কাল তুমি আলেয়া – ১০

দশ

কপাল সত্যিই মন্দ নয় গণুদার।

সেদিনের মত মেজাজ বিগড়লেও অমিত ঘোষ তার আবেদন ভোলেনি। ধারাপদর সামনেই যথাস্থানে টেলিফোন করেছে একদিন। সুপারিশের ছলে অভিযোগ, যোগ্য লোক বছরের পর বছর ধরে হেজে পচে মরছে, সেদিকে চোখ নেই কেন কর্তাদের? গণেশবাবু প্রুফ-রিডারকে সাব-এডিটার আর কবে করা হবে?

গণুদার প্রত্যাশা মিথ্যে নয়, ওটুকুতেই কাজ হয়েছে। মহৎজন তাকালেও ক্ষুদ্রজনের কপাল ফেরে। গদার ফিরেছে। গণুদা সাব-এডিটর হয়েছে। সেটা এত তাড়াতাড়ি সে বিস্ময়ে আর আনন্দে গণুদা নিজেই আত্মহারা।

পরিতোষণ-গুণ একটা আর্ট বিশেষ। তোষামোদ যে করে আর যে তাতে তুষ্ট হয় দুজনের মনের তারে মিল হওয়া চাই। অমিলটা জলের ওপর তেলের মত চোখে লাগে। গণুদা সেই মিল বোঝে না; মেলানোর আর্ট জানে না। তার সাম্প্রতিক স্নেহের টানটা ধীরাপদর গলায় ফাঁসের মত আটকে বসার দাখিল। তাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দুই-এক পশলা বচসা হয়ে গেছে তাও জানে। বিস্তৃত ভাবে না জানলেও আঁচ পেয়েছে। উমা বুঝতে শিখছে একটু-আধটু, আর ধীরুকার ওপর তার এমনই টান যে, যেটুকু বোঝে গোপনে ফাঁস না করে পারে না। অবশ্য তার বলাটা বাপের দিক টেনেই, বাবা চায় ধীরুকার আগের মতই তাদের ওখানে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হোক। উমাও তাই চায়। উমা আর তার বাবার মত মা যে ধীরুকাকে অত ভালবাসে না, মায়ের রাগ আর অবুঝপনা দেখে উমা এই গোপন সত্যটাও প্রকাশ না করে পারেনি।

মনে মনে গণুদার ওপর ভয়ানক বিরক্ত হয়েছে ধীরাপদ। সোনাবউদির ওপর খুশি হওয়ার কথা, তাও হয়েছে। কিন্তু অভিমানে মনে মনে ক্ষুব্ধও হয়েছে একটু। বাইরে চিড় খেলেও আর একটা অদৃশ্য যোগ পুষ্ট হয়ে উঠছিল। এটুকুর প্রতিই ধীরাপদর লোভ। কিন্তু সম্প্রতি সোনাবউদি সেটুকুই ছেঁটে দিয়েছে একেবারে। তার নির্বাক আচরণ প্রায় রূঢ়। মেয়েটা পর্যন্ত এসে দু-দণ্ড বসতে পায় না, আসতে না আসতে ঝাঁঝালো ডাক শুনে বা ভ্রুকুটির তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালায়।

পরিতোষ-কলার ব্যাপারে গণুদার যোগ্য দোসর রমণী পণ্ডিত। তাঁকে ঠেকানো শক্ত। পাহাড়ী জলের ধারার মত বার বার ঠোক্কর খেয়েও তিনি বক্তব্য-কেন্দ্রে এসে পৌঁছুবেনই। কুমুর সেই শাস্তির ব্যাপারের পর থেকে তাঁকে এড়িয়ে চলছিল ধীরাপদ। তাঁকে কুমুকে দুজনকেই। কিন্তু রমণী পণ্ডিত নাছোড়। গদার পদোন্নতিতে তাঁর কৃতিত্ব কম নয় কারো থেকে। গদার হবে যে, সে ঘোষণা তিনিই করেছিলেন—করেছিলেন বলেই যা কিছু চেষ্টা-চরিত্র। নইলে হাত-পা গুটিয়ে বসেই থাকত হয়ত। অবশ্য গণুদা যে তাঁর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞ সেজন্যে, সেটা রমণী পণ্ডিত স্বীকার করেছেন। গণুদার খুব ইচ্ছে, তাঁদের দুজনকে বাড়িতে একদিন ভালো করে খাওয়ায়—তাঁকে আর ধীরাপদকে। কিন্তু তার স্ত্রীটি একেবারে বেঁকে বসেছে বলে পণ্ডিতের কাছে দুঃখ করছিল সেদিন, আর একটা বড় রেস্তরাঁয় তাঁদের নিয়ে গিয়ে খাওয়াবে বলছিল।

ধীরাপদর মনোভাব উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছেন রমণী পণ্ডিত, উচ্চস্তরের মন্তব্য করেছেন তারপর, কি দরকার এ-সবের, কোন প্রত্যাশা নিয়ে তো কেউ আর উপকার করতে যায় নি, ভালো হয়েছে সেই ভালো। পণ্ডিতের কালো মুখে অন্তরঙ্গ হাসি, কিন্তু তাঁর স্ত্রীটি হঠাৎ অমন বেঁকে বসলেন কেন সেটাই আশ্চর্য।—আমি না হয় বলতে গেলে বাইরের লোক, আপনি তো আর সেরকম নন, কারো উপকার ছাড়া অপকার কোনদিন করেননি।

ধীরাপদ সবিনয়ে তাঁকে উঠতে বলবে ভাবছিল। রমণী পণ্ডিত তাও অনুমান করলেন কি না কে জানে। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন চট করে, ভদ্রলোক দুঃখ করছিল বলেই বলা, নইলে এ-সব নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়। ঘুরেফিরে নিজের দুরবস্থার প্রসঙ্গে এসে গেলেন তিনি, ধীরাপদর অনুগ্রহে বইয়ের বিজ্ঞাপন আর কবিরাজী ওষুধের বিজ্ঞাপন লিখে সামান্য কিছু পাচ্ছেন বটে, কিন্তু তাতে কি আর হয়—এর ওপর মেয়েটা বড় হয়ে গেল, তার বিয়ের ভাবনা। একটা জ্যোতিষীর ঘর নিয়ে বসতে পারলে সব দিকে সুরাহা হয়, নইলে তো দু বেলা আহার জোটানোই শক্ত, কোন দিকে যে তাকাবেন ….

পণ্ডিত উঠে যাবার পর ধীরাপদ নিজের মনেই হেসেছে অনেকক্ষণ। ব্যাপার বড় মন্দ হল না। এই সুলতান কুঠিতে এক সোনাবউদি ছাড়া আর কেউ তাকে দেখতে পারত না। এখন সকলেই আপনজন তার। চাকরিতে উন্নতি হয়েছে বলে গদা খুশি তার ওপর, রমণী পণ্ডিত বিজ্ঞাপনের কাজ পেয়ে। একাদশী শিকদার আর একখানা বাংলা কাগজ পেয়ে খুশি আর শকুনি ভট্টাচায চ্যবনপ্রাস পেয়ে। মাঝখান থেকে আপন যে ছিল সে-ই শুধু দূরে সরে আছে।

সেদিন সন্ধ্যায় সুলতান কুঠির আঙিনায় একটা পুরনো গাড়ি দাঁড়ানো দেখে ধীরাপদ অবাক। কার কাছে কে এলো আবার। জামা-কাপড় বদলে সুস্থ হয়ে বসার আগেই চমকে উঠতে হল। আগন্তুক একজন নয়, দুজন—তারা পাশের ঘর থেকেই বেরুলো। একজন ডাক্তার, হাতে স্টেথোসকোপ আর ডাক্তারি ব্যাগ, সঙ্গের লোকটির হাতে কি সরঞ্জাম দুই-একটা, ধীরাপদ ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারল না। পিছনে গণুদা।

কার অসুখ? কি অসুখ?

ধীরাপদ দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ভদ্রলোকদের বিদায় দিয়ে গণুদা সামনে এলো। মুখে সলজ্জ হাসি।

ডাক্তার কেন?

ইয়ে একটা ইনসিওরেন্স করলাম, অফিসের ওই ভদ্রলোক ধরল খুব, তাছাড়া পণ্ডিতমশাইও পরামর্শ দিলেন—

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধীরাপদ ঘরে চলে এলো। কিন্তু গণুদার ইনসিওরেন্স-বৃত্তান্ত শেষ হয়নি, তাছাড়া একটু গল্প করার ইচ্ছেও প্রবল বোধ হয়। সময় বা সুযোগ হয়ে ওঠে না বড়। গগুদাও ভিতরে এসে দাঁড়াল।

ইনসিওরেন্স গণুদা একার নামে করেনি, স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে করেছে। দশ হাজার টাকার। একজনের অবর্তমানে আর একজন পাবে। এই বয়সে প্রিমিয়াম একটু বেশিই হল,

কিন্তু ছেলে-মেয়ের কথা ভেবে না করেও পারল না। অনুমোদনের আশায় জিজ্ঞাসা করল, ভালো করিনি?

জয়েন্ট ইনসিওরেন্স শুনে ধীরাপদ তাজ্জব, এ বুদ্ধি আবার গণুদাকে কে দিলে! বলল, ভালোই তো—

বীমা-প্রসঙ্গ এড়িয়ে গণুদা অমিতাভ ঘোষের কুশল-সমাচার জিজ্ঞাসা করল, তার মহত্ত্বের কথা বলল। বিকেলে একদিন তাকে চায়ে ডাকা আর এক বাক্স নারকেলের সন্দেশ পাঠানোর অভিলাষও ব্যক্ত করল। ধীরাপদর কোনরকম আগ্রহ না দেখে দ্বিধান্বিত একটু, অসন্তুষ্ট হবেন নাকি?

হতে পারে। এ-সবের দরকার নেই।

থাক তাহলে এখন। গণুদার ভালো-মন্দের সে-ই যেন একমাত্র পরামর্শদাতা। তাকে বসতে পর্যন্ত বলেনি ধীরাপদ, আপাতত ঘর থেকে বেরুলে খুশি হয়। কিন্তু গণুদার যাবার ইচ্ছে নেই। এ-রকম অবকাশের মধ্যে পেয়ে সুপরিকল্পিত সদিচ্ছাটা চাড়িয়ে উঠতে লাগল, স্ত্রীকে দিয়ে হল না দেখে চিড়খাওয়া আত্মীয়তাটুকু এই ফাঁকে নিজেই জুড়তে বসল সে। কিন্তু বাকপটু নয় রমণী পণ্ডিতের মত, একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলতে গেলে মুখ লাল হয়, খেই হারায়।—ইয়ে, একটা কথা তোমাকে বলব ভাবছিলাম, তোমার বউদিকে তো চেনই—নিজের দেওরের মতই দেখে তোমাকে, তুমি গরদ এনে দিয়েছিলে কত খুশি—কিন্তু ভয়ানক অবুঝ, একটু-আধটু ভুল-বোঝাবুঝি হলেও আবার কি মিলেমিশে থাকে না কেউ?

ধীরাপদর দৃষ্টিটা খরখরে হয়ে উঠছে গর্দা লক্ষ্য করল না। বলল, কিন্তু ভয়ানক জিদ, মেয়েছেলের এত জিদ—কথাটা কিছুতেই আর তাকে দিয়ে—

কী কথা?

কণ্ঠস্বরটা কানে লাগল খট করে। গদা সচকিত। ঢোঁক গিলে তাকালো, এই বলছিলাম, আগের মতই আবার—

কেন বলছিলেন?

গণুদা হকচকিয়ে গেল, মুখ শুকনো। তবু সামলাতে চেষ্টা করল কোনপ্রকারে, তোমার খাওয়াদাওয়ার অসুবিধের জন্যে…

আমার অসুবিধে তাতে আপনার কী? অস্বাভাবিক রূঢ়তায় গলার স্বর কঠিন হয়ে উঠল আরো, আপনারা ডাকলেই আমি যাব ভেবেছেন কেন? কেন আমার প্রসঙ্গে এ-সব আলোচনা হয় আপনাদের? কেন অন্য লোকের সঙ্গে পর্যন্ত আপনি আমার ব্যাপার নিয়ে কথা বলেন?

নিষ্পলক মুহূর্ত গোটাকতক। বেত্রাহতের মত পাংশুমুখে গণুদার প্রস্থান।

ধীরাপদ বিছানায় এসে বসল। খানিক বাদে নিজের এই অস্বাভাবিক উত্তেজনায় নিজেই হতভম্ব। এ আবার কি কাণ্ড করে বসল! একটা তুচ্ছ কারণে, প্রায় অকারণেই এভাবে নিজের ওপর নিজের দখল হারিয়ে বসল কি করে? কেন?

কতক্ষণ বসে ছিল ঠিক নেই, এক ঘণ্টাও হতে পারে, দশ মিনিটও হতে পারে। অটুট গাম্ভীর্যে সোনাবউদিকে সরাসরি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

দু হাত কোমরে, কুঁদুলী মেয়ের মত সোনাবউদি ঝাঁঝিয়ে উঠল, আপনি মশাই আমার ঘরের লোককে এভাবে অপমান করেন কোন্ সাহসে শুনি?

ধীরাপদ বিমূঢ় খানিকক্ষণ। ওর নিজের ধৈর্য্যচ্যুতি যেমন অস্বাভাবিক, এই গাম্ভীর্য আর এই কটুভাষণও তেমনি বিসদৃশ। কিন্তু উষ্ণ হয়ে উঠতে গিয়েও কেমন মনে হল, ঠকবে তাহলে। জবাব দিল, ঘরের লোককে এবার থেকে ঘরে আটকে রাখবেন তাহলে।

কী? আবার কথা টকটকিয়ে? আরো গরম হয়ে চোখ পাকালো সোনাবউদি, আপনি না হয় আছেনই ছ’শ টাকা মাইনের চাকুরে, আপনার দৌলতে না-হয় হয়েছে বড় একটা প্রমোশন, না হয় এসেই ছিল আপনাকে একটু তোয়াজ- তোষামোদ করতে তা বলে লোকটাকে আপনি ঘর থেকে অপমান করে তাড়াবেন?

পাকানো চোখের দুই তারায় চাপা কৌতুক উপচে উঠতে লাগল, ভুরুর ঘন কুঞ্চন প্রয়াসে তরল রেখা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, আর রূঢ় গাম্ভীর্য চিরে হাসির বিজলি ঝলসে উঠতে লাগল। শেষে সমস্ত চাপা অভিব্যক্তিটা গোটাগুটিই ভেঙে পড়ল একসঙ্গে, প্রতিরোধের চেষ্টায় বারকয়েক ফুলে ফুলে উঠে হাসির দমকে সোনাবউদি মেঝের উপরেই লুটিয়ে বসে পড়ল।

বেদম হাসি।

ধীরাপদ দেখছে। দু চোখ ভরে দেখছে। চোখের স্নায়ুতে স্নায়ুতে আর গলার কাছে একটা অব্যক্ত অনুভূতি তরল হয়ে ঠেলে আসতে চাইছে তার। খুশিতে আনন্দে ধীরাপদ বিব্রত বোধ করছে।

হাসির ধকল সামলে স্থির হয়ে বসতে চেষ্টা করল সোনাবউদি। কি একটা গ্লানি ধুয়ে মুছে একেবারে পরিষ্কার যেন। বলল, দু ঘণ্টাও হয়নি দশ হাজার টাকার লাইফ ইসিওর করে উঠল, মনে কত আনন্দ – আপনি দিলেন সব পণ্ড করে! আমি আর যে-সে লোক নই, কোনরকমে একবারটি মরতে পারলেই করকরে দশ হাজার টাকা পাইয়ে দিতে পারি, বুঝলেন?

জীবন-বীমার এই যুগ্ম ধারাটিই গণুদা বেছে নিল কেন সেটা ধীরাপদর মাথায় ঢোকেনি তখনো। ওতে কিস্তির হার বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। হয়তো ওটাই ভালো করে বুঝিয়েছে কেউ তাকে। হতেও পারে ভালো, ধীরাপদর বীমার ব্যাপার জানা নেই। সোনাবউদির কৃত্রিম দম্ভের জবাবে সেই ঠাট্টাই করল। আমি তো দেখছি আনন্দের বদলে ভদ্রলোকের কপালে দুঃখ আছে, আপনার ওই মরাটুকু হয়ে না উঠলেই তো সব গেল!

মরা হবে না বলেন কি! দু চোখ টান করে ফেলল সোনাবউদি, তারপরেই হেসে অস্থির আবার।—ইনসিওর করার তাগিদ অবশ্য আমিই দিয়েছিলাম, কিন্তু ডবল ইন্‌সিওর হল কেন তাও বুঝছেন না? দুজনের কুষ্টি ঘাঁটাঘাঁটি করে গণকঠাকুরটি তো কবেই ভরসা দিয়ে রেখেছেন, দজ্জাল বউ বেশি দিন জ্বালাবে না, অনেক আগেই চোখ বুজবে। চোখ বোজার আনন্দে আবারও চোখ বড় করে ফেলল সোনাবউদি, দজ্জাল হই আর যা-ই হই, গেলে দুঃখ কম হবে ভাবেন নাকি? ওই দশ হাজার টাকার স্মৃতিটুকুই যা সান্ত্বনা তখন। আনন্দে আমার এক্ষুণি মরতে ইচ্ছে করছে।

ধীরাপদ হাঁ করে শুনছিল প্রথম। তারপর হেসে ফেলেছিল। কিন্তু হাসিটা থাকেনি বেশিক্ষণ। কেন জানি মনে হয়েছে, হাতে ক্ষমতা থাকলে জীবনবীমার এই যুগ্ম ধারাটা সে নাকচ করে দিত। যুক্তি থাক আর নাই থাক, মৃত্যুকে মাঝে রেখে এই বণিকের সাবধানতা ধীরাপদর ভালো লাগল না।

সোনাবউদি প্রসঙ্গ ঘোরালো, ঘরে গিয়ে মুখ কালো করে শুয়ে পড়ল একেবারে, কি বলেছেন?

ধীরাপদ যথার্থই লজ্জা পেল এবারে, যা বলেছে নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য। সোনাবউদি দেখল একটু, তারপর টিপ্পনী কাটল, আপনার আবার এত তেজ হল কবে থেকে?

এবারে জবাব দিল, বলল, যেদিন থেকে আপনি দুর্ব্যবহার শুরু করেছেন আমার সঙ্গে।

আমি। কি দুর্ব্যবহার? জবাবের অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে ছদ্ম-প্রত্যাশায় ফিসফিসিয়ে উঠল, কেমন ব্যবহার করতে হবে?

চেষ্টা করে আহত সুরটাই বজায় রাখল ধীরাপদ, জোর দিয়ে বলল, গণুদার চাকরির উন্নতিটা তাঁর নিজের চেষ্টাতেই হয়েছে, আমি কিছুই করিনি। আমার ওপর রাগ কেন আপনার… কিছু যদি করতামও সেটা অনুগ্রহ ভাববেন আপনি?

সোনাবউদি মুখের দিকে চেয়ে ছিল। চেয়েই রইল খানিক। এই চাউনিটুকু দিয়েই তার অভিযোগ মুছে দিল যেন। তারপর হাসল একটু, কি ভাবব?

ধীরাপদ জবাব দিল না। জবাবের প্রত্যাশাও করল না সোনাবউদি। হঠাৎ নিজের ভিতরেই তলিয়ে গেল যেন। খানিক আগের চপলতা নিশ্চিহ্ন। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল, অন্যমনস্কের মত বলল, রাগ ঠিক নয়, কি জানি কি ভয় একটা। অনেক লোভে শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষতি, বোধ হয় সেই ভয়। এবারে বড় করেই নিঃশ্বাস ফেলল, এত রাতে আপনি আর বাইরে খেতে বেরুবেন না, বসে থাকুন।

ধীরাপদ বসেই রইল।…

রণু হলে বলত বোধ হয়, তোমার সব ভয়-ভাবনা এবার থেকে আমার কাঁধে চাপিয়ে দাও সোনাবউদি। ধীরাপদরও ইচ্ছে করছিল তাই বলতে।

মাসের প্রথম শনিবার।

মেডিক্যাল হোমের কর্মচারীদের মাইনের দিন। বেলা চারটে নাগাদ পরিচিত স্টেশান ওয়াগানটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। ভিতরে বাইরে তিন শিফটের বেতন- প্রত্যাশীরা অপেক্ষা করছিল। ম্যানেজার থেকে ঝাড়ুদার পর্যন্ত। এই একদিন গাড়িটা দুটো-আড়াইটের মধ্যে এসে যায়। আজ আসছিল না বলে মনে মনে সকলেই উৎকণ্ঠিত ছিল একটু। এবারে শনিবার পড়েছে মাসের ছয় তারিখে। দিনগুলোকে শনিবার পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে আসতে প্রাণান্ত। তারপর যদিই বা এলো, মাইনে হবে কি হবে না সে সম্বন্ধে সংশয়ের কারণ ছিল। গাড়ি দেখে নিশ্চিন্ত তারা।

লাবণ্য সরকার নয়, টাকার ব্যাগ হাতে ধীরাপদ নামল গাড়ি থেকে।

তাকে কেউ আশা করেনি বটে, কিন্তু দেখে অবাকও হল না খুব। হবার কথাও নয়। কারণ লাবণ্য সরকারের অনুপস্থিতিতে আর কেউ টাকা নিয়ে আসবে সেটাই আশা করছিল তারা। মহিলাকে না দেখে সকলেই বুঝে নিল সে আজও ফেরেনি।

গত চার দিন আসেনি লাবণ্য সরকার, সে কলকাতায় নেই তাও সকলেই জানে। ক’মাসের মধ্যে মেডিক্যাল হোমে এই প্রথম পদার্পণ ধীরাপদর। ইচ্ছে করলে এক-আধবার আসতে পারত। ইচ্ছে একেবারে হয়নি কখনো তাও নয়। তাছাড়া ফাঁকমত এখানকার কাজ দেখাশুনা করাটাও চাকরির অঙ্গ। কিন্তু তেমন কোনো উপলক্ষ হয়নি বলেই আসেনি। তাকে নিয়ে এখানে যে প্রহসন ঘটে গেছে, অকারণে আসাটা চাকরির দাপট ভাববে সকলে। সেই সঙ্কোচে আসেনি। নইলে ম্যানেজারের না হোক, রমেন হালদারের মুখখানা অদ্ভূত একবার দেখার লোভ ছিল ধীরাপদর।

আজ যে আসবে নিজেও জানত না।

এই আসার পিছনে ফ্যাক্টরীতে আজকের নীরব বৈচিত্র্যটুকু উপভোগ্য। কিন্তু বড় সাহেব হিমাংশু মিত্রের সামনে তেমন উপভোগ্য মনে হয়নি, তাঁর চাপা রাগ লক্ষ্য করে ধীরাপদ বরং হকচকিয়ে গিয়েছিল।

সকলেই জানে কোম্পানীর কাজে দু-তিন দিনের জন্য ছোট সাহেবের সঙ্গে লাবণ্য সরকারেরও বোম্বাই যাওয়া প্রয়োজন হয়েছে। কোম্পানীর কাজে বোম্বাই দূর নয় মোটেই। আকাশপথে ঘণ্টা-কয়েকের ব্যাপার মাত্র। আর যে যাই ভাবুক, লাবণ্যর যাওয়াটা ধীরাপদ অন্তত খুব দরকার মনে করেনি। সেখান থেকে নিয়মিত কাঁচা মাল আমদানীর ব্যাপারে মাঝে মাঝে গোলযোগ হচ্ছে বলে যাওয়া। সিতাংশু মিত্র একা গেলেই হত। ওষুধের সরকারী অনুমোদন লাভের তদবিরে গিয়ে বড় সাহেব যেমন লাবণ্য সরকারকে এগিয়ে দিয়েছিলেন, সিতাংশুরও হয়ত সেই একই উদ্দেশ্য। কিন্তু অন্তস্তলের আর কেউ উদ্দেশ্যের এই একমাত্র সাদাসিধে ব্যাখ্যাটাই মেনে নিতে রাজী নয়। তার ভ্রুকুটি কুটিলতা ভরা। তাছাড়া আর একটা সাদা কথা, এই ক’টা দিন অফিস নীরস লেগেছে ধীরাপদর।

কিন্তু লাবণ্য সরকারের বোম্বাই যাওয়ার খবরটা যে হিমাংশু মিত্রও জানতেন না, ধীরাপদ একবারও কল্পনা করেনি। তিনি ফ্যাক্টরীতে এসেছেন তাও জানত না, ঘরে ডাক পড়তে অবাক হয়েছিল। গিয়ে দেখে গম্ভীর। তারপর প্রশ্ন শুনে হতভম্ব।

সতুর সঙ্গে লাবণ্যও বম্বে গেছে?

ধীরাপদ জবাব দিতে পারেনি, মাথা নেড়েছিল হয়ত।

কাল সকালে বাড়িতে এতক্ষণ কথা হল, একবারও বলোনি তো?

যেন ওরই অপরাধ কিছু। কোনো স্বাস্থ্য সাময়িকীতে ভেষজ উৎপাদন-সমস্যাগত রচনা লেখার আলোচনায় গতকাল তাঁর বাড়িতে অনেকক্ষণই কেটেছে বটে। মেজাজ বেশ প্রসন্ন ছিল বড় সাহেবের। এইসব নীরস লেখার মধ্যেও ধীরাপদর কাব্যভাবের ব্যঞ্জনা নিয়ে ঠাট্টা পর্যন্ত করেছেন। মন্তব্য, ও বা ওর বউ দুজনের একজন কবিতা লেখে নিশ্চয়। বউ নেই শুনে পাইপ দাঁতে চেপে লঘু বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, হোয়াই? এনি হার্ট-ব্রেকিং অ্যাফেয়ার?

ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায়, সেই ছেলেবেলার শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারোনি নাকি হে!

এর মধ্যে লাবণ্য সরকার কলকাতায় আছে কি নেই—এটা যে একটা বলার মত খবর, একবারও মনে হয়নি। আজই বা হঠাৎ কার কাছে শুনলেন, কে জানে? জবাব না পেয়ে ঈষৎ রুক্ষস্বরে আবার জিজ্ঞাসা করেছেন, তার যাওয়ার দরকার হল কেন? বলে গেছে কিছু?

ধীরাপদর এবারও বাক-নিঃসরণ হয়নি, মাথা নেড়েছে। চকিতে আর একদিনের কথা মনে পড়েছে তার। লাবণ্য সরকার ছেলের সঙ্গে কথা কইছে শুনে যেদিন নিজের গাড়িতে ওকে ডেকে নিয়েছিলেন। সেদিনও এমনি বিরক্তি লক্ষ্য করেছিল, তবে এতটা নয়।

হিমাংশু মিত্র বলেছেন, এভাবে গেলে তাদেরও বলে যাওয়া দরকার, তোমারও জেনে রাখা দরকার। মেডিক্যাল হোমের মাইনের দিন আজ, মাইনে যেন হয়—

আর কিছু বলেননি। মেডিক্যাল হোমের মাইনের দিনের কথা ধীরাপদর মনেও ছিল না। উনি বলে না গেলে গণ্ডগোল কিছু হতই, মাইনে হতই না হয়ত। তবু ধীরাপদর ধারণা, বড় সাহেবের এই উষ্মা সেই ত্রুটির সম্ভাবনার দরুন নয় আদৌ। এত বিরক্তির কারণ তাঁর অগোচরে ছেলের সঙ্গে লাবণ্য সরকার গেছে বলে।

ডাক্তারের চেম্বারে বসে লাবণ্যর মত ধীরাপদও ম্যানেজারকেই ডাকল প্রথম। দু-হাত একবার কপালে ঠেকিয়ে ম্যানেজার কলের মত সামনে এসে দাঁড়ালেন। আজকের এই বিপরীত পরিস্থিতিটি উপভোগ্য। আদেশের অপেক্ষায় প্রসারিত দুই গোল চোখ ওর মুখের ওপর স্থির।

বসুন, বসুন। হাসিমুখে অন্তরঙ্গ আপ্যায়ন জানালো ধীরাপদ, মিস সরকার আজও ফেরেনি, এদিকে কি ভাবে কি হয় আমি তো কিছুই জানি নে—আপনি একটু সাহায্য করুন।

পদস্থ ওপরঅলার এ হৃদ্যতায় খুব বিশ্বাসী মনে হল না ভদ্রলোককে। কলের মতই বসলেন, পে-শিট-এর নাম আর টাকার অঙ্কগুলো দেখে নিয়ে মুখ তুললেন। অর্থাৎ ঠিক আছে।

ধীরাপদ প্রথমেই তাঁর মাইনেটা দিয়ে দিল। তারপর একে একে নাম ডেকে চলল। ম্যানেজার টাকা গুনে দিতে লাগলেন। কিন্তু ভদ্রলোক যে একটুও সহজ হতে পারছেন না তা বোঝা যায়। যারা মাইনে নিয়ে যাচ্ছে তারাও যেন চুপচাপ তাদের ম্যানেজারের নীরব বিড়ম্বনাটুকু উপলব্ধি করে যাচ্ছে।

বেশ জনাকতক বাকি তখনো। একজন মাইনে নিতে এসে জানালো, চারটের ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ এসে বসে আছেন এবং বাইরে থেকেই দু-চারজন রোগী বিদায় – করেছেন।

এই সুযোগে ম্যানেজারকেই অব্যাহতি দিল ধীরাপদ। — আপনি তাঁকে একটু বুঝিয়ে- সুজিয়ে বলে দিন, আর এ ক’টা পেমেন্ট আমি নিজেই করে দিচ্ছি!

যন্ত্রচালিতের মতই ম্যানেজার উঠে গেলেন।

সব শেষে রমেন হালদারের ডাক পড়ল। দারোয়ান বেয়ারা ঝাড়ুদারেরও পরে ধীরাপদ ইচ্ছে করেই আগে ডাকেনি।

শুকনো মুখ, চকিত চাউনি। একে একে সকলের মাইনে হয়ে যেতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল হয়ত। কিন্তু ছেলেটা বোকা নয়, একনজর চেয়েই বুঝল সকলের পরে ডাক পড়াটা কোনরকম ভুল বা অবহেলার দরুন নয়, উল্টে পক্ষপাতিত্বসূচক।

ধীরাপদ মিটিমিটি হাসছিল। বোসো।

বিনয়ের বিঘ্ন দূর করে বসল কোনরকমে। মাইনে নিল। টাকা ক’টা গুনে নেবার রাসনা থাকলেও ক্ষণিকের দ্বিধা কাটিয়ে পকেটে রাখতে গেল।

গুনে নাও, সকলকে দিয়েথুয়ে নিচ্ছ, কম বেশি হতে পারে। সলজ্জ হাসি। গুনল। নিশ্চিন্ত।

ভালো আছ?

হ্যাঁ। লাজুক-লাজুক সঙ্কোচ, আপনি ভালো আছেন?

ধীরাপদর মজা লাগছে। — ভালো আছি কি নেই একবার গিয়ে তো দেখে আসতে পারতে। ক’মাসের মধ্যে একবারও তো এলে না। মনেই ছিল না বুঝি?

ছিল। ঠিক সাহস হয়নি স্যার…

স্যার? হাসি সামলে ধীরাপদ ভুরু কোঁচকাতে চেষ্টা করল।—স্যার কি হে! তুমি স্যার বলতে নাকি আগে?

ওরই মুখে শোনা লাবণ্য সরকারকে দিদি ডেকে বিপাকে পড়ার গল্পটা মনে পড়ে গেল। কিন্তু ছেলে সেয়ানা। আনন্দে বিনয়ে আটখানা হয়ে অনুমতি প্রার্থনা করল যেন, আগের মতই দাদা ডাকব?

না, ঠাকুরদাদা বলবে। হেসে ফেলল, আর তাহলে আমার সঙ্গে পার্টনারশিপের ওষুধের দোকান করবে না ঠিক করেছ তুমি?

কি যে বলেন দাদা…। যেন কত ছেলেমানুষি স্বপ্নের জাল বুনেছে একদিন সেটা নিজেই বুঝেছে এখন।

কিন্তু সঙ্কোচ আর বেশিক্ষণ থাকল না। খুশিতে আনন্দে চাপা গলায় এরপর অনেক কথাই বলে ফেললে সে। দাদা এমন একজন পদস্থ ব্যক্তি কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি…. দাদা এত সরল আর নিরহঙ্কার বলেই…। এইজন্যেই অমন গণ্ডগোলটা হয়ে গেল, মিস সরকার পর্যন্ত জানত না, অন্যের আর দোষ কি। আর কারো কথা বলতে পারে না, কিন্তু ও নিজে খুব খুশি হয়েছে। ক’দিন তো দোকানে শুধু তাঁর কথাই আলোচনা হয়েছে। প্রথম প্রথম সকলেই ভেবেছে জেনারেল সুপারভাইজার সাহেব এবারে শোধ নিয়ে ছাড়বে, ম্যানেজার অদ্ভুত মজাটি টের পাবেন। শুধু রমেনেরই তা মনে হয়নি একবারও, তার ঠিক বিশ্বাস ছিল দাদাটি কক্ষনো ও-রকম লোক নয়।

একসঙ্গে এত কথা বলতে পেরে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল রমেন হালদার। ধীরাপদ টিপ্পনী কাটল, এত বিশ্বাস যে দাদাকে স্যার বলছিলে!

কি করব, রমেন নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে প্রায়, এতদিনের মধ্যে আপনি একদিনও এলেন না, সাহস হয় কি করে? একটু থেমে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, এবার থেকে আপনিই আমাদের মাইনে দেবেন বুঝি?

সেটা কি তোমার ভালো লাগবে খুব?

রমেন লজ্জা পেল আবারও। লাবণ্য সরকারকে নিয়ে অনেকদিন অনেক বে- ফাঁস কথা বলেছে। ক’দিন নেই বলে কত নীরস লাগছে, আগে হলে তাও রসিয়ে ব্যক্ত করত হয়ত। আজ একদিনে এতটা পেরে উঠল না। সত্যি হোক মিথ্যে হোক, সামনের মুরুব্বীটিকে তোয়াজ করল, আপনি দিলে ভালো লাগবে।

আলাপে ছেদ পড়ল, ভিতরের দরজা ঠেলে ম্যানেজার গলা বাড়ালেন। ছোকরা অর্থাৎ রমেন কেমন জমিয়ে বসেছে একনজরে দেখে নিয়ে সংবাদ দিলেন, ফ্যাক্টরী থেকে চীফ কেমিস্ট টেলিফোনে জানিয়েছেন, তিনি এখানে আসছেন—তাঁর জন্যে যেন অপেক্ষা করা হয়।

গল্প আর জমল না। দু-পাঁচ মিনিট বসে থেকে রমেন হালদার উঠে গেল। নির্দেশ শুনে ধীরাপদ অবাকই হয়েছে। কি আবার দরকার পড়ল হঠাৎ? কিছুদিন ধরে লোকটির মেজাজের হদিস পাচ্ছিল না আবার। যতদিন হাতে ধরে কাজ-কর্ম শেখাচ্ছিল, এক-রকম ছিল। ভারী কাছে পেয়েছিল অমিতাভ ঘোষকে ওই ক’টা দিন। এখন আবার কিছু একটা পরামর্শের জন্যে গেলেও রুক্ষ মূর্তি। অথচ ফ্যাক্টরীর কাজেও খুব যে ব্যস্ত তা মনে হয় না। নিজের চেয়ারে কমই দেখা যায় তাকে। বেশির ভাগ সময় হয় অ্যানালিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টএ, নয়ত লাইব্রেরীতে সন্ধান মেলে তার। কিছু একটা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ মাথায় ঢুকেছে হয়ত। তার এ ধরনের এক-একটা ঝোঁকের গল্প ধীরাপদ জুনিয়ার কেমিস্টদের মুখে শুনেছে, তখন কাছে গেলেও বিরক্তি।

আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ধীরাপদ অনুভব করলে চীফ কেমিস্টের মেজাজ চড়া। কিন্তু কতটা চড়া আর কি কারণে চড়া তখনো কল্পনা করতে পারেনি। হড়বড় করে এলো, ইশারায় তাকে ডেকে দোকান ছেড়ে ফুটপাথে এসে দাঁড়াল।

দোকানের লোক তটস্থ।

শীতের শেষ হলেও সন্ধ্যা উত্তীর্ণ ততক্ষণে। কোম্পানীর স্টেশন ওয়াগনটার সামনে আর কোনো গাড়ি চোখে পড়ল না। অমিতাভ ঘোষ ট্রাম বা ট্যাক্সিতে এসেছে। নিজের পুরনো গাড়িটা তাকে কমই চালাতে দেখেছে। অত ধৈর্য নেই বলেও হতে পারে, আবার চারুদির নিষেধের দরুনও হতে পারে। তাকে স্টিয়ারিং-এ বসতে দেখলেই চারুদির নাকি বুক কাঁপে। যে অন্যমনস্ক, কখন কার ঘাড়ে গাড়ি তুলে দেবে ঠিক নেই। চারুদিকে বলতে শুনেছে, ছোঁড়া হাড়-কেপ্পন, চোদ্দশ টাকা মাইনে পায়, তার ওপর ব্যবসার লাভ—ব্যাঙ্কের টাকায় ছাতা পড়ছে, না কিনবে একটা নতুন গাড়ি না রাখবে একটা ড্রাইভার।

ওই গাড়িটা আপনি এনেছেন?

হীরাপদ মাথা নাড়ল, সে-ই এনেছে।

সরাসরি গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল সে, পিছনে ধীরাপদ। ড্রাইভার ঘাড় ফেরালো, সপ্রশ্ন প্রতীক্ষা, অর্থাৎ কোন দিকে যেতে হবে?

পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করতে করতে ইশারায় সামনের রাস্তা দেখিয়ে দিল।

সিগারেট ধরানো হল। চুপচাপ খানিকক্ষণ। অপরিচিত যাত্রীর মত গম্ভীর মুখে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে।

কোথায় যাচ্ছি?

চারুদির বাড়ি। সংক্ষিপ্ত জবাব।

রকম-সকম দেখে ধীরাপদ ঘাবড়ে যাচ্ছিল। কোনো খারাপ খবর কিনা, বুঝছে না। জিজ্ঞাসা করল, সেখানে হঠাৎ?

ঘুরে বসল।— আমাকে যাবার জন্য টেলিফোন করেছিল। আপনার যাবার ইচ্ছে না থাকলে নেমে যান।

ধীরাপদ হাসি চাপল। কারণ না জানলেও মেজাজ গরম কতখানি বুঝেছে। তার হেপাজতে গাড়ি, তাকেই নেমে যেতে বলা।

কিন্তু এই রাগ সবটাই যে ওরই ওপর, ধীরাপদ স্বপ্নেও ভাবেনি। বক্রোক্তি শুনে সচকিত। নিজের অগোচরে পকেটে প্যাকেট হাতড়াচ্ছে আবার। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিটা ওর মুখের ওপর।—আপনি কাজটাজ আজকাল তাহলে ভালোই দেখাচ্ছেন।

এটাই প্রশ্ন নয়। নিরীহ মুখে চুপচাপ প্রতীক্ষা করাই সমীচীন মনে হল ধীরাপদর।

আর ঠিক এই কারণেই হঠাৎ একেবারে যেন ফেটে পড়ল লোকটা।— হাঁ করে দেখছেন কি, কাজ দেখাবার খুব শখ, না? কেন আপনি মাইনে নিয়ে এলেন? নিজের কাজ ফেলে কেন আপনি এ-সব কাজ করবেন?

ধীরাপদ বিমুঢ় খানিকক্ষণ। আক্রমণটা এই পথে হবে ভাবা শক্ত।—না করলে আজ এদের মাইনে হত কি করে?

ফুটন্ত তেলের ওপর জলের ছিটে পড়ল যেন।—না হলে না হত, তাতে আপনার অত মাথাব্যথা কিসের?

দুর্বোধ্য রাগের ঝাপটায় ধীরাপদ নাজেহাল। হঠাৎ আবার মনে হল, লাবণ্য সরকার সিতাংশুর সঙ্গে বোম্বাই গেছে, হিমাংশু মিত্র সে-খবরটা আজই পেলেন কেমন করে? অমিতাভই বা হঠাৎ এমন ক্ষেপে উঠল কেন, তার কি অভিলাষ ছিল?

ধীরাপদ আবারও বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করল তাকে, লোকগুলো এই একটা দিনের আশায় সারা মাস কাজ করে, তাদেরও ঘর-সংসার ছেলেপুলে আছে, মাসের এই ছ’ তারিখেও মাইনে না পেলে তাদের ভয়ানক কষ্ট হত—

থাক থাক। সরোষে আধখাওয়া সিগারেটটা পায়ে করে পিষল বারকতক।- তারা কষ্টে পড়ত–পড়ত, তাতে আপনার কি?

অন্ধ রাগ যুক্তি দিয়ে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা বিড়ম্বনা। ধীরাপদ চুপ। কিন্তু এই মুহূর্তে তাও বরদাস্ত হল না, অমিতাভ সশ্লেষে বলে উঠল, ফিরে এসে ওই মেয়ে আপনাকে খুব ধন্যবাদ দেবে ভেবেছেন, কেমন?

…তাই তো! নরম হবার ফলে বার বার ঘা পড়ছে দেখে ধীরাপদ অন্য রাস্তা ধরল, আমাকে চারুদির বাড়ি ধরে নিয়ে চলেছেন কেন, বিচার-টিচার করবেন?

একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অমিতাভ পকেটে হাত ঢোকালো আবার। সিগারেট চাই। প্যাকেট আর দেশলাই পাশে রেখেছে খেয়াল নেই। ধীরাপদ ঝুঁকে সে দুটো তুলে তার হাতে দিল। তারপর শান্ত অথচ ঈষৎ ঝাঁজালো সুরে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? অবুঝের মত এভাবে মাথা গরম করছেন কেন?

জবাবে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে সরোষে জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল সে। একটু অবকাশ দিয়ে ধারাপদ আবারও তেমনি জোর দিয়ে বলল, কারো ধন্যবাদের ধার ধারি না, আপনার মামা বলেছেন মাইনে যেন হয়, তাই দিয়েছি। এতে অপরাধটা কোথায় হল জানলে বোঝা যেত… মুখের ওপর পারব না বলে দিলে আপনি খুশি হতেন?

জানলা থেকে মুখ ফেরালো। সিগারেটটা ধরানো হয়নি। মামার কথায় মাইনে নিয়ে এসেছে জানত না বোঝা গেল। গলার স্বরও উগ্র নয় অতটা।—মামা কখন বলেছে?

দুপুরে, ফ্যাক্টরীতে।…তাঁকেও বিরক্ত দেখলাম খুব, মিস সরকারও বম্বে গেছেন জানতেন না।

রাগের বদলে আগ্রহ দেখা গেল ঈষৎ।—কি বলেছে?

বলেননি কিছু। ধীরাপদ হাসল, তিনিও আপনার মতই অসন্তুষ্ট আমার ওপর, কেন গেল, কি বৃত্তাও কিছু খবর রাখি নে কেন? তবে মনে হয়, আসল রাগটা মিস সরকার গেছেন বলেই।

তপ্ত মেজাজ ঠাণ্ডা। শেষ বচনে তাপ মোচন। তবু সশ্লেষে বলে উঠল, রাগ হবে না! কত বড় মহারথীর মেয়ে পাকড়াও করবেন ছেলের জন্যে, ভবিষ্যতের কত আশা! এই যদি মনে ছিল, ছেলেকে না সামলে এতদিন চোখ বুজে ছিল কেন?

ধীরাপদ মেজাজের উজানে পড়েছিল এতক্ষণ। এবারে স্রোতের মুখে, খুশির মুখে। এই এক খবরেই টান ধরা স্নায়ু সুস্থ হয়েছে বোঝা গেল। আর কিছু বলল না দেখে কৌতূহল চেপে জিজ্ঞাসা করল, তা তো হল, কিন্তু আপনার ব্যাপারখানা কী? ও বেচারাদের আজ মাইনে হল বলে আপনি অমন রেগে গেলেন কেন? আপনার যেন কিছু একটা উদ্দেশ্য পশু হল মনে হচ্ছে?

অনেক মানসিক রোগ আছে যা রোগী নিজে দেখতে পেলে সারে। অন্তস্তলের তেমনি একটা বক্র ইচ্ছার ওপর একঝলক আলোকপাত হল যেন। তবু গোঁয়ারের মতই অমিতাভ জোর দিয়ে বলল, হয়েছে তো, আপনি সর্দারী করতে গেলেন কেন?

কেন গেল সে কৈফিয়ৎ ধীরাপদ আগেই দিয়েছে। ডাক্তার মেয়ের সঙ্গে ছেলের ঘনিষ্ঠতায় মামাটির আপত্তির একটা কারণ শোনা গেল। কিন্তু এই স্বার্থটাই সব মনে হয়নি। কথাপ্রসঙ্গে আরো কিছুর আঁচ পাবে ভেবেছিল। কিন্তু প্রসঙ্গের আপাতত ওখানেই ইতি। অমিতাভ বাইরের দিকে মুখ বাড়িয়ে ছিল। ড্রাইভারের উদ্দেশে হঠাৎ নির্দেশ দিল, সামনের মোড়ের মাথায় গাড়িটা একটু রাখতে।

কিছু না বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেল। অদূরে ফুটপাথ-ঘেঁষা লাইটপোস্টের উল্টোদিকে ফোটো-স্টুডিও। সেখানেই গেল। ফোটোর কথা মনে হলেই ধীরাপদ অস্বস্তি বোধ করে কেমন। একটা অননুভূত প্রলোভন উঁকিঝুঁকি দেয়, সেটা নির্মূল করার তাড়নায় নীরব যোঝাবুঝি চলে খানিক।… ক্যামেরা নেই সঙ্গে, রাত করে ওখানে আবার কি কাজ পড়ল এখন। হয়ত ছবি ডেভেলপ করতে দিয়েছে, নয়ত ফিল্ম-টিল্ম কিনবে কিছু।

অদুরের লাইট-পোস্টের ওধারে চোখ পড়তেই বিষম চমকে উঠল ধীরাপদ। সর্বাঙ্গে ঝাঁকুনি একটা।

বীটার রাইস।

আশ্চর্য, মেয়েটার কথা ধীরাপদর মনেও পড়েনি এতদিন।

বাস-স্টপে প্রতীক্ষারত সেই দেহ-পসারিণী মেয়ে। যৌবন বিকিকিনির আশায় যে-কোনো আগন্তুকের প্রত্যাশায় যে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই ক্ষীণ তনু, সেই কটকটে লাল ব্লাউজ, সেই ঝকমকে ছাপা শাড়ি, সেই দগদগে প্রসাধন, সেই সব কিছু। মেয়েটা জায়গা বদল করেছে, এলাকা বদল করেছে। এক জায়গায় পসার বেশিদিন চলে না বলে পসারিণী জায়গা বদল করেছে।

বীটার রাইস! বীটার রাইস! বীটার রাইস!

আশ্চর্য! বার বার আউড়েও শব্দ দুটো স্নায়ুতে স্নায়ুতে সে-ভাবে আর ঝনঝনিয়ে উঠছে না। শিরায় সে ভাবে আর তরল আগুন ছড়াচ্ছে না। ভেতো-চাল কটু-চাল কষা-চাল? না, জুতসই বাংলা খোঁজার তাড়নায় ভিতরটা সেভাবে আর উদগ্র হয়ে উঠছে না। ছবিটা যে দেখাই হল না শেষ পর্যন্ত, সেই খেদও তেমন করে আর উপলব্ধি করছে না।

মেয়েটা জায়গা বদল করেছে…। ধীরাপদ কী বদল করেছে?

মোড়ের মাথায় আলো কম একটু। মেয়েটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। গাড়ির দরজা খোলা, ধীরাপদ ও-ভাবে চেয়ে আছে বলেই এগিয়ে আসছে। প্রত্যাশার সম্ভাবনা কতটুকু, দেখতে এগিয়ে আসছে।

ধীরাপদ চেয়ে আছে চিত্রার্পিতের মত।

মেয়েটারও চেনা-চেনা লাগল বোধ হয়। লাগাই স্বাভাবিক। অনেকদিন দেখেছে। একেবারে কাছাকাছি মুখোমুখিও দেখেছে। গাড়িটার পাঁচ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। আর নড়ল না। প্রসাধনের ফাটলে ফাটলে হাসির রেখা গোটাকতক, চোখের তারায় আমন্ত্রণের প্রত্যাশা একটু, একটুখানি ইঙ্গিতের আশা।

হঠাৎ চমকে উঠে হাত দুই দূরে সরে গেল মেয়েটা। ধীরাপদরও হুঁশ ফিরল যেন। সামনেই একটা প্যাকেট হাতে অমিতাভ ঘোষ। সবিস্ময়ে ধীরাপদর দিকে তাকালো একবার, তারপর অদূরবর্তিনীর দিকে। বুঝে উঠছে না কি ব্যাপার!

মেয়েটার মুখে আশাভঙ্গের ক্ষোভ। তবু আশাটা গোটাগুটি বিসর্জন দিয়ে উঠতে পারছে না বোধ হয়। একটু একটু করে সরে যাচ্ছে বটে, কিন্তু দৃষ্টিটা এদিকেই। যাচাইয়ের দৃষ্টি। এতটুকু ইশারার আঁচ পেলে আবার দাঁড়াবে। আবার এগোবে।

উঠে আসুন।

ধীরাপদর ডাকে অমিতাভ গাড়িতে উঠে বসল। দরজা বন্ধ করল। গাড়ি চলল।

কি ব্যাপার? মেয়েটিকে চেনেন নাকি?

ধীরাপদ মাথা নাড়ল। চেনে।

ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিল কেন? কি বলছিল?

বলছিল না কিছু, শুধু এসে দাঁড়িয়েছিল।

দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত লেগেছিল অমিতাভর, কথা শুনে আরো অবাক। —কি জন্যে?

ধীরাপদ, মুচকি হাসল একটু।—আমার জন্যে আপনার জন্যে যে-কোনো একজনের জন্যে।

অমিতাভ ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর হঠাৎই বোধগম্য হল, ব্যাপারটা।—বাই জোভ! উৎফুল্ল মুখে সামনের দিকে ঝুঁকে বসল, নীচু গলায় বলল, তেমন তো দেখলাম না—কিন্তু আপনি চেনেন কি করে? ঘটনা আছে নাকি কিছু?

ধীরাপদ হাসছে অল্প অল্প। মাথা নাড়ল— আছে।

আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই, অ্যাঁ? দেখতে এমন, অথচ—বলুন না ছাই শুনি?

সবুর সয় না। চীফ কেমিস্টের ছেলেমানুষি আনন্দ লক্ষ্য করছে ধীরাপদ।

আড়চোখে পাশের প্যাকেটটা দেখল একবার। কি আছে…ছবি না ফিল্ম?

তারপর বলল।

দিনের পর দিন মেয়েটার বাস স্টপে দাঁড়ানোর গল্প আর আশার গল্প। ময়দানের গল্প আর শীতের রাতে বিনামূল্যে পসারিণীর সেই পসার লুঠ হবার গল্প। মেয়েটার সেই কান্নার গল্প আর সেই বুকভাঙা হতাশার গল্প।

অমিতাভ ঘোষ স্তব্ধ। একটু আগের প্রগলভতা গেছে। নির্বাক খানিকক্ষণ, তারপর তেতে উঠল হঠাৎ। অমন হাঁ করে না থেকে তখন বললেন না কেন? ড্রাইভার-

ড্রাইভার সচকিত।

ধীরাপদ বাধা দিল, ঠিক আছে, চলো।

অমিতাভ ঘোষ দুই-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অবুঝের মতই ঝাঁঝিয়ে উঠল আবার, মেয়েটার এই অবস্থা আপনি আগে বললেন না কেন?

মেয়েটার এই অবস্থা তাতে আপনার কী?

খানিক আগে মেডিক্যাল হোমের কর্মচারীদের দূরবস্থা প্রসঙ্গে অমিতাভ ঘোষ ধীরপদকে ঠিক এই কথাই বলেছিল। ধীরাপদ ঠিক তেমনি করেই বলল।

সিগারেটের খোঁজে পকেট হাতড়াচ্ছে। সিগারেট পেল। ধরালো। ওতে উত্তেজনা কমে কি বাড়ে ধীরাপদর ধারণা নেই। কিন্তু যে কোনো বিক্ষিপ্ত মুহূর্তে এই যেন একমাত্র সম্বল লোকটার। বাকবিতণ্ডার স্পৃহা নেই আর, চুপচাপ সিগারেট টানতে লাগল।

ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছে ধীরাপদ। অমিতাভ ঘোষকে গল্প- বলে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে, অতনু-উচ্ছলতার মুখে বরফ-গলানো জলের ঝাপ্‌টা দিয়েছে যেন। কিন্তু ধীরাপদ নিজে তেমন ঠাণ্ডা হতে পারছে না। নিজের প্রতি প্রচ্ছন্ন অভিযোগ কি একটা, নিজের প্রতি নিজের বিদ্বেষ। আর কোথাও না গিয়ে বাড়ি যেতে পারলে হত।

তারপর ভেবেচিন্তে দেখা যেত, নিজের দিকে তাকানো যেত, বিচার-বিশ্লেষণে বসা যেত।

রাত মন্দ হল না, সেখানে দেরি হবে না তো?

অমিতাভ জবাব দিল না, জানলার গায়ে মাথা রেখে সিগারেট টানছিল, চিবুক নামিয়ে একবার তাকালো শুধু।

বাইরের ঘরের আলোয় বাগানের ওধারে চারুদির গাড়িটা দেখা যায়। সিঁড়ির গায়ে স্টেশান ওয়াগনটা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে দোড়গোড়ায় দেখা দিল পার্বতী। বাইরের ঘরেই ছিল, কেউ আসছে জানত হয়ত। কিন্তু আসছে বলে কোনরকম আগ্রহ নেই।

একজনের বদলে দুজন দেখে পার্বত্য রমণীর অটল গাম্ভীর্যে একটু যেন চিড় খেল, মনে হল ধীরাপদর। আজ পর্যন্ত পাঁচটা কথাও হয়নি, তবু তার প্রতি মেয়েটাকে বিরূপ মনে হয়নি একদিনও। আজও মনে হল না।

অমিতাভ আগে ঘরে ঢুকে ধুপ করে সোফায় বসে পড়ল। পিছনে ধীরাপদ। কর্ত্রীকে খবর দেবার কোনরকম তাড়া দেখা গেল না পার্বতীর। চুপচাপ ঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। জোরালো আলোয় লক্ষ্য করলে মুখে একটু প্রসাধনের আভাস মেলে। মাথার চুলও চকচকে, টেনে বাঁধা। আর একদিন চারুদি যেমন করে বেঁধে দিয়েছিলেন। সেদিনও অমিত ঘোষের আসার কথা ছিল। পরনের ফরসা আঁট শাড়ির আঁচলটা গলায় জড়ানো।

ধীরাপদর মনে হল এসে ভালো করেনি। খানিক আগের সেই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধটা যেন হঠাৎই মন্ত্রবলে পরিপুষ্ট হয়ে ঠেলে উঠতে চাইছে। সামনে যে দাঁড়িয়ে তাকেই শুধু দেখছে না, ফোটো অ্যালবামের স্নায়ুবিভ্রমী ছবিগুলোও চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে। এই আকণ্ঠ আঁট-বসনার সঙ্গে সেগুলোর মিল যেমন স্পষ্ট, অমিলটাও তীক্ষ্ণ তেমনি।

চারুমাসি কই? প্রশ্ন অমিতাভরই বটে, কিন্তু সে প্রশ্নে তাগিদ নেই কিছুমাত্র দু চোখ পার্বতীর মুখের ওপর।

বাড়ি নেই।

পার্বতীর সংক্ষিপ্ত জবাব শুনে ধীরাপদ অবাক। জবাবটা অমিতাভও আশা করেনি বোঝা গেল। জোড়া ভুরু কুঁচকে গেল একটু, আমাকে টেলিফোনে আসতে বলল, বাড়ি নেই মানে? গাড়িও তো দেখলাম বাইরে?

পার্বতী নিরুত্তর। জানাবার যেটুকু জানিয়েছে।

ধারাপদ কি ভুল দেখছে? বিরক্তির বদলে অমিতাভ ঘোষের সমস্ত মুখে একটা চাপা খুশির তরঙ্গ দেখছে—ভুল দেখছে। পকেটে হাত ঢোকাল সিগারেটের খোঁজে। কিন্তু সচেতন মনে খুঁজছে না, হাত পকেটেই থেকে গেল—মামা এসেছিল? মামার সঙ্গে বেরিয়েছে?

পার্বতী এবারেও জবাব দিল না। নির্বিকার গাম্ভীর্যে হাবভাব লক্ষ করছে, পরিবর্তন লক্ষ্য করছে।

জবাবের প্রত্যাশাও বোধ হয় করেনি মানুষটা। আনন্দসিক্ত তরল চঞ্চল মুহূর্ত গোটাকতক। ধীরাপদর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সহজতার আড়ালে ঢোকার অপটু প্রয়াস। পকেট থেকে হাত বেরুলো, সিগারেটও কিন্তু ধোঁয়ার তৃষ্ণা প্রবল নয় আপাতত, প্রয়োজনে ওটা সহায়ও বটে। দেশলাই-প্যাকেট সোফার হাতলের ওপর রেখে সরাসরি বলে ফেলল, কোনো সিনেমায় গিয়ে ঢুকেছে তাহলে, শীগগির ফেরার আশা নেই— আপনি কি করবেন?

অর্থাৎ চারুদির ফিরতে যত দেরিই হোক, তাকে অপেক্ষা করতেই হবে, এখন সমস্যা ধারাপদকে নিয়ে। গাড়িতে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ধারাপদ বলেছিল বটে। প্রকারান্তরে তাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু এখানে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে যাবার কথা আর মনেও ছিল না। সংগোপন নিভৃতে একটা লোভনীয় দেখার ভোজে মগ্ন ছিল সে। অমিতাভ ঘোষের ভণিতা এতই স্পষ্ট যে হেসে ফেলার কথা। কিন্তু তার বদলে ধীরাপদ একটা ধাক্কা খেয়ে অপ্রতিভ একেবারে। এই দুজনের মাঝখানে সে অবাঞ্ছিত তৃতীয় লোক বসে আছে একজন।

না, আমি আর রাত করব না, উঠি—

উঠে দাঁড়াবার আগেই পার্বতীর স্থৈর্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। তার দিকে ঘুরে নিরুত্তাপ গলায় বলল, তাঁরা সিনেমায় যাননি, আপনি বসুন।

প্রায় আদেশের মত শোনালো কথা ক’টা। ধীরাপদ হকচকিয়ে গেল। না পারে ফিরে বসতে, না পারে যেতে। কিন্তু অমিতাভ ঘোষের ইচ্ছার বেগে আর যাই থাক, দুর্বল ছলনা নেই। সেটা যেমন স্পষ্ট তেমনি কলাকৌশল-বর্জিত। একটা চাপা রেষারেষির আনন্দে তার গোটা মুখ উৎফুল্ল। বলে উঠল, সিনেমায় না গিয়ে থাকলে গঙ্গার ধারে গেছে, সেই দু-ঘণ্টার ধাক্কা—বসুন তাহলে।

অনাবৃত বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে ধীরাপদ নীরবে হাবুডুবু খেয়ে উঠল একপ্রস্থ। অপলক নেত্রে পার্বতী ওই লোকটার দিকেই চেয়ে রইল খানিক, তারপর ধীরাপদর দিকে।

ধীরাপদ পালাতেই চায়। আর এক মুহূর্তও থাকতে চায় না এখানে। হাসতে চেষ্টা করে মেরুদণ্ডহীনের মতই পালাবার অজুহাত খুঁজে নিল। বিড়বিড় করে বলল, না, আমি কোম্পানীর গাড়ি সেই সকাল থেকে আটকে রেখেছি, ড্রাইভারটাকেও ছেড়ে দেওয়া দরকার—

ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সটান গাড়িতে।

ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ছুটেছে কিন্তু ধীরাপদ বিরক্ত, যত জোরে ছোটা দরকার তত জোরে ছুটছে না। এক আসনে মাথা রেখে আর এক আসনে পা ছড়িয়ে বসেছে। স্নায়ু শিথিল হোক, মাথাটা শূন্য হয়ে যাক, শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল সহজ হোক। তার শুধু দেখার কথা, দেখেছে। দেখে দেখে হাসার কথা। অন্তস্তলের কি একটা ঘূর্ণিপাক থেকে মুক্তির তাড়নায় ধীরাপদ হেসেই উঠল।

…কিন্তু পুরুষের কোন ফাঁকটা নারী ভরে তোলে? তার সান্নিধ্য ভালো লাগে—কেন লাগে? এই ভালো লাগার সংকেতটা এমন অমোঘ এমন অপরিহার্য কেন? ধীরাপদ আগে শুধু দেখত, হাসত। এখনও তাই করবে। লাবণ্য সরকার বোম্বাই গেছে সিতাংশু মিত্রের সঙ্গে, হিমাংশু মিত্রের সঙ্গে চারুদি বেড়াতে বেরিয়েছে—অমিতাভ আসবে জেনেও বেরিয়েছে। এলেই বা, পার্বতী আছে বাড়িতে। পার্বতীর চুল কে বেঁধে দিল আজ?

ধীরাপদ হাসতে পারছে বটে। কিন্তু হাসিটা ভিতর থেকে কে যেন টেনে নিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে। দুজনের নিরিবিলির দূরন্ত লোভে অমিতাভ ঘোষ প্রকারান্তরে ঠেলে তাড়িয়েছে ওকে। ধীরাপদর হাসতে পারার কথা। পারেনি। উল্টে প্রলোভনের তীরে ভিক্ষুকের মত বসে ছিল, বসে থাকতে চেয়েছিল। পার্বতী যে কারণে থাকতে বলেছিল তাকে, কিছু না বোঝার ভান করে সেই কারণটাকে প্রশ্রয় দিয়ে পালিয়ে এসেছে সে। তাকে দস্যু-মুঠোয় ফেলে রেখে এসেছে। কিন্তু সেজন্যে সুস্থ পরিতাপ দূরে থাক, তলায় তলায় কার নির্মম উল্লাস! নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল ধীরাপদ। দুই চোখ বিস্ফারিত। কাকে দেখছে? কার উল্লাস?

কি করবে? চোখ রাঙাবে তাকে? বসে বসে শুধু শুকনো রিক্ত নিঃশ্বাস কুড়োতে বলবে কতগুলো? জগৎ দেখতে বলবে? দেখে কি পাবে? সে তো কেবল বলছে—ছাড়ো ছাড়ো ছাড়ো।

বাসনার বিবরে একটা সুপ্ত প্রতিবাদ অজগরের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে থেকে থেকে। তার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে কামনার কণা। তার পদসঞ্চার আগুনের মত, ঘাতকের মত, ক্ষুধাতুর মৃত্যুর মত। সে আপন জানে না।

লাবণ্য বোম্বাই গেছে সিতাংশুর সঙ্গে। হিমাংশুবাবুর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছে চারুদি। ঘরে অমিতাভ ঘোষ আর পার্বতী। নারী আর পুরুষ। পুরুষ আর প্রকৃতি। বিশ্ব ছুটেছে এক সুনিশ্চিত রাজপথে।

ধীরাপদর নির্দেশে স্টেশান ওয়াগন যে পথে চলেছে সেটা সুলতান কুঠির পথ নয়।

আসার সময় যে পথে এসেছিল সেই পথ।

মোড়টার বেশ কিছু আগে নেমে পড়ে গাড়িটা বিদায় করে দিল। চেতনার কন্দরে কন্দরে রাত যত ভরাট হয়ে উঠেছে, বাইরের রাত অত নয়। লোক-চলাচল কিছু হালকা বটে। দোকানপাট একেবারে বন্ধ হয়নি। ফোটো স্টুডিওটা আধখানা খোলা।

লাইটপোস্টের গায়ে ঠেস দিয়ে মেয়েটা ঠায় দাঁড়িয়ে তখনো। খদ্দের জোটেনি।

চকিতে সোজা হয়ে দাঁড়াল মেয়েটা। দূর কম নয়, তবু কি করে টের পেল সে-ই জানে। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। ব্যবধান কমছে, সংশয়ও কমে আসছে।

ধীরাপদ স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে।

কাছাকাছি এসে থমকালো একটু। চিনেছে। কোনো ইশারার প্রয়োজন নেই, আমন্ত্রণের দরকার নেই। একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল। পাশে এসে। হাসছেও বোধ হয়। অনুরাগের ছক-বাঁধা হাসি, খদ্দের বুঝে ওজনকরা হাসি। কিন্তু ধীরাপদ একবারও তাকালো না। তাকাতে পারল না। এক পা দু’পা করে বড় রাস্তা ধরে চলতে লাগল সে।

মেয়েটা পাশে পাশে।

ট্যাক্সি। ধীরাপদ চমকে উঠেছিল। ট্যাক্সিওয়ালারাও জানে বোধ হয় সব, বোঝে বোধ হয়। গতি মন্থর করে ট্যাক্সিওলা গলা বাড়ালো, থামবে কিনা নির্বাক প্রশ্ন।

দরজা খুলে দিতে মেয়েটাই আগে উঠল। কলের মত উঠে ধীরাপদ দরজাটা টেনে দিল। ড্রাইভার পিছন ফিরে তাকালো একবার, কোনো নির্দেশ না পেয়ে সামনে বড় রাস্তা ধরেই চলল সে।

রাস্তার থেকে ট্যাক্সির ভিতরে আলো কম অনেক। ধীরাপদ সুস্থ বোধ করল একটু, সুস্থ বোধ করতে চেষ্টা করল। মাঝখানে ফিকে অন্ধকারের ব্যবধান। সে এ-পাশের দরজা ঘেঁষে বসে আছে, মেয়েটা ওপাশের। ফিরে ফিরে দেখছে, ও একবার তাকালেই সরে আসবে হয়ত। সঙ্গীর হাবভাব দেখে ভরসা পেয়ে উঠছে না।

চৌরঙ্গীতে পড়ে ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যেতে হবে?

ধীরাপদই কি জানে কোথায় যেতে হবে! গাড়ি থামাতে বলল। নেমে ভাড়া মেটালো। মেয়েটাও নেমে দাঁড়িয়েছে।

চৌরঙ্গীর জোরালো আলোয় ধীরাপদ এই প্রথম চোখ মেলে তাকালো তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল, আঁতকে উঠল প্রায়। তার কি হয়েছিল? এ কোন প্রেতিনীর সঙ্গ নিয়েছে সে? এক আচমকা আঘাতে দিশা ফিরে পাওয়া মাত্র ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করল। কিন্তু পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে আছে যেন। ধীরাপদ দেখছে—নারী নয়, নারীর কঙ্কাল। কটকটে লাল ব্লাউজটা চোখের হুলের মত বিঁধছে, দগদগে ক্ষত-ছাপের মত লাগছে ছাপা শাড়িটা, মুখের শুকনো প্রসাধনের হিজিবিজি চিড় খেয়েছে।

মুহূর্তে সমস্ত মুখ কঠিন হয়ে উঠল ধীরাপদর, ধারালো দু চোখে মোহগ্রস্ত উষ্ণতার লেশমাত্র নেই, একটা দুঃসহ ক্ষোভ গুমরে ঠেলে উঠছে ভিতর থেকে।

মেয়েটা ঘাবড়ে গেছে। দু চোখ টান করে চেয়ে আছে তার দিকে। এই আলোর ফোয়ারার মধ্যে এসে কোথায় গোলযোগ ঘটে গেছে বুঝেছে। দুই চোখে নীরব অভিযোগ, নীরব উদবেগ, আর নিষ্প্রভ আশা। ও-চাউনির ভাষা মূক নয় আদৌ, আমি অন্ধকারের মেয়ে, অন্ধকারে ছিলাম, এ আলোতে তুমি আমাকে টেনে এনেছ। সেই সঙ্গে অব্যক্ত কাকুতি, তোমার মোহ ভেঙেছে সে দোষ আমার নয়, আমাকে ঠেলে দিও না, আজকের এই দিনটার মত আমাকে বাঁচার প্রতিশ্রুতি দাও, আমি বড় ক্লান্ত, আমাকে ঘৃণা করলেও দয়া করো, এই অস্তিত্বের মিছিলে আমিও তো একজন—

মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করছে ধীরাপদর। মুখের কঠিন রেখাগুলো মিলিয়ে গিয়ে কোমলতার ছাপ পড়ছে। পণ্যা নারীকে নয়, মেয়েটাকেই দেখতে চেষ্টা করল সে। আগে যেমন দেখত, বয়স যার কুড়ি-একুশ, অপুষ্ট, বড় শুকনো আর বড় করুণ, ওই প্রসাধন পরিহার করলে মুখখানা যার সুশ্রীই মনে হয়। এত কাছ থেকে এভাবে অবশ্য আগে দেখেনি। পুরুষের অকরুণ বিশ্বাসঘাতকতায় ময়দানে কেঁদে ভাসিয়েছিল যেদিন সেদিনও না। এই মুখ দুর্ভিক্ষের মুখ। প্রাণের শিখাটুকু শুধু ধিকি ধিকি জ্বলছে।

সামনেই বড় রেস্তরাঁ একটা। নৈশ ভোজনবিলাসীর ভিড় কম নয় একেবারে। ক্যাবিনে ঢোকার মুখে ধীরাপদ দাঁড়িয়ে পড়ল। অদূরে এক কোণে কল-বেসিন দেখিয়ে বলল, হাতমুখ ধুয়ে এসো ভালো করে।

মেয়েটা চলে গেল। ধীরাপদ চুপচাপ এসে বসল। বয় খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল—রাতের পুরো খাবার।

হাতমুখ ধুয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে মেয়েটা ফিরে এলো।

ধীরাপদ এই রকমই কল্পনা করেছিল, চমকে উঠল তবু। প্রসাধনের রঙ ধুয়ে মুছে গেছে। সমস্ত মুখে যেন রক্ত নেই এক ফোঁটা। নিঃসাড় বিবর্ণ পাণ্ডুর।

আধ ঘণ্টা।

খাবারের ডিশে ধীরাপদর আঙুল ক’টা নড়াচড়া করছে শুধু। মুখে কিছু উঠছে না বড়। মেয়েটা খাচ্ছে। ধীরাপদ তাই দেখছে চেয়ে। এমন খাওয়া আর দেখেনি। হাত দিয়ে মুখ দিয়ে চোখ দিয়ে সমস্ত সত্তা দিয়ে খাচ্ছে যেন। এক-একবার সামনের লোকটার দিকে চোখ পড়ে যাচ্ছে হঠাৎ, কুণ্ঠাও বোধ করছে হয়ত একটু। পরক্ষণে এক খাওয়া ছাড়া আর কিছুই মনে থাকছে না।

অব্যক্ত যাতনায় গলার ভিতরটা বুজে আসছে ধীরাপদর। চোখের কোণগুলো শিরশির করছে। এক-একজনের দেহের ক্ষুধা মেটাবার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে যে ক্ষুধার তাড়নায়, সেটা এই ক্ষুধা।

খাওয়া হয়ে এসেছে। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে। ধীরাপদর ডিশের দিকে চোখ পড়তে লজ্জা পেল একটু, মৃদু স্বরে বলল, আপনি কিছু খেলেন না তো?

তোমাকে আর কিছু দেবে?

নীরব কৃতজ্ঞতায় শুধু মুখ তুলে তাকালো একবার। মাথা নাড়ল। আর কিছু না।

তোমার নাম কি?

কাঞ্চন।

নাম শুনে হাসি পাচ্ছে ধীরাপদর, কাঞ্চনই বটে, নইলে পরিহাস এতদূর গড়াবে কেন?—কোথায় থাক?

প্লেটের ওপর আঙুল ক’টা নড়াচড়া করতে লাগল। নিরুত্তর।

ধীরাপদ আবার জিজ্ঞাসা করল, থাকো কোথায়? গলার স্বর ঈষৎ রূঢ়।

মেয়েটা মুখ তুলল, কিন্তু তাকাতে ভরসা পেল না। চোখ নামিয়ে নিল। এমন লোকের পাল্লায় সেও আর পড়েনি বোধ হয়।

বস্তিতে।

সেটা কোথায়?

বলল।

সেখানে আর কে থাকে তোমার?

বাবা আর ভাইবোনেরা।

তারা কি করে?

বাবার চোখে ছানি, চোখে দেখে না।

আর ভাইবোনেরা?

তারা ছোট।

ফাঁক নেই কোথাও। মঞ্চে-ধরা নাটকের মত, আট-ঘাট বাঁধা। বাবার চোখে ছানি, ভাইবোনেরা ছোট। বড় যে, সে দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনের এই রাস্তাটা ওকে শেখালো কে? ধীরাপদ জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করল না। থাক, আরো কি শুনবে কে জানে!

রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে আবার ট্যাক্সি ধরল একটা। ড্রাইভারকে যে পথের নির্দেশ দিল শোনা মাত্র মেয়েটা চকিতে ঘুরে বসল আধাআধি। লোকটার মাথায় ছিট আছে কিনা সেই সন্দেহ হওয়াও বিচিত্র নয়। এবারেও সরে এসে বসতে বা কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পেল না সে।

ধীরাপদ কোণে মাথা রেখে শরীর এলিয়ে দিয়েছে—তোমার বস্তি এলে বোলো।

কম পথ নয়। এতটা রাস্তা মেয়েটা রোজ হেঁটে আসে হেঁটে ফেরে? নাকি তার খদ্দেররা পৌঁছে দিয়ে যায়? কিন্তু আর কিছু জেনে কাজ নেই ধীরাপদর। অনেক জেনেছে। জানার ধকলে স্নায়ু অবশ।

একটা কাঁচা গলির মুখে ট্যাক্সি দাঁড়াল। আলো নেই। একফালি সরু লম্বা অন্ধকার যেন হাঁ করে আছে। সেই হাঁ পেরিয়ে বস্তি। টিম-টিম আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দূর থেকে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া অন্ধকারের মত দেখাচ্ছে বস্তির ঘরগুলোও।

মেয়েটা নেমে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট তার হাতে দিয়ে ধীরাপদ সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল আবার। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে চালাতে নির্দেশ দিল।

নোট হাতে মেয়েটা বিমূঢ় মুখে দাঁড়িয়ে।

চলন্ত ট্যাক্সি থেকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অত অবাক হবার কি আছে? সেও তো খদ্দেরই বটে। খদ্দের ছাড়া আর কি? দাঁতে করে নিজের গায়ের মাংস টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ধীরাপদর।

সুলতান কুঠি।

ট্যাক্সি অনেকটা আগেই ছেড়ে দিয়েছে। আজকের মত নিজের অস্তিত্বটুকুও মুছে ফেলতে চায় ধীরাপদ। এই রাতের অস্তিত্বও। পায়ের নিচে শুকনো পাতা আর শুকনো কাঠ-কুটোর শব্দ খড়খড়ে বিদ্রূপের মত লাগছে। সুলতান কুঠিতে নিষুতি রাত। চোরের মতই সেই সুপ্তির গহ্বরে এসে দাঁড়াল সে।

একেবারেই ঘরে না গিয়ে কদমতলার বেঞ্চিতে এসে বসল। ঘরে ঢুকলেই তো আলো জ্বালাতে হবে। যাক আরো কিছুক্ষণ। আলো নাকি জীবনেরই প্রতিবিম্বিত মহিমা। এই মুহূর্তে অন্তত ধীরাপদ সেই মহিমার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না।

কিন্তু না চাইলেই ছাড়ে কে? মাথার ওপর ওই তারাময়ী আকাশটাও নির্লজ্জ, বিবসনা। যৌবন-স্বপ্নে বিভোর।

কানের কাছটা গরম ঠেকছে আবার। একটু আগের অমন বাস্তব আঘাতটাও মিইয়ে আসছে। ধীরাপদ উঠে দাঁড়ালো চট করে। পায়ের নিচে কঠিন মাটি উপলব্ধি করতে চাইল।

দরজা খুলে ঘরে এলো। অন্ধকারে জামা-কাপড় বদলে অন্ধকার হাতড়েই গামছাটা কাঁধে নিল। পা-টিপে কুয়োতলার দিকে চলে গেল, তারপর ভীরু সতর্কতায় কয়েক বালতি জল তুলল কুয়ো থেকে। একটুও শব্দ যেন না হয়, শব্দ হলেও অপরাধ হবে যেন। সুলতান কুঠির সুপ্ত-ঘন অন্ধকারের পরদাটা ছিঁড়ে যাবে।

শরীরটা জুড়িয়ে গেল, ঠাণ্ডা হল। বেশ ধীরে-সুস্থে আরাম করে সবটা জলই মাথায় ঢালল সে। একটা বিকারের ঘোর কেটে গেছে যেন। আর ভাবনা নেই, আর সমস্যা নেই।

গা মুছে ভিজে কাপড়ে ঘরের উদ্দেশে পা বাড়াল। কাপড় আনেনি, ঘরে গিয়ে বদলাবে।

কিন্তু সোনাবউদির ঘরের পিছনদিকের জানালাটা পেরুবার আগেই মুহূর্তের জন্য দু’পা আড়ষ্ট একেবারে। অন্ধকারে জানলার গরাদ ধরে সোনাবউদি দাঁড়িয়ে। চাপা বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? এত রাতে চান কেন?

গরম লাগছিল কেমন। অস্ফুট জবাব দিয়ে ধীরাপদ দ্রুত ঘরের দিকে পা চালিয়ে দিল। পালাতে চায়।

পালানো হল না।

ঘুরে এসে দেখে সোনাবউদি বারান্দায় তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। কাছে আসতে আপাদ-মস্তক দেখে নিল একবার।—কি হয়েছে?

ধীরাপদ সেই জবাব দিতে যাচ্ছিল। পারল না, সোনাবউদির দিকে চেয়েই চোখ দুটো থমকালো হঠাৎ। আদুড় গায়ে শাড়ির আঁচলটা বেশ করে জড়ানো। নিজের অগোচরে সোনাবউদির মুখের ওপর থেকে তার চোখ দুটো নেমে এসেছে। যৌবনের কোমল তরঙ্গ হৃদয়ের তীরে এসে স্তব্ধ যেখানে—সেইখানে।

কিছু না…। ধীরাপদ হঠাৎই আবার সবলে ছিঁড়ে নিয়ে এলো নিজেকে, অন্ধকার ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। তারপর নিস্পন্দের মত দাঁড়িয়ে রইল খানিক। এবারও আলো জ্বালল না। সোনাবউদি অবাক হয়ে খানিক অপেক্ষা করবে জানা কথা। আলো জ্বাললে আবারও হয়ত ঘরে আসবে। সর্বত্র এ কি অদ্ভুত ষড়যন্ত্র আজ। সেই ষড়যন্ত্রে সোনাবউদিও একজন!

এই না একটু আগে ঠাণ্ডা হয়েছিল, গা জুড়িয়েছিল, সব সমস্যার শেষ হয়েছিল? কাপড়টা তো এখনো জবজবে ভিজে, সোনাবউদি কি দেখল? কি বুঝল? কি ভাবল?

ধীরাপদ কি করবে এখন? নিজের এই চোখ দুটোকে খুবলে তুলবে?

অন্ধকারেই কাপড়টা বদলে নিল।

তারপর বসল। বিছানায় নয়, মাটিতে। ঠাণ্ডার তাগিদ আবারও। আকুতি। মাটিতেই শুয়ে পড়ল আস্তে আস্তে।

ঠাণ্ডা মাটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *