কাল তুমি আলেয়া – ১২

বারো

মানুষের দুই ভাব। জীবভাব আর বিশ্বভাব। অমিত ঘোষের বেলায় জ্ঞানের বচনটি পরিমিত ভাবে একটু বদলে নিয়ে দেখছে ধীরাপদ। তারও দুই ভাব—একটি জীব-ভাব, অন্যটি বিজ্ঞান-ভাব। কিন্তু দুটি ভাবই বড় বেশি সমভাবে উপস্থিত।

তুচ্ছতম সংঘাতেও জ্বলে উঠতে পারে মানুষটা। সেই জীব-ভাবটির সামনাসামনি দাঁড়ানো শক্ত তখন। তার রীতিতে আপস লেখা নেই। ফ্যাক্টরীর সকলের পক্ষে অন্তত এ দাপট বরদাস্ত করা সহজ নয়। অথচ বরদাস্ত করতে হয়। হয় বলেই ক্ষোভ আর বিরক্তি। তাছাড়া ব্যবসায়ের দিক থেকে ক্ষতিও। যে-কোন কাজই হোক বা যত বড় কাজই হোক, অশান্ত মুহূর্তে তাকে কাজের মধ্যে পাওয়া দায়। পেলেও কাজ নিয়ন্ত্রণ করার থেকে কাজ পণ্ডই করবে বেশি। নয়তো ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে এক উদগ্র তাড়নায় বেরিয়ে পড়বে কোনোদিকে। ঘরে শুয়ে-বসেও কাটিয়ে দিতে পারে দু-দশ দিন। জুনিয়র কেমিস্ট আছে আরো জনাকতক। পারতপক্ষে তারা তখন নতুন কাজে হাত দিতে চায় না, চীফ কেমিস্টের মেজাজের ঝক্কি নেবে কে? পছন্দ হল তো ভালো, না হলে যত টাকাই লোকসান হোক দেবে সব তছনছ করে।

এ-রকম লোকসান অনেকবার হয়েছে।

এই লোকসান ধীরাপদ কিছুটা নিজের চোখে দেখেছে, কিছুটা শুনেছে। চারুদি বলেছেন, কর্মচারীদের কারো মুখে শুনেছে। অর্গ্যানিজেশন চীফ সিতাংশু মিত্রের অসহিষ্ণুতা থেকেও টের পায়। কিন্তু এর ফলে বরাবরই সব থেকে বড় ধকলটা যায় লাবণ্যর ওপর দিয়ে। সে-ই অপদস্থ হয় সব থেকে বেশি। কারণ এখানকার এই কাজের স্রোতে চীফ কেমিস্টের আসন দুদিনের জন্যেও শূন্য পড়ে থাকার উপায় নেই। কাউকে এসে দাঁড়াতে হবে, নির্দেশ দিতে হবে, স্যাম্পল যাচাই করতে হবে, কাজ অনুমোদন করতে হবে।

অমিতাভর অনুপস্থিতিতে এই দায়িত্ব নিয়ে এসে দাঁড়াতে হয় লাবণ্য সরকারকে। সে শুধু ডাক্তারই নয়, গোড়ার দিকের অন্তরঙ্গ দিনে শিখিয়ে পড়িয়ে তাকে কেমিস্টের কাজেও যোগ্য সহকর্মিণী করে তুলেছিল অমিতাভ। তখন একদিনের জন্যও ওই আসন শূন্য থাকলে রীতিমত দাবি নিয়েই এসে দাঁড়াত লাবণ্য সরকার।

সেই দাবিই গলার কাঁটা এখন।

লাবণ্যর বিশ্বাস, চীফ কেমিস্টের এ ধরনের অপচয়-প্রবৃত্তির আসল হেতু তার প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ। তাকে জব্দ করার জন্যে আর অপদস্থ করার জন্যেই। অবশ্য তাতে ক্ষতি কিছু হয় না। কারণ এই বিশ্বাসের ভাগীদার স্বয়ং অর্গ্যানিজেশন চীফ সিতাংশু মিত্রও। প্রয়োজনে সে বরং সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সান্ত্বনায় ক্ষতির নৈতিক দায়টা ভোলা শক্ত। ইদানীং ওই বিভাগটির সাময়িক দায়িত্ব গ্রহণে লাবণ্যের বিশেষ আপত্তি লক্ষ্য করেছে ধীরাপদ। জরুরী তাগিদেও যেতে রাজী হয় না। বলে, কি লাভ, সবই তো নতুন করে করতে হবে আবার! ও যেমন আছে থাক, এলে হবে।

অসুখের পর তিন সপ্তাহ বাদে ধীরাপদ কারখানায় এসে দেখল মাঝবয়সী সিনিয়র কেমিস্ট নিযুক্ত হয়েছেন একজন।

জীবন সোম, অভিজ্ঞ রসায়নবিদ। তাঁকে নিয়ে আসার কৃতিত্ব সিতাংশু মিত্রের।

ধীরাপদর মনে হল, এই নবাগতটিকে কেন্দ্র করে এই কর্মমুখর পরিবেশের তলায় একটা অস্বস্তি জমে উঠেছে। মনে মনে ধীরাপদর প্রতীক্ষায় ছিল যেন সকলে। ও এলে পরিস্থিতি সহজ হবার আশা।

হিমাংশু মিত্র হাসিমুখে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করেছেন প্রথম।—ভালোই তো আছ মনে হচ্ছে, এভাবে অসুখ-বিসুখ বাধিয়ে বোসো না, অনেক ঝামেলা এখন।

ঝামেলা কি সেটা আর বলেননি। ধীরাপদর স্বাস্থ্য-প্রসঙ্গেই উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন, যে জায়গায় থাকো দেখলাম, অসুখ তো বারো মাস এমনিতেই হতে পারে। আমার ওখানেও উঠে আসতে পারো, বেশিরভাগ ঘরই খালি পড়ে আছে।

ধীরাপদ জবাব দেয়নি। আমন্ত্রণে খুশি হবার বদলে সঙ্কোচ বোধ করেছে। আর সেই সঙ্গে কেয়ার-টেক বাবু আর মানকের শ্রীবদন দুটি চোখের সামনে ভেসে উঠতে হাসিও পেয়েছে। প্রথম দিনের দর্শনে ঠাট্টার ছলে তার ও-বাড়িতে বসবাসের সম্ভাবনার কথা শুনে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর একযোগে হকচকিয়ে যাওয়াটা মনে পড়েছে।

ছোট সাহেব সিতাংশু মিত্র তাকে দেখে খোলাখুলি খুশি। বুদ্ধিমানের মত পদমর্যাদার বেড়াটা নিজের হাতে আগেই ভেঙে দিয়েছিল। ফলে এই খুশির ভাবটা অকৃত্রিমই মনে হয়েছে ধীরাপদর। আপনি এসেছেন? বাঁচা গেল। একদম সুস্থ তো এখন?

ধীরাপদ হেসে মাথা নাড়ল। সুস্থ।

যাক, বসে বসে এখন ঝামেলা সামলান তাহলে—

কিসের ঝামেলা?

এদিকের সব কিছুরই। আমার তো আর দেখাশুনোর ফুরসৎ নেই, বাবার কাণ্ড—

বাবার কাণ্ডর ব্যাখ্যায় ছেলের তুষ্টির অভাব লক্ষ্য করল ধীরাপদ। সেদিন সুলতান কুঠিতেও করেছিল। কোম্পানীর প্রসাধন-শাখার জমি কেনা হয়েছে কলকাতার বিপরীত প্রান্তে। সিতাংশু এঞ্জিনিয়ার নয়, কনট্রাক্টরও নয়, অথচ বাড়ি তোলার সব দায়-দায়িত্ব এখন থেকে তারই কাঁধে। নতুন ব্যবসা দাঁড় করানোর ঝক্কি তো আছেই এরপর।

বিরস বদন। শাখা সম্প্রসারণে উৎসাহ বা উদ্দীপনার অভাব সুস্পষ্ট। ব্যবসা বাড়ানো দরকার, নতুন কিছু করা দরকার, বড় সাহেব সে অভিপ্রায় অবশ্য আগেও ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এমন তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা করে ফেলার এত আগ্রহ ধীরাপদরও অস্বাভাবিক লাগছে।

সিতাংশু জিজ্ঞাসা করল, এদিকের খবর শুনেছেন? নতুন সিনিয়র কেমিস্ট এলেন একজন!

শুনেছি।

আলাপ হয়নি? আলাপ করে নেবেন, বেশ গুণী লোক, অনেক বড়বড় ফার্মে কাজ করেছেন। নিয়ে তো এলাম, এখন কদিন টিকে থাকতে পারেন কে জানে, এদিকে তো গোড়া থেকেই খড়গহস্ত!

উনি চান না এঁকে? খড়গহস্ত কে হতে পারে সেটা যেন ধীরাপদরও জানাই আছে।

কি উনি চান আর কি চান না উনিই জানেন। বাবাও যেমন, সরাসরি একটা বোঝাপড়া করে নেবে—তা না, কেবল ইয়ে—। সিতাংশুর মুখে বিরক্তির ছাপ। বাপের প্রতি ছেলের এতটা অনাস্থা ধীরাপদ আগে দেখেনি। অমিতাভর উদ্দেশ্যেই বিরূপ মন্তব্যের ঝাঁজে সোজা হয়ে বসল সে, বলল, নিজে কিছু দেখব না, অন্যে দেখতে এলেও বরদাস্ত হবে না, আর মিস সরকারই বা বছরের পর বছর এ অপমান সহ্য করবেন কেন—তাঁর অন্য কাজ নেই বা আত্মসম্মান নেই?

ধীরাপদ চুপ। মুখ তুলে ক্ষুব্ধ মূর্তিটি দেখল একবার।

বাবার ধারণা, ভাগ্নে মস্ত বিদ্বান। বিদ্যা ধুয়ে আমরা জল খাবো? কাজ চলে কি করে? না পার্টিকে বিদ্বান লোক দেখিয়ে দিলেই হবে?

ধীরাপদ অল্প একটু মাথা নেড়েছে হয়ত। অর্থাৎ সমস্যা বটে। তারপর আলাপের সুরে বলেছে, ওই কেমিস্ট ভদ্রলোকটিকে নেবার আগে অমিতবাবুর সঙ্গে একটু পরামর্শ করে নিলে মন্দ হত না বোধ হয়।

তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ চলে, না পরামর্শ করে কিছু করা যায়?

অর্থাৎ এতদিন ধরে তাহলে লোকটার আপনি কি দেখেছেন আর কতটুকু চিনেছেন? সিতাংশু উঠে যাবার পর ধীরাপদর মনে হয়েছে, কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। পরামর্শ ছোট সাহেব অন্তত করতে গেলে বিপরীত ফল অনিবার্য। কিন্তু তার কথা থেকে আর একটা সংশয়ও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চীফ কেমিস্টের খামখেয়ালীর দরুন অসুবিধা মাঝেসাঝে হয় ঠিকই। তাছাড়া কাজও দিনে দিনে বাড়ছেই। অভিজ্ঞ লোক একজন দরকার বটে। কিন্তু এই সিনিয়ার কেমিস্ট নিয়ে আসা শুধুই সেই দরকারে, না কি বছরের পর বছর লাবণ্য সরকার আর অপমান সহ্য করতে রাজী নয় বলেও? ধীরাপদর মনে হল, যোগ্য লোক সংগ্রহের কাজটা সিতাংশুই করছে যখন, সেটা এই বিবেচনার ফলেও খানিকটা হতে পারে। অন্যথায় জেনেশুনে এভাবে চীফ কেমিস্টের মেজাজের ঝক্কি না নিয়ে বুদ্ধিমানের মত ধীরেসুস্থে বাবাকে দিয়েই যা-হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারত। বেগতিক দেখলে বড় সাহেব সিনিয়র কেমিস্ট নিয়োগের ভারটা হয়ত অমিতাভর ওপরেই ছেড়ে দিতেন। বড় সাহেবের বিচক্ষণতায় ধীরাপদর আস্থা আছে।

কিন্তু যে কারণেই হোক, সম্প্রতি ছেলের যে তা নেই দেখছে। নেই কেন?

লাবণ্যর কথা মনে হতে ধীরাপদ উসখুস করতে লাগল। এসে অবধি দেখা হয়নি। তখন ছিল না, এখনো আসেনি বোধ হয়। এলে এ ঘরে একবার পদার্পণ ঘটতই। তবু উঠে দেখে আসবে কিনা ভাবছিল।

ঘরে ঢুকলেন যিনি, তিনি অপরিচিত। কিন্তু এক নজর দেখেই ধীরাপদর মনে হল ইনিই সেই নবাগত সিনিয়র কেমিস্ট—জীবন সোম। বছর পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে বয়স, হৃষ্টপুষ্ট গড়ন, কালো একমাথা খড়খড়ে চুল। মনে হয় চুলের সঙ্গে একগাদা ধুলো মিশে আছে।

দু হাত কপালে ঠেকিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরাপদ সাদর অভ্যর্থনা জানালো, বসুন বসুন—আমিই যাব আপনার কাছে ভাবছিলাম।

অভ্যর্থনায় খুশি হলেন বোধ হয়। বসে ধীরাপদর মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।—এখানে এসেই আপনার কথা শুনেছি, আপনি অসুস্থ ছিলেন, আজ এসেছেন শুনে আলাপ করতে এলাম। এখন ভালো তো বেশ?

হ্যাঁ। ধীরাপদ আলাপের দিকে এগোলো, কেমন লাগছে বলুন, অবশ্য আপনি যেসব ফার্ম দেখেছেন তার তুলনায় আমাদের অনেক ছোট ব্যাপার।

না বললেই ভাল হত। কারণ এক মুহূর্তের আলাপে বিনা ভনিতায় ভদ্রলোক নিজের সমস্যাটা সরাসরি এভাবে মুখের ওপর ব্যক্ত করে বসবেন ভাবেনি। ডাইনে-বাঁয়ে মাথা হেলিয়ে বললেন, ছোট আর কি, তবে সুবিধের ঠেকছে না খুব। লোভে পড়ে ছেড়েছুড়ে এলাম, এ বয়সে না এলেই ভালো হত। এখানকার চীফ কেমিস্ট আমাকে চান না হয়ত।

মন্তব্যের আশায় ভদ্রলোক চেয়ে আছেন। ধীরাপদ ফাঁপরে পড়ল। দ্বিধান্বিত মুখে বলল, ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে না চাওয়ার তাঁর তো কোনো কারণ নেই।

জীবন সোম বললেন, ম্যানেজমেন্টের সঙ্গেই বনছে না হয়ত—কিন্তু ভুগছি তো আমি। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনার চেষ্টাও করেছিলাম, কিন্তু আমার মুখ দেখতেও তাঁর আপত্তি বোধ হয়, কিছু বলতে গেলেই সাফ জবাব, যা কিছু বক্তব্য বড় সাহেবকে বলতে হবে, তাঁর কাছে নয়।

ধীরাপদ নিরুত্তর। কি-ই বা বলার আছে? শুধু মনে হল, চীফ কেমিস্ট লোকটিকে সঠিক জানা থাকলে ভদ্রলোক হয়ত এতটা বিপন্ন বোধ করতেন না। কিন্তু জীবন সোমের পরবর্তী আরজি শুনে ধীরাপদ রীতিমত অবাক। শুধু আলাপের উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি আসেননি সেটা স্পষ্টতর হল আরো।—মিস্টার ঘোষ আপনার বিশেষ বন্ধু শুনেছি, এঁরা বলছিলেন আপনি এলে আর তেমন অসুবিধে হবে না। আমার হয়ে আপনিই একটু বুঝিয়ে বলুন না তাঁকে, আমি কোনরকম ষড়যন্ত্র করে এখানে ঢুকে পড়িনি, আমাকে কাজ ছাড়িয়ে এখানে আনা হয়েছে।…ভালোর আশা কে না করে?

যুক্তি মিথ্যা নয়, কিন্তু ভদ্রলোককে মুশকিল-আসানের এই রাস্তাটা দেখিয়ে দিল কে? লাবণ্য সরকার না সিতাংশু মিত্র? এ ধরনের আলগা ভরসা বড় সাহেব দেননি নিশ্চয়। ধীরাপদ সবিনয় জানিয়ে দিল, নিজে থেকে বুঝতে না চাইলে চীফ কেমিস্টকে কিছু বুঝিয়ে বলাটা খুব সহজ নয়। আর সেও সামান্য কর্মচারী এখানকার—বন্ধুত্বের খবরটাও তেমন ভরসা করার মত কিছু নয়, তবে সুযোগ পেলেই সে চীফ কেমিস্টের সঙ্গে আলোচনা করবে।

জীবন সোম ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেবার আধ ঘণ্টার মধ্যেই ধীরাপদ ওই বিভাগটির সমাচার মোটামুটি জেনেছে। তার কুশল খবর নিতে আর যারা এসেছে তাদের মুখেই শুনেছে। অমিত ঘোষ এ পর্যন্ত বড় রকমের বিঘ্ন কিছু ঘটায়নি। এসটিমেট বা সাপ্লাই ফাইলে শুধু স্টেটমেন্ট জমেছে, স্বাক্ষর পড়ছে না। মাল অনুমোদনের ছাড়পত্রের অভাবে মাঝে মাঝে মাল আটকে থাকছে। এ ধরনের অসুবিধেও বেশিদিন থাকার কথা নয়, কারণ চীফ কেমিস্টের অনুপস্থিতিতে নতুন সিনিয়র কেমিস্ট শীগগিরই এ-সব ছোটখাটো দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষমতা পাবেন আশা করা যায়। নইলে তাঁকে আনার সার্থকতা কী? তবু ওই কর্মপরিবেশে একটা আশঙ্কা জট পাকিয়ে আছে অন্য কারণে।

আসল দুর্যোগ থেকে অনাগত দুর্যোগের ছায়া বেশি ঘোরালো। সদ্য-বর্তমানে চীফ কেমিস্টের সমাহিত বিজ্ঞান ভাবটা অকৃত্রিম মনে করছে না কেউ। ওর আড়ালে জীব-ভাবটা প্রবল দেখছে। কখন কোন্‌ মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাধিয়ে বসবে এটা ঠিক নেই যেন। এই অস্বাচ্ছন্দ্যটাই ক্রমশ ব্যাপ্তিলাভ করছে।

বাইরে এসে ধীরাপদ পাশের ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরটা একচুপি দেখে নিল। শূন্য। মহিলা এখনো আসেনি। কেন আসেনি বা কখন আসবে ইচ্ছে করলেই খবর নিয়ে জেনে নিতে পারে। অফিসের কেউ না কেউ জানে নিশ্চয়। ভিতরে ভিতরে এক ধরনের প্রতীক্ষার মত অনুভব করছে বলেই ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল।

নিচে এসে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল একটু। প্রস্তুতি নিজেরও অগোচরে। কিন্তু দরকার ছিল না, অ্যানালিটিক্যাল ডিপার্টমেন্ট-এ অমিতাভ ঘোষ নেই। ফিরল আবার। দোতলায় নয়, একেবারে তিনতলায় উঠল। লাইব্রেরি ঘরও শূন্য। সম্প্রতি দিনের বেশির ভাগ সময় এই দু জায়গার এক জায়গাতেই থাকে জানত। আসেইনি মোটে।

দোতলায় তার ঘরের সামনে যে মূর্তিটি দাঁড়িয়ে তাকে দেখে ধীরাপদ খুশিও, অবাকও। মেডিক্যাল হোমের রমেন হালদার। হাসি-হাসি সঙ্কোচ-বিড়ম্বিত প্রতীক্ষা। এখানে আসাটা একান্তই দুঃসাহসের কাজ হল কিনা, দৃষ্টিতে সেই সংশয়।

তুমি এখানে, কি আশ্চর্য। এসো এসো। কাঁধে হাত দিয়ে ভিতরে নিয়ে এলো, বাইরে দাঁড়িয়েছিলে কেন, ভিতরে এসে বসলেই পারতে—বোসো। নিজেও বসল,—তুমি এখানে হঠাৎ কি খবর?

কাঁধে হাত পড়তেই রমেন হালদার নিশ্চিন্ত। আপ্যায়নে আরো বিগলিত। মেডিক্যাল হোমের মাইনের দিনে যেমন দেখেছিল, এখানকার এত জাঁকজমকের মধ্যেও তেমনি দেখছে।

আপনার খুব অসুখ গেল শুনলাম, তাই…

তাই ভালো হয়ে যাবার পর দেখতে এলে?

সলজ্জ বদনে রমেন ত্রুটি প্রায় স্বীকারই করে নিল। বলল, কাজের চাপ বড্ড বেশি এখন, তাছাড়া বাড়িটাও ঠিক জানা নেই। আজ আপনি জয়েন করেছেন শুনে ম্যানেজারবাবুই ছুটি দিয়ে দিলে, বললেন, তোমার দাদার সঙ্গে দেখা করে এসো।

ম্যানেজারবাবু! বলো কি? চোখেমুখে তরল অবিশ্বাস ধীরাপদর।

বলবে না কেন? রমেন হালদারও উৎফুল্ল, লোক চিনতে বাকি কার? যে ব্যাভার করছে আপনার সঙ্গে, আর কেউ হলে বুঝিয়ে ছাড়ত—আপনাকে চিনেছে বলেই নিশ্চিন্ত এখন।

শোনার ইচ্ছে থাকলে ধীরাপদ প্রশংসা-বচন আরো খানিকটা শুনতে পারত। সে অবকাশ না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমার নিজের ওষুধের দোকান করার প্ল্যান কত দূর? আমাকে তো আর নেবেই না ঠিক করেছ…

মেডিক্যাল হোমের মাইনের দিনেও ধীরাপদ হালকা করে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিল। উদ্দেশ্য ঠাট্টা করা নয়। পারুক না পারুক, ছেলেটার ওই ইচ্ছের উদ্দীপনা ভালো লেগেছিল। তেমনি তাজা আছে কিনা ওটা সেই কৌতূহল। রমেন হালদার সেদিন লজ্জা পেয়েছিল, কিন্তু আজ এই থেকেই কিছু একটা বক্তব্যের মুখে এগোতে চেষ্টা করল। লজ্জিত মুখে ধীরাপদকে ব্যবসায় পাবার আশাটা ছেঁটে দিল প্রথম, বলল, আপনাকে তখন চিনলে ও-রকম বোকার মত বলতাম না…। তারপরে একটু থেমে হতাশার সুরে একেবারে স্থূল বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়ল।—আমারও আর কোনদিন কিছু হবে না, ক’টা টাকা মাইনে… মাস গেলে একটা টাকাও বাঁচে না, উল্টে ধার হয়ে যায়, কদিন আর মনের জোর থাকে?

সত্যি কথা। ছেলেমানুষের মুখে এই সত্যি কথাটাই ধীরাপদ আশা করেনি। কিন্তু রমেন হালদারের কথার এইটুকু শেষ নয়। তার নিবেদনের সার মর্ম, মনের জোর তা বলে তার এখনো কম নয়, শুধু দাদা একটু অনুগ্রহ করলেই কিছুটা সুরাহা হয়।

আমি কি করলে কি হয়?

কি হয় বোঝা গেল। গোড়াতেই বলেছিল বটে, কাজের চাপ সম্প্রতি বড্ড বেশি। ধীরাপদ তখন খেয়াল করেনি। তবু মনে মনে ছেলেটার তারিফই করল সে। সেয়ানা বটে। তার আরজি, দিন পনের হল মেডিক্যাল হোমের কাজ ছেড়ে একজন অন্যত্র চলে গেছে—পনের টাকা বেশি মাইনে ছিল তার, তার কাজ ও-ই করছে আপাতত, অতএব ও-জায়গায় যদি তাকেই পাকাপাকি বহাল করা হয়!

ধীরাপদ আলগা কথার মধ্যে নেই আর, জবাব দিল, আমি কি করতে পারি বলো, ও-সব মিস সরকারের ব্যাপার, তাকে বলে দেখো।

রমেন হালদার সবিনয় জানালো, সে চেষ্টা করা হয়েছিল, তাঁকে বলানো হয়েছিল কিন্তু ফল বিপরীত হয়েছে, দেখা হলেই উনি এখন বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে তাকান ওর দিকে।

ছেলেটার কথাবার্তার এই ধরনটাই ভালো লাগে ধীরাপদর। হেসে ফেলল, কাকে দিয়ে বলিয়েছিলে, ম্যানেজারবাবু?

না, ঢোক গিলল, সর্বেশ্বরবাবুকে দিয়ে, ওঁর সেই ভগ্নীপতি…

হালকা বিস্ময়ে ধীরাপদ তাকে চেয়ে চেয়ে দেখল একপ্রস্থ। ওই নামের ভদ্রলোকটিকে এতদিনে আর মনেও পড়েনি। এখন পড়ছে। হাসির রসে ভেজা ফরসা মুখ, কোঁচানো ধুতি, গিলে পাঞ্জাবির নিচে ধপধপে জালিগেঞ্জি, পায়ে চেকনাই হলদে নিউকাট, হাতে সোনার ঘড়ি সোনার ব্যান্ড, বুক থেকে গলা পর্যন্ত মিনে করা সোনার বোতাম, মাথার চুলে কলপ-চটা সাদার উঁকিঝুঁকি। বিপত্নীক, পাঁচ-ছটি ছেলেমেয়ে। প্রায়ই ভোগে যারা, আর মাসির হাতের ওষুধ না পড়া পর্যন্ত যাদের একটাও এমনিতে সেরে ওঠে না— মাসি-অন্ত -প্রাণ সব। পরিচয়-অন্তে রমেনের সেই সটীক মন্তব্য আজও ভোলেনি ধীরাপদ।

আবারও হেসেই ফেলল, তুমি বড্ড দুষ্টু, এখন ফল ভোগো।

রমেনের মুখ কাঁচুমাচু, আমি তো আমার ভালোর জন্যেই চেষ্টা করেছিলাম দাদা, আপনি যে তখন অসুখে পড়েছিলেন, ম্যানেজারবাবু আমার জন্যে বলতে যাবেন কেন, আমি ভাবলাম ওঁকে দিয়ে বলালেই কাজ হবে। নিজের ভগ্নিপতি, খাতিরও করেন দেখি…।

তা উনি যে তোমার জন্যে বলেছিলেন জানলে কি করে? ভুরু কোঁচকাতে দেখে? দায় বড়। সহজাত চপলতা দমন করে মাথা নাড়ল। — সর্বেশ্বরবাবুই জানিয়েছেন। মিস্ সরকার তাঁকে পষ্ট বলে দিয়েছেন, অফিসের ব্যাপারে এভাবে বলা-কওয়াটা উনি পছন্দ করেন না। আচ্ছা আমার কি দোষ বলুন দাদা-

শেষ করা গেল না। দরজার দিকে চেয়ে রমেন হালদার নির্বাক আড়ষ্ট একেবারে। লাবণ্য সরকার। হাসিমুখে ঘরে ঢুকছিল, ওকে দেখে হাসির বারো আনা গাম্ভীর্যের আবরণে ঢাকা পড়ে গেল। আবির্ভাবের লঘু ছন্দ শিথিল হল।

শশব্যস্তে রমেন হালদার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দু হাত কপালে ঠেকিয়ে বিনয়াবনত অভিবাদন সম্পন্ন করল একটা। তারপর দাঁড়িয়ে রইল।

লাবণ্য সরকার লক্ষ্য করল না। এই-ই রীতি এখানকার। সে টেবিলের কাছে এগিয়ে আসতে ধীরাপদই ওর হয়ে কৈফিয়ত দিল যেন, বলল, ওকে চিনলেন তো? ভারী ভালো ছেলে, আমাকে খুব পছন্দ ওর — অসুখ করেছিল শুনে দেখতে এসেছে।

ভালো ছেলের মুখের ওপর আর একটা নিস্পৃহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লাবণ্য চেয়ার টেনে বসল। ধীরাপদ রমেনকে বিদায় দিল, তুমি তো আবার কাজে যাবে এক্ষুনি! আজ যাও তাহলে, আবার দেখা হবে।

শুধু এই নির্দেশটুকুর প্রতীক্ষাতেই ছিল যেন, আবারও বিশেষ করে কর্ত্রীটির উদ্দেশেই আনত হয়ে ঘর ছেড়ে প্রস্থান করল সে। গমন-বৈচিত্র্যটুকুও উপভোগ্য। লাবণ্য সরকার হাসিমুখে তাকালো এবারে, প্রশ্রয়ের হেতু আবিষ্কারের চেষ্টা করল দুই- এক মুহূর্ত।—ভারী ভালো ছেলে বুঝলেন কি করে? আপনাকে দাদা বলে তো?

হাসছে ধীরাপদও। মাথা নাড়ল, বলে।

লাবণ্য ঠাট্টা করল, গোড়ায় গোড়ায় আমাকেও দিদি ডাকার চেষ্টায় ছিল— আমার তবু ভালো ছেলে মনে হয়নি!

দরদী সুরে ধীরাপদ বলল, সেই ব্যথা বেচারা জীবনে ভুলবে না। আপনাকে বলেছে বুঝি? লঘু ভ্রুকুটি।

বলেছে যখন, তখন আপনার মতই ও-ও আমাকে নিজের সমব্যথী সহকর্মী বলে জানত—দাদা সম্পর্কটা তখনই পাতিয়েছিল, কোনো ফলের আশা না করেই।

তবু হাল্কা জোরের ওপরেই তার ধারণাটা খণ্ডন করতে চেষ্টা করল লাবণ্য, আমি বলছি ও একটুও ভালো ছেলে নয়। এসেছিল কেন, চাকরির তদবিরে?

ধীরাপদ হেসে ফেলল! সেটা কি অপরাধ? কিন্তু বেচারার কোনো আশাভরসা নেই দেখছি।

নেই কেন, করে দিন! কিছু করা না করার মালিক তো এখন আপনি।

ব্যাপার তুচ্ছ, আর লাবণ্য সরকার বললও তেমনি তাচ্ছিল্য করেই। তবু উক্তিটা একেবারে শ্লেষশূন্য মনে হল না ধীরাপদর। মনের ভাব গোপন করে জবাব দিল, আমি মালিক হলে তো ওর হয়েই যেত, কিন্তু হওয়া-না-হওয়াটা কার হাতে সেটা ও ভালো করেই জানে। আমি অবশ্য একটু সুপারিশের আশা দিয়ে ফেলেছি, তখন কি আর জানতুম-

কি জানত না সেটা আর বলার দরকার হল না। হাসি দিয়েই তুচ্ছ প্রসঙ্গের সমাপ্তি টেনে দিল। ধীরাপদর ধারণা, সুপারিশটা প্রথম ভগ্নিপতি সর্বেশ্বরের মারফৎ হয়েছিল বলেই মহিলা এত বিরূপ।

লাবণ্য সরকারও তক্ষুনি ও আলোচনা ছেঁটে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কখন এলেন আজ?

চেয়ারে হেলান দিয়ে ধীরাপদ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল একটা, সেই সকালেই তো…

অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, সেই সকালে আসিনি শুধু, আসার পর থেকে এ পর্যন্ত মুহূর্ত গুনেছি।

সুরসিকার মতই হাসির ছোঁয়া লাগিয়ে লাবণ্য সরকার বসার ভঙ্গিটা আর একটু শিথিল করে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সকালে এসেছেন, মিস্টার মিত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাহলে! উনি তো রোজই আসছেন আজকাল।

প্রশ্ন স্পষ্ট, তাৎপর্যটুকু নয়। রোজ আসছেন, বলার মধ্যে ঈষৎ বিদ্রূপ প্রচ্ছন্ন মনে হল। ফিরে জিজ্ঞাসা করল, বড় মিত্র না ছোট মিত্র, কোন মিত্র?

বড় মিত্রের কথাই বলছি, ছোট মিত্রকে নিয়ে কবে আর আপনি মাথা ঘামান?

দেখা হয়েছে। তরল প্রতিবাদ, কিন্তু বড় মিত্রকে নিয়েই বা কবে আবার মাথা ঘামাতে দেখলেন আমাকে?

আপনি মাথা না ঘামালেও উনি ঘামাচ্ছিলেন, রোজই একবার করে আপনার খোঁজ করতেন কবে আসছেন? থামল একটু। —বললেন কিছু?

অসুস্থতার পর তিন সপ্তাহ বাদে অফিসে এসে এই প্রশ্নটাই প্রথম শুনবে, . ধীরাপদ কল্পনাও করেনি। লাবণ্যর মত সরাসরি ফিরে মুখের দিকে চেয়ে থাকতে সঙ্কোচ। পেরে ওঠে না, কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে চেয়ে থাকতে—দেখতে। এই রমণী-মুখও কি হৃদয়ের দর্পণ? হবেও বা-। লাবণ্য সরকারের হাবভাব কথাবার্তা এমন কি হাসিটুকুও সহজ স্বাচ্ছন্দ্যভরা লাগছে না খুব। দুই চোখের অতলে কিছু একটা সমস্যা উকিঝুঁকি দিচ্ছে, সেই সঙ্গে ক্ষোভও একটু।

যা সহজ ধীরাপদ তাই করল। হাসতে লাগল। তারপর যথাযথ সত্যি জবাবই দিল।—বড় সাহেব বললেন, আবার যেন এভাবে অসুখবিসুখ বাধিয়ে না বসি, অনেক ঝামেলা এখন। আর বললেন, তাঁর বাড়ির বেশির ভাগ ঘরই খালি পড়ে থাকে, অনায়াসেই সেখানে এসে থাকতে পারি।

মুখের দিকে চেয়ে লাবণ্য চুপচাপ অপেক্ষা করল খানিক। আরো কিছু শুনবে আশা করেছিল হয়ত। কিন্তু ওইখানেই শেষ হতে দেখে অনেকটা নির্লিপ্ত মুখে জিজ্ঞাসা করল, আপনার আপত্তি কেন, বউদির আদর-যত্ন পাবেন না বলে?

এ পরিহাস অপ্রত্যাশিত। বিশেষ করে লাবণ্য সরকারের মুখে। ধীরাপদ থতমত খেয়ে গেল কেমন। সেই একদিনে কতটুকুই বা দেখেছে সোনাবউদিকে! বিস্ময়-ব্যঞ্জনা লাবণার চোখে পড়ল কিনা সে-ই জানে। প্রসন্ন মুখেই প্রসঙ্গ বদলে ফেলল চট করে। — যাকগে, আপনি এখন কেমন আছেন বলুন দেখি?

ছদ্ম অনুযোগভরা দুই চোখ তুলে তাকাল ধীরাপদ। আপনাকে বলব সেই আশায় সকাল থেকে নিজের স্বাস্থ্য-সমাচার নানাভাবে সাজিয়ে সাজিয়ে এতক্ষণে ভুলেই গেলাম।

লাবণ্য হাসিমুখে বলল, ভালই আছেন তাহলে বোঝা যাচ্ছে।

বিরস বদনে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল ধীরাপদ, ভালো থাকা কাকে বলে আপনারাই জানেন।… মানুষ ছেড়ে অসুখবিসুখের ওপর আর আস্থা নেই আমার।

আবার একটা পরিহাসের আঁচ পেয়ে লাবণ্য সকৌতুকে চেয়ে আছে। ধীরাপদ টেনে টেনে বলল, এই একবার বিছানা নিয়ে অনেক আশা করেছিলাম। আশা ছিল, অসুখটা একটু অন্তত ঘোরালো পথে চলবে, আর তার ফলে আরো দু-চার দিন অন্তত আপনাকে সেই দীনের কুটিরে দেখা যাবে—কিছুই হল না।

নিজের প্রগলভতায় ধীরাপদ নিজেই পরিপুষ্ট। লাবণ্য সরকারও হাসল একপ্রস্থ। ওজন-পালিশ করা হাসি নয়, দাঁতের আভাস চিকিয়ে ওঠা ঝকঝকে হাসি। বলল, বড় দুঃখের কথা, কিন্তু ওই আশা-রোগের ধকল সামলাতে জানেন তো? মুখ দেখে তো কিছুই বোঝার উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল মুখে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল, বসুন, টেবিলে একগাদা কি জমে আছে দেখলাম- দেখে আসি। এক্ষুনি পালাচ্ছেন না তো! ধীরাপদ মাথা নেড়েছে হয়ত। লাবণ্য ঘরের আড়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, এই সবটুকুই ভূমিকা শুধু। অনুকূল আবহাওয়া রচনা করে গেল একটু। লাবণ্যর বক্তব্য আছে কিছু। সেটা শুনতে বাকি।

কিন্তু সে কৌতূহল ঠেলে দিয়ে মনের তলায় কে যেন চোখ রাঙাচ্ছে তাকে আবার? আবারও?

তলায় তলায় চকিত অস্বস্তি। লাবণ্য সরকার তার প্রয়োজনে খুশির হাওয়া রচনা করে গেছে—কিন্তু সেই খুশির বাতাস ওর গায়ে এসে লাগে কেন? গা জুড়োয় কেন? সকাল থেকে কোন আশার দারিদ্র্যে অমন উসখুস করছিল? এই সদ্য-প্রস্থান-পরা- তনু সম্মোহন থেকে নিজের চোখ দুটো ছিঁড়ে টেবিলে এনে রাখতে হয়েছিল, তাই বা গোপন করবে কাকে?

….বলে গেল আশা-রোগ। ঠাট্টা? একবারের এই ধকল সামলাতে পেরেছিল কি? সোনাবউদি জিজ্ঞাসা করেছিল, ঠাণ্ডাটা লাগল কেমন করে, পড়ন্ত শীতের রাতে ওভাবে চান করে আসার কারণটা কি? সদলে শকুনি ভটচায এসে না গেলে সত্যিই হয়ত সুলতান কুঠি ছাড়তে হত ওকে। সেই থেকে সোনাবউদিকে তো এড়িয়েই চলেছে একরকম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে—ও-রোগের প্রশ্রয় আর দেবে না, প্রবৃত্তিটাকে লাগামের মুখে রাখবে।

এই লাগাম?

লাবণ্য আবারও ঘরে এলো প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে। হাতে কিসের ফাইল একটা। কাজেরও হতে পারে, সহজ পদার্পণের উপলক্ষও হতে পারে। ফাইলটা ধীরাপদের সামনে ফেলে দিয়ে চেয়ার টেনে বসল।

ধীরাপদ ওপর থেকে নামটা দেখে নিল, তানিস সর্দারের ফাইল। ফুটন্ত লিভার এক্সট্রাক্টএ আধপোড়া হয়ে হাসপাতালে ছিল যে। লাবণ্য বলল, লোকটা জয়েন করেছে, আপনার নিজস্ব বিবেচনার ব্যাপার— আমি ভয়ে হাত দিইনি ওতে। হাসতে লাগল, এমনিতেই তো লোকটা চটে আছে আমার ওপর। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একেবারে বউসুদ্ধ এসে হাজির হয়েছিল আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে-অসুখ শুনে ভয়ানক মন খারাপ। ঠিকানা পেলে আপনার বাড়ি যেত, পেল না বলে অসন্তুষ্ট।

ধীরাপদ কোনো মন্তব্য করল না দেখেই ঠাট্টা করল, আপনারও বোধ হয় পছন্দ হল না, বউটার দুঃখ দেখে অস্থির হয়েছিলেন, এখন হাসিমুখ দেখতে পেতেন আর অনেক ভক্তি শ্রদ্ধার কথাও শুনতে পেতেন।

ধীরাপদ দেখছে, হাসছেও একটু একটু। তেমনি জবাব দিল, এখনো মন্দ হাসিমুখ দেখছি না, এবারে দু-একটা ভক্তিশ্রদ্ধার কথা শোনালে আর খেদ থাকে না।

রাগের ব্যঞ্জনা টিকল না, জব্দ করতে পারলে জব্দ হতে আপত্তি নেই যে মেয়ের সে সুরসিকা। লাবণ্যর বচনে আর ভ্রুরেখায় নতি-স্বীকারের লক্ষণ। ওদের মত অতটা কি পারব, বলুন কি শুনতে চান?

ধীরাপদ হাতের খেয়ালে সামনের ফাইলটা ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরাল একপ্রস্থ। আমার কেমন মনে হয়েছিল আপনিই কিছু বলবেন, আর সেটা ঠিক এই তানিস সর্দার আর তার বউয়ের কথাই নয়।

লাবণ্যর চোখ দুটো এবারে তার মুখের ওপর থমকে রইল একটু। শুধু কথাগুলো নয়, বলার ধরনটাও অন্যরকম লাগল। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে ছদ্ম-শঙ্কায় মন্তব্য করল, আপনাকে যত দেখছি তত ভয় বাড়ছে আমার।

ধীরাপদ ম্রিয়মাণ।-এটা কি প্রশংসার কথা?

খুব নিন্দার কথা! দু হাত টেবিলে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে টান হয়ে বসল একটু। শাড়ির আধখানা আঁচল কাঁধ থেকে কনুইয়ে ভেঙে এলো। জোর দিয়ে বলল, এতদিন বাদে এলেন আপনি, অফিসের ব্যাপারে আলোচনা তো ছিলই কিছু, কিন্তু এদিকে তো বেলা শেষ দেখি… আপনার তাড়া আছে?

ধীরাপদ সভয়ে বলল, অফিসের আলোচনা হলে তাড়া আছে। এতক্ষণ ছিলেন

কোথায়?

অমিতবাবুর ওখানে দেরি হয়ে গেল। আপনি আজ আসবেন জানি, আগে আসারই ইচ্ছে ছিল-

কৌতূহলের থেকেও ধীরাপদর বিস্ময় বেশি। এতদিন এই একজনের প্রসঙ্গই সন্তর্পণে পরিহার করে আসতে দেখেছে। এখনো জবাবদিহির দরকার ছিল না। অথচ লাবণ্য সরকার সাগ্রহে তাই করল।

অমিতবাবুর ওখানে—মানে বাড়িতে?

হ্যাঁ।

শরীর ভালো তো? অফিসে এলেনই না – শরীর ভালোই। মতি-গতি ভলো না।

অভিযোগ নয়। চিকিৎসক রোগের কারণে অভিযোগ করে না। সংশয়াতীত কোনো রোগ-নির্ণয়ের মতই নির্বিকার আর স্পষ্ট উক্তি। ধীরাপদর কৌতূহল বাড়ছে, বিস্ময়ও। দু’চোখ টান করে তাকাবার সুযোগ হল এবারে। সেটা ভালো করার দায়িত্বও কি আপনার ওপরেই নাকি?

জবাবে লঘু কৌতুকের আভাস। দায়িত্বটা প্রায় স্বীকার করে নিয়েই বলল, ডাক্তারের দায় কম নাকি — সময়-বিশেষে ওটাও রোগের আওতায় পড়ে। থামল একটু, এদিকের ব্যবস্থাপত্রের কিছু অদলবদল হয়েছে…শুনলেন সব?

ধীরাপদ ঘাড় নাড়ল, শুনেছে। সিতাংশু মিত্র আর জীবন সোম এসেছিলেন জানালো। বলল, কাউকে খুশি দেখছি না তেমন!

লাবণ্যর মতে নতুন কেমিস্টের অসন্তোষের হেতুটা সঙ্গত নয় হয়ত। জিজ্ঞাসা করল, মিঃ সোমের আবার অখুশির কারণটা কী?

কাজ-কর্মের সুবিধে হচ্ছে না…কো-অপারেশান পাচ্ছেন না।

মুখে বিরক্তির আঁচড় পড়ল কয়েকটা কাজকর্মের সুবিধের জন্যে তাঁর এখনি অত ব্যস্ত হবার দরকারটা কী? মিঃ মিত্রকেও সেদিন ও-কথা বলে এসেছেন-

লাবণ্যর মিস্টার মিত্র বলতে বড় সাহেব।

জীবন সোমের প্রসঙ্গও আর টানা প্রয়োজন বোধ করল না, বলল, ও-কথা যাক, এখন মুশকিল হয়েছে অমিতবাবুকে নিয়ে, তিনি ভাবছেন সবাই তাঁর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রে লেগেছে।

ধীরাপদর খানিক আগের অনুমান মিথ্যে নয়। লাবণ্যর সব সমস্যা আর আলোচনার বাসনাটার কারণও তেমনি অস্পষ্ট।

ও দুদিনেই আবার ঠিক হয়ে যাবে! শোনার আগ্রহ প্রবল বলেই ধীরাপদর উক্তিটা নিস্পৃহ।

লাবণ্য তক্ষুনি মাথা নাড়ল। ওই ভদ্রলোকের বেলায় অত সহজে ঠিক হয় না কিছু। ভিতরে বড় রকমের একটা নাড়াচাড়া পড়লেই একেবারে অস্থির কাণ্ড—ভালো হাতে অসুখ বাধানোর দাখিল। এ-রকম আমি আগেও একবার দেখেছি…ভালো করে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলা দরকার’ তাঁকে।

আলোচনার উদ্দেশ্য বোঝা গেল।

ধীরাপদর জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, আগেও একবার লাবণ্য কবে দেখেছিল এ রকম, বড় রকমের নাড়াচাড়াটা কবে পড়তে দেখেছিল এর আগে? সেটা এই কর্ম-বাণিজ্যে লাবণ্য সরকারের বন্দর বদলের পরেই কিনা, আর সেই কারণেই কিনা, অমিতাভ ঘোষের বুকের কোনো দিক খালি হয়ে গিয়েছিল বলে কিনা।

জানা সম্ভব নয়। লাবণ্যর বক্তব্য শেষ হয়েছে মনে হয় না, শোনার আশায় ধীরাপদ নিরুত্তর।

এই প্রথম রমণী মুখে দ্বিধার ভাব। নিরুপায় একটু হাসির চেষ্টাও। নিজের সমস্যার ঢাকনা সরালো তারপর, ভদ্রলোকের ধারণা কি জানেন? এই সব কিছুর মূলে আমি —সিতাংশুবাবুকে বলে-কয়ে সিনিয়র কেমিস্ট আনার ব্যবস্থাটা আমিই করেছি—

“ধীরাপদর মজাই লাগছে শুনতে। রমণীর মন শুধু দূর থেকেই দুর্জ্ঞেয় বোধ হয়। নিরীহ মুখে জিজ্ঞাসা করে বসল, সেটা একেবারে ঠিক নয় বলছেন?

আচমকা ঘা খেলে আত্মস্থ হতে যেটুকু সময় লাগে সেই সময়টুকু শুধু। তারপরেই রূপান্তর। শাড়ির আধভাঙা আঁচলটা কাঁধে তুলে দিল। সোজা হয়ে বসল একটু। টেবিলের ওপরের হাত দুটো নিজের কাছাকাছি গুটিয়ে নিল। নিটোল দুই বাহুতে খয়রা-রঙা আঁটা ব্লাউজের কনুই-ঘেঁষা হাতা দুটোর দংশন স্পষ্ট হয়ে উঠল। দৃষ্টি খরখরে।

অমিতবাবু এর মধ্যে আপনার ওখানে গেছলেন?

না তো। কেন?

আপনার কথা শুনে ভাবলাম, ধারণাটা আপনিই তাঁর মাথায় এনে দিলেন কি না?

কথাটার প্রতিক্রিয়া এতটা গোলমেলে হবে ধীরাপদ ভাবেনি। সবিনয়ে জবাব দিল, তাঁর নিজের ধারণা-শক্তি আমার থেকে কম নয়।

লাবণ্যর পর্যবেক্ষণরত দৃষ্টিটা ওর মুখের ওপর স্থির তেমনি। কণ্ঠস্বর রূঢ় শোনালো, আপনি আর কতদিন এসেছেন এখানে, দায়িত্ব নেবার লোকের অভাবে ওখানে কি অসুবিধের মধ্যে গিয়ে পড়তে হয় তারই বা কতটুকু জানেন? আমি সে ঝক্কি নিতে যাব কেন? আমি ভুগব কেন?

ধীরাপদ সমব্যথীর মতই সায় দিল, একটু আগে সিতাংশুবাবুও এই কথাই বলছিলেন-

সিতাংশুবাবুর কথা থাক, আপনি কি বলেন?

উষ্মার ঝাপটায় ধীরাপদ যথার্থই কাহিল— এসব বড় ব্যাপারে আমি কি বলব? নীরবে দুই-এক-মুহূর্ত তার মুখের ওপর ব্যঙ্গ ছড়ালো লাবণ্য সরকার। সশ্লেষে তার বলার `রাস্তাটাই যেন দেখিয়ে দিল তারপর।- আর কিছু না পারেন, অমিতবাবুকে গিয়েই বলুন তাহলে, তাঁকে জব্দ করার জন্যেই সিনিয়ার কেমিস্ট আনা হয়েছে এখানে! ভারী খুশি হবেন।

চেয়ার ছেড়ে ওঠার উপক্রম করতে ধীরাপদ তাড়াতাড়ি বাধা দিল, বসুন বসুন—। এমন শ্লেষটাও একটুও বেঁধেনি যেন, হাসিমুখে বলল, অমিতবাবুকে খুশি করার জন্য আমি একটুও ব্যস্ত নই, আপনি কি করলে খুশি হবেন তাই বলুন?

– লাবণ্য জবাব দিল না। দেখছে। আর লোকটার গণ্ডারের চামড়া কিনা তাই ভাবছে হয়ত

ধীরাপদর মুখে অকৃত্রিম গাম্ভীর্য।– আপনাদের সমস্যাটা সত্যিই আমার মাথায় ঢোকেনি এখনো পর্যন্ত।….কোম্পানীর দরকারে সিনিয়ার কেমিস্ট আনা হয়েছে, সেটা না বুঝে কেউ যদি মাথা-গরম করেন তা নিয়ে আপনারা ভেবে কি করবেন?

কিছু না ভেবেই অসহিষ্ণু কণ্ঠে লাবণ্য বলে উঠল, তাঁকে চিনলে আপনিও ভাবতেন, ও-ভাবে মাথা গরম করলে শক্ত অসুখ হয়ে বসতে পারে-ভাবি এই জন্যে।

ধীরাপদর দু চোখ এবারে সম্মুখবর্তিনীর মুখের ওপর নিবদ্ধ। ভাবনার এটাই একমাত্র নিগূঢ় হেতু বলে মনে হল না। বলে বসল, ডাক্তারদের তো রোগ নিয়েই কারবার…হয়ও যদি, তার জন্যেই বা বিশেষ করে আপনার এত চিন্তা কেন?

লাবণ্যর এতক্ষণের বিরূপতা থেকে তাজা ভাবটুকুও যেন ছেঁকে সরিয়ে নেওয়া হল একেবারে। যে দুর্বলতা সংগোপনে লালনের বস্তু তাই যেন ছিঁড়েখুঁড়ে আলোয় এনে ফেলা হয়েছে। ধীরাপদ তাড়াতাড়ি সামাল দিতে চেষ্টা করল, বলল, যাক—এ অবস্থায় আমি কি করতে পারি বলুন?

ভেবেছিলাম পারেন। ভাবা ভুল হয়েছে। থামল একটু, অনুচ্চ কঠিন শ্লেষে বিদ্ধ করার শেষ চেষ্টা।—বড় সাহেব আপনাকে আদর করে নিজের বাড়িতে এনে রাখতে চান, আবার অমিতবাবু আপনাকেই একমাত্র বন্ধু বলে ভাবেন! আপনি কি করতে পারেন আমি বলব?

ধীরাপদ হাসছে। রাগ করল না, প্রশস্তি খণ্ডনের চেষ্টাও করল না। ওই সৌভাগ্যবৈচিত্র্য তার নিজেরই বিস্ময়ের কারণ যেন। বলল, আশ্চর্য! অথচ দেখুন, আমি ডাক্তার নই, বড় সাহেবের ব্লাডপ্রেসারও মাপিনি কখনো বা চীফ কেমিস্টের মতিগতি ভালো করার দায়ও ঘাড়ে নিইনি, কেন যে কি হয়-

না, লাবণ্য সরকার চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেনি, ঘর ছেড়ে সবেগে প্রস্থানও করেনি। আরো খানিক বসেছিল। আরো খানিক দেখেছিল। ঠাণ্ডা নির্লিপ্ত মুখে তারপর অফিস সংক্রান্ত আরো দু-চার কথা বলেছিল। কোন ফাইলটা আগে দেখা দরকার, কোন প্যামফ্লেটটা অনুমোদনের অপেক্ষায় পড়ে আছে, লেবার ইউনিটের কি আরজি।

তারপর উঠে গেছে

তিন সপ্তাহ্ বাদে এসে প্রথম দিনটার এমন সমাপ্তি অভিপ্রেত ছিল না। লাবণ্য সরকারের শ্লেষ আর বিদ্রূপ গা-সওয়া। আর সেটা যে ভালো লাগত না বা লাগে না, এমনও নয়।

অমিত ঘোষের সামনে লাবণ্যর রূপান্তর আগেও দেখেছে। তার প্রসঙ্গে মুখের বিপরীত রেখা-বিন্যাস আগেও লক্ষ্য করেছে। অবশ্য তার দুর্বলতা এত স্পষ্ট করে আর বোঝা যায়নি। কিন্তু সেটা এমন গোপন কেন? ধরা পড়ে লাবণ্য তো ওর মুখের ওপর হেসে উঠতে পারত।

গোপনতা বড় সাহেবের কারণে, না ছোট সাহেবের?

পড়ন্ত দিনের মতই ধীরাপদর ভিতরেও শিথিল শ্রান্তির ছায়া পড়েছে একটা। ভিতরে ভিতরে এক অস্পষ্ট ইশারার অস্বস্তি। অমিত ঘোষ প্রিয়জন তোমার, এ আবিষ্কারে তোমার তো খুশি হবার কথা! কিন্তু তার বদলে ওই বিমর্ষ ছায়াটা কিসের? লাবণ্য সরকারের দুর্বলতা ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কোন দুর্বল আশায় টান পড়ল? নিজেরও অগোচর নিভৃতের কোনো-

অনেক হয়েছে, আর অফিস করে না। ধীরাপদ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।…

অমিত ঘোষের সঙ্গে দেখা আরো দিনতিনেক পরে। বাড়ি গিয়ে দেখা করবে কিনা ভাবছিল, সেদিন অফিসে এসেই শুনল চীফ কেমিস্ট লাইব্রেরিতে।

করিডোরের দেয়াল ঘেঁষে লাবণ্য নিজের ঘরের দিকে আসছিল। ধীরাপদকে তিনতলার সিঁড়ির দিকে এগোতে দেখে গতি মন্থর করল। এর মধ্যে ফাইল অনেক পাঠিয়েছে, নিজে আসেনি। বরং ধীরাপদ দিনান্তে দু-একবার তার ঘরে গেছে। যখনই গেছে ব্যস্ত দেখেছে। নয়তো শূন্য চেয়ার দেখে ফিরে এসেছে। কথাও যা দু-চারটে হয়েছে, কাজের কথাই

-মেডিক্যাল হোমের খালি জায়গায় আপনার ওই রমেন হালদারকেই নেওয়া হয়েছে। আজ নোট গেছে।

ব্যক্তিগত সুসমাচার শোনার মত করেই ধীরাপদ হাসল একটু।-ও জেনেছে? মিঃ মিত্রের টেবিলে ফাইল গেছে, সই হয়ে আসুক…ইচ্ছে করলে তাঁর হয়ে আপনি সই করে দিতে পারেন!

পারে কি পারে না সেই আলোচনা এড়িয়ে ধীরাপদ আবারও হেসে পাশ কাটানোর উপক্রম করল।

আপনি অমিতবাবুর কাছে যাচ্ছেন?

লাবণ্যর নিরাসক্ত দুই চোখে আগ্রহও নেই, আবেদনও নেই। —সিনিয়র কেমিস্ট এসেছেন বলে যদি আমার ওপর কোন অভিযোগ থাকে আপনি আমাকে ডেকে পাঠাবেন, যা বলার আমি বলব।

আর দাঁড়ায়নি।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ধীরাপদর মনে হল, অমিত ঘোষের কাছে যে দূতিয়ালির আশা নিয়ে মহিলা সেদিন ওর কাছে এসেছিল, সেইটাই আজ প্রত্যাহার করে নিয়ে গেল। সেদিনের সেই কথাবার্তার পর আর ওকে একটুও বিশ্বাস করে না হয়ত।

কিন্তু যে লোকের সঙ্গে সাক্ষাতের আশায় চলেছে, এখন এই মুহূর্তে মেজাজটি তার কোন তারে বাঁধা জানা থাকলে ধীরাপদ অমন সপাসপ ওপরে উঠে যেত না হয়ত। কুশনে গা ছেড়ে দিয়ে মোটা একটা বইয়ের মধ্যে ডুবে আছে। ধীরাপদ দূর থেকে দেখল, তারপর এগিয়ে এসে পাশেই বসে পড়ল।

অমিতাভ মুখ তুলে তাকালে। শুধু একবার। গম্ভীর তন্ময়তায় আবার বইয়ের দিকে চোখ ফেরাল। আলাপের অভিলাষ নেই।

ক’দিন দেখা না পেয়ে আজ ভাবছিলাম আপনার বাড়ি যাব। ধীরাপদর প্রসন্ন অবতরণিকা।

দরকার আছে কিছু? বইয়ের পাতা ওলটালো একটা। নিরুত্তাপ প্রশ্ন।

দরকার আর কি, কতদিন দেখা নেই বলুন তো—তিন সপ্তাহ বিছানায় পড়ে রইলাম! রোজ ভেবেছি আপনি আসবেন – একদিনও এলেন না!

আপনার আপনজনেরা তো সব গেছলেন। বই থেকে মুখ তুলল না এবারেও। মনে মনে ঘাবড়ালেও ধীরাপদ হেসে উঠল, আপনি কম আপনজন নাকি? জবাব নেই। গম্ভীর বিরক্তি। বই পড়ছে।

আর কথা বাড়ানো নিরাপদ নয়, তবু উঠে আসা গেল না। অথচ এই অবস্থায় কথা যদি বলতেই হয়, সেই কথার পিছনে নিঃশঙ্ক জোর থাকা দরকার। ফলাফল কি হতে পারে জেনেও ধীরাপদ নিরীহ মুখে জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার মেজাজের হঠাৎ এ অবস্থা কেন?

বই কোলের ওপর রেখে আস্তে আস্তে ঘাড় ফেরাল। দেখল। ওপরঅলা নীরব গাম্ভীর্যে যে-চোখে নিচের কর্মচারীর ধৃষ্টতা দেখে।

আপনার কাজ নেই কিছু?

আছে। আমার কাজটা আপাতত আপনার সঙ্গেই।

আর একটু ঘুরে বসল, পড়ার পৃষ্ঠায় আঙুল ঢুকিয়ে রেখে বইটা বন্ধ করল। চোখে চোখে তাকালো তারপর।— বলুন?

বলা মাথায় রেখে মানে মানে সরে পড়লে কেমন হয় এখন? সম্ভব নয়। তার হাতের সোনার রঙে নাম লেখা ঝকঝকে মোটা বইটার দিকে চোখ গেল। বইখানা ভারী সুদৃশ্য লাগছে যেন। বলল, আমার এই অসুখটার আগেও দেখেছি আপনি পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত, নতুন কোনো ওষুধবিষুধের প্ল্যান ভাবছেন নাকি? কি বই এটা?

চোখে-মুখে চিরাচরিত উগ্র অসহিষ্ণুতা দেখলেও ধীরাপদ মনে মনে স্বস্তি বোধ করত হয়ত। কিন্তু তার বদলে পাথর-মূর্তি একেবারে। বই হাতে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল সে।

আয়রন ইনট্রামাসকুলার থেরাপি, বুঝলেন?

ধীরাপদ বিপদগ্রস্তের মত মাথা নাড়ল, বোঝেনি।

গভীর আর গম্ভীর দৃষ্টি-ফলাকায় ওকে প্রায় দুখানা করে অমিতাভ গটগটিয়ে লাইব্রেরি ঘর ছেড়ে চলে গেল।

ধীরাপদই কুশনে গা ছেড়ে দিল এবার। ঘেমে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *