কালো বরফ, জাতির জীবনের কালো দিনের কথা
মাহমুদুল হক ততো পরিচিত নন এদেশে। তিনি বাংলাদেশের লেখক। এখন বেঁচে নেই। তিনিও হাসান আজিজুল হকের মতো এপারের মানুষ, পারটিশনের পর তাঁদের পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এই বই সেই দেশভাগের বিষ-বেদনা ধারণ করে আছে নীলকন্ঠের মতো।
আসলে আমরা চলে এসেছিলাম, ওঁরা চলে গিয়েছিলেন। আমরা মানে আমার বাবা কাকারা, আমার দাদা, এঁরা ছেড়ে এসেছিলেন এজাহার শানা, মোজাহার শানা, কুলছুম, ময়রম…কাল ভৈরব, চণ্ডী মণ্ডপ, বাগান পুকুর, প্রতিবেশীজন। ওঁরা ছেড়ে গিয়েছিলেন বারাসত, হাতিপুকুর, শেঠপুকুর, কাজীপাড়া, ছবিদি, টুকু, কেনারামকাকা, নির্মলকাকা…। জাতির ভবিতব্য যা ছিল তাই ঘটেছিল। আর সেই মিলিত শোক এত বছরেও কাটেনি। মিলিয়ে যায়নি। তাই এখনো দেশ বিভাগ নিয়ে কথা হয়। লেখক তাঁর শোকের কথা রেখে যান তাঁর রচনায়। আমার মা ২০০৪-এ চলে গেছেন, ১৯৪৭ থেকে এতটি বছর দুঃখ নিয়ে বেঁচেছেন। তিনি সেই কপোতাক্ষ, বড়দলের স্টিমারঘাটা, ধুরোল সাতক্ষীরে আর বাঁকা-ভবানীপুর গ্রামের কথা বলেই গেছেন। তাঁর কাছে শুনে শুনে আমি চিনেছিলাম আমাদের ফেলে আসা মাটি আর দেশ। মা রাধারানির বেদনাকেই উত্তরাধিকার সূত্রে ধারণ করেছি আমি। সদ্য ঘুরে এসেছি মায়ের বাপের বাড়ি, আমার মাতৃকুলের দেশ, সেই গ্রাম, মজে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ, টের পেয়েছি কীভাবে আমরা ধারণ করি সমস্ত বেদনার ভার। দেশ ভাগের সময়কাল যত দীর্ঘ হচ্ছে, দেশ ভাগের কথা ততো উঠে আসছে এই কালের লেখকদের লেখায়।
কালো বরফ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। তখন পূর্ব পাকিস্তান নেই। যে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল তারা, সেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ওপারের বাঙালি নিজের দেশ পেয়েছে কুড়ি বছরের উপর, কিন্তু তখনো বুঝি যায়নি পুরাতন শোক, তাই তাঁকে সেই শোকের কথা লিখে যেতে হয় অত বছর পরে। ‘কালো বরফ’ হল সেই শোকগাথা যা ক্রমাগত পাঠই হয়ে যাবে। আমি বছর দশ আগে প্রথম পড়ি, আবার পড়ি এখন। আমি সেই প্রথম পাঠকে ভুলিনি, দ্বিতীয় এই পাঠও আমার কাছে নতুন হয়ে এসেছে। আমি এখনো শুনতে পাচ্ছি রাত গভীরে ঘাটের পর ঘাট পার হয়ে গেছে স্টিমার, দেশ জুড়ে বিদায়ঘাট, তারপাশা, ভাগ্যকুল, ষাটনল, লৌহজং-তোদের আমি মারব, তারপাশা তোকে আমি মারব, ভাগ্যকুল তোকে আমি মারব, নদী তোকে আমি মারব…। আবার তো এও শুনেছি তারপাশা, ভাগ্যকুল, গোয়ালন্দ, ধুরোল, সাতক্ষীরে, কপোতাক্ষ, তোদের জন্য আমি কাঁদব। কাঁদব। সেই ক্রন্দনধ্বনি এখনো শোনা যায়। আমি ‘কালো বরফ’ পড়তে পড়তে আবার শুনতে পেয়েছি সেই কান্না। রাত দুপুরে আব্দুল খালেক কাঁদছে একা অন্ধকারে। তার বউ রেখা টের পেয়েও তাকে কাঁদতে দেয়। আসলে দেশভাগ তো নয়, মানুষের অন্তরটাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হৃদয় জোড়া লাগে না। লাগেনি এতবছরেও। ‘কালো বরফ’ সেই কাহিনি যেমন, তেমনই দুই নিরূপায় মানুষের কাহিনিও। আব্দুল খালেক ও রেখা। রেখার মা বাবা ছিল না, মামার বাড়ি লাথি-ঝেঁটা খেয়ে মানুষ। সে আব্দুল খালেকের সংসারে এসে শুধুই অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। স্বামী স্বাভাবিক নয়, রোজগেরে নয় তেমন। তার কলেজ অ্যাফিলিয়েশন পায়নি। কলেজ থাকবে না সেটি আলুর গুদাম হয়ে যাবে, তার ঠিক নেই। মন মরা হয়ে থাকে সব সময়। আব্দুল খালেক — পোকার কিছু একটা হয়েছে, কী হয়েছে তা রেখা জানে না। আন্দাজও করতে পারে না যে তার স্বামী ছেড়ে আসা শৈশব আর গ্রামের শোক ধারণ করে আছে এত বছর ধরে। সে এদিক থেকে ওদিকে যায়নি, কিন্তু সে ছিল নিরালম্ব এক মানবী। সেই ছোটবেলা থেকেই। সেই নিরালম্বতা তাকে ভীত করে। উদাসীন আর সতত অন্যমনস্ক স্বামীকে দেখে তার ভয় হয়, সে কি অন্য কোনো নারীর প্রেমে পড়েছে ? সে বাজার থেকে ডেকে আনে নরহরি ডাক্তারকে। ডাক্তারের চেম্বারে বসে সে সময় কাটায়, ডাক্তার জানতে পারে হয় তো। তার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তার স্বামীর, সে বুঝতে পারে না, সন্দেহ হয় তার…।
আসলে শিকড় তো অনেক গহীনে। সেখানে প্রবেশ করবে কী করে রেখা? সে ছিল নিরূপায় নিরালম্ব এক মানবী, খালেকও কি তাই নয়? খালেক-পোকার রক্তে যে শৈশব রয়েছে তাকে সে এড়াতে পারে না। তাকে সে ভোলেনি। টিপু ভাইজান, মনি ভাইজান, ছবিদি, ইস্কুল, পা ভাঙ্গা শালিক… কী অপূর্ব এক শৈশব এঁকেছেন মাহমুদুল হক। সেই শৈশবই খেয়েছে তার প্রাণমন। সেই ফেলে আসা গ্রাম, মানুষজন। ১৯৪৭-এর কথা তা। তখন বালকের বয়স আট হবে বড় জোর। ক্লাস টু। তার দাদা টিপু কলেজে ভর্তি হয়েছে। মনি ভাইজান ক্লাস নাইন হবে কি? সেই বালকের অমল শৈশবই এই উপন্যাসের আধার। এই উপন্যাসের প্রাণ। ছোট ছোট এমন অনুষঙ্গে ভরে আছে এই উপন্যাস যে পড়তে পড়তে বুক মুচড়ে যায়। দেখতে পাই আমার জন্মের আগের পৃথিবী। এই উপন্যাস তো আমাকে জাতিস্মর করে তোলে। দেখতে পাই সেই সময়কে। সেই যে বালক, পোকা যার ডাক নাম, মানে যে নামে তাকে ডাকত তার আব্বার বন্ধু, গ্রাম সম্পর্কে কাকা কেনারাম, যে কাকার হাত ধরে সে হাতি পুকুর চেনে, শেঠ পুকুর চেনে, সেই যে ছবিদি, পুঁটি নামের আলতা পায়ের মেয়েটি, যে অদ্ভুত সব কথা বলত, মাছের কথা, পাখির কথা, গাছের কথা বুঝতে পারত, গাছের গোড়ায় জল ঢেলে বলত, ‘গাছভাই গাছভাই, এই দ্যাখো আমি তোমার গোড়ায় এক ঘটি জল দিলাম, আমার যেন খুব ভাল বর হয়, নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে, একটা ডালপালাও তোমার আস্ত থাকবে না।’
তিনি এঁকেছেন ৪৭-এর আগের যে পৃথিবী, সেই পৃথিবীতে হিন্দু মুসলমান দুটি আলাদা সত্তা যেন ছিলই না। হিন্দু মুসলমানের হৃদয়ের অভিন্নতাই ছিল সেই অপূর্ব শৈশবের যাদু। আর তা ক্রমশ ভেঙে যেতে থাকে পাকিস্তানের জন্ম হতে থাকায়। সেই ইতিহাস আমাদের জানা। অনেক রাজনৈতিক কচকচি আছে। সেই কুৎসিত রাজনীতির ভিতরে প্রবেশ করেননি লেখক। তিনি একটি সাধারণ পরিবার সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। অতি সাধারণ হয়েছে সেই পোকা, আব্দুল খালেক। গ্রাম ছেড়ে পরিবারটি যখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, পাকিস্তানের দিকে রওনা হচ্ছে, তখন মণি ভাইজান ট্রাকে না উঠে দৌড় লাগায় পোকাকে নিয়ে। কোথায় গেল তারা, ছবিদের বাড়ি। ছবি পোকার দিদি রানিবুবুর বন্ধু। হা হা করে ওঠে বুক। হায় রে কে জানত মণি ভাইজান ভালবাসত যে মেয়েটিকে, তাকে এই জীবনের মতো, সমস্ত জীবনের মতো ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ছবি তুই আমারে কিছু দে? কী দেবে ছবি মনিকে। মাথার লাল ফিতে খুলে দিল, চুলের কাঁটা, ক্লিপ—তাই নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মনি ভাইজান পোকাকে নিয়ে ফিরল পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করা সেই ট্রাকের কাছে। মনি ভাইজান তার দুঃখকে ভোলেনি। সেই যে পদ্মার ভিতরে অন্ধকারে দূর অনিশ্চিত—পাকিস্তান যাত্রা, তারপাশা, ভাগ্যকুল, গোয়ালন্দ—ঘাটে ঘাটে দাঁড়ানো, বিদায় ঘাটে ঘাটে দাঁড়ানো, মণির হাতে লাল ফিতে, চুলের কাঁটা, ক্লিপ—লুকোন কান্নায় মুচড়ে যাচ্ছে সে। মণি পরে কটি ঘুমের বড়ি খেয়ে মরেছিল। টিপু আছে সৌদি আরবে। রানি বুবুর সুখের সংসার। খালেক মানে সেই পোকা, সত্যিকারের পোকার মতো বেঁচে আছে। হিন্দুস্তান পাকিস্তান, সেই দেশভাগ নিরূপায় সাধারণ মানুষের জীবনকে যে ভাবে নষ্ট করেছিল, এই উপন্যাস সেই কথা উচ্চারণ করেছে। একেবারে সাধারণ মানুষের কথা, না কোনো রাজনৈতিক কার্যকারণ সূত্র, তত্ব এখানে নেই, আছে শুধু সাধারণ মানুষের জীবনের বেদনার কথা, যে কথার খোঁজ রাখেননি আমাদের দেশ নায়করা। এই উপন্যাসে আছে সরল জীবন জটিল হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত। আছে ক্রমে সঞ্চারিত ভয়ের বৃত্তান্ত। হ্যাঁ, মাহমুদুল হকের উপন্যাস পড়ে আমার মনে জেগে উঠছে রাজনৈতিক সেই সিদ্ধান্তের প্রতি চরম ঘৃণা। আসলে সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবেন না কখনো। এখনো না। আমাদের এত বছরের স্বাধীনতা হলো উচ্ছেদের সত্তর বছর। ভিটে হারানোর সত্তর বছর।
এই উপন্যাসের সময় সেই ১৯৪৭-এর শৈশব আর হয়তো গত শতাব্দীর ৮০-র দশক। স্বাধীনতা এসেছে, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, কিন্তু সমাজের অসুখটা তো যায়নি। নরহরি ডাক্তারের হতাশা থেকে তা ধরা যায়। মালাউন—বলে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বাজারে তারই প্রতিবেশী। আব্দুল খালেকের কলেজ উঠেই যাবে। তার মনের ভিতরে সেই শৈশব পাহাড় হয়ে থাকে। সেই যে মাধুরী-মাধু নামের বিধবা বউটির হাতে অসুস্থ হয়ে পড়া স্যাকরা নগেন নিয়েছিল আশ্রয়, সামান্য সেই স্যাকরার প্রেম হয়েছিল ঘুটে কুড়ুনি কাঠ কুড়ুনি মাধুর সঙ্গে। স্যাকরার ছিল ক্ষয় রোগ। স্যাকরা ভালবেসেছিল তাকে। স্যাকরাকেও ভালবেসেছিল সে। কী অপূর্ব সেই প্রেম দেখেছিল বালক। স্যাকরার অন্তিম অবস্থা আর তাকে বাঁচিয়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা, মণি ভাইজানের হাত ধরে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কিছু করতে পারলাম না, ইচ্ছে ছিল! আমি কি কিছু চেয়েছি! বুক ফেটে যায়, ও বাবা গো।’ মণি ভাইজানের ছিল নরম প্রাণ। সে বাড়ি থেকে পাঁচ টাকা চুরি করে এনে মাধুরীর হাতে দিয়েছিল নগেন স্যাকরাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সেই মাধু, মাধুরীকে ভোলেনি পোকা—আব্দুল খালেক। সেই প্রেমের কথাও ভোলেনি। সে আর রেখা বেরিয়েছিল একটি নৌকো নিয়ে। হয় তো যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের তার সাথে দেখা হবে, সেই আশায়। তাদের প্রেম যেন ফুরিয়ে যাচ্ছিল। শৈশবে সব হারানোর বেদনা তাকে অধিকার করে ফেলেছিল। “সেসব কত কথা। ইচ্ছে করলেও এখন আর মনে পড়ে না। কতো কথা, কতো চার ভাঁজ করা ছবি, তেশিরা কাচ, লালকুঁচ, কতো সকাল–দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা! কখনো মনে হয়নি, একদিন সব কিছুর আবার খোঁজ পড়বে নতুন করে। বড় অবহেলা ছিল পোকার, বড় অবহেলা। অযত্ন আর হেলাফেলায় কতো কিছুই যে সে হারিয়ে ফেলেছে!…।” কী অপূর্ব এক নদীপথে স্বামী স্ত্রীর যাত্রায় এই উপন্যাস তার অন্তিমে পৌঁছয়। বিল, গাঙ, সেই পদ্মার ঘোলা জলের কাছে পৌঁছন। এক জায়গায় নৌকো ভিড়িয়ে তারা বনের ভিতরে নেমে যায়…। মিলিত হয় ভালবাসায়। গলায় হাত দিয়েও হাত সরিয়ে নিয়ে এসেছিল পোকা। তারপর নদীতে সাঁতের কেটে দুজনে ফিরে আসে নৌকোয়। মৃত মণি ভাইজানের কথা শুনতে চায় রেখা—পোকার প্রেমের মাধুরী। রেখার প্রতি আব্দুল খালেকের প্রেম কতটা নিবিড়, সেই নিরূপায় প্রেমিক-প্রেমিকা, স্যাকরা আর মাধুর যেমন ছিল, তেমনি হয়ে ওঠে অতি অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। পোকা, আব্দুল খালেক ডাকে তাকে মাধুরী নামে। ফিরে আসে সেই নিবার্সনের শৈশব। ভাগ্যকুল, তোকে আমি মারব, তারপাশা, তোকে আমি মারব, নদী, তোকে আমি মারব। মারবে, সেই ভাগ্যকুল, তারপাশাই তো তাকে এই জীবনব্যপী নিবার্সনে এনেছে যেন। এই উপন্যাস অনন্ত এক অশ্রুপাতের। যে অশ্রুপাত আমি আমার ছোটবেলা থেকে দেখেছি আমার মায়ের ভিতরে। যে অশ্রুপাত থামেনি। থামবে বলে মনে হয় না। জন্ম-জন্মান্তরে প্রবাহিত হয়ে যাবে। যাবেই।
উপন্যাসটি দেশভাগের বেদনা, দেশভাগে সবর্স্ব হারানো মানুষের হৃদয় বৃত্তান্ত। নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে বা মানুষের ঘরবাড়ি (অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়), কিংবা কেয়াপাতার নৌকা (প্রফুল্ল রায়) উপন্যাসের মতো বৃহৎ নয়। অতি ক্ষীণকায়, কিন্তু অনুভবে সমগোত্রীয়। লিখনে আলাদা। অতি আধুনিক এক লিখন শৈলী এর পরতে পরতে। বইটিকে আমি ঘুরে ঘুরে পড়ি। আবার পড়লাম।