কালোমেয়ে – ৩

৩.

হাফিজুর রহমান সেই যে ছেলের কাছ থেকে ফিরে এলেন, তারপর থেকে আর তার খোঁজ রাখলেন না।

সাজেদা বেগম একবার বলেছিলেন, ফায়জুর ছেলেমানুষ, আপনার কথা শুনে রাগের মাথায় ঐসব বলেছে, আপনি তাকে নিয়ে এসে অন্য জায়গায় ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিন। রাবুকে তার পছন্দ নয়। তাই সে আসতে চায় না।

স্ত্রীর কথা শুনে হাফিজুর রহমান গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখ রাবুর মা, তার কথা আমার কাছে আর বলবে না। আমি জানব, আমার কোনো পুত্রসন্তান নেই। যে ছেলে বাপের কথার অবাধ্য হয়, তার সঙ্গে আমি আর কোনো দিন যোগাযোগ রাখব না।

সাজেদা বেগম জানেন, তাকে নিকে করেছে বলে ফায়জুর এ বাড়ির সকলের উপর খুব অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে তার আব্বার এই কাজকে মেনে নিতে পারেনি। এই কথা ভেবে সাজেদা বেগম নিজেকে খুব অপরাধী ভাবেন। স্বামীর অগোচরে চোখের পানি ফেলেন আর ভাবেন, আমার জন্যই স্বামী পুত্র হারা, আর পুত্র বাপ হারা।

হাফিজুর রহমান রাবুর জন্য পাত্রের খোঁজ করতে লাগলেন। অনেক ছেলে দেখলেন, কিন্তু মনের মতো কাউকে পেলেন না। শেষে একটা ছেলের সন্ধান পেলেন, তার নাম মোকসেদ আলি। সে যশোহর টাউনে মামাদের বাড়িতে থেকে বি.এ পাস করে বেকার রয়েছে। তার মা-বাবা নেই।

হাফিজুর রহমান মোকসেদের সঙ্গে রাবুর বিয়ে দিয়ে ঘর জামাই করে রাখলেন। বিয়ের আগেই মোকসেদ ও তার মামার সঙ্গে সেই রকম চুক্তি করে এই কাজ করেছেন।

মোকসেদ খুব সহজ সরল ছেলে। তার গয়ের রং কালো কিন্তু দেখতে খারাপ না। রাবু দেখতে কালো হলেও তাকে অপছন্দ করল না।

আর রাবুর মনে যাই থাকুক না কেন, বিয়ের ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করল না। নিজের ভাগ্যকে মেনে নিল।

বিয়ের পর মোকসেদ শ্বশুরের কথামত জমি-জায়গা, চাষ-বাস দেখাশুনা করতে লাগল।

সাজেদা বেগম রাবুর বিয়ের ব্যাপারে স্বামীকে কোনো কথা বললেন না। মেয়েজামাইয়ের মিলমিশ দেখে তিনি খুশি।

বিয়ের তিন বছর পর বৈশাখের এক দুর্যোগের রাতে রাবু যে কন্যা সন্তান প্রসব করল, তা পাঠকরা কাহিনির শুরুতেই পড়েছেন।

হাফিজুর রহমান একটা খাসি জবেহ করে নাতনির আকিকা দিলেন। নাম রাখলেন আসিয়া বেগম।

আসিয়া যত বড় হতে লাগল তত তার গায়ের রং আরও কালো হতে থাকল।

প্রথম দিকে আসিয়ার গায়ের রং নিয়ে রাবু সবার অলক্ষে চোখের পানি ফেলত। মোকসেদ আলি মেয়ের জন্মের পর থেকে যেন বোবা হয়ে গেছে। অবশ্য আগের থেকে এমনি কথা কম বলত।

সাজেদা বেগম আঁতুড় ঘরে নাতনিকে দেখে যেমন ভয় পেয়েছিলেন তেমনি দুঃখও পেয়েছিলেন। কিন্তু হাফিজুর রহমানের কোনো পরিবর্তন কেউ বুঝতে পারল না। তিনি নাতনিকে নিয়ে সারাদিন মেতে থাকেন। আসিয়ার বয়স যখন চার বছর হলো তখন তিনি তাকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি করে দিলেন।

হাফিজুর রহমান বছর দুই হলো গ্রামের লোকজনদের নিয়ে মক্তবের সঙ্গে হাফিজিয়া মাদ্রাসা চালু করেছেন। তিনি নিজের খরচে মাদ্রাসা ও ছাত্রদের এবং হাফেজদের থাকার জন্য টিনের ঘর করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে গরিব ছাত্রদের জন্য লিল্লাহ বোডিং-এর ও হাফেজদের বেতনের জন্য দশ বিঘা জমি ওয়াকফ করে দিয়েছেন।

আসিয়ার মেধা খুব তীক্ষ্ণ। এক বছরের মধ্যে মক্তব্যের পড়া শেষ করে ফেলল। নাতনির তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি দেখে হাফিজুর রহমান তাকে হাফেজ করার মনস্থ করে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন।

আসিয়া সারাদিন মাদ্রাসায় পড়ে। দুপুরে বাড়ির চাকর ভাত নিয়ে এসে খাইয়ে যায়। মাগিরবের নামাজের আগে বাড়ি চলে আসে। রাতে মায়ের কাছে বাংলা, ইংরেজি ও ধারাপাত পড়ে।

রাবু ও মোকসেদ মেয়ের মেধাশক্তি ও পড়াশুনার ঝোঁক দেখে খুব অবাক হয়। মেয়ে ভীষণ কালো বলে তাদের মনে যে দুঃখ ছিল, এখন এইসব দেখে সেই দুঃখ অনেক হালকা হয়ে গেছে।

আসিয়া যখন আরও ছোট ছিল তখন পাড়ার ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খেলার সময় একটু কিছু হলেই তারা তাকে কালি বলে ডাকত।

একদিন আসিয়া কাঁদতে কাঁদতে বাইরে থেকে ঘরে এলে রাবু জিজ্ঞাসা করল, কিরে কাঁদছিস কেন? কেউ মেরেছে নাকি?

আসিয়া হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল, ওরা আমাকে কালি বলে তাড়িয়ে দিয়েছে, খেলতে নেয়নি।

রাবু মেয়েকে আদর করে তার চোখমুখ মুছে দিয়ে বলল, তুই আর ওদের সঙ্গে খেলতে যাবি না। তোর আব্বাকে অনেক খেলনা কিনে দিতে বলব। সেগুলো নিয়ে তুই ঘরে খেলা করবি। এরপর থেকে রাবু মেয়েকে পাড়ার ছেলেমেয়েদর সঙ্গে খেলতে যেতে দিত না। স্বামীকে দিয়ে কয়েক পদের খেলনা কিনে আনিয়ে দিল। এখন সে একটু বড় হয়েছে। পড়াশুনা নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে।

আসিয়া আট বছর বয়সে পুরো হাফেজ হয়ে যাবার পর হাফিজুর রহমান তাকে প্রাইমারি স্কুলে থ্রি-তে ভর্তি করে দিলেন।

রাবু তাকে ঘরে বাংলা ইংরেজি ও ধারাপাত পড়ার সাথে সাথে যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ শিখিয়েছে। প্রথম বছরেই বার্ষিক পরীক্ষায় সে ফার্স্ট হলো।

আসিয়া দেখতে খুব কালো বলে ক্লাসের ছেলে মেয়েরা তার সঙ্গে কেউ মিশত না। অনেকে তাকে কালি বলে বিদ্রূপ করত। আসিয়া সেসব শুনে কিছু বলত না। তবে তার মন খুব খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু শিক্ষকরা তার মেধার পরিচয় পেয়ে তাকে খুব ভালোবাসতেন। প্রাইমারিতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে তার সুনাম গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল।

হাফিজুর রহমান নাতনিকে জহুরপুর রামগোপাল হাই স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। হাই স্কুল পাশের গ্রামে প্রায় মাইল খানেক দূরে। তিনি একটা বয়স্ক মেয়ে রাখলেন। সে আসিয়াকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যায় আর নিয়ে আসে।

হাই স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও আসিয়া মেধার কারণে খুব প্রিয় হয়ে উঠল। তার মেধা এত প্রখর যে, একবার যে কথা শুনবে বা একবার যে পড়া রিডিং দিবে তা তার কণ্ঠস্থ হয়ে যায়। এ বছর সে এস.এস.সি.র পরীক্ষার্থী। ক্লাসমেটরা তাকে এখন আর কালি বলে দূরে সরিয়ে রাখে না। অনেকে তার সঙ্গে মিশে আবার অনেক হিংসাও করে। আসিয়া কোনো দিকে খেয়াল করে না। সে পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এস.এস.সিতে ছয়টা লেটার নিয়ে সম্মিলিত বিভাগে প্রথম হলো। তারপর মা-বাবা ও নানাকে বলল, আমি কলেজে পড়ব।

হাফিজুর রহমান নাতনিকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। আর সাজেদা বেগমের তো জানের জান। হাফিজুর রহমান নাতনিকে ধর্মীয় অনুশীলনে মানুষ করেছেন। আসিয়াও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মের সবকিছু মেনে চলে। আসিয়া মাদ্রাসায় হাফেজী পড়ার সময় থেকে রাবু তাকে পর্দা সম্বন্ধে নসিহত করত এবং সেই মতো পোশাক পরিয়ে মাদ্রাসায় ও স্কুলে পাঠাত। স্কুলে পড়ার সময় হাফিজুর রহমান নাতনিকে ধর্মের অনেক কিছু শোনাতেন। অনেক ধর্মীয় বইও পড়তে দিতেন।

হাফিজুর রহমান নাতনিকে যশোহরে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে কলেজে ভর্তি করে দিলেন।

আসিয়া এইচ.এস.সি.তেও এস.এস.সি’র মতো রেজাল্ট করে নানাকে বলল, আমি মেডিকেলে পড়ব।

আসিয়া দেখতে খুব কালো হলে কী হবে, শরীরের গঠন অত্যন্ত সুন্দর। তরুণী বয়সেই তাকে পূর্ণ যুবতিদের মতো দেখায়। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা দোহারা শরীর, চিকন কটি, ভারি নিতম্ব, পুরুষ্ঠ বক্ষ এবং জোড়ার নিচে পটলচেরা চোখ। আল্লাহপাক শুধু তার রংটাই যা কালো করেছেন। বাকি অন্যান্য সব কিছু এত নিখুঁত ও সুন্দর যা নাকি অদ্বিতীয়। সব থেকে তার পটলচেরা চোখ দুটো এত মায়াবী, যে কেউ সেই চোখের দিকে চাইলে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। আর তার গলার স্বর কোকিলের স্বরের মতো মিষ্টি। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে সে যেখানেই যাক না কেন হাতে পায়ে মোজা ও বোরখা ব্যবহার করত।

নাতনির কথা শুনে হাফিজুর রহমান হেসে উঠে বললেন, তুই ডাক্তার হতে চাস? কিন্তু আমি তো ঠিক করেছি এবার তোর বিয়ে দেব।

আসিয়াও হেসে উঠে বলল, এই কালিকে কেউ বিয়ে করবে না। তাই আমিও ঠিক করেছি, বিয়ে করব না। সারা জীবন ডাক্তারি করে গ্রামের দুঃখী মানুষের সেবা করে কাটিয়ে দেব।

: তোর গায়ের রং কালো হতে পারে; কিন্তু আল্লাহপাক তোকে অন্যান্য সব। দিক থেকে রত্ন করে তৈরি করেছেন। তোর মতো গুণবতী মেয়ে এ দুনিয়ায় খুব. কম আছে। ইনশাল্লাহ আমি তোর উপযুক্ত বর খুঁজে বের করবই।

আসিয়া আবার হেসে উঠে বলল, আপনি বর খুঁজতে খুঁজতে ততদিনে আমিও ইনশাআল্লাহ ডাক্তারি পাস করে ফেলব।

: আর তার আগেই যদি বর পেয়ে যাই?

: তখন না হয় অর্ধেক ডাক্তার হয়ে বরের ঘর করতে যাব। তবু আমি মেডিকেলে ভর্তি হব। আপনি সেই ব্যবস্থা করুন।

: এখন যা, ভেবেচিন্তে দেখি।

আসিয়া নানিকে, মাকে ও আব্বাকে মেডিকেলে পড়ার কথা বলে নানাকে বোঝাতে বলল। আরও বলল, তোমরা যদি এতে রজি না হও, তাহলে আমার ব্যবস্থা আমিই করব।

প্রথম দিকে আসিয়ার কথায় কেউ রাজি হলো না। শেষে আসিয়ার জিদে একরকম বাধ্য হয়ে হাফিজুর রহমান নিজে ঢাকায় এসে মেডিকেলে পরীক্ষা দেওয়ালেন। পরীক্ষায় ভালোভাবে পাস করার পর মেডিকেলে ভর্তি করে দিলেন। আসিয়া হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতে লাগল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *