কালো বাঘ – মনোরঞ্জন দে
দৈবের নির্বন্ধ আর কাকে বলে! একটা কালো বাঘই কিনা শেষে আমার সকল দুঃখ-কষ্ট ঘুচিয়ে দিল!
ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক। আমার বাবা ছিলেন খুব আয়েশী লোক। সৌখিনতার স্রোতে গা ভাসিয়ে তিনি তো জীবন কাটিয়ে গেলেন ; কিন্তু একবারও ভেবে দেখলেন না, তাঁর একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ কি। আমার জ্যাঠার বিপুল বৈভবের ওপর তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। অপুত্রক জ্যাঠার সম্পত্তি তাঁর একমাত্র ছেলে আমিই যে পাব, সে-ব্যাপারে আমার বাবার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও জাগে নি। সম্পত্তি যদি নাও পাই, অন্তত চাকরি আমাকে নিশ্চয়ই করতে হবে না। জ্যাঠার বিরাট জমিদারীর এক কোণে আমার জীবিকানির্বাহের ব্যবস্থা হয়েই যাবে।
বাবার ধারণা যে কত ভুল, তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই সেটা দেখে যেতে পারতেন। আমার জ্যাঠা শ্রদ্ধেয় প্রতাপবিক্রম চৌধুরী আমাকে অর্থাৎ তাঁর আদরের ভাইপোকে সম্পত্তির কানাকড়িও দিলেন না। না-মরবার সঙ্কল্প নিয়ে বছরের পর বছর, যকের ধনের মত নিজের সম্পত্তি আগলে রইলেন। মাঝে মাঝে দু-চারটে সৌখিন উপহার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিত যে, তাঁর বিরাট জমিদারীর প্রথম এবং প্রধান উত্তরাধিকারী আমিই। কিন্তু স্বপ্ন দেখে তো লোকের পেট ভরে না—আমারও ভরল না। বৃদ্ধের মৃত্যুর আশায় বসে থেকে থেকে আমার এমন দশা হয়ে দাঁড়াল। যে, দেনার দায়ে মাথার চুল সুদ্ধু বিকিয়ে যেতে বাকী। কলকাতায় আমার নামে একটি বাড়ি রেখে গিয়ে বাবা বুদ্ধিমানের কাজই করেছিলেন। নাহলে আমাকে হয়তো না খেয়েই মরতে হত। তখনও আমি প্রাণে মরি নি বটে, তবে মরমে মরে ছিলাম। পাওনাদারদের তাগাদায় অতিষ্ঠ হয়ে একদিন দেখতে পেলাম, আমার চুড়ান্ত সর্বনাশের আর সামান্যই বাকী আছে। অথচ করবারও কিছু নেই। বৃদ্ধ জ্যাঠার কাছে চিঠি লিখে কোনও উত্তর পাই না, দেখা করে শুধু উপদেশামৃতই লাভ করি। বংশমর্যাদার কথা চিন্তা করে ছোটখাটো কোন চাকরিও করতে পারি নি। ভাল চাকরিও পাবার জো নেই—যোগ্যতা অর্জন করি নি। ভেবে ভেবে যখন কোনই কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না, তখন দূরসম্পর্কীয় এক ভাইয়ের চিঠিতে কিছুটা আশার সঞ্চার হল। ভাইয়ের নাম অমিতবিক্রম চৌধুরী। অর্থকৌলীন্যে ইনিও কম যান না। অবশ্য সবই তাঁর স্বোপার্জিত অর্থ। ভাবলাম, অমিতবিক্ৰম নিজে থেকেই যখন আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তখন চেয়ে-চিন্তে কিছু অর্থ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। বলবার সময় লজ্জায় মাথা কাটা যাবে ঠিকই, কিন্তু এছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই। অগত্যা যাবার জন্য তৈরি হলাম।
ট্রেন আমাকে যেখানে নামিয়ে দিল, সেটা একটা অজ পাড়া-গাঁ। পৃথিবীর চারদিকে যে এত পরিবর্তন হয়ে গেছে, এ-তল্লাট দেখলে সেটা উপলব্ধি করা যায় না। অমিতবিক্ৰম কেন যে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে বাস করতে এলেন, সেটা এক দুরূহ রহস্য। শুনেছিলাম, তাঁর নিজস্ব মোটর গাড়ি আছে। সেই মোটর গাড়ি যে আমাকে নেবার জন্য আসবেই, এমনটি চিন্তা করা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু ঘণ্টা দুই অপেক্ষা করেও আমার ধারণা যখন ভুল বলে প্রমাণিত হল, তখন একটি ছইতোলা যাত্রীবাহী গরুর গাড়িতেই চেপে বসলাম। পরে জেনেছিলাম, আমার টেলিগ্রাম নাকি যথাসময়ে পাওয়া যায় নি।
গাড়োয়ানটিকে পেয়েছিলাম ভালই। তার সাদামাটা কথাবার্তায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। তার কাছেই শুনলাম, অমিতবিক্ৰম চৌধুরী নাকি এ-তল্লাটে ডাকসাইটে ব্যক্তি। তাঁর মত মহাপ্রাণ উদারচেতা মানুষ আর দুটি হয় না। কত যে জনহিতকর কাজ তিনি করেছেন, তা লিখলে বুঝি মহাভারত হয়ে যায়। দুর্মুখেরা নাকি বলে তাঁর উচ্চাশা ইলেকশানে জিতে মন্ত্রী হওয়া। কিন্তু গাড়োয়ানের মতে তাঁর মত ঋষিতুল্য ব্যক্তি এসব কথা স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারেন না।
গাড়োয়ানের কাছে অমিতবিক্ৰমের স্তুতিবাদ শুনতে শুনতে কান যখন ঝালাপালা হবার যোগাড়, তখন পথের ধারে টেলিগ্রাফের পোস্টে একটি অদ্ভুত পাখিকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলাম। এমন অপরূপ পাখি আর কখনও দেখি নি। নাম কি তাও জানি না। আমার তন্ময়তার কারণ বুঝতে পেরে গাড়োয়ান উল্লসিত হয়ে উঠল। নিজের বক্তব্য আরও জোরদার করে তুলবার সুযোগ পেল সে। তার কথায় জানতে পারলাম, যার অতিথি হয়ে এই বিজন প্রদেশে ছুটে এসেছি, এই সুন্দর পাখিটি তারই। দেশ-বিদেশ থেকে কত জন্তুজানোয়ার যে তিনি সংগ্রহ করে এনেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ভদ্রলোকের একটাই সখ আছে, আর সেটা হচ্ছে, রকমারি দেশের হরেক রকম আবহাওয়ার পশুপাখিকে বাংলা দেশের জলো-হাওয়ায় থাকতে অভ্যস্ত করানো।
বস্তুত তার প্রমাণও পেলাম হাতে নাতে। বিরাট পাঁচিল ঘেরা উদ্যানের পিচ-ঢালা চওড়া রাস্তা দিয়ে যাবার সময় অজানা সব পশুপাখির দর্শন পেলাম। নধর কচি ঘাসে যথেচ্ছ বিচরণ করছিল সেই জন্তুগুলি। সব দেখেশুনে আমার বেশ ভালই লাগছিল। এ তো আর চিড়িয়াখানার সংকীর্ণ পরিবেশে অসংখ্য জন্তুর জটলা নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশে মনের আনন্দে তাদের ঘুরে বেড়ানো।
আগেই বলেছি, অমিতবিক্রম চৌধুরী আমার দূরসম্পর্কের ভাই। তার নাম আমি অনেক শুনেছি, কিন্তু চাক্ষুষ দেখা এই প্রথম। অট্টালিকাতুল্য বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। শক্তসমর্থ জোয়ান দীর্ঘকায় চেহারা। গায়ের রং তামাটে। মুখে অসংখ্য কাটা দাগ-সৌন্দর্যের পরিপন্থী না হয়ে সেগুলি বরং তার শিকারপ্রিয়তার সাক্ষী হিসেবে চরিত্রে একটা অসাধারণ দৃঢ়তা এনে দিয়েছিল। বেশভূষায় জমিদারসুলভ আভিজাত্য। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগার। মুখে অমায়িক হাসি। কণ্ঠে যেন মধু—পরম শত্রুও তাঁর কথায় গলে জল হয়ে যায়।
আমাকে দেখেই সাদরে অভ্যর্থনা করলেন তিনি, ‘আসুন! আসুন ভবতোষবাবু! আপনার পদক্ষেপে এই জনবিরল ঘুমন্ত প্রদেশ ধন্য হয়ে উঠুক।’
আমি জবাব দিলাম, ‘না, না, এতটা অভ্যর্থনার যোগ্য নই আমি। আমার মত ছা-পোষা মানুষ আপনার মত সম্ভ্রান্ত পুরুষের কাছে এতটা অভ্যর্থনা আশা করে না।’
প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলেন ভদ্রলোক, ‘আপনি দেখছি, বিনয়ের অবতার। আরে মশাই, টাকা দিয়েই কি সব সময় সব কিছু যাচাই করা চলে? ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমরা উভয়েই সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে।’
‘তা বটে।’
তাঁর ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হয়ে গেলাম যে, আমার মনে হতে লাগল, কত কাল যেন আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত। ঋণগ্রস্ত হয়েই অবশ্য ভদ্রলোকের কাছে ছুটে এসেছি। তাই বলে নিজেকে এতটা হেয় মনে করবার কি আছে? এতটা গরিবানা চালই বা দেখাবার কি দরকার? বিশেষ করে ভদ্রলোক নিজেই যখন সম্পদের পরিমাণ দেখে সম্পর্কের বিচার করা পছন্দ করেন না
আমার আসার উদ্দেশ্য কিছুটা সিদ্ধ হয়েছে বলে যখন ধরে নিতে যাচ্ছিলাম, তখন ভদ্রলোকের স্ত্রীর নিরুত্তাপ ব্যবহার আমাকে হতাশ করল। ভদ্রমহিলার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, আমি যেন তাঁদের গলগ্রহ হয়ে থাকতে এসেছি—এখানে এসে যেন দারুণ গর্হিত কাজ করে ফেলেছি। মুখে অবশ্য বলেন না কিছুই। কিন্তু তাঁর ডাগর ডাগর চোখের অর্থপূর্ণ চাহনিতে বারবার তিনি আমাকে চলে যাবার ইঙ্গিতই দিতে লাগলেন।
আমি হয়তো চলেই আসতাম, যদি না পাওনাদারদের তাগাদা অহরহ আমাকে এমন ব্যতিব্যস্ত করে তুলত, যদি অমিতবিক্রম চৌধুরী আমাকে নিয়ে এতটা মেতে না উঠতেন ; ঘটা করে তিনি ঘর সাজালেন। এবং আমাকে থাকতে দিলেন সবচেয়ে সুন্দর কক্ষে। খানাপিনা যা হল, বহুদিন আমি তা চোখেও দেখি নি। আমার সুবিধে-অসুবিধের দিকে তাঁর কড়া নজর। সাধ্যমত সবই করলেন তিনি। এমন কি, আর কি হলে আমার আরাম ষোলকলায় পূর্ণ হবে, সেটাও জানতে চাইলেন। একবার ইচ্ছে হয়েছিল বলি—মোটা অঙ্কের চেক পেলেই আর কিছুর দরকার নেই। বড়জোর কথাটা সামলে নিয়েছিলাম। আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাত পেতে কিছু চাইলে নিজেকে খেলো করা হয়। গাড়োয়ান ঠিকই বলেছিল—এমন অতিথিপরায়ণ লোকের কাছে চাইতেও লজ্জা করে।
ভদ্রলোকের চরিত্র এক দিকে যেমন ফুলের মত নরম, অপর দিকে তেমনি বজ্রের মতই কঠোর। অচিরেই তার দৃষ্টান্তও পাওয়া গেল। অমিতবিক্রমের স্ত্রী কোন একটা গূঢ় অভিসন্ধি নিয়ে প্রথম থেকেই আমাকে উপেক্ষা করে আসছিলেন। আমি তখনও বিশেষ আমল দিই নি। আমি তখন জানতাম না যে ভদ্রমহিলার কথাবার্তা এত চাঁচা-ছোলা। আমাকে হকচকিয়ে দিয়ে হঠাৎ তিনি বলে বসলেন, ‘আজকেই চলে যাচ্ছেন তো? সন্ধের ট্রেন ধরতে হলে বেলা থাকতেই বেরিয়ে পড়া ভাল।’
আমি উত্তর দিলাম, ‘কিন্তু আজই চলে যাবার কথা তো ভাবি নি!’
‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি—’
‘অমিতবাবু আজ যেতে দেবেন বলেও তো মনে হয় না। তিনি যদি চান তো—’
কথা শেষ করবার আগেই অমিতবিক্রম ঘটনাস্থলে এসে হাজির। শেষের কথা কয়টি পরিষ্কারভাবে কানে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই আঁচ করে নিয়েছেন, জল কোথায় গড়াতে চলেছে। তাঁর সেই হাসিখুশি মুখটা তখন থমথম করছে রাগে। সেই মুহূর্তে মনে হল, রাশভারী লোক অনেক দেখেছি, কিন্তু এমনটি দেখি নি। আমাকে তিনি অনুরোধ করলেন, বাগানে গিয়ে বসবার জন্য। আমি বেরিয়ে যাবামাত্র ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং প্রচণ্ড রাগে তিনি ফেটে পড়লেন। আড়ি পেতে শুনবার অভ্যাস আমার কস্মিনকালেও নেই। তবু যেতে যেতে যা শুনলাম তাই যথেষ্ট। আমার প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য তিনি স্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত তলব করছেন। ব্যাপারটা অনেকদূর গড়িয়েছে বিবেচনা করে যখন যাব-যাব করছি, তখনই দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। তাকিয়ে দেখি, ভদ্রমহিলা হনহন করে আমার দিকেই আসছেন। চোখ দুটি তাঁর জবা ফুলের মত লাল।
এসেই বিনা ভূমিকায় বলে উঠলেন, ‘আমার স্বামী আমাকে আপনার কাছে মাফ চাইতে পাঠিয়েছেন।’
আমি বললাম, ‘ছি, ছি, ওকি কথা! ও-কথা বলে আর লজ্জা দেবেন না।’
হঠাৎ তাঁর চোখ দুটি যেন জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললেন, ‘বেহায়া অনেক দেখেছি, কিন্তু আপনার মত দেখি নি।’
কথাটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আকস্মিক আক্রমণের ধাক্কায় কিছু বলতেও পারলাম না।তাছাড়া ভদ্রমহিলা ততক্ষণে সরে পড়েছেন। অমিতবিক্রম একটু পরেই এলেন। ঠোঁটের কোণে সেই হাসি আবার ফিরে এসেছে তাঁর। বললেন, ‘আমার স্ত্রী নিশ্চয়ই মাফ চেয়েছে আপনার কাছে?’
বলতেই হল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’
‘ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ওর স্বভাবটাই একটু বেয়াড়া ধরনের— কারো ঘেঁষটুকু সহ্য হয় না। ও চায়, আমাদের দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় কোন ব্যক্তি এসে শান্তি ভঙ্গ না করুক। লোকালয় ওর পছন্দ নয়। এই জনবিরল স্থানে আমার আসার মূলে রয়েছে ওই। তবু যেন ও সুখী নয়। এখানেও মাঝে মাঝে লোকজন আসে। ধূ ধূ করা মরুভূমি বা খাঁ-খাঁ করা কোন দ্বীপই ওর উপযুক্ত জায়গা। আর বলেন কেন, বুঝিয়ে বুঝিয়ে হয়রান হয়ে গেলাম আমি।’
আমি বললাম, ‘কি আর করবেন বলুন। একে নিয়েই যখন ঘর করতে হবে, তখন আব্দার খানিকটা সহ্য না করে উপায় কি!’
‘কিন্তু আপনি কিছু মনে করেননি তো? ওর কথায় যদি চলে যাবার সঙ্কল্প করে থাকেন, তবে দারুণ আঘাত পাব আমি।’
‘না, না, আমি কিছু মনে করি নি।’
‘বেশ, চলুন, আপনাকে আমার সংগ্রহশালা ঘুরে ঘুরে দেখানো যাক। দেখবেন, কত বিচিত্র সব জানোয়ার আমি সংগ্রহ করেছি।’
সারাটা বিকেল কেটে গেল তাঁর সংগ্রহশালার বিচিত্র সব জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে পরিচিত হতে। কতকগুলি খাঁচায় আবদ্ধ, কতকগুলি উদ্যানে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাকে কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন, কাকে বা তিনি নিজেই ধরেছেন, সব জলের মত বলে যাচ্ছিলেন। কোন্ শিকারে গিয়ে তিনি প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন, কোথায় তাঁর ব্যর্থতা এসেছে, কোথায়ই বা রোমহর্ষক অভিযান করেছেন—সবই আমার জানা হয়ে গেল। উদ্যানে কোন পাখি হয়তো শিস্ দিয়ে উঠল, কোন জন্তু হয়তো নিজের লাফানোর কসরত দেখাল, কিংবা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কেউ হয়তো গাছের আড়ালে লুকোল, অমনি শিশুর মত আনন্দে নেচে উঠতেন তিনি। তখন যেন তিনি একেবারে ভিন্ন জাতের মানুষ।
সব দেখা হয়ে গেলে বললেন, ‘এবার যাকে দেখাব সে আমার সংগ্রহশালার রত্নবিশেষ। এজন্য নিজেরই বাড়ির একদিকে তার থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’
আমি কৌতুহলী হয়ে উঠলাম।
দরদালানের শেষপ্রান্তে বিশেষভাবে নির্মিত একটি ঘর। দালানের অপর অংশের সঙ্গে কোলাপসিবল্ গেট দিয়ে সেটি পৃথক করা। ঘরের দরজা নিরেট ইস্পাতের তৈরি। দরজার খানিকটা অংশে খড়খড়ির ব্যবস্থা আছে, যাতে সেখান দিয়ে ঘরের ভেতরে দৃষ্টিপাত করা সম্ভব হয়।
খড়খড়ি তুলে ধরে আমাকে ভেতরে তাকাতে বললেন।
বিরাট ঘর। অপর দিকের দেয়ালে ছোট ছোট জানলা, তাতে মোটা মোটা লোহার গরাদ। তারই একটি জানলাপথে দিনান্তের শেষ সূর্যরশ্মি এসে পড়েছিল ঘরের মেঝের একপ্রান্তে। সেই অবসন্ন রোদের মাঝে একটি বিশালকায় বাঘকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। রং তার আবলুস কাঠের চেয়েও কালো। তেল চুকচুকে সুন্দর চেহারা। বেড়ালের মত গুটিসুটি মেরে নিদ্রায় আচ্ছন্ন। বোধ হয়, সায়াহ্নের নাতিউষ্ণ রোদের আমেজ প্রাণভরে গ্রহণ করছিল। সেই বলদৃপ্ত পেশীবহুল পৈশাচিক সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারলাম না।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন দেখছেন?’
বললাম, ‘এত বেশি সুন্দর যে ভয় ধরে যায়।’
হেসে উঠলেন হো হো করে, ‘ঠিক বলেছেন।’
‘এরকম কালো বাঘ আর দেখি নি। কালো বাঘ যে এত সুন্দর হতে পারে ধারণা ছিল না।’
‘কেউ কেউ একে পুমা বলে ভুল করে। কেউ একে কালো প্যান্থার ভেবে বসে। আসলে এ হচ্ছে জাগুয়ার। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল থেকে একে ধরে আনা হয়েছে। আমার কাছে যখন বিক্রি করা হয়, তখন একে দেখতে ছিল এতটুকু একটা পুতুলের মত। রেশমী কালো লোমে দেহ ঢাকা—হলদে জ্বলজ্বলে দুটি চোখ তার মধ্য থেকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। এর মাকে গুলিবিদ্ধ করার পর সহজেই একে ধরা সম্ভব হয়। বর্তমানে এর মাপ লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত এগার ফিট। বয়স মোটে চার বছর। এখনো বাচ্চাই বলতে হয়।’
‘শুনেছি, এরা নাকি ভীষণ হিংস্র?’
‘সেকথা আর বলতে! এদের মত বিশ্বাসঘাতক আর রক্তলোলুপ প্রাণীর জুড়ি মেলা ভার। কোন রেড-ইন্ডিয়ানের কাছে এর নাম একবার বলে দেখুন না, শুনেই সাত হাত লাফিয়ে উঠবে সে। বেড়াল যেমন ইঁদুর নিয়ে খেলতে ভালবাসে, এরাও তেমনি মানুষ নিয়ে খেলে খুব আনন্দ পায়। অবশ্য এ এখনও তাজা রক্তের স্বাদ পায়নি। যেদিন পাবে, সেদিন মানুষের কাছে প্রকাণ্ড বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াবে। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত আমাকেই দেখতে অভ্যস্ত। আমিই ওর কাছে একাধারে মা এবং বাবা। তাই আমাকে ছাড়া আর কাউকেই সহ্য করতে পারে না।’
বস্তুত দেখলামও তাই। ধাতব কপাটের বিরাট পাল্লা দুটি খুলে সুড়ুৎ করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন তিনি, এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দরজা বন্ধ করার আওয়াজ গমগম করে ফিরতে লাগল দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে। সেই আওয়াজে জেগে উঠে প্রাণীটা আড়মোড়া ভাঙল। তারপর সুললিত ছন্দে দেহের পেশীতে পেশীতে হিল্লোল তুলে এগিয়ে এল মালিকের কাছে। অমিতবিক্রম চৌধুরী প্রচণ্ডবিক্রম সেই প্রাণীটির দেহে হাত বুলিয়ে আদরে-সোহাগে ভরিয়ে তুললেন। প্রতিদানে সেও লোমশ লম্বা লেজ আন্দোলিত করে মালিকের দেহে নিজের গা ঘষে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে লাগল।
গায়ে হালকা চাপড় মেরে তিনি বললেন, ‘এবার পুষি, তোমার খাঁচায় যাও তত লক্ষ্মীটি।’
দানবীয় চেহারার সেই বাঘটি লঘু পায়ে ঘরের একপাশে লোহার গরাদে ঘেরা নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। অমিতবিক্ৰম বাইরে এসে বিরাট একটি হাতল ঘোরাতে লাগলেন; সঙ্গে সঙ্গে একপাশের দেয়ালের ফাটল থেকে ইস্পাতের মোটা মোটা রড দিয়ে তৈরি মজবুত একটা দরজা বেরিয়ে এল। দরজাটি গরাদে ঘেরা স্থানটির সম্মুখভাগ দিয়ে চলে গেলে প্রকৃতই একটি খাঁচার মত দেখতে হল সেটিকে। বাঘটি সেই খাঁচায় আবদ্ধ রইল।
গৃহস্বামী এবার আমাকে নিয়ে ঘরের ভেতর পদার্পণ করলেন। মাংস-পচা ভ্যাপসা দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল আমার। মাংসাশী প্রাণীদের যত পরিচ্ছন্নতার মাঝেই রাখা যাক না কেন, এই দুর্গন্ধের হাত থেকে কিছুতেই রেহাই পাওয়া যায় না।
গৃহস্বামী বললেন, ‘দিনের বেলা চলে-ফিরে বেড়াবার জন্য সমস্ত ঘরটাই ছেড়ে দেওয়া হয় ওকে। আর রাতে ওকে আটকে রাখা হয় এই খাঁচায়। বাইরের ওই হাতলটা ঘোরালেই খাঁচার সম্মুখভাগ খুলে যায় বা বন্ধ হয়।’
আমি খঁচার গরাদের ওপর হাত দেওয়ামাত্র মুখিয়ে উঠলেন তিনি। ‘খবরদার, খবরদার! ও কাজটিও করবেন না। পুষিকে অতটা নিরাপদ ভাববেন না যেন।’
আমি হাত সরিয়ে নিলাম।
‘পুষির গায়ে আমি হাত বুলাই বলে অপরেও যে তাই পারবে, একথা ভাববেন না। দেখুন, দেখুন, কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে পুষি। ও বুঝতে পেরেছে, ওর ভোজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
খাঁচার সঙ্কীর্ণ পরিবেশে দ্রুত পদচারণা শুরু করেছিল কালো বাঘটি। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। ঘরের ভেতরকার সেই প্রায়ান্ধকার পরিবেশে হলদে চোখ দুটি আগুনের ভাঁটার মত জ্বলছিল। রক্তাভ লম্বা জিভটি ক্ষণে ক্ষণে ঝকঝকে দন্তপংক্তির বাইরে এলিয়ে পড়ছিল। বড় আকারের একটি রেকাবিতে হাড়সমেত বিরাট একটি মাংসখণ্ড নিয়ে হাজির হল একজন পরিচারক। খাঁচার ভেতরে সেটিকে ঢুকিয়ে দিতেই বাঘটা বিশাল থাবা বাড়িয়ে আলতোভাবে নিয়ে গেল সেটিকে। খাঁচার এক কোণে বসে সামনের দুই থাবার মাঝে মাংসখণ্ড চেপে ধরে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল সে। আর রক্তমাখা মুখখানা তুলে মাঝে মাঝে আমাদের ওপর অলস দৃষ্টি বুলিয়ে নিতে লাগল। সেই অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে গা শিরশির করে উঠল আমার।
বাইরে যাবার সময় গৃহস্বামী বলতে লাগলেন, ‘ওকে আমি এত ভালবাসি দেখে আপনি খুব অবাক হয়েছেন, তাই না? ছোটবেলা থেকে আমার কাছেই লালিত-পালিত বলে কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। ওকে রাখা বিপজ্জনক, আবার ছাড়তেও মন চায় না। চিড়িয়াখানার লোকেরা ওকে নেবার জন্য মাথা কুটে মরছে। তাদের সবাইকে বাধ্য হয়ে নিরাশ করতে হচ্ছে আমায়।’
দেখতে দেখতে ছ’টা দিন কেটে গেল। আমার আত্মীয়টি এই ক’দিন এতই ব্যস্ত রইলেন যে আমার মনের কথা মনেই রয়ে গেল। প্রতিদিনই তাঁর কাছে তিন-চারটি টেলিগ্রাম এসে পৌঁছতো। অস্বাভাবিক আগ্রহ নিয়ে সেগুলিকে খুলতেন তিনি। আমারও জানবার ইচ্ছে হত। কিন্তু অপরের ব্যক্তিগত ব্যাপারে অহেতুক কৌতূহল দেখানো ঠিক নয় বিবেচনা করে নিবৃত্ত হতাম। ঘোড়দৌড় কিংবা স্টক-এক্সচেঞ্জের সঙ্গে হয়তো জড়িত ছিলেন তিনি, কিংবা তার চেয়েও জরুরী কোন কাজ।
নিজের কাজে যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, আমার খাতির যত্নে কোনরূপ ক্রটি ছিল না। রাতে একসঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলতাম আমরা। তিনি তাঁর শিকারের গল্প বলতেন। আমি বলতাম শহরের কথা, আমার নিজের কথা। আমি যে কায়ক্লেশে দিন গুজরান করছি, ঋণের অতল গহ্বরে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছি, সে-কথাও বলতাম। কোন রকম খাটো নজর তাঁর ছিল না—সব শুনতেন ধৈর্য ধরে।
কখনো বলতেন, ‘আপনার ধনী জ্যাঠা থাকতে আপনার এই দুর্দশা কেন? আপনিই তো জ্যাঠার বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী?
আমি বললাম, ‘নামেই উত্তরাধিকারী। জ্যাঠা এ-পর্যন্ত স্তোকবাক্য দিয়েই ভুলিয়ে রেখেছে—কানাকড়িও ছুঁইয়ে দেখাননি।’’
তিনি সহানুভূতি দেখাতেন, ‘হ্যাঁ, তার কঞ্জুসপনার কথা আমারও অজানা নেই। বুড়ো মরতে চলেছে, আর এখনও কিনা টাকার কাঁড়ি নিয়ে পড়ে থাকতে চায়!’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম, ‘আজ নতুন কিছু তাঁর ঘটে নি—দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরেই তাঁর শরীরের অবস্থা খারাপ। আরো তিরিশ বছর এভাবেই কেটে যাবে। এদিকে আমার খাই-খরচের টাকাও নেই।’
‘আপনার কথা শুনে সত্যি আমার দুঃখ হচ্ছে।’
আর গড়িমসি করা ঠিক নয় বিবেচনা করে বলেই ফেললাম, ‘তাই বলছিলাম, আপনার তো খ্যাতি-প্রতিপত্তি দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আপনার বদান্যতার কথা কাগজেও অনেক পড়েছি। যদি আমাকে সংসারের ভরাডুবি থেকে রক্ষা করেন, যদি—’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। আমার যতদূর ক্ষমতা আমি আপনাকে সাহায্য করব। আজ রাতেই আপনার আর্থিক অবস্থার কথা সবিস্তারে বলুন আমাকে।’
আর চিন্তা নেই—কার্যোদ্ধার হতে চলেছে। কুয়াশা কেটে গিয়ে এবার ভাগ্যগগনে ঝিলমিলিয়ে সূর্য উঠবে। আবার আমি বুক ফুলিয়ে চলতে পারব, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। সারাটা দিন স্বপ্নের ঘোরে কেটে গেল। ফুলের সুগন্ধ কিংবা আহার্য দ্রব্যের খোশবায় এ-দিন যেন বিশেষ একটি অর্থবহ হয়ে ধরা দিল আমার কাছে। গোগ্রাসে খাবার খেলাম, অস্থির পায়ে ঘুরে বেড়ালাম। কত চাইব, তাই নিয়ে প্রচুর হিসেব-নিকেশ করলাম। জীবনটা কিভাবে শুরু করব, তাই নিয়ে ঘড়ি ঘড়ি মত বদলালাম। আর তখন আচমকা গৃহকর্ত্রীর দুর্বিনীত ব্যবহার শেল হয়ে আমার বুকে এসে বিঁধল।
তিনি মুখঝামটা দিয়ে উঠলেন, ‘খাসা লোক বটে আপনি! ধন্যি আপনার নির্লজ্জতা! চোখে যদি সামান্য চামড়াও থাকত…চশমখোর কোথাকার!’
ছুরির মত ধারালো কাটা কাটা কথা—একেবারে মরমে গিয়ে বেঁধে। একবার ইচ্ছে হয়েছিল, চলে যাই। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টায় আশার যে-ইমারত গড়ে তুলেছি, মুহূর্তের অবিবেচনায় সেটিকে খানখান করে ভেঙে দিতে মন চাইল না।
সেদিন বিকেল থেকেই প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে চলেছিল। সন্ধ্যার পর যেন তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল। যেমনি ঝড়ের বেগ, তেমনি মুষলধারে বৃষ্টি। নৈশ আহারের পর যখন সারাটা বাড়ি সুষুপ্তির কোলে ঢলে পড়ল, তখনও গৃহস্বামীর সঙ্গে আমার সাংসারিক আলোচনা চলছে। তাঁর মেজাজও বোধ হয় খানিকটা অশান্ত। নাহলে এভাবে মদিরার আশ্রয় নেবেন কেন? ঘনঘন পানপাত্রে চুমুক দিতে দিতেই আমার সঙ্গে আলোচনা করতে লাগলেন।
বাইরে প্রকৃতি তখন নেচেকুঁদে প্রলয় বাধিয়ে দিয়েছে। বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজ আর বৃষ্টির ঝমাঝম শব্দ ক্লান্তিহীন আবেগে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিহত হচ্ছে।
অযথা কালক্ষেপ না করে আমি আমার বক্তব্য বুঝিয়ে চলেছি আমার আশ্রয়দাতাকে। কার কাছে আমি কত ঋণী, সংখ্যাতত্ত্বের দ্বারা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। এজন্য নোটবইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে আমায়। কথাপ্রসঙ্গে আমার ওপর তাঁর স্ত্রীর খবরদারির কথা উঠেছিল, আমি কিন্তু এড়িয়ে গেছি। তিনি সব কিছুই শুনছিলেন ধৈর্য ধরে; অথচ মাঝে মাঝে এমন সঙ্গতিহীন মন্তব্য করে বসছিলেন যে, তাঁর অন্যমনস্কতায় আমি আহত হলাম। সন্দেহ হল, তাহলে কি আমার অর্থগৃধ্ন তাঁর বিরক্তির কারণ ঘটিয়েছে!
শেষে চুরুটটাকে নিভিয়ে ফেলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘দেখুন, সংখ্যাতত্ত্ব আমার মাথায় ঢোকে না। আপনি বরং এক কাজ করবেন, একটি কাগজে ঋণের মোটামুটি হিসেব লিখে আমাকে দেবেন।’
আমি সানন্দে তাতেই রাজী হলাম।
দেয়াল ঘড়িতে ঢং করে রাত একটা বাজল। বাইরে তখন ঝড়জলের হামলা সমানে চলেছে।
শুতে যাবার আগে তিনি কালো বাঘটাকে একবার দেখতে চাইলেন। এই ভয়ঙ্কর রাতে বেচারির মেজাজ কেমন আছে জানা দরকার।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাবেন নাকি দেখতে?’
আমি এক কথায় রাজী।
তিনি বললেন, ‘তাহলে নিঃশব্দে চলে আসুন। বাড়ির সবাই ঘুমে অচেতন। কথা বলে বা শব্দ করে কারো ঘুম ভাঙানোর প্রয়োজন নেই, কি বলেন?’
আমি সায় দিলাম।
হাতেধরা টর্চের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওদিকটায় আবার লাইট নেই— টর্চই একমাত্র ভরসা।’
বিরাট দরজা খুলে আমরা যখন ঘরের ভেতরে ঢুকলাম, তখন সেখানে অন্ধকার ঘুটঘুট করছে— অন্ধকারের সঙ্গে মিশে ব্যাঘ্রপ্রবর কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে বোঝবার উপায় নেই। ক্রুদ্ধ চাপা গর্জন ভেসে আসছিল খাঁচা থেকে। টর্চের জোরালো আলোয় দেখা গেল, বাঘটি খাঁচার এক কোণে বসে আছে ঠিকই কিন্তু তার লেজের অস্থির আন্দোলন উত্তেজিত মনোভাবেরই পরিচয় দিচ্ছে। লেজের ছায়া চুনকাম করা দেয়ালের ওপর বীভৎসভাবে নেচে বেড়াচ্ছিল।
গৃহস্বামী মন্তব্য করলেন, ‘এই ভয়াবহ রাতে একে কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে দেখুন। এর মন-মেজাজ বিশেষ সুবিধের নয় আজ। কিছু খেতে দিয়ে একে শান্ত করা দরকার। আপনি টর্চটা একটু ধরুন…আমি খাবার নিয়ে এখুনি আসছি।’
আমি টর্চটা হাতে নিতেই তিনি সিঁড়ি বেয়ে দরজার কাছে উঠে গেলেন। তারপর আমাকে চমকে দিয়ে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। অজানা আশঙ্কায় বুক দুরুদুরু করে উঠল আমার। গৃহস্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় আর সেই দানবীয় কালো বিভীষিকার আতঙ্কে দেহের অনুতে ভয়ের শিহরণ খেলে গেল।
ব্যস্তসমস্ত হয়ে দরজার কাছে ছুটে গিয়েই চেঁচাতে লাগলাম,‘দেখুন, আমাকে এভাবে একা ফেলে পালাবেন না।’
উত্তর হল, ‘ভয় কিসের—আলো তো হাতেই আছে। তাছাড়া আপনাকে তো একলা ফেলে পালাচ্ছি না—একজন সঙ্গী তো দিয়েই যাচ্ছি।’
‘এসব ঠাট্টা-ইয়ার্কি আমি মোটেই বরদাস্ত করব না, বলে রাখছি। আপনার কাছে হাত পাততে পারি, কিন্তু সম্মান একেবারে বিকিয়ে দিই নি।’
‘বটে—’
আমি যে তাঁর অতিথি, সেকথা স্মরণ করিয়ে দিলাম ; তাঁর মত সদাশয় ব্যক্তির পক্ষে এমন গর্হিত আচরণ শোভা পায় না, তাও বললাম ; একথা লোক-জানাজানি হলে তাঁর মত ব্যক্তির কেলেঙ্কারির একশেষ হবে, তাও বলতে ছাড়লাম না। অনুনয়-বিনয় করলাম, তারপর ভয় দেখালাম, শেষে কথার খেই হারিয়ে ফেলে আবোল-তাবোল বকতে শুরু করলাম। কিছুতেই কিছু ফল হল না।
ঝড়ের প্রচণ্ড গর্জন এবং উন্মত্ত প্রলাপের মাঝে আরেকটি শব্দ কানে ঢুকতেই বিস্ময়ে একেবারে থ হয়ে গেলাম। অমিতবিক্রম চৌধুরী হাতল ঘুরিয়ে খাঁচার মুখ খুলে দিতে শুরু করেছেন! এতক্ষণে আমার চোখ ফুটল। তাঁর অভিপ্রায় যে খারাপ, তাতে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ রইল না। কিন্তু কেন তিনি এমন করছেন? আমি তো তাঁর পাকা ধানে মই দিই নি। তবে?
টর্চের আলোয় দেখতে পেলাম, খাঁচার দরজা ইতিমধ্যে খানিকটা সরে গেছে, অন্তত ফুটখানেক ব্যবধান রচনা করেছে খাঁচার একপাশে। কালবিলম্ব না করে ছুটে গিয়ে দরজার শেষ লোহার রডটিকে চেপে ধরলাম। টর্চটি জ্বালানো অবস্থায় মেঝেতেই পড়ে রইল। রাগে-দুঃখে-ভয়ে আমি তখন পাগল হয়ে গেছি। বেপরোয়াভাবে খাঁচার দরজাটি ধরে রয়েছি। এক চুলও নড়তে দেব না―এই যেন পণ। আমার সেই অমানুষিক চেষ্টায় দরজাটি কিছুকাল স্থির হয়ে রইল। অমিতবিক্রম চৌধুরী তখন লোহার হাতল ঘুরিয়ে দরজাটি খোলবার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। আমি জানতাম, যান্ত্রিক কলাকৌশলের কাছে আমার দৈহিক বলের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতের শীত-শীত আমেজের মধ্যেও আমার শরীর দিয়ে দরদর ধারায় ঘাম ছুটল। হাতের পেশী ব্যথায় টনটন করতে লাগল, আঙুলগুলো অবশ হয়ে এল। একটু একটু করে অসমান পাথরের মেঝের ওপর দিয়ে আমার পা দুটি এগিয়ে যেতে লাগল। আর সারাক্ষণ আমি মা জগদম্বার কাছে এই বীভৎস মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য আকুল প্রার্থনা জানাতে লাগলাম। প্রতিবার আবেদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সভয়ে লক্ষ্য করলাম, একটু একটু করে দরজাটা দেয়ালে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, আর খাঁচার মুখের ফাঁকটা আকারে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মেঝের ওপর দিয়ে খাঁচার সম্মুখভাগের একপাশ থেকে আর একপাশ পর্যন্ত দরজাটা আমাকে টেনে টেনে নিয়ে গেল। শেষে হতাশাক্ষুব্ধ মন নিয়ে শ্রান্ত অবসন্ন হাতের দৃঢ় মুষ্টি শিথিল করে দিতেই হিড়হিড় করে দরজাটা দেয়ালের ফাটলপথে গায়েব হয়ে গেল। বেরিয়ে রইল শুধু সামান্য খানিকটা অংশ—হাড় বার করা পাঁজরের মত।
সেই নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগলাম আমি। টর্চটা খাঁচার মুখের অপরদিকে জ্বালানো অবস্থায় রয়েছিল। খাঁচার ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তাতে। ঘরের বাইরে তখন গৃহস্বামীর পায়ের চটির ক্রমক্ষীয়মাণ চটাস্ চটাস্ শব্দ এবং কোলাপসিবল্ গেট বন্ধ করার সুপরিচিত ঝনঝন আওয়াজ। তারপর আর কোন শব্দ নেই।
এতক্ষণ বাঘটা কিন্তু একচুলও নড়ে নি। বরং তার লেজের অস্থির আন্দোলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা লোককে পাগলের মত খাঁচার দরজার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তার জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি সারাক্ষণ নিবদ্ধ ছিল আমারই দিকে। টর্চটা এমনভাবে মেঝেতে পড়েছিল যে তাকে দেখতে আমার মোটেই কষ্ট হচ্ছিল না। অকূল অন্ধকারের সমুদ্রে টর্চটাই তখন আমার একমাত্র অবলম্বন। ওটিকে হাত করবার কথা চিন্তা করে যেই না পা বাড়িয়েছি, অমনি রাগে গরগর করে উঠল ব্যাঘ্রপ্রবর। বাধ্য হয়ে আমাকে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকতে হল।
ঠিক হাত ছয়েক দূরেই বাঘটা। তার জ্বলন্ত দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমি। অন্ধকারে ফসফরাসের দুটো চাকতি যেন জ্বলজ্বল করছিল। সেদিকে তাকিয়ে আমি যেন সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম—নড়বার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়েছিল। চরম বিপদের মুহূর্তে প্রকৃতি আমাদের নিয়ে বিচিত্র খেলা খেলে থাকে। আমি যেমন দৃষ্টি সরাতে পারছিলাম না, বাঘটার দৃষ্টিও তেমনি আমার ওপর থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে-দৃষ্টিতে যেন আলোর জোয়ার-ভাঁটা চলছিল। চোখ দুটি কখনো কখনো অত্যুগ্ৰ আলোর সূচ্যগ্র বিন্দুতে পরিণত হচ্ছিল—যেন একতাল জমাট অন্ধকারের দেহে বিদ্যুতের দীপ্তিময় স্ফুলিঙ্গ। তারপর সেই স্ফুলিঙ্গ আকারে-আয়তনে বাড়তে থাকল। সেই নারকীয় আলোর দ্যুতি তখন ছড়িয়ে পড়তে থাকল, ঘরের একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্তে। বার কয়েক এরকম হবার পর সেই বীভৎস আলোর দ্যুতি একেবারে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের গর্ভে। বুঝলাম, বাঘটা চোখ বুজেছে।
কোথায় যেন পড়েছিলাম যে, মানুষের দৃষ্টির একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। হিংস্র প্রাণীর চোখে চোখ রেখে যদি নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, তবে প্রাণীটির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী―সাময়িকভাবে হলেও বশীভূত হবেই। কথাটা কতদূর সত্য জানি না। তবে স্পষ্টই দেখলাম যে আমার দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি মেলাতে না পেরে বাঘটি চোখ বুজল। আমাকে আক্রমণ করার কোন লক্ষণই দেখলাম না তার মধ্যে। অন্য কোন কারণও হয়তো থাকতে পারে। ক্ষুধা না থাকায় আমাকে হয়তো আমল দেবার কোন প্রয়োজন বোধ করে নি। হয়তো তার তন্দ্রালু চোখ দুটি নিদ্রার ভারে আপনা হতেই বুজে গিয়েছিল। তাই লোমশ কালো বিরাট মাথাটা দুই থাবার ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কি করব আমি সহসা ভেবে পেলাম না। কতক্ষণই বা কাঠের পুতুলের মত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়। নড়লে বিপদ―প্রাণীটির দৃষ্টি হয়তো আকৃষ্ট হবে। না নড়লেও বিপদ—এখন আত্মরক্ষার চেষ্টা না করলে আর হয়তো সুযোগ পাওয়া যাবে না।
অমিতবিক্রম চৌধুরীর মিষ্টি কথায় ভুলে আমার ঘাট হয়েছে। ভদ্র আচরণের অন্তরালে যে এত বড় একটা ভাঁওতা লুকিয়ে থাকতে পারে, কে তখন জানত। আর একটু আগে যদি ভদ্রতার মুখোশ খুলে যেত, তবে সাবধান হতে পারতাম। রাতভর এই কালো বিভীষিকার সঙ্গে এক ঘরে সময় কাটাতে হত না। মালিকটি যখন এত নির্দয়, না জানি তার আদরের বাঘটি আরও কত নির্দয় হবে। সারা রাত কি এই বাঘটিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব? এই নিভৃত কক্ষে আমার মত দুর্বল মানুষের পক্ষে কি নিরস্ত্র প্রতিরোধ সম্ভব? পারব কি আমি গূঢ় অভিসন্ধির জাল কেটে বেরিয়ে আসতে―রোমহর্ষক বিপদের এই লকলকে শিখার হাত থেকে নিস্তার পেতে? দরজা খোলবার চেষ্টা করে লাভ নেই। জানলার অবস্থাও তথৈবচ। এবড়ো খেবড়ো পাথরের অসমান মেঝের কোথাও আশ্রয় পাবার আশা নেই। চিৎকার করা নিরর্থক—কেউ শুনতে পাবে না। একে তো ঝোড়ো হাওয়ার অবিরাম সোঁ সোঁ শব্দ, তার ওপর মূল বাড়ির সঙ্গে এর দূরত্ব একশ ফিটের কম হবে না। অগত্যা আমাকে আমার বুদ্ধি এবং সাহসের ওপরই শুধু ভরসা করতে হবে।
মেঝেয় পড়ে থাকা টর্চলাইটের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আর এক চোট ভয়ের শিহরণ খেলে গেল মগজের কোষে কোষে। আলো বেশ কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। দশ-পনের মিনিটের বেশি কিছুতেই স্থায়ী হবে না। যা করবার আমাকে এরই মধ্যে করতে হবে। আলো নিভে গেলে আমি একেবারে অসহায় হয়ে পড়ব। অন্ধকারে কালো বাঘটির গতিবিধি আমার নজরে পড়বে না, অথচ আমার চলাফেরা সে দেখতে পাবে। এই ভয়াবহ চিস্তা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মত অবসন্ন করে ফেলল আমাকে। উদভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে এলোমেলো তাকাতে লাগলাম―একটু যদি আশ্রয় মেলে এই আশায়। শেষে একটা জায়গার সন্ধান মিলল। একেবারে বিপদমুক্ত না হলেও জায়গাটা আত্মগোপনের পক্ষে নেহাত মন্দ নয়।
আগেই বলেছি, খাঁচাটা ছিল ঘরের এক কোণায়। খাঁচার মাথা এবং ঘরের ছাদের মাঝে দু-তিন ফিট পরিমিত স্থান খালি ছিল। চারটি মোটা মোটা লোহার খুঁটি এমনভাবে খাঁচার ছাদটাকে ধারণ করেছিল যেন বাঘটার মাথার ওপর ঝাঁঝরিওলা ইস্পাতের একটি চন্দ্রাতপ শোভা পাচ্ছিল। খাঁচার ছাদও যেমন খাঁচার তিন দিককার দেয়ালও তেমনি শক্ত মজবুত ইস্পাতের মোটা মোটা রড দিয়ে ঘেরা। রডগুলি সমান্তরালভাবে স্থাপিত—একটির সঙ্গে অপরটির দূরত্ব কয়েক ইঞ্চি মাত্র। অতিরিক্ত সাবধানতাবশত খাঁচার ছাদ এবং দেয়ালগুলি জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। কোনপ্রকারে একবার ধাঁচার মাথায় উঠতে পারলে, গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকা যেতে পারে বটে। ডাইনে―বাঁয়ে ওপর-নিচে কোন দিক থেকেই আক্রমণের আশঙ্কা থাকবে না। একমাত্র সম্মুখভাগই বিপদের কারণ হতে পারে। যদি পেছন দিকে সরে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে থাকা যায়, তবে বিপদের আশঙ্কা বেশ কিছুটা কমে যাবে। বাঘটা লাফিয়ে খাঁচার মাথায় উঠলেও ভেতরে ঢুকতে অসুবিধে বোধ করবে। এখন যদি কাজটা না সারতে পারি তো আর হবে না। শিগগিরই আলো নিভে যাবে।
কালমাত্র বিলম্ব না করে লাফ দিলাম এবং খাঁচার শীর্ষদেশের রড ধরে দোল খেয়ে হাতড়ে হাতড়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি, বাঘটা সোজা আমার দিকেই পিটপিট করে চেয়ে আছে, তার তপ্ত শ্বাস তখন ফোয়ারার মত আমার নাকেমুখে এসে পড়ছিল। সেই শ্বাসে যেমন দুর্গন্ধ, তেমনি ভয় জাগানো মাদকতা।
আমার কাণ্ডকারখানা দেখে বাঘটার রাগের চেয়ে কৌতূহলই হল বেশি। দেহের পেশীতে পেশীতে হিল্লোল তুলে উঠে দাঁড়াল, আড়মোড়া ভাঙল এবং শেষে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা থাবা খাঁচার দেয়ালে রেখে অপর থাবাটা খাঁচার জালের ওপর বুলোত লাগল। আমি তখনও খাঁচার মাথায় উঠে পড়তে পারি নি। একটা ধারালো সাদা হুক থাবা থেকে বেরিয়ে এসে আমার পায়ের গোড়ালিতে বিধতেই যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলাম। বাঘটার উদ্দেশ্য বিশেষ খারাপ ছিল না। সে শুধু পরীক্ষা করে দেখছিল, ফলাফল কি হয়। আমার চিৎকার শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে পা নামিয়ে নিল, এবং দ্রুত খাঁচার ভেতরে পায়চারি করতে লাগল। তারপর মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখতে লাগল আমাকে। আমি তখন খাঁচার মাথায় উঠে গেছি, এবং ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পেছন দিকে সরে যেতে শুরু করেছি। কারণ, যত ভেতরে ঢুকে যাব, ততই বাঘটার কাছ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা কম থাকবে।
বাইরে তখন ঝড়-জলের দাপট বেড়েই চলেছে। এমন প্রলয়ঙ্কর ঝড় আমার জীবনে আর দেখি নি। বিশ্বচরাচর যেন লোপ পেয়ে যাবে। কিন্তু সেদিকে তখন আমার ভ্রূক্ষেপ নেই। আমার দৃষ্টি তখন খাঁচার ভেতরে নিবদ্ধ। মুর্তিমান বিভীষিকা সেখানে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। বাঘটির অস্থিরতা তার দ্রুত পদচারণে প্রকাশ পাচ্ছে। এত বড় একটা বাঘ কেমন নিঃশব্দে, চলাফেরা করছে। সাক্ষাৎ দেখেও যেন বিশ্বাস হতে চায় না। আমার মৃত্যুদূত আমারই পায়ের নিচে অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে। ক্রমশই তার অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে আসছে আমার কাছে। শেষে টর্চের আলো এত কমে গেল যে বাঘটি আর নজরে এল না। অনুভবে বুঝলাম, অন্ধকারে মিশে তখনও সে অস্থিরভাবে ঘোরাঘুরি করছে। সেই ভীষণ অন্ধকারে ততোধিক ভীষণ শত্রুর সঙ্গে আমি একা রাত কাটাতে চলেছি।
বিপদের মুহূর্তে নিশ্চেষ্ট হয়ে মরার মত অভিশাপ আর নেই। আমি অবশ্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি বিপদকে ঠেকিয়ে রাখতে। আমার সান্ত্বনা এইটুকুই। এখন সাগ্রহে তাকিয়ে থাকব, ফলাফল কি ঘটে দেখবার জন্যে।
দেয়ালের গা ঘেঁষে নিস্পন্দ হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। বাঘটা যাতে আমার অস্তিত্ব ভুলে যায়, সেজন্য অতি সন্তর্পণে শ্বাসপ্রশ্বাস নিলাম। একবার শুধু রেডিয়াম-দেওয়া হাতঘড়িতে সময় দেখলাম। তখন রাত দুটো বাজে। পাঁচটার আগে ভোরের আলো দেখা যাবে না। আরো তিনটি ঘন্টা ঠায় বসে কাটাতে হবে। দু চোখের পাতা কোনক্রমেই এক করলে চলবে না। ভগবানকে অজস্র ধন্যবাদ। তাঁর কৃপায় সেই নিঃসীম অন্ধকারেও হতাশ হয়ে পড়ি নি, নিদ্রাদেবীর মত সাহসও আমাকে ফেলে পালায় নি। কিন্তু তারপর? তারপর কি ঘটবে?
বাইরে ঝড়-বাদলের প্রচণ্ড তাণ্ডব আর ভেতরে পূতিগন্ধময় বিষাক্ত বাতাস আমার স্নায়ুমণ্ডলের ওপর প্রচণ্ড চাপ দিতে লাগল। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। কালো বিভীষিকার হাতে মরার ভয়ই সবার ওপরে স্থান করে নিয়েছিল। এই ভয়ের হাত থেকে সাময়িকভাবে নিষ্কৃতি পাবার আশায় মনটাকে একটু অন্যমনস্ক করতে চাইলাম। আর তখনই মনে পড়ল আমার আশ্রয়দাতার কথা। তাঁর দয়ালু মনোভাব একটা প্রকাণ্ড ধাপ্পা ছাড়া আর কিছুই নয়। হায়, তখন যদি তাঁর চতুরালির একটুও হদিস পেতাম! তখন যদি তাঁর সাদর সম্ভাষণের কিছুমাত্র দাম না দিতাম! কথাকৌশলে ব্যাপারটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, সন্দিহান হবার সামান্যতম সুযোগ পর্যন্ত আমাকে দেওয়া হয়নি! তিনি যতই চতুর হোন না কেন, আমাকেও তাঁর সমস্ত জারিজুরি ফাঁসিয়ে দিতে হবে। কি শয়তানী বুদ্ধি! বাঘের কবলে পড়ে বেঘোরে আমার প্রাণটা গেলেও এই ভীষণ রাতে কেউ সেটা টের পাবে না। সবাই ভাববে, রাতে শোবার আগে বাঘটাকে এক নজর দেখবার জন্য আমি একাই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছিলাম। খাঁচার দরজা যে খোলা আছে, সেটা আমি লক্ষ্য করি নি। আমার অহেতুক কৌতূহলই আমার দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। আমার আশ্রয়দাতাও নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট সাফাই গাইবেন। তিনি আমাকে রাতে একা ওদিকে যেতে নিষেধ করেছেন। তাঁর নির্দেশ আমি অমান্য করেছি বলেই এই বিপদে পড়েছি। কেউ যদি তাঁর যুক্তি না মানতে চায়, কিংবা কেউ যদি তাঁকে সন্দেহই করে, তাতেও তাঁর কিছু যাবে আসবে না। কারণ, তিনিই যে এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, এমন কোন প্রমাণ নেই।
সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে কি করে যে তিনটি ঘন্টা কাটিয়েছিলাম, সেকথা চিন্তা করলে আজও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। একই ভঙ্গিতে বসে থাকায় পা ব্যথা হয়ে এল। চোখ দুটি ক্লান্তিতে ভারী হয়ে এল। বাঘটাকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তার চোখের জ্বলন্ত সবুজ আলো দেখে বুঝতে পারছিলাম, কখন সে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বেশিক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠত আমার, বুক ধড়াস ধড়াস করত। তবে একনাগাড়ে বেশিক্ষণ আমাকে দেখত না বলেই রক্ষে―আলতোভাবে দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিত শুধু। ধীরে ধীরে তার উত্তেজনা কমে এসেছিল। হয়তো আমার অস্তিত্বও ভুলে যাচ্ছিল ক্রমশ। কিংবা আমার মত নিরীহ প্রাণীকে আমল দেবার প্রয়োজন বোধ করে নি। শেষে এক সময় চকচক শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম, গভীর আলস্যে গায়ের লোম চাটতে শুরু করেছে।
কখন যেন আমার চোখ দুটি বুজে এসেছিল। হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠে দেখলাম, ভোর হয়েছে। এক পাশের ক্ষুদ্র চৌকো জানলাপথে একটুকরো আলো এসে পড়েছিল অপরদিকের দেওয়ালের ওপর। সেই আলোয় তখনও স্পষ্টতা আসে নি—ঘরের পুঞ্জীভূত আঁধার দূর করবার ক্ষমতা তার নেই। তবুও সেই অনুজ্জ্বল আলোয় ঘরের সব কিছুই দেখতে পেলাম।
কালো বাঘটার মেজাজ আবার তিরিক্ষে হয়ে উঠেছে। ভোরের ঠাণ্ডা আর ক্ষুধার তাড়না তাকে অস্থির করে তুলেছে আবার। তার পদচারণা এখন আর খাঁচার ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই―ঘরময় ছুটোছুটি শুরু করেছে সে। গলা দিয়ে ক্রুদ্ধ চাপা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। লেজটা অস্থির সর্পিল গতিতে ওঠানামা করছে। আর যখনই সে ঘরের অপরপ্রান্ত থেকে পাশ ফিরে এদিকে আসছে, তখনই একবার ক্রূর বীভৎস দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে ভয়ে মুহ্যমান এই হতভাগ্যর ওপর। বুঝলাম, আমার এই মহামান্য সঙ্গীর মাথায় এখন খুন চেপেছে। অবস্থা চরমে পৌঁছতে আর অধিক বিলম্ব নেই।
সেই গুরুতর অবস্থায় অপরে কি করত জানি না। আমি কিন্তু আসন্ন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও বিস্ফারিত নয়ন মেলে দেখে চলেছিলাম রক্তপিপাসু সেই বিকট কালো মৃর্তিকে। আহা মরি মরি, কি অপূর্ব সেই রূপের বহর! অঙ্গে অঙ্গে তার ভয় জাগানো নারকীয় দ্যুতি, সুললিত চলার ছন্দে প্রলয় নাচের ভঙ্গিমা, কালো ঠোঁটের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা রক্তরাঙা লম্বা জিভে মৃত্যুর আভাস, গলার গর্র আওয়াজে আক্রমণের ইঙ্গিত। নিষ্ঠুর নিয়তির হাতে আর বুঝি রেহাই নেই!
ভয়ে আমার তখন নাড়ী ছেড়ে যাবার উপক্রম। তার ওপর হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডায় ঠকঠক কাঁপছি। কিছু একটা না করলেও মৃত্যু এসে নীরবে আলিঙ্গন করবে আমাকে। সেটাও কোনপ্রকারেই কাম্য নয়। আমি কাপুরুষ নই–ভীতুও নই। সাহসে ভর করে আমাকে বিপদের মোকাবিলা করতে হবে। চাবুক মেরে মেরে যেন সুপ্ত পৌরুষকে জাগিয়ে তুললাম আবার। আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হলাম। উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগলাম, কিছু একটা অবলম্বনের আশায়। পালাবার পথ খুঁজতে লাগলাম।
চূড়ান্ত বিপদের মুহূর্তে মানুষের বুদ্ধি বোধ হয় একটু ভালভাবেই খেলে থাকে। নাহলে আমার মাথায় ওই কৌশলটা জাগল কি করে? ভাবলাম, খাঁচার দরজাটা যদি টেনে আবার যথাস্থানে আনা হয়, তবে আর কোন ভয় নেই। কিন্তু দরজাটা টেনে আনা কি আমার সাধ্যে কুলোবে? তাছাড়া বেশি নড়াচড়া করলে বাঘটাও হয়তো মারমুখী হয়ে উঠবে। অথচ এছাড়া আর কোন পথও তো নেই। অগত্যা খুব সাবধানে আস্তে আস্তে খাঁচার দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। দরজার খানিকটা অংশ দেয়ালের ফাটলপথে উঁকি মারছিল। অতি সন্তর্পণে হাতটাকে তার ওপর রাখলাম। দরজার শেষ লোহার রডটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলাম। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, অবলীলাক্রমে খানিকটা অংশ হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল। তাহলে ওটাকে টেনে আনা যাবে। কিন্তু ওটার সঙ্গে আমি লেগে থাকায় ওটাকে টেনে বের করার একটু অসুবিধে ছিল। তা থাক, এই সামান্য অসুবিধে কিছুই নয়। অগত্যা খাঁচার দরজাটা শক্ত করে ধরে প্রাণপণ শক্তিতে টান দিলাম। বেশ খানিকটা অংশ বেরিয়ে এল এবার। আর তখনই কালো বাঘটা লাফ দিল।
চোখের পলকে ঘটনাটা ঘটে গেল। আমাকে দরজাটা টানাটানি করতে দেখে বাঘটা রাগে চাপা গর্জন করে উঠেছিল। তারপরই দেখলাম, সে লাফ দিয়েছে। অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে জ্বলন্ত হলদে দুটি চোখ, বিরাট কালো মাথা, লাল টুকটুকে জিভ, আর ভয়াবহ ঝিলিকদার কতকগুলি দাঁত আমার দিকে ধেয়ে এল। খাঁচার শীর্ষদেশের প্রান্তভাগটা বাঘটা এসে ধাক্কা দিতেই সেই প্রচণ্ড ধাক্কায় লোহার খাঁচাটা থরথর করে কেঁপে উঠল। সেই মুহূর্তে আমার অনুভব করার শক্তি কতটুকু ছিল আমি জানি না। যা ছিল তাতেই বুঝলাম, প্রচণ্ড ভারে খাঁচার প্রান্তদেশ খানিকটা নুয়ে পড়েছে। বাঘটা খাঁচার মাথায় উঠতে পারে নি। সামনের থাবা দুটো প্রায় আমার পায়ের সামনে খাঁচার লোহার রডগুলো আঁকড়ে আছে। কিন্তু তাতে দেহের সমস্ত ভার রাখতে না পারায় পেছনের পা দুটো কিছু একটা অবলম্বনের আশায় ইস্পাতের জালটা আঁকড়ে ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। জালের ওপর পেছনের থাবার ঘষড়ানির শব্দ শুনে বোঝা গেল বাঘটা বেকায়দায় পড়েছে। এভাবে বেশিক্ষণ তার পক্ষে ঝুলে থাকা সম্ভব নয়। বাঘটা তখন আমার এত সামনে যে, দুর্গন্ধময় শ্বাসপ্রশ্বাস আমার নাকেমুখে পড়ে আমাকে যেন পাগল করে তুলল। শেষে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে পিছু হটে ধপাস শব্দে মাটিতে নেমে পড়ল সে। পরক্ষণেই প্রচণ্ড এক হুঙ্কার দিয়ে আবার লাফাবার জন্য তৈরি হল।
আর মাত্র কয়েকটি মুহর্তের মধ্যে আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে। কতটা তৎপরতার সঙ্গে আমি কাজ করতে পারি, আর আমার উপস্থিত বুদ্ধিই বা কত, তারই ওপর নির্ভর করছে আমার প্রাণ বাঁচবে কি বাঁচবে না। প্রথমবারের অভিজ্ঞতায় বাঘটা বুঝতে পেরেছে, কতটা জোরে তাকে লাফ দিতে হবে। দ্বিতীয়বার আর ভুল করবে না।
না, ভুল আমিও করব না। প্রাণের মায়া যদি থাকে, তবে এই বেলা একটা কিছু করতে হবে। এক ঝটকায় আমি আমার কোটটা খুলে ফেললাম। ওৎ পেতে বসে থাকা বাঘটার মাথায় নির্ভুল লক্ষ্যে সেটাকে ছুঁড়ে দিয়েই এক লাফে খাঁচার মাথা থেকে নেমে পড়লাম মাটিতে। খাঁচার দরজাটা শক্ত করে চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললাম মেঝের ওপর দিয়ে।
খাঁচার দরজাটা যে এত সহজে দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসবে, সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি নি। উত্তেজনায় আমি তখন মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম বলে আমার গায়ের জোরও হয়তো কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে দরজাটা দিয়ে ছুটবার সময় মনে পড়ল, আমি রয়েছি খাঁচার বাইরের দিকটায়। বাঘটাও রয়েছে বাইরেই। যদি খাঁচার ভেতর দিক থেকে দরজাটা টানতাম, তবে আমার গায়ে হয়তো আঁচড়টিও লাগত না। বিধাতার বোধ হয় সেটা কাম্য নয়।
কোটটা মাথায় জড়িয়ে যাওয়ায় বাঘটার গতি সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটাকে সরিয়ে ফেলতে বিশেষ বিলম্ব হয় নি তার। আমি যখন দরজাটা প্রায় বন্ধ করে এনেছি, সেও তখন এগিয়ে এসেছে আমার কাছে। সম্পূর্ণ বন্ধ করার আগে আমি যখন সুড়ুৎ করে প্রায় খাঁচার ভেতরে ঢুকে গেছি, সে তখন থাবা বাড়িয়ে একটা পা চেপে ধরেছে। তার কবল থেকে মুক্ত হবার আপ্রাণ চেষ্টায় পা-টা টেনে নিয়েছি, তখন সুদীর্ঘ ধারালো নখরের আঁচড়ে পায়ের হাড়গুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে―কাঠকাটা মেশিনে কাঠ যেভাবে চেরাই হয় ঠিক সেভাবে।
তারপর দড়াম করে দরজাটা সম্পূর্ণ টেনে দিয়েই প্রবল যন্ত্রণায় এলিয়ে পড়েছি মেঝেতে। পা থেকে রক্ত তখন ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে। তাজা রক্তের আস্বাদ পেয়ে বাঘটা তখন রক্তপাগল। খাঁচায় আটকানো নেংটি ইঁদুর ধরবার জন্য বেড়াল যেন তার চারধারে ঘুরঘুর করছে, আর মাঝে মাঝে খাঁচার ভেতরে থাবা চালিয়ে শিকারের নাগাল পাবার চেষ্টা করছে।
ক্লান্তি অবসাদ আর অত্যধিক রক্তক্ষরণে আমি তখন ভেঙে পড়েছি। নড়বার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়েছে। বাঘটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি তো আছিই। আমার কাছে সে যেন আর ভয়াবহ কোন জীব নয়। হয়তো ভয় পাবার ক্ষমতাই তখন বিলকুল লোপ পেয়েছিল। মাংসাশী প্রাণীদের আক্রমণে আহত হলে, সারা অঙ্গে নাকি প্রচণ্ড অবসাদের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এতদিন কথাটা শুনেই এসেছি, এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগলাম। ব্যক্তিত্ব বলে কিছুই যেন অবশিষ্ট রইল না আমার মধ্যে। কেমন যেন স্বপ্নালু মোহাবিষ্ট অবস্থা। বাঘটা থাবা বাড়িয়ে আমাকে নাগালে পাবার চেষ্টা করছে। কখনো কখনো তার নখরের আঘাতে জামা-কাপড়ের বিভিন্ন অংশ ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে আমার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। আত্মরক্ষার জন্য আরও ভেতর দিকে সরে যাওয়া দরকার। অথচ আমার আর তেমন মনোবল অবশিষ্ট নেই―দৈহিক বল তো নয়ই। মনে হচ্ছিল, আমি ওখানে দর্শকমাত্র। বাঘের সঙ্গে আমি তখন যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। তার আনন্দই যেন আমার আনন্দ, তার হতাশা আমার হতাশা। খাঁচার ভেতরকার প্রাণীটাকে ধরাই তার প্রধান লক্ষ্য এবং ধরতে পারলেই যেন পূর্ণ পরিতৃপ্তি। আমারও যেন তাই।
তারপর সব কিছুই আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হতে লাগল। সেই বীভৎস কালো বিকট মুখ, লালাভ লকলকে জিহ্বা, আর আগুনের ভাঁটার মত দুটি চোখ কখনো এগিয়ে আসছিল, আবার কখনো বা পিছিয়ে যাচ্ছিল। সেসব দেখতে দেখতে বুঝি-বা প্রলাপ বকতে লাগলাম আমি।
ঠিক কতক্ষণ সেই অবসন্ন অবস্থায় পড়েছিলাম, খেয়াল নেই। তবে হিসেব নিকেশ করে এখন বুঝতে পারি, ঘন্টা দুই হবে বোধ হয়। ঘরের দরজা খোলার সুপরিচিত ক্লিক আওয়াজে হয়তো সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম।
সশব্দে দরজা খুলে যিনি ভেতরে ঢুকলেন তিনি আর কেউ নন―আমারই দয়ালু আশ্রয়দাতা মহামান্য অমিতবিক্রম চৌধুরী। এমনটি দেখবেন বলে হয়তো আশা করেন নি। বাঘটা রয়েছে খাঁচার বাইরে, আর বন্ধ খাঁচায় একতাল রক্তের মধ্যে চিৎ হয়ে পড়ে আছে তারই শিকার হতভাগ্য একটি দ্বিপদ প্রাণী। সারা দেহে তার চাপ চাপ রক্তের ছোপ.; শতচ্ছিন্ন জামা-কাপড়ের টুকরো অংশগুলি ইতস্তত ছড়ানো।
অমিতবিক্রমের উদ্বেগ দেখে বুঝতে পারলাম, আমার মৃত্যু সম্বন্ধে তিনি নিঃসন্দেহ নন। ভয় পেলেন, তাহলে কি তাঁর পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল? আমি বেঁচে থাকলে তাঁর পক্ষে সমূহ বিপদ। তাই ব্যস্তসমস্ত হয়ে খাঁচার দিকেই ছুটে এলেন। আসবার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করতে ভুললেন না।
আমার তখন যা মনের অবস্থা, তাতে সব কিছু প্রত্যক্ষ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে বুঝলাম, তিনি উঁকি মেরে,আমাকেই দেখছেন। পরের মুহুর্তেই তাঁর দৃষ্টি আমার ওপর থেকে সরে গিয়ে বাঘটির ওপর পড়ল।
শুনতে পেলাম তিনি বলছেন, পুষি, একি বেয়াদবি হচ্ছে তোমার। সরে যাও, সরে যাও বলছি।’
কিন্তু সেই আদেশ বাঘটি মেনে নিল বলে মনে হল না। দেখলাম, তিনি আরও সরে এলেন খাঁচার কাছে। আমার দিকে তিনি পিছু ফিরে রইলেন, আর খাঁচার দেয়ালে লেপ্টে রইল তাঁর প্রশস্ত স্কন্ধ।
আবার তিনি ধমকে উঠলেন, ‘নির্বোধ জানোয়ার, একি দুষ্টুমি হচ্ছে। তোমার মালিককে চিনতে পারছ না বুঝি?’
আমার সেই মোহাচ্ছন্ন মগজেও চকিতে তাঁরই একদিনকার উক্তি মনে পড়ে গেল। বাঘটিকে দেখিয়ে সেদিন বলেছিলেন : এদের মত বিশ্বাসঘাতক আর রক্তলোলুপ প্রাণীর জুড়ি মেলা ভার। অবশ্য এ এখনও তাজা রক্তের স্বাদ পায় নি। যেদিন পাবে, সেদিন মানুষের কাছে প্রকাণ্ড বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াবে।
আজ সেই দিন এসেছে। আমার রক্তের আস্বাদ ইতিমধ্যেই সে লাভ করেছে। এখন আর এ নিরীহ গোবেচারাটি নেই―এতদিন পরে ব্যাঘ্রত্ব লাভ করেছে। অমিতবিক্রম চৌধুরীকে এবার নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
তিনি তখন রাগে চেঁচাতে শুরু করেছেন, ‘বেয়াদব, বেইমান! দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি আমি? দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি তোমাকে।’
কিন্তু কে কাকে মজা দেখায়। ভয়ে দিশেহারা হয়ে তিনি তখন এলোমেলো ছুটোছুটি করছেন, আর চাকরবাকরদের নাম ধরে কানফাটা আর্তনাদ শুরু করেছেন। বাঘটা তাঁর পিছু ধাওয়া করে চলেছে। থাবার আঘাতে জামাকাপড় ছিঁড়ে দিচ্ছে। কখনো বা এক-এক খাবলা মাংস তুলে নিচ্ছে। আর তিনি রক্তাক্ত কলেবরে পড়ে যাচ্ছেন, আবার উঠে দৌড়চ্ছেন। আমি নিমেষহীন নয়নে তাকিয়ে দেখছি সব। মগজে কিন্তু কিছুই ঢুকছে না―মগজটা যেন ফোঁপরা হয়ে গেছে।
সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে যেটুকু ভাসা ভাসা জ্ঞান ছিল তাতে দেখলাম, বাঘটা তার মালিকের বুকের ওপর বসে গপ্ করে একটা মরণ কামড় বসিয়ে দিল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
সেরে উঠতে বেশ কয়েক মাস সময় নিল। তবুও কি নির্দোষভাবে সেরে উঠতে পারলাম? একটা পা চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল। এরপর যতদিন বেঁচে থাকব, একটি যষ্টি আমার সারাক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকবে। কালো বাঘের সঙ্গে একই ঘরে একটি দুর্যোগের রাত যে কাটাতে বাধ্য হয়েছি, তারই পরিচয় দেবে হাতের যষ্টিটি।
পরে জানতে পেরেছি, অমিতবিক্রম চৌধুরীর প্রচণ্ড চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে চাকরবাকরেরা ছুটে আসে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দরজার লুকহোল দিয়ে তাকিয়ে তাদের চক্ষু স্থির হয়ে যায়। যার তত্ত্বাবধানে এতটুকু বয়েস থেকে লালিত-পালিত হয়ে আসছে, সেই খোদ মালিকেরই দেহের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে তাঁরই আদরের কালো বাঘ।
দরজার লুকহোল দিয়ে বাঘটাকে গুলি করে মারা হয়। অমিতবিক্রমের ছিন্নভিন্ন দেহটার সৎকার করা হয়। আর আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় খাঁচার ভেতর থেকে। বড় বড় ডাক্তার কলকাতা থেকে আনানো হয়। দেশের নামী শল্যচিকিৎসকেরাও এসে ভিড় করেন অমিতবিক্রমের বাড়িতে। যিনি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে তাঁরই বাড়িতে আমি ধীরে ধীরে সেরে উঠতে থাকি। প্রথম দিন চোখ খুলেই দেখতে পাই, সুদৃশ্য একটি ঘরে সুন্দরী নার্স এবং নামী ডাক্তার পরিবেষ্টিত হয়ে আমি শয্যায় শুয়ে আছি।
একদিন ঘরে যখন কেউ ছিল না, তখন অমিতবিক্রমের বিধবা পত্নী চুপি চুপি এসে হাজির হন আমার শয্যার পাশে। বিধবার বেশে থাকায় প্রথমে চিনতেই পারি নি তাঁকে। আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করছিলেন, আমি জেগে আছি কিনা। এ-বাড়িতে আসার পর থেকে যখনই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, তখনই তাঁর রণচণ্ডী মূর্তি দেখেছি। সেদিনই প্রথম এর ব্যতিক্রম দেখলাম। অমন অপরূপ মুখে শান্ত সমাহিত সুষমা দেখে চোখ দুটি জুড়িয়ে গেল। এটাই যেন তাঁর আসল রূপ।
আমার কপালে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই?’
আমি আস্তে ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। কারণ, তখনও আমার দুর্বলতা কাটে নি।
তিনি বললেন, ‘আর যাই বলুন, আপনিই এর জন্য দায়ী। আপনাকে প্রথম দিন থেকেই আমি তাড়াবার চেষ্টা করেছি। অপমান করেছি, গালাগাল দিয়েছি, যা খুশি তাই বলেছি। কিন্তু সেসব আপনি গায়েই মাখলেন না। আমার ওপর রাগ করে পালালে আজ কি আর এই দুর্দশা হত আপনার? অ্যাদ্দিন যে স্বামীরত্নটির সঙ্গে ঘর করেছি, তাঁকে কি আমার চিনতে বাকী ছিল? কালো বাঘের হিংস্রতা আপনি দেখেছেন। কিন্তু আমার স্বামীর নৃশংস ব্যবহার আপনি কখনো দেখেন নি। দেখলে বুঝতেন জগতে নিষ্ঠুরতম বিশ্বাসঘাতক কোন জীব যদি থেকে থাকে, তবে সে হচ্ছে আমার স্বামীই। এখন তিনি স্বর্গে গেছেন। তাই তাঁর সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছুই বলতে চাই না। আমি জানতাম, কেন তিনি আপনাকে চিঠি দিয়ে আনিয়েছেন। এও জানতাম, একবার যখন তাঁর কবলে পড়েছেন, তখন আপনার আর রেহাই নেই। তবু চেষ্টা করে দেখছিলাম, আপনাকে উদ্ধার করতে পারি কিনা। সরাসরি সব কিছু আপনাকে জানাতেও ভরসা পাচ্ছিলাম না। যদি একবার তাঁর কানে যায়, তবে আমাকে তাঁর পোষা বাঘ দিয়ে খাওয়াবেন। যাই হোক, আপনি আমার মস্ত বড় একটা উপকার করেছেন। এজন্যে চিরকাল আপনার কাছে ঋণী হয়ে থাকব। আমার স্বামী বাঘের হাতে না মরলে, চিরটা কাল আমাকে এভাবেই দগ্ধে দন্ধে মরতে হত। আপনি আমাকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, এজন্যে ধন্যবাদ। আর দেখুন, এমন ভুল ভবিষ্যতে আর যেন করবেন না।’
কথাগুলো বলে তিনি যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ঘুণাক্ষরেও জানতাম না যে, তাঁর সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। পরে শুনেছি, তিনি তাঁর বাপের বাড়ি চলে গেছেন।
একদিন দুদিন করে ছমাস কেটে গেল। শেষে ডাক্তার যেদিন জানাল যে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছি, সেদিন দারুণ মুষড়ে পড়লাম। কারণ, সুস্থ হওয়া মানেই কলকাতা ফেরা ; আর কলকাতা ফেরার অর্থই হচ্ছে পাওনাদারদের তাগিদে আবার অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা। কিন্তু উপায় নেই —কলকাতা ফিরতেই হল। ফিরেই যার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হল, তিনি হলেন আমাদের পরিবারের স্বনামধন্য উকিল বিমলবাবু।
বিমলবাবু আমাকে অভিনন্দন জানালেন।
তাঁর অভিনন্দনকে মস্করা ভেবে আমি বিরক্ত হলাম। আমার মনে ভয় ছিল। হয়তো আদালত থেকে আমার নামে শমন জারি করা হয়েছিল, সেকথাই তিনি জানাতে এসেছিলেন।
তিনি বললেন, ‘আর ভয় কি মশায়, আপনার তো বরাত খুলে গেছে।’
তবু আমি বিশেষ উৎসাহ পেলাম না।
কিন্তু যখন জানতে পারলাম, আমার অপুত্রক জ্যাঠার বিপুল সম্পত্তির আমিই একমাত্র উত্তরাধিকারী মনোনীত হয়েছি, তখন সত্যি আনন্দের কোন সীমা-পরিসীমা রইল না।
আমি নাকি বিগত ছ’মাস যাবৎ এই সম্পত্তির অধিকারী হয়ে রয়েছি। পাছে উল্লাসের আধিক্যে আমার সেরে ওঠায় বিলম্ব হয়, তাই এতদিন সব খবর চেপে রাখা হয়েছিল।
আমি যেদিন কালো বাঘের সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটাই, ঠিক সেদিনই জ্যাঠা মারা যায়। ব্যাপারটা কাকতালীয় বলে মনে হলেও আসলে তা নয়। অপুত্রক জ্যাঠা আমাকেই প্রথম এবং প্রধান উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। আমার অবর্তমানে অবশ্য সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে আমার দুরসম্পর্কীয় ভাই অমিতবিক্রম চৌধুরী। উইলের বিষয়বস্তু অমিতবিক্রম ভালভাবেই অবগত ছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে সম্পত্তির মালিক হবার কোন পথ খোলা না থাকায় তিনি আমাকে তাঁর পথ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সমস্ত বন্দোবস্ত তিনি পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে সইল না।
অমিতবিক্রমের বাড়িতে দৈনিক তিন-চারটি টেলিগ্রাম আসার অর্থ এতদিনে পরিষ্কার হল। বৃদ্ধ জ্যাঠার শারীরিক খবর বহন করেই যে সেই টেলিগ্রামগুলো আসত, একথা বলাই বাহুল্য। তাই বলে বৃদ্ধকে কিন্তু তিনি ভালবাসতেন না মোটেই ভালবাসতেন তাঁর সম্পত্তিকে। অমিতবিক্রমের চর সব সময়ই জ্যাঠার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। তারাই ঘন্টায় ঘন্টায় খবর দিত, যমের বাড়ির দিকে জ্যাঠা কতদূর এগোলেন।
যেদিন জ্যাঠা মারা গেলেন, সেদিন আমাকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলবার ব্যবস্থা হল। কিন্তু বিধাতার মর্জি ছিল অন্যরকম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরা থেকে তুলে নিয়ে আমাকেই বরং সম্পত্তি ভোগ করবার পথ নিষ্কন্টক করে দিলেন। সমস্ত কৃতিত্বই অবশ্য সেই কালো বাঘের।
তাই বলছিলাম, শেষে কিনা একটা কালো বাঘই আমার সকল দুঃখ-কষ্ট ঘুচিয়ে দিল। কালো বাঘকে আজও আমি আমার সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করি। আজও আমার শয়নঘরে কালো বাঘের পাথরে খোদাই করা একটি মূর্তি সব সময়ই রক্ষিত থাকে। এখন আমি রোজই তার সঙ্গে একই ঘরে রাত কাটাই।