তেইশ
বড়র জায়গায় বড় কেউ না বসলে একটা ফাঁক চোখে পড়েই। বড় সাহেব রওনা হয়ে যাবার দিনকতকের মধ্যে ধীরাপদর কাছে অন্তত তেমনি একটা ফাঁক স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সিতাংশুর প্রখর তত্ত্বাবধানে কর্মস্থলে হাওয়া পালটেছে বটে, ফাঁকটা ভরাট হয়নি।
আগে দিনের অর্ধেক প্রসাধন শাখায় কাটিয়ে তারপর এখানে আসত সিতাংশু। এখন সেই রীতি বদলেছে। সকালে সোজা এই অফিসে আসে, লাঞ্চের পর ঘণ্টাখানেক ঘণ্টা দেড়েকের জন্য প্রসাধন শাখা দেখতে বেরোয়। এই শাখাটির সঙ্গেও লাবণ্য সরকারের কোনরকম স্বার্থের যোগ দেখা দিয়েছে কিনা কেউ জানে না। কিন্তু তাকেও প্রায়ই সঙ্গে দেখা যায়।
বড় বড় পার্টিগুলোর সঙ্গে সংযোগ রক্ষার দায়িত্বও তারা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। একসঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে বেরোয়। কাগজে কলমে তার রিপোর্ট শুধু ধীরাপদ পায়। বড় কোনো স্যাংশনের ব্যাপারেও তাই। স্থির যা করার তারাই করে, প্রয়োজন হলে সিনিয়র কেমিস্ট জীবন সোমের পরামর্শ নেওয়া হয়। পরামর্শের জন্য আজকাল প্রায়ই তাঁকে এ দালানে আসতে দেখা যায়। লাবণ্য সরকারের পরে তিনিই সব থেকে বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছোট সাহেবের। ধীরাপদর শুধু নির্দেশ অনুযায়ী কাজ চালানোর দায়িত্ব।
আপত্তি নেই। ঝামেলা কম, ভাবনা-চিন্তা কম। কাজে এসেও অবকাশ মিলছে খানিকটা। ধীরাপদ যেন মজাই দেখে যাচ্ছে বসে বসে। মজা দেখতে গিয়ে সেই একটা দিনের কথা মনে পড়ে, যেদিন বড় সাহেবের মন বুঝে কর্তব্য ঠিক করার জন্য লাবণ্য তাকে নার্সিং হোমে ডেকেছিল। বড় সাহেবের মনোভাবটা সেদিন তাকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিল ধীরাপদ। পারিবারিক প্ল্যানে অনভিপ্রেত কিছু ঘটে সেটা বড় সাহেব চান না জানিয়ে সিতাংশুর সঙ্গে অমিতাভকেও জুড়েছিল। কিন্তু সেই রাগে লাবণ্য এই কর্তব্য বেছে নিল? সেদিনও সে ঝলসে উঠেছিল মনে আছে, বলেছিল, ঘটে যদি তিনি আটকাবেন কি করে?
ছেলের বিয়ে দিয়েও আটকাতে পারেন কিনা সেই চ্যালেঞ্জ এটা? সিতাংশুর সঙ্গে কোন ধরনের প্যাক্ট হয়েছে লাবণ্যর?
হাসতে গিয়েও হাসা হল না। চ্যালেঞ্জ হোক আর যাই হোক, সিতাংশু উপলক্ষ মাত্র। লক্ষ্য যে, তার রিসার্চের স্কীম বাতিলের ফলাফল ভেবে এখনো লাবণ্য সরকার বিচলিত হয়, অস্বস্তির তাড়নায় ধীরাপদ ঘরে না এসে পারে না। পারেনি।
বিয়ের পরেও ছোট সাহেবের ঠিক এইরকম হালচাল দেখবে কেউ ভাবেনি। অনেকদিন আগের মতই সসঙ্গিনী তার ছোট সাদা গাড়িটা চোখের আড়াল হতে না হতে অনেককে মুখ টিপে হাসতে দেখা গেছে, অনেককে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে দেখা গেছে। ধীরাপদ আর মেম-ডাক্তারের প্রসঙ্গে বউয়ের আবিষ্কার নিজেদের মধ্যে কতটা ফলাও করে প্রচার করেছে তানিস সর্দার, ধীরাপদ জানে না। কিন্তু তাঁর চোখেও বিভ্রান্ত কৌতূহল লক্ষ্য করেছে। সম্ভব হলে জিজ্ঞাসাই করে বসত, এ আবার কি রকম- সকম দেখি বাবু? ভদ্রজনদের এই রীতি নিয়ে সে বউয়ের সঙ্গেই জটলা করে হয়ত।
নতুন বউ আরতির সঙ্গে লাবণ্যর প্রাথমিক আলাপটা বড় সাহেবের মারফতই হয়েছে মনে হয়। সিতাংশুর বিয়ের পর দু মাসের মধ্যে বারতিনেক সে প্রেসার চেক করতে এসেছিল। আর শেষ এসেছে বড় সাহেবের যাত্রার আগের সন্ধ্যায়। সেটা প্রেসার দেখতে নয়, এমনি দেখা করতে। ধীরাপদ উপস্থিত ছিল সেখানে, সিতাংশু ছিল, আরতি ছিল। শুধু অমিতাভ ছিল না। বড় সাহেব খোসমেজাজে ছিলেন সন্ধ্যাটা। ঠাট্টা করেছেন, লাবণ্যকে প্রায়ই আজকাল নাকি গম্ভীর দেখছেন তিনি। বলেছেন, তোমরা নিজের ব্লাডপ্রেসার চেক-টেক করেছ শিগগীর? আবার বউয়ের কাছে লাবণ্যর কড়া ডাক্তারীর প্রশংসা করেছেন, বলেছেন, লাবণ্যর রোগীরা ওষুধ খেয়ে যত সুস্থ বোধ করে, ধমক খেয়ে তার থেকে কম সুস্থ বোধ করে না। হাসছিল কম বেশি সকলেই। আরতি হাসছিল আর সকৌতুকে লাবণ্যকে দেখছিল। বড় সাহেব আরতিকে বলেছেন, দরকার বুঝলেই এঁকে টেলিফোনে খবর দেবে, তোমার তো আবার ঘন ঘন মাথা ধরার রোগ আছে। লাবণ্যকে বলেছেন, তুমিও একটু খেয়াল রেখো—
কড়া ডাক্তারটির প্রসঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে আর কোনো শুভ সম্ভাবনার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে বউয়ের কাছে তিনি ব্যক্ত করেছেন কিনা ধীরাপদ জানে না। যে রকম নিশ্চিন্ত আনন্দে আছেন, একেবারে অসম্ভব মনে হয় না। তিনি রওনা হয়ে যাবার এই তিন সপ্তাহের মধ্যে অন্তত লাবণ্য বউয়ের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখার কোনো তাগিদ অনুভব করেনি। সে এলে এমন কি বউকে টেলিফোন করলেও খবরটা ঘুরে ফিরে মানকের মারফৎ কানে আসত। খবর থাকলেই মানকে খবর দেয়, তার কাছে দরকারী বা অদরকারী বলে কিছু নেই।
কিন্তু ধীরাপদ সেদিন এই বউটির মধ্যেই একটুখানি বৈচিত্র্যের সন্ধান পেল। গোডাউনের স্টক দেখে দালানের দিকে ফিরছিল। বড় সাহেবের লাল গাড়িটা গাড়িবারান্দার নিচে এসে থামতে দেখে অবাক। শুধু সে নয়, এদিক-ওদিক থেকে আরো অনেকের উৎসুক দৃষ্টি এদিকে আটকেছে। ছোট সাহেবের সাদা গাড়ি সামনেই দাঁড়িয়ে, এ গাড়িতে কে এলো?
ড্রাইভারের পাশ থেকে ব্যস্তসমস্ত মানকে নামল। পিছনের দরজা খুলে আরতি। বেশবাস আর প্রসাধন-শ্রীর সঙ্গে মানকের সেই পুরনো বর্ণনা মিলছে। জমজমে সাজ- পোশাক আর কপোলে অধরে লালের বিন্যাস। কিন্তু মানকের পটে-আঁকা মূর্তি নয় আদৌ, উল্টে উজ্জ্বল শিখার মত বলা যেতে পারে।
এই মেয়ে ঘরের বধূবেশে এত অন্যরকম যে হঠাৎ ধোঁকা খেতে হয়। ধীরাপদ আরো হতভম্ব তাকে এইখানে দেখে। অদূরে দাঁড়িয়ে গেছে সে। ড্রাইভার আর দারোয়ান শশব্যস্তে বউরাণীকে ভিতরে নিয়ে চলল। পিছনে মানকে।
দোতলার বারান্দায় শুধু মানকের সঙ্গেই দেখা হল ধীরাপদর। বোকার মত এদিক- ওদিক উকিঝুঁকি দিচ্ছিল। অকুল পাথারে আপনজনের সাক্ষাৎ মিলল যেন, মানকে আনন্দে উদ্ভাসিত।-বউরাণীকে ব্যবসা দেখাতে নিয়ে এলাম বাবু! বাবুর মুখে তবু সপ্রশ্ন বিস্ময় লক্ষ্য করেই হয়ত বাহাদুরির সবটা নিজের কাঁধে নেওয়া সঙ্গত বোধ করল না সে। উৎফুল্ল মুখেই কার্যকারণ বিস্তার করল। খাওয়া-দাওয়ার পর বউরাণী ওকে ডেকে বলল, মানিক, চলো বাবুদের কারবার দেখে আসি, মস্ত ব্যাপার শুনেছি, ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বলো—
বউরাণীর হুকুম, মানকে না নিয়ে এসে করে কি! তবু ছোট সাহেবকে সে একটা টেলিফোন করতে পরামর্শ দিয়েছিল। বউরাণী বলেছেন, টেলিফোন করতে হবে না, টেলিফোন করার কি আছে। আর কেউ না থাকলে ধীরুবাবুই সব দেখিয়ে-শুনিয়ে দেবেন আমাদের।
তার দরকার হয়নি, ছোট সাহেব আর লাবণ্য দুজনেই আছে। বউরাণী তাদের ঘরেই গেছে।
কারখানা ভালো করে দেখতে হলে ঘণ্টা দুই লাগে। কিন্তু বউরাণীর কারখানা দেখা আধ ঘণ্টার মধ্যেই হয়ে গেল। নিচে থেকে পরিচিত হর্ন কানে আসতে উঠে ধীরাপদ জানালার কাছে এসে দেখল, সামনে হাস্যবদন মানকে আর পিছনে তার বউরাণীকে নিয়ে লাল গাড়ি ফিরে চলল।
ভাবতে গেলে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। অস্বাভাবিক ভাবছেও না ধীরাপদ। তবু সেদিনটা তলায় তলায় বিস্ময়ের ছোঁয়া একটু লেগেই থাকল। অবশ্য পরদিনই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহের মুখে মানকের দ্বিতীয় দফা আনন্দের ঝাপটা লাগতে ভিতরটা সজাগ হয়ে উঠল। রাত বেশি নয় তখন, এ সময়টা ধীরাপদ ঘরে থাকলে আর মানকের হাতে কাজ না থাকলে ঘুরে-ফিরে সে বার বার এসে দর্শন দিয়ে যায়। তাকে এড়ানোর জন্য ধীরাপদ অনেক সময় ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে, নয়তো নাকের ডগায় একটা বই ধরে থাকে।
মানকে হাঁটু মুড়ে শয্যার পাশে মেঝেতে বসে পড়ল। বলার মত সংবাদ কিছু আছে এটা সেই লক্ষণ, ফলে ধীরাপদর মুখের কাছ থেকে বই সরল।
আজ আবার বউরাণীকে নিয়ে নয়া কারখানা দেখে এলাম বাবু-সেই সাজের কারখানা!
নয়া কারখানা বলতে প্রসাধন- শাখা। মানকে জানালো, বউরাণীর দেখাশোনার শখ খুব, সবেতে আগ্রহ। তার ধারণা, ভার দিলে বউরাণীও মেমডাক্তারের মত বড় বড় একটা ‘ডিপার্টমেন্টো’ চালাতে পারেন।
এটুকুই বক্তব্য হলে মানকের বসার কথা নয়। শ্রোতার মুখের দিকে চেয়ে কৌতূহলের পরিমাণ আঁচ করতে চেষ্টা করল সে, তারপর গলা নামিয়ে একটা সংশয় ব্যক্ত করল।-বউরাণী আগে থাকতে না বলে না কয়ে এভাবে হুট করে বেরিয়ে পড়েন তা বোধ হয় ছোট সাহেবের খুব পছন্দ নয় বাবু। আজ গম্ভীর গভীর দেখলাম তেনাকে। মেম-ডাক্তার অবশ্য খুব খুশি হয়েছেন, নিজেই ঘুরে দেখালেন শোনালেন, তারপর একগাদা সাজের ‘দ্রব্য’ দিয়ে দিলেন সঙ্গে।
মানকের ওঠার লক্ষণ নেই, আর কিছু বলারও না। বইটা আবার মুখের সামনে ধরবে কি না ভাবছিল ধীরাপদ।
বাবু—
দৃষ্টিটা তার মুখের ওপরে ফেলল আবার।
ভাগ্নেবাবুর কি হয়েছে বাবু?
কেন?
মানকের মুখে অস্বস্তির ছায়া, ইয়ে-বউরাণী আজ সকালো শুধোচ্ছিলেন। ভাগ্নেবাবু এদানীং দু বেলার এক বেলাও বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করেন না, বাড়িতে থাকেও না বড়—
বলতে বলতে মানকে হঠাৎ আর একটু সামনে ঝুঁকে ফারাক কমালো। চাপা উত্তেজনায় ফিস ফিস করে বলল, বউরাণী বাড়িতে অমনি সাদাসিধেভাবে থাকেন আর মিষ্টি মিষ্টি হাসেন—কিন্তু ভেতরে ভেতরে তেজ খুব বাবু, কাল রেতে স্ব-কম্বে শুনেছিলাম ছোট সাহেবকে করকরিয়ে কি সব বলছিলেন। ছোট সাহেব মুখ ভার করে বসেছিলেন… কেয়ার টেক বাবুও বউরাণীকে একদিন অমনি কড়া কথা বলতে শুনেছিলেন—ছোট সাহেব বউরাণীকে খুব ভয় করেন বলেন উনি।
মানকের ধারণা বউরাণীর এই মেজাজের সঙ্গে ভাগ্নেবাবুর অস্থির মতির কিছু যোগ আছে। নইলে আজই সকালে বউরাণী হঠাৎ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন, আচ্ছা মানিক, দাদার কি হয়েছে জানো? মানকে মাথা নেড়েছে, ভাগ্নেবাবুর কিছু হয়েছে সেটা সে দেখছে, কিন্তু কেন কি হয়েছে তা জানবে কি করে? তাই মাথা খাটিয়ে বউরাণীকে সে বলেছে, ধীরুবাবু জানতে পারেন। শুনে বউরাণী তক্ষুনি আদেশ করলেন, ধীরুবাবুকে একবার ওপরে ডেকে নিয়ে এসো। কিন্তু মানকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে না নামতে ফিরে ডাকলেন আবার, বললেন, এখন ডাকতে হবে না, থাক—
মানকে উঠে যাবার পরেও তার সমস্ত কথাগুলো বহুবার ধীরাপদর মগজের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। আরতির এই তীক্ষ্ণ দিকটা সেইদিনই ধীরাপদর চোখে পড়েছিল, সেজেগুজে যেদিন ফ্যাক্টরীতে এসেছিল। কিন্তু সিতাংশুকে কড়া কথা বলার সঙ্গে অমিতাভ ঘোষের কিছু হওয়া না হওয়ার কি যোগ বোঝা গেল না। মানকের ওপরেই মনটা বিরূপ হয়ে উঠতে লাগল ক্রমশ। সত্য-মিথ্যায় জড়িয়ে এই একটি মেয়ের মধ্যেও অশান্তির বীজ ছড়ানো হয়ে গেছে তাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মানকেকে একটু কড়া শাসন করা দরকার। আগেই করা উচিত ছিল।
ধীরাপদ উঠে সিঁড়ির ওপাশের ঘরে উঁকি দিল। ঘর অন্ধকার। গত এক মাসের মধ্যে তিন-চার দিনের বেশি অমিতাভর সঙ্গে দেখা হয়নি। আর কথা একটাও হয়নি। অমিতাভ মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে, সেই যাওয়াটা দুনিয়ার সব কিছুর ওপর পদাঘাত করে যাওয়ার মত। বাড়িতে থাকেই না বড়, থাকলেও ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। কারখানায় আসা বন্ধ একরকম, খরগোশ নিয়ে এক্সপেরিমেন্টও বন্ধ। ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে হঠাৎ এক-একদিন এসে হাজির হওয়ার খবর পায়। ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে ঘোরে, আর যখন খুশি যা খুশি ছবি তোলে। তার গুণমুগ্ধ অনুগতদের মুখের খবর, সে এলে সিনিয়র কেমিস্ট জীবন সোম ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করেন। কারণ চীফ কেমিস্ট এক-একদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওয়ার্কশপে বসে থাকে, এমন কি সকলের ছুটি হয়ে গেলে একাই বসে থাকে। কাগজে-কলমে তো এখনো সিনিয়র কেমিস্টের মুরুব্বী তিনি, ভদ্রলোক বলেনই বা কি?
সকলের বিশ্বাস, যে কারণেই হোক চীফ কেমিস্টের মাথাটা এবারে ভালমতই বিগড়েছে। ধীরাপদর আশঙ্কাও অন্যরকম নয়। ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে লোকটা কোথায় কোথায় ঘোরে, সমস্ত দিন করে কি, কি ছবি তোলে, কার ছবি? ছবির কথা মনে হলেই তার ঘরের অ্যালবাম দুটোর কথা মনে পড়ে। ওর একটা খুলেই ধীরাপদকে পালাতে হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্ধত অসম্বৃত বিস্মৃতির খোরাক লোকটা আর কোথায় পাবে? কার ছবি তুলছে?
পরদিন। ধীরাপদ অফিসে যাবার জন্য সবে তৈরী হয়েছে। খানিক আগে ছোট সাহেবের সাদা গাড়ি বেরিয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ মুখে সামনে এসে দাঁড়াল কেয়ার-টেক বাবু। তার দিকে চেয়ে ধীরাপদ অবাক।
বাবু! আমরা চাকরি করি বলে কি মানুষ নই? বিচার নেই বিবেচনা নেই, হুট করে এতকালের চাকরিটা খেলেই হল?
চাপা উত্তেজনায় লিকলিকে শরীরটা কাঁপছে তার, টাকে ঘাম দেখা দিয়েছে। ধীরাপদর মুখে কথা সরে না খানিকক্ষণ—কি হয়েছে?
মানকের জবাব হয়ে গেল। অফিস যাওয়ার মুখে ছোট সাহেব তার পাওনাগণ্ডা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেলেন।
কেন? না জিজ্ঞাসা করলেও হত, আপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মর্জি। বলব না তো আর কি বলব? উত্তেজনা বাড়ছে কেয়ার-টেক্ বাবুর, রাগের মাথায় মানকেকেই গালাগাল করে নিল একপ্রস্থ।—ওটা এক নম্বরের গাধা বলেই তো, মাথায় একরত্তি ঘিলু নেই বলেই তো—কতদিন সমঝে দিয়েছি, ছোট সাহেবের চোখের ওপরে দিনরাত অমন বউরাণীর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করিস না, অত ভালমানুষি দেখাস না-এখন টের পেলি তো মজাটা।—উল্টো সওয়াল হয়ে যাচ্ছে খেয়াল হতে একমুখেই মানকের পক্ষ সমর্থন করল আবার।—তা ওরই বা দোষটা কি বাবু, মনিব ইনিও উনিও। বউরাণী কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলবে না? কোথাও নিয়ে যেতে বললে নিয়ে যাবে না? তা হলে তো আবার ও-তরপ থেকে জবাব হয়ে যাবে। পরিবারের মন যুগিয়ে চললে চাকরি যায় এমন তাজ্জব কথা কখনো শুনেছেন? ছোট সাহেবের রাগ পড়লে আপনি একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলুন বাবু, এ দুর্দিনে চাকরি গেলে চলবে কেন!
অফিসে যেতে যেতে ধীরাপদ আর কিছু ভাবছিল না, ভাবছিল শুধু কেয়ার- টেক্ বাবুর কথা। মানকের চাকরি গেছে শুনলে দু হাত তুলে নাচলেও যেখানে অস্বাভাবিক লাগত না—তার এই মূর্তি আর এই বচন। হঠাৎ চোরের মার দেখে একাদশী শিকদারের আর্ত উত্তেজনার দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। বুকের তলায় কি যে ব্যাপার কার, হদিস মেলা ভার।
কিন্তু একাদশী শিকদারের না হোক, কেয়ার টেক্ বাবুর চিত্ত-বিক্ষোভের হদিস সেই রাতেই মিলল। মিলল চারুদির বাড়িতে।
অফিসে বসে চারুদির টেলিফোন পেয়েছে, অফিসের পর একবার যেতে হবে, কথা আছে। টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে ধীরাপদ ঠিক করেছিল যাবে না। চারুদির এই ডাকটা অনুরোধ নয়, অনেকটা আদেশের মত। সেদিন বলতে গেলে ধীরাপদকে তাড়িয়েই দিয়েছিলেন। চারুদি ব্যবসায়ের মনিবদেরই একজন বটে, কিন্তু এই মনিবের মন যুগিয়ে না চললে মানুকের মত তার চাকরি যাবে না।
বিকেলে বাড়ি এসে দেখে মানকেরও চাকরি যায়নি। বরং মুখখানা ঠুনকো গাম্ভীর্যের আড়ালে হাসি হাসি লাগছে। চা-জলখাবার দিতে এলে ধীরাপদ জিজ্ঞাসা করল, তোমার জবাব হয়ে গিয়েছিল শুনলাম?
গেছল। আবার বহাল হয়েছি।
গাম্ভীর্য টিকল না, চেষ্টা সত্ত্বেও মুখের খাঁজে খাঁজে হাসির জেল্লা ফুটে উঠতে ..লাগল। তারপর মজার ব্যাপারটা ফাঁস করল। বিকেলে ছোট সাহেব ফিরতে বউরাণীর ঘরে মানকের ডাক পড়েছিল। বউরাণী ওকে বললেন, এখানে তোমার জবাব হয়ে গিয়ে থাকে তো আমার বাপের বাড়ি গিয়ে কাজে লাগো—মাইনে যাতে এখানের থেকে বেশি হয় আমি বলে দেব। মানকে পালিয়ে এসেছিল, ছোট সাহেব বেরিয়ে যেতে আবার ডেকে বললেন, কোথাও যেতে হবে না, কাজ করোগে যাও।
ওনাদের মধ্যে আরো কথা হয়েছে বাবু, বড় সাহেবের ঘরে দাঁড়িয়ে কেয়ার- টেক বাবু স্ব-কম্বে শুনেছে। বিস্ময়ে আনন্দে মানকের দু চোখ কপালের দিকে উঠছে, আমি ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসতে ছোট সাহেব বউরাণীকে বলেছেন, তুমি চাকরবাকরের সামনে আমাকে অপমান করলে কেন? বউরাণীও তক্ষুনি বেশ মিষ্টি করে পাল্টা শুধিয়েছেন, তুমি ওকে যেতে বলে আমাকে অপমান করোনি?
ব্যস, ছোট সাহেবের ঠোঁট সেলাই একেবারে। মানকে হি-হি করে হেসে উঠল।
মানকের সত্যিই চাকরি যাক ধীরাপদ একবারও চায়নি। বরং চিন্তিত হয়েছিল। চিন্তা গেল বটে, কিন্তু একটুও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। বসে থাকতে ভালো লাগল না। চারুদির বাড়ি যাবে না ভেবেছিল তবু সেখানে যাবার জন্যই ঘর ছেড়ে বেরুল। সিঁড়ির ওপাশের সরু ফালি বারান্দায় মুখোমুখি বসে কাচের গ্লাসে চা খাচ্ছে মানকে আর কেয়ার টেক বাবু। ফিস ফিস করে কথা বলছে আর হাসছে। অন্তরঙ্গতার দৃশ্যটা আর কোনো সময়ে চোখে পড়লে অভিনব লাগত। আজ লাগল না। ধীরাপদ ওদের অগোচরে বেরিয়ে এলো। স্বার্থের বাঁধন পলকা হলেও বড় সহজে টোটে না।
চারুদির বাড়ির ফটকের সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল ধীরাপদ। ইচ্ছে করেই গাড়িটা ভেতরে ঢোকালো না। বাড়ির দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ ট্যাক্সিটা থামিয়েছে, তারপর লালমাটির পথ ভেঙে হেঁটে আসছে। বারান্দার একটা থামে ঠেস দিয়ে সিঁড়িতে বসে আছে পার্বতী। সামনের দিকে মুখ, মনে হবে বাগান দেখছে। বসার শিথিল ভঙ্গি এমনি স্থিরনিশ্চল যে জানা না থাকলে মাটির মূর্তি বলেও ভ্রম হতে পারে। ধীরাপদ একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় দু হাতের ব্যবধানের মধ্যে এসে দাঁড়ানো সত্ত্বেও টের পেল না।
ভালো আছ?
পার্বতী চমকালো একটু। ফিরে তাকালো, শাড়ির আঁচলটা বুক-পিঠ ঢেকে গলায় জড়িয়ে দিল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল। ভালো আছে।
বিকেলের আলোয় আসন্ন সন্ধ্যার কালচে ছোপ ধরেছে বলেই হয়ত মুখখানা অন্যরকম লাগছে একটু। কিন্তু ধীরাপদর চোখে সুন্দর লাগছে। পার্বতী এখনো যেন খুব কাছে উপস্থিত নয়, তার শান্ত মুখ থেকে এখনো দূরের তন্ময়তার ছায়া সরেনি। কেন বলা দরকার বোধ করল ধীরাপদ জানে না, বলল, আসার জন্যে টেলিফোনে জোর তাগিদ দিয়েছেন চারুদি-
মা ভেতরে আছেন।
পার্বতী না চাইলে কথা বাড়ানো যায় না। ধীরাপদ ভিতরের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু হঠাৎ হালকা লাগছে তার, ভালো লাগছে। পার্বতীর চোখে কোনো অনুযোগ দেখেনি, ভর্ৎসনা দেখেনি, ঘৃণা দেখেনি, বিদ্বেষ দেখেনি। এই মেয়ে এক মুহূর্তের জন্যেও নিজের কোনো দায় অন্যের ঘাড়ে ফেলেছে বলে মনে হয় না।
তাকে দেখা মাত্র চারুদির ঈষদুষ্ণ অভিযোগ, অফিস তো সেই কখন ছুটি হয়েছে, এতক্ষণ লাগল আসতে?
মুখের দিকে এক নজর তাকিয়েই বোঝা গেল, চারুদির স্নায়ুর ধকল কাটা দূরে থাক, বেড়েছে আরো। মুখ ছেড়ে কানের ওপরের দুধারের লালচে চুলও ভেজা। অনেকবার জল দেওয়া হয়ে গেছে বোধ হয়। ধীরাপদ ইঞ্জিচেয়ারে বসে হালকা জবাব দিল, তোমার কথাটা বেশ জরুরী মনে হচ্ছে!
যথারীতি শয্যায় বসলেন চারুদি। — অফিস থেকেই আসছ তো, খাবে কিছু?
না। আজকাল যে রকম অভ্যর্থনা জুটছে—ও পার্ট সেরেই আসি।
হাসার কথা, কিন্তু চারুদি ভুরু কোঁচকালেন। — ঢাকঢোল বাজিয়ে বরণকুলো সাজিয়ে অভ্যর্থনা করতে হবে? পর না ভেবে যখন যা দরকার নিজে চাইতে পার না?
পারি। এখন সমস্যাটা কি বলো শুনি।’
কিন্তু চারুদি চট করেই বললেন না কিছু। খাটে পা তুলে ঠেস দিয়ে বসলেন। তারপর চুপচাপ বসেই রইলেন খানিক। সে দেরিতে এলো বলেই রাগ, নইলে প্রয়োজনটা খুব জরুরী কিছু নয় যেন।
এর মধ্যে অমিতের সঙ্গে তোমার কিছু কথা হয়েছে?
না।
দেখা হয়েছে?
এবারেও একই জবাব দিলে ক্ষোভের কারণ হতে পারে। বলল, যেটুকু হয়েছে একতরফা, তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকছেন।
এরকম পাগলের মত করে বেড়াচ্ছে, তার রিসার্চের প্ল্যান বাতিল হয়েছে বলে, না আর কোনো কারণ আছে?
আর কি কারণ?
চারুদি এরপর বেখাপ্পা প্রশ্ন করে বসলেন একটা, অভয় বলছিল, বউয়ের কানভাঙানি দিচ্ছে সন্দেহ করে সিতাংশু পুরনো চাকরটাকে আজ জবাব দিয়েছে?
অভয় কে?
তোমাদের কেয়ার-টেক বাবু। শুনলাম, লাবণ্যর সঙ্গে আজকাল আবার সিতাংশুর খুব ভাব-সাব হয়েছে, অমিতেরও সেই জন্যেই অত গাত্রদাহ নয় তো?
ধীরাপদর চোখের সামনে থেকে একটা পরদা সরে গেল। যা, কোনো কিছুর মূলে মানকে নয় তাহলে— মুলে ওই কেয়ার টেক বাবু। ও বাড়ির সব খবর এ বাড়িতে পৌঁছয় তারই মুখে, আর বউরাণীর কানভাঙানি যদি কেউ দিয়ে থাকে—দিয়েছে সে-ই, মানকে নয়। এ কাজ করার পক্ষে মানকে নির্বোধই বটে, আর ধীরাপদও নির্বোধের মতই সর্ব ব্যাপারে তাকে দায়ী করে আসছে। ওই জন্যেই সকালে ওই মূর্তিতে তার শরণাপন্ন হয়েছিল কেয়ার-টেক বাবু, মানকের জবাব হয়ে যাবার মধ্যে নিজের বিপদের বিভীষিকা দেখেছিল সে।
একটু ভেবে বলল, না তা নয়, রিসার্চ প্ল্যান নাকচ হতে নিজে যেভাবে জ্বলছেন তিনি, তাতে আর কারো ভাব-সাব তাঁর চোখে পড়ছে না।
একেবারে নাকচ হল কেন তাহলে? আর তোমরাই বা চুপচাপ বসে আছ কেন? যে রকম ক্ষেপে উঠেছে, একটা কিছু বিপদ হতে কতক্ষণ? আমাকে হুকুম করে গেছে, আমার চার আনা অংশ কড়ায় গণ্ডায় তুলে নিতে হবে, নিজের দু আনা অংশও ছাড়িয়ে নেবে, ভিন্ন কোম্পানী করবে তারপর—তুমি এলে তোমাকেও নেবে। এইসব পাগলামি করছে আর উকীল ব্যারিস্টারের কাছে ছোটাছুটি করছে। আমি সায় দিইনি বলে পারে তো আমাকে খুন করে। ঘন ঘন নানা রকমের পরামর্শদাতা এনে হাজির করছে বাড়িতে। এর কি হবে? নাকি কোর্ট-কাছারি হয়ে একটা কেলেঙ্কারি হোক তাই চায় সকলে? তোমাদের বড় সাহেবকে কালই একটা জরুরী খবর পাঠাও, সব খুলে লেখো তাঁকে—
ব্যাপারটা এদিকে গড়াচ্ছে ধীরাপদ ভাবেনি। একটা ভাঙনের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে চুপচাপ বসে রইল খানিকক্ষণ। কিন্তু এ যেন কিছু একটা বলার মত প্রশস্ত মুহূর্ত বটে। বলল, বড় সাহেব এজন্যে একটুও চিন্তিত নন, আমাকে ওষুধ বাতলে দিয়ে গেছেন তিনি, এখন তুমি রাজী হলেই হয়।
চারুদি সোজা হয়ে বসলেন, চিন্তাক্লিষ্ট মুখে কঠিন রেখা পড়তে লাগল, তপ্ত চোখে শঙ্কার ছায়াও একটু। চাপা ঝাঁজে জিজ্ঞাসা করলেন, কিসে রাজী হলে কি হয়?
বিয়েতে। অমিতবাবু আর লাবণ্য সরকারের বিয়েটা দিয়ে ফেললেই সব দিকের গোলযোগ মেটে, আর কোনো দুশ্চিন্তার কারণ থাকে না। তোমাকে বুঝিয়ে বলে মত করানোর জন্যে আমাকে বিশেষ করে বলে গেছেন তিনি।
আমার মতামতে কি যায় আসে, বিয়ে দিক। চারুদির লালচে মুখে আগুনের আভা, কণ্ঠস্বরেও আগুনের হল্কা। তীক্ষ্ণ কটূ কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, কিন্তু এদিকের কি হবে?
কোন্ দিকের?
আমাকে আক্কেল দেবার জন্যে ওই যে হতভাগী পোড়ারমুখী পেটে ধরেছে একটাকে, তার কি হবে? সে কি করবে? দুনিয়ায় উনি আর ওর ভাগ্নেই শুধু মানুষ, তারা নিশ্চিন্ত হলেই সব হয়ে গেল—আর কেউ মানুষ নয়, আর কেউ কিছু নয়, কেমন?
ধীরাপদ যেন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেলো একটা, নিস্পৃহতার আবরণটা অকস্মাৎ ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে চারুদিকেই দেখছে সে। এইজন্যই গেল দিনে চারুদির অমন ক্ষিপ্ত মূর্তি দেখেছিল, পার্বতীর ওপর অমন ক্ষিপ্ত আক্রোশ দেখেছিল।
চারুদি দম নিলেন একটু, একটু সংযতও করলেন নিজেকে। গলার স্বর অত চড়ল না কিন্তু তেমনি কঠিন। বললেন, বড় সাহেবের হয়ে পরামর্শ করতে আসার আগে অমিতকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো, কি হবে-তারপর যেন অন্য ভাবনা ভাবে, নইলে আমিই তাকে ভালো করে শিক্ষা দেব। সবই খেলা পেয়েছে-
এই আগুনে-খেলার গোড়ার প্রশ্রয়টা কে দিয়েছে, সে কথা মনে হলেও বলা গেল না। খানিক নীরব থেকে ধীরাপদ শুধু জিজ্ঞাসা করল, তিনি জানেন…?
তার জানার দায়টা কী? চারুদি আবারও ফুঁসে উঠলেন, সে দিনরাত রিসার্চের ভাবনা ভাবছে না? মস্ত মানুষ না সে? আর বলবেই বা কে, মুখে কালি লেপেও দেমাকে মাটিতে পা পড়ে হতভাগীর? বললে মাথা নিতে আসবে না?
হঠাৎ দরজার ওধারে চোখ যেতে উগ্র মূর্তিতেই চারুদি থমকালেন, তারপর নিরুপায় হয়েই আবারো জ্বলে উঠলেন যেন, শুনছিস কি পাথরের মত দাঁড়িয়ে? এই তো বললাম ওকে কি করবি তুই আমার?
ধীরাপদও ঘাড় ফিরিয়েছে, তার পরেই আড়ষ্ট। দরজার ওধারে পাথরের মতই পার্বতী দাঁড়িয়ে—কিন্তু পাথরের মত কঠিন নয় একটুও। কমনীয়। শাড়ির আঁচলটা বুক-পিঠ ঘিরে গলায় তেমনি করে জড়ানো। চারুদির দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল খানিক, ধীরাপদকেও দেখল একবার। তারপর নিঃশব্দে চলে গেল।
একটা বিভ্রান্তির মধ্যে কেটেছে ধীরাপদর সেই রাতটা। আর থেকে থেকে চারুদির বিরুদ্ধেই রুক্ষ হয়ে উঠছে ভিতরটা। রাগে জ্বলে পুড়ে দু দিনই মুখে কালি লেপা আর কালি মাখার কথা বলেছেন চারুদি। কেবলই মনে হয়েছে নিজে একটা শিশু- অঙ্কুর প্রতিরোধ করতে পেরেছেন বলেই এমন কথা চারুদির মুখে সাজে না। চকিতের দেখায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পার্বতীর সেই মুখে কোথাও এতটুকু কালোর ছায়া দেখেনি ধীরাপদ, কোথাও একটা কালির আঁচড় চোখে পড়েনি। কুমারী জীবনের এই পরিস্থিতিতে ওভাবে দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে শুধু পার্বতীই পারে বুঝি, দাঁড়িয়ে অমন নিঃশব্দে সে-ই আবার চলে যেতে পারে। চারুদির ধারণা, শুধু তাঁকে জব্দ করার জন্যেই ইচ্ছে করে এই প্রতিশোধ নিলে পার্বতী। কিন্তু ধীরাপদর একবারও তা মনে হয় না। তার ইচ্ছাটুকুই শুধু সত্যি হতে পারে, সেই ইচ্ছার মূলে আর যাই থাক, প্রতিশোধের কোনো জ্বালা নেই। তার দরজার কাছে এসে দাঁড়ানোর মধ্যে ধীরাপদ এতটুকু অভিযোগ দেখেনি, যাতনা দেখেনি, মর্মদাহ দেখেনি। সেখানে এসে আর তাদের দিকে চেয়ে পার্বতী নিঃশব্দে শুধু নিরস্ত হতে বলেছে তাদের। আর কিছুই বলেনি, আর কিছুই চায়নি।
সিঁড়ির থামে শিথিল দেহলগ্ন সেই দূরের তন্ময়তা ধীরাপদ ভুলবে না।
অফিস থেকে ফিরে সে অমিতাভর ঘরে উঁকি দেয় একবার। তারপর রাতের মধ্যে অনেকবার। কিন্তু বেশি রাতে ছাড়া তার দেখা মেলে না। আবার ফেরেও না প্রায়ই। মনে মনে কি জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ধীরাপদর নিজের কাছেই স্পষ্ট নয় খুব।
সেদিন অফিস থেকে ফিরেই হতভম্ব। তার ঘরে রমণী পণ্ডিত বসে।
উদভ্রান্ত দিশেহারা মূর্তি। মুখ পোড়া কাঠের মত কালচে দেখলেই শঙ্কা জাগে, বড় রকমের ঝড়ে দিক-কূল হারিয়েছেন। তাকে দেখা মাত্র গলা দিয়ে একটা ফোঁপানো শব্দ বার করে উঠে কাছে এলেন, তারপরেই অকস্মাৎ বসে পড়ে তার দুই হাঁটু জাপটে ধরলেন।
সর্বনাশ হয়েছে ধীরুবাবু, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে— আমার কুমু আর নেই, তাকে আপনি খুঁজে বার করে দিন!
ধীরাপদ এমনই হকচকিয়ে গেল যে, কি বলবে কি জিজ্ঞাসা করবে দিশা পেয়ে উঠল না। বিমূঢ় বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিক, তারপর রমণী পণ্ডিতকে টেনে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিল।
কি হয়েছে?
পণ্ডিত আর্তনাদ করে উঠলেন, তিন দিন ধরে কুমু নেই, থানায় খবর দিয়েছি, সমস্ত কলকাতা চষেছি—কেউ কিছু বলতে পারলে না। তাকে কারা ধরে নিয়ে গেছে ধীরুবাবু, হয়ত সরিয়েই ফেলেছে-
দু হাতে মুখ ঢাকলেন। ধীরাপদ হাঁ করে চেয়ে আছে, তাঁকেই দেখছে। এমন উদভ্রান্ত শোক না দেখলে ব্যাপারটাকে হয়ত অনেকটা সহজ ভাবেই নিতে পারত সে। একটু আত্মস্থ হয়ে রমণী পণ্ডিত জানালেন, তিন দিন আগে খেয়েদেয়ে যেমন বেতের ঝুড়ি বানানোর কাজে বেরোয় তেমনি বেরিয়েছিল কুমু, ফিরে এসে বাবার সঙ্গে ভাই-বোনদের জামাকাপড় আর মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে যাবে বলে গিয়েছিল।
লোকে যাই বলুক, বাবা-মা-ভাই-বোন-অন্ত প্রাণ মেয়েটার। কক্ষনো সে নিজের ইচ্ছেয় কোথাও যায়নি, পণ্ডিতের দৃঢ় বিশ্বাস মেয়েটা কারো ষড়যন্ত্রের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। মেয়ের শোকে গণুদার হাতে-পায়ে ধরেছেন পণ্ডিত, তাঁর কেবলই মনে হয়েছে সে হয়ত জানে কিছু, কিন্তু গণুদা ভয়ানক রেগে গালমন্দ করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে।
হঠাৎ একি হল ধীরাপদর? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই দেহের সমস্ত কোষে কোষে অণুতে অণুতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি একটা, তারপরেই নিস্পন্দ একেবারে। শুধুমাত্র কোনো একটা সম্ভাবনায় এমন প্রতিক্রিয়া হয় না, সম্ভাবনাটা নিদারুণ কিছু সত্যের মতই অন্তস্তল ছিঁড়ে-খুঁড়ে চেতনার গোচরে ঠেলে উঠছে।
সেই লোকটা কে? সুলতান কুঠির পথে চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সেদিন গণুদা যার সঙ্গে কথা কইছিল, সেই কোট-প্যান্ট-পরা ঘাস-রঙা সিগারেটের টিন হাতে লোকটা কে?
কে? কে? কে? কে?
আলো জ্বললে যেভাবে অন্ধকার সরে, ধীরাপদর চোখের সুমুখ থেকে বিস্মৃতির পরদাটা পলকে সরে গেল তেমনি। অনেক— অনেকদিন আগে তাকে প্রথম দেখেছিল কার্জন পার্কের লোহার বেঞ্চিতে বসে। গোপনীয় বাক-বিতণ্ডার পর পকেটের পার্স বার করে একজন অশুভ মূর্তি লোকের হাতে গোটাকয়েক নোট গুঁজে দিতে দেখেছিল। দ্বিতীয় দিন দেখেছিল গড়ের মাঠে বসে, একটা লাইটপোস্ট আর বাস-স্টপের ক্ষীণ- যৌবন-পসারিণী কাঞ্চনের সঙ্গে। যেদিন মেয়েটার পসারই লুট হয়েছিল—দাম মেলেনি। ….এই লোকের কাছেই বঞ্চিত হয়েছিল, বঞ্চিত হয়ে ভয়ে ভগ্ন- বিকীর্ণ হতাশায় কাঁদতে কাঁদতে কাঞ্চন অন্ধকার মাঠে তার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।
সেই লোক। কার্জন পার্কের সেই লোক, গড়ের মাঠের সেই লোক
সম্বিৎ ফিরতে ধীরাপদ ডাকল, আমার সঙ্গে আসুন।
ট্যাক্সি ছুটেছে সুলতান কুঠির দিকে। ধীরাপদ স্থানুর মত বসে। পাশে রমণী পণ্ডিত। তাঁর শোক আর বিলাপে ছেদ পড়েছে আপাতত, আশা-আশঙ্কা নিয়ে ফিরে ফিরে দেখছেন। কথা কইতেও ভরসা পাচ্ছেন না খুব।
ট্যাক্সিটা সুলতান কুঠির খানিক আগে ছেড়ে দিয়ে ধীরাপদ হাঁটা পথ ধরল। পিছনে রমণী পণ্ডিত, তাঁর অবসন্ন পা দুটো সামনের লোকটার সঙ্গে সমান তালে চলছে না।
ধীরাপদ দাঁড়িয়ে গেল, মজা পুকুরের ওধারে একলা গণুদা বসে। রমণী পণ্ডিতকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে পুকুরটা ঘুরে একলাই ওধারে চলল। একটা অপ্রিয় পরিস্থিতি এড়ানো গেল, সোনাবউদি আর ছেলেমেয়েদের চোখের ওপর গণুদাকে বাইরে ডেকে আনার দরকার হল না। ওখান থেকে সুলতান কুঠি দেখাও যায় না, গাছগাছড়ার আড়ালে পড়ে।
গণুদা আড়ালই নিয়েছে। ধীরাপদ আর ওপারে রমণী পণ্ডিতকে দেখে বিষম চমকে উঠল। পাংশু শুকনো মুখ আরো শুকিয়ে গেল।
কুমু কোথায়? নরম করে সাদাসিধে ভাবেই জিজ্ঞাসা করেছে ধারাপদ।
ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত গণুদা বসা থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। তারপরেই রাগে ফেটে পড়তে চাইল, আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? আমি কার খবর রাখি? আমাকে জিজ্ঞাসা করার মানে কি?
কুমু কোথায়?
বা রে! গণুদার রাগের জোর কমছে, তাই গলা বাড়ছে। এবারের কোপটা রমণী পণ্ডিতের ওপর, ওই উনি বলেছেন বুঝি আমার কথা? এত বড় জ্যোতিষী হয়েছেন, গুনে মেয়ে কোথায় বার করুন—আমার কাছে কেন? আমি কি জানি? উনি নিজে জানেন না কেমন মেয়ে ওঁর? গণুদার ফরসা মুখ কাগজের মত সাদা, রাগে কাঁপছে। ধীরাপদ দেখছে তাকে। সঙ্কটে পড়লে অনেক পারে মানুষ। একসঙ্গে পাঁচটা কথা জুড়তে পারত না গণুদা, তার এই মূর্তি আর এই কথা!
চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সেদিন যার সঙ্গে কথা কইছিলেন সেই লোকটা কে? ধীরাপদর কণ্ঠস্বর আরো শাস্ত্র, কিন্তু আরো কঠিন।
কো—কোন লোক?
চকচকে চেহারা, চকচকে স্যুট পরা, হাতে ঘাস-রঙা সিগারেটের টিন—
ইয়ে আমি—তার কি? দুই চোখে অব্যক্ত ত্রাস গণুদার। রাগের মুখোশটা একটানে খুলে নিয়ে তারই আতঙ্কগ্রস্ত মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে যেন।
তাকে আমি চিনি। তাকে কোথায় পাওয়া যাবে এখন?
আমি জানি না, আমি কিছু জানি না। নিজেকে টেনে তোলার শেষ উগ্র চেষ্টা গণুদার।
ধীরাপদ অপেক্ষা করল একটু। তারপর যাবার জন্য পা বাড়িয়েও ফিরল একবার। তেমনি অনুচ্চ কঠিন স্বরে বলল, পুলিস আপনার মুখ থেকে কথা বার করতে পারবে।
জোর গেল, পায়ের নিচে মাটি নড়ল, সব ক-টা স্নায়ু একসী মুখ থুবড়ে পড়ল। হঠাৎ দু হাতে ধীরাপদর হাত দুটো আঁকড়ে ধরল গণুদা, সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠল, গলা জিভ ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ।
আমাকে বাঁচাও ধীরু। ওই লোকটা ঠিক এই করবে আমি জানতুম না। আমাকে ‘বাঁচাও ধীরুভাই!
লোকটা ধরা পড়েছে আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে। সঙ্গে একটা সুসংবদ্ধ পলের হদিস পাওয়া গেছে।
কুমুকে থানায় আনা হয়েছে। আরো কয়েকটি নিখোঁজ মেয়ের সন্ধান মিলেছে। আর, একাদশী শিকদারের খবরের কাগজ পড়ার তৃষ্ণা বরাবরকার মত মিটে গেছে।
রহস্যটা দিনের আলোর মতই স্পষ্ট এখন। তিনি ঘরের কোণে সেঁধিয়েছেন আর তাঁকে কোনদিন কাগজের প্রত্যাশায় উন্মুখ আগ্রহে কদমতলার বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখা যাবে না। যে ত্রাসে সকালে উঠেই তিনি কাগজ হাতে নিতেন আর যেটুকু খবরের ওপর চোখ বুলিয়েই সেই দিনটার মত নিশ্চিন্ত হতে পারতেন—চকচকে স্যুট পরা ঘাস-রঙের সিগারেটের টিন হাতে লোকটাকে পুলিস জালে আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সব কিছুর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
লোকটা একাদশী শিকদারের ছেলে!
গণুদাকে সনাক্ত করার জন্য পুলিস সেই ছেলেকে সুলতান কুঠিতে নিয়ে এসেছে। বাঁচার তাড়নায় বিপর্যয়ের মুখে লোকটা গণুদাকেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে। ঘটনাটা সাবালিকার প্রতি একটা বিচ্ছিন্ন মোহ প্রমাণ করতে পারলে তার শাস্তি লাঘবের সম্ভাবনা। তার বক্তব্য, মেয়েটাকে গদাই তার হাতে তুলে দিয়েছে। আর, মেয়েটাও স্বেচ্ছায় এসেছে।
সেই একদিন ঘরের কোণ থেকে একাদশী শিকদারকেও টেনে বার করেছে পুলিস। জেরা করেছে। মামুলী জেরা। শিকদারমশাই সব কথার জবাব দিয়ে উঠতে পারেননি। চেষ্টা করেছেন, মুখ নড়েছে, ঠোঁট দুটো নড়েছে—স্বর বেরোয়নি। কোটরাগত চোখ দুটো ছেলের সর্বাঙ্গে ওঠানামা করেছে। ধীরাপদ আড়ষ্ট হয়ে দেখছিল, হঠাৎ চোরের মারের কথা মনে পড়েছে তার! একাদশী শিকদারের সেই অসহায় উদভ্রান্ত উত্তেজনারও হদিস মিলেছে। চোরের জায়গায় নিজের অপরাধী ছেলেকে বসিয়ে জনতার বিচারের বিভীষিকা দেখেছিলেন তিনি।…শকুনি ভটচাযকে তোয়াজ করে চলতেন কেন একাদশী শিকদার? গোপনে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করাতেন তাঁকে দিয়ে—কারো মঙ্গলের জন্য, হয়ত বা কারো সুমতির জন্যও। রমণী পণ্ডিতের বদ্ধ ধারণা, শকুনি ভটচায কিন্তু দুর্বলতার আভাস পেয়েছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুতেও শিকদার মশাইকে শোকগ্রস্ত মনে হয়নি তেমন।
ধারণাটা এমন নির্মম সত্যের আগুনে দগদগিয়ে উঠতে পারে কেউ ভাবেনি। ছেলেকে নয়, দু চোখ টান করে একাদশী শিকদারকেই দেখছিল ধীরাপদ। মৃত্যুছোঁয়া ঘোলাটে চোখের তারায় আর বলির ভাঁজে ভাঁজে স্নেহের অক্ষরে বিধাতার অভিশাপ রচনা দেখছিল।
কুমু ভয় পেয়েছিল। অন্যথায় একাদশী শিকদারের ছেলের একার জবাবদিহিতে গণুদা এতটা জড়িয়ে পড়ত কিনা বলা যায় না। কিন্তু মেয়েটা মারাত্মক ভয় পেয়েছিল। পুরুষের যে মোহ এতদিন সে রঙিন বস্তু বলে জেনে এসেছে এই কটা দিনে তার বীভৎস নিষ্ঠুরতার দিকটাও দেখা হয়ে গেছে বোধ হয়। তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসার পরেও নিরাপদ বোধ করছিল না, আসামীর সামনে বসে কাঁপছিল থরথর করে। সেই দিশাহারা চাউনি দেখে ধীরাপদর মনে হয়েছে, তখনো মাংস-লোলুপ একটা নেকড়ের সামনেই বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।
পরে কুমুর ভীতত্রস্ত জবানবন্দি থেকে পুলিসের খাতায় একটা বিস্তৃত সন্ধানের উপকরণ সংগ্রহ হয়েছে। শুধু নিপীড়ন নির্যাতন নয়, অনেক রকমের ভয় দেখিয়ে দলের একজনের স্ত্রী সাজিয়ে আসামী কুমুকে বাইরে চালান দেবার ব্যবস্থা করেছিল। পুলিসের জেরায় গণুদার নামটাও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। লোকটার সঙ্গে গণুদাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল, তার বিশেষ বন্ধু, মস্ত কারবারী—এই বন্ধু সদয় থাকলে কুমুর আর ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে হবে না। পুলিসের একটা ঈষদুষ্ণ ধমক খেয়ে কুমু স্বীকার করেছে, অকারণে একবার গণুদা তাকে টাকাও কিছু দিয়েছে।
গণুদাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।
তার আগে ঘটনার একটা মোটামুটি আভাস ধীরাপদ পেয়েছে। প্রাণের দায়ে গণুদা যা বলেছিল তা মিথ্যে নয় হয়ত। মেয়েরা যে ফার্মে বেতের ঝুড়ি কার্ডবোর্ড বাক্স ইত্যাদি বানায় একাদশী শিকদারের ওই ছেলেকে প্রায়ই সেখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যেত। কার ছেলে সেটা জানা গেছে লোকটাকে পুলিসে ধরার পর। গণুদাও সেখানে চাকরির চেষ্টায় আসত প্রায়ই। নিজেকে লোকটা একজন বড় কনট্রাকটর বলে পরিচয় দিয়েছিল। সেধে গণুদার সঙ্গে আলাপ করেছে, সে আলাপ ঘনিষ্ঠ হতেও সময় লাগেনি। তাকে সুদিনের আশ্বাস দিয়েছে আর দফায় দফায় টাকাও দিয়েছে। একটা মেয়ের সঙ্গে খাতির করার লোভে এভাবে টাকা কেউ দিতে পারে গণুদার ধারণা ছিল না। বড়লোকের যেমন রোগ থাকে তেমনি রোগ ভেবেছিল। পণ্ডিতের ওই মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র যা, দুদিন আগে হোক পরে হোক তার সাহায্য ছাড়াও লোকটা তাকে হাত করবেই জানত। ভাই ফালতু আসছে ভেবে নির্বোধের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিয়েছে গণুদা, অভাবের তাড়নায় লোভ সামলাতে পারেনি।…কিন্তু এ যে এত বড় ষড়যন্ত্রের ব্যাপার সে কল্পনাও করেনি।
প্রধান আসামীসহ গণুদাকে অদূরের পুলিসভ্যানে চালান দিয়ে অফিসার ভদ্রলোক আবার দাওয়ায় ফিরে এলেন সোনাবউদির স্টেটমেন্ট নেবার জন্য। ধীরাপদর তড়িতাহত বোধশক্তি এতক্ষণে একটা বিপরীত ঘায়ে সজাগ হল যেন। সোনাবউদি দরজা ধরে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে উমা, আর ছোট ছেলে দুটোর চোখেমুখে বোবা গ্রাস। সম্ভব হলে অফিসারটিকে ফেরাত ধীরাপদ। সম্ভব নয়, নিজের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বসালো তাঁকে। সোনাবউদিকে ডাকতে হল না, বাইরে এসে তার দিকে তাকাতেই বুঝল মুখের দিকে চেয়ে রইল একটু, তারপর নিজের অগোচরেই যেন এক পা দু পা করে এ ঘরে এসে দাঁড়াল।
এক অব্যক্ত বেদনায় ধীরাপদর তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল সেদিকে; অন্য দিকেই মুখ ফিরিয়েছিল। কিন্তু সোন বউদির মুখে জেরার জবাব শুনে সশঙ্কে ফিরে তাকায়নি শুধু, সম্ভব হলে হাতে করে তার মুখ চাপা দিত। ঠিক এ ধরনের জবাব পাবেন অফিসারটি আশা করেননি হয়ত, মুখে প্রশ্ন করেছেন, হাতের পেন্সিল দ্রুত চলছে। সোনাবউদির চোখে পলক পড়ছে না, প্রায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে সমস্ত জেরারই উত্তর দিচ্ছে। ধীর অনুচ্চ, কিন্তু এত স্পষ্ট সত্য যে ধীরাপদর উদ্বেগভরা দুই চোখে শুধু নিষেধের ভাষা। সোনাবউদি তা দেখেনি, একবার তাকায়ওনি তার দিকে।
সুযোগ বুঝে ক্রমশ স্থূল কলাকৌশল-বর্জিত হয়ে উঠতে লাগল জেরার ধরন। .সোজাসুজি, স্পষ্টাস্পষ্টি।— গণুদার কতদিন চাকরি গেছে, কি কি অপরাধে এতকালের চাকরি গেল, রেস বা জুয়ার নেশা ছিল কিনা, মদ খেত কিনা—। সব প্রশ্নেরই জবাব অতি সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিপজ্জনক স্বীকৃতির মতই। যার প্রসঙ্গে বলা তার সঙ্গে কোনরকম ইষ্ট-অনিষ্টের যোগ নেই যেন সোনাবউদির।
এর পরের আচমকা প্রশ্নটা আরো অনাবৃত।—পণ্ডিত মশাইয়ের ওই মেয়েটির সঙ্গে আপনার স্বামীর ব্যবহার কি রকম দেখেছেন?
ভালো।
কি রকম ভালো?
তাকে সাহায্য করার আগ্রহ ছিল।
ধীরাপদ পটের ছবির মত দাঁড়িয়ে। পুলিশ অফিসার পরিভুষ্ট গাম্ভীর্যে নোট করলেন, তারপর নিঃসঙ্কোচে জেরাটা স্থুল বাস্তবের দিকে ঘুরিয়ে চলেছে কি করে?
তাঁর টাকাতেই।
তিনি টাকা পেলেন কোথায়?
ধীরাপদ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে, পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্বন্ধেও তেমনি মৃদু স্পষ্ট জবাব দিল, প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা ছিল।
ধীরাপদ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে, পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্বন্ধেও তেমনি সচেতন নয় যেন। এতক্ষণ সত্যি কথাই বলে এসেছে সোনাবউদি, কিন্তু এও কি সত্যি ভাববে? এদিকে পুলিশ অফিসারের দু চোখ অবিশ্বাসে ধারালো হয়ে উঠল, গলার স্বরও রুক্ষ শোনালো। বললেন, যা জিজ্ঞাসা করছি সত্যি জবাব দিন, বাজে কথা বলবেন না —মাসকয়েক আগে উনি নিজে থানায় এসে আমার কাছে ডায়রি করে গেছেন তাঁর প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা চুরি গেছে—
চুরি যায়নি।
পুলিস অফিসার ঝাঁজিয়ে উঠলেন, চুরি না গেলে লেখালেন কেন? সে টাকা কোথায়?
আমার কাছে।
ধীরাপদ হাঁ করে দেখছে আর শুনছে। কিন্তু সোনাবউদির মুখের দিকে চেয়ে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ওই মুখে কোনো ভয় কোনো দ্বিধা কোনো অনুভূতির লেশমাত্র নেই। নিষ্পলক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। জেরা ভূলে পুলিস অফিসারটিও নীরবে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন তাকে। এক কাজে এসে আর এক ব্যাপারে হদিস মিলবে ভাবেননি। সুর পাল্টে জিজ্ঞাসা করলেন, কত টাকা ছিল?
সাড়ে চার হাজার
এই ক’মাসে আপনার সব খরচ হয়ে যায়নি নিশ্চয়?
সোনাবউদি নিরুত্তর।
আর কত আছে?.
নিশ্চল মুহূর্ত দুই একটা, সোনাবউদি যন্ত্রচালিতের মত ফিরে দরজার দিকে অগ্রসর হতে গেল। কিন্তু তার আগেই বাধা পড়ল, কোথায় যাচ্ছেন?
অস্ফুট স্বরে সোনাবউদি বলল, নিয়ে আসছি।
সত্যি মিথ্যে যাচাই করার জন্য পুলিস অফিসার নিজেই বাকি টাকা দেখতে চাইতেন, এই উদ্দেশ্যেই এভাবে প্রশ্ন করা। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞ চোখে যাচাই হয়ে গেল বোধ হয়। বললেন, থাক, দরকার নেই। আপনি ও টাকা পেলেন কোথায়?
তাঁর কোটের পকেট থেকে।
কবে নিয়েছেন?
যেদিন তিনি পেয়েছেন।
তিনি টের পাননি?
না।
বিমুঢ় দৃষ্টিতে ধীরাপদ সোনাবউদির দিকেই চেয়ে আছে। কিন্তু তাকেও যেন ঠিক দেখছে না। তার মগজের মধ্যে তোলপাড় চলেছে কিছু একটার। সেই রাতের দৃশ্যটা চকিতে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। গণুদাকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সোনাবউদিকে চমকাতে দেখেছিল, তার চোখে ত্রাসের ছায়া দেখেছিল। রিকশভাড়া মিটিয়ে ফিরে আবার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সোনাবউদির অন্য মূর্তি দেখেছে। আর, প্রায় বেহুঁশ গণুদা খেদে ভেঙে পড়ছিল তখন…
পুলিস অফিসারের জেরা শেষ হয়েছে। এবারে ঈষৎ সদয় কণ্ঠেই বললেন, আচ্ছা আপনি যান।
সোনাবউদি যন্ত্রের মতই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। ধীরাপদর নির্বাক দৃষ্টিটা দরজা পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করল। পুলিস অফিসার এর পর তাকে কি দু-এক কথা জিজ্ঞাসা করেছেন খেয়াল নেই। তিনি চলে যাবার পরেও একা ঘরে ধীরাপদ কতক্ষণ বসেছিল হুঁশ নেই।…
দুটো মাস টানা-হেঁচড়ার পর কেস সেসানে গেছে।
এবারে আবার কম করে দু-তিন মাসের ধাক্কা! এ পর্যন্ত ব্যবস্থাপত্র যা করার ধীরাপদই করেছে। উকিলও সেই দিয়েছে। গণুদাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনতে চেষ্টা করা হয়েছিল, বিচারক সে আবেদন নাকচ করেছেন। ব্যবস্থাপত্রের ব্যাপারে সোনাবউদি এগিয়েও আসেনি, বাধাও দেয়নি। এমন কি দু মাসের মধ্যে ধীরাপদর সঙ্গে দুটো কথাও হয়নি। ধীরাপদ অনেকবার সুলতান কুঠিতে এসেছে। দরকারে এসেছে, বিনা দরকারেও। আসাটা কেমন করে সহজ হয়ে গেছে। বক্তব্য কিছু থাকলেও উমার মারফৎ বলে পাঠিয়েছে। নয়ত উমা আর তার ভাই দুটোকে নিয়ে সময় কাটিয়েছে।
সোনাবউদিকে প্রথম বিচারপর্বে হঠাৎ একদিন মাত্র কোর্টে দেখেছিল ধীরাপদ। কোর্ট থেকেই তাকে ডাকা হয়েছে ভেবেছিল। কিন্তু তাও নয়। পরে রমণী পণ্ডিতের মুখে শুনেছে নিজে থেকেই এসেছিল। চুপচাপ একধারে বসেছিল, ধীরাপদ সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু একটিও কথা হয়নি। তার নিষ্পলক দু চোখ আসামীর কাঠগড়ার দিকে। তারপর ঘণ্টাখানেক না যেতে হঠাৎ এক সময় লক্ষ্য করেছে সোনাবউদি নেই। রমণী পণ্ডিতের সঙ্গে এসেছিল, তাঁর সঙ্গেই চলে গেছে।
রমণী পণ্ডিত কেস করছেন না, কেস চালাচ্ছে সরকার। কিন্তু গোড়া থেকেই তাঁকে আর তাঁর মেয়েকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া চলেছে। কাঁদ কাঁদ মুখে রমণী পণ্ডিত অনেকবার ধীরাপদকে বলেছেন, যা হবার হয়ে গেছে, তিনি কারো ওপর প্রতিশোধ নিতে চান না, কোন উপায়ে কেস বন্ধ করা যায় কিনা। ধীরাপদ বিরক্ত হয়েছে, কিন্তু লোকটার দিকে চেয়ে কিছু বলতেও পারেনি। ওই বাতাহত মুখ যেন দুর্ভাগ্যে এই মানুষেরই প্রচ্ছন্ন অনুভূতির আবেগ লক্ষ্য করে। নিজের এত বড় ক্ষতি সত্ত্বেও মনে মনে উল্টে তিনিই যেন ওর কাছে অপরাধী হয়ে আছেন।
কেস সেসানে চালান হয়েছে, সোনাবউদিকে ডেকে ধীরাপদ সে খবরটা জানাবে কিনা ভাবছিল। সোনাবউদি ডাকলে আসবে, শুনবে, কিন্তু একটি কথাও বলবে না, একটা কথাও জিজ্ঞাসা করবে না। তার এই দুর্বহ নীরবতার সামনে ধীরাপদ সব থেকে বেশি অস্বস্তি বোধ করে।
উমা ঘরে এলো। তাঁর দু চোখ লাল। একটু আগে কেঁদেছে বোঝা যায়। একটু আধটু মারধরে মেয়েটা কাঁদে না বড়, বেশিই হয়েছে হয়ত।
মা বকেছে?
দাঁতে করে পাতলা ঠোঁট দুটো কামড়ে উমা প্রথমে সামলাতে চেষ্টা করল নিজেকে। না পেরে ধীরাপদর কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। বলল, বাবাকে ওরা ছেড়ে দিল না ধীরুকা?
উমার মাথার উপর হাতটা থেমে গেল ধীরাপদর। খবরটা তাহলে সোনাবউদি জেনেছে। রমণী পণ্ডিত জানিয়েছেন হয়ত। আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল কয়েক মুহূর্ত। এই মুহূর্তে ওই অমানুষকে হাতের কাছে পেলে কি করে সে? এই অবুঝ কচি মেয়ের বুকটা তাকে কি করে দেখায়?
তখনো সন্ধ্যা হয় নি। ঘরের আলোয় সবে টান ধরছে। দোরগোড়ায় সোনাবউদিকে দেখে ধীরাপদ ফিরে তাকালো। উমা তক্ষুনি উঠে মায়ের পাশ ঘেঁষে প্রস্থান করল। সোনাবউদি ঘরে ঢুকল। কিছু বলবে। কিছু বলার আছে। নইলে আসত না। দু মাসের মধ্যে নিজে থেকে আসেনি। আজই এলো বলে কৌতূহল ছেড়ে তলায় তলায় একটা অজ্ঞাত শঙ্কাই উঁকিঝুঁকি দিল।
শান্তমুখে সোনাবউদি বলল, আবার বিচার হবে শুনেছি…আপনি এ পর্যন্ত অনেক করেছেন, আর কিছু করতে হবে না।
ধীরাপদ নিরুত্তর। গণুদা যত অমানুষই হোক, এই সঙ্কটের মুহূর্তে অনেক সময়েই কেমন অকরুণ মনে হয়েছে সোনাবউদিকে। আজও মনে হল।
এ কথায় সে কান দেবে না—সেটা তার মুখ দেখে বোঝা গেছে কিনা জানে না। তেমনি শান্ত অথচ আরো স্পষ্ট স্বরে সোনাবউদি আবার বলল, এরপর যা হবার হবে, আপনি নিজের কাজ ফেলে এ নিয়ে আর ছোটাছুটি করেন আমার তা ইচ্ছে নয়।
সব সময় আপনার ইচ্ছেমতই চলতে হবে ভাবেন কেন?
ধীরাপদর আপন তো কেউ নয়, তার বলতে বাধা কি….। কথা ক’টা আপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, তারপর মাথা গোঁজ করে থেকেও সোনাবউদির নীরব দৃষ্টিটা মুখের ওপর অনুভব করেছে। কিন্তু একটু বাদে তেমনি শান্তু মৃদু জবাব শুনে সচকিত।
আপনি চলেন বলে ভাবি।
ধীরাপদ মুখ তুলেছে। তারপর চেয়েই আছে। ঘৃণা নয়, বিদ্বেষ নয়, ওই স্তব্ধতার গভীরে একটু যেন হাসির আভা দেখেছে। আর তারও গভীরে কোথায় যেন বহুদিনের আগের দেখা এক বিস্মৃতপ্রায় স্নেহ-সমুদ্রের সন্ধান পেয়েছে।
এই ব্যাপারে এ পর্যন্ত আপনার কত টাকা লেগেছে?
অতর্কিত ধাক্কা খেল, যদিও ঠিক এ প্রশ্নটা না হোক, তাকে আজ এ ঘরে আসতে দেখে এই গোছেরই কিছু একটা আশঙ্কা করেছিল। জবাব না দিয়ে ধীরাপদ অন্য দিকে চেয়ে রইল।
কত লাগল আমাকে জানাবেন। সোনাবউদি অপেক্ষা করল একটু, তারপর তার মনোভাব বুঝেই যেন আস্তে আস্তে আবারও বলল, আপনার কাছ থেকে আরো অনেক বড় ঋণই নেব, কিন্তু এই যন্ত্রণার বোঝা আর বাড়াতে চাই নে, এ টাকাটা তার সেই টাকা থেকেই দিয়ে ফেলতে চাই।
ধীরাপদর চকিত দৃষ্টি আবারও সোনাবউদির মুখের ওপর এসে থামল, তারপর প্রতীক্ষারত দুই চোখের কালো তারার গভীরে হারিয়ে গেল যেন।
সোনাবউদির এবারের কথা ক’টা আরো মৃদু, আরো শান্ত।—ওই টাকার জন্যে আপনার অনেক দুর্ভোগ হয়েছে। কিন্তু এত বড় অন্যায় আমি আর কার ওপরে করতে পারতুম?…টাকা আমি নিয়েছি জানতে পেলে ছেলেপুলে নিয়ে পরদিন থেকেই উপোস শুরু হত।
সোনাবউদি আর দাঁড়ায়নি।
একটা উষ্ণ তাপে ধীরাপদর কপালটা চিনচিন করছে। ঠাণ্ডা কিছু লাগাতে পারলে আরাম হত, ভালো লাগত।
…আরো ভালো লাগত, আরো ঠাণ্ডা হত, যে চলে গেল তার দুই পায়ের ওপর কপালটা খানিক রাখতে পারলে।