পঁচিশ
এতকালের মধ্যে চারুদি এই বাড়িতে কোনদিন ধীরাপদকে টেলিফোনে ডাকেন নি। গলা শুনেই বোঝা গেল তিনি বেশ ঘাবড়েছেন। সাড়া পেয়ে প্রথমেই অসহিষ্ণু বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কাজকর্ম ছেড়ে চলে গেছলে নাকি কোথাও?
কাজকর্ম ছাড়ার খবর বা আবার ফেরার খবর কার মুখে শুনেছেন ধীরাপদ ফিরে আর সে প্রশ্ন করল। শুধু জানালো, কোথাও যায়নি, তবে দিনকতক অফিসে অনুপস্থিত ছিল বটে।
চারুদিও আর এ প্রসঙ্গ তুললেন না। তাঁর গলার স্বরে উৎকণ্ঠা ঝরল। –কি ব্যাপার বলো তো, তুমি অমিতকে কিছু বলেছ নাকি? তার কি হয়েছে?
কি হয়েছে?
কানে রিসিভার ঠেকিয়ে শান্ত মুখে শুনল কি হয়েছে। গতকাল একটু বেশি রাতে অমিতাভ চারুদির বাড়ি গিয়েছিল। তার চেহারা দেখে চারুদি ভয়ই পেয়েছিলেন। একটা কথারও জবাব না দিয়ে সে অনেকক্ষণ পাগলের মত চেয়েছিল শুধু। তারপর বিড়বিড় করে জিজ্ঞাসা করেছে, পার্বতী কেমন আছে। চারুদি ভয় পেয়ে পার্বতীকে ডাকতে গিয়েছিলেন, অমিতাভ মাথা নেড়ে নিষেধ করেছে। তারপর হঠাৎ চারুদির কোলে মুখ গুঁজেছে। একটানা দু ঘণ্টা মুখ গুঁজে পড়েছিল, একটু নড়েচড়েনি পর্যন্ত। তারপর অত রাতে উঠে চলে গেছে, চারুদির ডাকাডাকিতে কান দেয়নি।
কি বলেছ তুমি ওকে? এই তো কদিন আগে তুমি অফিসে আসা ছেড়ে দিয়েছ বলে কত খুশিতে ছিল, তোমার সুখ্যাতি মুখে ধরে না-কি হল হঠাৎ? ওকে যে ডাক্তার দেখানো দরকার—
ধীরাপদ টেলিফোনে কিছু বলেনি, শুধু আশ্বাস দিয়েছে কোনো ভয় নেই। বলেছে, যা হয়েছে ভালই হয়েছে—খুব ভালো হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যেই দেখা করবে কথা দিয়ে তাড়াতাড়ি টেলিফোন ছেড়ে দিয়েছে। চারুদিকে মিথ্যে আশ্বাস দেয়নি, সে নিজেই বিশ্বাস করতে চাইছে ভালো হয়েছে—খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু ভালো হওয়ার তুষ্টিটুকু কেন যে উপলব্ধি করছে না সেটাই আশ্চর্য।
কারখানায় কর্মচারীদের খুশির অভ্যর্থনায় ধীরাপদ রীতিমত বিব্রত বোধ করল। তারা শুধু খুশি নয়, উত্তেজিতও। গত ক’টা দিনের বিচ্ছেদের ব্যাপারটা দশগুণ পল্লবিত হতে তাদের উত্তেজনা পুষ্ট করেছে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে জটলা হয়েছে, প্রকাশ্যে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়েছে। দল বেঁধে তাঁরা ছোট সাহেবের কাছে প্রাপ্য দাবি করেছে, আর জেনারেল সুপারভাইজারের কি হয়েছে জানতে চেয়েছে। ব্যাপারটা প্রতিদিন ঘোরালো হয়ে উঠছিল। ছোট সাহেব সেই চিরাচরিত বক্র রাস্তাটাই নিয়েছে, ঘা দিয়ে তাদের ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করেছে। অন্যায় আচরণের জন্য অনেককে লিখিত ওয়ার্নিং দিয়েছে, তানিস সর্দার আর তিন-চারজন পাণ্ডাকে “শো কজ” নোটিস দিয়েছে-শৃঙ্খলাভঙ্গ আর অন্যায় বিক্ষোভ সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত তারা, কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার কারণ দর্শাতে বলেছে।
ঘণ্টাখানেকের আগে ধীরাপদ নিচে থেকে দোতলায় উঠতে পারেনি। সব শুনে বিরক্ত হয়েছে, বিড়ম্বিত বোধ করেছে। ওপরে নিজের ঘরেও সুস্থির হয়ে বসতে পারেনি। প্রায় চুপিসাড়ে একের পর এক ভদ্রলোকেরাও এসে তার খবর করেছে, আনন্দ জ্ঞাপন করেছে। এমন একটা সরগরম ব্যাপার হয়ে উঠবে জানলে ধাঁরাপদ যাবার আগে ভাবত।
উঠে পাশের ঘরে এলো।
লাবণ্য আর সিতাংশু দুজনেই ঘরে ছিল। দুজনেই মুখ তুলল। কিন্তু সে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সিতাংশু গম্ভীর ব্যস্ততায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, কোনদিকে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দরজার আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ধীরাপদ ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল তাকে। সিতাংশুর মুখখানা কঠিন বটে, কিন্তু শুকনোও। ধীরাপদর কেমন মনে হল, সেটা এখানকার এই ঝামেলার দরুন নয়। এখানকার ব্যাপারে ছোট সাহেব অনেকটাই বেপরোয়া আজকাল। এমন কি তার সঙ্গে একটা রূঢ় বোঝাপড়ায় এগিয়ে এলেও হয়ত খুব বিস্মিত হত না। তার বদলে এই আচরণ অপ্রত্যাশিত।
মনে হল তাকেও হয়ত কৈফিয়ৎ দিতে হচ্ছে কারো কাছে। তাকেও লাগামের মুখে রেখে একজন কৈফিয়ৎ তলব করতে পারে। তার ঘরের একজন। আসল ঝামেলার উৎসটা হয়ত সেইখানেই।
দিব্বি সহজ ভাবে লাবণ্যর সামনের চেয়ারটা টেনে বসল। সোজাসুজি দুষ্টি বিনিময়। বলল, কাল বড় সাহেবের চিঠি পেলাম। আপনারা ঠিকমত আমার সহযোগিতা পাচ্ছেন না জেনে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, বেশ ক্ষুণ্ন হয়ে লিখেছেন।
একটু অবাক হয়েই লাবণ্য বলে বসল, এখানকার ব্যাপার তো তাঁকে কিছু জানানো হয়নি।
এখানকার কোন্ ব্যাপার?
লাবণ্য থমকালো। তারপর অনেকটা নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে জিজ্ঞাসা করল, আপনার এভাবে চলে যাবার মত কোনো কারণ ঘটেছিল? বড় সাহেব ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা চলত না?
চলত যে সেদিন সেটা আপনারা বুঝতে দেননি। তবে আমি তাঁর ফেরার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
আর ইতিমধ্যে একটু-আধটু গণ্ডগোলের সৃষ্টি হোক সেরকম ইচ্ছেও ছিল বোধ হয়?
ধীরাপদ হাল্কা জবাব দিল, এটুকু আপনাদের হাতযশ। আপনি আমার খোঁজে সুলতান কুঠিতে গেছলেন শুনলাম, সোনাবউদি জানালেন, এখানে আসার জন্যেও বিশেষ করে বলে এসেছেন। সেই জন্যেই এলাম…কিন্তু আমি এলে আপনাদের অসুবিধে ছাড়া সুবিধে তো কিছু দেখি না।
লাবণ্য চেয়ে আছে, মুখের রুক্ষ ছায়া স্পষ্টতর। চোখে চোখ রেখে কথা কইতে এখন আর একটুও সঙ্কোচ নেই ধীরাপদর। কিন্তু সঙ্কোচ না থাকলেও অন্য বিড়ম্বনা আছে। উষ্ণ, রমণীয় বিড়ম্বনা। তাই ওঠা দরকার এবার।
এদিকে যে সব ওয়ার্নিং আর নোটিস-টোটিস দিয়েছেন সেগুলো তুলে নিন, তারপর দেখা যাক।
ঈষৎ রূঢ়কণ্ঠে লাবণ্য বলে উঠল, নোটিস আমি দিইনি—
ধীরাপদ উঠে দাঁড়িয়েছে। লঘু কৌতুকে একটু চেয়ে থেকে বলল, তাহলে যিনি দিয়েছেন তাঁকেই তুলে নিতে বলুন। আমাকে দেখেই তো তিনি উঠে গেলেন, বাক্যালাপেও আপত্তি মনে হল—আমার হয়ে আপনিই তাঁকে এই অনুরোধটা করুন। কর্মচারীরা কর্মচারীই বটে, কিন্তু সব সময় ছড়ি উঁচিয়ে সেটা মনে রাখতে বললে তাদের ভালো লাগার কথা নয়।
বচনের ফলাফল দেখার জন্য আর অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে চলে এলো। কটা দিনের দুর্বহ নিষ্ক্রিয়তা থেকে নিজেকে টেনে তোলার জন্যই একাগ্রভাবে কাজের মধ্যে ডুব দিল। কিন্তু মনে মনে একজনের প্রতীক্ষা করছে সে। অমিতাভ ঘোষের। ইতিমধ্যে দিন দুই সে অফিসে এসেছে টের পেয়েছে। অ্যাকাউনটেন্ট বলেছেন। নইলে জানতেও পারত না। ধীরাপদর সঙ্গে তার দেখা হওয়া দরকার। কেন হওয়া দরকার জানে না। দেখা হলে কি বলবে তাও না। ভিতরে সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি, দেখা না হওয়া পর্যন্ত সেটা যাবে না।
অমিতাভ বেশি রাতে বাড়ি ফিরলেও ধীরাপদ টের পায়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তখন সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না। চারুদির টেলিফোনের কথা ভেবে উতলা বোধ করে। তবু না। সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত দরজা বন্ধ থাকে, তখন ইচ্ছে করলে দরজা ঠেলে ঢুকতে পারে। তাও হয় না। অনুকূল অবকাশ মনে হয় না সেটা।
কিন্তু অবকাশ আর হলই না। আচমকা ঝড় এলো একটা। এত বড় ব্যবসায়ের অস্তিত্ব বিড়ম্বিত হবার মত ঝড়। সে ঝড়ের ইন্ধন এলো বাইরে থেকে, যার জন্য একটি প্রাণীও প্রস্তুত ছিল না। এমন কি অমিতাভ ঘোষও না।
খবরের কাগজে সেদিন একটা ছোট্ট খবর চোখে পড়ল ধীরাপদর। না পড়তেও পারত। সাধারণের লক্ষ্য করার মত খবর কিছু নয়। এই ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে সেও লক্ষ্য করত না। জাপান থেকে নতুন ওষুধ বেরিয়েছে একটা—ছোটখাটো আবিষ্কারই বলা যেতে পারে। চিলেটেড আয়রন ইনট্রামাসকুলার ইনজেকশান নানাজাতীয় রক্তাল্পতার ব্যাধিতে এই আবিষ্কার বিশেষ ফলপ্রসু হবার সম্ভাবনা।
ধীরাপদ চমকে উঠেছিল। অমিতাভ ঘোষ আজ ক-বছর ধরে কি নিয়ে গবেষণা- মগ্ন? কি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল সে? কি জন্যে গবেষণা বিভাগ খোলার এত ভাগিদ ছিল তার? এই রকমই তো কী একটা শুনেছিল। এই ব্যাপারই তো। তাড়াতাড়ি অফিসে এসে তিন দিন আগের সাপ্তাহিক মেডিক্যাল জার্নাল খুলেছে। তার পরেই চক্ষুস্থির তার। ও কাগজের কাছে খবরটা ছোট নয়। তারা ওই আবিষ্কার সম্বন্ধে ফলাও করে লিখেছে। ওই ব্যাপারই যে, ধারাপদর আর একটুও সন্দেহ নেই।
হঠাৎ কি এক অজ্ঞাত ভয়ে আড়ষ্ট সে। মনে পড়ল গত তিন দিন ধরে বেশি রাতেও অমিতাভর বাড়ি ফেরার সাড়াশব্দ পায়নি। এখন মনে হচ্ছে, সে বাড়ি ফেরেই নি মোটে। আরো দুদিন মুখ বুজে অপেক্ষা করল, মাঝরাত পর্যন্ত কান খাড়া করে কাটালো। যত রাতেই ফিরুক সামনে গিয়ে দাঁড়াবে।
ফেরেনি।
ধারাপদ চারুদিকে টেলিফোন করল। তিনি উত্তলা না হন এইভাবেই কথা কইল। তার না যেতে পারার ব্যাপারে অনেকগুলো কৈফিয়ৎ খাড়া করল প্রথম, এমন কি নিজের সুস্থ শরীরকে অসুস্থ বানালো। চারুদি চুপচাপ শুনলেন শুধু, একবারও অনুযোগ করলেন না বা আসার তাগিদ দিলেন না। শেষে ধারাপদ অমিতাভর কথা জিজ্ঞাসা করল— ক’দিন বাড়িতে দেখা নেই, তার কি খবর?
চারুদি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, জানেন না। ইতিমধ্যে সেখানেও সে যায়নি। আরো কয়েকটা দিন গেল। ধীরাপদ ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছে। শেষে আর থাকতে না পেরে সিতাংশুর অনুপস্থিতেতে জার্নাল খুলে জাপানের নয়া ওষুধের বিবরণ লাবণ্যকে দেখালো সে। ডাক্তার হিসেবে তারই আগে দেখার কথা, কিন্তু দেখেনি।
দেখা মাত্র মুখ শুকোলো তারও। বিগত ক-টা দিনের ব্যক্তিগত সমাচারও শুনল। লাবণ্য নির্বাক।
তারপর ঝড়।
সেই ঝড়ের ধাক্কায় ছোট সাহেব সিতাংশু মিত্রের স্থির গাম্ভীর্যের মুখোস খসে গেছে। ক্ষিপ্ত দিশেহারা হয়ে উঠেছে সে। মুহূর্মুহু ডাক পড়ছে ধারাপদর, কখনো বা নিজেই হস্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। দিশাহারা ধীরাপদ আর লাবণ্য সরকারও।
পরপর দুটো সমন এসেছে কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেকটরের নামে।
ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের প্রতিনিধি হিসেবে সিতাংশু সেই সমন গ্রহণ করেছে। একটা হাইকোর্ট থেকে, অন্যটি ফৌজদারী আদালত থেকে। আরজির নকলসহ সমন। অভিযোগের দীর্ঘ জোরালো তালিকা। তহবিল তছরূপ, তহবিল অপচয়, প্রবঞ্চনা, জাল কর্মচারী নিয়োগ, ব্যক্তিগত প্রচারের খাতে অপব্যয়, লাবণ্য সরকারের ফ্রী কোয়ার্টারের খাতে অর্থব্যয় এবং সেখানকার বেড-এ বিনামূল্যে কোম্পানীর ওষুধ চালানো, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ইচ্ছাকৃত ও স্বার্থপ্রণোদিত পরিচালনার গলদ ইত্যাদি ইত্যাদি।
হাইকোর্টে অমিতাভ ঘোষ ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের অপসারণ দাবি করেছে এবং যতদিন তা না হয় ততদিনের জন্য অচিরে রিসিভার নিয়োগের আবেদন জানিয়েছে। আর ফৌজদারী আদালতে ফৌজদারী মামলা রুজু করেছে।
পরদিন সকালেই লাবণ্যর দাদা বিভূতি সরকারের সপ্তাহের খবরে জোর খবর, গরম খবর, বিষম খবর।
বিজ্ঞাপন বাদ দিলে কাগজের সবটাই প্রায় এই খবর। সপ্তাহের খবর কোম্পানীর গোড়া ধরে টান দিয়েছে। কার টাকায় ব্যবসায়ের পত্তন হয়েছিল প্রথম, আর সেই লোকেরই কি অবস্থা এখন, কেসের বিস্তৃত সমাচার, কতভাবে টাকা অপচয় হয়, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কর্মচারীদের বঞ্চিত ভাগ্য, বড় সাহেবের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও তাঁর বর্তমান সফরের উদ্দেশ্য, অস্তিত্বশূন্য কর্মচারীর ফিরিস্তি – ইত্যাদির পরে নতুন লট-এর সঙ্গে মেয়াদ-ফুরনো পুরনো ওষুধ বিক্রির রহস্য। ছোট বড় হরফে শুধু সংবাদ পরিবেশন করেনি, রঙ্গ-ব্যঙ্গ করে টিকা-টিপ্পনীসহ ঝাঁঝালো সম্পাদকীয় মন্তব্যও লেখা হয়েছে এই নিয়ে।
ঝড়ের ঝাপটায় সমস্ত কারখানায় মৃত্যুর স্তব্ধতা। বড় সাহেবের কাছে জরুরী তার পাঠানো হয়েছে, সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি যেন রওনা হন। সিতাংশু বারকতক ট্রাঙ্ককলেও ধরতে চেষ্টা করেছে তাঁকে কিন্তু তিনি এক জায়গায় বসে নেই বলে ধরা যায়নি। টেলিগ্রামও চট করে পাবেন কিনা সন্দেহ।
এদিকে লাবণ্য স্তব্ধ সব থেকে বেশি। ধীরাপদ তার কারণও অনুমান করতে পারে। বিভূতি সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের যোগটা ভুলবে কেমন করে? ধীরাপদ সেইদিনই বিভূতি সরকারের বাড়ি অর্থাৎ তাঁর সাপ্তাহিক খবরের অফিসে এসেছিল। দু-একজন কম্পোজিটারের সঙ্গে শুধু দেখা হয়েছে, তাঁর ঘর বন্ধ। খবর পেয়েছে দিনকয়েকের জন্য বাইরে গেছেন তিনি। ধীরাপদ ফিরে এসেছে। …যেতেও পারে বাইরে, অনেক টাকা পকেটে এলে তবে এর মধ্যে নাক গলানো সম্ভব। এই কাগজ সম্বন্ধে বা কাগজের খবর সম্বন্ধে লাবণ্য একেবারে নির্বাক। ধীরাপদর ধারণা সেও দাদার খোঁজে এসেছিল আর একই অনুপস্থিতির সংবাদ নিয়ে ফিরে গেছে।
কিন্তু ধীরাপদ আর একটা ভয়ে বিভ্রান্ত। শুধু টাকার লোভে বিভূতি সরকারের অতটা দুঃসাহসিক ব্যাপারের মধ্যে জড়িয়ে পড়া সম্ভব কিনা বুঝছে না। হাতেনাতে প্রমাণ না দেখে তিনি কিছু করেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু অমিতাভ ঘোষকে কতটা প্রমাণ হাতছাড়া করেছে? কি হাতছাড়া করেছে?
রাত একটা-দেড়টার কম নয় তখন। বহুবার এপাশ ওপাশ করার পর সবে একটু তন্দ্রার ঘোর এসেছে। পার্টিশনের ওধারে মানকের নাকের খেলা তেমন করে আর কানের পর্দায় ঘা দিচ্ছে না। হঠাৎ প্রায় আঁতকে উঠে ধীরাপদ এপাশ ফিরল, তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
ধীরুবাবু! ধীরুবাবু—
আবছা অন্ধকারে ধীরাপদ দু চোখ টান করে তাকালো। সামনে অমিতাভ ঘোষ। অস্ফুট স্বরে হেসে উঠল সে, চাপা গলায় বলল, এরই মধ্যে ঘুমুলেন নাকি?
হাত বাড়িয়ে ধীরাপদ টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টিপতে যাচ্ছিল, বাধা দিল। –থাক, আলো জ্বালতে হবে না, আপনাকে ডাকতে এলাম, আমার ঘরে আসুন।
ধীরাপদ তক্ষুণি বিছানা থেকে নেমে এলো। আশ্চর্য, কখন ফিরেছে! সারাক্ষণ তো জেগেই ছিল, কিন্তু টের পায়নি। অথচ ফিরলে সাধারণত টের পায়। অবশ্য আজ আসবে একবারও ভাবেনি। এই বাড়িতেই আর তার দেখা মিলবে কিনা সে রকম সন্দেহও হয়েছিল।
– বসুন। নিজে অগোছালো শয্যায় বসল। হাসছে। উদভ্রান্ত, স্নায়ুসর্বস্ব হাসি। হাসির সঙ্গে চাপা উত্তেজনা।— মজাটা কেমন দেখছেন বলুন?
ভালো।
ভালো, না? প্রতিভা ছিল কিনা টের পাচ্ছে এখন সব, কেমন? এখন ওরা কি করবে? বিদেশের বার-করা ওষুধ বেচে কমিশন লাভ করবে, এই তো? করাচ্ছি লাভ, সব তছনছ করে না দিতে পারি তো—। হেসে উঠল, হাঁ করে দেখছেন কী?
ধীরাপদ সত্যিই দেখছে আর বিপন্ন বোধ করছে। চারুদি অত্যুক্তি করেন নি, সত্যিই চিকিৎসা দরকার। এই মুখ এই নাক-চোখ দিয়ে আলগা রক্ত ছোটাও বিচিত্র নয় বুঝি। কিন্তু সে তো পরের কথা, এখন একে প্রকৃতিস্থ করতে হলে সহজ কথায় হবে না, নাটকীয় কিছুই বলা দরকার। কি বলবে?
বলল, প্রতিভার শেষ ফল দেখছি।
জ্বলজ্বলে চোখ দুটো মুখের ওপর থমকালো, কি রকম?
এ যুগের সব প্রতিভারই শেষ ফল তো ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বিনাশ—
ডোন্ট টক রট! চেঁচিয়েই উঠল প্রায়, আমি আপনার বক্তৃতা শুনতে চাই না। বিশ্বাসের গোড়াতেই ঘা পড়েছে যেন, সমস্ত মুখে সংশয় উপচে উঠল। আমি যা করেছি আপনার তাহলে সেটা পছন্দ নয়?
এ রাস্তায় হবে না বুঝে ধারাপদ সুর বদলে ফেলল। – আমার পছন্দ-অপছন্দর কথা হচ্ছে না, আপনি কথা দিয়েছিলেন কিছু করার আগে আমাকে জানাবেন, এখন দেখছি আপনি আমাকেও বিশ্বাস করেন না।
জ্বালা গেল, যাতনাও কমল। ওই মুখেই আবার হাসির আভাস জাগতে সময় লাগল না। আগের উত্তেজনার মধ্যেই ফিরে আসছে আবার। বলল, আপনি আচ্ছা ছেলেমানুষ… বিদেশ থেকে ওই ওষুধের খবর পড়ে আমার মাথার ঠিক ছিল ভেবেছেন? তা ছাড়া কত কাণ্ড করতে হল এর মধ্যে যদি জানতেন, অ্যাটর্নি বলেছে, আপনি যে দুটো পয়েন্ট মনে করিয়ে দিয়েছেন বড় মোক্ষম পয়েন্ট সে দুটো।
আগের মতই হেসে উঠল সে। ধীরাপদ বাইরে শান্ত, কিন্তু মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে চলেছে। জিজ্ঞেস করল, বিভূতি সরকারের কাগজে তো ঢালা খবর বেরিয়েছে দেখলাম, আপনার সেই সব কাগজপত্র আর অ্যালবামটাও এখন তাঁর হাতেই বোধ হয়?
অমিতাভ প্রায় অবাক, নির্বোধের কথা শুনছে যেন। আবার আনন্দও হচ্ছে। —এই বুদ্ধি আপনার…এই জন্যেই বুঝি ঘাবড়েছেন? মশাই টাকায় সব হয় আজকাল, বুঝলেন? সব হয়- তাকে শুধু কাগজপত্রগুলো দেখিয়েছি সব, আর করকরে তিন হাজার টাকার নোট নাকের ডগায় দুলিয়েছি, তাতেই কাজ হয়েছে। চালিয়ে গেলে পরে আরো দু হাজার দেব বলেছি। তিনি সব নোট করে নিয়েছেন, ছবির কপি চেয়েছিলেন তাও দিইনি—অবিশ্বাস করবে কেন, তার পিছনে তো দাঁড়াবই জানে —হাইকোর্ট আর ক্রিমিন্যাল কোর্টের নকল দেখেছে না?
ধীরাপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চেষ্টা করে আবারও অন্তরঙ্গ হৃদ্যতায় ছেলেমানুষি উপদেশ দিল, কোনো ডকুমেন্ট হাতছাড়া করবেন না, অ্যাটর্নির কাছেও নয়।
অমিতাভ হাসছে। উত্তেজনায় ভরপুর আত্মতুষ্টির হাসি। বলল, মশাই অ্যাটর্নিও মানুষ, নাকের ডগায় টাকা দোলালে তারও মাথা বিগড়োতে পারে সে জ্ঞান আমার আছে—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
নিশ্চিন্ত থাকা সহজ নয় যেন, একটু ইতস্তত করে ধীরাপদ বলল, কিন্তু যে ব্যাপারে নামছেন সেটা তো দু-পাঁচ হাজারের ব্যাপার নয়, টাকা তো অনেক ছড়াতে হবে। কভ? এক লক্ষ? দেড় লক্ষ? আমার টাকা নেই ভাবেন নাকি? আমি শেষ দেখব, বুঝলেন?
ধীরাপদ বুঝেছে। এই মুহূর্তে অন্তত বেসুরো একটা কথা বলাও ঠিক হবে না, এতটুকু বিপরীত আঁচ সহ্য হবে না। বরং অন্য কিছু বলা দরকার, খুব অন্তরঙ্গ কিছু এইভাবে একটানা স্নায়ুর নিষ্পেষণ চললে শেষ দেখার অনেক আগে নিজেকেই নিঃশেষ করবে লোকটা।
খানিক চুপ করে থেকে খুব শান্ত মুখে বলল, আমার একটা কথা শুনবেন?
জ্বলজ্বলে দৃষ্টিটা থমকালো একটু, জবাব দিল না। জিজ্ঞাসু প্রতীক্ষা।
তার আগে একটা কথা, আমাকে আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন?
কি বলবেন বলুন?
সত্যিই বিশ্বাস করেন, নাকি নাকের ডগায় টাকা দোলালে আমিও উল্টো রাস্তায় চলতে পারি মনে করেন?
চকিত অবিশ্বাসের ছায়াই দেখা দিল মুখে, তপ্ত বিরক্তিতে বলে উঠল, এসব কথা উঠছে কেন, কি বলবেন বলুন না?
সাধারণ কথা ক’টা যাতে খুব সাধারণ না শোনায়, ধীরাপদ সেই জন্যেই সময় নিল আরো একটু। তারপর অন্তরঙ্গ সুরে বলল, এই সব ভাবনা-চিন্তা ছেড়ে আপনি দিনকতক সময়মত খাওয়া-দাওয়া করুন, সময়মত ঘুমোন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছেন এর মধ্যে?
এই সামান্য কটা কথা এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছুবে ধীরাপদও আশা করেনি। এক মুহূর্তে সব অবিশ্বাস সব সংশয় কেটে গেল যেন, শিশুর অসহায় যাতনা ফুটে উঠল মুখে। একটা উদগত অনুভূতি সামলে উঠতে চেষ্টা করেও পারল না, হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ধীরাপদর দুটো হাত আঁকড়ে ধরল। অস্ফুট হ্রাস—ধীরুবাবু, আপনি ঠিক বলেছেন! আমি খেতে পারি না, ঘুমুতে পারি না, সব সময় কি জানি কি ভয়— এ আমার কি হল ধীরুবাবু?
মর্মছেঁড়া অদ্ভুত কথা, অদ্ভুত ব্যাকুলতা! আর কারো মুখে শুনলে বুকের ভিতরটা এমন মোচড় দিয়ে উঠত কিনা বলা যায় না। কয়েক মুহূর্ত ধীরাপদও অসহায় বোধ করল। তারপর কি ভেবে পরামর্শ দিল, দিনকতক না হয় আপনার মাসির কাছে গিয়ে থাকুন না?
মাথা নাড়ল, তাও পারবে না। বলল, এই ব্যবসায়ে মাসির স্বার্থও তো কম নয়, তার স্বার্থেও তো ঘা পড়েছে, এখন আর মাসিই বা আমাকে আগের মত দেখবে কেন? উত্তেজনা বাড়ল, তা ছাড়া আমি সেখানে যাই কি করে এখন, তারা তো আমাকে শত্রু ভাবছে।
তারা বলতে আর কে ধীরাপদ বুঝেছে। পার্বতী। শান্ত গলায় বলল, ভাবছে না।
আবারও সেই আগ্রহ, সামনে ঝুঁকে এলো। আপনি কি করে জানলেন?
আমি জানি। সেখানে কেন, এখানেও আপনার কোনো ভয় নেই।
নেই—না? আমিও জানি, কেউ আমার কোনো ক্ষতি করবে না জানি, ক্ষতি করতে পারবে না। তবু এ রকম হচ্ছে কেন? সর্বক্ষণ এ কিসের ভয় আমার?
ধীরাপদ তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, তখনকার মত ঠাণ্ডা করে নিজের ঘরে চলে এসেছে। কিন্তু মনে যা হয়েছে সে কথাটা বলতে পারেনি। জবাব দিতে পারেনি কিসের ভয়, কেন ভয়।…ভয় তার নিজেকেই। অন্তস্তলে ধ্বংসের বীজ বুনেছে। সেখানে ধ্বংসের ছায়া পড়েছে। যে মানুষ শুধু সৃষ্টির স্বপ্নে সৃষ্টির তন্ময়তায় বিভোর—ওই বীজ পুষ্ট হলে আর ওই ছায়া ঘোরালো হলে অন্তরতম সত্তা কেঁপে উঠবে না তো কী? বক্ষ ভেদ করে যে হাউইয়ের আগুন ছুটিয়েছে, এ পর্যন্ত সেটা তো তার নিজের বুকেই ফিরে এসেছে।
আশার কথা, লোকটা আজ এই প্রথম অসহায় শিশুর মতই একান্তভাবে বিশ্বাস করেছে তাকে, তার ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু ধীরাপদ কি করবে, কি তার করার আছে ভেবে পাচ্ছে না। আর ভাবতেও পারছে না সে। …আজ থাক, পরে চিন্তা করবে। পরে ভাববে।
পরে ভাবার অবকাশ হল না। বিচারে গদার জেল হয়েছে।
দলবলসহ একাদশী শিকদারের ছেলের জেল হয়েছে—কারো দশ বছর কারো আট বছর। গণুদা নতুন আসামী, নতুন হাতেখড়ি, তার জেল হয়েছে চার বছর।
সশ্রম কারাদণ্ড।
রায় যেদিন বেরুবে সেদিন ধীরাপদ কোর্টে উপস্থিত ছিল। আর সেই একদিন সোনাবউদিও। বিচারক রায় দিলেন। গদা শুনল, সোনাবউদি শুনল, ধীরাপদ শুনল। ধীরাপদ শুধু শুনল না, দেখলও। বিচারক রায় ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিস আসামীদের ভার নেবে। তাই নিল। পুলিসের সঙ্গে গণদা চলে গেল। কিন্তু যাবার আগে গণুদা কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র থমকে দাঁড়িয়েছিল।
সেই ক’টা মুহূর্ত ধীরাপদ ভুলবে না।
গণুদা দাঁড়িয়েছিল। মুখ তুলে সোনাবউদিকে দেখেছিল। সেই মুখে শুধু নির্বাক বিস্ময়। জীবনে সেই একটা মুহূর্তই যেন সে স্ত্রীকে দেখে গেছে—দেখে গেছে কিন্তু বোঝেনি। আর সোনাবউদিও তেমনি করেই তাকিয়েছে তার দিকে। রাগ নেই, বিদ্বেষ নেই, স্নিগ্ধ নীরব দুই চোখে শুধু যেন বলতে চেয়েছে, যেটুকু হওয়া প্রয়োজন ছিল সেইটুকু হয়েছে। যাও, ঘুরে এসো।
বিস্ময় শুধু গণুদার নয়, ধীরাপদরও। হয়ত বিচারের ফল এই হত, হয়ত সোনাবউদির বিবৃতিতে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু অনুভূতির রাজ্যে তার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম। সোনাবউদি পুলিসের কাছে যে এজাহার দিয়েছিল পরেও তা অস্বীকার করেনি। বিচারক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সোনাবউদি চুপ করে ছিল। সেই নীরবতা স্বীকৃতির সামিল। তাই শুধু গণুদার নয়, ধীরাপদরও কেমন মনে হয়েছে, সোনাবউদি গণুদাকে শাস্তির মুখে ঠেলে না দিক, তাকে রক্ষাও করতে চায়নি।
….এই কারণেই গণুদার এই বিস্ময় আর এই চাউনি।
সোনাবউদিকে নিয়ে ধীরাপদ সুলতান কুঠিতে ফিরল। ট্যাক্সিতে একটি কথাও হয়নি। সমস্তক্ষণ সোনাবউদি রাস্তার দিকেই চেয়েছিল। সুলতান কুঠিতে ফিরে পাশের খুপরি ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। সেখানেই চুপচাপ বসে আছে। বড় ঘরে উমা নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, ছেলে দুটো সঠিক বোঝেওনি কি হয়েছে।
সন্ধ্যের আগে একবার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল ধীরাপদ। কিন্তু সেখানেও ধাক্কা খেয়েছে একটা। দূরে, ঘরের ভিতর থেকে গলা বার করে দাঁড়িয়ে আছেন একাদশী শিকদার। এতদিনের মধ্যে ধীরাপদ এই আবার দেখল তাঁকে। কিন্তু না দেখলেই ভালো ছিল। শেষ খবরটা পাবার আশাতেই ওভাবে দাঁড়িয়ে আছেন হয়ত। অভিশাপ বহনের দৃশ্যটি সুসম্পূর্ণ, ধীরাপদ চোখ ফিরিয়ে নিল। মনে হল মূমুর্ষু নিষ্প্রভ ঘোলাটে দুই চোখের মিনতি তাকে টানছে। অথচ সত্যিই তিনি ডাকছেন না। ধীরাপদ কি করবে? কাছে গিয়ে খবরটা দেবে?…থাক, খবর জানতেই পারবেন একসময়ে।
ভিতরে চলে এলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। সুলতান কুঠির রাত গাঢ় হতে সময় লাগে না। সোনাবউদি সেই খুপরি ঘরেই বসে। আর খানিক বাদে ছেলেমেয়ে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে হয়ত। এর পরের ব্যবস্থাপ্রসঙ্গে সোনাবউদির সঙ্গে খোলাখুলি কিছু কথা হওয়া দরকার। অবশ্য তাড়া নেই, কথা দু দিন বাদে হলেও চলবে। কিন্তু আজকের এই স্তব্ধতা খুব স্বাভাবিক লাগছে না, সোনাবউদি কি আশা করেছিল গণুদা ছাড়া পাবে? একবারও তা মনে হল না, আশা করলে নিজের বিবৃতি অস্বীকার করত। করেনি যে সেই অনুতাপ?
পায়ে পায়ে ধীরাপদ খুপরি ঘরে ঢুকল। চৌকিতে সোনাবউদি মূর্তির মত বসে। কোনরকম অনুতাপ ও অনুভূতির চিহ্নমাত্র নেই। ধীরাপদ কাছে এসে দাঁড়াল, একেবারে চৌকির সামনে। সোনাবউদি তাকাল তার দিকে, দেখল। কিন্তু যে দেখল সে যেন ওই মূর্তির মধ্যে উপস্থিত নেই, চেতনার অন্য কোনো প্রান্তের অনেক দূরের কিছুতে তন্ময়। অথচ তখনো ধীরাপদর দিকেই চেয়ে আছে তাকেই দেখছে।
আর ভেবে কি করবেন, উঠুন-
অনুচ্চ, সামান্য ক’টা কথার শব্দতরঙ্গের মধ্যে এমন কিছু সান্ত্বনাও ছিল না, আশ্বাসও না। কিন্তু সোনাবউদির যেন দিশা ফিরল আস্তে আস্তে, নিজের মধ্যে ফিরে এলো। দৃষ্টি বদলালো, জীবনের বিষম কোনো মুহূর্তে হঠাৎ সব থেকে প্রয়োজনের মানুষকে একেবারে নাগালের মধ্যে পেলে যেমন হয়, সোনাবউদির চোখে সেই আলো সেই আগ্রহ। দু হাত বাড়িয়ে ধীরাপদর হাত দুটো ধরল, সর্বাঙ্গে চকিত শিহরণ একটু। আয়ত পক্ষরেখায় জলের আভাস, কিন্তু জল নেই। ধীরাপদ চেয়ে আছে, স্বচ্ছ দুটি কালো তারার গভীরে তার দৃষ্টিটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
অস্ফুট স্বরে, প্রায় ফিস ফিস করে, সোনাবউদি বলল, কি হবে ধীরুবাবু, এর পর কী হবে?
অনাগত দিনের বার্তা কি ধীরাপদর মুখেই লেখা আছে? দু হাতের মুঠোয় সোনাবউদি তার হাত দুটো আরো একটু জোরে আঁকড়ে ধরল। এই মুখ এই চোখ এই আকুলতা ধীরাপদ আর কি কখনো দেখেছে? সোনাবউদিকে নিশ্চিন্ত করার জন্য হঠাৎ কত কথার ঢেউ তোলপাড় করে ঠেলে উঠতে চাইছে বুকের তলা থেকে। কিন্তু মুখ দিয়ে বেরুলো শুধু দুটি কথা, যে কথা অনেকদিন ধীরাপদ বলতে চেয়েছে, অনেকদিন মনে মনে বলেছে…
বলল, আমি তো আছি, ভয় কি…
সঙ্গে সঙ্গে কি হয়ে গেল। হাতের স্পর্শ থেকে মনে হল সোনাবউদির সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কেঁপে উঠল একবার। মনে হল, কাঁপুনি দুই ঠোঁটের ফাঁকে এসে ভাঙতে চাইল। মনে হল, আয়ত পক্ষরেখার ওধারে কালো তারার অতল থেকে চকিত ঢেউ উঠল একটা। তারপরেই এক নিবিড় আকর্ষণে ধীরাপদ বসে পড়ল, তারপর কোথায় হারিয়ে যেতে লাগল জানে না। সোনাবউদি বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছে তাকে, দুই ব্যগ্র বাহু আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধছে তাকে। বিহ্বল আবেগে তার গালের ওপর নিজের গাল দুটো ঘষছে। একটা হাত তার ঘাড়ে মাথায় চুলের ঝাঁকড়ায় সমস্ত মুখের ওপর বিচরণ করে বেড়াল কয়েক মুহূর্ত, বিড়বিড় করে বলে গেল, আমি জানি আমি জানি, না জানলে এত পারি কোন ভরসায়। ছোট ছেলের মতই তার মাথাটা সবলে টেনে এনে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখল, কপালের ওপর গাল রেখে শেষবারের মতই বুকের মধ্যে আর দুই হাতের নিবিড়তার মধ্যে আঁকড়ে ধরে থাকল তাকে।
ঘরের দরজাটা খোলা।
বাঁধন ঢিলে হল একসময়। ছেড়ে দিল। উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দেখল দু-পলক। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেল।
ধীরাপদ বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত। নিস্পন্দ, কাঠ। একটা স্পর্শের শিহরণ লাগছে এক- একবার, সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে। অনেকক্ষণ বাদে সম্বিত ফিরল, সাড় ফিরল। উঠে এই খুপরি ঘর থেকে—এই সুলতান কুঠি থেকেই ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আর কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার হাতে পায়ে কেমন করে যেন শেকল পড়ে আছে। তার নড়াচড়ার উপায় নেই, একজনের ইচ্ছে ভিন্ন এই ঘর ছেড়ে তার কোথাও যাবার শক্তি নেই।
রাত বাড়ছে। ওধার থেকে রান্নার টুকটাক আওয়াজ আসছিল কানে, সেটা আর শোনা যাচ্ছে না। খুব সংক্ষেপেই রান্না সেরেছে মনে হয়।…উমা আর ছেলে দুটোর খাওয়া হয়ে গেল বোধ হয়। এবার তার ডাক পড়বে। সে খেয়ে নেবে। তারপর…তারপর কি হবে?
ডাক পড়ল না। তার খাবার নিয়ে সোনাবউদি এ ঘরেই এলো। এক হাতে মেঝেতে জল ছিটিয়ে জায়গা মুছে থালাটা রাখল। একটা আসন পেতে দিল। ধীরাপদ অবাক হয়ে দেখছে। এমন শান্ত সুন্দর আর বোধ হয় সোনাবউদিকে কোনদিন দেখেনি। চোখ ফেরানো যায় না এখন, অথচ এই মুহূর্তেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবার ইচ্ছেটা আরো বেশি অনুভব করছে।
জলের গেলাস রেখে সোনাবউদি তাকালো তার দিকে। যন্ত্রচালিতের মত উঠে এসে ধীরাপদ খেতে বসল। মাথা গোঁজ করে খেতে লাগল। পলকের দেখা সোনাবউদির ওই চাউনিটুকু বুকের তলায় নড়াচড়া করছে। ঠিক এমনি স্নিগ্ধ নীরব দৃষ্টি আজই যেন কোথায় দেখেছে। কোর্টে দেখেছে। সোনাবউদি যখন গণুদার দিকে চেয়েছিল তখন।
কিন্তু খাওয়া তো হয়ে গেল। আর একটু বাদেই সুলতান কুঠির রাত নিঝুম হবে। …তারপর কি হবে?
মুখ তুলল একবার। সোনাবউদি অদূরে বসে। নিষ্পলক চেয়ে আছে। দেখছে তাকে। ধীরাপদ তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিল। সোনাবউদির চোখে-মুখে একটুও অস্বস্তির ছায়া নেই, কোনো উত্তেজনার রেখামাত্র নেই। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আভাসের মত দেখল। কালো তারায় শুধু মমতার ধারা দেখল যেন।
উঠুন। আপনার অনেক রাত হয়ে গেছে আজ।
গোড়ার ওই রাতটুকু কি স্বপ্ন? ধীরাপদ স্বপ্ন দেখেছিল? আবারও মুখ তুলল, তারপর চেয়েই রইল।
এত রাতে আর ট্রাম-বাসের জন্য অপেক্ষা করবেন না, একটা গাড়ি ধরে নিয়ে চলে যান।
আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেও ভয় হয়ে গেল ধীরাপদর। চেয়ে আছে, আর মনে হচ্ছে এতক্ষণের শিকলটা বুঝি ভেঙে ভেঙে মিলিয়ে যাচ্ছে।
শাস্তমৃদু স্বরে সোনাবউদি বলল, আপনি আছেন আমার আর ভয়-ভাবনা নেই। তবু মন অবুঝ হলে এক কথাই ঘুরে ফিরে বলি…ডাকলে আপনাকে পাবো তো?
এই মুহূর্তে আবার ধীরাপদর বলতে ইচ্ছে করছিল, না ডাকলেও পাবেন। বলা গেল না। মাথা নাড়ল শুধু।
মুখের দিকে চেয়েই সোনাবউদি ভাবল কী, হাসলও একটু। এই হাসিটুকুর যেন তুলনা নেই। বলল, শিগগীরই ডাকব কিন্তু…। আচ্ছা রাত হল, উঠুন এখন—
পর পর তিন-চারটে দিন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে গেল ধীরাপদর। প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি একটা বিস্ফোরণের মুখে এসে ঠেকেছে খেয়াল নেই, অমিতাভর ক্ষিপ্ততার দিকে চোখ নেই। সবই দেখছে সবই শুনছে, নিয়মিত কাজে যাচ্ছে, কাজ করছে-কিন্তু ভিতরের মানুষটার সঙ্গে কোন কিছুর যোগ নেই। সে সারাক্ষণ প্রতীক্ষারত আর সারাক্ষণ উতলা। টেলিফোন বেজে উঠলে চমকে ওঠে, খামে নিজের নামে চিঠি দেখলে খাম খুলতে গিয়ে আঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে যায়। একটা ডাক শোনার আশঙ্কায় দু কান উৎকর্ণ সর্বদা। সুস্থ চিন্তার অবকাশে সোনাবউদির কথা হেঁয়ালির মত লেগেছে। ডেকে পাঠাবার আগে প্রকারান্তরে যেতে নিষেধ করেছে হয়ত। সেই ডাকের দুর্বহ প্রতীক্ষা, অথচ প্রতীক্ষার অবসান হোক একবারও চায় না। সোনাবউদির ডাক এলেই যেন এক চরম সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়াতে হবে তাকে, নিঃশব্দে পা বাড়াতে হবে। সে রাতের নিবিড় স্পর্শ আজও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, কিন্তু আশ্চর্য সেই স্পর্শের জ্বালা নেই যাতনা নেই তাপ নেই। সেই স্পর্শের অনুভূতিতে সর্বাঙ্গ সিরসিরিয়ে বুকের ভিতর থেকে একটা নিটোল ভরাট কান্নাই শুধু গলা বেয়ে উঠতে চায়। আর কিছু নয়।
ডাক এলে ধীরাপদ কি করবে? শিগগীরই ডাকব বলল কেন সোনাবউদি? উঠতে বসতে চলতে ফিরতে কথা ক’টা ভয়ের একটা সংকেতের মত কানে লেগে আছে কেন?
ডাক এলো।
সকালে সবে চায়ের পেয়ালা মুখে তুলেছে, হন্তদন্ত হয়ে রমণী পণ্ডিত এসে হাজির। কেউ তাঁকে নিয়ে আসেনি, নিজেই ঢুকে পড়েছেন। বড় হলঘরের এধারে আসার আগেই তাঁর কথা কানে এলো। — ধীরুবাবু শিগগীর চলুন, গণুবাবুর বউটির বোধহয় কিছু হয়ে গেল—
পেয়ালাটা হাত থেকে নামায় নি ধীরাপদ। কথাগুলো কানের ভিতর দিয়ে উপলব্ধির দোরে এসে পৌঁছনোর আগেই সমস্ত চেতনা সমস্ত বোধশক্তি নিষ্ক্রিয়, অসাড়। কাছে এসে রমণী পণ্ডিত আবার বললেন, শিগগীর চলুন। সকাল হলেই বার বার করে আপনাকে খবর দিতে বলে রেখেছিলেন, কিন্তু এরই মধ্যে কি হয়ে গেল আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। উঠুন! বসে রইলেন কেন?
আবারও একটা ঘা খেয়েই যেন চেতনা ফিরে আসছে। হাতের পেয়ালাটা নামিয়ে রাখল। সামনে রমণী পণ্ডিত দাঁড়িয়ে। উনি বললেন কিছু, তাকে উঠতে বলছেন, সোনাবউদির কিছু হয়েছে বলছেন।
উঠে দাঁড়াল। অকস্মাৎ সর্বাঙ্গের সব ক’টা স্নায়ু একসঙ্গে কেঁপে উঠল। সমস্বরে চিৎকার করে উঠতে চাইছে তারা, কি হয়েছে? কি হয়েছে সোনাবউদির? স্যাণ্ডেল জোড়া পায়ের কাছেই ছিল, এস্তে জামাটা টেনে গায়ে পরে নিল। তারপর একটা উদ্ভ্রান্ত অনুভূতি দমন করে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
বাইরে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। যেতে যেতে রমণী পণ্ডিত সংক্ষেপে সমাচার জানালেন, কাল রাতে গণুবাবুর বউ তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তিনি খুব অসুস্থ বোধ করছেন, সকাল হলেই নিজে গিয়ে যেন ধীরুবাবুকে একবার খবর দেন আর তাঁকে ডেকে আনেন। আর যদি সম্ভব হয় তা হলে ধীরুবাবু যেন তাঁদের অফিসের সেই মহিলা ডাক্তারটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। রমণী পণ্ডিত তক্ষুনি একজন ডাক্তারের খোঁজে যেতে চেয়েছিলেন, বউটির মুখ দেখে অসুখ কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু উনি তাঁকে ঘৱে ডেকে এনে অসুস্থ বোধ করার কথা বলতে তাঁর কেমন ভয় ধরেছিল। বউটি নিষেধ করলেন, বললেন, সকালের আগে কিছু করার দরকার নেই, সকাল হলেই তিনি যেন সোজা ধীরুবাবুর কাছে চলে আসেন। কিন্তু সকালের মধ্যেই এমন কাণ্ড হবে কে জানত? সকালে এখানে আসার আগে একবার খোঁজ নিতে গিয়ে রমণী পণ্ডিত দেখেন গণবাবুর মেয়েটা কাঁদছে আর চিৎকার করে মাকে ডাকাডাকি করছে —সঙ্গে ছেলে দুটোও। কিন্তু বউদির কোনো সাড়াশব্দ নেই, তিনি নিজেও ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া পাননি। একেবারে বেহুঁশ। মনে হয়েছে নিঃশ্বাসও পড়ছে না। সেখান থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়েছেন রমণী পণ্ডিত, সোজা এখানে চলে এসেছেন। গিয়ে কি দেখবেন জানেন না—
রমণী পণ্ডিতকে আর একটা ট্যাক্সি ধরে নিয়ে চলে যেতে বলে ধীরাপদ এই ট্যাক্সিতে উঠে বসল। ট্যাক্সি লাবণ্য সরকারের নার্সিং হোমের পথে ছুটল। ধীরাপদ মূর্তির মত বসে। বুকের ভিতরটা গুমরে গুমরে উঠতে চাইছে, সে উঠতে দিচ্ছে না।…সোনাবউদি এই ডাকাই তো ডাকবে, এই ডাকাই তো ডাকতে পারে সোনাবউদি! ধীরাপদর মত এমন নির্বোধ আর কে? এত বড় নির্বোধ আর কে আছে জগতে? কিন্তু সোনাবউদির কি সত্যিই কিছু হয়ে গেছে? কি হতে পারে ধীরাপদ ভেবে পাচ্ছে না। কেমন করে হতে পারে ধীরাপদ ভেবে পাচ্ছে না। ভাবতে গিয়ে দুর্বোধ্য জট পাকিয়ে যাচ্ছে একটা। হয়ত কিছুই হয়নি, হয়ত সোনাবউদি শুধু অসুস্থই হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার কথামত ধীরাপদ লাবণ্যকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কেন? ধীরাপদর ভয় করছে কেন? অজ্ঞাত ত্রাসে বুকের ভিতরটা নিস্পন্দ কেন?
লাবণ্য অবাক। মুখের দিকে চেয়ে ঘাবড়েও গেছে একটু—কি হয়েছে?
এক্ষুনি আসুন একবার।
কিন্তু কি হয়েছে? কারো অসুখ নাকি?
হ্যাঁ, সোনাবউদির। সঙ্গে ট্যাক্সি আছে, তাড়াতাড়ি এলে ভালো হয়।
লাবণ্য তবু দাঁড়িয়ে আরো একটু নিরীক্ষণ করে দেখল তাকে, তারপর ভিতরে চলে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ব্যাগ হাতে ফিরে এলো আবার। নিচে নামল। ধীরাপদ আগে আগে, লাবণ্য পেছনে। ট্যাক্সিতে উঠল। ট্যাক্সি ছুটল।
লাবণ্য ফিরে তাকালো।—কি অসুখ।
জানি না। সকালে লোকের মুখে খবর পেয়েছি। ধীরাপদ রাস্তার দিকে ফিরে বসল।
সুলতান কুঠি। দাওয়ার সামনে ট্যাক্সি থামল।
ট্যাক্সি থেকে নেমেই দু পা কাঠ ধীরাপদর। সোনাবউদির ঘরের দিকে একনজর তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বলে দিল, বড় দেরিতে এসেছে সে, যা হবার হয়ে গেছে। ব্যাগ হাতে লাবণ্য তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকল। কলের মূর্তির মত পায়ে পায়ে ধীরাপদও। দুই চোখ টান করে দেখছে সে। সব দেখছে।
…. মেঝেতে বিছানা পাতা। সোনাবউদি শয়ান। অঘোরে ঘুমুচ্ছে মনে হয়। পাশে উমা বসে ফ্রকের আঁচলটা মুখে গুঁজে দিয়ে কাঁদছে। ছেলে দুটোও মায়ের দুধারে পুতুলের মত বসে আছে আর ফ্যালফ্যাল করে এক-একজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সোনাবউদির মাথার কাছে ঘোমটা টেনে বসে বোধ হয় রমণী পণ্ডিতের স্ত্রী, ওধারে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কুমু। পণ্ডিতের অন্য ছেলেমেয়েগুলোও এধার-ওধার থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বাইরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুকলাল দারোয়ান, ভিতরে রমণী পণ্ডিত।
শিয়রের পাশে বসে পড়ে লাবণ্য তাড়াতাড়ি সোনাবউদির হাত টেনে নিল। হাতটা মুষ্ঠিবদ্ধ। নাড়ি দেখল। তারপরেই ঘাড় ফিরিয়ে চকিত দৃষ্টিনিক্ষেপ করল একটা ক্ষিপ্রহাতে স্টেথোস্কোপের জট ছাড়িয়ে যন্ত্রটা বুকে লাগাল, বুকের ওপর নিজেও ঝুঁকে পড়ল প্রায়। স্তব্ধ মুহূর্ত গোটা কয়েক, কান থেকে স্টেথোস্কোপ ফেলে দিয়ে ব্যাগটা কাছে টেনে নিল।
সেটা খোলার আগে হাত থেমে গেল। ব্যাগ ছেড়ে আস্তে আস্তে সোনাবউদির একটা চোখের পাতা টেনে দেখল। তারপর ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে তাকালো। সকলেই দেখে নিল একবার, ধীরাপদকেও।
আপনারা একবার বাইরে যান। রমণী পণ্ডিতের ঘোমটা টানা স্ত্রীও উঠে দাঁড়াতে তাঁকে শুধু বলল, আপনি থাকুন।
ধীরাপদ নিজের ঘরে এসেছে। তার কোলে মুখ গুঁজে উমা এতক্ষণে শব্দ করে কাঁদার অবকাশ পেয়েছে। ছেলে দুটো তেমনি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। অদূরে মাথা গোঁজ করে রমণী পণ্ডিত দাঁড়িয়ে। দোরগোড়ায় পাংশু মুখে শুকলাল দারোয়ান।
খানিক বাদে লাবণ্য এলো। উমা চমকে মুখ তুলল, তারপর ছুটে চলে গেল। মায়ের কাছেই গেল। ছেলে দুটোও অনুসরণ করল। তারা না বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত লাবণ্য কিছু বলল না। শুকলাল এরই মধ্যে একটা মোড়া ঘরে রেখে আবার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
লাবণ্য বসল। প্রথমে রমণী পণ্ডিতের দিকে তাকালো একবার, তারপর ধীরাপদর দিকে। জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রমহিলার স্বামী তো জেলে, না?
ধীরাপদ নির্বাক। বিচারের খবর কাগজে উঠলেও লাবণ্যর সেটা লক্ষ করা বা গণুদাকে চেনার কথা নয়। পরক্ষণে মনে হল, খবরটা ওই পাশের ঘর থেকেই সংগ্রহ করেছে, রমণী পণ্ডিতের স্ত্রীর কাছ থেকে। কিন্তু লাবণ্য বলছে না কেন কিছু? কি বলবে সে? প্রতিটি নীরব মুহূর্ত বুকের ওপর মুগুরের ঘা দিচ্ছে। ও-ঘরে উমার কান্না।
ব্যাগ খুলে লাবণ্য প্যাড বার করল। তারপর রমণী পণ্ডিতের দিকেই তাকালো আবার। বলল, বড় রকমের শক পেয়েছেন, কার্ডিওভাসকুলার ফেলিওর… হার্ট আর ব্লাডপ্রেসার একসঙ্গে কোলাপস করেছে।
ডেথ সার্টিফিকেট লিখল। প্যাড থেকে কাগজটা ছিঁড়ে ধীরাপদর হাতে দিল। তারপর ব্যাগ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। যাবে।
সব মিলিয়ে মিনিট কুড়িও নয়। ট্যাক্সিটা বাইরে অপেক্ষা করছে। লাবণ্য ট্যাক্সিতে উঠল। ধীরাপদ যন্ত্রচালিতের মত সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আপনি এখন এঁদের সঙ্গেই আছেন তো?
ধীরাপদ মাথা নেড়েছে হয়ত।
বিকেলে নয়তো সন্ধ্যার পরে একবার আমার ওখানে আসবেন। কথা আছে।
ট্যাক্সি চোখের আড়াল হয়ে গেল। ধীরাপদ দাঁড়িয়ে আছে। উমার আর্তকান্না কানে আসছে। মাথার ওপর আগুনের গোলার মত সূর্য জ্বলছে, সামনে রমণী পণ্ডিত দাঁড়িয়ে। ….হাতে এটা কী! ও! ডেথ সার্টিফিকেট…সোনাবউদি আর নেই! কার্ডিওভাসকুলার ফেলিওর! হার্ট আর ব্লাডপ্রেসার একসঙ্গে কোলাপ্স্ করেছে। হার্ট আর ব্লাডপ্রেসার…
এতকাল নিজের চোখ দুটোর ওপর ধীরাপদর ভারী আস্থা ছিল। সকলে যা দেখে না সে তাই দেখে। কিন্তু চোখের ওপর দিয়ে কত কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে সে কি দেখতে পাচ্ছে? দেখলে তো বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাবার কথা। আজ তা হচ্ছে না।
উমা আর ছেলে দুটোকে তারস্বরে কেঁদে উঠতে দেখেছে। উমা যদিও বুঝেছে, ছেলে দুটো মোটেই বোঝেনি তাদের মাকে কাঁধে তুলে কোথায় নিয়ে গেল সকলে। তারা ভয় পেয়ে আর দিদির কান্না দেখে কেঁদে উঠেছে। ধীরাপদ চেয়ে চেয়ে দেখেছে, অনুভব করতে চেষ্টা করেছে। পারেনি।
চিতার আগুন জ্বলে উঠেছে। সোনাবউদির দেহ ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে। ধীরাপদ নির্নিমেষে দেখছে। কিন্তু এই দেখাটাও অন্তস্তলে পৌঁছুচ্ছে না।
স্টেশন ওয়াগনে করে লাবণ্য এলো। শ্মশানে আসতে পারে ভাবেনি। ধীরাপদ বিমুঢ় চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। মিনিট দুই দাঁড়িয়ে লাবণ্য চিতা জ্বলতে দেখল। তারপর ধীরাপদর সামনে এসে দাঁড়াল। তার পাশে রমণী পণ্ডিত বসে।
সাদাসিধে ভাবে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখন যাচ্ছেন না তো? আমি এলাম একবার দেখতে…
চলে গেল। লাবণ্য কি দেখে গেল? কার্ডিওভাসকুলার ফেলিওরে চিতার আগুন ঠিক ঠিক জ্বলছে কি না?…না জ্বললে তার সমস্যা। কিন্তু ধীরাপদ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কেন? কার্ডিওভাসকুলার ফেলিওর না, বাড়িতে উমা আর ছেলে দুটোর কান্না না, সামনের ওই চিতার আগুনও না।
কিছুই দেখছে না, কারণ সারাক্ষণ নিজের মধ্যে ডুবে শুধু একটা জবাব হাতড়ে বেড়াচ্ছে সে। সেই খোঁজার তাড়নায় বাকি সব ক’টা অনুভূতি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। চোখের সুমুখ থেকে দুর্বোধ্যতার পরদাটা এখনো সরেনি।
বিকেল গেল। সন্ধ্যা গড়াল। রাত হল। সুলতান কুঠির রাত। রমণী পণ্ডিতকে দিয়ে খাবার আনিয়ে মেয়েটাকে আর ছেলে দুটোকে খাইয়েছে। তারপর ওদের জড়িয়ে ধরে শুয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে। আর আশ্চর্য, নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে কখন।
একেবারে সকালে চোখ মেলেছে।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত উঠে বসেছে। প্রথমেই মনে হয়েছে সোনাবউদি আর নেই—এটা সত্যি কিনা? সত্যি। তার মেয়ে আর ছেলেরা জড়াজড়ি করে ঘুমুচ্ছে। তা হলে সোনাবউদি নেই। কেন নেই?…কার্ডিওভাস্কুলার ফেলিওর, হার্ট আর ব্লাডপ্রেসার একসঙ্গে কোলাপস করেছে। সোনাবউদির মৃত্যুর ওপর ওগুলো কয়েকটা হিজিবিজি শব্দের বোঝা! কেন নেই সোনাবউদি? তাকে ডাকবে বলেছিল, ডেকেছে। কিন্তু সোনাবউদি নেই কেন?
ঘুমন্ত মেয়ে আর কচি ছেলে দুটোর দিকে চোখ গেল। আজ বুকের ভিতরে মোচড় পড়ছে, চোখ দুটো জ্বালা করছে। না, সোনাবউদিকে সে কোনদিন ক্ষমা করবে না, সোনাবউদি আছে কি নেই, ছিল কি ছিল না—সে চিন্তাও ভিতর থেকে নির্মূল করে দিতে চেষ্টা করবে। ওরাও যাতে মা ভোলে সেই চেষ্টা করবে। এই মাকে ওদের মনে রেখে কাজ নেই।
গতকাল সন্ধ্যায় লাবণ্য দেখা করতে বলেছিল। বলেছিল কথা আছে। ধীরাপদর মনেও ছিল না…লাবণ্য শ্মশানে গিয়েছিল কেন? অনুমান করতে পারে, কিন্তু থাক, ভেবে কাজ নেই। লাবণ্যর প্রতি কৃতজ্ঞ।
আজও সন্ধ্যার আগে সুলতান কুঠি থেকে বেরুবার অবকাশ পেল না ধীরাপদ। মা ভোলানোর চেষ্টাটা কম দুরূহ নয়। ওই নির্মম মাকেও ওরাও সহজে ভুলতে চায় না। এদিকের অন্যান্য ব্যবস্থায় শুকলাল দারোয়ানকে বড় কাছে পেয়েছে। সে না থাকলে ধারাপদ হিমসিম খেত। কুমুও ঘুরেফিরে কতবার এসেছে ঠিক নেই। রমণী পণ্ডিত এসেছেন, এমন কি ঘোমটা টেনে তাঁর স্ত্রীও। মানুষ অবিমিশ্র ভালো না হোক, অবিমিশ্র মন্দও যে নয় ধীরাপদ সেটুকুই অনুভব করতে চেষ্টা করেছে।…এক সোনাবউদি ছাড়া ধীরাপদ সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।
শুকলালকে ঘরে বসিয়ে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফেরার আশ্বাস দিয়ে ধীরাপদ লাবণ্যর নার্সিং হোমে এলো।
কিন্তু নার্সিং হোম আর নেই। বাইরের ঘরটা তেমনি আছে। ভিতরের ঘরে একটাও বেড নেই। ঘরটা যে রোগীর আবাস ছিল তাও বোঝা যায় না। একেবারে ফাঁকা। কোর্টের সমনের কথা মনে পড়ল। একটা নয়, দু-দুটো সমন। নিরাপত্তার প্রয়োজনে নার্সিং হোম রাতারাতি উঠে গেছে।
কড়া নাড়ল। সব ঘর খোলা যখন লাবণ্য ভিতরেই আছে। ছিল। তক্ষুনি বেরিয়ে এলো, বাইরের ঘরে বসলো দুজনে।
কাল এলেন না, ক্লান্ত ছিলেন?
ধীরাপদ চুপ করে রইল। ক্লান্তি এখনো। রাজ্যের ক্লান্তি।
লাবণ্য কুশানে গা এলিয়ে একটু একটু পা দোলাচ্ছে, আর তার দিকেই চেয়ে আছে।—এদিকের সব ভালো মত হয়ে গেল?
ধীরাপদ মাথা নাড়ল।
চিকিৎসকসুলভ নিস্পৃহতা সত্ত্বেও লাবণ্যর কৌতূহল চাপা থাকল না। বলল, ভদ্রমহিলা আমি যাবার অনেকক্ষণ আগে মারা গেছেন মনে হল, আপনি আমাকে ডাকতে আসারও আগে।…এত দেরিতে খবর দিলেন কেন?
চকিতে খেয়াল হল কি বলতে চায়। ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায়, রোগিণী মারা গেছে জেনেই তাকে ডাকতে আসা হয়েছিল। সন্দেহ অস্বাভাবিক নয়, ধীরাপদ বলল, আমিও জানতুম না, খবর পেয়ে আগে সোজা আপনার কাছে এসেছি।
লাবণ্যর দৃষ্টিটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, কিন্তু প্রশ্নটা নরম গলাতেই করল।— আগে আমার কাছে কেন?
উনি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
উনি কে?
সোনাবউদি।
বিস্মিত দৃষ্টিটা মুখের ওপর থেমে রইল একটু, কবে কার কাছে বলেছিলেন? আগের দিন রাতে, পণ্ডিত মশায়ের কাছে।
আবারও সংশয়ের ছায়া পড়ল মুখে, আপনার সোনাবউদি তখন অসুস্থ ছিলেন? পণ্ডিত মশাইকে বলেছিলেন, অসুস্থ বোধ করছেন, সকাল হলেই যেন আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই।
ও। ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করল চুপচাপ খানিক। তারপর স্বাভাবিক সুরেই জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রমহিলার মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয় আপনি বুঝেছেন বোধ হয়?
বুকের তলায় হৃৎপিণ্ডটা সংযত করতে বেগ পেতে হল। ধীরাপদ মাথা নাড়ল। বুঝেছে।
কেমন করে বুঝেছে সেটা আর লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল না, মুখের দিকে চেয়ে শুধু অপেক্ষা করল একটু। তারপর অনেকটা নিজের মনেই বলে গেল, গুচ্ছের সিডেটিভ খেয়েছেন, অত সিডেটিভ পেলেন কোথায়, আশ্চর্য। শেষে আর জল দিয়ে গেলেননি, মুড়ির মত চিবিয়েছেন। হাঁ করিয়ে দেখলাম মুখের মধ্যে তখনো ছিল, দু-একটা বিছানায় কাঁধের নিচেও পড়েছিল।
ধীরাপদর চোখের সুমুখ থেকে দুর্বোধ্যতার পরদাটা এবারে সরছে আস্তে আস্তে। সোনাবউদির রাতে ঘুম হত না শুনেছিলেন, শুকলাল দারোয়ানকে দিয়ে প্রায়ই ঘুমের ওষুধ কেনাত শুনেছিল। শুধু শুকলাল কেন, গণুদাকে দিয়েও কেনাত হয়ত, তখনও গণুদা জেলের বাইরে। আর হয়ত নিজেও সংগ্রহ করত। নইলে এত পেল কি করে? কতদিন ধরে সোনাবউদি এই ঘুমের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে? কবেকার সংকল্প এটা? এমন স্বার্থপরের মত ঘুমোবার মতলব সোনাবউদি কতদিন ধরে করে আসছে?
শোনার পর ধীরাপদ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে একটু। সঙ্কল্পটা অনেকদিনের জানার পর তার যেন হালকা বোধ করার কারণ আছে কিছু।…পরে ভাববে। লাবণ্য এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলেনি। অন্য আলোচনার ইচ্ছে ছিল বোধ হয় তার। বড় সাহেব টেলিগ্রাম পেলেন কিনা সেই দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছিল।
ধীরাপদ উঠে পড়ল। শরীরটা ভালো ঠেকছে না জানিয়ে আর অপেক্ষা করল না। এরপর কারবারের আসন্ন দুর্যোগের কথা উঠত, অমিতাভ ঘোষের মারাত্মক পাগলামির কথা উঠত, বিভূতি সরকারের সপ্তাহের খবরের কথাও উঠত কিনা বলা যায় না। সামনে গুরুতর সমস্যা, গুরুতর সংকট। কিন্তু আজ আর কোন কিছুতে মন দিতে পারছে না ধীরাপদ। কবে পারবে তারও ঠিক নেই।
সুলতান কুঠিতে ফেরার আগে মিত্তিরবাড়িতে এলো একবার। গতকাল থেকে সে নেই, সেখানে তারা হয়ত ভাবছে। খবরটা জানিয়ে যাওয়া দরকার। তা ছাড়া ও বাড়িতে বাস এবারে তো উঠলই মনে হয়।
কেয়ার-টেক বাবু জানালো, মানকেকে নিয়ে বউরাণী গেছে বাপের বাড়িতে। রাত হয়ে গেল, এখনো ফিরছে না দেখে সে চিন্তিত। তাকেই খবরটা দিল ধীরাপদ, বউরাণী এলে তাকে জানাতে বলল, আপাতত তার এখানে থাকা সম্ভব নয়, পরে একদিন এসে বউরাণীর সঙ্গে দেখা করবে।
শয্যার ওপাশের টেবিলের ওপর তার নামের খাম একটা। বাংলায় নাম-ঠিকানা লেখা। কেয়ার-টেক বাবু জানালো আজ দুপুরেই এসেছে ওটা। খামটা হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে কি যে হল ধীরাপদ জানে না, মুহুর্তের জন্য ধমনীর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল বুঝি, বুকের স্পন্দন থেমে গেল। তারপরেই প্রবল নাড়াচাড়া পড়ল, আস্তে আস্তে ধীরাপদ বিছানায় বসল।
বাবু কিছুক্ষণ থাকবে ভেবে কেয়ার টেক বাবু চলে গেল। ধীরাপদর চোখের সামনে খামের ওপরের অক্ষরগুলো নড়েচড়ে আবার স্থির হল। চেনা অক্ষর নয়, পরিচিত লেখাও নয়। কিন্তু ধীরাপদ নিঃসংশয় জানে এ চিঠি কোথা থেকে এসেছে, এই শেষ লেখা কে লিখেছে।
ধীরুবাবু,
আপনাকে ডাকব বলেছিলাম, ডাকলাম তো? এখন রাগ করুন আর যাই করুন, কথা ফেলার সাধ্য আপনার নেই। বলেছি না, আপনি আছেন না জানলে এত ভরসা আমি পেলাম কোথায়? সত্যি বলছি, কাল কি হবে ভেবে আমার এতটুকু দুঃখ নেই, আতঙ্ক নেই। শুধু আপনাদের বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করেই যা দুঃখ। নইলে এ পরিণতির জন্যে আমি কতদিন ধরে তিলে তিলে প্রস্তুত করেছি নিজেকে ঠিক নেই। সেই যেদিন চাকরি খুইয়ে তখনকার মত মনস্তাপী হয়ে আমাকে শুনিয়েছিল, আর তার বাঁচার ইচ্ছে নেই, একমাত্র আত্মহত্যা করলেই সব দিক রক্ষা হয়, জয়েন্ট লাইফ ইন্সিওরেন্সের দশ হাজার টাকা আমাকে দিয়ে যেতে পারে—সেই দিন থেকেই!
বিশ্বাস করুন, তার মুখের দিকে চেয়ে সেইদিন সেই মুহূর্তে কেমন করে যেন আমি নিজেকে এই পরিণতিটা দেখেছিলাম। দেখে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে দেখাটা সয়ে গেছে। তারপর সহজ হয়েছে। শেষে এত সহজ হয়েছে যে এক-এক সময় এই মরণদশার মধ্যেও নিজের মনে হেসেছি আর আপনাদের রমণী পণ্ডিতের গণনার বাহাদুরি দিয়েছি। আজ তাঁর কাছেও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
আপনি আমাকে বরাবর ছেলেমেয়ের প্রতি নিষ্ঠুর বলে এসেছেন। কিন্তু সত্যি সত্যি নিষ্ঠুর হতে পারলে তো বাঁচতুম। শুধু ওদের দিকে চেয়েই আমি আর কোনো পথ দেখলাম না। টাকাটা পেলে ওরা যদি বাঁচে ভেবে মৃত্যুটা খুব ত্রাসের মনে হয়নি আমার। এভাবে টাকা পেতে বিবেকে লেগেছে, প্রবঞ্চনা মনে হয়েছে। কিন্তু হলেও তার দাম তো কম দিচ্ছি নে, আমি এই দেহটা বয়ে বেড়িয়ে কি করতে পারতুম?
আমার বিচার ভগবান করবেন। আপনি শুধু গরীবের ছেলেমেয়ের মত মেয়েটা আর ছেলে দুটোকে মানুষ করে দেবেন। দেবেনই জানি। জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যা ব্যবস্থা করা দরকার করবেন। ব্যবস্থার ভার আমি আপনাকে দিয়ে গেলাম তাকে জানাবেন। আমার স্থির বিশ্বাস এতে কোনো বাধা হবে না। লোকটাকে আপনারা যত বড় অমানুষ দেখেছেন ঠিক ততটাই অমানুষ সে নয়। অন্তত ছিল না। লোভ তাকে বিষিয়েছে, এই দিনের অভিশাপ তাকে বিষিয়েছে। আমি তাকে রক্ষা করতে পারিনি। কিন্তু ভগবান রক্ষা করেছেন। সে বাইরে থাকলে আমার এই যাওয়াও যে ব্যর্থ হত সেটা এখন সে বুঝবে একটুও সন্দেহ নেই। আর তার ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই, আপনিও রাগ রাখবেন না। যতখানি আয়ু সে আমার ক্ষয় করেছে ভগবান আরো ততখানি সুস্থ পরমায়ু তাকে দিন।
এইবার আপনাদের রমণী পণ্ডিতকে ডাকব, কাল ভোরে আপনাকে খবর দিতে বলব। সম্ভব হলে আপনাদের লাবণ্য সরকারকেও ডাকতে বলব। তার কথা কেন মনে হচ্ছে জানি না। ডাক্তার এনে আপনারা তো হৈ-চৈ করবেনই জানা কথা, এই দেহটা নিয়ে টানা-হেঁচড়াও হবে হয়তো। যদিই এড়ানো যায়।
কোনোরকম পাগলামো করবেন না, আমার নিষেধ থাকল। ছেলেমেয়ের জন্যে আর আমি একটুও ভাবি না। আপনাকে নিয়েই আমার ভয়। নিজের ওপর কোনো অনিয়ম অত্যাচার করতে গেলেই আপনার যেন মনে হয় সোনাবউদি দেখছে। আপনার কোনো ক্ষতি আমার সহ্য হবে না। ভগবানের কাছে শত কোটি প্রার্থনা লাবণ্য যেন আপনাকে চিনতে পারে।
— সোনাবউদি
মাথাটা ঘুরছে একটু একটু। ও কিছু নয়, আলোটা চোখে বেশি লাগছে। উঠে আলো নিবিয়ে আবার এসে বসল। শুতে পারলে আর একটু ভালো লাগবে। বিছানায় গা ছেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতর থেকে নাড়ি-ছেঁড়া যাতনায় হাহাকার করে সে অবোধটা ডুকরে উঠতে চাইল, বালিশে প্রাণপণে নিজের মুখ চাপা দিয়ে তার মুখ চাপা দিতে চেষ্টা করল ধীরাপদ।
সোনাবউদি তুমি এ কি করলে!
তুমি এ কি করলে সোনাবউদি!
এ তুমি কি করলে সোনাবউদি—!