১.
বৈশাখের আধাআধি। প্রচণ্ড গরম। অনেক দিন বৃষ্টি হয়নি। মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির। দুপুরের পর থেকে লু-র মতো বাতাস বইতে থাকে। আজ বিকেল থেকে ঈশান কোণে একটা কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। মেঘটা খুব ধীরে ধীরে সমস্ত আকাশ ঘিরে ফেলার জন্য যেন হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। রাখাল বালকেরা গরু বকরি তাড়াতে তাড়াতে ঘরে ফেরায় ব্যস্ত। গৃহবধূরা হাঁস-মুরগি খোয়াড়ে তুলছে। রাস্তার লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যে যার ঘরের দিকে ছুটছে। বনের পশু পাখিরাও বিপদ সঙ্কেত বুঝতে পেরে নিজেদের আশ্রয় স্থলে ঢুকে পড়ছে। ঠিক মাগরিবের নামাযের পরপর কাল বৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। সে কী ভীষণ ঝড়ের দাপট। সেদিন কেউ এশার আজান দিতে বা নামায পড়তে মসজিদে যেতে পারল না। বহু বেড়ার ও টিনের বাড়িঘর ভূমিষ্যাৎ হল। ছোট বড় অনেক গাছপালাও উপড়ে গেল। লোকজন একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করতে লাগল। মুরুব্বিদের ধারণা আজান দিলে ঝড়-বৃষ্টি থেমে যায়। তাই তাদের অনেকে যে যার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আজান দিল। কিন্তু ঝড় বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। একটানা ঝড়-বৃষ্টি হয়ে চলল। মাঝে মাঝে চারদিক আলো করে বজ্রপাত হচ্ছে। পৃথিবীতে যেন কেয়ামতের নমুনা শুরু হয়ে গেল।
রাত তখন একটা। রাবু প্রসব ব্যথায় ছটফট করছে। আজ দুদিন থেকে প্রসব ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। গ্রামের ধাইমা প্রসব করাতে পারছে না। মেয়ের কষ্ট দেখে হাফিজুর রহমান আজ সকালে নিজে যশোহর জেনারেল হাসপাতাল থেকে একজন নার্সসহ লেডিস ডাক্তার এনেছেন। তারাও অনেক চেষ্টা করে প্রসব করাতে পারছেন না। একদিকে সন্ধ্যা থেকে একটানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা, আর অন্যদিকে প্রসব ব্যথায় রাবুর জান বেরিয়ে যাবার উপক্রম। ডাক্তার বেলা তিনটের সময় এসে তাড়াতাড়ি প্রসব হবার একটা ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি। রাবুর অবস্থা সংকটজনক দেখে কিছুক্ষণ আগে আবার একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে যখন দেখলেন, তাতেও কাজ হচ্ছে না তখন ঘরের বাইরে এসে হাফিজুর রহমানকে বললেন, অপারেশান ছাড়া কোনো উপায় নেই।
হাফিজুর রহমান বললেন, তা হলে সেই ব্যবস্থা করুন।
ডাক্তার বললেন, এখানে অপারেশান করা যাবে না। হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু এই দুর্যোগে নিয়ে যাবেন কী করে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখা যাক, থামে কি-না। তারপর তিনি আবার প্রসূতির ঘরে ঢুকে গেলেন।
হাফিজুর রহমান জামাইসহ ঘেরা বারান্দায় এতক্ষণ বসে ছিলেন। ডাক্তার চলে যাবার পর অযু করে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে দু’হাত তুলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দোয়া করলেন, “আল্লাহপাক তুমি অসীম দয়ালু, তোমার দয়া ছাড়া কেউ এক মুহূর্ত বাঁচতে পারে না। তুমি আমার মেয়ের উপর দয়া কর, আহসানীর সঙ্গে তার বাচ্চা প্রসব করিয়ে দাও। হাসপাতালে গেলে ইজ্জত আবরু কিছু থাকবে না। আমি মানত করছি, দশটা নফল রোযা রাখব, একশো গরিব মিসকীনকে দাওয়াত করে খাওয়াব, তোমার ঘর মসজিদে এক হাজার টাকা দান করব। তোমার নবী পাক (সঃ)-এর উপর শতশত দরুদ ও সালাম পেশ করছি, তুমি আমার দোয়া কবুল কর।”
মোনাজাত শেষ করে জামাইকে বললেন, যাও বাবা, তাহাজ্জুদের নামায পড়ে তুমিও দোয়া চাও। তারপর বসে বসে তসবীহ হাতে নিয়ে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন। এভাবে সুবেহ সাদেক হয়ে গেল।
ফজরের আজান হয়ে যাবার পর হাফিজুর রহমান নামায পড়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন, এমন সময় ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করুন, এই মাত্র আপনার নাতনি হয়েছে।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে হাফিজুর রহমান বললেন, আল্লাহ পাক এই নাদান গোনাহগারের মানত কবুল করেছেন। সেজন্য তাঁর পাক দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি। আমরা কি এখন দেখতে যেতে পারি? তাছাড়া আজানও দিতে হবে।
ডাক্তার বললেন, একটু পরে যাবেন। আপনারা নামায পড়ে নিন। আমরা ততক্ষণে বাচ্চাকে গোসল করিয়ে দিই। কথা শেষ করে তিনি চলে গেলেন।
হাফিজুর রহমান জামাইসহ নামায পড়ে আঁতুড় ঘরে গিয়ে প্রথমে আযান দিলেন, তারপর নাতনিকে দেখে একটু যেন চমকে উঠলেন। সাজেদা বেগম সাদা কাপড়ে জড়িয়ে কোলে নিয়ে বসে আছে। হাত পা ও মুখ দেখে ওঁর মনে হল, পাঁকের মতো কালো কুচকুচে একটা পুতুল সাজেদার কোলে রয়েছে। মানুষের বাচ্চা যে এত কালো হয়, তা তিনি কখনও দেখেননি ও শুনেননি। সাজেদা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার মুখে আতঙ্কের ছাপ। চোখ দিয়েও পানি পড়ছে। তারপর রাবুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কাঁদছ কেন মা? সবকিছু আল্লাহপাকের ইশারা। তোমরা কেঁদে কী করবে? জান না আল্লাহপাক যা কিছু করেন, বান্দাদের মঙ্গলের জন্য করেন? তার উপর সুখে দুঃখে সন্তুষ্ট থাকা প্রত্যেক ঈমানদারের উচিত। তারপর জামাইকে বললেন, চল আমরা বারান্দায় যাই।
বারান্দায় এসে হাফিজুর রহমান জামাইকে বললেন, মন খারাপ করো না, বাবা। বড় হলে অত কালো থাকবে না।
মোকসেদ আলি মেয়েকে দেখে চমকে উঠেছিল। সে ভাবতেই পারেনি, তারা স্বামী-স্ত্রী একটু কালো বলে তাদের মেয়ে এত কালো হবে! শ্বশুরের কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে রইল।
যশোহর টাউনের প্রায় দশ মাইল উত্তরে দীঘারপাড়া গ্রাম। এটা ঝিনাইদহ জেলার বর্ডারে। এখান থেকে ঝিনাইদহ্ টাউনের দূরত্ব প্রায় পনেরো মাইল। তাই এখানকার লোকজনের যশোহর টাউনের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ। এই গ্রামের হাফিজুর রহমান বেশ বিত্তবান, আলেম ও প্রভাবশালী লোক। ওঁরা দুই ভাই। তিনিই বড়। ছোট হামিদুর রহমান। তাদের আব্বা যখন মারা যান তখন হামিদুর ক্লাস টেনের ছাত্র। আব্বা মারা যাবার পর হামিদুর রহমান লেখাপড়া ছেড়ে দেন। হাফিজুর রহমান ছোট ভাইকে লেখাপড়া করার জন্য অনেক বোঝালেন। কিন্তু হামিদুর রহমান বড় ভাইয়ের কথায় কর্ণপাত করেন নি। জমি জায়গা, চাষ-বাস দেখাশুনা করতে থাকেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব সম্ভাব থাকলেও তাদের স্ত্রীদের মধ্যে তেমন নেই। বড়র নাম নাবিলা বেগম। আর ছোটর নাম সাজেদা বেগম। নাবিলা বেগম বড় ঘরের মেয়ে হলেও সাজেদা বেগম গরিব ঘরের মেয়ে। হাফিজুর রহমান ছোট ভাইয়ের বিয়ে বড় ঘরেই দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু হামিদুর রহমান রাজি হননি। তিনি পাশের গ্রামের সাজেদা বেগমকে ভালোবাসতেন। আর সাজেদা বেগমও তাকে ভালোবাসতেন। তবে সে সময় আজকালের ভালোবাসার মতো তাদের হয়নি। একে তো পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার, তার উপর সে সময় ভালোবাসাবাসির এত ছড়াছড়ি ছিল না। তখন আউবুড়ো ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পেত না। মুরুব্বিরাও এ ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতেন। তবু হামিদুর রহমান ও সাজেদা বেগমের মধ্যে ভালোবাসাবাসি হয়েছিল একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
দীঘারপাড়ার পাশের গ্রাম জহুরপুরের কলিম উদ্দিন হামিদুর রহমানদের জমি বর্গা করত। ধান ঝাড়াই-মাড়াই ও ভাগ নেয়ার সময় হামিদুর রহমান কলিম উদ্দিনের বাড়ি যেতেন। কলিম উদ্দিনের একটা বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে ছিল। তার নাম সাজেদা বেগম। কলিম উদ্দিন টাকার জন্য মেয়ের বিয়ে দিতে পারেনি। সাজেদা বেগমকে দেখে হামিদুর রহমানের খুব পছন্দ হয়। সুযোগ মতো একদিন তাকে বলল, সাজেদা আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যদি রাজি থাক, তা হলে বিয়ে করব। সেদিন সাজেদা বেগম লজ্জায় কিছু বলতে না পেরে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। সাজেদা বেগম অনেক আগে থেকে হামিদুর রহমানকে দেখে মনে মনে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সে জানে, এ আশা তার কোনো দিন পূরণ হবে না। ওঁরা হল জমিদার। আর আমি হলাম তাদের বর্গাচাষির মেয়ে। তাছাড়া তার গায়ের রং একটু কালো। তাই সহজে সে হামিদুর রহমানের সামনে আসত না। তার বাবা কলিম উদ্দিন কোনো কারণে ডাকলে আসত। হামিদুর রহমানের কথা শোনার পর মনকে প্রবোধ দিয়ে রাখতে পারল না। তবু মনকে সংযত করে রইল, হামিদুর রহমান কী করেন দেখার জন্য। ভাবল, তিনি যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন, তা হলে যা করার তিনিই করবেন। এর কিছুদিন পর আবার একদিন সুযোগ পেয়ে হামিদুর রহমান সাজেদা বেগমকে বললেন, তুমি সেদিন কিছু না বলে পালিয়ে গেলে কেন? আমাকে কি তুমি বিশ্বাস করতে পারনি? না পছন্দ হয় নি?
সাজেদা বেগম মাথা নিচু করে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ওসব কিছু নয়। আমার ভাগ্য কি এত বড় হবে? আপনি জমিদার মানুষ। আর আমি হলাম গরিব চাষির মেয়ে। সে কথা ভেবে দেখেছেন?
হামিদুর রহমান বললেন, আমি ভেবেচিন্তেই বলছি। ওসব কথা শুনতে চাই না। শুধু জানতে চাই, তুমি আমাকে ভালোবাস কিনা এবং বিয়েতে রাজি আছ কিনা? তারপর দেখে নিও আমি কী করি।
সাজেদা বেগম নিজের মনকে ধরে রাখতে পারল না। বলল, আপনি আব্বার সঙ্গে কথা বলুন। তারপর ছুটে পালিয়ে গেল।
হামিদুর রহমান কলিম উদ্দিনকে বললেন, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। আপনার মতামত বলুন।
কলিম উদ্দিন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
হামিদুর রহমান তা বুঝতে পেরে বললেন, খুব অবাক হয়েছেন তাই না? অবশ্য অবাক হবারই কথা। যাইহোক, আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
কলিম উদ্দিন বলল, কিন্তু বাবাজি, আপনার বড় ভাই কি রাজি হবেন?
হামিদুর রহমান বললেন, সে ব্যাপারে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। যা করার আমিই করব।
কলিম উদ্দিন ছলছল চোখে বলল, আল্লাহ যদি আমার মেয়ের ভাগ্যে রেখে থাকে, তা হলে আমি আর কী বলব বাবা।
সেদিন বাড়িতে এসে হামিদুর রহমান ভাবিকে দিয়ে কথাটা ভাইয়াকে জানালেন।
হাফিজুর রহমান শুনে প্রথমে খুব রাগারাগি করলেন। তারপর ছোট ভাইকে বংশের সম্মানের কথা বলে অনেক বোঝালেন। আরও বললেন, আমি তোর বিয়ে বড় ঘরে ভালো মেয়ের সঙ্গে দেব।
হামিদুর রহমান কিছুতেই বড় ভাইয়ের কথা মানলেন না। বললেন, তোমার যদি এতই বংশ মর্যাদা, তা হলে আমাকে আলাদা করে দাও। আমি কলিম উদ্দিনের মেয়েকে বিয়ে করবই।
এই কথা শুনে হাফিজুর রহমান মনে খুব আঘাত পেলেন। তাদের মা, তারা ছোট থাকতে মারা গেছেন। বাবা পাঁচ বছর আগে মারা যাবার সময় তার হাতে হামিদুর রহমানের হাত রেখে বলেছিলেন, বাবা হাফিজুর, হামিদুর একটু বদরাগী, ও একগুঁয়ে। ওকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। তুমি সব সময় ওর দিকে লক্ষ্য রাখবে। কোনো কারণে যেন ভাইয়ে ভাইয়ে মনমালিন্য না হয়। বাবার সেই কথা এখন হাফিজুর রহমানের মনে পড়ল। বললেন, ঠিক আছে, তুই যখন আমার কথা শুনবি না তখন তোর কথামতই কাজ হবে। তারপর কিছুদিনের মধ্যে সাজেদা বেগমকে ছোই ভাইয়ের বউ করে ঘরে আনেন।
সাজেদা বেগম বড়লোক স্বামীর ঘরে এসে সবাইকে মানিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।
তার বড় জা নাবিলার কোলে দু’বছরের ফায়জুর। সাজেদা ফায়জুরের আদর যত্ন করতে লাগলেন। ফায়জুর ক্রমশ সাজেদা বেগমের ভক্ত হয়ে উঠল। চাচি আম্মা না হলে গোসল করবে না, খাবে না, তার কাছে ঘুমাবে।
সবকিছু দেখে শুনে হাফিজুর রহমান ছোট ভাইয়ের বউয়ের উপর সন্তুষ্ট। কিন্তু নাবিলা বেগম সাজেদা বেগমকে বাইরে বাইরে ভালোবাসলেও কালো ও গরিব চাষির মেয়ে বলে মনে মনে দেখতে পারেন না। তাই ছেলেকে তার কাছ থেকে সরিয়ে নেন। সামান্য কারণে ছোট ঘরের মেয়ে বলে বিদ্রূপ করে রাগারাগি করেন। সাজেদা বেগম কোনো প্রতিবাদ করেন না। চুপ করে সবকিছু সহ্য করেন। দু’বছর পরে সাজেদা বেগম একটা মেয়ে প্রসব করলেন। প্রসবের পর সাজেদা বেগম কঠিন অসুখে পড়লেন। তার পিছনে অনেক টাকা পয়সা খরচ হতে লাগল। অসুখ ভালো হবার পরও অনেক দিন তিনি কোনো কাজ কর্ম করতে পারলেন না। সংসারের কাজের জন্য দুটো মেয়ে থাকলেও নাবিলা বেগমকে সব কিছু দেখাশুনা করতে হচ্ছে। এইসব নিয়ে নাবিলা বেগম সাজেদা বেগমকে যা-তা বলতে শুরু করলেন। তবু সাজেদা বেগম রা করেন না, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মুখ বুজে সব সহ্য করেন।
একদিন হামিদুর রহমানের সামনে যখন নাবিলা বেগম সাজেদা বেগমকে ঐ রকম করে বলছিলেন তখন তিনি ভাবির সঙ্গে স্ত্রীর হয়ে দু’এক কথা বলতে বলতে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে হামিদুর রহমান ভাবিকে বললেন, সাজেদা কালো ও গরিব ঘরের মেয়ে বলে তাকে তুমি দেখতে পার না। কারণে অকারণে যা-তা বলে রাগারাগি কর। কেন এসব কর বলতে পার? সাজেদার বাপ গরিব হলেও তার স্বামী তো গরিব না। সে আমার স্ত্রী, আর ভাইয়ের মতো এ সংসারের সবকিছুর উপর আমারও অধিকার আছে। সবকিছুর অর্ধেক মালিক আমি। যদি সাজেদাকে নিয়ে এক সংসারে থাকতে না চাও, তা হলে ভাইয়াকে বল, আমার পাওনা অর্ধেক সম্পত্তি দিয়ে আমাদেরকে আলাদা করে দিতে। সাজেদার মতো মেয়ে বলে এতদিন তোমার যন্ত্রণা সহ্য করেছে, অন্য কোনো মেয়ে হলে করত না।
দেবরের কথা শুনে নাবিলা বেগম খুব রেগে গিয়ে বললেন, অত চেঁচামেচির দরকার কি? আলাদা হতে চাও, সে কথা বললেই তো পারতে।
হামিদুর রহমান বললেন, আলাদা হতে তো চাইনি, কিন্তু তোমার ব্যবহারের জন্যই কথাটা বললাম। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।
রাতে হাফিজুর রহমান স্ত্রীর কাছে সবকিছু শুনে বললেন, আসলে মেয়েদের জন্যই সংসার আলাদা হয়। তুমি বড়। তোমাকে ছোটদের অনেক অন্যায় সহ্য করতে হবে। পরের দিন সকালে একাকী হামিদুর রহমানকে ডেকে বললেন, তুই তোর ভাবির কথায় রাগ করিস না। সংসারে ওরকম অনেক কিছু হয়। মেয়েদের কথায় পুরুষদের কান দেওয়া উচিত নয়। এখন আলাদা হতে চাচ্ছিস কেন? আমি কি কোনো দিন তোকে কিছু বলেছি? না তোর অমতে কিছু করেছি। আলাদা হয়ে গেলে লোকে নানারকম নিন্দা করবে। ছোট বউ যখন পরের মেয়ে। হয়ে সব কিছু সহ্য করতে পারছে তখন তুই ভাবির কথা সহ্য করতে পারছিস না কেন? তোর ভাবিকে আমি বুঝিয়ে বলব, সে যেন ছোট বউয়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। আর শোন, চিরকাল ভাইয়ে ভাইয়ে এক সংসারে থাকে না। যখন ভালো মনে করব তখন আমি নিজেই সে ব্যবস্থা করব।
হামিদুর রহমান এখন আলাদা হতে চায় না। তিনি বড় ভাইকে খুব সম্মান করেন। তবে রেগে গেলে তার হুঁশজ্ঞান থাকে না। কাল তার স্ত্রীর প্রতি ভাবির আচরণে রেগে গিয়ে ঐ কথা বলেছেন। এখন বড় ভাইয়ের কথা শুনে ভিজে গলায় বললেন, আমাকে মাফ করে দাও ভাইয়া। ঐ কথা বলে আমি অন্যায় করেছি।
হাফিজুর রহমান বললেন, ঠিক আছে, এখন যা, আমি কিছু মনে করিনি। হাফিজুর রহমান ছোট ভাইকে খুব ভালোবাসেন। আর ছোট বউয়ের প্রতি প্রথম দিকে অসন্তুষ্ট থাকলেও পরে তার আচার-ব্যবহারে সন্তুষ্ট।
হামিদুর রহমানের মেয়ের নাম রাখলেন রাবেয়া। সবাই রাবু বলে ডাকে। রাবু যত বড় হতে লাগল তত তার গায়ের রং কালো হতে লাগল। মেয়েটা মায়ের থেকে একটু বেশি কালো। তার বয়স যখন তিন বছর তখন হাফিজুর রহমানের স্ত্রী নাবিলা বেগম ও ছোট ভাই হামিদুর রহমান কয়েক দিনের ব্যবধানে পক্স হয়ে মারা গেলেন।
ফায়জুর তখন ক্লাস টুয়ে পড়ে। মায়ের জন্য সে খুব কান্নাকাটি করতে লাগল।
সাজেদা বেগম তাকে আদর করে প্রবোধ দিতে লাগলেন। এতদিনে নাবিলা বেগমের আর কোনো ছেলেমেয়ে হয় নি। সাজেদা বেগম ফায়জুরকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে লাগলেন। কিন্তু ফায়জুর চাচিকে একদম সহ্য করতে পারল না। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, মা চাচির উপর খুব অসন্তুষ্ট ছিল। চাচিকে প্রায় রাগারাগি করতেও দেখেছে। তাই সেও চাচির উপর অসন্তুষ্ট ছিল। মা মারা যাবার পর চাচি তাকে আদর যত্ন করছে দেখে মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে তার প্রতি খুব বিরক্ত। এভাবে এক বছর কেটে গেল।
হাফিজুর রহমান চিন্তার মধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন। ভাবলেন, ছোট বউ দেখতে কালো হলেও স্বাস্থ্যবতী। তার উপর কাঁচা বয়স। এ অবস্থায় সারাজীবন কাটাবে কী করে? আর আমিও কি নিকে না করে জীবন কাটাতে পারব? কিন্তু ছোট বৌয়ের একটা কিছু ব্যবস্থা না করে নিজে নিকে করি কী করে? আবার ভাবলেন, যে মেয়েকে নিকে করে আনব, সে হয়তো ফায়জুরকে কষ্ট দেবে, এইসব চিন্তা করে ছোট বৌকেই নিকে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে নিকে করলে, সবাই ছি ছি করবে। আর সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে? তাছাড়া ছোট বউ যদি রাজি না হয়, তখন কী হবে? শেষমেশ চিন্তা করলেন, জহুরপুরের ঈদরীশ মৌলবীকে ধরে এই কাজ করতে হবে। তিনি যদি আমাকে সাহায্য করেন, তা হলে একদিকে যেমন লোকনিন্দা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, অপর দিকে তেমনি ছোট বউ রাজি না হলে, তার বাবাকে দিয়ে তিনি রাজি করাতে পারবেন।
হাফিজুর রহমান অনেক চিন্তা ভাবনা করে একদিন জহুরপুরে গিয়ে ঈরদীশ মৌলবীকে কথাটা জানালেন।
ঈদরীশ মৌলবী হাফিজুর রহমানকে চেনেন। বললেন, এটা তো খুব ভালো কথা। তবে লোকজন একটু নিন্দা করবে।
হাফিজুর রহমান বললেন, আপনি সাহায্য করলে আমি ওসব পরওয়া করব না। তারপর সংসারের পরিস্থিতির কথা সবকিছু জানিয়ে বললেন, আপনাকে এই কাজ করিয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে আপনিই কলিম উদ্দিনকে বলবেন। আরও বলবেন, তার মেয়ে যদি রাজি না হয়, তাহলে সে যেন মেয়েকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করায়।
ঈদরীশ মৌলবী বললেন, আপনি মানীগুণী ও আলেম লোক। এই কাজ করলে আল্লাহপাকও খুশি হবেন। আল্লাহপাককে খুশি করার জন্য আমি এই কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিলাম। আপনি এখন বাড়ি গিয়ে ছোট বউকে তার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিন। তারপর যা কিছু করার আমি করব।
মফিজুর রহমান বললেন, ঠিক আছে, আমি ছোট বৌকে দু’একদিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তিন চারদিন পর ঈদরীশ মৌলবী সাজেদা বেগম এসেছে শুনে একদিন কলিম উদ্দিনকে হাফিজুর রহমানের কথা বললেন।
মৌলবী সাহেবের মুখে সেকথা শুনে কলিমউদ্দিনের মন ঘেন্নায় কুচকে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শরীয়তে জায়েজ থাকলেও হাফিজুর রহমান সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে?
মৌলবী সাহেব বললেন, হাফিজুর রহমান সমাজকে পরওয়া করেন নাকি? তাছাড়া তিনি তো কোরআন হাদিসের বরখেলাপ কিছু করছেন না। ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনার মেয়ের ভালোমন্দ চিন্তা করুন। এত অল্প বয়সে বিধবা হয়ে সারাজীবন কাটবে কী করে? হাফিজুর রহমানেরও স্ত্রী মারা গেছেন। এক ঘরে এ অবস্থায় থাকা কি ঠিক হবে? তখন বরং লোকে নিন্দা করবে। আর অন্য জায়গায় সাজেদার নিকে দিলে তার মেয়ের কী হবে? তার চেয়ে হাফিজুর রহমান নিকে করলে, সবদিক বজায় থাকবে। আরও অনেক কিছু বুঝিয়ে বলার পর কলিম উদ্দিন রাজি হয়ে বলল, সাজেদা যদি রাজি না হয়?
মৌলবী সাহেব বললেন, আপনি তাকে আমার কথা বলে বোঝাবেন। প্রথম দিকে রাজি না হলেও পরে রাজি হবে।
কলিমউদ্দিন স্ত্রীসহ মেয়েকে হাফিজুর রহমানের মতামত ও মৌলবী সাহেবের কথা বলে অনেক বোঝালেন।
সাজেদা বেগম শুনে প্রথমে লজ্জায় মরে যেতে লাগলেন। তার উপর স্বামীর ভালোবাসার কথা মনে করে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে লাগলেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না। মেয়েকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে তার মা বলল, কেঁদে আর কী করবি? তকদীরের লেখা কেউ রদ করতে পারে না। মৌলবী সাহেব কোরআন হাদিসের কথা বলেছেন। তুই রাজি হয়ে যা মা। তোর বয়স এখন কাঁচা। সারাজীবন কাটাবি কী করে? আমরা তো তোকে সারাজীবন টানতে পারব না। আমাদের বাদে কে তোকে দেখবে? তোর তো আর কোনো ভাই বোন নেই যে তোকে দেখবে?
সাজেদা বেগম কয়েক দিন ধরে কেঁদে কেঁদে চিন্তা করল, এর চেয়ে বিষ খেয়ে মরে যাওয়া ভালো। আবার ভাবল, রাবুকে তা হলে কে দেখবে? শেষমেশ
চিন্তা করে ঠিক করল, শরীয়তে যখন জায়েজ আছে তখন আর আমি কী করব? তকদীরে যা আছে তা যখন হবেই, তখন বাবা-মার কথার অবাধ্য হব কেন? আর তারাই বা কতদিন বাঁচবে? এইসব চিন্তা ভাবনা করে একদিন মাকে বলল, তোমরা যা ভালো বুঝ কর। ঈদরীশ মৌলবীর চেষ্টায় মাস দুয়েকের মধ্যে হাফিজুর রহমান সাজেদা বেগমকে নিকে করে ঘরে নিয়ে এলেন। যখন গ্রামের লোক শুনল, হাফিজুর রহমান ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে নিকে করেছেন, তখন অনেকে নিজেদের মধ্যে ছি, ছি, করতে লাগল। কিন্তু প্রভাবশালী হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্চ করতে পারল না। তবে মুরুব্বিদের কেউ কেউ বলল, শরীয়াতে এটা যখন জায়েজ আছে, তখন হাফিজুর রহমান ঠিকই করেছেন। নচেৎ কলিমউদ্দিনের মেয়ের কী অবস্থা হতো, তা আল্লাহ মালুম।
হাফিজুর রহমান সাজেদা বেগমকে নিকে করার পর একদিন ফায়জুরকে বললেন, এবার থেকে রাবুর মাকে আম্মা বলে ডাকবি।
ফায়জুর এখন থ্রিতে পড়ে। ভালোমন্দ বোঝার জ্ঞান না হলেও আব্বা চাচিকে বিয়ে করেছে, সে কথা বুঝতে পেরেছে। তাই বিয়ের দিন থেকে আব্বার উপর তার মন বিদ্বেষে ভরে গেছে। আর চাচিকে তো সে আগের থেকেই পছন্দ করত না। আব্বার কথা শুনে মনে মনে ভীষণ রেগে গেল। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
হাফিজুর রহমান বললেন, কিরে চুপ করে আছিস কেন? যা বললাম তাই করবি।
ফায়জুর হ্যাঁ না কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল।
হাফিজুর রহমান ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তার মনোভাব বুঝতে পারলেন। ভাবলেন, ছেলেমানুষ, চাচিকে আম্মা ডাকতে লজ্জা পাচ্ছে। কিছুদিন গেলে ঠিকই ডাকবে।
ফায়জুরের কিন্তু চাচির প্রতি বিদ্বেষ ভাবটা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলল। আব্বার প্রতিও তাই। রাতে মায়ের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলে।
খবরটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার পর ছোট বড় ও সমবয়সি অনেকে তাকে জিজ্ঞেস করে, কীরে তোর চাচিকে তুই মা বলে ডাকিস? তাদের কথা শুনে। ফায়জুর খুব রেগে যায়। রাগের সঙ্গে বলে, সে কথা তোদের জানার দরকার নেই। তারপর মায়ের কথা মনে করে যখন তার চোখে পানি এসে যায় তখন তাড়াতাড়ি তাদের কাছ থেকে সরে যায়।
এভাবে সে এস. এস. সি. পাস করে আব্বাকে জানাল, ঢাকায় হোস্টেলে থেকে কলেজে পড়বে।
হাফিজুর রহমান এই সাত আট বছর লক্ষ্য করেছেন, সে সাজেদা বেগমকে একবারও মা বলে ডাকেনি। এমনকি তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেনি। সাজেদা বেগম কিছু বললে, গাঁইগুই করে দায়সারা গোছের মতো বলে। হাফিজুর রহমান আরও লক্ষ্য করেছেন, সাজেদা বেগমকে নিকে করার পর থেকে তার সঙ্গেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। ধারে কাছেও আসে না। তাকে দেখলেই মুখ গম্ভীর করে মাথা নিচু করে সরে যায়। এখন তার কথা শুনে বললেন, ঢাকায় না গিয়ে যশোহরে থেকে কলেজে পড়।
ফায়জুর বলল, কলেজের পর ভার্সিটিতে পড়ার জন্য ঢাকায় যেতে হবে। তাই প্রথম থেকেই ঢাকায় পড়তে চাই।
হাফিজুর রহমান বুঝতে পারলেন, ছেলে আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বেশ তাই হবে।
ভাশুরের সঙ্গে সাজেদা বেগমের যখন নিকে হয় তখন রাবুর বয়স তিন বছর। বড় চাচি ও আব্বা মারা যাবার পর বড় চাচা যে তার মাকে নিকে করেছে, সেসব কথা তার মনে হয়নি। তাই ফায়জুরকে ছোট বেলা থেকে নিজের বড় ভাই বলে মনে করত। তারপর ক্রমশঃ বড় হয়ে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে? কিন্তু ফায়জুর তাকে কাছে টেনে নেয়নি। কোনো কিছু আব্দার করলে বকাঝকা করে ভাগিয়ে দিত। রাবুর কচিমনে খুব কষ্ট হতো। রাবু ভাবত, আমি কালো বলে ভাইয়া আমাকে দেখতে পারে না। যখন থেকে রাবু বুঝতে পারল, ভাইয়া তাকে মোটেই দেখতে পারে না তখন থেকে নেহায়েত দরকার না হলে সে আর তার ধারে কাছে যায় না। সে এখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। হাফিজুর রহমান যখন সাজেদা বেগমকে ফায়জুরের ঢাকায় পড়তে যাবার কথা বলেছিলেন তখন রাবু শুনে নতুন করে মনে কষ্ট পেল। এক সময় ফায়জুরকে বলল, ভাইয়া আব্বা বলছিল, তুমি নাকি ঢাকায় থেকে লেখাপড়া করবে?
ফায়জুর যত বড় হয়েছে, এ বাড়ির সবার উপর তত রাগ বেড়েছে। রাবুর কথা শুনে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শুধু বলল, হ্যাঁ।
রাবুর আর কোনো ভাইবোন হয়নি। তাই ভাইয়া তাকে দেখতে না পারলেও সে তাকে মনে মনে খুব শ্রদ্ধা করে। বলল, আমাদেরকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে? মন কেমন করবে না?
ফায়জুর বলল, তোরা আমার কে, যে মন কেমন করবে?
এই কথা শুনে অভিমানে রাবুর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
ফায়জুর বলল, এখন যা দেখি, বেশি বকবক করবি না। কথাটা বলে তার দিকে চাইতে দেখল, রাবুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
ভাইয়াকে তার দিকে চাইতে দেখে রাবু মাথা নিচু করে গুটি গুটি পায়ে সেখান থেকে চলে এল।
রাবুর চোখে পানি দেখে ফায়জুরের বিবেক তাকে বলল, ওর কী দোষ? আর ওর মায়েরই বা কী দোষ? ওর মা তো বিয়েতে রাজি ছিল না। তোমার আব্বাই তো জোর করে বিয়ে করেছে। এ জন্য রাবু ও তার মা দোষী হতে পারে না। রাবুর মায়ের বিষ খাওয়া ছাড়া অন্য পথ ছিল না। তবুও তাকে দোষী বলে মনে করলেও রাবু তখন নিষ্পাপ শিশু। তাকে কাছে টেনে নাওনি কেন? সে তোমাকে ছোটবেলা থেকে বড় ভাই হিসেবে ভক্তিশ্রদ্ধা করে, তোমার সঙ্গে মিশবার জন্য কতবার চেষ্ট করেছে। কিন্তু তুমি তার শিশু মনে বারবার আঘাত দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছ। এখনও সে তোমাকে বড় ভাই হিসেবে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। তুমি তাকে একদম দেখতে পার না জেনেও ঢাকায় লেখাপড়া করবে শুনে, তোমার কাছে এসেছিল। দেখলে না, তোমার কথা শুনে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চলে গেল?
ফায়জুর নিজের বিবেকের কাছে ছোট হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, হয়তো এসব কথা ঠিক, কিন্তু আমি যে কিছুতেই মনকে প্রবোধ দিতে পারি না। শুধু মনে হয়, এরা সবাই আমার মায়ের দুশমন। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.