কাল তুমি আলেয়া – ১

এক

লোহার বেঞ্চিতে পা ছড়িয়ে বসে অলস কৌতুকে ধীরাপদ যেন এক হৃদয়শূন্য কালের কাণ্ড দেখছিল। একের পর এক।

পাকস্থলীর গা-ঘুলনো অস্বস্তিটাও টের পাচ্ছে না আর।

সমান করে ছাঁটা মেহেদির বেড়ায় ঘেরা এই ছোট্ট অবসর বিনোদনের জায়গাটুকুতেও কাল তার পসরা খুলে বসেছে। কেউ দেখছে না। কিন্তু দেখলে দেখার মতই। ধীরাপদ দেখছে। আর এইটুকু দেখার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে এক ধরনের আত্ম-বিস্মৃতির ভুষ্টিতে বিভোর হয়ে আছে।

সদ্য রঙ্গপট সামনের ওই খালি বেঞ্চটাই। এক ভদ্রলোক এসে বসেছে। পরনে দামী স্যুট, পায়ে চকচকে জুতো, আর হাতে ঘাস-রঙা সিগারেটের টিন সত্ত্বেও এক নজরে বাঙালী বলে চেনা যায়। চঞ্চল প্রতীক্ষা। কোটের হাতা টেনে ঘন ঘন হাত- ঘড়ি দেখছে, এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলে নাচাচ্ছে মুহুর্মুহু, বিরক্তিতে আধ- খাওয়া সিগারেট মেহেদি-বেড়ার ওপর ছুঁড়ে ফেলে একটু বাদেই আবার টিন খুলছে।

প্রতীক্ষা সার্থক যার আবির্ভাবে, তাকে দেখে ধীরাপদ প্রায় হতভম্ব। ঢ্যাঙা আধ- বয়সী একটা লোক, পরনে চেক-লুঙ্গি, গায়ে সাদার ওপর সাদা ডোরাকাটা আধময়লা পাতলা জামা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি-ভরা মুখের কষে পানের ছোপ। সব মিলিয়ে অশুভ মূর্তি একটি। কিন্তু তাকে দেখামাত্র সাগ্রহে উঠে দাঁড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানালো স্যুট-পরা ভদ্রলোক। তারপর দুজনেই ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে বসল বেঞ্চিতে। ফিস ফিস কথাবার্তা। হাত-মুখ নেড়ে ভদ্রলোকই কথা কইছে বেশি। অপরজন অপেক্ষাকৃত নির্বিকার।

কথার মাঝে লোকটা নিজের পকেটে হাত দিতেই ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি সিগারেটের টিন খুলে ধরল। কিন্তু লোকটা নিরাসক্ত। সিগারেটের টিনের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে পকেট থেকে বিড়ি বার করে ধরালো। তারপর পরিতৃপ্তি সহকারে গোটা দুই তিন টান দিয়ে কি যেন বলল। সঙ্গে সঙ্গে ‘ভদ্রলোক বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেটের টিনসুদ্ধ দু হাত মাথার ওপরে তুলে নাচ জুড়ে দিল।

দেখার তন্ময়তায় ধীরাপদ প্রায় ঘুরে বসেছে। লুঙ্গিপরা লোকটা নিস্পৃহমুখে সেই নাচের মাঝখানে আবারও কি বলার সঙ্গে সঙ্গে দম ফুরানো কলের পুতুলের মতই নাচ থেমে গেল। ধপ করে তার পাশে বসে পড়ল আবার। টিন খুলে সিগারেট ধরাল। কোটের পকেট থেকে একটা স্ফীতকায় পার্স বার করে গোটাকতক দশ টাকার নোট তার কোলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর আর একটি কথাও না বলে শুধু একটা উগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে চলে গেল।

বিড়ি ফেলে নোট কখানা গুনে পকেটে রাখল লোকটা। ধীরাপদর মনে হল, গোটাসাতেক হবে। এক্ষুনি উঠে চলে যাবে বোধ হয় লোকটা—ওই যাচ্ছে। মনে মনে এবার জোরালো রহস্যের জাল বুনবে ধীরাপদ। সম্ভব অসম্ভব অনেক রকম। সময় না কাটলে দুর্বহ বোঝার মত, কিন্তু কাটাতে জানলে পলকে কাটে। ধীরাপদ জানে।

কিন্তু শুরুতেই মেহেদি-বেড়ার ওধারে একটা চেঁচামেচি শুনে রহস্যের বুননি ঢিলে হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল। এতক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ দাঁড়ানোর

ফলে সর্বাঙ্গের সব ক’টা স্নায়ু একসঙ্গে ঝিমঝিম করে উঠল। চোখে লালচে অন্ধকার, পায়ের নিচে ভূমিকম্প। তাড়াতাড়ি বেঞ্চিতে বসে পড়ে দু চোখ বুজে ফেলল। তারপর একটুখানি সামলে নিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকালো। সব ঠিক আছে, কিছুই ওলটপালট হয়নি। উঠে দাঁড়ানোর দরকার ছিল না। চেঁচামেচির কারণ বসে বসেই অনুমান করা যাচ্ছে। বেড়ার ওধারে বসে নানা রকমের চাট বেচছে একটা লোক। তার সামনে দশ-বারোটি খদ্দেরের রসনা চলছে। তাদেরই কোনো একজনের সঙ্গে হিসেবের গরমিল এবং বচসা।

দিনের ছোট বেলা পড়তে না পড়তে সন্ধ্যে। বিকেলের আলোয় কালচে ছোপ ধরেছে। এরই মধ্যে বেলা পড়ে আসছে দেখে মনে মনে খুশি। দূরে চৌরঙ্গীর প্রাসাদ- চূড়ার ঘড়িটাতে পাঁচটা বাজে। ওই ঘড়িটাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছে ধীরাপদ। মাঝে মাঝে অচল হয়, দশ মিনিট পিছিয়ে চলে। ধীরাপদর তাতে আপত্তি নেই, এগিয়ে চললেই আপত্তি। বাড়িটাতে ঢালাও ব্যবসা ছিল ইংরেজদের, এখন মালিকানা বদলেছে। কিন্তু ঘড়িটা এক-ভাবেই চলেছে। চলছে আর বন্ধ হচ্ছে। দেশেরও মালিকানা বদলেছে। কিন্তু ধীরাপদ এক-ভাবেই চলেছে। চলছে আর থামছে।

বদলাচ্ছে তো সব কিছুই। এই কার্জন পার্কই কি আগের মত আছে? আগের থেকে অনেক সংকীর্ণ হয়েছে, অনেক ছোট হয়ে গেছে। শোভা বেড়েছে বটে—কিন্তু অনেক ছাড়তে হয়েছে তাকে। নরম ঘাস আর নরম মাটি খুঁড়ে খুবলে পিচ দিয়ে বাঁধানো হয়েছে প্রায় অর্ধেকটা। দেহের শিরা-উপশিরার মত ঝকঝকে তকতকে আঁকা- বাঁকা অজস্র ইস্পাতের লাইন বসেছে তার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সান্ধ্য রোমান্সের হাওয়াও বদলেছে এখানকার। আগে সন্ধ্যা হতে না হতে জোড়া জোড়া দয়িত-দয়িতার আবির্ভাব হত। পরস্পরের কটি-বেষ্টন করে হাঁটত, নয়ত গুল্মঝোপের আড়ালে বা সুপরিসর মেহেদি-বেড়ার নিরিবিলি পাশটিতে বসে বারো মাস বসন্তের হাওয়া গায়ে লাগাত। ধৈর্য ধরে বসে থাকলে আরো গাঢ়তর অনুরাগের আভাসও পাওয়া যেত। বসন্তের

সেই সব অনুচর সহচরীরা কোথায় এখন?

বোধ হয় অন্য জায়গা বেছে নিয়েছে।

ভাবনাটা এবারে একঘেয়ে লাগছিল ধীরাপদর। পাকস্থলীর অস্বস্তিকর যাতনাটা চাড়িয়ে উঠতে চাইছে আবার। হাঁটুতে চাপ রেখে আর একটু ঝুঁকে বসল!

দেখতে দেখতে অফিস ফেরত জনতার ভিড়ে সমস্ত এলাকা ছেয়ে গেল। সার বেঁধে চলেছে বাঙালী, অবাঙালী, শেতাঙ্গিনী, শ্যামাঙ্গিনী। মুখের দিকে ভালো করে তাকালে গৃহ-প্রত্যাবর্তনের তাগিদটুকু অনুভব করা যায়। সমস্ত দিনের খাটুনির পর এই অধিকারটুকু অর্জন করেছে তারা। এটুকু মূল্যবান। নিস্পৃহ চোখে ধীরাপদ খানিকক্ষণ ধরে এই জনতার মিছিল দেখল চেয়ে চেয়ে। কেউ ব্যস্ত-সমস্ত, কারো গতি মন্থর। অফিসের চাপে শুধু ওই ফিরিঙ্গী মেয়েগুলোরই প্রাণ-চাঞ্চল্য স্তিমিত হয়নি মনে হল। কলহাস্যে নেচেকুঁদে চলেছে তারা। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন বাঙালী মেয়ে চলেছে একটি দুটি। তাদের চলন বিপরীত। এরই মধ্যে এক-একজনের মোটামুটি রকমের সুশ্রী নারী- অঙ্গে বহুজোড়া চোখের নীরব বিচরণ লক্ষ্য করছে। সামনের ওই ফর্সা-মত বিবাহিতা মেয়েটিকে এক-চাপ জনতা যেন চোখে চোখে আগলে নিয়ে চলেছে। ধীরাপদ হাসছে, প্রাকৃতিক চাহিদার কোনটা না মিটলে চলে? কোন জ্বালাটা কম?

দিনের আলো ভুবল। চৌরঙ্গীর প্রাসাদ-চূড়ায় ঘড়িটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না আর। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোর মেলায় চৌরঙ্গী হেসে উঠবে। একটা দুটো করে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। নিয়ন লাইটের বিজ্ঞাপন তরঙ্গ শুরু হয়ে গেছে। এখনও জমজমিয়ে ওঠেনি তেমন।

বেঞ্চির একধারে সরে এলো ধীরাপদ। গুটিতিনেক হাল-ফ্যাশানের ছোকরা বাকি জায়গাটুকু দখল করেছে। ধীরাপদ উঠেই যেত, কিন্তু তাদের রসালো আলোচনা কানে যেতে কান পাতলো। আবছা অন্ধকারে মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না। বিদেশী ছবির স্তুতির উচ্ছ্বাসে কান ভরে যাচ্ছে। একজনের এই দুবার দেখা হল ছবিটা, একজনের তিনবার, আর একজনের পাঁচবার। বার বার দেখেও পুরনো হচ্ছে না। কি নাম বলছে ওরা ছবিটার? সাগ্রহে ঘুরেই বসল ধীরাপদ।

….বীটার রাইস।

বীটার রাইস! এ-রকমও হয় নাকি আবার কোনো ছবির নাম? ছবি না-ই দেখুক, নাম পছন্দ হয়েছে ধীরাপদরও। অদ্ভুত নাম।…বীটার রাইস। বাংলায় কি হবে? তেতো চাল? কটু চাল? দূর! বাংলা হয় না। বাংলা করলে স্নায়ুর ওপর শব্দ দুটো তেমন করে ঝনঝনিয়ে ওঠে না। বীটার রাইস। খাসা নাম! একবার দেখলে হত ছবিখানা! পারলে দেখবে।

কি বলে ওরা! ও হরি, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করল বুঝি ছবির নায়িকা? ছবির নায়িকাই হবে বোধ হয়। আরো খুশি হল ধীরাপদ। ওদের খেদ শুনে হাসি পায়, বীটার রাইস-এর নায়িকা আত্মহত্যা করবে না তো কি! ছবিখানা দেখার আগ্রহ দ্বিগুণ বাড়ল, কিন্তু কোন দেশের ছবি? কারা জেনেছে বীটার রাইস-এর মর্ম?

ছবির প্রসঙ্গ থেকে নায়িকার আঁটসাঁট অত্যল্প বেশ-বাস উপচে পড়া যৌবন আর অঙ্গ-সৌষ্ঠবের দিকে ঘুরে গেল ওদের আলোচনা। এবারে দুবার তিনবার আর পাঁচবার করে দেখার তাৎপর্য বোঝা গেল। বীটার রাইসের নায়িকা মরেছে, কাহিনীর নায়িকা মরেছে—ছবির নায়িকা মরেনি। দর্শকের অতনু-মনে ঊর্বশীর পরমায়ু সেই নায়িকার।

হায় গো সাগর-পারের নায়িকা, তোমার ছায়া এমন, তুমি কেমন?

ধীরাপদ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। আবার না স্নায়ুগুলো ঝিমঝিম করে ওঠে। মাথাটা ঘুরছে একটু, শরীরটাও ঘুলিয়ে উঠছে কেমন। কিন্তু ও কিছু নয়, দু পা হাঁটলেই সেরে যাবে। হাল্কা লাগছে অনেক। দেহ সম্বন্ধে সচেতন হলেই যত বিড়ম্বনা। ওইটুকু খাঁচার মধ্যে মনটাকে আবদ্ধ রাখতে চাইলেই যত গোল। এত বড় দুনিয়ায় দেখার আছে কত। সেই দেখার সমারোহে নিজেকে ছেড়ে দাও, ছড়িয়ে দাও, মিশিয়ে দাও। শুধু নিজের সঙ্গে যুঝতে চেষ্টা করো না। তাহলেই সব বিড়ম্বনার অবসান, সব মুশকিল আসান। পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত বলতে গেলে এই দেখার আর্টটাই রপ্ত করেছে ধীরাপদ। রপ্ত করে জিতেছে। যেমন আজকের দিনটাও জিতল।

জেতার আনন্দে বড় বড় পা ফেলে ট্রাম-ডিপো আর রাস্তা পার হয়ে চৌরঙ্গীর ফুটপাথে এসে দাঁড়াল সে। আর সেই আনন্দেই আজকের মত ছেলে পড়ানোর কর্তব্যটাও অনায়াসে বাতিল করে দিতে পারল। ও কর্তব্যটার প্রতি বিবেকের তাড়না

নেই একটুও। নিক্তি মেপে ছাত্রের জন্যে বিদ্যা কেনেন তার অভিভাবক। মাসে তিরিশ টাকার বিদ্যে। প্রতি দিনের কামাই পিছু একটাকা কাটেন। এর বাইরে আর কোনো কৈফিয়ৎ নেই।

সন্ধ্যারাতের চৌরঙ্গী। দিনের পর দিন বছরের পর বছর দেখছে ধীরাপদ। তবু নতুন মনে হয় রোজই। কবে একদিন নাকি চৌরঙ্গীতে বাঘ ডাকত। ধীরাপদর হাসি পায়। আফ্রিকায় সিংহের রাজত্ব ছিল শুনলেও হয়ত দূরের বংশধরেরা হাসবে একদিন।

এ আলোয় কি এক মদির উপকরণ আছে। এখান দিয়ে হাঁটতে হালকা লাগে, নেশা ধরে। ধীরাপদ পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে আর লোকজনের আনাগোনা দেখে এখানকার জীবন যেন এমনি আলোর প্রতিবিম্বিত মহিমা। নারী-পুরুষেরা আসছে যাচ্ছে। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ। পুরুষের বেশ বাসে তারতম্য নেই খুব—তকতকে,

ফিটফাট। কিন্তু নারী এখানে বিচিত্ররূপিনী। তাদের বাসের ওধারে অন্তর্বাসের কারুকার্যটুকু পর্যন্ত স্পষ্ট। চার আঙুল করে কোমর দেখা যায় প্রায় সকল আধুনিকারই। উপকরণের মহিমায় মাঝবয়সী রমণীরও যৌবন উদ্ধত। রং-বাহার রূপের মেলা। রাতের চৌরঙ্গী আতিশয্যের

পরাভব জানে না।

ধীরাপদ দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ।

বাস-স্টপে সেই মেয়েটা আজও দাঁড়িয়ে।

বাঁয়ে লিওসে স্ট্রীট, সামনে রাস্তা। রাস্তার ওধারে বাস-স্টপ। সেইখানে মেয়েটা দাঁড়িয়ে। যেমন সেদিন ছিল। একের পর এক বাস আসছিল, থামছিল, চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো বাসেই ওঠার তাড়া নেই মেয়েটার। নিরাসক্ত মুখে যাত্রীদের ওঠা-নামা দেখছিল, পথচারীর আনাগোনা দেখছিল। ধীরাপদর প্রথম মনে হয়েছিল কারো প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রতীক্ষাই বটে, কোন ধরনের প্রতীক্ষা সেটাই সঠিক বুঝে ওঠেনি।

বছর কুড়ি-একুশ হবে বয়েস। ক্ষীণাঙ্গী। পরনে চোখ-তাতানো ছাপা শাড়ি আর উৎকট-লাল সিল্কের ব্লাউস। বুকের দিকে চোখ পড়লেই চোখে কেমন লাগে। কিন্তু তবু চোখ পড়েই। মুখে আর ঠোঁটের রঙে আর একটু সুপটু সামঞ্জস্য ঘটাতে পারলে, অথবা ওই পদার্থটুকু পরিহার করলে মুখখানা প্রায় সুশ্রীই বলা যেত। সুশ্রী আর শুকনো।

মেয়েটিও দেখেছিল তাকে সেদিন। একবার নয়, একটু বাদে বাদে বারকতক। শেষে বুরে দাঁড়িয়েছিল মুখোমুখি। দু পা এগিয়েও এসেছিল। মাঝে রাস্তা। রাস্তা পেরোয়নি। থমকে দাঁড়িয়ে আর একবার তার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখেছিল। তারপর ফিরে গেছে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেইখানে

ধীরাপদ দেখতে জানে। সেই দেখায় ভুল বড় হয় না। কিন্তু সারাক্ষণ ভয়ানক অন্যমনস্ক ছিল সেদিন। সোনাবউদি প্রথম বোঝাপড়া শুরু করেছিল সেই দিনই। সেটা যেমন আকস্মিক তেমনি অভিনব। সেই ভাবনার ফাঁকে সেদিন অনেক দেখাই অসম্পূর্ণ ছিল। এই মেয়েটার হাবভাবও সেদিন তলিয়ে বোঝেনি। তাও বুঝত, যদি না মুখখানা অমন শুকনো দেখাত। ধীরাপদ হতভম্ব হয়ে ভেবেছিল, মেয়েটি কি কোনো বিপদে পড়ে তাকে রলতে এসেছিল কিছু? তাহলে এসেও ও-ভাবে ফিরে গেল কেন?

সঙ্গে সঙ্গে নিজের জামা-কাপড়ের দিকে চোখ গেছে তার। ভদ্রলোক মনে হওয়া

শক্ত বটে। গালেও খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তিন-চার দিন শেভ করা হয়নি। কাছাকাছি এসে এইসব লক্ষ্য করেই ফিরে গেছে হয়ত, ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি।

কিন্তু আজ? আজ তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বলে দিল ওই মেয়েটা কে। কোন প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছে। সেই সাজ-পোশাক, সেই রঙ-চঙ, সেই শুকনো মুখ। বাস আসছে, দাঁড়াচ্ছে, চলে যাচ্ছে। যাত্রীদের ওঠা-নামা দেখছে, পথচারীর আনাগোনা দেখছে। মাঝের রাস্তার এদিকে দাঁড়িয়ে ধীরাপদ হেসে উঠল নিজের মনেই। বীটার রাইস। এরই মধ্যে ভুলে গিয়েছিল ছবিটার কথা। ছবিটা দেখতে হবে। বেশ নাম

কিন্তু মেয়েটা যে চেয়েই আছে তার দিকে। কুড়ি-একুশ বছরের অপুষ্ট মেয়ে। সর্বাঙ্গে আলগা পুষ্টিসাধনের কারুকার্য। মোহ ছড়ানোর প্রয়াস। শুধু মুখখানা শুকনো। তাজা মুখ জীবনের প্রতিবিম্ব। সেখানে টান ধরলে প্রতিবিঙ্গ তাজা হবে কেমন করে? বীটার রাইস-এর নায়িকা আত্মহত্যা করেছিল, আসল রমণীটি তাজা। কিন্তু এই মেয়েটা শুধু আত্মহত্যাই করেছে, ওর মধ্যে তাজা কি আছে? ওর কি প্রত্যাশা?

প্রত্যাশা আছে নিশ্চয়। এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। নিজের দিকে তাকালো ধীরাপদ। জামা-কাপড় পরিষ্কারই বটে আজ, সকালের কাচা। গালেও এক-খোঁচা দাড়ি নেই। নিজেরই ভদ্রলোক ভদ্রলোক লাগছে।

আজও মাঝের রাস্তাটার ওধারে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু আজ আর খুঁটিয়ে দেখার জন্যে নয়। গাড়ি যাচ্ছে একের পর এক। লাল আলো না জ্বলা পর্যন্ত দাঁড়াতে হবে। তারপর আসবে। আসবেই জানে। কিন্তু তারপর কি করবে? ধীরাপদর জানতে লোভ হচ্ছে। কিন্তু আর সাহসে কুলোচ্ছে না। আত্মহত্যার পরেও যারা বেঁচে থাকে, তারা কেমন কে জানে।

হনহন করে লিওসে স্ট্রীট ধরেই হাঁটতে শুরু করে দিল সে। বেশ খানিকটা এসে ফিরে তাকালো একবার। লাল আলো জ্বলছে এখন। গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এধারে চলে এসেছে। আর ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। একনজর তাকিয়েই ধীরাপদর মনে হল—দেখছে না, নীরবে অনুযোগ করছে যেন। প্রেতের অনুযোগ অমন খচখচিয়ে বেঁধে? ধীরাপদর বিঁধছে কেন? মুখখানা বড় শুকনো আর বড় করুণ। অপটু প্রসাধনের প্রতি ধীরাপদর বিতৃষ্ণা বাড়ল। ওই মেয়ে কোন মন ভোলাবে? কিন্তু নিজের মাথাব্যথা দেখে ধীরাপদ আবারও হেসেই ফেলল।

ফুটপাথের শো-কেস ঘেঁষে চলেছে। যা চোখে লাগে দেখে, না লাগলে পাশ কাটায়। ওগুলো যে কেনার জন্য—একবারও মনে হয় না। দেখতে বেশ লাগে।

মাথাটা ঝিমঝিম করছে আবারও একটু। বড় রাস্তা ধরে হনহন করে খানিকটা হাঁটতে পারলে ঠিক হত। ওই মেয়েটাই গণ্ডগোল করে দিলে। সুন্দর বিলিতি বাজনা কানে আসছে একটা। দিশি হোক বিলিতি হোক, কানে যা ভালো লাগে তাই ভালো। বাজনা অনুসরণ করে সামনের একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। মস্ত গ্রামোফোন রেডিওর দোকান। শো-কেসএ নানা রকমের ঝকঝকে বাদ্যযন্ত্র। ভিতরটা আলোয় আলোয় একাকার। সেই আলো ফুটপাথ পর্যন্ত এসে পড়েছে, ভিতরের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধায়।

বাজনাটা মিষ্টি লাগছে ধীরাপদর। যন্ত্রণাদায়ক ক্ষতর ওপর ঠাণ্ডা প্রলেপ পড়লে যেমন লাগে। ব্যথা মরে না, আরামও লাগে। বাজনাটা তেমনি করুণ অথচ মিষ্টি। অভিজাত সঙ্গীতরসিকের ভিড় এখানে।…আসছে, যাচ্ছে। কেউ মোটর থেকে নেমে দোকানে ঢুকছে, কেউ বা দোকান থেকে বেরিয়ে মোটরে উঠছে। অবাঙালী মেয়েপুরুষের সংখ্যাই বেশি, সাহেব-মেমও আছে।

মুখ তুলে ভিতরের দিকে তাকাতেই ধীরাপদ হঠাৎ হকচকিয়ে গেল একেবারে। বিস্মিত, বিভ্রান্ত!

দোকান থেকে বেরিয়ে আসছেন একটি মহিলা। হাতে খানকতক রেকর্ড। পরনে প্লেন চাঁপারঙের সিল্কের শাড়ি, সিল্কের ব্লাউজ—গায়ের রঙঘেঁষা প্রায়। যৌবন হয়ত গত, যৌবন-শ্রী অটুট।

মহিলা বেরিয়ে আসছেন। আর স্থানকাল ভুলে বেরুবার পথ আগলে প্রায় হাঁ করে চেয়ে আছে ধীরাপদ। নির্বাক, বিমূঢ়।

দরজার কাছে এসে মহিলা ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন একবার। হ্যাংলার মত একটা লোককে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখলে বিরক্ত হবারই কথা। থতমত খেয়ে ধীরাপদ সরে দাঁড়াল একটু। মহিলা পাশ কাটিয়ে গেলেন। ধীরাপদ সেই দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তার চেতনা যেন সক্রিয় নয় তখনো।

দু পা গিয়েই কি ভেবে মহিলা ফিরে তাকালেন একবার। তারপর থেমে গেলেন। ধীরাপদ চেয়েই আছে। মহিলার দু চোখ আটকে গেল তার মুখের ওপর। দু-চার মুহূর্ত। তারপরেই বিষম এক ঝাঁকুনি খেলেন যেন। এক ঝলক রক্ত নামল মুখে। ফুটপাথ ছেড়ে তরতরিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে গেলেন।

ক্রীম কালারের চকচকে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। তকমা-পরা ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। গাড়িতে উঠতে গিয়েও আবার থামলেন মহিলা। ফিরে তাকালেন।

ধীরাপদ চেয়েই আছে। তার দিকেই ঘুরে দাঁড়ালেন মহিলা। দেখলেন। বোধ হয় ভাবলেনও একটু। হাতের রেকর্ড ক’খানা পিছনের সীটে রেখে রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন আবার। ধীরাপদর দিকেই, ধীরাপদর কাছেই। এরই মধ্যে সামলে নিয়েছেন বোঝা যায়।

ধীরাপদ…ধীরু না?

চেষ্টা করেও গলা দিয়ে একটু শব্দ বার করতে পারল না ধীরাপদ। ফ্যাসফেসে একটু হাওয়া বেরুল শুধু। ঘাড় নাড়ল।

কি আশ্চর্য! আমি তো চিনতেই পারিনি প্রথমে। তুমি এখানে। কলকাতাতেই থাকো নাকি?

ধীরাপদর বাকস্ফুরণ হল না এবারও। মাথা নাড়ল।

করে দেখছ কি, চিনতে পেরেছ তো আমাকে?

ধীরাপদ হাসতে চেষ্টা করল। ঘাড় নেড়ে জানালো চিনেছে।

বলো তো কে?

চারুদি।

যাক। হাসলেন। কতকাল পরে দেখা, এখানে কি করছ, রেকর্ড কিনবে নাকি? ও, বাজনা শুনছিলে বুঝি? আর শুনতে হবে না, ওদিকে দাঁড়িয়ে কথা কই এসো।

ওদিকে অর্থাৎ মোটরের দিকে। চারুদি আগে আগে রাস্তা পার হলেন। ধীরাপদ পিছনে। এমন যোগাযোগের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এমন যোগাযোগ ঘটবে বলেই বোধ হয় দেখার এত সমারোহ আজ। কিন্তু কালের কাশুর মধ্যে এ আবার কোন্ অধ্যায়? ধীরাপদ খুশি হবে কি হবে না তাও বুঝে উঠছে না। কিন্তু চারুদিকে ভালো লাগছে। আগের থেকে অনেক মোটা হয়েছে চারুদি, তবু ভালই লাগছে।

মোটর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে চারুদি বললেন, তারপর খবর বলো, আমাকে তো চিনতেই পারনি তুমি, ভাগ্যে আমি এসে জিজ্ঞাসা করলাম!

জিজ্ঞাসা করার আগে তাঁর চকিত বিড়ম্বনাটুকু ভোলেনি ধীরাপদ। বলল, আমি ঠিকই চিনেছিলাম, তুমি পালাচ্ছিলে।

তা কি করব! অপ্রস্তুত হয়েও সামলে নিলেন, ভাবলাম কে না কে, এতকাল বাদে তোমাকে দেখব কে ভেবেছে। তার ওপর চেহারাখানা যা করেছ চেনে কার সাধ্য। চোখ দেখে চিনেছি, আর কপালের ওই কাটা দাগ দেখে।

কপালের কাটা দাগের প্রসঙ্গে সম্ভবত ধীরাপদর মায়ের কথা মনে পড়ল চারুদির। মায়ের হাতের তপ্ত খুন্তির চিহ্ন ওটুকু। ছেলেবেলার দস্যিপনার ফল। পাথর ছুঁড়ে খুড়তুত ভাইয়ের মাথা ফাটালেও এমন কিছু মারাত্মক হয়নি সেটা। কিন্তু এই চারুদি না আগলালে ওকে বোধহয় মা মেরেই ফেলত সেদিন। খুন্তির এক ঘায়েই আধমরা করেছিল। একটু হেসে চারুদি জিজ্ঞাসা করলেন, মাসিমা কোথায়? আর শৈল? সব এখানে?

তাঁর মুখের ওপর চোখ রেখে ধীরাপদ আঙুল দিয়ে আকাশটা দেখিয়ে দিল। আ-হা, কেউ নেই। চারুদি অপ্রস্তুত। একটু বিষণ্ণও।—কি করে আর জানব বলো, কারো সঙ্গেই তো—

থেমে প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন, তুমি আছ কোথায়? কি করছ আজকাল? সাহিত্য করা ছেড়েছ না এখনো আছে? নাম-টাম তো দেখিনে…

একসঙ্গে একাধিক প্রশ্নের সুবিধে এই যে একটারও জবাব না দিলে চলে। গুগুলো প্রশ্ন ঠিক নয়, এক ধরনের আবেগ বলা যেতে পারে। দ্বিধা কাটিয়ে সামনে এসে দাঁড়ানোর পর থেকেই চারুদির এই আবেগটুকু লক্ষ্য করছে ধীরাপদ। একটু হেসে জবাব এড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি যাবে কদ্দূর?

অনেক দূর। সাগ্রহে আরো একটু কাছে সরে এলেন চারুদি। — তুমি যাবে আমার সঙ্গে? চলো না, গাড়িতে গেলে কত আর দূর। চলো, আজ তোমাকে সহজে ছাড়ছি না, ড্রাইভার তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে’খন— তাড়া নেই তো কিছু?

তাড়া নেই জানাতে একেবারে হাত ধরে গাড়িতে তুললেন তাকে। নিজেও তার পাশে বসে ড্রাইভারকে হিন্দীতে বাড়ি ফেরার নির্দেশ দিলেন। এমন দামী গাড়ি দূরে থাক, মোটরেই শীগগির চড়েছে বলে মনে পড়ে না ধীরাপদর। নরম কুশনের আরামটা প্রায় অস্বস্তিকর। নরম আদরের মত। ধীরাপদ অভ্যস্ত নয়। সেই সঙ্গে মিষ্টি গন্ধ একটু। পার্শ্ববর্তিনীর সুচারু প্রসাধন-রুচি আছে বলতে হবে। আরো বুক-ভরে নিঃশ্বাস টানতে ইচ্ছে করছিল ধারাপদর, কিন্তু কোন সংকোচে লোভ দমন করল সে-ই জানে।

গাড়িতে উঠেই চারুদি হঠাৎ চুপ করেছেন একটু। বোধ হয় এই অপ্রত্যাশিত যোগাযোগের কথাই ভাবছেন। হয়ত আর কিছু ভাবছেন। ভিড় কাটিয়ে গাড়ি চৌরঙ্গীতে পড়তে সময় লাগছে। মোড়ের মাথায় আবার লাল আলো। ধীরাপদ তাড়াতাড়ি ঝুঁকে সেই বাস-স্টপের দিকে তাকালো। ওই মেয়েটা নিশ্চয় দাঁড়িয়ে আছে এখনো। কালই দেখতে হবে ছবিটা—বীটার রাইস— কোথায় হচ্ছে কে জানে। মনে মনে এখনো নামটার জুতসই একটা বাংলা হাতড়ে বেড়াচ্ছে ধীরাপদ।

….নেই। ধীরাপদ অবাকই হল একটু। সঙ্গী পেল? ওই ক্ষীণ তনু আর উগ্র প্রসাধন সত্ত্বেও। শুকনো মুখখানা অবশ্য টানে। কিন্তু সে তো অন্য জাতের টান, সঙ্গী জোটানোর নয়। ওই মেয়েটা সঙ্গী পেয়েছে…ও নিজেও কি সঙ্গিনী পেল? চারুদির মত সঙ্গিনী। এও তো অবাক হবার মতই—

সবুজ আলো দিয়েছে। গাড়ি ডাইনে ঘুরল।

কি দেখছিলে অমন করে?

পিছনের গদিতে শরীর এলিয়ে দিল ধীরাপদ। পিঠে সেই রকমই ঈষদুষ্ণ অস্বস্তিকর নরম স্পর্শ। কিছু না-

কাউকে খুঁজছিলে মনে হয়?

না, এমনি দেখছিলাম—

চারুদি টিপ্পনী কাটলেন, আগের মত সেই ড্যাবড্যাব করে দেখে বেড়ানোর অভ্যসটা এখনো আছে বুঝি।

চারুদি যদি জানতেন, এত কাছ থেকেও একেবারে ঘুরে বসে তাঁকেই নির্নিমেষে খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছেটা ধীরাপদ কি ভাবে ঠেকিয়ে রেখেছে, তাহলে বোধ হয় এই ঠাট্টা করতেন না। তার অভ্যেসের খবর জানলে চারুদি হয়ত গাড়িতে টেনে তুলতেন না তাকে। গ্রামোফোন দোকানের সামনে তাকে চিনে ফেলার পর দ্বিধা আর সঙ্কোচ কাটিয়ে কাছে না এসে শেষ পর্যন্ত না চিনেই গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যেতেন। চারুদি আর একটু হাসলেন, আর একটু ঘুরে বসলেন, ওই মিষ্টি গন্ধটা আর একটু বেশি ছড়ালে ধীরাপদ দেখার প্রলোভন আর বেশিক্ষণ আগলে রাখতে পারবে না।…চারুদিকে আজও ভালো লেগেছে তার। চারুদি অনেক বদলেছে, তবু। অনেকটা মোটা হয়েছে, তবু। এত ভালো লেগেছে, কারণ চারুদিও এখন বিশ্লেষণ করে দেখার মতই। কিন্তু অন্যের তা বরদাস্ত হওয়া সহজ নয়। তাই ভয়ে ভয়ে সরেই বসল আর একটু, তারপর জবাব দিল, অভ্যেসটা আরো বেড়েছে।

তাই নাকি! ভালো কথা নয়। চারুদি ঘুরে বসলেন। যতটা ঘুরে বসলে ধীরাপদর মুশকিল, ততটাই।—বিয়ে করেছ?

সঙ্গে সঙ্গে কি মনে পড়তে ছোট মেয়ের মতই হেসে উঠলেন। মনে পড়েছে ধীরাপদরও। অল্প হেসে মাথা নাড়ল।

ওমা, এখনো বিয়ে করোনি। বয়েস কত হল? দাঁড়াও, আমার এই চুয়াল্লিশ, আমার থেকে ন’ বছরের ছোট তুমি–তোমার পঁয়ত্রিশ। এখনো বিয়ে করোনি, আর করবে কবে? আবারও বেশ জোরেই হেসে উঠলেন চারুদি। বললেন, ছেলেবেলার কথা সব মনে আছে এখনো?

মৃদু হেসে ধীরাপদ পিছনের দিকে মাথা এলিয়ে দিল এবার। উত্তর কলকাতার পথ ধরে চলেছে গাড়ি। ধীরাপদর ঘুম পাচ্ছে। মাথা টলছে না আর, গা-ও ঘুলোচ্ছে না—রাজ্যের অবসাদ শুধু। শরীরটা শুধু ঘুম চাইছে। চারুদি কখনো থামছেন একটু, কখনো অনর্গল কথা বলছেন। কখনো এটা-সেটা জিজ্ঞাসা করছেন। ধীরাপদ কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না। কখনো হাসছে, কখনো বা হাঁ-না করে সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু ভাবছে অন্য কথা।.. চারুদির চুয়াল্লিশ হয়ে গেল এরই মধ্যে! চৌত্রিশ বললেও বে-মানান লাগত না। ওর ছেলেবেলার কথা মনে হতে চারুদি হেসে উঠেছেন। হাসিরই ব্যাপার।

ধীরাপদ ভোলেনি। তার সেই ছেলেমানুষি, সঞ্চয়ের ওপর অনেকবার অনেক দস্যুবৃত্তি হয়ে গেছে। তবু না। কালে-জলে কতই তো ধুয়ে-মুছে গেল কিন্তু এক-একটা স্মৃতির পরমায়ু বড় অদ্ভূত। চোখ বুজলেই সব যেন ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে। কত হল তার? পঁয়ত্রিশ। অথচ আর একটা বয়েস যেন সেই কবেকার পদ্মাপারের ওধারেই আটকে আছে। এক-এক সময় এমনও মনে হয়, বয়েস কি মানুষের সত্যিই বাড়ে? চারুদির বেড়েছে?

পদ্মাপারের মেয়ে চারুদি।

মোটা ছিলেন না এমন। বেতের মত দোহারা গড়ন। জ্বলজ্বলে ফর্সা, একমাথা লালচে চুল। সেই চারুদিকে এক-এক সময় আগুনের ফুলকির মত মনে হত ন বছরের ধীরাপদর। পাশাপাশি লাগালাগি বাড়িতে থাকত। ফাঁক পেলেই পালিয়ে এসে চারুদির গা-ঘেঁষে বসে থাকত। ইচ্ছে করত ওই লাল চুলের মধ্যে নিজের দু হাত চালিয়ে দিতে। ওকে হাঁ করে চেয়ে থাকতে দেখলেই চারুদি খুব হাসতেন।.

কি দেখিস তুই?

তোমাকে।

আমাকে ভালো লাগে তোর?

খুব।

এর দু বছর আগেই সে ঘোষণা করে বসে আছে বিয়ে যখন করতেই হবে একটা, চারুদিকেই বিয়ে করবে। এটা সাব্যস্ত করার পর থেকেই চারুদির ওপর যেন অধিকারও বেড়ে গিয়েছিল তার। ওর বিয়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে চারুদি হেসে ফেলেছিলেন এইজন্যেই।

শুধু এই নয়, আরো আছে। চারুদির বিয়ের রাতে মস্ত একটা লাঠি হাতে বিয়ের সিঁড়ির বরকে সরোষে তাড়া করেছিল ধারাপদ। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা বরদাস্ত করতে পারেনি সেদিন। ধরে না ফেললে একটা কাণ্ডই হত বোধ হয়।

বিয়ের পর চারুদি শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। এই কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু ধীরাপদর কাছে কলকাতা তখন রূপকথার দেশ। মা আর তার নিজের দিদির মুখে সে চারুদির স্বামী জীবটির অনেক প্রশংসা শুনত। শুনে মনে মনে জ্বলত। মস্ত বড়লোক শ্বশুর, মস্ত বাড়ি-গাড়ি-চারুদির বরও বিলেতফেরত ডাক্তার। অমন রূপের জোরেই নাকি অমন ঘর পেয়েছেন চারুদি। ঘর বাড়ি গাড়ির কথা জানে না, চারুদির বর লোকটাকে দৈত্য গোছের মনে হত ধীরাপদর। যেমন কালো তেমনি থপথপে। রূপকথার দেশ কলকাতা থেকে সেই দৈত্য-বরকে বধ করে চারুদিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার বাসনা জাগত। নেহাত ছোট, আর তলোয়ার নেই বলেই কিছু করতে পারত না।

বছরে একবার দুবার আসতেন চারুদি। খবর পেলে তিন রাত আগের থেকেই ঘুম হত না ধীরাপদর। পেয়ারা কামরাঙা পেড়ে পেড়ে টাল করে রাখত। চারুদিকে দেবে। কিন্তু সেই চারুদি আর নেই। একবার কাছে ডাকতেন কি ডাকতেন না। অথচ সারাক্ষণ কাছে কাছেই ঘুরঘুর করত সে। কাছে গেলে আদর অবশ্য করতেন। কিন্তু ধীরাপদর অভিমানও কম ছিল না। না ডাকলে বেশি কাছে ঘেঁষত না। লোভ হলেও না। লোভ তো হবেই। রূপকথার দেশের চারুদিকে আগের থেকে আরো ঢের সুন্দর লাগত। আগুনপানা রঙ হয়েছে প্রায়। আগুনপানা রঙ আর আগুনপানা চুল।

কিন্তু দুটো বছর না যেতে একদিন ধীরাপদ অবাক। এ বাড়িতে মা গম্ভীর, দিদি গম্ভীর। ও-বাড়িতে চারুদির মায়ের কান্নাকাটি। ক্রমে ব্যাপারটা শুনল ধীরাপদ। চারুদির স্বামী লোকটা মারা গেছে। ধীরাপদ ভাবল, বেশ হয়েছে। চারুদি এলে আর তাকে কেউ নিয়ে যাবে না।

এবার চারুদির আসার আনন্দটা শুধু যেন একা তারই। চারুদি আসছে অথচ কারো একটু আনন্দ নেই, মুখে এতটুকু হাসি নেই।

চারুদি এলেন। কিন্তু ধারে-কাছে ঘেঁষার সুযোগ পেল না সে। আসার সঙ্গে সঙ্গে কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেল আবার। ধীরাপদর মনে হত, খামকা কি কান্নাই কাঁদতে পারে চারুদির মা! শুধু কি তাই? কান্নাটা যেন একটা মজার জিনিস। এ বাড়ি থেকে মা আর দিদি পর্যন্ত গিয়ে গিয়ে কেঁদে আসছে। কান্না কান্না খেলা যেন।

দু-তিন দিনের মধ্যে চারুদিকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পেল না ধীরাপদ। যখনই যায় চারুদির ঘর বন্ধ। অভিমানও কম হল না। স্বামী মরেছে, কিন্তু ও তো আর মরেনি! এ কেমন ধারা ব্যবহার! ধীরাপদও দূরে দূরে থাকতে চেষ্টা করল ক’টা দিন, কিন্তু কেমন করে যেন বুঝল, হাজার অভিমান হলেও চারুদি এবারে নিজে থেকে ডাকবে না ওকে। তাই ঘর খোলা দেখে পায়ে পায়ে ঢুকেই পড়ল সেদিন।

একটু আগে দিদি ঢুকেছে। শৈলদি। তাই চারুদিকে দেখতে পাওয়ার আশা নিয়েই এসেছিল ধীরাপদ। কিন্তু এমনটি দেখবে একবারও ভাবেনি। দেখে দু-চোখে পাতা পড়ে না। মেঝেতে মুখ গোঁজ করে বসে আছেন চারুদি। পাশে দিদি বসে। দিদির চোখে জল টলমল। দুজনেই চুপচাপ। ধীরাপদ ঘরে ঢুকেছে টের পেয়েও একবার মুখ তুললেন না চারুদি। নাই তুলুক। তবু চোখ ফেরাতে পারছে না ধীরাপদ। চারুদির পরণে কোরা থান। লালচে রঙের সঙ্গে যেন মিশে গেছে। আর তার ওপর একপিঠ তেল-না-পড়া লালচে চুল। এই বেশে এমন সুন্দর দেখায় কাউকে ভাবতে পারে না। পায়ে পায়ে দিদির কাছে এসে দাঁড়াল। যেমনই হোক, একটা শোকের ব্যাপার ঘটেছে অনুভব করেই একটু সান্ত্বনা দেবার ইচ্ছে হল তারও। বলল, তোমাকে এখন খু-উ-ব সুন্দর দেখাচ্ছে চারুদি।

সঙ্গে সঙ্গে দিদির হাতের ঠাস করে একটা চড় গালে পড়তে হতভম্ব। অপমানে চোখে জল এসে গেল, ছুটে পালাল সেখান থেকে।

ভেবেছিল স্বামী মরেছে যখন, চারুদিকে আর কেউ নিতে আসবে না। স্বামী ছাড়াও যে নিতে আসার লোক আছে জানত না। চারুদি আবারও চলে গেলেন। এর পরে তাঁর বছরের নিয়মিত আসায় ছেদ পড়তে লাগল। শেষে দু-তিন বছরেও একবার আসেন কি আসেন না। বৃদ্ধিতে আর একটু পাক ধরেছে ধীরাপদর। শুনেছে, চারুদির আসায় শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো বাধা নেই। যখন খুশি আসতে পারেন। কিন্তু নিজেই ইচ্ছে করে আসেন না চারুদি।

এ ধরনের ইচ্ছা-বৈচিত্র্য দুর্বোধ্য।

ম্যাট্রিক পাস করে ধীরাপদ কলকাতায় পড়তে এলো। বোর্ডিংএ থেকে পড়া। অবিশ্বাস্য স্বাধীনতা।

কিন্তু কলকাতাকে আর রূপকথার দেশ মনে হয়নি তখন। শুধু চারুদি আছেন কলকাতায়, এইটুকুই রূপকথার রোমাঞ্চের মত। ধীরাপদ প্রায়ই আসত চারুদির সঙ্গে দেখা করতে। চারুদি খুশি হতেন। আগের মতই হাসতেন। তাঁর থান পোশাক গেছে। মিহি সাদা জমির পাড়ওলা শাড়ি পরতেন। বেশ চওড়া নক্সা-পেড়ে শাড়ি। হাতে বেশি না হলেও গয়না থাকতই। গলায় সরু হার আর কানে দুলও। ধীরাপদর তখন মনে হত, ঠিক ওইটুকুতেই সব থেকে বেশি মানায় চারুদিকে।

চারুদি গল্প করতেন আর জোরজার করে খাওয়াতেন। আগের সম্পর্ক নিয়ে একটু-আধটু ঠাট্টাও করতেন। তার কাঁচা বয়সের লেখার বাতিকটা একদিন কেমন করে যেন টের পেয়ে গেলেন তিনি। টের পাওয়ানোর চেষ্টা অবশ্য অনেকদিন ধরেই চলছিল। এখানে আসার সময় সদ্য সদ্য সব লেখাই ধীরাপদর পকেটের সঙ্গে চলে আসত। চারুদির উৎসাহে আর আগ্রহে সে ছোটখাটো একটি লেখক হয়ে বসেছে বলেই বিশ্বাস করত।

মাঝে মাঝে এই বাড়িতে আর একজন অপরিচিতের সাক্ষাৎ পেত ধীরাপদ। সুশ্রী, সুউন্নত পুরুষ। ধীর গম্ভীর, অথচ মুখখানা সব সময়ে হাসি-হাসি। ফর্সা নয়, সুন্দর নয় কিন্তু পুরুষের রূপ যেন তাকেই বলে। মার্জিত, অনমিত। গলার স্বরটি পর্যন্ত নিটোল ভরাট—চল্লিশের কিছু কমই হবে বয়েস। কিন্তু এর মধ্যেই কানের দু পাশের চুলে একটু একটু পাক ধরেছে—এই বয়সে ওটুকুও ব্যক্তিত্ব কম নয়।

শুধু চারুদিকেই গল্প করতে দেখত তাঁর সঙ্গে, আর কাউকে নয়। মোটরে এক-আধদিন বেড়াতেও দেখেছে তাঁদের। একদিন তো চারুদি ওকে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন-যেন দেখেননি। তারপর আর এক সপ্তাহ যায়নি ধীরাপদ। চারুদি চিঠি লিখতে তবে গেছে। চারুদি না বললেও ধীরাপদ জেনেছিল, তাঁর স্বামীর সব থেকে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন ভদ্রলোক!

কিন্তু এ নিয়ে মনে কোনরকম প্রশ্ন জাগেনি ধীরাপদর। সতের-আঠারো বছর বয়স মাত্র তখন। ছেলেদের মুক্ত বয়েস ওটা। আর ওই নিয়ে ছেলেবেলার মত ঈর্ষাও হত না। সেই হাস্যকর ছেলেবেলা আর নেই। তাছাড়া সেদিক থেকে ভদ্রলোকের তুলনায় নিজেকে এমন নাবালক মনে হত যে তাঁকে নিয়ে মাথাই ঘামাত না বড় একটা। শুধু চারুদির একটু আদর-যত্ন পেলেই খুশি। সেইটুকুর অভাব হত না।

এক বছর না যেতে সেই নতুন বয়সের গোড়াতেই আবার একটা ধাক্কা খেল ধীরাপদ। দিন দশ-বারো জ্বরে পড়ে ছিল, কিন্তু চারুদি লোক পাঠিয়ে বা চিঠি লিখে

একটা খবরও নেননি। অসুখ ভালো হবার পরেও অভিমান করে কাটালো আরো দিনকতক। ধীরাপদ বলে কেউ আছে তাই যেন ভুলে গেছেন চারুদি। শেষে একদিন গিয়ে উপস্থিত হল চারুদির শ্বশুরবাড়িতে।

শুনল চারুদি নেই।

কোথায় গেছেন, কি বৃত্তান্ত কিছুই বুঝল না। বাড়ির লোকের রকমসকম দেখে অবাক হল একটু। কেউ কখনো দুর্ব্যবহার করেননি তার সঙ্গে। এও দুর্ব্যবহার ঠিক নয়, তবু কেমন যেন।

এরপর আরো দু-তিন দিন গেছে। সেই এক জবাব। চারুদি নেই। কোথায় গেছেন কবে ফিরবেন কেউ কিছু জানে না।

ধীরাপদ হতভম্ব।

ছুটিতে বাড়ি এসে চারুদির কথা তুলতেই মা বলেন, চুপ চুপ। দিদি বলেন, চুপ চুপ!

এই চুপ চুপের অর্থ অবশ্য বুঝেছিল ধারাপদ। চুপ করেই ছিল। কিন্তু ভিতরটা তার চুপ করে ছিল না। কলকাতায় এসেও অনর্থক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। অন্যমনস্কের মত চোখ তার কি যেন খুঁজেছে। আর মনে হয়েছে, এই রূপকথার দেশে কি যেন তার হারিয়ে গেছে।

ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?

চারুদির কথায় চমক ভাঙল ধারাপদর। ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসল। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে একটা একতলা বাড়ির সামনে—ছোট লন-এর ভিতরে। রাতে ঠিক ঠাওর না হলেও বাড়িটা সুন্দরই লাগল। কিন্তু সে কি সত্যই ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি? কোথায় এলো? কি বলছিলেন চারুদি এতক্ষণ?

এই, বাড়ি?

এই বাড়ি। নামো।

চারুদি আগে নামলেন। পিছনে ধীরাপদ। বাবুকে বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্যে ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে তাকে নিয়ে চারুদি ভিতরে ঢুকলেন। সামনের ঘরে আলো জ্বলছিল। দোরগোড়ায় একজন বুড়ী-মত মেয়েছেলে বসে। কর্ত্রীর সাড়া পেয়ে উঠে গেল।

বোসো, এক্ষুনি আসছি।

রেকর্ড হাতে চারুদিও অন্দরে ঢুকলেন। এই অবকাশে ধীরাপদ ঘরের ভিতরটা দেখে নিল। ঝকঝকে তকতকে সাজানো গোছানো ঘর। মেঝেতে পুরু কার্পেট। নরম গদির সোফা-সেটি। বসলে শরীর ডুবে যায়। বসে যেন অস্বস্তি বাড়ল ধীরাপদর। ঘরের দু-কোণায় দুটো কাচের আলমারি। নানা রকম শৌখিন সংগ্রহ তাতে। উল্টোদিকের দেয়ালের বড় আলমারিটা বই এ ঠাসা। এই রকম ঘরে আর এই রকম জোরালো আলোয় নিজের মোটামুটি ফর্সা জামাকাপড়ও বেখাপ্পা রকমের স্থুল আর মলিন ঠেকছে ধীরাপদর চোখে।

দিনের বেলা এসো একদিন, ভালো করে বাড়ি দেখাব তোমাকে। বাগানও করেছি।

ভালো ডালিয়ার চারা পেয়েছি, মস্ত ডালিয়া হবে দেখো।

চারুদি ফিরে এসেছেন। ওকে ঘরখানা খুঁটিয়ে দেখতে দেখেই হয়ত খুশি হয়ে বলেছেন। বড় একটা সোফায় শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি। কাব্য করে বললে বলতে হয়, অলস শৈথিল্যে তনুভার সমর্পণ করলেন। ধীরাপদ দেখছে, এরই মধ্যে শাড়ি বদলে এসেছেন চারুদি। মিহি সাদা জমির ওপর টকটকে লাল ভেলভেট-পাড় শাড়ি। আটপৌরে ভাবে পরা। মুখে-চোখে জল দিয়ে এসেছেন বোঝা যায়। মুছে আসা সত্ত্বেও ভিজে ভিজে লাগছে। কপালের কাছের চুলে দুই-এক ফোঁটা জল আটকে আছে মুক্তোর মত। ঘরের সাদা আলোয় ধীরাপদ লক্ষ্য করল, চুল আগের মত শুকনো লাল না হলেও লালচেই বটে। এই ঘরে ঠিক যেমনটি মানায় তেমনই লাগছে চারুদিকে। ভারী স্বাভাবিক।

কিন্তু কোনো কিছুরই কাছে আসতে পারছে না ধীরাপদ। বাড়ি না গাড়ি না বাগান না ডালিয়া না- এমন কি চারুদিও না। এমন হল কেন? মাথাটা কি টলছে আবার গা ঘুলোচ্ছে? কিন্তু তাও তো এখন টের পাচ্ছে না তেমন!

তার দৃষ্টি অনুসরণ করেই বোধ হয় চারুদি বললেন, মুখ হাত ধুয়ে এলাম — ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল না দিয়ে পারিনে, মাথা গরম হয়ে যায়।

শুনে একটু খুশি হল কেন ধারাপদ?…এই একটি কথায় মাটির সঙ্গে যোগ পেল বোধ হয়। শ্যামবর্ণা বেশ স্বাস্থ্যবর্তী একটি মেয়ে ঘরে এসে দাঁড়াল। পরিচারিকা বা রাঁধুনী হবে। হুকুমের প্রতীক্ষায় কর্ত্রীর দিকে তাকালো।

তোমাকে চা দেবে তো?

ধীরাপদ মাথা নেড়েছে। কিন্তু হাঁ বলেছে, না না বলেছে? বোধ হয় না-ই বলেছে। মাথা নাড়ার সময় খেয়াল ছিল না, মেয়েটিকে দেখছিল। পরিচারিকা হোক বা রাঁধুনী হোক, আসলে বোধ হয় প্রহরিণী হিসেবেই এই পুরুষ-শূন্য গৃহে বহাল আছে সে। একেবারে বাঙালী গৃহস্থঘরের মেয়ের মত আটপৌরে শাড়ি না পরলে পাহাড়িনী ভাবত। অনুমান মিথ্যে নয়, ইঙ্গিতে তাকে বিদায় দিয়ে চারুনি হেসে বললেন, কেমন দেখলে আমার বডিগার্ড?

ভালো। কিন্তু ওর গার্ড দরকার নেই?

চারুদি হাসলেন খুব। অত হাসবেন জানলে বলত না।

ধীরাপদর মনে হল অত হাসলে চারুদিকে ভালো দেখায় না।

চারুদি বললেন, কি মনে হয়, দরকার আছে? ধারে-কাছে ঘেঁষবে কেউ? আগে শহরের মধ্যে থাকতুম যখন, দুই- একজন ঘুরঘুর করত বটে— তাদের একজনের সঙ্গে ডাব-কাটা দা নিয়ে দেখা করতে এগিয়েছিল পার্বতী। তারপর থেকে আর কেউ আসেনি।

খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে পার্বতী-সমাচার শুনতে হল ধীরাপদকে। পাহাড়ী পার্বতীই বটে। বছর দশেক বয়সে চারুদি শিলং পাহাড় থেকে কড়িয়েছিলেন ওকে। সেই থেকে গত পনেরো বছর ধরে চারুদির কাছেই আছে। এখন এক বাংলা ছাড়া আর কিছু বড় বোঝেও না, বলতেও পারে না।

তারপর তোমার খবর বলো শুনি! পার্বতী-সংবাদ শেষ করে প্রসঙ্গান্তরে ঘুরলেন চারুদি। কিছুই তো বললে না এখনো। যাচ্ছেতাই চেহারা হয়েছে, থাকার মধ্যে শুধু চোখ দুটো আছে, সেও আগের মত অত মিষ্টি নয়, বরং ধার ধার–কে দেখে-শোনে?

চারুদি হাসলেন। ধীরাপদও। দেখা-শোনার কথায় সোনাবউদির মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠল। ফলে আরো বেশি হাসি পেল ধীরাপদর। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতে হলেই যত বিড়ম্বনা।…বেশ তো নিজের কথা বলছিল চারুদি। এবারের বিড়ম্বনাও কাটিয়ে দিল পার্বতী ঘরে ঢুকে। জানালো, টেলিফোন এসেছে। মা যাবেন, না ফোন এখানে আনা হবে?

মা-ই গেলেন। ফিরেও এলেন একটু বাদেই। ধীরাপদ ঠিকই আশা করেছিল। কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন চারুদি ভুলে গেছেন। চারুদি শুনতে চান না, কিছু বলতে চান। বলে বলে আগের মতই হালকা হতে চান আর সহজ হতে চান। ধীরাপদর সেই রকমই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, মনের সাধে কথা বলার মত লোক চারুদি এই সতেরো-আঠারো বছরের মধ্যে পাননি। শেষ দেখা কতকাল আগে? সতেরো- আঠারো বছরই হবে।

ফিরে এসেই চারুদি গল্প জুড়ে দিয়েছেন আবার। অসংলগ্ন, একতরফা। … শহরের হাটের মধ্যে হাঁপ ধরত সর্বদা, তাই এই নিরিবিলিতে বাড়ি করেছেন। মনের মত বাড়ি করাও কি সোজা হাঙ্গামা, বিষম ধকল গেছে তাতেও। টাকা ফেললে লোকজন পাওয়া যায়, কিন্তু বিশ্বাস কাউকে করা যায় না। যতটা পেরেছেন নিজে দেখেছেন, বাকিটা পার্বতী। কেনা-কাটার জন্যে সপ্তাহে দু-তিন দিন মাত্র শহরে যান—তার বেশি নয়।

শুনতে শুনতে ধীরাপদর আবারও ঝিমুনি আসছে কেমন। গা এলাতে সাহস হয় না আর।

অমুক রেকর্ড পছন্দ, অমুক অমুক লেখকের লেখা। ধীরাপদ লেখে না কেন, বেশ তো মিষ্টি হাত ছিল লেখায়–লিখলে একদিন নাম-ডাক হত নিশ্চয়। অমুক ফুলের চারা খুঁজছেন, নিউ মার্কেট তন্ন তন্ন করে চষেছেন–নামই শোনে নি কেউ। তবে কে একজন আনিয়ে দেবে বলেছে।…মালীটা ভালো পেয়েছেন, বাগানের যত্ন-আত্তি করে। ড্রাইভারটাও ভালো তবে ওদের সঙ্গে হিন্দীতে কথা কইতে হয় বলেই যত মুশকিল চারুদির। হিন্দীর প্রথম ভাগ একখানা কিনেছেনও সেইজন্য, কিন্তু ওলটানো আর হয়ে ওঠে না। এখন বিশ্বস্ত একজন বন্দুকঅলা গেট-পাহারাদার পেলেই নিশ্চিন্ত হতে পারেন চারুদি।

শ্রোতার মুখের দিকে চেয়ে একটু সচেতন হলেন যেন।—ওমা, আমি তো সেই থেকে একাই বকে মরছি দেখি, তুমি তো এ পর্যন্ত সবসুদ্ধ দশটা কথাও বলোনি। কথা বলাও ছেড়েছো নাকি? শুধু দেখেই বেড়াও?

কি যে হল ধীরাপদর সে-ও জানে না। ঝিমুনি ভাবটা কেটে গেল একেবারে। নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। চোখে চোখ রেখে হাসল একটু। যেন মজার কিছু বলতে যাচ্ছে। বলল, না, কথাও বলি। তবে বড় গদ্যকথা। আমাকে কিছু খেতে দিতে পারো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *