কাল তুমি আলেয়া – ২৬

ছাব্বিশ

বিভূতি সরকারের সপ্তাহের খবরের অফিসের দরজায় কোম্পানীর স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে।

ধীরাপদ ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে ইতস্তত করল একটু। লাবণ্য, সরকার বোঝাপড়া করতে এসেছে তা হলে। সঙ্গে সিতাংশুও এসে থাকতে পারে। ধীরাপদ ঠিক কি উদ্দেশ্যে এসেছে নিজেও জানে না। তিনটে দিন আচ্ছন্নতার মধ্যে কাটিয়ে কাজে মন দিতে চেষ্টা করেছে। প্রথমেই মনে হয়েছে বিভূতি সরকারের সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। তাঁর অফিসের লোকের কাছে টেলিফোনে খোঁজ নিয়ে জেনেছে তিনি ফিরেছেন।

তাড়াতাড়ি সুলতান কুঠিতে ফেরার তাড়া ছিল। গণুদার ছেলেমেয়েরা নয় শুধু, গত দু দিন ধরে সেখানে আর একজন তার জন্য উন্মুখ প্রতীক্ষায় বসে থাকে। অমিতাভ ঘোষ। গত পরশু থেকে সে ধীরাপদর কাছে আছে। তার ঘরে থাকে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ধীরাপদ সোনাবউদির ঘরে থাকে। তিন দিন ধরে সেই চিঠিখানা তার পকেটেই ঘুরছে। এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না, ওটা কাছছাড়া করতে পারে না। ঘুমের ঘোরেও চিঠির কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। মনের এই অবস্থায় স্নায়ুবিধ্বস্ত অমিতাভ ঘোষকে সামলানো বিড়ম্বনা বিশেষ। এই ঝামেলা এড়াতেই চেয়েছিল। কিন্তু ক্ষোভে উত্তেজনায় অবিশ্বাসে আত্মতাড়নায় অসহায় শিশুর মত যে তাকেই শুধু আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছে, তাকে সে ফেরাবেই বা কেমন করে? উল্টে চিন্তিত হয়ে তাকে ডাক্তার দেখাতে হয়েছে, চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। প্রয়োজনে ধমকও দিতে হয়। অমিতাভ ওঠে, কিন্তু আরো বেশি কাছে আসে।

তার ওখানে আছে সে এ খবরটা চারুদির বাড়ির বা অফিসের কেউ জানে না। তার কড়া নিষেধ। কেউ যেন না জানে।

সকলের অগোচরে বিভৃতি সরকারের ওখান থেকে ফিরে যাবে ভেবেও পারল না। থাকলেই বা লাবণ্য অথবা সিতাংশু, ধীরাপদ তার কর্তব্যবোধে এসেছে। বরং ভালই হয়েছে। তারা মুখে না বলুক, মনে মনে বুঝবে সেও নিষ্ক্রিয় বা নিশ্চেষ্ট বসে নেই। কদিন ধরে শুধু এই কারণেই হয়ত সিতাংশু বিমুখ তার ওপর।

কিন্তু সে নেই। বিভূতি সরকারের ঘরে লাবণ্য একাই বসে। ভিতরে ঢোকার আগে ধীরাপদকে আবার দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। দাদার উদ্দেশে লাবণ্যর তীক্ষ্ণ অপমানকর কটূক্তি কানে এলো। কোন কিছুর জবাবেই সম্ভবত এক ঝলক তরল আগুনের ঝাপটা মেরে সে চুপ করল। বিভূতি সরকার মাথা নিচু করে কাগজ দেখছেন।

ধীরাপদকে এ সময় এখানে দেখবে লাবণ্য আদৌ আশা করেনি মনে হল। আর মনে হল, দেখে অখুশিও হয়নি। বরং এই আবির্ভাব সুবাঞ্ছিত যেন।

কাগজ ফেলে বিভূতি সরকার সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। হাসিখুশি দেখে একটুও বিড়ম্বিত মনে হল না তাঁকে। বরং এতক্ষণই যেন অসহায় বোধ করছিলেন, তাকে দেখে বল-ভরসা পেলেন।

– আসুন আসুন, কি ভাগ্য, বসুন। সকালে আপনি টেলিফোন করেছিলেন?

—হ্যাঁ। ধীরাপদ একটা চেয়ার টেনে বসল। খুব সহজ মুখেই কুশল প্রশ্ন করল, কেমন আছেন?

বিভৃতি সরকারের খাঁজ-পড়া ফর্সা মুখ অমায়িক হাসিতে ভরে উঠল।-ভালো থাকি কি করে বলুন, কাগজ চালানোর কি যে দায় কেউ বোঝে না। ওই দেখুন না, লাবণ্যের উদ্দেশে ইশারা – সেই থেকে রেগেই অস্থির, আমি কাগজ দেখব না—কে আপন কে পর সেই সেন্টিমেন্ট নিয়ে বসে থাকব? খবরের মত খবর পেলে কাগজওয়ালার আপন-পর জ্ঞান থাকে?

ধীরাপদ লক্ষ্য করল নির্বাক ক্রোধে লাবণ্যের মুখ আবারও লাল হয়ে উঠেছে। অগ্নিক্ষরণের পূর্বাভাস। ধীরাপদ মাথা নাড়ল। কথাটা মিথ্যে নয়।

বিভূতি সরকার বললেন, চাকরি যারা করছে তাদের সঙ্গে এ লেখার কি সম্পর্ক? এটা নিজেদের মান-অপমান ভাবছে কেন তারা? আপনাদের কোম্পানীর এ রকম একটা ব্যাপার—যে পেত সে-ই ছাপত। দু-চার দিনের মধ্যে অন্যান্য কাগজেও রিপোর্ট বেরুবে দেখবেন। সকলে শুধু প্রমাণের অপেক্ষায় আছে।

ধীরাপদ শান্তমুখে জানান দিল, যাতে না বেরোয় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিভূতি সরকার তার মুখের ওপর চকিত দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন একটা। বললেন, কিন্তু কাগজের স্বার্থ দেখলে না লিখে পারবে কি করে? ধরেছি যখন, আমার তো আরও অনেক লেখার আছে।

কোন্ স্বার্থ দেখে তুমি লিখেছ আর কোন্ স্বার্থের কথা ভেবে তোমার আরো লেখার আছে—আমরা জানি না ভেবেছ, কেমন? রাগ সামলাতে না পেরে লাবণ্যর গলা চড়ল আরো,— কত টাকা পেয়ে তোমার এই স্বার্থের জ্ঞান টনটনিয়ে উঠেছে? তুমি আমাকে বললে না কেন, আমি তার ডবল টাকা দিতুম—

আশ্চর্য, এর পরেও বিভূতি সরকার হাসলেন। হেসে ধীরাপদর দিকে চেয়ে বললেন, শুনলেন কথা? তারপর লাবণ্যকে বললেন, খবরটা তোকে আগে জানিয়ে রাখার ইচ্ছে ছিল, বার দুই টেলিফোনও করেছিলাম—কিন্তু তোকে ধরতে হলে তো কাজ ফেলে টেলিফোন নিয়েই বসে থাকতে হয়। কাজের চাপে পরে আর মনেও ছিল না।

কথাটা সত্যি নয় ধীরাপদর বুঝতে দেরি হল না। হয়ত লাবণ্যরও না। আর জেরা না করে রাগে বিতৃষ্ণায় গুম হয়ে বসে রইল সে। বিভূতি সরকার আজ যে নিয়ে রেখেছেন, কাগজে তাঁর আরও লেখার আছে। ধীরাপদ জানে। একটু চুপ করে থেকে খুব নির্লিপ্ত সুরে বলল, যে ব্যাপারে মাথা দিয়েছেন মনে না থাকারই কথা। …কিন্তু আপনি এঁর দাদা বলেই বলছি, এ রকম একটা রিস্ক আপনি নিলেন কি করে? যেটুকু লিখেছেন, কোম্পানি তো চুপ করে বসে থাকবে না।

হাসিটুকু বজায় রেখেই বিভূতি সরকার ঈষৎ তপ্ত প্রশ্ন ছুঁড়লেন, কেন, কোর্টে দু-দুটো কেস উঠেছে সেটা মিথ্যে নাকি?

মিথ্যে নয়। কিন্তু কেস রিপোর্ট করার বাইরেও আপনি অনেক কথা লিখেছেন। তিন হাজার টাকা আপনি হাতে পেয়েছেন, আরো লিখলে আরো দু হাজার পাবেন জানি। কিন্তু কোনো প্রমাণ হাতে না নিয়ে শুধু পাঁচ হাজার টাকার জন্যে এই ঝুঁকি কি করে নিলেন জানি না।

বিভূতি সরকার বিচলিত হয়েছেন বোঝা গেল। সঠিক টাকার অঙ্কটা এইভাবে আর একজনের মুখ থেকে শুনবেন আশা করেন নি হয়ত। ফলে যে কারণে অঙ্গস্তি সেটাই জোর দিয়ে তুচ্ছ করতে চাইলেন। বললেন, সেজন্যে ভাবি না, দরকার হলে প্রমাণও সবই হাতে আসবে।

ধীরাপদ মুচকি হাসল একটু। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভালো কথা।

কিন্তু আসার আগে কোনো কাগজঅলা এ রকম ঝুঁকি নিতে পারেন জানা ছিল না। গোলযোগ যদি হয় পাঁচ হাজারের পাঁচ গুণ দিয়েও এর জের সামলানো যাবে না হয়ত। আচ্ছা, চলি-

বসুন, বসুন একটু চা খান, আর আলোচনাটা উঠলই যখন—

না, আর বসব না, তাড়া আছে।

তা হলে আমিই যাব একদিন আপনার কাছে। কবে যাব বলুন, আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ তো কিছু নেই—

নেই-ই বা বলি কি করে, সম্ভব হলে আপনার এই কাগজ তুলে দেবার চেষ্টাও কোম্পানীর তরফ থেকে তো আমাকেই করতে হবে। ধীরাপদ নির্লিপ্ত, এরপর আপনি আর কতটা এগোবেন তাই বরং ভাবুন। আচ্ছা, নমস্কার।

বেরিয়ে এলো। এসে কাজ হয়েছে। বিভূতি সরকার আপাতত আর কিছু লিখবেন মনে হয় না। লোভের সঙ্গে ভয়ের একটা সহজাত যোগ আছে। এরপর তাঁর মন সুস্থির হতে সময় লাগবে। অমিতাভ জানতে পেলে ক্ষেপে যাবে। তবে জানার আশঙ্কা কম। অমিতাভর অজ্ঞাতবাসের খবর বিভূতি সরকারের পাবার কথা নয়। এক অমিতাভ নিজে যদি আসে। তাও আসবে না হয়ত, কাগজের মারফৎ যা সে করতে চেয়েছিল তা করা হয়ে গেছে। এখন তার মাথায় দিবারাত্র শুধু কোর্ট ঘুরছে।

লাবণ্যর গম্ভীর মুখেও চাপা বিস্ময় লক্ষ্য করেছে ধীরাপদ। দাদাটি হঠাৎ এ ভাবে ঘায়েল হবেন ভাবেনি বোধ হয়। অবশ্য ক্ষতি যা হবার হয়েই গেছে, তবু খুশি হয়েছে মনে হল।

দাঁড়ান –

ধীরাপদ দাঁড়াল। একেবারে অপ্রত্যাশিত আহ্বান নয়। লাবণ্য কাছে এসে বলল, গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে দেখেও চলে যাচ্ছেন কেন? উঠুন—

দুজনে স্টেশন ওয়াগনে উঠল। মুখোমুখি দুটো বেঞ্চিতে বসল। ড্রাইভারের উদ্দেশে লাবণ্য সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দিল, বাড়ি-

ধীরাপদর দিকে ফিরল, আপনি এখন যাবেন কোথায়?

বাড়ি।

কোন বাড়ি?

সুলতান কুঠি।

সেখানেই আছেন এখন?

হ্যাঁ।

চেয়ে রইল একটু। ধীরাপদ ভাবল, তাকে সুস্থ দেখাচ্ছে না লাবণ্য এ কথাই বলবে এবার। কিন্তু তা বলল না। বলল, বাড়ি পরে যাবেন, আমার ওখানে চলুন, আপনার সঙ্গে দরকারী পরামর্শ আছে।

লাবণ্যর এই জোরের সুরটা অনেক দিন বাদে শুনল। জোরের কারণও আছে বই কি। সোনাবউদির ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে কম ঝুঁকি নেয়নি। ডাক্তারের যা করার কথা নয় তাই করেছে। ধীরাপদর জন্যই করেছে। যখনই মনে পড়ে, ধীরাপদ অবাক হয়। অথচ সেই এক সন্ধ্যার পরে লাবণ্য এ নিয়ে আর এতটুকু কৌতূহল প্রকাশ করেনি, একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেনি। ভুলেই গেছে যেন।

বুকের কাছটা জ্বালা-জ্বালা করে উঠল। বুকপকেটে সোনাবউদির চিঠিটা মাঝে মাঝে এমনি জ্বালা ছড়ায়। মাঝের এই তিনটে দিনের যে কোনো দুর্বল মুহূর্তে ওটা হয়ত লাবণ্যকে দেখিয়েই ফেলত, যদি না চিঠিতে ওই শেষের কথা ক’টা লেখা থাকত। ….ভগবানের কাছে সোনাবউদির শতকোটি প্রার্থনা, লাবণ্য যেন ওকে চিনতে পারে। উদগত অভিমানে ধীরাপদ রাস্তার দিকে মুখ ফেরাল, উনি নিজেই যেন কত চিনতে পেরেছেন। চিঠিটা কালই বাক্সে রেখে দেবে।

লাবণ্য সামনের দিকে ঝুঁকল একটু, ঈষৎ আগ্রহে বলল, দাদা তো বেশ ঘাবড়েছে মনে হল, যা বলে এলেন ভাঁওতা না সত্যি?

এ প্রসঙ্গ উঠবে জানে। কিন্তু ধীরাপদর ভালো লাগছে না। সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, সত্যি।

কিন্তু দাদা যে বলল অনেকদিন ধরে খুঁটিনাটি অজস্র প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে, এমন কি কাজকর্ম খাতাপত্র হিসেবনিকেশের বহু ফোটো কপি পর্যন্ত আছে।

সে সব তাঁর কাছে নেই।

আপনাকে কে বললে?

অমিতবাবু।

একটু চুপ করে থেকে লাবণ্য আবার জিজ্ঞাসা করল, তাঁর সঙ্গে আপনার এর ভেতর দেখা হয়েছে?

ধীরাপদ জবাব দিল না, দৃষ্টি বাইরের দিকে।

এটুকুতেই লাবণ্য অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, বলল, আমার সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করতেও আপনার আপত্তি বোধ হয়?

ধীরাপদর দু চোখ আপনিই আবার তার দিকে ফিরল।— আপত্তি নয়, আজ ভালো লাগছে না।

লাবণ্যর এবারের নীরব পর্যবেক্ষণ অনুকূল নয়, ভালো আপনার কোনদিনও লাগে না। কিন্তু আপনার মনে কখন কি আছে খোলাখুলি বললে একটু বুঝে-সুঝে চলার চেষ্টা করা যেত। যখন-তখন অপমান হওয়ার ভয় থাকত না।

যখন-তখন অপমানের অনেক নজির মজুত আছে ধীরাপদ জানে। এই ক্ষোভ সদ্য কোনো কারণ-প্রসূত কিনা বুঝে উঠল না। চেয়ে রইল।

লাবণ্য শান্তমুখে বলে গেল, কাল পথে আপনার রমেন হালদারের সঙ্গে দেখা, পথ আগলে তাদের দোকানে একবার পায়ের ধুলো দেবার জন্যে দু হাত জুড়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করল। তার আর কাঞ্চনের দোকান, আপনি দোকান করার টাকা দিয়েছেন—আপনার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

রমেনের স্বভাব জানা আছে। তবু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, এতে অপমানের কি হল? কিন্তু চুপ করেই রইল, অযথা বিতর্ক করার মত মনের অবস্থা নয়।

লাবণ্য এখানেই শেষ করার জন্য এ প্রসঙ্গ তোলেনি, সে চুপ করে থাকল না। একটু অপেক্ষা করে বলল, আপনাকে এ রকম উদারতার খেসারত দিতে হবে জানলে চুরির ব্যাপারটা তুচ্ছ করেও ওকে আদর করে রেখে দিতাম।

সোনাবউদিকে চিতায় তোলার সার্টিফিকেট দিয়ে লাবণ্য হয়ত অনেকটাই কিনে ফেলেছে তাকে। নইলে এর জবাবে ধীরাপদর বলার কথা, ভগ্নিপতি সর্বেশ্বরের কাছ থেকে টাকা না নিলে ছেলেটার চাকরি যাবার পরে অন্তত চুরির ব্যাপারটা তুচ্ছই ভাবতে পারত সে।

কিন্তু জবাব না পাওয়াটাও তাচ্ছিলের সামিল। নিরীহ মন্তব্যের সুরে লাবণ্য এবারে জিজ্ঞাসা করল, এতগুলো টাকা দিলেন, ওই মেয়েটাও আপনার চোখে বেশ ভালই বলতে হবে…তাই না?

নিরুপায় ধীরাপদ তার মুখ বন্ধ করার জন্যই এড়িয়ে বলল, আমি যাই করে থাকি কাউকে অপমান করার উদ্দেশ্য নিয়ে করিনি, আপনার সঙ্গে রমেনের কোনদিন রাস্তায় দেখা হতে পারে ভেবেও না। এ আলোচনা থাক—

অকারণ ঝগড়ার মত শোনাবে বলে হোক, বা তার মুখে-চোখে শ্রান্তির ছাপ লক্ষ্য করে হোক, লাবণ্য আর কিছু বলল না। আরো কয়েক পলক দেখল শুধু, তারপর রাস্তার দিকে ঘুরে বসল।

গাড়ি থামতে নামল তারা। আগে লাবণ্য, পিছনে ধীরাপদ। সিঁড়ি ধরে উপরে উঠল। লাবণ্য আগে আগে, ধীরাপদ পিছনে। দৃষ্টিটা এত কাছে প্রতিহত হচ্ছে বলে অস্বাচ্ছন্দ্য। সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকেই ধীরাপদর ভিতরে ভিতরে কে সজাগ হয়ে উঠতে চাইছে। সজাগ হলে একটা মৃত্যুর অবরোধও খানিকক্ষণের জন্য মিলিয়ে যেতে পারে অনুভব করছে। কতকাল ধরে যেন এই চেনা বিস্মৃতির থেকে অনেক দূরে সরে আছে সে।

সামনের বসবার ঘরের দরজায় মস্ত একটা তালা ঝুলছে। বাড়িতে ঝি-চাকরও নেই বোঝা গেল। হাতব্যাগ থেকে চাবি বার করে লাবণ্য তালা খুলল। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল, তার পরের ঘরটারও।- আসুন।

যে ঘরটায় রোগী থাকত সেই ঘরের ভিতর দিয়ে লাবণ্যকে অনুসরণ করল। ঘরটা খাঁ খাঁ করছে, জানলাগুলোও বন্ধ।

পরের ঘরটাও অন্ধকার। ধীরাপদ চৌকাঠের এধারে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। শয্যা- সংলগ্ন দেয়ালের সুইচ টিপে লাবণ্য আলো জ্বেলে আবার ডাকল, আসুন—

ধারাপদ পায়ে পায়ে ভিতরে এসে দাঁড়াল। ঘরের মাঝামাঝি একটা ইজিচেয়ার, অদূরে একটা শৌখিন ছোট টেবিল আর একটা চেয়ার। টেবিলে টেলিফোন, খানকতক বই আর বড় ব্যাগটা। ইজিচেয়ারটা একটু টেনে দিয়ে লাবণ্য বলল, বসুন—

ঘরের জানলাগুলো খুলে দিল। বাইরেটা অন্ধকার। একটা জানলা বরাবর ফুটপাথ- ঘেঁষা ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে। ঘরের জোরালো আলোয় ওটা বিচ্ছিন্ন মনে হয়।

ইজিচেয়ারে বসে ধীরাপদ ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। এত বড় ঘরে যেমন ভাবে যা থাকলে মানায়, তেমনি পরিপাটি ভাবে সাজানো গোছানো।

ইলেকট্রিক হিটার জ্বেলে লাবণ্য কেটলিতে চায়ের জল চড়ালো। তারপর এধারের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। একটু বাদে তোয়ালে দিয়ে ভিজে হাত মুখ মুছতে মুছতে ফিরে এলো। তোয়ালে রেখে ছোট টেবিলটার দিকে এগোল। টেলিফোনের নম্বর ডায়েল করল। কথা শুনে বোঝা গেল কোথায় ফোন করছে। মেডিক্যাল হোমে জানিয়ে দিচ্ছে, তার যেতে দেরি হবে।

রিসিভার রেখে চা করতে বসল। তাক থেকে আগে ঝকঝকে দুটো পেয়ালা নামিয়ে গরম জলে ধুয়ে নিল বেশ করে, তারপর চায়ের অন্যান্য সরঞ্জাম নামালো।

ধীরাপদর চোখ দুটো আবার অবাধ্য হয়ে উঠছে। একটা মৃত্যুর ছায়াও আড়ালে সরে যাচ্ছে। এই ঘরের বাতাস, ওই শয্যা, আসবাবপত্র, এই ইজিচেয়ারটা— সব কিছুর মধ্যে এক সরল মাধুর্যের স্পর্শ লেগে আছে। জীবনের তাপ ছড়িয়ে আছে। এমন কি ঘরের এই নীরবতাটুকুও স্পর্শবাহী। সচেতন হয়ে ধীরাপদ নিজেকে আবার সেই পুরুষকারহীন গোপনতার কবরের তলায় ঠেলে দিতে চেষ্টা করল। লাবণ্যর চা করা হয়ে এলো। এখনি ফিরবে। ফিরলে তাকে দেখতে পাবে। কিন্তু তার আগে আরো কয়েকটা মুহূর্ত হাতে আছে।…ওই দেহতটের প্রতিটি রেখা প্রতিটি তরঙ্গ বড় বেশি চেনা। হাতের মুহূর্ত ক’টা নিঃশেষেই খরচ করছে ধীরাপদ।

লাবণ্য উঠল। আগে ঘরের কোণ থেকে একটা ছোট টেবিল এনে সামনে রাখল। তারপর চা দিল, প্লেটে বিস্কুট। বলল, ঘরে আর কিছুর ব্যবস্থা নেই—। নিজের পেয়ালাটা নিয়ে বিছানায় বসল সে।

সামান্য কথা ক’টা অকুল বিস্মৃতির সমুদ্র থেকে বাস্তবে ফেরার আশ্রয়ের মত। তার দিকে চেয়ে ধীরাপদর মনে হল, এতক্ষণ মহিলা নিজের সমস্যা নিয়েই মগ্ন ছিল, আর কোনো দিকে খেয়াল ছিল না। চোখে-মুখে এখনো গভীর চিন্তার ছাপ। কাচের ওপর থেকে আব্‌ছা বাষ্পকণা মুছে দেবার মত করে দুটো দরদী হাতে ওই মুখের চিন্তার প্রলেপ মুছে দিতে পারলে ধীরাপদ দিত।

চায়ের পেয়ালা আর বিস্কুট তুলে নিয়ে বলল, সব ব্যবস্থারই তো ওলট-পালট দেখছি। খাওয়া-দাওয়া চলছে কোথায়?

বলার এই সুরটা একটুখানি ব্যতিক্রমের মত লাবণ্যর কানে লাগার কথা। লাগল কিনা বোঝা গেল না। চা খেতে খেতে দেখল একটু। তারপর ক্ষুদ্র জবাব দিল, বাইরে। ধীরাপদ চা খাচ্ছে। বিস্কুট চিবুচ্ছে। আর সহজতার আবরণে মুখখানা ভরাট করে তুলছে। এই সান্নিধ্যে আর কিছুক্ষণ কাটাতে পারলে মাঝের ক’টা দিন সাময়িকভাবে অন্তত ভোলা যাবে।

লাবণ্য চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রাখল। দরকারী পরামর্শের সূচনায় মুখখানা আরো গম্ভীর। ছোট টেবিলটা হাত দুই-তিন সরিয়ে রেখে প্রস্তুত হয়ে বসল। বলল, আপনার মস্ত একটা শোকের ব্যাপার চলেছে বুঝতে পারছি, কিন্তু এদিকে যা শুরু হয়েছে আপনি না দেখলে চলে কি করে?

এদিকে যাই শুরু হোক, লাবণ্যর উক্তির শুরুটা ধীরাপদর পছন্দ হয়নি। শোকের ব্যাপারটা যে বড় ব্যাপার নয় কিছু, প্রকারান্তরে তাই বলা। তবু রাগ করল না, একটু আগের ভালোলাগাটুকু ছেঁটে দিতে মন চায় না। জবাব দিল, আমার আর কি দেখার আছে বলুন, সিতাংশুবাবু তো উকিল-ব্যারিস্টারের পরামর্শ নিচ্ছেন…

মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়ে গেলে এই কোম্পানী থাকবে? আর কিছু না হোক সুনাম তো নষ্ট হবেই—

সুনাম গেলে কতটা গেল ধীরাপদ জানে, আশ্বাস দেবার নেই কিছু। বলল, কোম্পানীর মালিকরা এত বড় ভুলের রাস্তায় এগোলে আমি আপনি ভেবে আর কি করতে পারি। বড় সাহেব আসুন—

মনঃপুত হল না, অসহিষ্ণু সুরে বলল, অমিতবাবুও খুব নির্ভুল রাস্তায় এগোচ্ছেন না।

আমি সব মালিকদের কথাই বলছি। তবে রিসার্চ ল্যাবরেটারি একটা হলে গণ্ডগোল এতটা পাকাতো না হয়ত।

জবাবে এবারেও বক্র ঝাঁজই প্রকাশ পেল। রিসার্চ ল্যাবরেটারি তো সেদিনের কথা, গণ্ডগোল পাকানোর মালমশলা তিনি যে অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করছেন সেটা বুঝতে কারো বাকি নেই।

অপ্রিয় বাদানুবাদ এখনো এড়াতেই চায় ধীরাপদ, তাই চুপ করে রইল। বললে: এবারে অনেক কথাই বলা যেত। কিন্তু ক্ষোভ তাতে আরও বাড়বে বই কমবে না।

খানিক গুম হয়ে থেকে লাবণ্য বর্তমান সমস্যার আর একদিকে ফিরল।—ও কথা থাক, এদিকে দাদার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কেমন তা তো জানেন, কিন্তু সে যা করেছে বড় সাহেবের কাছে মুখ দেখানো দায় হবে। এরই বা কি করা যাবে?

ধীরাপদর এবার ভালো লাগছে। লাবণ্যর রাগ ক্ষোভ স্বার্থ ইচ্ছে অনিচ্ছে এমন কি তার বলিষ্ঠতার মধ্যেও একটা বস্তুতন্ত্রীয় স্পষ্টতা আছে যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তিগুলোর মিল। এই মিল থাকলে মনের দিক থেকে সম্ভ্রম বা বিদ্বেষের ব্যবধান ঘোচে।

সিতাংশুবাবুকে বলুন কড়া করে অ্যাটর্নির চিঠি দিক—

সিতাংশুবাবুকে বলব কেন, আপনি দিতে পারেন না?

ধীরাপদর হাসি পাচ্ছিল। গোপন করতে হল। তার ওপর এই নির্ভরতার দাবিও নতুন লাগছে।—পারি, কিন্তু তাতে তো বড় সাহেবের কাছে আপনার মুখ দেখানোর সমস্যা যাবে না, সিতাংশুবাবুর মারফৎ উকিলের চিঠি গেলে তিনি হয়ত তাঁর বাবাকে বোঝাতে পারবেন আপনার পরামর্শ মতই এ কাজ করা হয়েছে—আপনি দাদা বলে খাতির করেননি।

বিদ্রুপ করতে চায়নি, বরং যাকে ভালো লেগেছে, সহজ ঠাট্টার ছলে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপে মগ্ন হবার বাসনাই ছিল। কিন্তু লাবণ্যর বর্তমান মানসিক অবস্থায় রসিকতাটুকুর বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে গেল। নিষ্পলক চেয়ে রইল কয়েক নিমেষ।

এই ব্যাপার ঘটেছে বলে আপনি তাহলে মনে মনে খুশি, কেমন?

বেগতিক দেখে ধীরাপদ এবারেও ঠাট্টার সুরেই জবাব দিল, খু-উ-ব আপনি সব সময় আমার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করেন কেন? আপনার আমি কখনো কোনো ক্ষতি করেছি?

বিস্মৃতির আবেশ গেল। বুকপকেটে সোনাবউদির চিঠিটা খরখর করে উঠল বুঝি। ক্ষতি না করার খোঁচায় লাবণ্য সরকার তার বুকের তলার ক্ষতটার ওপরেই আঘাত দিয়ে বসল। তার সাহায্যে সোনাবউদির দেহ বিনা বিড়ম্বনায় চিতায় তোলা গেছে, ভস্মীভূত করা গেছে—সেই ইঙ্গিত ভাবল। আবারও মনে হল, এই জোরেই কথাবার্তার এমন সুর পালটেছে, ধরন-ধারণ বদলেছে।

তার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল, আস্তে আস্তে বলল, না, অনেক উপকার করেছেন। লাবণ্য সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁজিয়ে উঠল, উপকার করার কথা আপনাকে বলা হয়নি! তারপর তপ্তশ্লেষে মন্তব্য করল, উপকার সর্বত্র আপনিই করে বেড়ান দেখছি, আমারও করেছেন বারকয়েক উপকার। সেই ভরসাতেই আপনার সঙ্গে একটু পরামর্শ করার ইচ্ছে ছিল, আপনার তাতে আপত্তি থাকলে থাক-

আপত্তি নেই, বলুন।

পরামর্শের মেজাজে চিড় খেলেও বাস্তব সমস্যাটা ছোট নয়। স্বল্পক্ষণের নীরবতায় সেই উপলব্ধিটাই বড় হয়ে উঠল হয়ত। বলল, দাদা আপনার কথায় তখন ভয় পেলেও চুপ করে বসে থাকার লোক নয়। এর পর অমিতবাবুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে ছুটবে নিশ্চয়, আর অমিতবাবুও তো তাকে বিপদে ফেলার জন্য এ কাজ করাননি-

ধীরাপদ বলল, আপাতত তাঁর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

লাবণ্য সঠিক বুঝে উঠল না, ঈষৎ বিস্মিত।—কেন, তিনি চারু দেবীর ওখানে নেই এখন?

অর্থাৎ চারুদির বাড়ি অথবা তাঁর সঙ্গে অমিত ঘোষের সম্পর্কটা বিভূতি সরকারের অজ্ঞাত নয়।–না, আমার ওখানে আছেন।

সুলতান কুঠিতে?

হ্যাঁ।

মুখে বিস্ময়ের রেখা পড়তে লাগল।-এ খবরটা আপনি বলেন নি তো?

বলার কি আছে?

শুধু বিস্ময় নয়, ধীরাপদর মনে হল খবরটা শোনার পর তার সততায় কতটা বিশ্বাস করা যেতে পারে সেই খটকাও লেগেছে। এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ঘোচানোর প্রতিশোধে মেতে উঠেছে যে লোক সে সকলকে অবিশ্বাস করে তার ঘরে তারই সঙ্গে আছে, এটা খুব সহজভাবে নিতে পারার কথাও নয় হয়ত। তবু দৃষ্টিটা ধারালো হয়ে উঠল ধীরাপদর, ভিতরে ভিতরে একটা উষ্ণ স্রোত ওঠানামা করতে লাগল।

খানিক চুপ করে থেকে লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল, তিনি সব সময়েই বাড়িতে থাকেন?

এখন থাকছেন। শরীর খুব অসুস্থ, বড় ডাক্তার দেখছেন।

ডাক্তারের নামও বলে দিল।

কি হয়েছে?

নতুন কিছু নয়, যা হয় তাই, এবারে আরো বেশি মাত্রায় হচ্ছে।

লাবণ্য তেতে উঠল। অসুখ নিয়েও বিশদ আলোচনার বাসনা নেই বুঝেছে হয়ত। অনুচ্চ সংযত স্বরেই বলল, হলে ডাক্তার তা কমাবে কি করে? আপনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে ফেরাতে চেষ্টা করছেন, নাকি আপনিও ডাক্তারের ভরসাতে আছেন?

আপনার কি মনে হয়?

জবাব পেল না। কিন্তু লাবণ্যর এই মুখও যদি অন্তরের দর্পণ না হয়, তাহলে ধীরাপদর এতকালের এত দেখার গর্ব মিথ্যে। এই দর্পণে সংশয়ের ছায়া দুলেছে। ধীরাপদ নিজের সঙ্গে যুঝছে এখনও। সে বিচলিত হবে না, স্নায়ুগুলো বশে রাখবে।

লাবণ্য কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিল কি। তাঁর সঙ্গে আমার একবার দেখা হওয়া দরকার।

বলব। তিনি আমার ওখানে আছেন সেটা কারো জানার কথা নয়…

বক্তব্য বুঝে নিতে সময় লাগল না। লাবণ্যর উষ্ণ দুই চোখ আবার তার মুখের ওপর স্থিরনিবদ্ধ হল। – তাহলে আর যাব না। আপনিই আমার হয়ে তাঁর কাছ থেকে দয়া করে জেনে নেবেন, আমি এখানকার কাজ ছেড়ে দিই—এই তিনি চান কি না। আমি জিজ্ঞাসা করেছি বলবেন। এ পর্যন্ত তাঁর অনেক অন্যায় আমি মুখ বুজে সহ্য করেছি, কিন্তু এবারে তিনি মাত্রা ছাড়িয়েছেন। মামলায় নার্সিং হোমকে জড়িয়ে তিনি আমাকেও অপদস্থ করতে চাচ্ছেন। তাঁকে বলবেন, এ রকম ব্যবহার তিনি কেন করছেন আমি জানতে চেয়েছি।

এমনি এক সুযোগের প্রতীক্ষাতেই ছিল বুঝি। সেটা আসা মাত্র অস্তস্তলের সব যোঝাযুঝির অবসান। মুখ বুজে ধীরাপদও অনেক সহ্য করেছে এতক্ষণ। যা জানতে চায় এবারে তা সে খুব স্পষ্ট করেই জানাবে। দেরি করলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে, তবু সুশোভন অবকাশ দরকার একটু। ততক্ষণে ধীরাপদর নিজের ভিতরটা আর একটু শান্ত হোক, মুখভাব আরো একটু সংযত হোক, নির্লিপ্ত হোক।

তাঁর ধারণা, আপনি দু নৌকোয় পা দিয়ে চলেছেন।…একদিন ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন। বোধ হয় সেই জন্যেই….

অমিত ঘোষের এই ধারণাটা লাবণ্য জানত না এমন হতে পারে না। কিন্তু আর একজনের মুখ থেকে সেটা শোনার প্রতিক্রিয়া যতটা দেখবে আশা করেছিল তার থেকে বেশি ছাড়া কম দেখল না। বসার ভঙ্গী বদলালো, মুখের রঙ বদল হল, আয়ত চোখে আগুন ছুটল। পদমর্যাদা আর আত্মবোধের খোলসটাও ভাঙল বুঝি।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর কানের পরদা চিরে দিয়ে গেল।— আর উনি? উনি নিজে ক’নৌকোয় পা দিয়ে বেড়াচ্ছেন? তাঁর কাছে একটা ফোটো অ্যালবাম আছে। সেটা একবার চেয়ে দেখে নেবেন, তারপর তাঁর ধারণার কথা শুনতে বসবেন।

অতটাই ক্রুদ্ধ না হলে, এই উক্তি করার আগে লাবণ্য ভাবত একটু। দেখতে যাকে বলছে সেই রমণীটি বর্তমানে সন্তান-সম্ভবা এ খবরটা ধীরাপদ জানাতে গিয়েও চেপে গেল। তার থেকেও সরস কিছু বলার আছে। তাকে দেখতে বলা হয়েছে বলেই যেন দ্বিধাগ্রস্ত জবাবটা বেরুলো মুখ দিয়ে—দেখেছি। আগে আপনার গোটাকয়েক ছবি আছে। পরেরগুলো পার্বতীর।

লাবণ্য স্তব্ধ খানিকক্ষণ। লোকটাকে যেন আবার একেবারে গোড়া থেকে দেখা শুরু করা দরকার। দেখতে গিয়ে তার মুখটা বেশ করে ঝলসে নি আগে। অনুষ্ঠ কঠিন স্বরে বলল, ও…তাঁর ধারণার সঙ্গে আপনার ধারণার বেশ মিল হয়েছে তাহলে। থামল একটু, দেখছে। যত বিরোধ আর যত বিদ্বেষের মূলে যেন শুধু এই একজন, আর কেউ নয়। মুখের ওপর চরম একটা আঘাত হেনে বসল তারপর।— আমি যেমনই হই আর যত নৌকোয় পা দিয়ে চলি, আমার জন্যে কাউকে চাকরি খুইয়ে পাগল হয়ে জেলে যেতে হয়নি, আর আমার জন্যে কারো বউকে আত্মহত্যা করেও জ্বালা জুড়োতে হয়নি, বুঝলেন?

ধীরাপদর হঠাৎ এ কি হল? মগজের মধ্যে এ কার দাপাদাপি শুনছে সে? চেয়ার থেকে কে তাকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল? পায়ের নিচে মাটি দুলছে, সমস্ত ঘরটা দুলছে, দেয়ালের আলোটা একটা আগুনের গোলার মত জ্বলছে। ধীরাপদ জানে না সে কি করছে, জানে না সে কি করবে। কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একেবারে মুখের কাছে। পায়ের সঙ্গে পা ঠেকেছে, হাত দুটো থাবার মত লাবণ্যর দুই কাঁধে চেপে বসেছে, মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকেছে।

কি বললে?

এই প্রতিক্রিয়া আর এই স্পর্ধা দেখার জন্য লাবণ্য প্রস্তুত ছিল না। সর্বাঙ্গের রক্তকণাগুলো ছুটোছুটি করে তার মুখের ওপর ভিড় করল, তারপর সেখানে স্থির হল।

ধীরাপদ আরো একটু ঝুঁকল, হাত দুটো কাঁধ ঘেঁষে বাহুর ওপর আরো জোরে চেপে বসল। তেমনি অস্ফুট কণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করল, কি বললে তুমি?

এবারেও লাবণ্য জবাব দিল না। তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল না। নিজেও নড়ল না। তার আগে সে যেন শেষ দেখে নিচ্ছে। দুঃসাহসের দৌড় দেখে নিচ্ছে।

আমার জন্যে কাউকে জেলে যেতে হয়নি, আমার জন্যে কারো বউ আত্মহত্যা করেনি। কিন্তু তোমার জন্যে তিলে তিলে নিজেকে হত্যা করেছি আমি। করছি। অধঃপতনের একেবারে তলায় এসে ঠেকেছি। দুঃসহ উত্তেজনায় আরো মৃদু আরো নির্মম কঠিন স্বরে ধীরাপদ বলে গেল, শুধু তোমার জন্যে, বুঝলে? একদিন আমি খেতে পেতাম না, কার্জন পার্কের বেঞ্চএ বসে হাওয়া খেয়ে দিন কাটত। কিন্তু সেই ক্ষুধার জ্বালায়ও এভাবে মাথা খুঁড়িনি কখনো। তুমি আমার অনেক-অনেক ক্ষতি করেছ।

আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। আরো রূঢ় আরো কঠিন কিছু। বলতে যাচ্ছিল, শুধু নিজের স্বার্থে তৃষ্ণার জল দেখিয়ে ঘুরে বেড়ায় যে, পুরুষের এই ক্ষতি সে বুঝবে কেমন করে?

বলা হল না।

তার হাতের মুঠোয় এক রমণীর দেহ। পুরুষের এই সান্নিধ্যেও তীক্ষ্ণ, অবিচলিত। দুই চোখের বিদ্বেষ আর বিদ্রুপের বন্যা ধীরাপদর ঝুঁকে পড়া মুখে এসে ভাঙছে। আঘাতে আঘাতে একটা ব্যঙ্গ-ভরা শূন্যতার গহ্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ঘরের বাতাসও যেন এক অপরিসীম অবজ্ঞার ভারে থমকে আছে।

এক ঝলক তপ্ত নিঃশ্বাসের স্পর্শে ধীরাপদ আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্পর্শটা মুখের ভিতর দিয়ে হাড়ের ভিতর দিয়ে পাঁজরের ভিতর দিয়ে বক্ষের পাতালে এসে মিশল। শিরায় শিরায় বহুদিন যে শিখা জ্বলে জ্বলে উঠতে চেয়েছে আজ আর কেউ সেটা নিবিয়ে দিল না। যে গ্রাসের নেশা বহুবার দু চোখে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে আজ আর কোনো ভ্রুকুটিতে সেটা বাধা পেল না। ইতিহাসের আদিপর্বের যে পুরুষ ক্রুর খেদে বহুবার ব্যবধান ঘোচাতে চেয়েছে আজ আর কেউ তাকে শেকলে বেঁধে টেনে নিয়ে গেল না।

ধীরাপদ চকিতে দেয়ালের দিকে তাকালো একবার। কাঁধ থেকে একটা হাত নেমে এলো। দেয়ালের গায়ের সুইচে খট করে শব্দ হল একটা।

অন্ধকার। অশান্ত নির্দয় দুই বাহুবেষ্টনে বন্দিনীর সমর্পণঘন বিপুল বিভ্ৰম।

ধীরাপদ চোখ মেলে তাকালো। বাণীশূন্য মহা-নৈঃশব্দের গভীর থেকে প্রাণের প্রথম জাগরণের মত। বিস্মৃতির স্তরে স্তরে চেতনার বিদ্যুৎ। কতক্ষণ কেটেছে জানে না। যতক্ষণই হোক, খণ্ডকালের কোনো ছোট পিঞ্জরে সেটা ধরবার মত নয়। সময়ের বেড়া ছাড়িয়ে অস্তিত্বের মরুসমুদ্র পার হওয়ার এই যাত্রা কি সম্ভব? ধীরাপদ স্বপ্ন দেখে উঠল?

সামনের দিকে তাকালো। স্বপ্ন নয়।

আস্তে আস্তে শয্যা থেকে নেমে দাঁড়াল। নিবিড়তা ভঙ্গের অভিযোগে দেহের শিরাগুলো স্পন্দিত হল দু-একবার। ঘরের অন্ধকার এখন আর জোরালো লাগছে না। বাইরের ল্যাম্পপোস্টটা শীর্ণ দূত পাঠাতে চেষ্টা করছে। এতক্ষণ চোখে পড়েনি। ধীরাপদ আর একবার ঘুরে তাকাে যার দিকে তাকালো সে শয্যায় মিশে আছে তখনো। মুখ দেখা যায় না। কিন্তু ধারাপদ জানে, আবছা অন্ধকারের পরদা ঠেলে দু চোখ মেলে সে তাকেই লক্ষ্য করছে নিঃশব্দে।

বুকের কাছে সেই থেকে খরখর করছিল কি। এখন হাত ঠেকতে মনে পড়ল। সোনাবউদির চিঠিটা। নিস্পন্দ কয়েক মুহূর্ত। নিজের অগোচরেই খামটা হাতে উঠে এলো। দুমড়ে গেছে একটু। আঙুলে করে সেটা ঠিক করে নেওয়ার ফাঁকে আবারও শয্যার দিকে ফিরল একবার। তারপর খামটা ছোট টেবিলটার ওপর রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

রাস্তা। অন্ধকার দিকটা ছেড়ে কখন আলোর ধার ধরে চলতে শুরু করেছে সে। ধীরাপদ যেন নিজেরই নিভৃতের কোনো একটা দরজায় কান পেতে আছে। বিবেকের অস্ত্র হাতে কেউ বেরুবে ওই দরজা খুলে। তাকে বিধবস্ত করবে, খণ্ড খণ্ড করে হৃৎপিণ্ডটা কাটবে। কিন্তু সাড়াশব্দ নেই কারো। উল্টে মনে হচ্ছে কত কালের কত যুগের আত্মনিপীড়নকারী একটা জমাট বাঁধা অবরোধ যেন বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেছে। হঠাৎ খেয়াল হল লঘু পায়ে দ্রুত হেঁটে চলেছে সে। সুলতান কুঠি পর্যন্ত কি হেঁটেই পাড়ি দেবে নাকি? ঘড়ি দেখলো, রাত মন্দ হয়নি।

ট্যাক্সির প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে পড়ল।…

পরদিন।

নিয়মিত অফিসে এসেছে। নিয়মিত কাজ নিয়েও বসেছে। মনটা কাজে বসছে না খুব। অথচ তেমন অশান্তিও নেই কিছু।

সচকিত হল। ঘরে কারো পদার্পণ ঘটেছে। না তাকিয়েও এই নিঃশব্দ পদার্পণ সে অনুভব করতে পারে। লাবণ্য টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল চুপচাপ। ধীরাপদ ফাইল থেকে মুখ তুলল। কয়েক নিমেষে লাবণ্য গতকালের দেখাটাই যেন শেষ করে নিল। তারপর হাতের খামটা তার সামনে টেবিলের ওপর রেখে যেমন এসেছিল তেমনি ধীর মন্থর পায়ে ফিরে চলল।

সোনাবউদির চিঠিটা ফিরিয়ে দিয়ে গেল।

ধীরাপদর দু চোখ দরজা পর্যন্ত অনুসরণ করল তাকে। রাগ নয়, তাপ নয়, দুরন্ত বাসনাও নয়—কি একটা যাতনার মত অনুভব করছে। এই খাতনার নাম কি ধীরাপদ জানে না।

সোনাবউদির বিশ্বাসে কোথাও ভুল হয়নি। ধীরাপদ জেলে গণুদার সঙ্গে দেখা করেছে। রমণী পণ্ডিতের চিঠিতে গণদা স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ আগেই পেয়েছে। ধীরাপদ তাঁকে লিখতে বলেছিল। আজ একটা বিমুখতা দমন করেই সে এসেছিল দেখা করতে। এসেও মুখের দিকে তাকাতে পারেনি। কিছু বলতেও পারেনি। সোনাবউদির লেখা চিঠিটা শুধু তার হাতে দিয়েছে।

চিঠিটা পড়তে পড়তে গণদা ঘুরে বসেছে। পড়া শেষ করেও মুখ ফেরায় নি। না, ধীরাপদ আর রাগ করবে না। সোনাবউদিও সেই অনুরোধই করেছে। না করলেও চলত, শেষ পর্যন্ত রাগ থাকত না। মাঝের এই ওলট-পালটের অধ্যায়টা যেন সত্যি নয়। পরম নির্ভরশীলা বধুর ওপর অভিমানে অবুঝ স্বামী অনেক সময় যেমন মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে, তেমনি মুখ ফিরিয়ে বসেছিল গণুদা।

অনেকক্ষণ বাদে চিঠিটা ফেরত দিয়েছে, ফিরে তাকায়নি। বলেছে, তুমি ব্যবস্থা করো, সইটই যা দরকার আমি করে দেব।

চোখের কোণ দুটো থেকে থেকে আজ আবার সিরসির করে উঠছে কেন? ধীরাপদ – তাড়াতাড়ি উঠে চলে এসেছে।

তাড়াও ছিল। এখান থেকে সোজা অফিসে যেতে পারবে না। আগে বাড়িতে অমিতাভর কয়েকটা ওষুধ পৌঁছে দিতে হবে। আজ সকালেও বড় ডাক্তার দেখে গেছেন। তার উত্তেজনা বাড়ছে, অস্থিরতা বাড়ছে, নিজেরই বক্ষ বিদীর্ণ করে যেন হাউইয়ের আগুন ছুটিয়েছে সে। সেই আগুন জ্বলছে। ধীরাপদ দিনকে দিন উতলা হয়ে পড়ছে, ডাক্তার আনলেও লোকটা ক্ষেপে যায়। তার মেজাজের ওপর মেজাজ চড়ালে তবে একটু ঠাণ্ডা হয়।

অফিসে আসতে সেই দেরিই হল। কিন্তু অদূরে গাড়িবারান্দার নিচে বড় সাহেবের লাল গাড়ি। অপ্রত্যাশিত নন তিনি, যে কোনো দিন এসে পড়ারই কথা। তবু এরকম ধাক্কা কেন খেল ধীরাপদ নিজেও জানে না।

সিঁড়িতে সিতাংশুর সঙ্গে দেখা! ব্যস্তসমস্ত ভাবে নেমে আসছিল। দাঁড়াল। — আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? বাবা সেই থেকে আপনাকে খুঁজছেন।

উনি কখন এলেন?

কাল রাতে। ঘরে আছেন, যান— আমি একবার অ্যাটর্নির অফিসে যাচ্ছি।

নেমে গেল। এই নামা দেখে মনে হল তার বল-ভরসা বেড়েছে। ধীরাপদর ঊর্ধ্বগতি আর একটু শিথিল হল।

বড় সাহেবের ওপাশের চেয়ারে লাবণ্য বসে আছে। থাকবে জানাই ছিল। ধীরাপদকে দেখে আর একদিকে মুখ ফেরালো। হিমাংশু মিত্র দরজার কাছ থেকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে দেখলেন তাকে।

বোসো!

তাঁর মুখোমুখি বসে ধীরাপদ সহজভাবেই বলল, আপনি কাল এসেছেন খবর পাইনি—

পাইপ-ধরা মুখে স্বাভাবিক কৌতুকের রেশ।—পেলে কি করতে? একটু থেমে হালকা অনুযোগ করলেন, এই ক’মাসে তুমিই বা কটা খবর দিয়েছ?

ধীরাপদ নিরুত্তর বটে, কিন্তু তিনি এসে পড়ায় শুধু ছেলে নয় সে নিজেও এখন স্বস্তিবোধ করছে। এই একজনের উপস্থিতির প্রভাব অন্যরকম।

ঘরে ঢুকলেন জীবন সোম। শুকনো মুখ। তাঁকে ডাকা হয়েছে বোঝা গেল। বড় সাহেব তাঁকে বসতে বলে শান্ত গাম্ভীর্যে নির্দেশ দিলেন একটা। পারফিউমারি ব্রাঞ্চে অভিজ্ঞ কেমিস্ট দরকার, কাল থেকে তাঁকে সেখানকার কাজের ভার নিতে হবে। মাইনে এখানে যা পাচ্ছেন তাই পাবেন, আর ওই ব্রাঞ্চটা এই কোম্পানীর সঙ্গেই যুক্ত করা হচ্ছে যখন, এখানকার অন্যান্য সুবিধেগুলোও পাবেন। ওখানকার কাজ সম্পর্কে মোটামুটি একটু আভাসও দিলেন তাঁকে।

এ প্রয়োজন কেন হল জীবন সোম মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পেলেন না। বিদেশ থেকে ফিরে এক রাতের মধ্যে তাঁর সম্বন্ধে আর প্রসাধন শাখার সম্বন্ধে এই ব্যবস্থা স্থির করে ফেলেছেন দেখে ধীরাপদ মনে মনে অবাক। লাবণ্য একভাবেই অন্যদিকে ঘাড় ফিরিয়ে আছে। বড় সাহেবের সঙ্কল্প তার জানাই ছিল মনে হয়।

পাঁচ মিনিটও নয়, জীবন সোম উঠলেন। বড় সাহেবের মুখের পাইপটা হাতে নামলো—আর একটা কথা, আমরা ব্যবসা করছি বটে, কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে খুব একটা লাভ-টাভ কিছু করতে চাইনে—প্লীজ রিমেম্বার।

জীবন সোম চলে গেলেন। পাইপটা আবার মুখে চালান দিয়ে বড় সাহেব অনেকটা নিজের মনেই বললেন, চারিদিকে এত গলদ আমি ঠিক জানতুম না। ধীরাপদর দিকে তাকালেন, তুমি জানতে?

লাবণ্যর মুখ এবারে আপনিই যেন এদিকে ফিরল একটু। পলকের দ্বিধা কাটিয়ে ধীরাপদ সহজ জবাব দিল, বরাবর তো এক রকমই চলে আসছে দেখছি।

অর্থাৎ এত গলদ তার আমলের নতুন কিছু নয়।

তা হলেও তুমি আমাকে বলতে পারতে। অমিত এখন কেমন আছে?

অসুস্থতার খবরও পেয়েছেন বোঝা গেল। — ভালো না।… খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

কোন্ ডাক্তার দেখছেন, তিনি কি বলেন, ভাগ্নে কি করে কি বলে, সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন। চুপচাপ ভাবলেন একটু, তারপর উঠে দাঁড়ালেন।—চলো।

কোথায় যেতে হবে সঠিক না বুঝেও ধীরাপদ নীরবে অনুসরণ করল তাঁকে। চেয়ার ছেড়ে ওঠার সময় লাবণ্যরও নীরব বিস্ময় লক্ষ্য করেছে। দরজার কাছাকাছি এসে ধীরাপদর আর একবার ফিরে তাকানোর ইচ্ছে ছিল। পারে নি।

লাল গাড়ি সুলতান কুঠির দিকে চলেছে। ধীরাপদ অস্বস্তি বোধ করছে। আধাআধি রাস্তা পর্যন্ত বড় সাহেব চুপচাপ শুধু পাইপ টেনেছেন, একটা কথাও বলেন নি। ভাবছেন কিছু বোঝা যায়।

সোজা হয়ে বসলেন একসময়। – এদিকের ব্যাপার সব সত্তুর মুখে কালই শুনলাম।

লাবণ্যও এসেছিল। বউমা বললেন, তোমার কে একজন আত্মীয়া মারা গেছেন বলে তুমি চলে গেছ।

ধীরাপদ উৎকর্ণ। এটা কথা নয়, কথার সূচনা। বড় সাহেব আবার নীরব বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু তারপর হঠাৎ যা বললেন তিনি ধীরাপদ তার তাৎপর্য খুঁজে পেল না।

অমিতের জিনিসপত্র বাক্স-টাক্স সবই তো তার ঘরে পড়ে আছে দেখছি, কিছুই নিয়ে যায় নি নাকি?

না বুঝেও ধীরাপদ জানালো, হঠাৎ এসে পড়েছেন একদিন, এসে আর যেতে চান নি।

বড় সাহেব তার দিকে ফিরলেন।— অনেকদিন ধরে সে ব্যবসার অনেক কিছু গলদ সংগ্রহ করেছে শুনলাম, ছবি-টবিও নাকি তুলে রেখেছে। তার ঘরে সে সব কিছু নেই। তোমার দিদির কাছেও নেই শুনলাম। ওই পার্বতী মেয়েটির কাছে থাকতে পারে, আর তা না হলে অ্যাটর্নির কাছে রেখেছে।

ধীরাপদ নিস্পন্দ, কাঠ হয়ে বসে রইল। কোন্ তাড়নায় তিনি সুলতান কুঠিতে চলেছেন, মনে হতে বিতৃষ্ণায় ভিতরটা ভরে উঠতে লাগল। যাচ্ছেন যার কাছে, এ প্রসঙ্গের আভাস মাত্র পেলে তার সমূহ ক্ষতি হতে পারে—এই আশঙ্কাও কম নয়।

কিন্তু ধীরাপদ ভুল করেছিল। সেখানে পৌঁছনোর খানিকক্ষণের মধ্যেই তার ভাবনা গেল, আড়ষ্টতা গেল। মনে করে রাখার মতই কিছু দেখল যেন সে।

অমিতাভ চৌকিতে শুয়েছিল। শুকলাল দারোয়ানকে দিয়ে ধীরাপদ একটা চৌকি আনিয়েছিল। মামাকে দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল খানিক, ঠিক দেখছে কিনা সেই বিস্ময়।

কি রে, কেমন আছিস?

অমিতাভর চোখের দৃষ্টি বদলাতে লাগল, মুখ লাল হতে লাগল। ক্রুর প্রতীক্ষা। হিমাংশুবাবু এগিয়ে গেলেন। দেখলেন। তাঁর এই দেখার চোখ দিয়েই ধীরাপদও যেন নতুন করে দেখল অমিতাভকে। শীর্ণ উদ্‌ভ্রান্ত আত্মঘাতী একটা স্নায়ুর স্তূপ মনে হল। চকিত দুশ্চিন্তার ছায়া গোপন করে হিমাংশুবাবু তেমনি সহজভাবেই বললেন আবার, দোষ তো করলাম আমি, তুই এখানে পালিয়ে আছিস কেন?

একটা উদ্‌গত আবেগ দমনের চেষ্টায় অমিতাভ পাশ ফিরে মাথা গোঁজ করে রইল।

হিমাংশুবাবু শিয়রের কাছে বসে একখানা হাত তার মাথায় রেখে নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করলেন তাকে। পারলেন না। তেমনি হাল্কা সুরেই বললেন, কি হয়েছে তোর, কিছুই হয়নি। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে নে, তোর পাল্লায় পড়ে জীবন সোমকে তো সরতে হল, তুই শুয়ে থাকলে সব দেখে-শোনে কে?

অমিতাভ আরও শক্ত হয়ে পাশ ফিরে রইল তেমনি।

ভালো হয়ে কি কি চাস তুই আমাকে একটা লিস্ট করে দে, নয়তো নিজেই সব ভার নে, আমি না হয় লেখাপড়া করে দিচ্ছি। এভাবে পাগলামি করে লাভ কি, শরীর নষ্ট শুধু। আর, অন্য দেশ থেকে একটা আবিষ্কার হয়ে গেছে বলে রিসার্চ তো সব ফুরিয়ে গেল না-

উঠে দাঁড়ালেন। ধীরাপদকে বললেন, তুমি আজকালের মধ্যে ওকে আমার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। ডাক্তারকে একবার জিজ্ঞাসা করে নিও।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পিছনে ধীরাপদ। ওদিকের ঘরের দোরে উমা আর ছেলে দুটো দাঁড়িয়েছিল। সরে গেল। হিমাংশুবাবু চুপচাপ গাড়ি পর্যন্ত এসে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, কেস যদি হয় ওকে বাঁচানো শক্ত হবে, না যাতে হয় সেই চেষ্টা করো।

লাল গাড়ি চোখের আড়াল হয়েছে। ধীরাপদ দাঁড়িয়েই আছে।

ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অমিতাভ চারখানা হয়ে ফেটে পড়ল। উঠে বসেছিল, উত্তেজনায় চৌকি থেকে নেমে দাঁড়াল।— আপনাকে খুব বিশ্বাস করেছিলাম, কেমন? আপনি কেন মামাকে এখানে নিয়ে এসেছেন? কেন? হোয়াই?

বসুন চুপ করে, বলছি।

আমি কোন কথা শুনতে চাই না, আপনি কেন তাঁকে এখানে নিয়ে এলেন? আমি থাকব না এখানে, আজই কোনো হোটেলে চলে যাব। আপনাকেও বিশ্বাস নেই আর-

চোখে চোখ রেখে ধীরাপদ অপেক্ষা করল একটু ধীর গম্ভীর মুখে বলল, আমাকে বিশ্বাস না করলে আপনার চলবে?

অমিতাভর আরক্ত মুখ সাদা হয়ে গেল আস্তে আস্তে। কিছু মনে পড়েছে। মনে পড়তে ধাক্কা খেয়েছে। চৌকিতে বসে পড়ে অস্ফুট স্বরে বলল, আমার এখানে আসাই ভুল হয়েছে।

কিচ্ছু ভুল হয়নি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ঘর থেকে বেরিয়ে ধীরাপদ শাস্তমুখে উমা আর ছেলে দুটোর” খোঁজে গেল।

বড় সাহেব আসার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাক্টরীর হাওয়া বদলেছে। ভরা গুমোটের মধ্যে দুই একটা দক্ষিণের জানালা খুলে গেছে যেন। বড় কিছু বিপদ ঘনিয়ে এসেছে সে খবরটা চাপা ছিল না। চীফ কেমিস্টকে যে যতই পছন্দ করুক, ভালবাসুক— প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবার সম্ভাবনায় সকলেরই সঙ্কট। এর মধ্যে বড় সাহেবের প্রত্যাবর্তন কিছুটা নিশ্চিত আশ্বাসের মতই। তাই তিনি আসা মাত্র ফ্যাক্টরীর সমস্ত বিভাগের কাজে একটা সুগম্ভীর তৎপরতা দেখা গেল। ফলের গাছ থেকে পাকা ফল পাড়ার মত ধীরাপদর টেবিলে টপাটপ ফাইল পড়তে লাগল।

এর মধ্যে অফিস সংক্রান্ত কোনো জরুরী কাজেও লাবণ্য স্বেচ্ছায় তার ঘরে আসবে সেটা দুরাশা ছিল। তবু তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেও হয়ত এতটা বিস্মিত হত না সে। তার আচমকা বিস্ময়ের কারণ, লাবণ্যর এই পদার্পণ ঘটল টিফিনের বিরতির সময়। অফিসের কাজে অন্তত এ সময়ে কোনোদিন ঘরে আসেনি সে। কখনো এলে হালকা কোনো প্রসঙ্গ নিয়েই গল্পগুজব করতে এসেছে। কিন্তু সে দিন অনেকদিন বিগত।

একনজর তাকিয়ে ধীরাপদ নতুন কোনো ঝড়ের সংকেত দেখল। স্নায়ুগুলো সব আপনা থেকেই সজাগ সতর্ক হয়ে উঠল।

শিথিল পায়ে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। যেমন আসে। ফাইল সরিয়ে রেখে ধীরাপদ সোজাসুজি তাকালো!

আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। যদিও ঠিক এখানে বসে বলার মত কথা নয়…।

কোথাও যেতে হবে?

মুহূর্তের জন্য তপ্তশ্লেষের ঝলক নামল চোখে।— না, সেরকম জায়গার অভাবে এখানেই বলার ইচ্ছে।

চেয়ার টেনে বসল। সংযমের আরো কয়েকটা অনড় রেখা পড়ল মুখে। বলল, বড় সাহেব কাল রাতে আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন। কোম্পানীর বিরুদ্ধে অমিতাভবাবু যে সব অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন সেগুলো তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করে আনার হুকুম হয়েছে আমার ওপর। তাঁর ধারণা এ কাজটা বিশেষ করে আমাকে দিয়েই হতে পারে।

ধীরাপদ স্থির, নিশ্চল খানিকক্ষণ। প্রতিক্রিয়া যাই হোক, এই বলতে এসেছে ভাবেনি। নির্লিপ্ত জবাব দিল, ধারণা মিথ্যে নাও হতে পারে, চেষ্টা করে দেখো।

শুধু বলাটা নয়, ‘তুমি’ বলার ব্যতিক্রমটাও কানে লেগেছে। নিষ্পলক চেয়ে আছে। মাথা নাড়ল একটু।—করব। কিন্তু কথায় কথায় এর পর আরো কিছু বলেছেন তিনি। বাইরে যাবার আগে তাঁর পারিবারিক ব্যাপারে কিছু সংকল্পের আভাস তিনি আপনাকে দিয়েছিলেন মনে হয়। কিন্তু একদিন আমার ঘরে বসে আপনি আমাকে তার উল্টো বুঝিয়েছেন, মনে পড়ে?

মনে বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই পড়েছে। হৃৎপিণ্ডটা থেঁতলে দেবার মতই হাতুড়ির ঘা পড়েছে। সেই একদিনের দহনপিপাসু পতঙ্গের মত্ততাও ভোলবার নয়। শিখাময়ীর মানসিক পরিস্থিতির সুযোগে সেদিন একটা মিথ্যেকে সত্যের খোলসের মধ্যে পুরে দিয়ে বড় সাহেবের মনোভাব ব্যক্ত করেছিল ধীরাপদ। বলেছিল, পারিবারিক ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব কিছু প্ল্যান আছে, সেখানে আর কোনো সম্ভাবনার কারণ ঘটে সেটা তিনি চান না…বলে পরোক্ষে সিতাংশুর সঙ্গে অমিতাভকে জুড়ে দিয়েছিল সে।

লাবণ্যর নির্মম শাণিত দুই চোখ তার মুখে বিঁধে আছে। কিন্তু আজ এই ধাক্কাও সামলে নিতে ধীরাপদর সময় লাগল না খুব। সেদিনের তস্করবৃত্তি আজ দস্যুবৃত্তির দিকে গড়িয়েছে। বলল, আমি লোক কেমন তোমার জানতে বাকি নেই। আজ সোজাটা বুঝে ফেলেছ যখন, ভাবনা কি….

সঙ্গে সঙ্গে লাবণ্য ছিটকে উঠে দাঁড়াল। টেবিলের একটা ফাইল তুলে সজোরে মুখের ওপর মেরে বসাও বিচিত্র ছিল না। চোখের আগুন কণ্ঠে নেমে এলো।—আপনি অতি নীচ, অতি হীন। এর ফল আপনাকে আমি বুঝিয়ে ছাড়ব।

জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের মতই ঘর ছেড়ে সবেগে প্রস্থান করল সে।

ধীরাপদ ফাইল টেনে নিল। কিন্তু একটু বাদেই সেটা ঠেলে সরিয়ে দিল আবার। শুধু সেটা নয়, সবগুলোই। কোন জড়বস্তু হাতের কাছে রাখা নিরাপদ বোধ করল না। মাথাটা কি এক সংহার-বাষ্পে ভরাট হয়ে উঠেছে। দেবে সকলের সব আশা সব আকাঙ্ক্ষা সব অভিলাষ ধূলিসাৎ করে? সে তাই পারে এখন, সব কিছু রসাতলে পাঠাতে পারে। এই প্রতিষ্ঠান, এই অস্তিত্ব ভস্মস্তূপে পরিণত হলেই বা ক্ষতি কি? ক্রূর তন্ময়তায় ধীরাপদ দেখছিল কি। বিষম চমকে উঠল।

ভস্মস্তূপের মধ্যেও অমিতাভর মুখখানা জ্বলজ্বল করছে।

বিকেলের দিকে বড় সাহেব টেলিফোনে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। নতুন কিছু নয়। এই ডাকাডাকি দিনকে দিন বাড়বে এখন।

নিচে মানকে কুশল প্রশ্ন করল প্রথম, দোতলার সিঁড়ির মুখে কেয়ার-টেক বাবু। শেষে বউরাণী আরতি। কিন্তু সে যে কুশলে আছে মুখের দিকে চেয়ে সেটা বোধ হয় বিশ্বাস হল না। মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে আরতি বলল, সেই গেছেন আর এই এলেন, আপনার শরীরও তো ভালো দেখছি না।

ধীরাপদ লক্ষ্য করল মুখের সেই ধারালো ভাবটা মিলিয়েছে। মিষ্টি কমনীয় লাগছে মুখখানা। বড় সাহেবের বটের ছায়াই বটে। আজ তুমি বলতেও বাধল না মুখে। হেসে বলল, না ভালোই আছি, তুমি ভালো আছ?

আরতি হাসিমুখে মাথা নাড়ল, ভালো আছে।

বড় সাহেব বিশেষ কোনো প্রয়োজনে আসতে বলেননি তাকে। ভাগ্নের খবরাখবর নিলেন। দরকার হলে আরো বড় ডাক্তার ডাকতে বললেন। গতকাল তিনি চলে আসার পর সে কিছু বলল কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। বিভূতি সরকারের ব্যক্তিগত নামে আর সপ্তাহের খবরের নামে উকীলের নোটিশ পাঠাতে বললেন। নিজেদের অ্যাটর্নির পরামর্শ অনুযায়ী খাতাপত্র হিসেবনিকেশের ব্যাপারে কিছু উপদেশ দিলেন।

একটানা অনেকগুলো কথা বলে পাইপ ধরালেন তিনি। ইতিমধ্যে আরতি জলখাবার রেখে গেছে। চা দিয়ে গেছে। ফলে ধীরাপদর কথা বলার দায় এড়ানো সহজ হয়েছে।

কিন্তু লক্ষ্য করছে। গতকালের থেকেও বেশি চিন্তাচ্ছন্ন, গম্ভীর লাগছিল ভদ্রলোককে। এখনো অন্যমনস্কের মত পাইপ টানছেন আর ভাবছেন কিছু। পরক্ষণে প্রবল একটা ঝাঁকুনি খেয়ে দেহের প্রতি ইন্দ্রিয় সঙ্গাগ উন্মুখ ধীরাপদ—আর একটা খবর শুনছে।

পাইপ-মুখে বড় সাহেব তার দিকে আধাআধি ফিরে বললেন, কাল রাতে লাবণ্য এসেছিল। অমিতের সম্পর্কে আমার ইচ্ছেটা তাকে জানিয়েছিলাম। বিয়েতে সে রাজী নয় দেখলাম। একটু থেমে তাকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার বলো তো?

ধীরাপদ স্তব্ধ, নিরুত্তর।

তিনি আবার বললেন, তার অমত হতে পারে ভাবিনি…..

এই স্তব্ধতা তিনি লক্ষ্য করলেন না। আর জেরাও করলেন না। নিজেই অন্যমনস্ক তিনি।

পরদিন ধীরাপদ জীবনের অনেকগুলো দিনের মত এই দিনটার পিছনে কোনরকম প্রস্তুতি ছিল না।

যথাসময়ে অফিসে এসেছে। বেলা একটা নাগাদ উঠে পড়েছে। সেখান থেকে লাইফ ইন্সিওরেন্স অফিসে গেছে। বেরুবার সময় সোনাবউদির ট্রাঙ্ক খুলে পলিসি আর কাগজপত্র সব সঙ্গে নিয়েছিল। লাইফ ইন্সিওরেন্স অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে বিকেল। আর অফিসে না গিয়ে সুলতান কুঠিতে ফিরেছে।

ঘরে ঢুকে হতভম্ব। ঘরে কেউ নেই। শূন্য শয্যা।

ও ঘর থেকে উমা ছুটে এলো। দু চোখ কপালে তুলে সমাচার জ্ঞাপন করল। —ধীরুকা, অফিসে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরে সেই মেয়ে ডাক্তার এসেছিল। প্রায় দু ঘণ্টা ছিল অমিতবাবুর কাছে। তারপর চলে গেছে। তারপর অমিতবাবু পাগলের মত ঘরের মধ্যে পায়চারি করেছে। তারপর বাইরে পায়চারি করেছে। সেই মূর্তি দেখে উমারা ঘরের মধ্যে থরথরিয়ে কেঁপেছে। ভাইদের নিয়ে রমণী জ্যাঠার ঘরে পালাবে কিনা ভেবেছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অমিতবাবু জামা পরে, আর কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে।

পায়ের নিচে মাটি নেই মনে হল ধীরাপদর। বিছানায় গিয়ে বসল। এবারে তার মুখ দেখেও উমা ঘাবড়েছে। কাঁদ কাঁদ গলায় বলে উঠল, তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন ধীরুকা? কি হয়েছে?

সচেতন হল। উমাকে কাছে টেনে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিছু হয়নি। আমি বেরুচ্ছি একটু, ভাইদের দেখিস—

উঠল। ভাববে না কিছু। আগে টেলিফোনে একটা খোঁজ নেওয়া দরকার কোথায় গেল। বিছানা ছেড়ে নড়া নিষেধ ছিল। কোথায় যেতে পারে? ঘড়ি দেখল, সাড়ে পাঁচটা। উমার বর্ণনা যথাযথ হলে বেরিয়েছে যে তাও ঘণ্টাপাঁচেক হয়ে গেল।

… টেলিফোনের ওধারে কেয়ার-টেক্ বাবুর গলা। না, বড় সাহেব বাড়ি নেই। দুপুরে একজন মহিলার টেলিফোন পেয়ে খুব ব্যস্ত-মুখে বেরিয়ে গেছেন। ভাগ্নেবাবু? তিনি এখানে কোথায়? তিনি তো সেই কবে থেকেই উধাও!

ধীরাপদ রিসিভার নামিয়ে রাখল। দুপুরে একজন মহিলার টেলিফোন পেয়ে বড় সাহেব ব্যস্ত-মুখে বেরিয়ে গেছেন…। আবার রিসিভার তুলল, নম্বর ডায়েল করল। …চারুদির গলা। গলাটা ভার-ভার। জিজ্ঞাসা করার দরকার হল না, তার সাড়া পেয়েই চাপা উত্তেজনায় বললেন, মস্ত বিপদ গেল, পার তো এসো একবার।

বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল ধীরাপদর। তারপর শান্ত।—কি হয়েছে বলো। শুনল কি হয়েছে। অমিতাভর স্ট্রোক হয়েছিল। ঘণ্টা দেড়েক অজ্ঞান হয়ে ছিল। তারপর জ্ঞান হয়েছে। চারুদি নিজের ঘরে ঘুমুচ্ছিলেন, তিনিও টের পাননি। পার্বতী তাঁকে ডেকে বলেনি পর্যন্ত। ওর টেলিফোনে দুজন বড় ডাক্তার এসে হাজির হতে টের পেয়েছেন। চারুদির গলায় উষ্মার আঁচ, মেয়ের সাহস বোঝো একবার। জ্ঞান হবার পরে ঘরেও ঢুকতে দেয়নি, ডাক্তার নাকি বারণ করে গেছে।…হ্যাঁ, উনি খবর পেয়েই এসেছিলেন, অনেকক্ষণ ছিলেন, আবার আসবেন বলে গেছেন।

শেষের জবাব বড় সাহেবের প্রসঙ্গে। ফোন ছাড়ার আগে ধীরাপদই জিজ্ঞাসা করেছিল। ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সচকিত হল। ক’টা ট্যাক্সি চোখের ওপর দিয়ে চলে গেল ঠিক নেই। যা ভাববে না ঠিক করেছিল সেই ভাবনাটাই কখন আবার মগজ চড়াও করেছে। আবারও ছেঁটে দিল সেটা। হাত বাড়িয়ে ট্যাক্সি থামালো। উঠল। …অমিতাভর স্বাস্থ্যের কথাই শুধু ভাবা উচিত এখন। স্ট্রোক হয়েছিল। দেড় ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে ছিল। বড় বিপদের নিশানা ওটা, আবার এ-রকম হলে সামলে ওঠা কঠিন হবে।

চারুদির বাইরের ঘরে ঢুকতেই পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল। সিঁড়ির কাছে লাল গাড়ি দেখে বড় সাহেব আবার এসেছেন ধরে নিয়েছিল। কিন্তু এখানে আর একজন আসতে পারে ভাবেনি। নাটকের ছকে-বাঁধা একটা দৃশ্য যেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে এখানে তার নিজের অবস্থানও অনিবার্য ছিল সম্ভবত। নইলে দশ মিনিট আগেও আসতে পারত, পরেও আসতে পারত।

চৌকাঠের ওধারে বারান্দার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বড় সাহেব। তাঁর পাশে লাবণ্য। সামনে চারুদি। তার সামনে পার্বতী। কেউ যে এলো কেউ টের পায়নি। চারুদির চাপা ঝাঁজালো উক্তি ধীরাপদর কানে এসে বিঁধল।

—হাঁ করে দেখছ কি? যা জানার জেনেছ, এখন এদিকে এসো বোসো। সেই থেকে ঠায় দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে, ঘরে ঢোকা নিষেধ। আমরা গেলে যদি ক্ষতি হয়! আমরা শত্রু না সব? একমাত্র আপনার লোক তো শুধু ও!

ধীরাপদ নিজের অগোচরে এগিয়ে এলো একটু। পার্বতী কোন দরজা আগলে দাঁড়িয়ে নেই, বারান্দার মাঝামাঝি চারুদির কাছেই দাঁড়িয়ে। বোধ হয় অমিতাভর খবর নেবার জন্য তাকে ডাকা হয়েছিল। হয়ত বড় সাহেব বা লাবণ্য রোগী দেখার জন্যে এগোতে এই বাধা। অবুঝ কর্ত্রীর ক্ষোভ সত্ত্বেও পার্বতীর মুখে রাগ নেই বিদ্বেষ নেই ঘৃণা নেই। সহনশীলা কিন্তু কর্তব্যে আর সংকল্পে অটুট।

তেমনি উষ্ণ গলায় চারুদি বড় সাহেবের উদ্দেশে আবার বললেন, তোমরা ওই যে কাগজ-পত্র খুঁজছ—সেও ওই ওর কাছেই আছে বলে দিলাম। নইলে যাবে কোথায়? সরোষে পার্বতীর দিকেই ফিরলেন। কেস না হতেই এই, দরদ দেখিয়ে ছেলেটাকে মারবি? ভালো চাস তো কোথায় রেখেছিস বার করে দে সব! পরে ওকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করা যাবে—

জবাবে পার্বতী শান্ত মুখে বলল, আমার কাছে কিছু নেই।

চারুদি আবার ঝাঁজিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগে বড় সাহেব এদিকে ফিরেছেন। ধীরাপদ দাঁড়িয়ে আছে দেখলেন। সেই সঙ্গে বাকি ক’জনেরও তার ওপর চোখ পড়ল।

কিন্তু ধীরাপদ শুধু লাবণ্যর দিকেই চেয়ে ছিল। তাকে দেখামাত্র লাবণ্যর দু চোখ দপ করে জ্বলে উঠেছে। পলক না পড়তে চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে এসে দাঁড়াল সে। কাছে এসে দাঁড়াল। মুহুর্তের স্তব্ধতা দুখানা করে তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল, কোম্পানীর বিরুদ্ধে অমিতবাবু এ পর্যন্ত যা-কিছু সংগ্রহ করেছেন সেই কাগজপত্র ছবি—সব বরাবর আপনার কাছেই ছিল, এখনো আপনার কাছেই আছে—দিয়ে দিন!

ঘরের মধ্যে একটা বাজ পড়লেও বোধ হয় এমন চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে থাকত না কেউ। চমক কতখানি লেগেছিল ধীরাপদ দেখেনি। এই নিস্পন্দ নীরবতা দেখল। বড়সাহেবের সমস্ত মুখ বিস্ময়াহত, চারুদি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন, বারান্দায় পার্বতীও ঘুরে দাঁড়িয়েছে আবার।

ধীরাপদ একটা সোফায় বসল। সব ভাবনা-চিন্তার অবসান। নিঃশব্দে শেষ দেখার অনুষ্ঠান যেন এটুকু। উত্তেজনা নেই যাতনা নেই ক্ষোভ নেই অভিযোগ নেই পরিতাপ নেই। মাথা নিচু করে চিন্তা করে নিল কি, মুখে হাসির আভাস উঠল। সকলের নির্বাক চোখের ওপর দিয়ে ভিতরের দিকে এগোলো।

বারান্দার একেবারে শেষ মাথার ঘরটার দোরগোড়ায় পার্বতী দাঁড়িয়ে। ধীরাপদ ঢোকেনি কখনো, কিন্তু জানে কার ঘর ওটা। পার্বতীর ঘর। অমিতাভ ও ঘরেই আছে তাহলে।

পার্বতী বাধা দিল না। সে ঘরে ঢুকতে ঘুরে দাঁড়াল শুধু। অমিতাভ এদিকেই চেয়ে আছে, তার চোখে চোখ রেখে ধীরাপদ হাসছে মৃদু মৃদু। হাসবে না তো কি, একেবারে ছেলেমানুষের চাউনি।

আমি তাহলে বিশ্বাসভঙ্গ করিনি, কি বলেন?

সঙ্গে সঙ্গে ও-পাশ ফিরল।

ধীরাপদ অস্ফুট শব্দে হেসেই উঠল। —ও-দিক ফিরলেন কেন? ভালোই তো করেছেন। আমি খুশি হয়েছি, বুঝলেন? 

কিন্তু অমিতাভ ও-পাশ ফিরেই থাকল। ধীরাপদর সকৌতুক দৃষ্টি এবারে পার্বতীর মুখের ওপর এসে সজাগ হল একটু। পার্বতীর চোখে নীরব মিনতি। ধীরাপদ বেরিয়ে এলো।

বাইরের ঘরের সেই নির্বাক দৃশ্যের মধ্যেই ফিরে এলো। বড় সাহেব সোফায় বসে, মুখে পাইপ। পাইপটা ধরানো হয়নি। এধারে মূর্তির মত চারুদি দাঁড়িয়ে। আর একটা সোফায় লাবণ্য বসে। ধীরাপদ কি হেসেই ফেলবে? কালের কাণ্ড দেখার চোখ দুটো এরই মধ্যে আবার যেন সে ফিরে পেয়েছে। লাবণ্যর এই মুখে উত্তেজনার চিহ্ন নেই, বিমূঢ় প্রতিক্রিয়ার সাদাটে ছাপটাই স্পষ্ট।

খুব সহজভাবেই ধীরাপদ হিমাংশুবাবুকে বলল, আপনি বসুন একটু, গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছি। লাবণ্যর দিকে ঘুরল, একবার আসতে হবে—

কোথায় যেতে হবে, কেন যেতে হবে, লাবণার বোধগম্য হয়নি। কয়েক পলক চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তবু। দাঁড়াতে হল যেন। হিমাংশুবাবুও নিঃশব্দ অনুমোদন করলেন মনে হল।

বাইরে এসে ধীরাপদ লাল গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিল। লাবণ্য উঠে বসল। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ধীরাপদ ঘুরে এসে এদিকের দরজা খুলে এপাশ ঘেঁষে বসল।

গাড়ি সুলতান কুঠির পথে চলেছে। লাবণ্য ক’বার ফিরে ফিরে তাকিয়েছে ঘাড় না ফিরিয়েও অনুভব করতে পেরেছে। নীরবতার পরিপুষ্ট ব্যবধানে ধীরাপদ স্থির বসে।

সুলতান কুঠির খানিক আগে গাড়ি থামলো। অন্ধকার এবড়োখেবড়ো পথের দরুন হতে পারে, অন্য কারণেও হতে পারে। দরজা খুলে নেমে পড়ে শুধু বলল, আসছি—

পড়ার বই হাতে উমা ঠিকে রাধুনীকে রান্নার উপদেশ দিচ্ছে। তার ভাই দুটোও মেঝেতে দুটো বই খুলে বসে আছে। উমার কড়া শাসন। ধীরাপদর হাসি পেল। ও মেয়ে বড় হলে আর একটি সোনাবউদি হবে। চমকে উঠল, না, সোনাবউদি হয়ে কাজ নেই।

পায়ের শব্দে উমা ঘুরে তাকিয়েছে। ধীরাপদ নিজের ট্রাঙ্ক খুলে কাগজপত্রের ফাইলটা বার করল। ফ্যাক্টরীর বিরুদ্ধে যাবতীয় নিদর্শনের সেই ফোটো অ্যালবামটাও। নিশ্চিন্ত লাগছে। ভারী হাল্কা লাগছে। নিয়তি যেন তাকে দিয়ে ঘাতকের কাজ করিয়ে নিতে যাচ্ছিল। বাঁচোয়া। প্রতিষ্ঠানের সবগুলো প্রত্যাশী মুখ চোখে ভাসছে। আর আশ্চর্য, সকলকে ছেড়ে তানিস সর্দারের কালো বউয়ের খুশি-ঝরা মুখখানা সব থেকে বেশি ভাসছে চোখের সামনে। ট্রাঙ্ক বন্ধ করে ফাইল আর অ্যালবাম হাতে উঠে দাঁড়াল।

উমা বাধা দিল, তুমি কি আবার বেরুচ্ছ নাকি!

এক্ষুনি ঘুরে আসছি। রান্না হলে তোরা খেয়ে নে।

এক্ষুনি ফিরবে তো, না কি?

যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা উদ্‌গত অনুভূতি যেন ধীরাপদর গলা দিয়ে ঠেলে উঠতে চাইছে। অনেক হারিয়ে ওইটুকু মেয়েরও বুকের তলায় অজ্ঞাত ভয় কিসের।

হঠাৎ ধমকেই উঠল উমাকে, ফিরব না তো যাব কোথায়? বোস্‌, কোথাও যাচ্ছি না আমি—

হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু একটু বাদে আপনা থেকেই গতি শিথিল

হল। লাবণ্য মোটর থেকে নেমে খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় দূর থেকেও তাকে দেখা যাচ্ছে।

কেন আনা হয়েছে তাকে, ভালো করে বুঝেছে তাহলে। এবারে বলবে কিছু ড্রাইভারকে এড়িয়ে তাই এগিয়ে এসে অপেক্ষা করছে।

হাতের জিনিস দুটো ধীরাপদ তার দিকে বাড়িয়ে দিল।—এই ছিল।

আমি নেব কেন? আপনি যাবেন না?

মুখে যা এসেছিল ধীরাপদ তা বলল না। তার যাতনা গেছে, আঘাত দেবার বাসনাও নেই আর।—না। গেলে আর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আসব কেন?

আবছা আলোয় লাবণ্য ভালো করে দেখে নিতে চেষ্টা করল তাকে।—তবে মানে আপনি আর অফিসেও আসছেন না?

কি করতে যাব, জবাবদিহি করতে না বরখাস্তের অর্ডার আনতে?

লাবণ্য থমকালো একটু, তারপর ঈষৎ জোর দিয়েই বলল, আপনি উপকার ছাড়া অপকার কিছু করেননি, কোম্পানীর ভালোর জন্যেই এগুলো অমিতবাবুর কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন সেটা সকলেই বুঝবে

নির্লিপ্ত গলায় ধীরাপদ তার বক্তব্য খণ্ডন করল। কিন্তু খানিক আগে এই কথাগুলো বলোনি তো?

অসহিষ্ণুতা গোপন থাকল না, লাবণ্য সরোষে বলে উঠল, বেশ করেছি বলিনি। মাথা ঠাণ্ডা করে বলার মত কোনো কাজ আপনি করেন? অদূরে গাড়িটার দিকে একনজর তাকিয়ে নিজেকে সংযত করল। তারপর অনুচ্চ গলায় আবার বলল, আমার ভুল হয়েছে। তাছাড়া, বলার সময়ও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। চলুন—

ধীরাপদ ধীর শান্ত। কথা বাড়াতে চায়নি। তবু সব কথার ওপর ছেদ টেনে দেবার জন্য স্পষ্ট করে বলে গেল, তোমার ভুল হয়নি। অমিতবাবুকে আমি শান্ত করতে চেষ্টা করেছি, আরো করতাম। কিন্তু কেস হলে তাঁর সঙ্গে মিথ্যার আশ্রয় যে-লোক নেয়নি, কোর্টে দাঁড়িয়ে তাঁকে মিথ্যের মধ্যে ঠেলে দিতেও পারতাম না হয়ত। অমিতবাবু আমাকে সব-দিক থেকে রক্ষা করেছেন। তোমার কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।

ধীরাপদ মোটরের কাছে এগিয়ে গেল। হাতের ফাইল আর অ্যালবাম পিছনের সীটে রাখল। আবছা আলোয় লাবণ্য সেখানেই নিশ্চল দাঁড়িয়ে। এদিকে তাকিয়ে আছে শুধু। ধীরাপদ তার পাশ কাটিয়ে সুলতান কুঠিতে ফিরে চলল। দাওয়ায় পা দেওয়া পর্যন্তও পিছন থেকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ কানে এলো না।

সাতাশ

রাত গভীর এখন।

আমি ধীরাপদ চক্রবর্তী, নতুন করে আবার সংসারের হাটের ছবি ভরতি করে চলেছি। কথা সাজাচ্ছি, ব্যথা নিঙড়ে তুলছি, হাসির বুদ্বুদ ফোটাচ্ছি, কান্নার আবর্তে ডুব দিচ্ছি! ভাবছি এরই নাম সার্থকতা—চোখ ফেরালেই দেখা যায় বুঝি, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় বুঝি। কিন্তু যায় না। ওটা আলেয়া। যত কাছে যাও, ওটা নড়বে সরবে, ওর রঙ বদলাবে রূপ বদলাবে আকার বদলাবে। জীবনের কটা বাঁক ঘুরে আবারও একদিন হঠাৎ এমনি করেই থমকে দাঁড়াতে হবে জানি। কিন্তু সে কবে আমি জানতে চাই না। এই কালটাই তো অন্ধকার গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে আলেয়ার হাতছানি সম্বল করে পথ খুঁজে মরছে। আমরা এর থেকে বিচ্ছিন্ন হব কেমন করে? কাল যদি আলেয়া, আশা করতে দোষ কি, আমারও এই দিন জাগা রাত জাগা লেখনীর কথাগুলো থেকে যাবে। প্রাণী মাত্রেই নাকি কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে বিচরণ-শেষে শিব আর সুন্দরের জগতে পৌঁছুবে একদিন। কালের বিধিলিপিও তাই। সুলতান কুঠির নিশুতি রাতে আমি সেই সুন্দরের জগৎটাকে দেখে নিতে চেষ্টা করছি জেনে যে হাসবে হাসুক। ভাবতে ভালো লাগছে, আলেয়া-শূন্য সেই সুদূর সুন্দর কালের মানুষেরা আছে আর আমার এই কথার স্তূপ তাদের কাছে পৌঁচেছে। কিন্তু এই আলেয়ার ইতিবৃত্তের মধ্যে বিচরণ করে সেই সুন্দর মানুষেরা কি শিউরে উঠবে? এত উঁচু-নিচু এত বিবাদ এত বৈষম্য দেখে তারা কি বর্বর ভাববে আমাদের? এই অশান্ত লোভ এই কামনা-বাসনার আবর্ত দেখে তারা কি ঘৃণায় কুঁচকে উঠবে? নাকি যুধ্যমান এই আমাদের হাড়পাঁজরের ওপর, আমাদের ধ্বংসস্তূপের ওপর, এই আলেয়া- অন্ধ অসম্পূর্ণ লোকালয়ের বিরাট ভস্মস্তূপের ওপর, তাদের সেই সুন্দরের জগৎ গড়ে উঠেছে জেনে শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় চোখগুলো তাদের চিকচিকিয়ে উঠবে? তাদের সেই সম্পূর্ণতার মধ্যে ভাগ্যহত কালের একটি সোনাবউদিকেও কি তারা নিঃশব্দে খুঁজে বেড়াবে না?

কে? সোনাবউদি? অনেকক্ষণ ধরে বাতাস-ভরাট ঝিঁঝির ডাকের মধ্যে তোমার গলার রেশ কানে আসছে। তুমি কি আছ কোথাও? নিঃশব্দ পায়ে আমার চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছ? হাসছ মুখ টিপে?

যত খুশি হাসো, কিন্তু তোমাকেও আলেয়া-মুক্ত ভাবিনে আমি। তোমার আকাঙ্ক্ষা তুমি তোমার ছেলেমেয়ের মধ্যে রেখে গেছ, দশ হাজার টাকার একটা সার্থকতার থলে তোমার চোখেও বড় হয়ে উঠেছে। তাদের আমি ভোলাতে চেষ্টা করব তোমাকে। পাশের ঘরে গিয়ে দেখে এসো কেমন নিশ্চিন্তে নিঃশঙ্কে আর একজনের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমুচ্ছে তারা। আমার কথা আমি রাখব, তোমার ইচ্ছে পূর্ণ হবে। উমার ভালো বিয়ে দেব। ছেলে দুটোকে মানুষ করব। আর তার পরেও বলব, তুমি আমার ওপর অবিচার করেছ। এমন আর কেউ করেনি। এই যাতনা তুমি বুঝবে না, রণু বুঝবে। দেখা হলে তার কাছ থেকে জেনে নিও কত বড় অবিচার তুমি আমার ওপর করেছ।

সুলতান কুঠির এটা শেষ রাত। কাল ভোরে আমাদের যাত্রা। মালপত্র সবই চলে গেছে। রাত পোহালে আমরা যাব। নতুন বাড়িতে উঠব। নতুন বাড়ি, নতুন জীবন, নতুন মিছিল, নতুন আলেয়া। শকুনি ভট্‌চাযের স্মৃতি তো অনেকদিনই মুছে গেছে, একাদশী শিকদারের স্মৃতিও নিশ্চিহ্ন। কোথায় কোন্ আশায় তিনি বুক বেঁধে আছেন এখন, আমার জানা নেই। বছর দুই হল সপরিবারে রমণী পণ্ডিতও উঠে গেছেন ওদিকটা ভেঙে পড়ার আগেই। তাঁর দিন বদলেছে। ভাগ্য গণনার জমাট পসার খুলে বসতে পেরেছেন। বাসনা-দগ্ধ সর্বেশ্বরবাবু গোড়ায় রসদ যুগিয়েছেন। তারপর পথ আপনি খুলেছে। দিন ফিরেছে রমণী পণ্ডিতের। দোরে সারি সারি মোটর দাঁড়ায় এখন। মেয়ে কুমুকে সেক্রেটারী করেছেন। দিনের হাল জানেন পণ্ডিত। মেয়েটা সুন্দর হয়েছে দেখতে, ভর-ভরতি। দেখেছি একদিন। আমাকে দেখে কত আদর-যত্ন করবে ভেবে পায় না। পণ্ডিতও উদার হতে বাধে না। কিন্তু তিনি উতলা এখনো, জায়গার সঙ্কুলান হচ্ছে না, মক্কেলদের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়, একটু জায়গা-জমি কিনে বসতে পারলে তবে সুরাহা। সুলতান কুঠিতে তাঁর বাসের স্মৃতি শুধু আমার চোখে লেগে আছে। কিন্তু আমরাও তো যাব। কতকাল ধরে কত মানুষ এমনি গেছে এখান থেকে জানি না। আমাদের পরে আর কেউ যাবে না। বাড়িটা বাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কলকাতা বড় হচ্ছে। বড় কলকাতা এদিকেও আসবে। এই কলঙ্কটা মাটিতে মিশবে। তার ওপর নতুন ইমারত উঠবে। এখানকার এই নিশুতি রাত তখন ঝিল্লিমুখরিত হবে না, এই অন্ধকারের তপস্যা ঘুচে যাবে, এখানকার প্রথম ঊষায় ওই গাছগুলোর, ওই আঙ্গিনার, ওই কদমতলার বেঞ্চটার শিশির জলের স্নানব্রত সাঙ্গ হবে।

বড় সাহেবের স্বপ্ন সফল হয়েছে। পাগল ভাগ্নের জন্য তাঁর বুকের একটা দিক এখনো খালি কিনা জানি না। গত তিন বছর ধরে নিখিল ভারত ভেষজ সংস্থার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে চলেছেন তিনি। শীগগীরই আন্তর্জাতিক সংস্থারও গণ্যমান্য একজন হবেন শুনছি। তাঁর কারখানা নাকি আরো বড় হয়েছে, আরো অনেক ওষুধ তৈরি হচ্ছে সেখানে। মানুষ কি রোগ জরা মৃত্যুজয়ী হয়ে উঠবে একদিন?

কিন্তু চারুদি কি নিয়ে আছেন? বাড়ি নিয়ে? বাগান নিয়ে? বোধ হয় তাই। বোধ হয় সেই সঙ্গে রামায়ণ মহাভারত নিয়েও। ছেলে ছেলে করে তিনি মেয়ে হারিয়েছেন। বহুদিন হল পার্বতী অমিতাভকে নিয়ে চলে গেছে। সে ভালো করে অসুখ থেকে সেরে না উঠতেই। কিন্তু কোথায় আছে তারা এখন? এই কালের জটিলতার ছায়া পড়েনি পার্বতী কি এমন জায়গা তার জন্য খুঁজে বার করতে পেরেছে?

তাকে একটিবার দেখতে ইচ্ছে করে। অমিতাভ ঘোষকেও। আর সিতাংশুর বউ আরতিকে। আর তানিস সর্দারের কালো বউটাকেও। কিন্তু থাক। আমার মনে যেটুকু আছে, সেটুকু অন্তত থাক। এও আলেয়া কিনা কে জানে। দেখা না হওয়াই ভালো। দেখা একদিন কাঞ্চন আর রমেন হালদারের সঙ্গে হয়েছিল। তারা ব্যবসাটা আর একটু বাড়ানোর নেশায় মশগুল। আমি পালিয়ে এসেছি। পথে মান্‌কের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একদিন। কেয়ার-টেক্ বাবুর নামে আবার তার অনেক অভিযোগ জমে উঠেছে। আধাআধি শুনেই আমি পালিয়েছি। অম্বিকা কবিরাজের দোকানে গিয়েছিলাম, সেখানে তাঁর ছেলে দুই চোখে ভীরু বাসনার প্রদীপ জ্বেলে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। আমি পালিয়ে এসেছি। নতুন পুরনো বইয়ের দোকানের দে-বাবু এখনো শক্ত-সমর্থ আছেন—আরো কত বই ছেপেছেন আর ছাপবেন সেই ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন তিনি।

আমি পালিয়ে এসেছি।

কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়? নিজের কাছ থেকে পালাব কেমন করে? এই নিটোল স্তব্ধ রাতে আমার মনে হচ্ছে, ওই আলেয়ার উৎসবের তলায় তলায় একটা পালানোর কান্নাও থিতিয়ে উঠেছে, পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে। আকাশসুদ্ধ আকাঙ্ক্ষার আলেয়ার লালে লাল হয়ে উঠেছে বলে সেই কান্নাটা তেমন করে অনুভব করা যাচ্ছে না এখনো। যাবে যখন তখন গতি হবে কি?…তবু বুকের তলায় কান পেতে শুনছি কিছু। ক্ষীণ আশ্বাসের মত এ কার ইশারা? কবেকার কোন্ অনন্ত-কালের একটা স্মৃতি যেন অতি বৃদ্ধ জটায়ুর মত পাখা ভেঙে পড়ে আছে এখনো। তার মুখে বারতা আছে। সে যেখানে যেতে বলছে—সেটা এক বিস্মৃত ভারতের চতুষ্পথ…। সেখানে এক মহামৌনী সাগ্নিক বসে আছেন। মন বলছে এঁরই কাছে মন্ত্র নিতে হবে। তোমাকে আমাকে সক্কলকে। সেই মন্ত্রে মুক্তি। তাঁর আলোয় এই আলেয়ার অভিশাপ ঘুচবে। যোগভ্রষ্ট কর্মের শিকল ভাঙবে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *