একুশ
পর পর ক’টা রাত ধীরাপদর ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে। পার্টিশনের ওধারে মাকের নাকের ঘড়ঘড়ানি বিরক্তিকর লেগেছে। সকাল হলেই ওকে অন্যত্র সরতে বলবে ভেবেছে। কিন্তু সকালের আলোয় নিজের দুর্বলতা চোখে পড়ে। হঠাৎ ঘুমের ওপর এমন দাবি কেন? সকাল হলে নিজেকেই পাশ কাটিয়ে চলে সে। থাক, ক’টা দিন আর, বড় সাহেব এলে তো চলেই যাবে এখান থেকে। এখনো ফিরছে না কেন আশ্চর্য! ফেরার সময় হয়ে গেছে।
মাঝরাতে সিঁড়ির ওধারে দাঁড়িয়ে অমিতাভ ঘোষের ঘরে আলোর আভাস দেখেছে। ও-ঘরে যে আলো জ্বলে এখন, সেটা ভোগের আলো নয়। এই তন্ময়তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বেখাপ্পা লাগে নিজেকে, ভিতরটা কুঁকড়ে যায়। পা এগোয় না, নিজের ঘরে ফিরে আসে আবার। নিজেকে ভোলায়, ভাবে কি দরকার একজনের নিবিষ্টতা পণ্ড করে? কিন্তু কদিন ভোলাবে? অনাবৃত সত্যের মুখ কদিন চাপা দেবে সে? আসলে ধীরাপদ চক্রবর্তী তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ। ওই মানুষকে তোমার মুখ দেখাতে সঙ্কোচ। ওই জন্যেই তোমার ঘুমের দাবি, ওই জন্যেই তোমার মানকের নাকের ডাক শুনে বিরক্তি, ওই জন্যেই এখন সুলতান কুঠিতে পালানোর বাসনা। সুলতান কুঠির অত নিঃসঙ্গতার মধ্যেও তোমার একটা আশ্রয় আছে ভাবো। গ্লানি আড়াল করতে পারার মত আশ্রয়।
নাড়াচাড়া খেয়ে সজাগ হয়ে ওঠে ধীরাপদ। এই অনুভূতিটাকেই বিধ্বস্ত করে ফেলতে চায় সে, নির্মূল করে দিতে চায়। কিসের আবার সঙ্কোচ? কিসের গ্লানি? হিমাংশুবাবুর মনোভাব বলতে গিয়ে পরোক্ষে অমিতাভ ঘোষের সম্পর্কেও লাবণ্যকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে সেই গ্লানি? বেশ করেছে। মন যা চেয়েছে তাই করেছে। শুনলে চারুদি এই প্রথম ওর কাজে খুশি হবেন বোধ হয়।…আর শুনলে তাঁর থেকেও বেশি খুশি হওয়ার কথা পার্বতীর।
ফ্যাক্টরী আঙ্গিনায় ঢুকে সদর্পে সেদিন প্রথমেই ওয়ার্কশপের দিকে চলল। অমিতাভ ঘোষ নেই। সেখানে জীবন সোম ইতিমধ্যে মোটামুটি দখল নিয়েছেন। কর্মচারীরাও অখুশি নয় তাঁর ওপর। এই লোকের সঙ্গে তাঁদের স্বার্থের ফারাক কম, নিজেদের মত করেই এঁকে তারা অনেকটা বুঝতে পারে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জায়গায় আধ ঘণ্টা মিটার দেখলে বা দু ঘণ্টার জায়গায় দেড় ঘণ্টা ‘হিট’ দিয়ে আধ ঘণ্টার ফুরসৎ লাভের চেষ্টা করলে ঘাড় থেকে মাথা ওড়ার দাখিল হয় না।
জীবন সোমের আপ্যায়ন এড়িয়ে ধীরাপদ মেন বিলডিংয়ের দিকে চলল। অমিত ঘোষকে মুখ দেখানোর তাগিদ। হয় অ্যানালিটিক্যাল নয়ত লাইব্রেরীতে আছে। আর না হলে খরগোশ নিয়ে পড়েছে। এই ক’টা দিনে গোটা তিনেক খরগোশের প্রাণান্ত হয়েছে। চীফ কেমিস্টের এই নতুন তন্ময়তা ধীরাপদ দূর থেকে লক্ষ্য করেছে।
অনুমান মিথ্যে নয়। ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় একটা খরগোস টেবিলের ওপর একতাল জড়স্তূপের মত পড়ে আছে। তার কান থেকে রক্ত টেনে রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা চলছে। ধীরাপদ পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল। সমঝদারের মতই চেয়ে চেয়ে দেখল খানিক।
আপনার আগের রোগী কেমন?
অমিতাভ মুখ তুলে তাকালো। দৃষ্টিটা ওর মুখের ওপর এক চক্কর ঘুরে আবার কাজের দিকে ফিরল। এটুকু অসহিষ্ণুতা থেকেই বোঝা গেল আগের রোগী অর্থাৎ আগের জীবটিরও ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। ধীরাপদ শোকের মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।
রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের কতদূর কি হল?
ধীরাপদর নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা, সে আমি কি জানি, কথাবার্তা তো মামার সঙ্গে হয়েছে আপনার—
উষ্ণ ব্যঙ্গ ঝরল এক পশলা, আপনি তো মামার ঘড়ির চেন এখন, জানতে চেষ্টা করুন। ওটা তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার।
কদিন বাদে সামনাসামনি এসে দাঁড়ানোর ফলে ধীরাপদর ভালো লাগছে। গম্ভীর মুখে তার দরকার আর নিজের কদর দুই-ই স্বীকার করে নিল যেন। বলল, তাহলে আপনি এসব কি করছেন না করছেন সব ভাল করে বোঝান আমাকে, আবেদন করুন, তদবির করুন; তারপর বিবেচনা করব।
জবাবে হ্যাঁচকা টানে নিশ্চেতন খরগোশটার কান ধরে সামনে নিয়ে এলো সে। ধীরাপদ আর দাঁড়ালে এটারও পরমায়ু এক্ষুনি শেষ হবে বোধ হয়। সহজ মুখ করেই বলল, চলি, এখনো ঘরে ঢুকিনি – আপনার হাতের কাজ শেষ হলে আসবেন, নয়তো ডেকে পাঠাবেন। আপনার তো দেখা পাওয়াই দায়।
ভুরু কুঁচকে খরগোশ পর্যবেক্ষণে রত। ধীরাপদ হলের ভিতর দিয়ে অদূরের দরজার দিকে এগোলো। কাছে এসে দাঁড়ানো গেছে, মুখ দেখানো হয়েছে। নিজের ওপর দখল বেড়েছে।
শুনুন-
ধীরাপদ ফিরে দাঁড়াল। কাছে আসার আগেই ঈষৎ তিক্ত-গাম্ভীর্যে অমিতাভ বলল, আপনাদের ওই গণুবাবু না গণেশবাবুকে আমার কাছে ঘোরাঘুরি করতে বারণ করে দেবেন, আমার দ্বারা কিছু হবে না।
ধীরাপদ অবাক। অতর্কিত প্রসঙ্গের তলকূল পেল না হঠাৎ। গণুবাবু মানে গণুদা তার অগোচরে এর কাছে ঘোরাঘুরি করছে! কিন্তু কেন? আরো কি আশা? গণুদা আত্মীয় নয়, কিন্তু তাঁরই মারফৎ যোগাযোগ বলে সম্মানে লাগলও একটু।
তিনি আবার আপনার কাছে ঘোরাঘুরি করছেন কেন?
অমিতাভ ঘোষ কাজে মন দিতে যাচ্ছিল, বিরক্ত হয়ে মুখ তুলল। কিন্তু ধীরাপদর মুখের দিকে চেয়ে ভ্রুকুটি গেল। কিছু জানে না বলেই মনে হল হয়ত। বলল, তার চাকরি গেছে। পুরনো কর্মচারী বলে বরখাস্ত করার আগে অফিস থেকে তিন-চারটে ওয়ার্নিং দিয়েছে, চুরি-জোচ্চুরি কিছু বাকি রাখেনি সে খোঁজ নিতে গিয়ে আমি অপ্রস্তুত।
পায়ের নিচে সত্যিই কি মাটি দুলছে ধীরাপদর? কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল তারো খেয়াল নেই। কখন নিজের ঘরে এসে বসেছে তাও না। মূর্তির মত বসেই আছে। .গণুদার চাকরি গেছে। কিন্তু গণুদার কথা একবারও ভাবছে না ধীরাপদ। সোনাবউদির সংসার-চিত্রটা চোখে ভাসছে। সোনাবউদির মুখ, উমার মুখ, ছোট ছোট ছেলে দুটোর মুখ। শেষে সকলকে ছাড়িয়ে শুধু সোনাবউদির মুখ। যে সোনাবউদি সংসারের অনটন সত্ত্বেও অন্যের দেওয়া বাড়তি টাকা সরিয়ে রেখে কুকার কেনার নাম করে ফিরিয়ে দেয়। যে সোনাবউদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপোস দেখবে তবু হাত পাতবে না।
এই মুহূর্তে ধীরাপদর সলতান কুঠিতে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। গিয়ে বলতে, ইচ্ছে করছে, সোনাবউদি তুমি কিছু ভেবো না; আমি তো আছি। রণু হলে তাই করত, তাই বলত। কিন্তু এই এক ব্যাপারে সোনাবউদি রণুর থেকে অনেক তফাত করে দেখবে ওকে, অনেক নির্মম তফাতে ঠেলে দেবে।
তবু নিশ্চেষ্ট বসে থাকা গেল না। বিকেলের দিকে গণুদার কাগজের অফিসে এলো খোঁজখবর নিতে। কি হয়েছে, কেন হয়েছে, কবে হয়েছে জানা দরকার। কিন্তু খবর করতে এসে ধীরাপদ পালাতে পারলে বাঁচে। হেন সহকর্মী নেই যার কাছে গণুদা দু-দশ-বিশ টাকা ধারে না। এমন কি দীর্ঘদিনের চেনা ওপরঅলাদের অনেকের কাছ থেকেও ভাঁওতা দিয়ে টাকা ধার করেছে নাকি। সে টাকায় জুয়া খেলেছে, রেস খেলেছে। কাজ-কর্মও ফাঁকির ওপর চলছিল। কিন্তু এটুকু অপরাধে কাগজের অফিসের চাকরি যায় না। লেখা ছাপা খবর ছাপার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রত্যাশী লোকের কাছ থেকে টাকা খেতে শুরু করেছিল গণুদা। পুরনো লোক, তাই ওপরঅলারা ডেকে অনেকবার সাবধান করেছেন। কিন্তু এমন মতিচ্ছন্ন হলে কে আর তাকে বাঁচাবে? শুধু চাকরি খুইয়ে বেঁচেছে এই ঢের। চাকরি গেছে তাও দশ-বারো দিন হয়ে গেল।
গণুদা কেন তাকে ডিঙিয়ে সোজা অমিতাভ ঘোষকে ধরেছিল বোঝা গেল। সেখান থেকে নিরাশ হয়ে এবারে হয়ত তার কাছে আসবে। এলে শুধু নিরাশ হওয়া নয়, কপালে আরো কিছু দুর্ভোগ আছে। এর থেকে গদার মৃত্যুসংবাদ পেলেও ধীরাপদ এত অসহায় পঙ্গু বোধ করত না। কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে সুলতান কুঠির দিকেই এসেছে। কিন্তু সুলতান কুঠি পর্যন্ত পা চলেনি। দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। কি করতে যাবে সে, কি বলতে কি দেখতে…। কিছু করা যাবে না, কিছু বলা যাবে না। দেখার যা সেটা না গিয়েও দেখতে পাচ্ছে। এক পরিবারের অনশনের পরিপূর্ণ চিত্রের ওপর সোনাবউদির স্তব্ধকঠিন মুখখানা সারাক্ষণই দেখতে পাচ্ছে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আজ কেন জানি ভয়ই করছে ধীরাপদর। সে ফিরে গেছে।
একে একে তিন-চারটে দিন গেল, গদা আসেনি। এসে ফল হবে না বুঝেছে বোধ হয়। কিংবা রমণী পণ্ডিত হয়ত আর কোনো লোভের রাস্তা দেখিয়েছেন তাকে। মানুষের কাঁধে শনি ভর করে শুনেছে। গণুদার কাঁধে রমণী পণ্ডিত শনি। কিছুকাল আগের সোনাবউদির একটা কথা বুকের তলায় খচখচ করে উঠল, বাতাস শুষে নিতে লাগল। যেদিন জয়েন্ট লাইফ ইনসিওরেন্স হয়েছিল দুজনার আর তারপরে আগের মত একসঙ্গে খাওয়ার কথা বলতে এসে গণুদা ওর তাড়া খেয়ে পালিয়েছিল—কথাটা সেইদিন বলেছিল সোনাবউদি। ধীরাপদ কৈফিয়ৎ চেয়েছিল, গণুদার চাকরির উন্নতি হয়েছে বলে তার ওপর রাগ কেন? সোনাবউদি প্রথমে ঠাট্টা করেছিল, পরে অন্যমনস্কের মত বলেছিল, রাগ নয়, কি জানি কি ভয় একটা, অনেক লোভে শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষতি, বোধ হয় সেই ভয়।
অনেক লোভে সেই অনেক ক্ষতিই হয়ে গেল শেষে।
বড় সাহেবের ফেরার অপেক্ষা। ধীরাপদ উদগ্রীব হয়েই প্রতীক্ষা করছে। তিনি এলে ওর সুলতান কুঠিতে ফিরে যাওয়া কিছুটা সহজ হবে। কাজের তাগিদে ঘর ছাড়তে হয়েছিল, কাজ শেষ হলে ঘরে ফিরেছে। কারো কিছু বলারও নেই, ভাববারও নেই। দু-চার ঘণ্টার জন্য গিয়ে ফিরে আসার থেকে সেটাই অনেক ভালো। কিন্তু সাত-আট দিন হয়ে গেল, বড় সাহেবের ফেরার লক্ষণ নেই। সেখানকার অনুষ্ঠান কবে শেষ হয়েছে। কাগজে তার বিবরণও বেরিয়েছে। এক শিল্প-বাণিজ্য সাপ্তাহিকে সপ্রশংস মন্তব্যসহ বড় সাহেবের স্পীচ গোটাগুটি ছাপা হয়েছে। একটা মেডিক্যাল জার্নালে ভেষজ-শিল্পে মিস্টার মিত্রের আশা-সঞ্চারী আলোকপাত প্রতিফলিত হয়েছে। বড় সাহেবের চিঠি না পেলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভাবত ধীরাপদ। তিনি লিখেছেন, খুব ভালো আছেন, ফিরতে দিনকতক দেরি হতে পারে। যতটা সম্ভব আগামী নির্বাচনের জমি নিড়িয়ে আসছেন হয়ত, নইলে দেরি হওয়ার কারণ নেই।
কিন্তু আছে কারণ। সেটা ধীরাপদকে কেউ চোখে খোঁচা দিয়ে দেখিয়ে না দিলে জানা হত না। দেখিয়ে দিল পার্বতী।
টেলিফোনে হঠাৎ গলার স্বর ঠাওর করতে পারেনি ধীরাপদ, অনেকটা সোনাবউদির মত ঠাণ্ডা গলা… মামাবাবু সুবিধেমত একবার এলে ভালো হয়, তার দু-একটা কথা ছিল।
ধীরাপদ বিকেলে যাবে বলেছে। টেলিফোন নামিয়ে রেখে অবাক হয়েছে। কৌতূহল সত্ত্বেও টেলিফোনে কি জানি কেন কিছুই জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারেনি।
টেলিফোনটা চারুদিই করালেন কিনা বুঝতে পারছে না, নইলে পার্বতীর কি কথা থাকতে পারে তার সঙ্গে?
পার্বতী বাইরের ঘরেই বসে ছিল। তার অপেক্ষাতেই ছিল হয়ত। পায়ের শব্দে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল না, বলল, বসুন—
এই মেয়ের মুখ দেখে কোনদিন কিছু বোঝার উপায় নেই। ধীরাপদ বসল। —কি ব্যাপার, চারুদির শরীর ভালো তো?
পার্বতী কথা খরচ না করে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ ভালো। শান্ত মন্থর গতিতে ভিতরের দরজার দিকে এগোলো।
শোনো—। ধীরাপদর খটকা লাগল কেমন, বলল, আমি চা-টা কিছু খাব না কিন্তু, খেয়ে এসেছি।…চারুদি বাড়ি নেই?
পার্বতী দরজার কাছেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চোখ দুটো তার মুখের ওপর স্থির হল একটু। মাথা নাড়ল আবারও। বাড়ি নেই। পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল আবার। কর্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তাকে ডেকে আনার দরুন ধীরাপদ বিরূপ না হলেও অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। – বোসো, কি কথা আছে বলছিলে?
পার্বতী বসল। সোফায় ঠেস দিয়ে নয়, দাঁড়িয়ে থাকার মত স্থির ঋজু। দ্বিধাশূন্য দৃষ্টিটা ধীরাপদর মুখের ওপর এসে থামল। বলল, সেদিন আমাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে আপনার কিছু কথা হয়ে থাকবে।…কি কথা, আমার জানার একটু দরকার হয়েছে। ধীরাপদর অস্বস্তি বাড়লো আরো।—তিনি কোনরকম দুর্ব্যবহার করেছেন তোমার সঙ্গে?
না। মাথা নাড়ল, ভালো ব্যবহার করেছেন। আমার সেটা আরো খারাপ লেগেছে। হয়ত বলতে চায় মায়ের ব্যবহার এরপরে আরো কৃত্রিম লেগেছে। বিব্রত ভাবটা হাসি চাপা দিতে চেষ্টা করল ধীরাপদ, বলল, তোমার খারাপ লাগার মত আমি তাঁকে কিছু বলতে পারি মনে করো নাকি?
এও কৃত্রিম কথাই যেন কিছু। পার্বতী চুপচাপ অপেক্ষা করল একটু, তারপর আবার বলল, আপনার সঙ্গে মায়ের কি কথা হয়েছে জানতে পেলে ভালো হত।
সেদিনও আর একজন ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বড় সাহেবের সঙ্গে তার কি কথা হয়েছে জানতে পেলে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিতে সুবিধে হত। লাবণ্যর সঙ্গে পার্বতীর এই জানতে চাওয়ার সুরে তফাৎ নেই খুব, কিন্তু তবু কোথায় যেন অনেক তফাৎ। জেনে সেই একজন বুঝে চলবে, আর এই একজন যেন সব বোঝাবুঝির অবসান করে দেবে। কি হয়েছে ধীরাপদ জানে না, কিন্তু এই নিরুত্তাপ মুখের দিকে চেয়ে অস্তস্তলের দাহ অনুভব করতে পারে। কিছু না জেনেও ধীরাপদ সেটুকু মুছে দেবার জন্যে ব্যগ্র। হাসিমুখেই বলল, তাহলে চারুদি আসুক, আমি অপেক্ষা করছি —তাঁর সামনেই শুনো কি কথা হয়েছে।
পার্বতী বলল, মা এখানে নেই। কানপুরে গেছেন।
ধীরাপদর বোকার মতই বিস্ময়, সে কি। বড় সাহেবের সঙ্গে? প্রশ্নটা করে ফেলে নিজেই অপ্রস্তুত একটু। সেদিন অমন ধাক্কা খাওয়ার পর চারুদি অনেকক্ষণ চুপচাপ কি ভেবেছিলেন মনে পড়ল, তারপর বড় সাহেব কবে যাচ্ছেন খোঁজ নিয়েছিলেন।
মুখের দিকে চেয়ে থেকে পার্বতী তেমনি নির্লিপ্ত গলায় আবার বলল, যাবার আগে তিনি বাড়ির দলিল আর ব্যাঙ্কের বইগুলো সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। আর টেলিফোনে বড় সাহেবকে তাঁর নামের ব্যবসায়ের কি সব কাগজপত্র সঙ্গে নিতে বলেছেন শুনেছি। আমাকে শাসিয়ে গেছেন, আমি মরলেও তোর কোনো ভাবনা নেই।
কথাবার্তায় পার্বতীর এই যান্ত্রিক মিতব্যয়িতার নিগূঢ় তাৎপর্য ধীরাপদ আর এক দিনও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে গিয়েছিল। আজও কি বলবে ভেবে না পেয়ে শেষে হাসতেই চেষ্টা করল।—তাহলে ভাবছ কেন?
মা অন্যায় কিছু প্রস্তাব করবেন আর বড় সাহেবকে দিয়ে অন্যায় কিছু স্বীকার করিয়ে নেবেন। নইলে বাড়ির দলিল নিতেন না। ব্যবসায়ের কাগজপত্রও সঙ্গে করে নিতে বলতেন না।
ধীরাপদই যেন কানাগলির দেয়ালে পিঠ দিয়েছে। বলল, অন্যায় মনে হলে বড় সাহেব তা করবেন কেন?
মা কাছে থাকলে করবেন। মা করাতে পারেন।
কানের কাছটা হঠাৎ গরম ঠেকতে ধীরাপদ বিব্রত বোধ করতে লাগল। রমণীর জোরের এই অনাবৃত দিকটার দিকে নিভৃতের দু চোখ ধাওয়া করতে চাইছে। সেই চোখ দুটো জোর করেই সামনের দিকে ফেরালো সে। পার্বতী নির্বিকার তেমনি। যেন যন্ত্রের মুখ দিয়ে দুটো নির্ভুল যান্ত্রিক কথা নির্গত হয়েছে শুধু, তার বেশি কিছু নয়।
স্বল্পক্ষণের নীরবতাও ভারী ঠেকছে। ধীরাপদ আস্তে আস্তে বলল, সেদিন চারুদির সঙ্গে আমার এ প্রসঙ্গে একটি কথাও হয়নি। নিজের ভুল শুধরে তিনি তোমাকে কাছে পাবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছেন হয়ত। তুমি সেটা অন্যায় ভাবছ কেন?
আমি কাছেই আছি, তিনি আমাকে তাড়াবার রাস্তা করছেন। আপনি দয়া করে এসব বন্ধ করুন। সম্পত্তি দিয়ে আমাকে ভোলাতে চেষ্টা করলে আরো ভুল হবে। তাঁর আমাকে কিছু দেবার নেই আমি জানি। সেজন্যে আমি তাঁকে কখনো দুষিনি।
এতগুলি কথা একসঙ্গে বলেনি পার্বতী। একটা একটা করে বলেছে। একটা ছেড়ে আর একটা বলেছে। ধীরাপদ অনেকক্ষণ ধরে শুনেছে যেন। অনেকক্ষণ ধরে কানে লেগে আছে। পার্বতীকে আর কিছু বোঝাতে চেষ্টা করে নি সে, কোনরকম আশ্বাসও দিয়ে আসেনি। এতখানি স্পষ্টভার মধ্যে কথা শুধু শব্দ হয়ে কানে বাজবে। চারুদি ওকে টোপের মত একজনের সামনে ঠেলে দিতে চেয়েছেন, সেইখানেই ওর আপত্তি, সেইজন্যেই বিরোধ। নইলে চারুদি কোথায় রিক্ত সে জানে। তাঁকে পার্বতী দুষবে কেন?
না, ধারাপদ ঠিক এভাবে ভাবেনি বটে কখনো। অভিযোগ পার্বতীর একজনের ওপরেই থাকা সম্ভব। সে অমিতাভ ঘোষ। যে মানুষটা তার জীবনের আঙ্গিনায় বার বার এগিয়ে এসেও আর এক দুর্বল পিছুটানে ফিরে ফিরে যাচ্ছে। আর সকলের অতি ভুচ্ছ পার্বতীর কাছে।
দায়ে পড়ে চারুদি সেদিন বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, অতীতের কোনো দাগ লেগে নেই ওর গায়ে— পার্বতীর আজকের পরিচয়টাই সব। কথাটা যে কত যথার্থ, ধীরাপদ আজ উপলব্ধি করছে। অনেক বিস্ময় সত্ত্বেও আর চারুদির নিরুপায় সুপারিশ সত্ত্বেও স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে এই পাহাড়ী মেয়েকে সেদিন অমিতাভ ঘোষের যোগ্য দোসর ভাবতে পারেনি সে। দোসর আজও ভাবছে কিনা জানে না, কিন্তু যোগ্যতার প্রশ্নটা মন থেকে নিঃশেষেই মুছে গেছে।
পথ চলতে চলতে ধীরাপদর কেমন মনে হল, অমিতাভ ঘোষের পিছুটানের ওই দুর্বল সুতোটাও ইচ্ছে করলে পার্বতী অনায়াসে ছিঁড়ে দিতে পারে। তা না দিয়ে সে শুধু দেখছে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের টানাপোড়েন দেখছে। এই দেখাটা নির্লিপ্ত বিদ্রুপের মত। পুরুষচিত্ত বিচলিত করে তোলার মত। হয়ত বা ঈষৎ উগ্র করে তোলার মতও।
সবে সন্ধ্যে তখন। এরই মধ্যে বাড়ি ফিরলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা বা মানুষের কচকচি শোনা ছাড়া আর কাজ নেই। দু-দুটো কাজের তাড়া মিটে যেতে অফিস ছুটির পরে অখণ্ড অবকাশ। কিন্তু আজ এক্ষুনি বাড়ি ফিরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও সময় ভালো কাটবে, সময় কাটানোর কিছু রসদ পার্বতী দিয়েছে। তবু এক্ষুনি ফেরার ইচ্ছে নেই ধীরাপদর, কারণ ও রসদ ঠুকরে ঠুকরে শেষে এক দুর্বল আসক্তির বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে নেই। তার অন্দরমহলের নিরাসক্ত দর্শকটি কবে নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছে। যখন-তখন সেই নিভৃতে হানা দিতে দ্বিধা এখন।
ধীরাপদ মেডিক্যাল হোমে এসে উপস্থিত। রমেন হালদারকে বাইরে ডেকে নেবে, তারপর বসবে কোথাও। তার কথা শোনা দরকার, শুনতে শুনতে তার মুখখানা বেশ ভালো করে দেখে নেওয়া দরকার, আর সব শেষে তাকে কিছু বলাও দরকার। এলো বটে, কিন্তু আসার তাগিদটা তেমন আর অনুভব করছিল না। বলার আছে কি, কাঞ্চন যাকে ভাবছে সে কাচ ছাড়া আর কিছু নয়— তাই বোঝাবে বসে বসে?
দোকানে সান্ধ্য-ভিড় লেগেছে। খদ্দেরের ভিড় আর লাবণ্যর রোগীর ভিড়। কিন্তু দোকানে ঢুকে একনজর তাকিয়েই বুঝল পার্টিশন-ঘরের ওধারে লাবণ্য অনুপস্থিত। অবশ্য তার আসার সময় উত্তরে যায়নি এখনো। মনে মনে ধীরাপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, তার সঙ্গে এখানে দেখা না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় ছিল কেন কে জানে।
কাউন্টারে রমেন হালদারকে দেখা গেল না। এদিক-ওদিক কোথাও না। ভিতরে থাকতে পারে। ধীরাপদ ভিতরে ঢুকে পড়বে কিনা ভাবল, কাঞ্চন কেমন কাজ করছে দেখে গেলে হয়। কিন্তু তার আগে ভিড়ের ফাঁকে ম্যানেজারের চোখ পড়েছে তার ওপর। ঈষৎ ব্যস্ততায় কাউন্টারের ওপাশ ঘুরে বেরিয়ে আসছেন তিনি। আজও ওকে দেখলে ভদ্রলোক বিব্রত বোধ করেন বেশ।
মিনিট পাঁচ-সাত দোকানে ছিল, তারপর বাড়ির দিকে পা বাড়াতে হয়েছে। রমেন আসেনি। ম্যানেজারের দ্বিধাগ্রস্ত দুই গোল চোখে ছেলেটার প্রতি অভিযোগের আভাস ছিল। ধীরাপদর নরম আচরণে ভরসা পেয়ে ভদ্রলোক সেটুকু ব্যক্ত করেছেন! প্রয়োজনে ওদের ডিউটি উলটে পালটে দিয়েছেন তিনি, রমেনের আর ওই কাঞ্চন মেয়েটির। মেয়েটির দশটা-পাঁচটা ডিউটি করেছেন। সে-ও আজ বাড়িতে জরুরী কাজের কথা জানিয়ে দুটোর সময় ছুটি নিয়ে চলে গেছে। রমেনের তিনটে থেকে দশটা ডিউটি, এখনো আসেনি যখন আর আসবেও না। কোনো খবরও দেয়নি। আগে দু-দশ মিনিটের ছুটি দরকার হলেও বলে রাখত, বলে যেত। এখন দু ঘণ্টা এদিক-ওদিক হলেও বলা দরকার মনে করে না। জিজ্ঞাসা করলে চুপ করে থাকে। শুধু জেনারেল সুপারভাইজার নয়, এখানকারও অনেকে ছেলেটাকে ভালবাসে! কিন্তু কিছুদিন হল ছেলেটার মতিগতি বদলাচ্ছে, বিশেষ করে ওই মেয়েটি এখানে চাকরিতে ঢোকার পর থেকে।
ধীরাপদ তেতে উঠেছিল, ওপরতলার উঁচু মেজাজে বলেছিল, আপনি রিপোর্ট করেন না কেন? বলেই মনে পড়ল রিপোর্ট উনি করেছেন, লাবণ্য সরকার ম্যানেজারের নাম করে এ প্রসঙ্গে তাকে দু-এক কথা বলেও ছিল।
ভদ্রলোক সেই কথাই জানালেন—রিপোর্ট করা হয়েছিল, শুনে মিস সরকার চুপ করে ছিলেন।
ম্যানেজার মুখে না বলুন, মনে মনে তিনি শুধু ওই মেয়েটিকেই দায়ী করেননি নিশ্চয়। একজনের প্রশ্রয় না থাকলে ছেলেটার চালচলন এভাবে বদলায় কি করে? ….খুব মিথ্যেও নয় বোধ হয়। না, আর প্রশ্রয় দেবে না ধীরাপদ, এর বিহিত করবে, কড়া কৈফিয়ৎ নেবে। কিন্তু বাড়ি পৌঁছবার আগেই রূঢ় সঙ্কল্পটা কখন এক বিপরীত বিশ্লেষণের মধ্যে নিরর্থক হয়ে গেল, নিজেও ভালো করে টের পায়নি। কৈফিয়ৎই বা কি নেবে, বিহিতই বা কি করবে? প্রবৃত্তির এ অমোঘ সম্মোহন থেকে কে কবে অব্যাহতি পেল? ও বস্তুটিকে লাগামের মুখে রাখার জন্যে মহাপুরুষদেরও কি কম চাবুক চালাতে হয়, কম ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়? ত্রিকালজ্ঞ ঋষিরও সত্তার কণায় কণায় কামনার কাঁপন লাগে কেন? চোখ কে কাকে রাঙাবে, নিয়মের রাস্তা খোলা না থাকলে অনিয়মের রাস্তায় না হেঁটে করবে কি রমেন হালদার?
ধারাপদর হাসি পাচ্ছে, রমণী নাকি অবলা, দুর্বল। কিন্তু ওইটুকুই বোধ হয় বিধাতার দেওয়া আত্মরক্ষার সেরা অস্ত্র তার। চরাচরের কোন জীবকে অস্ত্র না দিয়ে পাঠিয়েছে বিধাতা! কাউকে খোলস দিয়েছে, কাউকে নখদন্ত দিয়েছে, কাউকে বাহুবল দিয়েছে। রমণীকে অবলার খোলস দিয়েছে— ওটা খোলস। ওর আড়ালে সৃষ্টির আর বিপর্যয়ের শক্তি। খানিক আগে চারুদির অন্যায় কিছু প্রস্তাব করা বা বড় সাহেবকে দিয়ে অন্যায় কিছু স্বীকার করিয়ে নেওয়ার কথা বলছিল পার্বতী, আর ধীরাপদ বলেছিল, অন্যায় মনে হলে বড় সাহেব তা করবেন কেন? পার্বতী জবাব দিয়েছে, মা কাছে থাকলে করবেন। ‘মা করাতে পারেন।
ধারাপদর মনে হল, শুধু চারুদি নয়, পারে সকলেই—নারী মাত্রেই। চারুদি পারে, পার্বতী পারে, লাবণ্য সরকার পারে, সোনাবউদি পারে, রমণী পণ্ডিতের মেয়ে কুমু পারে, কারখানার শ্রমিক তানিস সর্দারের বউটা পারে, আর পথের অপুষ্টযৌবন পসারিণী কাঞ্চনও পারে। আওতার মধ্যে পেলে সকলেই পারে।
কানের কিছুটা গরম ঠেকতে ধারাপদ আত্মস্থ হল। যে কারণে নিজের অন্দরমহলে হানা দিতে দ্বিধা আজকাল, নিঃশব্দে সেদিকেই পদসঞ্চার ঘটছে অনুভব করা মাত্র চিন্তা-বিস্মৃতির ঝোঁক কাটল।
ঘরে ঢুকে জামার বোতাম খোলা হয়নি তখনো, মানকের আগমন ঘটল। তার দিকে একনজর চেয়েই ধারাপদর মনে হল সংবাদ আছে। অন্যথায় তার সদা- ক্ষুব্ধ মুখে নিস্পৃহ অভিব্যক্তি বড় দেখা যায় না। কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, বাবু খাবেন নাকি কিছু?
ধীরাপদ মাথা নাড়ল, এ সময়ে কিছু খাবে না!
এই জবাব মানকের জানাই ছিল, কর্তব্য-বোধে খোঁজ নেওয়া, এবারে ফিরলেই হয়। যাবার জন্য পা বাড়িয়েও ঘুরল আবার, এই রকমই রীতি তার। কথায় কথায় বলল, ছোট সাহেবের বেশ শরীর খারাপ হয়েছে বোধ হয় বাবু, সেই বিকেল থেকে শুয়ে আছেন। কেয়ার-টেক্ বাবু শুধোতে বললেন, শরীর ভালো না। এখনো শুয়ে আছেন, ঘরের বড় আলোটাও জ্বালেননি, সবুজ আলো জ্বলছে।
চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে ধীরাপদ অপেক্ষা করল একটু। মানকের ভীরু হাবভাব আর ঢোক গেলা দেখেই বোঝা যায় তার সমাচার শোনানো শেষ হয়নি। বলবে কি বলবে না সেই দ্বিধা, তারপর বলেই ফেলল, মেম- ডাক্তারও খবর পেয়েই দেখতে এয়েছেন বোধ হয়-
জামার বোতাম খোলা হল না ধীরাপদর, হাতটা আপনি নেমে এলো। জিজ্ঞাসা করল, কখন এসেছে?
এই তিন-পো ঘণ্টা হবে।
বাইরে কোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে নেই মনে হতে আবারও জিজ্ঞাসা করল, চলে গেছেন?
না, এখনো আছেন। যাই, ভাত চড়িয়ে এসেছি অনেকক্ষণ—
মানকের চকিত প্রস্থান। ধীরাপদ বিছানায় বসল, ভিতরে ওটা কিসের প্রতিক্রিয়া বোঝা দরকার। কিন্তু বোঝা হল না, কি একটা তাগিদ আবার তাকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে।…ছোট সাহেবের অসুস্থ হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়, মেম-ডাক্তারের দেখতে আসাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।…কিন্তু মাঝে তিন-পো ঘণ্টা সময় ডুবেছে…ছোট সাহেবের ঘরে সবুজ আলো জ্বলছে।
না, যে তাগিদটা অন্ধের মত ভিতর থেকে ঠেলছে, তাকে সে প্রশ্রয় দেবে না, কোনো ভদ্রলোকের তা দেওয়া উচিত নয়। তবু উঠে পায়ে পায়ে হলঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল সে। ধীরাপদ আসেনি, তার আসার ইচ্ছেও নেই —যে পতঙ্গ একদিন শিখা দেখেছিল, সে-ই ঠেলে নিয়ে এলো তাকে। আবার ওটা শিখার আঁচ পেয়েছে।
ধীরাপদ নিজেকে চোখ রাঙাল, ঘরের দিকে গলা ধাক্কা দিতে চেষ্টা করল বারকতক, তারপর সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগল। ঘরে এসে রাবার স্লিপার পরেছিল। শব্দ নেই। নিজের পায়ের শব্দ কানে এলেও হয়ত সচেতন হতে পারত, থামতে পারত। সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে আরো দ্রুত উঠতে লাগল, পাছে দহন-লোভী পতঙ্গটা ওর চোখরাঙানি দেখে ভয় পায়, হার মানে। কি হবে? মানকের মুখে অসুস্থতার খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি দেখতে এসেছে, বড় সাহেবের অনুপস্থিতিতে দেখতে আসাটা কর্তব্য ভেবেছে। মানকের চাকরি যাবে? চাকরি এখন কে কত নিতে পারে তার জানা আছে।
সিঁড়ির ডাইনের ঘরটায় সাদা আলো জ্বলছে। তারপর বড় সাহেবের ঘরটা অন্ধকার। তার ওধারে ছোট সাহেবের ঘর। বড় সাহেবের ঘরের মাঝামাঝি এসে পা দুটো স্থাণুর মত মাটির সঙ্গে আটকে থাকল খানিক, ছোট সাহেবের ঘরে সবুজ আলোই জ্বলছে এখনো, পুরু পরদার ফাঁকে সবুজ আলোর রেশ।
ধীরাপদ কখন এগিয়ে এসেছে জানে না, পরদাটা ক’আঙুল সরাতে পেরেছিল তাও না। আড়ষ্ট আঙুলের ফাঁক দিয়ে পরদাটা খসে গিয়ে আবার স্থির হয়েছে।… ঘরের দুজন পরদা নড়েছিল দেখেনি, পরদা দুলেছিল দেখেনি। দেখার কথাও নয়।
ধীরাপদ যা দেখেছে, তাও দেখবে ভাবেনি।
একটা চারপায়া কুশনে স্থিরমূর্তির মত বসে আছে লাবণ্য সরকার—কোন দিকে দৃষ্টি নেই তার। আর মেঝেতে জানু পেতে বসে ছোট ছেলের মত দু হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে কোলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে ছোট সাহেব সিতাংশু মিত্র। আহত ভুলুণ্ঠিতের মত সমর্পণের ব্যাকুলতায় দু হাতে সবলে তার কটি বেষ্টন করে কোলে মুখ গুঁজে আছে। মনে হয়, যা তাকে বোঝানো হয়েছে তা সে বুঝছে না বা বুঝতে চাইছে না। লাবণ্যর হাত দুটো তার মাথার ওপর…বিরূপ নয় হয়ত, কিন্তু সঙ্কল্পবদ্ধ।
সম্বিৎ ফিরতে ধীরাপদ চোরের মত নিঃশব্দে পালিয়ে এলো, নিচের ঘরে— একেবারে বিছানায়। নিজের বুকের ধকধকানি শুনতে পাচ্ছে। আড়ষ্ট নিস্পন্দের মত কতক্ষণ বসে ছিল ঠিক নেই।
শয্যা ছেড়ে নেমে এলো আবার হলঘরের বাইরে, অত দূরের সিঁড়ি ধরে কারো পায়ের শব্দ কানে আসেনি নিশ্চয়। কিন্তু আশ্চর্য, মন বলল নেমে আসছে কেউ, লাবণ্য সরকার ফিরে চলল। ধীরাপদ বাইরের দিকের জানালাটার কাছে এসে দাঁড়াল। মিথ্যে নয়, লাবণ্য সরকারই। আছা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না, ধীর মন্থর পায়ে হেঁটে চলেছে। কিন্তু ধীরাপদর চোখে অস্পষ্ট নয় কিছু। নিজের অগোচরে দু চোখ ধকধকিয়ে উঠেছে—ওই নারী যেন নিজেকে নিয়েই সম্পূর্ণ।
ফিরে এসে এতক্ষণে ঘরের আলো জ্বালল ধীরাপদ। টেবিলের সামনের চেয়ারটায় এসে বসল, টেবিল ল্যাম্পটাও খট করে জ্বেলে দিল। টেবিলে পড়ার মত বই নেই একটাও—নেই বলে বিরক্তি। মাসিকপত্র আছে দু-একটা, হাতের কাছে টেনে নিয়েও ওগুলোকে জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু মনে হল না। অফিসের ফাইলও আছে একটা, জরুরী নয়, সময় কাটানোর জন্যেই আনা—দেখে রাখতে ক্ষতি কি।
তাও বেশিক্ষণ পারা গেল না, অনুপস্থিত দৃষ্টি যে নিভৃতে বিচরণ করছে আর যে চিত্র লেহন করছে-সেখানে এই আলো নেই, এই টেবিল-চেয়ার নেই, ফাইল নেই—কিচ্ছু নেই। সেই ঘরে সবুজ আলো, কুশনে মূর্তিমতী যৌবন, মেঝেতে হাঁটু মুড়ে সেই যৌবনের কোলে মাথা খুঁড়ছে এক পুরুষ। ধীরাপদ দেখছে…রমণীর দেহতটে দুই বাহুর নিবিড় বেষ্টন দেখছে…দুই হাতের দশ আঙ্গুলের আকৃতি চোখে লেগে আছে।
চকিতে ধীরাপদ আর এক দফা টেনে তুলল নিজেকে, চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। মানকেটা সেই থেকে কি করছে, তাকে পেলেও হত—দুটো বাজে কথা বলা যেত আর দু’শ বাজে কথা শোনা যেত। একবার কেয়ার টেক্ বাবুর নামটা কানে তলে দিলে আধ ঘণ্টা নিশ্চিন্তি।
মানুকের খোঁজে বাইরে আসতে সিঁড়ির ওধারে চোখ গেল। অমিতাভ ঘোষ ফিরেছে, সামনের বড় ঘরটায় আলোর আভাস। কখন ফিরল আবার? ওই বিস্মৃতির মধ্যে ধীরাপদ কতক্ষণ তলিয়েছিল? মানকেকে বাতিল করে তাড়াতাড়ি ওদিকেই পা বাড়াল, একেবারে বিপরীত কিছুর মধ্যেই গিয়ে পড়া দরকার। মানকের থেকেও এই লোকের সঙ্গে লেগে সহজ হওয়া সহজ। অমিতাভ তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলেও একটুও আপত্তি হবে না, একটুও ক্ষুব্দ হবে না সে।
যা ভেবেছিল তাই—গবেষণা-চর্চায় বসে গেছে। বিছানার চতুর্দিকে ছড়ানো সেই বই আর চার্ট আর রেকর্ড। কিন্তু মেজাজ অপ্রসন্ন মনে হল না, হৃষ্টচিত্তে সিগারেট টানছে আর একটা গ্রাফের বাঁকাচোরা নক্সা দেখছে। সবে শুরু হয়ত, এখনো ভালো করে মন বসেনি—মন বসলে ভিন্ন মূর্তি।
কতক্ষণ এসেছেন? প্রথমেই এ প্রশ্নটা কেন বেরুল মুখ দিয়ে তা শুধু ধীরাপদই জানে।
এই তো। বসুন, কি খবর…
এক মুহূর্ত থমকালো ধীরাপদ, খবরটা দেবে নাকি? সঙ্গে সঙ্গে ভ্রুকুটিশাসনে সংযত করল নিজেকে, সামনের চেয়ারটার বইয়ের স্তূপ খানিকটা সরিয়ে বাকি আধখানায় বসল। তারপর গম্ভীর মুখে জবাব দিল, খবর ভালো। আজকের খরগোশটা প্রাণে বেঁচেছে, হিমোগ্লোবিন আশাপ্রদ, ব্লাডপ্রেসার উঠতির দিকে, বিহেভিয়ারও ভালো, পাগলামো কম করছে-
অমিতাভ ঘোষ হা-হা শব্দে হেসে উঠল! জবাবটা এত হাসির খোরাক হবে ভাবেনি, তেমনি গম্ভীর মুখে ধীরাপদ আবারও বলল, আচ্ছা মরে গেলে ওগুলোকে কি করেন, ফেলে দেন? খাওয়া যায় না? টাকাটাই তো—
সিগারেট মুখে অমিতাভ ঘোষ তার দিকে ঘুরে বসল। — পাঠিয়ে দেব আপনার কাছে, এরপর ইঁদুর গিনিপিগ বেড়াল বাঁদর অনেক কিছু লাগবে, সেগুলোও পাঠিয়ে দেব’খন। তরল ভ্রুকুটি গিয়ে কণ্ঠস্বর চড়ল, খাওয়াচ্ছি ভালো করে, ভালো চান তো মামাকে বলে আমার সব ব্যবস্থা চট ক’রে করে দিন।
মামাকে দিয়ে হবে না। ব্যবস্থাটা একটু চট করেই করা দরকার সেটা সেও অনুমোদন করল যেন, বলল, কালই ‘সি-এস-পি-সি-এ’কে একটা খবর দেব ভাবছি।
এবারেও রাগতে দেখা গেল না, হাসিমুখেই অমিতাভ বড় করে চোখ পাকালো, বলল, ওদের ছেড়ে আপনার ওপর হাত পাকাতে ইচ্ছে করছে। লঘু টিপ্পনী, কি হচ্ছে বুঝলে আপনি হয়ত সেধেই আত্মোৎসর্গ করতে আসবেন।
ধীরাপদর ভালো লাগছে, সুস্থ বোধ করছে। কিন্তু অপর দিকে পুঞ্জীভূত উদ্দীপনার উৎসটাতেই হঠাৎ নাড়া পড়ল যেন। সাগ্রহ বিপরীত উক্তি শোনা গেল মুখে, বোঝার ইচ্ছে থাকলে না বোঝারই বা কি আছে, আসলে কোনো ব্যাপারে ফ্যাক্টরীর কারো কোনো কৌতূহলই নেই—সেই ছকে বাঁধা সব কিছুতে গা ঢেলে বসে আছে, আর যেন কিছু করারও নেই ভাবারও নেই। আজই নাকি ধীরাপদর কথা ভাবছিল সে, আলোচনা করার কথা ভাবছিল—অনেক রকম রিসার্চের প্ল্যান মাথায় আছে তার, একটাও অসম্ভব কিছু নয়, তার মধ্যে সর্ব প্রথম যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, সেটা হল চিলেটেড আয়রন-
এবারে ধীরাপদ ভিতরে ভিতরে ঘাবড়েছে একটু। জলের মত সহজ বস্তুটা লোহার মতই তার গলায় আটকানোর দাখিল। ওদিকে উৎসাহের আতিশয্যে মোটা মোটা দু-তিনটে বই খোলা হয়ে গেল, খানিকটা করে পড়া হয়ে গেল, জার্নালে টান পড়ল, রেকর্ড আর চার্ট আর তথ্যের ফাইলে টান পড়ল। একাগ্র মনোযোগে বুঝতে না হোক শুনতে চেষ্টা করছে ধীরাপদ, আর মোটা কথাটা একেবারে যে না বুঝছে তাও না। আসল বক্তব্য, ওই ভেষজ পদার্থটি দেহগত নানা সমস্যার একটা বড় সমাধান, বিশেষ করে রক্তাল্পতার ব্যাপারে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র খুব চালু ওটা এখন, কিন্তু এ পর্যন্ত ওটা মুখে খেতে দেওয়া হচ্ছে— চীফ কেমিস্টের ধারণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওই দিয়ে ইন্ট্রামাসকুলার ইনজেকশন বার করতে পারলে তাতে অনেক বেশি সুফল হবে, আর কোম্পানীর দিক থেকে একটা মস্ত কাজও করা হবে।
-একবার লেগে গেলে কি ব্যাপার আপনি জানেন না। আশা-জমজমে উপসংহার। ধীরাপদ না জানুক শুনতে ভালো লাগছে, আর আশাটা দুরাশা নয়, উদ্দীপনা দেখে তাও ভাবতে ভাল লাগছে। সানন্দে সিগারেটের প্যাকেট খুলল অমিতাভ ঘোষ। সব বোঝাতে পারার তুষ্টি, সেই সঙ্গে পরিকল্পনায় মনের মতো একজন দোসর লাভেরও তুষ্টি বোধ হয়। বলল, ভাবলে এ রকম আরো কত কি করার আছে, কিন্তু একটা রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট না হলে কি করে কি হবে? শুধু মুদু দেরি হয়ে যাচ্ছে, কেউ তো আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকছে না—মামা এতদিন ধরে বাইরে কি করছে? কবে ফিরবে?
যে গ্রহের বক্র প্রভাব, চেষ্টা করে তাকে সোজা রাস্তায় চালানো সহজ নয়। ফস্ করে ধীরাপদ যা বলে বসল, এই আলোচনা আর এই উদ্দীপনার মুখে তা না বললেও চলত।
বলল, চারুদির পাল্লায় পড়েছেন, ফিরতে দেরি হতে পারে।
পুরু কাচের ওধারে অমিতাভর দৃষ্টিটা তার মুখের ওপর থমকালো একটু।— চারুমাসি কি করেছে?
না… ধীরাপদ ঢোক গিলল, তিনিও সঙ্গে গেছেন তো।
মামার সঙ্গে? কানপুরে?
বিস্ময়ের ধাক্কায় ধীরাপদ বিব্রত বোধ করছে, মুখের কথা খসলে ফেরে না, তবু আগের আলোচনার সুতো ধরে ফেরাতে চেষ্টা করল। জবাবে মাথা নাড়ল কি নাড়ল না। বলল, তা আপনার কি প্ল্যান কি স্কীম একটু খুলে বলুন না শুনি-
লোকটার সমস্ত আগ্রহে যেন আচমকা ছেদ পড়ে গেছে। সেই উদ্দীপনার মধ্যে ফেরার চেষ্টাও ব্যর্থ। জানালো, অনেকবার অনেক রকম প্ল্যান আর স্কীম ছক্কা হয়ে গেছে তার। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে তারই দু-একটা খুঁজল। কিন্তু মুখের দিকে এক নজর তাকালেই বোঝা যায়, খুঁজছে শুধু হাত দুটো— আসল মানুষটা আর কোথাও উধাও।
চারুমাসি একা গেছে?
প্রশ্ন এটা নয়, চারুদির পার্বতীও গেছে কিনা আসল প্রশ্ন সেটা। এই মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ একটু উতলা বোধ করছে কেন ধীরাপদর নিজের কাছেও স্পষ্ট নয় খুব। কবে যেন দেখেছিল…এই মুখ আর এই বেপরোয়া প্রত্যাশাভরা চোখ। নিরুপায়ের মত মাথা নাড়ল একটু, অর্থাৎ একাই—।
মনে পড়ল কবে দেখেছিল। মনে পড়ছে। এই মুখের দিকে আরো খানিক চেয়ে থাকলে আরো অনেক কিছু মনে পড়বে। কিন্তু ধীরাপদ মনে করতে চায় না।…অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে যেদিন চারুদির বাড়ি গিয়েছিল…সেদিনও চারুদি বাড়ি ছিল না, শুধু পার্বতী ছিল…এই মুখ আর চোখ সেদিন দেখেছিল। পার্বতী বিপন্নের মত সেদিন তাকে ধরে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু লোকটা প্রকারান্তরে তাকে বিদায় করতে চেয়েছিল। বিদায় করেও ছিল।…কিন্তু না, ধীরাপদ এসব কিচ্ছু মনে রাখতে চায় না।
অমিতাভর হাতে বিজ্ঞানের বই উঠে এলো। অর্থাৎ আজও প্রকারান্তরে তাকে যেতেই বলছে, বিদেয় হতে বলছে। কিন্তু এই বলাটুকুও যথেষ্ট নয়। মুখেই বলল, আচ্ছা, পরে একদিন আপনার সঙ্গে আলোচনা করব’খন, আজ থাক।
ব্যস, আর বসে থাকা চলে না। ধীরাপদ সেদিন যেভাবে চারুদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল আজও তেমনি করেই অমিতাভর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অবাঞ্ছিত, পরিত্যক্ত। কিন্তু সেদিন তারপর কি হয়েছিল ধীরাপদ ভাববে না। ঠাণ্ডার মধ্যে সুলতান কুঠির কুয়োতলায় গুবগুবিয়ে জল ঢেলে উঠেছিল, ঠাণ্ডা মাটিতে রাত কাটিয়েছিল, ঠাণ্ডা লাগিয়ে অসুখ বাধিয়েছিল—কিন্তু এসব ধীরাপদ কিছুই করেনি, আর কেউ তার কাঁধে চেপে বসেছিল, আর কেউ তাকে দিয়ে করিয়েছিল। তার ওপর ধীরাপদর দখল ছিল না।
দখল আজও নেই। দখল ছাড়িয়ে ভ্রুকুটি ছাড়িয়ে শাসন ছাড়িয়ে সেই আর কেউ তার ওপর অধিকার বিস্তারে উদ্যত। এধারের ঘরে এসে ধীরাপদ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
দশ মিনিট না যেতেই বিষম চমক আবার। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে সেই আর কেউ যেন ব্যঙ্গ করে উঠল তাকে। অত চমকাবার কি আছে, তুমি তো এরই প্রতীক্ষায় ছিলে, এই শব্দটার জন্যেই উৎকর্ণ হয়ে কান পেতে ছিলে।
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করার শব্দ। অমিতাভ ঘোষের পুরনো গাড়ির পরিচিত ঘড়ঘড় শব্দ। কারো হাতের চাবুক খেয়ে যেন গোঁ গোঁ করতে করতে সবেগে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। ধীরাপদ জানালার কাছে এসে দাঁড়াল একটু, শব্দটা দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। জানালা ছেড়ে দরজার কাছে এলো—সিঁড়ির ওধারের ঘরটা অন্ধকার।
সেদিন পার্বতীর প্রচ্ছন্ন নিষেধ সত্ত্বেও অমিতাভ ঘোষকে রেখে উঠে আসার মুহূর্তে ধীরাপদ তার চোখে নীরব ভর্ৎসনা দেখেছিল। আজ পার্বতী কি ভাববে? কার কাছ থেকে তার একলা থাকার খবর পেয়ে দুরস্ত দস্যুর মত লোকটা ছুটে গেল? কে ইন্ধন যোগালো?
কিন্তু পার্বতী কি ভাববে না ভাববে ধীরাপদ আর ভাবতে রাজি নয়। গায়ের জামাটা এখন পর্যন্ত খোলা হয়ে ওঠেনি, আর হলও না। আলোটা সহ্য হচ্ছে না, ভালো লাগছে না—খট করে আলোটা নিবিয়ে দিয়ে সটান বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। এমন হাস্যকর যোঝা ধীরাপদ নিজের সঙ্গে আর একটুও যুঝবে না। ওর ওপর আজও কেউ অধিকার বিস্তার করতে আসছে। আসুক। সেদিনের থেকেও অনেক জোরালো অনেক অবুঝ কেউ। আসুক, সে বাধা দেবে না।
এই বিকেল থেকে যা শুনেছে আর যা দেখেছে- প্রায় স্বেচ্ছায় সেই আবর্তনের মধ্যে তলিয়ে গেল কখন। পার্বতী বলছিল, চারুদি কাছে থাকলে অনেক অন্যায়ও বড় সাহেব করতে পারেন, চারুদি তা করাতে পারে। কোন জোরে পারে? ম্যানেজার বলছিল, ওই কাঞ্চন মেয়েটা চাকরিতে ঢোকার পর থেকে রমেন ছেলেটার মতিগতি বদলেছে। কেন বদলালো?…ঘরের আলো নিবিয়ে অন্ধকার দেখছে না ধীরাপদ, একটা পরদা সরিয়ে সবুজ আলো দেখছে। দু হাতে আঁকড়ে ধরে লাবণ্যের কোলে মুখ গুঁজে আছে সিতাংশু মিত্র-এক মুহূর্তের দেখায় একটা অনন্তকালের দেখা বাঁধা পড়ে গেছে। ভুলতে চাইলেই ভোলা যায়? সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা অদেখা দৃশ্যের পরদা সরানোর তাগিদ, যেখানে এক রমণীর একার নিভৃতে আর এক দুরন্ত দুর্বার পুরুষের পদার্পণ। সেই দৃশ্যটাই বা কেমন?
শুয়ে থাকা গেল না, একটা অশাস্ত্র শূন্যতার যাতনা যেন হাড়-পাঁজর-মজ্জার মধ্যে গিয়ে গিয়ে ঢুকছে। শুধু যাতনা নয়, জ্বালাও। শিখার চারধারের অবরোধে পতঙ্গের মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে আসার জ্বালা–নিঃশেষে জ্বলতে না পারার জ্বালা।
উঠল! একটু বাদেই মানকে খাবার তাগিদ দিতে আসবে। ভাবতেও বিরক্তি। এত বড় ঘরের সব বাতাস যেন টেনে নিয়েছে কে, বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করছে। অন্ধকারে জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। বাইরে থেকে একেবারে রাস্তায়।
কিন্তু যতটা বাতাস ধীরাপদর দরকার ততটা যেন এখানেও নেই—একটা ছোট গুমট ছেড়ে অনেক বড় গুমটের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে শুধু। হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা ট্যাক্সি ধেয়ে আসছে…খালি ট্যাক্সিই। ধীরাপদ যন্ত্রচালিতের মতই হাত দেখিয়েছে, তারপর সেই হাত বুকপকেটটা ছুঁয়ে দেখেছে। মানিব্যাগটা আছে। শুয়েছিল যখন, অলক্ষ্যে বিছানায় পড়ে থাকতেও পারত। পড়েনি, ষড়যন্ত্রে ফাঁক নেই। কিসের ষড়যন্ত্র ধীরাপদ জানে না, কিন্তু অমোঘ কিছু একটা বটেই। আগে পকেটে কিছুই থাকত না প্রায়, থাকলেও দু-চার আনা থাকত। এখন দু-চারশও থাকে ওটাতে, কেন থাকে কে জানে। খরচ করার দরকার হয় না, তবু থাকে নইলে ভালো লাগে না।
ট্যাক্সিটা থামল। ধীরাপদ উঠল। কোনো নির্দেশ না পেয়ে ট্যাক্সিটা যেদিকে যাচ্ছিল সেই পথেই ছুটল আবার। কিন্তু না, বাতাস আজ আর নেই-ই।
কতক্ষণ বাদে কোথায় নামল ধীরাপদর সঠিক হুঁশ নেই। কিন্তু নেমেছে ঠিকই। চেতনার অন্তস্তলে ষড়যন্ত্রে যারা মেতেছে তারা ওকে ঠিক জায়গাটিতেই নামিয়েছে। ট্যাক্সি বিদায় করে ধীরাপদ এগিয়ে চলল, সামনের অপরিসর রাস্তাগুলো এঁকেবেঁকে কোন দিকে মিশেছে ঠাওর করা শক্ত। সে চেষ্টাও করেনি। অদৃশ্য কারো হাত ধরে যেন একটা গোলকধাঁধার মধ্যে ঘুরে বেড়াল খানিকক্ষণ। প্রায় নিয়তির মতই কারো।
এখানকার রাত যত না স্পষ্ট তার থেকে অনেক বেশি রহস্যে ভরা, গোপন ইশারায় ভরা। দূরে দূরে এক-একটা পানের দোকান, পানওয়ালারা সোজাসুজি দেখছে না তাকে, বক্রদৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে। এদিকে-ওদিকে রাতের বুকে প্রেতের মত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে একজন দুজন—পরনে আধ-ময়লা পায়জামা, গায়ে শার্ট। তাদের চাউনিগুলোই বিশেষ করে বিঁধছে ধীরাপদর গায়ে পিঠে।
বাবু-
ধীরাপদ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, পিছনে চাপা গলায় ডাকছে কেউ। তাকেই ডাকছে। লোকটা আরো কাছে এসে তেমনি নিচু গলায় বলল, ভালো জায়গা আছে, যাবেন?
ধীরাপদ জবাব দেয়নি, জবাব দিতে পারেনি। হন হন করে হেঁটে এগিয়ে গেছে খানিকটা। আর একটা রাস্তার মোড় ঘুরে তারপর দাঁড়িয়েছে। ঘোর কেটেছে খানিকটা, চারদিকে তাকালো একবার। এসব রাস্তায় কখনো এসেছে কিনা মনে পড়ে না। কিন্তু অবচেতন মনের কেউ এসেছে, দেখেছে, চিনেছে। নইলে এলো কেমন করে? না, ঘর ছেড়ে কেউ দরজায় এসে দাঁড়িয়ে নেই। তারা কোথাও না কোথাও আত্মগোপন করে আছে। দেশের আইন বদলেছে, প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিলে আইনের কলে পড়তে হবে। তাদের হয়ে লোক ঘুরছে—তাদের জন্যে কারা ঘুরছে দেখলেই যারা বুঝতে পারে, সেই লোক।
আগের মূর্তির মতই আর একজন গুটিগুটি এগিয়ে আসছে তার দিকে। ধীরাপদ আবার দ্রুত পা চালালো। কিসের ভয় জানে না, জানে না বলে ভয়। অপেক্ষাকৃত একটা বড় রাস্তায় পা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অদূরে মোড়ের মাথায় দুটো লোক চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। দুজন নয়, চেঁচামেচি একজনই করছে, আর একজন অশ্লীল কটূক্তি করতে করতে তাকে ঠেলে একটা রিকশয় তুলে দিতে চেষ্টা করছে। লোকটা বদ্ধ মাতাল, হাত ছাড়িয়ে ঘাড়-মুখ গুঁজে মাটি আঁকড়ে ধরতে চাইছে। এই রাতের মত হয়ত তার ফুটপাথেই কাটানোর ইচ্ছে, কিন্তু অন্য লোকটার তাতে আপত্তি। ফুটপাথে লোক পড়ে থাকলে বা চেঁচামেচি হলে পুলিসের ভয়, শিকার ফসকানোর ভয়।
কোনদিকে না তাকিয়ে ধীরাপদ রিকশটার ওধার দিয়ে দ্রুত পাশ কাটাতে গেল।
অ ধীরু—ধীরুভাই—!
তড়িৎ-সৃষ্টের মত পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল। ধীরাপদ স্বপ্ন দেখছে না নিশির ডাক শুনছে? ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাবে না কাছে এসে দেখবে?
দেখলে দূরে থেকেও না চেনার কথা নয়। এ রকম আর্তনাদ না শুনুক, কণ্ঠস্বর অতি পরিচিত।
গণুদা! স্বপ্ন নয়, বিভ্রম নয়, নিশির ডাক নয়—গণুদা। গণদা ডাকছে তাকে।
ধীরাপদ স্তব্ধ, স্তম্ভিত। গণুদার গায়ে আধময়লা গলাবদ্ধ ছিটের কোট, পরনের ধুতিটা ফুটপাথের ধুলোমাটিতে বিবর্ণ। সমস্ত মুখ অস্বাভাবিক লাল, দু চোখ ঘোলাটে সাদা।
কাঁদ কাঁদ গলায় গণুদা বলে উঠল, ধীরুভাই আমাকে বাঁচাও, এরা আমাকে গুমখুন করতে নিয়ে যাচ্ছে—আমার ছেলেমেয়ে আছে, বউ আছে, ওরা বড় কাঁদবে, তোমার বউদি কাঁদবে।
নিজের অগোচরে ধীরাপদ দুই-এক পা সরে দাঁড়িয়েছে, নাকে একটা উগ্র গন্ধের ঝাঁজ লেগেছে। অস্পষ্ট জড়ানো কান্নার সুরে কথাগুলো বলতে বলতে গণুদা ফুটপাথে সটান শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। নিজের লোক পেয়ে নিশ্চিত্ত। যে লোকটা তাকে রিকশয় তোলার জন্য ধস্তাধস্তি করছিল সে হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে ধীরাপদকেই দেখছিল।
চোখোচোখি হতে অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বলল, একেবারে বেহুঁশ হয়ে পড়েছে, রিকশয় তুলে দিচ্ছিলাম।
রিকশওয়ালাটা এখানে এ ধরনের সওয়ারি টেনে অভ্যস্ত বোধ হয়, নির্লিপ্ত দর্শকের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ধীরাপদ ইশারায় কাছে ডাকল তাকে। ঘোর এতক্ষণে সম্পূর্ণই কেটেছে তার। অদৃশ্য ষড়যন্ত্রকারীরা কে কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে মিশে গেছে যেন। কেবল একটু শ্রান্তির মত লাগছে, অবসন্ন লাগছে। তা ছাড়া অফিসের ঠাণ্ডা-মাথা ধীরাপদ চক্রবর্তীর সঙ্গে খুব তফাত নেই।
রিকশাওয়ালার সাহায্যে গণুদাকে টেনে তোলা হল। অন্য লোকটা সরে গেছে। গণুদা চোখ টান করে তাকাতে চেষ্টা করল একবার, ধীরাপদকে দেখেই হয়ত রিকশায় উঠতে আপত্তি করল না। বিড়বিড় করে দু-এক কথা কি বলল, তারপর রিকশয় আর ধারাপদর কাঁধে গা এলিয়ে দিল।
রিকশ চলল। কিন্তু ভয়ানক অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে ধীরাপদ, গা-টা ঘুলোচ্ছে কেমন। গণুদার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গন্ধটা যেন তার নাকের ভিতর দিয়ে পেটের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। কম করে আধ ঘণ্টার পথ হবে এখান থেকে সুলতান কুঠি। আধ ঘণ্টা এভাবে এই লোকের সঙ্গে লেপটে চলা প্রায় আধ বছর ধরে চলার মতই। ভাবতেও অসহ্য লাগছে।
খানিকটা এগিয়ে সামনে আর একটা রিকশ দেখে, এটা থামিয়ে সেটাকে ডাকল। নেমে গণুদার অবশ দেহ আর মাথাটা ঠেলে ঠুলে ঠিক করে দিল। তারপর নিজে অন্য রিকশয় উঠল। গণুদার রিকশ আগে চলল, তারটা পিছনে। ধীরাপদ সুস্থবোধ করছে একটু।
ঠুনঠুন শব্দে রিকশ চলেছে, পথে লোক চলাচল নেই বললেই হয়। একজন দুজন যারা আসছে যাচ্ছে, তারা এক-আধবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে। তাকে দেখছে, গণুদাকে দেখছে। গোপনতার রহস্যে ভরা এই রাতটাও যেন তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। রাত কত এখন? ঘড়ি দেখল, মোটে সাড়ে দশটা। মনে হয় মাঝরাত। প্রায় এগারটা হবে সুলতান কুঠিতে পৌঁছুতে—সেটা সেখানকার মাঝরাতই।
সে সুলতান কুঠিতে যাচ্ছে এই গণুদাকে নিয়ে, যেখানে সোনাবউদি আছে। সোনাবউদির কাছেই যাচ্ছে। ভাবতে শুরু করলে আর যাওয়া হবে না বোধ হয়। অথচ যা ভাবতে চাইছে এখন—ভাবা যাচ্ছে, যা চাইছে না—তাও সব ভাবনা-চিন্তা থেকে মাথাটাকে ইচ্ছেমত ছুটি দেওয়া যায় না?
ধীরাপদ সেই চেষ্টাই করছে।
সুলতান কুঠি এসে গেল এক সময়। আসুক, ধীরাপদ অনেকটা নির্লিপ্ত হতে পেরেছে। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে মজা-দীঘির পাশ দিয়ে রিকশ সুলতান কুঠির নিস্তব্ধ আঙিনায় এসে ঢুকল। সোনাবউদির দাওয়ার সামনে থামল। ধীরাপদ আগে নেমে এসে বন্ধ দরজায় মৃদু টোকা দিল গোটাকয়েক।
ভিতরে কেউ জেগেই আছে। তক্ষুনি দরজা খোলার শব্দ হল।
দরজা খুলে আবছা অন্ধকারের প্রথমে ধীরাপদকে দেখেই সোনাবউদি বিষম চমকে উঠল।…আপনি।
সঙ্গে সঙ্গে বাইরে রিকশ দুটোর দিকে চোখ গেল। তারপরেই নির্বাক, পাথর একেবারে।
ধীরাপদ ফিরে এলো। রিকশ থেকে গণুদা নামলো। গণুদার হুঁশ নেই একটুও, প্রায় আলগা করেই টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে আসতে হল তাকে। সোনাবউদি ইতিমধ্যে ঘরের ডীম-করা হ্যারিকেনটা উসকে দিয়েছে। ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের বিছানার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত কাঠ হয়ে।
মেঝেটা পরিষ্কারই, ধীরাপদ মেঝেতেই বসিয়ে দিল গণুদাকে। গণুদা বসল না, সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। ধীরাপদর হাঁপ ধরে গেছে, মদের গন্ধটা সেই ফুটপাথে বা তারপরে খানিকক্ষণ এক রিকশয় বসেও যেন এখনকার মত এতটা উগ্র লাগেনি। ধীরাপদ সোজা হয়ে দাঁড়াল, মুখ তুলল, কিন্তু সোনাবউদির চোখে চোখ রাখা যাচ্ছে না—পাথরের মূর্তির মধ্যে শুধু দুটো চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। জ্বলছে না, সেই চোখে অজ্ঞাত আশঙ্কাও কি একটা।
রিকশভাড়া দিতে হবে, ধীরাপদ তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। নিঃশব্দেই ভাড়া মেটাতে গেল, দেড় টাকা করে তিনটে টাকা গুঁজে দিল একজনের হাতে। কিন্তু কোন্ দুর্বলতায় কাজে লেগেছে সেটা ওরা ভালই জানে। তিন টাকা পেয়ে তিন পয়সা পাওয়া মুখের মত হয়ে উঠল, সেই সঙ্গে মিলিত গলার প্রতিবাদের সূচনা। তাড়াতাড়ি টাকা তিনটে ফেরত না নিয়ে ধীরাপদ ওদের একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বাঁচল। সুলতান কুঠির এই রাত্রিও যেন গোপনতার রাত্রি— বচসা দূরে থাক, ধীরাপদ একটু শব্দও চায় না।
টাকা নিয়ে রিকশ সহ লোক দুটো চলে গেল। যতক্ষণ দেখা গেল তাদের চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল। তারপরেও সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল মিনিট তিন-চার। রাস্তার সেই ম্যাটমেটে আলো ভালো লাগছিল না, বারবনিতার চোখের মত লাগছিল। কিন্তু এখানে দ্বিগুণ অস্বস্তি, এখানে যেন ঠিক তেমনি বিপরীত অন্ধকারের উল্কি পরানো।
ঘরে যেতে হবে। সোনাবউদির সামনে। পায়ে পায়ে ঘরে এসে ঢুকল। সোনাবউদি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। গদা বেহুঁশ, অবস্থার একটু তারতম্য হয়েছে বোধ হয়, হাত- পা ছুঁড়ছে আর বিড়বিড় করে বকছে কি। পেটে যা আছে তা উদগীর্ণ হবার লক্ষণ কিনা ধীরাপদ সঠিক বুঝছে না।
সোনাবউদির আগুন-ঢালা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ কানে বিধতে ফিরে তাকালো। ঠিকই দেখছে, সোনাবউদি তাকেই যেন ভস্ম করবে। এখানে এনেছেন কেন? আপনার কি দরকার পড়েছিল এখানে তুলে আনার? আপনার কেন এত আস্পর্ধা? এক্ষুনি নিয়ে যান আমার চোখের সুমুখ থেকে, রাস্তায় রেখে আসুন—যেখানে খুশি রেখে আসুন। নিয়ে যান, যান যান, যান বলছি –
ধীরাপদ নিস্পন্দের মতো দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ে আছে। নিয়ে না গেলে, আর একটুও দেরি হলে, যে বলছে সে-ই এক্ষুনি ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবে বুঝি, বাইরের ওই অন্ধকারের মধ্যে বরাবরকার মতই মিশে যাবে। গণুদার নেশাও ধাক্কা খেয়েছে একটু, সখেদে কি বলছে, মাটি আঁকড়ে উঠে বসতে চাইছে।
ধীরাপদ হঠাৎ ভয় পেল। অস্ফুটস্বরে বলল, যাচ্ছি। চকিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পকেটে চাবির রিংটা আছে, ওতে পাশের ঘরের দ্বিতীয় চাবিটাও আছে। ঘর খুলল, একটা বন্ধ গুমট বাতাসের ঝাপটা লাগল গায়ে। একটা জানলা খুলে দিল। ফিরতে গিয়ে যথাস্থানে হ্যারিকেনটা আছে মনে হল। আছে। তেলও আছে, দেয়াল- তাকে দেশলাইও। আলো জ্বালল, বিছানাটার দিকে চোখ গেল একবার। অপরিচ্ছন্ন নয়, একটা বেডকভার দিয়ে ঢাকা। সোনাবউদির তদারকে ত্রুটি নেই।
গণুদা উঠে বসেছে কোনরকমে, কিন্তু দাঁড়ানোর শক্তি নেই। ধীরাপদকে দেখেই হাউ-মাউ কান্না, জড়িয়ে জড়িয়ে বলে উঠল, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল ধীরুভাই -নিজের পরিবারও পায়ে ধরতে দিলে না— ক্ষমা চাইতে দিলে না— সরে গেল— আমি আত্মহত্যা করব—আমাকে নিয়ে চল ধীরুভাই—
গণুদাকে টেনে তুলল, একটানা খেদ আর বিলাপ শুনতে শুনতে তাকে নিয়ে চলল। সোনাবউদির জ্বলন্ত চোখ ধীরাপদর মুখ পিঠ এখনো ঝলসে দিচ্ছে। নিজের ঘরের বিছানায় এনে বসালো গণুদাকে, তারপর জোর করেই শুইয়ে দিল। গায়ের গলাবন্ধ কোটটা খুলে দিলে ভালো হত, কিন্তু গণুদা শুয়ে পড়তে আর সে চেষ্টা করল না।
গণুদার খেদ আর বিলাপ চট করে থামল না। পরিবার যাকে ঘৃণা করে তার বেঁচে সুখ নেই, এ জীবন আর রাখবেই না গণুদা, আত্মহত্যা করবে, এতকালের চাকরিটা গেল তবু একটু দয়ামায়া নেই। না, মদ আর গণুদা জীবনে ছোঁবে না, মদ এই ছাড়ল —আর সকাল হলেই আত্মহত্যা করবে। পরক্ষণেই আবার বিপরীত ভয়, ধীরু যেন তাকে ছেড়ে না যায়, তাকে ফেলে না যায়, নিজের পরিবার ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে—এখন ধীরু ছাড়া তার আর কে আছে? একটা ভাই ছিল নিজের, দাদার থেকে সে যদিও বউদিকে বেশি ভালবাসত, তবু বেঁচে থাকলে কখনো দাদাকে ত্যাগ করে যেত না—ধীরাপদ ধীরু ধীরুভাই—যেন তাকে ছেড়ে না যায়।
চুপচাপ বসে মদের শক্তি দেখছিল ধীরাপদ, লোকটাকে একসঙ্গে দশটা কথা কখনো গুছিয়ে বলতে শোনেনি। অস্ফুট গলায় ধমকে উঠল, আপনি ঘুমোন চুপ করে!
ধমক খেয়ে গণুদা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল একটু, তারপর চুপ খানিকক্ষণ, তারপরেই তার নাকের ডাক শোনা যেতে লাগল। তারও কিছুক্ষণ পরে ধীরাপদ উঠল, হ্যারিকেনটা নিবিয়ে ফেলল প্রথম, কি ভেবে দরজার গায়ে ছিটকিনি তুলে দিল। মাঝরাতে জেগে উঠে আবার ও-ঘরে গিয়ে হামলা করবে কিনা কে জানে। মেঝেয় বসে ট্রাঙ্কটায় ঠেস দিল, শেষে মাথাটাও রাখল ট্রাঙ্কের ওপর। শরীর ভেঙে পড়ছে। কিন্তু চোখে ঘুম নেই।
তন্দ্রার মত এসেছিল কখন। পিঠটা ব্যথা করতে তন্দ্রা ছুটল। উঠে বসল। বাইরের অন্ধকার ফিকে হয়ে গেছে, খোলা জানলা দিয়ে বাইরের একফালি আকাশ দেখা যাচ্ছে —ভোরের আলোর আভাস জেগেছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, গণুদা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। তারও এই মাত্রই ঘুম ছুটেছে বোধ হয়, দুই চোখে দুর্বোধ্য বিস্ময়। চোখাচোখি হতেই চোখ বুজে ফেলল, ঘাড় ফিরিয়ে কাত হয়ে শুলো।
ধীরাপদ উঠল, দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। আকাশে তখনো গোটাকতক তারা রয়েছে, একটা দুটো পাখির প্রথম কাকলি কানে আসছে। ওপাশে সোনাবউদির ঘরের দরজা বন্ধ। আর না দাঁড়িয়ে ধীরাপদ সুলতান কুঠির আঙিনা ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল।
ট্যাক্সিটা বাড়ি পর্যন্ত না ঢুকিয়ে রাস্তায়ই নামল। ভাড়া মিটিয়ে ভিতরের দিকে এগোলো। বাইরের দরজাটা খোলা। খোলা কেন অনুমান করা শক্ত নয়। মাকে তার জন্যে অপেক্ষা করেছে, শেষে দরজা খোলা রেখেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘরে ঢুকল। পার্টিশনের ওধারে মানকের নাকের ডাক ততো চড়া নয় এখন। আর খানিক বাদেই ঘুম ভেঙে উঠে বসবে। ধীরাপদ পা টিপে ঘরে ঢুকেছে, জুতো ছেড়ে গায়ের জামাটাও খুলে ফেলেছে। তারপর বিছানায় গা ছেড়ে দিয়েছে। শাস্তি।
মানকের ডাকাডাকিতে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে হল।—বাবু উঠুন, উঠুন, আর কত ঘুমুবেন? রাতে কোথায় উঁবে গেলেন, আমি অপেক্ষা করে করে শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। কখন এয়েছেন? রাতে খাওয়াও তো হয়নি, আমাকে ডাকলেন না কেন?
একটা কথারও জবাব না পেয়ে মাকে তার ঘুম ভাঙানোর কারণটা বলল। বাইরে সেই থেকে একজন লোক তার সঙ্গে দেখা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, মানকে তাকে দোতলার অফিসঘরে বসতে বলেছিল, তা তিনি সেই থেকে দাঁড়িয়েই আছেন আর বলছেন জরুরী দরকার, একটু ডেকে দিলে ভালো হত।
ধীরাপদ ভেবে পেল না কে হতে পারে। সেখানেই তাকে পাঠিয়ে দিতে বলে ঘড়ি দেখল, নটা বাজে। খুব কম সময় ঘুমোয়নি, কিন্তু মাথাটা ভার-ভার এখনো।
মানকে সঙ্গে করে নিয়ে এল যাকে তাকে ধীরাপদ আশা করেনি। গণুদা! গায়ে সেই গলাবন্ধ কোট, পরনের কাপড়টা অবশ্য বদলেছে। রাতের ধকল এখনো মুছে যায়নি, শুকনো মুর্তি। ধীরাপদ বিছানায় বসেছিল, বসেই রইল-কোনো সম্ভাষণই বার হল না মুখ দিয়ে।
মানকে টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে দিতে গদা বসল। মাকে সরে না যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে রইল, তারপর ঢোক গিলে বলল, ইয়ে—ওটা কোথায় রেখেছ? তোমার বউদির কাছেও দাওনি শুনলাম-
ধীরাপদ দ্বিগুণ অবাক, এখনো লোকটার নেশার ঘোর কাটেনি কিনা বুঝছে না। —কোনটা?
গণুদা হাসতে চেষ্টা করল, বলল, টাকাটা—। আমি সাবধানেই রেখেছিলাম, মিছিমিছি ব্যস্ত হবার দরকার ছিল না।
সমস্ত স্নায়ুগুলো একসঙ্গে নাড়াচাড়া খেল, ধীরাপদ ধমকেই উঠল, কি বকছেন আবোল-তাবোল?
গণুদা ঈষৎ অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠল, এতগুলো টাকার ব্যাপার, ঠাট্টা ভালো লাগে না, দিয়ে দাও—
কিসের টাকা? হঠাৎ ধীর শাস্ত্র ধীরাপদ।
অতগুলো টাকা কিসের সে কৈফিয়ৎ দিতে গণুদার আপত্তি নেই। ওর পাইপয়সা অবধি হকের টাকা তার। গতকাল অফিস থেকে তার প্রভিডেন্ট ফান্ড আর অন্যান্য পাওনা-গণ্ডা চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে—চার হাজার পাঁচশ’ সাতানব্বই টাকা। সাতানব্বই টাকা আলাদা রেখে বাকি সাড়ে চার হাজার টাকা গণদা গলাবন্ধ কোটের ভিতরের পকেটে রেখেছিল—একটা খামে ছিল, পঁয়তাল্লিশখানা একশ টাকার নোট—ধীরাপদর সন্দেহের কোনো কারণ নেই, সবই নিজস্ব টাকা—নিজস্ব রোজগারের টাকা।
সততার টাকা যে সেটা প্রমাণ করতে পারলেই যেন আর যন্ত্রণা না দিয়ে ধীরাপদ টাকাটা বার করে দেবে। কিন্তু ধীরাপদর স্তব্ধতা দেখে গদার ফর্সা মুখের কালচে ছাপটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো।
আপনার টাকা আমি নিইনি!
গণুদা সানুনয়ে বলল, তুমি নিয়েছ কে বলছে, ভালোর জন্যেই সরিয়ে রেখেছ, টাকাটা পেলেই আমি তোমার বউদির হাতে দিয়ে দেব।
আপনার টাকা আমি সরাইনি! ক্ষিপ্তকণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে উঠল সে। দূরে গণুদার পিছনের দরজার কাছে মানকেকে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেকে সংযত করল। তার হাতে দু পেয়ালা চা, কাছে এগোতে ভরসা পাচ্ছে না।
গলা নামিয়ে ধীরাপদ বলল, কাল রাতে যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে যান, দরকার হলে পুলিসের ভয় দেখান, যে লোকটা আপনাকে রিকশয় তোলার জন্য ঠেলাঠেলি করছিল তাকেও ধরতে পারেন কিনা দেখুন, যান— আর বসে থাকবেন না এখানে।
কিন্তু গণুদা বসেই রইল। বলল, টাকা আমার কোটের ভিতরের পকেটেই ছিল —কেউ টের পায়নি। ওই লোকটাকে সেই ভয়েই কাল আমি কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিলাম না—তখনো ছিল। হঠাৎ ভেঙে পড়ল গণুদা, ধীরু, ওই ক’টা টাকাই শেষ সম্বল আমার, আর ঠাট্টা করো না- -তুমি নিজেই না হয় তোমার বউদিকে টাকাটা দেবে চলো-
ধীরাপদ কি করবে? মারবে ধরে? – আপনি যাবেন কি না এখান থেকে। যা বললাম শিগগীর তাই করুন, ও টাকা আপনার গেছে, যান এক্ষুনি।
গণুদাও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।—টাকা আমার পকেটেই ছিল, তুমি দেবে না তা হলে? গেট আউট! যান এখান থেকে, গিয়ে খোঁজ করুন। বিছানা ছেড়ে মাটিতে নেমে দাঁড়ান, যান শিগগীর, নয়তো আপনাকে আমি-
রাগে উত্তেজনায় একরকম ঠেলতে ঠেলতেই তাকে দরজার দিকে এগিয়ে দিল। বেগতিক দেখে চায়ের কাপ হাতে মানকে প্রস্থান করেছে।
ধীরাপদ একসময় উঠে চান করেছে, খেয়েছে, অফিসে এসেছে। কিন্তু কখন কি করেছে হুঁশ নেই। অফিসেও মন বসল না, এক মুহূর্তও ভালো লাগল না। যে সম্বল খোয়া গেছে সেটা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য ওই অপদার্থ লোকটার বলে ভাবতে পারছে না বলেই এমন মর্মান্তিক লাগছে। ওইটুকুও হারিয়ে সোনাবউদি কি করবে এখন? বলতে ইচ্ছে করছে, সোনাবউদি আর আমাকে ঠেলে সরিয়ে রেখো না, এবারে আমাকে রণু বলে ভাবো।
বলবে। বলবার জন্যেই বিকেল না হতে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা সুলতান কুঠিতে চলে এলো। কিন্তু ততক্ষণে তার সঙ্কল্পের জোর শেষ।
উমা তাকে দেখেও আগের মত লাফিয়ে উঠল না। তার শুকনো মুখে কি একটা ভয়ের ছাপ। ছেলে দুটোকেও শুকনো শুকনো লাগছে। ওদের পৃষ্টির রসদে হয়তো ইতিমধ্যেই টান পড়েছে।
সোনাবউদি পাশের খুপরি ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো। মায়ের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েরা সরে গেছে। ওদের যেন কেউ তাড়া করেছে। সোনাবউদি চুপচাপ সামনে এসে দাঁড়াল। ধীরাপদর মুখ দেখলে কেউ বলবে না, অত বড় এক কোম্পানীর হাজার টাকা মাইনের এই সেই ধীরাপদ চক্রবর্তী।
সহজ হবার চেষ্টায় দেয়ালের কাছ থেকে নিজেই মোড়াটা নিয়ে এসে বসতে বসতে বলল, গণুদার পকেট থেকে অতগুলো টাকা গেছে শুনলাম, উনি ভেবেছিলেন আমিই সাবধান করে সরিয়ে রেখেছি।
সোনাবউদি নীরবে চেয়ে আছে মুখের দিকে।
পুলিসে একটা খবর দেওয়া উচিত কিনা বুঝছি না, গদা একটু খোঁজটোঁজ করেছিলেন?
সোনাবউদি তেমনি নির্বাক, নিষ্পলক, কঠিন।
আর কি জিজ্ঞাসা করবে ধীরাপদ? মনে হল সব জিজ্ঞাসা আর সব কথা শেষ হয়েছে, এবারে উঠলে হয়।
কিন্তু সোনাবউদি জবাব দিল, গলার স্বর মৃদু হলেও ভয়ানক স্পষ্ট— প্রায় চমকে ওঠার মতই স্পষ্ট। পাল্টা প্রশ্ন করল, কোথায় খোঁজ করবে?
ধীরাপদ তাকালো শুধু একবার, কোথায় খোঁজ করবে বা করা উচিত বলতে পারল না।
খানিক অপেক্ষা করে সোনাবউদি আরো মৃদু অথচ আরো স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কাল তাকে কোথা থেকে তুলে এনেছেন?
রাস্তা থেকে।
কোন রাস্তা থেকে? সেটা কেমন এলাকা?
ধীরাপদ নিরুত্তর। এবারে আর তাকাতেও পারল না। ধমনীর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে যেন।
জবাবের প্রতীক্ষায় সোনাবউদি নীরব কিছুক্ষণ। তারপর নিজে থেকেই আবার বলল, কোন রাস্তা কেমন এলাকা সেটা তার টাকার শোক থেকে বোঝা গেছে—টাকার শোকে মাথা এত গরম না হলে বোঝা যেত না।…অত রাতে আপনার ওখানে কি কাজ পড়েছিল?
না, ধীরাপদ এবারেও জবাব দিতে পারেনি, এবারেও মুখ তুলে তাকাতে পারেনি। সোনাবউদি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, আরো কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখেছিল, তারপর কঠিন ব্যবধান রচনা করেই নিঃশব্দে সামনে থেকে সরে গিয়েছিল।
ধীরাপদ দুনিয়ার অলক্ষ্যে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল এখান থেকে। কিন্তু বাইরে তখনো দিনের আলো। দূরে, পিছন থেকে কে বুঝি তাকে ডেকেও ছিল, বোধ হয় রমণী পণ্ডিত। ধীরাপদ শোনেনি, ধীরাপদর শোনার উপায় নেই। এখান থেকে পালিয়ে কোনো অন্ধকারের গহ্বরে বিলীন হয়ে যাওয়ার তাড়া তার। ভদ্রলোক ছুটলেও তাকে ধরতে পারতেন কিনা সন্দেহ।
বড় সাহেব পাটনা থেকে ফিরলেন পরদিন খুব সকালে। ধীরাপদ বিছানায় শুয়ে শুয়েই টের পেয়েছে। মানকে আর কেয়ার-টেক বাবুর ব্যস্ততা অনুভব করেছে। কিন্তু ধীরাপদ উঠে আসেনি, তেমন উৎসাহও বোধ করেনি। দুদিন আগেও যেজন্যে তাঁর ফেরার অপেক্ষায় উৎসুক হয়ে ছিল, সেই কারণটার আর অস্তিত্ব নেই।
একটু বেলায় ডাক পড়ল তার। বড় সাহেব প্রথমে ঠাট্টা করলেন, খুব বিশ্রাম করছ বুঝি, এত বেলা পর্যন্ত ঘুম? কুশল প্রশ্ন করলেন, অফিসের খবর-বার্তা জিজ্ঞাসা করলেন, এমন কি সদ্য-বর্তমানে ভাগ্নেটির মেজাজ কেমন—তাও। তারপর খুশি মেজাজে নিজের সংবাদ আর কনফারেন্সের সংবাদ দিতে বসলেন। ব্লাডপ্রেসার-টেসার পালিয়েছে, খুব ভালো আছেন এখন, আর ওদিকে কনফারেন্সেও মাত। কতটা মাত ধীরাপদ তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারছে, তবু বিবরণ শুনতে হল। তাঁর বক্তৃতার পর সকলেই প্রতিক্রিয়ার কথাই বললেন বিশেষ করে।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে বড় সাহেব খেয়াল করে তাকালেন তার দিকে। —মুখ বুজে বসে আছ, শরীর ভালো তো তোমার?
ধীরাপদ হাসতে চেষ্টা করল, তাড়াতাড়ি মাথাও নাড়ল। ভালো।
তবু লক্ষ্য করে দেখছেন। ভুরু কোঁচকালেন, মাথা নাড়লেন, বললেন, ভালো দেখছি না।
ভালো অফিসেরও অন্তরঙ্গ দুই-একজন দেখল না। শরীর অসুস্থ কিনা জিজ্ঞাসা করল। ধীরাপদ কাউকে জবাব দিয়েছে, কাউকে বা না দিয়ে পাশ কাটিয়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রয়োজনেও কাউকে ডাকেনি। ওপাশের ঘরে লাবণ্য সরকার কখন এসেছে টের পেয়েছে, কখন চলে গেছে তাও।
পাঁচটার ওধারে এক মিনিটও অফিসে টিকতে পারল না। কিন্তু এবারে করবে কি? বাড়ি ফিরেই হিমাংশুবাবু ডাকবেন, সেটা আরও বিরক্তিকর। চারুদির কথা মনে হল, কিন্তু সে বাড়ির দরজাটা বন্ধ হলে ধীরাপদ নিজেই বাঁচত। চারুদি টেলিফোনে ডেকে পাঠালে কি করবে? যাবে?
না, ধীরাপদ ও নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না, মাথা আর কোন কিছু নিয়েই ঘামাবে না সে। ডাকলে দেখা যাবে।…কিন্তু চারুদি কি পার্বতীকে সম্পত্তি দেবার ব্যবস্থা করে আসতে পেরেছে? থাক, ভাববে না।
সামনে সিনেমা হল একটা। কোন্ হল কি ছবি জানে না। কিন্তু ধীরাপদ যেন তৃষ্ণার জল হাতের কাছে পেল। টিকিট কেটে ঢুকে পড়ল। বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে নটারও পরে। ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখা হয়নি—বিলিতি প্রেমের ছবি একটা। নারী- পুরুষের বাঁধ-ভাঙা এক উষ্ণ নিবিড় মুহূর্তে উঠে এসেছে। তারপর এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হেঁটেই ফিরছে। রাতে ঘুম দরকার।
মাকে এগিয়ে এলো। সে যেন তার প্রতীক্ষাতেই ছিল। বাবু সেই লোকটা আজও এসেছিল—
কোন্ লোকটা?
সেই কাল সকালবেলায় যে এসেছিল, আপনি যাকে ধমকে তাড়ালেন ঘর থেকে। ভাগ্নেবাবুর সঙ্গে দেখা করে গেল— অর্থাৎ গণুদা এসেছিল। গণুদা অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে দেখা করে গেছে। ভাগ্নেবাবুর দোরে দাঁড়িয়ে মানকের স্বকর্ণে সব কিছু সোনার সাহস হয়নি, কিন্তু তার বিশ্বাস লোকটা ভয়ানক খারাপ, ধীরুবাবুর নামে কি সব বলছিল—
একটিও কথা না বলে ধীরাপদ অমিতাভর ঘরের দিকে চলল। কিন্তু হল পেরিয়ে তার ঘর পর্যন্ত গেল না, দাঁড়িয়ে ভাবল একটু, তারপর আবার ফিরে এলো। ভিতরটা বড় বেশি উগ্র হয়ে আছে নিজেই উপলব্ধি করছে। এতটুকু কৌতুকও বরদাস্ত হবে না, অকারণে একটা বচসা হয়ে যাবার সম্ভাবনা। স্নায়ু অত তেতে না থাকলে মানকের মুখে আরও কিছু শোনা যেত, গণ্দা অনেক কি বলছিল তার কিছু আভাস পেতে পারত।
পেল পরদিন, আর পেল এমন একজনের মুখ থেকে যার ওপর বিগত কদিন ধরে ধীরাপদ মনে মনে শাসনের ছড়ি উঁচিয়ে আছে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিসে নিঃশব্দে নিজের ঘরে কাটিয়ে ফটকের বাইরে আসতে রমেন হালদারের সঙ্গে দেখা। তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল, চোখে চোখ পড়তে হাসতে চেষ্টা করল। জানালো, দাদার সঙ্গে একটু গোপনীয় কথা ছিল তাই ভিতরে না গিয়ে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।
গোপনীয় কথা শোনার জন্য ধীরাপদ দাঁড়ায়নি—মুখ শুধু গম্ভীর নয়, কঠিনও। মেডিক্যাল হোম থেকে কারো মুখে কিছু শুনে নিজের সততার কৈফিয়ৎ নিয়ে ছুটে এসেছে, আর ফাঁক পেলে ম্যানেজারের নামেও উল্টে কিছু লাগিয়ে যাবে নিশ্চয়। কিন্তু সে ফাঁক ধীরাপদ আজ আর ওকে দেবে না।
তুমি এ সময়ে এখানে এলে কি করে, কাজে যাওনি?
রমেন মাথা চুলকে জবাব দিল, ইয়ে—এখান থেকে যাব।
দেরি হবে, ম্যানেজারকে বলে এসেছ?
ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, গিয়েই বলবে। তারপরেই এভাবে ছুটে আসার তাগিদটা কেন বোঝাবার জন্যে হড়বড়িয়ে যা সে বলে গেল শুনে ধীরাপদ বিমূঢ়। নিজের কানে কাল যা শুনল তারপর না এসে রমেন হালদার করবে কি, দাদা রাগ করলেও ছুটি- টুটি নেবার কথা তার মনে হয়নি, দাদার বিরুদ্ধে নোংরা একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে ভেবে কাল প্রায় সমস্ত রাত সে ঘুমুতেও পারেনি-আজ কাঞ্চনই তাকে একরকম ঠেলে পাঠিয়েছে এখানে, সব খুলে বলতে পরামর্শ দিয়েছে—বলেছে, দাদা এমন আপনার লোক, তাকে জানাতে ভয়ই বা কি সঙ্কোচই বা কি, না জানালে দাদার যদি বিপদ হয়, তখন?
ধীরাপদ দাঁড়িয়ে পড়েছিল, চেয়েছিল মুখের দিকে।—কি হয়েছে?
কি হয়েছে সরাসরি বলতে তবু মুখে আটকেছে রমেনের, ভনিতার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে আর এক দফা।—কতগুলো বিচ্ছিরি কথা কাল তার কানে এসেছে, দাদার কাছে মুখ ফুটে কি করে যে বলবে-অথচ, কাল একজন ওই ছাই পাঁশ বলে গেল, আর, আর একজন দিব্যি বসে বসে তাই শুনল।
ভিতরটা হঠাৎ অতিরিক্ত দাপাদাপি শুরু করেছে ধীরাপদর, নিজেকে সংযত করার জন্য পায়ে পায়ে আবার এগিয়ে চলল। অস্ফুট বিরক্তি, কথা না বাড়িয়ে কি হয়েছে বলো।
রমেন বলেছে। ধীরাপদ শুনেছে। মানকের বলার সঙ্গে তার বলার অনেক তফাত, কথার বুনোট ছাড়ালে সবই স্পষ্ট, নগ্ন। মেডিক্যাল হোমে কাল বিকেলে খুব ফর্সা অথচ রস-ছড়ানো ছিবড়ের মত একজন শুকনো মূর্তি লোক এসে লাবণ্য সরকারের খোঁজ করেছিল। একটু পরেই বোঝা গেছে সে খদ্দেরও নয়, মিস সরকারের রোগীও নয়। তার শুকনো দিশেহারা হাবভাব রমেনের কেমন যেন লেগেছে। খানিক বাদে বাইরে এসে দেখে লোকটা যায়নি, বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। রমেনকে দেখে ইশারায় ডেকেছে, তারপর এমন সব কথা বলেছে যে সে অবাক। বলেছে, খুব বিপদে পড়ে মিস সরকারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রোগীর ভিড় কখন কম থাকে, কখন এলে তাকে নিরিবিলিতে পাওয়া যায়, মিস সরকার লোক কেমন, রাগী না আলাপী – বার বার নিজের বিপদের কথা বলে এই সবও শুধিয়েছে। তারপর হঠাৎ দাদার কথা তুলেছে সে, দাদা কোম্পানীর কি, কত বড় চাকরি করে, দাদার চাকরিটা বড় না মিস সরকারের, দাদার সঙ্গে মিস সরকারের ভাব কেমন, উনি কিছু বললে দাদা শোনেন কি না—এই সব।
তখনকার মতন লোকটা চলে গিয়েছিল, তারপর সময় বুঝে আবার এসেছিল। মিস সরকারের তখন দু-তিনজন মাত্র রোগী বসে। প্রথমে দুই একটা কি কথা হয়েছে তার সঙ্গে রমেন ঠিক জানে না, কিন্তু উনিও যে বেশ অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন সেটা ঠিক লক্ষ্য করেছে। মিস সরকার শেষ রোগী বিদায় করে তাকে ঘরে ডেকেছেন। দাদা ভালো বলুন আর মন্দ বলুন, রমেন তখন পার্টিশনের পিছনে গিয়ে না দাঁড়িয়ে পারেনি।
এরপর কি শুনবে ধীরাপদ জানে। তবু বাধা দিল না। লাবণ্য সরকারের মন্তব্য শোনার প্রতীক্ষা, নির্বাক একাগ্রতায় কান পেতে আছে আর নিজের অগোচরে পথ ভাঙছে। গণুদা বলেছে, ধীরাপদ সর্বস্বান্ত করেছে তাকে, পরশু রাতে শরীরটা হঠাৎ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সে তাকে রাস্তা থেকে তুলে রিকশা করে বাড়ি নিয়ে এসেছে, তারপর তার সঙ্গে এক ঘরে কাটিয়েছে সমস্ত রাত, আর সকাল না হতে উঠে চলে গেছে। সেই সঙ্গে তার গলাবন্ধ কোটের ভিতরের পকেট থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা উধাও – অথচ, অসুস্থ অবস্থায় রিকশয় ওঠার সময়ও টাকাটা কোটের ভিতরের পকেটে ছিল তার ঠিক মনে আছে। টাকাটা ফিরিয়ে দিতে বলার জন্য লাবণ্য সরকারের কাছে কাকুতি মিনতি করেছে গদা, বলেছে তার চাকরি গেছে, অফিস থেকে পাওয়া ওই পুঁজিটুকুই শেষ সম্বল, ঘরে ছোট ছোট ছেলেপুলে, টাকাটা না পেলে তার আত্মহত্যা করা ছাড়া পথ নেই।
রমেনের চাপা উত্তেজিত মুখে তপ্ত বিস্ময়, এতখানি শোনার পরেও ভদ্রমহিলার মুখে কটু কথা নেই একটাও, উল্টে টুকটাক কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে উনি যেন সাহায্যই করবেন তাকে।
ধীরাপদ উৎকর্ণ, চলার গতি শিথিল হয়ে আসছে।
লাবণ্য সরকার সদয়ভাবেই এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে গণুদাকে, কোথায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কি হয়েছিল, রাত কত—তখন বাড়ি ফিরেও ধীরুবাবুর ঘরে রাত কাটানো হল কেন, এই সব। রমেনের মতে গণুদার এলোমেলো জবাব থেকেই বোঝা গেছে লোকটা কেমন, আর লাবণ্য সরকার তা বুঝেও ভালমানুষের মত জিজ্ঞাসা করেছে, পরদিন টাকা নেই শুনে তার স্ত্রী কি বললেন?
ধীরাপদ দাঁড়িয়েই পড়ল।
নিজের স্ত্রীর সম্বন্ধে বাইরের একজনের কানে কেউ এত বিষ ঢালতে পারে রমেনের ধারণা ছিল না। যেন ওই রকম করে বলতে পারলেই নিজের সততার সম্বন্ধে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না, আর যে সাহায্যের আশায় আসা তাও পেয়ে যাবে। বলেছে, অমন মন্দ স্বভাবের স্ত্রীলোক আর দুটি হয় না, শুধু তার জন্যেই সব গেছে। এমন কি চাকরিটাও বলতে গেলে তার জন্যেই খুইয়েছে—ঘরে যার এই স্ত্রী আর এমন অশান্তি, সুস্থ হয়ে অফিসে বসে সে চাকরি করে কেমন করে? টাকা গেছে শুনে ওই স্ত্রী আর কী বলবে, গুম হয়ে বসে আছে শুধু। বাইরের একটা লোককে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে, বলবে কোন মুখে? তারপর স্ত্রীর সঙ্গে দাদাকে জড়িয়ে এমন সব ইঙ্গিত করেছে যে রমেনের ইচ্ছে করছিল তাকে ঘর থেকে টেনে এনে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেয়।
এতখানি শোনার পর লাবণ্য সরকার আর তেমন আগ্রহ দেখায়নি, উল্টে একটু ঠাণ্ডা ভাব দেখিয়েই বিদায় করেছে গণুদাকে। এ ব্যাপারে তাঁর কিছু করার বা বলার নেই জানিয়েছে। আর মুখ ফুটে এ কথাও বলেছে, ধীরুবাবু তার টাকা নিয়েছে সেটা বিশ্বাস্য নয়। বলেছে, যদি নিয়েই থাকেন সে টাকা আপনার স্ত্রীর কাছেই আছে দেখুন গে যান।
মুখ বুজে হাঁটতে হাঁটতে ধীরাপদর খেয়াল হল রমেন আছে পাশে। আত্মস্থ হওয়া দরকার, ঠাণ্ডা মাথায় আগে ওকে বিদায় করা দরকার। ছেলেটা বোকা নয়, এই অশান্ত স্তব্ধতা উপলব্ধি করছে। নইলে এত কথা বলার পর চুপ করে থাকত না, কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করত। গোড়ার সেই অনুশাসনের মেজাজ ধীরাপদর আর নেই, তবু ওকে যেতে বলার আগে দাদার গাম্ভীর্যে একটু সমঝে দিতে হবে, দু-চার কথা বলতে হবে। না বললে ওর চোখে দুর্বলতার দিকটাই বড় হয়ে উঠবে।
নৈতিক উক্তি নিজের কানেই বিদ্রূপ বর্ষাবে, ধীরাপদ মাঝামাঝি রাস্তা নিল। —এসব বাজে কথায় তুমি একটু মাথা কম ঘামিও এবার থেকে। এখন তোমার ব্যাপারটা কি বলো, সেদিন আমি মেডিক্যাল হোমে গেছলাম শুনেছ?
কৌতূহল আর বিস্ময়ের আবর্ত থেকে বঁড়শী-বেঁধা মাছের মত হ্যাঁচকা টানে শুকনো ডাঙায় টেনে তোলা হল তাকে। মিটমিট করে তাকিয়ে ঢোক গিলল, ম্যানেজার লাগিয়েছে বুঝি…
ম্যানেজার মিছিমিছি কারো নামে লাগাতে আসে কিনা সে কথা তোমার মুখ থেকে আমার শোনার দরকার নেই।—চুপচাপ কয়েক পা এগিয়ে আবার বলল, ওই মেয়েটা কোথাকার মেয়ে, কি ছিল, সব জানো?
রমেনের চকিত চাউনি এবার অতটা ভীতগ্রস্ত নয়। হাতেনাতে ধরা পড়া অপরাধীর মুখ অন্তত নয়। জবাব না দিয়ে মাথা নাড়ল শুধু, অর্থাৎ জানে। কিন্তু শুধু মাথা নেড়েই সব জানার পর্ব শেষ করল না। একটু বাদে দ্বিধা জলাঞ্জলি দিয়ে দাদার একটুখানি সুবিবেচনাই দাবি করল যেন। বলল, কাঞ্চনই সব বলেছে দাদা, কি ছিল, কিভাবে মরতে বসেছিল, আপনি কত দয়া করে ওকে বাঁচিয়ে এই ভালোর দিকে এগিয়ে দিয়েছেন—সব বলেছে। বলেছে আর কেঁদেছে। সব জেনেও আপনি এতখানি করেছেন বলেই একটা দিনের জন্যেও আমি ওকে খারাপ চোখে দেখিনি দাদা।
ব্যস, এর পরে তর্ক অচল, যুক্তি অচল। দাদার ভালোর দিকে এগিয়ে দেওয়াটাই তার প্রীতির চোখে দেখার পরোয়ানা। নিজের উদারতার প্রশংসা শুনে হোক বা ছেলেটার মতিগতি দেখেই হোক, ধীরাপদর ভিতরটা তিক্ত হয়ে উঠল হঠাৎ। রুক্ষ শাসনের সুরেই বলল, ওই মেয়েটার নামে এরপর যদি কোন রকম নালিশ আসে তাহলে তুমিই তার সব থেকে বড় ক্ষতি করবে, ম্যানেজার একটি কথাও বললে তার চাকরি থাকবে না—এখন কি চোখে দেখবে ভাবো গে যাও।
মুখ কালো করে রমেন চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে বা সেই মেয়ে ধীরাপদর মন থেকে মুছে গেল। টাকার শোকে উম্মাদ গণুদা যে কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, ধীরাপদ সেজন্যে উতলা নয়। কিন্তু ভিতরটা তবু জ্বলছে। টাকা কোন চুলোয় গেছে তা নিয়ে লাবণ্য সরকার এক মুহূর্তও মাথা ঘামায়নি, ওর নাম জড়িয়ে গদা নিজের স্ত্রীর মুখে যে কালি মাখিয়েছে সেইটুকুই শোনার মত তার হৃষ্টচিত্তে তাই হয়ত শুনেছে বসে বসে। আর একটা ভাবনাও মনে আসছে, যা সে একদিনের মধ্যে একবারও ভাবেনি। লাবণ্য সরকার গণুদাকে জিজ্ঞাসা করেছে, টাকা চুরি গেছে শুনে তার স্ত্রী কি বললেন…। কি বলে? মুখে না হোক, মনে মনে কি বলছে সোনাবউদি? কি ভাবছে? যে টাকা হারিয়ে গণুদা এমন ক্ষিপ্ত, সেই ক’টা টাকা তো শেষ সম্বল সোনাবউদিরও—এই মানসিক সঙ্কটে তার ভাবনা কোন পর্যায়ে গড়িয়েছে? সোনাবউদির চোখে সে তো অনেক নেমেছে। কত নেমেছে ঠিক নেই। সর্বস্ব খুইয়ে সেই সোনাবউদি শুধু টাকার ব্যাপারেই এখনো পরম সাধু ভাবছে তাকে? টাকা যে পকেটেই ছিল সেটা গণুদা তাকে কতভাবে বুঝিয়েছে ঠিক কি? ধীরাপদর মনে হল, গণুদা এই কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে সোনাবউদির কাছ থেকে কোন বাধা আসেনি বলে। সোনাবউদি বাধা দিলে গণদা এমন বেপোরোয়া হয়ে উঠতে পারত না।
পরদিন দুপুরে কারখানায় বড় সাহেবের ঘরে ডাক পড়তে ধীরাপদ গিয়ে দেখে সেখানে সেই উদভ্রান্ত-মূর্তি গণুদা বসে। লাবণ্য সরকারও আছে, নিস্পৃহ মুখে অফিসের ফাইল দেখছে একটা। মুহূর্তে আত্মস্থ হল ধীরাপদ, সব কটা স্নায়ু সজাগ কঠিন হয়ে উঠল। লাবণ্য সরকার এখানে কেন, বড় সাহেবই তাকে অফিসের কাজে ডেকেছেন কিনা সে কথা মনে হল না। এই পরিস্থিতিতে লাবণ্য সরকার উপস্থিত এইটুকুই যথেষ্ট। কাজ থাক আর নাই থাক, এই গাম্ভীর্যের আড়ালে বসে মজাই দেখবে।
শুধু তাকে নয়, এবারে ধীরাপদ সকলকেই মজা দেখাবার জন্য প্রস্তুত।
বড় সাহেব বললেন, এ কি সব বলছে সেই থেকে আমি কিছু বুঝছি না, একে চেনো?
জবাব না দিয়ে ধীরাপদ গণুদার দিকে তাকালো, সেই দৃষ্টির ঘায়ে হোক বা টাকার তাড়নায় হোক গণুদা বসে থাকতে পারল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর শুকনো ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে বলতে চেষ্টা করল, ধীরুভাই, তোমার বউদির মুখ চেয়েও অন্তত—
শেষটুকু মুখেই থেকে গেল। ধীরাপদ দরজার কাছে এসে বেয়ারা তলব করেছে, বেয়ারা শশব্যস্তে ঘরে ঢুকতে গণুদাকে দেখিয়ে আদেশ করেছে বাইরে নিয়ে যেতে। একেবারে ফটকের বাইরে। আর তারই মারফৎ গেটের দারোয়ানের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে, এই লোক আবার কারখানা এলাকায় ঢুকতে পেলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
নালিশ যার নামে করতে এসেছিল তারই এমন প্রতাপ দেখে গদা হকচকিয়ে গেল। কাউকে কিছু বলতে হল না, পাংশু বিবর্ণ মুখে নিজে থেকেই প্রস্থান করল।
লাবণ্যর হাতের ফাইল টেবিলে নেমেছে। বড় সাহেবও প্রায় বিস্ফারিত নেত্রেই চেয়ে আছেন, গণুদার পিছনে বেয়ারা অদৃশ্য হতে ধীরাপদ চুপচাপ ফিরে তাকালো তাঁর দিকে। হিমাংশুবাবুর হাতের পাইপ মুখে উঠল, পাইপ ধরানোটা কৌতুক গোপনের চেষ্টার মত লাগল।
বসো। আরো একবার দেখে নিলেন। লোকটার না হয় টাকা গিয়ে মাথার ঠিক নেই, তোমার কি হয়েছে?
ধীরাপদ বসল না। ঘাড় ফেরালে লাবণ্যর মুখেও প্রচ্ছন্ন হাসির আভাস দেখবে মনে হল, কিন্তু ফেরানো গেল না। এবারে হাল্কা জবাবই দিতে হবে, তাই দিল। কিছু হয়নি। টেবিলে কাজ ফেলে উঠে এসেছি। আর বলবেন কিছু?
বড় সাহেব সভয়েই তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন যেন। ধীরাপদ বেরিয়ে এলো। কিন্তু জ্বালা জুড়োয়নি একটুও। যে জবাব জিভের ডগায় করকর করে উঠেছিল সেটা বলে আসা গেল না। বলা গেল না, তার কিছু হয়নি, তার মাথা খুব সুস্থ খুব ঠাণ্ডা আছে। তারপর বড় সাহেবকে সচকিত করে লাবণ্যকে জিজ্ঞাসা করা গেল না, ঘরের নীল আলোয় কোলের মধ্যে সেদিন মাথা গুঁজে পড়েছিল যে সেই মাথাটা এখন সুস্থ কিনা, ঠাণ্ডা কিনা—ছোট সাহেব কেমন আছে। বলতে পারলে একসঙ্গে দুজনকে ঠাণ্ডা করে দেবার মত জবাব হত। জ্বালা জুড়োত।
পাঁচটার বেশ আগেই ধীরাপদ অফিস থেকে বেরিয়েছে। সঙ্গে পোর্টফোলিও ব্যাগটা আছে। দরকার হতে পারে, দরকার যাতে হয় ধীরাপদ সেই সঙ্কল্প নিয়েই চলেছে। দু দিন আগে যে চিন্তা মনে রেখাপাতও করেনি সেটাই এখন দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করেছে একটা। সোনাবউদি কি ভাবছে জানা দরকার, তার গোচরেই গণুদা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল কিনা বোঝা দরকার। এই চিন্তা তার ঘুম কেড়েছে। শাস্তি কেড়েছে। যদিও এক-একবার মন বলছে, সোনাবউদির নয়, ভাবনাটা তারই একটা ভ্রান্তির আবর্তে পড়ে সঙ্গতিভ্রষ্ট হয়েছে। কিন্তু ওই মনের ওপর আর আস্থা নেই, দখল নেই। সেই মন এখন উত্তেজনা খুঁজছে, উল্টো রাস্তা খুঁজছে।
সুলতান কুঠিতে আসতে হলে আজকাল আর এখানকার বাসিন্দাদের চোখ এড়ানোর উপায় নেই। কারো না কারো সঙ্গে হবেই দেখা। এবড়ো-খেবড়ো পথের মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখে বিগলিত অভ্যর্থনায় ঘুরে দাঁড়ালেন যিনি তিনি একাদশী শিকদার। ভিতরটা অকারণে উগ্র হয়ে উঠেছে, ধীরাপদ নিজেই টের পাচ্ছে।
শিকদার মশাইও বাইরে থেকে ঘরে ফিরছিলেন। কুশল প্রশ্ন করে সখেদে সমাচার শোনালেন। এই বয়সে পা আর চলে না, তবু বিকেলের দিকে একবার অদ্ভূত না বেরিয়ে পারেন না। দুখানা কাগজ পড়ে পড়ে এমনই অভ্যাস হয়ে গেছে যে ওর একখানা না দেখলে সেই দিনটাই যেন আবছা আবছা লাগে। বিশেষ করে গণুবাবুর ঘরের যে কাগজটা এতকাল ধরে পড়ে এসেছেন, সেটা একবার হাতে না পেলে ভালো লাগে না। চাকরি গিয়ে কাগজওয়ালার ঘরে এখন কাগজ আসা বন্ধ হয়েছে, ফলে তাঁরই দুর্ভোগ। ধীরাপদর অনুগ্রহে একখানা কাগজ ধরে বসেই পড়তে পাচ্ছেন, কিন্তু ঐ কাগজখানাও একটু নেড়েচেড়ে দেখার জন্যে বেরুতেই হয়।
মুখ ফুটে বলার পর ওই আর একখানা কাগজও ঘরে বসেই পড়তে পাবেন আশা করেছিলেন কিনা তিনিই জানেন। কিন্তু অনুগ্রহ যে করতে পারে তার মুখের দিকে চেয়ে শিকদার মশাই কাগজ-প্রসঙ্গ সেখানেই চাপা দিলেন। ধীরাপদ কবে সুলতান কুঠিতে ফিরে আসছে খোঁজ নিলেন, তার অবর্তমানে দিনকে দিন বাড়িটা যে বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে সে কথা একবাক্যে ঘোষণা করলেন, তারপর আর একটা সংসারের কথা তুলে আক্ষেপ করতে করতে কদমতলা পর্যন্ত এসে গেলেন। সোনাবউদির সংসারের কথা। সেটাই মনঃপুত হবে ভেবেছেন হয়ত। বউটি ভালো, এ বাজারে চাকরিটা গেল, ছেলেপুলে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে কি করবে, ধীরাপদ আছে আপনার লোক, সেটা অবশ্য কম ভরসার কথা নয়।…কিন্তু বউটি বড় অশান্তির মধ্যে আছে, পণ্ডিত বলছিল, প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত বাইরের দাওয়ায় বসে থাকে চুপচাপ, রাতে ঘুম হয় না বলে মাঝে মাঝে ওই শুকলাল দারোয়ানকে দিয়ে ঘুমের ওষুধ আনিয়ে খায়—পণ্ডিতের তো আবার সবই দেখা চাই, সকলের নাড়ির খবর টেনে বার করা চাই।
ধীরাপদ আর শোনেনি, আর শুনতে চায়নি। আর শুনলে কদমতলা পর্যন্ত এসেও হয়ত তাকে ফিরে যেতে হবে। এখনই পায়ের ওপর আর তেমন জোর পাচ্ছে না। দাঁড়াল, শিকদার মশাইকে বলল, আর একখানা কাগজও কাল থেকে তিনি রাখতে পারেন।
অপেক্ষা না করে সোনাবউদির ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। আগের দিনও সাড়া না দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল, আজ পরদার এধারে দাঁড়িয়েই উমাকে ডাকল। উমা দৌড়ে এসেও থমকে দাঁড়িয়ে গেছে।
তোর মাকে এ ঘরে একবার আসতে বল।
নিজের ঘরের দরজা খুলল। ভিতরটা আজো অগোছালো বা অপরিচ্ছন্ন নয়। জুতো খুলে ধীরাপদ ভূমিশয্যায় এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে অস্বস্তি। বসল।
অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, অস্থিরতা বাড়ছে। কেউ আসছে না। হয়ত না এসেই অপমান করবে তাকে। কিন্তু না, প্রায় মিনিট দশেক প্রতীক্ষার পর সোনাবউদি এলো। ঘরের ভিতর থেকে ধীরাপদর দু চোখ সোজা তার মুখের ওপর গিয়ে আটকালো। কতখানি অশান্তির মধ্যে আছে, ক’টা বিনিদ্র রাতের দাগ পড়েছে চোখের কোলে বোঝা গেল না। দশ মিনিট বাদে এই মন্থর আবির্ভাবে একটা অবজ্ঞাভরা রূঢ়তাই স্পষ্ট শুধু।
গোটাকতক কথা ছিল, বসলে ভালো হত।
বসলে মাটিতেই বসে সোনাবউদি, বেশিক্ষণ থাকলে সরে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দেয়। বসল না, দাঁড়িয়েই রইল। পলকের রুক্ষ অভিব্যক্তি একটু, বলুন শুনছি—
অর্থাৎ বসার প্রবৃত্তি নেই, বেশিক্ষণ দাঁড়ানোরও না।
নিজেকে শান্ত সংযত করার চেষ্টায় আরো কয়েকটা মুহূর্ত নীরবে কাটল, তারপর ধীরাপদ বলল, গণুদা সকলের কাছে বলছেন, আমি তাঁর টাকা নিয়েছি, টাকাটা তাঁকে ফেরত দিতে বলার জন্যে তাদের কাছে হাতজোড় করে বেড়াচ্ছেন।
সোনাবউদি চুপচাপ চেয়ে আছে, আরো কিছু বলবে কিনা সেই প্রতীক্ষা। তারপর নিরুত্তাপ প্রশ্ন করল, আমি তার কি করব?
উনি এই করছেন আপনি জানেন?
এবারের জবাবটা আরো নির্লিপ্ত, বীতস্পৃহ। জানি। খবরটা কাগজে তোলা যায় কিনা এখন সেই চেষ্টায় আছে।
জবাবটা নয়, গণুদা কি করেছে বা করছে তাও নয়, এই প্রীতিশূন্য অবজ্ঞার আঘাতটা মর্মান্তিক। ধীরাপদ যেভাবে তাকালো, এই একজনের দিকে এমন করে আর কখনো তাকায়নি। কিন্তু না, আশা করার মত একটুখানি মরীচিকার সম্বলও ওই মুখে খুঁজে পেল না।
আপনি তাঁকে বাধা দেওয়ার দরকার মনে করছেন না বোধ হয়?
না। কথা বাড়ানো হচ্ছে বলে বিরাগের আভাস, সে এখন নিজের মতই একজন ভাবছে আপনাকে, দোষ দিই কি করে?
ও…। আপনারও তাহলে সন্দেহ টাকাটা আমিই নিয়ে থাকতে পারি?
সোনাবউদির দু চোখ স্থির হয়ে তার মুখের ওপর বিঁধে থাকল কয়েক নিমেষ, তার পরে আবার তেমনি নির্লিপ্ত। ঠিক তেমনি নয়, অনুচ্চ কথা ক’টা হৃৎপিণ্ড খুবলে দেওয়ার মতই তাচ্ছিল্যে ভরা। বলল, ভেবে দেখিনি। তবে মানুষকে আর বিশ্বাসই বা কি!
ধীরাপদ আর কথা বাড়াবে না, কথার শেষ হয়েছে। আর যেটুকু বাকি সেটুকু করে ওঠার মতই স্থৈর্য দরকার, সংযম দরকার। সংযমের আবরণটা প্রায় দুর্ভেদ্য করে পোর্টফোলিও ব্যাগ খুলল। চেকবই বার করল, পকেট থেকে কলম নিল।….স্বর্ণময়ী না স্বর্ণবালা? অনেককাল আগে রণুর মুখে একদিন শুনেছিল নামটা…স্বর্ণবালাই। নাম লিখল, টাকার অঙ্ক বসাল, নিচে নিজের নাম সই করে ধীরে-সুস্থে চেকটা ছিঁড়ল। চেকবই ব্যাগে ঢুকল, কলম পকেটে উঠল। মুখের দিকে তাকাবে না ভেবেছিল, একটুখানি প্রশ্রয়ের আভাস পেলে যথাসর্বস্ব তুলে এনে পায়ের কাছে রাখতে পারত যার, সাড়ে চার হাজারের এই সর্বগ্রাসী কাগজটা তার হাতে তুলে দেবার সময় মুখের দিকে তাকানো যাবে না ভেবেছিল। কিন্তু চেকটা বাড়িয়ে দেবার সময় চোখ দুটো শাসন মানল না, আর মানল না যখন সে চোখ ফেরানোও গেল না।
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত স্নায়ুতে স্নায়ুতে খুশির তরঙ্গ-এতক্ষণের এই দাহ বিস্মৃত হবার মতই। ধীরাপদ ওই মূর্তি চেনে, ওই আগ্নেয়-স্তব্ধতা চেনে। কাজ হয়েছে। দৃষ্টি বদলেছে, নিস্পৃহতার আবরণ খসেছে, অবজ্ঞার বদলে মুখে অপমানের আঁচ ঝলসে উঠেছে।
কিন্তু এও কিছুক্ষণ মাত্র। একটু বাদে ছাইচাপা আগুনের মত নিরুত্তাপ দেখালো সোনাবউদির গনগনে মুখখানা। চেকটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে নিল।
টাকাটা দিয়েই ফেলছেন?
হ্যাঁ। ব্যাগ হাতে ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল, দু চোখে শ্লেষ উপছে উঠতে চাইছে, সাড়ে চার হাজার টাকা যে এত টাকা জানত না। বলল, গণুদাকেও জানাবেন দিয়ে গেলাম—
জানাবই যদি তাহলে আর আমার নামে লিখলেন কেন…। অল্প মাথা নাড়ল, জানানো ঠিক হবে না-
ধীরাপদ কথা শেষ করেছে, অনেক কিছুই শেষ করেছে। বিছানা থেকে উঠে জুতো পায়ে গলালো।
টাকাটা হাতে পেয়েই যেন সোনাবউদির গলার স্বরও একেবারে শমে নেমেছে। বলল, সাড়ে চার হাজার টাকা তো এমনি কেউ দেয় না, এর পর কি করতে হবে বলুন-
ধীরাপদর পা থেমে গেল, কি এক অজ্ঞাত আশঙ্কায় ভিতরটা সচকিত হয়ে উঠল।
সোনাবউদি প্রতীক্ষা করল একটু। ধীর সবিনয় প্রতীক্ষার মতই। বলল, যে দুর্যোগের মধ্যে পড়েছি কোন দিকে যাব ঠিক নেই।…এ রাস্তাটাই নিই যদি আপনাকেই না হয় সবার আগে ডাকব, আপনার অনেক টাকা।
ধীরাপদর দিকেই চেয়ে আছে, তার দিকে চেয়েই বলছে কথাগুলো। হাতের চেকটা ততক্ষণে চার টুকরো হয়ে গেছে। আরো কয়েকটা টুকরো করে মেঝেতে ফেলে দিল সেগুলো। বলল, কিন্তু তা যতদিন না ঠিক করে উঠতে পারছি, টাকা পকেটে করে যে জায়গায় ঘোরাঘুরি করছেন আজকাল সেখানেই যান।
আর দাঁড়ায়নি, আর একবারও ফিরে তাকায়নি, সোনাবউদি ঘর ছেড়ে চলে গেছে। ধীরাপদর চোখ দুটো কি দরজা পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল তাকে? তারপরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল আর? মনে নেই। ট্যাক্সিতে ওঠার পর একবার শুধু মনে হয়েছে ঘরটা খোলা ফেলেই চলে এলো। মনে হতে না হতেই ভুলে গেছে। সব ক’টা স্নায়ু একাগ্র হয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে কি। অননুভূত এক অন্ধ আক্রোশে আত্মবিনাশের রাস্তা খুঁড়ে চলেছে সেই থেকে। যেখানে যেতে বলল সোনাবউদি সদম্ভে এবার সেখানেই যাবে? সেদিনের মত যাওয়া নয়, সেদিন সে যায়নি, একটা বিস্মৃতির ঘোর তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সেই যাওয়ার পিছনে একটা গোটা দিনের ষড়যন্ত্র ছিল। আজ নিজে গিয়ে প্রতিশোধ নেবে? সমস্ত আদিম রিপুর উল্লাস একত্র করে সেই পিচ্ছিল মৃত্যুর গহ্বরে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারাটাই হয়ত সব থেকে বড় প্রতিশোধ নেওয়া হবে সোনাবউদির ওপর। নিজের ওপরেও।
কিন্তু ড্রাইভারকে হয়ত কিছু একটা নির্দেশ দিয়েছে সে-ই। ট্যাক্সি মিত্তির বাড়ির রাস্তায় ছুটেছে। ধীরাপদ গা এলিয়ে দিল।… চেকটা সোনাবউদির হাতে তুলে দেবার সময় যে শেষের যবনিকা দেখছিল চোখের সামনে, সেটাই নিবিড় কালো দ্বিগুণ অনড় হয়ে সামনে ঝুলছে এখন। এইখানেই শেষ যেন সব। এর ওধারে চোখ চলে না।