কাল তুমি আলেয়া – ৩

তিন

পাশের ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেই সোনাবউদির গোটা সংসারটা চোখে পড়ে। মন্তু ঘর। যে দুটো ঘরে থাকত এই একটাই তার চারগুণ। কালের জরায় ঘরের জলুস গেছে, কাঠামো যা আছে তাও তাক লাগার মত। ধীরাপদর মনে আছে ঘর দেখাতে এনে সোনাবউদির দু চোখে আনন্দের বন্যা দেখেছিল। রাজপুরুষের আমলে এটা নাকি ছিল মজলিস কোঠা। ভিতরের দরজা দিয়ে সঙ্গে একটা খুপরি ঘর। এটার তুলনায় বেখাপ্পা ছোট। সোনাবউদি আরো খুশি, এটা মজলিস ঘর আর ওটা কী?

ওটা কি বা কেন, ধীরাপদ ভাববার অবকাশ পায়নি তখনো। কি করেই বা পাবে, একাদশী শিকদার আর শকুনি ভট্টচার্যের গঞ্জনায় আর ওর ছাত্রী পড়ানোর দাপটে নাজেহাল হয়ে আগের দিন মাত্র মজলিস ঘরের বাস তুলেছেন রমণী পণ্ডিত। আর তার পরদিনই গর্দা আর সোনাবউদিকে ঘর দেখাতে নিয়ে এসেছিল ধীরাপদ। সোনাবউদির আনন্দ দেখে তারও আনন্দ হয়েছিল। বলেছিল, এটা বোধ হয় রসদ- ঘর, মজলিসের রসদ মজুত থাকত…।

এই রসদ-ঘর এখন গণুদার শয়নঘর।

প্রথম দিন থেকেই সেই ব্যবস্থা সোনাবউদির। প্রস্তাবনাটা ধীরাপদ আজও ভোলেনি। গণুদার দিকে চেয়ে বেশ হালকা করেই বলেছিল, যেমন রসদই হোক যোগাচ্ছে যখন— ভূমি ওই ঘরটাতেই থাকো।

যে ঘরে এতকাল থেকে এসেছে সে তুলনায় ওই খুপরি ঘরও স্বর্গ। তবু এমন গড়ের মাঠের মত জায়গা পড়ে থাকতে তাকে ওখানে ঠেলার ব্যবস্থাটা গণুদার মনঃপূত হয়নি। মৃদু আপত্তিও করেছিল, এত জায়গা থাকতে আবার ওখানে কেন, ও-ঘরে জিনিসপত্র —

শেষ করে উঠতে পারেনি। কাচের সরঞ্জামগুলো মুছে মুছে সোনাবউদি তাকে ওপর তুলে রাখছিল। সেখান থেকেই ফিরে তাকিয়েছিল শুধু। গণুদা আমতা আমতা করে বলেছে, ও ঘরটায় তেমন বাতাস লাগবে না বোধ হয়—

থাক, আর বেশি বাতাস লাগিয়ে কাজ নেই–

ধীরাপদর চোখে চোখ পড়তে সোনাবউদি হেসে ফেলে ভাড়া দিয়েছে, সং-এর মত দাঁড়িয়ে না থেকে একটু গোছগাছ করলেও তো পারেন!

একটু আগে বেশি ব্যস্ত হওয়ার জন্য তাড়া খেয়ে ধীরাপদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সোনাবউদি ঘরণী পটু। এত বড় ঘরটাকে বেশ সুবিন্যস্তভাবে কাজে লাগিয়েছে। একটা দিক ভাগ করে নিয়ে গৃহস্থালি পেতেছে, অন্যদিকে নিজের আর ছেলেমেয়েদের শোবার জায়গা। মাঝখানটা ফাঁকা। তার ওধারে একফালি ঢাকা বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা।

ধীরাপদ ঘরে ঢুকল। এক কোণে ঘাড় গুঁজে মেয়ে উমারাণী হাতের লেখা মক্স করছে। ঘরের মধ্যে চক্রাকারে ঘুরে মুখ দিয়ে একটা কল্পিত এঞ্জিন চালাচ্ছে পাঁচ বছরের টুনু। আর তার পরের বাচ্চাটা দিদির পাশে বসে নিবিষ্টচিত্তে এক খণ্ড কাগজ বহু খণ্ডে ভাগ করছে।

ওদিকে ফিরে বসে সোনাবউদি বাটিতে দুধ ভাগ করছিল। কারো পদার্পণ অনুমান করেই ফিরে তাকালো। তোলা উনুনে ছোট জলের কেটলিটা চাপিয়ে দিয়ে ঘরে এসে মেয়েকে বলল, খেয়ে নে গে যা, ওদের নিয়ে যা–

ধীরাপদর দিকে ফিরল, আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি?

না…।

সেই কখন থেকে তো উঠে বসে আছেন দেখলাম, এতক্ষণ কি করলেন?

আপনার প্রণামের ঘটা দেখে ভক্তিতত্ত্বের কূলকিনারা খুঁজছিলাম–

হেসে ফেলেও সামলে নিল–পেলেন?

না। চৌকির একধারে বসল সে।

পাপী-তাপী মানুষ, পাবেন কি করে– অমন সৎ ব্রাহ্মণ, পায়ের ধুলো পাওয়াও ভাগ্যি– বসুন, চা করে আনি।

উনুনে কেটলি চাপাতে দেখে মনে মনে ধীরাপদ এই ভয়টাই করছিল। যতটা সম্ভব সহজভাবেই বাধা দিল—চা থাক, কি কাজ আছে বলছিলেন?

দু বছরের মধ্যে সম্ভবত এই প্রথম চায়ে অরুচি। বাধা পেয়ে সোনাবউদি দাঁড়িয়ে গেল। প্রচ্ছন্ন কৌতুকাভাস। –চা থাকবে কেন, কটা দিন দিইনি বলে?

এই প্রসঙ্গ ধীরাপদ এড়াতে চেয়েছিল। আজ এই ঘরে আবার তার ডাক পড়াটা সহজভাবে নিতে পারেনি। নেওয়া সম্ভবও নয়। নয় বলেই বাইরের সহজতাটুকু বজায় রাখার তাগিদ। তাছাড়া, দিন তার একেবারে খারাপ যাচ্ছে না সে-রকম একটু আভাস সোনাবউদি পাক। নির্লিপ্ত জবাব দিল, কাল রাতের খাওয়াটা বড় বেশি হয়ে গেছে… এখনো ভার ভার লাগছে।

সোনাবউদি সেখান থেকেই মেয়েকে নির্দেশ দিল চায়ের কেটলিটা উনুন থেকে নামিয়ে রাখতে। তারপর ঠোঁটের ডগায় হাসি চেপে বেশ সাদাসিধে ভাবেই জিজ্ঞাসা করল, কাল রাতের খাওয়াটা অমন বেশি হয়ে গেল কোথায়?

আর কথা বাড়াতে আপত্তি নেই ধীরাপদর। –অনেককাল বাদে এক দিদির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তার ওখানে।

আপনার দিদি আছে জানতুম না তো!

নিজের দিদি নয়।

পাতানো দিদি? হেসে ফেলেও চট করেই গম্ভীর আবার। প্রাতরাশ শেষ করে ছেলেমেয়ে ঘরে ঢুকেছে। সোনাবউদি মেয়েকে আদেশ দিল বাপের খুপরি ঘরে বসে পড়তে। মায়ের মেজাজ মেয়ে ছেলে এমন কি ওই দু বছরের বাচ্চাটাও বুঝতে শিখেছে। বোনের সঙ্গে সঙ্গে তারাও সরে গেল। সোনাবউদির উৎফুল্ল হাসি তারপর।—আপনার যদি একটুও জ্ঞানগম্যি থাকত, পাতানো বউদি দেখেও শিক্ষা হল না, আবার পাতানো দিদি!

ধীরাপদ হাসিমুখেই জানিয়ে দিল, এ সম্পর্কটা তিরিশ বছর আগের। কি বলবেন বলুন, একটু বেরুব…

দিদির ওখানে যাবেন?

না।

ঈষৎ চিন্তিতমুখেই সোনাবউদি তাকে ডাকার কারণটা ব্যক্ত করল এবার। বলল, এমন দিনেই ব্রত সাঙ্গ হল, সৎ ব্রাহ্মণ দুজন আহার করবেন, কিন্তু কাকে দিয়েই বা ব্যবস্থা করি…..

ধীরাপদ অবাক। — ভটচায মশাই আর শিকদার মশাই?

মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত সোনাবউদির চিন্তাটা বাহ্যিক। বড় নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিল, হ্যাঁ, কপালগুণে ওঁরাই আজ গোপাল ঠাকুর।

আমাকে গিয়ে নেমতন্ন করতে হবে?

তাকে আঁতকে উঠতে দেখে সোনাবউদি এবারে হেসেই ফেলল। – আপনার নেম এঁরা নেবেন কেন? সে কাজটা আপনার দাদা কাল রাতেই সেরে রেখেছে। কিন্তু বাজারটা করাই কাকে দিয়ে, আপনার আবার দিদি জুটে যাবে জানলে ব্রতটা আপাতত সাঙ্গ না করলেও হত।

ভোরবেলার ব্যাপারটা স্পষ্ট হল এতক্ষণে। সদাচারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘরের মেয়ে ব্রত-পার্বণ পালন অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবু দুর্বোধ্য লাগছে। দু বছরের মধ্যে কোনরকম আচার-অনুষ্ঠান দেখা দুরে থাক, এ-সবে মতি আছে বলেও মনে হয়নি কখনো।

কিসের ব্রত ছিল?

তোরঙ্গ থেকে টাকা বার করে এনে সোনাবউদি ঠাট্টার সুরেই ফিরে জিজ্ঞাসা করল, ক’টা ব্রত আপনার জানা আছে? নিন, আর দেরি করবেন না।

টাকা নিয়ে ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল। – কি আনতে হবে?

হাতী ঘোড়া বাঘ ভালুক যা পান – হেসে ফেলল, যা ভালো বোঝেন আনবেন, নিন্দে না হলেই হল, আর একটু বেশি-বেশিই আনবেন—

বাজার করা এই প্রথম নয়, সপ্তাহে তিন-চার দিনই করতে হত। কিন্তু টাকার সঙ্গে কি আনতে হবে না হবে তারও একটা চিরকুট থাকত সোনাবউদির। আজ নেমন্তন্নের দিনেও সেটা নেই কেন অনুমান করা খুব শক্ত নয়। বাজারের পথে যেতে যেতে ধীরাপদ সেই কথাই ভাবছিল। নির্ভরতা দেখালো। আজ অনেক কিছুই দেখিয়েছে সোনাবউদি। সকালে প্রণামের ঘটা, দুপুরে আবার ওই দুজনেরই নেমতন্ন। তাঁরা এখন থেকে তুষ্টই থাকবেন বোধ হয়। ধীরাপদ বাইরে শান্ত, কিন্তু ভিতরটা তার তুষ্ট নয় একটুও। তার সঙ্গে নতুন করে এই আপসের চেষ্টা কেন সোনাবউদির, সে-ও কি ওঁদেরই একজন? ডাকলে কাছে আসবে, ঠেলে দিলে দূরে সরে যাবে? সোনাবউদির ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সহজতার মুখোশটা আপনি খসে গেছে। কি করবে স্থির করে নিতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি।

বাজার নিয়ে কুঠি-সংলগ্ন দারোয়ানের পোড়ো ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। এখান থেকেও তাদের ঘর বেশ খানিকটা পথ। ডাকল, শুকলাল আছ?

মাঝবয়সী দরোয়ান শুকলাল তক্ষুনি বেরিয়ে এলো। নোমস্কার ধীরুবাবু, কি খোবর বলেন-

খবর ভালো, আমার বিশেষ তাড়া আছে, তুমি এগুলো একটু পৌঁছে দিয়ে এসো তো—

ওনেক বাজার দেখি! হৃষ্টচিত্তে শুকলাল থলে দুটো নিল। কোন ঘর কার কাছে পৌঁছে দিতে হবে তার জানাই আছে।

নিশ্চিন্ত মনে ধীরাপদ বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল আবার। ভিতরে ভিতরে তারও এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে বৈকি। বাজার পৌঁছে দিয়েই শুকলাল ফিরে আসবে না। রান্নার বারান্দার কাছেই গ্যাঁট হয়ে বসবে। বাজার দেখে তারিফ করবে। তাই থেকেই জিনিসপত্রের দুর্মূল্যের কথা উঠবে, দিন-কালের কথা উঠবে। দুটো আলু একটা বেগুন একটুকরো কুমড়ো ইত্যাদি তার দিকে এগিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ওঠার তাড়া দেখা যাবে না। মুখ ফুটে চাইবে না কিছু, দিলে বরং সলজ্জ আপত্তি জানিয়েই গ্রহণ করবে সেগুলো।

সে এসে বসলেই সোনাবউদি হাসে।

…আজ হাসবে?

ধীরাপদ খুশি হতে চেষ্টা করছে, তবু কোথায় অস্বস্তি একটুখানি। মাঝে মাঝে বিমনাও হয়ে পড়ছে। নিজের ওপরেই বিরক্ত হল সে, যা করেছে বেশ করেছে –ও নিয়ে আর মাথা ঘামানো কেন, তার এখন অনেক কাজ।

কাজের তাগিদে দ্রুত পা চালিয়ে দিল।

কাজ বলতে বিজ্ঞাপন লেখার কাজ। সেও বাঁধাধরা কিছু নয়, যখন জোটে। আর বিজ্ঞাপন বলতেও ফলাও কোনো ব্যাপার নয়। ছোট ছোট দুটো কবিরাজের দোকান আর একটা পুরনো বইয়ের দোকানের সঙ্গে কি করে একদিন যোগাযোগ হয়েছিল আজ আর মনেও নেই। কবিরাজদের নতুন নতুন ঔষধ উদ্ভাবনে রোগ সারুক আর না সারুক, বিজ্ঞাপনের চটকে কাজ হয়। রোগীও তুষ্ট চিকিৎসকও তুষ্ট।

বিজ্ঞাপন আশা-সঞ্জীবনী।

বইয়ের দোকানের বিজ্ঞাপন লেখার কাজটা একটু অন্যরকমের হলেও মনে মনে ধীরাপদর সেটা আরো অপছন্দ। পুরনো বইয়ের দোকানে পুরনো বই মেলেই—সেই সঙ্গে বটতলার কাগজে ছাপা রঙ-বেরঙের মলাট দেওয়া নতুন বইও মেলে অনেক। স্বর্গ-দরজার কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার মত আচার-অনুষ্ঠান ক্রিয়াকলাপ বিধিবিধানের পুস্তিকাও আছে, আবার সম্মোহন বশীকরণ দেহবিজ্ঞান নব যৌবনলাভের সুলভ তথ্যের রসদও মজুত। দোকানের মালিক নিজেই পছন্দমত লেখক সংগ্রহ করে সুযোগসুবিধে মত এ ধরনের দুই-একখানা করে বই ছেপে ফেলেন।

ওষুধের বিজ্ঞাপন লিখতে হলে ওষুধ খেতে হয় না, কিন্তু বইয়ের বিজ্ঞাপন লিখতে হলে বইগুলো পড়তে হয়। এইজন্যই এ কাজটা ধীরাপদর ততো পছন্দ নয়। পড়ার পরে আর লিখতে মন সরে না। এখানকার বিজ্ঞাপন-স্ফুলিঙ্গের পতঙ্গ কারা সেও নিজের চোখেই দেখেছে। দেখে দেখে ধীরাপদর এক-এক সময় মনে হয়েছে, এই কালটাই ব্যাধিগ্রস্ত।

বইয়ের দোকানের মালিক দে-বাবু বলেন মন্দ না। আভাসে ইঙ্গিতে অনেকবার টসটসে জোরালো কিছু একটা লেখার প্রেরণা দিয়েছেন তাকে। জোরালো বিজ্ঞাপন নয়। জোরালো আর কিছু। শেষে হাল ছেড়ে বলেছেন, আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না—আরে মশাই, যে মদ খায় সে খাবেই, এ দোকানে না পেলে অন্য দোকানে খাবে —কোথাও না পেলে নিজে তৈরি করে খাবে— তাহলে দোকান খুলে বসতে দোষ কি। আপনারই বা লিখতে আপত্তি কি?

স্বচ্ছ দৃষ্টি।

জোরালো অন্যকিছু না হোক, সে-দিন জোরালো বিজ্ঞাপন লিখে অদ্ভুত দে-বাবুকে খুশি করেছিল ধীরাপদ।

মশাই যে! কবে ফিরলেন? প্রত্যাশী-জনের প্রতি অম্বিকা কবিরাজের স্বভাবসুলভ বিদ্রূপ।

ধীরাপদ আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করল, কাজ ছিল নাকি?

না। এই ছাপোষা দোকানের কি আর কাজ– পাঁচজনে এসে জ্বালাতন করে, তবু পুরনো লোককে না খুঁজে পারিনে বলেই যত ঝামেলা—কাল একবার আসবেন।

অম্বিকা কবিরাজ ঘুরে বসলেন, যেন আর তার মুখদর্শনও করতে চান না। ধীরাপদ বেরিয়ে এলো। এ-রকম অভ্যর্থনা গা-সওয়া। কাজ থাক বা না থাক, অনুগ্রহভাজনেরা দিনান্তে একবার এসে দেখা না দিয়ে গেলে তারা নিজেরাই একটু দুর্বল বোধ করেন বোধ হয়। বইয়ের দোকানের মালিক দে-বাবুর অন্য অভিযোগ। – কাজ তো আছে মশাই, কিন্তু আপনাকে দিয়ে হবে কি না ভাবছি… আপনার লেখাগুলো বড় একঘেয়ে হয়ে গেছে, আর তেমন টানছে না।

তারপর রয়ে সয়ে যে সুসংবাদ জ্ঞাপন করলেন তার মর্ম, এবারে যাকে বলে টাকা-বর্ষানো বই-ই বার করছেন তিনি—সরল যৌগিক ব্যায়ামের বই একখানা, মাইনর পাশ বিদ্যে নিয়েও ও-বই অনুসরণ করলে মনের জোরে পাহাড় টলবে। ছাপা প্রায় আধাআধি শেষ, চারখানা মলাটের ওপর এবারে এমন কিছু লিখতে হবে যাতে একবার হাতে নিলে ও-বই আর হাত থেকে না নামে। আর খবরের কাগজের অনুকূল মন্তব্যও কিছু পাওয়া দরকার। – তারা লিখবে না কেন, এ তো আর খারাপ বই কিছু নয়, কি বলেন?

গণুদার সহায়তায় একবার তার কি একটা বইয়ের দু লাইন সমালোচনা ধীরাপদ কাগজে বার করিয়েছিল। একটু নিরীহ রসিকতার লোভ ছাড়তে পারল না। বলল, তা লিখবে না কেন, ভালো বই-ই তো।… বিজ্ঞাপনের কাজটাও অন্য কাউকে দিয়েই করিয়ে দেখুন না, অন্যহাতে অন্যরকম তো কিছু হবেই।

ভুরু কুঁচকে ঝপ করে কাগজপত্রে মন দিলেন দে-বাবু। ধীরাপদ উঠে দাঁড়াতে মুখ তুললেন আবার।- ব্যবসায় নামলে পাঁচটা দিক ভাবতেই হয়, বুঝলেন? সামনের হপ্তায় একবার আসবেন।

আপাতত পাঁচটা টাকা দেবেন?

টাকা চাইলেই বিরক্তিতে মুখখানা যে রকম করে ফেলেন, অভ্যাসবশত দে-বাবু সেই রকমই করলেন প্রথম। সে শুধু মুহূর্তের জন্যে। এ-যাচনা অবাঞ্ছিত নয় খেয়াল হল বোধ হয়।-কথা শুনে তো মনে হচ্ছিল আপনার দু’পকেট ভরতি টাকা!

কাঠের টেবিলের ড্রয়ার খুলে আধ-ময়লা একটা পাঁচ টাকার নোটই সামনে ফেলে দিলেন।

বাইরে এসে হাঁফ ফেলল ধীরাপদ। মুখে এঁরা যে যাই বলুন, নিজের কদরটাও মনে মনে ভালই জানে সে। এত সস্তায় আর এমন মুখ বুজে কাজ করার লোকও সব সময় মেলে না। হঠাৎ চারুদির কথা মনে পড়তে হাসি পেয়ে গেল, সাহিত্য করা ছেড়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিল। সাহিত্য কোথায় এসে ঠেকেছে জানলে কি বলত?

কাজ পাক না পাক এদিকে এসে আরো দু-পাঁচটা দোকানে ঘোরে সাধারণত। কিন্তু আজ আর ভালো লাগছে না। বেলা বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে জঠরের তাগিদও বাড়ছে। …সেই পরিচিত হোটেলেই, যেতে হবে, নতুন করে আবার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে। দশ বছরের পুরনো খদ্দের সে। সাত পয়সার ‘মিল’ দু বছর আগে ছ আনায় ঠেকেছিল। এই দু বছরে সেটা করে দাঁড়িয়েছে জানা নেই।

হোটেলের ম্যানেজার পুরনো খদ্দেরকে দেখেই চিনলেন। আদর-যত্নও করলেন একটু। পুরনো খদ্দেরের খাতিরে নিজের থেকেই দশ আনায় মিল রফা করলেন। আর হৃদ্যতাসূচক রসিকতাও করলেন একটু, চেহারাপত্র তো দিব্যি ফিরে গেছে আপনার, দেখেই মনে হয়েছিল— বে-’থা’ করেছেন বুঝি?

খেতে বসে ধীরাপদ খাওয়ার তাগিদটা অনুভব করছে না তেমন। এ দু বছরে মুখ বদলে গেছে। আজ ভালো না লাগলেও দু দিন বাদে এই বেশ লাগবে। সে-জন্যে নয়, শুকলালের হাতে বাজার পাঠানোর পরের সেই অস্বস্তিটাই আবার উকিঝুঁকি দিচ্ছে। সোনাবউদি যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। এটুকু তাকে বোঝানো দরকারও ছিল। তা ছাড়া সে তো আর তার ব্রতসাঙ্গর ব্রাহ্মণ নয়।

দু’ বেলার খাওয়াটা সোনাবউদির ওখানেই বরাদ্দ ছিল। ধীরাপদই বরং তাতে আপত্তি করেছিল প্রথম প্রথম। সোনাবউদি শোনেনি। বলেছে, যে টাকাটা আপনি খাওয়ার পিছনে খরচ করেন সেটা বরং আমাকে দেবেন। তার আগে অবশ্য হোটেলে সে কি খায় না খায় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে শুনে নিয়েছিল। আর বলেছিল, হোটেলের থেকে ভালো খাওয়াব, ভয় নেই।

প্রথম ক’মাস ছেলে পড়ানোর টাকা হাতে এলেই তার থেকে কুড়িটি করে টাকা সোনাবউদির হাতে দিয়েছে। সম্প্রতি গণুদার চাকরির মোড় ঘুরেছে হঠাৎ। সাংবাদিক রাজ্যের নতুন বিধি-ব্যবস্থার ফলে মাইনে রাতারাতি অনেক বেড়ে গেছে। প্রুফরীডারও সাংবাদিকদের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু তখন বেশ অনটনই ছিল। ফলে সোনাবউদির মেজাজ বিগড়াতো প্রায়ই। গণুদাকে যে-ভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলত, এক-এক সময় ধীরাপদর এমনও মনে হয়েছে যে সেটা শুধু গণুদার উদ্দেশেই নয়। আর সে-রকম একবার মনে হলে তার গ্লানিও কম নয়। এ-রকম দুই একবার শোনার পর ধীরাপদ ছেলে পড়ানোর তিরিশ টাকাই সোনাবউদির হাতে তুলে দিয়েছে। অনুপস্থিতির দরুন মাইনে দু-চার টাকা কাটান গেলে পরে তাও উজ্জ্বল করে দিয়েছে। বিজ্ঞাপন লিখে মাসে গড়পড়তা বিশ-পঁচিশটা টাকা আসেই।

প্রথমবার টাকা বেশি দেখে সোনাবউদি অবশ্য একটু অবাক হয়েছিল, তিরিশ টাকা কেন?

ধীরাপদ বলেছে, রাখুন না, তিরিশ টাকাই বা কি এমন…

সোনাবউদি খানিক তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল শুধু, আর কিছু বলে নি। আপত্তিও করেনি।

পরোক্ষেও অনটনের গঞ্জনা আর শুনতে হয়নি। এর থেকে সোনাবউদি যদি সরাসরি ওকে এসে বলত, ধীরুবাবু কুলিয়ে উঠতে পারছি না, আরো কিছু দিতে পারেন কি না দেখুন—ধীরাপদ খুশি হত। সেটা অনেক সহজ হত, সুশোভনও হত। তবু সে-গ্লানি কেটে যেতে দু দিনও লাগেনি। সুলতান কুঠির এই রঙ্গভূমিটুকুতে এ পর্যন্ত অনেক কৃপণতা দেখেছে, অনেক সংকীর্ণতা দেখেছে। সেখানে সোনাবউদির আসাটা ঊষর রিক্ততার মধ্যে একটুখানি সবুজের আভাসের মতন। নিজের অগোচরে অল্প আলোয় আর অল্প কিছু মায়ায় ধীরাপদর শুকনো বুকের অনেকটাই ভরে উঠেছিল।

কিন্তু এক ধাক্কায় সব তছনছ হয়ে গেছে। ধীরাপদর মোহ ভেঙেছে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হেসেছে শেষ পর্যন্ত। যা হবার তাই হয়েছে, যা স্বাভাবিক তাই ঘটেছে। উপোসী মনের তাগিদে সে একটা মায়ার জাল বুনছিল শুধু। সেটা ছিঁড়েছে ভালই হয়েছে। ও মোহ তো রোগের মোহের মতই। আবার সে ওতে জড়াতে যাবে কেন? ফিরে আবার ডাকলেই বা সোনাবউদি!

খাওয়া অনেকক্ষণ সারা। হাতমুখ ধুয়ে বাইরের শুরু বারান্দায় হাতলভাঙা একটা কাঠের চেয়ারে এসে বসল। পড়তি বেলায় হোটেলের কর্মব্যস্ততা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

ধীরাপদও সুস্থ বোধ করছে একটু।

না, শুকলালের হাতে বাজার পাঠিয়ে দিয়ে সে কিছু অন্যায় করেনি। সোনাবউদির পরোক্ষ আমন্ত্রণ এ-ভাবে প্রত্যাখ্যান করাটা কিছুমাত্র অন্যায় হয়নি তার।

….সোনাবউদি নিজে একদিন তার সংসারে ডেকে নিয়েছিল তাকে। আর, বিদায় করেছে গণুদাকে দিয়ে।

বিদায় করেছে একাদশী শিকদার আর শকুনি ভটচাযের ভয়ে? আর যে-ই বিশ্বাস করুক ধীরাপদ বিশ্বাস করে না। গণুদা বিশ্বাস করেছে কিন্তু ও করেনি। বক্তব্য পেশ করতে এসেও বিড়ম্বনার একশেষ গদার। তিনবার ঢোক গিলে তবে বক্তব্য শেষ করতে পেরেছে।…তোমার বউদির মেজাজ তো জান ভাই, একেবারে ক্ষেপে গেছে, আর এ-সব শুনলে কে-ই বা… পাঁচজনের সঙ্গে বাস, বুঝতেই তো পারছ…তোমাকে ভাই দু’বেলার খাওয়ার ব্যবস্থাটা আবার…

আর বলার দরকার হয়নি। বলতে পারেওনি গণুদা।

কথা হচ্ছিল ধীরাপদর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। স্ত্রীর উদ্দেশে গদা হঠাৎই একটা হাঁক দিয়ে বসেছিল তারপর। কই গো, শুনছ–

আসবে ধীরাপদ ভাবেনি। কিন্তু সোনাবউদি দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। আর সেই থমথমে মুখের দিকে ধীরাপদ নির্দ্বিধায় তাকাতেও পেরেছিল। ডেকে ফেলে বরং একটু বিব্রত বোধ করেছিল গদা নিজেই। – ধীরুকে বুঝিয়ে বললাম সব, ও আপনজন বুঝবে না কেন? কই, আজ ওকে চা দিলে না এখনো?

চায়ের বদলে দু চোখে আগুন ছড়িয়ে সোনাবউদি আবার ঘরে ঢুকে গেছে।

গণুদার ঘরণী ক্ষেপে যে গেছে সেটা নিজের চোখেও দেখে ধীরাপদ বিশ্বাস করেনি। করেনি কারণ, অনুভূতির রাজ্যে যুক্তি অচল। সেই অনুভূতির ইশারাটা অন্য- রকম। শকুনি ভট্টচার্য আর একাদশী শিকদারের রসনার বক্র আভাস শুরু হয়েছিল তাদের সংসারটিকে ওখানে এনে বসানোর দিনকতকের মধ্যেই। সোনাবউদি সে-সব গায়ে মাখা দূরে থাক, হাসি-বিদ্রূপে নিজেই পঞ্চমুখী। বলেছে, তিন ছেলে-মেয়ের মা তাতে কি, মেয়েরা মেয়েই—কদর দেখুন একবার! চোখ পাকিয়ে তর্জন করেছে, আপনি নাকি রমণী পণ্ডিতের ওই চৌদ্দ বছরের মেয়েটার দিকে পর্যন্ত চোখ দিয়েছিলেন, অ্যাঁ?

দু বছরে নিরুদবেগ-সম্প্রীতি বেড়েছে বই কমেনি। ওই শিকদার আর ভটচায মশাই বরং হাল ছেড়েছিলেন। বদ্ধ জলাতেই আলগা আগাছা পচে, কিন্তু স্রোতের মুখে কুটোর মত ভেসে যায়। তাঁদেরও উদ্যম ফুরিয়েছিল। এত দিন পরে রাতারাতি হঠাৎ আবার তাঁরা এমন সবল হয়ে উঠলেন কোন মন্ত্রবলে? হলেও সোনাবউদি গদাকে দিয়ে এভাবে বলে পাঠাতো না। নিজেই এসে বলত। বলত, আর পারা গেল না ধীরুবাবু, এবার নিজের ব্যবস্থা নিজে দেখুন। সেই রকমই বাচন-বচন তার। আসলে যা ঘটেছে, সেটা কোনো অপবাদের ভয়ে নয়। ভয় যা করে, সেটা আজ তার প্রণামের বহর দেখে আর বেছে বেছে ওই বৃদ্ধ দুটিকেই নেমন্তন্ন খাওয়ানোর ব্যবস্থা থেকে আরো ভালো করে বোঝা গেছে। এত সহজে এমন কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন সোনাবউদির দ্বারাই সম্ভব।

অপবাদ উপলক্ষ মাত্র। আর কোনো হেতু আছে যা প্রকাশ্যে বলার মত নয়, যা ধীরাপদ অনেক ভেবেও সঠিক ঠাওর করে উঠতে পারেনি। যে স্থূল কারণটা বার বার মনে আসে সেটাই সত্যি বলে ভাবতে এখনো ভেতরটা টনটন করে ওঠে। গণুদার অনেক মাইনে বেড়েছে, অনটনের দুর্ভাবনা গেছে, বাইরের লোক এখন বাড়তি ঝামেলার মতই।…এই কারণেই কি?

হোটেলে বিকেলের সাড়া জাগতে উঠে পড়ল। সন্ধ্যায় একেবারে ছেলে পড়ানো শেষ করে ঘরে ফিরবে। শীতকালের বেলা, দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হবে। ধীরাপদ চৌরঙ্গীর দিকে পা চালিয়ে দিল। অন্যমনস্ক তখনো। গণুদার চাকরির উন্নতিতে সে-ও মনে মনে খুশি হয়েছিল। সোনাবউদি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে ভাবতে হালকা লেগেছিল।

মায়ের কথা মনে পড়ে ধীরাপদর।

বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে পর্যন্ত পরিচয় ছিল না, ভালো করে একখানা চিঠি পড়ে উঠতে পারত না। বাবা তেমন বড় না হোক ভালো উকীল ছিল। আর সংসারেও প্রাচুর্য না থাক, অনটন ছিল না। সেই সংসার মা চালাতো। কিন্তু হিসেবপত্র ঠিকমত রাখতে পারতো না, কি দিয়ে কি করছে না করছে সব সময় মনে থাকত না। ফলে এক এক সময় বাবার ওকালতি-জেরায় পড়ে মাকে ফাঁপরে পড়তে হত। বাবা কখনো বিরক্ত হত, কখনো বা মায়ের বিদ্যে-বুদ্ধি নিয়ে প্রকাশ্যেই ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। এরই মধ্যে মফঃস্বল ইস্কুলের চাকরি খুইয়ে সপরিবারে কাকা তাদের ওখানেই এসে উঠেছিল। কাকিমাকে বোধ হয় আশ্বাস দিয়েছিল, শহরে গেলেই চট করে কিছু একটা জুটে যাবে। কিন্তু শীগগির জোটেনি। বাবা মুখে কিছু বলত না, কিন্তু মাসের খরচ ঠিক মত কুলিয়ে উঠতে না পারলে বেশ গম্ভীর হয়ে যেত। মা তার বিপরীত, কাকা-কাকিমা এসে আছে এ-যেন তাদেরই অনুগ্রহ। কিন্তু ছেলেপুলে নিয়ে আর একজনের কাঁধে ভর করে অনুগ্রহ দেখানোর বাসনা কাকিমার অন্তত ছিল না। কাকাকে প্রায়ই গঞ্জনা দিত। অশান্তি আর খিটিরমিটির লেগেই থাকত দুজনায়। আর তাই শুনে মা কোথায় পালাবে ভেবে পেত না।

সেই অশান্তির অবসান হয়েছিল। দু মাস না যেতে কাকিমার মুখে হাসি ফুটেছিল। সামান্য হলেও সংসার খরচের জন্য কিছু টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে পারছে সেই আনন্দে। মাকেও উৎফুল্ল মুখে টাকা নিতে দেখেছে ধীরাপদ আর বলতে শুনেছে, ঠাকুরের পায়ে ভরসা রাখ, ঠাকুর মুখ তুলে তাকাবে না তো কি!

কাকিমার সেই টাকা দিতে পারার রহস্যটা অনেক পরে জানতে পেরেছিল। বাবার মুখে শুনেছিল।

তখন মা নেই।

বাবার কাছেই মা ধরা পড়েছিল। কাকিমার হাত দিয়ে দেওয়ার জন্য কাকার হাতে মায়ের টাকা গুঁজে দেওয়াটা বাবার কাছেও ফাঁকি দিয়ে সারতে পারবে এমন চৌকস মা নয়। ধরা পড়ে তাই দ্বিগুণ ফাঁপরে পড়তে হয়েছিল মাকে। হাসিমুখে নিরক্ষরা স্ত্রীর সেই কাণ্ডকারখানার কথা বলতে বলতে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বাবা কি একটা ওকালতি বই খুঁজতে শুরু করেছিল। দিদিটা পালিয়েছিল। আর ও নিজেও ঝাপসা চোখে খবরের কাগজে কি একটা খুঁজছিল যেন।

সে যুগ তো গেছে। সেই কাল তো গেছে। তবু খেদ কেন? সেই অজ্ঞ যুগের হৃদয়ের বস্তু আজও ঠিক তেমনি করেই বুকের ভিতরে নাড়া দেয় কেন?

গড়ের মাঠের একটু নিরিবিলি দিক বেছে নিয়ে ধীরাপদ বসল। খুব তাড়াতাড়িই হেঁটে এলো বোধ হয়। এখনো দিনের আলো স্পষ্ট। এত তাড়াতাড়ি গেলে ছাত্রের দেখা পাবে না। কিন্তু শীত-শীত করছে। সোনাবউদির ব্রাহ্মণভোজনের বাজার করা আর বাজার পৌঁছে দেওয়ার গরমে বিকেলের জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরুনোর কথাটা মনে ছিল না।

সোনাবউদিকে দেখে কখনো কি নিজের মায়ের কথা মনে হয়েছিল ধীরাপদর? মনে পড়ে না। তবে রণুর অসুখে গোট-হার বিক্রি করার পর সুলতান কুঠির সেই বিনিদ্র রাতে একটা বড় প্রাপ্তির সন্ধানে ভিতরটা ভরে উঠেছিল। কিন্তু তা বলে মায়ের মত কবে ভাবতে গেছে তাকে? দিদির মতও না। আরো কাছের কারো মত ভাবা আরো হাস্যকর। তাহলে কার মত? ওই সকলকে মিলিয়ে আরো শক্ত সবল কারো মত কি? সেইজন্যেই ওখান থেকে ধাক্কাটা এমন করে বুকে লাগছে।

ধীরাপদ হাসতে লাগল। তাই যদি হবে, ভুলটা মোটামুটি নিজের ছাড়া আর কার? প্রত্যাশার জন্য দায়ী আর কাকে করতে যাবে?

হঠাৎ থমকে গিয়ে একদিকে চেয়ে রইল ধীরাপদ। একটি মেয়ে একটি পুরুষ। এদিকেই আসছে। পড়তি দিনের ঘোলাটে আলোয় দূর থেকে চেনা শক্ত। তবু ধীরাপদ এক নজরেই চিনেছে। সেই চোখ-তাতানো ছাপা শাড়ি, সেই উৎকট লাল সিল্কের ব্লাউস, সেই সমর্পণমুখী ক্ষীণাঙ্গী তনু।

বাস-স্টপের সেই মেয়েটা।

সঙ্গীর হাতে হাত জড়ানো। হাসছে খুব। মুখখানা ততো শুকনো লাগছে না আজ। তেমন দুর্বলও মনে হচ্ছে না। বেশ হালকা পায়েই হেঁটে আসছে। ধীরাপদ চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। মেয়েটাকে দেখে নয়, তার সঙ্গীকে দেখে। কোথায় দেখেছে? দেখেছে নিশ্চয়ই। কোথায়? পরনে ঝকঝকে স্যুট, হাতে ঘাস-রঙা সিগারেটের টিন, চঞ্চল হাবভাব কোথায় দেখল?

মনে পড়েছে। চেক-লুঙ্গি-পরা সেই অশুভ-মূর্তি ঢ্যাঙা লোকটার প্রতীক্ষায় কার্জন পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখেছিল। লোকটার কথা শুনে একেই দু হাত মাথার ওপর তুলে নাচতে দেখেছিল আর তারপর মানিব্যাগ খুলে সাতখানা দশ টাকার নোট বার করে দিতে দেখেছিল।…সে-ই তো!

পাঁচ-সাত হাত দূর দিয়ে তারা পাশ কাটিয়ে গেল। যাবার আগে দুজনেই ফিরে তাকালো একবার। শীতের আসন্ন সন্ধ্যায় এমন নিরিবিলিতে কাউকে একা বসে থাকতে দেখাটা খুব প্রত্যাশিত নয়। মেয়েটির কটাক্ষে ছদ্ম বিরক্তির আভাস। হ্যাংলার মত কেউ হাঁ করে চেয়েই আছে দেখলে ঘরের মেয়েরা যেমন কোপ প্রকাশ করে, অনেকটা তেমনি। সঙ্গীর কাছে নিজের কদর বাড়ল একটু। দু পা এগিয়ে গিয়ে সঙ্গী হয়ত রসালো কিছু মন্তব্য করেছে, কারণ হাসিমুখে মেয়েটা আবারও তার দিকে ফিরে তাকালো একবার। চেনেনি নিশ্চয়, লিওসে স্ট্রীটের সেদিনের সেই হতাশা মনে করে বসে থাকার কথা নয়। পণ্যপথে কতজনের আনাগোনা, কতজনের যাচাই বাছাই। কজনকে মনে রাখবে? সঙ্গীর রসিকতার সুযোগে আর একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখার ফাঁকে এবারে বোধ হয় ওকে চিনে রাখতেই চেষ্টা করল মেয়েটা।…পণ্যের প্রয়োজনে কানাকড়িও লক্ষ্মী।

বীটার রাইস! কি আশ্চর্য, ছবিটার কথা আর মনেই ছিল না ধীরাপদর! এখন ক’টা বাজে, আর সময় আছে? ঘাড় ফিরিয়ে দূরের সেই ঘড়ি-বাড়ির দিকে তাকালো। এই আলোয় এত দূর থেকে ঘড়িটা চোখে পড়ে না। আজ আর সময় নেই বোধ হয়, কোথায় হচ্ছে ছবিটা তাই জানে না।…তেতো চাল… কষা চাল…কটু চাল…বীটার রাইস। স্যাকরার ঠুকঠুক কামারের এক ঘা—বাংলা হয় না।

কিন্তু আর একটা কথাও ভাবছে সেই সঙ্গে। কথা ঠিক নয়, বিপরীত অনুভূতি। তেতো হোক কষা হোক কটু হোক—দুনিয়ায় বেঁচে থাকার শক্তিটাও বড় অদ্ভুত।

শীত করছে বেশ। ছোট বেলা, দেখতে দেখতে অন্ধকার। ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল, ছাত্র পড়ানো আছে। দূরের রাস্তায় আলো জ্বলছে, ওখানে পৌঁছুতে হলেও অন্ধকার মাঠ অনেকটা ভাঙতে হবে। দে-বাবুর পাঁচ টাকার বেশির ভাগই অবশিষ্ট আছে, ট্রামে- বাসে যাওয়া যাবে। কিন্তু ছেলে পড়ানোর নামে মাঠ ভেঙে ঐ রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছুতেও পা দুটোর বেজায় আপত্তি। তার ওপর শীত। শীত করছে মনে হতেই ধীরাপদ ধুপ করে বসে পড়ল আবার। এই অবস্থায় ছেলে পড়াতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। ঠাণ্ডায় সে হি-হি করবে আর ছেলেটা অবাক হবে। ভাববে হয়ত, মাস্টার ছেঁড়া চাদরটাও বেচে দিলে নাকি।

আজকের মতও থাক ছেলে পড়ানো। শীতের প্রতি কৃতজ্ঞ। মাসকাবারে সোনাবউদির হাতে তিরিশ টাকা গুনে দেবার তাগিদ তো আর নেই। নিশ্চিন্ত। ছেলে পড়াতে যাবে না ঠিক করার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডাটা আর তেমন কনকনে লাগছিল না। তবু বিবেকের কাছে চক্ষুলজ্জা আছে একটু—কাপড়ের খুঁটটা টেনে জামার ওপর দিয়েই গায়ে জড়িয়ে নিল। আর একটু বাদেই ওঠা যাবে, তাড়া নেই।

সোনাবউদি, না সোনাবউদি থাক। চারুদি। সকাল থেকে সোনাবউদির কাণ্ডকারখানায় চারুদিকে মনে পড়েনি। ঠিকানাপত্তর নিয়ে রেখেছে চারুদি, বার বার আসতে বলেছে আবার, সম্ভব হলে আজই যেতে বলে দিয়েছিল। ওইভাবে খেতে চাওয়ার ধাক্কা সামলে সহজ হবার জন্যে চারুদির সেই অন্তরঙ্গ আগ্রহ দেখে ধীরাপদ বেশ কৌতুক বোধ করেছিল মনে মনে। কালকের মত আজও অমনি একটা যোগাযোগ হয়ে গেলে কেমন হয়! শীতের সন্ধ্যার ধোঁয়াটে অন্ধকারে মাঠের মধ্যে একা ওকে এইভাবে বসে থাকতে দেখলে চারুদি আঁতকে উঠত বোধ হয়।

কিন্তু হঠাৎ আঁতকে উঠল ধীরাপদ নিজেই। গায়ের সমস্ত রোমে রোমে কাঁটা। এক ঝটকায় একেবারে উঠে দাঁড়াল সে। বিকৃত উত্তেজনায় বলে উঠল, কে? কে তুমি?

খানিক দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে একটি মেয়েই। না, চারুদি নয়। ধীরাপদর হঠাৎ মনে হয়েছে, প্রেতিনীর মত কেউ যেন। অন্ধকারে দশ হাত দূরেও ঠিকমত চোখ চলে না, কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি।

জবাব না দিয়ে মেয়েটা কুণ্ঠিতচরণে আরো দু পা এগিয়ে এলো শুধু।

ধীরাপদ চিনল। বাস-স্টপের সেই ক্ষীণাঙ্গী মেয়েটাই। ক্ষণিকের সঙ্গীর হাতে হাত মিলিয়ে কিছুক্ষণ আগে যে এইখান দিয়ে গেছে। স্বাভাবিক স্থলে এইটুকু এক মেয়েকে দেখে স্নায়ু এতটা বিড়ম্বিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অন্ধকার মাঠের মধ্যে হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে পড়ে ধীরাপদ উত্তেজনা দমন করতে পারল না। বিকৃত রূঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

দ্বিধান্বিত কাতর আবেদন কানে এলো, রাস্তার ওই আলোর ধার পর্যন্ত একটু এগিয়ে দেবেন…

ওই তো আলো দেখা যাচ্ছে, চলে যাও না, এগিয়ে দিতে হবে কেন? অস্ফুট জবাব শুনল, বড় অন্ধকার, অনেক রকম লোক থাকে। ধীরাপদ আবারও রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো, অনেক রকম লোক থাকলেও তোমার অসুবিধে কিসের?

তবু দাঁড়িয়ে আছে দেখে ফেরার জন্য নিজেই তাড়াতাড়ি পা বাড়াল। কিন্তু পারল না। বিকেলে সঙ্গী-লাভের প্রগলভ চপলতা নয়, বাস-স্টপের সেই শুকনো মুখটাই মনে পড়ে। এই অন্ধকারে মুখ অবশ্য দেখতে পায়নি, তবু গলা শুনে সেই মুখই মনে পড়েছে।

ধীরাপদ ঘুরে দাঁড়াল। আমার পিছনে আসতে পারো কোনরকম চালাকি করতে যেও না।

হনহনিয়ে মাঠ ভেঙে রাস্তার দিকে এগুলো সে। একবারও ফিরে তাকালো না। তার সঙ্গ ধরে আসতে হলে মেয়েটাকে যে প্রায় ছুটতে হবে সে খেয়ালও নেই। স্নায়ুগুলি বশে আসেনি তখনো। অন্ধকারে কোনো লোক চোখে পড়েনি। চোখে পড়তে পারে সেভাবে চোখ ফেরায়ওনি কোনদিকে। অন্ধকারের গর্ভবাস থেকে আলোর কাছে আসার এমন তাগিদ আর বুঝি কখনো অনুভব করেনি ধীরাপদ।

মাঠের ধারের দিকটা অত অন্ধকার নয়। খানিকটা পর্যন্ত রাস্তার আলো এসে পড়েছে। ধীরাপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। উত্তেজনা কমে আসছে, গতি মন্থর হল। রাস্তার একটা লাইটপোস্টের কাছে এসে তারপর ঘুরে দাঁড়াল সে।

পিছনে পিছনে মেয়েটাও এসেছে। নির্ঝঞ্ঝাটে আসার তাড়নাতেই এসেছে। এসে হাঁপাচ্ছে। কিন্তু মুখের ওপর চোখ পড়তেই ধীরাপদ আবারও বেশ বড় রকমের ধাক্কা খেল একটা। মেয়েটা শুধু হাঁপাচ্ছে না, সেই সঙ্গে কাঁদছেও। কাঁদতে কাঁদতেই এসেছে। চোখের জলে মুখের উগ্র প্রসাধন থকথকে কুৎসিত দেখাচ্ছে। কুশ্রী মুখে জীবনধারণের বিড়ম্বনা আর বুকভাঙা হতাশার ছাপ শুধু। ধীরাপদ চেয়েই রইল কিছুক্ষণ। তারপর এক নিমেষে বুঝল ব্যাপারটা। জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই, পসারিণীর পসারই শুধু লুঠ হয়েছে, দাম মেলেনি। এ ছাড়া অমন ভগ্ন-বিদীর্ণ হতাশার আর কোনো কারণ নেই।

ধীরাপদর সর্বাঙ্গের স্নায়ুগুলো যেন কাঁপছে আবারও। অন্ধকারে শ্বাপদ মানুষের হামলার ভয়ে মেয়েটা প্রাণের দায়েই ওর সঙ্গ নিয়েছে বোঝা যায়। মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়েছিল, এবারে মুখ তুলে তাকালো। একটু কৃতজ্ঞতা, আর সেই সঙ্গে একটু আশা। আশা নয়, আশার আকৃতি। যেন আজকের মত বাঁচনমরণটা তারই অনুকম্পার ওপর নির্ভর করছে। চোখের জলে ভেজা রঙ-পালিশ-করা মুখে হাল ছাড়া ক্লান্তি।

নিজের অগোচরে ধীরাপদ পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল। দে-বাবুর দেওয়া টাকা ক’টা আঙুলে ঠেকেছিল। তারপরেই সচেতন হয়ে হাত বার করে নিয়েছে। এক ঝটকায় অনেক দূরে চলে এসেছে। কোথাও যাবার তাড়ায় যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে চলেছে সে। ভেতরে কেমন একটা আলোড়ন হচ্ছে, কিছুতে থামানো যাচ্ছে না। লোকজন আসছে যাচ্ছে, কারো দিকে কারো চোখ নেই। ধীরাপদ কি করবে? হাসবে হা-হা করে? নাকি এক- একজনকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করবে, মশাই, বীটার রাইস ছবিটা কোথায় হচ্ছে বলে দিতে পারেন?

সন্ধ্যা পেরুলেই সুলতান কুঠির রাত গভীর। কোনো ঘরেই ইলেকট্রিক নেই, লণ্ঠন ভরসা। তেল খরচ করে সেই লণ্ঠনও অকারণে জ্বালায় না কেউ। বড় বড় গাছগুলো আরো বেশি অন্ধকার ছড়ায়। অভ্যস্ত পা না হলে পায়ে পায়ে ঠোক্কর খেতে হয়।

কে, ধীরুবাবু নাকি?

ধীরাপদ অন্যমনস্ক ছিল বলেই চমকে উঠল। নইলে চমকাবার মত কেউ নয়, রমণী পণ্ডিতের গলা। কদমতলার বেঞ্চিতে বসে আছেন। অন্ধকারে বসে আছেন বলেই ওকে দেখতে পেয়েছেন, ধীরাপদর তাঁকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেঞ্চির সামনে এসে দাঁড়াল, এই ঠাণ্ডায় বসে যে!

এমনি। ঘরে কি আর নিরিবিলিতে হাত-পা ছড়িয়ে দুদণ্ড বসার জো আছে!…তা এই ফিরলেন বুঝি, বেরিয়েছেন তো সেই সকালে!

হ্যাঁ!

বসবেন? বসুন না একটু, দুটো কথা কই, কি আর এমন ঠাণ্ডা–

সুলতান কুঠির এলাকায় বসে রমণী পণ্ডিত ইদানীংকালের মধ্যে ওর সঙ্গে গল্প করার বাসনা প্রকাশ করেছেন বলে মনে পড়ে না। রাতে একাদশী শিকদার আর শকুনি ভটচায নিজেদের ঘরের বাইরে গলা বাড়াবেন না এটুকুই ভরসা বোধ হয়। ধীরাপদ বলল, না আর বসব না, ঘরে যাই।

ও, আচ্ছা-খুব ক্লান্ত বুঝি? যান তাহলে, আর আটকাবো না।

কিন্তু একেবারে কিছু না বলার জন্যে ডাকেননি। ধীরাপদ ঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগেই নিরর্থক হাসলেন, তারপর চাপা গলায় বললেন, ইয়ে—এদিকে তো আজ খুব ঘটা করে হঠাৎ এক ব্রত সাঙ্গ হল শুনলাম, ভট্টচার্য মশাই আর শিকদার মশাইকে খুব খাইয়েছেন নাকি। আবারও হাসলেন, এরণ্ডোঽপি দ্রুমায়তে—যে রাজ্যে গাছ নেই সেখানে আড়গাছও গাছ— সুলতান কুঠিতেও ব্রাহ্মণ বলতে ওঁরাই। তা বলিহারী বুদ্ধি মশাই, ব্রত-টতর কথা কিছু জানতেন নাকি? গণুবাবুর সঙ্গে এত কথা…মানে কত সময় কথা হয়, ব্ৰত-টতর কথা তো কখনো শুনিনি। ধীরাপদকে নিস্পৃহ দেখে সামাল দিতে চেষ্টাও করলেন, অবশ্য নিম্নের কিছু নেই, আত্মানং সততং রক্ষেৎ-আত্মরক্ষা তো করতেই হবে, যে-ভাবে পিছনে লেগেছিলেন ওঁরা, তাছাড়া থাকতেও পারে ব্রত —কি বলেন?

কিছু না বলে ধীরাপদ ফেরার উদ্যোগ করল। কিন্তু রমণী পণ্ডিতের বক্তব্য শেষ হয়নি তখনো। সামনের দিকে আর একটু ঝুঁকে বললেন, আপনাকে আবার শোনাচ্ছি কি, আপনি তো সবই জানেন। আপনিই তো সকালে বাজার করে দিয়ে গেছেন শুনলাম, কে যেন বলছিল—শুকলাল। ব্যবসার জন্যে একটা ঘরের খোঁজ করার কথা বলতে গেছলাম শুকলালকে—ওই বলল। তা আপনারও তো তাহলে নেম ছিল, অথচ ফিরলেন তো দেখি একেবারে সন্ধ্যা কাবার করে।

ধীরাপদ কিছু বলার আগেই সাগ্রহে আরো হাতখানেক সরে এসে উৎফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, জবাব দিলেন বুঝি? অ্যাঁ? বেশ করেছেন। আপনাকেও ওদের মতই হা-ভাতে ভেবেছে আর কি! হাত না দেখলেও কপাল দেখেই বুঝতে পারি আমি, আপনার অনেক হবে—আমার কথা মিলিয়ে নেবেন একদিন। আচ্ছা ঘরে যান- আপনি, আর বিরক্ত করব না, আমিও উঠব ভাবছি।

ঘরে ঢুকে ধীরাপদ হাঁপ ফেলে বাঁচল। কষ্ট করে আলো জ্বালার তেমন দরকার ছিল না, ইচ্ছেও ছিল না। তবু ঘরে ঢুকেই কোণের হারিকেনটা জ্বেলে নিল। গড়ের মাঠের সেই অন্ধকার এখনো যেন চেপে বসে আছে। এখানকার এই অন্ধকারের জাত আলাদা অবশ্য, তবু অন্ধকার অন্ধকারই।

ভূমিশয্যা পাতাই আছে। পাতাই থাকে। সরাসরি কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল। এখন শীত করছে বেশ। বেচারা রমণী পণ্ডিত! দুটো লোককে নেমন্তন্ত্র করে এই একটা লোককে বাদ দিল কেন সোনাবউদি? ওর বদলে না হয় তাঁকেই বলত। সব জেনেশুনেই এ-রকম এক-একটা কাণ্ড করে সোনাবউদি। বললেই ঝামেলা চুকে যেত। ঘরের খোঁজে আর তাহলে শুকলালের কাছে যেতেন না ভদ্রলোক, এই ঠাণ্ডায় বাইরে বসে থাকতেন না! ক্ষোভ হতেই পারে, ওই অন্য দুজনের থেকে একটু ঠাণ্ডা মেজাজের বলে নেমন্তন্ত্রের বেলাও অবহেলা!

দরজা ঠেলে সন্তর্পণে ঘরে ঢুকল আট বছরের উমারাণী। ঘরের বাসিন্দাটি ফিরেছে টের পেয়ে শুভাগমন। রাতে তাড়াতাড়ি ফিরলেই ও গল্প শুনতে আসে। গত ক’টা দিনের মধ্যে আজই সকাল সকাল ফিরেছে ধীরাপদ। কিন্তু আজ যেন ঠিক গল্প শোনার তাগিদে আসা নয় উমারাণীর। ডাগর ডাগর চোখ দুটিতে কিছু একটা কৌতূহল চিক চিক করছে। মানুষটা চেয়ে আছে দেখে সরাসরি একেবারেই বিছানায় না এসে একটু দূর থেকেই জিজ্ঞাসা করল, ধীরুকা ঘুমুচ্ছ নাকি?

ধীরাপদও প্রায় গম্ভীর মুখেই জবাব দিল, কি মনে হয়, ঘুমুচ্ছি?

না।

আয়, বোস্-

ইচ্ছে ষোল আনা, কিন্তু ঠিক যেন সাহসে কুলোচ্ছে না। ফিরে আধা-ভেজানো দরজার দিকে তাকালো একবার, তারপর আর একটু এগিয়ে এসে বলেই ফেলল, মা যদি বকে?

এইটুকু মেয়েও জানে কিছু একটা গোলযোগের ব্যাপার ঘটেছে। ধীরাপদ জিজ্ঞাসা করল, মা বকবে কেন?

উমারাণীর আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হল না। মাটির ধার ঘেঁষে শয্যায় এসে বসল। তারপর অনুযোগের সুরে বলল, তুমি যে আজ খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছ—

কথা বাড়ানো উচিত কি অনুচিত ভাবার আগেই পরের প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কি রকম খারাপ কাজ?

উমারাণী গড়গড় করে বলে গেল, তুমি খেতে এলে না, তাই মা-ও খেল না।

বাবা তখন মাকে বকল আর মাও বাবাকে খুব বকল। বাবা তারপর অফিসে চলে গেল আর মা সমস্ত দিন না খেয়ে শুয়ে থাকল—কত খাবার হয়েছিল আজ জানো?

কাকা একটা ভালো রকমের ভোজ ফসকেছে এটুকুই বক্তব্য। কিন্তু শেষটুকু আর কানে যায়নি। সকালের সেই অস্বস্তিটাই মুহূর্তে দ্বিগুণ হয়ে উঠল। এরকম পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে ধীরাপদর কল্পনার বাইরে। বিব্রত বোধ করছে বলেই বিরক্ত আরো বেশি। নিজেরা ঝগড়াঝাঁটি করে যত খুশি না খেয়ে থাকুক, ওকে নিয়ে টানাটানি কেন?

মেয়েটাকে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে ধীরাপদ দরজার দিকে তাকাল। …সোনাবউদি। গম্ভীর। মায়ের গা ঘেঁষেই মেয়ে ছুটে পালালো। সেই দিকেই চেয়ে ভুরু কোঁচকালো সোনাবউদি, মেয়ের যাওয়া দেখো না, যেন ওকে কেউ মারতে এলো—

ধীরাপদ গায়ে কম্বল জড়িয়ে উঠে বসল।

তার দিকে চোখ রেখে সোনাবউদি দরজার কাছ থেকে দুই এক পা এগিয়ে এলো। নিস্পৃহ গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কতক্ষণ?

এই ঠাণ্ডা চাউনি আর বাঁকা কণ্ঠস্বর ধীরাপদ চেনে। এরই থেকে মেজাজগতিক ভালই বোঝা যায়। কিন্তু মেজাজ সম্প্রতি ধীরাপদরও খুব ঠাণ্ডা নয়। তেমনি সংক্ষেপে জবাব দিল, এই তো…

আপনার সেই দিদির বাড়ি গেছলেন?

না। একটা জুতসই জবাব দিতে পারলে ভালো লাগত, তবু সে চেষ্টা না করে জবাবটাই দিল শুধু।

সোনাবউদির এবারের ব্যঙ্গোক্তি আগের থেকে একটু হালকা শোনালো! — আমি ভাবলাম আজও বুঝি দিদির ওখানে ভারি খাওয়া হয়ে গেল, তাই সাত-তাড়াতাড়ি এসে শুয়ে পড়েছেন, আর নড়তে-চড়তে পারছেন না।

ধীরাপদ কথার পিঠে চট করে কথা ফলাতে পারে না। এই একজনের সঙ্গে অদ্ভূত পারে না। ভিতরে ভিতরে তপ্ত হলেও চুপচাপ বসে রইল। কিন্তু মহিলা তারও আভাস পেল বোধ হয়। আরো হালকাভাবে ক্ষতর ওপর এবারে যেন নুন ছড়িয়ে দিল একপ্রস্থ।—আজ সকাল থেকে এ পর্যন্ত শুধু মাঠের হাওয়া খেয়েই কাটল তাহলে? এইবারে জবাব দিল ধীরাপদ, বলল, হ্যাঁ, কিন্তু আপনার তো তাও জোটেনি শুনলাম—

কাজ হয়েছে। থতমত খেয়েছে একটু। হারিকেনের অল্প আলোয় মুখখানা কঠিন দেখাচ্ছে আবার।—ওই মুখপুড়ি মেয়ে বলে গেল বুঝি!

এক্ষুনি গিয়ে বোধ হয় মেয়েটার চুলের ঝুঁটি ধরবে। সেই দায়েই ধীরাপদ এবারে একটু রুক্ষ কণ্ঠেই বলল, মেয়েটার দোষ নেই, ওইটুকু মেয়ে–না বললেই বরং ভাবনার কথা হত। আপনাদের বোঝাপড়াটা এবার থেকে ওদের চোখ-কানের আড়ালেই করতে চেষ্টা করবেন।

সোনাবউদির মুখভাব বদলাল আবার। দুই চোখে ঈষৎ কৌতুকের ছায়া, ঠোঁটের ফাঁকে হাসির মত। মেয়েটার ফাড়া কাটল বোধ হয়। চুপচাপ দেখল খানিক, তারপর লঘু বিদ্রূপের সুরেই বলল, পুরুষমানুষের ঠমক তো একটু-আধটু আছেই দেখি, তবু এমন অবস্থা কেন?

চকিতে মুখ তুলে তাকালো ধীরাপদ আর সঙ্গে সঙ্গে সুর পালটে সোনাবউদি ঝাঁজিয়ে উঠল প্রায়, দয়া করে উঠে হাত-মুখ ধোবেন, না সব ড্রেনে ঢেলে দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হব?

মুহূর্তে একটা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে ধীরাপদ একেবারে যেন হাবুডুবু খেতে লাগল। এইখানেই সোনাবউদির জিত আর এখানেই ধীরাপদর হেরেও আনন্দ। এইটুকু যেতে বসেছে বলেই যত যন্ত্রণা। তবু থাক, হৃদয়ের এ-বস্তুর ওপর আর ভরসা করে কাজ নেই। সেই লোভে ভিক্ষার গ্লানি। যাতনা কেমন, মর্মে মর্মে জেনেছে। এই একটা দিনের ব্যাপার এক দিনেই শেষ হোক, মিছিমিছি তাকে উপলক্ষ করে আর একজনও না খেয়ে থাকবে কেন?

আপনি যান, আমি আসছি।

থাক অত কষ্ট করে কাজ নেই, এখানেই নিয়ে আসছি।

ধীরাপদ উঠে হাতমুখ ধোবার কথাও ভুলে গেল। আধ-ঘণ্টাখানেক বাদে সোনাবউদি আসন পেতে খাবার সাজিয়ে দিতে তাড়াতাড়ি উঠে হাতটা ধুয়ে এলো শুধু। আগে হলে এত খাবার দেখে খুশিতে আঁতকে উঠত। সবই গরম করে আনা হয়েছে, সেইজন্যও মহিলার একটু স্তুতি প্রাপ্য। কিন্তু সহজ আলাপের চেষ্টা ছেড়ে ধীরাপদ মাথা গোঁজ করে খেতেই লাগল।

তাও অস্বস্তিকর। অদূরে বসে সোনাবউদি চুপচাপ দেখছে। খানিক বাদে ধীরাপদ সহজভাবেই খোঁজ নিতে চেষ্টা করল, আপনার নিমন্ত্রিতরা খেয়ে খুশি হলেন?

ওঁরা আপনার মত নয়, ষেঠের বাছা ষষ্ঠীর দাস—খেয়েদেয়ে খুশি হয়ে আশীর্বাদ করতে করতে চলে গেলেন।

ওদিকের গাম্ভীর্য তরল হয়েছে। ফলে ধীরাপদ নিজেও সহজ বোধ করল একটু। মুখের গরাস জঠরে চালান করে হাসিমুখেই বলল, ওঁদের আশীর্বাদ না হয় আপনার দরকার ছিল কিন্তু আমাকে নিয়ে এ-ভাবে টানা-হেঁচড়া কেন?

জবাবে সোনাবউদি চোখে চোখ রেখে একটু চুপ করে থেকে হাসি চাপতে চেষ্টা করল বোধ হয়। একটা ছদ্ম নিঃশ্বাস ফেলল তারপর। বলল, সখা যার সুদর্শন, তার সঙ্গে কি সাজে রণ—

আহারের দিকেই ঝুঁকতে হল আবারও। সোনাবউদি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের মেয়ে। সুলতান কুঠিতে সংস্কৃত বুলি দুই-একটা শকুনি ভটচায আর রমণী পণ্ডিতই আওড়ায়। কিন্তু সোনাবউদির বাংলা বচনের ভাণ্ডারটি বড় ছোট নয়। মেজাজ প্রসন্ন থাকলে কথায় কথায় ছড়া-পাঁচালির ঘায়ে অনেককেই নাজেহাল করতে পারে। এমন অনেক শুনেছে ধীরাপদ। তবু আজ অবাক একটু, ওর আজকের আচরণে মহিলার শেষ পর্যন্ত খুশির কি কারণ ঘটল?

নিরীহ মুখে এবারে সোনাবউদিই জিজ্ঞাসা করল, ওঁদের আশীর্বাদ আমার দরকার ছিল কেন?

প্রণাম আর নেমন্তন্ত্র দেখে ভাবলাম—

হুঁ।

যে-ভাবে ভুরু কুঁচকে শব্দটা বার করল, তার সাদা অর্থ, বুদ্ধির দৌড় তো এই!

ধীরাপদর ঠিক বিশ্বাস হল না, তবু এ নিয়ে কথাও বাড়ালো না। হঠাৎ রমণী পণ্ডিতকেই মনে পড়ে গেল। বলল, যে জন্যেই নেমক্স করুন, আর এক বেচারীকেই বা বাদ দিলেন কেন? দুঃখ করছিল।

দু চোখ প্রায় কপালে তুলে ফেলল সোনাবউদি, কাকে বাদ দিলুম, ওই বিটলে গণৎকারকে?

হ্যাঁ। এই ঠাণ্ডায়ও কদমতলার বেঞ্চিতে চুপচাপ বসেছিলেন দেখলাম, মনে বড় লেগেছে।

শোনামাত্র চকিতে সোনাবউদি বাইরের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। একটা দরজা ভেজানো ছিল, চোখের পলকে উঠে গিয়ে সেটাও সটান খুলে দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ধীরাপদ অবাক। বলল, এতক্ষণে উঠে গেছেন—

দরজা খোলা রেখেই সোনাবউদি ফিরে এলো। মুখ এরই মধ্যে গম্ভীর আবার। বলল, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বাজি রাখছি, গিয়ে দেখে আসুন এখনো ঠিক বসে আছে—আপনাকে আসতে দেখে ও উঠে যাবে! কতটা যত্ন-আত্তি করছি দেখবে না? জায়গা মত জ্যোতিষী ফলাবে কি করে তাহলে? দেখুক, ভালো করে দেখুক।

রাগের মাথায় ও হেসেই ফেলল। হাঁ করে দেখছেন কি? ফাঁক পেলেই পুকুরধারে ফিসফিস—গণনায় চাকরির ডবল উন্নতিটা ফলেছে, স্ত্রীর অবনতিটাই বা ফলবে না কেন? মস্ত জ্যোতিষী যে! যত জ্বালা ঘরের জ্বালা, নইলে ওই দুই বুড়োকে আমি কেয়ার করি ভাবেন?

ধীরাপদ চেয়ে আছে আর হাঁ করেই আছে।

খাওয়া হয়ে গেছে। জায়গাটা মুছে দিয়ে থালা-বাটি নিয়ে সোনাবউদি চলে গেল। ধীরাপদও উঠেছে, হাতমুখ ধুয়ে আবার শয্যায় এসে বসেছে। কিন্তু বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত যেন তখনো।

এমন এক ওলট-পালটের মধ্যে গণুদার কথা তো একবারও মনে হয়নি তার। একটু স্বার্থপর হলেও সাদাসিধে মানুষ বলেই জানে। কিন্তু আসল ঘা’টা এসেছে সেখান থেকেই। তারই কান বিষিয়েছে রমণী পণ্ডিত!

তাই তো স্বাভাবিক, ধীরাপদ ভাবেনি কেন?

রমণী পণ্ডিত শোধ নিয়েছেন। ধীরাপদই তো চক্রান্ত করে কোণা-ঘরে ঠেলেছিল তাঁকে, ওই দুই বুড়োর কাছে নাজেহাল করে ঘর ছাড়া করেছিল। রাগ আর তাঁর

কার ওপর।

ভাবনায় ছেদ পড়ল। সোনাবউদি আবার এসেছে। হাত-কতক দূরে বসে ভণিতা বাদ দিয়ে সোজাসুজি বলল, কথা আছে মন দিয়ে শুনুন-

মন দিয়ে শোনার মত মনের অবস্থা নয়, ধীরাপদ তাকালো শুধু।

এ-ভাবে শরীর মাটি করে ক’টা দিন আর চলবে, কালই একটা কুকার কিনে নিন, কিছু শক্ত কাজ নয়, দুই-এক দিন দেখলেই পারবেন—এই টাকাটা রাখুন।

হাত বাড়িয়ে এক পুরনো খাম এগিয়ে দিল। সেটা নেওয়া দূরে থাক, শোনামাত্র ধীরাপদ সংকোচে তটস্থ খামটা সোনাবউদি তার কোলের ওপর ফেলে দিয়ে বলল, লজ্জা করতে হবে না, আমি দান-খয়রাত করতে বসিনি — ওটা আপনারই টাকা। মাসখরচ বাবদ দশ টাকা করে বেশি দিতে শুরু করেছিলেন কেন, কথাবার্তাগুলো বিধত বুঝি? সেই টাকা সরিয়ে রেখেছি, আপনার কাছে থাকলে কি আর থাকত! অবশ্য আমারও খরচ হয়ে গেছে কিছু, দেড়শ’ টাকা আছে ওখানে, গোটা তিরিশেক টাকা আপনি আরো পাবেন—

এত বড় ঘরে ওই লণ্ঠনের আলোটুকুও কি বড় বেশি জোরালো মনে হচ্ছে ধীরাপদর? দুই হাতে করে নিজের মুখটা ঢেকে ফেলতে ইচ্ছা করেছিল বার বার। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হলে বিষম লজ্জা। যাবার আগে সোনাবউদি আবারও কুকারের সম্বন্ধে কি বলে গেল কানে ঢোকেনি।

একসময় খেয়াল হতে দেখে, শূন্য ঘরের শয্যায় স্থাণুর মত বসে আছে সে। উঠে আলো নিবিয়ে কম্বল টেনে সটান শুয়ে পড়ল। আর কোনো ভাবনা নয়, কিচ্ছু না। স্নায়ুর ওপর দিয়ে আজ অনেক ধকল গেছে, কাল ভাববে। কাল—

কিন্তু জোর করে ঘুমের চেষ্টা বিড়ম্বনা। বাইরে একটানা ঝিঁঝির ডাকে নৈশ স্তব্ধতা বাড়ছে। আর, ওর আচ্ছন্ন চেতনা যেন সজাগ হয়ে উঠছে ক্রমশ। রমণী পণ্ডিত ভুল বলেননি, সোনাবউদির ব্রত-টত কিছু নয়, কিন্তু ভুল তাঁর অন্যত্র হয়েছে। নেমন্ত্র করে খাইয়ে শকুনি ভট্টচার্য আর একাদশী শিকদারের মুখ বন্ধ করতে চায়নি সোনাবউদি, মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে রমণী পণ্ডিতেরই। শুধু গণুদার কানেই বিষ ঢেলে ক্ষান্ত হননি ভদ্রলোক, ওই দুজনকেও রসদ যুগিয়ে এবারে উনিই সক্রিয় করে তুলেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। সেই জন্যেই অমন প্রণামের ঘটা আর সেইজন্যেই অমন অভিনব ব্যবস্থা!

…আর, সব কিছুই শুধু ওরই জন্য, শুধু ধীরাপদরই জন্য।

কম্বল ফেলে দিল। গরম লাগছে। ঘরের বাতাসও যেন কমে গেছে। -নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে অস্বস্তি। বালিশের নিচে টাকার খামটা-। হাতটা যেন পঙ্গু হয়ে ছিল, তুলে ওটা ফেরত দিতেও পারেনি। থেকে থেকে ওটাও যেন মাথায় বিধছে। ঘরের মধ্যে নিঃশব্দচারী কার যেন আনাগোনা।

কে? কে রে তুই? রণু?

বোবা আলোড়ন। ধারাপদর মনে হল, রণু এসে বসেছে তার শিয়রের কাছে। যেমন ও বসত তার রোগ-শয্যায়। মেরুদণ্ডে ঘুণ-ধরা রণু নয়, নিঃশঙ্ক তরতাজা। নিটোল দুর্ভেদ্য অন্ধকারে দু চোখ টান করে চেয়ে রইল ধীরাপদ। কান পাতল। একটানা ঝিঁঝির ডাক, আর ফিসফিস জিজ্ঞাসা, কি হে, সোনাবউদি কেমন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *