কাল তুমি আলেয়া – ২০

কুড়ি

ভাষণে আদর্শ বাণিজ্য-স্বপ্নটি বিস্তার করছেন হিমাংশু মিত্র। সভা উম্মুখ শান্ত। সমস্ত প্রতিষ্ঠানের অনাগত আশার ভিত রচনায় মগ্ন বড় সাহেব। সকলের সব আগ্রহ আর উদ্দীপনা বুকের কাছটিতে এসে থেমে আছে। এখন শুধু শোনার পালা। শোনা শেষ হলে গোনা শুরু হবে। বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হবে। এখন গুনছে না কেউ, শুধু শুনছে।

একমাত্র ধীরাপদ গুনছে। দূরে এক কোণে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে শব্দ গুনছে, প্রতিশ্রুতি শুনছে। স্তব্ধ, উন্মুখ বোধ করি সে-ই সব থেকে বেশি।

ভাষণ আর বিবৃতি আজ পর্যন্ত অনেক লিখে দিয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে শোনা এই প্রথম। ঈষং ক্লান্ত দেখাচ্ছে বড় সাহেবকে, রেশমের মত অবিন্যস্ত সাদা চুলের গোছা থেকে থেকে সামনে এসে পড়ছে, আর আপনিই সরে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও সুন্দর আর সবল লাগছে তাঁকে। ধীরাপদর অন্তত লাগছে। বেশ মৃদু অথচ গম্ভীর, স্পষ্ট পরিপুষ্ট গলা। কান পেতে শোনার মত। ধীরাপদ কান পেতেই শুনছে। শুনছে আর গুনছে। শুনছে, গুনছে, আর বিস্মিত হচ্ছে।

এই বয়স পর্যন্ত কোনো একটা গোটা বক্তৃতা ধীরাপদ শোনেনি বোধ হয়। সকৌতুকে বরং শ্রোতাদের দেখেছে চেয়ে চেয়ে। যারা আসে শুনতে অথচ আসলে চায় অবাক হতে, মুগ্ধ হতে। কিন্তু আজ ধীরাপদর সমস্ত চেতনা বুঝি তার শ্রবণ- ইন্দ্রিয়ের দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে। আর কে কি ভাবে শুনছে, কে কেমন অবাক হচ্ছে বা মুগ্ধ হচ্ছে, জানে না। আর ধীরাপদ নিজেই শুনছে আর অবাক হচ্ছে বা মুগ্ধ হচ্ছে। যে বিবৃতির প্রতিটি অক্ষর প্রতি শব্দ প্রতিটি ব্যঞ্জনা প্রতিটি যতি তার চেনা, তার জানা। নিজের রচিত স্বপ্নজালে তার অন্তত আচ্ছন্ন হবার কথা নয়। তবু।

যা সে শুনছে, তা সে শুনবে বলে আশা করেনি। কারণ এই সকালেই আরো কিছু শুনেছিল সে।

অমিতাভ বলেছিল। আর কারখানার বুড়ো পুরনো অ্যাকাউনটেন্টও কিছু বলেছিলেন। গতকাল চারুদির ওকে পালিয়ে বেড়ানোর কথাটা বলার তাৎপর্যও আজ স্পষ্ট হয়েছিল।

…. বিকেলের দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গতকাল বড় সাহেব কারখানাতেই এসেছিলেন। শুধু মূল ভাষণলিপিটি নয়, ধীরাপদর যুক্তি-নির্ভর সেই মোটা মেটিরিয়াল ফাইলটাও সঙ্গে এনেছিলেন। কোম্পানীর বর্তমান অবস্থার যাবতীয় হিসেব-নিকেশ আর তথ্য সন্নিবদ্ধ যে ফাইলে- সেটা। আসার আগে ছেলেকে টেলিফোনে খবর দিয়েছিলেন বোধ হয়, কারণ সে-ও এসেছিল। প্রথমেই ধীরাপদর খোঁজ পড়েছিল। তাকে না পেয়ে ভাগ্নে আর লাবণ্য সরকারকে ডেকেছেন তিনি। অনেক দিনের অভিজ্ঞ অ্যাকাউনটেন্টকেও।

খুব স্পীচ লিখে দিয়েছিলেন যে, লালে লাল করে দিয়েছে, কার কি জোটে এখন দেখুন! অমিতাভ ঘোষ এর বেশি আর কিছু বলেনি।

অর্থাৎ ভাষণের প্রতিশ্রুতিগুলির ওপর লাল পেন্সিলের আঁচড় পড়েছে। বাতিল করা হয়েছে কোনগুলি অ্যাকাউনটেন্টও তা সঠিক বলতে পারেননি। তাঁর কাছ থেকে গতকালের পরিস্থিতির মোটামুটি আভাস পাওয়া গিয়েছিল। মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার লাবণ্য সরকার সামনে ছিল, স্পীচটা বড় সাহেব প্রথমে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করেছেন, ঘোষণার ব্যাপারে সকলে একমত হয়ে এই সিদ্ধান্ত করেছে কিনা? লাল দাগ দেখে দেখে বিষয়গুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিতে সময় লাগেনি লাবণ্য সরকারের। সে জবাব দিয়েছে, এর দুই-একটা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল শুধু, এটা আগে দেখেনি সে—জানেও না কিছু। ওটা তারপর ভাগ্নের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন বড় সাহেব। ভাগ্নে দেখেনি, বলেছে, কি আছে ওতে সে জানে। আর বলেছে, কেন কি করা হয়েছে সবই তো তাঁর টেবিলে ফেলে রাখা হয়েছে কদিন ধরে দেখার সময় না হলে কে কি করতে পারে।

ছোট সাহেব একটা কথাও বলেনি একটা মন্তব্যও করেনি। চুপচাপ স্পীচটা পড়েছে শুধু।

বড় সাহেব সেই মোটা মেটিরিয়াল ফাইল খুলেছেন। বসে বসে একটানা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক দেখেছেন সেটা। অ্যাকাউনটেন্টকে জিজ্ঞাসা করে করে অনেকগুলো হিসেব আর তথ্যের বিশ্লেষণ বুঝে নিতে চেষ্টা করেছেন। অ্যাকাউনটেন্টের ধারণা, খুব ভালো বোঝেননি তিনি।

… কিন্তু আজ ধীরাপদ শুনছে আর গুনছে আর অবাক হচ্ছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। কারণ যা সে লিখেছিল তাই হুবহু পাঠ করছেন বড় সাহেব। একটি শব্দের অদল- বদল করেননি।…ওই বোনাস ঘোষণা হয়ে গেল। বোনাস্ কথাটার উৎপত্তি ব্যুৎপত্তি নিয়ে রসালো মন্তব্য একটু। পাকা চাকরির গ্রেড, স্বেচ্ছাপ্রদত্ত বাড়তি প্রভিডেন্ট ফান্ড স্কীম, গ্র্যাচুইটি, বেতনমূলক ছুটিছাটা, নিখরচায় অসুস্থ কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণের আশ্বাস, এমন কি চীপ-রেট ক্যান্টিন প্রসঙ্গও বাদ গেল না। কোনোটা ঘোষণা কোনোটা বা প্রতিশ্রুতি ঠিক যেমন সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তেমনি বলেছেন। না, বলেছেন আরো অনেক সুন্দর করে।

আদর্শ-বাণিজ্যের ওই স্বপ্নজালে নিজেই জড়িয়েছে যেন ধীরাপদ। ভাষণ-বিরতির সঙ্গে সঙ্গে অনেকক্ষণের একটা অবরুদ্ধ সম্মিলিত প্রতীক্ষা সরবে মুক্তি পেয়ে বাঁচল। গতানুগতিক হাততালি পড়ল, সোরগোল উঠল, শব্দজটিলতা থেকে প্রতিশ্রুতি আর ঘোষণার ইতিবৃত্ত ছেঁকে তোলবার আগ্রহ মুখর হয়ে উঠল। প্রাপ্তির পরিমাণটা টাকা- আনায় বুঝে নেবার বাসনা, ভবিষ্যতের আশ্বাসগুলো ক্যালেন্ডারের পাতায় স্পষ্ট করে নেবার বাসনা।

ধীরাপদর চমক ভাঙল একটু বাদেই। সামনের মঞ্চটা শূন্যে। বড় সাহেব নেমে গেছেন। সকলের অলক্ষ্যে দোতলায় নিজের অফিসঘরে চলে এলো সে। দেরাজ থেকে ফাইল বার করল একটা বড় সাহেবের পার্সোন্যাল ফাইল। ভাষণের গোটাকতক প্রতিলিপি ওতে রাখাই আছে। ওটা হাতে করে নিচে নেমে এলো আবার। সকলের অগোচরে প্রায় নিঃশব্দে কারখানার চত্বর থেকে বেরিয়ে এলো সে।

ফিরল সন্ধ্যার পরে।

উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে গেছে। এই পর্বে বহিরাগত সভাপতি আর প্রধান অতিথির আমদানি ঘটেছে। তাঁরা গণ্যমান্য ব্যক্তি, সারাক্ষণ থাকা সম্ভব নয় বলে গোড়াতেই নিজের ভাষণ-সূচী শেষ করে নিয়েছেন। বড় সাহেবের অসুস্থতার দরুন ছোট সাহেব তাঁর হয়ে সভার উদ্দেশে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে। সম্ভ্রান্ত অতিথি অভ্যাগতরা অনেকেই একে একে বিদায় নিয়েছেন। সংবাদপত্রের মালিকরাও অনেকে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে গেছেন। এখনো রিপোর্টার উপস্থিত আছে দু-চারজন।

এরপর মনোরঞ্জনের সুচী। আমন্ত্রিত শিল্পীদের অনেকে এসে গেছেন, অনেকে আসছেন, আরো অনেকে আসবেন। এ সূচী কত রাত পর্যন্ত চলবে ঠিক নেই। এ পর্বে উৎসব-কমিটির ভলান্টিয়াররা ব্যস্ত বেশি। এখনকার অনুষ্ঠান তাদের দখলে।

কারখানা এলাকার মাঝখানের বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে মস্ত প্যান্ডেল। আলোয় আলোয় ভিতরটা দিনের মত সাদাটে লাগছে। সেই আলো বাইরেও অনেকটা ছড়িয়েছে। বাইরের একদিক জুড়ে পয়সাওলা অভ্যাগতদের সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে। কোনো পরিচিত সম্ভ্রান্ত অতিথিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরছিল সিতাংশু মিত্র। ধীরাপদর সঙ্গে দেখা।

আপনি সেই দুপুর থেকে ছিলেন কোথায়? বিস্ময় থেকেও বিরক্তি বেশি।

কাজ ছিল।

জবাবদিহি করার জন্য না দাঁড়িয়ে ধীরাপদ প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে গেল। এত দেরি হবে সে-ও ভাবেনি। কিন্তু আগে ফেরারও ভাড়া ছিল না খুব। এমন কি আজ আর এখানে না এলেও চলত যেন।

প্যান্ডেলের বাইরে সামনেই যে ভদ্রলোক বিগলিত খুশির আতিশয্যে হাত-মুখ নেড়ে অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে আলাপে মগ্ন তিনি লাবণ্য সরকারের দাদা, সপ্তাহের খবরের কর্ণধার বিভূতি সরকর। হাত তিনেক তফাতে লাবণ্য দাঁড়িয়ে। অনুমান, লাবণ্য দাদাকে এগিয়ে দিতে আসছিল, বিদায়ের মুখে চীফ কেমিস্টের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে বিভূতি সরকার তাকে চড়াও করেছেন। তাঁর এক হাতে চীফ কেমিস্টের একখানি হাত ধরা। এক নজরে বোঝা গেল লোকটি অন্তরঙ্গ জনই হবেন, অন্যথায় হাতে হাত মিলিয়ে এতটা হাসিমুখে অতিথি আপ্যায়নের ধাত নয় অমিতাভ ঘোষের।

লাবণ্য আগেই দেখেছিল ধীরাপদকে, কাছাকাছি হতে আর একবার দেখল। ভাষণ নিয়ে গতকাল ওই আলোচনার পর আজ হুবহু সেটাই পাঠ করবেন বড় সাহেব, এ ধীরাপদর মতই তার কাছেও কম বিস্ময় নয়।… কিন্তু চাপা আনন্দের বদলে ওর এই উসকো-খুসকো শুকনো মূর্তি দেখবে ভাবেনি হয়ত। আগে হলে এর পরেও কাছে এসে জিজ্ঞাসা করত, কি ব্যাপার—ছিলেন কোথায় সমস্ত দিন?

কিন্তু কথাবার্তায় বা আচার-আচরণে সংগতি বজায় রেখে চলার মেজাজে চিড় খেয়ে গেছে তার। লোকটার আজকের এই অনুপস্থিতিও উদ্দেশ্যমূলক ধরে নিয়েছে। আজও সেই খবরের কাগজের মালিকদের অভ্যর্থনায় তাকেই এগিয়ে আসতে হয়েছে। হাসিমুখেই আপ্যায়ন জানিয়েছে তাঁদের, আলাপ করেছে। কিন্তু কেউ যদি তার এই হাসি আর আপ্যায়ন পণ্যের মত ব্যবহার করা যেতে পারে বুঝিয়ে দিয়ে এই দায়িত্বে ঠেলে দেয়—সেটা বরদাস্ত করা সহজ নয়। লাবণ্য সরকার ভাই ধরে নিয়েছে। আজকের দিনেও এতক্ষণের অনুপস্থিতির আর কোনো কারণ দেখেনি সে।

দাদাকে বিদায়সূচক একটা কথাও না বলে লাবণ্য গম্ভীরমুখে ভিতরে চলে গেল। ধীরাপদ একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়াল। বিভূতি সরকার বা অমিতাভ ঘোষের এখনো তার দিকে চোখ পড়েনি। এত লোকের আনাগোনা, বিশেষ করে কে আর কাকে দেখছে। একটু বাদে হাত ঝাঁকাঝাঁকি আর কাঁধ ঝাঁকাঝাঁকি করে বিদায় নিলেন বিভূতি সরকার। যাবার আগে বার বার তাঁর দপ্তরে চীফ কেমিস্টের পদধূলির প্রত্যাশা করে গেলেন হয়ত। কথা শুনতে পাচ্ছে না ধীরাপদ, অন্তরঙ্গ অনুরোধ আর প্রতিশ্রুতি বিনিময়ের হাবভাব থেকেই সেই রকমই মনে হচ্ছে। অমিতাভ ঘোষ প্যান্ডেলের দিকে ফিরল, বিভূতি সরকার বোনের উদ্দেশেই একবার এদিক-ওদিক চোখ চালিয়ে সামনের রাস্তা ধরলেন।

নমস্কার, চললেন?

বিভূতি সরকার ঘুরে দাঁড়ালেন। বহু বাঞ্ছিত কারো সঙ্গে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে গেলে যেমন হয়, তেমনি দেখতে হল মুখখানা। ফর্সা খাঁজকাটা মুখের ভাঁজে ভাঁজে আলগা আনন্দের ছোঁয়া লাগল। কেউ বলবে না, এর আগে মাত্র একদিনের দেখাসাক্ষাৎ, একদিনের আলাপ।

কি আশ্চর্য! আপনি! আপনাকে তো শুনছি সেই দুপুর থেকে খোঁজাখুঁজি করছেন সকলে। মোস্ট ইম্পরট্যান্ট পারসন অফ দি ডে–মিসিং! একটু আগে’ আমাকে নিখোজের বিজ্ঞাপন দিতে বলেছিলেন মিস্টার ঘোষ। হাসলেন, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আপনার সঙ্গে দেখা হল না ভেবে বড় আপসোস হচ্ছিল।

ধীরাপদ সবিনয়ে বলল, আপনাদের দরজায় দরজায়ই ঘুরছিলাম সেই থেকে। সকালের একটা ডিটেলড্ রিপোর্ট রেখে এসেছি আর দু-একটা ছবি, দেখবেন একটু…

নিশ্চয় নিশ্চয়, কি আশ্চর্য। পারলে বিভূতি সরকার তক্ষুনি দেখে ফেলেন। —আপনি আবার কষ্ট করলেন কেন, আমি তো আসতুমই, আর এটা তো কাগজেরই কাজ। সপ্তাহের খবর খুলে পাতা-ভরা কভারেজ পাবেন—আমি গিয়েই দেখছি সব।

আগাম টাকা দিয়ে তিন দিনের বিজ্ঞাপন বুক করে আসার এই ফলটুকু আশা করাই যায়।

ধীরাপদ কৃতজ্ঞতাসুলভ অভিবাদন জ্ঞাপন করার আগেই বিভূতি সরকার আবার বললেন, কাল পরশু সময় করে আসুন না একদিন, পছন্দমত হল কিনা নিজের চোখেই দেখে নেবেন। সময় তো আছে, আর যদি কিছু জানবার থাকে জানিয়ে দেবেন —আসুন, কেমন?

ধীরাপদ মাথা নাড়ল, যাবে।

নিজের নগণ্য কাগজের প্রতি সুনজরের সুপারিশ তারপর। একই প্রসঙ্গের একটু দ্বিতীয় অংশ যেন। যেমন মিস্টার ঘোষের সঙ্গে বৈষয়িক কথাবার্তা হল কিছু, তিনি বললেন সব কিছুর আসল চাবি এখন ধীরুবাবুর হাতে। শুনে বিভূতিবাবু আগের মতই নিশ্চিন্ত হয়েছেন। অনুগ্রহ করে চাবিটা মাঝে মাঝে ধীরুবাবু তাঁর দিকেও ঘোরাবেন একটু-আধটু, সেটা আদৌ দুরাশা নয় তাঁর…ধীরুবাবুর সহৃদয়তার পরিচয় তিনি প্রথম দিনেই পেয়েছেন।

চাবির কথা সবিনয়ে অস্বীকার করলেও স্মরণ রাখার আশ্বাস দিয়েই বিদায় করতে হয়েছে তাঁকে। প্যান্ডেল থেকে একটু নিরিবিলি তফাতেই দাঁড়িয়ে রইল ধীরাপদ। দেখার তাগিদ নেই, ইচ্ছে করলে এখানে দাঁড়িয়েও গান-বাজনা শুনতে পারে। কানে আসছে বটে, কিন্তু শোনার তাগিদও নেই। চাবির কথাটা অস্বস্তিকর। আর সকালের সমস্ত ব্যাপারটাও। এই প্যান্ডেল, এই উৎসব, এই সব কিছু ছেড়ে সারাক্ষণ তার চোখ জুড়ে আর মন জুড়ে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি তিনি বড় সাহেব হিমাংশু মিত্র। মোটা ফাইলে সে যত হিসেব-নিকেশ আর যুক্তি দাখিল করুক, আর সেই ভাষণ যত খোলাখুলি তাঁর সামনে ফেলে রেখে নিজের সততা দেখাক, ভিতরে সে যে তাঁকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল, সেটা অস্বীকার করবে কেমন করে?

ধীরাপদ নিজেই খানিকটা বিভ্রান্ত হয়েছে।…এই চাবির কথা অমিতাভ ঘোষ কেন, আজ অন্তত অনেকেই বলবে। লাবণ্য সরকার বলবে, সিতাংশু মিত্র বলবে, বুড়ো অ্যাকাউনটেন্ট বলবেন। অস্বস্তি বাড়ছে ধীরাপদর। নিজেরই নিভৃতের কোনো একান্তজনের কাছে আবেদন, আমি চাবি চাই নে।…সত্যিই মাথা নাড়ছিল খেয়াল নেই। চাবি সে চায় না।

দাদা, আপনি এখানে?

সচকিত হয়ে ঘাড় ফেরাল ধীরাপদ। মেডিক্যাল হোমের রমেন হালদার। ফিটফাট চকচকে হয়ে উৎসবে এসেছে। ধীরাপদও খুশি একটু। ছেলেটা খুশির দূত।—এই এলে?

এই! চোখ টান করল, এসেছি সেই বিকেলে—সেই থেকে তো আপনাকেই খুঁজছি আমরা। এখনো তো আপনার দেখা মেলে কিনা দেখার জন্য ও-ই ঠেলে পাঠালে।

আমরা…ও-ই ঠেলে পাঠালে। ধীরাপদ অবাক, কে পাঠালে? .

ওই ইয়ে—কাঞ্চন। একেবারে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছিল রমেন হালদার, তুষ্টির ব্যঞ্জনা চোখে না পড়ার কথা নয়। ধীরাপদ হাঁ করেই চেয়ে আছে। লাউড-স্পীকারে আসরের গানের শব্দও ডুবে গিয়ে রমেনের হড়বড়ানি কানে আসছে।— আজ চার দিন হল ও আমাদের ওখানে কাজে লেগেছে, আপনাকে আর বলছি কি, আপনিই তো করলেন—খুব ভালো মেয়ে দাদা, আপনার প্রশংসা ধরে না, আজ সকালে আপনার কথা বলতে বলতে তো কেঁদেই ফেলল। হি হি হাসি,—বলছিল আপনি নাকি দেবতার মতন; আমি বলেছি, মতন নয়— আমার দাদা দেবতাই। আপনি দাঁড়ান দাদা একটু, যাবেন না যেন—আমি এক্ষুনি আসছি।

শশব্যস্ত ভিতরে ঢুকে গেল। দেবতার মত দাদা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে।…চার দিন আগেই লাবণ্যর সঙ্গে কাঞ্চনের চাকরির ফয়সালা হয়েছিল বটে। কিন্তু মাত্র চার দিনের ফসল দেখে দুই চক্ষু স্থির ধীরাপদর।

রমেন ফিরল একটু বাদেই। সঙ্গে সঙ্গিনী। সামনে এসে দাঁড়াল। ভীরু, লজ্জাবনত। রমেন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে বলে উঠল, এই দেখো, ভিড়ের মধ্যে হাঁকডাক হম্বিতম্বি করার লোক নন দাদা, এইখানেই একলাটি দাঁড়িয়ে—

কাঞ্চনের মুখ তুলতে সঙ্কোচ। দেবতুল্য ব্যক্তির এই নীরব পর্যবেক্ষণের দরুন ঈষৎ শঙ্কিতও হয়ত। মুখের দিকে তাকাতে চেষ্টা করল একবার, তারপর কি করবে বা কি বলবে ভেবে না পেয়ে পায়ের কাছে টিপ করে প্রণাম করে উঠল একটা।

এধার ওধারে দু-একজন ঘাড় ফেরাল। নড়েচড়ে আত্মস্থ হল ধীরাপদ।—ভালো আছ?

মাথা নাড়ল। ভালো আছে। কতটা ভালো আছে তাই একটু দেখে নিল ধীরাপদ, সেই নিঃসাড় শীর্ণ মুখ খুব তাজা দেখাচ্ছে না এখনো, কিন্তু এই মুখে আশার কাঁচা রঙ লেগেছে। আর দু-চার দিন বা দু চার মাস গেলে তাজাও দেখাবে হয়ত।

কোথায় আছ এখন?

জানালো, মিস সরকারের ওখানেই আছে এখনো, দু-তিন দিনের মধ্যেই বাড়ি যাবে।

সঙ্গে সঙ্গে রমেনের সেই প্রগল্ভ হাসি আর চাপা মন্তব্য।—ও-ও আমার মতই ওঁকে দিদি ডাকতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে দাদা, একদিন দিদি বলে আর বলেনি।

ধীরাপদর কেন কে জানে ধমকে উঠতে ইচ্ছে করছিল রমেনকে। কিছু বলল না বটে, কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাও বাড়ালো না। গম্ভীর মুখে আবার গান শুনতে পাঠিয়ে দিল তাদের। পরে পায়ে পায়ে নিজেও প্যান্ডেলের কাছে এসে দাঁড়াল। ভিতরের বহু মাথার মধ্যেও ওই দুজনকে আবিষ্কার করা গেল। তিন-চার সারি ওধারে দুটি চেয়ারে পাশাপাশি বসে। এক বয়সীই হবে, কিন্তু তারুণ্যের জোয়ারে ছেলেটাকে ছেলেমানুষ লাগছে। কাঞ্চনের পরনে চোখতাতানো ছাপা শাড়ি নেই, কটকটে লাল সিল্কের ব্লাউজ নেই, মুখের প্রসাধনও অনেক কম। কিন্তু ওই দিকে চেয়ে চেয়ে এই মুহূর্তে ফুটপাথের সেই কদর্য মূর্তিই কেমন যেন বড় বেশি চোখে ভাসছে ধীরাপদর।

আবারও ফাঁকায় এসে দাঁড়াল সে। ভিতরে ভিতরে নতুন ভ্রুকুটি জমে উঠেছিল একটা, বিরক্ত হয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে হাল্কা বোধ করতে চেষ্টা করল। কেউ কিছু করে না, কেউ কিছু ঘটায় না। যা হবার আপনি হয়, যা ঘটার আপনি ঘটে। নইলে কার্জন পার্কের লোহার বেঞ্চির সেই ধীরাপদ চক্রবর্তী আজ এত বড় প্রতিষ্ঠানের এমন এক হোমরাচোমরা ব্যক্তি হয়ে বসল কি করে? আর বিকৃত রিপুদগ্ধ পথচারীর ক্ষণসঙ্গিনী এই পথের অভিসারিকাই বা এত বড় দুনিয়ায় ঘুরে ফিরে মেডিক্যাল হোমের ওষুধ- বেচা রমেন হালদারের পাশে এসে বসে কেমন করে?

ভালো লাগছে না, মাথাটা টলছে একটু একটু, পা দুটো অবশ লাগছে। ধীরাপদর খেয়াল হল, পেয়ালা-কতক চা ছাড়া সমস্ত দিনে আর খাওয়া হয়নি কিছু। সময় হয়নি, মনেও পড়েনি। চুপচাপ গা-ঢাকা দিলে কেমন হয়…! বাড়ি গিয়ে চান, খাওয়া—ঘুম! কিন্তু হিমাংশু মিত্র জেগে থাকলে আর টের পেলে অসুবিধে। ডাক পড়তে পারে। আজ আর তাঁর মুখোমুখি দাঁড়ানোর ইচ্ছে নেই। কাল—আজকের এই রাতের থেকে কালকের সকালটা অনেক অন্যরকম হতে পারে। রাত আর দিনের মতই তফাত হতে পারে। হয় যাতে ধীরাপদ সমস্ত দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সেই চেষ্টাই করেছে।

প্যান্ডেলের পিছনের দিকে প্রথম সোরগোল উঠল একটু, তারপর হুড়মুড় করে সেদিকের দর্শক-শ্রোতারা সরে আসতে লাগল। গণ্ডগোল বাড়ছে, গানবাজনা থেমে গেছে, ওদিকে ভলান্টিয়াররা ছোটাছুটি করছে। ধীরাপদ এগিয়ে গেল দেখতে।

প্যান্ডেলের একদিকে আগুন লেগেছে। তেমন কিছু নয়। কিন্তু আগুনটা বাড়ার আগে নেভানো দরকার। কারেন্ট লিক করছিল হয়ত, কাপড়ে তারে-বাঁশে জড়িয়ে ধরে গেছে। এত উঁচুতে যে কিছু করা শক্ত। মেন অফ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের সমুদ্র। আগুন নেভানোর ব্যবস্থা সব কারখানাতেই থাকে, এখানেও আছে-কিন্তু সব সরঞ্জাম বাইরে এনে কাজে লাগানো সময়সাপেক্ষ। এই ছোটাছুটির মধ্যেই বেপরোয়া গোছের একটা লোক ছালা কাঁধে মোটা থাম বেয়ে তরতরিয়ে ওপরে উঠে গেল। লোকটা কারখানারই শ্রমিক। উদ্দেশ্য, ওখানকার তার ছিঁড়ে আগুন ছালা-চাপা দেবে।

বাহাদুরি আছে লোকটার, আগুন নেভালো ঠিকই। সাত-আট মিনিটের ব্যাপার সবসুদ্ধ। একটু বাদে আলো জ্বলল। দেখা গেল লোকটার একটা হাত অনেকটা ঝলসে গেছে, কাঁধের কাছটা পুড়ে গেছে, হাতে বাহুতে গলায় মস্ত মস্ত ফোসকা। অনেকেই দৌড়ে এলো। সিতাংশু অমিতাভ লাবণ্য সিনিয়র কেমিস্ট আরো অনেক। ধীরাপদও। ব্যাপারটা দেখেই লাবণ্য সরকার দ্রুত অফিস বিলডিংয়ের দিকে চলে গেল। খানিকক্ষণের মধ্যেই একেবারে ইনজেকশান রেডি করে ফিরে এলো।

কিন্তু যে লোক ঝোঁকের মাথায় এমন কাণ্ড করে আগুন নিভিয়ে এলো সে ইনজেকশান নিতে নারাজ। সুই নেবে না। বার বার বলতে লাগল, সে ঠিক আছে, তার কিছু হয়নি।

লাবণ্য ধমকে উঠল, তোমার যা হয়েছে তুমি টেরও পাবে না, বসো চুপ করে।

কিন্তু চুপ করে বসবে কি, একে এতখানি পোড়ার যন্ত্রণা, তার ওর ঘাবড়েছে লোকটা। ফলে ছোট সাহেবের ধমক খেতে হল এবারে। সিনিয়র কেমিস্ট জীবন সোমও চোখ রাঙিয়ে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করলেন। অন্য বাবুরা দু-একজন চেপেচুপে ধরল তাকে।

লাবণ্য সরকার ইনজেকশান দিল।

লোকজনের সাহায্যে তানিস সর্দার লোকটাকে তুলে নিয়ে গেল। নির্বুদ্ধিতার জন্য সে এরই মধ্যে কয়েক দফা বকাবকি করেছে তাকে। পোড়া ঘায়ের জ্বালা জানে সে।

আসরে গান-বাজনা বেসুরো লাগছে এরপর। নীরস আর বিরক্তিকর লাগছে। ধীরাপদর আবারও মনে হল, যা হবার তাই হয়, যা ঘটবার তাই ঘটে। ওই লোকটাই কি জানত, এমন উৎসবের রাতেও এই মাশুল দিতে হবে তাকে?

জানলে অনেক কিছুই হত না। লোকটা ওভাবে পোড়া-পোড়া হত না। হলেও লাবণ্য সরকার সাত-তাড়াতাড়ি ইনজেকশান দিতে ছুটে আসত না। এলেও ধীরাপদই হয়ত বাধা দিত।…ওই লোকটার জন্যে নয়, লাবণ্যর কথা ভেবেই বাধা দিত।

কিন্তু কি থেকে কি যে হয় আগে আর কে জানছে।

পরদিন। মান্‌কে এসে খবর দিল, বড় সাহেব ডাকছেন।

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে প্রস্তুত হয়ে বসেছিল ধীরাপদ। এতক্ষণ কোনো খবর না পেয়ে বরং অবাক হচ্ছিল। এই দিনের সূচনা অন্যরকম হবে জানত। সে যে রকম আশা করছে সে রকম নাও হতে পারে। না হলে ধীরাপদ কি করবে? বিশ্বাসভঙ্গের অনুযোগ ভ্রুকুটি বা বিরাগের আভাস দেখলে কি করবে? বড় সাহেব কি বলতে পারেন জানা থাকলে জবাব নিয়ে প্রস্তুত হয়েই যেত সে। অনিশ্চয়তার মধ্যে বসে প্রত্যেকটা মুহূর্ত ভারী লাগছিল।

সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওপর থেকে অমিতাভ নেমে আসছে। মুখ দেখে মনে হয় মামার কাছ থেকে আসছে।…এই জন্যেই তার ডাক পড়তে দেরি বোধ হয়।

কি ব্যাপার? কাঁধের ওপর মাথাটা থাকবে তো? ধীরাপদর মুখে কৃত্রিম ভীতির বিন্যাস।

থাকবে।…যান, মাথা আর একটা বেশিও গজাতে পারে। সিঁড়ির মুখ আগলে না দাঁড়ালে অমিতাভ এক মুহূর্তও দাঁড়াত না হয়ত। এই মুখ সর্বদাই ভিতরের মেজাজের দর্পণ। এ দর্পণে কদিন ধরে ঘোরালো ছায়া পড়ে আছে। কিন্তু এই সদ্য বিরূপতা যেন তারই ওপরে। বিদ্রূপের আঁচে চশমার পুরু কাচ দুটোও চকচকে দেখাচ্ছে। বলল, দু’শ টাকা কেন, যা করেছেন, মাইনে ডবল হওয়া উচিত আপনার।

প্রায় গা ঠেলেই নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। ধীরাপদ বোকার মত চেয়ে ঘরে ঢুকে যেতে দেখল তাকে।….দু’শ টাকা মাইনে বাড়ানো হচ্ছে নাকি তার! একেবারে ওপরের দিকের কজনের মাইনে কত বাড়বে না বাড়বে সেটা বড় সাহেবের নিজস্ব বিবেচনাসাপেক্ষ। এ নিয়ে ধীরাপদ এক মুহূর্তও মাথা ঘামায়নি। অমিতাভও ঘামায়নি নিশ্চয়। তাছাড়া ওর মাইনে যে অনেক বেশি হওয়া উচিত এ কথা সে-ই চারুদিকে বলে এসেছিল একদিন। এই শ্লেষের আর উষ্মার ভিন্ন কারণ। ভোরের খবরের কাগজ দেখেছে। ক’টা দেখেছে কে জানে! দেখে ওর চাটুবৃত্তি আবিষ্কার করেছে। হাল ছেড়ে ধীরাপদ ওপরে উঠতে লাগল, এমন অবুঝকে সে সামলাবে কেমন করে? সকালেই আবার কোন্ ফয়সালা নিয়ে মামার ঘরে হাজির হয়েছিল তাই বা কে জানে?

বড় সাহেব বললেন, বসো—

ধীরাপদ আগেই খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। মুখ দেখে আরো একটু স্বস্তি। খাটের ওপর ছড়ানো একরাশ খবরের কাগজ। ছোট বড় যত আছে সব ক’টাই বোধ হয়। ওর কোনটাতে কি আছে ধীরাপদর প্রায় মুখস্থ। নিজেই বসে বসে বিবৃতি লিখে দিয়ে এসেছে। এক-একটা কাগজের জন্য এক-একরকম করে লিখেছে। কিন্তু মূল কথায় অর্থাৎ ঢালা প্রশংসায় খুব তফাত নেই। এই প্রশংসার আড়ালে তাঁর প্রতিশ্রুতিগুলির ওপরেও পাকা ছাপ পড়েছে। সব কাগজেই প্রতিষ্ঠান-কর্ণধারের ছবি বেরিয়েছে। রিপোর্টারদের সৌজন্যে কোনো কোনো কাগজে এর ওপর ভাষণরত সভাপতির ছবিও ছাপা হয়েছে। দু-একটা কাগজে সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয় মন্তব্যলাভও ঘটেছে।

ধীরাপদ জেনেছে টাকায় অনেক হয়। আর তার সঙ্গে সুদর্শনা রমণীর বলিষ্ঠ আর সুচারু আবেদনের যোগ থাকলে আরো অনেক কিছু হয়। মনে মনে ধীরাপদ আজ লাবণ্যর প্রতিও কৃতজ্ঞ।

ইজিচেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে বড় সাহেব পাইপ টানছিলেন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন একবার। দৃষ্টিটা কৌতুক-প্রচ্ছন্ন। খবরের কাগজগুলোও হয়ত ইচ্ছে করেই খোলা—ছড়িয়ে রেখেছেন।

এইসব কাগজে কত টাকার বিজ্ঞাপন ঢেলেছ এ পর্যন্ত?

মনে মনে অনেক কথার জবাব ঝালিয়েছে সে, কিন্তু এ-প্রশ্নটা অতর্কিত! তবু ধীরাপদ বিব্রত বোধ করছে না। সহজ জবাব দিল, এখনো হিসেব করে দেখা হয়নি।

….পরের ব্যাপারটার জন্যে আরো তো অনেক গুণ বেশি লাগবে, নইলে এদের ব্যাকিং পাব কেন?

পরের ব্যাপারটার জন্য অর্থাৎ আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের দরুন। বড় সাহেবকে সেটা বিশ্লেষণ করে বলা নিষ্প্রয়োজন। এই এক দিনের প্রচারের আড়ম্বরেই যে লক্ষ্যপথে বেশ খানিকটা এগোনো গেছে সেটুকু তিনি অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারেন। সামনের কানপুরের অধিবেশনেই অনেকটা বাড়তি মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন তিনি।

পাইপ মুখে সকৌতুক গাম্ভীর্যে নিরীক্ষণ করছেন ওকে।-একটু আগে টেলিফোনে তোমার দিদিকে তোমার কথাই বলছিলাম। তুমি লোক সুবিধের নও, রাদার ডেঞ্জারাস…

ধীরাপদও হাসছে অল্প অল্প। চুপ করে থেকে অভিযোগ মেনেই নিল।

বড় সাহেব তাকে প্রশ্রয় দিতে রাজী আছেন, সমর্থন করতেও, কিন্তু একটু- আধটু সচেতন না করে দিয়ে নয়। স্নেহভাজন একজন বিশ্বস্ত কর্মীর সঙ্গে কোম্পানীর অতীত-ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে গল্প করছেন যেন। কোন অবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠান আজ এই পর্যায়ে এসেছে আর কতবার তাদের বিলুপ্তির সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে সেই গল্প ধীরাপদ আগেও শুনেছে। এমন কি ওরই লেখা বড় সাহেবের গতকালের ভাষণেও এই আবেগের দিকটায় ছাড় পড়ে নি। সেইটুকুরই পুনরুক্তি। বললেন, কোম্পানীর সংস্রবে যারা আছে তাদের আরো অনেক ভালো হোক, অনেক পাক তারা, তাঁর একটুও আপত্তি নেই। কিন্তু যা থেকে ভালো হবে আর পাবে ভাতে যেন টান না ধরে।-ডোন্ট কীল দি বার্ড দ্যাট গিভস্ ইউ গোল্ডেন এস্‌!

একটু বাদে ভাগ্নের প্রসঙ্গও তুললেন তিনি। অবিলম্বে গোটাগুটি একটা রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট চাই তার। প্রস্তাবটা নতুন নয় শুনল, আগে এজন্যে প্রায়ই তাগিদ দিত। বছর কয়েক আগে একবার এ নিয়ে ক্ষেপে গিয়েছিল নাকি। মাঝে চুপচাপ ছিল, এখন আবার নতুন কিছু মাথায় ঢুকেছে হয়ত।

বড় সাহেবের মুখ চিন্তাচ্ছন্ন। ভাগ্নের এবারের চাওয়াটা ছেঁটে দিতে পারছেন না বোধ হয়। এসব সমস্যা ধীরাপদ আজকাল ভালই বোঝে, শুধু গবেষণা চালানোর জন্য আলাদা একটা বিভাগ পত্তন করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এতে ধরাবাঁধা সময়ের মিয়াদ কিছু নেই, খরচেরও ঠিক-ঠিকানা নেই। ভাগ্নের প্রতিভায় অনাস্থা নেই বড় সাহেবের, অনাস্থা তার মেজাজের ওপর। আজকের ঝোঁক কাল কেটে যেতে পারে। এ প্রোডাকশন ইউনিট নয় যে একজনের কাজ আর একজনকে দিয়ে হবে।

বড় সাহেব আর কিছু বলবেন মনে হয় না। ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল, তারপর ইতস্তত করে জানালো, আজ বিকেলে সে সুলতান কুঠিতে ফিরে যাচ্ছে!

যেজন্য তার এই বাড়িতে এসে থাকা সেই কাজ শেষ। আপত্তি করার কথা নয়, এই রকমই কথা ছিল। কিন্তু বড় সাহেবের আর তা মনেও ছিল না হয়ত। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন একটু, এখানে তোমার কি অসুবিধে?

আপত্তির এই সুর ধীরাপদ আগেই আঁচ করেছিল। বলল, অসুবিধে কিছু না, এমনিই যাব ভাবছি।

না গেলে ক্ষতি হচ্ছে খুব?

জবাব পেলেন না, জবাব আশাও করেননি। ধীরাপদর মনে হল, এবারে রসালো মন্তব্যই কিছু করে বসবেন হয়ত। শেষ পর্যন্ত তা না করে রায় দিলেন, আচ্ছা আমি কানপুর থেকে ঘুরে আসি, তারপর কথা হবে।

আসার সময় ধীরাপদ খুব মাথা উঁচু করে ঘরে ঢোকেনি। কালকের ভাষণ আর প্রতিশ্রুতি রচনা নিয়ে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা ছিল। রূঢ় বোঝাপড়াও কিছু হয়ে যেতে পারত। বেরুবার সময় সে বেরিয়ে এলো মাথা উঁচু করেই। এত দিনের একটা মানসিক দ্বন্দ্বের অনুকূল নিষ্পত্তির দরুন নয়, মাথা-উঁচু এই মানুষটিকে আজ তার অনেক উঁচু মনে হয়েছে বলে।

এই একটা দিনে আরো কিছু বিস্ময় সঞ্চিত ছিল ধীরাপদ জানত না। ধীরাপদ কেন, কেউ জানত না। কারখানার আঙিনা থেকে গতকালের উৎসবের আয়োজন এখনো গোটানো হয়নি। তাঁবু ওঠেনি, মঞ্চ বাঁধা, চেয়ারগুলো শুধু ভাঁজ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে কারখানার হাওয়া উগ্র, বিপরীত।

ওদের হাবভাব ঘোরালো, চাউনি বাঁকা, কথাবার্তা ধারালো। বিশেষ করে স্বল্প বেতনের অদক্ষ কর্মচারীদের। কাজে হাত পড়েনি তখনো, জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে জটলা করছে। গত রাতের উৎসবে গলা-কাঁধ-হাত পোড়া সেই লোকটার সমাচার শুনে ধীরাপদ বিমূঢ় একেবারে। ইনজেকশন দেবার দশ মিনিটের মধ্যে তানিস সর্দার গাড়ি করে তাকে ঘরে তোলার আগেই মারাত্মক অবস্থা নাকি। লোকটা কেঁপে কেঁপে হাত-পা ছুঁড়ে অস্থির। পাগলের মতো অবস্থা সেই থেকে এ পর্যন্ত। ঘন ঘন গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কথা বলতে পারছে না, তোতলামি হচ্ছে, সর্বাঙ্গ জ্বলে জ্বলে যাচ্ছে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, দেয়ালে মাথা ঠুকছে—হাসছে কাঁদছে লাফাচ্ছে, অনেক কাণ্ড করছে।

দোতলায় উঠেই ধীরাপদ আর এক নাটকীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন। সামনের করিডোরে লাবণ্য সরকারকে ঘিরে জনাকয়েক পদস্থ অফিসারের আর একটা জটলা। জটলা ঠিক নয়, নির্বাক নারীমূর্তির চারদিকে ভদ্রলোকেরা মৌন বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে শুধু। একটু তফাতে জনাতিনেক সাধারণ কর্মচারী হাত-মুখ নেড়ে চীফ কেমিস্ট অমিতাভ ঘোষকে বোঝাচ্ছে কি। ইউনিয়নের পাণ্ডা গোছের লোক তারা, বক্তব্য থাকলে যাদের বলতে কইতে দ্বিধা নেই।

ধীরাপদর মনে হল, তাকে দেখেই লাবণ্যর চোখে প্রথম পলক পড়ল। চাপা স্বস্তির আভাস একটু। কিন্তু সে সামনে এসে দাঁড়ানোর আগে অমিতাভ ঘোষ এগিয়ে এলো। লাবণ্যকে জিজ্ঞাসা করল, কি ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল—-অ্যাট্রোপিন অ্যান্ড মরফিন?

লাবণ্য নির্বাক এখনো, কিন্তু সাড় ফিরেছে। তাকালো তার দিকে। জবাব দিত না হয়ত, পিছনে ইউনিয়নের অর্ধশিক্ষিত লোক ক’টাকে দেখেই মাথা নাড়ল বোধ হয়। অর্থাৎ তাই।

ডোজ?

রমণীর কঠিন দৃষ্টি তার মুখের ওপর বিঁধে থাকল খানিক।— অ্যাট্রোপিন ওয়ান- হানড্রেথ গ্রেন, মরফিন ওয়ান-ফোর্থ।

মাথা ঝাঁকিয়ে অমিতাভ ঘোষ অসহিষ্ণু প্রশ্ন ছুঁড়ল একটা।— অ্যাট্রোপিন একটা ট্যাবলেট দিয়েছিলে কি দুটো?

এবারেও ধৈর্য সম্বরণ করল লাবণ্য সরকার। কিন্তু সে চেষ্টায় মুখের রঙ বদলাচ্ছে। নিষ্পলক কঠিন দুই চোখ তার মুখের ওপর স্থির।

একটা।

আর ইউ সিওর?

আর জবাব দিল না, কয়েক নিমেষ দাঁড়িয়ে মর্মান্তিক দেখাটুকুই শেষ করে নিল শুধু। তারপর ধীর পদক্ষেপে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

নালিশ নিয়ে যারা এসেছিল তাদেরই সামনে এ ধরনের বাক-বিনিময়ের ফলে বিড়ম্বনা বাড়ল বই কমল না। ধীরাপদর কাজে মন বসছিল না। লাবণ্য সরকার লোকটার ভালো করতেই গিয়েছিল, কিন্তু এ আবার কি কাণ্ড? সে কি দোষ করল? খানিক বাদে আবারও নিচে নেমে আসতে একসঙ্গে অনেকে ছেঁকে ধরেছে তাকে। তাদের বক্তব্য, কোম্পানীর ডাক্তার রোগী দেখে এসে বলেছেন, ওষুধটা সহ্য হয়নি হয়ত। ডাক্তার সাহেব যেটুকু বলার ভদ্রতা করে বলেছেন, সহ্য যে হয়নি সে তো তারা নিজের চোখেই দেখছে। সহা হবে কেমন করে? চীফ কেমিস্ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন, একটা টেবলেট দেওয়া হয়েছে কি দুটো—কিন্তু কটা দিয়েছেন ঠাকরোন ঠিক কি! মানুষকে তো আর মানুষ বলে গণ্য করেন না, হয়ত বা চাট্টে-পাঁচটাই ফুঁড়ে দিয়ে বসে আছেন!

ওদের সামনেই কোম্পানীর ডাক্তারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলল ধীরাপদ।

তারপর তাদের বোঝাতে চেষ্টা করল, ডাক্তার সাহেব ওষুধ ভুল এ কথা একবারও বলেননি—পুড়ে গেলে সকলেই ওই ইনজেকশনই দিত। তবে কোনো বিশেষ কারণে কারো কারো শরীরে অনেক ওষুধ সয় না, এও সেই রকমই কিছু ব্যাপার হয়েছে—

কিন্তু কেন কি হয়েছে তা ওরা শুনতে চায় না। ওদের বিশ্বাস লোকটার জীবন বরবাদ হয়ে যেতে বসেছে, আর সেটা হয়েছে মেম-ডাক্তারের দোষে। তারা কৈফিয়ৎ চায়, বিহিত চায়। তারা কানুন জানে— শ্রমিকদের কিছু হলে কোম্পানীর কোন ডাক্তার দেখবে তাদের, সেটা কানুনে ঠিক করে দেওয়া আছে, মেম-ডাক্তার কানুনের ডাক্তার না হয়েও সুই ফুঁড়তে গেলেন কেন? তা ছাড়া লোকটা তো বার বার আপত্তি করেছিল, বার বার বলেছিল, সে ঠিক আছে, তার কিছু হয়নি-তবু ধরে বেঁধে তাকে সুই দেওয়া হল কেন?

আইনের দিকটা মিথ্যে নয়, ওদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসক আছে কোম্পানীর। কিন্তু এরই মধ্যে ওদের আইন বোঝাতে গেল কে? ধীরাপদর ধারণা, এই উত্তেজনার পিছনে মাথাওয়ালাদের সক্রিয় ইন্ধন আছে। লোকটার অবস্থা বা তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না কেউ, আগে বিহিতের কথা তুলছে। অন্যান্য কর্মচারীরাও ছদ্মগাম্ভীর্যের আড়ালে কাউকে জব্দ করতে পারার মজা দেখছে যেন। অথচ গতকাল বড় সাহেবের ঘোষণার আর উৎসবের পরে মন-মেজাজ সকলেরই ভালো থাকার কথা।

ক্ষোভের হেতু স্পষ্ট হল ক্রমশ। বিকেলের দিকে বুড়ো অ্যাকাউনটেন্টই ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। ভাষণের আগের দিন বিকেলে বড় সাহেবের হঠাৎ কারখানায় পদার্পণের খবর কে আর না রাখে? ধীরাপদর অনুপস্থিতিতে অন্য কর্তাদের নিয়ে দু ঘণ্টা ধরে মিটিং করা হয়েছে, প্রাপ্তির খসড়ায় অনেক লাল দাগ পড়েছে, মিস সরকার আর ছোট সাহেব তাদের পাওনার ব্যাপারে সায় দেয়নি—এই সবই তাদের কানে পৌঁচেছে হয়ত। একটুখানি পৌঁছলেও বাকিটা অনুমান করে নিতে কতক্ষণ? এত সবের পরেও বড় সাহেব মূল ঘোষণাপত্রটিই হুবহু পাঠ করেছেন, এ তারা বিশ্বাস করবে কেন? কি পেয়েছে বা পাবে নিচের দিকের কর্মচারীদের স্পষ্ট ধারণা নেই এখনো পর্যন্ত, কিন্তু তাদের বিশ্বাস মোটা প্রাপ্তির যোগটা শেষ মুহূর্তে কেটেছেঁটে অনেক ছোট করা হয়েছে।

বুড়ো অ্যাকাউনটেন্ট এত সব বলেননি অবশ্য, হাসিমুখে একটু মজার আভাসই দিয়ে গেছেন শুধু। বলেছেন, ওরা এখনো ভাবছে আপনি আরো অনেক কিছুর সুপারিশ করেছিলেন, আর সেই দিন এসে এনাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বড় সাহেব তার অনেক কিছু নাকচ করেছেন। কেউ বলছে হিসেবপত্র করে ধীরুবাবু তিন মাসের বোনাসের কথা লিখেছিলেন, কেউ বলছে পেনশনের কথা লেখা ছিল, কেউ বা ভাবছে এখনই যা দেবার কথা সেসব পরের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

ধীরাপদ একটু থেকেই বুঝে নিয়েছে। ছোট সাহেব নাগালের বাইরে, মেম- ডাক্তারকে জব্দ করার এ সুযোগ ওরা ছাড়বে না। আর কিছু না হোক, নাজেহাল করতে পারাটাই লাভ। কিন্তু কাল রাতের সেই আধপোড়া দস্যি লোকটার সত্যিই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা নাকি?

জনতার মেজাজ চড়লে যা হয় এক্ষেত্রেও তাই। বিশেষ করে কড়া প্রতিবাদ নেই যেখানে। আগের দিন যারা চুপচাপ ছিল, পরের দিন তাদেরও গলা শোনা যেতে লাগল। জটলার জোর বাড়ছে, হুমকি বাড়ছে, বিহিতের দাবিটা আন্দোলনের আকার নিচ্ছে। নির্দয় মেম-ডাক্তারের অপরাধ প্রতিপন্ন হয়ে গেছে যেন। চিকিৎসার নামে কানুন ডিঙিয়ে শ্রমিকদের ওপর দিয়ে বাহাদুরি নেবার চেষ্টা বরদাস্ত করবেন না তারা। কি সুই দিয়েছে কে জানে? কি ওষুধ দিয়েছে কে জানে? কতটা দিয়েছে ভাই বা কে জানে? বাবুদেরই তো সন্দেহ হচ্ছে, তাছাড়া গড়বড় না হলে অতবড় জোয়ান লোকটা অমন ধড়ফড় করবে কেন? নিষেধ করা সত্ত্বেও চোখ রাঙিয়ে সুই দেবার দরকার কি ছিল? বড় সাহেবের কাছে মিলিত দরখাস্ত পাঠাবে তারা, কোর্ট করবে, ট্রাইবুন্যালে যাবে—বিহিত না হলে অনেক কিছু করবার রাস্তা আছে তাদের।

কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে পরদিনও এই গণ্ডগোল সেই লোকটা আছে কেমন সেই খবরটাই সঠিক সংগ্রহ করে উঠতে পারল না ধীরাপদ। যাকে জিজ্ঞাসা করে সে-ই মাথা নাড়ে। অর্থাৎ লোকটা আর নেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। ওদের ওই গরম জটলার মধ্যে ভানিস সর্দারকে একাধিকবার লক্ষ্য করেছে ধীরাপদ। সেও মন্ত্রণাদাতাদের একজন। কিন্তু ধারাপদ ফাঁকমত সামনাসামনি পেল না তাকে। মাতব্বরদের সঙ্গে শলা-পরামর্শে ব্যস্ত বোধ হয়। তাকে পেলে সঠিক খবরটা জানা যেত, ওই লোকটার কাছাকাছি ডেরাতে থাকে সে।

লাবণ্য সরকার অফিসে আছে কি নেই বোঝা যায় না। আছে—ধীরাপদ জানে। কিন্তু যেভাবে আছে কোনো জনমানবের মুখ দেখতেও রাজী নয় মনে হয়। মর্যাদার ওপর এমন আচমকা ঘা পড়লে এ রকম হওয়া বিচিত্র নয়। তবু সে এগিয়ে এসে দু কথা বললে বা বোঝাতে চেষ্টা করলে পরিস্থিতি এতটা জটিল নাও হতে পারত। এগিয়ে আসা দূরে থাক, এক রূঢ় স্তব্ধতার পাল্টা ব্যূহ রচনা করে তার মধ্যে বসে আছে যেন। দেখছে কতদূর গড়ায়। কর্মচারীদের এই উদ্ধত উত্তেজনার পিছনে পদস্থ ব্যক্তিরও উসকানি আছে ভাবছে হয়ত। ধীরাপদকে তাদের ব্যতিক্রম মনে করার কারণ নেই।

খানিক আগে হন্তদন্ত হয়ে সিতাংশু মিত্র এসে হাজির তার ঘরে। রীতিমত তেতেই এসেছিল, গলার স্বর তেমন চড়া না হোক কড়া বটেই।—কি ব্যাপার?

কী? প্রায় অকারণে রক্তকণাগুলো আজকাল উষ্ণ হয়ে উঠতে চায় কেন ধীরাপদ নিজেও জানে না।

কি সব গণ্ডগোল শুনছি এখানে?

আর বলেন কেন, যতদূর সম্ভব নির্লিপ্ত ধীরাপদ, যেমন কাণ্ড এদের সব—

তা আপনি কিছু করছেন, না বসে বসে শুধু কাণ্ডই দেখছেন?

ধীরাপদ বসে ছিল, সিতাংশু দাঁড়িয়ে। ধীরাপদ বসতে বলেনি, এ কথার পর ঘরের দরজা দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু দরজা দেখানোর অন্য রীতিও জানা আছে। মোলায়েম করেই বলল, আপনি এসে গেছেন ভালই হয়েছে, দেখুন না কিছু করা যায় কিনা, আমিও কর্মচারী বই তো নয়…

সিতাংশু আর দাঁড়ায়নি। সম্প্রতি এই একজনের ওপর সব থেকে বেশি রাগ তার।

কিছু করা যায় কিনা সে চেষ্টা সিতাংশু করে গেছে। মাতব্বরদের ডেকে পাঠিয়েছিল। তারা আসেনি, ছুতোনাতায় এড়িয়ে গেছে। কিছুকাল আগেও এ ধরনের অবাধ্যতা ভাবা যেত না। নিচে নেমে ছোট সাহেব হম্বিতম্বি করেছে, চোখ রাঙিয়েছে। কিন্তু এইসব মেহনতী মানুষদের ধাত আর ধাতু চিনতে এখনো অনেক বাকি তার! একবার তারা কোনো জোরের ওপর দাঁড়াতে পারলে পরোয়া কমই করে। তাদের ক্ষুব্ধ চেঁচামেচিতে ছোট সাহেবের কণ্ঠস্বর ডুবে গেছে। ক্ষোভ তাদের শুধু মেম- ডাক্তারের ওপরেই নয়।

বিকেলের দিকে ধীরাপদ কোম্পানীর ডাক্তারকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালো। · কিন্তু এই ভদ্রলোকও ব্যাপার ঠিক বুঝে উঠছেন না যেন। অ্যাট্রোপিন অ্যালার্জির কেস, প্রতিষেধক ওষুধ দিয়েছেন—রোগীর লক্ষণ খানিকটা অন্তত স্বাভাবিক হবার কথা, সুস্থ বোধ করার কথা—কিন্তু কিছুই হচ্ছে না, এক ভাবেই আছে। এ রকমটা ঠিক হবার কথা নয় জানালেন—অবশ্য পোড়া ঘায়ের জ্বালা-যন্ত্রণা আছেই।

রোগীর সম্বন্ধে আরো কিছুক্ষণ আলোচনা করে ডাক্তার ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে ধীরাপদ নিজেও উঠে পড়ল। পাঁচটা অনেকক্ষণ বেজে গেছে। বাইরে এসে লাবণ্যর ঘরের সামনে দাঁড়াল একটু, তারপর আস্তে আস্তে দরজার একটা পাট ঠেলে খুলল। চেয়ার টেবিল ফাঁকা, ঘরে কেউ নেই।

ধীরাপদ কি আশা করেছিল, সঙ্কোচ ঠেলে লাবণ্য সরকার তার কাছে না এলেও তারই প্রতীক্ষায় নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে? কেউ নেই দেখেও ঘরে ঢুকল। টেবিলটায় হাত ছোঁয়ালো, গোছানো ফাইলপত্রগুলিতেও। একটা অননুভূত দরদের ছোঁয়া লাগছে যেন। মায়া লাগছে। এভাবে সম্মানের হানি ঘটলে ধীরাপদ নিজে কি করে বসত বলা যায় না।

অফিসে রেজিস্ট্রি বই থেকে তানিস সর্দারের ঠিকানা টুকে এনেছিল ধীরাপদ। ডেরা খুঁজে পেতে দেরি হল না। ঘরের মেঝেতে বসে তানিস সর্দার খাচ্ছিল, ডাক শুনে তার বউ বেরিয়ে এলো।

বউটা মুখের দিকে হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে আচমকা তার পায়ের ওপর উবুড় হয়ে পড়ল একেবারে। দুই পায়ের ওপর ঘন ঘন মাথা ঠুকল কয়েকবার ধীরাপদ সরে দাঁড়াবারও ফুরসৎ পেল না। মাথা ঠোকা শেষ করে তার জুতোর ধুলো জিভে ঠেকালো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভাষায় চেঁচামেচি করে উঠল, ওরে কে এসেছে শিগগির দেখবি আয়।

তানিস সর্দার ভিতর থেকে দৌড়ে এলো। খালি গা, পরনে থাকী হাফ প্যান্ট। সর্বাঙ্গের শুকনো পোড়া দাগগুলো চোখে বেঁধে। আগন্তুক দেখে সেও হতভম্ব কয়েক মুহূর্ত।—হুজুর আপনি!

বউটা দৌড়ে ভিতরে ঢুকল, আর তক্ষুনি বেরিয়ে এসে দাওয়ায় একটা আধাছেঁড়া চাটাই পেতে দিল।—বৈঠিয়ে বাবুজী।

‘না বসব না, সর্দারকে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে—

কথা যে আছে তানিস সর্দার বুঝেছে এবং কি কথা তাও। কিন্তু এই বাবুটির মনের সত্যিকারের হদিস সে আজও পেল না যেন। চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। শিক্ষাদীক্ষা থাকলে তানিস সর্দারের বউ সরে যেত, কিন্তু সেও দাঁড়িয়ে রইল।

ধীরাপদ জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের সেই লোকটি এখন আছে কেমন?

খুব খারাপ। সর্দার গম্ভীর।

খারাপ তো তাকে ঘরে আটকে রেখেছ কেন, ডাক্তার সাহেব তো তাকে হাসপাতালে পাঠাতে বলেছেন।

সর্দার জানালো, ওই সুই নেবার পর হাসপাতালে আর যেতে চায় না, তার বউও যেতে দিতে রাজি নয়—মরে তো ঘরেই মরবে।

মরবে না। ধীরাপদর কণ্ঠস্বর অনুচ্চ কঠিন, ডাক্তার সাহেবের ধারণা সে ভালো আছে, তোমরা তাকে ভালো থাকতে দিচ্ছ না—

অন্য কেউ হলে লোকটা অন্যরকম উত্তর দিত বোধ হয়। একটু থেমে বিনীত জবাব দিল, কি রকম কষ্ট পাচ্ছে হুজুর নিজের চোখেই দেখবেন চলুন।

ধীরাপদ দুই চোখ তার আদুড় গায়ের ক্ষতচিহ্নগুলির ওপর বিচরণ করে নিল একবার।—পোড়া ঘায়ে কি রকম কষ্ট পায় তুমি জানো না?

সর্দার চুপ। পাশ থেকে তার বউয়ের অস্ফুট কটূক্তি শোনা গেল একটা। কি বলল বা কার উদ্দেশ্যে বলল, না বুঝে ধীরাপদ তার দিকে তাকালো একবার—তানিস সর্দারও।

গলার সুর পাল্টে নরম করে ধীরাপদ একটা অবাস্তর প্রসঙ্গে ঘুরে গেল। বলল, তোমরা কি পেয়েছ কেউ জানো না, আস্তে আস্তে জানবে। আমরা যে সুপারিশ করেছি বড় সাহেব তার একটা অক্ষরও কাঁটছাঁট করেননি, কেউ বাধা দেয়নি, কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো। মেমসাহেব আপত্তি করলে তোমাদের ক্ষতি হত, কিন্তু তিনি তা করেননি। তা ছাড়া লোকটার ওই বিপদে সবার আগে যিনি সাহায্যের জন্যে ছুটে এলেন, তাঁকেই জব্দ করার জন্য ক্ষেপে উঠেছ তোমরা! তোমাদের কি কৃতজ্ঞতা বলে কিছু নেই?

আর একদিনও এই মেমসাহেবের দিক টেনেই কথা বলতে শুনেছিল হুজুরকে, সেদিন তানিস সর্দার সেটা ভদ্রলোকের রীতি বলে ধরে নিয়েছিল—বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ সে অবাক হল। কারণ তাদের এই হৈ-চৈয়ের পিছনে ভদ্রলোক-বাবুদেরও তলায় তলায় একটু সমর্থন আছে—এ তারাও ধরেই নিয়েছিল। তাদের বিশ্বাস ছোট সাহেবকে যতটা না হোক, ওই মেমসাহেবটিকে একটু-আধটু জব্দ করতে ভদ্দরলোক- বাবুরাও সকলেই চায়। হুজুর কতটা মনের কথা বলছে মুখের দিকে চেয়ে সর্দার সেটা আঁচ করতে চেষ্টা করল। তারপর মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। দলগত কারণে তার পক্ষে কিছু বলা বা নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেওয়াও শক্ত।

ধীরাপদ গম্ভীর আবারও, গলার স্বরও চড়ল একটু।—এভাবে মিছিমিছি গণ্ডগোল করলে কেউ সহ্য করবে না, ওই লোকটাকে হাসপাতালে যেতে হবে— তোমরা কি জন্যে কি করছ সবই বোঝা যাবে তখন। ওই লোকটার চাকরি যাবে, তোমাদেরও ফল ভালো হবে না। কালকের মধ্যেই গণ্ডগোল থামা দরকার সেটা তোমাদের দলের লোককে ভাল করে বুঝিয়ে দিও। আমি বলছি বলো—

এই হুঁশিয়ারিতেও ফল কিছু হত কিনা বলা শক্ত, কারণ উভয় সঙ্কটে পড়ে তানিস সর্দার মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়েই ছিল। কিন্তু তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বউটা এগিয়ে এসে হ্যাঁচকা টানে লোকটাকে হাত ধরে আর এক ধারে টেনে নিয়ে গেল। অসহিষ্ণু বিরক্তিতে ফিসফিস করে যা বলতে চাইল তার প্রতি বর্ণ ধীরাপদর কানে এসেছে। প্রথমে মরদগুলোর বুদ্ধি-সুদ্ধির ওপর কটাক্ষ। ওদের ঘরোয়া ভাষা ধীরাপদ বলতে না পারুক, বুঝতে না পারার কথা নয়। সে শুনছে কি শুনছে না সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই বউটার। তার চাপা তর্জনের মর্ম, তোরা কি শেষে এই বাবুজীর সঙ্গে লড়বি নাকি নেমকহারাম বেইমান! তোরা না বলেছিলি মেমসাহেবকে কেউ দেখতে পারে না—এই বুদ্ধি তোদের, অ্যাঁ? চোখ কানা তোদের। বাবুজী দেখতে পারে কিনা দেখছিস না? নইলে তোর ঘরে আসে? ফিসফিসিনি আর এক পরদা নামল, কিন্তু বউটার কালো মুখে যেন আবিষ্কারের আলো ঝলসাচ্ছে। তোদের এই মেম-সাহেব বাবুজীর দিল কেড়েছে, এখনো বুঝছিস না বুদ্ধ কোথাকারের!

ধীরাপদ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। তার পায়ের নিচে মাটি দুলছে। তানিস সর্দার হতভম্ব মুখেই পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল আবার। এক নজর চেয়ে বউয়ের বচন পরখ করে নিল। বোকা বোকা মুখখানা কমনীয় দেখাচ্ছে। তার পিছনে তার কালো বউ চাপা খুশিতে ঝলমল করছে।

তানিস সর্দার বলল, আপনি নিশ্চিন্ত মনে ঘরে গিয়ে আরাম করুন বাবুজী, আর কেউ টু শব্দ করবে না, আমার জান কবুল।

ধীরাপদ নিঃশব্দে চলে এলো। ভালো-মন্দ একটা কথাও বলেনি আর। এরপর কথা অচল। তানিস সর্দারের ওই মিশকালো বউটা টিপ টিপ করে তার পায়ের ওপর কপাল ঠুকেছে, পথের আবর্জনাময় জুতোর ধুলো জিভে ঠেকিয়েছে—সশরীরে হঠাৎ কোনো দেবতারই পদার্পণ ঘটেছিল যেন ওদের দাওয়ায়। কিন্তু আসতে আসতে ধীরাপদ শিক্ষাদীক্ষা-স্বাস্থ্যজ্ঞানহীনা ওই শ্রমিক ঘরণীর উদ্দেশে মাথা না নুইয়ে পারেনি। সমস্ত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে যে নারী, সেখানে সে শক্তিরূপিণী পুরুষের দোসরই বটে। সেখানে সে সহজ সুন্দর, সেখানে কোনো কালোকুলোর লেশমাত্র নেই।

ওদের এই নূতন আবিষ্কারের কোনোরকম প্রতিবাদ করেনি ধীরাপদ, একটু বিরূপ আভাসও ব্যক্ত করেনি। খবরটা ওদের মহলে এবারে ভালো করেই রটবে বোধ হয়। কিন্তু সেজন্য একটুও বিড়ম্বনা বোধ করছে না ধীরাপদ, এতটুকু অস্বস্তিও না।

মাঝে আর একটা দিন গেছে। তানিস সর্দার কি ভাবে সকলের মুখ বন্ধ করেছে আর উত্তেজনা চাপা দিয়েছে সেই জানে। যারা মজা দেখার আশায় ছিল তারা নিরাশ হয়েছে।…শোরগোলটা হঠাৎ এমনি মিইয়ে গেল কি করে ভেবে না পেয়ে অনেকে অবাকও হয়েছে। কোম্পানীর সেই ডাক্তারটি পরদিনই এসে ধীরাপদকে খবর দিয়েছে, তাঁর রোগী আপাতত অনেকটাই সুস্থ, পোড়া ঘায়ের জ্বালা-যন্ত্রণা সত্ত্বেও অতটা আর লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে না- অস্থিরতা কমেছে।

তার পরদিন বিকেলের দিকে ধীরাপদকে প্রতিষ্ঠানের এক পার্টির কাছে যেতে হয়েছিল। ফিরতে বিকেল গড়িয়েছে। এসেই টেবিলের ওপর ছোট চিরকুট চোখে পড়েছে একটা। ধীরাপদ ঘড়ি দেখেছে— সাড়ে ছটার এক ঘণ্টার ওপর বাকি তখনো। চিরকুট পকেটে ফেলে তক্ষুনি আবার বেরিয়ে পড়েছে। ট্রামে-বাসে গেলেও আধ ঘণ্টা আগেই পৌঁছত, কিন্তু ট্যাক্সি নিল।

লাবণ্য সরকার নার্সিং হোমের বারান্দার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ট্যাক্সি থামতে দেখল, ধীরাপদকে নামতে দেখল, কিন্তু আর এক দিনের মত সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এলো না।

চিরকুট তারই। খুব সংক্ষিপ্ত অনুরোধ। অনুগ্রহ করে বিকেলে একবার নার্সিং হোমে এলে ভালো হয়, বিশেষ কথা ছিল। সে সাড়ে ছটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কি কথা থাকতে পারে ট্যাক্সিতে বসে ধীরাপদ তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। শুধু মনে হয়েছে, অনুরোধটা লাবণ্য অফিসে নিজের মুখেই করতে পারত। ইচ্ছে করেই তা করেনি। ধীরাপদ অফিস থেকে বেরিয়েছিল সাড়ে তিনটেরও পরে। লাবণ্য তখন নিজের ঘরেই ছিল। বেরুবার আগে ধীরাপদ তার ঘরে এসেছিল। বলে গেছে, অমুক জায়গায় যাচ্ছে, কেউ খোঁজ করলে যেন বলে দেয়। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আবার অফিসে ফিরবে তাও জানিয়েছে। বড় সাহেব সেই দিনই কানপুর রওনা হচ্ছেন, কাজেই খোঁজ করার সম্ভাবনা ছিল।

কিন্তু লাবণ্য তখনো কিছু বলেনি। দরকারী কথার আভাসও দেয়নি। হাতের কলম থামিয়ে চুপচাপ শুনেছে, তারপর আবার মুখ নামিয়ে লেখায় মন দিয়েছে।

আসুন। রেলিং থেকে সরে বসবার ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল লাবণ্য সরকার। অস্ফুট ইঙ্গিতে তাকে বসতে বলে সে ভিতরে চলে গেল। দুই এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে অদূরের সোফায় বসল।

কোন্ পর্যায়ের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হবে মুখ দেখে ধীরাপদ ঠিক করতে পারল না। জিজ্ঞাসা করল, কাঞ্চন চলে গেছে, না এখানেই?

চলে গেছে। একটু থেমে সংযত অথচ খুব সহজভাবে লাবণ্য বলল, ওকে ওখানে ঢোকানোর জন্যে ম্যানেজার খুব খুশি নন দেখলাম, ওর আর রমেন হালদারের সম্বন্ধে কালই কি সব বলছিলেন।

ম্যানেজার কি বলেছেন বা বলতে পারেন ধীরাপদ অনুমান করতে পারে। সে নিজে এক সন্ধ্যায় যেটুকু লক্ষ্য করেছে তাইতেই অস্বস্তি বোধ করেছিল। ম্যানেজার মাত্র আট ঘণ্টার প্রহরী। তাঁর ওইটুকু কড়া অনুশাসনের গণ্ডির মধ্যেই যদি ওদের আচরণ অসঙ্গত লেগে থাকে, দিনের বাকি ষোল ঘণ্টার হিসেব কে রাখে? ছেলেটাকে ভালই বাসে ধীরাপদ, ওর মত ছেলেকে ভাল না বেসে কেউ পারে না। দুই-একদিনের মধ্যে তাকে ডেকে পাঠাবে, সম্ভব হলে কালই।

পরিচারিকা দু পেয়ালা চা রেখে গেল। চায়ের কথা বলতেই লাবণ্য ভিতরে গিয়েছিল বোঝা গেল। সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু নেই দেখে স্বস্তি বোধ করছে। থাকলে একটা কৃত্রিমতাই বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে পড়ত। তার বিশেষ কথাটা কাঞ্চনের কথাই কিনা ধীরাপদ বুঝে উঠছে না। কারণ আর তেমন কিছু বলার তাড়া বা প্রস্তুতি দেখছে না।

না, তা নয়, কাঞ্চন প্রসঙ্গ ওখানেই শেষ। ঝুঁকে চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে লাবণ্য আবার সোফায় ঠেস দিল। নিরুত্তাপ প্রশ্ন, মিস্টার মিত্র আজ চলে গেলেন?

যাবার তো কথা, গেছেন বোধ হয়।

কবে ফিরবেন?

দিন তিন-চারের মধ্যেই হয়ত, বেশি দিন লাগার কথা নয়।

ধীরাপদর পেয়ালাটা তার হাতে, ধীরে-সুস্থে চুমুক দিচ্ছে। নিজের পেয়ালাটা খালি করে লাবণ্য সামনের ছোট টেবিলে রাখল, তারপর সোফায় আর ঠেস না দিয়ে সোজাসুজি তাকাল তার দিকে। সমস্ত মুখ, এমন কি চাউনিটাও শান্ত।—অনেক রকম গগুগোল নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে হচ্ছে আপনাকে, এ সময়ে ডেকে অসুবিধে করলাম বোধ হয়?

সুচনা সুবিধের ঠেকছে না ধারাপদর। হাতের পেয়ালা নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি বলে ফেলল, না অসুবিধে কি, আর ওই গণ্ডগোলও তো মিটে গেছে শুনেছি।

লাবণ্যর শিথিল দৃষ্টিটা আরো কয়েকটা মুহূর্ত তার মুখের ওপরে পড়ে রইল তেমনি। তারপর প্রসঙ্গের উপসংহারে পৌঁছানোর মত করে সাদাসিধে ভাবেই বলল, আপনি শোনেননি, আপনি মিটিয়েছেন। আপনি ওই সর্দার লোকটার ওখানে পরশু গিয়েছিলেন, আমি কাল গিয়েছিলাম—

উঠে পেয়ালা দুটো ওধারের একটা ছোট টেবিলে রেখে আবার এসে বসল। ধারাপদর পক্ষে এই সুচারু বিরতিও উপভোগ্য নয় খুব। একনজর চেয়ে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করল লাবণ্য সরকার, তেমনি স্পষ্ট ধীরস্বরেই বলে গেল, আমি রোগী দেখার জন্য গিয়েছিলাম, রোগী না দেখিয়ে আমাকে সেই সর্দার লোকটার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছিল। সে ঘরে ছিল না, তার বউ ছিল। আমাকে আদর করে ঘরে ডেকে নিয়ে বউটা অন্তরঙ্গজনের মতই কথাবার্তা কইতে চেষ্টা করেছে। আমার সেটা খুব ভালো লাগেনি।

কোথায় কোন্ মুহূর্তে থামা দরকার লাবণ্য জানে। থেমেছে। দেখেছে। পরের প্রশ্নটা আরো ঠাণ্ডা, মোলায়েম।— ওরা যা বুঝেছে, গণ্ডগোল মেটানোর জন্যে ওদের সেই রকমই বোঝানো দরকার হয়েছিল বোধ হয় আপনার?

ধীরাপদ কি করবে? অস্বীকার করবে, না জবাবদিহি করবে, না একটা বেপরোয়া স্বীকৃতি ছুঁড়ে দেবে মুখের ওপর? অফিসে সেদিন পার্শ্ববর্তিনীর শূন্য ঘরের শূন্য টেবিল আর শূন্য আসবাবপত্রের সামনে দাঁড়িয়ে যে মমতার ছোঁয়ায় ভেতরটা ভরে উঠেছিল, খানিক আগে পর্যন্তও ধীরাপদ নিজের অগোচরে সেই অনুভূতির মধ্যে ডুবে ছিল হয়ত। তারই ওপর বিপরীত ব্যঙ্গবর্ষণ ঘটল যেন একপ্রস্থ। বশ-না-মানা নারী একদিন পুরুষের দুই বাহুর সবল অধিকারের সামগ্রী ছিল নাকি…। ঘরে আয়না থাকলে ধীরাপদ নিজের দুই চোখে সেই কাল হারানোর ক্রুর খেদ দেখতে পেত।

বলল, ওদের ও-রকম বোঝার মধ্যে আমার হাত ছিল না…তবে, আমাকে দেখে ওরা যা বুঝেছিল আপনাকে দেখার পর ওদের সে ভুল ভেঙে গেছে নিশ্চয়।

আপনাকে দেখে ওরা তাহলে কিছু বুঝেছিল বলছেন?

ধীরাপদ চেষ্টা করে হাসতেও পারল।—আমি না, আপনি বলছেন।… বাড়ি পর্যন্ত ছুটতে দেখে ওরা কিছু একটা সহজ কারণই খুঁজেছে।

আপনি ছুটেছিলেন কেন?

সিতাংশুবাবুর জন্যে। ভদ্রলোক ভয়ানক বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। ধীরাপদর ঠোঁটের ডগায় জবাব মজুত।

প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ সত্ত্বেও চিরাচরিত রাগ-বিরাগের এতটুকু আঁচ চোখে পড়ল না। লাবণ্য জবাবটা শুনেও শুনল না যেন। একটু চুপ করে থেকে শান্ত মন্তব্য করল, আপনার অত ব্যস্ত হওয়ার দরকার ছিল না, এটুকুর দায় আমি নিজেই নিতে পারতাম। যাক, এ নিয়ে কথা কাটাকাটির জন্য আপনাকে আমি কষ্ট করে আসতে বলিনি, যা করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ।

হঠাৎ ধন্যবাদ লাভ করে স্নায়ুর চড়া প্রস্তুতির মুখে থমকাতে হল ধীরাপদকে। চকিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।

পরের কথাটা কি ভাবে বলবে লাবণ্য তাই হয়ত ভেবে নিল। অটুট গাম্ভীর্য সত্ত্বেও আলগা উত্তাপের চিহ্নমাত্র নেই।— আপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কয়েকটা কথা আছে।…এখানকার যে রকম ব্যাপার দেখছি তাতে নিজের সম্বন্ধে একটু ভাবা দরকার হয়ে পড়েছে মনে হয়, কি বলেন?

প্রশ্ন স্পষ্ট নয় একটুও, তবু ধীরাপদ অস্বস্তি বোধ করল। ঈষৎ বিস্ময়ের আড়ালেই গুটিয়ে রাখতে চেষ্টা করল নিজেকে।

আর একটু খোলাখুলি বলুন-

কতটা খোলাখুলি বলা দরকার লাবণ্য তাই যেন দেখে নিল। তারপর খুব স্পষ্ট করেই বলল, বাড়িতে অমিতবাবু আর সিতাংশুবাবুর সঙ্গে মিস্টার মিত্রের কিছু একটা মনোমালিন্যের ব্যাপার চলেছে, যার ফলে আমার প্রতিও এঁদের সকলের ব্যবহারে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।…গোলযোগটা কি নিয়ে?

ধীরাপদর মুখের দ্বিধাগ্রস্ত ভাবটা কৃত্রিম নয় খুব।—এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

কারণ এসব কথার মধ্যে আপনিও উপস্থিত ছিলেন শুনেছি। ওঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার হলে জিজ্ঞাসা করতাম না, এর সঙ্গে আমি কতটা জড়িত জানা দরকার।

ধীরাপদর বলতে ইচ্ছে করছিল, সবটাই—। বিব্রত মুখে এবারও জবাব এড়াতেই চেষ্টা করল। বলল, কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি সে তো ব্যক্তিগত ব্যাপারই। সিতাংশুবাবু পারফিউমারি ব্র্যাঞ্চে লেগে থাকতে চান না—বড় সাহেব তাই চান। আর অমিতবাবু কখন কি যে বরদাস্ত করেন আর কখন করেন না বোঝা ভার—

এ পর্যন্ত আমার জানা আছে। লাবণ্যর বিশ্লেষণরত দৃষ্টি ঈষৎ নড়েচড়ে আবার তার মুখের ওপর স্থির হল।—সিতাংশুবাবু বা অমিতবাবুর ব্যবহারের জন্য তাঁরাই দায়ী, কিন্তু আমার প্রসঙ্গে বড় সাহেব আপনাকে কখনো কিছু বলেছেন কিনা, আর বলে থাকলে কি বলেছেন আমাকে জানাতে আপনার খুব আপত্তি আছে? জানতে পেলে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিতে সুবিধে হত –

তড়িত গতিতে মস্তিষ্ক চালনা করেও ধীরাপদ সঠিক বুঝে উঠল না, বড় সাহেব তাকে কিছু বলতে পারেন এ সন্দেহ হল কেমন করে? ছেলে বা ভাগ্নের সঙ্গে মনোমালিন্য চলেছে জানে বলে এই অনুমান, নাকি ছেলে সেদিন বাপের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এসে ঘা খেয়ে চলে যাবার পরেও ধীরাপদ ঘরে ছিল শুনেছে বলে? জবাবের প্রতীক্ষায় লাবণ্য সরকার অপলক নেত্রে চেয়ে আছে তার দিকে।

হঠাৎ সমস্ত হৃৎপিণ্ডটা ধকধকিয়ে উঠল বুঝি ধীরাপদর। পতঙ্গের মত লোভের শিখার দিকে কে তাকে এমন করে ঠেলছে জানে না। ধীরাপদ চাইছে নিজেকে প্রতিরোধ করতে, চাইছে সে যা বলতে যাচ্ছে তা না বলতে। কান দুটো গরম লাগছে, কপালের কাছটা ঘেমে উঠেছে, ঠোট দুটো শুকনো, জিভের ডগা খরখরে। কিন্তু নীতির ভ্রুকুটিতে আর সংযমের কথায় পতঙ্গ ফেরে না। ফিরল না। নাগালের মধ্যে সে শিখা দেখেছে।

প্রশ্নের গুরুত্ব অনুযায়ী স্থিরভাবেই জবাব দিল, আপনাকে তিনি শ্রদ্ধা করেন, অফিসের কাজে-কর্মে আপনাকে তিনি বিশেষ সহায় ভাবেন।… কিন্তু নিজের পারিবারিক ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব কিছু প্ল্যান আছে হয়ত, সেখানে আর কোনো সম্ভাবনার কারণ ঘটে সেটা তিনি চান না মনে হয়।

সেটা তিনি কবে থেকে চান না? এতক্ষণের সংযম চিড় খেল, হঠাৎ তীক্ষ্ণ শোনালো কণ্ঠস্বর।

ধীরাপদ নীরব।

ছেলেকে নিয়ে প্ল্যান আছে জানি, কিন্তু ভাগ্নের সম্বন্ধে প্ল্যানটা তাঁর নিজের না চারু দেবীর?

ধীরাপদ নির্বাক।

দাহ শুরু হলে পতঙ্গ কি তার জ্বালা অনুভব করে? ধীরাপদ করছে। লাবণ্যকে যা বলেছে তার মধ্যে মিথ্যে নেই। কিন্তু সত্যটাও খোলস মাত্র। গোটাগুটি খোলস। ছেলের দিক থেকে তার উক্তি যেমন সত্যি, ভাগ্নের দিক থেকে সেটা ঠিক ততো বড়ই মিথ্যে। ধীরাপদ ভাগ্নের নাম করেনি, কারোরই নাম করেনি। পারিবারিক ব্যাপারে বড় সাহেবের অনভিপ্রেত কি সেই ইঙ্গিত করেছে। কবে একটা অনুক্ত মিথ্যেকে অবিমিশ্র সত্যের খোলসের মধ্যে পুরে দিয়েছে। ওই থেকে অমিতাভ ঘোষকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কথা নয় লাবণ্য সরকারের, হিমাংশু মিত্রের পরিবার থেকে অমিত ঘোষকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কথা নয়। দেখবে না, ভাববে না—ধীরাপদ জানত।

সত্যের খোলস আঁটা বড় লোভনীয় মিথ্যের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে পতঙ্গ।

মাত্র কিছুক্ষণের জন্য স্নায়ুর ওপর দখল হারিয়েছিল লাবণ্য সরকার, সংযমের বাঁধনে সেটুকু কষে বেঁধে নিতে সময় লাগল না। কিন্তু অপমানে মুখের রঙ বদলেছে। প্রায় আগের মতই ঠাণ্ডা চোখ মেলে তাকালো আবার—এই কথা তিনি আপনাকে বলেছেন?

বলেছেন। সংক্ষিপ্ত, প্রায়-রূঢ় জবাব।

হিমাংশু মিত্র না হোক তাঁরই কোনো প্রতিনিধি সামনে বসে যেন, লাবণ্য তাকেই দেখছে চেয়ে চেয়ে। ধীর, অনুচ্চ কঠিন স্বরে আবারও বলল, কিন্তু সে রকম সম্ভাবনার কারণ ঘটে যদি—তিনি আটকাবেন কি করে? সকলেই তাঁর প্ল্যান মত চলবে ভাবেন?

ধীরাপদ মোলায়েম জবাব দিল, সেই রকমই ভেবে অভ্যস্ত তিনি।

গোটাকতক মৌন মুহূর্তের স্তব্ধতা ঠেলে লাবণ্য সোফা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তার বিশেষ কথা শেষ হয়েছে। ঘড়ি দেখল। বলল, আমার মেডিক্যাল হোমের সময় হয়ে গেছে—

ধীরাপদও উঠে দাঁড়িয়েছে। ঘরের দিকে পা বাড়াবার আগে লাবণ্য আর একবার ফিরল তার দিকে। অপলক দৃষ্টি বিনিময়। বলল, এরপর আমার কর্তব্য আমি ভেবে নিতে পারব আশা করি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

পায়ের নিচে নিরেট মাটি, মাথার ওপর তারার ঘা-ভরা নীরন্ধ্র আকাশ। দুই-ই অসহ্য লাগছে ধীরাপদর। রাস্তার আলোগুলো পর্যন্ত তাপ ছড়ানোর মত জোরালো লাগছে। অপেক্ষাকৃত অন্ধকার ধার ধরে চলেছে সে। কবে যেন অন্ধকার থেকে আলোয় আসার তাগিদে সে সন্ত্রাসে ছুটেছিল একদিন। গড়ের মাঠে সেই একদিন, যেদিন কাঞ্চন এসে সামনে দাঁড়িয়েছিল… বিনামূল্যে যেদিন পসারিণীর পসার লুঠ হয়েছিল। আজ বিপরীত তাগিদ, আলো থেকে অন্ধকারে যাবার তাগিদ। কিন্তু মনের মত অন্ধকারও জোটা দায়, নিজের বুকের তলাতেই কোথায় যেন ধিকি ধিকি আলো জ্বলছে। আলো না আগুন?

না, আজ আর ধীরাপদ ভাববে না কিছু। সে ভাবছে বলেই, নইলে কোনো কিছু দংশাচ্ছে না তাকে। দংশাবে কেন, সে তো আর ত্যাগের নামাবলী পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে না। নতুন সুরাপায়ীর মত বিবেক বস্তুটা ছিঁড়েখুঁড়ে উপড়ে ফেলে সাময়িক বিস্মৃতিটুকুই . আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইল সে। যে বিস্মৃতির সামনে এতক্ষণ বসেছিল সেই বিস্মৃতির উৎস চোখের আওতায় নতুন করে বেঁধে নিয়ে পথ চলল। মনে হল, লাবণ্যকে এত স্পষ্ট এত পরিপূর্ণ করে আগে আর কখনো দেখেনি। নারী-তনুর প্রতিটি রেখা প্রতিটি কমনীয় ইঙ্গিতের মধ্যে বিচরণ করতে পারার মতই স্পষ্ট আর পরিপূর্ণ করে দেখে এসেছে। দেখছে…। লাবণ্য কর্তব্য ভাববে বলছিল। কর্তব্যটি কী? কি আবার ভাববে? চাকরি ছাড়বে নাকি? চাকরি ছেড়ে কি করবে, শুধু প্র্যাকটিস? করলেও করতে পারে, পসার এখনই মন্দ নয়। সামনে এসে দাঁড়ালে ছ আনা রোগ সারে, কথাবার্তা কইতে শুরু করলে দশ আনা, আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হলে চোদ্দ আনা—এমন ডাক্তারের পসার হবে না তো কার হবে? কিন্তু মন বলছে, শুধু প্র্যাকটিস করবে না— একেবারে অতখানি গোড়া থেকে শুরু করার ধৈর্য্য নেই। তাহলে আর কি করতে পারে? বিলেত চলে যেতে পারে। এতগুলো বছর ধরে টাকা কম জমায়নি। তাছাড়া নিজের টাকার দরকারই বা কি, বিলেত যাবে শুনলেই ভগ্নিপতি টাকার থলে উঁচিয়ে ছুটে আসবে।

ধীরাপদ ভাবতে চেষ্টা করল, এই এত বড় প্রতিষ্ঠানে একজন মাত্র নেই। বড় সাহেব আছেন, ছোট সাহেব আছে, অমিত ঘোষ আছে, ও নিজেও আছে এমন কি পরোক্ষ ভাবে চারুদিও আছে,– শুধু লাবণ্য সরকার নেই। ধান কেটে নেওয়া ক্ষেত্রের মত সব কিছুই শূন্য তাহলে। কার্জন পার্কের সেই লোহার বেঞ্চএর কালের থেকেও শূন্য।

শূন্যতার চিন্তাটা সমূলে নাকচ করতে করতে পথ ভাঙছে আজকের ধীরাপদ চক্রবর্তী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *