কাল তুমি আলেয়া – ১৮

আঠারো

দু-পাঁচজনের কথা যখন দু-পাঁচশ’র কানে ছড়ায়, কথা তখন রটনার পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। প্রিয় হোক, অপ্রিয় হোক জনতা রটনার উত্তেজনা ভালবাসে।

ফ্যাক্টরীর ছোট পরিসরে এমনি এক ভিত্তিহীন চাপা ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অমিতাভ ঘোষকে কিছু বলা আর ঢাকের কাঠি উসকে দেওয়া সমান কথা। কিন্তু এমন অদ্ভুত রটনার জন্যে তাকেও ঠিক দায়ী করা চলে না। প্রতিষ্ঠান সংগঠনের আদর্শ চিত্রটা ধীরাপদ ভার সামনে তুলে ধরেছিল। বড় সাহেবের ভাষণে সেই প্রস্তুতির প্ৰতিশ্ৰুতি যে থাকবে সে আভাসও দিয়েছিল। এদিকে সদ্য-বর্তমানের প্রাপ্তিযোগটা কোথায় এসে ঠেকল না জানা পর্যন্ত স্বস্তি নেই কারো। এ ব্যাপারে তোড়জোড়টা চাপা বলে সকলের আশাও বেশি আশঙ্কাও বেশি। কাজের লোকদের চীফ কেমিস্ট মাঝে-মধ্যে প্রশ্রয়ও কম দেয় না। ফাঁক বুঝে একদিন এমনি জনাকয়েক কর্মচারী ভাকে ধরে পাওনাটা বুঝে নিতে চেষ্টা করেছিল।

ধীরাপদও উপস্থিত ছিল সেখানে। ঠাট্টা করে অমিতাভ তাকেই দেখিয়ে দিয়েছে। —ওঁর কাছে যাও। গোটা কোম্পানীটাই উনি তোমাদের দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছেন। ধীরাপদর উদারতায় তাদের কোনো সংশয় নেই। কিন্তু সে আর যাই হোক মালিক নয়। সেই কারণে চীফ কেমিস্টের আশ্বাসের মূল্য বেশি। তার মুখ থেকেই শুনতে চায় তারা।

অমিতাভ ঘোষ শুনিয়েছে। বলেছে, পাওনার লিস্ট-এ তো অনেক কিছুই আছে, কোন পর্যন্ত টেকে এখন দেখো।

ধীরাপদর ধারণা, এই সংশয়ের সুতো ধরেই তারা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা গবেষণা করেছে। তারপর বৃহত্তর জটলার মুখে পড়ে তার রূপ আর আকার দুই বদলেছে। যথা, ভবিষ্যতে ভাগ্যের সিকে ছেঁড়ার মতই মস্ত কিছু প্ল্যান করা হয়েছিল তাদের জন্য, কিন্তু কারো প্রতিকূলতায় এখন সেটার কাটছাঁট চলেছে। সেরকম প্রতিকূলতা করতে এক লাবণ্য সরকার ছাড়া আর কে? তার চলন কবে আর সোজা দেখেছে তারা? তাদের সিদ্ধান্ত, ছোট সাহেবের সঙ্গে যোগসাজসে সে-ই বড় সাহেবকে বুঝিয়ে তাদের পাওনার অনেকটাই বরবাদ করে দিয়েছে বা দিচ্ছে!

উৎসবের আর দিন তিনেক বাকি। ফ্যাক্টরীর আঙিনায় সোৎসাহে একদল কর্মচারী মঞ্চ বাঁধছে, প্যাণ্ডেল সাজাচ্ছে। সভায় বক্তৃতা অনুষ্ঠানের পর গানবাজনা আর যাত্রা হবে। বেলা তিনটে থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রোগ্রাম। তত্ত্বাবধান করার জন্য ধীরাপদ নেমে এসেছিল একবার। ফেরার মুখে সিঁড়ির কাছে ইউনিয়নের পাণ্ডাগোছের আট- দশজন কর্মচারী ঘিরে ধরল তাকে। তারা জানতে চায় যা শুনছে সেটা সত্যি কিনা। অর্থাৎ মেম-ডাক্তার ঠিক ওইভাবেই শত্রুতা করছে কিনা।

দলের মধ্যে তানিস সর্দারও ছিল, কিন্তু সে সামনে এগোয়নি, চুপচাপ পিছনে দাঁড়িয়েছিল। ধীরাপদ প্রায় ধমকেই বিদায় করেছে সকলকে। বলেছে, এক বর্ণও সত্যি নয়, বড় সাহেব অসুস্থ, তাই কিছুই এখনো ঠিক হয়নি। আর এ রকম বাজে জটলায় মাথা গলালে তাদেরই ক্ষতির সম্ভাবনা।

তবু সকলে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে মনে হয়নি। এ ধরনের বৃহৎ ব্যাপারে কাউকে অবিশ্বাস করতে না পেলে তেমন জমেও না হয়ত। ওপরে উঠতে উঠতে ধীরাপদর হাসি পাচ্ছিল। মহিলার প্রতিদ্বন্দ্বিনীর রূপটাই সর্বত্র প্রধান যেন। গুজবটা তার কানেও গেছে কিনা জানে না। সেদিনের পরে কোন কাজের কথা নিয়েও লাবণ্য সরকার তার সামনে আসেনি।

কি ভেবে ধীরাপদ সেই দিনই প্রতিশ্রুতির খসড়াটা বড় সাহেবের কাছে পেশ করবে স্থির করল। এখানকার এই প্রত্যাশার উত্তেজনা দেখে হোক বা আর যে কারণেই হোক—একটা নিষ্পত্তির তাগিদ সেও অনুভব করছে। হিমাংশু মিত্রের মানসিক সমাচার সম্প্রতি কুশল নয় খুব। ব্লাডপ্রেসার কমেনি, ছেলের ব্যাপারেও ভাবেন হয়ত। তবু ধীরাপদর দিক থেকে সময়টা অনুকূল। বড় সাহেবের বড় কাজটা মনের মত হয়েছে। অল ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের উদ্বোধনী ভাষণে লক্ষ্যের নিশানা জোরালো ভাবেই উচিয়ে উঠবে মনে হয়। কাজটা যথার্থই খুব সহজ ছিল না—বিশেষ করে ভাষাও যেখানে বাংলা নয়, ইংরেজি। বড় সাহেবের ঠাট্টা থেকেও তাঁর খুশির পরিমাণ অনুমান করা গেছে। বলেছেন, এসব নীরস কাজে না এসে নাটক-নভেল লিখলে ভালো জমাতে পারতে—

নাটক না লিখুক, নাটক একটা ধীরাপদ ফেঁদে বসেছে। এখানকার উৎসবের বাংলা ভাষণ পড়ে বড় সাহেব কি বলবেন?…সেখানে উদ্দেশ্যের চারধারে অনাবিল একটা স্বপ্নের মায়া ছড়িয়েছে ধীরাপদ। আদর্শ বাণিজ্যস্বপ্ন।

পাঁচটা অনেকক্ষণ বেজে গেছে। টেলিফোনে অমিতাভর একটা খবর নেবে কিনা ভাবছিল। বড় সাহেবের সামনে আজ তাকেও উপস্থিত থাকার জন্যে অনুরোধ করেছিল। হাতের কাজ সেরে সে আসবে জানিয়েছিল। দরকারী ফাইল দুটো হাতের কাছে গুছিয়ে নিয়ে ধীরাপদ চুপচাপ অপেক্ষা করছিল। তার মধ্যে একটা ফাইলের কলেবর নেহাত কম নয়।

সিগারেট হাতে হড়বড় করে ঘরে ঢুকল অমিতাভ ঘোষ। চেয়ারের একটা হাতলে পিঠ ঠেকিয়ে আর এক হাতলের ওধার দিয়ে দু পা ঝুলিয়ে দিয়ে চোখ পাকিয়ে ধীরাপদরই বিষম কোনো অপরাধের কৈফিয়ৎ তলব করল যেন।—হ্যাঁ মশাই, মহিলাটিকে পাশের ঘরে পেয়ে দিব্বি অত্যাচার চালিয়েছেন বুঝি, অ্যাঁ?

ভাষাশৈলীর ধাক্কায় ধীরাপদর হেসে ফেলার কথা। কিন্তু সেরকম হাসা গেল না। বলল, কি করলাম…?

কি করলেন তাই তো জিজ্ঞাসা করছি। হঠাৎ এমন মারাত্মক গম্ভীর কেন? দেখা নেই, কথা নেই, টেলিফানেও হাঁ-না ছাড়া জবাব নেই—আজ লাঞ্চের সময় আসতে বলে বিনয়ের খোঁচায় হাঁ আমি। বলল, হুকুম হলে আসতেই হবে, যে কাজে লাগাব সেই কাজেই লাগতে হবে—তবে ফুরসৎ কম, না এলে চলে কি না।..কি ব্যাপার?

ব্যাপার একমাত্র ধীরাপদই জানে। কিন্তু সে জানাটা ব্যক্ত না করে ছোটখাটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা। ফিরে হালকা অভিযোগ করল, আপনার ওপরেই রাগ হয়ত, আপনার জন্যেই লোকে যা-তা বলে বেড়াচ্ছে।

যথার্থই অবাক অমিতাভ, লোকে কি যা-তা বলে বেড়াচ্ছে? প্রাপ্তির ব্যাপারে এখানকার সন্দেহের গুজবটা শুনে হেসে উঠল হা-হা করে। সিগারেটে একসঙ্গে ক’টা টান দিয়ে অ্যাশপটে গুঁজে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

দাঁড়ান, ডাকি—

বসুন—তিনি নেই। খানিক আগে সিতাংশুবাবুর সঙ্গে বেরুলেন দেখলাম। অমিতাভ চেয়ার নিল আবার। প্রত্যাশিত ছন্দপতন।—সে আবার হঠাৎ যে? সিনিয়র-কেমিস্ট-সংশ্লিষ্ট মনান্তরের অবসান ঘটিয়ে ধীরাপদই ভরা গুমটের ওপর একটা উত্তুরে বাতাস টেনে এনেছিল। সেই থেকে চীফ কেমিস্টের মেজাজের পালে খুশির হাওয়া লেগে আছে। আজ নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরের মত ধীরাপদ নিজেই আবার ওতে বড় একটা ছিদ্র করে বসল। বলল, হঠাৎ নয়, তিন-চার দিন ধরেই আসছেন দেখছি —একসঙ্গে বেরুচ্ছেনও।

ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ভারী হয়ে উঠছে। এই নির্বাক অসহিষ্ণুতা ধীরাপদ চেনে। ভাবছে কিছু। ভাবনাটা ক্ষোভশূন্য নয়। পকেট হাতড়ে সিগারেট খুঁজছে। এক-সময় তার সঙ্গেই উঠে গাড়িতে এসে বসেছে। একে একে তিন-চারটে সিগারেট ছাই হয়েছে।

ধীরাপদ সত্যের অপলাপ করেনি। মিথ্যে বলেনি। কিন্তু যা বলেছে না বললেও চলত। এই সত্যটা আজ অন্তত মুখের উপর ছুঁড়ে না দিলেও পারত। দিয়ে গ্লানি বোধ করছে এখন। আর ভাবছে, বড় সাহেবের কাছে আজ এই লোককে টেনে না নিয়ে আসাই ভালো ছিল।

ভালো যে ছিল খানিক বাদেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল।

একে এই দ্বিতীয়াবির্ভাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না হিমাংশু মিত্র, তার ওপর ধীরাপদর হাতে ওই অতিকায় ফাইল! লঘু শঙ্কায় বড় বড় চোখ করে তাকালেন তিনি, প্ল্যানড অ্যাটাক মনে হচ্ছে? ভাগ্নের দিকে ফিরলেন, তোকে শুদ্ধু ধরে এনেছে, কি ব্যাপার? বোস–

পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বার করে সামনের ছোট টিপয়ে রেখে অমিতাভ বসল। দৃষ্টিটা মামার মুখের ওপর। জিজ্ঞাসা করল, তোমার প্রেসারের খবর কী?

খুব খারাপ, হিমাংশুবাবু গম্ভীর, কোন রকম ঝকাঝকি সইবে না—একটা ঝগড়ার কথা বলেছিস কি লাবণ্যর কাছে রিপোর্ট চলে যাবে!

কোলের ওপর ফাইল দুটো রেখে চুপচাপ বসে ধীরাপদ আড়ে আড়ে অমিতাভকেই লক্ষ্য করছে। মেজাজ এখন কোন তারে বাঁধা জানে। বড় সাহেবের লঘু উক্তির জবাবে মুখের অসহিষ্ণু অভিব্যক্তি স্পষ্টতর হল শুধু। সিগারেটের প্যাকেট হাতে উঠে এলো।

হিমাংশুবাবু এর ওপরেই খোঁচা দিয়ে বসলেন একটু। বললেন, আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তুই জানিস তা হলে?

মুখের ওপরেই ফিরে ব্যঙ্গ করে উঠল অমিতাভ, বড় সাহেবের শরীর খারাপ, না জানলে চাকরি থাকবে কেন? তিক্ত কণ্ঠস্বর আর এক পরদা চড়ল, শরীর ভালো যাচ্ছে না তো তুমি এভাবে বসে আছ কোন আনন্দে–কলকাতা শহরে লাবণ্য সরকার ছাড়া আর ডাক্তার নেই?

ধীরাপদ আড়ে আড়ে দেখছে না আর, সোজাসুজি ঘাড় ফিরিয়েছে। বড় সাহেব মৃদু মৃদু হাসছেন। পাইপ ধরানোর ফাঁকে ভাগ্নের মুখখানা দেখছেন। ধীরাপদর কেমন মনে হল পাইপ মুখে দিয়ে একটা খুশির আলোড়ন আড়াল করছেন তিনি। মনে হল, সাফল্যের তিলক পরা এই মানুষটা শুধু এটুকু থেকেই বঞ্চিত। নিজের ছেলের কাছ থেকেও। সিতাংশুর সেদিনের কথা মনে পড়ল। বলেছিল, ভিতরে ভিতরে বাবার এখনো সব থেকে বেশি টান দাদার ওপর।

পাইপ ধরিয়ে বড় সাহেব জোরেই হাসলেন। বললেন, লাবণ্য এলে তাকে বলব সে এভাবে রোগী দখল করে বসে আছে কেন—আজ রাতেই আসবে হয়ত।

কিন্তু ঘরের বাতাস হালকা হল না একটুও। হিমাংশুবাবু ধীরাপদর দিকে ফিরলেন এবারে।—তোমার হাতে এত সব কী?

তাঁকে খানিকটা নিশ্চিন্ত করার জন্যেই ধীরাপদ ছোট ফাইলটা এগিয়ে দিল। বলল, তিন দিন বাদে ফাংশান, এটা এবারে দেখে দিন —

কিন্তু তার হাতের মোটা ফাইলটার ভয়েই উতলা তিনি। এটার কাজ শেষ হলেই ওটা এগিয়ে দেবে ভাবছেন। তাই আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কী?

মোটা ফাইলটাও এবার তাঁর সামনের ছোট টেবিলে রাখল ধীরাপদ। কী এটা এক কথায় জবাব দেওয়া সহজ নয়। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থায় যা কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে আর যত কিছু হিসেব-নিকেশ করেছে তার যাবতীয় খুঁটিনাটি ওতে আছে। বড় সাহেবের ঘোষণা রচনায় আদর্শের স্বপ্নটা যে অলীক নয় তার কৈফিয়ৎ বা সমর্থন এর থেকে মিলবে। সে যে শূন্য থেকে সংগঠনের সৌধ রচনা করেনি এটা তার নজির। বড় সাহেব সব নাকচ করে দিলেও এটাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। দুই-এক কথায় জানালো কি ওটা। মেটিরিয়াল ফাইল। এর ওপর নির্ভর করে ঘোষণার খসড়া তৈরি করা হয়েছে।

বড় সাহেব হাসলেন, তোমার খাটুনি ঠেকাবে কে? ছোট ফাইলের ওপর চোখ বোলালেন একটু। ধীরাপদর প্রায়-দুর্ভেদ্য হাতের লেখা নিয়ে অনেকদিন ঠাট্টা করেছেন। আজও ভুরু কোঁচকালেন। ফাইল হাতেই থাকল। জিজ্ঞাসা করলেন, কি করলে শুনি, বোনাস কি দিলে?

বলল, নিচের দিকের দেড় মাস থেকে ওপরের দিকে পনের দিনের সুপারিশ করেছে তারা।

বড় সাহেব ভাবলেন একটু, তারপর দেড় মাসটা এক মাস করে দিতে বললেন। ধীরাপদ ঘাড় নাড়ল, তাই করবে। অমিতাভ কুশনে মাথা এলিয়ে সিগারেট টানছে। . তার কোনো আগ্রহ বা উৎসাহ নেই। বিরক্তিকর লাগছে হয়ত। বেশিক্ষণ এ আলোচনা চললে ধৈর্য ধরে বসে থাকবে কিনা সন্দেহ।

বোনাস-প্রসঙ্গ শেষ করে বড় সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর আর কি? আর কি সেটা বোনাসের অঙ্কের মত দু কথায় বলা সম্ভব নয়। আর যা, সেটা সরল করে আনার তাগিদেই যা কিছু জটিলতার আশ্রয়। খসড়ার ভাব আর আবেগ থেকে লক্ষ্যের তালিকাটা ছেঁকে তুললে যতিশূন্য শোনাবে। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে তালিকাটা ছোট নয়। পাকা চাকরির গ্রেড বাঁধা, স্বেচ্ছাপ্রদত্ত বাড়তি প্রভিডেন্ট ফান্ড স্কীম, গ্র্যাচুইটি ঘোষণা, কোম্পানীর চিকিৎসকের নির্দেশসাপেক্ষ অসুস্থ কর্মচারীদের নিখরচায় যাবতীয় ওষুধ বিতরণ, চীপ-রেটে ক্যান্টিন স্থাপন, বেতনমূলক ছুটিছাটার আনুকূল্য—ইত্যাদি কোনোটা সদ্য ঘোষণার আকারে, কোনোটা বা ভবিষ্যৎ-প্রতিশ্রুতির মত করে সাজিয়েছে। ধীরাপদ কোনটা ছেড়ে কোটা বলবে?

বেশি বলার দরকার হল না। ঘোষণার মূল দু-তিনটে দফা শুনেই তিনি বললেন, বছরে খরচ কত বাড়বে শুনি আগে।

বড় ফাইলটা খুলে ধীরাপদ তৎক্ষণাৎ হিসেব দাখিল করল। বাড়তি খরচ শুধু নয়, সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি আয়ের দিকটাও দেখালো। নতুন সংগঠন অপরিহার্য, দু-চার কথায় তাও জানাতে দ্বিধা করল না। কিন্তু বড় সাহেব সেদিকে কান দিলেন না তেমন, খরচের অঙ্কটাই কানে বিঁধেছে। চিন্তিত মুখে বললেন, একবারে হঠাৎ এত খরচ বাড়িয়ে ফেললে সামলাবে কি করে বুঝছি না।

বাড়তি ব্যয়ের সমূহ অঙ্কটাই দেখিয়েছে ধীরাপদ। সব ক’টা প্রতিশ্রুতি ধরে দেখালে ওটা দ্বিগুণ হবার সম্ভাবনা। ছোটখাটো একটা বক্তৃতার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল ধীরাপদ, আর বড় ফাইলটা খুলে কোন যুক্তির ভিত্তিতে কি করা হয়েছে সেটা দেখাতে যাচ্ছিল।

বাধা পড়ল। সিগারেট ফেলে অমিতাভ হঠাৎ সোজা হয়ে বসেছে। খরখরে দৃষ্টিটাও শঙ্কার কারণ। ধীরাপদর হয়ে বোঝাপড়া করার দায়টা যেন তারই। সেইজন্যেই প্রস্তুত। কিন্তু তার প্রস্তুতির ধরন আলাদা।

বলল, কোম্পানীর ভালোর জন্যে দরকার হলে সামলাতে হবে। অন্য বাজে খরচ বাদ দিয়ে দাও।

এমন বেপরোয়া সমর্থন ধীরাপদত্ত আশা করেনি। বড় সাহেব ফিরে ভাগ্নের মুখখানা দেখলেন একটু। –কোন বাজে খরচটা বাদ দেব?

সবার আগে পারফিউমারি ব্রাঞ্চের প্ল্যান বাতিল করো। অনেক টাকা বাঁচবে।

তার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক টাকার। মিছিমিছি লোকসান দেবে কেন?

লোকসান হবেই বলছিস?

অমিতাভ তেতে উঠল, হবে কি হবে না আমার থেকে তুমি ভালো জানো।

এ রকম একটা আলোচনায় গাম্ভীর্য দরকার বলেই গম্ভীর যেন বড় সাহেব। ধীরেসুস্থে বললেন, তা হলেও পারে কি না দেখা যাক-

মামার সামনে ভাগ্নের ঠিক এই মূর্তি ধীরাপদ আর কখনো দেখেনি। একজন যেমন ঠাণ্ডা আর একজন তেমনি গরম। অমিতাভ বলে উঠল, কিন্তু কোম্পানীর দেখতে যাওয়ার কি দায় পড়েছে, কোম্পানী এভাবে টাকা রিস্ক করবে কেন?

এই উক্তিও গায়ে মাখলেন না বড় সাহেব। হাতের ফাইলটা ধীরাপদর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, টাইপে দিয়ে দাও। ভাগ্নের দিকে ফিরে নির্লিপ্ত জবাব দিলেন, কোম্পানী টাকা রিস্ক করবে না– আমি ঠিক করেছি ওটা আলাদা সতুর নামেই হবে।

ধীরাপদ নির্বাক দ্রষ্টা এবং শ্রোতা। ঘোষণার খসড়াটা টাইপ করতে দেওয়া পরোক্ষ অনুমোদনের সামিল। যদিও টাইপ করানো আর সঙ্কল্পে পৌঁছানোর মধ্যে অনেক ফারাক এখনো। তবু শুরুতে একটা বড় তিক্ততার সম্ভাবনা এড়ানো গেল বলে ধীরাপদর খুশি হবার কথা, স্বস্তি বোধ করার কথা। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে আসা, এই মুহূর্তে সেটা যেন সেও ভুলে গেছে।

জবাব শুনে অমিতাভ থমকালো একটু। কোম্পানীর টাকা লোকসানের সম্ভাবনাটাই একমাত্র ক্ষোভের কারণ হলে এর ওপর আর কথা থাকার কথা নয়। কিন্তু অমিতাভর ফরসা মুখখানা ক্ষণিকে স্তব্ধতায় আরক্ত হতে দেখল ধীরাপদ।

তুমি কি ঠিক করেছ না করেছ সেটা সে জানে?

জানবে।

জানিয়ে দাও তা হলে। তপ্ত বিদ্রূপ ঝরল একপশলা, সে জানে আমার জন্যেই তুমি কোম্পানী থেকে সরিয়েছ তাকে— সেই রাগে আর দুঃখে চোখে ঘুম নেই তার, রাতদুপুরে আসে আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে।

সঙ্গে সঙ্গে সেই রাত্রের কথা মনে পড়ল ধীরাপদর। যে রাত্রে তার ঘরে গিয়ে দাঁড়াতে রিসার্চের প্ল্যান-মগ্ন লোকটা আর কারো পুনর্পদার্পণ ভেবেছিল। বই থেকে মুখ না তুলে বলেছিল, অত রাতে ফয়সালা কিছু হতে পারে না, মামার সঙ্গে কথা হবে—তারপর যেন আসে।

….এই কথা তাহলে।

পাইপ মুখে বড় সাহেবকে আর তত নিরাসক্ত মনে হল না।—কি বলেছে?

কি বলেছে তাকেই ডেকে জিজ্ঞাসা করো।

তবু একটু অপেক্ষা করলেন তিনি, তারপর বললেন, করব। কিন্তু ও নির্বোধের মত ভাবছে বলে তোর মাথা গরম কেন? কোম্পানীর মেজর শেয়ার ওর আর আমার নামে—তাকে সরাবার কথা ওঠে কোথা থেকে?

ছেলেকে নির্বোধ বলা সত্ত্বেও উক্তিটা ধীরাপদর কানে বিসদৃশ লাগল কেমন। ছেলে ভাবছে বলে ভাগনেও যেন তাই ভেবে বসে না থাকে, সেই ইঙ্গিত কিনা বুঝল না। বোঝাবুঝির অবকাশও নেই আপাতত। অমিতাভ উঠে দাঁড়িয়েছে, চোখের তাপ চশমার পুরু কাচের ভিতর দিয়ে ঠিকরে আসছে।

কথা ওঠে না, সে জ্ঞান তোমার থেকেও তার অনেক বেশি টনটনে। তবু ও–রকম নির্বোধের মত ভাবছে কেন সেটাই বরং তুমি এখন ভাবতে চেষ্টা করো বসে। পারো তো তোমাদের ওই মেডিক্যাল অ্যাডভাইসারকে ওর ওখানে পারফিউমারি অ্যাডভাইসার করে পাঠাও — মাথা ঠাণ্ডা হবে।

সবেগে ঘর ছেড়ে চলে গেল। সকল সংস্রব থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাবার মত করে গেল। সিতাংশু বা লাবণ্য সরকারের ওপর নয়, এই মুহূর্তের যত ক্ষোভ মামার উপরে। ধীরাপদ নির্বাক বসে। বড় সাহেব পাইপ টানছেন। তেমন বিচলিত বা বিড়ম্বিত মনে হল না তাঁকে। অন্তত ধীরাপদ যতটা আশঙ্কা করেছিল ততটা নয়। ছেলের ব্যাপারে ভাগ্নে নতুন কিছু হদিস দিয়ে যায়নি। সবই জানা।

তবে গম্ভীর। কি ভাবছেন ঠাওর করা শক্ত। ছেলের মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য লাবণ্য সরকারকে পারফিউমারি অ্যাডভাইসার করে পাঠানোর কথা নিশ্চয় না। তার বিপরীত কিছুই হয়ত। ছেলে সেদিন প্রসাধন-শাখা নিয়ে বাপের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এসে ফিরে যাবার পর এই ব্যাপারে নিজের মনোভাব খুব স্পষ্ট করেই ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। আজ আর তার পুনরুক্তি করলেন না। ধীরাপদ ওঠার জন্য উসখুস করছে টের পেয়ে ঘাড় নেড়ে ইশারা করলেন। অর্থাৎ কাজ নেই কিছু যেতে পারে।

ফাইল হাতে বাইরে এসে আর একবার থমকে দাঁড়াতে হল। সিঁড়ির মুখে সিতাংশু দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই নিঃসংশয়ে বুঝে নিল একটু আগে অমিতাভকে সে ওই মূর্তিতে নেমে যেতে দেখেছে। ধীরাপদ হয়ত বলত কিছু। এই মুহূর্তে বাবার সঙ্গে আবার কিছু বোঝাপড়া করতে যাওয়া খুব বিবেচনার কাজ হবে না, সে রকম আভাসও দিতে পারত। কিন্তু কিছুই বলল না। কারণ, সিতাংশুর দুই চোখের চকিত দৃষ্টি অবিশ্বাসে ভরা। পাশ কাটিয়ে ধীরাপদ নিচে নেমে এলো।

ছেলে বাপের ঘরে অনেকক্ষণ ছিল সে খবরটা মানকের মুখে শুনেছে। কি কথা হয়েছে ধীরাপদ জানে না। মানকের ধারণা বিয়ের কথা। বিয়ের কথা নিয়ে কথা কাটাকাটি। ছোট সাহেবের বিয়ের প্রসঙ্গে মান্‌কে বা কেয়ার-টেক্ বাবু কারো থেকে কম ভাবছে না।

রাত্রে লাবণ্য সরকারের আসার কথা ছিল। অসুস্থ না সারার ব্যাপারে ভাগ্নের রাগ দেখে বড় সাহেব ঠাট্টা করেছিলেন, সে এলে রোগী দখল করে বসে থাকার কৈফিয়ৎ নেবে। সে এসেছিল টের পেয়েছে। রাত মন্দ নয় তখন, মেডিক্যাল হোমের ডিউটি সেরে এসেছিল হয়ত। কিছুক্ষণ ছিল। কি কথা হয়েছে জানে না। রোগী আগলে থাকার পরিহাসটা আর করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

নিচে নেমে লাবণ্য সরকার অমিতাভ ঘোষের ঘরে গেছে। ধীরাপদর অনুমান, পাঁচ মিনিটের বেশি ছিল না। অনুমান, অমিতাভর আজকের এই উত্তাপের সবটাই ভাইয়ের কারণে নয়। তাই হলে সিতাংশুর রাতদুপুরে ঘরে বোঝাপড়া করতে আসা নিয়ে মামার সঙ্গে আজকের এই প্রহসনটা সে দিনকতক আগেই সেরে ফেলত। অনুমান, এতদিন বাদে মহিলাটির আবার সেই দু নৌকোয় পা দেওয়ার চেষ্টা আবিষ্কার করেছে সে। বড় সাহেবেরও সেই কারণেই মনে মনে ক্ষোভ লাবণ্যর ওপর। ছেলেকে সে প্রশ্রয় দেয়। ধীরাপদকে স্পষ্টই বলেছেন সেদিন। বড় সাহেবের ঘর থেকে লাবণ্য নিচে নেমে সরাসরি ওঘরে গিয়ে ঢুকল কেন? তাপ দূর করতে? প্রলেপ দিতে? বোধ হয় না। পাঁচ মিনিটে ও প্রলেপ হয় না। কেন গেছে বা কি কথা হয়েছে ধীরাপদ জানে না।

পরদিন সকাল সকাল অফিসে এসেছিল। অনেক কাজ। অনেক ভাবনা। উৎসবের দিন তো এসেই গেল। কিন্তু কাজ এগোচ্ছে না, ভাবনাগুলোও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এবারে বেশ বড়দরের একটা নাটক গড়ে উঠছে মনে হয়। আবহাওয়া সেই রকম‍ই এ নাটক থেকে ধীরাপদ বাহ্যত বিচ্ছিন্ন। কিন্তু মন কস্তুটা বিচিত্র। তার যোগ-বিয়োগ অঙ্কের ধার ধারে না। কাজ করছেও বটে, ভাবছেও বটে, কিন্তু মনটা কালকের ওই অতগুলো না-জানা পরদার আনাচ-কানাচে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। খুব সগোচরে নয়। মনের ওপর খানিকটা লাগাম করার হাত থাকত তাহলে। হাত নেই। ফলে সবেতে অকারণ বিরক্তি।

ওটা কী? নোটটা টেনে নিল। পুরুষালি ছাঁদের রমণী-হস্তাক্ষর বড় বেশি চেনা। দেখে কপালের কুঞ্চন-রেখা মিলিয়েছিল। নোটটা পড়তে পড়তে সেগুলো আবার দেখা দিল। লাবণ্য সরকার পাশের ঘর থেকে নোট পাঠিয়েছে। বাক্যালাপের রীতি না থাকলে এই রীতি তার। অফিসিয়াল নোট। কাঞ্চন নামে যে মেয়েটি তার আবাসিক নার্সিং হোমে আছে, চীফ কেমিস্ট শ্রীঘোষের প্রস্তাব, তাকে মেডিকেল হোমের শিশি-বোতল ধোয়া, লেবেল কাটা, লেবেল আঁটা, ট্যাবলেট বিক্রির ছোট খাম তৈরি করা প্রভৃতির কাজে নেওয়া হোক। মেডিক্যাল হোমে এ ধরনের কাজের জন্য বাড়তি কর্মচারীর প্রয়োজন। মাইনে আশি টাকা। প্রস্তাবটি জেনারেল সুপারভাইজারের বিবেচনার্থে পাঠানো।

ধীরাপদর প্রথম প্রতিক্রিয়া অনুকূল নয় খুব। মাথাটা আর কত দিকে ভাগ করে ভাবতে পারে সে? নোটটা পড়তে পড়তে প্রথমেই চোখ-তাতানো ছাপা শাড়ি আর কটকটে লাল ব্লাউজ পরনে ক্ষীণাঙ্গী মূর্তিটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। ফ্যাকাশে মুখে উগ্র প্রসাধনের চটক আর চোখের বুভুক্ষু আমন্ত্রণ। কিন্তু একটু বাদে নিজেরই ভিতর থেকে কার যেন ভ্রুকুটি। আসল বিরক্তির কারণ, দায়টা তার ঘাড়ে পড়েছে বলে। নইলে ওই স্থূল বেশবাস আর প্রসাধনের আড়ালে থেকেও একখানি প্রায়-সুশ্রী শুকনো কচি মুখ আবিষ্কার করতে পেরেছিল সে। রেস্তোরাঁয় আর লাবণ্যর ঘরের রুগ্নশয্যায় যে মূর্তি আর যে কান্না দেখেছিল ভোলবার নয়।

কিন্তু মাইনে আশি টাকা। এ বাজারে আশি টাকায় ক’টা জঠরের জ্বালা জুড়বে? ফলে যে রাস্তা মেয়েটার জানা আছে সেই রাস্তায় বিচরণ কি তার বন্ধ হবে, না চাকুরি পেলে সেটাই আর একটু ভদ্রস্থ, আরো একটু লোভনীয় করে নেবে? ধীরাপদ সমস্যায় পড়ল। দরদ আর অনুকম্পা সত্ত্বেও ও-রকম পরিস্থিতির এক মেয়েকে কোম্পানীর ঘাড়ে চাপানোর ব্যাপারে মন সায় দিচ্ছে না।

নোট হাতে পাশের ঘরের উদ্দেশে উঠে এলো। সেদিন মোটর থেকে নেমে যাওয়ার পর সামনাসামনি বাক্যালাপ এ কদিনের মধ্যে আর হয়নি। লাবণ্য সরকার টেবিলে একগাদা প্যামফ্লেট ছড়িয়ে বসেছিল। মুখ তুলল।

এটার কি করা যায়? সহজ পরামর্শের সুর।

লাবণ্য জবাব দিল না। বসতেও বলল না। চুপচাপ চেয়ে রইল।

ধীরাপদ সামনের চেয়ারের কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল একটু। স্বাভাবিক হৃদ্যতায় কখনো কোনো ছেদ পড়েনি যেন। জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি বলেন?

লাবণ্য চোখ ফেরায়নি। ওটা আপনার মতামতের জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমি ঠিক ভালো বুঝছি না, ও ধরনের কোনো মেয়েকে একেবারে কোম্পানীতে এনে ঢোকানো

কথাটা শেষ হল না। লাবণ্য সরকারের হাতে টেলিফোনের রিসিভার উঠে এসেছে।—চীফ কেমিস্ট!

ধীরাপদ চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অপারেটার চীফ কেমিস্টের টেবিলে কানেকশান দিল।

মিস্টার চক্রবর্তী ওরকম কোনো মেয়েকে কোম্পানীতে নিয়ে আসাটা ভালো বিবেচনা করছেন না।

ধীরাপদ নয়, ধীরাপদবাবু নয়–মিস্টার চক্রবর্তী! দুই-একটা মুহূর্ত। রিসিভারটা লাবণ্য তার দিকে বাড়িয়ে দিল। অর্থাৎ চিফ কেমিস্ট তার সঙ্গে কথা বলবে।

সাড়া দেবার সঙ্গে সঙ্গে অমিতাভর গম্ভীর গলা কানের পরদায় গোঁ গোঁ করে উঠল, আপনি ভালো বিবেচনা করছেন না কেন, লাবণ্য সরকারের সেরকম ইচ্ছে নয় বলে?

ধীরাপদ আড়চোখে সামনের দিকে তাকালো একবার। জবাব দিল, তাঁর ইচ্ছে নয় আমি জানতুম না।

আমারও জানা ছিল না, কাল সন্ধ্যেয় মনে হয়েছে। দু-চার দিন আগেও ইচ্ছে দেখেছিলাম। ওই মেয়েটির কোথায় জায়গা হতে পারে সেটা সে-ই আমাকে দেখিয়েছিল। টেলিফোনের ওধারে গলা চড়ছে। যাক, আপনার বিবেচনাটা তা হলে ওই মেয়েটাকে গিয়ে জানিয়ে আসুন, রাস্তায় রাস্তায় আবার লোক ধরে বেড়াতে বলুন—

সজোরে টেলিফোন নামিয়ে রাখার শব্দ। এত জোরে যে কান থেকে ধীরাপদ হাতের রিসিভার আপনি সরে গেল। হাত বাড়িয়ে লাবণা রিসিভারটা নিয়ে যথাস্থানে রাখল। টেলিফোনটা তারই হাতের পাশে। খরখরে দৃষ্টি, ফোনের বাক্যালাপের মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা।

ধীরাপদ বলল, উনি বলেছেন ওই মেয়েটিকে নেবার জায়গা আপনিই তাঁকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন-

শুধু চাউনি নয়, হয়ত কণ্ঠস্বরও সংযত করার চেষ্টায় লাবণ্য কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর জবাব দিল, উনি জায়গার খোঁজ করেছিলেন তাই জায়গা দেখানো হয়েছে, জায়গা যে আছে ওই নোটেও লেখা আছে। সে জায়গা ভরাট করার দায়িত্ব আমি নিতে রাজি নই—সেটা আপনি দেখুন।

সেখানে দাঁড়িয়েই ধীরাপদ নোট অনুমোদন করে নাম সই করে দিল। তারপর ওটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, নিয়ে নিন—

দরজা ঠেলে বাইরে চলে এলো। নিজের ঘরে নিজের চেয়ারে এসে বসল। অনেক কাজ, অনেক ভাবনা। বড় সাহেবের ভাষণ টাইপে দিতে হবে, ওরা কতদূর কি করল না করল নিচে গিয়ে একবার দেখে আসতে হবে। এই ফাঁকেই টেবিলে আরো গোটাকতক ফাইল চালান করেছে কে আবার। জরুরী কিনা দেখার জন্য হাতের কাছে টেনে নিল।

তারপরেই থমকে গেল হঠাৎ।

ভালো লাগছে কেন? এতক্ষণ তো লাগছিল না। এই কদিনের মধ্যেও লাগেনি। কদিনের জং-ধরা মনোযন্ত্রটা সদ্য তেল-পড়া-গোছের সচল সজীব লাগছে কেন? একটু চোখের দেখা, একটু কাছের দেখা, দুটো কথা বলা—শুধু এইটুকুতেই জীর্ণ হলদে পাতায় নতুন সবুজের রঙ ধরতে চায় কেন? কেন ভালো লাগে? কেন ভালো লাগছে? সে না দেয়াল তুলে দিয়েছিল? বুকের এধারে শক্ত দেয়াল খাড়া করেছিল না একটা?

ফাইলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ধীরাপদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *