কাল তুমি আলেয়া – ১৪

চৌদ্দ

কোম্পানীর সঙ্গে নার্সিং হোমের কোনো সম্পর্ক নেই, মেডিক্যাল হোমের প্রথম দিনের আলাপে রমেন হালদার বলেছিল, ওর মালিক মিস সরকার আর ছোট সাহেব ইকোয়াল পার্টনারস্।

লাবণ্য সরকারকে ভালো মত চেনবার উদ্দীপনায় চপল গাম্ভীর্যে বক্তব্যটা আরো খানিকটা ফাঁপিয়েছিল সে। বলেছিল, মস্ত মস্ত ঘরের ফ্ল্যাট, একটা মিস সরকারের বেডরুম, দু ঘরে চারটে বেড়, আর একটা ঘরে বাদবাকি যা কিছু। মাস গেলে তিনশ’ পঁচাত্তর টাকা ভাড়া-মেডিক্যাল অ্যাডভাইসারের কোয়ার্টার প্রাপ্য বলে ভাড়াটা কোম্পানী থেকেই দেওয়া হয়। আর, সেখানে আলমারি বোঝাই যে সব দরকারি পেটেন্ট ওষুধ-টষুধ থাকে তাও কোম্পানী থেকে নার্সিং হোমের খাতে অমনি যায়, দাম দিতে হয় না—খুব লাভের ব্যবসা দাদা, বুঝলেন?

এতখানি বোঝাবার পর হাসি চাপতে পারেনি, হি-হি করে হেসে উঠেছিল রমেন হালদার।

এতদিনের মধ্যেও লাবণ্য সরকারের নার্সিং হোম সম্বন্ধে ধীরাপদ এর থেকে বেশি আর কিছু জানে না। জানার অবকাশও ছিল না। আজ এইভাবে সেখানে তার ডাক পড়তে রমেন হালদারের প্রথম দিনের তরল উক্তি মনে পড়ল। মনে হল, মেডিক্যাল হোম আর ফ্যাক্টরীতে লাবণ্য সরকারকে যতটা দেখেছে তা অনেকটাই বটে, কিন্তু সবটা নয়। ড্রাইভারকে গন্তব্যস্থানের নির্দেশ দেবার পর ধীরাপদর এই কৌতূহলের মধ্যে তলিয়ে যাবার কথা।

তা হল না। এমন অপ্রত্যাশিত আহ্বান সত্ত্বেও নিজের অগোচরে কৌতূহল মনের পর্দার ওধারেই ঝাপসা হয়ে থাকল। থেকে থেকে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে যে সে লাবণ্য সরকার নয়, পার্বতী। পার্বতী কি সত্যিই তার কাছে চেয়েছে কিছু? সত্যিই কি আশা করে কিছু? ধীরাপদর ওপর কর্ত্রীর নির্ভরতা দেখেছে, বড় সাহেবের আস্থা দেখেছে, আর সমস্যা যাকে নিয়ে হয়ত বা তারও প্রসন্নতার আভাস কিছু পেয়েছে—আশা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে মনের কথা ব্যক্ত করার মত যে মেয়ের নাগালের মধ্যে দ্বিতীয় আর কেউ কোথাও নেই। পার্বতী যা চেয়েছে বা যে আশার কথা বলেছে তার মধ্যে অস্পষ্টতা কিছু ছিল না। তবু কি জানি কেন, ধীরাপদ নিঃসংশয় নয় একেবারে। আর, কেবলই মনে হয়েছে, পার্বতী নিজেই হাল ধরতে জানে। উলের বোনা হাতে সামনে শুধু মোড়া টেনে বসে চীফ কেমিস্টের মত অসহিষ্ণু লোকটাকেও বশ করতে পারে।…আজকের এই অভিনব ব্যাপারটাও অবলার নিছক দুর্বল নির্ভরতার আশাতেই নয়। তার সমস্ত ক্ষোভের পিছনেও কোথায় যেন নিজস্ব শক্তি আছে একটা।

এই নীরব শক্তির দিকটাই আর কার সঙ্গে মেলে? সোনাবউদির সঙ্গে?

ভাবনা এর পর কোন্ দিকে গড়াতো বলা যায় না, গাড়িটা থামতে ছেদ পড়ল। ড্রাইভার বাঁয়ের বাড়িটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে জানালো গন্তব্যস্থানে এসেছে। বার দুই হর্নও বাজিয়ে দিল সে।

ধীরাপদ নেমে দাঁড়াল। রাত করে তেমন ঠাওর না হলেও রমেন হালদারের বর্ণনার সঙ্গে মিলবে মনে হল। হর্নের শব্দ শুনে লাবণ্য দোতলার বারান্দার রেলিংয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ ভালো না দেখা গেলেও স্পষ্টই চেনা যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যেতে বলল ড্রাইভার, দোতলার ফ্ল্যাট।

দোতলায় উঠতে উঠতে দেখল লাবণ্য সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সামান্য মাথা নাড়ল, অর্থাৎ আসুন। তারপর জিজ্ঞাসা করল, বাড়ি চিনতে কষ্ট হয়েছে?

ধীরাপদ হেসে জবাব দিল, না, ড্রাইভার চেনে মনে ছিল না।

বাড়িটা ধীরাপদর না চেনাটা ইচ্ছাকৃত যেন। কিন্তু লাবণ্য মুখে সে কথা বলল না। আসুন।

বারান্দা ধরে আগে আগে চলল। ওদিক থেকে একজন নার্স আসছিল। সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল সে। সামনেই বসার ঘর। রমেন হালদারের কথা মিলছে। বড় ঘরই। বসার পরিপাটি ব্যবস্থা। দুদিকে ঝকমকে দুটো বড় আলমারি। একটাতে বই, অন্যটাতে ওষুধ।

বসুন। গম্ভীরমুখে সে নিজেও সামনের একটা কুশনে বসল।

এই বাড়িতে প্রথম দিনের অভ্যর্থনা ঠিক এ-রকম হবার কথা নয়। কিন্তু ধীরাপদ এই রকমই আশা করেছিল। অসুখের পরে অফিস জয়েন করা থেকে এ পর্যন্ত সহকর্মিণীর বিদ্বেষের মাত্রা যে দিনে দিনে চড়ছে সেটা তার থেকে বেশি আর কে জানে। সব শেষে এই সরকারী ওষুধ সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটা স্নায়ুর ওপর চেপে বসেছে একেবারে। এ নিয়ে সেদিনের সেই বাক-বিনিময়ের পরে দায়ে না পড়লে আর তার মুখ দেখত কি না সন্দেহ। আজকের দায়টা কি ধীরাপদ জানে না। দায় যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, নইলে এভাবে বাড়িতে ডাকত না। কিন্তু আগ্রহ সত্ত্বেও এসেই জিজ্ঞাসা করতে পারল না, মুখ দেখেই মনে হয়েছে সমাচার কুশল নয়।

লাবণ্য সরকার একেবারেই আপ্যায়ন ভুলল না তা বলে। নির্লিপ্ত মুখে কর্তব্য করে নিল আগে—চা খাবেন?

না, এই খেয়ে এলাম। অন্তরঙ্গ অতিথির মতই ধীরাপদ ঘরের চারদিকে চোখ বোলাল একবার। পিছনের দরজা দিয়ে আর একটা প্রশস্ত ঘর দেখা যাচ্ছে।—-আপনার ফ্ল্যাটটা তো বেশ!

এভাবে ডেকে পাঠানোর হেতু না জানলেও প্রথমেই অনুকূল আবহাওয়া রচনার চেষ্টা একটু।

কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা। ফ্ল্যাটের স্তুতি পদ্মপাতায় জলের মত একদিকে গড়িয়ে পড়ল। আঁট হয়ে বসার ফাঁকে লাবণ্য তাকে দেখে নিল একটু। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ও-বাড়িতে তো কেউ নেই শুনলাম, চা কে খাওয়াল, পার্বতী?

লাবণ্যর গাম্ভীর্যের তলায় বিদ্রূপের আঁচ। পার্বতীকে ভালই চেনে তাহলে, ভালই জানে। ধীরাপদর কেন যেন ভালো লাগল হঠাৎ। বলল, শুধু চা? যে খাওয়া খাইয়েছে হাঁসফাঁস অবস্থা। চমৎকার রাঁধে, ওর রান্না খেয়েছেন কখনো?

লাবণ্য তেমনি ওজন করে জবাব দিল, খেয়েছি, তবে হাঁসফাস করার মত করে খাইনি। পার্বতী জুলুম করে খাওয়াতে জানে, তাও এই প্রথম জানলাম।

আরো ভালো লাগছে। এবারে লাবণ্যকে সুদ্ধ ভালো লাগছে ধীরাপদর।— আর বলেন কেন, এখানে আসতে আসতে আপনার থেকে ওষুধ চেয়ে নেব ভাবছিলাম।

ওষুধ কতটা দরকার স্থির চোখে তাই যেন দেখছে লাবণ্য সরকার। বলল, পার্বতী টেলিফোনের খবরটা আপনাকে দিতে চায়নি, আমি কে কথা বলছি; কেন ডাকছি জিজ্ঞাসা করছিল। অত খাওয়ার পরে আপনার বিশ্রামের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটানো ইচ্ছে ছিল না হয়ত। প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্যেই থামল দুই এক মুহূর্ত।—ইচ্ছে আমারও ছিল না, দায়ে পড়েই আপনাকে কষ্ট দিতে হল।

এই দায়ের প্রসঙ্গ একেবারে না উঠলে ধীরাপদ খুশি হত। কিন্তু কতক্ষণ আর এড়ানো যায়? বলল, কষ্ট আর কি। কিছু একটা বিশেষ কারণে তাকে ডেকে আনা হয়েছে সেটা যেন এতক্ষণে মনে পড়ল। –কি ব্যাপার, জরুরী তলব কেন?

আপনাকে একজন পেসেন্ট দেখাবার জন্যে।

ধীরাপদ অবাক। এমন দায়ের কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। চকিতে অমিতাভ ঘোষের কথাই মনে হল প্রথম। তার কি হয়েছে, কি হতে পারে। কিন্তু লাবণ্য আর কিছু না বলে চেয়ে চেয়ে খবরটার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছে শুধু।

…আমাকে পেসেন্ট দেখাবার জন্যে? কে?

আসুন। লাবণ্য উঠে দাঁড়াল।

তাকে অনুসরণ করে হতভম্বের মত ধীরাপদ সামনের ঘরে এলো। ঘরের একদিকের বেড খালি, অন্যদিকের বেড়টায় পেসেন্ট একজন। কিন্তু অমিত ঘোষ নয় ত একটি মেয়ে। কে? ধীরাপদ হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারল না কে, গলা পর্যন্ত চাদর ঢাকা, বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। ঘুমিয়ে আছে। রক্তশূন্য, বিবর্ণ।

কে। ধীরাপদ এগিয়ে এলো আরো দু পা। তার পরেই বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্তপ্রায়। লাবণ্য স্থির-চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। ধীরাপদ বিমূঢ় বিস্ময়ে রোগী দেখছে। রোগী নয় রোগিণী।

বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার পর অবশ স্নায়ু যেমন সক্রিয় হয়ে ওঠে একটু একটু করে, তেমনি হল। স্মৃতির অস্ত্র-তন্ত্র দগদগিয়ে উঠতে লাগল চোখের সামনে।

বীটার রাইস! বীটার রাইস। বীটার রাইস।

ধীরাপদ চক্রবর্তী, তুমি একদিন ছেলে পড়াতে আর কবিরাজি ওষুধের আর দে-বাবুর বইয়ের আশা-জাগানো আর কামনা-তাতানো বিজ্ঞাপন লিখতে, লাল জল গিলে আর বাতাস গিলে কার্জন পার্কের বেঞ্চিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে, আর চোখে যা পড়ত চেয়ে চেয়ে দেখতে। শুধু দেখতে। তোমার সেই দেখার মিছিলে এই মেয়েটাও এসেছিল একদিন, তারপর আরো অনেক দিন। এই সেদিনও, যেদিন রেস্তোরাঁয় বসে তুমি ওর খাওয়া দেখছিলে আর তার প্রতি গরাসে তোমার বাসনার গালে চড় পড়েছিল একটা করে। বীটার রাইস…বাংলা হয় না। না হওয়ার জ্বালাও জুড়িয়েছে।

কিন্তু আশ্চর্য, এই মেয়ে এখানে এলো কেমন করে? পৃথিবীটা এত গোল? চিনলেন? যতটা দেখবে ভেবেছিল, লাবণ্য সরকার তার থেকে বেশি কিছুই দেখেছে।

জবাব না দিয়ে ধীরাপদ মেয়েটার দিকে তাকালো আবার, তারপর লাবণ্যর দিকে।

ও ইনজেকশনে ঘুমিয়েছে, এখন উঠবে না। অর্থাৎ, রোগিণীর কারণে চুপ করে থাকার দরকার নেই। তবু কি ভেবে লাবণ্য নিজেই বসার ঘরের দিকে ফিরল আবার, যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকালো শুধু। তাৎপর্য, দেখা হয়ে থাকে তো আসুন এবার—

ফিরে আগের জায়গাতেই এসে বসল ধীরাপদ। কিন্তু একটু আগের সেই লোকই নয়। আক্রোশ-ভরা চোখে লাবণ্য তার এই হতচকিত অবস্থাটা মেপে নিল একপ্রস্থ। প্রবলের একটা মস্ত দুর্বল দিক অনাবৃত দেখার মত করে।

মেয়েটার নাম কী?

কি নাম মেয়েটার। জানত তো সোনা রূপো হীরে…

কাঞ্চন।

কাঞ্চন কী? লাবণ্য যেন কোণঠাসা করছে তাকে।

ধীরাপদ মাথা নাড়ল, জানে না। লাবণ্যর বিদ্রুপভরা গাম্ভীর্য আর ঈষদুষ্ণ জেরার সুরটা চোখে পড়ল, কানে লাগল। আবারও একটা নাড়াচাড়া খেয়ে সচেতন হল সে। ওকে জড়িয়েই কিছু একটা ঘটেছে, আর সেই কারণে টেলিফোনে প্রায় চোখ রাঙিয়ে তাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে। জবাবদিহি করার জন্যে।

নিজেকে আরো একটু সংযত করে নিল আগে। সবই জানতে বাকি, বুঝতে বাকি। শাশুমুখে এবারে সে-ই জিজ্ঞাসা করল, এই মেয়েটা আপনার এখানে এলো কি করে?

এই পরিবর্তনটুকুও লাবণ্য লক্ষ্য করল বোধ হয়। ফুটপাথের কোন ল্যাম্পপোস্টের নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, আর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। অমিতবাবু গাড়ি করে যাচ্ছিলেন, দেখতে পেয়ে দয়া করে তুলে এনে এখানে দিয়ে গেছেন। আর, হুকুম করে গেছেন সেবাযত্ন করে সারিয়ে তোলা হয় যেন। খারাপ জাতের অ্যানিমিয়া, অন্য রোগও থাকতে পারে, কিন্তু সে-সব অত ধৈর্য ধরে শোনার সময় হয়নি তাঁর।

শোনার আগ্রহ ধীরাপদরও কমে আসছিল। রোগের নাম শোনার পরেও। খাদ্যের অভাব আর পুষ্টির অভাবেই সাধারণত ওই রোগ হয় শুনেছিল। মেয়েটার ক্ষুধার সে- দৃশ্য অনেকবার মনের তলায় মোচড় দিয়েছে, কিন্তু এই মুহূর্তে দিল না। জিজ্ঞাসা করল, আমাকে আপনি কি জন্যে ডেকে এনেছেন?

লাবণ্য সোজাসুজি চেয়ে রইল একটু। চোখে আর ঠোঁটে চাপা বিদ্রূপ। বলল, অসুখ তো কারো হুকুমে সারে না, মন্ত্রগুণেও নয়। চিকিৎসা করতে হলে পেসেন্ট সম্বন্ধে ডাক্তারের কিছু খবরাখবর জানা দরকার—সেই জন্যে। অমিতবাবু কিছু বলতে পারলেন না, শুনলাম আপনিই জানেন শোনেন…

আঁচড় যেটুকু পড়বার পড়ল।

কিন্তু ধীরাপদর মুখ দেখে বোঝা গেল না পড়ল কি না। অমিত ঘোষ কি বলেছে বা কতটা বলেছে আপাতত তাও জানার আগ্রহ নেই।

কি খবর চান?

রোগিণীর খবর সংগ্রহের জন্য তাকে ডেকে আনা হয়নি ভালই জানে। একটা নগ্ন বিড়ম্বনায় হাবুডুবু খেতে দেখবে সেই আশায় ডেকেছে। ওকে লাগামের মুখে রাখার মতই মস্ত এক অস্ত্র হাতে পেয়েছে ভেবেছে। তপ্ত শ্লেষে লাবণ্য বলে উঠল, কেমন রাঁধে, খেয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা হয় কি না, এই সব খবর-

হাসা শক্ত তবু হাসতে চেষ্টা করল ধীরাপদ। বলল, যে অসুখের নাম করলেন রাঁধা বা রেঁধে খাওয়ানোর সুযোগ তেমন পেয়েছে মনে হয় না।

ধৈর্য ধরে লাবণ্য সরকার আরো একটু দেখে নিল।—ও-রকম একটা মেয়েকে অমিতবাবু চিনলেন কি করে?

ধীরাপদর মনে হল, বিদ্বেষের এ-ও হয়ত একটা বড় কারণ। এ রকম মেয়েকে অমিত ঘোষ চেনে, শুধু চেনে না— অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলে রাস্তা থেকে তুলেও আনে। ভিতরটা হঠাৎই অকরুণ তুষ্টিতে ভরে উঠেছে ধীরাপদর। নির্লিপ্ত জবাব দিল, আমিই একদিন চিনিয়ে দিয়েছিলাম।

ও। ধৈর্যের বাঁধ টলমল তবু সংযত সুরেই বলল, মেয়েটাকে এখান থেকে সরাবার ব্যবস্থাও তাহলে আপনিই করুন, এ-রকম পেসেন্ট এক দিনের জন্যেও এখানে থাকে সেটা আমার ইচ্ছে নয়।

বুদ্ধিমতী হয়েও এমন অবুঝের মত কথা বলবে ভাবেনি ধীরাপদ। রাগের মাত্রা টের পাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে যথার্থই তুষ্ট এবারে, কিন্তু সে তুষ্টি প্রীতিসিক্ত নয় আদৌ। খানিক আগের সেই ভালো লাগার ওপর কালি ঢালা হয়ে গেছে। ধীরাপদর সরাসরি চেয়ে থাকতেও বাধছে না আর, নিজের অগোচরে দু চোখ ভোজের রসদ খুঁজছে।

বলল, আপনি ডাক্তার, আপনার রাখতে অসুবিধে কি, আমি তো বুঝছি না।

একেবারেই বুঝছেন না, কেমন?

ধীরাপদ সত্যিই বুঝে উঠছে না বলে বিব্রত আর বিড়ম্বিত যেন। মাথা নাড়ল। —না। কোম্পানীর কোয়ার্টার, বেডও খালি আছে, ওষুধও বেশির ভাগ হয়ত কোম্পানী থেকেই পাওয়া যাবে… আপনার রাখতে এমন কি অসুবিধে?

লাবণ্য স্তম্ভিত কয়েক মুহূর্ত। এই সুবিধে পায় বলেই ইঙ্গিতটা আরো অসহ্য। এতকাল এ নিয়ে ঠেস দেবার সাহস কারো হয়নি। নিশ্চিত্ত নিরুপদ্রব দখলের ওপর অতর্কিত স্থূল ছোবল পড়ল যেন একটা। ঘরের সাদাটে আলোয় প্রায় ফর্সা মুখখানা রীতিমত ফর্সা দেখাচ্ছিল এতক্ষণ। বর্ণান্তর ঘটতে লাগল।

আপনি কি এটা ঠাট্টার ব্যাপার পেয়েছেন?

তেমনি শাক্ত মুখে ধীরাপদ ফিরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমাকে এখানে কেন ডেকে এনেছেন?

এখানে এ-সব নোংরা ব্যাপার কেন আমি বরদাস্ত করব?

বরদাস্ত না করতে চাইলে যিনি এনেছেন তাঁকে বলুন, আমাকে কেন ডেকেছেন? যিনি এনেছেন তিনি আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছেন, আপনাকে খবর দিতে বলেছেন।

চোখে চোখ রেখে ধীরাপদ থমকালো একটু, অমিত ঘোষ কি বলতে পারে আর কতটা বলতে পারে অনুমান করা শক্ত নয়। তাকে দেখিয়ে দেওয়া বা খবর দিতে বলাও স্বাভাবিক। মেজাজে থাকলে ঠাট্টাও করে থাকতে পারে কিছু। নিস্পৃহ জবাব দিল, লোক ডেকে আবার রাস্তায়ই রেখে আসতে বলুন তাহলে-

ওই ঘরে মেয়েটার শয্যাপাশে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অমন বোবা স্তব্ধতা নিজের চোখে না দেখলে এই জবাব শুনে লাবণ্যর খটকাই লাগত হয়ত। কিন্তু যা দেখেছে ভোলবার নয়। আচমকা ঝাঁকুনি খেতে দেখেছে, তারপর বিস্ময়ে পাথর হয়ে থাকতে দেখেছে কয়েকটা মুহূর্ত। লাবণ্য চেয়ে আছে। উদ্ধত নির্লিপ্ততার আড়ালে অপরাধ-চেতন দুর্বলতার ছায়া খুঁজছে।

অর্থাৎ, ওই মেয়েটাকে আপনি জানেন স্বীকার করতেও আপত্তি, আর আপনার কোনো দায়িত্ব নেই, কেমন?

ধীরাপদ উঠে দাঁড়াল।— আপনি যতটা জানি ভাবছেন ততটা স্বীকার করতে আপত্তি। আর, দায়িত্বটা আপাতত আমার থেকে আপনারই বেশি।

কোনো সম্ভাষণ না জানিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। নিচে নেমে সোজা স্টেশান ওয়াগনে উঠেছে। রাগে নয়, ভয়ে নয়—নিজের ওপর আস্থা কমে আসছিল। ঘরের অত সাদা আলোয় লোভের ইশারা ছড়ানো ছিল। লাবণ্যর বিরাগের ফাঁকে ধীরাপদর চোখে সেদিনের মত সেই গ্রাসের নেশা ঘনিয়ে আসছিল। গাড়িতে ওঠার পর নিজের ওপরেই যত আক্রোশ তার। দরদের একটুখানি সরু বুনোনির বাঁধন এত কাম্য কেন? সেটা না পেলেই প্রবৃত্তির আগুন অমন জ্বলে উঠতে চায় কেন?…লাবণ্য কোন সময় বরদাস্ত করতে চায় না ওকে, না চাওয়ারই কথা। ওকে অপদস্থ করার চেষ্টা সর্বদা ভাবলে তাও অস্বাভাবিক নয় কিছু। লাবণ্যর চো। পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, তার পাশাপাশি ওর অবস্থানটাই বড় বেশি স্থূল বাস্তবের মত। তার প্রতিষ্ঠার অভিসারে সুলতান কুঠির ধীরাপদ চক্রবর্তীর আবির্ভাব ভূঁইফোড় প্রহরীর মতই অবাঞ্ছিত।

ড্রাইভার কোনো নির্দেশ না নিয়েই গাড়ি ছুটিয়েছে। এবারের গন্তব্যস্থল সুলতান কুঠি, জানা আছে। একরকম জোর করেই ধীরাপদ ওই আলো-ধোয়া সাদা ঘরের লোলুপ তন্ময়তা থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে এলো। পাশের ঘরের রোগশয্যায় অচেতন ওই পথের মেয়ের রক্তশূন্য পাংশু মূর্তির চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আজও তার পরনে চোখ-তাতানো ছাপা শাড়ি আর গায়ে কটকটে লাল ব্লাউস ছিল কিনা ধীরাপদ দেখেনি। গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা ছিল। মুখেও কোনো প্রসাধনের চিহ্ন ছিল না, জলের ঝাপটায় উঠে গিয়ে থাকবে। নিঃসাড় কচি একটা মুখ শুধু…করুণ আবেদনের মত বিছানায় মিশে আছে।

ধীরাপদর বুকের কাছটা মোচড় দিয়ে উঠল কেমন। গভীর মমতায় অন্তস্তলের সব আলোড়ন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে আর একজনের প্রতি শ্রদ্ধায় অনুরাগে মন ভরে উঠেছে। সব জেনেও মেয়েটাকে পথ থেকে নির্দ্বিধায় তুলে এনেছে অমিত ঘোষ, তুলে আনতে পেরেছে। সে-ই পারে। ধীরাপদ পারত না। শুধু তাই নয়, সেবা- শুশ্রূষায় মেয়েটাকে সারিয়ে তুলতে হুকুম করে গেছে লাবণ্যকে। ধীরাপদর কেমন মনে হচ্ছে, গ্লানির গর্ভবাস থেকে মেয়েটার মুক্তি ঘটল।

হঠাৎ কি ভেবে ড্রাইভারকে আর এক পথে যেতে নির্দেশ দিল সে। ভাবছে গলিটা চিনবে কি না। সেই কবে একদিন অন্ধকারে এসেছিল। একটা খবর দেওয়া দরকার, ছোট ছোট কতগুলো ভাই-বোন আছে শুনেছিল, আর বাপ আছে…চোখে ছানি। খবর না পেলে সমস্ত রাত ধরে প্রতীক্ষাই করতে হবে তাদের। অন্নদাত্রীর প্রতীক্ষা, জঠরের রসদ জুটবে কি জুটবে না সেই প্রতীক্ষা।

কিন্তু যত এগোচ্ছে তত অস্বস্তি। আলো শুষে নেওয়া অন্ধকার গলিটা ঠাওর না করতে পারলেই যেন ভালো হয়। সেই ভালোটা হবে না জানা কথা, একবার দেখলে ভোলে না বড়। একটা বাস্তবের ঝাপটায় যেন মোহভঙ্গ হয়ে গেল আবার। কোথায় চলেছে সে? সেখানে গিয়ে কার কাছে কি বলবে? ধীরাপদ লোকটাই বা কে? তা ছাড়া দেহের বিনিময়ে পেটের অন্ন সংগ্রহ করতে হয় যাকে, সে-ই সময়মত ঘরে ফিরল কি ফিরল না সে-জন্যে কোন্ বাবা-ভাই-বোনেরা উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে? এক রাত দু রাত না ফিরলে বরং তাদের আশার কথা, বড়দের শিকার লাভের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠার কথা।

গলিটা পেরিয়ে গেল। ধীরাপদ বড় করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল একটা। নিজের পাগলামি দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। চেষ্টা করে অমিত ঘোষ হওয়া যায় না।

পরদিন। ধীরাপদর অফিসঘরে অমিতাভ ঘোষ নিজেই এসে হাজির। আজ এর থেকে বেশি কাম্য আর বোধ হয় কিছু ছিল না।

ধীরাপদর আসতে একটু দেরি হয়েছিল। এসে শুনেছে, বড় সাহেব আজও সকালে এসেছিলেন। এসে তাকেই ডেকেছিলেন, তাকে না পেয়ে মিস সরকারের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে গেছেন। অন্যদিন হলে ধীরাপদ লাবণ্যর ঘরে খবর নিতে ঢুকত। আজ গেল না। সে-ই আসে কিনা দেখা যাক। তেমন জরুরী হলে আসবে।

টেবিলে অনেক কাজ জমে। গত দু দিন বলতে গেলে কিছুই করেনি। কিন্তু ফাইলে মন বসছিল না। বড় সাহেবের কথা ভাবছিল না, লাবণ্যর কথাও না। ভাবছিল অমিতাভ ঘোষের কথা। আজকের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। এখানে হোক বাড়িতে হোক দেখা করবে।

সিগারেট মুখে হড়বড় করে তাকেই ঘরে ঢুকতে দেখে ধীরাপদর আনন্দের অভিব্যক্তিটুকু প্রকাশ হয়ে পড়ছিল। সামলে নিল। ফাইলে চোখ আটকে নিস্পৃহ আহ্বান জানালো, আসুন—। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দেখে নিয়েছে। মুখখানা আজ আর অত থমথমে নয়।

শব্দ করে চেয়ার টেনে বসতে বসতে অমিতাভ জিজ্ঞাসা করল, ব্যস্ত খুব?

খুব না। একটা ফাইল ঠেলে দিয়ে আর একটা ফাইল হাতের কাছে টেনে নিয়ে তাকালো। এতদিনের একটানা গাম্ভীর্য একেবারে তরল নয়, মেঘের ওপর কাঁচা রোদের মত ওই গাম্ভীর্যের ওপর একটুখানি কৌতুকের আভাস চিকচিক করে উঠেছে। ধীরাপদর কাছে ওটুকুই আশ্বাসের মত।

চেয়ারের হাতলের ওপর দিয়ে এক পা ঝুলিয়ে দিয়ে অমিতাভ আরাম করে বসল। ছটফটে খুশির ভাব একটু। হাতের কাছে মনের মত কিছু পেয়ে গেলে ছোট ছেলে যেমন সাময়িক ক্ষোভ ভোলে, অনেকটা তেমনি। লঘু ভ্রুকুটি।-আমাদের এখানকার মহিলাটির সঙ্গে আপনার আজ দেখা হয়েছে?

আজ? না, আজ হয়নি। কোন্ প্রসঙ্গের অবতারণা ধীরাপদ আন্দাজ করেছে। –কাল দেখা হয়েছিল।

কাল কখন?

দুপুরে অফিসে, তারপর রাত্রিতে…..

রাত্রিতে কখন? চেয়ারের হাতল থেকে পা নামিয়ে অমিতাভ সকৌতুকে সামনের দিকে ঝুঁকল।

আপনি সেই মেয়েটাকে রেখে যাবার খানিক পরেই হয়ত… আমাকে টেলিফোনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

অমিতাভ হাসতে লাগল। কাউকে মনের মত জব্দ করতে পারার তুষ্টি। কিন্তু ধীরাপদর মনে হল, স্মৃতির ভাণ্ডারে পুঁজি করে রাখার মত সেটুকু। চপল আনন্দে সে ধমকেই উঠল, আপনি অমন টিপটিপ করে বলছেন কেন? কি হল, ক্ষেপে গেছে খুব?

যাওয়ারই তো কথা-

দুই ভুরুর মাঝে কৃঞ্চন-রেখা পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। কি বলে, মেয়েটাকে রাখবে না?

ঠিক তা বলেননি-

তবে?

জবাব দেওয়ার ফুরসৎ হল না। তার আগে দুজনারই দরজার দিকে চোখ গেল। লাবণ্য সরকার। ঠাণ্ডা নিরাসক্ত আবির্ভাব। এক নজর দেখেই ধীরাপদর মনে হল, ঘরে আর কে আছে জেনেই এসেছে।

কাম্ ইন্‌ ম্যাডাম। ছদ্ম-গাম্ভীর্যে অমিতাভর দরাজ আহ্বান, তোমার কথাই হচ্ছিল। পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করল।

জবাবে লাবণ্য নির্লিপ্ত চোখে তাকালো শুধু একবার। অর্থাৎ প্রতীক্ষার জন্যে ব্যস্ত নয় সে, শোনার জন্যেও ব্যগ্র নয়। মন্থর গতিতে টেবিলের সামনে এসে ধীরাপদর দিকে আধাআধি ফিরে দাঁড়াল।—মিস্টার মিত্র সকালে আপনার খোঁজ করছিলেন।

কেন খোঁজ করছিলেন শোনার আগে ধীরাপদ বসতে বলতে যাচ্ছিল, কি ভেবে বলল না। বললেও বসবে না, যা বলতে এসেছে তাই বলবে শুধু। নীরব, জিজ্ঞাসু।

উনি অ্যানিভারসারির প্রোগ্রাম করতে বলে গেলেন আমাদের, তারপর আলোচনায় বসবেন।

অমিতাভর সিগারেট ধরানো হল না, উৎফুল্ল মুখে বাধা দিয়ে উঠল, আমাদের বলতে আর কে? হু এলস?

লাবণ্য তার দিকে ঘাড় ফেরাল। – আপনি নয়।

আই নো, আই নো, বাট হু এলস- ধীরুবাবু? পুরু লেন্সের ওপর চপল বিস্ময় উপচে পড়ছে, ওসব প্রোগ্রাম-টোগ্রাম তো এত কাল ছোট সাহেবের সঙ্গে বসে করতে, সে আউট এখন? একেবারে বাতিল?

লাবণ্য চুপচাপ শুনল আর উচ্ছ্বাস দেখল। তারপর ধীরাপদর দিকে ফিরে ধীরে- সুস্থে বড় সাহেবের দ্বিতীয় দফা নির্দেশ পেশ করল।—মিস্টার মিত্র আজ সন্ধ্যায় বাড়ি থাকবেন না, কাল সকালেও ব্যস্ত থাকবেন, কাল অফিসের পর তাঁর পার্সোন্যাল ফাইল নিয়ে আপনাকে বাড়িতে দেখা করতে বলে গেছেন, বিশেষ দরকার-

অমিতাভর উচ্ছ্বাসের জবাব দেয়নি বটে, কিন্তু একটু জবাবের মতই। প্রোগ্রাম তাকে যার সঙ্গে বসে করতে হবে সে মানুষ কোন্ দরের, বড় সাহেবের নির্দেশ জানিয়ে পরোক্ষে সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

হিমাংশু মিত্রের এই পার্সোন্যাল ফাইলের খবর সকলেই জানে। তাঁর বাণী, তাঁর ভাষণ, তাঁর সভা-সমিতির বিবরণ, তাঁর চ্যারিটি, তাঁর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, ব্যবসায়ে নীতি এবং আদর্শ প্রসঙ্গে তাঁর বহুবিধ মন্তব্য, তাঁর প্রসঙ্গে খবরের কাগজ আর কমার্স জার্নালের মন্তব্য, তাঁর বাণিজ্যকেন্দ্রিক নিবন্ধ—এক কথায় ছাপার অক্ষরে তাঁর কর্মশীলতার যাবতীয় খুঁটিনাটি তারিখ মিলিয়ে যে ফাইলে সাজানো সেটাই পার্সোন্যাল ফাইল। সে ফাইল এখন ধীরাপদর হেপাজতে। সেটা নিয়ে বাড়িতে যেতে বলার একটাই উদ্দেশ্য—তাঁর নতুন কোনো ভাষণ বা প্রেরণা রচনার বুনোটে বেঁধে দিতে হবে।

ধীরাপদ অমিতাভর দিকে তাকালো একবার, একটু আগের হাসিখুশির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আভাস।

লাবণ্য নির্বিকার।—জীবন সোমও আপনার খোঁজ করে গেছেন, বিশেষ কথা আছে বলেছিলেন। মনে পড়ল বলে বলা গোছের খবর এটা।

ফস্ করে দেশলাই জ্বালার শব্দ। অমিতাভ সিগারেট ধরিয়ে বিরক্তবিচ্ছিন্ন মুখে ধোঁয়া ছড়াতে লাগল।

সময় বুঝে বড় সাহেবের নির্দেশ জানাতে আসা প্রায় সার্থক। জীবন সোমের খোঁজ করে যাওয়ার বার্তায় কোম্পানীর সমূহ সমস্যার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কাজটাও সুসম্পন্ন। পরিতুষ্ট গাম্ভীর্যে লাবণ্য ধীরে-সুস্থে এবারে অমিতাভর মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াল।—কাল রাতে আপনাকে আমি দুবার টেলিফোন করেছিলাম। একবার নটায়, একবার এগারোটায়—

রাত তিনটেয় করলে পেতে। গভীর প্রত্যুত্তর। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল বোধ হয়, দুবার টেলিফোনটা অফিস সংক্রান্ত কোনো তাগিদে নয়। টেলিফোন করার মত একটা জুতসই গণ্ডগোল সে-ই গত সন্ধ্যায় পাকিয়ে রেখে এসেছিল বটে। ছেলেমানুষের মতই দু চোখ উৎসুক হয়ে উঠল আবার, কেন—ওই মেয়েটি আছে কেমন?

সেরে উঠে এতক্ষণে ছুটোছুটি করছে বোধ হয়।

অমিতাভ হেসে উঠল। মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে বলল, রোগিণী না হয়ে রোগী হলে করত, এতক্ষণে হার্টফেল করেছে কিনা জিজ্ঞাসা করছিলাম—

ঈষৎ রূঢ় গলায় লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল, আপনার মাননীয় পেসেন্টের প্যাথলজিক্যাল টেস্টগুলো সব কে করিয়ে আনবে? ওটা হাসপাতাল নয় যে পেসেন্ট ফেলে এলেই চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে— সে-সব দায়িত্ব কে নেবে?

অম্লান বদনে অমিতাভ তৎক্ষণাৎ ধীরাপদকে দেখিয়ে দিল। বলল, উনি। মাননীয় পেসেন্টের ওপর আমার থেকে ওঁর ক্লেম বেশি, মায় চিকিৎসার খরচসুদ্ধ তুমি ওঁর নামে বিল করে দিতে পারো।

এ-রকম কিছু একটা সুযোগের প্রতীক্ষাতেই ছিল। উনি বলতে কাকে বলছে ঘাড় ফিরিয়ে লাবণ্য তাই যেন দেখে নিল একবার। তপ্ত শ্লেষে নিটোল কণ্ঠস্বর ভরাট শোনালো আরো। – আপনার কথায় বিশ্বাস করে কাল রাতে ওঁকেই ডেকে দায়িত্বের কথা বলতে গিয়েছিলাম। দায়িত্ব নেওয়া দূরে থাক, উনি ওই পেসেন্টকে চেনেন বলেও মনে হল না।

অমিত ঘোষের এবারের চাউনিটা বিস্ময়যুক্ত। এ জবাব খুব অপ্রত্যাশিত নয়। এতক্ষণ মুখ বুজেই ছিল ধীরাপদ, একটি কথাও বলেনি। কিন্তু আর চুপ করে থাকা গেল না, চুপ করে থাকাটা কাপুরুষতার সামিল। লাবণ্য সরকার প্রকারান্তরে কাপুরুষই বলেছে তাকে। লঘু সংযমের মুখোশ অটুট রেখে ধীরাপদ যে-কথাগুলো বলে বসল, তা এই অফিস-ঘরে অন্তত বলার কথা নয়। লাবণ্যর চোখ দুটো নিজের দিকে ফেরাবার জন্যে প্রায় হাসিমুখেই হাতের এধারের ফাইল দুটো তুলে নিয়ে একটু শব্দ করে টেবিলের ওধারে রাখল।

লাবণ্য ফিরে তাকালো।

আমি চিনি না বলিনি, বলেছি আপনি যতটা চিনি বলে ধরে নিয়েছেন ততটা চিনি না। থামল, চোখে চোখ রেখে হাসতে লাগল।-আমার স্বভাব-চরিত্র জানার ব্যাপারে আপনার আগ্রহ আছে সেই আশা পেলে শুধু মুখে বলা নয়, একেবারে সাক্ষী-প্রমাণ এনে নিজের জন্যে খানিকটা সুপারিশ করতেও রাজি আছি।

কতক্ষণ লাগে কথাগুলো কানের পর্দায় ঝনঝনিয়ে উঠতে আর তার প্রতিক্রিয়া সর্বাঙ্গের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়তে? কোম্পানীর মেডিক্যাল অ্যাডভাইসার, মেডিক্যাল হোমের ডাক্তার, নার্সিং হোমের হাফমালিক লাবণ্য সরকারের সময় লাগল একটু। সময় লাগছে।

দৃষ্টি-দহনে কারো মুখ ঝলসে দেওয়া সম্ভব হলে ধীরাপদর মুখখানা অক্ষত থাকত না হয়ত। লাবণ্য ঘর ছেড়ে চলে গেল। যাবার আগে সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি একবার অমিতাভ ঘোষের মুখের ওপরেও বুলিয়ে দিয়ে গেল।

অমিতাভ হেসে উঠেছিল। সে চলে যেতে উৎফুল্ল আনন্দে ধীরাপদর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, এইজন্যেই আপনাকে মাঝে মাঝে ভালো লাগে আমার—

কিন্তু ধীরাপদর হাসলে চলবে না এখন, এ সুযোগ গেলে অনেকটাই গেল। হাতে হাত ঠেকানোর বদলে গম্ভীর মুখে কলমটা এগিয়ে দিল সে। —লিখে দিন, আপনার সার্টিফিকেট খুব দরকার এখন। তারপর খোলা কলমটা বন্ধ করতে করতে পাল্টা ধাক্কা দিল, আপনার ব্যবহার মাঝে মাঝে আমার প্রায় অসহ্য লাগে!

প্রসঙ্গ পরিবর্তনের সূচনা এটা অমিতাভ ভাবতে পারেনি। খুশির উদ্দীপনায় চোখ পাকিয়ে তরল প্রতিবাদ জানালো, ওই মেয়েটাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছি বলে? কি অবস্থায় পড়েছিল জানেন?

জানি। সেজন্যে নয়।

অমিতাভ থমকালো, সপ্রশ্ন চাউনি।

লোহা পিটবে তখন, গনগনে গরম যখন। কিন্তু ধীরাপদ কার হয়ে হাতুড়ি হাতে নেবে প্রথম—হিমাংশু মিত্রের না চারুদির না পার্বতীর? অবকাশও একবারের বেশি দুবার পাবে বলে মনে হয় না। কোম্পানীর সমস্যাটাই গলার কাঁটা আপাতত, ওই কাঁটা নেমে গেলে মোটামুটি একটা বড় দুশ্চিন্তার অবসান। পরের কথা পরে ভাববে। শান্তমুখে বলল, আর তিন-চার দিন বাদে গভর্ণমেন্ট অর্ডার সাপ্লাইয়ের ডেট, তাদের কোনো খবর দেওয়া হয়নি—ওই তারিখেই তারা মাল ডেলিভারি চাইবে। আপনি আমাকে এভাবে অপদস্থ করছেন কেন?

অমিতাভ যেমন বিস্মিত, তেমনি বিরক্ত।—অর্ডার সাপ্লাই হোক বা না হোক আপনার কি আসে যায়? এর মধ্যে আপনি কে? হু আর ইউ?

আমি কে আপনার মাসিকে সেটা জিজ্ঞাসা করে নেবেন। আপনার বিরাগভাজন হয়ে এখানে যে আমি এক দিনও টিকে থাকতে পারি না, সেটা আর কেউ না জানুক তিনি জানেন।

দুর্বোধ্য লাগতে বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে অমিতাভ মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু। টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট হাতে উঠে এসেছে।

কোনরকম বিশ্লেষণের ধার দিয়েও গেল না ধীরাপদ। অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন, সেটা হয়ে উঠেছে। কণ্ঠস্বর আরো গম্ভীর।—অসুখের পর কাজে এসে টের পেলাম আপনার বিরুদ্ধে আমি ষড়যন্ত্র করেছি এ-রকম সন্দেহও আপনার মনে এসেছে—

টেবিল চাপড়ে অমিতাভ ক্ষিপ্তকণ্ঠে ধমকে উঠল, বাট হু আর ইউ? আপনি ষড়যন্ত্র করার কে?

কেউ যে না সেটা আপনিই ভাবতে পারছেন না কেন? মিস্টার মিত্রকে একজন অভিজ্ঞ সিনিয়র কেমিস্ট আনার পরামর্শ দিয়েছিলাম কোম্পানীর সুবিধের জন্যে, আর সব থেকে বেশি আপনার সুবিধের জন্যে—সেটা আপনি একবারও ভাবলেন না কেন? আপনার সঙ্গেই বিশেষ ভাবে আলোচনা করে নেওয়ার কথা, অসুখে পড়ে যেতে হয়ে উঠল না—একটা দিনের জন্যে আপনিও এলেন না। তবু আমার ধারণা ছিল আপনিই সব থেকে খুশি হবেন।

ধীরাপদ অভিনয় কখনো করেনি, কিন্তু সত্যের এমন নিখুঁত অপলাপ করতে গিয়ে মুখের একটা রেখাও বিচলিত হল না তার। অমিতাভ হতভম্ব, বিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত। অস্ফুট বিস্ময়, সিনিয়র কেমিস্ট আপনার পরামর্শমত আনা হয়েছে?

আহত ক্ষোভেই ধীরাপদ নিরুত্তর যেন।

তপ্ত রাগে পুরু লেন্সের ওধারে চোখ দুটো ছোট দেখাচ্ছে।— আমাকে এ কথা জানান নি কেন?

জানাতে গিয়েছিলাম, আপনি এসেছেন শুনেই লাইব্রেরিতে আপনার সঙ্গে দেখা করতে ছুটেছিলাম—আপনি আমাকে অপমান করে চলে গেলেন।

ইউ ডিজার্ভড মোর। কে আপনাকে এ নিয়ে মাথা ঘামাতে বলেছিল? হু টোলড ইউ? অসহিষ্ণু রাগে গলার স্বর দ্বিগুণ চড়া। – আপনার জন্যে কজনের সঙ্গে মিছিমিছি দুর্ব্যবহার করতে হয়েছে জানেন? ডু ইউ নো?

আর কার সঙ্গে করেছেন জানি না, আমার সঙ্গে করেছেন দেখতেই পাচ্ছি। রাগে এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অমিতাভ ঘোষ, চোখের দৃষ্টিতে আর এক পশলা আগুন ছুঁড়ে ট্রাউজারের পকেটে সিগারেটের প্যাকেট গুঁজতে গুঁজতে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। অর্থাৎ, দুর্ব্যবহার আর বোঝাপড়া এর পর ভালো হাতেই করবে সে।

ধীরাপদ চেয়ারের কাঁধে ঘাড় এলিয়ে দিয়ে নিস্পন্দের মত বসে রইল খানিক। হাঁফ ধরে আসছিল। কিন্তু বসা হল না। উঠে আস্তে আস্তে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল।

না, ব্যর্থ হয়নি।

মেন বিলডিং থেকে নেমে সামনের আঙিনা পেরিয়ে লোকটা হনহন করে ফ্যাক্টরী- ঘরের দিকেই চলেছে।

গোটা ফ্যাক্টরীর স্নায়ুতে একটা অপ্রীতিকর টান ধরেছিল। সেটা গেল।

সময় পেলে নিচে ওপরে রোজই দু-একবার টহল দেয় ধীরাপদ। পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব আছে, দেখতেও ভালো লাগে। আজকের এই নিঃশব্দ উদ্দীপনা আর নিশ্চিন্ত কর্মতৎপরতার সবটাই চোখের ভুল নয় বোধ হয়। সকলেরই সব থেকে বড় স্বার্থটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। রুটির যোগ। তাই এর অশুভ কেউ চায় না। তবু ধীরাপদর ধারণা, ওই টান-ধরা স্নায়ুর উপশমবোধের কারণ সরকারী অর্ডার সাপ্লাইয়ের ফাঁড়া কাটল বলেই নয়, হস্তদন্ত হয়ে আজ হঠাৎ আবার যে লোকটা গিয়ে কাজে লেগেছে, সে চীফ কেমিস্ট অমিতাভ ঘোষ—এই জন্যে।

সিনিয়র কেমিস্ট জীবন সোম এক ফাঁকে ওপরে উঠে এসেছিলেন। তাঁর হাসিমুখের বিড়ম্বনাটুকু স্পষ্ট।— মিস্টার ঘোষ তো আজ ওই কাজটা টেক-আপ করলেন দেখছি।

ধীরাপদ হালকা জবাব দিয়েছে, এখানে থাকলে অমন হামেশা ছাড়তে দেখবেন আর টেক-আপ করতে দেখবেন!

….শুনেছি, তবু এবারে সবাই একটু ঘাবড়েছিল মনে হল। কিন্তু নিজে তিনি নিঃসংশয় নন একেবারে, জিজ্ঞাসা করেছেন, এ কদিনের মধ্যে কাজটা হয়ে যাবে মনে হয়?

ধীরাপদ হাসিমুখে মাথা নেড়েছে, মনে হয়।

বারান্দায় যাতায়াতের পথে আর সিঁড়ির কাছে ধীরাপদ লাবণ্যর মুখোমুখি হয়েছে বার দুই। অটল গাম্ভীর্য সত্ত্বেও সেই মুখে বিস্ময় আর কৌতূহল অপ্রচ্ছন্ন নয়। অর্ডার সাপ্লাইয়ের এই গণ্ডগোলের মানসিক ধকলটা তার ওপর দিয়েই বেশি গেছে। তত্ত্বাবধান- প্রধানা হিসেবে একবারে নাম স্বাক্ষরের মজাটা অমিতাভ ঘোষ ভালো ভাবে বুঝিয়ে ছেড়েছে। মনে মনে আজ হাঁফ ফেলে বেঁচেছে হয়ত। কিন্তু এই ঘর থেকে বেরিয়ে সরাসরি তার কাজে গিয়ে লাগার রহস্য অজ্ঞাত। জানা যেতে পারে যার কাছ থেকে সেই লোকের সঙ্গে বাক্যালাপের বাসনা চিরকালের মতই গেছে যেন। স্থির গভীর ঈষৎ চকিত দৃষ্টিনিক্ষেপে যতটা আঁচ করা যায়।

আপাত-সমস্যাটা এত সহজে মিটে যেতে ধীরাপদরই সব থেকে খুশি হওয়ার কথা। অথচ ভিতর থেকে খুশির প্রেরণা নেই কিছুমাত্র। একটা দুশ্চিন্তার অবসান এই যা। সমস্ত দিন একরকম মুখ বুজেই কাজ করে গেল সে। কাজও ঠিক নয়, এক- একটা ফাইল নিয়ে সময় কাটালো। পাঁচটা অনেকক্ষণ বেজে গেছে। অফিস এতক্ষণে ফাঁকা নিশ্চয়। লাবণ্যও চলে গিয়ে থাকবে। পাঁচটার ওধারে পাঁচ মিনিটও থাকে না ইদানীং। হিমাংশুবাবু ছেলেকে বিকেলের বৈঠকে আটকানোর পর থেকে ধীরাপদ সেটা লক্ষ্য করেছে। পাঁচটার পরে দু-একদিন এসে সিতাংশু মুখ কালো করে ফিরে গেছে।

আজও সন্ধ্যার আসর নেই মনে পড়তে ধীরাপদর ওঠার তাগিদ গেল। নিচে অমিতাভর ওখান থেকে একবার ঘুরে আসবে কিনা ভাবল। পরমুহূর্তেই সে ইচ্ছে বাতিল করে দিল। আজ আর না। ওধারের পুরনো ফাইল টা হাতের কাছে টেনে নিল। কিন্তু তাও ভালো লাগছে না।

ওগুলো ঠেলে সরিয়ে রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল মেডিক্যাল হোমের রমেন হালদারের ফাইলের ওপর। ছেলেটার প্রমোশনের অর্ডার হয়ে আছে অনেকদিন, অথচ একটা খবরও দেওয়া হয়নি। ধীরাপদর ভিতরটা সক্রিয় হয়ে উঠল একটু, সেখানেই যাবে। ছেলেটার তারুণ্যের তাপ শুকোয়নি এখনো। ভালো লাগে। ভালো লাগে এমন কিছুই খুঁজছিল এতক্ষণ।

দরজা ঠেলে বাইরে আসতে সামনে আভূমি নত হয়ে অভিবাদন জানালো যে লোকটা সে তানিস সর্দার। ফুটন্ত লিভার এক্সট্রাক্ট অ্যাকসিডেন্টের নায়ক। ঘা শুকোলেও বীভৎস পোড়া দাগগুলো এ জীবনে মিলোবে না। খাকী হাফপ্যান্ট আর হাফশার্টের বাইরে যেটুকু চোখে পড়ে তাই শিউরে ওঠার মত।

ভালো আছ?

জী। লোকটা বাঙালী না হলেও পরিষ্কার বাংলা বলতে পারে। ফিরে জিজ্ঞাসা করল, হুজুরের তবিয়ত কেমন এখন?

ভালো। ওর ছুটিছাটার ফয়সালা আগেই হয়ে গেছে, অপেক্ষাকৃত লঘু মেহনতের কাজে লেগেছে এখন। নিজের প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্যে ধীরাপদ খোঁজ নিল, কাজ-কর্ম করতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?

মাথা নাড়ল, অসুবিধে হচ্ছে না। নিজের সুবিধে-অসুবিধের কোন কথা বলতে যে আসেনি সেটা ধীরাপদ তার মুখের দিকে চেয়েই বুঝেছিল। এসেছে অন্য তাগিদে, হৃদয়ের তাগিদে। প্রকাশের পথ না পেলে পুঞ্জীভূত কৃতজ্ঞতা বোধও বেদনার মতই টনটনিয়ে ওঠে বুঝি। এ কদিনের চেষ্টায় সামনাসামনি আসতে পেরেছে যখন, মুখ বুজে ফিরে যাবে না। গেলও না। ধীরাপদকে বরং মুখ বুজে শুনে যেতে হল। শুধু অন্তরের কৃতাঞ্জলি নয়, সেই সঙ্গে কোনো একজনের উদ্দেশে খেদও একটু। হুজুরের দয়াতে ওর প্রাণরক্ষা হয়েছে। নিজের দোষে ফুটন্ত লিভার এক্সট্রাক্টের ভ্যাট ওলটানো সত্ত্বেও কোম্পানীর খরচে তার চিকিৎসা হয়েছে। অত টাকা লোকসানের পরেও তার চাকরিটা পর্যন্ত যায়নি, উল্টে হালকা কাজ দেওয়া হয়েছে তাকে। তানিস সর্দার অন্য কোম্পানীতেও কাজ করেছে, কিন্তু এ-রকম কোথাও দেখেনি। শুধু ও কেন, কেউ দেখেনি। এখানেও দেখত না, শুধু হুজুরের দয়ায় দেখল। ও দেখল, সকলে দেখল। কিন্তু সেই হুজুরের এমন শক্ত বেমার গেল অথচ ও একবার গিয়ে তাকে দেখে আসতে পেল না। মেম-ডাক্তার কিছুতে ঠিকানা দিল না। তাদের ধারণা ওরা মেহনতী মানুষ বলে এত নির্বোধ যে জীবনদাতারও ক্ষতি করে বসতে পারে। ঠিকানা পেলে ও আর ওর বউ গিয়ে হুজুরকে দূর থেকে শুধু একবার চোখের দেখা দেখে আসত, একটি কথাও বলত না। ওর বউ হুজুরের জন্য কালীমায়ীর কাছে ফুল দিয়েছে আর ও দোয়া মেঙেছে—এ ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারে ওরা?

বিব্রত বোধ করছে ধীরাপদ। অশিক্ষিত অজ্ঞ মানুষের এই ক’টা অতি সাধারণ কথাতেও আবেগের কাঁটাটা অমন সর্বাঙ্গে খচখচ করে উঠতে চায় কেন? ধারাপদ হাসতে চেষ্টা করল একটু। কিন্তু হেসে নিরস্ত করা গেল না তাকে। এক ক্ষোভ নতুন ক্ষোভের দোসর। নতুন ক্ষোভ নয়, পুরনো ক্ষোভই নতুন করে জেগে উঠল আবার। যেমন, ছোট সাহেব আর মেম-ডাক্তারের সঙ্গে কত ঝগড়াঝাঁটি করে তার চাকরি রাখা হয়েছে—সেটা তানিস সর্দার জানে। সকলেই জানে। ওদের কেউ মানুষ বলে ভাবে না। যেটুকু সুবিধে এখন পাচ্ছে ওরা, কার দয়াতে পাচ্ছে সেও এদের সক্কলে খুব ভালো করেই জানে। হুজুরের দিল এত বড় বলেই কেউ তার সঙ্গে বিবাদ করে সুবিধে করতে পারবে না- খোদ বড় সাহেবের ছেলে হয়েও ছোট সাহেবকে তো অন্যত্র সরে যেতে হল। মেম-ডাক্তারও যে হুজুরের কাছে জব্দ হবে একদিন তাতে ওদের কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। যারা শত্রুতা করতে চায়, চীফ কেমিস্ট ঘোষ সাহেব আর হুজুরের দিলের সামনে তারা সক্কলেই কুঁকড়ে যাবে একদিন।

কোথা থেকে কি এসে পড়ল দেখে ধীরাপদ অবাক। এই একজনের খেদ থেকে গোটা ফ্যাক্টরীর মেহনতী মানুষের নাড়ির হদিস পেল। কি ভাবে ওরা? কি আলোচনা করে? ছোট সাহেবকে সরে যেতে হয়েছে, মেম-ডাক্তারও জব্দ হবে একদিন, ওর আর অমিত ঘোষের দিলের কাছে কারো শত্রুতা টিকবে না।…এই ভাবে ওরা, এই আলোচনা করে, এই আশা করে। ধীরাপদ বিমূঢ় খানিকক্ষণ। সর্দারের চিকিৎসা আর চাকরির ব্যাপারে মেম-ডাক্তার অদ্ভুত কোনো বাধা দেয়নি বলবে ভেবেছিল, কিন্তু সব শোনার পর আলাদা করে কিছু বলা হল না।

-এসব বাজে খবর তোমাদের কে দেয়, আর এ নিয়ে তোমরা মাথাই বা ঘামাও কেন? প্রচ্ছন্ন অনুশাসনের সুরে ধীরাপদ বলল, এখানে কারোর সঙ্গে কারো ঝগড়াও নেই, শত্রুতাও নেই, তুমি নিজে বরং এবার থেকে নিজের সঙ্গে শত্রুতাও একটু কম করে কোরো, অমন হড়বড়িয়ে কাজ করতে যেও না, একেবারে তো শেষই হতে বসেছিলে—

আগের উক্তি বিশ্বাস করেনি। পরের অনুশাসনে কৃতজ্ঞতায় উদ্বেলিত। মাথা নেড়ে অস্ফুট জবাব দিল, না হুজুর, আর অমন কাজ করব না।

রাস্তায় এসেও ধীরাপদ সবিস্ময়ে ভাবছিল, ওর আর অমিত ঘোষের সঙ্গে অপর হুজুর-হুজুরানীর একটা বিরোধ চলেছে—এই ধারণাটা সকলের বদ্ধমূল হল কেমন করে? হাসিই পেল। এই বঞ্চিত মানুষদের সাদা-সাপটা উপলব্ধির জগৎটা আলাদাই বটে। কিন্তু এই আলাদা জগতের নিরক্ষর একজোড়া মেয়ে-পুরুষের কাছ থেকে আজ তার প্রাপ্তি ঘটেছে কিছু। অক্লেশে দুই জগতের সমস্ত ব্যবধান ঘোচানোর মতই কিছু সর্দারের ওই বউটার মুখখানা মনে করতে চেষ্টা করছে। ধীরাপদর অসুখ ভালো হওয়ার কামনায় ইষ্ট-পায়ে ফুল দিয়েছে, সর্দারও প্রার্থনা করেছে। ওরা যা করেছে, হৃদয়ের দিক থেকে ধীরাপদ ওদের জন্যে কি তার থেকে খুব বেশি কিছু করেছে?

কাঞ্চনের কচি মুখখানা উঁকিঝুঁকি দিল মনের তলায়। রাজপথের অভিসারিকা নয়, অস্তিত্বের সংগ্রামে ঝলসানো অসহায় এক মেয়ে রোগশয্যায় ধুঁকছে। রোগশয্যাও জুটত না। তাদের মত ওই একজন নিয়ম-শৃঙ্খলার সঙ্গে ভালবাসতে বা ঘৃণা করতে শেখেনি বলে জুটেছে। শেখেনি বলেই তাকে ফুটপাথ থেকে তুলে আনতে পেরেছে। আর ধীরাপদ কি করেছে? স্তুতি-নিন্দার বাষ্পবুদবুদে স্নায়ু চড়িয়ে একরকম অস্বীকারই করে এসেছে।

একটু আগেই সেই আবেগ ফিরে যেন ব্যঙ্গ করে উঠল তাকে। ফলে সমুহ গম্ভব্যপথটা বদলালো।

গতকাল রাত্রিতে এলেও আজ দিনের বেলায় নার্সিং হোমটা চিনে নিতে কষ্ট হল না। লাবণ্য সরকার আছে কি নেই সে চিন্তাটা মন থেকে ছেঁটে দিয়েছিল। তবু নেই শুনে স্বস্তিবোধ করল একটু। সেই নার্সটিই রোগিণীর শয্যার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেল তাকে।

আগের দিনের মতই সাদা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা। রক্তশূন্য সাদাটে মুখ, শিয়রের টেবিল-ফ্যানের অল্প হাওয়ায় কপালের কাছের খরখরে চুলগুলি মুখের ওপর নড়াচড়া করছে।

আজ জেগে আছে। ঘাড় ফেরাল।

একনজরে চিনতে পারার কথা নয়। ফ্যাল ফ্যাল করে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। তার পর চিনল। চিনে কোনো অব্যক্ত রহস্যের হদিস পেল যেন। তারপরেও চেয়েই রইল। অপরিসীম এক শূন্যতার বিবরে শুধু দুটো চোখ, শুধু নিস্পন্দ চাউনি একটা।

তারপর চাদরে ঢাকা সর্বাঙ্গে চেতনার সাড়া জাগল আচমকা, শূন্য চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, ঠোঁট দুটো থরথরিয়ে উঠতে লাগল। চাদরের তলা থেকে শীর্ণ দুই হাত বার করে কপালে ঠেকাতে গিয়ে ঈষৎ কাত হয়ে সেই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।

ধীরাপদ নির্বাক। মেয়েটা কি জীবনে আর কাঁদেনি? বেসাতির মাশুল না মেলায় হতাশায় গড়ের মাঠের অন্ধকারেও কাঁদতে দেখেছিল এক রাতে। কিন্তু সেটা এই কান্না নয়। এ কান্নায় শুধু কেঁদে কেঁদে নিজেকে লুপ্ত করে দেবার তাগিদ, লুপ্ত করে দিয়ে নিজেকে উদ্ধার করার তাগিদ।

ধীরাপদ বোবার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেছে। তারপর নিজের অগোচরে এগিয়ে এসে কখন একটা হাত রেখেছে তার মাথায়, হাত-ঢাকা মুখের ওপর থেকে অবিন্যস্ত চুলগুলো সরিয়ে দিয়েছে। গভীর মমতায় অস্ফুট আশ্বাসও দিতে চেষ্টা করেছে একটু, ভয় কি…ভালো হয়ে যাবে।

কান্না বেড়েছে আরো, দুই হাতের মধ্যে আরো জোরে মুখ গুঁজে দিয়েছে আর মাথা নেড়েছে। ভালো হওয়াটাই একমাত্র আশা নয়, ওই জীবনে ওটুকু কোনো আশ্বাসই নয়। ধীরাপদ জানে। কিন্তু কি বলবে সে, কি আশ্বাস দেবে?

অনেকক্ষণ বাদে শান্ত হল। গায়ের ওই চাদরে করেই ছোট্ট মেয়ের মত চোখ- মুখ মুছে নিল। তারপর তাকালো তার দিকে। সব কিছুর জন্যেই কৃতজ্ঞ, এইভাবে কাঁদতে পেরেও।

কিন্তু ধীরাপদর এটুকু প্রাপ্য নয়। ভুলটা ভেঙে দেবার জন্যেই সাদাসিধে ভাবে বলল, আমার এক বন্ধু তোমাকে ওভাবে দেখতে পেয়ে তুলে এনেছেন। তাঁকে একদিন তোমার কথা বলেছিলাম।

দৃষ্টির ভাবান্তর দেখা গেল না তবু। তুলে আনার থেকে বলাটাই বড় যেন, যে তুলে এনেছে তার থেকে যে দাঁড়িয়ে আছে সামনে সে-ই বড়। সেই বড়র অবিশ্বাস্য আবির্ভাব ঘটেছে তার জীবনে, বিহ্বল দৃষ্টি মেলে সে তাকেই দেখছে।

তোমার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে?

জবাব এলো পিছন থেকে, নার্স জানালো, কর্ত্রীর নির্দেশে সে ঠিকানা নিয়ে বাড়িতে চিঠি লিখে দিয়েছে, যদিও পেসেন্ট বলেছিল খবর দেবার কিছু দরকার নেই!

নার্স কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ধীরাপদ টের পায়নি। একটা অনুভূতির জগৎ থেকে পুরোপুরি বাহ্যজগতে ফিরে এলো। নির্লিপ্ত উপদেশ দিল কাঞ্চনকে, এঁদের কথা শুনে চলো, কান্নাকাটি করো না। ইচ্ছে ছিল বলে, সে আবার এসে দেখে যাবে। বলল না। বলা গেল না।

কৃতজ্ঞতা কুড়োবারই দিন বটে আজ।

তানিস সর্দার আর তার বউ কৃতজ্ঞ। কাঞ্চন কৃতজ্ঞ। মেডিক্যাল হোমের রমেন হালদারও।

যদিও প্রমোশনের খবরটা সে আগেই পেয়েছে। রোগী দেখতে দেখতে ডক্টর মিস সরকার সদয় হয়ে হঠাৎ সেদিন ডেকেছিলো তাকে। খবরটা জানিয়েছিলেন। আর ওর জায়গায় কাজ তো সে করছেই। তবু দাদা আজ নিজে এসেছেন তাকে জানাতে, কম ভাগ্যের কথা নাকি?

রমেন হালদারের মুখে খুশি ধরে না।

অনতিদূরের একটা রেস্তোরাঁয় দু পেয়ালা চা নিয়ে বসেছিল দুজনে। ধীরাপদই তাকে এখানে ডেকে এনে বসেছে। দোকানের মধ্যে সকলের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে ক’টা কথা আর বলা যায়? অবশ্য খবরটা দিয়েই চলে আসবে ভেবেছিল। কিন্তু ঠিক এই সময়ে তেমনটি দেখল না। খদ্দেরের ভিড় অবশ্য কিছু ছিল, কিন্তু অন্য দিকটা খালি। রোগী ছিল না। আর, তাদের ডাক্তার লাবণ্য সরকারও ছিল না।

এ-রকম ব্যতিক্রমের দরুনই যে রমেনের সঙ্গে দু-দশ মিনিট গল্পগুজব করার ইচ্ছে হয়েছিল, ঠিক তাও নয়। দোকানে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ধীরাপদ সকলের মুখে- চোখে এক ধরনের গাম্ভীর্য দেখেছে। ওপরঅলার আগমনে নিম্নতনদের কর্মতৎপর গাম্ভীর্য নয় ঠিক। বড়দের কোনো কাণ্ড দেখে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেলেও ছোটরা যে ভাবে গাম্ভীর্যের প্রলেপ চড়ায় অনেকটা তেমনি। দোকানে ঢুকেই রোগী আর ডাক্তারের দিকটা শূন্য দেখে ঈষৎ বিস্ময়ে এদিকে ঘাড় ফিরিয়ে ধীরাপদ কর্মচারীদের সেই নীরব অভিব্যক্তিটুকু উপলব্ধি করেছে। সকলেই ধরে নিয়ে থাকবে, সে মহিলাটির খোঁজেই এসেছিল।

তার কথামত রমেন হালদার মিনিট দশেকের ছুটি নিয়ে এসেছে ম্যানেজারের কাছ থেকে। জেনারেল সুপারভাইজারের তলবে বাইরে আসবে খানিকক্ষণের জন্যে, কাউকে বলা-বলির ধার ধারে না। তবু দাদা বলেছে যখন বলেই এসেছে। হাল্কা আনন্দে রমেন হালদার স্তুতির জাল বিছালো খানিকক্ষণ ধরে। দাদার কত সুনাম কত খাতির সর্বত্র, দাদাই জানেন কিনা সন্দেহ। ফ্যাক্টরীর কেউ না কেউ তো হামেশাই আসছে দোকানে—একটা নিন্দের কথা দূরে থাক, দাদার সুখ্যাতি ধরে না। অত গুণ না থাকলে বড় সাহেবকে বশ করা চাট্টিখানি কথা নয়—

স্তুতির উদ্দীপনার মুখে ধীরাপদ এখানে আসার হেতুটা ব্যক্ত করে ফেলেও রেহাই পেল না। প্রমোশনের খবর রমেন পেয়েছে, কিন্তু রোগী দেখতে দেখতে ঘরে ডেকে নিয়ে নেকনজরী চালে খবর দেওয়া আর দাদার মত একজনের নিজে এসে বলে যাওয়া কি এক ব্যাপার নাকি? দাদা এইজন্যে এসেছেন— শুধু এই জন্যে! রমেন হালদার হাওয়ায় ভাসবে না তো কি?

হাওয়ায় ভাসার ফাঁকে ধীরাপদই জিজ্ঞাসা করল, মিস সরকারকে দেখলাম না যে…তিনি আজ আসেননি?

সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া বদল। নতুন হাওয়ায় নতুন ধরনের উদ্দীপনা। এসেছিলেন। এসেই চলে গেছেন। খবর রসিয়ে ভাঙতে জানে রমেন হালদার। বলল, মিস সরকারের খোঁজে মেডিক্যাল হোমে একে একে অনেক গণ্যমান্য লোক এলেন আজ—

দোকানের কর্মচারীদের চাপা গাম্ভীর্যের কারণ বোঝা গেল। তাকেও সেই গণ্যমান্যদের শেষ একজন ধরে নিয়েছে।

রমেন হালদারের প্রগল্ভ গাম্ভীর্যে তরল আমেজ এখন। না, মিস সরকারের খোঁজে সর্বপ্রথম যে এসেছিল শুনল, সেই নামটা ধীরাপদ আদৌ আশা করেনি। অমিতাভ ঘোষ। লাবণ্য সরকার নিয়মিত রোগী দেখা শুরু করার খানিকক্ষণের মধ্যেই নিজের গাড়িতে নিজে ড্রাইভ করে চীফ কেমিস্ট এসে হাজির। দোকানে ঢোকেননি, বাইরে গাড়িতে বসেই মিস সরকারকে খবর দিতে বলেছেন। মিস সরকার ধীরে- সুস্থেই গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু আধ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে সরাসরি রোগীপত্র বিদায় করে দিয়ে আবার গিয়ে গাড়িতে উঠেছেন। আজ আর ফিরবেন না, ম্যানেজারকে তাও জানিয়ে গেছেন।

রমেন হালদার হাসছে। হাসির তাৎপর্য স্পষ্ট। মিস সরকারের খোঁজে আসা গণ্যমান্যের হিড়িকে একমাত্র চীফ কেমিস্টেরই জিত।

তারপর?

তার পরের আগন্তুক অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয়। ছোট সাহেব সিতাংশু মিত্র। তিনিও গাড়িতেই এসেছিলেন, তবে গাড়ি থেকে নেমে তিনি দোকানে ঢুকেছিলেন। আর দোকানে ঢুকে মিস সরকারকে না দেখে অবাক হয়েছিলেন। প্রথমে অবাক পরে গম্ভীর। অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে তাঁর গাড়িতে বেরিয়ে গেছেন শুনে আরো গম্ভীর। এত গম্ভীর যে রমেনের ভয় ধরে গিয়েছিল। ভাবছিল, ঠাস করে তার গালে বুঝি বা চড়ই পড়ে একটা। সে-ই সামনে ছিল, তাকেই তো বলতে হয়েছে সব — — মিস সরকার কখন গেলেন, কার সঙ্গে গেলেন—

ধীরাপদরও হাসি সামলানো দায় হচ্ছিল এবার। ফাজিল-অবতার একেবারে! কিন্তু এর পর কে? সিতাংশু মিত্রের পরের গণ্যমান্য আগন্তুকটি কে? ধীরাপদ নিজে?

না। সর্বেশ্বরবাবু। প্রায়-আশাহত বিপত্নীক ভগ্নীপতিটি। তাঁর গাড়ি নেই, ট্যাক্সিতে এসেছিলেন। রমেনের ধারণা গাড়ি থাকার মতই অবস্থা, নেই ইনকাম ট্যাক্সের ভয়ে।

ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে ওর সঙ্গে খানিক কথাবার্তা বলে বিষণ্ন মুখে ট্যাক্সিতেই চলে গেছেন আবার। ছোট ছেলেটা সকাল থেকেই ব্যামোয় কাতরাচ্ছে, ইচ্ছে ছিল মাসিকে ট্যাক্সিতে তুলে চট করে দেখিয়ে নিয়ে আসবেন একবার — হল না, মন খারাপ হবারই কথা।…তা কার সঙ্গে বেরিয়েছেন মিস সরকার, আর তাঁর আগে কার গাড়ি অমনি ফিরে গেছে, তাও শুনেছেন। খোঁজ-খবর করছিলেন বলে রমেন বলেছে।

বিশ্লেষণ শেষ করে মুখখানা যতটা সম্ভব সহানুভূতিতে শুকনো করে তুলে জানালো, ভদ্রলোকের ছেলেপুলেগুলো আজকাল আগের থেকেও ঘন ঘন ভুগছে দাদা। একটু থেমে আবার বলল, অনেক দিন তাঁর বাড়িতে যাবার জন্যে নেমন্ত্র করেছেন, গেলাম না বলে আজও দুঃখ করছিলেন, গেলে ভালোমন্দ খাওয়াবেন বোধ হয়….একদিন যাব দাদা?

ধীরাপদ হেসেই ফেলল। বলল, না।

সঙ্গে সঙ্গে হাসির আবেগে রমেনেরও টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়ার দাখিল। রমেনকে বিদায় দিয়ে অন্যমনস্কের মত ধীরাপদ কতক্ষণ ধরে শুধু হেঁটেই চলেছে খেয়াল নেই। আজকের যা কিছু ঘটনা আর যত কিছু খবর, তার মধ্যে ঘটনা আর খবর শুধু একটা। মেডিক্যাল হোমে এসে অমিতাভ ঘোষের লাবণ্য সরকারকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া। নিভৃত মন নিজের অগোচরে শুধু ওই একটা ঘটনা আর খবরই বিস্তার করছিল এতক্ষণ ধরে।

ধীরাপদ সচকিত। ঈর্ষা করতে ঘৃণা করে। এটা ঈর্ষা নয়। নিজের অসম্পূর্ণতার ক্লান্তির মত। ক্লান্তই লাগছে বটে। সত্তার বল্গায় তেজী ঘোড়ার মত কতগুলো প্রবৃত্তি বাঁধা যেন। কোনোটা আগে ছুটছে, কোনোটা পিছনে পড়ছে। যে এগিয়ে যাচ্ছে তাকে টেনে নিয়ে আসছে, যে পিছিয়ে পড়ছে তাকে ঠেলে দিচ্ছে। আজীবন এই সামঞ্জস্যের শাসন সম্বল আর শ্রান্তি সম্বল।

‘…যখন ফিরব আমি সন্ধ্যায় আপন কূটীরে, অস্ত-রবি-রঞ্জিত, তখন যেন বক্ষে পাই এমন পত্নী, কোলে তার শিশু।’

জ্বালাতন। হেসে ফেলে ভুরু কোঁচকালো ধীরাপদ। কিন্তু ভুরু কুঁচকে জ্বালাতনের মায়া এড়ানো গেল না একেবারে। ভাবতে ভালো লাগছে, কোথা থেকে কেমন করে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সে। ভিতরে ভিতরে ঘরমুখী তাগিদ একটা, ঘরের তৃষ্ণা। কিন্তু ঘর কোথায়? সুলতান কুঠিতে? যখন ফিরব আমি সন্ধ্যায় আপন কুঠীরে, অস্ত রবি-রঞ্জিত…

ধীরাপদ হেসে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল। তবু থেকে থেকে ওই সুলতান কুঠিই আজ কেমন টানছে তাকে। রোজই তো ফেরে সেখানে। হিমাংশু মিত্রের সান্ধ্য বৈঠকের দরুন বা অন্য যে কারণেই হোক, ফিরতে বেশ রাত হয় অবশ্য। ফিরতে হয় বলে ফেরে, ফেরার তাগিদ কখনো অনুভব করে না। আজ করছে। সেখানে ধীরাপদ ঘর নেই বটে, কিন্তু ঘর তো আছে।

আর সোনাবউদি আছে।

যখন ফিরব আমি সন্ধ্যায় আপন কুটীরে, অস্ত-রবি-রঞ্জিত—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *