবাবুকে না বলা ভালো ছিল। লোকটি চিন্তান্বিত।—আপনি না হয় ওষুধের দোকানেই চলে যান এখন, বিকেলে মিস সরকার সেখানে এলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে নেবেন।
ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল, হাসল একটু। — আজ আর কোথাও না, সাহেবরা এলে বলে দেবেন।
কেয়ার-টেক বাবু বিলক্ষণ বিস্মিত, আজ কোথাও না মানে আজ কাজে জয়েন করবেন না? কাজ পেয়ে কাজে লাগার আগ্রহ নেই আর দেখেনি বোধ হয়। একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করল, আপনি থাকেন কোথায়?
রসিকতার লোভ আর সম্বরণ করা গেল না। মানকের সঙ্গে আগে আলাপের দরুনই হোক বা তার প্রতি কেয়ার টেক বাবুর অবিচারের ফিরিস্তি শুনেই হোক, ধীরাপদর সহানুভূতি আপাতত আগের জনের প্রতি। যেভাবে দাবড়ানি দিয়ে থামালো লোকটাকে তাতেও টানটা দুর্বলের দিকেই হওয়া স্বাভাবিক। কেয়ার টেক বাবুর দিকে চেয়ে হেসেই জবাব দিল, এখন পর্যন্ত থাকার ঠিক নেই কিছু, এখানেও থেকে যেতে পারি।
সঙ্গে সঙ্গে মুখের চকিত রূপান্তর। শুধু কেয়ারটেক বাবু নয়, মানকেও ক্ষোভ ভুলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর নিজেদের মধ্যেই দৃষ্টি বিনিময়। সাদা অর্থ, এ আবার কি ঝামেলার কথা।
হাসি চেপে ধীরাপদ দরজার দিকে এগোলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রমণী পণ্ডিতের কথাটাই মনে পড়ে গেল। সিংহও ঘুমিয়ে থাকলে নিজে থেকে হরিণ গিয়ে তার মুখে ঢোকে না—চেষ্টা থাকা চাই। জবাব দিলে হত, শনির দৃষ্টি সামনে পড়লে চেষ্টাতেও কিছু হয় না, পোড়া শোলমাছও পালায়—
কিন্তু ধীরাপদর কিছু লোকসান হয়নি, এতক্ষণের প্রতীক্ষার ক্লান্তিও তেমন টের পাচ্ছে না আর। ওই লোক দুটিই অনেকটা পুষিয়ে দিয়েছে। জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের এই আল-বাঁধা ক্ষেতে কত রকম জীবনের চাষ তার কি ঠিক-ঠিকানা আছে?
বাবু! বাবু!
ধীরাপদ ট্রামের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, ব্যস্ত-সমস্ত ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াল। তাকেই ডাকা হচ্ছে। ডাকছে মানকে।
হস্তদন্ত হয়ে কাছে এসে বড়সড় একটা দম নিয়ে উদ্ভাসিত মুখে জানালো, এক্ষুনি ফিরতে হবে, ফ্যাক্টরী থেকে ছোট সাহেবের টেলিফোন এসেছে।
ইচ্ছে খুব ছিল না, তবু ফিরতেই হল। কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত যেতে হল না। গায়ে জামা চড়িয়ে আর ক্যাম্বিসের জুতোয় পা গলিয়ে কেয়ার টেক বাবু নিচে নেমে এসেছে। গম্ভীর মুখে সংবাদ দিল, ভাগ্নেবাবুর খোঁজে ফ্যাক্টরী থেকে ছোট সাহেবের টেলিফোন এসেছিল। কেয়ার-টেক বাবু ধীরাপদর কথা জানাতে সঙ্গে করে ওষুধের দোকানে পৌঁছে দিয়ে আসার হুকুম হয়েছে।
ধীরাপদ আপত্তি করল না।
মধ্য কলকাতার সাহেব-পাড়ায় মস্ত ওষুধের দোকান। রাস্তায় দশ-বিশ গজ দূরে দূরে যেমন দেখে তেমন নয়। চোখে পড়ার মতই। গোটা একটা দালানের সমস্ত নিচের তলাটা দোকানের দখলে। এমাথা-ওমাথা কাউন্টারে কম করে পনেরো-বিশজন কর্মচারী দাঁড়াতে পারে। গ্লাসকেসএ ওষুধ সাজানো। কাউন্টারের এধারে আগাগোড়া কাচ-দরজার আলমারি। চার আঙুলও ফাঁক নেই ভিতরে, ওষুধে ঠাসা। ভিতরের একদিকে ‘ডিসপেনসিং রুম’– মিকশ্চার পাউডার ইত্যাদি তৈরি হয় সেখানে। অন্যদিকে ডাক্তারের চেম্বার। চেম্বারের সামনে গোটাকতক চকচকে বেঞ্চ পাতা, কয়েকটা মোম- পালিশ চেয়ারও।
দুপুরে এত বড় দোকানটার ঝিমন্ত অবস্থা। এদিকে-ওদিকে দু-চারজন খদ্দের মাত্র। কর্মচারীও এ সময়ে পাঁচ-সাতজনের বেশি দেখল না। ডাক্তারের চেম্বার শূন্য। দুরে আর এক কোণে তকতকে অর্ধেক কাচ ঘেরা ক্যাশ-চেম্বার।
হাল ফ্যাশানের বিলিতি কায়দার দোকান। মেডিক্যাল হোম।
ধীরাপদকে সঙ্গে করে এনে প্রথমেই ম্যানেজারবাবুর খোঁজ করল কেয়ার-টেক বাবু। চারটের আগে ম্যানেজারবাবু ডিউটিতে আসেন না শুনে নিজের পছন্দমত বাইশ- চব্বিশ বছরের একটি চটপটে ছোকরাকে ডেকে তার হাতে যেন সঁপেই দিয়ে গেল ধীরাপদকে। বলে গেল, সাহেবদের নিজের লোক তাই নিজে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে —ম্যানেজার এলে যেন তাকে বলা হয়, আর ভালো করে কাজকর্ম শেখানো হয়। ছেলেটি সকৌতুকে সাহেবদের নিজের লোকের আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে মাথা নাড়ল।
কর্তব্য শেষ। কেয়ার-টেক বাবুর প্রস্থান। ধীরাপদর ধারণা, সে-ও মিত্র বাড়িতে আস্তানা নিতে পারে সেই আশঙ্কাতেই তার এই অন্তরঙ্গ সতর্কতা।
সদ্যপরিচিত ছেলেটি রসিক আর তার রসনাও মুখর। অন্তত সংযত নয় খুব। ধীরাপদকে নিয়ে কোণের বেঞ্চিতে বসল। নাম জেনে নিল, নিজের নাম বলল। রমেন – রমেন হালদার। ছ বছর ধরে এই দোকানে কাজ করছে। ধীরাপদ আগে কোন দোকানে কাজ করত, ডিসপেনসিং শিখবে না কাউন্টারে দাঁড়াবে? কোনো কিছুরই অভিজ্ঞতা নেই জেনে অবাক একটু। এত লোক থাকতে আর একজন লোক ঢোকানো দরকার হল কেন? ও, সাহেবের নিজের লোক—তাই! মনে মনে হাসছে, কেমন নিজের লোক তা এই সামান্য কাজে ঢোকা দেখেই বুঝে নিয়েছে।
চমৎকার দোকান। এ তল্লাটে বাঙালীর এত বড় দোকান আর কই!
এখন তো দোকান ফাঁকা, দেখবেন বিকেলে আর সন্ধ্যার পর। সকালেও ভিড় থাকে কিছু, বিকেলের মত অত নয়। সন্ধ্যার পর তো এক-কুড়ি লোক কাউন্টারে দাঁড়িয়েও হিমসিম খায়। আর ঠেলে রোগীও আসে তখন, সে-সময় আবার ডক্টর মিস সরকারের চেম্বার- আওয়ার তো-
পলকের কৌতুকাভাস ধীরাপদর চোখ এড়ালো না। দোকানে সবসুদ্ধ চারজন ডাক্তার বসেন। সকাল আটটা থেকে দশটা একজন, দশটা থেকে বারোটা আর একজন। তারপর বিকেলে চারটে থেকে ছ’টা একজন, শেষে ছ’টা থেকে আটটা মিস সরকার। প্রথম তিন ডাক্তারই বিলেত-ফেরত, তবু মিস সরকারেরই রোগী বা রোগিণী বেশি। মন্তব্য, হবেই তো—রাতের দিকেই সব রোগের জের বাড়ে, বুঝলেন না?
ধীরাপদ বুঝল। মাত্র বাইশ-তেইশ হবে বয়েস। পেকেছে ভালো।
মিস সরকার কোম্পানীর কেউ, না শুধু ডাক্তার?
বাস, এইটুকু থেকেই রমেন হালদার আরো ভালো করে বুঝে নিয়েছে কেমন আপন-জন সাহেবদের! নিশ্চিন্তে মুখ আলগা করা যেতে পারে আরো একটু। বলল, আপনি কি রকম আপনার লোক দাদা সাহেবদের—মিস সরকারকে চেনেন না? উনি তো দণ্ডমুণ্ডের মালিক আমাদের। কোম্পানীর মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার, দোকানের ডাক্তার আর সুপারভাইজার, নার্সিং হোমের অর্ধেক মালিক। সকলে ঠিক পছন্দ করেন না, আমার কিন্তু বেশ লাগে দাদা-
ওদিকটা একবার দেখে নিয়ে হি-হি করে হাসতে লাগল।
ছেলেটা ফাজিল হলেও ধীরাপদর মন্দ লাগছে না। হাসি-খুশি প্রাণবন্ত। নার্সিং হোম প্রসঙ্গে জানা গেল, কোম্পানীর সঙ্গে ওটার কোনো সম্পর্ক নেই। ওর মালিক মিস সরকার আর ছোট সাহেব। ইকোয়াল পার্টনারস। মস্ত মস্ত ঘরের ফ্ল্যাট, একটা মিস সরকারের বেড়-রুম, দু ঘরে চারটে বেড, আর একটা ঘরে বাদবাকি যা কিছু। মাস গেলে তিনশ পঁচাত্তর টাকা ভাড়া—মেডিক্যাল অ্যাডভাইসারের ফ্রী-কোয়ার্টার প্রাপ্য বলে ভাড়াটা কোম্পানী থেকেই দেওয়া হয়। আর সেখানে আলমারি বোঝাই যে-সব দরকারী পেটেন্ট ওষুধ-টষুধ থাকে তাও কোম্পানী থেকেই নার্সিং হোম-এর হেড-এ অমনি যায়, দাম দিতে হয় না। খুব লাভের ব্যবসা দাদা, বুঝলেন?
আবার হি-হি হাসি।
ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক চারটেয় ম্যানেজার হাজির। বেঁটে-খাটো মোটা-সোটা— মাথায় কাঁচাপাকা একরাশ ঝাঁকড়া চুল। বয়েস পঞ্চাশের কম নয়। তাঁকে দেখেই রমেন হালদার চট করে উঠে একদিকে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল কি। ধীরাপদর কথাই হবে। কথার ফাঁকে ছেলেটাকে হাসতেও দেখা গেল। সাহেবদের আপন-জন জানানোর ফুর্তি হয়ত।
ম্যানেজার ঘুরে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই দেখলেন একবার। নিস্পৃহ দৃষ্টি। বিজ্ঞাপন লেখার প্রত্যাশায় এলে অম্বিকা কবিরাজ বা নতুন-পুরনো বইয়ের দোকানের মালিক দে-বাবু যে চোখে তাকান অনেকটা সেই রকম। তাঁদের থেকেও নিরাসক্ত।
উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত জুড়ে নমস্কার জানালো। জবাবে তিনি ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা একটু নাড়লেন শুধু। ডাকলেনও না বা কিছু জিজ্ঞাসাও করলেন না। তার কাজের গুণাবলী বা কেরামতি রমেন হালদারই জানিয়ে দিয়েছে সম্ভবত। প্রথম নির্বাক দর্শনেই লোকটিকে কড়া মেজাজের মনে হল ধীরাপদর।
খানিক বাদে এক ফাঁকে রমেনই কাছে এলো আবার। -ম্যানেজারকে বললাম আপনার কথা, ওঁর মেজাজ অমনি একটু ইয়ে তো—বলছিলেন, কাজ জানে না কম্ম জানে না হুট করে আবার একজনকে ঘাড়ে চাপানো কেন? আপনি কিছু ভাববেন না, আমি আপনাকে দু দিনেই শিখিয়ে দেব, কোন্ আলমারির কোন তাকে কোন্ রকমের ওষুধ থাকে এই তো—
বিকেল থেকে দোকানের চেহারা অন্যরকম। কর্মচারীরা একে একে এসে গেল। খদ্দেরের ভিড়ও বাড়তে লাগল। পাইকিরি আর খুচরো দু-রকমের বিক্রী, ভিড় হবারই কথা। রমেন হালদার বাড়িয়ে বলেনি, সন্ধ্যের দিকে দিশেহারা অবস্থাই বটে। কর্মচারীদের যান্ত্রিক তৎপরতা সত্ত্বেও খদ্দেরের তাড়ায় তাদেরও তাড়া বাড়ছে। ওটা আনো সেটা আনো, ওটা বার করো সেটা বার করো, ওটা দেখাও সেটা দেখাও—। কে কোনটা আনছে, বার করছে, দেখাচ্ছে, ধীরাপদ হদিস পেয়ে উঠছে না। এরই মধ্যে একটু ফাঁকা হলে কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে সে, আবার ভিড় বাড়লে বাইরের দিকে সরে আসছে, বা জায়গা থাকলে বেঞ্চিতে বসছে।
ছটা নাগাদ ফুটপাথের ওধারে গাড়ি দাঁড়াল একটা। কোম্পানীর গাড়ি, স্টেশান ওয়াগন গোছের। ড্রাইভার শশব্যস্তে নেমে পিছনের দরজা খুলে দিল।
যে নামল, মনে মনে ধীরাপদ তাকেই আশা করছিল হয়ত।…ডক্টর মিস লাবণ্য সরকার।
গোটা নামটা কেউ বলেনি তাকে। ডাক্তারের চেম্বারের গায়ে অ্যাটেন্ডিং ফিজিসিয়ানদের নামের বোর্ড থেকে দেখেছে। চারটে থেকে ছটার ডাক্তার একটু আগে বিদায় নিয়ে গেছেন।
আগের দিনের মতই শিথিল চরণে দোকানে ঢুকল। পিছনে সেই মস্ত ব্যাগ হাতে ড্রাইভার। প্রতীক্ষারত রোগীদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে খদ্দেরদের পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। ওদিক দিয়ে অর্থাৎ দোকানের অন্দরমহল দিয়ে চেম্বারে ঢোকার আর একটা দরজা আছে। রোগীদের দেখার সময় ধীরাপদর সঙ্গেও একবার চোখোচোখি হয়েছে, কারণ সে ওদিকটাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। আলাদা করে কিছু খেয়াল করেছে বলে মনে হল না।
ভিতরে যেতে যেতে যে কজন কর্মচারীর মুখোমুখি হয়েছে, সকলকেই জোড়হাত কপালে ঠেকাতে দেখা গেছে। রমেন হালদার ওদিক থেকে এগিয়ে এসে সামনাসামনি হয়েছে এবং তৎপর অভিবাদন জ্ঞাপন করেছে। এমন কি এতক্ষণের হাঁক-ডাক আদেশ- নির্দেশে ব্যস্ত ম্যানেজার এই প্রথম মুখে একটু হাসি টেনে একটা হাত কপালে তুললো, তাঁর অন্য হাতে ওষুধের প্যাকেট।
একটু বাদে এদিকের দরজা ঠেলে রোগীদের সম্মুখীন হতে দেখা গেল মহিলাকে। গায়ে ঢোলা সাদা এপ্রন, হাত কনুয়ের ওপর গোটানো, গলায় হারের মত স্টেথোসকোপ ঝুলছে। দেখে ধীরাপদরও রোগী হবার বাসনা। বেঞ্চি ক’টায় ঠাসাঠাসি লোক। একটা বেঞ্চে শুধু মেয়েছেলে। চেয়ার ক’টাও খালি নয়। এসেই বেয়ারার হাতে স্লিপ দিতে হয়, সেই স্লিপ অনুযায়ী পর পর ডাক পড়ে। যারা আগের পরিচিত রোগী অথবা যারা শুধু রিপোর্ট করতে এসেছে—একে একে তাদের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়েই কথা বলল। অসুখের খবর নিল, প্রেসকৃপশান দেখল, তারপর নির্দেশ দিয়ে বিদায় করল। ওষুধ বদলানোর প্রয়োজনে কাউকে বা বসতে বলল। তারপর স্লিপ অনুযায়ী একজন একজন করে নিজেই ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল। আগের ডাক্তারের সঙ্গে রোগী দেখার তারতম্য লক্ষ্য করল ধীরাপদ। আগের ডাক্তারটিকে একবারও চেয়ার ছেড়ে উঠে আসতে দেখেনি। লাবণ্য সরকার পর্যবেক্ষণ শেষ করে প্রত্যেকটি রোগীর সঙ্গে বেরিয়ে আসছে আর পরের জনকে ডেকে নিচ্ছে।
ধীরাপদর আর কেনা-বেচার দিকে ফিরে যাওয়া হয়ে উঠল না। সেই এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। বেঞ্চির খালি জায়গা নতুন রোগী বা রোগিণীর আবির্ভাবে ভরে উঠতে সময় লাগছে না। সকলে স্লিপ পাঠাচ্ছে তাও নয়। মনে মনে ধীরাপদ হিমাংশু মিত্রের বুদ্ধির তারিফ করেছে এরই মধ্যে। এমন সবল আকর্ষণ রচনার দরুন বাহাদুরি প্রাপ্য বটে। মহিলার গলার স্বরটি পর্যন্ত চেহারার সঙ্গে মানায়। মেয়েদের তুলনায় নিটোল ভরাট কণ্ঠস্বর। চোখ বুজে শুনলে মনে হবে অল্পবয়সী ছেলের মিষ্টি গলা। যতবার বেরুচ্ছে, ধীরাপদ নিরীক্ষণ করে দেখছে। নামটাও মানায়। লাবণ্য। নারী-সুলভ ঢলঢলে লাবণ্যের চিহ্নমাত্র নেই বলেই ওই নাম বেশি মানায়। যা আছে সেটুকু উপলব্ধি করার মত, দেখার মত নয়। রঙ খুব ফর্সা নয়, ফর্সা করার চেষ্টাও নেই। চুল টেনে বাঁধা, ফলে ওদিক থেকেও কিছুটা লাবণ্য চুরি। চোখের দৃষ্টি গভীর অথচ নিঃসঙ্কোচ, কিছুটা বা নির্লিপ্ত। ঠোটের ফাঁকে একটু-আধটু হাসির আভাস কমনীয়.
বটে, কিন্তু তেমন অন্তরঙ্গ নয়। এক ধরনের জোরালো স্পষ্টতার আড়ালে নারী-মাধুর্য প্রচ্ছন্ন রাখার মধ্যেই লাবণ্য নাম সার্থক।
পুরুষের চোখ অলক্ষ্যে যতই উকিঝুঁকি দিক, অমন মেয়ে সামনাসামনি হলে নিজেকে দোসর ভাবা শক্ত।
লাবণ্য সরকার সেটুকুও জানে যেন।
বেঞ্চি আর চেয়ার প্রায় ফাঁকা। এদিক-ওদিকে দুই একজন বসে তখনো। শেষের যে লোকটিকে ডেকে নিয়ে গেছে তাকে দেখতে সময় লাগল একটু। ইতিমধ্যে আরও জনাকতক নতুন আগন্তুক বেঞ্চি দখল করেছে। ওই জোড়াটি বোধ হয় স্বামী-স্ত্রী। আগেও দু-চারজনকে সস্ত্রীক আসতে দেখেছে। স্বামীটি রোগী কি স্ত্রীটি রোগিণী ধীরাপদ অনেক ক্ষেত্রেই ঠাওর করে উঠতে পারেনি। তাদের দিকে চেয়ে মনে মনে সেই গবেষণাতেই মগ্ন ছিল।
দরজা ঠেলে লাবণ্য সরকার বেঞ্চিতে আবার নতুন আগন্তুক দেখে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার পরে ধীরাপদর দিকেই চোখ গেল তার। কে তেমন খেয়াল করেনি, অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, শুধু সেটুকুই লক্ষ্য করছিল। যে ক’জন প্রতীক্ষা-রত তাদের সকলের আগে এসেছে ভেবেই ডাকল, এবারে আপনি আসুন।
সমস্ত দিনের উপোসী মুখে অসুস্থতার ছাপ পড়াও বিচিত্র নয়। ধীরাপদ যতটা সম্ভব কোণের দিকে মুখ করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। থতমত খেয়ে দু-এক পা এগিয়ে এলো। আহ্বানকারিণী চেম্বারের দিকে এগোতে গিয়েও মুখের দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়াল। ভুরুর মাঝে কুঞ্চন-রেখা। কিছু স্মরণের চেষ্টা।
আপনি … আচ্ছা, আসুন। ভিতরে ঢুকে গেল। অগত্যা বেঞ্চি ক’টার পাশ কাটিয়ে ধীরাপদও।
একটা ছোট টেবিলের এদিকে দুটো চেয়ার, উল্টোদিকে ডাক্তারের নিজের। টেবিলের ওপর প্রেসক্রিপশান প্যাড আর সেই বড় ব্যাগটা। দেয়ালের গায়ে রোগী. পরীক্ষার হাত-দেড়েক চওড়া ধপধপে বেড।
নিজের চেয়ারটা টেনে বসল লাবণ্য সরকার। ওকে বসতে বলল না। কাছে এসে না দাঁড়ানো পর্যন্ত চেয়ে রইল। ভুল হচ্ছে কি না সেই সংশয়।— আপনিই কাল মিস্টার মিত্রের বাড়ি গেছলেন না?
ধীরাপদ মাথা নাড়ল, গিয়েছিল।
আপনাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?
সিতাংশুবাবু এখানে আসতে বলেছেন শুনলাম…
গতকাল হিমাংশুবাবু বলে খোঁজ করতে লাবণ্য সরকার বাবুকে মিস্টার মিত্র করে নিয়ে জবাব দিয়েছিল ধারাপদর মনে আছে। আজও মুখের ওপর ঠাণ্ডা দুই চোখ একবার বুলিয়ে নিয়ে বলল, তিনি সমস্ত বিজনেসের অর্গ্যানিজেশন চীফ– সকলে ছোট- সাহেব বলে। তা আপনি সেই থেকে ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন, ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
ধীরাপদ ঘাড় নাড়ার আগেই টেবিলের বোতাম টিপল। বেয়ারা হাজির। ম্যানেজার বাবু-
পরক্ষণে ভিতরের দরজা ঠেলে ম্যানেজারের আবির্ভাব। রোগী ডাকার জন্য লাবণ্য সরকার চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ইনি ওদিকে দাঁড়িয়ে কেন, কি কাজ দেখিয়ে-টেখিয়ে দিন—যান এঁর সঙ্গে।
শেষের নির্দেশ ধীরাপদর উদ্দেশে। গুরুগম্ভীর ম্যানেজারের সঙ্গে বিব্রত দৃষ্টি বিনিময়। তাঁকে অনুসরণ করে ভিতরের দরজার এধারে আসতেই বিরক্তি চাপতে পারলেন না ভদ্রলোক। —ওদিকে হাঁ করে দেখার কি ছিল, এদিকে যান—দেখুন কি হচ্ছে না হচ্ছে। এই তাড়াহুড়োর সময় কাজ দেখান বললেই দেখানো যায় না, কাজ শিখতে হলে দুপুরের নিরিবিলিতে এসে দেখতে হবে-
গজগজ করতে করতে আর একদিকে চলে গেলেন তিনি।
ব্যাপার দেখে ধীরাপদর হাসি পাচ্ছে। ভিতরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার দরুন কাউন্টারের কর্মচারীদের সঙ্গে মিশে গেল সেও। কেনা-বেচার হিড়িক কমেনি তখনো। যান্ত্রিক তৎপরতায় কর্মচারীরা ওইটুকু পরিসরের মধ্যেই একে অন্যের পাশ কাটিয়ে আলমারির কাচ-দরজা ঠেলে ঠেলে ওষুধ বার করছে—শিশি বোতল প্যাকেট ট্যাবলেট। এ-মাথা ও-মাথা ওষুধ-ঠাসা আলমারির মধ্যে কোথায় কোন খুঁটিনাটি বস্তুটি রয়েছে তাও যেন সকলের নখদর্পণে। ধীরাপদ ওষুধ অনেক কিনেছে, এভাবে ওষুধ বার করতেও দেখেছে—কিন্তু কাজটা যে এমন দুর্বোধ্য রকমের দুরূহ একবারও ভাবেনি। হালদার আশ্বাস দিয়েছিল দু দিনেই শিখিয়ে দেবে, দু বছরেও ওর দ্বারা হবে কিনা সন্দেহ।
আঃ, আপনি ও-দিকে সরে দাঁড়ান না, কাজের সময়-
সচকিত হয়ে ধীরাপদ তিন-চার হাত সরে দাঁড়াল, প্যাসেজ জুড়ে আড়াআড়ি দাঁড়িয়েছিল বলে বিরক্তিটা তারই উদ্দেশে। খানিক বাদে আলমারি খুলতে বাধা পেয়ে আর একজন বলল সরে দাঁড়ান। ধীরাপদ আবার দু-চার পা এগিয়েছে। একজন খদ্দের ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রেসক্রিপশান এগিয়ে দিতে বিব্রত মুখে হাত বাড়িয়েছে, সেই সঙ্গে কর্মচঞ্চল ব্যস্ততায় হাত বাড়িয়েছে পাশের কর্মচারীটিও। হাতে হাতে কলিশন। অস্ফূট বিরক্তি, আপনি এটা নিয়ে কিছু বুঝবেন এখন? সরুন ওদিকে—
ধীরাপদ আবারও সরেছে।
আধ ঘণ্টার মধ্যে এমনি বারকতক তাড়া খেয়ে সরতে সরতে ধীরাপদ একেবারে দরজার কাছটিতে এসে গেছে। তার পাশেই তখন যে-লোকটি দাঁড়িয়ে সে যদি সরতে বলে, দরজা ঠেলে ধীরাপদকে এরপর দোকানের বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়।
বলার অপেক্ষা না রেখে বাইরেই চলে এলো।
ফাঁকা রাস্তায় পা চালিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুই করতে হয়নি তবু বেশ একটা ধকল গেল যেন। চাকরি-পর্বের এখানেই ইতি, আর এ-মুখো হচ্ছে না। শান্তি। বিবেকের তাড়নায় ভুগতে হবে না আর।
কিন্তু পরদিন এ নিশ্চিন্ততাটা দুপুরের ও ধার পর্যন্ত গড়ালো না। ওষুধের দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ওষুধ বিক্রী করার চাকরি দেবার জন্য চারুদির এমন আগ্রহ- সে-রকম কিছু মনে হচ্ছে না। হিমাংশু মিত্রকে লেখা চিঠির সুর, চিঠির ভাষা মনে আছে। লিখেছিলেন, নির্দ্বিধায় দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। সেটা এই দায়িত্ব? তাছাড়া চিঠি খোলা হয়েছে ধরে ফেলেও হিমাংশু মিত্র যে ব্যবহার করেছেন আর যে-কথা বলেছেন তাতে. কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ওষুধ বিক্রির কাজটা ঠিক প্রত্যাশিত নয়।
নতুন-পুরনো বইয়ের দোকানের মালিক দে-বাবুর সঙ্গে দেখা করবে বলে বেরিয়েও রাস্তা বদলে ধীরাপদ মধ্য কলকাতার সেই ওষুধের দোকানে এসেই ঢুকল।
আগের দিনের মতই দুপুরের নিরিবিলি পরিবেশ। আজও সেই ছোকরা অর্থাৎ রমেন হালদারই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো। — দাদা কাল পালালেন কখন? ম্যানেজারকে না বলেকয়ে ওভাবে যায়। ম্যানেজার চটে লাল, কড়া মানুষ তো—আজ শোনাবে’খন। তাছাড়া সকালেও তো এলেন না, ডিউটির টাইমও ঠিক হল না।
কোনরকম উৎকণ্ঠার আভাস না দেখে একটু বোধ হয় বিস্মিত হল সে। পরামর্শ দিল, যা-ই বলুক, মুখ শুকিয়ে বলবেন, নতুন মানুষ ভুল হয়ে গেছে—
একটু বেশি তড়বড় করলেও ছেলেটাকে গতকালই ভালো লেগেছিল ধীরাপদর। এই নীরস কর্মচঞ্চলতার মধ্যেও প্রাণবন্ত। অন্যের কান বাঁচিয়ে কোণের বেঞ্চিতে বসে ধীরাপদ বলল, ম্যানেজারের জন্যে ভাবনা নেই, ফ্যাক্টরীটা কোথায় বলো দেখি ভাই? প্রশ্নটা শুনে হালদারকে আসন পরিগ্রহ করতে হল। সেখানে যাবেন?
মাথা নাড়ল।
সাহেবদের সঙ্গে দেখা করবেন?
দু চোখ গোল হতে দেখে ধীরাপদ হেসেই ফেলল।
ছেলেটাও হাসল।—আমাদের কাছে ওঁরা আবার ভগবানের মতই কি না…আপনি এখানে কাজ করবেন না?
দেখা যাক—
ফ্যাক্টরীর হদিস দিয়ে রমেন আবারও সংশয় প্রকাশ করল, কিন্তু আপনি ভিতরে ঢুকবেন কি করে, দরজায় তো বন্দুকওয়ালা পাহারা—এনকোয়ারি ক্লার্কের সঙ্গে দেখা করতে হবে, সে সন্তুষ্ট হলে সাহেবদের টেলিফোন করবে, হুকুম হলে তবে যেতে দেবে।
এত গণ্ডগোল জানত না, ধীরাপদ দমে গেল একটু।
রমেনই আর একটা সহজ পথ বাতলে দিল। জানালো, তিনটের সময় মেডিক্যাল হোমের গাড়ি যাবে ফ্যাক্টরী থেকে মাল আনতে, ড্রাইভারকে বলে দিলে দোকানের কর্মচারী হিসেবে সেই গাড়িতেই ধীরাপদ বিনা বাধায় ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। সহজ পন্থা দেখিয়ে দেবার ফলে ভয়ও পেল একটু, সাহেবরা রেগে যাবেন না তো? আমি বলেছি বলবেন না যেন…
ধীরাপদ হেসে অভয় দিল।
তিনটে বাজতে ঘণ্টাখানেক দেরি তখনো। ম্যানেজার আসার আগেই সরে পড়তে পারবে, সেটা মন্দ নয়।
রমেন হালদার গম্ভীর মুখেই বলে যেতে লাগল, দেখুন যদি অন্য কিছু পেয়ে যান, এখানে আমাদের যা মাইনে-ছ বছর ধরে আছি, পাচ্ছি মাত্র একশ পঁচিশ —চলে আজকের দিনে? ম্যানেজারই পায় মাত্র সাড়ে তিনশ—সেই গোড়া থেকে আছে, আমাদের আর কত হবে। অল্প কিছু টাকা হাতে পেলে নিজেই একটা দোকান খুলতাম, আটঘাট সব জেনে গেছি, টাকাই নেই, কি হবে—
কি মনে পড়তে সমস্যার কথা ভুলে চপল কৌতূহলে দু চোখ উৎসুক হয়ে উঠল তার। -ডক্টর মিস সরকার কাল আপনাকে ঘরে ডেকে কি বললেন?
বিশেষ কিছু না।
সংক্ষিপ্ত জবাব মনঃপূত হল না। একটু অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু তাঁকে ডিঙিয়ে আপনি সাহেবদের সঙ্গে দেখা করবেন … সাহেবরা তো আবার তাঁর কথাতেই ওঠেন বসেন, বিশেষ করে ছোট সাহেব— এখানকার যা কিছু সবই মিস সরকারের হাতে।
ধীরাপদ নিরুত্তর। চিন্তিত নয় তা বলে, যেটুকু নাড়াচাড়া করে দেখছে, খেলার ছলেই দেখছে। এতকালের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে ফিরে যেতে মনের একটা দিক সব- সময়ই প্রস্তুত।
কিন্তু যাই বলুন দাদা, অন্তরঙ্গ জনের কাছে মনের কথা ব্যক্ত করার জন্যেই যেন আরো কাছে ঝুঁকে রমেন হালদার গলা খাটো করে বলল, মিস সরকারকে আপনার ভালো লাগেনি? যতক্ষণ থাকেন উনি আমার কিন্তু বেশ লাগে, অমন জোরালো মেয়েছেলে কম দেখেছি, আর তেমনি চালাক, মাইনে বাড়িয়ে নেবার জন্য একটু ইয়ে করতে গিয়ে আমার যা অবস্থা শুনলে আপনি হেসে মরবেন-
হেসে মরার বাসনা না থাকলেও ধীরাপদর শোনার আগ্রহটুকু অকৃত্রিম। মিস সরকারকে তারও ভাল লেগেছে কি না জিজ্ঞাসা করতে নিজের অন্তস্থলে হঠাৎই যেন একঝলক আলোকপাত হয়েছিল। ধীরাপদর যা স্বভাব, মিত্রবাড়িতে গতকাল ওইরকম প্রতীক্ষার পর কেয়ার-টেক বাবুর সঙ্গে তার ওষুধের দোকান পর্যন্ত আসার কথা নয়। আসার পিছনে নিজের অগোচরে একটুখানি আকর্ষণ ছিল, মানকের মুখে মেম-ডাক্তারের কথা শুনে রমণীটিকে আর একবার দেখার বাসনা হয়েছিল বইকি। সেই বাড়িতে অল্প একটু দেখার ফাঁকে তার নির্লিপ্ত বলিষ্ঠতাটুকু এক ধরনের কৌতূহল যুগিয়েছে। তাই মনে হয়েছে, ভালো করে দেখা হয়নি, ভালো করে দেখতে পারলে কিছু যেন আবিষ্কারের সম্ভাবনা। ধপধপে সাদা মোটরে তার পাশে সিতাংশু মিত্রকে নিষ্কম্প শিখার পাশে চঞ্চল পতঙ্গের মত মনে হয়েছিল ধীরাপদর। যখন খুশি গ্রাস করতে পারে, শুধু তেমন তাড়া নেই যেন।
দোকানের অমন কাজের ঝড়ের মধ্যে মহিলার আবির্ভাব বায়ুগতি কর্মরথের বলগা-ধরা সারথিনীর মত। ভ্রুকুটি নেই অথচ এক ভ্রুকুটিতে সব ওলট-পালট হতে পারে। ধীরাপদ তন্ময় হয়েই দেখছিল, সমস্ত দিনের অনাহারের ক্লেশও ভুলে গিয়েছিল। তন্ময়তায় ছেদ পড়েছিল ওকেই ডেকে বসাতে হকচকিয়েও গিয়েছিল একটু। কাউন্টারের সেই স্বল্পক্ষণের অভিজ্ঞতার ফলেও আর দোকানমুখো হবার কথা নয় ধীরাপদর। নানান সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে তবেই এসেছে বটে। কিন্তু কোথায় অলক্ষ্য একটু তাগিদও ছিল। ওই ধরনের মেয়ের প্রতিকূলতা করতে পারার মতই পুরুষোচিত লোভের হাতছানি একটু। কাল নিজেকে বড় বেশি তুচ্ছ মনে হয়েছিল বলে পুরুষ- চিত্তের সহজাত উসখুসুনি আজও তাকে দোকানের দিকে ঠেলেছে।
মাইনে বাড়িয়ে নেবার উদ্দেশ্যে লাবণ্য সরকারের সঙ্গে একটু ইয়ে করতে গিয়ে কি হাল হয়েছিল, মনের আনন্দে রমেন সেই কাগুর শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বসেছে।
অনেক দিন পাঁয়তাড়া কষে সামনে সামনে ঘুরঘুর করেছে, মিস সরকার এলেই ভিতরের দরজার কাছটিতে কাজ নিয়েছে সে, বেয়ারা ইনজেকশানের স্লিপ নিয়ে এলেই প্রত্যেক বার নিজে গিয়ে ইনজেকশানের ওষুধ সাপ্লাই করেছে, বেয়ারার হাত দিয়ে পাঠায়নি। মিকশ্চারের প্রেসক্রিপশানও নিজে নিয়ে এসেছে। মিস সরকার ইনজেকশানও দেন সব থেকে বেশি, মিকশ্চারের প্রেসক্রিপশানও করেন সব থেকে বেশি। ইনজেকশান দেবার জন্য দু টাকা করে পান— কম্পাউণ্ডার ইনজেকশান করলে এক টাকাতেই হয়, কিন্তু রোগীর সামনেই যখন ইনজেকশান চেয়ে পাঠান রোগী তো আর বলতে পারে না এক টাকা বাঁচানোর জন্যে কম্পাউণ্ডারের হাতে ইনজেকশান নেবে! ওদিকে মিকশ্চারের প্রেসক্রিপশানেও টাকায় চার আনা লাভ। কম হল নাকি। ছ’শ টাকা মাইনে পান, আরো কোন না চার-পাঁচশ এই করে হয়। রোগীদের কাছে ওনারই তো কদর বেশি, এই রোজগারের ওপর নার্সিং হোমের রোজগার—ভাবুন একবার! তা যাই হোক, মাইনে যদি কিছু বাড়ে আর নার্সিং হোমেও যদি একটু কিছু পার্টটাইম কাজ- টাজ জোটে সেই আশায় রমেন হালদার অনেক দিন বলতে গেলে ওনার পায়ের জুতোর সঙ্গে মিশে থাকতে চেষ্টা করেছিল। তার পর সুযোগ-সুবিধে বুঝে একদিন —আর যখন একটিও রোগী নেই বাইরে—দুর্গা গণেশ স্মরণ করে ভিতরে এসে দিদি বলেই ডেকে বসেছিল। নিজের দিদি হলে ওটুকুতেই স্নেহে চক্ষু ছলছল করে ওঠার কথা—
তার পর? তার পর সে যা হল— রমেনের মুখ আমসি। দিদি ডাক শুনেই এমন ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন যে মনে হচ্ছিল তার সমস্ত মুখে যেন দু’ টুকরো বরফ বোলানো হচ্ছে।
একটু বাদে মিস সরকার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি বলবে?
রমেনের মনে হয়েছিল চোখের থেকেও গলার স্বর আরো ঠাণ্ডা, একেবারে হাড়ে গিয়ে লাগার মত। যা বলবে বলে এসেছিল ততক্ষণে সব ভুল হয়ে গেছে। যা মুখে এসেছে তাই বলে বসেছে। বলেছে, আজ একটু আগে বাড়ি যাওয়া দরকার ছিল।
রমেনের ধারণা, এতখানির পর এর থেকে অনেক বড় কিছু নিবেদন আশা করেছিলেন মিস সরকারও। আর দিদি ডাকে না ভুলে জবাব দেবার জন্যেও তৈরি ছিলেন। ওর আরজি শুনে ঠাণ্ডা ভাবটা কমলো একটু। রাত প্রায় ন’টা তখন, তা ছাড়া ছুটি কেউ কখনো ওঁর কাছে চাইতে আসে না, একদিন দু-দিন পর্যন্ত ছুটি ম্যানেজারই মঞ্জুর করে থাকেন। কিন্তু রমেন তো আর অত সব ভেবে বলেনি, যা হোক কিছু বলে ঘর থেকে পালাবার মতলব। কিন্তু কি বিভ্রাটেই না পড়তে হল ওকে ওইটুকু থেকে—প্যাঁক করে টেবিলের বোতাম টিপে বসেছেন মিস সরকার, ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, এর বোধ হয় একটু আগে ছুটি দরকার, দেখুন।
ব্যস, বাইরে এসে ম্যানেজার হাঁ করে খানিক চেয়ে রইলেন ওর দিকে, কারণ তিনি তো জানেনই যে ওর ডিউটি শেষ হয়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে— ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারে।
তার পর এই মারেন তো সেই মারেন।
ফন্দিটা রমেন হালদার মন্দ বাতলে দেয়নি। বিনা বাধায় সরাসরি একেবারে ফ্যাক্টরী এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়া গেল। কোম্পানীর গাড়ি দেখে গেটম্যান গোটা ফটক খুলে দিল। বন্দুক হাতে যেখানে পাহারাওয়ালা বসে, সেখান দিয়ে পাশাপাশি দুজনও ঢুকতে বা বেরুতে পারে না।
কিন্তু এভাবে ভিতরে ঢুকে ধারাপদ যেন আরো বেশি ফাঁপরে পড়ে গেল। কোথায় কোন দিকে যাবে কিছুই হদিস পেল না। বিস্তৃত ঘেরানো এলাকার মধ্যে তিন-চারটে ছোট বড় দালান। দালান বলতে বিশাল এক-একটা গুদোমঘরের মত। শুধু মাঝখানের বড় দালানটা তিনতলা। অনুমানে ধীরাপদ সেদিকেই এগোলো।
তালকানার মত নিচের বড় বড় ঘরগুলোতে এক চক্কর ঘুরে নিল। কোনো ঘরে সারি সারি মেসিনের মধ্য দিয়ে টুপটুপ করে অবিরাম ট্যাবলেট বৃষ্টি হচ্ছে। কোনো ঘরে মেসিনে করে গোটাদশেক বিশাল বিশাল ডেকচি ঘোরানো হচ্ছে—সব কটার মধ্যেই নানা আকারের ট্যাবলেট। একজন লোক ডেকচির মধ্যে রঙের মত কি ঢেলে দিচ্ছে। ট্যাবলেট রঙ করা হচ্ছে বোধ হয়। আর একটা ঘরে ইলেকট্রিক ফিট-করা গোটাকতক মস্ত মস্ত আলমারি। এক-একবার খোলা হচ্ছে, বন্ধ করা হচ্ছে। প্ৰত্যেক তাকে হাতলঅলা বড় বড় ট্রেতে গুঁড়ো ওষুধ শুকোনো হচ্ছে।
কর্মরত এ-পরিবেশটা ধারাপদর ওষুধের দোকানের থেকে অনেক ভালো লাগল। নিচে না ঘুরে ওপরে উঠে এলো। সেখানেও ঘরে ঘরে ছোট ছোট যন্ত্রপাতি সাজ- সরঞ্জাম—যতদূর ধারণা, ওষুধ বিশ্লেষণের কাজ চলছে এখানে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল হিমাংশু মিত্র আজ আসেননি, আর সিতাংশু মিত্র কন্ট্রোল- রুমে। কন্ট্রোল-রুমের খোঁজে এদিক-ওদিক বিচরণের ফলে একটা প্যাসেজের মুখে যার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা, সে মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার লাবণ্য সরকার। একটা প্যামফ্লেট পড়তে পড়তে এদিকেই আসছিল। ধীরাপদ পাশ কাটিয়ে গেলে লক্ষ্য ও করত না হয়ত। কিন্তু ধীরাপদ দাঁড়িয়ে পড়ল আর চেয়ে রইল।
কাছাকাছি এসে প্যামফ্লেট সরিয়ে মুখ তুলল লাবণ্য সরকার। নিজের অগোচরেই ধীরাপদর যুক্ত-কর কপাল স্পর্শ করল। ওদিকে প্যামফ্লেট-ধরা হাতখানা সামান্যই নড়ল।—আপনি এখানে?
ধীরাপদ একবার ভাবল বলে, এমনি ফ্যাক্টরী দেখতে এসেছে। বলে ফেললে পরে নিজের ওপরেই রেগে যেত। জবাব দিল, সিতাংশুবাবু মানে ছোট সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করব বলে এসেছিলাম।
নামের ভুলটা হয়ত ইচ্ছে করেই করল আর শুধরে নিল। লাবণ্য সরকার বলল, তিনি ব্যস্ত আছেন, আপনার কি দরকার?
… আমার দরকার ঠিক নয়, আমাকে তাঁর দরকার আছে কি না জেনে নিতে এসেছিলাম।
জবাবে যা স্বাভাবিক তাই হল। দুই চক্ষু ওর মুখের ওপর প্রসারিত হল। কিন্তু ধীরাপদরই বরাতক্রমে সম্ভবত আর বাক-বিনিময়ের অবকাশ থাকল না। ফিটফাট সাহেবী পোশাক-পরা দুটি লোক হন্তদন্ত হয়ে লাবণ্য সরকারকে চড়াও করে ফেলল। একজনের হাতে খোলা মেডিক্যাল জার্নাল একটা, আর একজনের হাতে বই। মুখে কিছু একটা আবিষ্কারের ব্যগ্র আনন্দ। বই আর জার্নাল খুলে কোনো সমস্যা-সংক্রান্ত তথ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার।
লাবণ্য সরকার নিরুৎসুক দৃষ্টিতে বইয়ের ওপর চোখ বোলালো একবার, তার পর বলল, চলুন দেখছি—
এক পা এগিয়েও ধীরাপদর দিকে ফিরে তাকালো। —মিস্টার মিত্র ওপরে।
দুপাশের দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে সামনের দিকে এগোলো। ধীরাপদ চেয়ে আছে। ভক্ত-সমাবেশে অচপল চরণে দেবীর প্রস্থান।
সিতাংশু মিত্রের সঙ্গে দেখা করার আর তেমন তাগিদ নেই। দেখাটা হিমাংশু মিত্রের সঙ্গে হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। পায়ে পায়ে উপরে উঠল তবু। সামনের এ-মাথা ও-মাথা বিশাল হলঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল সে।
এখানকার কর্মরত দৃশ্যটা নয়নাভিরাম। হল-ভরতি তিন সারিতে নানা বয়সের প্রায় একশ লোক ডিসটিড ওয়াটারে অ্যামপুল ধুচ্ছে। প্রত্যেকের সামনে কল ফিট করা একটা করে বেসিন। কলের মুখ দিয়ে রেখার মত তারের নালে জল পড়ছে। এক-একটা অ্যামপুল ধোয়া হতে তিন সেকেণ্ডও লাগছে না। তার পর জালের মত গর্ত-করা কাঠের র্যাকে উপুড় করে রাখা হচ্ছে সেগুলো। গোটা হলঘরটাই সেই উপুড় করা অ্যামপুলএ ঝকঝক করছে। প্রয়োজন ভুলে ধীরাপদ তাই দেখতে লাগল।
হলের ও-মাথার দরজায় সপার্ষদ সিতাংশু মিত্রের আবির্ভাব। সঙ্গে সঙ্গে অ্যামপুল- ধোয়া কর্মীদের বাড়তি নির্বিষ্টতাটুকু উপলব্ধি করা গেল। সিতাংশু মিত্রের দুপাশে জনা-পাঁচেক অনুগত মূর্তি, হাত নেড়ে তাদের উদ্দেশে কি বলতে বলতে এদিকে এগিয়ে আসছে। এ দরজার দারোয়ান শশব্যস্তে টুল ছেড়ে বুকটান করে দাঁড়ালো।
একনজরে মালিক চেনা যায়।
এদিকের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুই-এক কথার পর অনুসরণরত পার্ষদদের বেশির ভাগই ফিরে গেল। তার পর ধীরাপদর সঙ্গে চোখাচোখি।
চৌকাঠ পেরিয়ে সিতাংশু মিত্র এগিয়ে এলো। আপনি … ও আপনি। ছোট সাহেবের, মনে পড়েছে, আপনাকে তো কাল ওষুধের দোকানে যেতে বলেছিলাম – যাননি?
ধীরাপদ ঘাড় নাড়ল, গিয়েছিল।
কথাবার্তা হয়নি বুঝি কিছু, আমারও মনে ছিল না। আচ্ছা আপনি সেখানেই যান, আমি বলে দেব’খন।
ধীরাপদর মুখে বিব্রত হাসির আভাস। -সেখানে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ওষুধ বিক্রি করব?
কাজটা নগণ্য অথবা ওর যোগ্য নয় সেই অর্থে বলতে চায়নি, ওর দ্বারা ও কাজ সম্ভব নয় সেইটুকুই ব্যক্ত করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আগের অর্থটাই দাঁড়াল। আর তাতে সুফলই হল বোধ হয়। ছোট সাহেবের মনে পড়ল, কারো কাছ থেকে চিঠি নিয়ে আসার ফলে বাবা ব্যস্ততা সত্ত্বেও লোকটির সঙ্গে দেখা করেছেন, তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন, কোন কাজে স্যুট করবে ভাবতে বলেছেন, আর পরদিन এই প্রসঙ্গে তাঁর আলোচনা করার ইচ্ছেও ছিল।
আচ্ছা আপনি ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।
বেয়ারার প্রতি ওকে ঘরে নিয়ে বসাবার ইঙ্গিত। আর একদিকে চলে গেল
সিতাংশু মিত্র। ব্যস্ত, কোনো কারণে একটু চিন্তিতও যেন।
তিনতলার বেয়ারা দোতলার কন্ট্রোল-রুমের দরজায় মোতায়েন বেয়ারার হেপাজতে তাকে ছেড়ে দিয়ে গেল।
আগাগোড়া কার্পেট বিছানো মস্ত ঘর। দু’দিকের দেওয়ালের কাছে কাচবসানো বড় বড় দুটো সেক্রেটেরিয়েট টেবিল। সামনে দুখানা করে শৌখিন ভিজিটারস চেয়ার। মাঝামাঝি জানালার দিক ঘেঁষে স্টেনোগ্রাফারের ছোট টেবিল। একজন মাঝবয়সী মেমসাহেব টাইপে মগ্ন। দামী মেসিন সম্ভবত, টাইপের শব্দটা খট খট করে কানে লাগছে না, টুক টুক মৃদু শব্দ। বড় টেবিলের একটাতে লাবণ্য সরকার সামনে কতগুলো ছড়ানো কাগজপত্র থেকে লিখছে কি।
ঘরে ঢুকেই বাঁ দিকে একপ্রস্থ দামী সোফা-সেটি। বেয়ারা ধীরাপদকে সেখানে এনে বসালো। লাবণ্য সরকার মুখ তুলল একবার।
দ্বিতীয় শূন্য টেবিলটা নিঃসন্দেহে ছোট সাহেবের। পাশের দেয়ালে মস্ত চার্ট একটা, তাতে খুব সম্ভব কারখানার সমস্ত বিভাগের নক্সা আঁকা। ও-পাশের দেয়ালে একটা বোর্ডের গায়ে কোন বিভাগে কত কর্মচারী উপস্থিত সেদিন তার তালিকা। বিভাগের নামগুলো স্থায়ী হরফের, উপস্থিতির সংখ্যা খড়ি দিয়ে লেখা।
ধীরাপদ আড়চোখে দেখছে এক-একবার। সোজাসুজি চেয়ে থাকলেও কারো কোনো বিরক্তির কারণ হত না- মহিলার নিরুদ্বেগ কাজের গতিতে একটুও ছেদ পড়ত না। সেটুকু উপলব্ধি করেও ধীরাপদ চুরি করেই দেখতে লাগল। খুব যে একাগ্র মনোযোগে কাজ করছে তা নয়, ধীরেসুস্থে হাতের কাজ সেরে রাখছে মনে হয়।
বাইরে কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ। প্রথমে ছোট সাহেবের প্রবেশ, পরে অনুবর্তীদের। লাবণ্য সরকার এবারে মুখ তুলে তাকালো।
আজ তো হলই না, কালও হবার কোনো লক্ষণ দেখছি না।— প্রচ্ছন্ন ক্ষোভে উদ্দেশে খবরটা বলতে বলতে সিতাংশু মিত্র নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল।
হাতের কলমের মুখটা আটকাতে আটকাতে লাবণ্য সরকার উঠে এসে তার সামনের চেয়ারটাতে বসল। অন্য আগন্তুকরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে। ধীরাপদর দিকে চোখ নেই কারো। তাদের বাক-বিনিময় থেকে সমস্যা কিছু কিছু আঁচ করা যাচ্ছে। নতুন বয়লার চালানো যাচ্ছে না, কারণ চীফ কেমিস্টের হুকুম নেই। অথচ পুরানো বয়লারের ওপর সরকারী নোটিসের দিন এগিয়ে আসছে। আগন্তুকরা সম্ভবত ওই কাজেরই কর্মচারী, ছোট সাহেবের মন রেখে তারা বয়লার চালানোর সুবিধের কথাও বলছে, আবার চীফ কেমিস্টের বিরাগভাজন হবার সম্ভাবনাতেই হয়ত অসুবিধের কথাও বলছে।
লাবণ্য সরকার সামনের বোর্ডটার দিকে ইঙ্গিত করল, লোকজন তো সবই উপস্থিত, তাহলে এমন কি অসুবিধে হবে? আপনি তাঁর সঙ্গেই একবার পরিষ্কার আলোচনা করে নিন না, খেয়াল-খুশিমত হবে না বললে চলবে কেন?
প্রস্তাবের জবাবে খট করে টেলিফোন তুলে কানে লাগালো সিতাংশু মিত্র।— সি, সি। সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর মৃদু শোনালো। – একবার আসবে? কথা ছিল…
টেলিফোন নামালো। মাথা নাড়ল একটু, অর্থাৎ আসছে। ইঙ্গিতে অন্য সকলকে বিদায় দিল। ধীরাপদর ধারণা, এ ফয়সালার মধ্যে তারা থাকতেও চায় না। সিতাংশু মিত্র ঘাড় ফিরিয়ে কর্মচারীদের উপস্থিতি-তালিকার বোর্ডটা দেখছে। আর সেই সঙ্গে নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিচ্ছে হয়ত। সমস্যার ভারে ধীরাপদর কথা মনেও নেই বোধ হয়। সোফার কোণে নির্বাক মূর্তির মত গা ডুবিয়ে বসে আছে সে।
লাবণ্য সরকার নড়েচড়ে বসলো। পদমর্যাদার ঠাণ্ডা অভিব্যক্তির এই প্রথম ব্যতিক্রম একটু। … ধীরাপদর চোখের ভুল না দেখার ভুল? অভ্যস্ত উদাসীনতার বদলে রমণী-মুখে চকিত কমনীয়তার আভাস। দেখার ভুল না চোখের ভুল?
এবারে যে-মানুষের চঞ্চল আবির্ভাব তাকে দেখে ধীরাপদ ভিতরে ভিতরে চাঙ্গা হয়ে উঠল। অমিতাভ ঘোষ। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, পাট-ভাঙা দাগ-ধরা দামী স্যুট, ঠোঁটে সিগারেট।
কি রে, কি খবর—
ছোট সাহেবের মুখে সহজতা বজায় রাখার আয়াস। – বোসো, ব্যস্ত ছিলে নাকি?
না। অমিতাভ ঘোষ দুজনকেই দেখল একবার। শূন্য চেয়ারটায় একখানা পা তুলে দিয়ে চেয়ারের কাঁধ ধরে ঝুঁকে দাঁড়াল। –কি ব্যাপার? বয়লার?
হ্যাঁ, আজ তো চললই না, কালও চলবে না?
না। সাফ জবাব।
লাবণ্য সরকার অন্যদিকে মুখ ফেরালো। ছোট সাহেবের কণ্ঠস্বর ঈষৎ অসহিষ্ণু।
—কিন্তু না চললে এদিকে সামলাবে কি করে, তাছাড়া বাবা বার বার বলে দিয়েছেন—
সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। বচন শুনে নিজের উপস্থিতির দরুণ ধীরাপদ নিজেরই অস্বস্তি। -মামাকে গিয়ে বল—ঘরে বসে বার বার বললেই বয়লার চলবে, আর কোনো ব্যবস্থার দরকার নেই—
দুই এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সিতাংশু খোঁচাটা হজম করে নিল, তারপর উষ্ণ জবাব দিল সে-ও। -তোমার তো দুদিন ধরে পাত্তা নেই, সেদিনও বাড়িতে বাবা বহুক্ষণ অপেক্ষা করলেন- ঘরে বসে না থেকে তাহলে তোমার পিছনেই ঘুরতে বলি?
পায়ে করে চেয়ারটা একটু ঠেলে দিয়ে অমিতাভ সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখের সিগারেটটা অ্যাশপটে গুঁজল। – আমার যা বলার আমি পনেরো দিন আগেই লিখে জানিয়েছি। বয়লার চালাবে কে? তুই না আমি না ইনি? শেষের ইঙ্গিত মহিলার প্রতি।
ছোট সাহেব দৃঢ় অথচ মৃদু জবাব দিল, যারা চালাবার তারাই চালাবে, তুমি আপত্তি করছ কেন?
চেয়ারটা টেনে নিয়ে এবারে অমিতাভ বসল ধুপ করে। বেশ, কারা চালাবে ডাকো তাদের, বুঝে নিই কি করে চালাবে। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ছোট সাহেবের সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিল।
কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যে সিতাংশুর কাউকে ডাকার অভিলাষ দেখা গেল না। তার বক্তব্য, পুরনো বয়লারের লোক দিয়ে নতুন বয়লার আপাতত চালু করা হোক, পুরনোটা তো বন্ধই হয়ে যাচ্ছে, পরে একসঙ্গে দুটোই যখন চলবে তখন দেখেশুনে জনাকতক পটু কারিগর নিয়ে আসা যাবে। সমর্থনের আশাতেই বোধ করি নির্বাক রমণীমূর্তির দিকে তাকালো সে। কিছু বুঝুক না বুঝুক মেম-টাইপিস্টের হাত চলছে না।
সামনের বোর্ডের ওপর চোখ রেখে লাবণ্য সরকার এই প্রথম মন্তব্য করল, ফুল স্ট্রেংথ তো আপাতত আমাদের আছেই, ওখানকার রিজার্ভ হ্যাণ্ড ক’জনও পাচ্ছি, তাদের পুরনো বয়লারে লাগিয়ে সেখানকার স্কিলড হ্যান্ড…
ব্যস ব্যস ব্যস। অমিতাভ ঘোষ যেন ফাঁপরে পড়ে থামিয়ে দিল তাকে। হালকা বিদ্রূপের সুরে বলে উঠল, এতক্ষণ অমন গম্ভীর হয়ে বসেছিলে খুব ভালো লাগছিল, দ্যাট ওয়াজ ওয়ান্ডারফুল।
তরল অভিব্যক্তির ধাক্কায় ধীরাপদ সুদ্ধ সোফার মধ্যে সন্তর্পণে নড়েচড়ে বসল। মেম-টাইপিস্টের মুখেও কৌতুকের আভাস, ছোট সাহেব গম্ভীর।
লাবণ্য সরকারের গোটা মুখখানাই আরক্ত। সোজা মুখের দিকে তাকালো এবার।
–কেন, হবে না কেন?
ঈষদুষ্ণ চ্যালেঞ্জের জবাবে চীফ কেমিস্ট ফিরে দুই এক পলক চেয়ে রইল শুধু। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আবার। সিতাংশু মিত্রকে বলল, তোমরা চেষ্টা করে দেখতে পারো, আমি কোনো দায়িত্ব নেব না। লাবণ্য সরকারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, মুখখানি তেমনি লঘু কৌতুকে ভরা। – তুমি বললে এখানে সব হবে, এভরিথিং ইজ পসিবল-
দরজার দিকে দু পা বাড়িয়েও দাঁড়িয়ে গেল। ধীরাপদর সঙ্কট আসন্ন এবার, তাকে দেখেই থেমেছে। চিনেছেও।
মামা—মানে অনেকটা সেই-রকম যে। আপনি এখানে বসে, কি ব্যাপার? উৎফুল্ল মুখে কাছে এগিয়ে এলো।
এই পরিবেশে এভাবে আক্রান্ত হবার ফলে নাজেহাল অবস্থা। উঠে যদিও বা দাঁড়ানো গেল, সহজ আলাপের চেষ্টা ব্যর্থ। জবাবে, যার জন্যে বসে ধীরাপদ তার দিকেই শুধু তাকালো একবার। ওদিকে এমন এক অপ্রত্যাশিত আপ্যায়নে লাবণ্য সরকার আর সিতাংশু মিত্রও বিস্মিত। তার অবাঞ্ছিত উপস্থিতি এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি বলে বিরক্তও। ছোট সাহেবের মুখে মালিক-সুলভ গাম্ভীর্য। – আপনি সন্ধ্যার পর দোকানে এসে এঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে নেবেন।
নির্দেশ জানিয়ে ছোট সাহেব গটগট করে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
এঁর সঙ্গে অর্থাৎ লাবণ্য সরকারের সঙ্গে। ক্ষণপূর্বের বিড়ম্বনার সাক্ষী হিসেবে ধীরাপদর অবস্থান মহিলাটির চোখে আরো বেশি মর্যাদাহানিকর বোধ হয়। চীফ কেমিস্টের বিদ্রূপের জেরই তখনও পর্যন্ত সামলে উঠতে পারেনি। ধীরাপদরই কপাল মন্দ। মহিলা যে-ভাবে ঘুরে তাকালো ওর দিকে, মনে হল, ছোট সাহেবের হয়ে কথা বলার পরোয়ানা পেয়ে ঠাণ্ডা চোখে এখনই কিছু একটা কৈফিয়তই তলব করে বসবে।
কিন্তু কিছুই বলল না। যেটুকু বুঝিয়ে দেবার পরেই ভালো করে বুঝিয়ে দেবে, তাড়া নেই যেন। উঠে নিজের জায়গায় গিয়ে হাতের কলমটা টেবিলের ওপর রাখল। খানিক আগে লেখা কাগজটা তুলে নিয়ে সেটার ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে সেও দরজার দিকে এগোলো।
অমিতাভ ঘোষ আধাআধি ঘুরে দাঁড়িয়ে উৎসুক নেত্রে একে একে দুজনের দুটি প্রস্থান-পর্ব নিরীক্ষণ করল। তারপর ধীরাপদর ওপরেই চড়াও হল আবার। – কি ব্যাপার বলুন তো, এঁদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?
ধীরাপদ এতক্ষণে হালকা বোধ করছে একটু। মাথা নাড়ল, অর্থাৎ সেই রকমই বাসনা ছিল বটে।
কেন?
প্রশ্নটা নীরস শোনাল। জবাব শোনার আগেই দরজার দিকে পা-ও বাড়িয়েছে।
আর বলেন কেন, চারুদির পাল্লায় পড়ে দু দিন ধরেই তো ঘুরছি। তাকে অনুসরণ করে ধীরাপদও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একদিনের স্বল্প আলাপের এই একজনকেই কিছুটা কাছের লোক মনে হয়েছে।
চারুদির নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতই কাজ হল বুঝি। আবার বিস্ময় আর আগ্রহ। -চারুমাসি পাঠিয়েছে আপনাকে? কেন? চাকরি?
কি জানি কেন, ধরে-বেঁধে তো পাঠিয়েছেন-
সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল দুজনেই। অমিতাভ ঘোষ ফিরে এবারে ভালো করে নিরীক্ষণ করল তাকে। স-প্রশ্ন খুশির আভাস। চলুন নিচে চলুন। হাত বাড়িয়ে ধীরাপদর কাঁধ বেষ্টন করে নিচে নামতে লাগল। – আপনি তাহলে চারুমাসির রিপ্রেজেনটেটিভ। তাই বলুন … কি আশ্চর্য!
ধীরাপদর মনে হল আশ্চর্য বলেই এত খুশি, আর হঠাৎ এই অন্তরঙ্গতাও চারুদির কারণে। তাকে সঙ্গে করে ফুল-বাগান পেরিয়ে সামনের মস্ত একতলা দালানের দিকে পা চালিয়ে অমিতাভ ঘোষ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল, তা আপনি এদের কাছে ঘুরছেন কেন? মামার সঙ্গে দেখা করুন।
ধীরাপদ বুঝে নিল মামাটি কে। মানকের মুখে শোনা ভাগ্নেবাবুর সমাচারও মনে আছে। -দেখা করেছিলাম চারুদি তাঁর কাছেই চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি পরে কথা বলবেন বলেছিলেন, কিন্তু দু দিনের মধ্যে তাঁর তো দেখাই পাওয়া গেল না।
দেখা পাওয়া শক্ত। হাসতে লাগল, দুটো দিন কি বেশি হল? দু মাস তো হয়নি। পকেট হাতড়াতে লাগল, সিগারেট আছে? থাক, আমার টেবিলেই আছে বোধ হয়। তাহলে আপনার আর ভাবনাটা কিসের এখন?
ভাবনা নয়, এঁদের মেজাজ-গতিক ঠিক সুবিধের লাগছে না…
অমিতাভ ঘোষ হা-হা করে হেসে উঠল একপ্রস্থ। এ-মাথা ও-মাথা শেড দেওয়া এক মস্ত ফ্যাক্টরী-ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তারা। তপ্ত গুমোট বাতাস। লোকজন গলদঘর্ম হয়ে কাজ করছে। ইলেকট্রিক প্লেট বসানো সারি সারি চৌবাচ্চার মধ্যে কি সব ফুটছে, লোহার ফ্রেমে ঝুলছে মিটার বসানো মস্ত মস্ত ড্রাম — বোধহয় শুকনো হচ্ছে কিছু, অদূরে কাচ- ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎশক্তিতে বিশাল বিশাল জাঁতার মত ঘুরছে কি আর তাল তাল একটা কঠিন সাদা পদার্থ পিষে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে—সেই তকতকে গুঁড়ো সারি সারি ভ্যাটের মধ্যে ময়দার স্তূপের মত দেখাচ্ছে। চারিদিকে গোঁ-গোঁ শোঁ-শোঁ একটানা যান্ত্রিক শব্দ। ভিতরে ঢুকেই বাঁ-দিকে অল্প একটু ঘেরানো জায়গায় চীফ-কেমিস্টের টেবিল-চেয়ার।
– বসুন। নিজেও বসল, তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, আপনি নিশ্চিন্ত মনে চুপচাপ বসে থাকুন, যাঁর কাছ থেকে আসছেন এঁদের মেজাজের ধার ধারতে হবে না আপনাকে—মামার সঙ্গে দেখা হলে আমি কথা বলব’খন।
হৃষ্টচিত্তে সিগারেট ধরালো একটা।
ধীরাপদর আবারও মনে হল, সে চারুদির লোক, চারুদির কাছ থেকে আসছে –আপনজনের মত লোকটির এই প্রসন্ন অন্তরঙ্গতা শুধু সেইজন্যেই। আর কোনো হেতু নেই। ধীরাপদর ভালো লাগছে বটে, সেই সঙ্গে বুদ্ধির অগম্য কিছু হাতড়েও বেড়াচ্ছে। চারুদি কাউকে পাঠাতে পারে এ কি জানত নাকি। বোধ হয় জানত, নইলে চারুদির রিপ্রেজেনটেটিভ বলবে কেন ওকে? চারুদির লোক বলেই ওর জোরটা যেন ঠুনকো নয় একটুও। অথচ যে বলছে, নিজে সে চারুদিকে পরোয়া কতখানি করে তা ধীরাপদ নিজের চোখেই দেখেছে সেদিন, নিজের কানেই শুনেছে। অবশ্য পরোয়া কাউকেই করে বলে মনে হয় না। ছোট সাহেবের ঘরে বসে স্বয়ং বড় সাহেবের উদ্দেশেই তো তার নিঃশঙ্ক ব্যঙ্গোক্তি শুনে এলো খানিক আগে।
চেয়ারের কাঁধে মাথা রেখে অমিতাভ ঘোষ পরম আয়েসে সিগারেট টানছে। গোটাকতক লম্বা টানে সিগারেট অর্ধেক।
কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, একটু বাদেই বিপরীত রোষে খুশির আমেজ খান-খান। অদূরের মিটার বসানো ড্রামগুলোর ওদিক থেকে একজন অল্পবয়সী কর্মচারী কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আধ ঘণ্টা মিটার দেখা হয়েছে, আর হিট দেওয়া দরকার আছে কি না।
চেয়ারের কাঁধে তেমনি মাথা রেখেই চীফ কেমিস্ট আগন্তুকের মুখের ওপর অলস দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একটা। – তুমি নতুন এলে এখানে?
জবাবে কর্মচারীটির নিবেদন, গত দু দিন চীফ কেমিস্টের অনুপস্থিতিতে মিস সরকার কাজ দেখেছেন … পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বদলে তিনি আধ ঘণ্টা মিটার দেখতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
যান্ত্রিক পরিবেশের সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ যেন বাজ পড়ল একটা।
গেট আউট।
চীফ কেমিস্টের গোটা মুখ রক্তবর্ণ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মারমুখো চিৎকার, সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের ওপর প্রচণ্ড চাপড়।
লোকটা সত্রাসে পালিয়ে বাঁচল। কাছে, দূরে সকলেই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। ধীরাপদ হতভম্ব।