কাল তুমি আলেয়া – ৪

চার

চিঠি এসেছে।

সুলতান কুঠিতে পিওনের পদার্পণ একেবারে নেই বলা ঠিক হবে না। মাসে এক-আধবার তাকে কুঠির আঙিনায় দেখা যায়। এলে সাধারণত রমণী পণ্ডিতের খোঁজ পড়ে। দু-চারটে জানা ঘর আছে, বিয়ের ঠিকুজি মেলানো বা দৈব সমাধানের এক-আধটা খোঁজখবর আসে তাঁর কাছে। খামে নয়, তিন নয়া পয়সা বা পাঁচ নয়া পয়সার পোস্টাকার্ডই যথেষ্ট।

দু-চার মাস অন্তর একাদশী শিকদারের কাছেও আসে এক-আধখানা পোস্টকার্ডের চিঠি। ছেলে অন্যত্র কোথায় চাকরি করে। কোথায় থাকে বা কি চাকরি করে সেটা এক শিকদার মশাই ছাড়া আর কেউ জানে না বোধ হয়। তবে তাঁর একখানা চিঠি পিওনের ভুলে একবার নাকি রমণী পণ্ডিতের হাতেই পড়েছিল। সে-চিঠিতে প্রেরকের নাম-ঠিকানা ছিল না, শুধু তারিখ ছিল। তবে পোস্ট অফিসের ছাপটা নাকি চোখে পড়েছিল পণ্ডিতের। সেই চিঠি কলকাতা থেকেই এসেছিল। খেয়াল না করেই পণ্ডিত চিঠিখানা পড়ে ফেলেছিলেন, তিন-চার লাইন মাত্র বয়ান—’টানাটানির সময়, বেশি টাকা দেওয়া সম্ভব নয়, তবু এবারের মত কিছু বেশি দিতে চেষ্টা করব।’

মেয়ে কুমুকে পড়ানোর খাতিরের সময় সেই চিঠির সমাচার পণ্ডিত নিজেই সঙ্গোপনে ধীরাপদর কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর ধারণা, ছেলে কলকাতাতেই থাকে, বছরান্তে একটা দিনও বুড়ো বাপ-মাকে দেখতে আসে না সেই লজ্জাতেই গোপন সেটা। তাঁর আরও ধারণা, মাসের গোড়ার দিকে এক-আধদিন ঘরে-কাচা জামা-কাপড় পরে শিকদার মশাইকে বেরুতে দেখা যায়—সেটা পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকা আনার উদ্দেশ্যে নয়, ছেলের বাড়ি থেকে টাকা আনার উদ্দেশ্যেই। যাই হোক, এখানে প্রায়- অথর্ব গৃহিণী আর প্রৌঢ়া বিধবা কন্যা নিয়ে শিকদার মশাইয়ের সংসার। দেশ-খোয়ানো ভিটেমাটি বিক্রীর কিছু পুঁজি তাঁর হাতে আছে। সে-প্রসঙ্গ অবান্তর, কখনো-সখনো পোস্টকার্ডে লেখা এক-আধটা চিঠি তিনিও পান, এটা ঠিক।

শকুনি ভটচার্যের কাছে চিঠি লেখার নেই কেউ। তিনি শিকদার মশাইয়েরও বয়োজ্যেষ্ঠ। তাঁর গোটা পরিবারটিই এখানে। বঙ্গচ্ছেদের আগে যজমানী করতেন কোথায়, ছেলেরাও চাকরি করতেন। গোলযোগের সূচনাতেই সব ছেড়েছুড়ে স্ত্রী-পুত্র- পুত্রবধূ-নাতি-নাতনীসহ এই কুঠিতে ঠাঁই নিয়েছেন। দুই ছেলেই প্রৌঢ় বয়সে শহরের উপকণ্ঠের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করেছেন। এ ছাড়া প্রাইভেটে ছেলে পড়ানোর কাজও তাঁরা সেখানেই জুটিয়ে নিয়েছেন। অতএব তাঁরা ঊষায় যান, নিশায় ফেরেন। ঘরে বৃদ্ধা গৃহিণী, পুত্রবধূ দুটি, এমন কি নাতনীরাও প্রায় অসূর্যস্পশ্যা। এ পরিবারে চিঠি আসার বালাই নেই।

এ-দিকের এলাকায় আর থাকল গণুদার সংসার। সেখানে শুধু সাইকেল-পিওন আসে আর দুটি খবরের কাগজ আসে। আর কেউ না বা কিছু না।

কিন্তু যে চিঠি এসেছে সেটা রমণী পণ্ডিতের নয়, একাদশী শিকদারের নয় বা গণুদার ধরেরও নয়। সেই চিঠি ধীরাপদর। যার কাছে কেউ কোনদিন চিঠি আসতে দেখেনি।

পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি নয়, হালকা নীল শৌখিন খাম একটা।

ধীরাপদ বাড়ি ছিল না। নতুন-পুরনো বইএর দোকানের মালিক দে-বাবুর নতুন বইএর বিজ্ঞাপন লেখার তাগিদে সকালে উঠেই বেরিয়েছিল। ডাকপিওন চিঠি দিয়ে গেছে কদমতলায় শকুনি ভট্টচাযের হাতে। হুঁকো-পর্বের পরে প্রাক-গাত্রোত্থানের মুহূর্তে। সন্তর্পণে উল্টেপাল্টে দেখে সেটা তিনি শিকদার মশাইয়ের হাতে দিয়েছেন। এ-রকম একটা তকতকে খাম জীবনে তিনি হাতে করেছেন কিনা সন্দেহ। খামটা বাড়িয়ে দেবার সময় রমণী পণ্ডিত সাগ্রহে ঘাড় বাড়িয়ে কৌতূহল মেটাতে চেষ্টা করেছেন। ওদিকে একাদশী শিকদারের নীরব বিস্ময়ও ভটচায মশাইয়ের মতই।

ধীরাপদর ঘর বন্ধ ছিল। জানালা দিয়ে খামটা ভিতরে ফেলে দেওয়া যেত, শিকদার মশাই তা করলেন না। সোনাবউদিকে ডেকে চিঠিখানা তার হাতে দিলেন। পাশের ঘরের বাবুর চিঠি, এলে দিয়ে দিও।

ধীরাপদর ফিরতে একটু বেলা হয়েছিল। তাড়াতাড়ি চান সেরে খেতে বেরুতে যাচ্ছিল সে। দিনের আহার সেই পুরনো হোটেলেই চলছিল। কুকারের টাকাটা ধীরাপদ পরদিনই সোনাবউদিকে ফেরত দিতে গিয়েছিল। সোনাবউদি টাকা রাখেনি বা হোটেলে খাওয়া সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করেনি। তারপর এ ক’দিনের মধ্যে আর চোখের দেখাও হয়নি।

সোনাবউদি চিঠি দিয়ে গেল। যেন প্রায়ই আসে এমনি চিঠি, আর প্রায়ই দিয়ে যায়—কোনো কৌতূহল নেই।

বিস্মিত নেত্রে খামের ওপর চোখ বুলিয়ে ধীরাপদ মুখ তুলে দেখে সোনাবউদি ততক্ষণে চৌকাঠ পেরিয়ে গেছে।

হোটেলের খাওয়া সেরে ঘরেই ফিরল আবার। অবাক সেও হয়েছে বটে। সেই রাতের পরে সত্যিই আবার চারুদি এমন অন্তরঙ্গভাবে যেতে লিখবে একবারও আশা করেনি। তার ঠিকানা অবশ্য রেখেছিল আর ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি করে বাড়িও পৌঁছে দিয়েছিল। ধীরাপদ ভেবেছিল, সেই আন্তরিকতা শুধু চক্ষুলজ্জার খাতিরে। নইলে ব্যবধান সে ভালই রচনা করে এসেছে। সমানে অসমানে করুণার সম্পর্ক, মিতালির নয়। চারুদির দুয়েতেই বাধবে।

কিন্তু এ-চিঠিতে না যাওয়ার দরুন অনুযোগ এবং অবিলম্বে আসার জন্য অনুরোধ সতেরো-আঠারো বছর আগে হস্টেলের সেই ছাত্র-জীবনের সঙ্গে মেলে। অভিমান- বশে দিনকতক দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করলে যেমন তাগিদ আসত! সেই তাগিদের প্রতীক্ষাও করত তখন, কিন্তু আজ যাবে কোন মুখে? ক্ষুধার যে চিত্র দেখিয়ে এসেছে তাতে শুধু অহঙ্কার নয় আঘাত দেবার বাসনাও ছিল। সেটা চারুদির বুঝতে বাকি নেই। তবু ডাকাডাকি কেন?

বিকেলের দিকে বারান্দায় সোনাবউদির সঙ্গে আর একবার দেখা হয়ে গেল। দুধওয়ালা টাকার জন্য বসেছিল, টাকাটা মেটাতে এসে ওকে দেখে একটু যেন স্বস্তিবোধ করল।—হিসেবটা ঠিক হল কিনা দেখুন তো—

হিসেবের ব্যাপারে সোনাবউদিও চট করে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। এ পর্যন্ত হিসেব- পত্র সব ধীরাপদই দেখে দিয়েছিল। এটা বোধ হয় গণুদার করা।

ঠিক আছে—

দুধওয়ালাকে বিদায় করে সোনাবউদি ঘরমুখো হয়েও ফিরে দাঁড়াল। একটু থেমে আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, আপনার দিদি কি লিখলেন?

নীল শৌখিন খাম দেখেই ধীরাপদ অনুমান করেছিল চিঠি কার। এখন দেখছে, অনুমানটা শুধু তার একার নয়।

যেতে-

গেলেন না?

জবাব না দিয়ে ধীরাপদ হাসল একটু। তার আপাদ-মস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে সোনাবউদি আবার বলল, জামা-কাপড় কাচা নেই বুঝি?…জামা তো গায়ে হবে না, ধুতি দিতে পারি। দেব?

হাসি করুণা বিরাগ বিদ্রূপ কোনটা কখন কার গায়ে এসে পড়ে ঠিক নেই। ধীরাপদ হেসেই জবাব দিল, গেলে এতেই হবে।

সোনাবউদি নিশ্চিত্ত যেন। — খামের বাহার দেখে আমি ভাবছিলাম হবে না বোধ হয়।

হাসি চেপে ঘরে ঢুকে গেল।

পরের কটা দিন ধীরাপদ একরকম ঘরে বসেই কাটিয়ে দিল। চারুদির চিঠি পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে ছুটে যাবার মত কোনো তাগিদ যে অনুভব করেনি সেটা সত্যি। এবারে সেখানে গেলে অনুকম্পা জুটবে হয়ত। সেটা বরদাস্ত হবে না। অনুগ্রহ দেখাবার মত সংগতি চারুদির আছে, অমন বাড়ি-গাড়িতেই প্রমাণ।…কিন্তু সে-সংগতি চারুদির এলো কোথা থেকে, কিসের বিনিময়ে? ফুটপাথে বাসস্টপের ধারে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে যে-বিনিময়ের প্রত্যাশায় তার সঙ্গে তফাত কতটুকু? আঠারো বছর আগে যে-চারুদিকে হারিয়ে শূন্য হৃদয়ে কলকাতার পথে পথে ঘুরেছে একদিন, সেই চারুদি হারিয়েই গেছে। তাই চিঠি পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে যাবার চিন্তাটা ধীরাপদ বাতিল করে দিতে পেরেছে।

কিন্তু একদিন চারুদির হারানোটা যেমন অঘটন, আঠারো বছর বাদে গ্রামোফোন- রেডিওর দোকানের সামনে অপ্রত্যাশিত যোগাযোগটা যে তেমনই এক নতুন সূচনার ইঙ্গিত, সেটা জানত না। জানলে চিঠি পেয়েই ছুটত। আর, তাহলে বিব্রতও হত না এমন।

দুপুর গড়িয়ে বসে বিকেল তখন। শুয়ে শুয়ে ধীরাপদ একটা পুরনো বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিল, বইয়ের দোকানের দে-বাবু আর ওষুধের দোকানের অম্বিকা কবিরাজের সঙ্গে একবার দেখা করে আসবে। আজও না গেলে দে-বাবু অন্তত মারমুখো হবেন।

সোনাবউদি এসে খবর দিল, আপনাকে বাইরে কে ডাকছেন, দেখুন—

ধীরাপদ বই নামালো। খবরটা সাদাসিধে ভাবেই দিতে চেষ্টা করেছে সোনাবউদি, কিন্তু তার চোখেমুখে চাপা আগ্রহ। বইয়ের দোকানের দে-বাবু আবার লোক পাঠালেন কিনা ভাবতে ভাবতে বাইরে এসেই ধীরাপদ একেবারে হতভম্ব।

কদমতলা ছাড়িয়ে অনতিদূরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে চারুদির ঝকঝকে মোটর গাড়িটা। পিছনের সীটে চারুদি বসে, পাশে আর একটি অপরিচিত মূর্তি—সিগারেট টানছে। এদিকে বিস্ময়ে বিমূঢ় সুলতান কুঠির প্রায় সমস্ত বাসিন্দারা। মোটরের গা ঘেঁষে হাঁ করে চেয়ে দেখছে গণুদার মেয়ে আর বাচ্চা ছেলে দুটো, আর রমণী পণ্ডিতের ছোট ছেলেমেয়ের দঙ্গল। কদমতলার বেঞ্চির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন রমণী পণ্ডিত, তাঁর খানিকটা তফাতে শকুনি ভটচায। অন্য মেয়ে-বউরা জানালা-দরজা দিয়ে উকিঝুঁকি দিচ্ছে। হুঁকো হাতে শিকদার মশাইও বেরিয়ে এসেছেন।

পরিস্থিতি দেখে ধীরাপদও হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই কাপড়ের খুঁটটা গায়ে জড়িয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল।

কি ব্যাপার?

এক লহমা তাকে দেখে নিয়ে চারুদি বললেন, ঠিকানাটা ঠিকই দিয়েছিলে তাহলে। ধীরাপদ বিব্রত মুখে পিছনের দিকে ঘুরে তাকালো একবার। ছেলে বুড়ো মেয়ে পুরুষের জোড়া জোড়া চোখ এদিকেই আটকে আছে। চারুদির পাশের সুদর্শন লোকটি কুশনে মাথা এলিয়ে সিগারেট টানছে আর পুরু চশমার ফাঁক দিয়ে আড়ে আড়ে কিছু যেন মজা দেখছে।

চারুদি জিজ্ঞাসা করলেন, আমার চিঠি পেয়েছিলে?

হ্যাঁ —মানে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু তুমি হঠাৎ? বসবে?

না, জামা পরে এসো।

ধীরাপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নামলে কোথায়ই বা বসাতো? বলল, কি কাণ্ড, এই জন্যে তুমি নিজে কষ্ট করে এসেছ। তুমি যাও, আমি পরে যাবখন-

আঃ। চারুদির মুখে সত্যিকারের বিরক্তি, সংয়ের মত বসে থাকতে পারছি না, তাড়াতাড়ি এসো।

অগত্যা জামা পরার জন্য তাড়াতাড়িই ঘরে আসতে হল তাকে। ভেবেছিল, দরজার আড়ালে সোনাবউদিকেও দেখবে। দেখল না। লোহার হুকে দুটো জামা ঝুলছে, দুটোই আধময়লা। তার একটা গায়ে চড়িয়ে চাদরটা জড়িয়ে নিল।

মোটর চলার রাস্তা নেই। এবড়োখেবড়ো উঠোন ভেঙে গাড়ি রাস্তায় পড়তে চারুদি সহজভাবে বললেন, তোমার এই বাড়ির লোকেরা বুঝি মেয়েদের গাড়ি চড়তে দেখেনি কখনো?

ধীরাপদ সামনে বসেছিল। পিছনের আসনেই তাকে জায়গা দেবার জন্যে চারুদি পাশের দিকে ঘেঁষে বসতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই সামনের দরজা খুলে ধীরাপদ সরাসরি ড্রাইভারের পাশের আসনে গিয়ে বসেছে। কথা শুনে ঘুরে তাকালো। হাসিমুখেই বলল, দেখেছে- গাড়ি চড়ে আমার কাছে আসতে দেখেনি কখনো।

চিঠি পেয়ে এলে না কেন? খুব জব্দ—

যেন ওকে জব্দ করবার জন্যেই তাঁর এই অভিনব আবির্ভাব। ধীরাপদ সামনের দিকে চোখ ফেরাল। চারুদির পাশের লোকটিকে আবারও দেখে নিয়েছে। আর একটা সিগারেট ধরিয়েছে। বছর বত্রিশ-তেত্রিশ হবে রয়েস। পরনের স্যুটটা দামী হলেও ভাঁজ-ভাঙা আর জায়গায় জায়গায় দাগ-ধরা। মাথার একরাশ ঝাঁকড়া চুলে বহুদিন কাঁচি পড়েনি। মুখ নাক আর চওড়া কপালের তুলনায় চোখ দুটো একটু ছোট বোধ হয়। পুরু লেন্স-এর জন্যেও ছোট দেখাতে পারে।

ধীরাপদ মনে মনে প্রতীক্ষা করছে, ভব্যতা অনুযায়ী চারুদির এবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু চারুদি তা করলেন না। একটা লোককে জোরজার করে ধরে আনা হয়েছে তাই যেন ভুলে গেলেন। তাঁর পাশের সঙ্গীটির উদ্দেশেই এটা- সেটা বলতে লাগলেন তিনি। বলা ঠিক নয়, সব কথাতেই অনুযোগের সুর। সে আবার অফিসে ফিরবে কিনা, ফেরা উচিত, কাজে-কর্মে একটুও মন নেই—সকলেই বলে।

সকলের আর দোষ কি, খেয়াল-খুশিমত চললে বলবেই। কত বড় দায়িত্ব তার, এ-ভাবে চললে নিচের পাঁচজনও ফাঁকি দেবেই। তাছাড়া নিজের ভবিষ্যৎও ভাবা দরকার-

থামো, বাজে বোকো না—

সামনে থেকে ধীরাপদও সচকিত হয়ে উঠল একটু। এমন কি একবার ঘাড় না ফিরিয়েও পারল না। সেই থেকে নিরাসক্ত ভাবে বসে সিগারেট টানাটা ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। উপেক্ষার মত লাগছিল। তাছাড়া চারুদির এমন অল্পবয়স্ক সঙ্গীটি কে সেই বক্র কৌতূহলও ছিল। কিন্তু এই স্পষ্ট গম্ভীর বিরক্তির ফলে একটু যেন শ্রদ্ধা হল। ধীরাপদ ফিরে তাকাতে চারুদি হেসে ফেললেন, দেখেছ, ও সব সময় এমনি মেজাজ দেখায় আমাকে-মেজাজ যে দেখায় তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি সেটা চারুদির খেয়াল নেই বোধ হয়। কিন্তু তাঁর উপদেশের ফলেই হোক বা যে কারণেই হোক, মেজাজীর মেজাজ তখনো অপ্রসন্নই মনে হল। প্যাকেট থেকে আর একটা সিগারেট বার করতে করতে আবারও অসহিষ্ণুতা জ্ঞাপন করল, কি বাজে বকছ সেই থেকে!

ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে থাকা অশোভন। ড্রাইভারের সামনের ছোট আর্শিতে চারুদিকে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তীর একাংশও। চারুদি খপ করে তার হাত থেকে সিগারেটটা টেনে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলেন-ধোঁয়া-ধোঁয়ায় সারা গায়ে গন্ধ হয়ে গেল—আমি তো বাজেই বকি সব সময়, বাজে কথা শোনার জন্য আমার সঙ্গে আসতে তোকে কে সেধেছিল?

লোকটা কে না জানলেও ধীরাপদর কৌতূহল এক দফা পাঁক-মুক্ত হয়ে গেল। উপদেশ বা অনুযোগের অধ্যায়ে চারুদি ‘তুমি’ করে বলছিলেন। এবারের বাৎসল্যসিক্ত ব্যতিক্রমটা কানে আসতে ধীরাপদ সুস্থ নিঃশ্বাস ফেলল। প্যাকেটে আর সিগারেট ছিল না, কারণ শূন্য প্যাকেটটা বাইরে নিক্ষেপ করা হল টের পেল। আর্শিতে শুধু চারুদিকেই দেখা যাচ্ছে এখন, পিছন ফিরে না তাকিয়েও ধীরাপদ অনুভব করল, বাৎসল্যের পাত্রটি তার দিকের জানালা ঘেঁষে ঘুরে বসেছে। অর্থাৎ চারুদির কথার পিঠে কথা বলার অভিলাষ নেই।

সেদিন রাতের অভ্যর্থনায় চারুদি অতিশয়োক্তি করেননি। দিনের আলোয় তাঁর বাড়িটা ছবির মতই দেখতে। ঝকঝকে সাদা ছোট্ট বাড়ি। দু’দিকের ফুলবাগানে বেশির ভাগই লালচে ফুল। ফটক থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত লাল মাটির রাস্তা।

বসার ঘরে চারুদির প্রতীক্ষায় এক ভদ্রলোক বসে। অবাঙালী, বোধ হয় পার্শী। তাঁকে দেখেই চারুদি ভয়ানক খুশি। বলে উঠলেন, কি আশ্চর্য, আপনি কতক্ষণ? আমার তো খেয়ালই ছিল না, অথচ ক’দিন ধরে শুধু আপনার কথাই ভেবেছি।

চারুদির মুখে পরিষ্কার ইংরেজি শুনে ধীরাপদ মনে মনে অবাক একটু। মনে পড়ে চারুদি ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন বটে, কিন্তু শুধু সেটুকুর দ্বারা এমন অভ্যস্ত বাক-বিনিময় সম্ভব নয়।

বোসো ধীরু বোসো, অমিত বোসো। নিজেও একটা সোফায় আসন নিয়ে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গেই আলাপে মগ্ন হলেন চারুদি। ভদ্রলোক ফুলের সমঝদার এবং ফুল-সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞ বোঝা গেল। কারণ রোগী যেমন করে চিকিৎসকের কাছে স্বাস্থ্য-সমাচার জ্ঞাপন করে, চারুদি তেমনি করেই তাঁর ফুল আর ফুল-বাগানের সমাচার শোনাতে লাগলেন।—ডালিয়া তেমন বড় হচ্ছে না, আরো সর্বনেশে কাশু পাতাগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছে। আর ন্যাপ ড্রাগন নিয়ে হয়েছে এক জ্বালা, শুটগুলো গলা বাড়িয়ে লম্বা হচ্ছে বলে মোটেই ভর-ভরতি দেখাচ্ছে না। প্যানজি? চমৎকার হয়েছে, দেখাচ্ছি চলুন—মিকি মাউসের মত কান উঁচু উঁচু করে আছে সব।…ফ্লক্স হয়েছে তো ভালো কিন্তু সব রঙে মিলেমিশে একেবারে খিচুড়ি—আলাদা আলাদা রঙের চারা যোগাড় করা যায় না? পপির তো বেশ আলাদা আলাদা রঙের বেড় হয়েছে। ক্রিসেনথিমাম খুব ভালো হয়েছে, কিন্তু সারাক্ষণই পোকার ভয়ে অস্থির আমি!

আশঙ্কায় চারুদির দেহে সুচারু শিহরণ একটু। ধীরাপদ হাঁ করে শুনছিল আর তাঁকে দেখছিল। বলার ধরনে সমস্যাগুলো তার কাছেও সমস্যার মতই লাগছিল। কাঁটা বিনা কমল নেই আর কলঙ্ক বিনা চাঁদ নেই। কাঁটা আর কলঙ্ক না থাকলে চারুদির গতি কি হত!

মোটরের সিগারেটখোর কোট-প্যান্ট-পরা সঙ্গীটি সোফায় শরীর এলিয়ে একটা রঙচঙা ইংরেজি সাপ্তাহিকে মুখ ঢেকেছে। একটু আগে চারুদির মুখে নাম শুনেছে অমিত। হাবভাবে মিতাচারের লক্ষণ কমই। অসহিষ্ণু বিরক্তিতে এক-একবার চোখ থেকে সাপ্তাহিক নামাচ্ছে, দুই-এক কথা শুনছে, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে-তারপর আবার মুখ ঢেকে সাপ্তাহিকের পাতা ওলটাচ্ছে।

কিন্তু চারুদি তাঁর ফুল আর ফুলবাগান নিয়ে হাবুডুবু। তাদের বসতে বলে ফুল- বিশেষজ্ঞটিকে নিয়ে বাগান পর্যবেক্ষণে চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাতের সাপ্তাহিক চটাস করে সামনের সেন্টার টেবিলের ওপর পড়ল। ধীরাপদ সচকিত। লোকটা উঠে বই-ভরা কাচের আলমারির সামনে দাঁড়াল, ঝুঁকে ভিতরের বইগুলো দেখল খানিক। ঝুঁকতে হবে, কারণ তার মাথা আলমারির মাথার সমান। কিন্তু একটা বইয়ের নামও পড়ল না। পাশের ছোট টেবিলে সাজানো ঝকঝকে অতিকায় কড়ি আর শামুকের খোলটা উল্টেপাল্টে দেখল একবার। আবার এসে ধুপ করে সোফায় বসল। অসহিষ্ণুতা নয়নাভিরাম।

আপনার নামটা কি?

আচমকা প্রশ্নটার জন্য ধীরাপদ প্রস্তুত ছিল না। নাম বলল।

চারু মাসি আপনার দিদি?

চারুদি বলেছে বোধ হয়, কিন্তু বললে আবার এ কেমনধারা জিজ্ঞাসা! ধীরাপদ মুশকিল কম নয়। বলল, অনেকটা সেই রকমই …

লোকটির দু চোখ নিঃশব্দে তার মুখের ওপর থেমে রইল খানিক। তারপর বলল, আমার নাম অমিত। অমিতাভ। অমিতাভ ঘোষ। আপনার দিদি আমার মাসি, নিজের মাসি নয়, অনেকটা সেই রকমই…

সঙ্গে সঙ্গে দমকা হাসিতে ঘরের আসবাবপত্রগুলো পর্যন্ত যেন সজাগ হয়ে উঠল। এমন কৌতুক-ঝরা হাড়-নড়ানো হাসি ধীরাপদ কমই শুনেছে। এই লোক এমন হাসতে পারে একদণ্ড আগেও মনে হয়নি।

কিন্তু তখনো শেষ হয়নি। একটু সামলে আবার বলল, আপনি হলেন তাহলে মামা, মানে অনেকটা সেই রকমই…

সঙ্গে সঙ্গে আবার। এবারের হাসিটা আরো উচ্চগ্রামের অথচ শ্রুতিকটু নয়। ধীরাপদও হাসতে চেষ্টা করছে। লোকটা বুদ্ধিমান তো বটেই, বেপরোয়া রসিকও। অমিত নয়, অমিতাভ…তেজোময়। হাসির তেজটা অন্তত বিষম।

হাসি থামতে সচিত্র সাপ্তাহিকটা হাতে তুলে নিল আবার। অন্য হাতে কোটের এ-পকেট ও-পকেট হাতড়াতে লাগল।— আপনার কাছে সিগারেট আছে?

ধীরাপদ মাথা নাড়ল, নেই। কেমন মনে হল, থাকলে ভালো হত।

একেবারে চুপ। একটু আগে অমন বিষম হেসেছে কে বলবে। ফলে ঘরটাই যেন গম্ভীর। ধীরাপদ আড়চোখে তাকালো, পড়ছেও না, ছবিও দেখছে না—শুধু চোখ দুটোকে আটকে রেখেছে। খানিক আগের সেই প্রচ্ছন্ন অসহিষ্ণুতার পুনরাভাস।

কাগজখানা নামিয়ে ভিতরের দরজার দিকে চেয়ে হঠাৎ হাঁক পাড়ল, পার্বতী – 1 সঙ্গে সঙ্গে কাগজ হাতেই উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়ে গলার স্বর আরো চড়িয়ে দিল, পাবতী!

সোফায় ফিরে এসে কাগজ খুলল।

আবার কোন্ প্রহসনের সূচনা কে জানে? যাকে ডাকা হল ধীরাপদ তার কথা ভুলেই গিয়েছিল এতক্ষণ। সেদিনের পরিবেশন করে খাওয়ানোটা ভোলার কথা নয়।

দু হাতে একটা চায়ের ট্রে নিয়ে খানিক বাদে পার্বতীর প্রায় যান্ত্রিক আবির্ভাব। ট্রেতে দু’ পেয়ালা চা। দিনের আলোতেও আজ তেমন কালো লাগছে না, পরনের শাড়িটা বেশ ফর্সা। আজও ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ধীরাপদর মনে হল, গৃহ পুরুষ— শূন্য হলেও চারুদি নিরাপদই বটেন। আঁটসাঁট বসনের শাসনে এই তনু-মাধুর্য ভারাবনত নয় একটুও, যৌবনের এ বিদ্রোহে পার্বত্য গাম্ভীর্য। প্রভাব আছে, ইশারা নেই।

ট্রে-সুদ্ধ আগে অমিত ঘোষের সামনে এসে দাঁড়াল। সে-ই কাছে ছিল। কিন্তু চায়ের বদলে সে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল। চেয়ে যে আছে তাও ঠিক খেয়াল নেই যেন।

মেয়েটা ভাবলেশশূন্য। দাঁড়িয়ে আছে পটের মূর্তির মত। ফিরে চেয়ে আছে সে-ও, কিন্তু সে চোখে কোনো ভাষা নেই। চায়ের ট্রে-টা যন্ত্রচালিতের মতই আর একটু এগিয়ে ধরল শুধু। এইবার ঈষৎ ব্যস্ততায় অমিতাভ ঘোষ ট্রে থেকে চায়ের পেয়ালা তুলে নিল।

দ্বিতীয় পেয়ালাটা ধীরাপদকে দিয়ে পার্বতী এক হাতে শূন্য ট্রে-টা ঝুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। দু-চার মুহূর্তের প্রতীক্ষা। কিন্তু গভীর মনোযোগে অমিতাভ ঘোষ চা-পানে রত। যেন শুধু এইজন্যেই একটু আগে অমন হাঁক-ডাক করে উঠেছিল। মন্থর পায়ে পার্বতী ভিতরে চলে গেল।

চুপচাপ চা-পান চলল। ধীরাপদ ভাবছে, চারুদি কতক্ষণে ফিরবে কে জানে? পাৰ্বতী!

ধীরাপদ চমকেই উঠেছিল এবারে। কি ব্যাপার আবার, চিনি চাই না দুধ চাই? কিন্তু চায়ের পেয়ালা তো খালি ওদিকে!

পার্বতী এলো। এবারে খালি হাতেই। তেমনি অভিব্যক্তিশূন্য নীরব প্রতীক্ষা। ড্রাইভারকে বলো এক প্যাকেট সিগারেট এনে দেবে। পেয়ালা রেখে আবার সাপ্তাহিক পত্র হাতে নিয়েছে।

ড্রাইভার নেই।

ও! মুখ তুলে তাকালো, সমস্যাটার সমাধান যেন নিশ্চয় রমণী-মূর্তির মুখেই লেখা। পার্বতী চলে গেল, যাবার আগে পেয়ালা দুটো তুলে নিল। পাছে এবার আবার ওর সঙ্গেই ভদ্রলোকের আলাপের বাসনা জাগে সেই ভয়ে ধীরাপদ মুখ ফিরিয়ে দূর থেকেই কাচের আলমারির বইগুলো নিরীক্ষণ করতে লাগল।

পাবতী!

ধীরাপদ তটস্থ। সেদিন চারুদির মুখে শোনা, একজনের সঙ্গে পার্বতীর ডাব-কাটা দা হাতে দেখা করতে এগনোর কথাটাই কেন জানি মনে পড়ে গেল।

এবারে মেয়েটা কাছে এসে দাঁড়ানোর আগেই হুকুম হল, সেদিন ক্যামেরাটা ফেলে গেছলাম, এনে দাও।

আবার প্রবর্তন এবং একটু বাদেই ক্যামেরা হাতে আগমন। ক্যামেরাটা ছোট হলেও দামী বোঝা যায়। সামনের সেন্টার টেবিলে সেটা রেখে পার্বতীর পুনঃপ্রস্থান। ও-মুখে ভাব-বিকার নেই একটুও–বিরক্তিরও না, তুষ্টিরও না।

পার্বতী—!

ধীরাপদ কি উঠে পালাবে এবার? বাইরে চারুদির বাগান দেখবে গিয়ে? এ কার সঙ্গে বসিয়ে রেখে গেল চারুদি তাকে? আড়চোখে তাকালো একবার, ছবি তোলার জন্যে ডাকেনি বোধ হয়, চামড়ার কেসের মধ্যে ক্যামেরাটা সেন্টার, টেবিলের ওপরেই পড়ে আছে।

পাৰ্বতী!

তার আগেই পার্বতী এসেছে। না, হাতে লাঠিসোঁটা বা ভাব-কাটা দা নয়, ছোট মোড়া একটা। অন্য হাতে বোনার সরঞ্জাম। মোড়াটা ঘরের মধ্যেই দরজার কাছাকাছি রেখে এগিয়ে এলো। হাতে শুধু বোনার সরঞ্জামই নয়, এক প্যাকেট সিগারেট আর একটা দেশলাইও। সে-দুটো সোফার হাতলে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল একটু।

ধীরাপদ মনে মনে বিস্মিত, ড্রাইভার তো নেই, এরই মধ্যে সিগারেট এলো কোত্থেকে? যে মার্কার সিগারেটের শূন্য প্যাকেট মোটরের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দেখেছিল সেই সিগারেটই।

এবারের আহ্বানটা কেন সেটা আর বোঝা গেল না। লোকটার দু হাতের মোটা মোটা আঙুলগুলি সিগারেটের প্যাকেট খোলায় তৎপর। সিগারেট কোথা থেকে বা কি করে এলো চোখে-মুখে সে প্রশ্নের চিহ্নও নেই। ধীরেসুস্থে পার্বতী মোড়ায় গিয়ে বসল, একবার শুধু মুখ তুলে নির্বিকার চোখ দুটো ধীরাপদর মুখের ওপর রাখল। তারপর মাথা নিচু করে বোনায় মন দিল।

ধীরাপদ আশা করছিল, ওই রমণী-মুখের পালিশ করা নির্লিপ্ততার তলায় কৌতুকের ছায়া একটু দেখা যাবেই। আর একটু সংকোচের আভাসও। ঘরের মধ্যে মোড়া এনে বসার একটাই অর্থ, ডাকাডাকি বন্ধ হোক।

কিন্তু কিছুই দেখলো না ধীরাপদ, না কৌতুক না সংকোচ। একেবারে স্থির, অচল —পার্বত্য। এমনটা সেই রাত্রিতেও দেখেনি। বোনার ওপর কাঁটা-ধরা আঙুল ক’টা নড়ছে, তাও যেন কলের মতই। অস্থির রোগীকে শাস্ত করার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক যেমন কিছু একটা ব্যবস্থা করে, ঘরের মধ্যে মোড়া এনে বসাটা তেমনিই একটা ব্যবস্থা যেন।

ব্যবস্থায় কাজও হল। ডাকাডাকি বন্ধ হল।…শান্ত একাগ্রতায় সিগারেট টানছে লোকটা, ধীরেসুস্থে সাপ্তাহিকের পাতা ওলটাচ্ছে, অলস চোখে বোনা দেখছে খানিক, সোফায় মাথা রেখে ঘরের ছাদও দেখছে।

এই নীরব নাটক আরো কতক্ষণ চলত বলা যায় না। দু হাত বোঝাই নানা রকমের ফুল নিয়ে মালী ঘরে ঢুকতে ছেদ পড়ল। কর্ত্রী বাগান থেকে তুলে পাঠিয়েছেন বোধ হয়। কিছু না বলে ফুলসহ সে পার্বতীর কাছে এসে দাঁড়াল। পার্বতী ইশারায় ভিতরে যেতে বলল তাকে। তারপর মোড়াটা তুলে নিয়ে সেও অনুসরণ করল।

অমিতাভ ঘোষ সিগারেটের শেষটুকু শেষ করে অ্যাশপটে গুঁজল। আর একটা সিগারেট ধরিয়ে দেশলাই আর প্যাকেট পকেটে ফেলল। তারপর ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যে বসে আছে, তাকে কোনরকম সম্ভাষণ জানানো প্রয়োজন বোধ করল না।

ধীরাপদ এতক্ষণ যা দেখেছে সে তুলনায় এ আর তেমন বিসদৃশ লাগল না। আরো আশ্চর্য, এতক্ষণের এই কাণ্ডটা নীতিগতভাবে একবারও অশোভন মনে হয়নি তার। অবাকই হয়েছে শুধু। লোকটার অদ্ভুত আচরণ কতটা বাহ্যিক তাও খুঁটিয়ে দেখতে ছাড়েনি। ওর চোখে ফাঁকি দেবে এমন নিপুণ অভিনেতা মনে হয় না। ধীরাপদ রোগ- নির্ণয় করে ফেলল- হেড কেস…বড়লোকের মজার হেড-কেস। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৌতূহল একটু থেকেই গেল।

চারুদি একাই ঘরে ঢুকলেন, ফুল-এক্সপার্ট বাগান থেকেই বিদায় নিয়েছেন। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির ফলে চারুদি বেশ শ্রান্ত। ধীরাপদকে একলা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, অমিত কোথায়, ভিতরে?

না, এই তো চলে গেলেন।

চলে গেল! সোফায় বসে পড়ে বললেন, ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। এখানে কি হাতের কাছে ট্যাক্সি পাবে, না ট্রাম-বাস পাবে! যাকে বলছেন তার সঙ্গে যে চলে গেল তার কোনো যোগ বা পরিচয় নেই মনে হতেই বোধ হয় প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন।—তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম, চা দিয়েছে তো, না তাও দেয়নি?

দিয়েছে।

এতক্ষণ একা বসিয়ে রাখার কৈফিয়ৎটা শেষ করে নিলেন। কি করি বলো, ভদ্রলোক এসে গেলেন, আমারও ওদিকে বাগান নিয়ে ঝামেলা, এটা হয় তো ওটা হয় না—ভদ্রলোক জানেন শোনেন খুব, পুণার পোচা নার্সারির লোক।

পোচা নার্সারির লোকের সম্বন্ধে ধীরাপদর কোনো আগ্রহ নেই, বরং অমিতাভ

ঘোষ সম্বন্ধে দু-চার কথা বললে শোনা যেত।

চলো ভিতরে গিয়ে বসি, শীগগির ছাড়া পাচ্ছ না। ধীরাপদ বলল, আজ একটু কাজ ছিল—

চারুদি উঠে দাঁড়িয়েছেন, ফিরে তাকালেন।—কাজও তাহলে কিছু করো তুমি। কি কাজ?

এখানে এই ঘরে বসে কি কাজের কথাই বা বলতে পারে ধীরাপদ। নতুন পুরনো বইয়ের দোকানের মালিক দে-বাবুর সঙ্গে দেখা করার কাজটা নিজের কাছেই তার জরুরী মনে হচ্ছে না। জবাব না দিয়ে হাসল একটু।

অন্দরমহলের প্রথম দুটো ঘর ছাড়িয়ে চারুদির শয়নঘর। দামী খাটে পরিপাটি শয্যা আর স্বল্প আসবাবপত্র। বেশ বড় ঘর, একদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার, তার পাশে ইজিচেয়ার। টেবিলে টেলিফোন, লেখার সরঞ্জাম। অন্য কোণে মস্ত ড্রেসিং টেবিল আর আলমারি একটা। মেঝেতে কুশন-বসানো গোটা দুই মোড়া।

বোসো-

চারুদি দোরগোড়া থেকে চলে গেলেন এবং একটু বাদেই আঁচলে করে ভিজে মুখ মুছতে মুছতে ফিরে এলেন। ধীরাপদর মনে পড়ল, আগের দিন বলেছিলেন ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল না দিলে মাথা গরম হয়ে যায়।

দাঁড়িয়ে কেন, বোসো-

শয্যার ওপরেই নিজে পা গুটিয়ে বসলেন, ধীরাপদ কাছের মোড়াটা টেনে নিল। তারপর কি খবর বলো—দাঁড়াও, আগে তোমাকে খেতে দিতে বলি-

খাট থেকে নামতে যাচ্ছিলেন, ধীরাপদ বাধা দিল। বোসো, আজ খাবার তাড়া নেই কিছু

কিচ্ছু না?

না, অবেলায় খেয়েছি।

সত্যি বলছ, না শেষে জব্দ করবে আবার?

ধীরাপদ হাসতে লাগল। সে-দিনে ওভাবে খেতে চাওয়ায় শুধু যদি জব্দ করার ইচ্ছেটাই দেখে থাকে বাঁচোয়া।

চারুদি আবার পা গুটিয়ে নিয়ে খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার চিঠি পেয়েও এলে না কেন?

আসব ভাইছিলাম…।

হুঁ, আসলে তোমার এড়াবার মতলব ছিল। নইলে কতকাল বাদে দেখা, আমি তো ভেবেছিলাম পরদিনই আসবে!

ধীরাপদ হাসিমুখেই বলে বসল, কতকাল বাদের দেখাটা সত্যিই তুমি জিইয়ে রাখতে চাইবে জানব কি করে? এবারে জানলাম।

চারুদি থতমত খেয়ে গেলেন একটু। তারপর সহজভাবেই বললেন, তোমার কথাবার্তাও বদলেছে দেখছি। এবারে জানলে যখন আর বোধ হয় গাড়ি নিয়ে হাজির হতে হবে না!

ধীরাপদ তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল। কিন্তু চারুদির তার আগেই কিছু যেন মনে পড়েছে। বললেন, আচ্ছা তোমার ঘরের সামনে ওই যে বউটিকে দেখলাম—সেই তো বোধ হয় খবর দিলে তোমাকে, কে?

ধীরাপদর হাসি পেয়ে গেল। মেয়েদের এই এক বিচিত্র দিক। এত লোকের মধ্যে চারুদিরও শুধু সোনাবউদিকে চোখে পড়েছে। নিজের অগোচরেই আঠারো বছরের ব্যবধান ঘুচতে চলেছে ধীরাপদর। গম্ভীর মুখে জবাব দিল, সোনাবউদি।

সোনাবউদি।

হ্যাঁ, গণুদার বউ।

চারুদি অবাক।- তারা কারা?

চিনলে না?

আমি কি করে চিনব?

ধীরাপদ হেসে ফেলল, ও-বাড়ির কাকেই বা চেনো তুমি!

হাসলেন চারুদিও…তাই তো, যাকগে তোমার খবর বলো, ওখানেই বরাবর আছ? হ্যাঁ।

কিন্তু বাড়িটার যা অবস্থা দেখলাম, ও তো যখন-তখন মাথার ওপর ভেঙে পড়তে পারে।

ও-বাড়ির অনেকেই সেই সুদিনের আশায় আছে, কিন্তু বাড়িটা নির্লজ্জের মত শুধু আশাই দিচ্ছে।

শুনে চারুদি কেন জানি একটু খুশিই হলেন মনে হল। মুখে অবশ্য কোপ প্রকাশ করলেন, কি বিচ্ছিরি কথাবার্তা তোমার।

শয্যায় পা-টান করে বসে আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরাখবর জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। ধীরাপদর এটা স্বাভাবিক লাগছে না খুব। গত আঠারো বছরের ব্যক্তিগত সব কিছুই যেন জানার আগ্রহ তাঁর। কোন পর্যন্ত পড়েছে, এম-এটা পড়ল না কেন, তারপর এ ক’বছর কি করেছে, এখন কি করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষের দিকে প্রায় জেরার মত লাগছিল। যেন চারুদির জানারই প্রয়োজন। উঠে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিয়ে এসে বসলেন আবার।

দিনের আলো বিদায়মুখী, তবু ঘরের আলো আর একটু পরে জ্বাললেও হত। ধীরাপদর মনে হল উনি মুখেই জেরা করছেন না, তাঁর চোখও সজাগ। আর জিজ্ঞাসাবাদের ফুরসৎ না দিয়ে বলল, এবারে তোমার পাত্রীর খবর বলো শুনি।

পাত্রীর খবর! চারুদি সঠিক বুঝলেন না।

যে-ভাবে জিজ্ঞাসা করছ ভাবলাম হাতে বুঝি জবর পাত্রী-টাত্রী কিছু আছে! উৎফুর মুখে চারুদি তক্ষুনি জবাব দিলেন, তোমার পাত্রী তো আমি! আর পছন্দ হয় না বুঝি? যে হতভাগা অবস্থা দেখছি তোমার, তোমাকে মেয়ে দেবে কে?

আজ উঠি তাহলে।

– চারুদি হেসে ফেললেন, না, অতটা হতাশ হতে বলিনে। ভেবে নিলেন একটু, তারপর নিরপেক্ষ মন্তব্য করে বসলেন, কিন্তু এভাবে এতগুলো বছর কাটানো পুরুষমানুষের পক্ষে লজ্জার কথা।

বলার মধ্যে দরদ কম‍ই ছিল, ধীরাপদ উষ্ণ হয়ে উঠল। যেন এমন একটা কথা বলার যোগ্যতা উনি নিজে অর্জন করেছেন। বিরক্তি চেপে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের সুরে বলল, তা হবে। কিন্তু যে ভাবে তুমি আমার খবর-বার্তা নিচ্ছ সেই থেকে, মনে হচ্ছিল লজ্জাটা ইচ্ছে করলে তুমিই দূর করে ফেলতে পারো।

চারুদি সোজাসুজি খানিক চেয়ে রইলেন তার দিকে, তারপর খুব স্পষ্ট করে জবাব দিলেন, পারি। তুমি রাজী আছ?

এমন প্রস্তাবের মুখে পড়তে হবে জানলে ধীরাপদ বিদ্রূপের চেষ্টা না করে খোঁচাটা হজম করেই যেত। কিন্তু যত না বিব্রত বোধ করল তার থেকে অবাকই হল বেশি। রমণী-মহিমায় রাজার রাজ্য টলে শুনেছে, এই বা কম কি। জবাবের প্রতীক্ষায় চারুদি তেমনি চেয়ে আছেন।

হাসিমুখে ধীরাপদ পরাজয়টা স্বীকার করেই নিল একরকম, যাক, তাহলে পারো বোঝা গেল—

তুমি রাজী আছ কিনা তাই বলো!!

এবারে ধীরাপদর দু চোখ তার মুখের ওপর ঘুরে এলো একবার। পরিহাসের আভাসমাত্র নেই, বরং ওর জবাবেরই নীরব প্রতীক্ষা দেখল। বিস্ময়ের বদলে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে কেমন, মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে চারুদির এতক্ষণের এত জেরা শুধু এই প্রশ্নটার মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোর জন্যেই। রমণী-মন-পবনের এ কোন ইশারা – ঠিক ধরতে পারছে না। রাজী হোক না হোক, এই বয়সে চারুদির এমন জোরের উৎসটা কোথায় জানার কৌতূহল একটু ছিল। হেসে বিব্রত ভাবটাই প্রকাশ করল, ঘাবড়ে দিলে যে দেখি, উপকার না করে ছাড়বে না?

একটু থেমে চারুদি বললেন, উপকারটা তোমার একার নাও হতে পারে। আর আবার কার – তোমারও?

চারুদি বিরক্ত হয়েও হেসে ফেললেন, বড় বাজে কথা বলো, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও না?

বিড়ম্বনার একশেষ। ধীরাপদ কেন যেন প্রসঙ্গটা এবারে এড়াতেই চেষ্টা করল। হস্টেলে থাকতে যেভাবে কথাবার্তা কইত অনেকটা সেই সুরেই বলল, এই না হলে আর মেয়েছেলে বলে, আঠারো বছর বাদে সবে তো দু দিনের দেখা—আঠারো দিন অন্তত দেখে নাও মানুষটা কোথা থেকে কোথায় এসে ঠেকেছি।

আমার দেখা হয়েছে, সে ভাবনা তোমার। তেমন যদি বদলেই থাকো, আজকের ব্যবস্থাও কাল বদলাতে কতক্ষণ?

সাফ জবাব। অর্থাৎ, দেবো ধন বুঝব মন–কেড়ে নিতে কতক্ষণ? কিন্তু এ নিয়ে ধীরাপদ আর বাক-বিনিময়ের অবকাশও পেল না। চারুদি খাট থেকে নেমে দাঁড়ালেন।

পার্বতী!

এই এক নামের আহ্বান-বৈচিত্র্য আজ অনেকবারই শুনেছে। পার্বতী দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। রাতের আলোয় হোক বা যে জন্যেই হোক, মুখখানা অতটা ভাবলেশশূন্য পালিশ করা লাগছে না এখন।

মামাবাবু এখানে খেয়ে যাবেন।

নির্দেশ শ্রবণ এবং প্রস্থান। এর মধ্যে আর কারো কোনো বক্তব্য নেই যেন। পার্বতী চলে যাবার পরেও ধীরাপদ হয়ত আপত্তি করত বা বলত কিছু, কিন্তু সে চেষ্টার আগেই চারুদি সোজা টেবিলে গিয়ে বসলেন। প্যাড আর কলম টেনে নিয়ে দু-চার মুহূর্ত ভাবলেন কি, তারপর চিঠি লিখতে শুরু করে দিলেন।

ধীরাপদ নির্বাক দ্রষ্টা।

রাত মন্দ হয়নি।

আজও চারুদির গাড়ি করেই ধীরাপদ বাড়ি ফিরছে। বুকপকেটের খামটা বার দুই উল্টে-পাল্টে দেখেছে। এ আলোয় দেখা সম্ভব নয়, অস্বস্তিকর কৌতূহলে হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করেছে শুধু।

তেমনি নীল খাম, যেমন ডাকে এসেছিল সেদিন। অপরিচিত নাম, অপরিচিত ঠিকানা। পরিচ্ছন্নভাবে আঁটা, চারুদি খাম আঁটেন বটে। এ-মাথা ও-মাথা নিশ্ছিদ্র। ধীরাপদর কৌতূহল অনেকবার ওই বন্ধ খামের ওপর থেকে ব্যাহত হয়ে ফিরে এসেছে।

আকাশের পরীরা একবার নাকি বড় মুশকিলে পড়েছিল। বিধাতার বরে তাদেরও বর দেবার ক্ষমতা জন্মেছিল। কিন্তু ওদিকে যে বরের যুগের বিশ্বাসটা যেতে বসেছে বেচারীরা জানত না। বর দেবার জন্যে তারা মানুষের রাজ্যে যখন-তখন এসে ঘুর- ঘুর করত আর বর দেবার ফাঁক খুঁজত। চুপি চুপি অনুরোধ-উপরোধও করত একটা বর প্রার্থনা করার জন্যে। একেবারে করুণদশা তাদের।

গল্পটা মনে পড়তে ধীরাপদর প্রথমে মজাই লাগছিল। এই আঠারো বছরে চারুদিরও হয়ত কিছু দেবার ক্ষমতা জন্মেছে, কিন্তু নেবার লোক জোটেনি নাকি?

চারুদি বর গছালেন?

পরীর গল্পের শেষটা মনে পড়তে ধীরাপদ একা-একাই হেসে উঠেছিল। এক পরীর তাগিদে উত্যক্ত হয়ে একজন মানুষ বর চেয়েই বসেছিল। চাইবার আগে পরীর মিষ্টি মুখখানি ভালো করে দেখে নিয়েছিল। শেষে বলেছিল, বর দেবে তো ঠিক? পরী বলেছিল, বর দেবার জন্যেই তো হাঁসফাঁস করছি — সত্যাবদ্ধ হয়ে বর দেব না, বলো কি তুমি!

তাহলে ওই ডানা দুটি আগে খোলো।

কিছু না বুঝেই পরী ডানা খুলেছিল।

এবারে আমার রমণীটি হয়ে এখানেই থেকে যাও।

ভাবতে মন্দ মজা লাগছিল না ধীরাপদর, বর গছিয়ে ফেলে চারুদি যদি বিপদই ডেকে এনে থাকেন নিজের! চিঠিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করল আবারও, আষ্টেপৃষ্ঠে আঁটা-বরের নমুনাটা জানা গেল না।

চিঠি হাতেই থাকল। ভাবছে। প্রথম কৌতূহল আর কৌতুকানুভূতির পরে ভাবনাটা বাস্তবের দিকে গড়াতে লাগল। চিঠি নিয়ে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে হবে কাল বা পরশুর মধ্যেই। চারুদির সেই রকমই নির্দেশ। পরশু রবিবার, কি হল না হল সোমবার চারুদিকে এসে খবর দিতে হবে। চিঠি হাতে নিয়েও ধীরাপদ একটু আপত্তি করেছিল, বলেছিল, একেবারে অপাত্রে করুণা করছ চারুদি, চাকরিতে অনেকবার মাথা গলিয়েছি, কোথাও মানিয়ে নেওয়া গেল না—

চারুদি খানিক মুখের দিকে চেয়ে থেকে জবাব দিয়েছেন, সেটাই ভরসার কথা, খুব তাহলে বদলাওনি তুমি!

ধীরাপদর দুর্বোধ্য লেগেছিল। আগাগোড়াই দুর্বোধ্য লাগছে এখনও। কার সঙ্গে দেখা করতে হবে? চাকুরে না ব্যবসাদার? যাই হোন, বড়লোক নিশ্চয়ই। কিন্তু কে চেনে তো না! কলকাতা শহরে কমলার ভাণ্ডারী তো একটি দুটি নয়-ছড়াছড়ি। এক-একজনের বিত্তের অঙ্ক শুনলে হার্টফেল করার দাখিল। ক’জনকেই বা চেনে সে।

তবু কে ভদ্রলোক?

স্মৃতির পটে ধীরাপদ একটা মূর্তি হাতড়ে বেড়ালো কিছুক্ষণ। মুখ স্পষ্ট ধরা পড়ছে না। ধীর, গম্ভীর অথচ মুখখানা যাঁর হাসি-হাসি, কানের দু পাশের চুলে একটু একটু পাক ধরায় যাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে প্রায় ছেলেমানুষ মনে হত নিজেকে।

তিনিই কি?

কিন্তু তাঁর তো নিজের গাড়িও ছিল না তখন। চারুদির গাড়িতেই ঘুরে বেড়াতেন। চিঠি নিয়ে দেখা করতে যাবে কি যাবে না সেটা পরের কথা। বোধ হয় যাবেই না, চিঠিতে চারুদি ওর হয়ে সংস্থান ভিক্ষা করেছেন কিনা কে জানে? একবার দেখতে পারলে হত কি লিখেছেন। কিন্তু তার তাগিদ নেই জেনেও চারুদির এত আগ্রহ কেন? চারুদির এই ব্যাপারটাই অদ্ভুত ঠেকেছে। শুধু এই ব্যাপারটা নয়, আজকের গোড়া থেকে সবটাই। এর আগের দিন যে-চারুদিকে দেখেছিল, এমন কি পোচা নার্সারির সেই ফুল-বিশেষজ্ঞটির সামনে সমস্যা-ভারাক্রান্ত যে চারুদিকে দেখেছিল, তার সঙ্গে এই চারুদির বেশ তফাত।

এই চারুদির ভিতরে যেন অনেক সমস্যা। এই চারুদি প্ল্যান করতে জানে। ধীরাপদ ভাবছে, কিছু একটা জট ছাড়াবার মত করেই ভাবছে। চিঠিতে ডেকে পাঠানো সত্ত্বেও ও যায়নি, গাড়ি হাঁকিয়ে চারুদি নিজেই এসে ওকে ধরে নিয়ে গেছেন। অস্বাভাবিক আগ্রহে ওর এই অলস মরচে-ধরা জীবনের খবরাখবরও জানতে চেয়েছেন। জেনে খুব যে দুঃখিত হয়েছেন মনে হয় না। উল্টে মনে হয়েছে, ওর এই জোড়াতাড়া অবস্থাটাই কিছু একটা উদ্দেশ্যের অনুকূল তাঁর। চারুদি স্নেহ করতেন, ভালও বাসতেন হয়তো—কিন্তু সেই স্নেহ বা ভালবাসাও ছিল ভক্তের প্রতি করুণার মতই। তার বেশি কিছু নয়। ভক্তের প্রতি মায়া একটু-আধটু কার না থাকে? কিন্তু এই দেড় যুগেও সেটা অটুট থাকার কথা নয়। উল্টো হওয়ার কথা এখন। চারুদির এই প্রাচুর্যের মধ্যে সে তো মূর্তিমান ছন্দপতন। তাঁর বিস্মৃতিকামী জীবনের এই অঙ্কের ও তো কোনো সুবাঞ্ছিত দর্শক নয়, বরং স্মৃতির কাঁটার মতই।

চারুদিরই তাকে এড়িয়ে চলার কথা সব দিক থেকে।

তার বদলে এই চিঠি। কি চিঠি কে জানে? উদ্দেশ্য যাই হোক, তার দারিদ্র্যটাই ফলাও করে এঁকে দেননি তো? দিক, যাচ্ছে কে!

কিন্তু এই এক চিঠির তাড়নায় পরের দিনটাও প্রায় ভেবে ভেবেই কেটে গেল। এমন কি এই ভাবনার ফাঁক দিয়ে তার প্রতি সুলতান কুঠির বাসিন্দাদের সদ্যজাগ্রত কৌতূহলও দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। গত রাতে ধীরাপদ দূর থেকে গাড়ি ছেড়ে দেয়নি, অন্যমনস্কতার ফলে গাড়িটা সুলতান কুঠির আঙিনার মধ্যেই ঢুকে পড়েছিল।

মধ্যাহ্নে হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার সময়ে সোনাবউদির সঙ্গে একবার চোখোচোখি হয়েছিল। সোনাবউদি নিজের ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে মুচকি হেসে সরে গেছে। ঘরে এসে সরাসরি জেরা করতে বসলে বরং ধীরাপদ খুশি হত। কথায় কথায় সবই বলা যেত সোনাবউদিকে। ঠাট্টা করুক আর যাই করুক; পরামর্শ ঠিক দিত।

কিন্তু আসার সময় আসাটা সোনাবউদির রীতি নয়।

চারুদির চিঠি নিয়ে নির্দেশমত কাল একবার দেখা করে আসার কথাই ধীরাপদ ভাবছে এখন। না গেলে চারুদি আবারও এসে উপস্থিত হবেন কিনা ঠিক কি! আর একটা কথাও আজ ভাবছে। শুধু প্রাচুর্য নয়, চারুদির চলনে-বলনে বেশ একটা আত্মপ্রত্যয়ী মর্যাদাবোধ ধীরাপদ লক্ষ্য করেছে। অকারণে একটা হালকা ব্যাপার করে বসে চারুদি নিজেকে খেলো করতে পারেন সেটা আজ আর একবারও মনে হচ্ছে না।

ঠিকানা মিলিয়ে ধীরাপদ যে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল, চারুদির বাড়ি দেখার পর এমন একটা বাড়িতে আসছে একবারও কল্পনা করেনি। বেঢপ গঠন, স্ফীতি আছে ছাঁদ-ছিরি নেই। খুব পুরনো নাও হতে পারে, কিন্তু অনেকখানি অযত্ন আর উপেক্ষা নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে বোঝা যায়। এক যুগের মধ্যেও ওর বাইরের অবয়বে অন্তত রঙ পালিশ পড়েনি।

রাস্তা ছাড়িয়ে একটা কানা গলির মুখে বাড়িটা। সামনেই ছোট উঠোনের মত খানিকটা জায়গা। সেখানে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে। একটা ছোট একটা বড়। ছোটটা ধপধপে সাদা, নতুন। বড়টা গাঢ় লাল রঙের, তার চালকটি মাঝের গদিতে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। ছোট গাড়ির চালকের আসন শূন্য।

ধীরাপদ দরজার কাছে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। বাড়িতে জনমানব আছে বলে মনে হয় না। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে, জানালাগুলোও বেশির ভাগই বন্ধ। ভিতরে ঢুকেই ডাইনে বাঁয়ে ঘর, সামনে দোতলার সিঁড়ি। দরজার কোণে কলিং বেল চোখে পড়ল একটা। আরো একটু অপেক্ষা করে অগত্যা ধীরাপদ সেটাই চড়াও করে দেখল একবার।

একটু বাদে বাঁ দিকের ঘর থেকে মাঝবয়সী একজন লোক এসে দাঁড়াল। ঠাকুর- চাকর বা সেই গোছেরই কেউ হবে। শয্যার আরাম ছেড়ে উঠে আসতে হয়েছে বোধ হয়, কারণ শীতে লোকটার গায়ে কাঁটা দিয়েছে। এক কথার জবাবে তিন কথা বলে সম্ভাব্য দায় সেরে ফেলতে চেষ্টা করল সে। ধীরাপদ জানল হিমাংশু মিত্রের এই বাড়ি, কিন্তু সাহেব এখন ব্যস্ত-মিটিং করছেন, আগের থেকে ‘এপোন্টমেন’ না থাকলে দেখা হওয়া শক্ত। ইচ্ছে করলে সে ওপরে গিয়ে খোঁজ নিতে পারে।

ধীরাপদ মোলায়েম করে বলল, একবার খবর দিলে হত না?

লোকটা তার দরকার মনে করল না, কারণ ওপরে লোক আছে, তাছাড়া ছোট সাহেবও আছেন, দেখা যদি হয় ওপরে গেলেই হবে। আর কালবিলম্ব না করে সে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

অতএব পায়ে পায়ে ঊর্ধ্ব-পথে।

দোরগোড়ায় বেয়ারা না দেখে দ্বিধান্বিত চরণে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। আর দু-চার মুহূর্তের একটা নয়নাভিরাম দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে বিব্রত বোধ করতে লাগল। বড় হলঘর একটা, বেশ সাজানো-গোছানো। তার মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে বড় পোর্টফোলিও ব্যাগ হাতে একটি মেয়ে। সামনের দিকে মুখ করে আছে বলে মুখের আধখানা দেখা যাচ্ছে। হলের ওধারে আর একটা ঘর। মাঝের হাফ- দরজার সামনে ফাইল হাতে একটি ফিটফাট তরুণ ওখান থেকেই হাতের ইশারায় মেয়েটিকে কিছু বলছে। হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে খুব সম্ভব আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার অনুরোধ। এদিকে মেয়েটির মুখে মৃদু হাসি। জবাবে ফোলিও ব্যাগসুদ্ধ বাঁ হাত তুলে ডান হাতের আঙুলে করে ঘড়ির কাঁটা ইশারা করছে সে।

সেইক্ষণে আবির্ভাব।

খুব শুভ আবির্ভাব নয় বোধ হয়।

এদিকে ফিরে ছিল বলে দূরের মানুষটিরই আগে দেখার কথা ওকে। সে-ই দেখল। ধীরাপদ ধরে নিল এই ছোট সাহেব। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেয়েটিও ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ধীরেসুস্থে এগিয়ে এলো। এইটুকুর মধ্যেই ধীরাপদর মনে হল, আসাটা রমণীয় ছন্দের নয় ঠিক, কিছুটা পুরুষ-সুলভ নির্লিপ্ত ঢঙের।

কাকে চান? ওকে নীরব দেখে মেয়েটিই জিজ্ঞাসা করল।

হিমাংশুবাবু-

এক পলক দেখে নিয়ে বলল, মিঃ মিত্র এক্ষুনি উঠে পড়বেন, আপনি কোথা থেকে আসছেন?

ফ্যাসাদ কম নয়, বলবে চারুদির কাছ থেকে? বলল, একটা চিঠি ছিল, তাঁকে দিতে হবে—

হাত বাড়াল, দিন। সামান্য কথাটা বলতেও ইতস্তত করছে দেখেই হয়ত প্ৰচ্ছন্ন বিরক্তি একটু।

এই গণ্ডগোলে পড়তে হবে জানলে ধীরাপদ চিঠির কথা বলত কিনা সন্দেহ।

খামটা উল্টে-পাল্টে দেখে নিয়ে মেয়েটি আর একবার তাকালো। ঠিকানায় মেয়েলী অক্ষর-বিন্যাস দেখে সম্ভবত। তারপর চিঠি হাতে ফিরে চলল। হাফ-দরজা-সংলগ্ন সুদর্শনটি তখনো দাঁড়িয়ে। খামসুদ্ধ রমণী-বাহুর ইশারায় তার প্রতি আর একটু অবস্থানের ইঙ্গিত। পত্রবাহিকার এই ফিরে যাওয়াটুকুও তেমনি সবল-মাধুৰ্য-পুষ্ট বিলম্বিত লয়ের। দেখে পুরুষের চোখ একটু সজাগ হলেও আত্মবোধ কিছুটা দুর্বল হবার মত।

চিঠিখানা লোকটির হাতে দিতে সেও সেখান থেকে ধীরাপদর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল একটা, তারপর হাফ-দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। মেয়েটি ফিরে এসে একটা সোফায় বসল, হাতের অত বড় ব্যাগটা কোলের ওপর। সোফায় মাথা রেখে চোখ বুজল কিনা বোঝা গেল না।

একটু বাদে সম্ভবপর ছোট সাহেবটি বেরিয়ে এসে দূর থেকেই ধীরাপদকে ইঙ্গিতে জানালো, সে ভিতরে গিয়ে সাক্ষাৎ করতে পারে। তারপর এগিয়ে এসে মেয়েটির পাশে ধুপ করে বসে পড়ল। অসহিষ্ণু অভিব্যক্তি, তাই দেখে মেয়েটির মুখে চাপা কৌতুক।

দুজোড়া চোখের ওপর দিয়ে ধীরপায়ে ধীরাপদ হাফ-দরজার দিকে এগোলো। এদের চোখে নিজেকে অবাঞ্ছিত লাগছে বলেই অপ্রতিভ। ভিতরে ঢুকল।

সেক্রেটেরিয়েট টেবিলের ওধারে রিভলভিং চেয়ারটা ভরাট করে বসে আছেন একজনই। ঘরে দ্বিতীয় কেউ নেই। ভারি মুখে মোটা পাইপ, আয়ত চোখে লাইব্রেরী- ফ্রেম চশমা। পরনে দামী স্যুট।

মনে মনে ধীরাপদ এঁকেই দেখবে আশা করেছিল।

আঠারো বছর বাদে দেখেও চিনতে একটুও দেরি হল না। বয়সে এখন বোধ হয় সাতান্ন-আটান্ন। চারুদির শ্বশুরবাড়িতে এঁকেই দেখত মাঝে-সাজে। তেমনি গম্ভীর অথচ হাসিমুখ। কানের দু পাশের চুলে তখনই পাক ধরেছিল, এখন যে ক’টা চুল আছে সবই রেশমের মত সাদা। আঠারো বছর আগের দেখা সেই পুরুষোচিত রূপে বয়েসের দাগ পড়েছে, ছাপ পড়েনি।

ধীরাপদ দু হাত জুড়ে নমস্কার জানালো।

রিভলভিং চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে আয়েস করে বসলেন তিনি, দাঁতে পাইপ চেপে মাথা নাড়লেন একটু। সেই ফাঁকে নীরব ঔৎসুক্যে দেখেও নিলেন তাকে। তারপর ইঙ্গিতে সামনের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন।

চারুদির চিঠিটা টেবিলের ওপর খোলা পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে একবার চোখ বোলালেন। পরে চিঠি পকেটে রেখে চেয়ার ঘুরিয়ে ওর মুখোমুখি হলেন।— চাকরি চাই?

চাই বলতে বাধল। আর চাইনে বললে এল কেন? নিরুত্তরে হাসল একটু।

চশমার ওধারে দুটো চোখ তার মুখের ওপর আটকে আছে। দু-চারটে মামুলী প্রশ্ন, কতদূর পড়াশুনা করেছে, চাকরির কি অভিজ্ঞতা, এখন কি করছে ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য, ধীরাপদর কোনো জবাবই ত্বরিত নিয়োগের অনুকূল নয়। এর পরে খুব সহজভাবেই ভারী একটা বেখাপ্পা প্রশ্ন করে বসলেন তিনি। বললেন, যিনি আপনাকে চিঠি দিয়েছেন তিনি লিখেছেন আপনি খুব বিশ্বাসী, আই মিন ভেরি ভেরি রিলায়েবল — রিয়েলি?

ভদ্রলোকের দু চোখ শিথিল বিশ্লেষণরত। ধীরাপদ জবাব কি দেবে। বলল, সেটা উনিই জানেন…

উনি কত দিন জানেন?

ছেলেবেলা থেকে।

ভুরুর মাঝে কুঞ্চন-রেখা পড়ল। তার দিকে চেয়েই কিছু স্মরণ করার চেষ্টা। –ডোন্ট মাইন্ড, তাঁর সঙ্গে আপনার কত দিন পরে দেখা?

ধীরাপদর অনুমান, টেলিফোনে এঁর সঙ্গে চারুদির আগেই আলোচনা হয়েছে। তাই প্রশ্নের তাৎপর্য না বুঝলেও যথাযথ জবাব দিল, প্রায় আঠারো বছর….

দেখছেন নিরীক্ষণ করে, মুখ আরো একটু হাসি-হাসি।—এ প্রিটি লং টাইম, এতগুলো বছরে যে কোনো লোক একেবারে বদলে যেতে পারে…হোয়াট ডু ইউ সে?

বিদ্রূপের আভাস যেন। ধীরাপদর মুখে সংশয়ের চকিত ছায়া একটা। চুপচাপ চেয়ে রইল। তিনি আবার বললেন—বললেন না, পরামর্শ দিলেন যেন।— গরম জলের কেটলির মুখে কিছুক্ষণ ধরে রাখলে খাম খোলা সহজ হয়, নেক্সট টাইম ইফ ইউ হ্যাভ টু ডু ইট, ট্রাই দ্যাট ওয়ে!

এমন অশোভন ব্যাপারে ধরা পড়েই যেন ধীরাপদর এই অনভ্যস্ত পরিবেশে এসে পড়ার জড়তা গেল। নিজের নির্বিকার সহজতায় আত্মস্থ হতে সময় লাগল না। মনে মনে ভদ্রলোকের প্রশংসাই করতে হল। এই দাঁড়াবে ভাবেনি। তাঁর দিকে চেয়েই নিরাসক্ত জবাব দিল, চিঠিটা পড়ে ছিঁড়ে ফেলব বলে খুলেছিলাম। আমার জন্য চাকরি ভিক্ষা করা হয়েছে ভেবেছিলাম। তাতে আপত্তি ছিল।

চোরের মুখ হল না দেখেই ভদ্রলোক বিস্মিত হচ্ছিলেন, কথা শুনে বেশ অবাক। – চাকরির দরকার নেই?

ধীরাপদ হালকা জবাব দিল, আছে। তবে না পেলেও এখন আর তেমন কষ্ট হয় না। আচ্ছা নমস্কার-

সীট ডাউন প্লীজ-!

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার মুখে অপ্রত্যাশিত একটা তাড়া খেয়ে ধীরাপদ বসে পড়ল আবার। রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে পাইপ ধরানোর ফাঁকে তাঁর বক্র দৃষ্টি আরো বারকতক তার মুখের ওপর এসে পড়ল। আগের মতই হাসি-হাসি দেখাচ্ছে, তুমি কাল থেকে এসো, শ্যাল বি গ্লাড টু হ্যাভ ইউ উইথ আস—

ইলেকট্রিক বেল-এর বোতাম টিপলেন। প্যাঁ-ক করে শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের তরুণটির প্রবেশ। পাইপের মুখ হাতে নিয়ে হিমাংশু মিত্র উঠে দাঁড়ালেন। সৌজন্যের রীতি অনুযায়ী উঠে দাঁড়ানো উচিত ধীরাপদরও, কিন্তু সেটা খেয়াল থাকল না। সে দেখছে, এখনো তেমনি উন্নত ঋজু স্বাস্থ্য ভদ্রলোকের।

ধারাপদকে দেখিয়ে আগন্তুকের উদ্দেশে বললেন, ইনি কাল থেকে আমাদের অর্গ্যানিজেশনে আসছেন—নাম-ঠিকানা লিখে নাও আর কোন কাজ সুট করবে আলাপ করে দেখো, তারপর কাল আলোচনা করা যাবে। ধীরাপদকে বললেন, এ আমার ছেলে সীতাংশু-অর্গ্যানিজেশন চীফ।

ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল। নমস্কার বিনিময়।

হিমাংশু মিত্র ততক্ষণে দরজার কাছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে এসেছে?

ছেলে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল।

এলে বলিস তার জন্য আমি ঘড়ি ধরে দু ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। ফ্যাক্টরীতে টেলিফোন করেছিলি?

নেই সেখানে।

হাফ-দরজা ঠেলে ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। অর্গ্যানিজেশন চীফ সীতাংশু মিত্র এবারে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। একটুও তুষ্ট মনে হল না। বসতেও বলল না। হাবভাবে ব্যস্ততা। জিজ্ঞাসা করল, কি চাকরির জন্যে এসেছেন বলুন তো?

ধীরাপদ হাসিমুখে জবাব দিল, আপনাদের কোনো চাকরির সম্বন্ধেই আমার কিছু ধারণা নেই।

টেবিলের প্যাড টেনে নিল।—নাম-ঠিকানা বলুন।

হাফ-দরজা ঠেলে এবারে ঘরে ঢুকল সেই মেয়েটি। শিথিল চরণে এবং নিরাসক্ত মুখে ভিতরে এসে দাঁড়াল। হাতে ব্যাগটা নেই।

ধীরাপদ নাম-ঠিকানা বলল। এর পর আলাপ আরো অস্বস্তিকর লাগবে ভাবছে। কিন্তু আলাপ আজকের মত ওখানেই শেষ দেখে হাঁফ ফেলে বাঁচল। সীতাংশু মিত্র বলল, আচ্ছা আপনি কাল তো আসছেন, কাল কথা হবে আজ একটু ব্যস্ত আছি। ওকে বিদায় করার ব্যস্ততায় কাল কখন আসবে তাও কিছু বলল না। নিস্পৃহ রমণী-দৃষ্টি টেবিল-জোড়া কাচ আবরণের নিচের চার্টটার ওপর।

রাস্তায় নেমে ধীরাপদ পায়ে পায়ে হেঁটে চলল। হাসিই পাচ্ছে এখন। কি চাকরি করতে হবে বা কত মাইনে পাবে সে-সম্বন্ধে খুব কৌতূহল নেই। শুধু ভাবছে ব্যাপার মন্দ হল না।

পাশ দিয়ে সেই টকটকে লাল বড় গাড়িটা বেরিয়ে গেল। ধীরাপদ সচকিত একটু। ভদ্রলোক ওকে দেখেননি, পিছনের সীটে মাথা রেখে পাইপ টানছেন। গাড়ি আড়াল হয়ে গেল।

মনে মনে ধীরাপদ আবারও তারিফ করল ভদ্রলোকের। চোখ বটে। কি করে বুঝলেন চিঠি খোলা হয়েছে সেটা এখনো বিস্ময়। কথাবার্তা চালচলন সুষ্ঠু ব্যক্তিত্ব- ব্যঞ্জক। অথচ মুখখানি হাসি-হাসি। আঠারো বছর আগেও প্রায় এই রকমই দেখেছিল মনে পড়ে।

ধীরাপদ থমকে দাঁড়াল।

আর একটা গাড়ি। সেই ধপধপে সাদা ছোট গাড়িটা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। ড্রাইভ করছে অর্গ্যানিজেশন চীফ সীতাংশু মিত্র। পাশে মেয়েটি। আত্মপ্রতীতি-চেতন। পলকের দেখা বসার শিথিল ভঙ্গিটুকুও সেই রকমই মনে হল। ধীরাপদর আবির্ভাবে ছোট সাহেবটির বিরূপ অভিব্যক্তির হেতু বোঝা গেল এতক্ষণে। ও এসে বড় সাহেবকে আটকানোর ফলে এদের কিছু একটা আনন্দের ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছিল বোধ হয়। ওপরের হলঘরে ইঙ্গিতে একজনের ঘড়ির কাঁটা দেখানোর দৃশ্যটা মনে পড়ল। ধীরাপদ হাসতে লাগল, বিসদৃশ অভ্যর্থনার দরুন আর কোনো অভিযোগ নেই। গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেয়নি এই ঢের। কত হবে বয়সে? মেয়েটির পঁচিশ-ছাব্বিশ, ছেলেটিরও আঠাশ- ঊনত্রিশের বেশি নয়। কিন্তু মেয়েটির কাছে ছেলেটি একেবারে ছেলেমানুষ যেন।

কোন দিকে যাবে ভাবতে গিয়ে ধীরাপদর মনে হল আজই একবার চারুদির সঙ্গে দেখা করা দরকার। এক্ষুনি। কাল যাবার কথা। চিঠি খোলার ব্যাপারটা চারুদি আর কারো মুখে শোনার আগে ও নিজেই বলবে। স্পষ্ট স্বীকৃতিরও মর্যাদা আছে, আপাতত ওটুকুই হাতের কড়ি। আজ যাওয়াই ভালো।

দূর কম নয় চারুদির বাড়ি। দুটো বাসে মিলিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ।

গেট পেরিয়ে অন্যমনস্কের মতই দালানের দিকে এগোচ্ছিল, হঠাৎ ধারাপদর দু চোখ যেন একস্তুপ লালের ধাক্কায় বিষম হোঁচট খেল। পা দুটো স্থাণুর মত আটকে গেল।

হতভম্ব। চোখ দুটো কি গেছে! গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত লাল মাটির রাস্তা আর বাগান-ভরা লাল ফুলের সমারোহের মধ্যে সিঁড়ি-লগ্ন লাল নিশানাটা তেমন বিচ্ছিন্ন মনোযোগে লক্ষ্য করেনি।

সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হিমাংশু মিত্রের টকটকে লাল গাড়িটা।

সম্বিৎ ফিরতে ধীরাপদ চকিতে ঘুরে গেটের দিকে পা চালিয়ে দিল আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *