চব্বিশ
শুধু সুলতান কুঠিতে নয়, ধীরাপদ সর্বত্রই একটা অনাগত বিপর্যয়ের ছায়া দেখছে।
বড় সাহেবের বাড়িতে অসন্তোষ, চারুদির বাড়িতে অসন্তোষ, কারখানায় অসন্তোষ, এমন কি ধীরাপদর মগজের মধ্যেও কি এক অসন্তোষের বাষ্প জমাট বাঁধছে। কেবলই মনে হয় এই সবগুলি অসন্তোষের ধারা কোথাও এসে মিলবে তার খরবেগে তখন অনেক কিছুই তলিয়ে যাবে।
অর্গ্যানিজেশন চীফ সিতাংশু মিত্র অর্গ্যানিজেশনে মেতেছে। প্রেম-দেউলে পুরুষ অনেক সময় নেশাসক্ত হয় নাকি। ছোট সাহেবের সংগঠনের নেশায় পেয়েছে। দুর্বলের দাপটে ভয়ের থেকে অস্বস্তি বেশি। ঘরের সবুজ আলোয় একজনের কোলে তার মুখ- থুবড়ানো দুর্বল চেহারাটা ধীরাপদর দেখা আছে। কিন্তু লাবণ্য সরকার প্রকাশ্যে আগের থেকেও আরো অনেক কম জাহির করে নিজেকে। একেবারে নিজস্ব আওতার কিছু না হলে কোনো কাগজপত্রে তার মন্তব্য বা সইসাবুদও দেখা যায় না বড়। তবু ধীরাপদর ধারণা, যে কারণে মহিলা একজনকে মন দেওয়া সত্ত্বেও আর একজনকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে এতকাল, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই কারণটা আরো জটিল বই সরল হয়নি।
বহুদিন আগে অফিসের কাজে লাবণ্যকে নিয়ে সিতাংশু একবার বোম্বাই গিয়েছিল। ফলে বড় সাহেব বিরূপ হয়েছিলেন, অমিতাভ ক্ষেপে উঠেছিল। সম্প্রতি একজন সমুদ্রপারে আর একজন কাছে থেকেও অনেক দূরে। কিন্তু খুব কাছে তৃতীয় একজন আছে। একই উপলক্ষে এবারে আর এক বৈচিত্র্যের সম্মুখীন হল ধীরাপদ।
রাতে মানকে এসে কথায় কথায় জানালো, বউরাণীর মাথা-টাথা ধরে থাকবে, ওষুধের দোকানে ফোন করে মেম-ডাক্তারের খোঁজ করছিলেন। মেম-ডাক্তার আসছেন হয়ত…
মন বলে বস্তুটাকে ধীরাপদ ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায়, কিন্তু এরা এক-একটা নাড়াচাড়া দিয়ে সজাগ করবেই। ধীরাপদ জানে মেম-ডাক্তার আসবে না। সকালের প্লেনেই তারা বোম্বাই পৌঁছে গেছে। আসতে আসতে কাল বিকেল। ভালো, ভালো, এতদিনের মধ্যে দিন বুঝে সময় বুঝে বউরাণীর তাহলে আজই মাথা ধরেছিল! খুব ভালো। ধরতেই পারে, দেহযন্ত্রের সারথি এই মাথাটা, কম ব্যাপার নয়!
পরদিন সকালে চায়ের অপেক্ষায় বসেছিল, নির্লিপ্ত-বদন মানকে খালিহাতে এসে খবর দিল, বউরাণী আপনাকে ওপরে গিয়ে চা খেতে বললেন।
বউরাণীর মাথার আওতায় নিজেও পড়তে পারে ভাবেনি। শুনে ধীরাপদ খুব স্বস্তিবোধ করল না। বউরাণীর তলব এই প্রথম। এযাবৎ আড়াল থেকে তার যত্ন- আত্তির আভাস পেয়েছে।
বড় সাহেবের ঘরে টিপয়ে চায়ের সরঞ্জাম রেখে অপেক্ষা করছিল। মাথার কাপড়টা খোঁপার ওপর নেমে এসেছিল, একটু তুলে দিয়ে তাকালো। সলাজ মিষ্টি অভিব্যক্তি, আপনাকে ওপরে ডেকে বিরক্ত করলাম… বসুন।
সঙ্কোচ নেই বটে, কিন্তু ঘরের বউয়ের সহজাত নম্রতাটুকু সুশোভন। টিপয়ের সামনের চেয়ারটায় বসে ধীরাপদ সহজভাবেই বলল, না, বিরক্তি কিসের।
খাবারের ডিশটা এগিয়ে দিয়ে বউরাণী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা করতে লাগল। এই অভ্যর্থনার পিছনে একটা প্রচ্ছন্ন লক্ষ্য ধীরাপদ অনুভব করছে। কি ভেবে সে নিজেই জিজ্ঞাসা করে বসল, কাল রাতে আপনি অসুস্থ বোধ করছিলেন নাকি?
হাত থামল, মুখ তুলল-পলকের বিড়ম্বনা। তারপরেই প্রশ্নের হেতু বুঝল। দুই ভুরুর মাঝে ওই চকিত কুঞ্চনের আভাস মানকের প্রতি বিরক্তিসূচক হয়ত।
না…। চা করা শেষ হতে জিজ্ঞাসা করল, দেব?
ধীরাপদ ঈষৎ ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি ঢেলে নেব’খন, আপনি বসুন।
একটু সরে গিয়ে খাটের বাজু ধরে দাঁড়াল সে, বসল না। বলল, আমাকে তুমি বলবেন, আমার নাম আরতি।
নাম জানে, কিন্তু প্রস্তাবটা অপ্রত্যাশিত। এ বাড়িতে বড় সাহেব ধীরাপদকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন বটে, কিন্তু এতটা করেছেন নিজেও জানত না। এর পর আরো সহজ হওয়ার কথা, অথচ বিপরীত হল। হাসতে চেষ্টা করে সে শূন্য পেয়ালাটা কাছে টেনে নিল।
আরতি এগিয়ে এসে পেয়ালায় চা ঢেলে দিয়ে আবার খাটের বাজু ধরে দাঁড়াল। ধীরাপদর এও ভালো লাগল, মিষ্টি লাগল, অথচ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। শিখার মত সেজেগুজে মানকেকে বাহন করে যে মেয়ে স্বামীর ফ্যাক্টরী দেখতে যায়, এই আটপৌরে বেশবাস আর মিষ্টি সৌজন্যের মধ্যেও সেই মেয়েই উকিঝুঁকি দিচ্ছে।
দু মাস হল আপনাকে খুব ব্যস্ত দেখছি, কারখানার কাজ বেড়ে গেছে বুঝি?
না…অন্য একটা ঝামেলা নিয়ে আছি। ফ্যাক্টরীর কিছু না-
কাল সকালে উনি বঙ্গে চলে গেলেন, পরে শুনলাম লাবণ্য দেবী গেছেন। খুব জরুরী কিছু ব্যাপার বোধ হয়?
যে মেয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল নির্দ্বিধায় তার সামনেও সে এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে ধীরাপদ ভাবেনি। অথচ বলার ধরনে তির্যক আভাসমাত্র নেই, যেন খবর করার মত সহজ সরল প্রশ্নই একটা।
ঠিক জানি নে…
দুই এক মুহূর্তের বিনয়-নম্র প্রতীক্ষা। ধীরাপদ চায়ের পেয়ালা মুখে তুলেছে। শ্বশুরমশাই যেভাবে বলেন, মনে হয় কারবারের মাথা বলতে এখন আপনি। এঁরা কেন গেলেন আপনি জানেনও না?
ধীরাপদ নিরুত্তর, চায়ের পেয়ালা নামায়নি। আরতির সৌজন্যে চিড় খেতে দেখল না, পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে হাসির মত কি লেগে আছে। শ্রদ্ধেয়জনের সঙ্গে শ্রদ্ধাসহকারেই কথা কইছে, কিন্তু সেও মিত্তিরবাড়ির বউ, জিজ্ঞাসা যা করছে তার যথাযথ উত্তর সে প্রত্যাশা করে মনে হল।
একটু থেমে ঘুরিয়ে সেই গোড়ার প্রশ্নেরই পুনরুক্তি করল, এখানেও দিনরাতের খাটুনি দেখছি, বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ারও সময় হয় না… কারখানার কাজের চাপ এখন খুব বেশি নাকি?
ধীরাপদ পেয়ালা নামালো। সহজভাবেই বলল, নিজে সব দিক দেখাশুনা করছেন তাই চাপ একটু বেশিই পড়েছে।
আরতি আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি, কিন্তু এরপরেও একটা অনুক্ত জিজ্ঞাসা তার চোখে লেগে ছিল। সিতাংশু একা সব দিক দেখাশুনা করছে, না সঙ্গে একজন আছেন…তিনি কতটা আছেন? দুজনে একসঙ্গে বম্বে যাওয়ার মত সত্যিই কিছু জরুরী কাজ পড়েছিল কিনা সেটুকু জানাই বোধহয় আসল উদ্দেশ্য ছিল তার। নিজের অজ্ঞাতে ধীরাপদ তার জবাবও দিয়ে ফেলেছে। সে জানে না মানেই তেমন গুরুতর প্রয়োজন কিছু ছিল না। অন্তত আরতি তাই ধরে নিয়েছে। কিন্তু ধীরাপদ সত্যিই সঠিক জানত না। হয়ত বা ফিলড অর্গ্যানিজেশনেই গেছে সিতাংশু। বোঁঙ্গাই মস্ত মার্কেট। সঙ্গে ডাক্তার থাকলে সুবিধেও হয়। লাবণ্যর মত ডাক্তার থাকলে অনেকগুণ বেশিই সুবিধে হয়।
ভিতরে ভিতরে মেয়েটার ভালরকম মানসিক দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। বড় বেশি স্পষ্ট মেয়েটা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কম। কিন্তু বেশ মেয়ে, ধীরাপদ খুশি হয়েছে। অফিসের পরিবেশে সিতাংশু এমনিতেই গভীর, এর পরের কয়েকটা দিন আরো বেশি গম্ভীর মনে হয়েছে তাকে। তার বোম্বাই সফরের স্টেটমেন্টে দেখা গেছে, বছরে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকার ব্যবসা বাড়ার সম্ভাবনা।
কিন্তু অন্দরমহলের ক্ষোভের জের কোথায় এসে ঠেকল সে সম্বন্ধে মানকের মুখ থেকেও কিছু আভাস পাওয়া গেল না। সে জানলে তার কানে আসতই। সেদিন শরীর অসুস্থ হয়েছিল কিনা জিজ্ঞাসা করে ধীরাপদই হয়ত বোকার মত সতর্ক করে দিয়েছে মেয়েটাকে।
গণুদার কেসটা প্রথম কোর্টেই ঝুলছে তখনো, তাই আগের মত অতটা নিষ্ক্রিয় ভাবনা-চিন্তার অবকাশ ছিল না। তবু এরই ফাঁকে ব্যক্তিগত ভাবনাটা বক্রগতি নিয়েছে। নিভৃতে এই ভাবনাটা লালন করতে ভালো লাগছে ধীরাপদর। সেই ভাবনা লাবণ্য সরকারকে ঘিরে।… সব কটা জটিল আবর্তের মূলে সে, তাকে কেন্দ্র করেই যা কিছু। মাটির তলা থেকে গাছের শিকড়সুদ্ধ উপড়ে নেওয়ার মত এই একজনকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে আনতে পারলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায় বোধহয়। চারুদি ছেলে চায়, পার্বতী আরো বেশি কিছু। গ্লানিমুক্ত বাতাসে একটি শিশুর আবির্ভাব ঘটতে পারে। আরতির মাথাধরা ছেড়ে যেতে পারে, সুস্থ সম্পদে ভরে উঠতে পারে মেয়েটা। আরো অনেক দিকে অনেক কিছু হতে পারে…। ধীরাপদ কি এই সঙ্কল্প নেবে? পুরুষের সঙ্কল্প? আরতির মুখ, চারুদির মুখ, পার্বতীর মুখ, এমন কি যে জাতক এখনো ভূমিষ্ট হয়নি সেই মুখের হাসিটুকুরও যেন তার এই সঙ্কল্পের সঙ্গে যোগ।
কিন্তু নিজের ভিতরটাই ধীরাপদর একপ্রস্থ কুয়াশায় ছাওয়া। অন্তস্তলের নিভৃতচারীকে দেখার ভয়ে সেই কুয়াশাও নিজেই পুষছে। লাবণ্যকে মোটামুটিভাবে সরিয়ে আনা মানে কর্মস্থল থেকে তাকে বিচ্যুত করা নয়। তাঁর ভগ্নিপতির বাসনার ইন্ধন যুগিয়ে বড় ডাক্তার হয়ে আসার জন্য তাকে বিলেত পাঠানোও নয়। দুটোর একটার সঙ্গেও আপোস করতে পারে না। তাহলে আর কিভাবে সরিয়ে আনবে? সঙ্কল্প নেবে কেমন করে?
রমেন হালদারের চাকরি গেল।
খুব সঙ্গত কারণেই গেল। আগে হলে কেসটা ধীরাপদর কাছেই আসত। তা আসেনি। বরখাস্তের নোটিসে সিতাংশু সই করেছে। কিন্তু ধীরাপদর কাছে এলে সেও একই নিষ্পত্তি করত। রমেন হালদারের চাকরি যেত।
চুরি ধরা পড়েছে। দোকানের ওষুধ সরিয়ে অন্য দোকানে সস্তায় চালান দিচ্ছিল। কতদিন ধরে এ কাজ শুরু হয়েছে সঠিক জানা যায়নি। অন্য দোকান থেকে সস্তায় সেই ওষুধ কিনে একজন মুখচেনা খদ্দের ম্যানেজারকে চোখ রাঙাতে এসেছিল—এই দোকানে দাম এত বেশি নেওয়া হয় কেন?
ওষুধের প্যাকেট হাতে করে ম্যানেজার হতভম্ব, প্যাকেটে এই দোকানের সাঙ্কেতিক দাগ। ভুলবশতই হোক বা ওষুধ নিয়ে কেউ যাচাই করতে আসতে পারে না ভাবার দরুনই হোক, পেন্সিলের দাগটা তোলা হয়নি। ম্যানেজার প্যাকেট হাতছাড়া করেননি। চুরির ব্যাপারে কেউ গণ্ডগোল পছন্দ করে না। ম্যানেজার প্যাকেটসহ সেই দোকানে গিয়ে গণ্ডগোল পাকিয়ে তোলার উপক্রম করতেই তারা সত্য প্রকাশ করে দিয়েছে। তারা জানে ডাক্তারের কাছ থেকে পাওয়া ওষুধ, কত ডাক্তার কত রকমের কত ওষুধ সংগ্রহ করে। তারা সস্তায় পেয়েছে, কিনেছে।
ম্যানেজার লাবণ্য সরকারকে জানিয়েছেন সে তাঁর লিখিত রিপোর্ট আদায় করে সিতাংশুকে দিয়েছে। তারপর সেই রিপোর্টসহ বরখাস্তের কপি ধীরাপদর কাছে এসেছে। শুধু তাই নয়, ম্যানেজারের মৌখিক অভিযোগের দরুন কাঞ্চনকেও আপাতত সাসপেণ্ড করা হয়েছে। তার চাকরি থাকবে কি থাকবে না সেটা বিবেচনা-সাপেক্ষ।
ধীরাপদ ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করেছিল। তিনি সেই পুরানো কথাই বলেছেন। সেই সঙ্গে একটা নতুন কথাও।
রমেনের চুরি হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। তবু একেবারে চাকরি যাক সেটা তিনি চাননি। কয়েক বছর আগেও এরকম একটা কেস হয়েছিল। হাতেপায়ে ধরতে বড় সাহেব সেই লোকটিকে ক্ষমা করেছিলেন। এ কথা তিনি মিস সরকারকে জানিয়েছিলেন, চাকরিটা যাতে থাকে সেই অনুরোধও করেছিলেন। ছেলেটাকে সকলেই ভালবাসে, লোভে পড়ে করেছে। ম্যানেজারের আসল রাগ কাঞ্চনের ওপর, তাঁর বিশ্বাস ওই মেয়েটার জন্যই এ কাণ্ড করেছে সে— তাকে টাকা-পয়সাও দেয় হয়ত, যার দরুন নিজের খরচ চালাতে পারে না। ওই মেয়েটার ফাঁদে পা দিয়েই লোভের ফাঁদে পা দিয়েছে সে। ম্যানেজার জানালেন মিস সরকার কোনো কথা কানে তোলেননি। কিছুদিন ধরেই তিনি ছোকরার ওপর বিষম তেতে ছিলেন। তাঁর ধারণা, রমেন মিস সরকারের এক আত্মীয়ের কাছে তার নামে কিছু বলেছে। মিস সরকার নিজেই একদিন ম্যানেজারকে ঘরে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর আত্মীয়টি দোকানে এলে কার সঙ্গে কথাবার্তা হয়—শুধু রমেনের সঙ্গেই কিনা।
বাড়ি ফিরে ঘরের আবছা অন্ধকারে অস্ফুট শব্দ করে ধীরাপদ আঁতকে উঠেছিল একেবারে। তারপরেই স্থির। দু পা আঁকড়ে ধরে পায়ে মুখ গুঁজে পড়ে আছে কাঞ্চন। বিকালেই এসেছিল হয়ত, মানকেই এ ঘরে এনে বসিয়ে থাকবে, তারপর খেয়াল করে আর আলো জ্বেলে দিয়ে যায়নি।
আজ ধীরাপদর একটুও মায়া হল না, একটুও মমতা বোধ করল না। ম্যানেজারের মতই একটা হাসিখুশি ভালো ছেলের অধঃপতনের মূলে এই মেয়েটাকেও দেখছে সেও।…রমেনের বিধবা মা আছে শুনেছিল, বড় ভাইটা পাগল, আরো একটা নাবালক ভাই আছে।
ওঠো।
উঠল না।
ওঠো—! কণ্ঠস্বর আরো রুক্ষ, আরো কঠিন।
এইবার উঠল!
ধীরাপদ ঘরের আলো জ্বালল, চেয়ারটা টেনে বসতে দিল, তারপর মুখের দিকে না চেয়ে বলল, তোমাদের কোনো ব্যাপারে আমি নেই, এখানে এসেছ কেন? কে বলেছে এখানে আসতে?
কাঞ্চন মাথা নাড়ল। কেউ বলেনি।
আমার কাছে কেন এসেছ?
এসেছে কিছু বলতে। ধীরাপদ শুনতে প্রস্তুত নয়, কিন্তু বাধা দেবার আগে যে ক’টা কথা বলল তারপর আর বাধা দেওয়া গেল না। ঠিক এই কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।
কাঞ্চন নিজের জন্য দয়াভিক্ষা করতে আসেনি, ও দয়ার যোগ্য নয় জানে। তার বাঁচার দাবি অনেক আগেই ফুরিয়েছিল, এই বাঁচাটুকুই অনেক বাড়তি। কিন্তু রমেনের কোনো দোষ নেই, সব দোষ ওর–দাদা দয়া করে রমেনকে বাঁচান। সে লোভে পড়ে এই কাজ করেছে, ওকে নিয়ে আলাদা দোকান করার আশায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়েছিল। ও না থাকলে সে এসব কিছুই করত না, এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠার জন্যে পাগল হত না। একটি একটি করে পয়সা জমাতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু অভাবের তাড়নায় তাও না পেরে শেষে এই কাজ করেছে। চাকরি গেলে রমেনের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না, দাদা তাকে রক্ষা করুন, ওর চাকরিটা নিয়ে তার চাকরিটা রাখুন।
বলতে বলতে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
তাকে কোনরকম আশ্বাস না দিয়ে বিদায় করার পরেও একটা দৃশ্য ধীরাপদ কিছুতে মন থেকে তাড়াতে পারছিল না। একদিন না একদিন নিজস্ব একটা দোকান হওয়ার সম্ভাবনায় ছেলেটার সেই আশা জ্বলজ্বলে মুখখানা। তার দোকানে তাকে নেবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে আশার আলোটা চতুর্গুণ হয়েছিল, কিন্তু লজ্জায় ভেঙে পড়ে বলেছিল, যাঃ, দাদা ঠাট্টা করছেন।
পরদিন কোম্পানীর স্টেশন ওয়াগনে বাড়ি ফিরছিল, ধীরাপদর চোখ দুটো একটা শুকনো বিবর্ণ পাংশু মুখের ওপর ধাক্কা খেয়ে অন্যদিকে ফিরল।
ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিল না। থামালেই বরং ড্রাইভার ধমক খেত। ফটক থেকে খানিকটা দূরে রমেন দাঁড়িয়েছিল। কার প্রতীক্ষায় তাও জানে। কাতর দৃষ্টিটা মুহূর্তের মধ্যেই বিধিয়ে দিতে পেরেছিল, কিন্তু ফল হয়নি।
পরদিন অফিসেই এলো। তার ঘরে। ধীরাপদ মুখ তুলতেই তার চেয়ারটার দিকে এগোলো সে।
দাঁড়াও।
রমেন দাঁড়িয়ে পড়ল। শুকনো জিভে করে শুকনো ঠোঁট দুটো ঘষে নিল একবার।
আঙুল দিয়ে দরজা দেখিয়ে দিল ধীরাপদ, যাও—।
তবু সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আগুন জ্বলল মাথায়, কঠোর কণ্ঠে বলল, চোরের জন্যে আমি কোনো সুপারিশ করিনে, যাও এখান থেকে; নইলে দারোয়ান ডাকব।
রমেন তবু দাঁড়িয়ে। তবু কিছু বলতে চায়। ধীরাপদ এবারে চেয়ারসুদ্ধ ঘুরল তার দিকে। এরা বুঝি পাগলই করে দেবে তাকে। কিন্তু আর কিছু বলার অবকাশ হল না। দরকার হল না। দরজা ঠেলে লাবণ্য ঘরে ঢুকল।
রমেন চলে গেল।
লাবণ্যর আসার কারণ বোঝা গেল। কোনো রকম ভনিতা না করে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল, আপনি এই ছেলেটাকে প্রশ্রয় দেন কেন?
ধীরাপদ চেয়ারটা ঘুরিয়ে ঠিক করে নিল। শান্ত, সংযত।—কি প্রশ্রয় দিতে দেখলেন?
ও এখানে আসে কোন সাহসে? ওকে কারবারের ত্রিসীমানায় আসতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে!
মুখের দিকে সরাসরি চেয়ে এখন আর কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করে না ধীরাপদ। -ওকে বরখাস্ত করেও ওর ওপর আপনাদের রাগ যায়নি দেখছি। কেন?
কঠিন কিছু একটা বলার প্রস্তুতিই শুধু দেখা গেল, বলল না কিছু। তেমনি ধীরেসুস্থে ধীরাপদ আবার বলল, চুরি করলে মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে না আপনাকে কে বলল? রোজগারের পথ বন্ধ হয়েছে, ওর আসাই স্বাভাবিক!
কে বললে বন্ধ হয়েছে? রোজগারের অনেক পথ জানা আছে ওর, এখানে না এসে সেই চেষ্টা করতে বলুন গে।
তপ্ত জবাব ছুঁড়ে প্রস্থান করল। ধীরাপদর মনে হল লাবণ্যর অসহিষ্ণুতা একটু বেড়েছে। ছোট সাহেবের জোরে জোর বেড়েছে হয়ত। কাজে মন দিতে চেষ্টা করত, কিন্তু লাবণ্যর শেষের উক্তি বাধা সৃষ্টি করছে। ম্যানেজারের কথাগুলো মনে পড়ছে। ….ভগ্নিপতি সর্বেশ্বরবাবুটিকে মনে পড়ছে। রমেনের রোজগারের আর কি পথ জানা আছে?—ছিল হয়ত, এখন সে পথও বন্ধ।
কি ভেবে সেই বিকেলেই ধীরাপদ লাবণ্যর ভগ্নিপতির বাড়ি এসে হাজির। লাবণ্যর সঙ্গেই একদিন এসেছিল, আবার আসার জন্য ভদ্রলোক অনেক করে বলে দিয়েছিলেন। সেই বাড়ি, ঘর। দেয়ালের খোপে লাল গণেশমূর্তি, রেকাবিতে শুকনো বাতাসা। দেয়ালে কড়ি-গাঁথা গোবরছাপ। পুরনো বইয়ে ঠাসা তাক, সেগুলোর মাঝে মাঝে একটা দুটো চকচকে নতুন বই। সর্বেশ্বরবাবুর বড় মেয়ে তাকে বসিয়ে বাবাকে খবর দিতে গেল। ধীরাপদ আজও বেছে বেছে রমণী পণ্ডিতের বই কখানাই টেনে নিল। সেদিন ছিল একখানা, এখন আরো দুখানা চটি বই হয়েছে। এই বই দুখানারও সর্বস্বত্ব দে-বাবুর। বই অজস্র বিক্রি হলেও দে-বাবুর লেখকরা টাকার মুখ দেখেন না।
অপ্রত্যাশিত পায়ের ধুলো পড়তে সর্বেশ্বরবাবু আজও বিনয়ে গলে গলে পড়তে লাগলেন।—কম ভাগ্য তাঁর! মহৎ জন কথা দিয়ে গিয়েছিলেন আসবেন, সত্যিই এলেন–এ কি সোজা সৌভাগ্য। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, বাড়ি দেখে মনে পড়ে গেল? এও ভাগ্য ছাড়া আর কি! সেই সৌভাগ্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দশমুখে ঘোষণা করতে লাগলেন তিনি।-বসুন বসুন, না, এখানেই বা বসবেন কেন, একেবারে ভিতরেই চলুন, আপনি বাইরের ঘরে বসবেন কেন?
তার আগেই ধীরাপদ বসে পড়েছে। এখানেই ভালো লাগছে তার। কুশল প্রশ্ন বিনিময়ের পর সর্বেশ্বরবাবু ঘর ছেড়ে বেরুবার উদ্যোগ করতে ধীরাপদ বাধা দিল। ভয়ানক অসুস্থ সে, জলটুকুও মুখে দেবার উপায় নেই, সেজন্যে পীড়াপীড়ি করলে তাকে তক্ষুনি উঠতে হবে। ভদ্রলোকের ফরসা মুখ বিষণ্ণ হয়ে উঠল, সেদিনও ব্রাহ্মণ শুধুমুখে চলে গিয়েছিলেন, আজও তাই। সবই ভাগ্য, এত অসুস্থ যখন তিনি আর পীড়াপীড়ি করেন কি করে?
বই কটার দিকে চোখ পড়ল। — সঙ্গে সঙ্গে সলজ্জ উৎসাহ, আজও এইসব বই-ই বার করেছেন, আপনার নিশ্চয় চর্চা আছে কিছু! নেই? তাহলে পড়তে ভাল লাগে বুঝি? লাগবেই তো। ভদ্রলোকের লেখার ক্ষমতা আছে— জলের মতো তরল মনে হয় সব, পড়লেই বোঝা যায় মস্ত গুণী মানুষ। হঠাৎ দ্বিগুণ আগ্রহ, আচ্ছা, এই ভদ্রলোককে একবার পাওয়া যায় না? আমার কিছু ক্রিয়াকর্ম করানোর ছিল, নিজের আর ছেলেপুলের কুষ্টিগুলোও দেখাতাম…এসব লোক কারো বাড়ি-টাড়ি আসেন না, না?
বইয়ের দোকানে লিখুন।
লিখব কি, আমি নিজেই গিয়েছিলাম। তারা আরো একগাদা আজেবাজে বই গছালে কিন্তু ঠিকানা দিলে না। মহাপুরুষ ব্যক্তি… নিষেধ-টিষেধ আছে বোধহয়। ঠিকানা পেলেই তো লোক গিয়ে হামলা করবে।
ঠিকানা না পেয়ে ভদ্রলোকের শ্রদ্ধা আরো অনেক গুণ বেড়েছে, রমণী পণ্ডিতকে মহাপুরুষ ঠাওরেছেন। প্রয়োজনে দে-বাবুও মহাপুরুষ বানিয়ে থাকতে পারেন তাঁকে। অন্যান্য দু-পাঁচ কথার পর প্রশংসাটা ধীরাপদর দিকেই বাঁক নিল আবার। সত্যিই বড় খুশির দিন আজ সর্বেশ্বরবাবুর, তাঁর মহত্ত্ব আর বিচার-বিবেচনার কথা এত শুনেছেন যে দু কান ভরে আছে—
সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল ধীরাপদ, এটুকুই সুযোগের মত। হাসিমুখে তক্ষুনি বলল, কিন্তু এত সব যার মুখে শুনেছেন তার তো চাকরি গেল—
সর্বেশ্বরবাবু সচকিত। ঢোক গিললেন, তাই নাকি! ইয়ে, কেন? কেন?
আপনি কি ওর সম্বন্ধে লাবণ্য দেবীকে কিছু বলেছেন?
রমেনের সম্বন্ধে! না তো…ইয়ে, রাগের মাথায় অবশ্য একদিন দু-এক কথা বলে ফেলেছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস ছোঁড়াটা অনেক বানানো কথাও বলে—
আপনার কাছ থেকে এ পর্যন্ত টাকাও অনেক নিয়েছে বোধ হয়?
না…মানে, অনেক না। অভাবী ছেলে, মাঝে-মধ্যে দু-দশ টাকা এমনিই দিতুম। কিন্তু টাকার কথা তো লাবুকে আমি বলিনি!
ও নিজেই স্বীকার করেছে। ধীরাপদ গম্ভীর।
লাবুর কাছে? ভদ্রলোক আঁতকে উঠলেন।
না, আমার কাছে।
আপনি তাহলে দয়া করে এটা আর কাউকে বলবেন না। অভাবের সময় এসে হাত পাতলে কিছু না দিয়ে পারিনে, অথচ শুনলে কে কি ভাববে ঠিক নেই। চাকরি গেল কেন? কাজকর্ম কিছু করত না বুঝি?…ওই জন্যেই লাবু ক্ষেপেছে তাহলে, কাজে হেলাফেলা করলে তার কাছে মাপ নেই। আপনি দয়া করে তাকে টাকার কথাটা বলবেন না…বলবেন না তো? পাজী ছোকরা আপনার কাছে স্রেফ মিছে কথা বলেছে মশাই, অভাবে কেঁদে হাত পাততো তাই দিতুম, আর কিছুর জন্যে না— যাকগে, লাবুকে এসব কিছুই বলার দরকার নেই। বলবেন না, কেমন?
ধীরাপদ মাথা নাড়ল, বলবে না। হাসতে না পারলেও হাসিই পাচ্ছে এখন। নিরীহমুখে জিজ্ঞাসা করল, লাবণ্য দেবীকে বিলেত পাঠানোর কথা বলছিলেন সেদিন, তার কি হল?
কই আর হল! কিছুই হল না! সখেদে বড় নিঃশ্বাস ফেললেন একটা, তারপর কি মনে হতে ধীরাপদর হাত দুটো সাগ্রহে চেপে ধরলেন।— আপনি একটু চেষ্টা করে দেখবেন? কৌশলে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দেখুন না—আপনার অনেক ক্ষমতা, অনেক গুণ, আপনার সম্বন্ধে তো আর বাড়িয়ে বলেনি ছোঁড়াটা, দেবতার মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করে আপনাকে দেখেছি— করারই কথা, আপনি চেষ্টা করলে যেতে রাজী হতে পারে। কি হবে গোলামী করে? দুটো বছর ঘুরে এলে কত বড় ভবিষ্যৎ! আমি এতখানি করেছি, এখন গোলামী করতে দেখলে ভালো লাগে? যায় যদি আমি বিশ-তিরিশ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারি, আরো বেশিও পারি-
এই লোকের কাছ থেকে রমেন হালদার টাকা নেবে না তো আর কার কাছ থেকে নেবে? বাইরে এসে ধীরাপদর মনে হচ্ছিল, রমণীর পায়ে এমন আত্মনিবেদনের নজির আর দেখেনি। নিজে নাগাল না পাক, শ্যালিকাটি আর কারো নাগালের বাইরে গেলেও ভদ্রলোকের শান্তি।
পরদিন। অফিসে সেই থেকে চুপচাপ বসে আছে ধীরাপদ। তার সামনে দুটো জিনিস।
একটা রমেন হালদারের চিঠি।
চিঠি ডাকে এসেছে। রমেন লিখেছে, দাদা তাকে তাড়িয়ে দেবেন জেনেও এসেছিল। তার যোগ্যশাস্তি হয়েছে। নিজের অদৃষ্টে কি আছে সে জানে, কিন্তু তার অপরাধে নিরপরাধ কাঞ্চনকে কেন শাস্তি দেওয়া হবে? তার কোনো দোষ নেই। দাদা দেবতার মত, একবার তাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন, বিনা দোষে আবার যেন তাকে সেই ঘৃণ্য মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দেন। এই কথা বলতেই সে দাদার কাছে এসেছিল, আর দাদার এই দয়াটুকু ভিক্ষে চেয়েই সে চিঠি লিখছে।
সেদিন ওই মেয়েটা তার দু’পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছিল, রমেনের কোনো দোষ নেই, তাকে নিয়ে দোকান করার লোভে ফাঁদে পা দিয়েছে, সব দোষ তার—তার যা হয় হবে, দাদা যেন ওকে বাঁচান। কেন কেন কেন? কেন এমন হয়? চোরের বুকে আর দেহজীবিনীর বুকের মধ্যেও এ কোন বস্তুর কারিগরী? কোন দুর্নিরীক্ষ্য অবুঝের খেলা?
দ্বিতীয় জিনিসটা ম্যানেজারের মতামতসহ কাঞ্চনের ফাইল।
ধীরাপদর বিবেচনার জন্য এটা পাশের ঘর থেকে এসেছে। কেন এসেছে অনুমান করা কঠিন নয়। কাঞ্চনের নিয়োগের ব্যাপারে অমিতাভ ঘোষের ইচ্ছের জোর ছিল। বরখাস্তটা সিতাংশুর হাত দিয়ে হলেও তাতে লাবণ্যর হাত আছে ভাবতে পারে সে। অতএব ধীরাপদ রাখতে ইচ্ছে হলে রাখুক, বিদায় দিতে হলে বিদায় দিক।
বিকেলের দিকে ফাইলটা টেনে ধীরাপদ নিয়ে খসখস করে বরখাস্তের নির্দেশই দিল। তারপর রমেনের ফাইল তলব করে তার বাড়ির ঠিকানা নোট করে পকেটে রাখল।
দেরি করতে ভরসা হয় না। আজকালকার ছেলেদের বিশ্বাস নেই কিছু। ঠিকানা মিলিয়ে যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা একটা বস্তিঘর। রমেন বাড়িতেই ছিল। আর তাকে দেখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ধীরাপদ যা বলার পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে বলে এসেছে। রমেন হাঁ করে শুনেছে, তারপর দু গাল বেয়ে ধারা নেমেছে। কিন্তু তখনো নড়তে পারেনি সে, তখনো স্বপ্ন দেখছে যেন। স্বপ্নের কথা শুনছে যেন।
সমস্ত নিষ্ক্রিয়তা ঝেড়ে ফেলে ধীরাপদ আবার কাজে মন দিয়েছে। কর্মচারীদের অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বাড়ছিল। বড় সাহেবের বিগত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের প্রাপ্যের একটা বড় অংশ বাকি বলে তারা ক্ষুব্ধ। তা ছাড়া যে সব সুবিধে তাদের দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, তারও কোনরকম লক্ষণ দেখছে না, তোড়জোড় দেখছে না। ধীরাপদ এইসব ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করতে এলো সিতাংশুর সঙ্গে। সিতাংশু দু কথায় ফিরিয়ে দিল তাকে, কোম্পানীর এখন অনেক খরচ অনেক ঝামেলা-এখন এসব ভাবার সময় নয়।
অতএব ধীরাপদ সব কাজ ফেলে কোম্পানীর আয়বায়ের নথিপত্রের মধ্যে ডুবে রইল দিনকতক। তারপর আবার এলো।
বক্তব্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোম্পানী স্বচ্ছন্দে কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দিতে পারে। আর ঘোষণা অনুযায়ী নতুন ব্যবস্থাও কিছুটা এগোনো যেতে পারে। হিসেবের ফাইলটা তার সামনে রাখল।
ওটা আবার ঠেলে দিয়ে সিতাংশু রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠল, এসব নিয়ে আপনাকে এখন কে মাথা ঘামাতে বলেছে?
আপনার বাবা। আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে যতটা করা সম্ভব করতে বলে গেছেন।
কিন্তু আমি আপনাকে বলেছি কিছু করতে হবে না, এখন কিছু হবে না।
ধীরাপদ ফাইলটা হাতে তুলে নিল, লাবণ্যর দিকে ফিরল তারপর।— আপনারও তাই মত বোধহয়? তিনি আপনার সঙ্গেও পরামর্শ করতে বলেছিলেন।
লাবণ্য জবাব দিল না। সিতাংশুর দিকে চেয়ে মনে হল, চূড়ান্ত কিছু একটা জবাব এবারে সে-ই দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুখে কিছু বলল না।
ধীরাপদ বলল, তাহলে আপাতত আমি চলি। আপনার বাবা ফিরে আসুন। তাঁরও আর আমাকে দরকার আছে কিনা একবার এসে জেনে যাব।
সিতাংশু হকচকিয়ে গেল, কিছুটা লাবণ্যও। ধীরাপদ দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে দরজার দিকে পা বাড়ালো। সিতাংশু বাধা দিল, তার মানে আপনি এতদিন আর আসবেন না?
ধীরাপদ ঘুরে দাঁড়াল, বলল, তার মানে তাই।
নিজের ঘরে এসে বসল। চেয়ার-টেবিলময় ঘরটাসুদ্ধ ঘুরছে চোখের সামনে। এই জবাব দিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হয়ে ও ঘরে ঢোকেনি। কর্মচারীদের এর পর ছোট সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দেবে, সে এসব ব্যাপারে থাকবে না—এই কথাটাই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে আসবে স্থির করেছিল। লাবণ্য ঘরে না থাকলে হয়ত সেই কথাই বলে আসত। কিন্তু সব কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেল। যে কথা মনেও আসেনি সেই কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
হিসেবের ফাইলটা অ্যাকাউনটেন্ট-এর জিম্মায় রেখে এলো। শুধু তাঁকেই জানিয়েছে কিছুদিন সে হয়ত আর আসবে না— দরকারী কাগজপত্র সব যেন ছোট সাহেবের কাছে পাঠানো হয়।
রাস্তা। বছর কতক আগেও এই রাস্তাই সম্বল ছিল। কিন্তু বুকের ভিতর আজ একটা শূন্যতা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে, আগে তা উঠত না। এবারে কি করবে? সুলতান কুঠিতে ফিরবে? হিমাংশুবাবুর বাড়িতে এর পর থাকা চলে না। কিন্তু সুলতান কুঠিতে ফেরার চিন্তাটাও বাতিল করে দিল। সেখানেও নয়, আর কোনোখানে। যেখানে তাকে নিয়ে কারো কোনো কৌতূহল নেই, কারো আগ্রহ নেই। হাতে টাকা থাকলে এরকম জায়গা অনেক মিলবে। কত টাকা আছে ব্যাঙ্কে? ঠিক মনে করতে পারছে না কত আছে। দিনকয়েক হল এক ধাক্কায় হাজার তিনেক কমেছে, হঠাৎ হাসি পেল, রমেন আর কাঞ্চনের সঙ্গে গিয়েই যোগ দেবে নাকি?
মন্দ টাকা থাকার কথা নয় এখনো, কিছুকাল নিশ্চিন্তে চলে যাবার কথা। তারপর দেখা যাবে। ধীরাপদ নিশ্চিন্ত বোধ করতে চেষ্টা করছে। একটা ট্যাক্সি নিয়েই বাড়ি ঢুকল। আদেশ অনুযায়ী হতভম্ব মানকে ট্যাক্সিতে তার জিনিসপত্র তুলে দিল। একটু ফাঁক পেলেই ছুটে গিয়ে সে বউরাণীকে খবরটা দিয়ে আসত। কিন্তু সেই ফাঁক ধীরাপদ তাকে দিল না। ট্যাক্সিতে উঠে তাকে জানালো, বউরাণীকে যেন বলে দেয়, আপাতত তার এখানে থাকার সুবিধে হল না।
না, চারুদির বাড়িতেও নয়, খুব একটা সাধারণ মেসে এসে উঠল। সেখানেই কাটল দিনকতক। মনে মনে মাঝের এই ক’টা বছর স্বপ্ন বলে ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু তবু থেকে থেকে মনে হল, স্বপ্নটা বড় তুচ্ছ কারণে ভেঙে গেছে। অফুরম্ভ সময়, দিনরাতের চব্বিশ ঘণ্টাই নিজের দখলে। আগে যেমন ছিল। অথচ এই অবকাশ দুঃসহ বোঝার মত বুকের ওপর চেপে বসছে।
কার্জন পার্কের সেই পরিচিত বেঞ্চটায় এসে বসল সেদিন। কিন্তু সেই ধীরাপদ বদলে গেছে। বসে বসে কালের কাণ্ড দেখার সেই চোখ গেছে, মন গেছে। দূরের প্রাসাদলগ্ন বড় ঘড়িটা তেমনি চলছে, কিন্তু ধীরাপদর মনে হচ্ছে থেমে আছে। বেশিক্ষণ বসা গেল না, উঠে পড়ল। চৌরঙ্গীর দিকেও চোখ পড়ছে না, অথচ এই চৌরঙ্গীর দিকে চেয়ে চেয়ে কতদিন কত কি আবিষ্কার করেছে সে।
অম্বিকা কবিরাজের দোকান। তেমনি আছে বোধ হয়, কিন্তু ধীরাপদর চোখে আরো নিষ্প্রভ লাগছে। কবিরাজ মশাইও আরো বুড়িয়ে গেছেন। তাকে দেখে খুশি। সত্যিকারের বড় যে, বড় হয়েও পুরনো সম্পর্কের মায়া শুধু সে-ই ছাড়তে পারে না—বলে মন্তব্য করলেন। বিকৃত আনন্দে একসময় রমণী পণ্ডিতের কথা তুললেন, বললেন, তার মাথার ঠিক আছে, সেই সব ওষুধের জন্যে হাতে পায়ে ধরছে মশাই —তার মেয়েটাকে কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কাগজে পড়েছেন তো?
ধীরাপদকে দেখে আরো বেশি খুশি নতুন পুরনো বইয়ের দোকানের মালিক দে-বাবু। চা না খাইয়ে ছাড়লেন না, বড় হয়েও পুরনো সম্পর্ক ধীরাপদ ভোলেনি —তিনিই কি ভুলেছেন। তাঁর অবস্থা আগের থেকে আরো ফিরেছে মনে হল।—আপনি এখন হাজার দুই পাচ্ছেন মাসে, না? পণ্ডিত সেই রকমই বলছিল একদিন। দে-বাবু ধীরাপদকে আপ্যায়ন করেননি, দু-হাজারওলাকে আপ্যায়ন করেছেন। তিনিও শেষে রমণী পণ্ডিতের কথাই তুলেছেন, বই ক-টা তো মন্দ কাটছিল না তার, কিন্তু আর লিখবে কি; অন্যকে আশা-ভরসাই বা কি দেবে—নিজেই খাঁচা কলে পড়ে গেছে কাজকর্মের নাম নেই, কেবল হাত পেতেই আছে, টাকা দাও আর টাকা দাও— আচ্ছা লোক ঠেকিয়ে দিয়ে গেছেন মসাই!
না, সংস্থানের জন্য আবার যদি পথে পথে ঘুরতেও হয়, এই দুই দোকানের কাছ দিয়ে অন্তত ধীরাপদর আর ঘেঁষা চলবে না। সুলতান কুঠির দিকে চলল। ওদিকের খবর কিছু আছে কিনা জানে না। গণুদার সেসানের কেস চলছে পুরোদমে। তাছাড়া কেন কে জানে রমণী পণ্ডিতের সঙ্গেও একবার দেখা হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে হচ্ছে।
দেখা হল। মজা-পুকুরের ধারে কুঠিবাসীদের চোখের আড়ালে একদিন গণুদা যেখানে বসেছিল, রমণী পণ্ডিত সেখানে একা বসে। ধীরাপদকে দেখে বিড়বিড় করে কুশল প্রশ্ন করলেন। নিষ্প্রভ কোটরগত দুই চোখে মৃত্যু-ছোঁয়া হতাশার ছায়া দেখল ধীরাপদ। আগেও দেখেছে, কিন্তু এই মন দিয়ে দেখেনি হয়ত। রমণী পণ্ডিত কেসের খবর দিলেন—নতুন খবর কিছু নেই, একভাবেই চলছে। তারপর সখেদে বললেন, মেয়েটা যদি আঁতুড়ে মরত ধীরুবাবু-
ধীরাপদ চেয়ে চেয়ে দেখছে তাঁকে। যা হতে পারত তা দেখছে না, যা হয়েছে তাই দেখছে। তাঁর ছেলের থেকে মেয়ে বড়, তাই ওই মেয়েকে দিয়েই একদিন অনেক আশা করেছিলেন ভদ্রলোক।
ধীরাপদ দেখছে। সোনাবউদির চাল পাঠানোর কথা শুনে ভিতরে মুহূর্তের জন্যে একটু নাড়া পড়েছিল, তারপর আবার তেমনি ঠাণ্ডা, প্রায় নির্লিপ্ত। কালের কাণ্ড দেখতে বসে অনুভূতির বন্যায় নিজে ভাসলে দেখায় ফাঁক থেকে যায়।
হাত ছেড়ে দিয়ে রমণী পণ্ডিত দৃষ্টি ফেরালেন, মজা পুকুরের দিকে চেয়ে রইলেন ধীরাপদ দেখছে, ওই মজা পুকুরটার সঙ্গে ভদ্রলোকের বেশ মিল। কিন্তু তেমন করে ছেঁচতে পারলে ওটা তো আবার নতুন জলে টলমল করে উঠতে পারে, এঁর কি সেই আশাও নেই?
তেমনি নিরাসক্ত মুখে ধীরাপদ আশাই দিল। আর ঘণ্টাখানেক লেগেছে এই আশার বারতা সম্পূর্ণ করতে। তারপর যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যেই রমণী পণ্ডিতের নিষ্প্রভ দুই চোখের জরা সরে গেছে, হতাশা সরে গেছে —জীবনের আলো চিকচিকিয়ে উঠেছে। পিঁজরাবদ্ধ পশু হঠাৎ মুক্তির হদিস পেলে যেভাবে থমকে তাকায়, তার সঙ্গে মেলে এই চাউনিটা।
ধীরাপদ সুলতান কুঠির দিকে চলেছে। কোনো ন্যায়-অন্যায় বোধ তাকে উতলা করছে না। যতটুকু মিয়াদ এই জীবনের ততটুকু বাঁচতে হবে, এর মধ্যে ন্যায়-অন্যায় কি? প্রতি মুহূর্তে বাঁচার নিঃশ্বাসে কত শত জীবাণু মরছে-ন্যায়-অন্যায় দেখছে কে? লোভ কামনা বাসনার ওপর তো দুনিয়া চলছে, ওই আলেয়া কাকে না টানছে? এরই থেকে রমণী পণ্ডিত যদি জীবনের রসদ সংগ্রহ করতে পারে করুক, ক্ষতি কি? একভাবে না একভাবে সবাই তাই করছে। লাবণ্য সরকারের ভগ্নিপতির অনেক টাকা, লোভের ইন্ধন যোগাতে পারলে অনায়াসে তিরিশ পঁয়তিরিশ হাজার পর্যন্ত খরচ করতে পারেন। দৈবানুকুল্যের আশায় এই রমণী পণ্ডিতের মতই একজন মহাপুরুষকে খুঁজছেন তিনি। একটু আগে পণ্ডিত জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই বয়সে আর কোন রাস্তায় যাবেন তিনি? ধীরাপদ যে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে সেটা লাবণ্য সরকারের ভগ্নিপতি সর্বেশ্বরবাবুর বাড়ির ঠিকানায় এসে থেমেছে। এখন মহাপুরুষের হাতযশ। ধীরাপদর ন্যায়-অন্যায় ভাবার দরকার নেই।
আজও ছেলেমেয়েরা নয়, সোনাবউদিই ঘরে এলো। দু-এক পলক নিরীক্ষণ করে দেখল তাকে। ফিরে ধীরাপদও। সোনাবউদির মুখ কালচে দেখাচ্ছে, চোখের কোলে কালি ভেসে উঠেছে।
আপনি আজকাল কোথায় আছেন?
ধীরাপদ অবাক, তার ওদিকের কোনো আভাস সুলতান কুঠিতে পৌঁচেছে ভাবেনি। সত্যি জবাবই দিল। —একটা মেসে।
কেন?
নিরুত্তর। একটু থেমে সোনাবউদি ঠাণ্ডা সুরে সংবাদ দিল, গত কয়েকদিনের মধ্যে অনেকে তার খোঁজ করে গেছে, কারা এসেছে একে একে তাও জানালো। প্রথমে এসেছেন আপনি যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির ছেলের বউ, নাম বললেন আরতি। একজন লোকের সঙ্গে গাড়িতে এসেছিলেন। আপনি এখানে এলেই আপনাকে অবশ্য একবার পাঠিয়ে দিতে বলে গেছেন। তিনি আট দিন আগে এসেছিলেন।
ধীরাপদ অবাক। ….আরতি এসেছিল, কেয়ার-টেক্ বাবুকে সঙ্গে করে নিশ্চয়। কিন্তু আশ্চর্য…
দিনকয়েক আগে এসেছিলেন লাবণ্য সরকার। আপনি এখানে থাকেন না, তিনি ভাবেননি। বলার পরেও বিশ্বাস করেছেন কিনা জানি না। তাঁর ধারণা, আমি আপনাকে বললে আপনি কারখানায় ফিরে যাবেন। বলার জন্যে অনুরোধ করে গেছেন।
ধীরাপদ নির্বাক। সোনাবউদি আবারও থামল একটু, তেমনি ভাবলেশশূন্য।
চার দিন আগে আপনার দিদি আপনার খোঁজে ড্রাইভার আর গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। পরশু দিন অমিতাভ ঘোষ এসেছিলেন। তিনি কিছু বলে যাননি।
ধীরাপদ হতভম্বের মত বসে। এতগুলো সম্ভাবনা স্বপ্নের অগোচর ছিল। চারুদি খবর পেলেন কি করে জানে না। অমিতাভর আসাটা আরো অবাক হবার মত। তার একবারের অসুখে সবাই যখন ছোটাছুটি করে এসেছিল, তখন একমাত্র সে-ই আসেনি।
সংবাদ দেওয়া শেষ করে সোনাবউদি চুপচাপ চেয়ে ছিল তার দিকে। মুখ তুলে ধীরাপদ হাসতে চেষ্টা করল একটু।
আপনি কি কাজ ছেড়ে দিয়েছেন নাকি?
ধীরাপদ মাথা নাড়ল। কিন্তু তাও খুব স্পষ্ট করে নয়। অর্থাৎ ঠিক ছাড়েনি।
সোনাবউদি আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না, এখানে না এসে মেসে আছে কেন তাও না।
সুলতান কুঠি থেকে সোজা হিমাংশুবাবুর বাড়ি চলে আসতে ধীরাপদ আর একটুও দ্বিধা বা সঙ্কোচ বোধ করেনি। আজকের দিনটা ছাড়লে ঠিক এগারো দিন আগে এই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সে। প্রথমেই মানকের মুখোমুখি। বিস্ময় আর কৌতূহলের ধাক্কা সামলে চট করে সুমুখ থেকে সরে গেল সে। বাধা পড়ার আগেই তাড়াতাড়ি বউরাণীকে খবর দিতে ছুটল হয়ত। ধীরাপদ নিচের ঘরে এসে বসতে না বসতে ফিরে এলো। তার হাতে খাম একটা। বিলেতের খাম।
বউরাণী দিলেন—
খাম হাতে নেবার আগেই ধীরাপদ অনুমান করেছে বড় সাহেবের চিঠি। খুলে পড়ল। না, সে কারখানায় যাচ্ছে না বা এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে খবর পাননি। এই চিঠিতে অন্তত তার কোন আভাস নেই। কিন্তু চিঠিখানা প্রচ্ছন্ন অনুযোগে ভরা। ছেলের চিঠিতে জেনেছেন, কারখানার প্রায় সকল ব্যাপারে তার আম্ভরিক সহযোগিতার অভাব। ছেলের প্রতি তার বিরূপ মনোভাবের দরুন তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, ছেলেকে তিনি একরকম পাকাপাকিভাবেই তাঁর জায়গায় বসিয়ে এসেছেন, তার সঙ্গে মতের মিল বা মনের মিল না হলে চলবে কেন? লিখেছেন, ধীরাপদর ওপর তাঁর অনেক আস্থা অনেক নির্ভর, ছেলেরও সে ডান হাত হয়ে উঠবে এই আশা তাঁর। মতের অমিল যদি কিছু হয়ও সেটা যেন কোনরকম মনোমালিন্যের হেতু হয়ে না দাঁড়ায়—অন্তত তিনি ফেরা পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করা হয়।
ভিতরটা জ্বালা-জ্বালা করছিল ধীরাপদর। ছেলের প্রতি বাৎসল্য স্বাভাবিক কিন্তু সেটা উজিয়ে উঠে অতি বিশ্বস্তজনকেও যখন সংশয়ের চোখে দেখতে শেখায়, তখন এমনিই জ্বলে বোধ হয়। সিতাংশু কি লিখেছে তার বাবাকে জানে না, যাই লিখুক, ধীরাপদর কর্তব্যের দিকটাই বড় সাহেবকে বড় করে ভাবার দরকার হয়েছে। ভেবে এই চিঠি লিখেছেন। মোলায়েম মিষ্টি অক্ষরগুলোর মধ্য দিয়ে ধীরাপদ নিজের কর্মক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ চিত্রটা দেখতে পাচ্ছে।
চকিত উঠে দাঁড়াল, মানকের বউরাণী আরতি আসছে। বাইরে যাতায়াতের প্রয়োজন ছাড়া-এ পর্যন্ত কখনো নিচে নামতে দেখা যায়নি তাকে। মাথায় ছোট ঘোমটা, নম্র পদক্ষেপ, অথচ আসার মধ্যে একটুও জড়তা নেই।
আমাকে ডাকলেই তো হত—
আমার আসতে অসুবিধে কি…। মৃদু জবাব, আপনি আমাকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন?
ধীরাপদ বিব্রত বোধ করল, এ বাড়ি থেকে যেতে হলে তাকে জানিয়ে যাওয়া দরকার সে আভাস দেয়নি—বিস্ময়টুকু মিষ্টি দাবির মত শোনালো।
আরতি একবার এদিক-ওদিক তাকালো, তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনার জিনিষপত্র কোথায়?
জবাব না দিয়ে ধীরাপদ এবারও বিব্রতমুখে হাসল শুধু। এই মেয়েটিকে অদ্ভুত ছোট ভাইয়ের বউয়ের মত ভাবতে ইচ্ছে করে।
দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আরতি নির্দ্বিধায় বলল, শ্বশুরমশাই যাবার আগে আপনার কথাই বার বার বলে গেছেন। কোন রকম অসুবিধে হলে, কোন কিছু দরকার হলে তক্ষুনি যেন আপনাকে জানাই—আপনি থাকলে কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই।… কিছু না বলে আপনি এভাবে চলে যেতে পারেন আমি ভাবিনি।
চুপ করে থাকা ছাড়া ধীরাপদ এবারেও কিই বা বলতে পারে? এভাবে কেউ অনুযোগ করতে পারে জানলে যেত না হয়ত। অন্তত না বলে যেত না নিশ্চয়। কিন্তু এও মুখ ফুটে বলার কথা নয়।
যেতে যদি হয় তিনি ফিরে এলে যাবেন। মিষ্টি মুখখানা গম্ভীরই দেখাচ্ছে এখন, বলল, তখন আমারও কিছু চিন্তা করার আছে। তিনি ফিরে আসার পরেও কি হয় আমি সেই দেখার অপেক্ষায় আছি। আপনার জিনিসপত্র নিয়ে আসুন।
সেদিনের মত আজও এই নিঃসঙ্কোচ ঋজু স্পষ্টভাটুকুই ধারাপদকে অভিভূত করেছে। মেসে জবাব দিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত তখন। কিন্তু ফিরে নিজের ঘরে ঢোকা হল না, জিনিসপত্র মানকের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে পায়ে পায়ে ডাইনের বড় হল-এর দিকে এগোলো। অমিতাভ ঘরে আছে, তার ঘরে আলো জ্বলছে।
হ্যালো হ্যালো হ্যালো গ্রেট ম্যান! ভিতরে আসুন, আমি তো আপনার অপেক্ষাতেই দিন গুনছি।
ধীরাপদ ভিতরে এসে দাঁড়াল। এত উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক লাগছে না খুব। একটানা অনিয়মে চোখ-মুখ শুকনো অথচ কি এক অশান্ত উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল করছে। চেয়ারটা খাটের সামনে টেনে নিয়ে বসতে গিয়ে ছোটখাটো ধাক্কা খেল একটা। অবিন্যস্ত শয্যায় ছড়ানো কাগজপত্রের মধ্যে সেই ফোটো অ্যালবাম।…এই উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনার উৎস কি তাহলে ওটাই? ফোটো থেকে আগের পার্বতীকে আবিষ্কার করেছিল বসে বসে? তারপর? আপনার আদর্শের ভরাডুবি হয়েছে? নাও হ্যাভ ইউ রিয়ালাইজড—কি করতে পারবেন আর কি করতে পারবেন না?
ধীরাপদ চুপচাপ দেখছে তাকে। এত কাছ থেকে এত ভালো করে শিগগীর দেখার সুযোগ হয়নি। খুশির ছটায় ধীরাপদ কিছুটা বিভ্রান্ত। উতলাও। এই খুশির তলায় তলায় গনগনিয়ে জ্বলছে কিছু।
-কিন্তু আমাকে না বলে সব ছেড়েছুড়ে আপনি পালিয়েছিলেন কেন? হোয়াই ডিড ইউ লীভ? ওদের মুখে রাজভোগ তুলে দিয়ে এইভাবে যাব আমরা ভেবেছেন? যখন যাব সব ঝাঁজরা করে দিয়ে যাব—বাট ওয়েট, সময় আসুক। একগোছা টাইপ- করা কাগজ তার মুখের সামনে নেড়ে দিল, অ্যাটর্নির নোটিস – সব তছনছ করে পাইপয়সা অবধি বুঝে নেব—তারপর আরো আছে, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ—
জোরেই হেসে উঠল। ধীরাপদ ভাবছে, কদিন ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া হয়নি লোকটার? ক’রাত ঘুমোয়নি? কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে গেলে বিপরীত হবে। কাগজের গোছার দিকে হাত বাড়াতে হাসি থামিয়ে অমিতাভ ছদ্মগাম্ভীর্যে ভুরু কোঁচকালো। আপনাকে বিশ্বাস কি?
আপনাকে আর কিছু না হোক এই একজনের বিশ্বাসটুকু যে ষোল আনা লাভ হয়েছে, ধীরাপদর ভাতে একটুও সন্দেহ নেই। বিশ্বাস অমিতাভ তাকে আগেও করত, কিন্তু এত করত কিনা সন্দেহ। এই নবলব্ধ বিশ্বাসের জোয়ারে ভেসেই সে তার খোঁজে সুলতান কুঠি পর্যন্ত হানা দিয়ে এসেছে। কারখানার সংস্রব ছেড়ে ছুড়ে ডুব দিয়েছিল বলে চোখ রাঙালেও মনে মনে তার মত অত খুশি আর বোধ হয় কেউ হয়নি, সেটা তার প্রথম অভ্যর্থনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করা গেছে। তার চোখে সে এখন স্বার্থের কষ্টিপাথরে যাচাই করা জোরালো রকমের খাঁটি মানুষ একটা।
হাত গুটিয়ে নিয়ে নিস্পৃহ গাম্ভীর্যে ধীরাপদ জবাব দিল, বিশ্বাস করার জন্যে কে আপনাকে সাধছে?
অমিতাভ খলখলিয়ে হেসে উঠল আবারও। এ্যাটর্নির কাগজের গোছা একধারে ঠেলে দিয়ে অ্যালবামটা টেনে নিল।—এসব উকীলের কচকচি কি বুঝবেন, তার থেকে এটা দেখুন; দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ—
কিছু না বুঝে অ্যালবামের মলাট উল্টে ধীরাপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ঘরে দুটো অ্যালবাম দেখেছিল, এটা অন্যটা। পার্বতীরমণীর যৌবন ধরা সেই অ্যালবামটা, নয়। কিন্তু এও অবাক ব্যাপার, এত সব কি এতে—কিছুই বোধগম্য হল না চট করে। নানারকম অ্যাকাউন্টের কপি বা ফোটো কপি, আর ফ্যাক্টরীর কর্মরত পরিবেশের ছবি। কোম্পানীর অ্যাকাউন্টে ডাইরেক্টরদের অর্থাৎ হিমাংশু মিত্রের আর সিতাংশু মিত্রের পারসোন্যাল ড্রইংস, ব্যক্তিগত প্রচারের খাতে স্ফীতকায় ব্যয়ের অঙ্ক, লাবণ্য সরকারের ফ্রী কোয়ার্টারের খাতে বছরে কত টাকা ব্যয় হয়, কত টাকার ওষুধ যায়, সেখানকার বেডে কত রোগী আসে ইত্যাদির হিসেব, গত বার্ষিকী উৎসবে প্রতিশ্রুতি এবং প্রাপ্তির খসড়া, এমনকি পাকা চাকুরে রমেন হালদারের বরখাস্তের কপি পর্যন্ত আছে ওতে। ছবিগুলো আরো দুর্বোধ্য। কর্মচারীদের ওষুধভরতি শিশির লেবেল তোলা আর লেবেল আঁটার ছবি অনেকগুলো। আরো খানিক খুঁটিয়ে দেখে ধীরাপদ হতভম্ব। ওষুধভরতি লেবেল তোলা শিশিতে নতুন লেবেল আঁটা হচ্ছে বোঝা যায়। একটা বড় রকমের ধাক্কা খেয়ে ধীরাপদ সচকিত হয়ে উঠল। হৈ-চৈ করে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মুখে দুর্নামের কালি মাখাতে হলে আগের নজিরগুলো ফেলনা নয়, কিন্তু এই ব্যাপারটা বিপজ্জনক।
তার দিকে চেয়ে অমিতাভ হাসছে। চশমার পুরু লেন্সের ভিতর দিয়ে সেই হাসির আভা তার মুখের ওপর পড়ছে।
এ কি কাণ্ড?
কেন, কিছু নয় মনে হচ্ছে? অমিতাভ ঘোষ চাপা আনন্দে ভরপুর।
কিন্তু এসব কি পাগলামি করতে যাচ্ছেন আপনি?
কী? হাসি মিলিয়ে গিয়ে ফরসা মুখ লাল হল মুহূর্তের মধ্যে। এতটা বিশ্বাসের যোগ্য কি না এখন তাই আবার খুঁটিয়ে দেখছে। ধীরাপদর মুখটা চোখের ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে দেখছে। কণ্ঠস্বরেও চাপা আগুন ঝরল, বলল, এ যেন আর কেউ জানতে না পারে।
চালে ভুল হয়ে গেল ধীরাপদরও মনে হয়েছে। কিন্তু এক্ষুনি এই ভুল শুধরে দ্বিগুণ বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠার অস্ত্র আছে তার হাতে। সেই অস্ত্র লোকটার হাতে ভুলে দেবে কি না চকিতে ভেবে নিল। হিমাংশু মিত্রের চিঠিখানা অন্তস্থলে নতুন করে জ্বালা ছড়ালো একপ্রস্থ…কর্মক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ চিত্রটাও তে দেখা হয়ে গেছে। অঘটন ঘটেই যদি জোরালো রকমই ঘটুক না। ভাঙন যদি ধরেই, হুড়মুড়িয়েই ভাঙবে না হয় সব। কিন্তু এই লোকের বিশ্বাসের ওপর পুরোপুরি দখল নেওয়াই দরকার। হয়ত বা তাতে করে ভাঙন রোধ করাও যেতে পারে। লোকটাকে বশে আনতে পারলে হয়ত বা আরো অনেক কিছু হতে পারে।…চারুদি ছেলে পেতে পারে, পার্বতী আরো বেশী কিছু পেতে পারে, আর গ্লানিমুক্ত বাতাসে একটা শিশুর আবির্ভাব ঘটতে পারে। অমিতাভকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ধীরাপদর কারখানার গোলযোগের কথা একবারও মনে হয়নি, জীবনের এই পথে তাকে ফেরানো যায় কি না সেই কথাই শুধু মনে হয়েছে।
বলল, আমাকে বিশ্বাস কি, দেখবেন কালই হয়ত জানাজানি হয়ে গেছে।
পরিহাস বুঝেও অমিতাভর চোখের ধার নরম হল না, এসব ব্যাপারে ঠাট্টাও বরদাস্ত হবার নয়।
ধীরাপদ নির্লিপ্ত মুখে আবার বলল, আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কোনরকম গণ্ডগোল বাধিয়ে বসবেন না যদি কথা দেন, তাহলে হয়ত ছবি তোলার আরো দু-একটা সাবজেক্ট আমি বলতে পারি—
এই এক কথা শুনেই ভিন্ন মানুষ আবার। চোখে-মুখে উৎসুক আগ্রহ। — কী?
কথা দিচ্ছেন?
আঃ, বলুন না! আমি এক্ষুনি কিছু করতে যাচ্ছি না, করলে আর কেউ না জানুক আপনি জানবেন।
ধীরাপদ নিশ্চিত্ত যেন। বলল, অনেক বড় বড় ব্যবসাতে ট্যাক্সের গণ্ডগোল এড়ানোর জন্যে অনেকরকম ব্যবস্থা থাকে শুনেছি, আমাদেরও আছে কিনা খোঁজ করে দেখতে পারেন।
শোনা মাত্র নড়েচড়ে বসল অমিতাভ ঘোষ, এমন একটা জানা ব্যাপার মনেও পড়েনি, আশ্চর্য! নীরব প্রশংসার বন্যায় ধীরাপদকে চান করিয়ে দিল যেন, তারপর জিজ্ঞাসা করল, আর কি?
আর, কোনো কোনো বড় কারখানার অনেক ফিকটিশাস লেবারও থাকে শুনেছি, যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই—আমাদের এখানে সপ্তাহে কত লোক টিপসই দিয়ে মজুরি নিয়ে যাচ্ছে আর সত্যি সত্যি কত লোক আছে একবার খোঁজ করে দেখলে পারেন। মনে হয়, লোকের থেকে টিপসইয়ের সংখ্যা দিন-কে-দিন বাড়ছে।
অমিতাভ ঘোষ লাফিয়ে উঠল একেবারে। এও বলতে গেলে জানা ব্যাপারই, অথচ সময়ে মনে পড়েনি। হিংস্র আনন্দে গোটা মুখ উদ্ভাসিত। তার কাঁধ ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিল গোটাকয়েক, আপনি সাঙ্ঘাতিক লোক, আমারই মনে পড়া উচিত ছিল —ইউ আর ওয়ান্ডারফুল, সিম্পলি ওয়ান্ডারফুল!
ধীরাপদ গম্ভীর, বসুন, আরো কথা আছে—
অমিতাভ তক্ষুনি বসে পড়ল আবার। উন্মুখ প্রতীক্ষা। আঘাত যদি দিতেই হয় এটাই সুসময় ধীরাপদর কাছে—এই উদ্ভ্রান্ত উত্তেজনার মুখেই। সহজ মুখেই বলল, আপনি পার্বতীর সম্বন্ধে চিন্তা কি করছেন?
আচমকা এই বিপরীত ধাক্কার প্রতিক্রিয়া যেমন হবে ভেবেছিল তেমনই হল। বিস্মিত, বিভ্রান্ত। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
তার কোলে ছেলে আসছে। আপনার ছেলে।
একনজর তাকিয়েই বোঝা গেল খবরটা এই প্রথম শুনল। এমন বিমূঢ় হতচেতন মূর্তি আর দেখেনি। কিন্তু অস্ত্রোপচারে বসে চিকিৎসকের মায়া করতে গেলে চলে না। ধীরাপদও সেই গোছের নির্মম। বলল, চারুদি আপনাকে চান, কিন্তু এইভাবে এই ব্যাপারটা চান না। ফলে ওই মেয়েটাকেই মুখ বুজে সব গঞ্জনা ভোগ করতে হচ্ছে—
অমিতাভর চাউনিটা ধারালো হয়ে উঠেছে একটু একটু করে। উক্তির মধ্যে আতিশয্য বা ছলচাতুরীর আভাস আছে কিনা দেখছে। ছাড়া পশুকে খাঁচার দিকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে বুঝতে পারলে সে যেভাবে তাকায় তেমনি চেয়ে আছে।
আর একজনের, বিশেষ করে, এই একজনের অনুভূতি-বিপর্যয় ঘটাতে হলে যতটা দরকার ততটাই ধীর শান্ত ধীরাপদ। বলল, আপনার মাথায় মস্ত মস্ত গবেষণা ঘুরছে, কিন্তু আমি ওসব বুঝি না। আমি কাছের মানুষদের ভালমন্দ বুঝি শুধু। এদের মাথায় এই নিগ্রহের বোঝা চাপিয়ে আপনি যত বড় গবেষণাতেই মেতে থাকুন, আমি সেটা বড় করে দেখব না। এরকম হলে আপনি আমাকে শত্রু বলে জেনে রাখুন।
অমিতাভ বিড়বিড় করে বলল, থামুন-
ধীরাপদ নিষ্পলক চেয়ে আছে তেমনি, তার থামার সময় হয়নি এখনো। প্রতিক্রিয়া দেখছে।—পার্বতী ভিক্ষে চাইতে জানে না। জানলে এসব কথা আপনাকে আমার মুখ থেকে শুনতে হত না। আমি চারুদির কাছে শুনেছি। ছেলের জন্যেও সে আপনার কাছে ভিক্ষে চাইতে আসবে না, একটি কথাও বলবে না, মনে মনে আপনাকে শুধু ঘৃণা করে যাবে।
স্টপ…
ধীরাপদর কানেও গেল না যেন, নির্মম বিশ্লেষণে মগ্ন সে। হয়ত আপনার থেকেও বড় সম্ভাবনা নিয়ে আসছে কেউ, কিন্তু আপনার হাত দিয়েই তার মুলে ঘা পড়বে। এরপর তাকে জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু কেউ ভাববে না—পথে-ঘাটে এমন অনেক জঞ্জাল দেখে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিই। আমার মতে এও হত্যাই। আপনারা বিজ্ঞানভক্ত, এর থেকে অনেক সহজ হত্যার রাস্তা আপনাদের জানা আছে। যে আসছে সে আসবে কি আসবে না আপনি ভাবুন এখন-
স্টপ! স্টপ! স্টপ! উদভ্রান্ত ক্ষিপ্ত আক্রোশে অমিতাভ তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল। যেভাবে চিৎকার করে উঠে এলো, আঘাত করে বসাও বিচিত্র ছিল না। চোখের আগুনে তাকে দগ্ধ ক’রে দু হাতে অমিতাভ ঘোষ নিজের চুলের গোছাই টেনে ছেঁড়ার উপক্রম করল, তারপর মাতালের মত টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঘর খোলা। দরজার আটায় তালাচাবি ঝুলছে। শয্যায় অত যত্নের গোপনীয় কাগজপত্র ছড়ানো…ভালো নাটক হয়ে গেল। লোকটা অমিতাভ ঘোষ বলেই হল। এই রকমই হ’বে আশা ছিল ধীরাপদর। এই নাটকের জন্যেই অনেকদিন ধরে একটা নীরব প্রস্তুতি চলছিল। উঠে অ্যাটর্নির লেখা কাগজের গোছা আর অ্যালবামটা দেয়ালের কাছে খোলা সুটকেসের মধ্যে রাখল, তারপর দরজায় তালা-চাবি লাগিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। রাতে এক সময় কেয়ার টেক বাবুকে ডেকে চাবিটা তার জিম্মায় রাখল –অমিতবাবু এলেই ওটা যেন তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়।