কালোমেয়ে – ৮

৮.

নানার শরীর খারাপ থাকায় আসিয়া ছুটি শেষ হওয়ার চার দিন পর ঢাকায় ফিরল। রুমমেট কুলসুম বলল, কলেজ খোলার পর একদিন ফরিদা তোর খোঁজে এসেছিল। আর সৈকত নামে একটা ছেলে তো প্রতিদিন আসে। আজও কিছুক্ষণ আগে এসেছিল। তা তোর ফিরতে দেরি হলো কেন?

আসিয়া নানার অসুখের কথা বলে জিজ্ঞেস করল, সৈকত কিছু বলে যায়নি?

: বললেন, আসিয়া না আসা পর্যন্ত আপনাকে বিরক্ত করব, কিছু মাইণ্ড করবেন না। কে রে ছেলেটা? দেখতে কিন্তু দারুণ।

: সৈকত এ বছর ফোর্থ ইয়ারে পরীক্ষা দিয়েছে। এমনি একদিন পরিচয় হয়েছিল। তাই কোনো দরকারে হয়তো এসেছিল। সৈকত দেখতে অবশ্য খুবই সুন্দর। তা তুই লাইন দেবার চেষ্টা করতে পারতিস।

: মনে যে হয়নি তা নয়; তবে ভাবলাম, তোর সঙ্গে হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে। তাই চেষ্টা করিনি।

: এই কালো পেত্নীর দিকে কে নজর দেবে বল। তুই চেষ্টা করে দেখতে পারিস।

: কিন্তু তার হাবভাব দেখে মনে হলো, সে তোর বিরহে ছটফট করছে।

: তাই নাকি? কী জানি হয়তো হবে। তবে আমার সঙ্গে তার সে রকম সম্পর্ক নেই। যাকগে, বাদ দে ওসব কথা।

পরের দিন লাস্ট ক্লাস চলার সময় আসিয়া সৈকতকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবল, আমার ফিরতে দেরি হতে সৈকত খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

ক্লাস শেষ হবার পর আসিয়া তার কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?

সৈকত সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর আবার বলল, এখানে আর কোনো কথা নয়, এস আমার সঙ্গে, এই কথা বলে গাড়ির দিকে এগোল।

দু’জনে গাড়িতে উঠার পর সৈকত জিজ্ঞেস করল, ফিরতে দেরি করলে কেন?

আসিয়া নানার অসুখের কথা বলল।

: জান, মা তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য বলেছে, তাই এই কয়দিন হোস্টেলে প্রতিদিন খোঁজ নিতে গেছি।

: তা হলে মায়ের কথাতেই গেছ, নিজের ইচ্ছায় যাওনি?

: তুমি যা ভাবছ তা নয়। মুখ থেকে হঠাৎ মায়ের কথাটা বেরিয়ে গেল।

: এখন কি তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছ?

: হ্যাঁ, কেন, তোমার কি আপত্তি আছে?

: আপত্তি থাকবে কেন, চল।

বাড়িতে পৌঁছে সৈকত আসিয়াকে ড্রইং রুমে বসিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, তুমি যে মেয়েটাকে নিয়ে আসতে বলেছিলে, তাকে নিয়ে এসেছি।

হেমা বললেন, ওমা তাই নাকি? কোথায় বসিয়েছিস তাকে?

: ড্রইং রুমে।

: ঠিক আছে তুই যা, আমি আসছি।

: বাবা নেই?

: না এখনও ফিরেনি।

সৈকত আর কিছু না বলে ড্রইংরুমে এসে আসিয়াকে বলল, বাবা নেই, মা আসছে।

কয়েক মিনিট পরে হেমা এসে ড্রইংরুমে ঢুকলেন।

আসিয়া দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কদমবুছি করার জন্য এগিয়ে গেল।

আসিয়া রুমে ঢুকে মুখের কাপড় সরিয়ে দিয়েছিল। হেমা তার মুখের দিকে চেয়ে খুব অবাক হয়ে ভাবলেন, কালো মেয়ে অনেক দেখেছি; কিন্তু এত কালো। কখনো দেখিনি। হেমা শিক্ষিত মেয়ে, তাই মনের ভাব বাইরে প্রকাশ না করে ভালো মুখে সালামের উত্তর দিয়ে তার হাত ধরে বললেন, থাক মা থাক, সালাম করতে হবে না, বস।

আসিয়া বসার পর সৈকত মাকে বলল, তুমি ওর সঙ্গে কথা বল, আমি একটু আসছি। এই কথা বলে সে ভিতরে চলে গেল।

হেমা আসিয়াকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যখন জানতে পারলেন, এ তার ননদ রাবুর মেয়ে তখন চমকে উঠলেন। আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করলেন, সৈকত এই মেয়েকে কী করে পছন্দ করল? একে-তো মেয়েটা ভীষণ কালো, তার উপর রাবুর মেয়ে। সে কথা ওর বাবা শুনলে রেগে গিয়ে কোনো অঘটন না। ঘটিয়ে ফেলে? সৈকতকে সাবধান করে দিতে হবে।

এমন সময় সৈকত এসে মাকে উদ্দেশ করে বলল, তোমাদের আলাপ শেষ। হয়েছে?

হেমা গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে। আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে তারপর তোরা যাবি। কথা শেষ করে তিনি চলে গেলেন।

মা চলে যাবার পর সৈকত আসিয়াকে বলল, মা তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে?

আসিয়া বলল, হ্যাঁ করেছেন। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, উনি আমাদের সবাইকে চেনেন। আচ্ছা, সেদিন তোমার বাবার নাম ফায়জুর রহমান বলেছিলে না।

: হ্যাঁ।

: আসিয়া চমকে উঠে বলল, তুমি তো তোমার বাবার দেশের বাড়ির সব খবর জান না, তোমার মায়ের কাছ থকে জেনে নিয়ে দু’একদিনের মধ্যে আমাকে। জানাবে।

: কেন বল তো?

: যখন জানাবে তখন বলব। প্লিজ এখন কোনো কথা জিজ্ঞেস কর না। বলতে পারব না, সে জন্য মাফ চাইছি। এবার চল উঠা যাক।

সৈকত বুঝতে পারল, মা হয়তো এমন কিছু বলেছে যা শুনে আসিয়া দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু বাবার নাম শুনে চমকে উঠল কেন? বাবার দেশের বাড়ির খবরই বা জানতে চাইল কেন?

এমন সময় আয়া নাস্তা নিয়ে এলে সৈকত বলল, নাস্তা খেয়ে নিই, এস, যেতে যেতে কথা বলা যাবে। তারপর নাস্তা খেয়ে বলল, চল তোমাকে পৌঁছে দিই।

গাড়ি চালাতে চালাতে সৈকত বলল, মা কি তোমাকে তেমন কিছু বলেছে?

: না, তবে তিনি আমাকে দেখে খুশি হননি।

: তোমাকে তো বলেছি, মা-বাবার কথা আমি চিন্তা করি না। তোমার জন্য কী করি না করি, সময় মতো জানতে পারবে।

: একটা কথা মনে রেখ, আল্লাহ ও রসুল (দঃ)-এর পরে মা-বাবার স্থান, তাদের মনে কষ্ট দিতে আল্লাহ ও রসুল (দঃ) কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

সন্তান হিসেবে যা কর্তব্য, ইনশাআল্লাহ তা পালন করতে ত্রুটি করব না। তবে তুমিও মনে রেখ, যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে আমি তোমাকে পেতে চাই। ওয়াদা কর, আমার জন্য অপেক্ষা করবে?

আসিয়া তার প্রতি সৈকতের ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, বেশ ওয়াদা করলাম, তোমার জন্য আমি আজীবন অপেক্ষা করব।

ততক্ষণে তারা হোস্টেলের গেটে এসে পৌঁছে গেছে। আসিয়া গাড়ি থেকে নেমে বলল, তোমাকে যে কথাগুলো জানার জন্য বললাম, মনে থাকবে?

সৈকত বলল, থাকবে। কালকের মধ্যেই জেনে নিয়ে জানাব।

আসিয়া সালাম বিনিময় করে আল্লাহ হাফেজ বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

সৈকত মগবাজারে মনোয়ারা ক্লিনিকে এল। বন্ধু জহির কয়েক দিন কলেজে আসেনি। তাই আজ তাদের বাড়িতে ফোন করে জানতে পারে, সে অসুস্থ হয়ে মনোয়ারা ক্লিনিকে আছে। তার বেডের কাছে গিয়ে সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, কিরে তোর কী এমন হয়েছে যে, এখানে রয়েছিস?

জহির বলল, তেমন কিছু হয়নি। বস বলছি। হঠাৎ একদিন নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। আব্বা-আম্মা ভয় পেয়ে এখানে নিয়ে এল। এত করে বললাম, অনেক সময় পিত্ত থেকে কোনো কারণে এরকম বের হয়। তারা আমার কথা বিশ্বাসই করল না। যাক, তোর আসিয়ার কথা বল, কতদূর এগোলি?

: আমরা শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। ভাবছি, ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব। তোকে একটা সুখবর দিচ্ছি, ফরিদার ভুল আমি ভাঙিয়ে দিয়েছি। আমরা ধারণা এবার সে নিজেই তোর দিকে এগোবে।

: তোর ধারণাই ঠিক। এর মধ্যে সে একদিন এসে দেখে গেছে।

সৈকত আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, সত্যি। বলছিস?

জহির বলল, হ্যাঁ সত্যি বলছি। আবার বলল, এই কয়েক মাসের মধ্যে তোর কিন্তু অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দিন দিন ধর্মিক হয়ে উঠছিস।

: জানিস তো কার সংস্পর্শে এসেছি। সত্যি দোস্ত, আসিয়া দেখতে কালো হলে কী হবে, সে পরশ পাথর। তার কাছে যে আসবে সেই মানিক হয়ে যাবে।

: কই একদিনও তো পরিচয় করিয়ে দিলি না?

: তার কাছে পৌঁছাতে আমারই এতদিন সময় লাগল। তুই সেরে উঠ, এবার পরিচয় করিয়ে দেব। এখন আসি তাহলে?

: আবার আসিস। ও নিশ্চয় আসব, বলে সৈকত সালাম বিনিময় করে চলে এল।

সৈকত আসিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর ফায়জুর রহমান ফিরলেন।

হেমা স্বামীকে চা-নাস্তা দিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, কীভাবে আসিয়ার কথাটা তুলবেন।

ফায়জুর রহমান স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার, কিছু বলছ কেন? মনে হচ্ছে, কিছু যেন চিন্তা করছ?

: হ্যাঁ করছি।

: আমাকে বলা যাবে না?

: বলতে তো হবেই; কিন্তু শুনে যদি তুমি খুব রেগে যাও?

ফায়জুর রহমান হেসে উঠে বললেন, অবশ্য আমার রাগ একটু বেশি। তবে তোমার উপর কোনোদিন রাগারাগি করেছি বলে তো মনে হয় না।

: তা অবশ্য ঠিক। তবে এই ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে নয়, সৈকতকে নিয়ে।

: সৈকত কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। সে সেরকম ছেলেই নয়।

: তা আমি ও জানি। কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের সবাইয়ের সঙ্গে জড়িত।

: তাহলে চিন্তা না করে বলে ফেল।

হেমা প্রথমে সৈকত ও আসিয়ার সম্পর্কের কথা বললেন, তারপর আসিয়া যে খুব কালো সে কথা বলে তার সম্পূর্ণ পরিচয় বললেন।

ফায়জুর রহমান কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। ততক্ষণে নাস্তা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়েছিলেন। কাপটা নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আসিয়ার পরিচয় জানলে কেমন করে?

হেমা স্বামীর গম্ভীর স্বর শুনে বুঝতে পারলেন, ভীষণ রেগে গেছে। বললেন, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? রেগে না গিয়ে আমাদের সৈকতকে আসিয়ার কাছ থেকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবতে হবে। একদিন ফরিদার কথা তুলে সৈকতের মতামত জানতে চেয়েছিলাম। বলল, ফরিদাকে সে নিজের ছোট বোন মনে করে। সেইদিন সে বলেছিল, আসিয়া নামে একটা মেয়েকে তার পছন্দ। আমি তাকে একদিন আনতে বলেছিলাম। আজ সৈকত আসিয়াকে নিয়ে এসেছিল। আসিয়ার মুখেই তার পরিচয় জেনেছি।

ফায়জুর রহমান বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে চুপ করে থেকে রাগ সামলালেন। তারপর বললেন, জান হেমা, যে বিষের জ্বালায় আমি নিজের জন্মভূমি গ্রামকে ছেড়ে এসেছি, আমার বাবাকে ছেড়েছি, সেই বিষ সৈকত পান করতে যাচ্ছে। না-না, তা কখনো আমি হতে দেব না। সৈকতকে আমি ঐ বিষ পান করতে কিছুতেই দেব না। তুমি আসিয়াকে কিছু বলেছ না কী?

: না বলিনি। রেগে গেলেও নাস্তা খাইয়ে বিদায় করেছি।

: খুব ভালো করেছ। আচ্ছা, আসিয়া কি আমাদের পরিচয় বুঝতে পেরেছ?

: তা আমি কী করে বলব? তবে আমার মনে হয়, পারেনি।

: সৈকত কোথায়? ও আসিয়াকে পৌঁছে দিতে গেছে।

: ফিরে এলে তাকে ঐ পথ থেকে সরে আসতে বলবে। যদি রাজি না হয়, তাহলে আমাকে জানাবে। বলার আমি বলব।

: ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কর না। আমি তোমার কথা বলে বুঝিয়ে বললে, সৈকত নিশ্চয় নিজের ভুল বুঝতে পারবে।

: কিন্তু ও তো আবার খুব নীতিবাগীশ। বলে দেখ, কী বলে। তাকে একটা কথা জানিয়ে দিও, আমি বেঁচে থাকতে আসিয়াকে গ্রহণ করব না।

সৈকত ফেরার পর হেমা ছেলের রুমে এলেন।

সৈকত বুঝতে পারল, মা নিশ্চয় আসিয়ার কথা বলতে এসেছে। তাই নিজেই আগে বেড়ে বলল, আমি তোমার কাছে একটা কথা জানার জন্য যাব ভাবছিলাম।

: কী জানতে চাস?

: বাবার সম্পূর্ণ পরিচয় জানতে চাই।

: কেন?

: কেন আবার, বাবার পরিচয় জানা কি ছেলের উচিত নয়?

হেমা চিন্তা করলেন, বলাই উচিত। সবকিছু জানার পর আসিয়াকে ঘৃণা করে তার কাছ থেকে নিজেই সরে আসবে। আমাকে আর কিছু বলতে হবে না। হেমা স্বামীর পুরো হিস্ট্রি বলে ছেলের মনোভাব বোঝার জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সৈকত এতক্ষণ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে শুনছিল। তার বলা শেষ হতে মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল, আল্লাহ পাকের কী কুদরত, বাবা যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আল্লাহ পাক সেই সম্পর্ক আবার জুড়ে দেবার জন্য আমার ও আসিয়ার মধ্যে প্রেমের বীজ বুনে দিয়েছেন। তার মন আনন্দে ভরে উঠল। মনে মনে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করল।

হেমা ছেলের মুখে ঘৃণা বা রাগের চিহ্নের বদলে আনন্দের ছাপ দেখে রাগের সঙ্গে বললেন, এরপর আসিয়ার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবি না।

সৈকত বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন? আসিয়ার পরিচয় জেনে তো আমাদের সবাইয়ের খুশি হবার কথা? এতদিন পরে দাদা, দাদি ও ফুপিকে আমি পাব। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে মা, তা তোমাকে বোঝাতে পারছি না। তুমি খুশি হওনি?

হেমা রাগের সঙ্গেই বললেন, না। আসিয়ার পরিচয় তোর বাবাকে বলেছি। শুনে খুব রেগে গেছে, সেও আসিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখতে তোকে নিষেধ করেছে।

: এ তুমি কী বলছ মা?

: হ্যাঁ, যা বললাম, তা সত্য। আমিও তোর বাবার সঙ্গে একমত। তুই যদি আমাদের নিষেধ না শুনিস, তা হলে তোকে আমরা ক্ষমা করব না।

: কিন্তু মা, এখানে আসিয়ার অপরাধ কোথায়? সে তো এইসব জেনে আমাকে ভালোবাসেনি। যে কালো বলে প্রথম দিকে আমার সঙ্গে মিশতে চায়নি। আমি তাকে ভালোবেসে কাছে টেনেছি। সব থকে বড় কথা, পূর্ব পুরুষদের জন্য সে কেন অপরাধী হবে?

: দেখ, তুই বড় বেশি কথা বলছিস। আমি ও তোর বাবা চাই না, আসিয়া এ বাড়ির বউ হয়ে আসুক। ঐ কালো মেয়েকে নিয়ে আমরা সমাজে মুখ দেখাব কী করে? আর তুইও কী পারবি, বউকে নিয়ে সমাজে মিশতে? আমি তোর মা হয়ে বলছি, তুই আসিয়াকে ভুলে যা। ওর সাথে আর মেলামেশা করবি না। কথা শেষ করে তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।

সে রাতে সৈকত অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারল না। তার কী করা উচিত চিন্তা করতে লাগল। শেষে ভেবে ঠিক করল, কাল আসিয়াকে বাবার পরিচয় দিয়ে দেখব, সে কী বলে। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।

পরের দিন কলেজ ছুটি হবার পর সৈকত আসিয়ার সঙ্গে দেখা করে বাবার পরিচয় বলে অপেক্ষা করতে লাগল কী বলে শোনার জন্য।

আসিয়া শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, প্রথম যেদিন তুমি তোমার পরিচয় কিছুটা বলেছিল, তখন আমার এই রকম সন্দেহ হয়েছিল। কারণ, তোমার বাবার, মানে আমার মামার কথা মায়ের কাছে অনেক আগে কিছু কিছু শুনেছিলাম, এবারে গ্রামে যাবার পর নানা যখন বললেন, আমর পাত্র দেখেছেন এবং তারা আমাকে দেখার পর বিয়ের দিন ঠিক হবে তখন আমি নানাকে তোমার কথা বললাম। নানা তোমাকে নিয়ে যেতে বললেন। তারপর কেন কী জানি, নিজের থেকে মামার সব কথা বললেন। মামা যে ব্যবসা করে ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন তাও বললেন। সেই থেকে তোমার বাবার সম্পূর্ণ পরিচয় জানার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। তাই সিওর হবার জন্য ঢাকায় ফিরে তোমাকে তোমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করি এবং তোমার বাবার। সম্পূর্ণ পরিচয় আমাকে জানাতে বলি। তারপর হাসতে হাসতে বলল, এখন। নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমি তোমার ফুপাত বোন আর তুমি আমার মামাত ভাই?

এইসব জেনে আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি। তুমি হওনি?

সৈকত কিছু না বলে চুপ করে তার মুখের দিকে চেয়ে মায়ের কথা চিন্তা করতে লাগল।

আসিয়া তার চিন্তিত মুখের দিকে চেয়ে বলল, পরিচয় পাবার পর আমার প্রতি তোমার ঘৃণা হচ্ছে না কি?

: এ কথা তুমি বলতে পারলে? আগেই তো বলেছি, কোনো কিছুর বিনিময়েও তোমাকে হারাতে পারব না। আমার পরিচয় পেয়ে তুমি কতটা খুশি হয়েছ জানি না, আমি কিন্তু তোমার থেকে অনেক বেশি খুশি হয়েছি।

: তা হলে মুখ গোমড়া করে রয়েছ কেন?

সৈকত ভেবে এসেছে, মা-বাবার কথা এখন আসিয়াকে জানাবে না। তার আগে যেমন করে হোক দাদা-দাদির উপর মা-বাবার রাগ ঠাণ্ডা করাবে। তারপর আসিয়াকে বিয়ে করে সবকিছু জানাবে। তাই আসিয়ার কথা শুনে হেসে উঠে বলল, কোথায় মুখ গোমড়া করে আছি? চল, আজ এই খুশির কারণে তোমাকে চাইনিজ খাওয়াব।

আসিয়াও হেসে উঠে বলল, এখন চাইনিজ খাবার সময় বুঝি? তাছাড়া আমি চাইনিজ খেতে একদম পছন্দ করি না। তার চেয়ে চল, কোনো হোটেলে গিয়ে কাবাব পরোটা খাওয়া যাক।

তাই চল, বলে সৈকত তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। তোপখানা রোডে কাফে ঝিলের সামনে গাড়ি পার্ক করে বলল, এই হোটেলের কাবাব পরোটা খুব ভালো।

খেতে খেতে আসিয়া জিজ্ঞেস করল, মামিমা তোমাকে কিছু বলেনি?

মিথ্যা করে কিছু বলতে সৈকতের বিবেকে বাধল। তাই যা গোপন রাখতে চেয়েছিল, তা পারল না। মা যেসব কথা বলেছে, বলল। বাবার রেগে যাবার কথাও বলল।

আসিয়া বলল, ওঁরা যে এরকম বলবেন, তা আমি জানতাম। এখন কী করবে বল।

: কী আবার করব? আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না।

: একটা কথা বলব রাখবে?

: আগে বল, না শুনে ওয়াদা করতে পারব না।

: তুমি আমাকে ভুলে যাও।

সৈকত তার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে ভিজে গলায় বলল, এরকম কথা তোমার মুখ থেকে শুনব আশা করিনি। আমি যদি কথাটা তোমাকে বলি, পারবে?

: আমি মেয়ে। মেয়েরা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সব কিছু সহ্য করতে পারে।

: মেয়েরা পারলেও আমি পারব না। আবার যদি ঐ কথা বল, তা হলে অতি সতুর আমার মৃত্যুর খবর পাবে।

আসিয়া চমকে উঠে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, এ রকম কথা বলতে তোমার বিবেকে বাধল না? আমাকে কাঁদিয়ে খুব শান্তি পাও বুঝি? কথা শেষ করে চোখের পানি মুছতে লাগল।

সৈকত বলল, তা হলে তুমি ভুলে যাবার কথা বললে কেন? ওয়াদা কর, আর কখনও বলবে না?

: ঠিক আছে, আর বলব না। তুমিও ওয়াদা কর, ওরকম কথা আর বলবে?

সৈকত আসিয়ার কথাটা রিপিট করল।

ততক্ষণে তাদের নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে। দু’জনে বেসিন থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে সৈকত দু’কাপ কফির অর্ডার দিল।

কফিতে চুমুক দিয়ে আসিয়া বলল, আমার কথা মন দিয়ে শোন। তারপর তোমার কিছু বলার থাকলে বলবে।

: বেশ বল।

: তোমার ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত এ ব্যাপার নিয়ে মামা-মামির সাথে আর কোনো কথা বল না। ওঁনারা কিছু বললে বলবে, “পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছ, ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে দিয়েছ।” পাস করার পর এক বছর ইন্টারনিশিপ কোর্সটাও শেষ করবে। ততদিন আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবে। তারপর যা করার তুমি করবে।

সৈকত হর্ষোফুল্ল কণ্ঠে বলল, দারুণ কথা বলেছ! কথাটা আমার মাথায় আসেনি। সত্যি তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।

: পাম্পটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

সৈকত হাসতে হাসতে বলল, তুমি তো কোনো দিন আমাকে পাম্প দাওনি। তাই সেটাও তোমাকে দিয়ে দিলাম।

আসিয়াও হাসতে হাসতে বলল, তাই?

সৈকত বলল, হ্যাঁ তাই।

এরপর থেকে তারা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত রইল। আসিয়ার কথামত মাসে দু’দিন তারা দেখা-সাক্ষাৎ করে।

এইভাবে চার-পাঁচ মাস পর আসিয়া নানাকে চিঠি দিয়ে সৈকতের ও তার বাবার সম্পূর্ণ পরিচয় জানাল। আরও জানাল, সামনের মাসে সাতদিনের ছুটিতে সৈকতকে নিয়ে আসছে।

হাফিজুর রহমান চিঠি পেয়ে আনন্দে চোখে পানি ধরে রাখতে পারলেন না। ছেলের উপর রাগ ও অভিমান করে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও লোকের দ্বারা তার খোঁজ খবর রেখেছেন। ছেলে সুখে আছে জেনে হাফিজুর রহমান দুশ্চিন্তা না করলেও অশান্তির আগুনে জ্বলছিলেন। এতদিনের সেই অশান্তির আগুন চোখের পানিতে নিভাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

রাবু সংসারের কাজ করতে করতে আব্বাকে চিঠি হাতে চোখের পানি ফেলতে দেখে তার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ভাবল, আসিয়ার কোনো খারাপ খবর আসেনি তো? তাড়াতাড়ি হাতের কাজ ফেলে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছ কেন আব্বা? ওটা কার চিঠি?

হাফিজুর রহমান চিঠিটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, পড়ে দেখ।

চিঠি পড়ে রাবুর চোখ দিয়েও পানি পড়তে লাগল। চোখ মুছে ভিজে গলায় আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করে বলল, এবার ভাইয়া আর রাগ করে থাকতে পারবে না, নিশ্চয় আসবে।

হাফিজুর রহমানও ভিজে গলায় বললেন, দোয়া করি, আল্লাহপাক যেন তার আশা পূরণ করেন।

এক সপ্তাহের ছুটিতে সৈকত মা-বাবাকে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাবার কথা বলে আসিয়ার সঙ্গে দীঘারপাড়া রওয়ানা দিল।

বাসে করে আসবার সময় আসিয়া সৈকতকে বলল, আমাদের গ্রামের পাশের গ্রাম জহুরপুরে পল্লি বিদ্যুৎ গেলেও দীঘারপাড়াতে এখনও আসেনি। গরমে তুমি খুব কষ্ট পাবে।

সৈকত বলল, মানুষ অভ্যাসের দাস। যা অভ্যাস করবে, তা সয়ে যাবে। তা ছাড়া তুমি সঙ্গে থাকলে সব কষ্ট সহ্য করতে পারব।

বাড়িতে পৌঁছাবার পর হাফিজুর রহমান সৈকতকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আসিয়া চিঠিতে তোমার পরিচয় জানিয়েছে। চিঠি পাবার পর থেকে তোমাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। আল্লাহপাকের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া, তিনি আমার সেই আশা পূরণ করলেন।

সৈকত দাদাকে কদমবুছি করে দাদি, ফুপা ও ফুপিকে কদমবুছি করল। সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অনেক দোয়া করল। অনেকদিন পর এ বাড়িতে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু হলো।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর হাফিজুর রহমান নাতিকে নিয়ে গল্প করতে বসলেন। একে একে অন্যরাও এসে বসলেন। হাফিজুর রহমান সৈকতকে তার বাবা-মার কথা, শিক্ষা জীবনের কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। সাজেদা বেগম ও রাবু মাঝে মাঝে এটা সেটা জিজ্ঞেস করলেন। সৈকত হাসিমুখে সকলের কথার উত্তর দিতে লাগল। কিন্তু মা-বাবার রাগের কথা বলল না।

পরের দিন সকালে সৈকত দাদাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রাম দেখতে বেরোবার সময় আসিয়াকেও সঙ্গে যেতে বলল।

আসিয়া বলল, এটা ঢাকা শহর নয়, গ্রাম। যেখানকার সমাজ ব্যবস্থা যেমন, তা মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সৈকত বলল, সমাজের কুসংস্কার দূর করাও শিক্ষিত ছেলে-মেয়ের কাজ। তুমি পর্দার সঙ্গে যাবে, তাতে সমাজ বাধা দেবে কেন? তাছাড়া তুমি তো পর্দার সঙ্গে হাইস্কুলে গেছ। তখন সমাজ কিছু বলেনি?

আসিয়া বলল, সবাই না বললেও অনেকে বলেছে। আমি সেসব গ্রাহ্য করিনি। প্রয়োজনে মেয়েদেরকে পর্দার সঙ্গে বাইরে যেতে ইসলামে নিষেধ নেই। আমি এই গ্রামের মেয়ে। আশপাশের সবকিছু আমার দেখা। আল্লাহপাক যদি সে দিন দেন, তা হলে তোমার সঙ্গে আবার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াব।

হাফিজুর রহমান এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিলেন। আসিয়া থেমে যেতে বললেন, তোমাদের দু’জনেরই কথা ঠিক। আসিয়ার এখন গিয়ে কাজ নেই। চল আমি তোমাকে গ্রাম দেখিয়ে আনি। এই কথা বলে তিনি সৈকতের কাঁধে একটা হাত রাখলেন।

হাঁটতে হাঁটতে যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, হাফিজুর রহমান তাকেই নাতির পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন।

এভাবে কেমন করে যে এক সপ্তাহ কেটে গেল, সৈকত টের পেল না। দাদা-দাদির আদর স্নেহ, ফুপা-ফুপির স্নেহ মমতা ও খাতির যত্ন দেখে তার স্বপ্নের মতো দিনগুলো চলে গেল।

আজ সৈকত ও আসিয়া ঢাকায় ফিরবে। সকাল আটটায় বাস। তাও যশোহরে। দীঘারপাড়া থেকে প্রায় চার পাঁচ মাইল হেঁটে অথবা গরুর গাড়ি করে খাজুরা বাসস্ট্যাণ্ডে আসতে হবে। তারপর লোকাল বাসে করে যশোহরে এসে ঢাকার বাসে উঠতে হবে। তাই গতরাতে বাড়ির মেয়েরা কেউ ঘুমায়নি। তারা সারারাত জেগে কয়েক পদের পিঠা ও ক্ষীর তৈরি করেছে। ফজরের নামাযের পর সেই সব নাস্তা সৈকতকে খেতে হলো।

হাফিজুর রহমান গতকাল একটা গরুর গাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলেন। সেই গাড়িতে সৈকত ও আসিয়াকে তুলে দিয়ে তিনি চোখ মুছতে মুছতে জামাইকে তাদের সাথে যশোহর পর্যন্ত গিয়ে ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে আসতে বললেন।

সৈকত ও আসিয়া দু’জনেই আপত্তি করল। কিন্তু হাফিজুর রহমান শুনলেন না।

বিদায় মুহূর্তে সবাইয়ের চোখে পানি দেখে সৈকত নিজেকে সামলাতে পারল না। বারবার রুমালে চোখ মুছতে লাগল। ঢাকার বাসে উঠে সৈকত আসিয়াকে বলল, গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের কাছে যে এত স্নেহ, মায়া, মমতা পাব, তা কল্পনা করি নাই। আর গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে হলেও তারা কত সহজ সরল, সেকথা ভাবলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এখন মনে হচ্ছে, গ্রামের জীবন কত সুখের, কত শান্তির।

আসিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, দুঃখের বিষয় কি জান? গ্রামের ছেলেরা শিক্ষিত হয়ে উপার্জনের জন্য শহরে গিয়ে গ্রামকে ভুলে যায়। বলে, গ্রামে কি মানুষ বাস করে? যাক ওসব কথা বলে কোনো লাভ নেই।

ঢাকায় ফিরে মেলামেশা কমিয়ে দিয়ে দু’জনেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত রইল। সৈকতই মাঝে মাঝে এসে আসিয়াকে নিয়ে কোনোদিন পার্কে, আবার কোনো দিন রেস্টুরেন্টে আলাপ করে। এভাবে সৈকত ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারনিশিপ কোর্স শেষ করল।

ততদিনে আসিয়াও ফাইনাল পরীক্ষায় স্কলারশিপ নিয়ে পাস করল।

প্রিন্সিপাল আসিয়াকে ডেকে গাইনিতে উচ্চ শিক্ষা নেবার কথা বলে বললেন, তুমি ইন্টারনিশিপ কোর্স শেষ কর। আমি তোমাকে বিদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেব।

আসিয়া প্রিন্সিপালকে কদমবুছি করে বলল, এ তো আমার সৌভাগ্য স্যার। আমার গার্জেনদের অনুমতি নিয়ে আপনাকে জানাব।

প্রিন্সিপাল বললেন, তুমি তোমার গার্জেনদের কাউকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বল।

জ্বি স্যার বলব বলে সালাম দিয়ে আসিয়া হোস্টেলে চলে এল। তারপর রেজাল্টের কথা ও প্রিন্সিপালের কথা লিখে নানাকে চিঠি দিল। তাতে আরও লিখল, সে এখন দেশে যেতে পারবে না। নানা যেন তাড়াতাড়ি ঢাকায় এসে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করেন।

নাতনির চিঠি পেয়ে হাফিজুর রহমানের বুক আনন্দে ভরে গেল। হাঁকডাক করে বাড়ির সবাইকে ডেকে চিঠি পড়ে শুনালেন। তারপর দশ কেজি মিষ্টি কিনে পাড়ার লোকজনদের নাতনির খবর জানিয়ে বিলি করলেন। একদিন মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ও গ্রামের গরিব-বড়লোক সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খানা করে খাওয়ালেন। তারপর ঢাকায় যাবার প্রস্তুতি নিলেন।

সাজেদা বেগম ও রাবু যুক্তি করে ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর সাজেদা বেগম স্বামীকে বললেন, হায়াৎ-মউতের কথা তো বলা যায় না। ফায়জুরকে দেখার জন্য আমার মন খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চলুন।

হাফিজুর রহমান স্ত্রীর মনের ব্যথা জানেন। বললেন, ঠিক আছে, তাই যাবে।

রাবু মাকে প্রথমে পাঠিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। আব্বার কথা শুনে সামনে এসে বলল, আমিও যাব। ভাইয়াকে আজ কত বছর দেখিনি। তাকে দেখার জন্য মন খুব ছটফট করছে।

হাফিজুর রহমান না করতে পারলেন না। তবু বললেন, সবাই চলে গেলে বাড়িতে থাকবে কে? তুই পরে যাস।

রাবু বলল, আপনাদের জামাই থাকবে। কাজের দু’জন লোকও রয়েছে। আমি আপনাদের সাথেই যাব।

হাফিজুর রহমান বললেন, ঠিক আছে, তুইও যাবি।

তারপর একদিন জমাইকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে হাফিজুর রহমান স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ঢাকা রওয়ানা দিলেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *