কাল তুমি আলেয়া – ১৯

উনিশ

পরের দিন উৎসব।

আগের দিন সকাল থেকেই উৎসবের হাওয়া লেগেছে। কর্মচারীদের উদ্দীপনা প্রায় উত্তেজনার মতই। ধীরাপদর যতখানি মানসিক যোগ থাকার কথা আগামী দিনটার সঙ্গে ততটা নেই। বেলা তিনটে থেকে উশখুশ করছিল সে। পাঁচটা বাজলেই উঠবে। সোজা চারুদির বাড়ি যাবে। কদিনই যাবে যাবে করে গিয়ে উঠতে পারেনি। আজ পাঁচটা বাজলেই পালাবে। কিন্তু তার আগেই না বাড়ি থেকে বড় সাহেবের তলব আসে। কাল ভাষণ পাঠ করবেন তিনি। কাগজপত্র সব তাঁর টেবিলে গুছিয়ে রেখে এসেছে।

শরীর ভালো থাকলে ভালো করে একবার পড়ে দেখবেন হয়ত। পড়লে নতুন করে আবার টনক নড়তে পারে। তখন ডাক পড়তে পারে। আবার না-ও হতে পারে। ধীরাপদকে বড় বেশি বিশ্বাস করেন। দেখবেন না ভাবতেও অস্বস্তি, ধীরাপদ চায় দেখুন, পড়ন। পড়ে যা করার তিনি নিজে করুন। সে আর ডাকাডাকি কাটাকাটি বাদ- প্রতিবাদের মধ্যে মাথা গলাতে চায় না।

টেলিফোনে তলব একটা এলো। বড় সাহেবের ওখান থেকেও নয়, চারুদির বাড়ি থেকেও নয়। টেলিফোন রমণী পণ্ডিতের।

এক্ষুনি একবার সুলতান কুঠিতে আসতে হবে ধীরাপদকে। দিনেদুপুরে তার ঘরের তালা খুলে চোর ঢুকেছিল। চোর ধরা পড়েছে। একাদশী শিকদার দেখতে পেয়ে চেঁচামেচি করে উঠেছিলেন। চোরটা শুকলাল দারোয়ানের ঘরের পাশ দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। থানা অফিসার এখন ঘরের মালিকের এজাহার চান একটা, সব ঠিক আছে না কিছু খোয়া গেছে—তাঁকে জানিয়ে আসতে হবে।

কি ভেবে ধীরাপদ অমিতাভকে টেলিফোনে খবরটা দিল। সুলতান কুঠিতে তার ঘরে চোর ঢুকেছিল, ধরা পড়েছে, এখন পুলিসের টানা-হেঁচড়া— তাকে এক্ষুনি যেতে হচ্ছে। ধীরাপদর নিজের বিবেচনার ওপর আস্থা আছে। খবরটা জানিয়ে ভালো করেছিল। পরে নিজেই নিজের বুদ্ধির তারিফ করেছে।

চোর ঘরের তালা ভেঙেছিল বলে একটুও উতলা হয়নি সে। নেবার মত কি-ই বা ছিল! নেহাত বোকা চোর বলে তার ঘরে ঢুকেছে আর দুর্ভাগ্য বলে ধরা পড়েছে।

কদমতলার বেঞ্চিতে পাড়ার গুটিকয়েক মুখ চেনা ছেলে-ছোকরার সঙ্গে রমণী পণ্ডিত বসে। চুরি নিয়েই জটলা বোধ হয়। ওদিকে ঘরের সামনের বারান্দায় উমা দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে চট করে ঘরে ঢুকে গেল।

রমণী পণ্ডিতের উত্তেজনা কমেনি তখনো। তারই অপেক্ষায় ছিলেন হয়ত। তাড়াতাড়ি উঠে এসে চুরির বৃত্তান্ত ফেঁদে বসলেন। খুব রক্ষা হয়েছে। যোগাযোগ ছাড়া আর কি! নইলে একাদশী শিকদারের সেই মাসে একদিন সেজেগুজে বেরুবার দিনটা পড়বি তো পড় আজই গিয়ে পড়ল কেন? ফেরার মুখে ঘরে তালা না দেখে তিনি দরজা ঠেলেছিলেন। চোর তখন বাক্স ভেঙে কি নেওয়া যেতে পারে গোছগাছ করছে। শিকদার মশাই চোর চোর বলে আর্তনাদ করতে করতে ছুট। গণুবাবুও বাড়ি ছিলেন—তিনিও চেঁচামেচি করে চোরের পিছু ধাওয়া করেছেন। শুকলাল দারোয়ান চোরটাকে দু হাতে জাপটে ধরে ঘায়েল করেছে। গায়ে জোর আছে বটে লোকটার। ….ছিঁচকে চোর। মোটেই না। গাঁট্টা-গোট্টা অবাঙালী চোর, নিশ্চয় আগেভাগে সব জেনে তৈরি হয়ে এসেছিল, নইলে ঘরের তালা খুলল কি করে?

ঘরে এখন পেল্লায় তালা ঝুলছে একটা। উমা চাবি হাতে দাঁড়িয়ে। সোনাবউদির তালা, তিনিই চাবি দিয়ে মেয়েকে পাঠিয়েছেন বোঝা গেল।

কি রে, কেমন আছিস?

কিন্তু উমা তার আপ্যায়নে ভুলল না। চাবি দিয়ে মুখ গোঁজ করে চলে গেল। তার রাগের হেতু আছে। প্রত্যেক শনিবারে আসার কথা, ক’টা শনিবার গেল ঠিক নেই। চুরি কিছু যায়নি জানাই ছিল। তোরঙ্গটা ভাঙা, লণ্ডভণ্ড অবস্থা, এই যা। ঘর বন্ধ করে পাশের ঘরে ঢোকার ইচ্ছে ছিল ধীরাপদর। কিন্তু রমণী পণ্ডিত তাকে থানায় টেনে নিয়ে চললেন। থানা অফিসার অপেক্ষা করছেন।

আসলে চুরি-পর্বের ফিরিস্তি দেওয়া শেষ হয়নি তাঁর। মজা পুকুরের ধার দিয়ে যেতে যেতে বললেন, চুরি তো চুরি, এদিকে কি কাণ্ড জানেন? একেবারে অবাক কাণ্ড—

ধীরাপদ উদগ্রীব। এদিক বলতে সোনাবউদির দিক ছাড়া আর কোন দিক? কিন্তু না, অন্যদিকই বটে। একাদশী শিকদারের দিক।

শুনল। সত্যি হলে অবাক কাণ্ডই বটে। চোর ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে কত লোক জুটে গিয়েছিল ঠিক নেই। তারপর কি মার–কি মার। সেই মার দেখলে গা ঘুলোয়। নাক মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বার হচ্ছিল লোকটার। একেবারে আধমরা না করে কেউ ছাড়ত না বোধ হয়। মার বন্ধ হল একাদশী শিকদারের জন্য। তার দিকে চোখ পড়তে সকলে অবাক। দু হাত মাথার ওপর তুলে নাচছিলেন তিনি। সত্যি নাচছিলেন না, কাঁপছিলেন। আর সকলকে মারতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছিল না। রাগে ত্রাসে আতঙ্কে গোঁ-গোঁ শব্দ করছিলেন। আর শুন্যের মধ্যে হাত ছুঁড়ছিলেন। সে মূর্তি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না নাকি।

সে মূর্তি না দেখুক, যতটা ধীরাপদ দেখেছে তাতেও অবাক। থানায় এজাহার দিয়ে ধীরাপদ ফিরে এসে দেখে কদমতলার বেঞ্চ-এ একা বসে একাদশী শিকদার তামাক খাচ্ছেন। ওকে দেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন।

রমণী পণ্ডিত কাজের অছিলায় নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। এখন আর এঁদের মধ্যে বাহ্যিক অন্তরঙ্গতাটুকুও আছে বলে মনে হল না। ফেরার পথেও রমণী পণ্ডিতের কালো মুখখানা অনেকবার কৌতূহলে হকচকিয়ে উঠতে দেখা গেছে। ধীরাপদকে জিজ্ঞাসা করেছেন, একটা অবাঙালী চোরের জন্যে এত দরদ ভদ্রলোকের … কি ব্যাপার বলুন তো?

চোখের সামনে আসুরিক মারধর দেখাটা সহ্য হয় না অনেকের। কিন্তু শিকদার মশাইকে দেখে কেমন যেন লাগল। ভদ্রলোকের সমস্ত শিথিল স্নায়ুর ওপর দিয়ে বড় রকমের ঝড় গেছে একটা। এখনো তার জের চলছে। শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারছেন না, শুকনো হাড় বার করা মুখের মধ্যে চোখের দৃষ্টিটা এখনো অস্বাভাবিক।

থানায় গেছলে?

হ্যাঁ, আপনার জন্যেই কিছু খোয়া যায়নি শুনলাম।

কানে গেল না বোধহয়। জিজ্ঞাসা করলেন, লোকটাকে দেখলে? একেবারে গেছে না বেঁচে আছে?

ধীরাপদকে দেখতে হয়েছে। থানা অফিসার দেখিয়েছেন। যদিই চেনা মুখ হয়। কুৎসিত-দর্শন মূর্তি, নাম ছোট্টু নাকি—লোকটা গরাদের ওধারে মেঝেতে শুয়ে ধুঁকছিল। তার সামনেই থানা অফিসার আর একদফা জেরা করেছেন। ভাঙা বাংলা বলে। চাবি সারাইয়ের পেশা ছিল, ওতে পেট চলে না তাই এ রাস্তা ধরেছে।

….ওই লোকের জন্য ও-রকম দরদ খুব স্বাভাবিক নয় বটে। ধীরাপদ আশ্বস্ত করল, না, বেঁচেই আছে।

শিকদার মশাইয়ের ত্রাসের ঘোর কাটেনি। বিড়বিড় করে বললেন, কি মার মারলে ওরা লোকটাকে, দেখলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যেত। মারের চোটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মাটিতে গড়াগড়ি করেছে—তবু মারছে। লোকে মেরে যে কি সুখ পায় এত বুঝিনে। আনন্দে কাড়াকাড়ি করে মারা।

দু চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল শিকদার মশাইয়ের, পরক্ষণে সেই ঘোলাটে চোখেই ক্রোধের আভাস দেখা গেছে।—আমিই তো চেঁচামেচি করে চোর ধরিয়েছি, তা বলে মারের বেলায় এত বীভৎস আনন্দ তোদের? এভাবে যারা মারতে পারে তারা কি খুব সাধু পুরুষ? বলো তো বাবা? তোরাই এমন মার মারবি যদি থানা পুলিস আছে কি করতে?

ধীরাপদ অবাক হচ্ছিল আর ভাবছিল, মানুষের ভিতর চিনতে তার অনেক বাকি এখনো।

সেই অমানুষিক মার দেখে শিকদার মশাইয়ের ভিতরটা ভালো ভাবেই নাড়াচাড়া খেয়ে থাকবে। বললেন, আমি থামাতে চেষ্টা করেছিলাম বলে ওই ওঁরা আবার আমার ওপরেই মারমুখী—ওই ঘরের গণুবাবু আর রমণী পণ্ডিত। গণুবাবুর কথা ছেড়েই দিলুম, তিনি চাকরি-বাকরি করছেন—কিন্তু রমণী অত সাধুগিরি ফলায় কি করে? তার কি করে দিন চলে কে না জানে? ওই গণুবাবুকেও তো ভালোমানুষ পেয়ে ভাঁওতা দিয়ে রশ করেছিস তুই।

শিকদার মশাইয়ের এ ধরনের কথাবার্তাই বেশি চেনা। রমণী পণ্ডিতের কি করে দিন চলে ধীরাপদর অন্তত জানা নেই-জানার বাসনাও নেই। আর, গণুদাকেও নিশ্চয় তেমন ভালোমানুষ মনে করেন না শিকদার মশাই—শুধু ধীরাপদর খাতিরে ওটুকু সতর্কতা অবলম্বন

উমা আবার বাইরে এসে দাঁড়াতে ধীরাপদ তাড়াতাড়ি প্রস্থান করে বাঁচল। উমার হাত ধরে ঘরে ঢুকে গেল।

ওধারের ছোট ঢাকা বারান্দায় বসে সোনাবউদি কেট্‌লি থেকে চা ছাঁকছিল। এক নজর দেখে নিয়ে বলল, ওখানকার বাসিন্দেদের আদর-আপ্যায়ন শেষ হলে পাছে ধুলোপায়েই চলে যান সেই জন্যে মেয়েটাকে আবার পাঠালাম ডাকতে—

ধীরাপদর ইচ্ছা হল বলে, আজ রাতটার মতই এখানকার বাসিন্দা হয়ে থাকার বাসনা। বলা গেল না। সোনাবউদিকে অনেক সময় অনেক কথাই বলা যায় না। এদিকে উমারাণী মান-অভিমানের পালাটা তাড়াতাড়ি সেরে নেবার জন্য ব্যস্ত। মা এসে বসলে তাকে উঠতে হবে জানে। বড়দের কথার মাঝে ছোটদের বসে থাকা নিষেধ। উমা মুখ মুচকে বলল, এই তোমার প্রত্যেক শনি-রবিবারে আসা?

তার ভাই দুটোও দুদিক থেকে ছেঁকে ধরেছে। ধীরাপদ আগে তাদের আদর করল। তারপর গলা নীচু করে উমারাণীকে কৈফিয়ৎ দিতে বসল, কি ভয়ানক বিচ্ছিরি কাজের ঝামেলা চলেছে তার। সোনাবউদি চা আর খাবার দিয়ে গেল। খাবারের পরিমাণ প্রায় আপত্তি করার মতই। কিন্তু ভরসা করে আপত্তি করল না। সোনাবউদি দাঁড়াল একটু, তারপর ঢাকা বারান্দায় ফিরে গিয়ে ছেলেমেয়ের খাবার গোছাতে লাগল। হয়ত বা মেয়েটাকেই আর একটু গল্প করার অবকাশ দিল।

ধীরাপদ গল্প করছে। যেখানে থাকে সেটা বিচ্ছিরি জায়গা, আর লোকগুলোও দিনরাত কত খাটায় তাকে। গল্পের মাঝে ওদের মুখেও খাবার চালান করছে, নিজেও খাচ্ছে। নিজের দুঃখের ফিরিস্তি শেষ করে উমারাণীর পড়াশুনার খোঁজখবর নিতে লাগল। চোখ দুটো মাঝেমাঝেই ঢাকা বারান্দার দিকে ঘুরে আসছিল। সোনাবউদি ওদিক ফিরে হাতের কাজ সেরে রাখছে মনে হতে গলা খাটো করে উমাকে জিজ্ঞাসা করল, তোর বাবা কোথায় রে?

উমা ঘাড় বাঁকিয়ে চট করে তার মাকে একবার দেখে নিল, তারপর প্রায় কানে কানে বলল, মায়ের ওপর রাগ করে অফিসে চলে গেছে… ভট্টচার্য মশায়ের চোরের ওপর মায়া দেখে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বাবা আর পণ্ডিতমশায় খুব হাসাহাসি কচ্ছিল আর কি বলাবলি কচ্ছিল, তাই শুনে মা বাবাকে ঘরে ডেকে যাচ্ছেতাই বকল আর বাবাও রাগ করে চলে গেল।

ধীরাপদ তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করল। জিজ্ঞাসা করল, তুই মারধর কেমন খাচ্ছিস আজকাল?

জবাব দেওয়া হল না। সোনাবউদি ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়ের দিকে চেয়ে ভুরু কোঁচকালো একটু, নালিশ হচ্ছে বুঝি?

ধীরাপদ মাথা নাড়ল।—না, আপনি আদর কেমন করেন আজকাল জিজ্ঞাসা করছিলাম।

কাকে? সোনাবউদির দু চোখ তাকেই চড়াও করল।

ধীরাপদ থতমত খেয়ে হেসে ফেলল।

সোনাবউদির মুখে হাসির আভাস দেখা গেল কি গেল না। মেঝেতে বসল। মেয়েকে বলল, খেয়ে নিগে যা, ওদের নিয়ে যা-

এক কথা দুবার বলার দরকার হয় না। ছেলে দুটো পর্যন্ত দিদির সঙ্গ ধরে ঢাকা বারান্দার দিকে চলল। সোনাবউদি বলল, বাড়িতে চোর ঢোকাতে এই একটা মেয়েই খুশি হয়েছিল, ধীরুকা আসবে শুনেছে—

আর কোন অভিযোগ না, এতদিন না আসার দরুন কোনো ঠেসও না। তবু ধীরাপদ কৈফিয়ৎ নিয়ে প্রস্তুত মনে মনে।

সোনাবউদি ভালো করে চেয়ে দেখল এবারে।—তারপর, আছেন কেমন?

একটুও ভালো না। কাজের চাপে—

সেসব তো মেয়েকে একদফা বললেন শুনলাম। ভালো না কেন, এতদিনেও সুবিধে-টুবিধে হল না একটু?

ধীরাপদ হাসিমুখেই মাথা নাড়ল। হল না।

আপনার আর সুবিধে হবেও না কোনো কালে, ঠাণ্ডা মাটিতে গড়াগড়ি করেই কাটবে—আরো দু-চার দিন রাতদুপুরে চান-টান করেছেন নাকি?

ধীরাপদর আচমকা দম বন্ধ হবার দাখিল। এ পর্যায়ের আক্রমণ হবে জানলে চুরি ছেড়ে ডাকাতি হয়েছে জানলেও আসত না। ওকে কথার বড়শীতে আটকে সোনাবউদি এতক্ষণে মুখ টিপে হাসল। রাতদুপুরে চান করে মাটিতে গড়াগড়ি করাটাই শুধু দেখেছে, না সেই এক দুর্বহ রাতে আরো কিছু তার চোখে পড়েছে, মনে হলে আজও মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করে ধীরাপদর।

যাক, আর কি খবর বলুন? সোনাবউদি জিজ্ঞাসা করল।

খবর নেই। আপনি কেমন আছেন?

খুব ভালো।

কিন্তু ভালো মনে হচ্ছে না ধীরাপদর। হালকা কথাবার্তা সত্ত্বেও মুখখানা শুকনো লাগছে সোনাবউদির। শরীর বিশেষ করে মনের ওপর দিয়ে একটানা কোনো ধকল গেলে যেমন দেখতে হয়। এখন তেমন গম্ভীর না হোক, হাসিখুশিও না। এক-এক সময় যেমন দেখত তেমনটি নয়। সে-ও এবারে সোজাসুজি নিরীক্ষণের ফাঁকে মন্তব্য করল, খুব ভালো লাগছে না!

সোনাবউদি নিজের প্রসঙ্গ এড়াতে চায়। চকিত অসহিষ্ণুতার অভিব্যক্তি একটু। ঠাট্টার সুরেই বলল, খুব ভালো না লাগাই ভালো।

কিন্তু ধীরাপদ জানতেই চায়। এতদিন বাদে এলেও সে বাইরের লোকের মত আসেনি, বাইরের লোকের মত চলেও যাবে না। সমাচার বুঝতে হলে গণুদাকে টানা দরকার। একটু আগে উমার ফিসফিসিনিও কানে গেছে কি না কে জানে! সোনাবউদির কতদিকে কটা করে চোখ কান ধীরাপদ আজও হদিস পেল না। জিজ্ঞাসা করল, গণুদা কোথায়? তখন ছিলেন শুনলাম—

ছিলেন। আপনি আসছেন শুনে বেরিয়ে গেলেন। জবাবটার আরো একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন বোধ করল হয়ত। বলল, যাবার আগে আপনি সেই বলে গিয়েছিলেন, একটা শনি-রবিবারে এসে ধরবেন, সে কথা বলে আমিও শাসিয়ে রেখেছিলাম।…তাই।

জবাব এড়ানো গেল, চোখের বার হলে মনের বার—সেই ঠেসও দেওয়া হল। অবতরণিকার উদ্দেশ্যটাই ভুল হয়ে গেল ধীরাপদর। সেই পুরনো বিস্ময়। ঠোঁটের ডগায় এভাবে জবাব মজুত থাকে কি করে? আজও মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তা-ও নিরাপদ নয়। একটু আগে ভাইদের নিয়ে উমা বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ধীরাপদর ইচ্ছে হল তাকেই ডাকে। ডেকে সোনাবউদিকে বুঝিয়ে দেয়, সে হার মানল।

সোনাবউদির কাজের কথা মনে পড়ল যেন। বলল, এবারে আমাকে রেহাই দিন তো, আপনার ঘরে কি আছে নিয়ে-টিয়ে যান, আর ঘরটার কি ব্যবস্থা করুন-এর পর আবার কখন কি হয় ভয়ে বাঁচি নে।

মাথা নেড়ে ধীরাপদ সায় দিল। বলল, ভয়ে ভয়ে আপনাকে আধখানা দেখাচ্ছে—

মুখের চাপা শুকনো ভাবটা মিলোবার উপক্রম এতক্ষণে। হাসিটাও তাজা লাগছে। বলল, না, আমার ভালো লাগে না, যা হয় ব্যবস্থা করুন।

ব্যবস্থা ঠিকই আছে, রমণী পণ্ডিতকে ও-ঘরে এসে থাকতে বলব ভেবেছি, পাশাপাশি থাকলে গণুদার সুবিধে হবে।

সোনাবউদি হেসেই ফেলল, বলল, আপনার যেমন বুদ্ধি, এতখানি চোখের ওপর থাকতে হলে সুবিধের বদলে চোখে অন্ধকার দেখবে দুজনেই।

মাথা নেড়ে ধীরাপদ সেই অসুবিধাটাও স্বীকারই করে নিল।—তাহলে গণুদাকেই থাকতে বলি।…সপ্তাহে আজকাল ঠিক কদিন করে ঘর থেকে তাড়াচ্ছেন ভদ্রলোককে?

আশা, এমনি লঘু কথাবার্তার ভিতর দিয়েই যদি নিভৃতের সমাচার কিছু বোঝা যায়। তার বোঝার অধিকার আছে, দাবি আছে। প্রায় আগের মতই লাগছে সোনাবউদিকে, চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।— আপনার সাহস তো কম নয় দেখি!

হবে না…কত বড় চাকরি করি!

সোনাবউদি হাসতে লাগল। উন্নতি হয়েছে দেখছি। আপনি বড় চাকরি করেন তাতে আমার কী?

হাসছে ধীরাপদও। এই হাওয়াটা আরো খানিকক্ষণ জিইয়ে রাখতে পারলে হয়ত সরাসরি খোঁজ নিতে পারত, গণুদা এখনো মদ খায় কিনা, গাঁজা খায় কিনা, জুয়া খেলে কিনা, রেসএ যায় কিনা। ওর দাবির দিকটা উপলব্ধি করানো গেলে সোনাবউদি নির্দ্বিধায় বলত সব, বলে হালকা বোধ করত।

কিন্তু তা হল না, তার আগেই সোনাবউদির মুখের হাসি গেল। ঝুঁকে হঠাৎ দরজার দিকে তাকালো। দরজার ওধারে কেউ সসঙ্কোচে দাঁড়িয়ে। ধীরাপদও ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করল।…শাড়ির আভাস।

ঈষৎ তীক্ষ্ণকণ্ঠে সোনাবউদি ডাকল, কে ওখানে—এদিকে আয়!

রমণী পণ্ডিতের মেয়ে কুমু। দরজায় এসে দাঁড়াল।

ধীরাপদ অবাক। সেই কুমু…! পণ্ডিতের দিন চলে না, ভালোমত খেতে পায় না, কিন্তু মেয়ের চেহারায় তো দাক্ষিণ্যের ঘাটতি ঘটছে না কিছু। এরই মধ্যে বয়সই বা কত হল সেই কুমুর? শেষ কবে দেখেছিল? বাপের শাসনের তাড়নায় যেদিন ওর পায়ে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল— সেই দিন। অনেক দিনই বটে। তারপর থেকে কুমু উবে গিয়েছিল তার চোখের সামনে থেকে। আজ আবির্ভাব। এই আবির্ভাবে জোরালো ঘোষণা আছে কিছুর। একদিন বাবার কাছে নালিশ করে বোকার মত যে হেনস্থা করা হয়েছিল তার, এটা যেন তারই জবাব।

কিন্তু আপাতত কুমুর মুখখানা শুকনো। সেটা কার ভয়ে ধীরাপদ অনুমান করতে পারে। সোনাবউদির দৃষ্টিটা সদয় নয় খুব।—ওখানে চোরের মত দাঁড়িয়ে কেন? কি বলবি?

শুকনো ঠোটের ওপর জিব বুলিয়ে কুম্ আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল কোন প্রকারে।…ধীরুকা আজ থাকবেন কিনা বাবা জানতে পাঠালেন, তাদের ঘরে যদি একবারটি আসেন…বাবার কথা ছিল।

সোনাবউদির গলার স্বর একটুও নরম হল না, বরং আরো একটু কঠিন, ঝাঁজালো শোনালো।—বাবা জানতে পাঠালেন তো তোর এই ফাঁসির মুখ কেন? কি জানার আছে জেনে যা—

নিরুপায় দু চোখ মেলে কুমু ধীরাপদর দিকে তাকালো শুধু। ধীরাপদরও হঠাৎ কি জানি কি হল। বিরস গম্ভীর জবাব দিল, আজ সময় হবে না, তাড়া আছে। আর একদিন শুনব।

কুমুর প্রস্থান। নিজের মেজাজের পরিবর্তনটা সোনাবউদি নিজেও টের পাচ্ছিল বোধ হয়। অসহিষ্ণু হাসিটুকুও ক্ষোভের মত। কিন্তু সে মাত্র মুহূর্তের জন্য। চোখ দুটো ধীরাপদর মুখে এসে থেমেছে আবার।—মেয়েটাকে অনেক দিন পরে দেখলেন বুঝি?

অর্থাৎ, কুমুর আবির্ভাবে ধীরাপদর নীরব অভিব্যক্তিটুকুও চোখ এড়ায়নি। ঘাড় নাড়ল। তাই।

কেমন দেখলেন? আলতো প্রশ্ন।

ভালই তো…। হাসি ঠিক নয়, হাসার চেষ্টা

কিন্তু সোনাবউদি হাসছে না আর। গম্ভীর। মাথা নেড়ে সায় দিল আগে। তারপর বলল, মেয়েদের এ বয়েসটা ভালো লাগার বয়েস…ভালো লাগলে লোকে সেধে উপকার করতে এগোয়। আপনার দাদাও উপকার করছে, কোথায় কি বেতের ঝুড়ি আর বড় বড় কাগজের বাক্স বানিয়ে অভাবের সংসারে মেয়েটা মন্দ রোজগার করছে না শুনলাম। বাবা-মেয়ে সেজন্যে ভারী কৃতজ্ঞ আমাদের ওপর—

সটীক ভূমিকা শেষ হল। ধীরাপদর দৃষ্টিটা নিস্পৃহ, কান দুটো উৎকর্ণ।

তা এটুকুতে কি আর এমন উপকার, উপসংহারে এসে পৌঁছল সোনাবউদি, আপনি ইচ্ছে করলে এর থেকে অনেক বেশী উপকার করতে পারেন।…সেই আশাতেই হয়ত ভদ্রলোক নিজে না এসে মেয়েকে পাঠিয়েছেন। কি বলেন শুনেই আসুন না হয়।

পরিহাস-ছোঁয়া কথাগুলিতে কৌতুকের ছিটে-ফোঁটাও নেই। ধীরাপদ চুপচাপ বসে। শকুনি ভট্টচার্য যে রাতে মারা গেলেন সেই সন্ধ্যায় পণ্ডিতের এই মেয়ের সম্বন্ধে একটা স্থূল আভাস ব্যক্ত করে ফেলেছিলেন একাদশী শিকদার। রমণী পণ্ডিতের খেদও ভোলেনি ধীরাপদ। বলেছিলেন, বাপের বয়সী গণুবাবু মেয়েটাকে একটু-আধটু সাহায্যের চেষ্টা করছেন, এতেও ওদের গাত্রদাহের শেষ নেই। ওই দুই বৃদ্ধের সন্দেহের বাতিক জানা ছিল, ধীরাপদ নিজেই ভুক্তভোগী। তবু, শোনার পর থেকে অস্বস্তি বোধ করেছিল। নিজের অগোচরে সেটা থিতিয়ে ছিল টের পেল। সেখানেই নাড়াচাড়া পড়ল।…মনে যা উঁকিঝুঁকি দেয়, প্রথমেই সেটা বিশ্বাস্য নয় নিশ্চয়। রমণী পণ্ডিত অতটা নির্বোধ নন। আর গণুদাও অতটা বেপরোয়া নয়। নিজের স্ত্রীটিকে বিলক্ষণ ভয়ই করে সে।

তবু সোনাবউদির এই উক্তিতে বিশ্বাস্য কিছু একটা আছেই। সোনাবউদির কথা একাদশী শিকদারের কথা নয়।

ওই ভালো-লাগা-বয়সের মেয়েকে গণুদা মাথা উঁচিয়ে সাহায্যের চেষ্টায় এগোলে সোনাবউদি হয়ত একটা কথাও বলত না। কিন্তু ভবিতব্যের সোনার জাল বিছিয়ে লোকটাকে বশ করেছে রমণী পণ্ডিত, তাকে লোভাতুর কাপুরুষ বানিয়েছে— সোনাবউদির এখানেই ভয়, এখানেই যাতনা।

আপনার তাড়া আছে বলছিলেন, কোথায় যাবেন? উঠে ঘরের কোণ থেকে হ্যারিকেন নিয়ে মুছতে মুছতে সোনাবউদিই সচেতন করল তাকে। উমা আর ছেলে দুটো দোরগোড়ায় উকি দিচ্ছে। বাইরে দিনের আলোয় টান ধরেছে। ঘরের ভিতরটা আরো আবছা।

ধীরাপদ আর একবার চেষ্টা করে দেখবে ঘরের এই বাতাস ফেরানো যায় কিনা? খানিক আগে তো পেরেছিল, সোনাবউদির মুখে হাসি দেখেছিল। বলল, চারুদির ওখানে যাব একবার। চারুদির কিন্তু ভয়ানক ভালো লেগেছে আপনাকে, খুব প্রশংসা করেন।

চিমনি টেনে সোনাবউদি হ্যারিকেন জ্বালল। তারপর চিমনিটা ঠিকমত বসাতে বসাতে নিরুৎসুক জবাব দিল, প্রশংসা করলে আপনি খুশি হবেন ভেবেছেন বোধ হয়, নইলে প্রশংসার আছে কি!

না, আজ আর কিছু হবে না। ধীরাপদ উঠে পড়ল। দরজার দিকে চেয়ে উমাকে ডাকল, তোরা বাইরে কি করছিস, ভেতরে আয়। আজ আর ঘরের বাতাস ফিরবে না। ওরা ভিতরে এলোও না। ঘরে একটা ছেড়ে দশটা লণ্ঠন জ্বাললেও সেটা দিনের আলো হবে না। কিন্তু এভাবেও চলতে পারে না। ধীরাপদ আর একদিন আসবে। আর একদিন চেষ্টা করবে। খুব শীগগীরই আর একদিন।

চারুদির বাড়ির দিকেই চলেছে। কিন্তু সুলতান কুঠি থেকে মনটাকে ফেরানো সহজ হচ্ছিল না। ফেরানো দরকার। ওখানে যেতে হলে এখন কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি দরকার।

বড় সাহেব আর চারুদির কথামত ধীরাপদ অমিত ঘোষের মতি-গতি খানিকটা ফেরাতে চেষ্টা করেছিল। মাঝখানে ফিরেও ছিল অনেকটা। ভাগ্নের সেই পরিবর্তনের আভাস পেয়ে বড় সাহেব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু চারুদির খুশি হবার কথা নয়। পার্বতীরও নয়।

ধীরাপদ নিজেই কি খুশি হয়েছিল?

বিশ্লেষণের এই বাঁকা অনুভূতিটা তাড়াতাড়ি ঠেলে সরিয়ে দিল। চারুদির ওখানে যাচ্ছে সে, এর মধ্যে পার্বতীর কথাও ভাবতে রাজি নয়। ভাবলে অসস্তি। কিন্তু চারুদির ওখানেই বা যাচ্ছে কেন? কি শুনতে, কি বুঝতে? কদিন ধরে চারুদির সঙ্গে দেখা করার তাগিদের উদ্দেশ্যটাও এখন অস্পষ্ট হয়ে আসছে কেমন।

অমিতাভ ঘোষের এ কদিনের মেজাজের খবর জানলে চারুদি একটু খুশি হতেন হয়ত। পার্বতী? পার্বতীর কথা থাক।

‘শি ইজ মোস্ট চার্মিং হোয়েন শি ইজ্ অন ট্যু বোটস’– লাবণ্য সরকার প্রসঙ্গে অমিত ঘোষের কৌতুকোচ্ছল মন্তব্য একদিনের। তানিস সর্দারকে হাসপাতালে দেখে আসার পর যেদিন সুলতান কুঠিতে সে ধারাপদর ঘরে এসে বসেছিল, সেইদিন বলেছিল। অবচেতন মনের সঙ্গে যোগ থাকলে কথা হারায় না। অনেক দিন আগের উক্তিটা মনে পড়ে গেল।

—কিন্তু দু নৌকো না তিন নৌকো? বড় সাহেবকে গোটাগুটি বাদ দেবে? বিচার বিবেচনা করলে বাদ দেওয়াই উচিত। ছেলেকে আগলে রেখে প্রশ্রয়টা তিনি ভাগ্নেকেই দিতে চান, সে আভাস ধীরাপদ খুব ভালো করেই পেয়েছে। তবু জটিলতার অবসান হয় না কেন? মনের তলায় ঠিক কি পুষছেন বড় সাহেব?

চারুদির মুখখানা ভিজে ভিজে। একটু আগে জল দিয়ে এসেছেন বোধ হয়। সামনের দিকের কয়েক গোছা লালচে চুল এখনো কপালের সঙ্গে লেপটে আছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল না দিলে চারুদির মাথা গরম হয়ে যায়।… নিজেই বলেছিলেন। কিন্তু মুখ দেখে মনে হয়, মাথা গরম হবার মত সদ্য কিছু কারণ ঘটেছে। চারুদির লালচে মুখে বিরক্তি-ঘেঁষা গাম্ভীর্যের ছাপ পড়লে এখনো দেখায় বেশ। হাসি ভাঙলে অত ভালো দেখায় না।

খাটে পা ছড়িয়ে আধাআধি শুয়েছিলেন, উঠে বসলেন। আজ এ সময়ে ওকে আদৌ আশা করেননি। তবু অন্য দিনের মত খুশি বা অভিযোগের উচ্ছ্বাস নেই। ডাকলেন, এসো—

ঘরের কোণ থেকে ইজিচেয়ারটা খাটের মুখোমুখি টেনে নিয়ে ধীরাপদ বসল। —এ সময়ে শুয়ে যে?

বললেন, মাথাটা ধরে আছে সেই থেকে।

খাবারের তাগিদ এড়ানোর জন্যে হোক বা যে কারণেই হোক দোকান থেকে দুটো পান কিনে চিবুতে চিবুতে এসেছে ধীরাপদ। মুখের দিকে একটু চেয়ে থেকে চারুদি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের সেই কুঠি-বাড়ি থেকে আসছ বুঝি…সেখানে কি চুরি হয়েছে তোমার?

ধীরাপদ থমকালো।—চুরি হয়নি, চোর ধরা পড়েছে। তোমাকে কে বললে?

জবাব না দিয়ে চারুদি এবারে ঈষৎ বিস্ময় প্রকাশ করলেন, কাল তোমাদের সেই ব্যাপার অথচ তুমি এদিকে ঘোরাঘুরি করছ…পালিয়ে বেড়াচ্ছ নাকি?

পান গলায় আটকানোর দাখিল। দৃষ্টিটা ধাক্কা খেয়ে সজাগ হল। বিকেল পর্যন্ত তো সেখানেই ছিলাম, পালাবো কেন?

বিশদ বাক্যালাপের মেজাজ নয় আজ চারুদির, খানিক চুপ করে থেকে শুধু কথা জিইয়ে রাখার মত করে বললেন, কর্মচারীদের এবারে অনেক কিছু দিয়েছ আর ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু দিচ্ছ শুনলাম?

সহজতায় চিড় খেয়েছে, পান চিবুনো থেমেছে ধীরাপদর। চারুদি এত সব শুনলেন কোথায়? হিমাংশু মিত্র এসেছিলেন? সেদিন অমিতাভ ঘোষ বলেছিল, লাবণ্যর কড়াকড়িতে মামার অফিস বন্ধ হলেও একেবারে ঘরে বসে থাকেন না তিনি। আজও এসেছিলেন? ধীরাপদর ভিতরটা তিক্ত হয়ে উঠল, বলল, আমি দেবার কে? আমি শুধু লিখেছি—ইচ্ছে হলে দেবেন, ইচ্ছে না হলে ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। অপেক্ষা করল একটু, তারপর হাল্কা সুরে বলে বসল, তোমাকে এমন ভার-ভার দেখছি কেন —অনেক দেওয়া হয়ে গেল সেই চিন্তায়?

চারুদি চুপচাপ বসে। এ আলোচনায় আর তাঁর কোনো আগ্রহ আছে বলেও মনে হল না। একটু বাদে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের বড় সাহেবের শরীর কেমন এখন?

আবারও হেঁয়ালির মধ্যে পড়ে গেল ধীরাপদ। বড় সাহেব সশরীরে এখানে আসেনি তাহলে! এলে চারুদি শরীরের খোঁজ নিতেন না। কিছু বলার আগে তাঁর কথা থেকেই দুর্বোধ্যতার হদিস মিলল। বললেন, বাড়ি থেকে আজ বেরিয়েছেন শুনে কারখানায় অমিতকে টেলিফোন করেছিলাম—ও ছেলের কথা থেকে কি কিছু বোঝার উপায় আছে?

অনেকক্ষণের একটা যুদ্ধ নিঃশ্বাস মুক্তি পেয়ে বাঁচল। কিন্তু অফিস থেকে ওর পালিয়ে বেড়ানোর কথাটা কেন বললেন চারুদি বোঝা গেল না। অমিতাভই কিছু বলে থাকবে। বাড়ির চুরির খবরও।

প্রেসার তো চড়েই আছে সেই থেকে, চিকিৎসার কি হচ্ছে? ভালো ডাক্তার এনে দেখাচ্ছে না কেন?

চারুদির মুখখানা বিরস দেখাচ্ছে আরো। জলের দাগ গেছে, কিন্তু মাথা খুব ঠাণ্ডা মনে হয় না। আর সেটা এই অসুখের দুশ্চিন্তার দরুনই নয় বোধ হয়। ঠোঁটের ডগায় একটা রূঢ় জবাব এসে গিয়েছিল ধীরাপদর। পার্বতী বলেছিল, অমিতবাবুর মন না পেলে মায়ের কাছে আপনার কোনো দাম নেই। কথাটা ভোলবার নয়। বলতে যাচ্ছিল, এটাও আমার ডিউটির মধ্যে নাকি?

বলল না। তার বদলে নির্লিপ্ত মন্তব্য করল, প্রেসারের আর দোষ কি, বাড়িতে যে ব্যাপার চলেছে, ডাক্তার কি করবে!…

চারুদি সোজা হয়ে বসলেন আস্তে আস্তে। গাম্ভীর্যের সঙ্গে আগ্রহের এই সুচারু মিশেল ন বছরের ছোট ধারাপদর চোখেও প্রায় চিত্তাকর্ষক।—বাড়িতে কি ব্যাপার চলেছে?

একদিকে ছেলে আর একদিকে ভাগ্নে কোন দিক সামলাবেন ভদ্রলোক?

কি হয়েছে? অসহিষ্ণু তাড়া চারুদির।

কি হয়েছে রয়ে-সয়ে অতঃপর তাই ব্যক্ত করল ধীরাপদ। চারুদিকে জেরা করার অবকাশ দিয়ে দিয়ে কর্তার সঙ্গে ছেলে আর ভাগ্নের কদিনের বোঝাপড়ার চিত্রটা সবিস্তারেই সম্পূর্ণ করল সে। ছেলের প্রসঙ্গেই বেশি বলল। রাতদুপুরে তার অমিতাভর ঘরে মীমাংসা করতে আসা বা ওর ঘরে সুপারিশের আশায় আসাটাও অনুক্ত থাকল না।

হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটল যেন চারুদির। সরোষে বলে উঠলেন, এতটা বিগড়েছে দেখেও ওদিকে বসে আছে কোন ভরসায়? বিয়েটা দিয়ে দিলেই তো হয়—ছেলে তো খোকা নয় যে কথামত উঠবে বসবে?

লালচে মুখে লালের কারুকার্য দেখছে ধাঁরাপদ। দেখা শেষ করে নিরুৎসুক মন্তব্য করল, খোকা ভাগ্নেও নয়।…তাঁর বিশ্বাস বিয়েটা দিলে গণ্ডগোল বাড়বে আরো।

কিসের গণ্ডগোল? বেখাপ্পা রাগ চারুদির, বিয়ের পরেও ভাইয়ের বউকে ধরে টানাটানি করবে ভেবেছে?

ধীরাপদ হাসেনি। তেমনি সাদা মুখ করেই বলল, তার থেকেও খারাপ কিছু হতে পারে। তাছাড়া, এমনিতেও ছেলের বিয়ে এখানে দেবার ইচ্ছে তাঁর নেই। আর ছেলের জন্যে উনি তেমন উতলাও নন বোধ হয়, তাঁর ভাবনা ভাগ্নেকে নিয়ে। আর তোমাকে নিয়ে।

রাগের মুখেই চারুদি থতমত খেয়ে উঠলেন একদফা। জোড়া ভুরু কুঁচকে গেল। সপ্রশ্ন প্রতীক্ষা।

সেদিন বলছিলেন, তোমার দিদি একটু বুঝে চললে কবে সব গণ্ডগোল মিটে যেত। তুমিই নাকি উল্টো রাস্তায় চলেছ!

চারুদির দৃষ্টিটা একটু একটু করে স্থির হয়ে বসছে ধীরাপদর মুখের ওপর। —কবে বলেছেন? 

এই তো সেদিন—ধীরাপদর নিরীহ বিস্ময়, কিন্তু কি ব্যাপার বলো তো—তুমি কি করতে পারো?

খানিক গুম হয়ে থেকে অস্ফুট ঝাঁজালো জবাব দিলেন, ওই মেমডাক্তারের সঙ্গে ভাগ্নের বিয়ে দিয়ে তাঁকে ষোল আনা নিশ্চিন্ত করতে পারি, আর কি পারি! দিলেই তো পারে বিয়ে, কে আটকে রেখেছে?

আটকে কে রেখেছে সেটা এত স্পষ্ট করে ধীরাপদ আর কখনো বোঝেনি। আজ এই চারুদিকে দেখে লাবণ্য সরকারের নৌকো থেকে হিমাংশু মিত্রকে নিঃসংশয়েই বাদ দেওয়া যেতে পারে।

সমস্ত ক্ষোভের একেবারে গোড়ায় নাড়া পড়েছে যেন চারুদির। এর পরেও চট করে থামেননি তিনি। ধীরাপদই দেয়নি থামতে। তার একটুখানি সংশয় বা একটুখানি বিস্ময় অথবা এক-আধটা অসংলগ্ন প্রশ্ন সেই ক্ষোভের মুখে অনুপানের কাজ করেছে।

ধীরাপদর চোখের সমুখ থেকে সব অস্পষ্টতা ঘুচে গেছে। যেটুকু জানতে বাকি ছিল জানা হয়েছে, যেটুকু বুঝতে বাকি ছিল বুঝে নিয়েছে।

যে কারণে চারুদির এত বিদ্বেষ লাবণ্য সরকারের প্রতি, ঠিক সেই কারণেই হিমাংশু মিত্রের এত সুনজর তার ওপর। যে কারণে চারুদি তাকে চান না, ঠিক সেই কারণেই হিমাংশু মিত্র চান তাকে। যে কারণে চারুদি অমিতাভ ঘোষের সমুখ থেকে লাবণ্য সরকারকে মুছে দিতে চান, ঠিক সেই কারণেই ওই মেয়ের কাছ থেকে নিজের ছেলেকে সরিয়ে রাখার সঙ্কল্প হিমাংশু মিত্রের। যে উদ্দেশ্যে চারুদি পার্বতীকে এগিয়ে দিয়েছেন, সেই একই উদ্দেশ্যে বড় সাহেব লাবণ্য সরকারকে এগিয়ে দিতে চান। ছেলে আছে বড় সাহেবের, আর তার সঙ্গে নাড়ির যোগও আছেই। প্রাকৃতিক বিধানে সেই যোগ বুকজোড়াও বটে। কিন্তু এই ভাগ্নেও কম নয় তাঁর কাছে। সে চোখের মণি। এত আস্থা, এত প্রত্যয় বড় সাহেবের আর বোধ হয় কারো ওপরে নয়। ছেলের ওপরে তো নয়ই। কারো কথায় নয়, ধীরাপদ নিজেই সেটুকু অনেকদিন অনুভব করেছে।

এই ভাগ্নেটিকে হারাতে চান না বড় সাহেব। কিন্তু হারাবার লক্ষণ দেখছেন। লাবণ্য সরকার তাঁর হাতের মুঠোয়। সেই মেয়ে যার ওপর দখল নেবে, সে কত আর দূরে সরবে? বুদ্ধিমতী জোরালো মেয়ে লাবণ্য সরকার। ওই অসহিষ্ণু, অস্থির- চিত্ত ভাগ্নের সঙ্গে জুড়ে দেবার মতই বুদ্ধিমতী আর জোরালো ভাবেন তিনি। সেটা সম্ভব হলে বিচ্ছেদের আশঙ্কা ঘোচে তাঁর, ব্যবসায়ের শ্রীবৃদ্ধি সুনির্বিষণ হবে মনে করেন।

পার্বতী টোপ। লাবণ্য সরকার শেকল। চারুদির এই খর-মূর্তির সন্নিধানে বসেও হাসি পাচ্ছে ধীরাপদর। অমিতাভ ঘোষ টোপ গিলবে, না শেকল পরবে?

একটানা বকেছেন চারুদি। এখন একটানা চুপ। ধীরাপদ উঠবে কিনা ভাবছিল, চমক ভাঙার মতই তপ্তস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন চারুদি, তুমি এই মেয়েটার একটা কিছু ব্যবস্থা করতে পারো? কত জায়গায় তো ঘোরো-টোরো—

এই মেয়েটার অর্থাৎ পার্বতীর। ধীরাপদ বুঝেছে। বুঝেও বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে। এতক্ষণের মধ্যে এই একজনকে নিভৃত মন থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরাতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। আসার সময়ে দেখেনি তাকে। না দেখে স্বস্তি বোধ করছে। আর এ পর্যন্তও সাক্ষাৎ মেলেনি। কিন্তু এই বাড়িতে পার্বতীর অগোচর অবস্থানও ভোলবার নয়। কোনো একটা ঘরে আছে। চুপচাপ বসে আছে, নয়তো নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে কাজ করছে কিছু। কিন্তু তার দৃষ্টিদর্পণ থেকে নিজেকে ধীরাপদর খুব বেশি দূরে মনে হয়নি।

পার্বতীর কথা বলছ?

আর কার? আর কার কাছে এত অপরাধ করেছি? আসল বক্তব্যটাই ভুলে গেলেন যেন চারুদি, ঈষৎ আগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকলেন একটু। গলার স্বর নামিয়ে বললেন, আচ্ছা, তুমি তো এতদিন দেখছ, তোমার কখনো পথের মেয়ে বলে মনে হয়েছে ওকে? কোনদিন মনে হয়েছে?

ধীরাপদ ফাঁপড়ে পড়ে গেল। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালো একবার। চারুদি জবাবের আশায় উদগ্রীব, যেন এই জবাবের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

মাথা নাড়ল, না। তা মনে হতে যাবে কেন?

এটুকুতেই উৎসাহ বোধ করলেন চারুদি, কেন হবে বলো তো? এইটুকু থেকে আমার কাছে আছে, ওর গায়ে এখনো সেই দাগ লেগে আছে, না ও এখন যা তাই? ক্ষোভের মুখে ঢালা প্রশংসা শুরু করে দিলেন পার্বতীর, লেখাপড়াই শেখেনি খুব একটা, নইলে অমন স্বাস্থ্য, অমন স্বভাব, অমন বুদ্ধিমতী কাজের মেয়ে ক’টা দেখেছ? হাঁ করলে কি চাও বুঝে নেয়। ও একাই কতটা তোমার ধারণা নেই। অমিতের ভরসায় বসে থাকলে এই বড় বাড়িটাও শেষ পর্যন্ত উঠত কিনা সন্দেহ—ও কোমর বেঁধে দাঁড়াতে তবে উঠল।

ধারণা না থাকুক, ধীরাপদ ধারণা করে নিতে পারে। আর চারুদির থেকেও বেশি ছাড়া কম পারে না হয়ত। চুপচাপ খানিক অপেক্ষা করে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কি হয়েছে, পার্বতীর কি ব্যবস্থা চাও?

ব্যবস্থার প্রসঙ্গটা রোষের অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছু নয় বোঝা গেল। বিরক্তির আঁচ লাগল আবার, বললেন, কি ব্যবস্থা জানলে তো আমি নিজেই করতাম, তোমাকে বলতে যাব কেন? উষ্মার ঝাপটা এবারে আবার পার্বতীর ওপরেই এসে পড়ল।— নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে না ওর? নিজের ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে না? আমার ওপর ভরসা কতটুকু? আমাকে বিশ্বাস কী?

ধীরাপদর মুখে কথা নেই। চুপচাপ বসে দেখছে। এই কি সেই পদ্মাপারের আগুনপানা মেয়ে চারুদি? এই অসহায় চারুদি যে কাঁদতে পেলে বাঁচে।

কি যে বলছেন নিজেরই হুঁশ নেই বোধ হয়, কার ওপর রাগ ঠাওর করা শক্ত। পরক্ষণে এই তপ্তমুখেই উল্টো কথা। বললেন, ওরই বা দোষ কি, কি নিয়ে থাকে—। সেই কবে নার্সিং-ফার্সিং পাস করা হয়ে যেত এতদিনে, কদিন আমার সঙ্গে ঝকাঝাকি করে শখ করে তো ঢুকেছিল গিয়ে—ছেলে তাকে ছাড়িয়ে-ছুড়িয়ে এনে তবে নিশ্চিন্ত। লেখাপড়া শেখাবে, পরীক্ষায় পাস করাবে— একেবারে ডাক্তার বানিয়ে তবে ছাড়বে। সব করেছে!

বড় করে দম ফেললেন একটা। কিন্তু দাহ নিঃশেষ হল না তাতেও। ক্ষুব্ধ মন্তব্যের মত শোনালো শেষটুকু। যমের মুখ থেকে টেনেহিঁচড়ে ফিরিয়ে এনেছিল, চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। একটু কৃতজ্ঞতাবোধ যদি থাকত!

উপসংহারটুকু অমিতাভ ঘোষের সেই বিগত অসুখ প্রসঙ্গে। সবটা জুড়লে চারুদির মর্মদাহের একটা চিত্র এবারে দাঁড় করানো যায় বোধ হয়

সে অবকাশ পেল না।

চারুদির রুক্ষ দৃষ্টি অনুসরণ করে চকিতে দরজার দিকে ঘাড় ফেরাল ধীরাপদ। পার্বতী। তার হাতে খল-নুড়ি। খলে কিছু একটা ঘষতে ঘষতে মন্থর পায়ে ঘরে ঢুকল।

নিষ্পলক কয়েকটা মুহূর্ত, চারুদি যেন জ্যান্ত ভস্ম করলেন তাকে। তারপর রাগে ফেটে পড়লেন একেবারে। —কি ওটা? কে তোকে আনতে বলেছে? রোজ আমি এ সময়ে স্বর্ণসিন্দুর খাই যে বলা নেই কওয়া নেই আমার জন্যে স্বর্ণসিন্দুর মেড়ে নিয়ে এলি? আমার মাথা গরম হয়েছে মামাবাবুকে তাই বোঝাতে চাস— কেমন?

পার্বতী খাটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে খলের ওপর নুড়িটা ঘষছে—ঘষাটুকু শেষ হলে হাতে দেবে।

চারুদির দিকে চেয়ে প্রমাদ গুনছে ধীরাপদ। উঠে দু ঘা বসিয়ে দেওয়াও বিচিত্র নয় বুঝি। কিন্তু হঠাৎ সুর বদলালো একটু চারুদির, যে প্রস্তাব করলেন শুনে ধীরাপদও বিমূঢ়।

এত মেজাজের কি হয়েছে তোদের? সারাক্ষণ এত মেজাজে ফুটছিস কেন? কি দোষ করা হয়েছে তোর কাছে মামাবাবুকে বল্—যা তোর মনে আছে সব বল —ও কারো দিকে টেনে বলার লোক নয়, শুনে বলুক কি অপরাধ করেছি আমি? মুখ বুজে আছিস কেন, বল্‌?

মুখ বুজে থাকল না পার্বতী। খলের ওপর নুড়িটা থামল। ধীরাপদর দিকে তাকালো। বলল, আপনাকে চা দেব?

ধীরাপদ ব্যতিব্যস্ত, না না, এই একটু আগে চা খেয়েছি—

খলের ওপর নুড়ি নড়ল। চারুদি অগ্নিমূর্তি আবারও।— ওটা এখানে রাখবি তো আছড়ে ভাঙব আমি বলে দিলাম। যা, দূর হ এখান থেকে!

ঘষা শেষ হয়েছে। মুখ তুলে পার্বতী শিথিল দৃষ্টিটা চারুদির মুখের উপর একবার বুলিয়ে নিল। পাশের ছোট টেবিল থেকে একটা চকচকে বিলিতি সাপ্তাহিক তুলে তাঁর সামনে বিছানায় রাখল। তার ওপর খলনুড়িটা। ঘরের কোণের কুঁজো থেকে আধ গ্লাস জল গড়িয়ে সেখানে রেখে যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।

ধীরাপদ চিত্রার্পিতের মত বসে।

চারুদির ক্রুদ্ধ দৃষ্টিটা দরজা পর্যন্ত অনুসরণ করল, তারপর ওর দিকে ফিরল। অস্ফুটকণ্ঠে বললেন, দেখলে আস্পর্ধাটা?

ধীরাপদ দেখেছে। আর কিছু বুঝেওছে। স্বর্ণসিন্দুর দিয়ে চারুদির মাথা গরম হয়েছে তাই শুধু বলে গেল না, ওকেও নিষেধ করে গেল কিছু—সচেতন করে দিয়ে গেল। বসে বসে কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার শোনার কৌতূহলের ওপর একটা নীরব ভ্রুকুটি ছড়িয়ে গেল।

চারুদির লালচে মুখ কাঁদ-কাঁদ দেখাচ্ছে এখন। ভগ্ন বিকৃতকণ্ঠে বলে উঠলেন, ভালো কারো করতে নেই, বুঝলে? ভালো করার এই ফল- সেই দশ বছর বয়েস থেকে মেয়ের মত এত বড় করেছি আর আজ আমিই ওর শত্রু— আমাকে ও শত্রু ভাবে, মা ভাবে না।

চারুদির ওপর ধীরাপদর মনটাও অনেকদিন ধরেই প্রসন্ন ছিল না। কিন্তু এই অসহায় স্নায়ু-তপ্ত-মূর্তির দিকে তাকিয়ে আঘাত দিতে মায়া হয়। তবু চুপ করে থাকা গেল না একেবারে। বলল, ও হয়ত মা-ই ভাবে, তুমি ওকে মেয়ে ভাবো কিনা সেখানেই হয়ত সন্দেহ ওর।

বিষম থতমত খেয়ে থমকে চেয়ে রইলেন চারুদি। সন্ধিগ্ধ দুই চক্ষু ধীরাপদর মুখের ওপর আটকে থাকল খানিকক্ষণ।—তোমাকে ও বলেছে কিছু?

পার্বতীকে এ প্রসঙ্গ থেকে তফাতে রাখতেই চেষ্টা করল ধীরাপদ। আরো শান্তমুখে জবাব দিল, ও কতটা কি বলার মত মেয়ে তুমি ভালই জানো। শুধু ওকে দেখছি না, তোমাকেও তো এই ক-বছর দেখছি, খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেই দেখ না এ রকম হচ্ছে কেন, তোমার যত কিছু ভাবনা-চিন্তা ইচ্ছা-অনিচ্ছা সব কাকে নিয়ে, কার জন্যে? এতকাল ধরে আছে তোমার কাছে, তোমার এত টাকা-পয়সা বাড়ি-গাড়ি-এর মধ্যে বড় রকমের কোথাও ঘা না খেলে ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে কেন?

চারুদির মুখখানা আর লালচে দেখাচ্ছে না একটুও। ফ্যাকাশে পাংশু দেখাচ্ছে। চেয়ে আছেন তার দিকেই, কিন্তু ও চোখে আর তাপ নেই একটুও। একটু আগের ওই উষ্ণ মূর্তি থেকে জীবনের নির্যাসটুকু যেন ছেঁকে নেওয়া হয়েছে।

কতক্ষণ কেটেছে ধীরাপদরও খেয়াল নেই। চারুদি সচকিত হলেন হঠাৎ। ভুরুর মাঝে কুঞ্চনরেখা পড়ল দু-একটা। কি ভেবে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের বড় সাহেব সেই কানপুরের মিটিংয়ে কবে যাচ্ছেন?

প্রশ্নের তাৎপর্য বোঝা গেল না।— চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই যাওয়ার কথা।

এই শরীরে যেতে পারবেন?

ধীরাপদ হাসতে চেষ্টা করল। বলল, না পারলে শরীর আরো বেশি খারাপ হবে।

চারুদি আবার নীরব কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর বললেন, আচ্ছা আজ এসো তুমি, ক্লান্ত লাগছে—

এ রকম কথাও ধীরাপদ এই প্রথম শুনল। যখনই এসেছে, চারুদি ধরে রাখতেই চেয়েছেন!

কিন্তু সে-ও ওঠার তাগিদ উপলব্ধি করছিল। বাইরের ঘরের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালো একবার। আসার সময় পার্বতীকে না দেখে স্বস্তি বোধ করেছিল। কিন্তু ফেরার সময় উৎসুক দৃষ্টিটা তাকেই খুঁজছিল। দেখা হলে ধীরাপদ কি বলত, জানে না। কিছু বলত কিনা তাও না—তবু মন চাইছিল দেখা হোক। বাইরের ঘরে এসে আর একবার দাঁড়াল। এখানেও নেই। থাকবে না জানা কথাই। কোনো একটা ঘরে আছে। চুপচাপ বসে আছে, নয়তো নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে কাজ করছে কিছু। কিন্তু এবারে তার দৃষ্টি-দর্পণ থেকে নিজেকে অনেকটাই দূর মনে হচ্ছে ধীরাপদর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *