৫.
আসিয়া সেই প্রথম দিন কলেজের বারান্দা দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাবার সময় ফরিদার কথাগুলো শুনে তার দিকে চাইতে সৈকতকে দেখে একটু চমকে উঠেছিল। তখন তার মনে হয়েছিল, ছেলেটা যেন কতকালের চেনা, কত আপন। তারপর থেকে মাঝে মাঝে সৈকতের কথা তার মনে পড়ে। আবার যেদিন নিউ মার্কেটের গেটে তার সঙ্গে কথা বলল, সেদিন তাকে ভালো করে দেখে আরও বেশি সেই কথা মনে হল। সেই সাথে বুঝতে পারল, ছেলেটা তার পিছনে লেগেছে। তারপর থেকে তার মনের অস্থিরতা বেড়ে যায়। শেষে ক্যান্টিনের ঘটনার পর তার মনের খবর পেয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। একদিকে সে নিজেও তার প্রতি খুব দুর্বল অনুভব করছে। আর অন্য দিকে চিন্তা করছে, আমার কুৎসিত চেহারা দেখেও ছেলেটা কেন ঘৃণা করছে না? তাহলে কি আমাকে নিয়ে খেলতে চায়? এইসব চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, সৈকতের সঙ্গে দেখা হলে আজেবাজে কথা বলে অপমান করবে। তাহলে পরে সে আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না।
আসিয়া সিওর ছিল, এক মাস পরে নির্দিষ্ট দিনে সৈকত লাইব্রেরিতে তার সাথে দেখা করবেই। তাই আজ তাকে কী বলে অপমান করবে ভেবে চিন্তে তৈরি হয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন সৈকত এল না তখন চিন্তা করল, সে এল না কেন? কোনো অসুখ-বিসুখ করেনি তো? আর হলেই বা কি? আমার অত চিন্তা করার কী আছে? বরং না এসে ভালোই করেছে। এলে তো অপমানিত হয়ে ফিরে যেত। এইসব ভাবতে ভাবতে লাইব্রেরি থেকে চলে এল বটে, কিন্তু তার মুখের ছবি বারবার মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল। যখন আরও এক মাস পার হয়ে গেল তখন ভাবল, বড়লোকের ছেলেদের স্বভাবই হয়তো এই রকম। যখন মনে যা আসে তাই করে। দুদিন পরে সব ভুলে যায়।
সৈকত পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বিশ্বনবী পড়ার পর চার খলিফা ও সাহাবিদের জীবনী পড়ার জন্য তার মন খুব উদগ্রীব হয়ে উঠল। তাই সেই সব বই কিনে অবসর সময়ে পড়তে লাগল। মাঝে মাঝে আসিয়ার কথা মনে যে পড়েনি তা নয়। মনে পড়লে নিজেকে নিজে শাসন করে বলে, বলেছি না, পরীক্ষার পর তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করব। তাকে নিয়ে অনেক জায়গায় বেড়াতে যাব। তারপর আসিয়াকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলে পরীক্ষাটা হয়ে যাক, তারপর দেখব তুমি কেমন করে আমাকে ফিরিয়ে দাও।
আসিয়া যতই সৈকতকে ভুলে থাকতে চায়, ততই সৈকতের কথা মনে পড়ে। তাকে দেখার জন্য মনের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করে। তাই একদিন সে ফোর্থ ইয়ারের একটা মেয়ের কাছ থেকে খবর নিল, কবে তাদের পরীক্ষা শেষ হবে। ওদের পরীক্ষা আগেই শেষ হয়েছে। সৈকতের শেষ পরীক্ষার দিন সে কলেজের বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে তাকে এক নজর দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
সৈকত পরীক্ষার হল থেকে যখন বেরোল তখন তার সাথে অনেক ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ লক্ষ্য করল, থামের আড়াল থেকে একটা বোরখাপরা মেয়ে মুখ বাড়িয়ে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। সৈকত সেদিকে চাইতেই মেয়েটা সম্পূর্ণ আড়াল হয়ে গেল। সৈকত বুঝতে পারল, মেয়েটা নিশ্চয় আসিয়া। দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে সবাইয়ের সাথে গাড়ির কাছে এসে তাদেরকে বলল, তোরা যা, আমি প্রিন্সিপালের সঙ্গে একটু দেখা করব। তারপর কেউ কিছু বলার আগে সে হন হন করে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে চলে গেল।
আসিয়া মনে করল, সৈকত ওর দিকে তাকালেও ওকে দেখতে পায়নি। তাই সে বাড়ি ফিরে যাবার মনস্থ করল। তারপর সৈকতকে গাড়ির কাছ থেকে ফিরে প্রিন্সপালের রুমের দিকে যেতে দেখে দাঁড়িয়ে রইল।
সৈকত প্রিন্সিপালের রুমে না ঢুকে টয়লেটে গিয়ে সাথিদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে আসিয়ার কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সৈকতকে সালাম দিতে দেখে আসিয়া বেশ অবাক হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহপাকের রহমতে ভালো। আপনি কেমন আছেন?
: পরীক্ষার পড়া নিয়ে খুব পরিশ্রম করেছি সে জন্য শরীরটা তেমন ভালো নেই। আর মানসিক অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।
: আপনাদের মতো ধনীর দুলালের মন খারাপ থাকার তো কথা নয়। মনের শান্তির জন্য আপনাদের সমাজে কত রকমের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
: আপনার কথা হয়তো ঠিক, তবে আমার ক্ষেত্রে ঠিক নয়।
: তাহলে অশান্তির কারণটা বলুন।
: শুনবেন?
: শুনব না কেন?
: সেকথা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না, আসুন আমার সঙ্গে। তারপর সে হাঁটতে শুরু করল।
আসিয়ার এক মন বলল, যাওয়া কি ঠিক হবে? আর এক মন বলল, না। গেলে সৈকতের মনে খুব কষ্ট হবে। তাছাড়া ভদ্রতা বলে তো একটা কথা আছে। শেষমেশ দ্বিধাচিত্তে তার পিছু নিল।
সৈকত গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, উঠে আসুন।
আসিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে বসতে বাধ্য হল। কারণ এখন আর না বলা চলে না।
আসিয়া উঠে বসার পর সৈকত হাত বাড়িয়ে গেট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল। কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে বলল, আমাদের বাড়িতে যাবেন? আম্মা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে।
আসিয়া চমকে উঠে বলল, না-না, আজ নয়, অন্যদিন যাব।
: তাহলে কোনো রেস্টুরেন্টে যাই চলুন। নাস্তা খেতে খেতে আলাপ করা। যাবে। আসিয়া কোনো কথা না বলে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল।
সৈকতও আর কোনো কথা না বলে একেবারে এলিফ্যান্ট রোডের একটা রেস্টুরেন্টের সামনে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করল। তারপর আসিয়াকে সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা কেবিনে বসে বলল, খিদে পেয়েছে। নাস্তা খেতে খেতে আলাপ করা যাবে। বলুন কী খাবেন?
আসিয়া বলল, আপনার ইচ্ছামত অর্ডার দিন। কোনো কিছুতেই আমার আপত্তি নেই। তাদেরকে দেখে একজন বেয়ারার এগিয়ে এল।
সৈকত তাকে জিজ্ঞেস করল, চিকেন বিরানি পাওয়া যাবে?
: যাবে।
: তাহলে দু’প্লেট দিন। আর সেই সঙ্গে বোরহানি থাকলে দেবেন।
বেয়ারার কয়েক মিনিটের মধ্যে সবকিছু দিয়ে চলে যাবার পর আসিয়া বলল, এটা বুঝি নাস্তা?
: রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখুন এখন কি নাস্তা খাবার সময়?
: সামান্য কিছু নাস্তা খেয়ে আলাপ সেরে বাড়িতে গিয়ে ভাত খেতে পারতেন।
হোটেলের খাবার খেলে শরীর খারাপ করবে। তারপর রিস্ট ওয়াচ দেখে বলল, মাত্র পৌণে দুটো।
: আপনার প্রথম কথার উত্তরে বলব, মাঝে মাঝে এক-আধ দিন হোটেলে খেলে শরীর খারাপ করে না। আর দ্বিতীয় কথার উত্তরে বলব, আলাপ করতে করতে হয়তো চারটে-পাঁচটা বেজে যাবে। কথা না বাড়িয়ে শুরু করুন।
খেতে খেতে দু’জনে একে অপরের মুখের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। ফলে বারবার চোখাচোখি হচ্ছে। দুজনে দুজনের কাছে ধরা পড়ে লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এক সময় আসিয়া মৃদু হেসে বলল, এই কুৎসিত কালো মুখের দিকে বারবার চেয়ে কী দেখছেন?
: দেখছি আমার মানস প্রতিমার মুখ।
: বিদ্রূপ, না কৌতুক?
: যদি বলি কোনোটাই নয়।
: আবার কিন্তু তাই করছেন।
: খোদার কসম খেয়ে বলছি, ও দুটোর কোনোটাই নয়।
আসিয়া চমকে উঠে বলল, আল্লাহর নামে সত্য ছাড়া মিথ্যা কসম খাওয়া শক্ত গোনাহ। সে জন্যে …..।
: ওসব আমি জানি না, তবে আমি মিথ্যা কসম খাইনি।
তার কথা শুনে আসিয়া খাওয়া বন্ধ করে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তারপর সেই পানি গাল বেয়ে টপ টপ করে খাওয়ার প্লেটে পড়তে লাগল।
সৈকত তার অবস্থা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, কী হলো? আপনি কাঁদছেন কেন?
আসিয়া ক্যান্টিনে সৈকতের সঙ্গে আলাপের সময় তার চোখের দৃষ্টিতে যা দেখেছিল, তাতেই বুঝতে পেরেছিল, সৈকত তাকে ভালোবাসে। আর সেও তাকে প্রথমদিন দেখার পর থেকে তার প্রতি ভীষণ দুর্বলতা অনুভব করে। তারপর দু’দুবার তার সঙ্গে আলাপ করে সেই দুর্বলতা আরও বেশি হয়েছে। নিজের কালো চেহারার কথা মনে করে মনকে শক্ত করে রেখেছিল, তারপর নির্দিষ্ট দিনে কলেজ লাইব্রেরিতে সৈকত না আসায়, মনকে বুঝিয়েছিল, এই কালো কুৎসিত মেয়েকে কোনো ছেলেই পছন্দ করবে না। সৈকত হয়তো তার কালো চেহারার কথা ভেবে ঐ দিন লাইব্রেরিতে দেখা করতে আসেনি। এখন সৈকতের কথা শুনে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে আনন্দ অশ্রু ফেলতে লাগল।
সৈকত জিজ্ঞেস করার পরও যখন আসিয়ার কোনো পরিবর্তন দেখল না, তখন বাঁ-হাত দিয়ে তার একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে আবার বলল, কী ব্যাপার? কাঁদছেন কেন?
এবার আসিয়া চমকে উঠে সংবিৎ ফিরে পেয়ে বেসিন থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে বসে বলল, মাফ করবেন, বেয়াদবি করে ফেললাম, আমি আর খেতে পারব না, আপনি খয়ে নিন।
সৈকতেরও আর খেতে ইচ্ছা করল না। তবু দু’চার লোকমা খেয়ে হাত মুখ। ধুয়ে এসে বসে বেয়ারাকে দুটো পেপসি দিতে বলল।
বেয়ারার পেপসি দিয়ে যাবার পর সৈকত একটা বোতল আসিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে খেতে বলে নিজেরটা নিয়ে পাইপে কয়েকটা টান দিল। তারপর বলল, কেন কাঁদছিলেন বলবেন না?
আসিয়া বলল, সে কথা পরে বলব। আগে বলুন, ঐ দিন লাইব্রেরিতে এলেন না কেন? তা হলে কি বিশ্বনবী পড়েন নি?
: পনেরো দিনের মধ্যে শেষ করে আরও অনেক ইসলামিক বই কিনে পড়েছি। দেখা করার ইচ্ছাও প্রবল ছিল; কিন্তু মা ব্যাপারটা জানতে পেরে জিজ্ঞেস করল, সামনে পরীক্ষা তবু কেন কলেজের বই না পড়ে ঐ সব পড়ছি। আমি কখনো মিথ্যা বলিনি। তাই সত্য কথা বললাম।
: সত্য কথা বললাম মানে?
: এই তোমার কথা, সরি, আপনার কথা ও আপনার হুকুমের কথা।
: বলতে বিবেকে বাধল না?
: সত্য কথা বলতে বিবেকে বাধবে কেন? বরং মিথ্যে কথা বললে বাধত।
আসিয়া বুঝতে পারল, সৈকত খুব সরল। আজকালের ছেলেদের মতো তার মনে মারপ্যাঁচ নেই। জিজ্ঞেস করল, মা শুনে কী বললেন?
: বললেন, ওসব চিন্তা দূর করে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। নচেৎ পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবে। মায়ের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরীক্ষার আগে তোমার সাথে সরি, আপনার সাথে দেখা করব না। পরীক্ষার পর দেখা করে মাফ চেয়ে নেব।
সৈকত যে মিথ্যা বলছে না, তা বুঝতে পেরে আসিয়া বলল, কই মাফ তো এখনও চাইলেন না?
: মাফ চাওয়ার সুযোগ পেলাম কোথায়? পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আপনাকে দেখতে পেয়ে কায়দা করে বন্ধুদের বিদায় করলাম। তারপর তোমাকে সরি, আপনাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। যাক এখন মাফ চাইছি। বলুন মাফ করেছেন?
আসিয়া বলল, আপনি ঠিক কাজ করেছেন। মায়ের কথা মান্য করা প্রত্যেক সন্তানের উচিত। আপনি কোনো অন্যায় করেন নি। অতএব, মাফ চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এবার আমি একটা কথা বলব, রাখবেন?
: নিশ্চয় রাখব, বলুন কী কথা?
: এবার থেকে আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।
: তুমি সরি, আপনিও তাহলে আমাকে তুমি করেই বলবেন বলুন?
আসিয়া হেসে উঠে বলল, এই কিছুক্ষণের মধ্যে কতবার আপনি তুমি করে বলেছেন, খেয়াল করেছেন? আসলে মনের ভিতর থেকে যা আসে, তাকে বাধা দিয়ে মেকি-ভদ্রতা দেখানো ঠিক নয়। আপনি যখন আগে তুমি করে বলা আরম্ভ করেছেন, তখন চালিয়ে যান, আমি পরে চালাবার চেষ্টা করব।
: উঁহু, তা হবে না, যা করব দু’জনে এক সঙ্গে করব। এবার থেকে দু’জনেই তুমি করে বলব।
: কিন্তু আমাদের এতটা এখোন কি উচিত হবে?
: কেন হবে না? একশোবার হবে। যেখানে আমরা দুজন দুজনের প্রেমে পড়েছি, সেখানে উচিত অনুচিতের প্রশ্ন আসবে কেন?
আসিয়া হেসে উঠে বলল, আপনি একদম ছেলেমানুষ, তা না হলে একরম কথা বলতে পারতেন না।
সৈকত বলল, আবার আপনি করে বলছ?
: আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এবার তুমি করেই বলব, হল তো?
: হ্যাঁ কথাটা মনে রাখবে।
: কিন্তু তুমি যে বললে আমাদের দুজনের মধ্যে প্রেম হয়েছে, কথাটা চিন্তা করে বলেছ?
: এতে চিন্তা করার কী আছে। মনের সত্য কথাটা তো বললাম।
: তোমার মনের কথা তুমি না হয় বললে, কিন্তু আমার কথা বললে কি করে?
: আমি বুঝতে পেরেই বলেছি।
আসিয়া মৃদু হেসে বলল, আমি প্রেমে পড়েছি কী পড়িনি, সে কথা তো তোমাকে বলিনি। বুঝতে পারলে কি করে?
: ওসব জিনিস মুখে বলতে হয় না, এমনিতেই বোঝা যায়। তুমি যে আমার প্রেমে পড়েছ তা অস্বীকার করতে পারবে?
: সে কথা পরে বলছি, তার আগে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
: বেশ তো বল।
: আমার গায়ের রং খুব কালো। চেনা জানা অনেকে আমাকে কালোপেত্নী বলে। কিন্তু তুমি কেন আমার প্রেমে পড়লে?
: তোমার গায়ের রং কালো হতে পারে, কিন্তু কালোর মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা দেখার ক্ষমতা যাদের নেই, তারাই তোমাকে ঐ রকম বলে। আমার চোখে তুমি অতুলনীয়া।
: কিন্তু তোমার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন আমার মতো কালো মেয়েকে পছন্দ করবেন না। আমাকে দেখার পর তারা তোমার উপর খুব রেগে যাবেন। হয়তো তড়িঘড়ি করে কোনো রূপসীর সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে দেবেন।
: তারা রেগে গিয়ে হয়তো বকাবকি করতে পারে। তাই বলে জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না। সে রকম কিছু বুঝতে পারলে বিয়ের আগেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলব।
: আসিয়া আবার হেসে উঠে বলল, সত্যিই তুমি একদম ছেলেমানুষ। ভাবছি কী করে ডাক্তারি পড়ছ?
: ছেলেমানুষের মতো আবার কী বললাম?
: ছেলেমানুষি নয় তো কি? তুমি যে বললে, আমাকে বিয়ে করে ফেলবে, বিয়ে কি হাতের রসগোল্লা যে, কেউ ভাগ বসাতে চাইলে টপ করে গালে ফেলে দিবে? বিয়ে করে আমাকে রাখবে কোথায়? বিয়ের পর যদি তোমার মা-বাবা আমাকে ঘরে তুলতে না চান, তখন কী হবে?
: তখন তোমার বাবা-মার কাছে থাকব?
: আমার বাবা-মার খোঁজ খবর নিয়েছ? আমাদের বাড়িঘর আছে কিনা তাও তো জান না।
: তাই তো? সে কথা আমার খেয়াল হয়নি। এখন বল তো শুনি।
আসিয়া হাসতে হাসতে বলল, এখন বলা যাবে না। অন্য একদিন বলব, এবার উঠা যাক। তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ওমা চারটে বাজে। অনেক দেরি হয়ে গেল। হোস্টেলের সুপারিন্টেণ্ডের কাছে বকুনি খেতে হবে।
: ওঁনি বুঝি খুব কড়া?
: শুধু কড়া নন, জাদরেল মেয়েমানুষ। দুপুরে ও রাতে খাওয়ার সময় রোল কল করেন।
: তাহলে তো তোমাকে খুব বিপদে ফেলে দিলাম।
: বিপদ তেমন হবে না। কারণ আমি কোনোদিন হোস্টেলের নিয়ম ভঙ্গ করিনি। আজই প্রথম। সে জন্য হয়তো কিছু বলবেন না; তবে কড়া গলায় ওয়ার্নিং দেবেন।
সৈকত দাঁড়িয়ে বলল, চল তোমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিই।
আসিয়া কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল।
সৈকত বিল মিটিয়ে আসিয়াকে নিয়ে গাড়িতে উঠল হোস্টেলের গেটে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাল তোমাদের ক্লাস আছে নাকি?
আসিয়া বলল, আছে।
সৈকত বলল, আমাদের নেই। বিকেল সাড়ে চারটের সময় এখানে অপেক্ষা করব।
ঠিক আছে, তাই কর বলে আসিয়া সালাম জানিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলল।
সৈকত সালামের উত্তর দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে গাড়ি ছেড়ে দিল।
পরের দিন সৈকত সময়মত হোস্টেলের গেটের কাছে এসে আসিয়াকে দেখতে পেয়ে প্রথমে সালাম বিনিময় করল। তারপর তাকে গাড়িতে উঠতে বলল। আসিয়া উঠার পর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, খিদে পেয়েছ কিছু খাওয়া দরকার। কাল যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম, সেখানে যেতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
আসিয়া বলল, না তা নেই।
রেস্টুরেন্টে এসে নাস্তা খেতে খেতে সৈকত বলল, কালকের অসমাপ্ত কথাগুলো বল।
: অসমাপ্ত কথা না শোনাই ভালো।
: আমাকে শুনতেই হবে আর তোমাকে বলতেই হবে।
: যদি না বলি?
: তাহলে দু’জনেরই ক্ষতি।
: যেমন?
: না বললে, আমার মনে খুব কষ্ট হবে। আমার মনের কষ্ট হলে তুমিও কষ্ট পাবে।
: তোমার মনে কষ্ট হবে কেন?
: আমার সঙ্গে প্রেম করেছ বলে।
: আচ্ছা, তুমি যে প্রেম প্রেম করছ তার পরিণতির কথা চিন্তা করেছ?
: হ্যাঁ করেছি।
: কী চিন্তা করেছ?
: পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করব।
: প্রেম করে বিয়ে করলে, প্রেমের মৃত্যু হয়।
: একদম বাজে কথা।
: ধর, বিয়ের পর আমাদের মতবিরোধ হল। তখন আর প্রেমের কথা মনে থাকবে না।
: মতবিরোধ হবে কেন। প্রেম মানে তো একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে সাংসারিক জীবন প্রেম সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে পার করে দেয়া।
: তা আমিও জানি, কিন্তু তবু মনোমালিন্য হবে। যেমন আমি জ্ঞানমত আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-এর হুকুম মেনে চলি। তুমি ও তোমাদের বাড়ির কেউ অজ্ঞানতাবশতঃ সে সব মেনে চল না। তোমাদের সমাজের অনেক রীতিনীতি ইসলামের রীতিনীতির বাইরে। সেই জন্য তোমাদের সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে মতবিরোধ হবে। তখন তোমরা বলবে বউ যেমন কালো, তেমনি তার মনমানসিকতাও কালো। সে সময় তোমরা যেমন অশান্তি পাবে তেমনি আমিও পাব।
: তোমার কথাগুলো অবশ্য সত্য। কিন্তু তুমি বোধহয় জান না, আমি ইসলামের বিভিন্ন বই ছাড়াও কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে শুরু করেছি। এরমধ্যে আল্লাহ পাক আমার মনের অনেক অন্ধকার দূর করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তুমি যদি আমাকে সহযোগিতা কর, তাহলে মা-বাবার মনের অন্ধকার দূর করে ইসলামের আলোতে ভরিয়ে দিতে ইনশাআল্লাহ সক্ষম হব। তখন আর আমাদের সঙ্গে তোমার কোনো ব্যাপারেই মতবিরোধ হবে না। আর একথা তুমিও নিশ্চয় জান, মানুষের মন থকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে ইসলামের জ্ঞান বিস্তার করে আলোকিত করা প্রত্যেক জ্ঞানবান মুসলমানের কর্তব্য।
আসিয়া সৈকতের কথা শুনে আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলল, সুবহান আল্লাহ। তারপর বলল, জ্ঞান আহরণ করে শুধু বিস্তার করতে আল্লাহ পাক বলেন না, জ্ঞান আহরণ করার সাথে সাথে সেই সব অনুশীলন করতেও বলেছেন। যেমন কোরআন পাকে বলেছেন, “হে মুমেনগণ! তোমরা যা পালন কর না, তা বল কেন? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক।” [সূরা আস-সফ, ২৩ আয়াত, পারা ২৮]
.
সৈকত বলল, আমি এখনও সম্পূর্ণ কুরানের ব্যাখা পড়িনি। তবু আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে যতটুকু জেনেছি, সেসব মেনে চলার চেষ্টা করছি। পরে তোমার সঙ্গে এসব ব্যাপারে আলোচনা করব। এখন তোমার সম্পূর্ণ পরিচয় বল।
আসিয়া বলল, তুমি যখন নাছোড়বান্দা তখন বলছি শোন, আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করি। দেশের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার দীঘারপাড়া গ্রামে। আব্বার মামা ছাড়া কেউ নেই। তিনি ঘরজামাই হয়ে শ্বশুর বাড়িতে আছেন। আমার নানা একজন আলেম। নানা-নানি দু’জনেই বেঁচে আছেন। আম্মাই বর্তমানে ওনাদের একমাত্র সন্তান। তবে একটা ছেলেও ছিল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় নানার সঙ্গে কী ব্যাপারে রাগারাগি করে বাড়ির সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঢাকাতে থেকে যান। শুনেছি তিনি এখনও ঢাকাতেই আছেন। বাড়ির কেউ আমাকে বেশি লেখাপড়া করাতে চাননি। এইচ. এস. সি. পাস করার পর তারা সবাই আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে নানা তো একদম পড়াতেই চাইলেন না। বললেন, তুই যথেষ্ট লেখাপড়া করেছিস, আর দরকার নেই। মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করে কী লাভ? আমি বললাম, আমার মতো কালো কুৎসিত মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। আমি ডাক্তারি পড়ব। ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরে এসে গরিবদের চিকিৎসা করব। তাতেও রাজি হলেন না। শেষে আমি বললাম, আপনি পাত্র খুঁজতে থাকুন, যতদিন না পাওয়া যাবে ততদিন আমি মেডিকেলে পড়ব। তারপর আমি খুব কান্নাকাটি করতে লাগলাম। নানা আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। তাই আমার অবস্থা দেখে বললেন, তুই যদি কথা দিস, পাত্র পাওয়া গেলে পড়া ছেড়ে দিবি, তা হলে তোকে মেডিকেলে পড়াতে পারি। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। এখনও বোধহয় নানা নাতজামাই খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই এখনও পড়তে পারছি। শুনলে তো এই কালো পেত্নীর পরিচয়?
সৈকত বলল, শুনলাম কিন্তু তুমি নিজেকে কালো পেত্নী বললে কেন?
: অনেকে বলে তাই বললাম। তাছাড়া মিথ্যে তো আর বলিনি।
সৈকত আহতস্বরে বলল, অনেকে কী বলে আমার শোনার দরকার নেই। তুমি কিন্তু আমার সামনে ঐ কথা আর কখনও বলবে না। আমার মনে খুব কষ্ট হবে।
আসিয়া বলল, ঠিক আছে, আর বলব না।
: প্রমিস?
: প্রমিস।
: এবার আমার পরিচয় বলছি শোন।
: শোনাতে হবে না।
: জান নাকি?
: না।
: তবে।
: তবে আবার কি? তুমি আমাকে ভুলে যাও সৈকত। আমি গ্রামের মেয়ে। তকদদ্বীরে যদি ডাক্তার হবার সৌভাগ্য লেখা থাকে, তা হলে পাস করার পর গ্রামে ফিরে গিয়ে গরিবদের চিকিৎসা করে জীবনটা কাটিয়ে দেব। অনেক ভেবে দেখলাম, আমাকে জড়ালে তোমার জীবন দুঃখে ও অশান্তিতে ভরে উঠবে। তোমার আমার সমাজ জীবন আসমান জমিন তফাত। আমার জন্য তোমাকে দুঃখের সাগরে ভাসাতে পারব না। তুমি আমাকে ভুল বুঝ না সৈকত, তোমাকে না পেলেও তোমার কথা ভেবে আমি সারা জীবন কাটিয়ে দেব। ডাক্তার হবার সৌভাগ্য যদি না হয়, আর এর মধ্যে নানা যদি পাত্র ঠিক করে ফেলেন, তা হলে নানার কাছে যে ওয়াদা করেছি সেই মোতাবেক পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করতে হবে। তুমি তো আমার সবকিছু শুনলে এবার তুমিই বল, আমাদের দু’জনের মধ্যে প্রেম হলেও আলাপের বেশি এগোন কি উচিত?
সৈকত বলল, শুনেছি তুমি খুব মেধাবী ও তুখোড়। তার প্রমাণও পেয়েছি। কিন্তু সেই অনুপাতে বুদ্ধি একটু কম। তা না হলে প্রেমে পড়ার পর এই রকম কথা বলতে না। যাই হোক, তুমি শুনতে না চাইলেও আমি আমার পরিচয় বলছি। আমার বাবা ফয়জুর রহমান একজন বিজনেস ম্যান। আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। যশোহরের দিকে কোনো এক গ্রামে বাড়ি। বাবা এইচ. এস. সি. পাস করার পর দাদা বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। তাই দাদা একমাত্র ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। বাবা অনেক কষ্ট করে ঢাকাতে থেকে লেখাপড়া করেছে। তারপর বিজনেস করে বড় হয়েছে। অবশ্য আমার নানাই বাবাকে বিজনেসে নামান। এবার তোমার কথার উত্তরে বলব, আমার প্রতি তোমার প্রেমের গভীরতা কত তা আমি জানি না। কিন্তু তোমার প্রতি আমার প্রেমের গভীরতার কোনো ঠিকানা নেই। কথাটা তুমি বিশ্বাস না করলেও সত্য বললাম। ডাক্তারি পাস করার আগে যদি তোমার নানা তোমার বিয়ে দিতে চান, তাহলে সেই পাত্র আমি, আর যদি ডাক্তারি পাস করার পর বিয়ে করান তাহলে সেই পাত্রও আমি। একটা কথা মনে রেখ, তুমি পৃথিবীর যেখানেই থাক না কেন, তোমাকে আমি খুঁজে বের করবই। তখন তুমি বিয়ে করতে না চাইলেও আমি কিডন্যাপ করে হলেও বিয়ে করবই। নচেৎ আমি চিরকুমার হয়ে থাকব। আমারও খুব ইচ্ছা দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসা করার। প্রয়োজন হলে আমিও তোমার সঙ্গে থেকে গ্রামের গরিবদের চিকিৎসা করব। দুজনে মিলে দাঁতব্য চিকিৎসালয় খুলব। তবু তোমাকে আমি হারাতে পারব না। এটাই আমার প্রথম ও শেষ কথা। ভাগ্যে সুখ শান্তি থাকলে পাব। যদি না থাকে, ভাগ্যকে মেনে নেব। তোমাকে এখন ওয়াদা করতে হবে, এরমধ্যে যদি তোমার নানা বিয়ের ব্যবস্থা করে তোমাকে খবর দেন, তা হলে তুমি আমাকে জানাবে। আমি তোমার নানার সঙ্গে দেখা করে যা করার করব, তা নিজের চোখে দেখতে পাবে।
সৈকতের কথা শুনতে শুনতে আনন্দে আসিয়ার চোখে পানি এসে গেছে। তাই সে এতক্ষণ মাথা নিচু করেছিল। সৈকত থেমে যাবার পরও ঐ অবস্থায় রইল।
আসিয়া কিছু বলছে না দেখে সৈকত তার চিবুক ধরে তুলে চোখ থেকে পানি পড়ছে দেখে বলল, তুমি কাঁদছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
আসিয়া অশ্রুভেজা চোখে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, না শরীর খারাপ লাগছে না। ভাবছি, আল্লাহ পাক কি এত বড় সৌভাগ্য আমার করেছেন? আমি কালো ও কুৎসিত বলে ছোট বেলায় সবাইয়ের কাছে ঘৃণার পাত্রী ছিলাম। বড় হয়ে আমার দৃঢ় ধারণা জন্মায়, কোনো ছেলেই আমাকে দেখলে বিয়ে করবে না। কিন্তু আল্লাহ পাক তোমার মুখ থেকে একি শোনালেন? আমার কাছে সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
সৈকত চিবুক ছেড়ে দিয়ে তার হাতে খুব জোরে চিমটি কেটে বলল, এবার বুঝতে চেষ্টা কর, স্বপ্ন না বাস্তব।
আসিয়া ঊহ্ করে উঠে চিমটি কাটা জায়গাটায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, তুমি তো খুব ডেঞ্জারেস ছেলে, এত জোরে কেউ চিমটি কাটে? আমার ব্যথা লাগেনি বুঝি?
সৈকত বলল, এটা যে স্বপ্ন নয় বাস্তব, তা বোঝাবার জন্য ব্যথা দিলাম। সে জন্য দুঃখিত। তারপর করজোড় করে বলল, মাফ করে দাও।
আসিয়া চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলল, মাফ করব না।
: কেন? ও করলে আবার কোনো সময়ে চিমটি কাটবে।
: ঠিক আছে, আর কাটব না।
: ওয়াদা?
: ওয়াদা।
আসিয়া হেসে উঠে বলল, তাহলে মাফ করে দিলাম। এবার কিন্তু উঠতে হবে।
: কেন?
: প্রথম কারণ মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে আসছে, দ্বিতীয় কারণ হোস্টেলে সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে।
: তাহলে কথা দাও, প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্য হলেও সাক্ষাৎ দেবে?
: ও হ্যাঁ, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, পরশু থেকে কলেজ বন্ধ হচ্ছে, পরের দিন আমি গ্রামের বাড়ি যাব। ছুটি শেষ করে ফিরব।
: এতদিন তোমাকে না দেখে আমি থাকব কী করে? এই, আমাকে তোমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে? আমি কখনো গ্রামে যাইনি। কয়েকদিন থেকে গ্রাম দেখব, গ্রামের মানুষের পরিচয় জানব।
: তুমি যাবে সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু আমাদের দীঘারপাড়া গ্রামে এখনও বিদ্যু যায়নি। তোমার খুব কষ্ট হবে।
: তোমার জন্য আমি সব রকমের কষ্ট সহ্য করতে পারব। এবার বল নিয়ে যাবে কিনা?
আসিয়া কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে ছলছল চোখে বলল, তুমি অমন করে বল না। তুমি যাবে শুনে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, তা বোঝাতে পারব না। কিন্তু এবারে তোমাকে সঙ্গে নিতে পারব না, পরেরবারে যেও।
: কেন?
: আমার নানা একে তো গ্রামের লোক, তার উপর আলেম। যখন দেখবে যুবতি নাতনি একটা যুবককে নিয়ে এসেছে, তখন আমার উপর ভীষণ রেগে যাবেন, আব্বা আম্মাও রেগে যাবেন। তোমার সামনে আমাকে যদি রাগারাগি করেন অথবা তোমাকে যদি অপমান করেন, তাহলে আমি লজ্জায় ও দুঃখে হয়তো মরেই যাব। প্লিজ, এই কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরে থাক। আমি চিঠি দেব, তুমিও দিও। কথা দিচ্ছি, পরেরবারে যাতে তোমাকে সঙ্গে নিতে পারি, সে ব্যবস্থা করে আসব।
সৈকত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, তোমার কথা মেনে নিলাম। চল তাড়াতাড়ি ফিরি, নচেৎ নামায কাযা হয়ে যাবে।
.