কাল তুমি আলেয়া – ১৭

সতের

সমস্ত প্রেরণার তলায় তলায় তবু দ্বিধার টান একটু।

ধীরাপদ কি বিশ্বাসঘাতকতা করতে চলেছে? মন বলছে, না। সুযোগ পেয়েও এই বৃহত্তর স্বার্থের দিকে না তাকালেই বিশ্বাসঘাতকতা হত। মন বলছে, সকলের এই মিলিত স্বার্থের, জোয়ার সংহত হলে গোটা প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ। মন বলছে, সংকীর্ণতার বদ্ধমুষ্টিটা ভূমি খুলে দাও, তোমার কাজ ভুমি করে যাও—প্রেরণা দ্বিধার সহচরী নয় কোনোদিন।

মন যা বলছে ধীরাপদ তাই করেছে। এই কদিনের একটানা ভাবনা-চিন্তা আর হিসেব শেষ। সাদা কাগজগুলো কালির আঁচড়ে ভরে উঠল। ধীরাপদর হাতের লেখা ভালো না। পড়তে বেগ পেতে হয়, ফলে মর্মোদ্ধারেও। টাইপের সারিতে বাঁধা পড়লে এরই ভিন্ন রূপ, ভিন্ন মূর্তি।

টেবিলের টাইমপাস ঘড়িতে রাত একটার কাছাকাছি। এমন কিছু নয়, গেল ক-রাত ছোট কাঁটাটা তিন ছুঁয়েছে। খানিকক্ষণ কান পেতে শুনলে পার্টিশনের ওধারে মাকের নাকের ডাকের ওঠানামাটা একেবারে ছন্দশূন্য মনে হয় না। তবে গোড়ার রাতে তার সুপ্তি-সাধনায় দুবার অন্তত ছেদ পড়ে। একবার ছোট সাহেবের গাড়ির হর্ন শুনে আর একবার ভাগ্নেবাবুর। নাকের ওপর হাত থাক না থাক, এই আগমনবার্তা শুনে অভ্যস্ত সে। দুবারই শয্যা ছেড়ে উঠে আসতে হয় তাকে। বড় সাহেব সুস্থ থাকলে হয়ত তিনবার উঠতে হত।

ঘরের মধ্যে বারকতক পায়চারি করল ধীরাপদ। মনের তলায় অজ্ঞাত অস্বাচ্ছন্দ্য বোধটা একেবারে যাচ্ছে না। নিজের ওপরেই বিরক্ত তাই।…বড় সাহেব একা কিছু করতে বলেননি তাকে। কিন্তু একলার চাপটাই মনের ওপর বড় হয়ে উঠছে। অমিতাভ ঘোষের বিশদ করে শোনার ধৈর্য নেই অত। খসড়ার মোটামুটি কাঠামোটা তাকে জানিয়ে রাখবে? মনে ধরলে তার জোরের সঙ্গে ওর জোরটা মিলতে পারে। আর গোপনই বা কিসের, যা করেছে সবই তো খোলাখুলি বড় সাহেবের টেবিলের ওপর ফেলে দিতে হবে। ধীরাপদ শুধু সময়ের ওপর দখল চাইছে একটু।

কি ভেবে দরজার বাইরে দোতলার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। ওধারে হলঘরটার অন্ধকার অন্যদিনের মতই তরল লাগছে। অর্থাৎ ‘আজও এই রাতে অমিত ঘোষের ঘরে আলো জ্বলছে। খোলা দরজা দিয়ে সেই আলোর মিশেলে হলের অন্ধকার ফিকে, দেখায়। সিঁড়ি পেরিয়ে ধাঁরাপদ তিন-চার দিন ওই হলঘরটায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে দরজা দুটোই দেখা যায় শুধু, অমিতাভর ঘর ভিতরের দিকে।

রোজই প্রায় অত রাত পর্যন্ত ঘরে আলো জ্বেলে কি করে? ফোটো অ্যালবাম দেখে বসে বসে? দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে? কৌতূহল সত্ত্বেও একদিনও দরজা পর্যন্ত এগোয়নি।

আজ এগোলো। হলঘরের ভিতর দিয়ে পায়ে পায়ে খোলা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। যা দেখল, তা অন্তত দেখবে ভাবেনি।

অমিতাভর খাটখানা মস্ত চওড়া। খাটময় ছড়ানো মোটা মোটা বই খাতা জার্নাল।

একধারে অর্ধেক বিছানাজোড়া খোলা চার্ট একটা, মাটিতেও ওরকম হাতের তৈরি আর একটা চার্ট পড়ে। কোলের ওপর একটা মোটা বই খুলে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে।

ধীরাপদ নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল। অমিতাভ আড়াআড়ি বসে, মুখের আধখানা দেখা যাচ্ছে। কেউ যে এসেছে তার টের পাবার কথা নয়, দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেও এ তন্ময়তা ভাঙবে ভাবেনি। কিন্তু দু মিনিট না যেতে ভারী গলার বিরক্তি- প্রচ্ছন্ন উক্তি। বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, এই রাতেই তো আর কোনো ফয়সালা কিছু হতে পারে না, মামার সঙ্গে আমার কথা হবে— তারপর এসো।

ধীরাপদ হতভম্ব। এ আবার কোথা থেকে কিসের মধ্যে এসে পড়ল সে! আগন্তুকের ছায়াটা তবু নড়ল না দেখেই হয়ত গম্ভীর অসহিষ্ণুতায় ঘাড় ফেরালো সে। তারপরেই অবাক। খুশিও।— আপনি! কি আশ্চর্য, বসুন বসুন—তাই তো, কোথায়ই বা বসবেন-

খাটের পাশের চেয়ারটাতেও স্তূপীকৃত বই। ধীরাপদ দু পা এগিয়ে টেবিলটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল, ধ্যানভঙ্গ করলাম। আপনি কে ভেবেছিলেন?

অমিতাভ হাসতে লাগল, কিন্তু কে ভেবেছিল সেটা ব্যক্ত করল না।—কেউ না। আপনি এত রাত পর্যন্ত ঘুমুন নি যে, কি ব্যাপার?

জবাব না দিয়ে ধীরাপদ ফিরে বলল, আমিও দেখতে এসেছিলাম কি ব্যাপার। এ সব কী?

অমিতাভ আজ আর সেদিনের মতো দুর্বোধ্য কিছু বলে বসল না, অর্থাৎ এসব বোঝা যে তার আওতার বাইরে সেরকম কিছু মন্তব্য করল না। উল্টে তার আগ্রহ দেখে মনে হবে, এ নৈশ সাধনায় মরমী সমঝদার কেউ এসে হাজির হয়েছে। ছড়ানো বই-পত্র-চার্টের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সোৎসাহে বলল, এসব একটা রিসার্চের প্ল্যান…হলে অনেক কিছু হতে পারে, আপনাকে বলব’খন সব একদিন। আজ ক-বছর ধরে আমি এই এক ব্যাপার নিয়ে ভাবছি…

মন-মেজাজ যেমনই থাক, আর ফ্যাক্টরীর কাজে এক-এক সময় যত বিঘ্নই সৃষ্টি করুক, তার লাইব্রেরীর পড়াশুনা অথবা অ্যানালিটিক্যালের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কখনো ছেদ পড়তে দেখেনি কেউ। বরং এক দিকের ক্ষোভ আর এক দিকের রূঢ় নিবিষ্টভায় ভরে উঠতে দেখা গেছে। চারুদির বাড়িতে সেদিন হিমাংশুবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি করে বা কি পড়ে ধীরাপদ জানে কি না। আজও না জানুক, একটা কিছুর হদিস পেল।

কিন্তু স্বস্থানে ফিরে আসার পর ধীরাপদর গোড়ার বিস্ময়টাই আগে হানা দিল। সে যাবার আগে অত রাতে কে আবার ওই ঘরে ঢুকেছিল? কার পুনর্পদার্পণ ভেবে অমিতাভ অমন উক্তি করল? মানকে তো সেই থেকে ঘুমের কসরৎ দেখিয়ে চলেছে। কেয়ার-টেক বাবু? এই রাতে তারই বা কি এমন ফয়সালার তাগিদ?

তাগিদটা কার অনুমান করা গেল দু দিন না যেতেই।

রাত তখন এগারোটার কাছাকাছি। ধীরাপদ বড় সাহেবের বড় কাজ অর্থাৎ কানপুরের কাজ নিয়ে বসেছিল। এ কাজটাও হয়ে এসেছে। পার্টিশনের ওধারে মানকের নাকের ডাক জমে ওঠেনি তখনো। পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে মনে হতে ঘাড় ফেরাল।

সিতাংশু।

সঙ্গে সঙ্গে: ভিতর থেকে কে যেন তাকে বলে দিল, সেদিন অত রাতে তার আগে যে লোক অমিত ঘোষের ঘরে ঢুকেছিল, সে মানকের কেয়ার-টেক বাবু নয় —সিতাংশু। কেয়ার টেক বাবুর অত সাহস হবার কথা নয়, বা তার উদ্দেশে অমিতাভর অমন গুরুগম্ভীর উক্তিও প্রযোজ্য নয়।

সিতাংশু হাসল একটু, সঙ্কোচ তাড়ানো গোছের ছেলেমানুষি হাসি। উত্তরাধিকারচক্রে কর্তা-ব্যক্তি হয়ে বসেছে, নইলে কতই বা বয়স। শুকনো মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় আরো ছেলেমানুষ লাগছে। বলল, আপনারা তো সবাই খুব ব্যস্ত এখন—

বসুন

ধীরাপদ চেয়ার ছেড়ে বিছানায় বসতে যাচ্ছিল, তার আগেই সিতাংশুই খাটের ধার ঘেঁষে বসে পড়ল। —কি করছেন?

মিস্টার মিত্র কানপুরের ফাংশানে যাবেন, সেই ব্যাপার।

ও…। প্রেসার তো রোজই বাড়ছে শুনেছি, যাবেন কি করে?

প্রশ্ন কিছু নয়। ক্ষোভের অভিব্যক্তি মাত্র। ধীরাপদ অপেক্ষা করছে।

এদিকের অ্যানিভার্সারির ব্যবস্থা সব শেষ?

প্রায়—।

কি হচ্ছে না হচ্ছে আমি কিছুই জানিনে। চাপা অসহিষ্ণুতায় উপেক্ষার যাতনাটাই বেশি স্পষ্ট!

ধীরাপদর মুশকিল কম নয়। নরম গলায় আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করল, আপনাকেও বলবেন নিশ্চয়, এখনো তো আছে ক’টা দিন।…তাছাড়া আপনার কাঁধেও তো বিরাট দায়িত্ব এখন।

কিসের বিরাট দায়িত্ব, পারফিউমারি ব্র্যাঞ্চের? সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তার ক্ষোভের জায়গাটাই যেন খুঁচিয়ে দিয়েছে ধীরাপদ। —ফ্যাক্টরীর সব দিকের সব উন্নতি শেষ, না এ সময় একটা নতুন ব্র্যাঞ্চ খোলাটা ভয়ানক দরকার হয়ে পড়েছিল?

ধীরাপদ নিরুত্তর। মনে মনে বলছে, তোমাকেই সরানো দরকার হয়েছিল। সেটা শক্ত বলেই তোড়জোড়টা এত বড়।

কোনরকম বোঝাপড়া করতে আসেনি, উদগত উষ্মার মুখে সেটাই মনে পড়ে গেল বোধ হয়। গলার সুর শমে নামল, শুকনো মুখে আবারও সেই ছেলেমানুষি বিড়ম্বনা। এবারে আগের থেকেও বেশি। বলল, যাকগে, আপনার সঙ্গে আমার একটু ব্যক্তিগত কথা ছিল।

ধীরাপদর নীরব প্রতীক্ষা সহৃদয় প্রতিশ্রুতির মতই।

কিন্তু শুনল, যা, তা নয়, নির্জলা আবেদন। দ্বিধা দ্বন্দ্ব আর কাঁচা মুখের বর্ণব্যঞ্জনা সত্ত্বেও বক্তব্য স্পষ্ট।…বাবা এক জায়গায় তার বিয়ের ব্যবস্থায় এগিয়েছেন। বলতে গেলে স্থিরই করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ছেলের আপাতত বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তাছাড়া বিয়ের ব্যাপারে সকলেরই ব্যক্তিগত মতামত কিছু থাকতে পারে। সেটা বাবার জানা দরকার। বোঝা দরকার। প্রকারান্তরে সেটা তাঁকে জানানো হয়েছে, কিন্তু বোঝানো হয়নি। এসব ব্যাপারে বাবার সঙ্গে সামনাসামনি আলোচনায় অভ্যস্থ নয় সে। কাজেই বোঝানোটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। একমাত্র দাদা পারে। অর্থাৎ অমিতাভ পারে। ভিতরে ভিতরে এখনো বাবার সব থেকে বেশি টান দাদার ওপর। আর সিতাংশুর ধারণা, দাদা ছাড়া এখন এসব ব্যাপারে আর যে কথাবার্তা কইতে পারে বাবার সঙ্গে — সে ধীরাপদ। বাবা যে শুধু পছন্দ করেন তাকে ভাই নয়, বাবার এত আস্থা এক দাদা ছাড়া আর কারো ওপর দেখেনি।

অতএব-

অতএব-এর আবর্তের মধ্যে পড়ে ধীরাপদ নির্বাক কিছুক্ষণ। সঙ্কোচ কাটিয়ে ওঠার পর অরগ্যানিজেশন চীফ সিতাংশুর প্রত্যাশার দৃষ্টিটা কলেজে পড়া ছাত্রের মতই তার মুখের ওপর আশা আর সংশয়ে দোদুল্যমান। কিন্তু ধীরাপদ কি করবে? আশা দেবে? বড় সাহেবের বদলে তারই হাতে মীমাংসার চাবি থাকলে সে কি করে? কোন দিকে ঘোরায় সেটা? ধারাপদর হাসি পাচ্ছে।

-কথা না উঠলে এ ব্যাপারে আমার কথা কইতে যাওয়া কি ঠিক হবে?

সিতাংশু ভাবল একটু।—আমিই আপনাকে বলার জন্যে অনুরোধ করেছি বলবেন।

তাহলে হয়ত তিনি আপনার আপত্তি কেন জানতে চাইবেন।

সেটা তিনি জানেন। আগ্রহের আভাস দেখছে না বলে ঈষৎ অসহিষ্ণু।

তবু ধীরাপদ চুপচাপ কিছুক্ষণ। তারপর বাবার বদলে ছেলেকেই বোঝানোর মত করে বলল, দু-দুটো ব্যাপার সামনে, তার ওপর ওঁর শরীরও সুস্থ নয়, ক’টা দিন যাক না—পরে হয়ত এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যাবে।

সিতাংশু আর অনুরোধ করল না। পদস্থ ওপরওয়ালা একটা গোপন দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে যেভাবে সচেতন হয়, তেমন সচেতন গাম্ভীর্যে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। মানকের নাকের ডাকের সংগ্রামোত্তীর্ণ একটা পরিপুষ্ট লয় কানে আসতে ভুরু কুঁচকে পার্টিশনটার দিকে তাকালো— আপনার অসুবিধে হয় না?

হয় বললে তক্ষুনি চুলের মুঠি ধরে মানকেকে টেনে তুলত বোধ হয়। ধারাপদ হাসল, ক্ষণপূর্বের আলোচনাটা মনে করে রাখার মত গুরুতর কিছু নয় সে-ও তাই বোঝাতে চায়। ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল, না, শুনতে শুনতে বরং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি এক-এক দিন।

সিতাংশু চলে যাবার পর ঘুমের চেষ্টা করা দূরে থাক, মানকের সুপ্তিসহায়ক নাকের ডাকও অনেক রাত পর্যন্ত কানে ঢোকেনি।

পরে নয়, এই বিশেষ প্রসঙ্গে হিমাংশুবাবুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ধীরাপদ পরদিনই পেয়েছে। আর সেই সুযোগ আচমকা এসে তাঁর ছেলেই করে দিয়ে গেছে। টানধরা স্নায়ুর সঙ্গে ধৈর্যের আপস নেই কোনকালে। সেরকম বিড়ম্বনার এক-একটা দিন ছেড়ে এক-একটা মুহূর্তও দুর্বহ। একটা রাত আর একটা বিকেলের মধ্যেই সিতাংশুর মনের গতি বদলেছে।

সন্ধ্যার পরে ধীরাপদ মুখহাত ধুয়ে সবে হিমাংশুবাবুর শোবার ঘরে এসে বসেছিল, কর্তার নির্দেশে মানকে দু পেয়ালা চা দিয়ে গেছে। মেজাজ প্রসন্নই ছিল। সন্ধ্যের মধ্যে দু পেয়ালা হয়ে গেল শুনে লাবণ্য যদি রাগ করে, দোষটা তাহলে তিনি ধীরাপদর ঘাড়ে চাপাবেন, শুনিয়ে রেখেছেন। হাতের পাইপটাকে অনেকক্ষণ বিশ্রাম দিয়েছেন মনে হয়। শয্যার পাশে ছোট টেবিলের কাগজপত্রের ওপর পাইপের শূন্য গহ্বর ঘরের কড়িকাঠের দিকে হাঁ করে আছে।

সিতাংশুর অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে আজ আর কাজ নিয়ে বসার অবকাশ হল না। সান্ধ্যবৈঠকে যেমন আসত সেরকম আসা নয়। মুখ গতরাতের থেকেও শুকনো। শুকনো মুখেও সঙ্কল্পের ছাপ। ধীরাপদর থেকে হাত দুই তফাতে একটা কুশনে এসে বসল চুপচাপ।

চায়ের পেয়ালা রেখে হিমাংশুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে, কি খবর?

কি হচ্ছে না হচ্ছে শুনতে এলাম।

জবাবটা কানে অন্য রকম লাগল বোধ হয়, ঈষৎ কৌতুকে তিনি ছেলের মুখখানা পর্যবেক্ষণ করলেন একটু।—ভোর দিকের কতটা কি এগোলো বল শুনি।

আগমনের হেতু জানে বলেই ধীরাপদ মনে মনে শঙ্কিত। উঠে যাওয়া সম্ভব হলে উঠে পড়ত। কিন্তু ছেলের জবাব শুনে অবাক।

এগোচ্ছে না। আমি ও কাজ পারব না।

হাত-পা ছড়িয়ে খাটে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন হিমাংশুবাবু। আস্তে আস্তে সোজা হলেন। অবাক তিনিও। কি পারবি না, নতুন ব্র্যাঞ্চ চালাতে?

নিরুত্তর। অর্থাৎ, ভাই।

বড় সাহেবের দিকে চেয়ে ধীরাপদর একবারও মনে হল না চড়া ব্লাডপ্রেসারে ভুগছেন তিনি। রাগ ভুলে বিস্ময় আর কৌতুকে ছেলের মুখখানা চেয়ে চেয়ে দেখলেন খানিক। হাত বাড়িয়ে পাইপটা তুলে নিলেন, তারপর টোবাকো পাউচটা। কিন্তু সে দুটো হাতেই থাকল। ধীরাপদর দিকেও হালকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন একবার।

মনে মনে কি একটু হিসেব করে নিলেন মনে হল। বললেন, সাড়ে তিন হাজার করে চৌদ্দ কাঠা জমির দাম পড়েছে ঊনপঞ্চাশ হাজার টাকা, একতলা বিলডিং কনসট্রাকশনের জন্য কনট্রাক্টরের সঙ্গে রফা হয়েছে ছেচল্লিশ হাজার টাকায়…হল পঁচানব্বই হাজার। তার ওপর ইকুইপমেন্ট। সব মিলিয়ে সোয়া লাখ টাকার ধাক্কা। এ টাকাটার কি হবে?

জবাব নেই।

স্পীক! কি হবে, বেচে দিবি?

তা না চাও তো কেউ দায়িত্ব নিক, আমি পেরে উঠব না।

পাউচ খুলে পাইপের মুখে আস্তে ধীরে টোবাকো পুরতে লাগলেন। পাইপ ধরালেন। ধীরাপদর দিকে তাকালেন আবার। বিব্রত মুখে তাকে উসখুস করতে দেখে ইঙ্গিতে বসে থাকতেই নির্দেশ দিলেন। ছেলের দিকে মুখ ফেরালেন তার পর। এবারে গম্ভার বটে, কিন্তু উষ্মার চিহ্ন নেই। বললেন, টাকা লোকসান হয় হোক, পারা যে গেল না সেটাই আমি দেখতে চাই।

কণ্ঠস্বর মৃদু শান্ত, কিন্তু সমস্ত বক্তব্যের ওপর পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেবার মত। সিতাংশু চুপচাপ উঠে গেছে। তার পরেও হিমাংশুবাবু নীরব খানিকক্ষণ। পাইপ টানছেন।

অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল- তাঁকে, কি রকম নিঃসঙ্গও। খাটে হেলান দিয়ে ধীরাপদর দিকে চোখ ফেরালেন।—রাগের কারণ বুঝলে? চোখে চোখ পড়তে একেবারে বোঝেনি মনে হল না। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে বলেছে কিছু?

সাহায্যের প্রতিশ্রুতি না দিক, কথা উঠলে কথা বলবে সে রকম আশ্বাস দিয়েছিল সিতাংশুকে। দ্বিধান্বিত জবাব দিল, এ ব্যাপারে কিছু বলেননি….

এটা কোনো ব্যাপার নয় বললাম তো, এটা রাগ। কি বলেছে?

বিয়ের প্রসঙ্গে তাঁর নিজের কিছু মতামত আছে বোধ হয়।

থাকতে পারে। কিন্তু যা সে চায় তার সঙ্গে আমার মতটা কোনদিন মিলবে না এটা তাকে জানিয়ে দিও। সোজা হয়ে বসলেন, পাইপ টেবিলে রাখলেন। হি ইজ্ নো ম্যাচ ফর হার, ওখানে বিয়ে করলে আজীবন ওই মেয়ের হাতের খেলনা হয়ে থাকতে হবে তাকে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট দ্যাট। অ্যান্ড দেয়ার আর আদার কমপ্লিকেশনস . ট্যু…আমি তা চাই না। ওকে আমি সে আভাস অনেকবার দিয়েছি, ওর সেটা বোঝা উচিত ছিল।

কণ্ঠস্বর তেমন না চড়লেও ছেলের উদ্দেশ্যে ভর্ৎসনাটুকু অনমনীয়। ‘অ্যান্ড দেয়ার আর আদার কমপ্লিকেশনস ট্যু’—কথা কটা ধীরাপদর কানের পর্দায় আটকে থাকল অনেকক্ষণ পর্যন্ত। আর কি সমস্যা? কোন জটিলতার ইঙ্গিত? ধীরাপদর নীরব দুই চোখ তাঁর মুখের ওপর বিচরণ করছে। বিরক্তি আর ঈষৎ উত্তেজনায় মুখখানা লালচে দেখাচ্ছে।

খানিক বাদে ঠাণ্ডা হলেন। তবু রক্তচাপ বেশি কিনা ধীরাপদর সেই সংশয় গেল না। এরপর যা বলে গেলেন তাও প্রত্যাশিত নয়। ওই মুখে এ ধরনের আত্মগত চিন্তার ছায়াও আর দেখেনি কখনো। পাইপ আবারও হাতে উঠে এসেছে, খাটের উঁচু ধারটায় পিঠ রেখে গা ছেড়ে দিয়েছেন।

লাবণ্য বুদ্ধিমতী মেয়ে, অনেক গুণও আছে, আই লাইক হার। কিন্তু এ ব্যাপারটায় সে প্রশ্রয় দেবে আশা করিনি। সেও এই চায় আমি বিশ্বাস করি না। এখানেই থামলেন না। বললেন, তোমার দিদি একটু বুঝে চললে কবেই সব মিটে যেত…কিন্তু তাঁর তো আবার উল্টো রাস্তায় চলতে হবে সর্বদা।

চারুদি! ধীরাপদ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েই রইল শুধু।

নিচের ঘরে নেমে এসে ভিতরে ভিতরে উন্মুখ অনেকক্ষণ পর্যন্ত। কতই বা রাত, চারুদির ওখান থেকে ঘুরে আসবে নাকি আজই একবার?

সম্ভব হলে পরদিন যাবে ভেবেছিল, কিন্তু সকাল থেকেই দিনের গতি অন্যদিকে গড়ালো। আসন্ন অনুষ্ঠানের আর দিনসাতেক বাকি মাত্র। হাতের কাজ যেভাবে ছড়িয়েছে, আস্তে ধীরে এবারে গোটানো দরকার সেগুলো। খবরের কাগজগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, বিজ্ঞাপন দিয়ে আসতে হবে—এটাই সমূহ কাজ আপাতত।

বিজ্ঞাপনের কথা মনে হতে আরো কি মনে পড়ল। চুপচাপ বসে ভাবল খানিক, তারপর দোতলার অফিসম্বরে উঠে এলো। হিমাংশুবাবুর বাড়ির সিঁড়ির বাঁয়ের অফিসঘরে।

টেলিফোন ডায়াল করল। ওধারে লাবণ্য সরকারই ধরেছে।

বিজ্ঞাপন নিয়ে আজ আপনার দাদার ওখানে যেতে পারি। যাবেন?

লাবণ্য ধন্যবাদ জানালো। যাবে।

কথা বাড়ালে লাবণ্যও ওধার থেকে খুশি হয়েই কথা বলত হয়ত। ধীরাপদ টেলিফোন রেখে দিল।

দিনকতক আগে দাদার সপ্তাহের খবরে বিজ্ঞাপন দেবার জন্যে লাবণ্য প্রকারান্তরে অনুরোধই করেছিল তাকে। দাদার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করবার জন্যে একদিন তাকে নিয়ে যেতেও চেয়েছিল। ধীরাপদ বিজ্ঞাপনের প্ল্যান ঠিক করে তারপর যাবে বলেছিল।

বিভৃতি সরকার আর বিভৃতি সরকারের সপ্তাহের খবরের অনেক খবরই বহুদিন আগে ধীরাপদ চারুদির মুখে শুনেছিল। সেখান থেকে লাবণ্যর এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের সমাচার পর্যন্ত। ধীরাপদ আসার পর বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে বহু গেছে, হামেশা যাচ্ছেও, কিন্তু তার হাত দিয়ে সপ্তাহের খবরে বিজ্ঞাপন একবারও গেছে বলে মনে পড়ে না। সিতাংশু মিত্রের হাত দিয়ে যেত জানে, অথচ এ ভুলটা ধীরাপদ ঠিক ইচ্ছাকৃত নয়। কাজ নিয়ে যখন মাথা ঘামিয়েছে, এই কাগজটার কথা মনেই পড়েনি তার। লাবণ্যও মনে করিয়ে দেয়নি।

নিজের ঘরে বসে লাবণ্য লিখছিল কি। অফিসেরই কোনো কাজ হবে।

ধীরাপদ ঘরে ঢুকতে মুখ তুলল, এখন যাবেন?

ধীরাপদ মাথা নাড়ল।

লেখা কাগজগুলোর ওপর পেপারওয়েট চাপা দিয়ে কলম বন্ধ করতে করতে লাবণ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।—চলুন, সেরেই আসি।

সেরে আসতে একটু দেরি হবে হয়ত, অন্য কাগজের অফিস কটাও ঘুরে আসব।

আমাকেও সেসব জায়গায় যেতে হবে?

গেলে ভালো হয়।

লাবণ্যর মুখে চকিত হাসির আভাস। আজকাল এরকম একটু-আধটু অনুগ্রহ করতে তার আপত্তি নেই ধীরাপদ জানে। তার ওপর আজ বিশেষ করে তার দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যেই বেরুনো। টেবিল থেকে বড় পোর্টফোলিও ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। মেয়েদের স্বাভাবিক নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদের মত ওটা। আত্মনির্ভরশীলতার বিজ্ঞাপনের মত। হাতে থাকলে মর্যাদা বাড়ে। কিন্তু ধীরাপদ অবিচার করেছিল, নিছক এই কারণেই ওটা হাতে নেয়নি। লাবণ্য বলল, চলুন, আমিও কিন্তু মাঝখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে একটু নামব, একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে যেতে হবে—বেশি সময় লাগবে না।

শোনা মাত্র তার ভগ্নিপতির কথা মনে হল ধীরাপদর, আর রমেন হালদারের কথা। রোগী যখন বাচ্চা মেয়ে আর বাড়িটা যখন আত্মীয়ের, গন্তব্যস্থলটি তখন কোথায় সটীক মন্তব্যসহ চোখ-কান বুজে বলে দিতে পারত রমেন হালদার।

একতলার সিঁড়ির গোড়ায় বড় সাহেবের লাল গাড়িটা দেখে লাবণ্য থমকে দাঁড়াল। —মিস্টার মিত্র অফিসে এসেছেন নাকি!

কিন্তু অবাক হয়ে দেখল তকমা-পরা ড্রাইভার সেলাম ঠুকে তাদের উদ্দেশেই পিছনের দরজা খুলে দিল। ধীরাপদ জানালো এসব কাজ নিয়ে ঘোরা স্টেশন ওয়াগনে সুবিধে হয় না বলে গাড়িটা সে-ই পাঠাতে বলে এসেছিল।

গাড়ি ফ্যাক্টরী এলাকা ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়তে লাবণ্য প্রথমে কোথায় যাবে ড্রাইভারকে সেই নির্দেশ দিয়ে দিল। তারপর অনেকদিন আগের একদিনের মতই অন্তরঙ্গ খেদ প্রকাশ করল, দিনকে-দিন আপনার প্রতিপত্তি দেখে হিংসা হচ্ছে!

ধীরাপদ জবাব দিল না। বড় গাড়ি, দুজনের মাঝখানে অনেকটা ফাঁক। এধারে একেবারে কোণ ঘেঁষে বসেছে সে। আরো একদিন এমনি এক গাড়িতে পাশাপাশি বসেছিল মনে পড়ে। হিমাংশুবাবু আর লাবণ্যর সঙ্গে ওষুধের ত্বরিত সরকারী অনুমোদন লাভের সুপারিশে সেদিন সে-ও উপস্থিত ছিল। বাক্যবিন্যাসের ছটায় রমণীর সেই সপ্রতিভ সরল মাধুর্য দেখে সেদিন শুধু সংশ্লিষ্ট অফিসার নয় ধীরাপদ নিজেও ঘায়েল হয়েছিল। ফেরার পথে লাবণ্য আর সে ট্যাক্সিতে ফিরেছিল। সেদিনও দুজনের মাঝে যতটা সম্ভব ফাঁক ছিল। কারণ ধীরাপদর নিজের মধ্যেই তখন অনেক দ্বন্দ্ব। লাবণ্য সরকার তাকে অধীনস্থ সামান্য কর্মচারী বলে জানত সেদিন। ধীরাপদ নিজেও তাই জানত।

কিন্তু দ্বন্দ্ব আজও। সেদিনের মতো আত্মবোধের দ্বন্দ্ব নয়, স্নায়ুতাতানো লাল গাড়িতে পাশাপাশি বসার দ্বন্দ্ব। সান্নিধ্যের আলেয়া থেকে আত্মরক্ষার দ্বন্দ্ব। ধীরাপদ জেনেছে, স্নায়ু যত বিভ্রান্ত হয়, আত্মরক্ষা ততো কঠিন হয়ে পড়ে। আজ সে বিশেষ একটা সঙ্কল্প নিয়ে বেরিয়েছে এটাই সত্যি, আর কিছুই সত্যি নয়। লাল গাড়িতে পাশাপাশি বসাও নয়, আর রমণী-মুখের এই অন্তরঙ্গতাও নয়।

গাড়ির ওধারের কোণ ঘেঁষে বসাটা লাবণ্য লক্ষ্য করেছে। সাদাসিধেভাবেই জিজ্ঞাসা করল, বড় সাহেবের বাড়িতে আদর-যত্ন কেমন পাচ্ছেন বলুন—

ভালই।

আপনি আসছিলেন না দেখে উনি তো হতাশই হয়ে পড়েছিলেন শুনলাম, সুলতান কুঠির ওপরে আপনার এত কিসের টান ভেবে পাচ্ছিলেন না।…আপনার ভালই লাগছে তাহলে?

ঠাট্টাটা অমিত ঘোষের মারফৎ এখানেও পৌঁচেছে বোঝা গেল। ধীরাপদ নির্লিপ্ত উত্তর দিল, কাজের জন্যে ক’টা দিন এসে থাকা, এর মধ্যে লাগালাগির কি আছে—

কাজ শেষ হলে ওই বাড়িতেই ফিরে যাবেন আবার?

ধীরাপদ মাথা নাড়ল, যাবে।

লাবণ্য ঘুরে বসেছে একটু।—ওই বাড়িটার ওপর আপনার সত্যিই যে ভয়ানক মায়া! কেন বলুন তো?

ধারাপদ শান্তমুখেই ফিরে তাকালো এবার, পার্শ্ববর্তিনীর মুখের চাপা কৌতুকচ্ছটা নিরীক্ষণ করল দুই-এক মুহূর্ত। খুব সহজ সরল করে উত্তরটা দিল তারপর। বলল, সেখানে আমার সোনাবউদি আছে বলে।

এতটা অকপট উক্তি আশা করেনি হয়ত, লাবণ্যর কৌতুক-কটাক্ষ তার মুখের ওপর থমকালো একটু। –ও। আপনার পাশের ঘরের সেই বউদি সোনাবউদি।

হ্যাঁ। সহজতার নিজস্ব ভারী অদ্ভুত একটা শক্তি আছে। হৃষ্টচিত্তে ধীরাপদ তাই উপলব্ধি করছে।

লাবণ্য হেসে ফেলেও চট করে সামলে নিল।— তাহলে তাঁদের সুদ্ধ তুলে নিয়ে ভালো একটা বাড়ি দেখে উঠে আসুন না, ও-রকম জায়গায় পড়ে আছেন কেন?

ধীরাপদর মজাই লাগছে এখন। বলল, সোনাবউদিকে ইচ্ছেমত তুলে নিয়ে আসা যায় না।

লাবণ্য এখানেই থামত কিনা সন্দেহ। কিন্তু বাড়িটা এসে পড়ল, দোরগোড়ায় ভগ্নিপতি সর্বেশ্বরবাবু দাঁড়িয়ে। লাল গাড়ি দেখে একটু বিস্মিত হয়েছিলেন, কিন্তু ভিতরে লাবণ্যর সঙ্গে তেমন আশঙ্কাজনক কাউকে না দেখে ফর্সা ভারী মুখখানা আনন্দ-রসে ভরে উঠল। রোগীর কারণে চিকিৎসকের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন ভাবা কঠিন। একগাল হেসে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।

গাড়ি থেকে লাবণ্য ধীরাপদকে বলল, আমার বেশি দেরী হবে না, বসুন একটু—

সঙ্গে সঙ্গে ভগ্নিপতি সর্বেশ্বরবাবু এমন অবিবেচনার কথা শুনে হাঁসফাঁস করে উঠলেন একেবারে। –কি আশ্চর্য, উনি গাড়িতে বসে থাকবেন কেন? দু হাত জুড়ে ধীরাপদর উদ্দেশে বিগলিত হলেন, নমস্কার, আমি আপনাকে বিলক্ষণ চিনি, আপনি তো ধীরাপদবাবু, এসেছেন যখন পায়ের ধুলো দিয়ে যেতে হবে, এমন ভাগ্য কি রোজ হয়—

অনুরোধ এড়ানো গেল না, নামতে হল। অগত্যা লাবণ্য ভগ্নিপতির পরিচয় দিতে গেল, কিন্তু তার আগেই ধীরাপদ বাধা দিল, আমিও ওঁকে চিনি, উনি সর্বেশ্বরবাবু –আপনার ভগ্নিপতি।

সর্বেশ্বরবাবুর মুখ দেখে মনে হবে তিনি ধন্য হয়ে গেলেন। দরজার দিকে পা বাড়িয়ে লাবণ্য হঠাৎ ঈষৎ গম্ভীর। জিজ্ঞাসা করল, আপনি ওঁকে চিনলেন কি করে? মেডিক্যাল হোমে দেখেছি, অসুখ-বিসুখের খবর নিয়ে মাঝে মাঝে যেতেন— সর্বেশ্বরবাবু সবিনয়ে জবাবদিহি করলেন, ছেলেপুলের বাড়ি, একটা না একটা লেগেই আছে, ও-ই তো ভরসা–

ভরসার পাত্রটি ব্যাগ হাতে আগে আগে ঘরে ঢুকল। কোণের দিকের একটা টেবিলে বছর পনেরোর একটি রোগা মেয়ে পড়াশুনা করছিল। মুখ তুলে সকলকে দেখল একবার, তারপর বইয়ের দিকে মুখ নামালো।

কি রে, খুব পড়ছিস? সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে যেতে যেতে লাবণ্য বলে গেল।

মেয়েটি চুপচাপ আবার মুখ তুলল। দেখল। তারপর নিরাসক্ত দুই চোখ বইয়ের ওপর নামিয়ে আনল। ধীরাপদর অনুমান, মেয়েটি সর্বেশ্বরবাবুরই। আর অনুমান মাসির আগমনে আর যে-ই খুশি হোক, এই মেয়েটি অন্তত হয়নি।

সর্বেশ্বরবাবু পাশের ঘরটিতে এনে বসালেন তাকে। বসুন, আমি একটু ওদিকটা দেখে আসি কি হল—ছেলেটা দু দিন দাঁতে কাটেনি কিছু—

অনুমতি লাভ করে হস্তদন্ত হয়ে ভিতরে চলে গেলেন। ধীরাপদ হাসছে মৃদু: মৃদু। ঘরের চারদিকে দেখল একবার, দেয়ালের ছোট খোপে লাল গণেশমূর্তি, সামনে ছোট রেকাবির বাতাসা কটা পিঁপড়েয় ছেকে আছে। পাশেই দেয়ালে কড়ি-গাঁথা গোবরছাপ। এধারের একটা বড় তাকে অনেকগুলো বই ঠাসা—মাঝে মাঝে দুই-একটা নতুন বইও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কি বই দেখার জন্য ধীরাপদ উঠে এলো।

শরৎবাবুর উপন্যাস গোটাকতক, কাগজের পুরু মলাট দেওয়া কয়েক বছরের পুরনো পঞ্জিকা, ছোটদের আধছেঁড়া কতকগুলো রোমাঞ্চকর বই, আর ধর্মগ্রন্থ কয়েকটা। এরই ভিতর থেকে একখানা চেনা বই ধীরাপদর হাতে উঠে এলো। রমণী পণ্ডিতের লেখা দে-বাবুর দোকানের সেই জ্যোতিষের বই, যা পড়তে অতি অজ্ঞজনেরও ব্যক্তিগত ভূত-ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ হতে পারে।

ব্যস্তসমস্ত ভাবে সর্বেশ্বরবাবু এদিকে অতিথি সম্বর্ধনায় এলেন আবার। ছেলে মাসির সামনে বসে দিব্বি খাচ্ছে এখন, উৎফুল্ল মুখে সেই সমাচার ব্যক্ত করলেন। অতিথির হাতে জ্যোতিষের বই দেখে লজ্জাও পেলেন একটু। বললেন, ওই একটু-আধটু নেড়েচেড়ে দেখি আর কি, বল-ভরসা পাওয়া যায়…বইটা বড় ভালো, জানতে বুঝতে কষ্ট হয় না, খুব গুণী লোকের লেখা মনে হয়। ওই বইটাই বার করেছেন, আপনার ও এসবে বিশ্বাস আছে নাকি?

আছে বললে খুশি হবার কথা, মানুষ সব সময়েই দুর্বলতার দোসর খোঁজে। বলল, বিশ্বাস না থাকার কি আছে, এক রকমের বিজ্ঞাপনই তো—

সমর্থন পেয়ে সাগ্রহে কাছে এগিয়ে এলেন তিনি, আপনি চর্চা করেছেন? কিছু জানেন নিশ্চয়?

জানে বললে তক্ষুনি কোষ্ঠী আনতে ছুটতেন হয়ত, হাতখানা অন্তত বাড়িয়ে দিতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দশ মিনিটের মধ্যে বার তিন-চার এ ঘরে আর ভিতরের ঘরে ছোটাছুটি করলেন সর্বেশ্বরবাবু। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও অতিথিকে একটু মিষ্টিমুখ করানো গেল না বলে গভীর মনস্তাপ। মাঝে চিকিৎসার ব্যাপারে শ্যালিকার হাতযশের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলেন। ডাক্তার তো কলকাতার পথে-ঘাটে কতই দেখা যায়, কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ালে রোগ পালায় এমন ডাক্তার ক’টা মেলে? কতবার যে বলেছেন আর এখনো বলছেন, বিলেত চলে যাও, আরো জেনে এসো আরো শিখে এসো, খরচপত্রের জন্যে ভাবনা নেই—কিন্তু কি যে এক চাকরির মোহে পেয়ে বসেছে উনি ভেবে পান না—ডাক্তারী কাজ স্বাধীন কাজ, কি বলেন? গোলামী করতে যাব কেন? তাছাড়া বড়লোকের, ইয়ে–

খেদের মুখে সামলে নিয়ে তাকেই সালিশ মেনেছেন, আপনিই বলুন, এতখানি উঠে থেমে থাকতে আছে?

হাসি চেপে ধীরাপদ সায় দিয়েছে। না দিয়ে উপায় কি, ধীরাপদর মত মহাশয় ব্যক্তিও আর হয় না নাকি। তার সম্বন্ধেও যে অনেক প্রশংসা শুনেছেন সর্বেশ্বরবাবু, আজ স্বচক্ষে দেখলেন। মহা সৌভাগ্য তাঁর। এমন মাননীয় অতিথি শুধুমুখে ফিরে যাচ্ছেন, আর একদিন কি পায়ের ধুলোর সৌভাগ্য হবে তাঁর? ধীরাপদ আশ্বাস দিয়েছে, হবে। গাড়িতে বসে ভাবছিল, তার সম্বন্ধে কি এত প্রশংসা শুনলেন…কোন ব্যাপারে তাঁকে ভরসা দেবার জন্যে অত প্রশংসা করা দরকার হল রমেন হালদারের?

লাবণ্যর মুখখানা আগের মত অত হালকা সরস লাগছে না আর, ভগ্নিপতি তাকেও এভাবে গাড়ি থেকে টেনে নামাবেন ভাবেনি হয়ত। তাঁর সঙ্গে ধীরাপদর কথা কি হয়েছে লাবণ্য জানে না, কিন্তু ভগ্নিপতির কথার ধাঁচ জানে নিশ্চয়।

ধীরাপদও এবারে বলার মত পেয়েছে কিছু। বলল, বেশ অমায়িক ভদ্রলোক …আর, আপনার ভারী গুণমুগ্ধ দেখলাম।

লাবণ্য ফিরে তাকালো, কতটা দেখেছে অনুমানের চেষ্টা। পরিহাসের সম্ভাবনা এড়ানোর জন্যে ঈষৎ গম্ভীর কৃতজ্ঞতার সুরে জবাব দিল, উনি না থাকলে আমার ডাক্তার হওয়া হত না।

ধীরাপদ জানে। আরো কিছু শোনা যেতে পারে ভেবে না জানার ভান করল। কিন্তু পার্শ্ববর্তিনী এ প্রসঙ্গে আর বেশি এগোতে রাজি নয় দেখে মন্তব্য করল, বেচারার বড় দুর্ভোগ হত তাহলে, কলকাতা শহরে আপনি ছাড়া আর দ্বিতীয় ডাক্তার আছে ভাবতে পারেন না। সবটা প্রশংসা শোনার সময় হল না আজ, আর একদিন আসব বলে এসেছি।

ভ্রুকুটি করে লাবণ্য একরকম ঘুরেই বসল তার দিকে। মাঝের ফাঁকটুকু অনেকটা ঘুচে গেল। হাসিমুখে তর্জন করল, না, আপনাকে আর আসতে হবে না।

ধীরাপদ এটুকুতেই সচেতন। আর সরে বসার জায়গা নেই। ঘাড় ফিরিয়ে রাস্তা দেখতে লাগল সে।

কিন্তু এই লঘু ভ্রুভঙ্গির ফাঁকে মনের মত আর এক প্রসঙ্গে পাড়ি দেবার সুযোগ পেল লাবণ্য সরকার। ছদ্মকোপে অনুযোগ করল, সেদিন আপনাদের কুঠির সেই বুড়ো ভদ্রলোককে দেখতে গিয়ে আপনার বড়দির…সরি, আপনার সোনাবউদির কাছে আপনার নিন্দা করেছিলাম, আপনি লোক ভালো নন, ফাঁক পেলেই খোঁচা দিয়ে কথা বলেন। শুনে তিনি আপনার পক্ষ নিলেন। সাধ করে খোঁচা খেতে না গেলে আপনি নাকি নির্বিলিক ভালো মানুষ। আসলে আপনার স্বভাবটি আপনার সোনাবউদিও জানেন না।

সোনাবউদি বলেছিলেন নালিশ করতে এসেছিল। ফিরে যে জব্দ করেছেন তা বলেননি। ধীরাপদ সহজভাবেই হাসতে চেষ্টা করল একটু, তারপর রাস্তার দিকে চোখ ফেরালো।

…আজ সে বিশেষ একটা সঙ্কল্প নিয়ে বেরিয়েছে এটাই সত্যি আর কিছু সত্যি নয়। লাল গাড়িতে পাশাপাশি বসাও নয়, আর রমণী-মুখের এই অন্তরঙ্গতাও নয়। এই পথে আলাপ এগোলো না দেখেও লাবণ্য চুপচাপ বসে থাকল না। তাছাড়া কই আপনি মুখ বুজে বসে থাকাটা কেমন অস্বস্তিকরও। খানিক বাদে জিজ্ঞাসা করল, তো আমার ওখানে আর একদিনও এলেন না, মেয়েটা মুখে না বললেও সেই থেকে আপনার আশায় দিন গুনছে।

এই কদিনের মধ্যে কাঞ্চনকে আর একদিনও মনে পড়েনি সত্য কথাই। অথচ মনে পড়া উচিত ছিল। জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছে এখন?

ভালই আছে…তবে ভালো থাকতে চায় না বোধ হয়। বিশদ করে কিছু আর না বললেও চলত, তবু লাবণ্য আরো একটু খোলাখুলি ব্যক্ত করল সমস্যাটা।—ভালো হয়ে ছাড়া পেলেই তো আবার সেই একই ভাবনা, কোথায় যাবে, কি করবে। নইলে এ কদিনে আরো অনেকটাই সেরে ওঠার কথা। অমিতবাবুর কাছে ভরসা পেয়ে ইদানীং কিছুটা অবশ্য ঠাণ্ডা হয়েছে, তাহলেও আসল ভরসাটা আপনার কাছ থেকেই চায় বোধ হয়।

আমি আর কি আশা দিতে পারি?

আপনিই পারেন। অমিতবাবুকে কি কিছু বিশ্বাস আছে, দরদে মোচড় পড়লে এমন আশাই দিয়ে বসে থাকবেন যে দায় সামলানো মুশকিল। সত্যিই আসুন একদিন, এলে মেয়েটার মনের দিক থেকে কাজ হবে মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে আবার উজ্জ্বল দেখালো তাকে, বলল, আর আমার মুখদর্শনে যদি খুব আপত্তি থাকে আপনার, যেদিন যাবেন আগে থাকতে বলবেন, আমি না হয় থাকব না।

গাড়িটা যেন ধীরাপদর মনের মত চলছে না।

…আজ সে বিশেষ একটা সঙ্কল্প নিয়ে বেরিয়েছে সেটাই সত্যি, আর কিছু সত্যি নয়। লাল গাড়িতে পাশাপাশি বসাও নয়, রমণী-মুখের এই অন্তরঙ্গতাও নয়।

অণিমা লঘিমা ব্যাপ্তি প্রাকাম্য মহিমা ঈশিত্ব বশিত্ব কামাবসায়িতা—যোগলব্ধ এই আট ঐশ্বর্যের নাম বিভূতি।

সপ্তাহের খবরের কর্ণধার লাবণ্যর দাদা বিভূতি সরকারের মধ্যে এর সব ক’টা না হোক, গোটাকতক ঐশ্বর্য অন্তত একদিনের আলাপেই ধারাপদ আবিষ্কার করেছে। লম্বা রোগা ফর্সা—পাশাপাশি দেখলেও এই বোনের অগ্রজ কেউ বলবে না। যোগলব্ধ আট ঐশ্বর্যের অনেকগুলি খাঁজ তার ফর্সা মুখে দাগ কেটে বসেছে। দেখা এবং খানিকক্ষণ আলাপের পরেই মনে হয়, এই লোককে এড়ানো ভালো।

অতি অমায়িক, মিষ্টভাষী। তাঁর কাগজের মতো এমন একটা তুচ্ছ কাগজকে মনে রাখা অনুগ্রহেরই নামান্তর নাকি। বললেন, সকলের এই সহৃদয়তাটুকুই ভরসা তাঁর-সর্বত্র এই ভরসা পাচ্ছেন তাই টিকে আছেন। তাঁকে ভালোবাসেন বলেই বড় বড় রথী-মহারথীরা আর বড় বড় প্রতিষ্ঠানের হোমরাচোমরা ব্যক্তিরা মাঝেসাঝে আসেন ভাঁর কাছে, নইলে এ রকম একটা ছোট কাগজের কেই বা পরোয়া করে।

আলাপের দ্বিতীয় পর্যায়ে চীফ কেমিস্ট অমিতাভ ঘোষের টানা প্রশংসার ফাঁকে নিজের ঈশিত্ব আর বশিত্বের প্রভাব আরো স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। অমিতাভ ঘোষের মত এমন খাঁটি অথচ অত দরাজ অন্তঃকরণের মানুষ তিনি বেশি দেখেননি। এক- একবার এসে পাতা-ভর বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছেন, দু-চার-ছ মাসের পর্যন্ত টানা কনট্রাক্ট করে গেছেন।… প্রীতির টানেই হামেশা আসতেন তিনি, সাহায্য করতেন, নইলে মিস্টার ঘোষের মত মানুষের এই নগণ্য কাগজকে সমীহ করার তো কিছু নেই।

তাঁর মত মানুষও যে সমীহ করতেন প্রকারান্তরে সেটাই জানিয়ে দিলেন। আলাপের তৃতীয় পর্যায়ে চাপা খেদ এবং অনুযোগ।…অমিতাভ ঘোষের পরে স্মরণ কিছুটা সিতাংশু মিত্রও রেখেছিলেন। বোনের সঙ্গে তিনিও আসতেন মাঝেসাঝে, এটা-সেটা পাঠাতেন। কিন্তু ইদানীং কিছুকাল ধরে কেন যে অনুগ্রহ থেকে একেবারে বঞ্চিত হয়ে আছেন জানেন না। অন্য সব কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোয়, নোটিশ বেরোয় —তিনি দেখেন শুধু, কি আর করবেন। তবে আজ জেনারেল সুপারভাইজার ধীরাপদবাবু স্বয়ং এসেছেন তাঁর ভাগ্য — মহা ভাগ্য।

দাদাটি বয়সে অনেক বড় হলেও লাবণ্যর সহজভাবে কিছু বলে বসতে খুব বাধে না দেখল। দাদার আলাপের ধরন-ধারণ কানে তারও খুব সরল ঠেকছিল না হয়ত। লঘু গাম্ভীর্যে বলল, দেখো দাদা, ধীরুবাবু ভালো মানুষ হলেও ভয়ানক রগচটা লোক কিন্তু। ওঁর যদি একবার মনে হয় আজকাল বিজ্ঞাপন পাচ্ছ না বলে ওঁকে ঠেস দিচ্ছ, তাহলে আর কোনোদিন উনি এমুখো হবেন না বলে দিলাম। ওসব সাংবাদিক বিনয়ের প্যাঁচ রেখে সোজাসুজি বলো, তাতে বরং কাজ হবে।

বোনের ওপর মনে মনে চটলেও বিভূতি সরকার আকাশ থেকে পড়লেন একেবারে।—সে কি! আপনি অসন্তুষ্ট হলেন নাকি? আমি সত্যিই কিছু মনে করে বলিনি, অনেকদিনের যোগাযোগ আপনাদের সঙ্গে, তাই বলছিলাম — আপনি কিছু মনে করেননি তো?

ধীরাপদ হাসিমুখে আশ্বস্ত করল তাঁকে, না, আমি কিছু মনে করিনি, তাছাড়া আমি রগচটা লোকও নই—মাঝে আপনার বিজ্ঞাপন বন্ধ ছিল তার জন্যে ইনিই দায়ী। একসঙ্গে অনেকগুলো ঝামেলা নিয়ে পড়েছি, তার মধ্যে ইনিও আপনার কথা কোনদিন বলেননি আমাকে সেদিন বলেছেন, আজ এসেছি।

বোনের মুখের ওপর দৃষ্টিটা একবার বুলিয়ে নিলেন বিভূতি সরকার। সে দৃষ্টি মিষ্টি নয় খুব। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে বোনের নিস্পৃহতা খুব অবিশ্বাস্য নয়। বললেন, আপনার মত ও-ও অনেক ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ত, ছাপোষা দাদার কথা ভাবার সময় হয় না।

কিন্তু বিজ্ঞাপন পেয়ে ক্ষোভ গেছে বোঝা গেল। যতটা দেবে ধীরাপদ মনস্থ করে এসেছিল তার তিনগুণ দিল। এক দিন অন্তর অন্তর তিন দিনের ভরাপাতা স্পেস বুক করল। উৎসবে স্বয়ং যোগদানের জন্য এবং উৎসব-অন্তে ছবিসহ সহৃদয় বিবৃতি ছাপানোর জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করল। পকেট থেকে চেকবই বার করে খসখস করে অগ্রিম টাকার মোটা অঙ্ক বসিয়ে দিল।

লাবণ্য সরকার চকিত দৃষ্টিনিক্ষেপ করল একটা, ম্যানেজিং ডাইরেক্টার হিমাংশু মিত্রের সই করা চেক। শূন্য চেক সই করে দিয়েছেন বড় সাহেব একটা নয়, কয়েকটাই। সপ্তাহের খবরের অফিস থেকে বেরিয়ে লাবণ্য সানন্দে মন্তব্য করল, দাদা এবারে আপনার হাতের মুঠোয়। সুর বদলালো তারপরেই, আপনি তখন ভালোমানুষের মত সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাতে গেলেন কেন? দাদা ঠিক ভেবেছেন আমার সত্যিই কোন গরজ নেই!

গরজ আছে?

না থাকলে আপনাকে নিয়ে এলাম কেন?

আমি ভেবেছিলাম, ভয়ে–।

লাবণ্য প্রায় অবাক। — ভয় কিসের?

পাছে রেগে গিয়ে কাগজে বেফাস কিছু লিখে বসে আপনাকে অপ্রস্তুত করেন–

লাবণ্য হাসতে লাগল। – মিথ্যে বলেননি। দাদাটি লোক খুব সহজ নন। কিন্তু আপনিও তো কম নন দেখি, জেনে-শুনে ও কথা বলে এলেন। এমনিতেই তাঁর ধারণা আমি কিছু ভাবি না তাঁর জন্যে, এরপর হাতের কাছে না পেলেও দশবার টেলিফোনে অনুযোগ করবেন।

দুজনের মাঝের ব্যবধান আরো একটু কমেছে, সেটা লাবণ্য খেয়াল না করলেও ধীরাপদ করেছে। পশ্চিমা ড্রাইভারকে এবারের গন্তব্যস্থানের নির্দেশ দিয়ে রাস্তার দিকে চোখ ফেরালো সে।

যে বিশেষ সঙ্কল্প নিয়ে বেরিয়েছে আজ, সেই উদ্দেশ্যেই চলল এখন। সেটাই আসল। সেটাই সত্যি। আর কিছু সত্যি নয়, লাল গাড়িতে পাশাপাশি বসাও নয়, আর রমণী-মুখের এই অন্তরঙ্গতাও নয়। 

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খ্যাতনামা ইংরেজি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধারের ঘর থেকে কাজ সেরে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে লাবণ্যর মনে যে খটকা লেগেছে ধীরাপদ সেটা অনুমান করতে পারে। গাড়িতে বসেও সে ফিরে ফিরে দেখছে ওকে। শুধুই সঙ্গলাভের আকর্ষণে বড় সাহেবের লাল গাড়িতে টেনে আনেনি তাকে এ রকম একটা সন্দেহ মনে এসেছে বোধ হয়। পকেট থেকে নোটবই বার করে ধীরাপদ গভীর মনোনিবেশে হিসেবে দেখছে কি একটা। আসলে কিছুই দেখছে না, পার্শ্ববর্তিনীর নীরব অস্বস্তি উপলব্ধি করছে।

এই কাগজের অফিসটায় অন্তত তার সঙ্কল্পমত কাজ হয়েছে। বিদেশী সাংবাদিক অফিসারটির কাছে কোম্পানীর মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার মিস লাবণ্য সরকারকে সামনে এগিয়ে দিয়েছে ধীরাপদ। সে শুধু বিজ্ঞাপন বুক করে টাকার অঙ্ক বসিয়ে চেকটা পেশ করে দিয়েছে। তার নীরবতার ফলে আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা, কার্ড দিয়ে সনির্বন্ধ আমন্ত্রণ জানানো, উৎসবের বিবৃতি নেবার জন্য রিপোর্টার পাঠানোর আবেদন, আর সবশেষে তাদের আদর্শ শিল্প-প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সংবাদপত্রের দরদী সহযোগিতা প্রার্থনা —এই সব কিছুই লাবণ্য করেছে। মনে মনে যেমন আশা করেছিল ধীরাপদ, সেই রকম করেই করেছে। ইচ্ছে করে বা চেষ্টা করে কিছুই করতে হয়নি। এসব কাজে এই মুখে পরিপুষ্ট মাধুর্য আপনি ঝরে।

সাংবাদিক অফিসার খাতির করেছেন এবং প্রত্যাশিত আনুকূল্যের আশ্বাসও দিয়েছেন।

লাবণ্যর প্রথমে হয়ত মনে হয়েছিল, বিদেশী অফিসারের সঙ্গে ইংরেজি বাকপটুতার প্রয়োজনে তাকে সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গাড়িতে বসে সে রকম লাগছে না। লাগছে না যে ধীরাপদ সেটা তার দিকে না তাকিয়ে অনুভব করতে পারছে।

দ্বিতীয় নামকরা খবরের কাগজের অফিসে এসে লাবণ্যর খটকা একেবারে গেল। তাকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য স্পষ্ট বুঝেছে। এটি বাঙালীর প্রতিষ্ঠান, কর্তা-ব্যক্তিটিও আধবয়সী বাঙালী। গণুদাদের অফিসের মত ইংরেজি বাংলা দুটো নামকরা কাগজ বেরোয় এখান থেকেও। ধীরাপদ স্লিপ পাঠালো শুধু মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার মিস লাবণ্য সরকারের নামে। লাবণ্য লক্ষ্য করল সেটা, কিন্তু কিছু বলার আগেই বেয়ারা সেলাম ঠুকে ভিতরে যেতে বলল। কর্তাব্যক্তিটি সাদর আপ্যায়নে বসালেন তাদের।

তাদের ঠিক নয়, যার নামে স্লিপ বিশেষ করে তাকেই। এখানেও ধীরাপদর ভূমিকা সামান্য কর্মচারীর মতই। অধীনস্থ অনুচরের মত। যেন বিজ্ঞাপনের ডামি বহন করা আর টাকার অঙ্ক লিখে সই করা চেক ছিঁড়ে দেওয়ার নগণ্য কাজ দুটোর জন্যেই কর্ত্রীর সঙ্গে এসেছে। এই দুটো কাজের পর স্বয়ং মেডিক্যাল অ্যাডভাইসারের আগমনের উদ্দেশ্যটি ব্যক্ত করে মুখ বুজেছে সে।

কর্তাস্থানীয় ভদ্রলোকটি লাবণ্যর দিকে রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে সবিনয় আন্তরিকতায় জিজ্ঞাসা করেছেন, আমরা কি করতে পারি বলুন–

অগত্যা লাবণ্য বলেছে তাঁরা কি করতে পারেন। ভদ্রলোক সাগ্রহে শুনেছেন। মাঝে বেল টিপে বেয়ারাকে তিন পেয়ালা চা দিয়ে যেতে বলেছেন। আর সবশেষে সর্বাঙ্গীন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নিজে তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে যাবেন, রিপোর্টার পাঠাবেন। তাঁদের দুটো কাগজের দ্বারা যতটা প্রচার সম্ভব সেটা তিনি নিজে দেখবেন সেই নিশ্চিত আশ্বাসও মিলেছে।

এবারে লাল গাড়ি ছুটেছে গণুদার কাগজ দুটোর অফিসের দিকে। লাবণ্য সরকার গম্ভীর। দুজনের মাঝের ফাঁক এবারে বিস্তৃত হয়েছে। ধীরাপদর অস্বাভাবিক লাগছে না কিছু। মুখ ফুটে অনুরোধ করতে ওকে খুশি করার জন্য খুশি হয়েই লাবণ্য সঙ্গিনী হয়েছিল। এই বিনিময়টুকুই অনুগ্রহের মত ভেবেছিল। কিন্তু তার বদলে কেউ যদি তাকে টোপের মত ব্যবহার করেছে মনে হয়, তার প্রতিক্রিয়াও স্বাভাবিক।

আপনি এসব কাজে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন কেন?

এ রকম একটা বোঝাপড়ার জন্যে ধীরাপদ মনে মনে হয়ত প্রস্তুতই ছিল। তেমন বিস্মিত বা বিচলিত দেখা গেল না তাকে। সহজভাবেই ঘাড় ফেরালো, কেন, কি হল…

লাবণ্যর তপ্ত দুই চোখ তার মুখের ওপর বিঁধে আছে— আমি জানতে চাই কি উদ্দেশ্যে আপনি আমাকে সঙ্গে এনেছেন?

নরম কৈফিয়তের আড়ালে আত্মগোপন করার অভিলাষ নেই ধীরাপদরও। আর এই স্পষ্টতার মুখোমুখি সে চেষ্টাও নিরর্থক। তেমনি নির্বিকার মুখেই উল্টে প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয়?

রাগে অপমানে লাবণ্যর মুখে কথা সরল না কয়েক মুহূর্ত।— আপনি জবাব দেবেন কিনা?

ধীরাপদ জবাব দিল। বলল, কাজের খানিকটা সুবিধে হয় বলে–

কি সুবিধে?

যে সুবিধেটা কোম্পানির আপাতত দরকার। কাগজের অফিসের ভদ্রলোকেরা আমাদের মত লোকের আরজি হামেশা শোনেন বলে অভটা আমল দেন না, সে তুলনায় ভদ্রমহিলাদের বরং কিছুটা মান্যগণ্য করেন এই সুবিধে।

লাবণ্য চেয়ে চেয়ে দেখছে। দেখার ভাপে সমস্ত মুখটা ঝলসে দিতে চাইছে। -নিজের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে এ রকম সুবিধে নেবার পরামর্শটাও বড় সাহেবই আপনাকে দিয়েছেন বোধ হয়?

না সুবিধে যে হয় সেটা আমি নিজেই দেখেছি। ধীরাপদ রয়েসয়ে কিছু একটা তথ্য বিশ্লেষণ করছে যেন।—অনেক দিন আগে বড় সাহেবের সঙ্গে আপনি একবার একটা ওষুধের ড্রাগ-লাইসেন্সের তাগিদে এসেছিলেন। সুবিধে হয়েছিল। দু মাসের মধ্যে যার স্যাম্পল টেস্ট হয়নি সেটা সাত দিনে বেরিয়ে এসেছিল।

লাবণ্য চেয়ে আছে। দেখছে।—ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলুন, আমি নেমে যাব। অবাঙালী ড্রাইভার এতক্ষণের গরম হাওয়া টের পাচ্ছিল কিনা সে-ই জানে। এবার যে টের পেয়েছে স্পষ্টই বোঝা গেল। ঈষৎ উচ্চ-কঠিন কণ্ঠস্বর কানে আসতে কিছু একটা নির্দেশের সম্ভাবনায় ঘাড় ফেরাল।

ইঙ্গিতে ধীরাপদ চালাতেই বলল তাকে।

তারপর শান্তমুখে অগ্নিমূর্তির সম্মুখীন হল। বড় সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, আপনার সেই ড্রাগ-লাইসেন্স বার করার থেকেও সম্প্রতি এই প্রচারের ব্যবস্থা করাটা বেশি জরুরী। সামনের বারে অল ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ইলেকশানে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। কোম্পানীর সুনাম আর যশ এখন থেকে সব কাগজে কাগজে ছড়ানো দরকার। এ ব্যাপারটা আপনি একটু সহজভাবে দেখলে আর কোনো গণ্ডগোল থাকে না।

উপদেশমত কতটা সহজভাবে দেখল, ধীরাপদ সেটা আর ফিরে দেখল না। গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দরজা খুলে নেবে দাঁড়াল। —আসুন।

আবারও লাবণ্য সরকার নীরবে তার মুখের ওপর আগুন ছড়ালো একপ্রস্থ। কিন্তু না নেমে পথ নেই, লোকটা দাঁড়িয়েই থাকবে, আর ড্রাইভার ঘাড় না ফিরিয়েও বসে বসে অবাক হবে।

এবারের কর্তা-ব্যক্তিটির কাছে ধাঁরাপদ ঠিক আর আগের মত এগিয়ে দিল না তাকে। যা বলার নিজেই বলল। তাছাড়া অমিতাভ ঘোষের পরিচয় দিল। এই ভদ্রলোকই তার সেই বন্ধু—গণুদাদের দণ্ডমুণ্ডের মালিক। পরিচয়ের ফলে, মোটা বিজ্ঞাপন-প্রাপ্তির ফলে আর ধীরাপদ নিঃসংশয়–লাবণ্য সরকারের প্রায় নির্বাক উপস্থিতির ফলেও, আগের ক-জায়গার মতই এখানকারও অনুকূল সহযোগিতার নিশ্চিত আশ্বাস মিলল।

ধীরাপদর নির্দেশে লাল গাড়ি অফিসের দিকে ছুটেছে এবারে।

লাবণ্য বাঁয়ের রাস্তা দেখছে।

ধীরাপদ ডাইনের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *