পনের
রমণী পণ্ডিতের কোণা ধরে নয়, তার একটু আগে শকুনি ভটচায আর একাদশী শিকদারের দাওয়ার মাঝামাঝি একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে জনাকতক লোক প্রায় নিঃশব্দে জটলা করছে মনে হল। শিকদার মশাই আর রমণী পণ্ডিতও আছেন।
এদিকের ঘরের দরজা দিয়ে আধখানা পিঠ আর গলা বার করে গণুদার বড় মেয়ে কিছু একটা রসাস্বাদনের চেষ্টায় সেইদিকে চেয়ে ঝুঁকে আছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ে ধীরাপদও ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করল। এত দূর থেকে অনুমান করা গেল না। ঘরের তালা খুলতে খুলতে মেয়েটার তন্ময়তা ভঙ্গ করল, উমারাণীর লুকিয়ে লুকিয়ে কি দেখা হচ্ছে?
উমা চমকে ঘাড় ফেরাল, তারপর ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দাঁড়াল।—ও, ধীরুকা তুমি…আজ এত সকাল সকাল চলে এলে যে?
খট করে যেন সোনাবউদির গলার স্বরটা কানে লাগল তার। ধীরাপদ মনে মনে অবাক, এই মেয়েও ওই রকমই হবে নাকি? বলল, তোর জন্যেই তো, আয়—
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। এক কোণে হ্যারিকেনের আলো ‘ডিম’ করা। টান করে বিছানা পাতা। দেয়ালের ধারে তার রাতের খাবার ঢাকা। এরই মধ্যে সোনাবউদি খাবার ঢেকে রেখে গেছে ভাবেনি। দিনের বেলায় অফিসে লাঞ্চ খায়, রাতে এই ব্যবস্থা। অসুখের পর থেকে এই রকম চলছে। গণুদার মত সোনাবউদি কোনো প্রস্তাবও করেনি, অনুমতিও নেয়নি। ঘরের দুটো চাবির একটা চাবিও সেই থেকে তার কাছেই। খাবারটা আগে ঢেকে রাখত না, ধীরাপদর সাড়া পেলে দিয়ে যেত। কিন্তু ফিরতে আজকাল রাত হচ্ছে বলে ও নিজেই জোরজার করে এই ব্যবস্থা করেছে। ভয় দেখিয়েছে, এই ব্যবস্থা না হলে সে বাইরে থেকে খেয়ে আসবে।
সোনাবউদি রাজী হয়েছে, কিন্তু ফোড়ন দিতে ছাড়েনি। বলেছে, যে মুখ দেখে আসেন তার পর আর আমার মুখ দেখতেও ইচ্ছে করে না সেটা বেশ বুঝেছি। এমন কি রাতের আহারের দরুন ধীরাপদ এ পর্যন্ত কিছু টাকাও তার হাতে দিয়ে উঠতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল একদিন, একটা খামে টাকা পুরে এগিয়ে দিয়েছিল, এটা রাখুন—
হাত না বাড়িয়ে সোনাবউদি খামটা চেয়ে দেখেছে, তারপর ছদ্ম আগ্রহে জিজ্ঞাসা করেছে, কি আছে ওতে, গোপন পত্ৰটত্র কিছু?
ধীরাপদ হেসে ফেলেছিল।
কি আছে, টাকা?
বাঃ, দিতে হবে না? ধীরাপদ জোর ফলাতে চেষ্টা করেছিল।
নিশ্চয় দিতে হবে, সোনাবউদি গম্ভীর, কত দিচ্ছেন?
বলে উঠতে পারেনি কত।
সোনাবউদি জবাবের অপেক্ষা করেনি, বলেছে, দাঁড়ান, হিসেব করি কত দিতে হবে। চারখানা রুটি ধরুন তিন আনা, আর মাছ-তরকারি যা জোটে বড় জোর সাত
আনা—মোট দশ আনা, তিরিশ দিনে তিনশ আনা। কত হল?
টাকা দিতে গিয়ে মনে মনে গালে চড় খেয়ে ক্ষান্ত হয়েছে ধীরাপদ। সোনাবউদি বলেছে, হিসেব যা হল আপনার কাছেই থাক আপাতত, দরকার মত চেয়ে নেব।
দরকার যে কোনদিনই হবে না সেটা ধীরাপদর থেকে ভালো আর কে জানে? মনে মনে দুঃখ হয়েছে একটু, ‘কিন্তু এ নিয়ে আর জোর করতে পারেনি কোনদিন। ছ’শ’ টাকা মাইনে গত বছরের মুখে সাড়ে সাত শ’য়ে দাঁড়িয়েছে—সামনের দশম বার্ষিকীর উৎসবে আরো বেশ মোটামুটি বাড়বে মনে হয়। কিন্তু হাত পেতে যে টাকা নিলে সব থেকে আনন্দ হত, সে হাত গুটিয়ে আছে বলেই অত টাকা এক-এক সময় বোঝার মত লাগে ধীরাপদর। ব্যাঙ্কে কম জমল না এ পর্যন্ত…
ঘরে ঢুকে জামাটা খুলে র্যাকে টাঙিয়ে রাখছিল, উমারাণী বিছানার এক ধারে বসতে বসতে গম্ভীর মুখে ব্যক্ত করল, বসে গল্প করার মত সময় বিশেষ নেই তার, কাল ইস্কুলের একগাদা পড়া বাকি।
ধীরাপদ অবাক, স্কুলে ভর্তি হয়েছিস? কবে?
উমারাণী ততোধিক অবাক। বা রে। সেই কবে তো, তুমি জান না পর্যন্ত। অনুযোগ- ভরা মন্তব্য, তুমি কি কিছু খবর রাখো আজকাল আমাদের, কেবল চাকরিই কাচ্চ—
সত্যিই খবর রাখে না। এমন কি উমার দিকে চেয়েও ধীরাপদর মনে হল, ও একটু বড় হয়েছে, মাথায় বেড়েছে, আগের থেকেও পাকাপোক্ত হয়েছে।
বিছানায় বসে ধীরাপদ উমারাণীরই মন যোগাতে চেষ্টা করল প্রথম। কোন্ স্কুলে পড়ছে, কোন্ ক্লাসে পড়ছে, স্কুলটা কোথায়, কখন যায়, কখন ফেরে, কি কি বই —যাবতীয় সমাচার। তার শোনার আগ্রহ থেকে উমারাণীর বলার আগ্রহ কম নয়, কিন্তু বইয়ের প্রসঙ্গে এসে বাবার বিরুদ্ধে তপ্ত অভিযোগ উমার।—বই অনেক—ইংরেজি বাংলা অঙ্ক ইতিহাস ভূগোল স্বাস্থ্য প্রকৃতিপাঠ অঙ্কন-প্রণালী—এর ওপর সব বিষয়ের একগাদা খাতা—কিন্তু আজ পর্যন্ত অর্ধেক বইখাতাও কেনা হয়নি তার, বাবা গত মাসে বলেছে এ মাসে কিনে দেবে, আর এ মাসে বলছে, সামনের মাসে হবে। ইস্কুলে দিদিরা ছাড়বে কেন? রোজই বকে প্রায়, এক-এক দিন ঘণ্টা ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে -কিন্তু বাবার হুঁশ নেই। বাড়িতে এসে বললে বাবার ওপর রাগ করে মা উল্টে ওর পিঠেই দুমদাম বসিয়ে দেয় কয়েক ঘা, বলে, ঝি-গিরি করগে যা, পড়তে হবে না।
দু চোখ পাকিয়ে যে ভাবে বলল উমারাণী, হেসে ফেলার উপক্রম। এইটুকু মেয়ের দুর্দশা ভেবে রাগও হয়। কিন্তু ধীরাপদ কিছু বলার আগে বলার মত আর একটা প্রসঙ্গ পেল উমারাণী। আর একটু কাছে ঘেঁষে ফিস-ফিসিয়ে বলল, মা আজকাল আরো কি ভীষণ রাগী হয়ে গেছে তুমি জানো না ধীরুকা— মুখের দিকে তাকালে পর্যন্ত খখরিয়ে কাঁপুনি —আর বাবার দিকে এমন করে চায় একেবারে যেন ভস্ম করে ফেলবে। এক- একদিন মনে হয় বাবাকেও বুঝি দু ঘা দেবে। আর বাবাটাও কেমন ভীতু হয়ে গেছে আজকাল, আগের মত ঝগড়া করার সাহস নেই, হয় মুখ বুজে থাকে নয় পালিয়ে যায়-
ধীরাপদ নির্বাক কয়েক মুহূর্ত। এইটুকু মেয়ে এই কথাগুলো শুধু শোনার দোসর হিসেবেই শোনাল না তাকে। বাবা-মায়ের বিবাদ কলহ অনেক দেখছে, কাঁচা মনে এর ছাপ পড়ার কথা নয়। কিন্তু পড়ছে, অশুভ ছায়া পড়ছে। কারণ না বুঝলেও এত বড় অসঙ্গতি ভিতরে ভিতরে ত্রাসের কারণ হয়েছে, পীড়ার কারণ হয়েছে। নইলে এই দুর্লভ অবকাশে ওই মেয়ের এতক্ষণে গল্পের বায়নায় অস্থির করে তোলার কথা তাকে।
ধীরাপদ উমারাণীর নিজস্ব সমস্যাটাই সমাধানের আশ্বাস দিল চট করে। বলল, আচ্ছা কাল সকালে তোর বুকলিস্ট আর খাতার লিস্ট আমাকে দিস-অফিস-ফেরত সব এসে যাবে, কেমন?
উমারাণী মহাখুশি।—সত্যি বলছ ধীরুকা?
ধীরাপদর চোখের কোণ দুটো শিরশির করে ওঠে কেন, আবারও মনে হয় কেন সে ঘর-ছাড়া হয়ে পড়েছিল। মাথা নাড়ল, সত্যি। মেয়েটার মন ফেরানোর জন্যেই তারপর জিজ্ঞাসা করল, তা উমারাণীর পড়াশুনোর এত চাপ সত্ত্বেও দরজায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে গলা বাড়িয়ে কি দেখা হচ্ছিল?
সঙ্গে সঙ্গে উমারাণী দু চোখ গোল করে তার কোল ঘেঁষে বসল প্রায়। একটা বিস্মৃত উত্তেজনা নতুন করে ফিরে এলো যেন।—ওমা, তুমি জান না বুঝি। ভচ্চাখ মশাই যে মর মর।
ধীরাপদর ভিতরটা ছ্যাঁত্ করে উঠল। উমারাণীর সাদামাঠা উক্তি থেকে যা বোঝা গেল তার মর্ম, বিকেলের দিকে কুয়োপাড়ে বসে কাশতে কাশতে ভটচায মশাই হঠাৎ দু হাতে বুক চেপে শুয়ে পড়েন, তারপর অজ্ঞান, তারপর মর মর।
ধীরাপদ তক্ষুনি উঠে গেছে খবর নিতে। দাওয়ার কাছে হ্যারিকেন জ্বলছে শুধু, বাইরে কেউ নেই। পায়ে পায়ে এগিয়ে দাওয়ার কাছে দাঁড়িয়েছে। আড়াআড়ি দরজা পর্যন্ত মস্ত একটা ছায়া পড়েছে, সেই ছায়া দেখেই হয়ত ভটচায মশাইয়ের বড় ছেলে বেরিয়ে এলেন। তাঁরও বয়েস হয়েছে। ধীরাপদর সঙ্গে এতকালের মধ্যে মৌখিক দু- চারটে কথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ।
খবর শুনল। জ্ঞান ফেরেনি। আর ফিরবে তেমন আশাও দেন না ডাক্তার। বিকেলে রমণী পণ্ডিতই ডাক্তার নিয়ে এসেছেন, তাঁরা দু ভাই রোজকার মত মফঃস্বলে স্কুল করতে চলে গিয়েছিলেন, রাতে এসে শুনেছেন। খুব উপকার করেছেন পণ্ডিতমশাই, ডাক্তারের জন্যে ছুটোছুটি করেছেন। ওষুধপত্র এনে দিয়েছেন। নামকরা ডাক্তার না হলেও এম. বি. পাস ডাক্তারই—তাঁরা বাড়ি ফিরে আবারও তাঁকে আনিয়েছিলেন, কিন্তু সময় ঘনালে ডাক্তার আর কি করবে…
ফিরে এসে ধীরাপদ চুপচাপ কদমতলার বেঞ্চ-এর কাছে দাঁড়িয়েছিল খানিকক্ষণ। ভদ্রলোকের জীবনী-শক্তি শুকিয়ে আসছে লক্ষ্য করছিল কিন্তু এত শীগগির শেষ ঘনাবে ভাবেনি। ইচ্ছে করেছিল ভিতরে গিয়ে দেখে একবার। বিব্রত করা হবে ভেবে বলতে পারেনি…সে এখন আর সুলতান কুঠির একজন নয়, গণ্যমান্য একজন। সেটা এখন আর এখানে ভুলতে পারে না কেউ। আলাপ থাক না থাক, ভট্টচার্য মশাইয়ের ছেলেও অতি সম্ভ্রমভরে কথাবার্তা কইলেন—অসুখের খবর নিতে গেছে তাইতেই কৃতজ্ঞ যেন। …. সুলতান কুঠির সঙ্গে ধীরাপদর নাড়ির যোগ গেছে, এখানে রমণী পণ্ডিত বরং আপনজন।
খাবারের ঢাকনা তুলে খেতে বসেও ধীরাপদ আশা করছিল সোনাবউদি আজ হয়তো আসবে একবার। মেয়ে এ ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছিল সেটা না জানার কথা নয়। কিন্তু সোনাবউদির ছায়াও দেখা গেল না। খেতে খেতে ধীরাপদ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সোনাবউদির এত অন্তর্দাহের হেতু প্রায় দুর্বোধ্য। মেয়েটার ওই বই ক’টাই বা এ পর্যন্ত কেনা হল না কেন? গণদার গাফিলতি না সংসারের টানাটানি? মাইনে তো আগের দ্বিগুণেরও বেশি পায় গণদা… মোটা টাকার লাইফ ইন্সিওরেন্স করেছে অবশ্য, আজ দিনকালও দিনে দিনে চড়েছে- আগুন দাম সব কিছুর! মেয়েটার বই না জোটার উৎপীড়ন বিঁধছে থেকে থেকে, বিনা মাসোহারায় এই রাতের আহার গলা দিয়ে নামতে চাইছে না।
খাওয়ার রুচি গেল। ধীরাপদর ঘর নেই। সোনাবউদির ওই ঘরের সে কেউ নয়। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল যখন, কদমতলার বেঞ্চিতে একাদশী শিকদারের দুখানা বাংলা কাগজ পড়া শেষ। কাগজ দুটো একপাশে সরিয়ে রেখে একা একা হুঁকো টানছেন। এতকালের ওই বেঞ্চির দোসর আর হুঁকোর দোসর চলতি, কিন্তু যতটা ম্রিয়মাণ দেখবে ভেবেছিল ভদ্রলোককে, ততটা মনে হল না।
রোগীর সকালের অবস্থা বলতে গিয়ে অনেকগুলো কথা বলে ফেললেন তিনি। অবস্থা একরকমই, জ্ঞান হয়নি, আর হবেও না, এবারে বোধ হয় যাবার ডাকই পড়ল। কাল অত রাতেও ধীরাপদ খবর নিতে ছুটে গিয়েছিল, সে কথাও শুনেছেন। ….সোনার টুকরো ছেলে, কারো বিপদ শুনলে সে কি ঘরে বসে থাকবে নাকি। না, শিকদার মশাই সেটা একটুও বেশি মনে করেননি। শুধু ভেবেছেন, দাদার জ্ঞান আর হবে না হয়ত, কিন্তু হলে শান্তি পেতেন একটু। সমস্ত জীবন তো কারোরই ভালো চোখে পড়ল না কিছু, যাবার সময় সকলের মুখই ভালো দেখে যেতে পারতেন।
শিকদার মশাই বসতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু ধীরাপদ কাগজ নিয়ে ঘরে চলে এলো।
স্নান করে রোজ সকাল নটার মধ্যে অফিসে বেরিয়ে পড়ে। নইলে বাস্-এ ভিড় হয়ে যায়। ধীরাপদ ডাক্তার আসার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু এদিকে সাড়ে নটা বাজতে চলন।
ইতিমধ্যে বার দুই ভট্টচার্য মশাইয়ের দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছে, ছেলেদের সঙ্গে দু-একটা কথাও হয়েছে। বড় কোনো ডাক্তার এনে দেখানোর কথাটা বলি বলি করেও বলে উঠতে পারেনি। শেষবারে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রমণী পণ্ডিতকে ও-ধারের দাওয়ায় দেখতে পেল। ধীরাপদ ঘরের তালা বন্ধ করছিল, পাশের ঘর থেকে গণুদা বেরুলো। রাতে কখন বাড়ি ফিরেছে ধীরাপদ টের পায়নি। এখন অফিসে চলেছে মনে হল।
মুখখানা শুকনো শুকনো। ধীরাপদকে দেখে থমকালো। বেরুবে নাকি…?
দেরি হবে একটু, আপনি যান। একসঙ্গে এগোবার ইচ্ছে ছিল হয়ত, পা বাড়িয়ে গণুদা দুই একবার ফিরে ফিরে দেখল ওকে। কিন্তু ধীরাপদ একেবারে বাজে কথা বলেনি, দেরি একটু হবে। রমণী পণ্ডিতের সঙ্গে কথা বলবে, ফিরে এসে উমার কাছ থেকে বুকলিস্ট চেয়ে নেবে। মেয়ে ভুলেই বসে আছে বোধ হয়।
কাছে এসে কথা বলার আগে পণ্ডিতের মুখের দিকে চেয়ে ধীরাপদ হঠাৎ চমকে উঠল। এই সুলতান কুঠির সঙ্গে সত্যিই কতদিন যোগ নেই তার। পণ্ডিতের কালো মুখে যেন কুড়ো উড়ছে, চোয়ালের হাড় উঁচিয়েছে, চোখ দুটো বসা, দেহ শীর্ণ হয়েছে। রমণী পণ্ডিত হঠাৎ যেন বুড়িয়ে গেছে। রোগীর বলার আগে ধীরাপদ তাঁর খবরই জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার অসুখ করেছিল নাকি?
রমণী পণ্ডিত উঠে দাঁড়ালেন। নিষ্প্রভ চোখে আশার আমেজ।—না, অসুখ আর কি…
অসুখ না হোক, শুনলে দুঃখের কথা শোনাতে পারেন কিছু। ধীরাপদ তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার তো এখনো এলেন না দেখছি।
পণ্ডিত ঠোঁট উল্টে দিলেন। —আসবেন। রাজঘরে এলেও প্রাপ্তিযোগ তো অর্ধেক, নিজের সময়মত আসবেন!
দ্বিধা কাটিয়ে ধীরাপদ বড় ডাক্তার এনে দেখানোর কথাটা তাঁকেই বলে গেল। ছেলেদের সঙ্গে আর ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখতে বলল, যদি দরকার মনে করেন তাঁরা, রমণী পণ্ডিত যেন তাকে টেলিফোনে জানিয়ে দেন- সে ব্যবস্থা করবে, আর ফীয়ের জন্যেও ভাবতে হবে না। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিসে থাকবে, তার মধ্যে যেন টেলিফোন করা হয়।
রমণী পণ্ডিত ঘাড় নাড়লেন। চোখে আশার আলো। যিনি যেতে বসেছেন তার প্রতি মমতা হৃদয়ের পরিচয় বটে। কিন্তু বাঁচার তাগিদে আধমরা হাল যার, সে কি একটুও অনুকম্পার যোগ্য নয়? ধীরাপদর মনে হল, সেই ব্যাকুলতাই এবারে প্রকাশ করে ফেলবেন তিনি।
অফিসের তাড়া দেখিয়ে পালিয়ে এলো।
গণুদার দরজার কাছে এসে উমাকে ডাকতে সে বেরিয়ে এলো। মুখখানা আমসি। বুকলিস্ট কই?
উমা কান্না চেপে মাথা নাড়ল শুধু। ধীরাপদ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝেছে, কিন্তু বুঝেও তেতে উঠল হঠাৎ।– কি হল, বই চাই না?
উমা সভয়ে ঘরের ভিতরে তাকালো একবার, তার পর মৃদু জবাব দিল, মা বলল আনতে হবে না।
ও! ধীরাপদ বড় বড় দু পা ফেলে এগিয়ে গেল। মাত্র দু পা-ই। থামল আবার, তেমনি সবেগে ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়াল। ভিতরের চিলতে বারান্দায় মোড়া পেতে বসে সোনাবউদি রাঁধছে। বাইরের একটা কথাও কানে যায়নি যেন।
ধীরাপদ ধীর গম্ভীর মুখে জানিয়ে দিল, আজ থেকে তার রাতের খাবার রাখার দরকার নেই, সে বাইরে থেকে খেয়ে আসবে।
জবাবে সোনাবউদি খুক্তি থামিয়ে একবার তাকালো শুধু। কানে গেছে এই পর্যন্ত। আদৌ না খেলেও যায় আসে না যেন। হাতের খুক্তি নড়তে লাগল আবার।
উমার বিহ্বল মূর্তির দিকে একবারও না তাকিয়ে ধীরাপদ দ্রুত সুলতান কুঠির আঙিনা পেরিয়ে গেল। ভিতরে কি রকম দপদপানি একটা, যতটা বলে এলে আক্রোশ মেটে তার কিছুই বলা হয়নি। ওই সুলতান কুঠিতেই ফিরবে না আর—বলে এলে হত।
থমকে দাঁড়াল। ঈষৎ ব্যস্তমুখে গণুদা ফিরে আসছে।
চললে? বিব্রত প্রশ্ন গদার।
নিরুত্তরে পাশ কাটানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু গণুদা সামনেই দাঁড়িয়ে গেল। বলল, এতটা পথ ভেঙে আবার ফিরতে হল, ইয়ে—আজ আবার ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম দেবার শেষ দিন। সকালে বলে রেখেছিলাম, দেয়নি-গেলেও দেবে কি না কে জানে। যে মেজাজ। গণুদা ঢোক গিলল, স্ত্রীর মেজাজের ভয়ে মুখখানা শুকনো।—তোমার সঙ্গে আছে নাকি, রাতে বাড়ি এসে দিয়ে দিতাম, এখন আবার…
কত?
গণুদা আশান্বিত, প্রিমিয়াম তো পঞ্চাশ টাকা, তোমার সঙ্গে কত আছে? অফিস থেকেও কিছু যোগাড় করে নিতে পারি—
পার্স বার করে পাঁচখানা দশ টাকার নোট গণুদার হাতে দিয়ে ধীরাপদ হনহন করে এগিয়ে চলল আবার। তার জন্যে অপেক্ষা করল না বা ফিরেও দেখল না। জ্বালা জুড়িয়েছে একটু। একবেলার জন্যে হলেও টাকাটা ওর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। সোনাবউদি জানবে।
ধীরাপদ অন্যদিকে মন ফেরাতে চেষ্টা করল। রমণী পণ্ডিতের টেলিফোন পেলে লাবণ্যকেই জিজ্ঞাসা করবে ভট্টচার্য মশাইকে কাকে দেখানো যায়। তাকেই কোনো ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিতে বলবে। ব্যক্তিগত ব্যাপার কিছু নয়, বরং দাক্ষিণ্যের ব্যাপার। ফী ধীরাপদই দেবে, ওষুধপত্রের খরচ যা লাগে তাও। কিন্তু অফিসে পা দিয়ে এই সহজ ব্যাপারটাও সহজ লাগছে না একটুও। বললে লাবণ্য সাগ্রহে ব্যবস্থা করবে হয়ত, কিন্তু ধীরাপদর সে সুযোগ দিতেও আপত্তি। রমণী পণ্ডিতকে বরং বলে দেবে যে ডাক্তার দেখছেন ভট্টচার্য মশাইকে, তিনিই কোনো বড় ডাক্তার নিয়ে আসুন। ফী দেবার জন্যে না হয় ট্যাক্সি নিয়ে ছুটবে এখান থেকে। সেটা বরং সহজ।
সোজাসুজি না দেখলেও ধীরাপদ লক্ষ্য করেছে লাবণ্য সরকারের মুখখানা লাবণ্যে ঢলঢল আজ। দূর থেকে লক্ষ্য করেছে, অন্যের সঙ্গে যখন কথা বলছিল তখনো দেখেছে। চোখে মুখে সর্বাঙ্গে লঘু খুশির ছন্দ দেখেছে। কোনোদিকে না চেয়ে নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে গেছে ধীরাপদ। কিন্তু রমণীর খুশির আমেজ লাগা আপসের নরম দৃষ্টিটা ঠিকই উপলব্ধি করেছে।
ঠাণ্ডা মাথায় নিজের টেবিলে বসে কাজে মন দিতে চেষ্টা করেছে। পেরে ওঠেনি। …আজ লাবণ্য সরকারও কৃতজ্ঞ বই কি। সরকারী অর্ডার সাপ্লাইয়ের গোল মেটেনি শুধু, সিনিয়র কেমিস্ট আনার দায়টা নিজের ঘাড়ে নিয়ে তাদের মস্ত একটা ভুল- বোঝাবুঝির অবসান করে দিয়েছে সে। গতকাল মেডিক্যাল হোম থেকে লাবণ্যকে গাড়িতে তুলে নিয়ে অমিতাভ ঘোষ হয়ত বা নিজের এতদিনের ব্যবহারের দরুন অনুশোচনাই প্রকাশ করেছে।… লাবণ্য সরকার হকচকিয়ে গিয়েছিল কি?
মহিলার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ধরন আলাদা। তানিস সর্দারের মত বলবে না কিছু, কাঞ্চনের মত নির্বাক দু চোখ উপছে উঠবে না। তার প্রসন্নতা লাভটুকুই দুর্লভ জানে, সেইটুকু বর্ষণ করবে। ধীরাপদর অনুমান, অবকাশ মত লাবণ্য সরকার আজও তার ঘরে আসবে।
কিন্তু চায় না আসুক। সকাল থেকেই নিজের মেজাজের ওপর দখল গেছে। স্নায়ু বিক্ষিপ্ত। আশার এ দারিদ্র্য দুর্বহ। আজ সে এককোণে সরে থাকতে চায়। আজ, কাল, প্রত্যহ—সামনের যে ক’টা দিন চোখে পড়ে।
তা ছাড়া, ও যেন কারো সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। লাবণ্যর এই চাপা খুশির ঝলক দেখে আর একখানি থমথমে মুখ মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সেই থেকে। সে মুখ পার্বতীর।…লাবণ্যর প্রাপ্তিযোগ যত বড়, পার্বতীর হারানোর যোগও ঠিক ততো বড়ই।
আর, এই দুটো যোগেরই সে-ই নিয়ামক! আশ্চর্য লাবণ্য ঘরে এলো বেলা দুটোর পর। আসার উপলক্ষ বড় সাহেবই গতকাল করে রেখে গেছেন। আসন্ন দশম বার্ষিকী উৎসবের প্রোগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা। সদালাপী সহকর্মীর ঘরে হামেশা যেভাবে আসা চলে সেই ভাবেই এসেছে।
প্রথমেই কাজের কথা তোলেনি। বড় সাহেবের বাইরে থেকে ফেরার খবরটা দিয়েছে। সকালে ফিরেছেন। ব্লাডপ্রেসার চড়েছে। লাবণ্যকে টেলিফোনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। প্রেসার কিছু বেশিই বটে। লাবণ্য কড়াকড়ি করে এসেছে, কয়েকটা দিন বেরুনো বা কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামানো বা বেশি কথাবার্তা বলা বন্ধ।
ধীরাপদর স্নায়ুর যুদ্ধ, এ যুদ্ধে হারলে নিজেকে ক্ষমা করবে না। তাকালো শুধু একবার, তারপর নিরাসক্ত তন্ময়তায় ফাইলে চোখ নামালো। আর একদিনের ব্লাডপ্রেসার দেখাটা চোখে ভাসছে।
বসতে বলেনি, লাবণ্য সরকার নিজেই চেয়ার টেনে বসল। হাল্কা তৎপরতায় ধীরাপদ নোটের নীচে খসখস করে মন্তব্য লিখে চলেছে।
আজ প্রোগ্রাম নিয়ে বসবেন?
প্রোগ্রাম…না, আজ থাক। এ ফাইলের কাজ শেষ, আর একটা ফাইলে টান পড়ল। বাঁচা গেল, আমারও ভাল লাগছিল না। হাসির আড়ালে সঙ্কোচ অপসারণের চেষ্টা আর মাঝের এই অপ্রীতিকর দিন ক’টাকে মুছে দেবার চেষ্টা। কাঞ্চন-প্রসঙ্গ উত্থাপন করল।—কাল আপনি আমার ওখানে ওই মেয়েটিকে দেখতে গেছলেন শুনলাম, আমাকে বলেননি তো যাবেন?
ধীরাপদও সহজ হতে চাইছে। অবাক করে দেবার মত সহজ, অবজ্ঞা করতে পারার মত সহজ। মুখ না তুলে জবাব দিল, আপনি আমাকে যত খারাপ ভেবেছিলেন তত খারাপ যে নই সেটা তখনো পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেননি…বললে নার্সিং হোমের দরজা বন্ধ রাখার হুকুম হত বোধ হয়!
বিস্ময়ের রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই হাসি চাপা দিয়ে লাবণ্য গতকালের অভ্যর্থনার সম্ভাবনাটা প্রায় স্বীকারই করে নিল। বলল, আজ যদি আসেন তো দেখবেন সব দরজা সটান খোলা রেখে আমি নিজে দাঁড়িয়ে আছি। আসবেন?
অন্তরঙ্গ সুরটা সুপরিচিত, হাসির জাদুও। আর এরই ওপর লাবণ্যর আস্থাও কম নয়। ধীরাপদর কানে গেল এই পর্যন্ত, প্রত্যুত্তরের তাগিদ নেই। নির্লিপ্ত নিবিষ্টতায় গোটা টেবিলটা ফাইল-মুক্ত করার ইচ্ছে।
খানিক অপেক্ষা করে সাদাসিধেভাবে লাবণ্য একটা প্রশংসার খবরই ব্যক্ত করল যেন।—মেয়েটার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে মনে হল এ পর্যন্ত মানুষ ওর জীবনে একজনই দেখেছে—
মেয়েটা বোকা! ধীরাপদর নিরুৎসুক মন্তব্য।
আমার তো ধারণা মেয়েটা বেশ চালাক, লঘু প্রতিবাদ,—নইলে এত লোকের মধ্যে শুধু একজনকে বেছে নিল কি করে?
ফাইল ছেড়ে ধীরাপদর দৃষ্টিটা লাবণ্যর মুখের ওপর এসে থেমে রইল একটু। তেমনি ঠাণ্ডা জবাব দিল, এইজন্যেই আর পাঁচজনের তুলনায় বোকা বলছি—
অন্যদিন হলে এটুকুতেই প্রতিদ্বন্দ্বিনী তেতে উঠত, কিন্তু আজ সে রাগ-বিরাগের ধার দিয়েও গেল না। উল্টে ছদ্ম কৌতুকের ওপর আহত বিস্ময় ছড়িয়ে বলে উঠল, এই পাঁচজনের আমিও একজন বুঝি?
ধীরাপদ স্টেটমেন্ট পড়ছে একটা।
অতি বড় সাধবীরও আপন-পর সব পুরুষেরই নিস্পৃহতা চক্ষুশূল নাকি। চক্ষুলজ্জা – কাটিয়ে অস্তরঙ্গ আপসের চেষ্টায় নিজে সেধে এসেও ফিরে যাবে, তেমন মেয়ে নয় লাবণ্য সরকার। উত্তরের প্রত্যাশা না করেই বলে গেল, কি কাঁদুনে মেয়ে আপনার ওই বোকা মেয়ে, কেঁদে কেঁদে বিছানা বালিশ সব ভাসিয়ে দিলে, চিকিৎসা করব না কান্না থামাব।…অমিতবাবু আজ বিকেলে দেখতে যাবেন বলছিলেন, আপনিও আসুন ना?
আজ তাড়া আছে—
হিমাংশুবাবুর বাড়িতে তো সেই সন্ধ্যেয় যাচ্ছেন! অর্থাৎ বিকেলে তাড়া নেই।
না, অফিসের পরেই যাব, তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার—
অসুখ।
কি দরকার?
স্টেটমেন্ট পড়া প্রায় শেষ, এতক্ষণের সহিষ্ণুতায় চিড় খেতে দেবে না। — বাড়িতে
নিজের আওতায় এনে ফেলা গেল যেন এবারে। কার অসুখ?
ও-বাড়ির একজনের
আপনার আত্মীয়ের? আত্মীয়ের মত…
উত্তর থেকেই প্রশ্নের রসদ পাচ্ছে লাবণ্য সরকার। ওই বাড়িটার সকলেই আপনার আত্মীয়ের মত বুঝি?
কপালের বিরক্তির কুঞ্চন স্টেটমেন্ট পছন্দ না হওয়ার কারণেও হতে পারে। নিরুত্তর।
ওটা কি পড়ছেন?
টাইপ করা কাগজের গোছা একধারে সরিয়ে রাখল। জবাব দিল, ইউ. পি. রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর স্টেটমেন্ট। ফাঁকির ওপর চলেছে…
সর্বত্রই এক ব্যাপার। প্রচ্ছন্ন গাম্ভীর্যে লাবণ্য সমর্থনসূচক বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা।—তা আপনার ওই আত্মীয়ের মত ভদ্রলোকের কি অসুখ?
হাতের কাছে আর একটা ফাইল টেনে নিয়েছিল ধীরাপদ। সেটা খোলা হল না। সোজাসুজি মুখের দিকে চেয়ে তার সব প্রশ্নেরই জবাব সেরে নেবার জন্য প্রস্তুত হল।—কাল বিকেলের দিকে কুয়োতলায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, আজ সকালে পর্যন্ত জ্ঞান হয়নি দেখে এসেছি।
লাবণ্য এতটা আশা করেনি। ওমা! থ্রম্বসিস্ নয় তো? বয়স কত? কে দেখছেন? -ধীরাপদর ধৈর্যের পরীক্ষা! বয়েস অনেক। চার টাকা ফী-এর একজন ডাক্তারকে ধরে-পড়ে দু টাকায় আনা হয়েছে।
অনুরোধ করলে কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে লাবণ্য আজ এই মুহূর্তে তার সঙ্গে গিয়ে রোগী দেখে আসতে আপত্তি করত না। দেখে এসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করত। কিন্তু না বললে আগ্রহ দেখানো সম্ভব নয়। বলবে না বুঝেই খোঁচা দিতে ছাড়ল না, তাহলে কেমন আত্মীয়ের মত আপনার?
উত্তরটা মনের মত ধারালো করে তোলার আঁচে ধীরাপদ শকুনি ভটচাযকে অনেক উঁচুস্তরে টেনে তুলতেও দ্বিধা করল না। তেমনি বক্র গাম্ভীর্যে জবাব দিল, কি আর করা যাবে, ইচ্ছে থাকলেই তো সকলকে অনুগ্রহ করা চলে না।
টিপ্পনীর দরুন হোক বা চিকিৎসকের চোখে একজনের বিপদ এ ধরনের অবহেলার কারণেই হোক, লাবণ্য সরকার সঙ্গে সঙ্গে তেতে উঠল এবারে। গলার স্বরও চড়ল, চলে কি চলে না সেটা অজ্ঞান অবস্থায় ভদ্রলোক এসে আপনাকে বলে গেছেন?
জবাব না দিয়ে ধীরাপদ চেয়ে রইল চুপচাপ। কিন্তু দৃষ্টিটা এবারে ফাইলে টেনে নামানো দরকার অনুভব করছে। সম্মুখবর্তিনীর এই মূর্তি আর এই সুতৎপর তীক্ষ্ণতা পুরুষের লোভনীয় নিভৃতের সামগ্রী। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে দৃষ্টি নত করাটাও যেন স্নায়ু-দ্বন্দ্বে হার স্বীকার করার সামিল। পরিস্থিতি বদলাল লাবণ্যর বেয়ারা এসে ঘরে ঢুকতে। মেম-ডাক্তারের টেলিফোন। ডাকছে চীফ কেমিস্ট ঘোষ সাহেব।
মনের স্বাভাবিক অবস্থায় লাবণ্যর চকিত বিড়ম্বনাটুকু উপভোগ করার কথা। মর্যাদাময়ীর মুখে বুঝি বা নিমেষের জন্য লালিমা-সিক্ত একটি মেয়ের মুখই উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল। কটাক্ষে ধীরাপদর দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। অত বিশদ করে বলার দরুন বেয়ারাটার ওপরেই হয়ত চটেছে মনে মনে।
স্থির অবিচ্ছিন্ন একাগ্রতায় ধীরাপদর দু চোখ হাতের ফাইলে এসে নেমেছে আবার, নারী-তনু-বিশ্লেষণের রূঢ় প্রলোভনে দরজা পর্যন্ত অনুসরণ করেনি আগের মত। তার পরেও একটানা কাজ করে গেছে, নিবিষ্টতায় ছেদ পড়তে দেয়নি। নিজের ভিতরে যেন একটা পাকাপোক্ত দেয়াল তুলে দিয়েছে সে, সেই দেয়ালের ওধারে কেউ যদি মাথা খোঁড়ে খুঁড়ক। ধীরাপদ কান দেবে না, প্রশ্রয় দেবে না।
ঘড়ি ধরে পাঁচটায় উঠেছে। যথানির্দেশ পার্সোনাল ফাইল নিয়ে হিমাংশুবাবুর বাড়ি গেছে। মনিবের নির্দেশ। মাকে তাকে অন্দরের বসার ঘরের ভিতর দিয়ে শোবার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। বড় সাহেব অত সকালে আশা করেননি তাকে, দেখে খুশি হয়েছিলেন। তাড়াতাড়ি ফেরার ইচ্ছে শুনে হালকা অভিযোগ করেছেন, আমি ভাবলাম শরীর খারাপ শুনে এলে-
প্রেসার কত?
খুশি মেজাজে ছিলেন। প্রেসার কত সঠিক বলতে পারলেন না, তবে অনুমান, কিছু বেশিই হবে। কারণ প্রেসার মাপতে মাপতে মেয়েটার মুখখানা একটু বেশিই গম্ভীর হয়েছিল দেখেছেন। লাবণ্য যখন প্রেসার দেখে বড় সাহেব তখন তার মুখ দেখেন—দেখে আঁচ করেন প্রেসার কম কি বেশি। লঘু গাম্ভীর্যে তাঁর নির্দেশের কড়াকড়িও শুনিয়েছেন। -ওঠা-বসা চলা-ফেরা কাজ-কর্ম চিন্তা-ভাবনা খাওয়া-দাওয়া সব বাতিল—এভরিথিং নো। হেসেছেন। আগে তার ওই ডাক্তারি দেখার জন্যেই অনেক সময় তাকে ডেকে পাঠাতেন নাকি।
অর্থাৎ ডেকে পাঠিয়ে রোগী সাজতেন। পাইপ-চাপা মুখের সকৌতুক প্রসন্নতার ওপর ধীরাপদর দৃষ্টিটা আটকে ছিল কয়েক মুহূর্ত। প্রসঙ্গ পরিবর্তনের আশায় পার্সোন্যাল ফাইলটা পালঙ্কের পাশে ছোট টেবিলটার ওপর রেখেছিল।
কিন্তু বড় সাহেব লক্ষ্য করেননি তেমন। ভাগ্নে কাজে যোগ দিয়েছে জেনে খুশি। লাবণ্যর মুখে শুনেছেন বললেন। ধীরাপদও কিছু বলবে আশা করেছিলেন হয়ত, কিন্তু তাকে চুপ করে থাকতে দেখে এ ব্যাপারে আর কৌতূহল প্রকাশ করেননি। বলেছেন, লাবণ্যও আজ খুব প্রশংসা করছিল তোমার
খানিক আগে নিজের মধ্যে যে দেয়াল খাড়া করেছিল, প্রশংসাটা তার এধারেই ধাক্কা খেয়ে ফিরেছে। ধীরাপদ নির্বিকার। উঠতে পারলে হত।
ঘণ্টাখানেকের আগে ছাড়া পায়নি। আসন্ন অ্যানিভার্সারির প্রসঙ্গ উঠেছে। উৎসবটা উৎসবের মতই হওয়া দরকার, এখানকার এবং ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশান সংলগ্ন বাইরের সব ইউনিটকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে, কাগজে স্পেশ্যাল বিজ্ঞাপন দিতে হবে। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের উদ্বোধন ভাষণটা এবারে যেন খুব ভেবেচিত্তে লেখা হয়, কর্মচারীদের স্পেশ্যাল বোনাস ঘোষণা আর ভবিষ্যতে আরো কিছু সুবিধে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকবে তাতে। অর্থাৎ, বিলিতি ফার্মের মতই এখানকার কর্মচারীরাও সুবিধে পাচ্ছে এবং পাবে সেই আভাস যেন থাকে। কি কি প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেতে পারে সে সম্বন্ধে অমিত আর লাবণ্যর সঙ্গে যেন ভালো করে আলোচনা করে নেওয়া হয়। না, ছেলেকে তিনি এর মধ্যে টানতে চান না, প্রসাধন-শাখা নিয়েই থাকা দরকার তার। তা ছাড়া ছেলে এর মধ্যে থাকলে ভাগ্নেকে পাওয়া যাবে না সেটা সিনিয়র কেমিস্ট আনার ব্যাপারেই বিলক্ষণ বোঝা গেছে। ধীরাপদ দায়িত্ব নিলে সে যদি ঠাণ্ডা থাকে—থাক্
পার্সোন্যাল ফাইল কেন নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল সেটা বোঝা গেল সব শেষে। বড় সাহেবের কাছে আসন্ন উৎসবের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এবারের অল ইণ্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশানের সাধারণ অধিবেশন বসছে কানপুরে। তারও খুব দেরি নেই আর। অধিবেশনে প্রধান বক্তা হিসেবে যোগদান করবেন তিনি। সেই ভাষণে বৈদেশিক ব্যবসায়ের পাশাপাশি এ দেশের গোটা ভেষজ ব্যবসায়ের চিত্রটি তুলে ধরতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারী নীতির পরিবর্তন এবং আনুষঙ্গিক বাধা-বিঘ্ন দূর করতে পারলে দেশের এই শিল্প কোন্ আদর্শ-পর্যায়ে উঠতে পারে তারও যুক্তিসঙ্গত নজির বিশ্লেষণ করতে হবে। সেই সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশানের নিষ্ক্রিয়তার আভাসও প্রচ্ছন্ন থাকবে।
ব্লাডপ্রেসার ভুলে আর লাবণ্য সরকারের কড়াকড়ি ভুলে সাগ্রহে নিজেই উঠে গিয়ে ওধারের অফিসঘর থেকে ছোট-বড় একপাঁজা পুস্তিকা এনে হাজির করলেন তিনি…এ-রকম আরো অনেক আসছে জানালেন, ধীরাপদর তথ্যের অভাব হবে না।
এ পর্যন্ত বড় সাহেবের অনেক বক্তৃতা অনেক ভাষণ অনেক বাণী লিখেছে, কিন্তু ঠিক এতটা উদ্দীপনা আর দেখেছে বলে মনে পড়ে না। ব্লাডপ্রেসারের প্রতিক্রিয়া কিনা সেই সংশয় মনে এসেছিল। কিন্তু না, এরও কারণ গোপন থাকল না।
তাঁর লক্ষ্য, আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট ইলেকশান্। অল ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশানের বাঙালী প্রেসিডেন্ট এ পর্যন্ত দু-একজনের বেশি হয়নি। বর্তমানের প্রাদেশিকতায় সে সম্ভাবনা ক্রমশ নিষ্প্রভ হতে বসেছে। সামনের বছরের নির্বাচনে বাঙালীর গৌরব ফিরিয়ে আনা যায় কিনা সেটাই একবার দেখবেন তিনি। বাইরের অনেক ইউনিটের বন্ধুস্থানীয় কর্মকর্তারা ক-বছর ধরেই তাঁকে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছেন, আর সমর্থনের আশ্বাস দিচ্ছেন।
এবারে তাঁর এগিয়ে আসার সঙ্কর। আগামীবারে নির্বাচনে দাঁড়াবেন।
প্রধান বক্তার ভাষণে সেই প্রস্তুতিটি জোরালো করে তুলতে হবে ধীরাপদকে। সকলের টনক নড়ে যায় এমন কিছু শোনাতে হবে। পরের প্রচার-ব্যবস্থা ভেবেচিত্তে পরে করা যাবে।
তাঁর বক্তব্যের উপসংহার, এ-রকম দু-দুটো দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ধীরাপদর অন্যত্র থাকা চলে না, এমন এক জায়গায় থাকে যে একটা টেলিফোনের যোগাযোগ পর্যন্ত নেই, একটা লোক পাঠাতে হলেও এক ঘণ্টার ধাক্কা। অতএব অবিলম্বে সুলতান কুঠির বাস গুটিয়ে তার এখানে চলে আসা দরকার, কোনরকম অসুবিধে যাতে না হয় সে ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।
ধীরাপদ জবাব দেয়নি, কিন্তু বিব্রত জবাবটা মুখেই লেখা ছিল বোধ হয়। হিমাংশু মিত্রের নজর এড়ালো না। ঠাট্টা করলেন, তুমি ও-রকম একটা জায়গা আঁকড়ে আছ কেন…এনি সুইট অ্যাফেয়ার?
এরই বা জবাব কি?
হিমাংশুবাবু আংশিক অব্যাহতি দিলেন তাকে। বরাবরকার মত উঠে আসতে আপত্তি হলে এই কাজের সময়টা অন্তত এখানে থাকতে নির্দেশ দিলেন।
সেখান থেকে বেরিয়ে ধীরাপদর প্রথমেই মনে পড়ল মেয়ের বুক-লিস্ট দেয়নি বলে আজই রাগের মাথায় ভাবছিল সুলতান কুঠি ছেড়ে চলে আসবে। সেই মুখের কথা শুনেই অলক্ষ্য চক্রীটির যেন জব্দ করার ইচ্ছে তাকে।
বাস-এ উঠতে গিয়ে থমকালো আবার। ঘড়ি দেখল, সাতটা বাজে। সোনাবউদিকে রাতের খাবার রাখতে নিষেধ করে এসেছে। এই সাত-সন্ধ্যায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসার ইচ্ছে আদৌ নেই। রাত আরো বেশি হলেও সে ইচ্ছে হত না। তার থেকে বরং এক রাত না খেয়ে কাটাবে, আগে কত রাতই তো কেটেছে। ধীরে-সুস্থে গেলে ঘরে পৌঁছুতে প্রায় আটটা হবে।… খেয়ে আসেনি সেটা নাও ভাবতে পারে তখন ধীরাপদ বাস ধরল।
সুলতান কুঠির আঙিনায় পা দিয়ে দেখে কদমতলার বেঞ্চিতে হুঁকো হাতে একাদশী শিকদার বসে। এ সময়টা তাকে বাইরে দেখা যায় না বড়। দূরে শকুনি ভট্টচাষের দাওয়ায় টিমটিম লন্ঠন জ্বলছে গতরাতের মতো। সেখানেও দাঁড়িয়ে কারা। বোধ হয় ছেলেরা আর রমণী পণ্ডিত।
ভটচায মশাই কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতে আগে ব্যস্ত হয়ে একটু সরে বসে বেঞ্চি চাপড়ালেন একাদশী শিকদার, বোসো বাবা বোসো, সারাদিন খেটেখুটে এলে-
খবরাখবর নেবার জন্যই ধীরাপদ বসল।
হুঁকোর মায়া ভুলে শিকদার মশাই বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন একটা, তার পর সমাচার শোনালেন।…অবস্থা একরকমই ছিল, বিকেলের দিকে শ্বাসকষ্ট বাড়তে ধীরাপদর অফিসে খবর দেওয়া হয়—খবর পেয়ে যে মেয়ে ডাক্তারটি এসেছিলেন তিনি খুব যত্ন করেই রোগী দেখে গেছেন-মা যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী—কিন্তু কালে টেনেছে যাকে তাকে আর ধরে রাখা যাবে কেমন করে? রোগীর নাকে শুধু বাতাসের নল লাগানোর ব্যবস্থা দিয়ে তিনি চলে গেছেন, যাবার আগে মেয়েটি গণুদার বউদির সঙ্গেও একটু বাক্যালাপ করে গেছেন। সঙ্গে আর একটি সাহেব পানা অল্পবয়সী ভদ্রলোক ছিলেন, কিন্তু তিনি আর ঘরে ঢোকেননি।
ধীরাপদ হতভম্ব একেবারে। পাঁচটার পরে টেলিফোন করা হয়েছিল, টেলিফোন পেয়ে লাবণ্য এসেছিল আর অমিতাভ ঘোষ এসেছিল। ইচ্ছে থাকলে অনুগ্রহ যে করা চলে তাই দেখিয়ে গেল। নিমেষে সমস্ত ভিতরটা তিক্ত হয়ে গেল। কি দরকার ছিল অত ভাবপ্রবণ হয়ে সাত-তাড়াতাড়ি রমণী পণ্ডিতকে ফোন করতে বলার—শকুনি ভচাযের জন্যে কতটুকু দরদ তার? রুক্ষকণ্ঠে বলে উঠল, আমি তো পাঁচটার আগে ফোন করতে বলে গিয়েছিলাম, পাঁচটার পরে কে করতে বলেছে?
হুঁকো হাতে নড়েচড়ে বসলেন শিকদার মশাই, আছা অন্ধকারের অলক্ষ্যে হয়ত একটু সরেও। মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মেজাজী গলা কানের পরদায় খটখট করে উঠল, বলেছিলে বুঝি। ওই রকমই আজকাল কাণ্ডজ্ঞান হয়েছে পণ্ডিতের, দুপুরে বেরুবার মুখে:: ন-ফোন কি বলে গেল আমার কাছে—আমি সাতজন্মে কখনো ওসব হাতে করেছি ন। কানে লাগিয়েছি। আবার বিকেলে এসে একবার খোঁজখবর করেই বেরিয়ে গেল—আধ ঘণ্টা না যেতে দেখি মেয়ে ডাক্তার এসে হাজির। আমরা তো ধরে বসে আছি তুমি পাঠালে।
ধীরাপদ তার পরেও বসেছিল খানিকক্ষণ। আর কিছু শোনার জন্যে নয়, এমনিই। কিন্তু সেই অবকাশে মোলায়েম খেদে একাদশী শিকদার শুনিয়েছেন কিছু। অতগুলো ছেলেপুলে নিয়ে অভাবে পড়েই হয়ত পণ্ডিতের মতিগতি কেমন বদলে গেছে আজকাল। ধীরাপদ নিশ্চয় কিছুই লক্ষ্য করেনি, কিছুই জানে না— কাজের লোক সে, জানার কথাও নয়। কিন্তু চোখের ওপর তাঁদের তো দেখতেই হচ্ছে আর সুনাম-দুর্নামটাও ভাবতে হচ্ছে।…পণ্ডিতের মেয়েটার চালচলন দিনকে দিনই কেমন হচ্ছে, কাউকে
কেয়ারও করে না। তাঁদের মত বুড়োদের চোখে পড়ে বলে লাগে, কিন্তু বাপ আজকাল ওসব দেখেও দেখে না, অভাবের তাড়নায় উলটে প্রশ্রয়ই দেয় হয়ত। এদিকে কুঠিবাড়ির যা অবস্থা, আজ এদিক খসে তো কাল ওদিক, এর মধ্যে কাবুলিওয়ালা এসে এসে লাঠি ঠুকে ওদিকটার ভিতসুদ্ধ নাড়িয়ে দিল— গত পনের দিনের মধ্যে কম করে তিন দিন পণ্ডিতের দাওয়ায় কাবুলিওয়ালা হানা দিয়েছে—আরো কদিন দেবে কে জানে!
নিজের অগোচরে বসে শুনছিল ধীরাপদ। নির্বাক…উঠে পড়ল। ইচ্ছে না থাকলেও ওদিকটায় একবার গিয়ে দাঁড়ানো দরকার, রোগীর খোঁজ নেওয়া দরকার। লাবণ্য সরকার কি বলে গেছে তাও ভালো করে জানা দরকার।
তাকে উঠতে দেখে হুঁকো হাতে শিকদার মশাইও উঠলেন।
লাবণ্য সরকার শুধু অক্সিজেন টিউব লাগানো ছাড়া নতুন আর কিছুই ব্যবস্থা দিয়ে যায়নি বটে। রমণী পণ্ডিতকে বলে গেছে, ধীরুবাবু ছিলেন না বলেই সে এসে দেখে গেল, তবে করার কিছু নেই আপাতত, দরকার বুঝলে কাল যেন ধীরুবাবু বড় ডাক্তার নিয়ে আসেন।
রমণী পণ্ডিতের ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে ধীরাপদ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। অন্ধকারে শ্রোতার ভাবলেশহীন মুখখানা চোখে পড়েনি। কদমতলার কাছাকাছি এসে মেয়ে ডাক্তারটির সহৃদয়তার প্রশংসা শুরু করেছিলেন তিনিও। মেয়েটিই টেলিফোন ধরেছিলেন, সুলতান কুঠি থেকে টেলিফোনে কথা বলা হচ্ছে শুনে নিজে থেকে বাড়ির অসুখের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন।
আমি আপনাকে পাঁচটার মধ্যে ফোন করতে বলেছিলাম, সমস্ত দিন পার করে তারপর উপকার করতে দৌড়নোর দরকার ছিল কী?
রমণী পণ্ডিত থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু ধীরাপদ দাঁড়িয়ে আর কিছু শুনতে রাজি নয় দেখে আত্মস্থ হতে সময় লাগল না। ফুটন্ত তেলে জলের ছিটে —ওই শিকদার এইসব বলেছে আপনাকে সাতখানা করে, না? বলবেই তো, আমি জানি বলবে। সমস্ত দিন আমি সংসারের ধান্দায় ঘুরি, তার পরেও যেটুকু পারি করি —কিন্তু ওনারা কুৎসা করে বেড়ানো ছাড়া আর কি করেন?
ঘরের কাছাকাছি এসে ধীরাপদ বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে গেছে। এই উদ্গিরণের মুখে ঘর খুললে উনিও ঘরে ঢুকবেন। ধীরাপদ নিরিবিলি চাইছে।
রমণী পণ্ডিতের গলায় উত্তাপ সত্ত্বেও সুবিচারের আবেদন ছিল। তাঁর বক্তব্য না শোনা পর্যন্ত অব্যাহতি নেই। তাঁর সওয়ালে কান পাততে হয়েছে।…বেলা দেড়টা পর্যন্ত হাফ-ফীয়ের ডাক্তার আসেননি, রমণী পণ্ডিত দু-দুবার তাঁকে তাগিদ দিতে গিয়ে দেখা পাননি। তারপর আর অপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে, না বেরুলে রাতে হাঁড়ি চড়ে না। তাই একাদশী শিকদারকেই এইটুকু ব্যবস্থার ভার দিয়ে গিয়েছিলেন, ডাক্তারের মত হলে ছেলেরা কেউ একজন গিয়ে যেন ধীরুবাবুকে ফোন করে আসে সেই কথাও বলে গিয়েছিলেন। ধীরুবাবুর দেওয়া টেলিফোন নম্বর লেখা কাগজটা পর্যন্ত তাঁর হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন—কিন্তু এসে দেখেন কোনো ব্যবস্থাই হয়নি, রোগীর এদিকে শ্বাসকষ্ট, বাড়িতে কান্নাকাটি। তখন পাঁচটা বেজে গেছে কি বাজেনি রমণী পণ্ডিত জানেন না, তক্ষুনি আবার ছুটেছেন টেলিফোন করতে।
নিজের রূঢ়তার দরুন ধীরাপদ নিজেই লজ্জিত একটু, একজনের মৃত্যুর সামনে এ রকম মর্যাদাবোধ টনটনিয়ে না উঠলেই হত। ভদ্রলোক করছেনই তো, ভটচায মশাইয়ের ছেলেরাও কৃতজ্ঞ সেজন্য। তাছাড়া, লাবণ্য সরকার কাকে জব্দ করার জন্যে এমন সহৃদয়তার পরিচয় দিয়ে গেল সেটা আর উনি জানবেন কি করে।
· কিন্তু রমণী পণ্ডিতের রাগ আর আবেদন মিশানো খেদ-উক্তির সবে শুরু। তিনি ঠিক জানেন, একাদশী শিকদার ইচ্ছে করেই কোন ব্যবস্থা করেননি, ছেলেদেরও বলেননি। কেন, বলবেন? দরদ থাকলে তো বলবেন, মনে মনে এখন হয়ত হিসেব করছেন, এ ক-বছর তাঁর ক-মণ তামাকের ধোঁয়া ভটচায মশায়ের পেটে গেছে – রমণী হলপ করে বলতে পারেন শকুনি ভটচায চোখ বুজতে চলেছেন বলে তার একটুও দুঃখ হয়নি, উলটে কোনো ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন। কি ব্যাপার তিনি জানেন না অবশ্য, কিন্তু কিছু একটা আছেই। ওই জন্যেই এতকাল তাঁকে তোয়াজ করে এসেছেন। গোপনে গোপনে অনেকবার শান্তি-স্বস্তায়ন করিয়েছেন ভটচাৰ্য মশাইকে দিয়ে, হয়ত সেই কারণে উনি শিকদার মশাইয়ের অনেক দুর্বলতার কথাও জানতেন। এখন নিশ্চিত্ত, এখন আর কিছু ফাঁস হবার ভয় নেই।
ধীরাপদ অবাক, ঘরে ঢোকার তাগিদ ভূলে গেল, নিরিবিলির তাগিদ ভুলে গেল। রমণী পণ্ডিতের অসহিষ্ণু জ্বালাটা ঠাণ্ডা হল একটু, সুর নরম হল।… বুড়ো ভদ্রলোক যেতে বসেছেন, এ অবস্থায় তাঁর মিথ্যে নিম্নে করলে পণ্ডিতের জিভ খসে যায় যেন, কিন্তু এত বয়স পর্যন্ত ওই দুই বুড়ো ভদ্রলোক নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে কালি ঢেলেছেন শুধু, একটুও দয়ামায়া যদি থাকত ওঁদের বুকে। ওইটুকু একটা মেয়েকে নিয়ে আবার তাঁরা গঞ্জনা দিতে শুরু করেছিলেন পণ্ডিতকে। ধীরাবাবু দয়া করে একটু পড়াত, তাতেও তাঁদের চোখ টাটিয়েছিল, এখন প্রায় বাপের বয়সী গবাবু একটু-আধটু সাহায্যের চেষ্টা করেছেন, চেনা-জানা মেয়েদের দু-একটা হাতের কাজ শেখানোর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন-এতেও এঁদের গাত্রদাহের শেষ নেই। রমণী পণ্ডিত শাপমনি করেন না কাউকে, কিন্তু এতে কি ওঁদের ভালো হচ্ছে, না হবে?
নিজের ঘরে বসেও ধীরাপদর মাথাটা ঝিমঝিম করেছে অনেকক্ষণ পর্যন্ত। ঘর- দোর অন্য দিনের মতই পরিচয় দেখেছে, বিছানাটাও রোজকার মত পরিপাটি করে পাতা, সামনের দেওয়ালের কাছে খাবারটা ঢাকা দেওয়া নেই শুধু। তার সময়ও হয়নি। কিন্তু ধীরাপদ এসব নিয়ে ভাবছে না। একাদশী শিকদারের খেপ আর রমণী পণ্ডিতের মর্মদাহে মাথা ঠাসা।
…এতকালের একমাত্র সঙ্গীর বিয়োগ-সম্ভাবনায় একাদশী শিকদার তেমন যে কাতর হননি, সেটা ধীরাপদ নিজেই লক্ষ্য করেছে। অন্যদিকে পন্ডিতের মেয়ে কুমুর চালচলনের কটাক্ষটা যে সম্প্রতি গণুদা পর্যন্ত গড়িয়েছে, সেটা বিশ্বাস না হলেও ধীরাপদ অস্বস্তিবোধ করছে কেমন। মায়ের মেজাজ প্রসঙ্গে উমারাণীর গতকালের গোপন ত্রাসের কথাগুলো নতুন করে কানের কাছে ভিড় করে আসছে। বলেছিল, মায়ের মুখের দিকে আজকাল তাকালে পর্যন্ত থরথরিয়ে কাঁপুনি, আর, তার বাবারও তার আগের মত ঝগড়া করার সাহস নেই, হয় মুখ বুজে থাকে নয়তো পালিয়ে যায়।
মা আজকাল আরো কি ভীষণ রাগী হয়ে গেছে ভূমি জান না ধীরুকা…
ধীরাপদর আবার মনে হল, খুব বেশি রকমের অসঙ্গতি না দেখলে ওইটুকু মেয়ের এমন কথা বলার কথা নয়।
ভাবনায় ছেদ পড়ল, খাবার থালা আর গ্লাস হাতে সোনাবউদি ঘরে ঢুকেছে। কিন্তু উমারাণীর অমন ত্রাসের টাটকা নজির কিছু চোখে পড়ল না, বরং বিপরীত দেখল। দুই-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সোনাবউদি সুপরিচিত চাপা বিদ্রূপে অনুমতি প্রার্থনা করল যেন, রাখব না নিয়ে যাব?
কিন্তু ধীরাপদ যথার্থই গম্ভীর, সকালের অপমান সমস্ত দিন ধরে ভিতরটা করেছে। মেজাজের ওপর মেজাজ চড়ালে বরং এই একজনকে অনেক সময় নরম হতে দেখেছে। সকালে চড়িয়েছিল। এখনো আগে কৈফিয়ৎই নেবে।
সকালে মেয়েকে বুকলিস্ট দিতে দেননি কেন?
থালা গেলাস যথাস্থানে রাখল সোনাবউদি, ঘরের কোণ থেকে আসনখানা এনে পেতে দিল। তারপর ধীরেসুস্থে বলল, ঘরের মানুষটার মতিগতি যাতে একটু ফেরে সেই জন্যে। আপনার কি ইচ্ছে, সে চেষ্টা করব না?
তাকে অমন বিষম থতমত খেতে দেখেই হয়ত সোনাবউদি হেসে ফেলল। সামলে নেবার একটু অবকাশ দিয়ে আবার টিপ্পনী কাটল, রাগ গেছে, নাকি কাল আবার বলবেন এই বাড়িমুখোই হবেন না আর?
জোরালো আলোর ঘায়ে একঘর চাপ অন্ধকার যেমন নিমেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কৈফিয়ৎটা শোনামাত্র ধীরাপদর সমস্ত দিনের থমথমে গুরুভারও তেমনি মিলিয়ে গেল কোথায়। হালকা লাগছে, গতকালের ঘরে ফেরার তৃষ্ণাটা এই মিটল বুঝি। নিজের ঘর না হোক, নিজের কারো ঘর…
সোনাবউদির শেষের টিপ্পনীটুকুও আশ্রয়ের মত, খানিকটা আড়াল পাবার মত। খাবারের থালার দিকে চোখ রেখে বলল, কাল না হোক, দু চার দিনের মধ্যেই এখান থেকে নড়তে হবে দিনকতকের জন্য।
নীরব প্রতীক্ষা একটু। — কোথায়?
বড় সাহেবের বাড়িতে, অনেকগুলো কাজের চাপ পড়েছে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকার হুকুম।
যেন এই কারণেই এত বিষণ্ণতা আর এত মেজাজ খারাপ। চোখ তুলে সোজাসুজি তাকাতে পারেনি, কিন্তু ধীরাপদর অনুমান, সোনাবউদির মুখখানা পরিহাস-সিক্ত হয়ে
তা আপনার নড়তে বাধাটা কোথায়?
কোথায় বলা গেল না, কিন্তু ভারী ইচ্ছে হচ্ছিল বলে।
রয়েসয়ে এবারে বিকেলের খবরটা দিল সোনাবউদি, আপনাদের লাবণ্য ডাক্তার ভট্টচার্য মশাইকে দেখে ফেরার মুখে আমাকেও দেখে গেছেন।… ভট্টচার্য মশায়ের রাত কাটবে কিনা সন্দেহ বললেন, আমার সম্বন্ধে অবশ্য কিছু বলেননি।
ধীরাপদ হেসে ফেলল।
সোনাবউদি গম্ভীর।-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দু-চার মিনিট আলাপ-সালাপ করলেন, আর আপনার নামে কিছু নালিশ করলেন। আমাকে আপনার গার্জেন ভেবেছেন বোধ হয়। আপনাদের বড় সাহেবের বাড়ি থেকে তাঁর বাড়িটা কত দূর?
অনেক দূর।
তাই তো, তাহলে এখান থেকে নড়ে আপনার কি-বা সুবিধে। আর, যে লোককে তাঁর সঙ্গে দেখলাম, আপনার কতটুকু আশা তাও বুঝি নে!
আশা নেই। ধীরাপদ হাসছে, হেসেই সায় দিতে পারছে। —কিন্তু আমার নামে আবার কি নালিশ করে গেলেন?
সোনাবউদির গম্ভীর মুখের মধ্যে শুধু চোখ দুটোতে খানিকটা করে তরল কৌতুক জমাট বেঁধে আছে।—কি নালিশ খেতে খেতে মনের আনন্দে ভাবতে থাকুন, রুটি আজ আর দু-চারখানা বেশি লাগবে বোধ হয়— লাগলে ডাকবেন। আমার আর দাঁড়াবার সময় নেই, মেয়েটা খায়নি এখনো পর্যন্ত-
সত্যিই চলে গেল। ধীরাপদ তক্ষুনি উঠে খেতে বসল। খিদের তাগিদে নয়, সোনাবউদির ওপর সমস্ত দিনের ক্ষোভের অপরাধ তাতে কিছুটা লাঘব হবে যেন।
কিন্তু উমারাণীর গতরাতের উক্তিতে অতিশয়োক্তি ছিল না।
খাওয়া প্রায় শেষ। মুখ-হাত ধুয়ে ভট্টচার্য মশায়ের আর একবার খবর নিয়ে আসবে ভাবছিল, বাইরে থেকে যে মুখখানা উঁকি দিল সেটি গণুদার। ঘরে আর দ্বিতীয় কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল।
—তোমার সকালের টাকাটা দিতে এলাম। গলার মৃদু স্বর সোনাবউদির ভয়েই আরো মৃদু বোধ হয়, কিন্তু ফর্সা মুখখানা খুশিতে টসটসে। হাসল,— টাকাটা তখন পেয়ে খুব উপকার হয়েছে। বিকেলে অবশ্য অফিসের ওভারটাইম বিলটা পেয়ে গেলাম—
গণুদা পান খাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে পান চিবুচ্ছে বোধ হয়, একটা দুটো পানে দাঁত অস্ত্র লাল হয় না, ঠোঁটের এধারে পর্যন্ত শুকনো লালের ছোপ। কিন্তু সাধারণ দু পয়সার পান খাচ্ছে না গণুদা, আতর-মুশকি দেওয়া বিলাসী পান হবে—ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটা আমেজী গন্ধ ছড়িয়েছে।
ধীরাপদ ইশারায় বিছানাটা দেখিয়ে দিল, অর্থাৎ টাকাটা ওখানে রেখে যেতে পারে। কিন্তু টাকা রাখার বদলে গণুদা নিজেই বিছানায় এসে বসে পড়ল। — তুমি খাও, আমি বসি একটু।
এই পান-বিলাসের মুখে সহধর্মিণীর সামনে পড়তে চায় না। খাওয়া হয়ে গেছে। হাসি চেপে ধীরাপদ বারান্দার উঠোনে মুখ ধুতে গেল, মুখ ধুয়ে এসে দেখে, গণুদা গায়ের জামাটা খুলে ফেলেছে। বলল, গরম লাগছে—
মুখ মুছে বিছানায় বসে ধীরাপদ একটু হেসে মন্তব্য করল, নবাবী আমলের ‘রইস’রা পান খেয়ে গরমে তিন দিন বরফ জলে গলা ডুবিয়ে বসে থাকতো শুনেছি।
আনন্দে সব ক-টা লাল দাঁত দেখা গেল গণুদার। কাছাকাছি বসতে গন্ধটা উগ্র লাগছে এখন। বলল, তোমার জন্যেও নিয়ে আসব একদিন, এক-একটার দাম আট আনা করে, একদিন খেলে তিন দিন স্বাদ লেগে থাকে।
ধীরাপদকে গম্ভীর দেখে তাড়াতাড়ি জামাটা টেনে বুকপকেট থেকে পাঁচখানা দশ টাকার নোট তার দিকে এগিয়ে দিল।
হাত বাড়িয়ে সবে টাকাটা নিয়েছে, ঘরের মধ্যে যেন শূন্য থেকেই আবির্ভাব সোনাবউদির। কিসের টাকা ওটা?
কানের মধ্যে একঝলক করে গলানো আগুন ঢুকল দুজনারই। গণুদার পানমুখ সঙ্গে সঙ্গে কাগজের মত সাদা। ধীরাপদও হঠাৎ হকচকিয়ে গেল কেমন।
ও টাকা কিসের?
গণদার বিবর্ণ মুখে আর এক ঝলক আগুনের ঝাপটা। অস্ফুট জবাব দিতে চেষ্টা করল, ধী-ধীরুর-
ধীরুর টাকা তোমার কাছে কেন?
গণুদার মুখ নিচু। ধীরাপদ হতভম্ব। জবাব দিচ্ছে না কেন, কি এমন অপরাধ করেছে গণুদা!
এগিয়ে এসে হঠাৎ ছোঁ মেরে গণুদার হাত থেকে জামাটা টেনে নিল সোনাবউদি। ভাঁজ লণ্ডভণ্ড করে নাকের কাছে ধরে শুঁকল একটু। ক্ষিপ্ত জ্বালায় হিসহিসিয়ে উঠল আবার।—পান খেয়ে ও ছাইপাঁশের গন্ধ ঢাকবে ভেবেছ তুমি?
জামাটাই ফালা ফালা করবে বোধ হয়, কিন্তু না, জামার নিচের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নোট বার করল এক তাড়া-শ’ আড়াই-তিন হবে। নোট আর জামা হাতে সোনাবউদি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর দু হাতে জামাসুদ্ধ নোটগুলো দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে সজোরে গণুদার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল। ধীরাপদ নিষ্পন্দ কাঠ, সোনাবউদির দু চোখে ধকধক করছে সাদা আগুন।
নোট-দুমড়ানো জামাটা তুলে নিয়ে গণুদা ঘর ছেড়ে পালালো তক্ষুনি।
আপনি ওকে টাকা দিয়েছেন কেন?
এবারে ধীরাপদর পিঠের ওপরে যেন আচমকা চাবুক পড়ল একটা। কিন্তু ধীরাপদ বিমূঢ় তখনো।
আমি জানতে চাই আপনি কেন ওর হাতে টাকা দিয়েছেন? তীক্ষ্ণ অসহিষ্ণুতায় ঘরের বাতাস সুদ্ধ দুখানা হয়ে গেল যেন।
লাইফ ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম দেবার জন্যে চেয়েছিলেন।
সোনাবউদির শোনার ধৈর্য নেই, দ্বিগুণ ক্ষিপ্ততায় গলা চড়ল আরো।— ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম শুকলাল দারোয়ান দেয়, আপনি কেন আমাকে না জিজ্ঞাসা করে ওর হাতে টাকা দেবেন? কেন? কেন?
ধীরাপদ কি ভুল দেখছে? ভুল শুনছে? প্রিমিয়াম শুকলাল দারোয়ান দেয়? আজ কি বার? শনিবার নয়, রেস-এর দিন নয়। কিন্তু গণুদার পকেটে অত টাকা। জুয়ার আসর? জুয়ার আসরের দিনক্ষণ নেই।
ধীরাপদ নির্বাক, স্তব্ধ। কিন্তু সোনাবউদি থামেনি। তার কঠিন শাণিত কণ্ঠস্বর দু কান বিদীর্ণ করে বুকের মধ্যে গিয়ে কেটে বসছে—আপনার মস্ত চাকরি, অনেক টাকা মাইনে, কেমন? কেউ চাইলে টাকা দিয়ে অনুগ্রহ করার লোভ কিছুতে আর সামলে উঠতে পারেন না, না? কেন আপনার এত টাকার দেমাক? কেন আপনি-
বাইরে থেকে একটা কান্নার রোল ভেসে আসতে আচমকা থেমে গেল।
আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো সোনাবউদি। স্তব্ধ মুহূর্ত গোটাকতক। শ্লথ, অবসন্ন পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শকুনি ভট্টচাষ মারা গেলেন।
ধীরাপদ স্থাণুর মত বসে।