দুই
ধীরাপদর এক রাতের সুখনিদ্রার শেষ তৃপ্তিটুকু খানখান হয়ে গেল শকুনি ভটচাষের পাঁজর-দুমড়ানো প্রভাতী কাশির শব্দে।
প্রথম ভোৱে সর্বত্র স-কলরবে পাখি জাগে। এই সুলতান কুঠির প্রথম ভোরে স-কাশি শকুনি ভটচায় জাগেন। বারোয়ারী কলতলায় এক বালতি জল নিয়ে বসে বিপুল বিক্রমে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে কাশেন। অন্ধকারে শুরু হয়, আলো জাগলে শেষ হয়। ধীরাপদ রোজই শোনে, শুনতে শুনতে আবার পাশ ফিরে ঘুমোয়। কিন্তু এই একটা রাত সুলতানের মতই সুলতান কুঠিতে ঘুমিয়েছিল ধীরাপদ। ঘুমের থেকেও বেশি। সুপ্তি-ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল।
একটানা ঠনঠন কাশির শব্দে ঘোর কেটে গেল। সেই কাশির ঘায়ে সারারাতের সর্বাঙ্গ-জড়ানো নরম অনুভূতিটুকু মিলিয়ে যেতে লাগল। দুই চোখ বন্ধ রেখেই হাতড়ে হাতড়ে অনুভব করে নিল, গা-ডোবানো পালঙ্ক নয়—সে শয়ান ভূমি-শয্যায়। দুই চোখ বুজে বিস্মৃতির অতলে ডুবতে চেষ্টা করল আবারও। কিন্তু সাধ্য কি?
ধীরাপদ চোখ মেলে তাকালো। আবছা অন্ধকার। খুশি হল। সুলতান কুঠির বাস্তবের ওপর আলোকপাত হয়নি এখনো। এক ওই বেদম কাশি ছাড়া। সোনাবউদি বলে, ঘাটের কাশি। সোনাবউদিকে নিয়ে চারুদির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন হয়? মনে মনে ওই দুজনকে মুখোমুখি দেখতে চেষ্টা করে ধীরাপদ হেসে ফেলল। সোনাবউদির বয়েস বছর তিরিশ, আর চারুদির চুয়াল্লিশ। কিন্তু মেয়েদের আসল বয়েস নাকি যেমন দেখায় তেমন। সোনাবউদির বয়েস যখন যেমন মুখ খোলে তখন তেমন শুয়ে শুয়ে ধীরাপদ গত রাতের ব্যাপারটাই ভাবছে আর বেণ কৌতুক অনুভব করছে। সে এ রকম একটা কাণ্ড করে বসল কেন? ও-ভাবে খেতে চাওয়ার পরে চারুদির মুখের চকিত কারুকার্য ভোলবার নয়। আগে চারুদি অনেক খাইয়েছেন, কালও যদি ও সহজভাবে বলত, চারুদি খিদে পেয়েছে, কি আছে বার করো—কিছুই মনে করার ছিল না। এতক্ষণ না বলার জন্য মৃদু তিরস্কার করে তাড়াতাড়িই খাবার ব্যবস্থা করতেন তিনি। কিন্তু তার বদলে অপ্রস্তুতের একশেষ একেবারে। স্বপ্নরাজ্য থেকে তাঁকে যেন একেবারে রূঢ় বাস্তবে টেনে এনে আছড়ে দিয়েছে ও। চারুদি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিলেন মুখের দিকে। এতক্ষণের মধ্যে সেই যেন প্রথম দেখলেন তাকে তারপর এস্তে উঠে গেছেন। একটি কথাও বলতে পারেননি। ক্ষুধার্তকে অতক্ষণ ধরে খাদ্যের বদলে কাব্য পরিবেশনের লজ্জা ভোগ করেছেন। খাবার আসতে সময় লাগেনি খুব। পার্বতীর গম্ভীর তত্ত্বাবধানে উগ্র রকমেরই হয়েছিল খাওয়াটা। কি লাগবে পার্বতী একবারও জিজ্ঞাসা করেনি, সরাসরি দিয়ে গেছে।
চারুদির ভর-ভরতি আত্মমগ্নতার মধ্যে ও-ভাবে খেতে চেয়ে দুজনের ব্যবধানটা হঠাৎ বড় বিসদৃশ ভাবেই উদঘাটন করে দিয়ে এসেছে সে। চারুদি আর তেমন সহজ হতে পারেননি। চেষ্টা করেছেন। পারেননি। ব্যবধান থেকেই গেছে। অন্তরঙ্গ আগ্রহে চারুদি তার ঠিকানা নিয়ে রেখেছেন, বার বার করে আসতে বলেছেন, গাড়ি করে বাড়ি পাঠিয়েছেন—তবু। গাড়ি অবশ্য বাড়ি পর্যন্ত আনে নি ধীরাপদ। আগেই ছেড়ে দিয়েছে। সুলতান কুঠির আঙ্গিনায় ওই গাড়ি ঢুকলে অত রাতেও বাড়িটার গোটা আবহাওয়া চকিত বিস্ময়ে নড়েচড়ে উঠত। কিন্তু এতকাল বাদে দেখা চারুদির সঙ্গে সে এমন একটা কাণ্ড করে বসল কেন? জঠরের চাহিদা তো অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল। অমন খুশির মুখে এ-ভাবে অপ্রস্তুত করতে গেল কেন চারুদিকে? জেনেশুনেই করেছে। হঠাৎ রূঢ় ছন্দপতন ঘটানোর লোভটা সংবরণ করতে পারেনি কিছুতে। চারুদির কথাবার্তা হাসি-খুশি চিন্তা-ভাবনা ঘরের আবহাওয়া, এমন কি তাঁর বসার শিথিল সৌন্দর্যটুকু পর্যন্ত কি একটা প্রতিকূল ইন্ধন যুগিয়েছে। ক্ষুধার চিত্রটা ঠিক ওইভাবেই প্রকাশ না করে পারেনি।
কিন্তু হঠাৎ এমন হল কেন?
ধীরাপদ নিজের মনেই হাসতে লাগল, সোনাবউদির বাতাস লাগল গায়ে?
ঘরের মধ্যে ভোরের আলো স্পষ্টতর। ধীরাপদ ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে উঠে বসল। আর শুতে ভালো লাগছে না। জানালা দিয়ে চুনবালি-খসা দাগ-ধরা দেয়ালের ওপর ভোরের প্রথম আলোর তির্যক রেখা পড়েছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। এই সুলতান কুঠিরও সকালের প্রথম রূপটা মন্দ নয় যেন। দেখা বড় হয় না ধীরপদর, বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। বুড়ো বুড়ো গাছগুলো আর ওই মজা পুকুরটাও যেন এই ভোরের আলোয় শুচিস্নান করে উঠেছে। স্নিগ্ধ নম্রতাটুকু চোখে পড়ার মতই। দুই-একজন অতিবৃদ্ধকেও সুন্দর লাগে। সকালের এই সুলতান কুঠির পরিবেশটিও তেমন। বুড়িয়ে গেছে, কিন্তু একেবারে যতিশূন্য হয়নি।
খানিক বাদেই এই রেশটুকু আর থাকবে না। ঊষা-বর্ণের ওপর আর একটু আলো চড়লেই সুলতান কুঠির অতি বৃদ্ধ হাড়-পাঁজর শিরা-উপশিরাগুলো গজগজিয়ে উঠবে। মানুষগুলো একে একে জেগে উঠলেই নিষ্ক্রিয় হবে সুলতান কুঠির হৃৎপিণ্ড-কুৎসিতই মনে হবে তখন। শকুনি ভটচায জেগে উঠেছেন, কিন্তু তিনি কল-পারে কাশছেন বলে এদিকটার মৌন ছন্দে ছেদ পড়েনি। পড়বে—ওই কদমতলার বেঞ্চিতে হুঁকো হাতে একাদশী শিকদার এসে বসলেই। শকুনি ভটচার্যের পর তাঁর জাগার পালা। গায়ে একটা বিবর্ণ তুলোর কম্বল জড়িয়ে ওই বেঞ্চিটাতে বসে গুড়গুড় করে ভামাক টানবেন আর অপেক্ষা করবেন।
অপেক্ষা করবেন খবরের কাগজের জন্যে।
তাঁর সেই সতৃষ্ণ প্রতীক্ষা নিয়ে সোনাবউদি অনেক হাসাহাসি করেছে, টিকাটিপ্পনী কেটেছে। অবশ্য শুধু ধারাপদর কাছেই। ধীরাপদ নিজের চোখেও দেখেছে দুই-একদিন। খবরের কাগজ পড়ার জন্যে এই বয়সে আর এমন নিষ্ক্রিয় জীবনে এত আগ্রহ বড় দেখা যায় না। তামাক টানেন আর পুকুরধারের সাইকেল-রাস্তাটার দিকে চেয়ে থাকেন। কাগজওয়ালার লালরঙা সাইকেলটা চোখে পড়ামাত্র সাগ্রহে দুমড়ানো মেরুদণ্ড সোজা করে বসেন। জানালা দিয়ে সোনাবউদির ঘরে কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে যায় কাগজওয়ালা। হুঁকো হাতে শিকদার মশাই ঘুরে বসেন একেবারে। সামনের বন্ধ দরজার ওপর দু চোখ আটকে থাকে। আহার-রত গৃহস্বামীর মুখের দিকে যেমন করে চেয়ে থাকে ঘরের পোষা বেড়াল—তেমনি। একটু বাদে দরজা খুলে যায়। একটা ছোট ছেলে বা মেয়ে কাগজ দিয়ে যায় তাঁকে। কাগজ নয়, উপোসী লোকের পাতে রাজভোগ দিয়ে যায় যেন। হুঁকোটা বেঞ্চির কোণে রেখে শশব্যস্তে কাগজ খোলেন শিকদার মশাই।
কিন্তু আরো অবাক কাণ্ড, এত আগ্রহের পরে কাগজখানা পড়ে উঠতে পুরো দশ মিনিটও লাগে না তাঁর। পড়লে ঘণ্টাখানেক লাগার কথা। কিন্তু তিনি পড়েন না, দেখেন। দেখা হলে কাগজখানা ভাঁজ করে পাশে রেখে দেন। ওই ঘর থেকে আবার কোনো বাচ্চা-কাচ্চা বেরিয়ে এলে দিয়ে দেবেন। ধীরেসুস্থে শিথিল হাতে তামাক সাজেন আবার। একটা বাদামী রঙের ঠোঙায় বাড়তি টিকে তামাক মজুত থাকে পাশে। ওদিকে কল-পারের কাশি-পর্ব সেরে শকুনি ভট্টচার্য ব্রাহ্ম-স্তোত্র আওড়াতে আওড়াতে নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকেন। কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে আরো খানিক ভগবানের নাম করেন। পাশাপাশি ঘরের বাসিন্দাদের নিদ্রাভঙ্গ হয় তখন। অতঃপর খেলনা-বাটির মত খুব ছোট একটা এনামেলের বাটি হাতে জবাকুসুমসংকাশং স্মরণ করতে করতে কদমতলার বেঞ্চিতে এসে বসেন শকুনি ভট্টচার্য।
বাটিতে গঙ্গাজল।
শিকদার মশাই তাড়াতাড়ি হুঁকো এগিয়ে দেন। গঙ্গাজলে হুঁকো শুদ্ধি করে নিয়ে তামাক খেতে খেতে শকুনি ভট্টচার্য সেদিনের খবরের কাগজের খবর-বার্তা শোনেন। দশ মিনিটে পড়া কাগজের মর্ম দু ঘন্টা ধরে বলতে পারেন একাদশী শিকদার। কিন্তু তাঁর বলা না-বলাটা শ্রোতার আগ্রহের ওপর নির্ভর করে। আলোচনা জমে উঠলে হুঁকো হাতা-হাতি হতে থাকে ঘন ঘন, নতুন করে সাজা হয় তামাক। ছোট্ট বাটির গঙ্গাজলে হুঁকো শুদ্ধি হতে থাকে বার বার। ইতিমধ্যে শ্রোতা এবং হুঁকোর ভাগীদার আর একজন বাড়ে। কোণা-ঘরের রমণী পণ্ডিত। রোজ না হোক, প্রায়ই আসেন তিনিও। প্রায় অপরাধীর মতই গুটিগুটি এসে বেঞ্চির একেবারে কোণ ঘেঁষে বসেন। বয়েস এঁদের থেকে কিছু কমই হবে। বোবা-মুখে বসে বসে তত্ত্বকথা শোনেন, আর মাঝে মাঝে একটু-আধটু নিরীহ সংশয় অথবা নির্বোধ বিস্ময় প্রকাশ করে বসেন। আলোচনাটা তখনি জমে। শকুনি ভট্টচার্য আর শিকদার মশাইয়ের রসনা চড়তে থাকে। কারণ রমণী পণ্ডিত মানুষটা যত নিরীহ হোন, তাঁর মুখের অজ্ঞ সংশয়ের হাবভাবটুকু খুব সহজে বিলুপ্ত হয় না। ফলে অন্য দুজনের মন্তব্য আর টিপ্পনী প্রায় কটূক্তির মত শোনায়। কিন্তু অভিজ্ঞজনের শ্লেষ গায়ে বেঁধে না রমণী পণ্ডিতের। আরো বার দুই-তিন তামাক সাজার কষ্টটা তিনিই করে যান। তিন হাতে তখন হুঁকো বদল হতে থাকে আর গঙ্গাজলে শোধন হতে থাকে।
শকুনি ভট্টচার্যের ঘরে পতিতপাবনীর অনিঃশেষ অনুগ্রহ।
সুলতান কুঠি থেকে গঙ্গা অনেক দূর। ধীরাপদর ধারণা পুণ্যও। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে পুণ্য চয়ন অথবা গঙ্গাজল সংগ্রহে বেগ পেতে হয় না একটুও। গঙ্গোদক এবং পূণ্যদানের ভাণ্ডারী শকুনি ভটচায। ত্রিসন্ধ্যাশ্রয়ী শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি। পুণ্যের স্টকিস্ট হলেও হতে পারেন, কিন্তু গঙ্গাজল? ধীরাপদ বোকার মতই ভাবত আগে, অত গঙ্গাজল আসে কোথা থেকে?
ধীরাপদর অজ্ঞতা দেখে সোনাবউদি একদিন হেসে সারা। এমন বুদ্ধি না হলে আর এই অবস্থা হবে কেন—এক সের দুধের সঙ্গে দু সের জল মিশিয়ে তিন সের খাঁটি দুধ হয়, আর এক কমণ্ডলু গঙ্গাজলের সঙ্গে কলের জল মিশিয়ে দশ বালতি খাঁটি গঙ্গাজলও হতে পারে না?
ওই রকমই কথাবার্তা সোনাবউদির। সোজা কথা সোজা ভাবে বলে না বড় তবু ব্যাপারটা বুঝেছে ধীরাপদ।
ভূমি-শয্যায় উঠে দাঁড়িয়ে একবার বাইরেটা দেখে নিল। তারপর আবার বসল। একাদশী শিকদার এখনো আসেননি। বেঞ্চিটা খালি। শীতের সকাল আর একটু উষ্ণ না হলে হাড়ে কুলোয় না বোধ হয়। আজ এত ভোরে উঠেই পড়েছে যখন, তাঁর মুখখানা একবার দেখার ইচ্ছে আছে ধীরাপদর। ফলে আজ আহার না জোটে না-ই জুটুক।
ভদ্রলোকের নাম একাদশী নয়, শকুনি ভট্টচাযের নামও শকুনি নয়। এক দঙ্গল ফাজিল ছেলের আবিষ্কার এই নাম দুটো। ওই নামে তাঁদের কাছে ডাকে চিঠি পর্যন্ত পাঠিয়েছে দুষ্টু ছেলেরা। কিন্তু গোড়ায় গোড়ায় ভদ্রলোকদের সব রাগ গিয়ে পড়েছিল ধীরাপদর ওপর। তাঁদের ধারণা সে-ই পালের গোদা। কারণ, ও তখন ওই বাউণ্ডুলে ছেলেগুলোকে একত্র করে কুঠি সংস্কারের কাজে মন দিয়েছিল। কিন্তু সে সব পুরনো কথা। সংস্কারের ঝোঁক বেশিদিন টেকেনি। ছেলেগুলোর বেশির ভাগই চলে গেছে। ওই অক্ষয় নাম দুটি রেখে গেছে।
নামহানির অমর্যাদায় ও বেদনায় ক্রুদ্ধ এবং কাতর হয়ে দুজনেই তাঁরা গোপনে এক একে ধীরাপদর কাছেই আবেদন আর প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ধীরাপদ প্রতিকার কিছু করতে পারেনি। ফলে বিদ্বেষ। এতদিনে ওঁদের আসল নাম সকলেই ভুলেছে। এমন কি ওই নামে বাইরে থেকে কেউ খোঁজ করতে এলেও তাঁরাই বেরিয়ে আসেন। কিন্তু বিদ্বেষটুকু থেকেই গেছে। এক কুঠিতে ধীরাপদ তাঁদের সঙ্গে বাস করে আসছে ট্রেনের এক কামরায় নিস্পৃহ যাত্রীর মতই। যোগ আছে, তবু বিচ্ছিন্ন। কিন্তু সে নিস্পৃহ থাকলেও তাঁরা নিস্পৃহ নন।
আজ সকালে উঠে একাদশী শিকদারের মুখখানি দেখার বাসনার পিছনে কারণ আছে একটু। গত তিন দিন ধরে আগের মতই আধ মাইল পথ ঠেঙিয়ে একটা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজ পড়ে আসতে হচ্ছে ভদ্রলোককে। সোনাবউদি সুলতান কুঠিতে * ডেরা নেবার আগে যেমন পড়তেন। গত দুবছর ওই মেহনত আর করতে হয়নি। বাড়ির আঙ্গিনায় বসে কোলের ওপর কাগজ পেয়েছেন। দুটো বছরে বয়েসও দু বছর বেড়েছে, এতদিনের অনভ্যাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজ দেখার ধকল সয় না। স্টলের সামনে হাঁটু মুড়ে বসতে হয়েছে তাঁকে। সেই অবস্থায় তিন দিনের মধ্যে দু দিনই ধীরাপদর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেছে। দুর্দশা দেখে দুঃখও হয়েছে, হাসিও পেয়েছে। সোনাবউদিই বা এ-রকম কেন? পাঠিয়ে দিলেই তো পারে কাগজখানা!
গত তিন দিন ধরে সোনাবউদির ঘর থেকে কদমতলার বেঞ্চিতে কাগজ যাচ্ছে না। গেলে আর ফুটপাতে বসে কাগজ পড়বেন কেন শিকদার মশাই?
সুলতান কুঠিতে একমাত্র সোনাবউদির ঘরেই রোজ সকালে খবরের কাগজ আসে। একখানা নয়, দুখানা আসে। একটা ইংরেজী একটা বাংলা।
গণুদা অর্থাৎ গণেশবাবু খবরের কাগজের অফিসের পাকাপোক্ত প্রুফরিডার। ইংরেজি বাংলা দুখানা নামকরা কাগজ বেরোয় সেই দপ্তর থেকে। গণুদা বাংলার প্রুফ- রিডার হলেও দুখানা কাগজই বিনা পয়সায় পায়।
আর খানিক বাদেই হয়ত সিকদার মশাই বেঞ্চিতে এসে বসবেন। তার একটু পরে কাগজওয়ালা জানালা দিয়ে কাগজ ফেলে যাবে সোনাবউদির ঘরে। নেশাগ্রস্তের মত চনমনিয়ে উঠবেন একাদশী সিকদার। ঘুরে বসে বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে থাকবেন নির্নিমেষে। দরজা একসময়ে খুলবে ঠিকই, কিন্তু কেউ কাগজ দিয়ে যাবে না তাঁর কাছে।
তারপর শকুনি ভটচায আসবেন, খবরের কাগজের খবর নিয়ে কথা উঠবে মা নিশ্চয়ই। শিকদার মশায়ের প্রাতঃকালীন কাগজপাঠে বিঘ্ন উপস্থিত হয়েছে তিনিও জানেন। দুদিন ধরে সকালের আসরে রমণী পণ্ডিতকে দেখা যাচ্ছে না। এঁদের মন- মেজাজ বুঝেই হয়ত কাছে ঘেঁষতে সাহস করছেন না।
অবশ্য সবই ধীরাপদর অনুমান। অনুমান, ভট্টচার্য এবং শিকদার মশাই গণুদাকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে কিছু আলোক দান এবং কিছু পরামর্শ দান করেছেন। সংসারাভিজ্ঞ শুভার্থী প্রতিবেশীর কর্তব্য-বোধ তো এখনো জগৎ থেকে লুপ্ত হয়ে যায়নি একেবারে। তার ওপর গদা নির্বিরোধী মানুষ, কোনো কিছুর সাতে-পাঁচে নেই। সকলেই জানে গণুদা ভালো মানুষ। নিজের আপিস নিয়েই ব্যস্ত সর্বদা। কোনো সপ্তাহে সকালে ডিউটি, কোনো সপ্তাহে বিকেলে, কোনো সপ্তাহে বা রাত্রিরে। রাত্তিরে অর্থাৎ সমস্ত রাত। এর ওপর আবার বাড়তি রোজগারের জন্য মাসের মধ্যে দু সপ্তাহ ডবল শিফট ডিউটি করে। ঘর দেখার ফুরসৎ কোথায় তার?
কিন্তু তার নেই বলে কি আর কারো নেই? গুণী বদ্যি নিজের ঘরের দিকে তাকাবার ফুরসৎ না পেলেও আর দশ ঘরের নাড়ীর খবর রাখে। আর কর্তব্য-চেতন গুণী পড়শীর নাড়ী-নক্ষত্রের খবর রাখে। এ তো এক বাড়ির ব্যাপার, অতএব কর্তব্যবোধেই ভট্চায আর শিকদার মশাই ভালোমানুষ গণুদার জটিলা রমণীটির হালচালের ওপর খরদৃষ্টি রাখবেন সেটা বেশি কিছু নয়। আর কর্তব্যবোধেই তাঁরা ভালোমানুষটিকে একটু-আধটু উপদেশ দেবেন তাই বা এমন বেশি কি?
তবে তাঁদের এই কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে একটু আভাস ধীরাপদ রমণী পণ্ডিতের কাছ থেকে আগেই পেয়েছিল। কিন্তু ধীরাপদ তখন তলিয়ে ভাবেনি কিছু। অনর্থক অমন অনেক কথাই বলেন রমণী পণ্ডিত। ফাঁকমত সকলের সঙ্গেই একটু হৃদ্যতা বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করেন। ধীরাপদ সেদিন কুঠির দিকে আসছিল আর তিনি যাচ্ছিলেন কোথায়। পথে দেখা। বাড়িতে দেখা হলে না দেখেই পাশ কাটিয়ে থাকেন। পথটা বাড়ির থেকে অনেক নিরাপদ বলেই হয়ত দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। হাসিমুখে যেভাবে কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন, মনে হবে অন্তরঙ্গ পরিচিত জনের সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা, শেষে বলেছেন, আজ এরই মধ্যে বাড়ি ফিরছেন? তা কি-ই বা করবেন, যে-রকম বাজার পড়েছে, চট করে কিছুই আর হয়ে ওঠে না… অনেক দিন ভেবেছি আপনার হাতখানা একবার দেখব, তা আপনার তো আর ও-সবে বিশ্বাস টিশ্বাস নেই।
-তবু দেখাবেন না একবার, আপনার তো আর পয়সা লাগছে না।
ধীরাপদ হাসিমুখেই মাথা নেড়েছিল।
– যাচ্ছেন? আচ্ছা যান পুকুরধারে, শিকদার আর ভট্টচার্য মশাইকে দেখলাম বসে গণুবাবুর সঙ্গে গল্পসল্প করছেন—
অকারণে বোকার মত একটু বেশিই হেসেছিলেন পণ্ডিত। গণুদাকে বাড়ির কারো সঙ্গে বড় একটা মিশতে দেখে না কেউ। কখন থাকে না থাকে হদিস পাওয়াই ভার। সেই গণুদার সঙ্গে মজা পুকুরের ধারে বসে গল্প করছেন একাদশী শিকদার আর শকুনি ভটচায…ভাবলে ভাবার মত কিছু ছিল বই কি। পণ্ডিত সেদিন বোকার মত হাসেননি। বোকার মত সে-ই বরং ওই পণ্ডিতের দুরাশার কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরেছিল। বড় আশা ভদ্রলোকের, শহরের জাঁকজমকের মধ্যে একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে জাঁকিয়ে বসবেন। জ্যোতিষার্ণব হবেন। মস্ত সাইনবোর্ড ঝুলবে। দু-পাঁচজন সাগরেদ থাকবে, রীতিমত অফিস হবে-চকচকে ঝকঝকে দু-পাঁচটা গাড়িও এসে দাঁড়াবে দোরগোড়ায়। সবই হত, অভাব শুধু মূলধনের। সম্বলের মধ্যে অনেকগুলো ছেলেপুলে আর রুমা স্ত্রী। হাঁড়িতে জল ফোটে, দোকানে চাল। তবু আশা পোষণ করেন রমণী পণ্ডিত।
তাঁর দোষ নেই। আশা আর বাসা ছোট করতে নেই।
পণ্ডিতের সেই বোকা হাসির অর্থ ধীরাপদ পরে বুঝেছিল। এখানে দিন যাপনের একটানা ধারাটা আচমকা ধাক্কায় ওলট পালট হয়ে যাবার পরে। আর সেই সঙ্গে সকালে একাদশী শিকদারের খবরের কাগজ বন্ধ হতে দেখে। একটার সঙ্গে আর একটার যোগ অনুমান করা কঠিন হয়নি। অনেক কিছুই অনুমান করা সম্ভব হয়েছে তারপর। সেদিন দাঁড়িয়ে শুনলে রমণী পণ্ডিত হয়ত আরো খানিকটা আভাস দিতেন। কারণ এর আগে শকুনি ভটচায আর একাদশী শিকদারের কর্তব্যবোধের ধকলটা তাঁর ওপর দিয়েই গেছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ভদ্রলোক, কোণা-ঘরে পালিয়ে বেঁচেছেন।
সচকিতে জানালার দিকে ঘাড় ফেরাল ধীরাপদ। কদমতলায় যাঁদের আশা করেছিল তাঁরা নয়। তার জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে সোনাবউদি। মুখে-চোখে সদ্য ঘুমভাঙা জড়িমা। চুপচাপ দেখে যেতে এসেছিল বোধ হয়। ধরা পড়ে অপ্রতিভ একটু, কিন্তু এত সকালে কম্বল মুড়ি দিয়ে শয্যায় ও-ভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক আরো বেশি। এগিয়ে এসে এক হাতে জানালার গরাদ ধরে জিজ্ঞাসা করল, কার ধ্যান হচ্ছে?
কম্বল ফেলে ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল। কিন্তু দরজার দিকে এগোবার আগেই সোনাবউদি বাধা দিল আবার, থাক, দরজা খুলতে হবে না, এই সাতসকালে ও-ঘর থেকে আমাকে বেরুতে দেখলে ঘাটের কাশি একেবারে ঘাটে পাঠিয়ে ছাড়বে।
হেসে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে কদমতলার দিকটা দেখে নিল একবার। তারপর ঈষৎ কৌতুকভরা দু চোখ ধীরাপদর মুখের উপর রাখল। শুধু কৌতুকভরা নয়, প্রচ্ছন্ন সন্ধানীও। গায়ে কম্বল না থাকায় শীত-শীত করছে ধীরাপদর। কিন্তু সোনাবউদির শীতের বালাই নেই। শাড়ির আঁচলটাও গায়ে জড়ায়নি, স্রস্ত শৈথিল্যে কাঁধের ওপর পড়ে আছে। রাতের নিদ্রায় মাথার চুল কিছুটা অবিন্যস্ত। তিন ছেলেমেয়ের মা সোনাবউদিকে রূপসী কেউ বলবে না। গায়ের রঙ ফর্সাও নয়, কালোও নয়। নাক মুখ চোখ সুন্দরও নয়, কুৎসিতও নয়। স্বাস্থ্য খুব ভালও নয়, তেমন মন্দও নয়। তবু ওই ভারী সাধারণের মধ্যেও কিছু যেন আছে যা নিজের অগোচরে ধীরাপদ অনেক সময় খুঁজেছে। আজকের প্রথম ঊষায় জরাজীর্ণ সুলতান কুঠিরও একটা ভিন্ন রূপ দেখেছে। ধীরাপদর লোভ হল, এই সকালে সোনাবউদির মুখটির দিকে ভালো করে তাকালেও সেই কিছুটা হয়ত চোখে পড়বে। কিন্তু সোনাবউদি যে ভাবে দেখছে, ওর পক্ষে ফিরে সেইভাবে তাকে দেখা সম্ভব নয়।
বিব্রত মুখে ধীরাপদ দাগধরা দেয়ালটার দিকে চেয়ে হাসল একটু।
একেবারে রাত কাবার করেই ফেরা হল বুঝি?
হালকা সুর, হালকা প্রশ্ন। মাঝের এই ক’টা দিন ছেঁটে ফেলতে পারলে একেবারে স্বাভাবিক। ঘাড় ফিরিয়েও ধীরাপদ মুখের দিকে তাকাতে পারল না ঠিকমত। কারণ সোনাবউদির দু চোখ তখনো ওর মুখের ওপর বিশ্লেষণরত। নিরুত্তর দৃষ্টি তার কাঁধ- ঘেঁষে কদমতলার খালি বেঞ্চিটার ওপর গিয়ে পড়ল। ফলে সোনাবউদি চকিতে আরো একবার ফিরে দেখে নিল সেখানে কেউ এসেছে কিনা।
রাতটা কোথায় ছিলেন কাল?
এই ঘরেই।
এলেন কখন, মাঝরাতে?
না, গোড়ার রাতেই।
ওমা, আমি তাহলে কি কচ্ছিলাম! জেগে ঘুমুচ্ছিলাম বোধ হয়। বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা, তারপর আর একবার আপাদ-মস্তক দেখে নিয়ে বলল, ঘণ্টাখানেক বাদে একবার ঘরে আসবেন, একটু কাজ আছে।
সোনাবউদি চলে যাবার পরও ধীরাপদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। ভাবছে মাঝের এই ক’টা দিন কি মিথ্যে? কিছুই ঘটেনি? মিথ্যে নয়। ঘটেছেও। কিন্তু যা ঘটেছে তার থেকেও ধীরাপদ আজ অবাক হল আরো বেশি। ঘণ্টাখানেক বাদে ঘরে যেতে বলে গেল ওকে। ঠিক আদেশও নয়, অনুরোধও নয়। ওই রকম করেই বলত আগে। কিন্তু আগের সঙ্গে তো এখন অনেক তফাত। আবার কি তাহলে আপস হবে একটা? ধীরাপদ আর তা চায় না। সোনাবউদির সব মানায়, আপস মানায় না।
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ যেতে আর ভাবা হল না। হুঁকো আর তামাকের ঠোঙা হাতে শিকদার মশাই আর গঙ্গাজলের বাটি হাতে শকুনি ভট্টচার্য একসঙ্গেই এসে কদমতলার বেঞ্চিতে বসলেন। আর কাগজ আসে না বলেই বোধ হয় শিকদার মশাইয়ের আগে আসার তাড়া নেই। হাত বদলে বদলে প্রথমে চুপচাপ খানিকক্ষণ তামাক টানলেন তাঁরা। তারপর একটা দুটো কথা। কি কথা ধীরাপদ এখান থেকে জানবে কি করে? কিন্তু কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বসে দুজনেই তাঁরা বাড়িটার দিকে তাকালেন। প্রথমে গণুদার ঘরের দিকে, তারপর এদিকে। জানালার এধারে তাকে দেখেই তাড়াতাড়ি ফিরে বসলেন আবার।
কিন্তু মুখ দেখে তাঁদের খুব রুষ্ট মনে হল না ধীরাপদর। বরং তুষ্ট যেন কিছুটা। একটা দুষ্ট বুদ্ধি জাগল হঠাৎ। ওই বেঞ্চিতে গিয়ে বসলে কি হয়? সম্পত্তি তো নয় কারো। বসুক না বসুক ধীরাপদ ঘরের বন্ধ দরজাটা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে লাল সাইকেল হাঁকিয়ে কাগজওয়ালার আবির্ভাব। একাদশী শিকদারের হুঁকো টানা বন্ধ হল। কাগজওয়ালা কাগজ ফেলে দিয়ে প্রস্থান করল। সতৃষ্ণ নেত্রে ঘরের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। তাঁর হাত থেকে হুঁকো টেনে নিলেন শকুনি ভট্টচার্য খেয়াল নেই। পাশের ঘরের দোরগোড়ায় ধীরাপদ দাঁড়িয়ে আছে তাও না।
সুলতান কুঠির আজকের এই দিনটাই অন্য সব দিনের থেকে আলাদা বুঝি। দু-চার মিনিটের মধ্যেই যে-দৃশ্যটি দেখল, ধারাপদ নিজেই হতভম্ব। আধ-হাত ঘোমটা টেনে কাগজ হাতে ঘর থেকে বেরুল স্বয়ং সোনাবউদি। কুলবধূর নম্রমন্থর চরণে কদমতলার বেঞ্চির দিকে এগিয়ে গেল। শিকদার মশাই শশব্যস্তে বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শকুনি ভটচাযও। কাগজখানা হাতে নিয়ে একাদশী শিকদার সসঙ্কোচে কিছু বললেন। হয়ত নিজে কাগজ নিয়ে আসার জন্যেই বললেন কিছু।
এটুকু দেখেই ধীরাপদ অবাক হয়েছিল; পরের কাণ্ডটা দেখে দুই চোখ বিস্ফারিত ভার। গলায় শাড়ির আঁচল জড়িয়ে দুজনকেই একে একে প্রণাম করে উঠল সোনাবউদি। যেমন-তেমন প্রণাম নয়, ভক্তি-ললিত প্রণাম।
বিস্ময়াভিভূত শিকদার ভটচার্যের যুগপৎ আশিস-বর্ষণ শেষ হবার আগেই তেমনি ধীর-নম্র চরণে সোনাবউদি ফিরল আবার।
আধ-হাত ঘোমটা সত্ত্বেও ধীরাপদকে দেখেছে নিশ্চয়। কিন্তু কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গেল।
বিমূঢ় মুখে ধীরাপদ নিজের বিছানায় এসে বসল।
ছোটখাটো একটা ভোজবাজি দেখে উঠল যেন। এ পর্যন্ত সোনাবউদির অনেক আচরণে অনেকবার হকচকিয়ে গেছে ধীরাপদ। সে-সবই তার স্বভাবের সঙ্গে মেলে। এ একেবারে বিপরীত।
সোনাবউদি কড়াপাকের সন্দেশ রে, আসলে খারাপ নয়।
খট করে রণুর কথা ক’টা মনে পড়ে ধীরাপদর। রণু বলত। রণেশ—গণুদার ছোট ভাই। এদের সঙ্গে যোগাযোগের অনেক আগেই এই সোনাবউদিটির কথা শোনা ছিল ধীরাপদর। স্বর্ণবালা থেকে সোনাবউদি। মস্ত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের মেয়ে নাকি। কিন্তু পণ্ডিত হলে হবে কি, ইস্কুলমাস্টারের আর আয় কত। তার ওপর মেয়েও একটি নয়। রণু বলত, তাই তাদের মত ঘরে এসে পড়েছে, নইলে…
তখনকার এই অদেখা সোনাবউদিকে নিয়ে ধীরাপদ ঠাট্টাও কম করেনি।
হঠাৎ রণুর কথা মনে হতে ধীরাপদ জোরে বাতাস টানতে চেষ্টা করল আর বিরক্ত হল। মনে পড়ে কেন? এত নিস্পৃহতা সত্ত্বেও এখনো বুকের মধ্যে এ-ভাবে টান পড়ে কি করে?
দু ভাইকে পাশাপাশি দেখলে সহোদর ভাবা শক্ত। বেঁটে-খাটো গোলগাল চেহারা গণুদার—ধপধপে ফর্সা রঙ। সুখী আদল। রণু ঠিক উল্টো। কলেজে পড়তেই ধীরাপদর কেমন মনে হত ছেলেটা বেশী দিন বাঁচতে আসেনি। খুব দূরের কিছুর সঙ্গে কেমন যেন যোগ ওর। আধ-ময়লা রোগা লম্বা চির-রুগ্ন মূর্তি। কথাবার্তা কম বলত, বেশি দিন টিকবে না নিজেই বুঝেছিল বোধ হয়।
সোনাবউদির সঙ্গে ধীরাপদর সাক্ষাৎ এবং পরিচয় হাসপাতাল থেকে রণুকে বাড়ি নিয়ে আসার পরে। গণুদার বাড়ি বলতে তখন এক আধা-ভদ্র বস্তির দুখানা খুপরি ঘর। হাসপাতাল থেকে রণুর জবাব হয়ে গেছে। একটা চেষ্টা বাকি। পিঠের ঘুণ-ধরা হাড়ের গোটা অংশটা কেটে বাদ দেওয়া। সেই অপারেশনও তখন মাদ্রাজের কোথায় হয়, এখানে হয় না। চিকিৎসা বলতে টাকার খেলা।
গণুদা ঘাবড়ে গিয়েছিল। আরো বেশি ঘাবড়েছিল রোগীকে আপাতত বাড়ি নিয়ে যেতে হবে শুনে। ঢোঁক গিলে দ্বিধা প্রকাশ করেছিল, কি যে করি, ইয়ে আমার ওখানে একটু অসুবিধে আছে।
বিপদের সময় সেই মিনমিনে ভাব দেখে ধীরাপদ চটে গিয়েছিল। জোরজার করে রণুকে সে-ই একরকম ওখানে এনে তুলেছিল। বলেছে, অসুবিধের কথা পরে ভাবা যাবে। সোনাবউদি মুখ বুজে সেই দু ঘরের এক ঘরে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে ধীরাপদর মনে হয়েছিল কাজটা ভালো হল না। আর মনে হয়েছিল, গণুদার অসুবিধার কারণ বোধ হয় ইনিই। হাসপাতালেও কোনদিন দেখেনি মহিলাকে। রণুর মুখের দিকে চেয়ে মায়া হত বলেই কোনদিন তার কথা জিজ্ঞাসা করেনি। নইলে ধীরাপদর মনে হত ঠিকই।
শুধু মনে হওয়া নয়, তারপর কানেই শুনতে হয়েছে অনেক কিছু। হাসপাতাল থেকে রণুকে নিয়ে আসার দিনতিনেক পরের কথা। বিকেলের দিকে ওর বিছানার পাশে ধীরাপদ বসেছিল। পাশের ঘর থেকে নারীকণ্ঠের তর্জন শোনা গেল। শোনাতে হয়ত চায়নি, কিন্তু যেমন ঘর না শুনে উপায় নেই।
যেখান থেকে হোক টাকা যোগাড় করে পাঠিয়ে দাও, টাকা নেই বলে কি গুষ্টিসুদ্ধ মরতে হবে।
আঃ, লোক আছে ও-ঘরে। গণুদার গলা।
থাক লোক। আর দুটো দিন সবুর করে যেখানে পাঠাতে বলছে ওরা, একেবারে সেখানে পাঠালেই হত, সাত-তাড়াতাড়ি এখানে এনে তোলার কি দরকার ছিল?
ক্লান্তিতে দু চোখ বোজা ছিল রণুর। কানে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু একটুও বিব্রত বোধ করেছে বলে মনে হয়নি। বরং ধীরাপদই না বলে পারেনি। হালকা ঠাট্টায় ফিসফিস করে বলেছে, তোর বউদি কড়াপাকের ছানার সন্দেশ না ইটের সন্দেশ রে!
চোখ মেলে রণু অল্প একটু হেসেছিল মনে আছে। নির্লিপ্ত মুখে বলেছিল, টাকা আদায় করার জন্য ও-ভাবে বলছে। ধীরাপদ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু রণুর বিশ্বাস দেখে অবাক হয়েছিল।
অবাক ধীরাপদ আরো হয়েছিল। সেটা তার পরদিনই। দুপুরের দিকেই এসেছিল —যেমন আসে। কিন্তু ঘরে ঢোকার আগেই সোনাবউদি এগিয়ে এলো। বলল, ও ঘুমুচ্ছে, এ-ঘরে আসুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে–
ধীরাপদ তাকে অনুসরণ করে অন্য ঘরটিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। এ ঘরটা আরো অপরিসর। মেঝের একদিকে ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে ঘুমুচ্ছে, অন্যদিকে একটি চার- পাঁচ মাসের শিশু হাত-পা ছুঁড়ছে। কোণ থেকে একটা গোটানো মাদুর নিয়ে সোনাবউদি আধখানা পেতে দিয়ে বলল, বসুন—
অনতিদূরে নিজেও মেঝেতে বসল পা গুটিয়ে। দুই এক পলক ওকে দেখে নিল তারই মধ্যে।— বিপদের সময় আর লজ্জা করে কি হবে, তাই ডাকলুম। আপনার সঙ্গে ঠাকুরপোর অনেকদিনের পরিচয় শুনেছি, আপনার কথা প্রায়ই বলত।
গরমে হোক বা যে জন্যেই হোক, ধীরাপদ ঘেমে উঠেছিল। সোনাবউদি আর এক নজর দেখে নিল। ধীরাপদর মনে হল, কিছু বলবার আগে যেন যাচাই করে নিল আর এক প্রস্থ।
আপনি কি করেন?
কথা আছে বলে ঘরে ডেকে এনে বসিয়ে এ আবার কি প্রশ্ন। ধীরাপদ ফাঁপরে পড়ল।
তেমন কিছু না…
সে তো জানি, তেমন কিছু করলে আর এ বাড়ির সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কেমন করে? ভাবল একটু, তারপর সোজাসুজি তাকালো মুখের দিকে।—বন্ধুর চিকিৎসার জন্য শ’ পাঁচেক টাকা আপনাকে কেউ ধার দিয়েছে শুনলে লোকে বিশ্বাস করবে?
ধীরাপদর মুখের অবস্থা কেমন হয়েছিল কে জানে। কারণ তার দিকে চেয়ে সোনাবউদি হেসেই ফেলেছিল। ভয় নেই, আপনাকে ধার করতে বেরুতে হবে না, কাল একটু সকাল সকাল আসুন, বিশেষ দরকার আছে। কাউকে কিছু বলবেন না! সকাল-সকালই এসেছিল পরদিন। এসে দেখে সোনাবউদি কোথায় বেরুবার জন্য প্রস্তুত। বাচ্চাগুলো ঘরের মধ্যে ঘুমুচ্ছে আগের দিনের মতই। বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে ঘরের শিকল তুলে দিল। আসুন।
তিনটে বাচ্চাকে এইভাবে ঘরে বন্ধ করে কোথায় যেতে চায় ধীরাপদ কিছুই বুঝল না। জিজ্ঞাসা করার ফুরসৎ পেল না। রাস্তায় এসে সোনাবউদি নিজে থেকেই বলল, ভালো একটা গয়নার দোকানে নিয়ে চলুন, কলকাতায় থাকলেও কিছুই চিনি না-
ধীরাপদও তেমনিই চেনে গয়নার দোকান। তবে দুই-একটা দেখেছে বটে। সোনাবউদি গয়না বিক্রি করল। সেকেলে আমলের ভারী গোট হার একটা। সোনার দাম চড়া। মোটা টাকাই পেল। চুলচেরা হিসেব বুঝে নিয়ে খাদের সম্ভাব্য পরিমাণ ইত্যাদি নিয়ে ঝকাঝকি করে তারপর টাকা নিল। তবু সংশয় যায় না, ঠকল কি না সারা পথ চুপচাপ তাই ভাবছিল বোধ হয়।
বাড়ির কাছাকাছি এসে বলল, ঠাকুরপো বা কাউকে কিছু বলবেন না… অবশ্য এটা ওরই জিনিস, তবু শুনলে দুঃখ পাবে।
গয়নার দোকানে সোনাবউদির দর-কষাকষি ধীরাপদর ভালো লাগছিল না। বাচ্চাগুলোকে ওভাবে ঘরে বন্ধ করে আসাটাও না। রণুর জিনিস শোনামাত্র মনটা বিরূপ হবার সুযোগ পেল। রণুর মা-ঠাকুমা খুব সম্ভব ওর নামে রেখে গেছেন। বিক্রির জন্য সেটা বিশ্বাস করে ধীরাপদর হাতে না ছেড়ে দিতে পারাটা অন্যায় নয়। কিন্তু ও কাজটা তো গদাকে দিয়েও হত। এত অবিশ্বাস আর এত গোপনতা কিসের!
রণুর পাশে এসে বসামাত্র সে জিজ্ঞাসা করল, কি রে, হার বিক্রি করে এলি? ধীরাপদ অবাক। সামলে নিয়ে বলল, করব না তো কি, হার ধুয়ে জল খাবি? তুই জানলি কি করে?
হাসল একটু।—আমি হাসপাতালে থাকতেই জানতুম এবার ওটা খসবে। ধীরাপদ বিরক্ত হচ্ছিল, কিন্তু পরের কথাটা শুনে বিস্ময়ে থমকে গেল। রণু বলল, ওটুকুই ছিল সোনাবউদির সোনাবউদির।
কিন্তু তিনি যে বললেন ওটা তোর?
বলল, না? খুশিতে শীর্ণ মুখ ভরে উঠেছিল রণুর।— সোনাবউদি ওই রকমই বলে। প্রথম অসুখে ওটা বার করে বলেছিল, এই দিয়ে চিকিৎসা করো। আমি বলেছিলাম দরকার হলে পরে নেব। সেই থেকে ওটা আমার হয়ে গেছে। ওটা ওর দিদিমার দেওয়া।
ধীরাপদর মনে আছে সুলতান কুঠির এই ভূমিশয্যায় সেই একটা রাতও প্রায় বিনিদ্র কেটেছিল তার। সমস্তক্ষণ কি ভেবেছে এলোমেলো, আর ছটফট করেছে। থেকে থেকে মনে হয়েছে, রণুর মত সে-ও যদি ঠিক অমনি করে সোনাবউদি বলে ডাকতে পারত। পারলে বলত, সোনাবউদি তোমার ওপর বড় অবিচার করেছিলাম, দোষ নিও না।
রণু মারা গেছে।
ভিতরে ভিতরে ধীরাপদ আবারও নাড়াচাড়া খেয়েছিল। মারা গেছে বলে নয়। যাবে জানতই। কিন্তু এমন নিঃশব্দ বিদায় কল্পনা করেনি। যেন কোনো যাত্রাপথের মাঝখানে দিনকতকের জন্য থেমেছিল। সময় হল চলে গেল। তার পর কেউ এলো খবর করতে। খবর পেল, নেই—চলে গেছে।
ধীরাপদও খবরটা পেয়েছিল অনেকটা সেইভাবেই। রণুকে মাদ্রাজে পাঠানোর পর আর রোজ আসত না। পাঁচ-সাত দিন পরে পরে এসে খোঁজ নিয়ে যেত। কথাবার্তা গণুদার সঙ্গেই হত। একটা অপারেশান হয়ে গেছে—আরো একটা হবে—তাও হয়ে গেল—হ্যাঁ, ভালই আছে বোধ হয়—ও, তুমি জান না বুঝি? আজ চার দিন হল রণু মারা গেছে।
গণুদার অফিসের তাড়া, ভাই ছেড়ে নিজে মরলেও প্রেস অপেক্ষা করবে না। ঘরের মধ্যে ছেলে আর মেয়েটা হুটোপুটি করছে, কোলের শিশুটা শুয়ে শুয়ে হাত পা ছুঁড়ছে। সোনাবউদি কলতলায় জামাকাপড় কাচছে।
যে নেই তার দাগও নেই।
গণুদা বসতে বলে গেছে তাকে, সোনাবউদির কি কথা আছে নাকি।
এককালে রবি ঠাকুরের কিছু কবিতা পড়েছিল ধীরাপদ। স্বর্গচ্যুত কোনো শাপভ্ৰষ্ট দেবতার যখন মাটিতে টান পড়ে—শোকহীন হৃদয়হীন স্বর্গভূমি উদাসীন তখনো। কিন্তু মাটির শেকল-ছেঁড়া মানুষের শোকে বসুন্ধরার আকুল কান্না। কবির চোখে সেই শোক হৃদয়ের সম্পদ। স্বর্গের সঙ্গে মর্ত্যের এইটুকুই তফাত।
ধীরাপদর হাসি পাচ্ছিল, তফাত ঘুচতে খুব দেরি নেই।
আদুড় গায়ে শাড়িটা বেশ করে জড়িয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সোনাবউদি এসে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিল, আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা এবারে শেষ হল বোধ হয়?
জবাব না দিয়ে ধীরাপদ চুপচাপ মুখের দিকে চেয়েছিল। নিজের অগোচরে শোকের দাগ খুঁজছিল হয়ত… গম্ভীরই দেখাচ্ছে বটে। ছেলে-মেয়ের চেঁচামেচিতে মহিলা একবার শুধু ফিরে তাকাতেই সভয়ে ঘর ছেড়ে পালালো তারা। ভয়টা স্বাভাবিক, মায়ের হাতে তাদের নিগ্রহ ধীরাপদ নিজের চোখেই দেখেছে।
সোনাবউদির দু চোখ তার মুখের ওপর ফিরল আবার। – আপনার দাদা বলেন, মস্ত বড় বাড়িতে নাকি থাকেন আপনি, আর, একটু চেষ্টা করলে আমাদেরও সেখানে জায়গা হতে পারে। তাঁর ধারণা আমি আপনাকে বললে আপনি সে-চেষ্টা করবেন– বলছি না বলে রাগ। কিন্তু বন্ধু থাকতেই করেন নি যখন, এখন আর কেন করবেন বুঝছি না।
ধীরাপদ হাঁ করেই চেয়েছিল খানিকক্ষণ। স্টেশনে রণুকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার আগে পর্যন্ত অফিস কামাই করেও গণুদা মাঝে মাঝে সুলতান কুঠিতে আসত বটে। ব্যবস্থা-পত্র সম্বন্ধে পরামর্শ করত, মিনমিন করে নিজের সুবিধে-অসুবিধের কথা বলত। বাড়িটাও একদিন ঘুরে ঘুরে দেখেছিল মনে পড়ে।
ঠিক এই মুহূর্তে এই স্বার্থের কথাগুলো না শুনলে ধীরাপদ কিছু মনে করত না। এমন কি রণুর প্রসঙ্গে দু-চার কথা বলার পরে যদি বলত তাহলেও খারাপ লাগত না। কিন্তু সব সত্ত্বেও সোনাবউদির বলার ধরনটা বিচিত্র মনে হয়েছিল।
গণুদা মনস্তাত্ত্বিক নয়, খবরের কাগজের প্রুফরিডার। সোনাবউদি বললে সে চেষ্টা করবে, এটা বুঝেছিল কি করে? যে করেই হোক বুঝেছিল ঠিকই। ধীরাপদ চেষ্টা করেছিল। যে চলে গেছে তার শোক আঁকড়ে কে কদিন বসে থাকে? স্বার্থ কার নেই? রণুর জায়গা দখল করার একটুখানি প্রচ্ছন্ন লোভ কি ভিতরেও উকিঝুঁকি দেয়নি? না দিলে সোনাবউদির কথাগুলো অলক্ষ্য তাগিদের মত অমন অষ্টপ্রহর মনে লেগে থাকত কেন? আর তাদের এখানে নিয়ে আসার জন্য অমন এক অদ্ভুত কাণ্ডই বা করে বসেছিল কি করে?
বরাতক্রমে কোণা-ঘর দুটো খালিই ছিল তখন। বাসের অযোগ্য নয়, তবে সুলতান কুঠির অন্যত্র ঠাঁই পেলে ওখানে সাধ করে ঠাঁই নেবে না কেউ। সপরিবারে গণুদাকে ওখানেই এনে তোলা যেত। আর ভদ্রলোক হাঁফ ফেলে বাঁচত তাহলেও।
কিন্তু ধীরাপদর বাসনা অন্য রকম।
রমণী পণ্ডিতকে ওখানে চালান করার সুযোগটা ছাড়েনি সে। ধীরাপদ নিজের মনে হেসেছে আর নিজেকেই পাষণ্ড বলে গাল দিয়েছে।
তার পাশের ঘরেই সোনাবউদির সংসার-সেখানে তখন থাকতেন রমণী পণ্ডিত। অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের মধ্যে মেয়েটি বড়। বড় বলতে বছর তের-চৌদ্দ বয়েস তখন। রমণী পণ্ডিতের সাধ ছিল মেয়ে লেখাপড়া শিখবে, আই.এ বি.এ পাস করবে। ছেলের থেকেও আজকাল লেখাপড়া জানা মেয়ের কদর বেশি। ধীরাপদ অনেকবার তাঁকে বলতে শুনেছে, মেয়ের হাতটিতে বিদ্যাস্থান বড় শুভ। কিন্তু মেয়েকে বিদ্যার খোঁয়াড়ে ঠেলে দিতে না পারলে সরস্বতী ঠাকরোন যেচে এসে হাতে বসবেন না। আশা পুরণের একটাই উপায় দেখেছিলেন রমণী পণ্ডিত। ঘষে-মেজে ধীরাপদ যদি মেয়েটাকে প্রথম ধাপ অর্থাৎ স্কুল-ফাইন্যালটা পার করে দিতে পারে, তাহলে বাকি ধাপগুলো মেয়ে নিজেই টপাটপ টপকে যাবে।
ধীরাপদ রাজী হয়েছিল। রাজী হয়ে অথৈ জলে পড়েছিল। মেয়ের হাতে বিদ্যাস্থান যত শুভ মগজে ততো নয়। রোজই পড়তে আসত। মুখ বুজে পড়ত বা পড়া শুনত। চৌদ্দ বছরের মেয়ে কুমুর ধৈর্যের অপবাদ দিতে পারবে না ধীরাপদ। সে অপবাদটা বরং ওর নিজেরই প্রাপ্য। সে নিজেই হাল ছেড়েছিল।
কিন্তু কুমুর হাতে বিদ্যাস্থান যে বড় শুভ, রোজ সকালে একগাদা বই হাতে তার আগমন ঠেকাবে কি করে? দিনকে দিন ধীরাপদ নিজেই হতাশ হয়ে পড়ছিল।
নি-খরচায় মেয়ের বিদ্যালাভের ব্যবস্থা করার সময় সুলতান কুঠির নীতির পাহারাদার দুটির কথা মনে হয়নি রমণী পণ্ডিতের। একাদশী শিকদার আর শকুনি ভটচার্যের কথা। দিনকতক চুপচাপ দেখলেন তাঁরা, তারপর ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন। ধীরাপদর অবশ্য টের পাওয়ার কথা নয়, ক্ষোভের মাথায় রমণী পণ্ডিতই প্রকাশ করে দিয়েছেন। –কি রকম মানুষ ওঁরা বলুন তো—ওই কচি মেয়ে—আর আপনি এমন একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, কারো সাতে নেই পাঁচে নেই, আমার অনুরোধ ঠেলতে না পেরে দয়া করে মেয়েটাকে পড়াচ্ছেন একটু—তাতেও ওদের চোখ টাটায়। নীচ, নীচ- একদম নীচ, বুঝলেন? আমি নিজে হাত দেখেছি ওদের—কোথাও কিছু ভালো নেই, বুঝলেন?
বুঝে একটু আশ্বস্ত হয়েছিল ধীরাপদ। কিন্তু পরদিনও যথাপূর্ব বিদ্যাস্থানে বিদ্যার বোঝা-সহ কুমুকে এসে দাঁড়াতে দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছে। একভাবেই চলছিল। ঠিক একভাবে নয়, একাদশী শিকদার আর শকুনি ভটচার্যের টিকা-টিপ্পনী আর গঞ্জনার মাত্রা যে বাড়ছে সেটা ধারাপদ অনুমান করেছিল রমণী পণ্ডিতকে দেখে। মেয়ের পড়ার সময়টায় প্রায়ই বারান্দায় পায়চারি করতেন তিনি, অকারণে এক-আধবার ঘরেও ঢুকতেন। কদমতলার বেঞ্চির শুভার্থী দুজন ভালয় ভালয় তাঁকে কোণা-ঘরে উঠে যেতে পরামর্শ দিচ্ছেন, এ খবরটাও কেমন করে যেন ধীরাপদর কানে এসেছিল।
ঠিক এই শুভ-মুহূর্তে সোনাবউদির মারফৎ গণুদার সেই ঠাইয়ের তাগিদ।
ঘর খালি থাকলে আর সুলতান কুঠিতে কাউকে এনে বসাতে হলে কোনো বাড়ি-অলার কাছে দরবার নিষ্প্রয়োজন। যাকে খুশি এনে বসিয়ে দাও আগে, পরের কথা পরে। কার বাড়ি কে মালিক সে খবর এখনো ভালো করে জানা নেই কারো। বাড়ির তদারক করে বিহারী দারোয়ান শুকলাল। কুঠিসংলগ্ন একটা পোড়ো-ঘরে থাকে সে। ভাড়াটেদের ফাই-ফরমাশ খেটেও দু-এক টাকা বাড়তি রোজগার হয় তার। সুলতান- কুঠিরক্ষক দারোয়ানের মেজাজ নয় শুকলালের। ঠাণ্ডা মেজাজের ভালো মানুষ। পুরানো বাসিন্দা হিসেবে ধীরাপদর সঙ্গে খাতিরও আছে। মাসকাবারে মনি-অর্ডার ফর্ম লেখানো বা মাঝেসাজে খাম-পোস্টকার্ডে ঠিকানা লিখে দেওয়ার কাজটা তাকে দিয়েই হয়।
সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত। কিন্তু সোনাবউদির জন্য ওই কোণা-ঘর দুটো পছন্দ নয়। হঠাৎ ধীরাপদর পড়ানোর চাড় দেখে শুধু ছাত্রী নয়, ছাত্রীর বাবা পর্যন্ত হকচকিয়ে গিয়েছিলেন।
সকালে বই হাতে কুমু এসে হাজির হবার আগেই তার ডাকাডাকি শুরু হল। ভোরে ওঠা আর সকাল সকাল পড়তে বসার সুবর্ণ ফল প্রসঙ্গে মুখ বুজে মেয়েটাকে অনেক বক্তৃতা শুনতে হয়েছে। পড়ানোর সময় কল্পিত গোলযোগের কারণে ঘরের দরজা চারভাগের তিনভাগ বন্ধ। ছাত্রী পড়া না পারার ফলে ধীরাপদ হাসিটা বাইরে রমণী পণ্ডিতের চকিত কানে অনেকবার গলিত শিসার মত গিয়ে ঢুকেছে। স্বাস্থ্য- বিজ্ঞানের পাঠদান আর ঘরে বসে সুবিধে হয়নি তেমন। ওই মজা-পুকুরের ধারে একাদশী শিকদার আর শকুনি ভট্টচায়ের চোখের নাগালের মধ্যে ছাত্রীসহ বিচরণ করতে করতে সেই পাঠ সম্পন্ন হয়েছে। ক’দিনে অনেক শিখেছিল বিস্ময়-বিমূঢ় চতুর্দশী কুমু। কেমন করে আকাশে মেঘ হয়, মেঘ গর্জায় কেন, সকালের বাতাসে স্বাস্থ্যোপযোগী কি কি উপাদান আছে, কোনটা উপকারী কোনটা নয়, গাছপালা বেঁচে থাকে কি করে —এমন কি মজা-পুকুরের শেওলা দেখে শেওলা আসে কোথা থেকে, হাসিমুখে সে- সম্বন্ধেও নিজের মৌলিক গবেষণামূলক কিছু তথ্য শোনাতে কার্পণ্য করেনি ধীরাপদ।
সেই বেপরোয়া পড়ানো দেখে ছাত্রী হতভঙ্গ, ছাত্রীর বাবা তটস্থ, কদমতলার বেঞ্চির শুভার্থীরা নির্বাক। বেগতিক দেখলেও ভরসা করে মুখ খুলবেন রমণী পণ্ডিত, তেমন খোলামুখ নয় তাঁর। কিন্তু শেষে রাত্রিতেও অঙ্ক পাঠ নেবার জন্য পাশের ঘরে মেয়ের ডাক পড়তে তাঁর অঙ্কের হিসেবটা একেবারে বরবাদ হয়ে গেল। সেই রাতে অঙ্ক শেখা শেষ করে শ্রান্ত ছাত্রী ঘরে ফিরতে না ফিরতে ও-ঘরের রোষ চাপা থাকে নি। এ ঘর থেকেও তার কিছু আভাস পাওয়া গেছে। মারধরও করেছে বোধ হয়, মেয়েটা কান্না চাপতে পারেনি। সত্যিই নিজেকে একেবারে পাষণ্ড মনে হয়েছিল ধীরাপদর।
এর দু’দিনের মধ্যেই সপরিবারে রমণী পণ্ডিত কোণা-ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। দুড়দাড় পায়ের শব্দে ধীরাপদর চমক ভাঙল। গদার আট বছরের বড় মেয়েটা ঘরে ঢুকল।— ধীরুকা, মা ডাকছে। জলদি।
তলব জানিয়েই যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।
বাইরের রোদ চড়েছে। কদমতলার বেঞ্চি থেকে শিকদার আর ভটচার্য মশাইও কখন উঠে গেছেন।