২.
ফায়জুর সেই ঢাকায় এল, আর দেশের বাড়িতে যাবার নাম করল না। কলেজের দীর্ঘদিনের ছুটিগুলো সে হোস্টেলেই থেকে কাটায়। কখনো-সখনো হয়তো কোনো বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। তাও কয়েকদিন থেকে হোস্টেলে ফিরে আসে। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে নানা ছুতো দেখিয়ে এড়িয়ে যায়। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রকিবকে শুধু বলেছে, বাড়িতে সৎ মা, সে আমাকে একদম দেখতে পারে না। সুযোগ পেলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে। রকিব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও তাদের বাড়িতে কখনো যায়নি। ঢাকায় এসে তার চরিত্রের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নামায রোযা ছেড়ে দিয়েছে। বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখে, আড্ডা দেয়। জ্ঞান হবার পর থেকে তার মনে হয়, আব্বা চাচিকে নিকে করে খুব বড় অন্যায় করেছে। তার আরও মনে হয় আলেমরা অন্যকে সৎ উপদেশ দিলেও নিজেরা সে সব মানে না।
হাফিজুর রহমান পত্র দিয়ে ফায়জুরকে ছুটির সময় বাড়ি আসতে বলেন, কেমন আছে চিঠি দিয়ে জানাতে বলেন। তবুও ফায়জুর বাড়িতে আসে না, তবে প্রত্যেক মাসে একবার আব্বার পাঠানো টাকা প্রাপ্তির খবরের সঙ্গে নিজের ভালোমন্দ লিখে জানায়।
যত দিন, মাস, বছর পর হয় তত হাফিজুর রহমানও ছেলের ব্যবহারে তার উপর ক্রমশঃ রেগে যাচ্ছেন। ভাবেন, কোনো ছেলের কি উচিত, বাবাকে অপরাধী ভাবা? বিশেষ করে যে ছেলে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে। ওঁর খুব ইচ্ছা, ফায়জুরের সঙ্গে রাবুর বিয়ে দেবার। তাই একদিন স্ত্রীকে নিজের ইচ্ছার কথা বলে বললেন, রাবুর সঙ্গে ফায়জুরের বিয়ে হলে সবদিক বজায় থাকবে। প্রথমত, রাবু কালো বলে তাকে পাত্রস্থ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত বয়সকালে রাবু আমাদের যতটা সেবা যত্ন করবে, বাইরের মেয়ে অতটা কি করবে?. আর সব থেকে বড় কথা রাবুর অন্য জায়গায় বিয়ে হলে, তার স্বামী ইচ্ছা করলে শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে রাবুর উপর অত্যাচার করতে পারে। তখন আমাদেরকে সম্পত্তি দিতে বাধ্য হতে হবে। আর ফায়জুরের সঙ্গে বিয়ে হলে। কোনো দিকে কোনো ঝামেলা হবে না।
সাজেদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, এ বিয়ে জায়েজ আছে?
হাফিজুর রহমান বললেন, আছে।
সাজেদা বেগম বললেন, এমনি সে আমাকে দেখতে পারে না। আমাকে নিকে করেছেন বলে আপনার উপরও অসন্তুষ্ট। সেই জন্যে ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে আসেনি। তার উপর রাবুর গায়ের রং বেশ কালো। আমার মনে হয়, সে কিছুতেই রাবুকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।
হাফিজুর রহমান বললেন, যাতে রাজি হয়, সে ব্যবস্থা আমি করব।
সাজেদা বেগম বললেন, আপনি ব্যবস্থা করলে আমি খুশিই হব। দোয়া করি, আল্লাহ যেন সেদিন আমাকে দেখান।
ফায়জুর দু’বছর পর যখন এইচ.এস.সি. তে ভালো রেজাল্ট করে অনার্স পড়ার জন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হবার কথা লিখে টাকা চেয়ে পাঠাল তখন হাফিজুর রহমান নিজে ঢাকায় এসে ছেলেকে বললেন, ভার্সিটিতে পড়তে চাও পড়বে। কিন্তু তার আগে আমার সঙ্গে দেশের বাড়িতে চল। এ বছর আমি হজ্ব করব নিয়ত করেছি। হজ্বে যাবার আগে রাবুর সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে চাই।
ফায়জুর ঢাকায় এসে প্রতিজ্ঞা করেছে; আর কোনো দিন দেশের বাড়িতে যাবে না, তার উপর রাবুর সঙ্গে বিয়ে দেবার কথা শুনে খুব রেগে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এ আপনি কী বলছেন? রাবুর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ভাবলেন কী করে? সে তো আমার বোন।
হাফিজুর রহমান গম্ভীর স্বরে বললেন, বোন হলেও সে তোমার চাচাতো বোন। এ রকম বিয়ে শরীয়তে জায়েজ আছে।
ফায়জুর রাগের সঙ্গে দৃঢ়স্বরে বলল, তবু আমি করব না। ঐ কালো পেত্নীকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না।
সাজেদা বেগমকে নিকে করার পর থেকে হাফিজুর ছেলের ব্যবহারে মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। তখন ভেবেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বড় হবার পরও যখন তার আচরণের পরিবর্তন হলো না তখন থেকে ছেলের প্রতি রেগে ছিলেন। তারপর ঢাকায় থেকে লেখাপড়া করার কথা শুনে আরও রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাহিরে প্রকাশ না করে ছেলের কথা মেনে নিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ দু’বছর অনেকবার চিঠি দিয়ে তাকে বাড়িতে আসতে বলা সত্ত্বেও আসেনি। ফলে সেই রাগ আরও বেশি বেড়েছে। এখন ছেলের কথা শুনে এত বছরের পুঞ্জিভূত রাগ সামলাতে পারলেন না। গর্জে উঠে বললেন, তুমি লেখাপড়া করছ, কিন্তু মানুষ হলে না। বাবার মুখের উপর কথা বলতে তোমার বিবেকে বাধল না। তোমার মতো অকৃতজ্ঞ বেয়াদবকে ছেলে বলে স্বীকার করতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। আর রাবুকে কালো পেত্নী বলছ কেন? সাদা কালো সবই আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। রাবুকে তোমার পছন্দ না হতে পারে। তাই বলে ঘৃণা করা কবিরা গোনাহ। এর জন্য আল্লাহ পাক তোমাকে শাস্তি দিবেন। যাক আমার কথা শেষ কথা, হয় তুমি আমার সঙ্গে যাবে, নচেৎ আমি তোমার লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দেব। দেখব কেমন করে তুমি লেখাপড়া কর। তোমাকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করব।
আব্বার কথা শুনে ফায়জুরেরও এতদিনের পুঞ্জিভূত বিদ্বেষ ও অভিমান ফুঁসে উঠল, বলল, আপনার যা মন চায় তাই করুন আব্বা, তবু আমি আর কখনও দেশের বাড়িতে যাব না।
হাফিজুর রহমান রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, এটাই কি তোমার শেষ কথা?
ফায়জুর দৃঢ়কণ্ঠেই বলল, হ্যাঁ আব্বা, এটাই আমার শেষ কথা।
হাফিজুর রহমান ছেলের কথায় যেমন ভীষণ রেগে গেলেন, তেমনি মনে। আঘাতও পেলেন। বললেন, তোমার এটাই যদি শেষ কথা হয়, তা হলে আমিও যা বলেছি সেটাও আমার শেষ কথা। তারপর আর কোনো কথা না বলে দেশে ফিরে এলেন।
সাজেদা বেগম স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে যা বুঝবার বুঝে ফেললেন। কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করলেন না।
একসময় হাফিজুর রহমান স্ত্রীকে সব কথা বললেন।
সাজেদা বেগম বললেন, ফায়জুর যে রাজি হবে না, সে কথা আমি নিশ্চিত ছিলাম। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন ভেবে, অমত করিনি। ফায়জুর রাজি হয়নি তাতে আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু আপনি তাকে লেখাপড়ার খরচ দেবেন না, তাকে ত্যাজ্যপুত্র করবেন এই কথা শুনে খুব দুঃখ পেলাম। আসলে ও আমাদের নিকেটা মেনে নিতে পারেনি। তাই রাবুকে বিয়ে করতে চায় না। তাই বলে তাকে এতবড় শাস্তি দেয়া কি আপনার উচিত হবে? আর পাঁচজন শুনলে, তারাই বা কী ভাববে, বলবে একজন আলেম লোক হয়ে একি কাজ করলেন? না না, এ হতে পারে না। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ফায়জুর আমাদের একমাত্র ছেলে। তাকে এতবড় শস্তি দিবেন না। রাবু দু’দিন পর পরের ঘরে চলে যাবে। তখন আমাদের এতকিছু ভোগ করবে কে? শেষ বয়সে কে আমাদেরকে দেখবে?
হাফিজুর রহমান গম্ভীর স্বরে বললেন, তোমার কথাগুলো খুব ভালো। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে এতটুকু এদিক ওদিক হব না। এ ব্যাপারে তুমি আর কিছু আমাকে বল না।
রাবু এ বছর এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। আব্বা ঢাকা থেকে এসে মাকে যা কিছু বলেছে, আড়াল থেকে সব শুনেছে। শুনে তার চোখ দিয়েও পানি পড়তে লাগল। ভাবল, আমাকে বিয়ে করতে হবে শুনে ভাইয়া ঐ রকম কথা বলেছে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে মায়ের অনুমতি নিয়ে তাকে চিঠি লিখতে বসল।
ভাইয়া,
পত্রে আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ সালাম নিও। আশা করি খোদার ফজলে ভালো আছ। আমিও বাড়ির সকলে আল্লাহ পাকের রহমতে ভালো আছি। তুমি আজ দু’বছরের বেশি হয়ে গেল বাড়িতে আস না। কারণটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছি। অনেকবার ভেবেছি তোমাকে আসতে বলে চিঠি দেব। কিন্তু তুমি আমার চিঠি না পড়ে ছিঁড়ে ফেলবে অথবা পুড়িয়ে ফেলবে ভেবে দিইনি। আব্বা ঢাকা থেকে ফিরে এসে মাকে যেসব কথা বলল, তাতে বুঝতে পারলাম, আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবার জন্য আব্বা তোমাকে আনতে গিয়েছিল। তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার মতো কালো পেত্নীকে বিয়ে করে কেউ সুখী হবে না। তুমি খুব বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছ। তবে আব্বা ফেরার সময় তোমাকে যে সব কথা বলেছে, তা শুনে আমি যেমন খুব ভয় পেয়েছি, তেমনি খুব দুঃখও পেয়েছি। তুমি আমাকে ছোটবেলা থেকে দেখতে না পারলেও তখন থেকে আমি তোমাকে বড় ভাইয়ের মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে এসেছি। এখনও করি এবং চিরকাল করে যাব। আমি খুব কালো বলে হয়তো আমাকে চিরকুমারী থাকতে হবে। সে দুঃখ আমি সহজেই সহ্য করতে পারব। কিন্তু আমার কারণে তোমাকে আব্বা ত্যাজ্যপুত্র করবে, সে দুঃখ আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। আল্লাহপাক আমাকে রূপ না দিলেও মেহেরবানী করে কিছু দ্বীনি এলেম দিয়েছেন। সেইজন্যে হয়তো আত্মঘাতী হতে পারব না। কিন্তু চিরকাল চোখের পানিতে বুক ভাসাতে হবে। ভাইয়া তোমার পায়ে ধরে বলছি, এই পত্র পেয়ে বাড়ি আসবে। বাড়ি এলে আব্বা যদি আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবার চেষ্টা করেন, তাহলে আমি আত্মঘাতী হবার ভয় দেখিয়ে তাকে বাধা দেব। তাতে কৃতকার্য না হলে সত্যি সত্যি আত্মঘাতী হব। একান্ত যদি তুমি আমার কথা না রাখ, তা হলে এই কথাটা অন্তত জেনে রেখ, আব্বা তোমার খরচ না পাঠালেও আমি যেমন করে তোক পাঠাব। আব্বা ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারবে না। তুমি মন দিয়ে পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হও, এটাই আমি আল্লাহ পাকের কাছে সব সময় দোয়া করি। আশা করি ছোট বোনের এই আবদারটুকু অন্তত পূরণ করবে। আল্লাহ পাক তোমাকে বুঝশক্তি দিক এবং তোমাকে সহিসালামতে রাখুক এবং আবার তোমাকে আসবার জন্য কাকুতি মিনতি জানিয়ে শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ—
ইতি–
তোমার অযোগ্য বোন
রাবু।
ফায়জুর যথা সময়ে চিঠি পেয়ে খামের উপর প্রেরকের নাম দেখেই রেগে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইল। হঠাৎ তার মন বলল, চিঠিটা না পড়ে ছেঁড়া উচিত নয়। কিছুক্ষণ খামটার দিকে চেয়ে থেকে চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল। পড়া শেষ করে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আবার পড়ল। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চিন্তা করল, রাবুর গায়ের রং কালো হলে কী হবে মনটা খুব উদার। তারপর বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, দুঃখিত রাবু, তোর চিঠি পড়ে আমি খুশি হলাম ঠিকই, কিন্তু তোর কথামত বাড়ি যেতে পারব না। আর টাকা নিতেও পারব না। আমায় ক্ষমা করে দিস বোন।
রাবু চিঠি পোস্ট করার ছয় সাত দিন পর থেকে ভাইয়া আসার অথবা চিঠির উত্তরের আশায় দিন গুনতে লাগল। তারপর যখন মাসের পর মাস অপেক্ষা করার পরও তার আশা পূরণ হলো না, তখন ভাবল, ভাইয়া কোনোদিন আসবে না।
রাবু ভাইয়াকে চিঠি লেখার আগে মায়ের অনুমতি নিলেও লেখার পর মাকে পড়িয়ে শুনিয়েছিল। শুনে সাজেদা বেগম আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে বলেছিলেন, তোকে আল্লাহ পাক এত বুদ্ধি দিয়েছেন? খুব সুন্দর করে বেশ গুছিয়ে লিখেছিস তো? আমার মনের কথাগুলো যেন লিখেছিস। তিনি জানেন, এই চিঠি পেয়েও ফায়জুর আসবে না। তবু মেয়ের মন রাখার জন্য বললেন, দেখিস এই চিঠি পেয়ে ফায়জুর নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিশ্চয় আসবে।
শেষে রাবু যখন নিশ্চিত হল, তার আশা পূরণ হবে না তখন একদিন মাকে বলল, মনে হয় ভাইয়া আর কোনোদিন আসবে না। তুমি টাকা দাও, আমি মনিঅর্ডার করে পাঠাব।
সাজেদা বেগম নিজের টাকা থেকে কিছু টাকা এনে মেয়ের হাতে দিলেন।
রাবু পোস্ট অফিসে গিয়ে ভাইয়াকে টাকা মনিঅর্ডার করে দিল।
ফায়জুর বন্ধু রকিবের সাহায্যে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে অনেক চেষ্টা-চারিত করে হলে সিট নিয়ে পড়াশোনা করতে লাগল। সে ভেবেছিল, আব্বার কথা শুনিনি বলে হয়তো রাগের মাথায় ঐ সব বলেছে। রাগ পড়ে গেলে লেখাপড়ার খরচ নিশ্চয় পাঠাবে। কিন্তু রাবুর চিঠি পেয়ে বুঝতে পারল, আব্বা আর কখনো টাকা পাঠাবে না। সে তখন অনেক কষ্টে দু’টো ছাত্র যোগাড় করে টিউশনি করতে লাগল। ফায়জুর প্রতিজ্ঞা করল, আব্বা যখন টাকা পাঠাল না তখন আর কারো টাকা নেবে না। নিজেই যেমন করে হোক পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। তাকে অন্তত মাস্টার্স ডিগ্রি নিতেই হবে। কিন্তু দু’টো ছাত্রকে পড়িয়ে যে টাকা পায় তাতে তার খরচ সংকুলান হয় না। এর মধ্যে রাবুর পাঠানো টাকা এসে গেল। ফায়জুর টাকা রিসিভ করল না। ভাবল, ওদের কারো সাহায্য নেব না। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে বন্ধু রকিবের শরণাপন্ন হল।
রকিব তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। খুব বড়লোকের ছেলে। সে সাহায্য না করলে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারত না। হলেও সিট পাওয়া মুশকিল ছিল। রকিব ফায়জুরের সব খবর জানে। কেন সে বাড়িতে যায় না, আব্বা কেন তাকে টাকা পয়সা দেওয়া বন্ধ করেছে, সব কথা ফায়জুর রকিবকে বলেছে। এমনকি রাবুর চিঠিও তাকে পড়তে দিয়েছে। তার আব্বা একজন আলেম লোক হয়ে ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে নিকে করেছে এবং সেই স্ত্রীর আগের স্বামীর ঔরসের গর্ভজাত মেয়ে রাবুর সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চায়, সে কথাও রকিবকে বলেছে। রকিব তাকে তাদের বাড়িতে থাকতে বলেছিল, কিন্তু ফায়জুর রাজি হয়নি। রকিবরা একভাই একবোন। বোনটা ছোট। নাম হামিদা আখতার। ডাকনাম হেমা। সে এবছর ইডেনে ইন্টারে ভর্তি হয়েছে। তার বাবা মাহবুব আখতার একজন বিজনেস ম্যাগনেট। আখতার সাহেব নামে তিনি সমাজে পরিচিত।
একদিন ফায়জুর রকিবকে বলল, আমাকে একটা ভালো টিউশনি যোগাড় করে দে, নচেৎ খরচ কুলাতে পারছি না।
রকিব একটু চিন্তা করে বলল, আমার হাতে একটা ইন্টারের ছাত্রী আছে, পড়াতে পারিস। বেতন ভালো পাবি।
: ইয়ার্কি করছিস না তো?
: না রে, সত্যি বলছি।
: তাহলে ব্যবস্থা করে দে।
: ঠিক আছে, কাল তোকে বলব।
সেদিন বাড়িতে ফেরার সময় রকিব চিন্তা করল, বাবা হেমার জন্য একজন প্রাইভেট টিউটর দেখতে বলেছিল। ফায়জুরকে রাখলে কেমন হয়? বাবাকে সে কথা বলে দেখতে হবে।
রাতে খাবার টেবিলে হেমা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, বছরের অর্ধেক পার হয়ে গেল এখনও মাস্টার খুঁজে পেলে না? ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় ইংলিশে রেজাল্ট খারাপ হবে বলে রাখলাম। তখন আবার মুখ গোমড়া করে থেক না।
আখতার সাহেব বললেন, আজকাল কি আর ভালো মাস্টার পাওয়া যায়? সবাই টুকলিফাই করে পাস করে। যে দু’চারজন আছে, তাদেরকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। তারপর ছেলের দিকে চেয়ে বললেন, কিরে রাকিব, তোকে যে হেমার মাস্টারের কথা বলেছিলাম, খোঁজ নিয়েছিলি?
রকিব কিছু বলার আগে তার মা ফাবিহা বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আসলে তুই ইংলিশ খুব কম পড়িস। তাই ঐ সাবজেক্টে কাঁচা। জানিস, দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে সহজ ভাষা হলো ইংলিশ। সেবারে আমরা যখন দিল্লি, বোম্বাই বেড়াতে গেলাম, সে সময় দেখিসনি? ঐ সব জায়গায় মুটে-মজুর ও সুইপাররাও কেমন ইংলিশে কথা বলে।
রকিব মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আসলে কি জান মা, পরিবেশ ও কালচার মানুষকে অনেক বদলে দিতে পারে। তোমার কথাই ঠিক, হেমা নিচের ক্লাস থেকে ইংলিশে ফাঁকি দিয়ে এসেছে। তাই এখন তার কাছে কঠিন লাগছে।
হেমা রেগে গিয়ে রকিবের দিকে চেয়ে বলল, ভাইয়া, তুমিও আমার সঙ্গে দুশমনি করবে? বেশ আমার মাস্টার লাগবে না। তারপর সে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
রকিব হেমার বাম পাশে বসেছিল। তার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, ভাত খেয়ে নে। আজ আমি তোর জন্যে একটা মাস্টার ঠিক করেছি। কাল তাকে নিয়ে আসব।
হেমা গাল ফুলিয়ে বলল, তুমি আমাকে ফাঁকিবাজ বললে কেন? ভাত খাব na।
: আর বলব না, নে ভাত খেয়ে নে।
আখতার সাহেব রকিবকে বললেন, তা মাস্টারের পরিচয় ভালো করে নিয়েছিস তো? আজকাল অপরিচিত লোককে বিশ্বাস করা যায় না।
রকিব বলল, সে কথা আমি জানি, বাবা। আমি যার কথা বলছি, সে আমার ক্লাসমেট ও বন্ধু। খুব জিনিয়াস ছাত্র। তার নাম ফায়জুর রহমান। জান বাবা, ও
খুব বড় লোকের ছেলে। ও যখন ছোট তখন ওর মা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেছেন। কী একটা ব্যাপারে বাবার সঙ্গে মতভেদ হয়। সেই থেকে ওর বাবা ওকে খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বড় লোকের ছেলে হয়েও খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। আজ সে নিজেই আমাকে ছাত্রছাত্রী যোগাড় করে দিতে বলল।
আখতার সাহেব বললেন, তা হলে তো ভালোই হলো। তাকে হেমার কথা বলেছিস?
ও না বলিনি, তবে বলেছি, আমার হাতে একটা ইন্টারের ছাত্রী আছে, কাল ফাইনাল জানাব। তোমাদেরকে একটা কথা বলে রাখি, ফায়জুরের আত্মসম্মান জ্ঞান খুব বেশি। ছাত্রী আমার বোন শুনলে পড়াতে রাজি হবে না। তাই ঠিক করেছি, ওকে সে কথা জানাব না। হেমা আমার আত্মীয়া বলে চালিয়ে দেব।
হেমার খাওয়া হয়ে গেছে। হাত ধুতে ধুতে হেসে উঠে বলল, কতদিন আর চালাবে? একদিন যখন জানতে পারবে তখন কী হবে?
রকিব বলল, তখনকার চিন্তা তখন করা যাবে। ততদিনে কিছু একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব।
ফাবিহা বেগম বললেন, এ ব্যাপার নিয়ে যদি তোদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়?
রকিব বলল, তোমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ফায়জুর সে ধরনের ছেলেই নয়। তাছাড়া তার সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব।
হেমা তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বলল, তা হলে তাকে একদিনও বাড়িতে আননি কেন?
কতবার আনতে চেয়েছি, আসতে চায় না। বলে বন্ধুত্ব হয়েছে তোর সঙ্গে, তোদের বাড়ির সঙ্গে তো হয়নি। আমি বললাম, তাহলে বন্ধু বন্ধুর বাড়িতে যাবি না, এ কেমন কথা? তখন বলল কি জানিস? বলল, আমার মা নেই, বাবা থেকেও নেই। তোর মা-বাবাকে দেখলে তাদের কথা মনে পড়ে আমার কান্না পাবে।
ফাবিহা বেগম বলে উঠলেন, আহারে, ছেলেটার মনে অনেক দুঃখ। সে হেমাকে পড়াক আর না পড়াক তুই তাকে নিয়ে আসবি।
রকিব বলল, কাল ওকে নিয়ে আসব। তোমরা কিন্তু আমার পরিচয় ওকে দিবে না।
ফাবিহা বেগম বললেন, ঠিক আছে তাই হবে।
পরের দিন ভর্সিটিতে ক্লাস শেষ হবার পর রকিব ফায়জুরকে বলল, চল আজ তোকে একটা ছাত্রীর বাড়িতে নিয়ে যাব। ছাত্রীটা ইংলিশে কাঁচা। ইচ্ছা করলে পড়াতে পারিস।
ফায়জুর বলল, আগে তাকে টেস্ট করে দেখব, যদি দেখি একদম কাঁচা তা হলে পড়াব না।
রকিব বলল, পড়াবি না কেন? বড় লোকের আদুরে মেয়ে। অন্য সব বিষয়ে ভালো, শুধু ইংলিশে কাঁচা বলেই তো মাস্টার রাখতে চাচ্ছে। তুই ইংলিশে তুখোড়। কাঁচাকে পাকা করে ফেলবি।
ফায়জুর হেসে উঠে বলল, ছাত্রীর এনার্জি থাকলে অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি করব না। কথা বলতে বলতে রকিব তার গাড়ির কাছে এসে বলল, নে গাড়িতে উঠ।
রকিব বাড়ির গেটের কাছে এসে হর্ন বাজাতে দারোয়ান গেট খুলে দিল। করিডোরে গাড়ি পার্ক করে রকিব ফায়জুরকে সঙ্গে নিয়ে ড্রইং রুমে এসে বলল, তুই বস, আমি ভিতরে গিয়ে ওদেরকে খবরটা দিই। কথা শেষ করে সে ভিতরে চলে গেল।
ফায়জুর একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে ঘরের চারদিকে চেয়ে দামি দামি আসবাবপত্র দেখে অবাক হয়ে ভাবল, এরা কত বড়লোক? মেঝেয় মখমলের কার্পেট বিছানো। দরজা জানালায় দামি পর্দা। পর্দার সঙ্গে ম্যাচ করে, একই কালারের সোফাসেটের কভার। একপাশে একটা গ্লাস লাগান কাঠের শোকেস, তাতে বই ভর্তি। শোকেসের পাশে একটা বিশ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন। চারপাশের দেওয়ালে বড় বড় মনীষীদের অয়েল পেন্টিং। এইসব দেখে আব্বার। কথা মনে পড়ল। তার আব্বাও খুব সৌখিন মানুষ। তার ঘরের দেওয়ালে কৃাবা শরীফ, হজরত রাসূলে করিম (দঃ)-এর রওজা মোবারক, বড় পীর সাহেবের রওজা মোবারক, দিল্লির জুম্মা মসজিদ ও আগ্রার তাজমহলের ছবি টাঙানো আছে। সে যখন এইসব ভাবছিল তখন রকিব মা বাবা ও বোনকে সঙ্গে করে ফিরে এল।
তাদেরকে দেখে ফায়জুর দাঁড়িয়ে সালাম দিল। আখতার সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে সবাইকে বসতে বলে নিজেও বসলেন।
রকিব ফায়জুরের দিকে চেয়ে বলল, তুই পরিচয় পর্ব শেষ কর। আমি একটু আসছি। এই কথা বলে সেখান থেকে বাইরের দিকে চলে গেল।
আখতার সাহেব ফায়জুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রকিবের কাছে আপনার পরিচয় পেয়েছি। তারপর স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন, ইনি আমার স্ত্রী। মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, আমার মেয়ে হেমা। ওকে পড়াতে হবে। ও ইংলিশে বেশ কাঁচা। রকিবের কাছে শুনেছি আপনি ঐ সাবজেক্টে পাকা। ওর রিডিং রুমে গিয়ে ওকে একটু টেস্ট করতে পারেন।
ফায়জুর মনে মনে রকিবের উপর রেগে গেল। ভাবল, টেস্ট করার কথাটা নিশ্চয় ঐ বলেছে। বলল, দেখুন আমি রকিবকে এমনি কথার ছলে ঐ কথা। বলেছিলাম। আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমার মনে হয় উনি ইংলিশ কম পড়াশোনা করেন। টেস্ট করা লাগবে না। যাদের ডাল মেরীট, তারা সব সাবজেক্টে খারাপ থাকে। উনি তো ইংলিশ ছাড়া সব সাবজেক্টে ভালো।
এমন সময় একটা কাজের মেয়ে চা-নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখল।
ফাবিহা বেগম হেমাকে বললেন, তুমি পরিবেশন কর। আমাদেরকে শুধু চা দাও।
হেমা মাস্টারকে নাস্তা পরিবেশন করে বাবা-মাকে চা দিল।
ফায়জুর হেমাকে বলল, রকিব কোথায় গেল?
হেমা বলল, সে তো আপনার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। কখন আসে না আসে তার কোনো ঠিক নেই।
ফায়জুর একা খেতে লজ্জা করতে লাগল। সে চুপ করে রইল।
তাই দেখে ফাবিহা বেগম বললেন, রকিব ঘরের ছেলের মতো। যখন। আসবে তখন খাবে, আপনি খেয়ে নিন।
চা-নাস্তা খাওয়ার পর হেমা বলল, আপনি কিন্তু কাল থেকে পড়াতে আসবেন।
ফায়জুর হ্যাঁ না কিছু বলল না।
আখতার সাহেব বললেন, তার আগে বেতনের কথাটা বলে নেয়া উচিত।
ফায়জুর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, সেটা বলার দরকার নেই। আপনারা যা দেবেন তাতেই হবে।
আখতার সাহেব বললেন, তবু আপনার জানা দরকার।
ফায়জুর বলল, সেটা না হয় রকিবের কাছে জানাবেন। এখন আমাকে যাবার অনুমতি দিন।
ফাহিবা বেগম বললেন, কিন্তু রকিব তো এখনও এল না। ছেলেটা যে কী? বন্ধুকে এনে কোথায় চলে গেল। তারপর মেয়েকে বললেন, তুই মাস্টারকে নিয়ে তোর রিডিং রুমে গিয়ে আলাপ কর। ততক্ষণে হয়তো রকিব এসে পড়বে।
হেমা ফায়জুরের দিকে চেয়ে বলল, তাই চলুন, স্যার।
ফায়জুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেমার সঙ্গে তার রিডিং রুমে এল।
হেমা পড়ার টেবিলের কাছে এসে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বলল, বসুন স্যার।
ফায়জুর বসে বলল, রকিব কোথায় গেছে জানেন?
: না।
: ও আপনাদের কী রকম আত্মীয়?
হেমা মৃদু হেসে বলল, সেটা পরে জানতে পারবেন। এখন কি একটু পড়াবেন?
ফায়জুর চিন্তা করল, রকিব কখন আসবে না আসবে ততক্ষণ শুধু শুধু বসে থাকা ঠিক হবে না। বলল, আপনার টেনসের নলেজ কেমন?
: টেনস প্রধানত তিন প্রকার। প্রেজেন্ট, পাস্ট এবং ফিউচার। এই নলেজ ছাড়া আর কিছু নেই।
ফায়জুর মৃদু হেসে বলল, তাহলে তো আপনাকে গোড়া থেকে শুরু করাতে হবে। মনে রাখবেন, টেনসের নলেজ এবং স্টক অফ ওয়ার্ড থাকলে যে কেউ ইংলিশে অনর্গল কথা বলতে পারে। ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ইংলিশ মাছ। ভাতের মতো।
হেমাও মৃদু হেসে বলল, কিন্তু টেনসের ঐ প্রধান তিনটির যে কত ফাঁকড়া রয়েছে, সেসব মাথায় ঢুকে না।
ফায়জুর বলল, আমি বুঝিয়ে দেব। আপনি যদি ইংলিশে পরদর্শী হবার মন মানসিকতা নিয়ে শুনেন এবং আপনার শেখার এনার্জি থাকে, তাহলে দু’-এক মাসের মধ্যে আপনিও ইংলিশে অনর্গল কথা বলতে পারবেন। শুধু তাই নয়, ঐ সাবজেক্টের কোনো প্রশ্ন এস-এ বা লেটার মুখস্থ করতে হবে না। নিজেই বানিয়ে লিখতে পারবেন।
হেমা বলল, সত্যি বলছেন?
স্যারেরা কোনো দিন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মিথ্যা বলেন না। আমার কথা সত্য না মিথ্যা তা মন দিয়ে পড়লেই কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারবেন।
এমন সময় রকিব সেখানে এসে বলল, কিরে হেমা, মাস্টার ইন্টারভিউ নিচ্ছে বুঝি?
হেমা কিছু বলার আগে ফায়জুর তার দিকে চেয়ে বলল, তুই কী বল তো? আমাকে রেখে এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তারপর হেমাকে বলল, আজ আসি, কাল থেকে পড়াব।
রকিব মিথ্যে করে বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে চা নাস্তা খাইয়ে দেরি করে দিল। তুই গাড়িতে গিয়ে বস, আমি হেমার মা-বাবাকে বলে আসছি।
রফিক ফিরে এসে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, ছাত্রীকে কেমন মনে হলো?
: আচ্ছা তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই নেই? ছাত্রীকে টেস্ট করার কথা তোকে ইয়ার্কি করে বলেছিলাম। আর তুই কিনা তার মা-বাবাকে বলে দিলি?
রকিব হেসে উঠে বলল, বলেছি তো কী হয়েছে? যাকগে যা বলে ফেলেছি, তা নিয়ে বকবক করে লাভ নেই। হেমার বাবা বললেন, তোকে দেড় হাজার টাকা করে দেবেন।
: তুই বুঝি ওঁর কাছে বেতনের কথা তুলেছিলি?
: আরে না-না, আমাকে এত ছোট ভাবিস না। হেমার বাবা আখতার সাহেব নিজের থেকেই বললেন।
পরের দিন থেকে ফায়জুর হেমাকে সপ্তাহে তিনদিন পড়াতে লাগল। দু’একদিন পড়িয়েই বুঝতে পারল, তার অনুমান ঠিক। হোমা ছাত্রী হিসেবে সত্যিই ভালো। ইংলিশ বই ভালো করে পড়েনি, তাই ঐ সাবজেক্ট তার কাছে কঠিন মনে হয়। দু’তিন মাসের মধ্যে গ্রামারের সবকিছু শিখিয়ে দিতে এখন আর ইংলিশ পড়তে ভয় পায় না। নিজে নিজে সবকিছু করতে পারে।
একদনি পড়া হয়ে যেতে হেমা বলল, স্যার, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে দু’একটা কথা বলতে চাই।
: মনে করার কী আছে? কী বলবেন বলুন।
: আমি তো আপনার ছাত্রী এবং বয়সেও আপনার ছোট, তা ছাড়া এতদিন হয়ে গেল পড়াচ্ছেন, আমাকে আপনি করে বলেন কেন? তুমি করে বলতে পারেন না?
ফায়জুর কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, কেন? আপনি সম্বোধন তো সম্মানসূচক।
: তা ঠিক, তবে বড়রা কিন্তু ছোটদের তুমি করেই বলে। আমাকে তুমি করেই বলবেন।
ফায়জুর কিছু না বলে চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল।
হেমাও দাঁড়িয়ে বলল, কিছু বললেন না যে?
: কী বলব?
: যা বললাম।
এমন সময় রকিব রুমে ঢুকে তাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফায়জুরকে উদ্দেশ করে বলল, কী রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়াচ্ছিস কেন?
ফায়জুর কিছু বলার আগে হেমা আবেগের বশে ভুল করে বলে ফেলল, দেখ না ভাইয়া, এখনও স্যার আমাকে আপনি করে বলেন। তুমিই বল তো ভাইয়া, বন্ধুর ছোট বোনকে কেউ আপনি করে বলে?
কয়েক মাস হয়ে গেল ফায়জুর হেমাকে পড়াচ্ছে। সেই প্রথম দিন রকিব তাকে সঙ্গে করে এনেছিল, তারপর আর একদিনও তাকে এখানে দেখেনি। হেমার মুখের দিকে তাকালেই ফায়জুরের রকিবের কথা মনে পড়ে। দু’জনের মুখের মিল অনেকটা একই ধরনের! মাঝে মাঝে ভাবত, হেমা কি রকিবের বোন? আবার ভাবত, তাই বা কী করে হয়? বোন হলে পরিচয় গোপন করবে কেন? তার মন বলে উঠল, বোন বলে পরিচয় দিলে তুমি যদি পড়াতে না চাও? এদিকে তোমার টাকার দরকার। সে দিলেও তো তুমি নিতে না। তাই বন্ধুর উপকারের জন্য সবকিছু গোপন করেছে।
এখন হেমা রকিবকে ভাইয়া বলে ডাকাতে এবং তার কথা শুনে সেই অনুমানটা সত্যি বলে ফায়জুরের মনে হলো। একবার হেমার মুখের দিকে আবার একবার রকিবের মুখের দিকে এভাবে কয়েকবার তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে রকিবকে বলল, কাজটা তুই ভালো করিসনি।
হেমার কথায় যে ফায়জুর তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছে, তা রকিব বুঝতে পেরেও বলল, তুই কী কাজের কথা বলছিস। আমি বুঝতে পারছি না।
ফায়জুর কোনো কথা না বলে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল।
রকিব তার পথ আগলে বলল, উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছিস যে?
ফায়জুর গম্ভীর স্বরেই বলল, তুই আমাকে কী মনে করিস?
: কী আবার মনে করব? তুই আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু আর ভার্সিটির জিনিয়াস ছাত্র।
: তা হলে এ বাড়ি তোদের এবং হেমা তোর বোন, এ কথা গোপন করলি কেন? এটাই বুঝি অন্তরঙ্গ বন্ধুর পরিচয়?
রকিব হেমাকে বলল, তুই মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়। তারপর ফায়জুরের হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে বলল, আমি ভুলে করেছি, মাফ করে দে দোস্ত। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, বন্ধু হয়ে বন্ধুকে মাফ করবি না?
: কিন্তু তুই আমাকে এতবড় অপমান করতে পারলি?
: এতে যে তোকে অপমান করা হবে, তা আগে বুঝতে পারিনি। আমার বোনকে তুই পড়াবি না ভেবে পরিচয় গোপন রেখেছিলাম। তখন ভেবেছিলাম, এক সময় তোকে বুঝিয়ে বলব। তুই শুনে রেগে যাবি এবং হেমাকে পড়াবি না, তাই বলতে সাহস করিনি।
হেমার কাছে ঘটনাটা শুনে আখতার সাহেব ও ফাবিহা বেগম তাকে সঙ্গে নিয়ে আসার সময় রুমে ঢোকার আগে তাদেরকে কথা বলতে শুনে দরজায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এবার ভিতরে এসে আখতার সাহেব ফায়জুরকে উদ্দেশ করে বললেন, রকিব তোমার ব্যাপারটা আমাদের জানিয়েই করেছে। এতে তার দোষ কিছু হলেও তোমাকে অপমান করার মতো কিছু করেনি। রকিবের বন্ধু হিসেবে তুমিও আমার ছেলের মতো। তুমি অপমান বোধ করছ কেন? আজ থেকে তুমিও এ বাড়ির ছেলে।
ফায়জুর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে রইল।
এবার ফাবিহা বেগম বললেন, তোমাকে আমরা প্রথম থেকেই ছেলের মতো। ভেবেছি। শুধু রকিবের কথায় এতদিন কিছু বলিনি। রকিবের বাবা ঠিক কথা বলেছে। আজ থেকে তুমি রকিবের ভাই। তোমরা গল্প কর, আমি তোমাদের নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর তিনি স্বামীকে ডেকে নিয়ে চলে গেলেন।
তারা চলে যাবার পর রকিব ফায়জুরকে বলল, কিরে এখনও আমার উপর রেগে আছিস? তারপর হেমার দিকে চেয়ে বলল, আজ থেকে তুইও আর একে আপনি করে বলবি না। ভাইকে কেউ আপনি করে বলে না। তাই না?
হেমা মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ তাই, কিন্তু তোমার বন্ধু তো কিছু বলছে না।
রকিব ফায়জুরের কাছে এসে বলল, কী রে কিছু বলছিস না কেন?
ফায়জুর দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, তোর মতো বন্ধু পেয়ে আমি ধন্য। তোর মা-বাবার মতো ভালো মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছে, জানতাম না।
রকিব নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, যাক মস্তবড় চিন্তা দূর হলো। আমাদের পরিচয় জেনে গিয়ে তুই কি করবি ভেবে এতদিন খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
এরপর থেকে ফায়জুর রকিবদের বাড়ির ছেলের মতো হয়ে গেল।
.