কালোঘোড়া – ১৭

সতেরো 

দিন পনেরোর মধ্যে শ্রীমন্ত আর সুমিত্রার মধ্যে বিবাহ হয়ে গেল। সমারোহের সঙ্গে নয়, শান্তভাবে এবং তিন আইন অনুযায়ী। সাবালিকা কন্যার ভালোমন্দ বোঝবার উপর যথেষ্ট আস্থা থাকা সত্ত্বেও ভাদ্র মাসে তিন আইন অনুযায়ী রেজেস্ট্রি-করা বিবাহে সুমিত্রার বাপ- মা কেউ উপস্থিত হতে পারলেন না। শ্রীমন্তর বাপ-মায়ের বালাই নেই। উভয়পক্ষের একমাত্র সাক্ষী ক্যাপ্টেন হেনরী আলেকজান্ডার। 

হেনরী ওকে উপহার দিয়েছে একখানা গোলাপী রঙের বেনারসী এবং ডাকছে ‘গোলাপী বন্ধু’ বলে। আর শ্রীমন্ত নিজে দিয়েছে জড়োয়া গহনা থেকে আরম্ভ করে সাবান পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার টাকার জিনিস। মাইনে থেকে সুমিত্রাও কিছু জমিয়েছিল। তাই থেকে সে একটা হীরার আংটি দিয়েছে। 

বাপ-মা বিয়েতে আসেননি বলে সুমিত্রার দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু সে দুঃখ এখন আর নেই। বেশ আনন্দেই সে আছে। এখন তার মনে একমাত্র প্রশ্ন, চাকরি ছেড়ে দেবে কিনা। ঘরে তার মন বসেছে, বাইরের চাকরি আর ভালো লাগে না। বিয়ের পর কোন মেয়েরই বা লাগে? 

কথাটা একদিন ও শ্রীমন্তকে বললে অফিস থেকে ফেরবার পথে। 

শ্রীমন্ত আজকাল আর অফিস থেকে বেরুতে আগের মতো দেরি করে না। যদি-বা একটু দেরী হয়, সুমিত্রা অপেক্ষা করে। আশ্চর্য এই যে, ওদের বিয়ের খবর অফিসের জনপ্রাণীও জানে না- এমন কি বড়বাবু পর্যন্ত না। 

তার ফলে বড়বাবু মাঝে মাঝে শ্রীমন্তর সামনেই সুমিত্রার সঙ্গে রসিকতা করেন। ওরা হাসে, রাগ করে না। 

ট্রামে যা ভীড় তাতে শ্রীমন্ত দূরের কথা, সুমিত্রা পর্যন্ত কোনো কোনো দিন বসবার জায়গা পায় না। সুতরাং বড় একটা কথা হয় না। একে অফিসের হাড়ভাঙা খাটুনী, তার উপর ট্রামের এই ভীড়! 

সুমিত্রা বিরক্তভাবে বললে, আর ভালো লাগে না চাকরি। মনে করছি, ছেড়ে দোব। তুমি কি বলো? 

শ্রীমন্ত বললে, যা ট্রামে ভিড়! ভদ্রতা বজায় রেখে মেয়েদের যাওয়া-আসা করাই মুশকিল। 

ওরা বাড়ী এসে গিয়েছিল। হাতের বেঁটে ছাতাটা দুলিয়ে সুমিত্রা বললে, শুধু সেই জন্যেই নয়। 

—তবে? 

সুমিত্রা একটু রহস্যময় হেসে বললে, দু’জন খেটে-খুটে আসব, চাকরে চা দেবে, এইটে আমার ভালো লাগে না। 

—কি করতে চাও তার বদলে? 

—তার বদলে আমি তোমার জন্যে সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসে থাকব। তুমি এলে হাসি দিয়ে তোমায় অভ্যর্থনা করব, নিজের হাতে চা তৈরি করে দোব। সেই ভালো, না? 

—নিশ্চয়!শ্রীমন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললে। 

সত্য কথা বলতে গেলে, এই বিয়েতে সব চেয়ে লাভ হয়েছে শ্রীমন্তর। শুধু যে বাড়ির চেহারাই বদলে গেছে তাই নয়, তরকারিগুলোর স্বাদ পর্যন্ত। 

একটা ঠাকুর সম্প্রতি পাওয়া গেছে। ভাগ্যের বিষয়, সেটা কালা নয়। কিন্তু রান্না যে শুধু তারই নয়, তাতে সুমিত্রার হাতেরও স্পর্শ আছে, অন্তত সুমিত্রার তত্ত্বাবধানে তা বুঝতে বিলম্ব হয় না। 

ফলে এই অল্প দিনেই শ্রীমন্তর খাওয়ায়, শোওয়ায়, বেশ আরামের বোধ এসেছে। ও বুঝতে পারে, এই আরামের রসে জারিয়ে সুমিত্রা ওকে ধীরে ধীরে কাবু করে ফেলছে। তবু আরামের লোভ শেষ পর্যন্ত ছাড়তে পারে না। জ্ঞাতসারেই ও মাকড়সার জালে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে। জ্ঞাতসারে এবং স্বেচ্ছায়। 

সুমিত্রা চাকরি ছেড়ে দিলে সেই আরাম ওর আরও বাড়বে এই সম্ভাবনায় পুলকিত হয়ে বললে, তাহলে আর দেরী কোরো না। কালকেই এক মাসের নোটিশ দিয়ে দাও। 

.

পরের দিন সকালবেলা হঠাৎ শঙ্কর এসে উপস্থিত। 

—শ্রীমন্তদা! 

শ্রীমন্ত তখন ঈজিচেয়ারে শুয়ে জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়ছিলো। ওর চেয়ারের হাতলে বসে সুমিত্রা শুনছিলো। শঙ্কর আসতে ধীরে ধীরে উঠে পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো। 

—কি খবর শঙ্কর?—শ্রীমন্ত খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলে।

শঙ্কর তখনও হাঁফাচ্ছে। মুখ উত্তেজনায় লাল। বললে, তোমার বাড়ির সামনে একটা খুন হয়ে গেল। 

শ্রীমন্ত এবং সুমিত্রা দু’জনে এক সঙ্গে চীৎকার ক’রে উঠলো : খুন? 

—হ্যাঁ। মোড়ের মাথায় কতকগুলো ছেলে একটা ট্রাম পোড়াচ্ছিল। এমন সময়ে একটা মিলিটারি পেট্রল এসে পড়লো। ছেলেরা যে যেদিকে পারলে পালালে। মারা পড়লো ফল-ওলা। 

শুনে ওরা স্তব্ধ হয়ে গেল। 

কংগ্রেস-নেতৃবৃন্দ আটক হওয়ার পর থেকেই এই কাণ্ড চলছে। ভারতের নানাস্থানে রেলের লাইন তুলে, টেলিগ্রাফের তার কেটে রেলস্টেশনে আর পোস্টাফিস পুড়িয়ে লোকেরা একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করছে। কলকাতাতেও খুব গোলযোগ আরম্ভ হয়ে মধ্যে একটা বছর বন্ধ ছিল। আবার কি নতুন করে আরম্ভ হোল নাকি? 

শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করলে, তুমি এদিকে কি করতে এসেছিলে? 

—তোমার কাছেই আসছিলাম। পথে ট্রাম পোড়ানো দেখে ওরই মধ্যে মেতে গিয়েছিলাম। 

—সর্বনাশ! খবরদার ওর মধ্যেও যেও না। মারা পড়বে কোন দিন। 

সলজ্জভাবে হেসে শঙ্কর বললে, আমাদের পাড়াতেও খুব গোলযোগ চলেছে। আমাদের বাড়ির সামনে একটা কাঁদুনে বোমা ছুঁড়েছিল। আমাদের দারোয়ানটা চোখ জ্বালা করে যায় আর কি! 

—তারপরে?—সুমিত্রা সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলে। 

উত্তর দিতে গিয়ে শঙ্কর থমকে গেল। উত্তেজনার মুহূর্তে সে প্রথমে সুমিত্রাকে খেয়ালই করেনি। এখন সবিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো। 

শ্রীমন্ত হেসে বললে, তোমার বৌদিদি। 

—বৌদিদি? শঙ্কর তবু যেন বুঝতে পারছিল না। 

শ্রীমন্ত লজ্জিতভাবে বললে, অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বিয়ে হোল, তোমাদের কাউকে জানাতে পারিনি। মাকে বোলো একদিন ওকে নিয়ে যাবো তোমাদের বাড়ি। 

তারপর সুমিত্রার দিকে চেয়ে বললে, ওর নাম শঙ্কর। ওদেরই বাড়িতে আমি মানুষ হয়েছি। শোভাবাজারের ঘোষেদের নাম শোনোনি? তাদেরই বাড়ির ছেলে! 

বিদ্যুৎবেগে অনেক কথা সুমিত্রার মাথার ভিতর দিয়ে ঘুরে গেল। বললে, বুঝেছি, তুমি হৈমন্তীর ভাই? 

—ছোটদিকে আপনি চেনেন? 

—ঠিক চিনি না, নাম শুনেছি অনেক বার। বোসো, তোমার জন্যে চা নিয়ে আসি। শেষে তোমার ছোটদির কাছে গিয়ে নিন্দে করবে, ওদের বাড়ী গেলাম, এক পেয়ালা চাও খাওয়ালে না। 

দ্রুতপদে সুমিত্রা ভিতরে চলে গেল। 

শ্রীমন্ত একদৃষ্টে সুমিত্রার মুখের দিকেই চেয়েছিল। এখন শঙ্করের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তারপরে? 

—আরও কিছু চাল চাই যে শ্রীমন্তদা। 

—বেশ তো। কালকে দিয়ে আসব। কিছু লজ্জা কোরো না আমাকে। 

—না। লজ্জা করব কেন? 

বলে শঙ্কর বুক পকেট থেকে পাঁচখানা দশ টাকার নোট বের করলে। 

বললে, সেবারের দাম তো বলে আসোনি। মা বললেন, পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে যা। বেশী হোলে শ্রীমন্তকে বলবি এর পরের দিন যখন আসবে যেন চেয়ে নিয়ে যায়। 

দু’মণ চালের দাম তখন ত্রিশ। কিন্তু বিনা দ্বিধায় শ্রীমন্ত সমস্ত টাকাই পকেটে ফেললে। বললে, না। মাকে বোলো এর চেয়ে বেশী লাগবে না; আর বোলো কালকেই হোক আর পরশুই হোক, আরও এক বস্তা চাল আমি সেদিনকার মতো গিয়ে দিয়ে আসব। 

খুশি হয়ে শঙ্কর উঠতে যাচ্ছিল। এমন সময় সুমিত্রা এক হাতে একটা প্লেটে খাবার, অন্য হাতে চা নিয়ে এসে ওর সামনে রাখলে। 

শঙ্কর আবার বসলো। 

খেতে-খেতে বললে, আপনারা দু’জনে একদিন কিন্তু আমাদের বাড়ি আসবেন বৌদি। নইলে মা খুব দুঃখ করবেন। 

—নিশ্চয় যাব। তোমার ছোটদি রয়েছেন তো? তাঁকে বোলো একদিন গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে আসব। 

—বেশ। 

শঙ্কর চলে যাওয়ার পরে শ্রীমন্ত সুমিত্রাকে জিজ্ঞাসা করলে, ক’বারই তুমি হৈমন্তীর কথা বললে সুমিত্রা। তুমি কি তার সম্বন্ধে ‘জেলাস’ হতে আরম্ভ করলে? 

সুমিত্রা ওর ঈজিচেয়ারের হাতলের উপর বসলো। 

বললে, না। কেন বলো তো? হৈমন্তীর সঙ্গে দেখা করব শুনে কি ভয় করছে তোমার? 

—ভয় কেন করবে? 

—পাছে তার কাছ থেকে বুক-পোড়ানো মন্তরটা শিখে আসি? 

শ্রীমন্ত হাসলে। বললে, সে কি সবাই পারে? 

কথাটার মধ্যে একটা খোঁচা ছিল। সুমিত্রার বুকে বিঁধলো। এবং সুমিত্রার মুখে কে যেন মুহূর্তের মধ্যে কালি মাখিয়ে দিলে। 

শ্রীমন্ত তাড়াতাড়ি নিজের কথা সংশোধন করে বললে, তুমি হোলে ভরা বর্ষার মেঘ, আর ও হোল বজ্র। বজ্রেরই কাজ বুক পোড়ানো, মেঘের নয়। 

সুমিত্রা বুঝলে, এটা সান্ত্বনা। কিন্তু এ নিয়ে কলহ করতে তার প্রবৃত্তি হোল না। বরং প্রকাশ্যে হেসে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে উড়িয়ে দেবারই চেষ্টা করলে। 

জিজ্ঞাসা করলে, শঙ্কর কি জন্যে এসেছিল? 

শ্রীমন্ত হেসে বললে, সে এক কলঙ্কজনক ইতিহাস। চাল পাওয়া যাচ্ছে না জানো তো? চালের অভাবে ‘দেবধামে’ বহু দাসী চাকর ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু চাল ব্ল্যাক-মার্কেট থেকে কিনে কোন রকমে চালাচ্ছেন। কিন্তু বড় বাবু পারছেন না। 

—এই ব্ল্যাক-মার্কেট কি এমনি করেই চলবে? 

—চলবে। কারণ, যারা চালের মহাজন, বেশী লাভের লোভে তারা চাল লুকিয়ে ফেলেছে। সেই চাল ব্ল্যাক-মার্কেটে চড়া দামে বিক্রি করছে। 

—চাল লুকুচ্ছে কোথায়? হাজার হাজার বস্তা চাল তো সহজ নয়। ধরা পড়ছে না কেন? 

—না। ধরা না পড়বার কৌশল জানে তারা। যেখানে ইংরেজের রাজত্ব যাবার আশঙ্কা থাকে, সেখানে গর্বনমেন্ট সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেন। ব্ল্যাক-মার্কেটে ইংরেজের রাজত্ব যাবার আশঙ্কা তো নেই। তাই অবারিত ঘুষের জোরে ব্ল্যাক-মার্কেট প্রকাশ্যেই চলেছে। 

—কিন্তু লোকের কত কষ্ট হচ্ছে? 

শ্রীমন্ত হো হো করে হেসে উঠলো। 

বললে, ভারতবর্ষে লোকের কষ্ট কবে কম সুমিত্রা? বরাবরই তো এরা পঙ্গপালের মতো জন্মায় আর পিঁপড়ের মতো মরে। এ আর একটা নতুন ব্যাপার কি?

ওর কথা শুনে এবং বলবার ভঙ্গি দেখে সুমিত্রা স্তব্ধ হয়ে গেল।

শ্রীমন্ত বলতে লাগলো : 

—ব্ল্যাক-মার্কেট কি শুধু বড় মহাজনই করছে ভেবেছ? ঝি-চাকরগুলো পর্যন্ত এই নেশায় মেতেছে। তারা সদলবলে এসে কন্ট্রোলের দোকান থেকে কন্ট্রোলের দরে চাল, চিনি, কেরোসিন নিচ্ছে, আর অসহায় ভদ্রলোকদের কাছে চারগুণ দামে তাই বিক্রি করছে। 

—বলো কি, তারাও? 

শ্রীমন্ত বললে, এদিকে ঝি-চাকর খোঁজো, পাবে না। বোমার ভয়ে যারা পালিয়েছিল সব ফিরে এসেছে। কিন্তু তারা এখন আর লোকের বাড়ি চাকরি করতে চাচ্ছে না। সেদিন সোমেশ কি বললে জানো? 

—কি বললে? 

—ওদের বাড়ির ঝিটা ছেলের অসুখে দেশে যাবার নাম করে সরে পড়েছে। সোমেশের স্ত্রী পাশের বস্তীর একটি স্ত্রীলোককে ডেকে বললেন, একটা ঝি দেখে দিতে পারো দিদি? একগাল হেসে স্ত্রীলোকটি বললে, দিন কতক এখন নিজেই বাসন ক’খানা মেজে নাও দিদি; ঝি আর পাওয়া যাবে না। কন্ট্রোলে দাঁড়িয়ে তারা দিনে দুটো করে টাকা রোজগার করছে। শুনলে কথা? 

সুমিত্রা স্তব্ধ হয়ে শুনলে। 

জিজ্ঞাসা করলে, লাভের নেশায় এই যে সব মানুষ উম্মাদ হয়ে ছুটে চলেছে, এর পরিণাম কি বলতে পারো? 

—মৃত্যু। লাভের নেশায় যারা ট্যাঙ্ক নিয়ে যুদ্ধে চলেছে, তাদেরও যে পরিণতি, এদেরও তাই। 

—তবে যাচ্ছে কেন? 

শ্রীমন্ত হাসলে। বললে, আলোর দিকে পতঙ্গ কেন ছোটে? 

সুমিত্রা নিঃশব্দে ভাবতে লাগলো। 

হঠাৎ এক সময় জিজ্ঞাসা করলে, শঙ্করদের যে মিহি চাল দেবে, সে চালের তোমার যোগাড় আছে? 

—আছে। 

—কি করে যোগাড় করলে গো? এক বস্তা চাল তো আজকের দিনে সামান্য ব্যাপার নয়!

শ্রীমন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ হেসে বললে, তোমাকে এখন জানাতে সঙ্কোচ নেই, বেনামীতে তিনখানা কন্ট্রোলের দোকান আমি চালাচ্ছি। ব্যাঙ্কে যে টাকা আমার জমেছে, তার অধিকাংশই এই থেকে। আমি বুঝতে পারছি, তুমি লজ্জা পাচ্ছ। কিন্তু যুদ্ধের পরে হীরে মুক্তো সোনায় তোমার সমস্ত লজ্জা ঢেকে দোব, এই প্রতিশ্রুতি দিলাম। 

তৃপ্তির আনন্দে শ্রীমন্ত হা হা করে হাসতে লাগলো। 

.

ট্যাক্সির পিছনে এক বস্তা চাল লুকিয়ে নিয়ে সুমিত্রা ও শ্রীমন্ত ‘দেবধাম’ রওনা হোল।

সন্ধ্যার মুখ। সূর্যের আলো তখন নেই, কিন্তু আলোর আভা একেবারে মিলিয়ে যায়নি। তারই একটুখানি সুমিত্রার প্রসাধন-সুন্দর মুখে এসে পড়েছে। 

শ্রীমন্ত আড়চোখে চেয়ে দেখলে, সুমিত্রা আজ যেন বিশেষ করে সেজেছে। ওই জমকালো শাড়ীখানা সেদিন শ্রীমন্ত সাধ্যসাধনা করেও সুমিত্রাকে পরাতে পারেনি। এত গহনাও সুমিত্রাকে সে এর আগে কখনও পরতে দেখেনি। 

এ কি তার যোদ্ধৃবেশ? 

হৈমন্তীর সামনে সে কি তার ঐশ্বর্যের বর্মচর্ম পরিধান করে দাঁড়াতে চায়? 

শ্রীমন্ত মনে মনে হাসলে। মুখে কিছু বলতে সাহস করলে না। সুমিত্রার কাছে হৈমন্তীর প্রসঙ্গে হৈমন্তীর পক্ষ টেনে কিছু বলতে এখন সে ভয় পায়। 

সেদিনকার মতো আজও ওদের ট্যাক্সি একেবারে ‘দেবধামে’র ভিতর গাড়ি- বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু আজ আর শঙ্কর এলো না ওদের সম্বর্ধনা করতে। 

রঘুয়া বললে, উপরে যান বাবু। মা ডাকছেন। 

শ্রীমন্ত ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রঘুয়াকে বললে, পিছনের ক্যারিয়ারে এক বস্তা চাল আছে। সেটা নামিয়ে নাও। খবর সব ভালো তো রঘুয়া? 

চালটা নামাতে নামাতে রঘুয়া বললে, ভালো কিছু নয় বাবু। উপরে গেলেই শুনতে পাবেন। 

শ্রীমন্তর বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠলো : কি এমন খারাপ খবর? কে জানে কার আবার কি হোল! 

ওরা দু’জনে দ্রুতপদে দোতলায় গেল। হিমাংশুবাবুর দরজা বন্ধ। ওদিকের বারান্দায় সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রতিমূর্তির মতো নয়নতারা স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে। 

ওরা তাঁকে প্রণাম করতেই দু’জনের মাথায় হাত রেখে তিনি আশীর্বাদ করলেন।

–এসো মা, ভিতরে এসো। অ কদম, এঘরে দু’টো আসন দিয়ে যা তো। 

—কিছু দরকার নেই মা! এই তো চমৎকার বসলাম। ওরা মেঝেতেই বসে পড়লো এবং উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে গৃহিণীর দিকে চেয়ে রইলো। 

মিনিট খানেক নিঃশব্দে থেকে নয়নতারা বললেন, শঙ্করকে পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে। 

—শঙ্করকে!-ওরা দু’জনে চমকে উঠলো।–-কেন? 

—আমাদের দেউড়ির পাশে যে চিঠির বাক্স আছে, সেইটেতে কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে ও আগুন দিচ্ছিল। 

—তারপরে? 

—পিছন থেকে মোটরে করে পুলিস আসছিল, ওরা টের পায়নি। এসেই ওদের ধরে ফেলে। 

শ্রীমন্ত ও সুমিত্রা স্তব্ধভাবে বসে রইলো। 

নয়নতারা বললেন, ছাড়াবার জন্যে বহু চেষ্টা হচ্ছে, হয়তো ছাড়া পেয়ে যেতো। কিন্তু শঙ্কর জেলে যাবার জন্যে বদ্ধপরিকর। সে যেন ছাড়া পেতেই চায় না। 

নয়নতারা আবার বললেন, এ বাড়ির ছেলে জেলে গেল এই প্রথম। তা যাক। কিন্তু যাদের সঙ্গে মিশে জেলে গেল সেইটেই লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা কারা জানো, এ পাড়ার যত ভবঘুরে ছেলে। তাদের না আছে চাল না আছে চুলো। জীবনে কখনও ও তাদের সঙ্গে মেশেনি। তাদের চেনে কি না সন্দেহ। কেন যে এমন মতিগতি হোল! 

নয়নতারা শঙ্করের জেলে যাওয়া মার্জনা করতে প্রস্তুত। কিন্তু যার-তার সঙ্গে মিশে যে জেলে গেল, এইটে কিছুতে মার্জনা করতে পারছেন না। এ-বংশের ধারা যেন ও বদলে দিতে যাচ্ছে। সেইটেই পরিপাক করা ওঁদের পক্ষে কঠিন হচ্ছে। 

সেই ভারী নিস্তব্ধতার মধ্যে অনেকক্ষণ বসে থেকে সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলে, হৈমন্তীদি কোথায় মা? 

নয়নতারা ব্যস্তভাবে বললেন, ওমা তাই তো! সে বোধ হয় তোমাদের আসা টেরই পায়নি। অ কদম, বৌমাকে ছোট দিদিমণির ঘরে নিয়ে যা তো। বড্ড আঘাত পেয়েছে মা সে। আজ সকালে শঙ্কর ধরা পড়লো, তার পর থেকে আর ওঠেনি। সে যে কি করে ভালোয় ভালোয় নেয়েধুয়ে উঠবে মা, আর এক চিন্তা। 

নয়নতারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। 

কদম এসে সুমিত্রাকে তেতলায় হৈমন্তীর ঘরে নিয়ে গেল। 

.

হৈমন্তী দরজার দিকে পিছন করে খাটে শুয়ে ছিল। ওদের পায়ের শব্দে পাশ ফিরেই ধড়মড় করে উঠে বসলো। সুমিত্রার দিকে এক মুহূর্ত অবাক হয়ে সে চেয়ে রইলো। ধীরে ধীরে ওর মুখ অনাবিল হাস্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। 

আস্তে আস্তে বললে, আপনার সঙ্গে অনেক ঝগড়া করবার ছিল। কিন্তু এমন একটা নিরানন্দ দিনে এলেন যে, ঝগড়া করারও মন নেই। 

সুমিত্রা বলে, শঙ্কর-ঠাকুরপোর কথা শুনলাম। কিন্তু দুঃখ করে লাভ নেই ছোটদি। যুগের হাওয়া কেউ রোধ করতে পারে না। নইলে রায়বাহাদুরের বংশধর সাধারণের ছেলেদের সঙ্গে এক দড়িতে বাঁধা পড়ে? 

–কেন এমন হচ্ছে, বৌদি?

–কি জানি ভাই। কিন্তু হচ্ছে,–শুধু এখানেই নয়, পৃথিবী জুড়ে সর্বত্রই এই হচ্ছে। নীল রক্তের আভিজাত্য আর বুঝি থাকে না। 

—আমাদের অপরাধ কি? 

—মানুষকে দূরে ঠেকিয়ে রাখা মস্ত বড় অপরাধ দিদি। দীর্ঘকালের সঞ্চয়ে সেই অপরাধ পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর ভারকেন্দ্র আজ টলেছে। তাইতেই বুঝি এই বিপর্যয়। 

একটুক্ষণ চিন্তা করে হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করলে, শঙ্করকে কি ছাড়ানো যাবে না?

–জেলের থেকে? কেন যাবে না? এই শহরে আপনাদের কত বড় বড় আত্মীয়- স্বজন। তাকে ছাড়িয়ে আনা কিছু কঠিন নয়। কিন্তু আমার কি মনে হচ্ছে জানেন? তার মধ্যে নীল রক্তের ধারা বোধ করি স্তিমিত হয়ে এসেছে। আমার সন্দেহ হয়, ‘দেবধামের’ উত্তরাধিকারীকে আপনারা আর কোনো দিন ফিরে পাবেন না। 

—ওসব কথা বলবেন না বৌদি। আমার বড় ভয় করে। 

—ভয়েরই তো কথা ছোটদি। সেইজন্যেই মায়ের কাছে আমি চুপ করে ছিলাম। আপনাকে বলছি এই জন্যে যে, আপনি হয়তো প্রকৃত অবস্থা বুঝবেন। 

হৈমন্তী উষ্মার সঙ্গে বললে, ‘দেবধানে’ নীল রক্ত শেষ হয়ে আসছে, একথা বুঝতে আমার ভালো লাগবে, এ আপনি কেমন করে প্রত্যাশা করেন? 

সুমিত্রা হাসলে। বললে, ভালো লাগার কথা নয় ছোটদি। ভালো লাগবে না তাও জানি। তবু তৈরী থাকা ভালো। তাতে আঘাত কম লাগে। 

হৈমন্তী হঠাৎ চটে গেল। তার চোখ দপ্ করে জ্বলে উঠলো। বললে, এসে পর্যন্ত তুমি শক্ত শক্ত কথা শোনাচ্ছ কেন জানিনে বৌদি। ওসব আমার ভালো লাগে না। 

গ্রীবা বেঁকিয়ে হৈমন্তী গুম হয়ে বসে রইলো। 

সুমিত্রা এবার জোরে জোরে হেসে উঠলো। বললে, কী সুন্দর! তোমার এই রূপ দেখবার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম ছোটদি। এতক্ষণে দেখতে পেলাম। 

হৈমন্তী অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো। 

সুমিত্রা ওকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলতে লাগলো : যেদিন থেকে তোমার কথা শুনেছি, তোমাকে কল্পনা করেছি হোমাগ্নি শিখার মতো। এসে দেখি, সেই শিখা জ্যোতিহীন, ধোঁয়ায় মলিন। দুঃখ হোল। ভাবলাম, প্রথম দিনে তোমার এই মলিন রূপ দেখেই ফিরে যেতে হবে? ভাগ্য ভালো, তুমি প্রসন্ন হোলে। তোমার চোখে আগুন দেখতে পেলাম। 

হৈমন্তী বললে, কী পাগলের মতো এলোমেলো বকছ বৌদি? 

সুমিত্রা প্রাণপণবলে ওকে জড়িয়ে ধরে বললে, এলোমেলোই বটে। এ তুমি বুঝবে না, বোঝবার চেষ্টাও কোরো না। তোমাকে আমি কত রাত্রি স্বপ্ন দেখেছি জানো? 

—স্বপ্ন দেখেছ? আমাকে?—হৈমন্তীর বিস্ময়ের আর শেষ নেই। 

—হ্যাঁ, তোমাকে। সংসারে একটিমাত্র মেয়ে, যাকে আমি সুমিত্রা—স্বপ্ন দেখি। –কেন বলো তো? 

—তোমার শক্তি আমাকে অভিভূত করেছে। 

—আমার শক্তি? আমাকে তো তুমি চিনতেই না বৌদি! আমার শক্তির তুমি কী জানো!

সুমিত্রা হঠাৎ নিজেকে সামলে নিলে। হেসে বললে, বিশেষ কিছুই জানিনে ছোটদি, তবু তোমাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বকে-বকে গলা যে শুকিয়ে গেল। একটু চা-ও কি খাওয়াবে না? 

হৈমন্তী হেসে বললে, আমার অন্নপূর্ণা মায়ের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, তখন ভয় কিছুই নেই। ওই দেখ, কদম চা এনেছে দু’জনেরই। রাত্রে নিশ্চয় খেয়েও যেতে হবে। শ্রীমন্তদা কোথায় কদম? 

—বাবুর ঘরে। 

কদম টিপয়ের উপর দু’জনের চা খাবার নামিয়ে দিয়ে গেল। 

শ্রীমন্ত আবার বাবুর ঘরে! হৈমন্তী ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু কিছু বললে না। 

.

ট্যাক্সিতে বসে শ্রীমন্ত প্রথম কথা কইলো : বড়বাবু একেবারে মুষড়ে গেছেন। মুহুর্মুহু শুধু মদ খাচ্ছেন আর কাঁদছেন। 

সুমিত্রা বোধকরি অন্যমনস্ক ছিল। বললে, 

শ্রীমন্ত বলতে লাগলো, শুধু ছেলের জেলই নয়। সংসারের অবস্থাও ভালো নয়। দু’লক্ষ টাকার দু’টো ডিক্রি ঝুলছে। এটর্নী জানা লোক। তাঁকে বলেকয়ে কোনরকমে থামিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু আর বোধ হয় থামানো যায় না। জমিদারীর কিছু কিছু বিক্রি হয়ে গেছে। বাকিও বুঝি যায়। বড়বাবুর ধারণা, এই দুঃখেই শঙ্কর জেলে গেছে। বোধ হয় ভেবেছে, নিজের চোখে সেই সর্বনাশ দেখার চেয়ে জেলে বসে থাকা ভালো। 

অন্যমনস্কভাবেই সুমিত্রা আবার বললে, হুঁ। 

—আমি বলে এলাম, জমিদারী আপনার একটা আয়। এটা রাখতেই হবে। বাড়িখানা বিক্রি করে দিন। এ বাজারে ওর দাম তিন লক্ষ টাকার কাছাকাছি হবে। এত বড় বাড়ির কোন দরকার নেই। দেনা শোধ করে বাকি টাকা দিয়ে একটা ছোট বাড়ি কিনুন। তাতে খরচও অনেক বাঁচবে। ভদ্রলোক হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। 

কান্নার কথায় সুমিত্রা চমকে উঠলো। বললে, কে কাঁদলে? 

–বড়বাবু।

–কেন?

—কি বলো? কত পুরুষের ‘দেবধাম’। ওঁদের সমস্ত মর্যাদা, সমস্ত আভিজাত্য ওই বাড়ীর ইটের সঙ্গে গাঁথা। সেই বাড়ি বিক্রি করার কথায় কে না কেঁদে পারে? 

সুমিত্রা নিঃশব্দে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলো। 

শ্রীমন্ত নড়েচড়ে বেশ শক্ত হয়ে বসে বললে, কিন্তু বাড়ি ওঁকে বিক্রি করতেই হবে। না করলে ওঁকে জমিদারীও বিক্রি করতে হবে, বাড়িও। 

সুমিত্রা শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, দেনা কি খুবই বেশি হয়েছে? 

—বেশি হয়নি? দু’লক্ষ টাকার তো ডিক্রিই ঝুলছে। আরও কত আছে কে জানে? আমার বিশ্বাস, আরও অন্তত লাখখানেক টাকার আছেই। 

সুমিত্রা সাড়া দিলে না। বাইরের দিকে চেয়ে রইলো। 

একটু পরে শ্রীমন্ত হঠাৎ জোরের সঙ্গে বললে, বাড়িটা ওঁকে বিক্রি করতেই হবে। ওটা আমার চাই। 

সুমিত্রা অবাক হয়ে ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে চাইলে! বললে, ওর তো অনেক টাকা দাম!

—তার জন্যে চিন্তা করি না। সে জোগাড় হয়ে যাবে।—শ্রীমন্ত অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল।

বললে, আজ বলামাত্র কেঁদে ফেললেন। আর একদিন এসে ভালো করে বোঝাতে হবে। মাড়োয়ারীর হাতে যাওয়ার আগে আমার হাতে আনতে হবে। 

—ওই পুরোনো বাড়ীর উপর তোমার এত লোভ কেন? তুমিও কি আর একটা অভিজাত বংশের পত্তন করতে চাও? 

—না। আভিজাত্যের পরিণতি আমি অনেক দেখেছি। কিন্তু যখন ভাবি এই বাড়িতে অনুগৃহীত অনাথ বালকের মতো আমি মানুষ হয়েছি, তখন ওর মালিক হবার জন্যে আমার লোভ দুর্জয় হয়ে ওঠে। 

বাকি পথটুকু ওরা দু’জনে নিঃশব্দে চললো। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই শ্ৰীমন্ত সচেতন হয়ে উঠলো। ড্রাইভারকে বললে, রোকো, ওই সামনের বারান্দাওয়ালা বাড়ি। 

—এর মধ্যে এসে গেছি? 

মন্ত্রাভিভূতের মতো সুমিত্রা উঠলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে একবার চেয়ে শ্রীমন্ত ট্যাক্সির ভাড়াটা মিটিয়ে দিলে। 

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বললে, তুমি কি ভাবছ বলো তো? 

–কী হবে শুনে?—সুমিত্রা উত্তর দিলে।

—শুনি না! 

—তোমার হৈমন্তীর কথা। 

—আমার হৈমন্তী? —শ্রীমন্তর কণ্ঠস্বরে অপরিসীম বিস্ময়। 

পাখাটা খুলে দিয়ে শ্রীমন্তর চেয়ারটা ঘুরে ওদিকের চেয়ারে গিয়ে সুমিত্রা বসলো।

বললে, হ্যাঁ গো, তোমারই হৈমন্তী। ওই তো ‘দেবধামের’ আত্মা। তাই তো ‘দেবধামের’ উপর তোমার লোভ এত দুর্জয়! দাঁড়াও, একটু কফির ব্যবস্থা করে আসি। 

হাওয়ায় শাড়ীর তরঙ্গ তুলে সুমিত্রা ভিতরে গেল। 

.

ফিরে এসে সুমিত্রা নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে নিঃশব্দে দুষ্টমিভরা হাসতে লাগলো। 

শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করলে, হাসো কেন? 

সুমিত্রা জবাব দিলে না। আরাম কেদারায় একটা লোভনীয় এলায়িত ভঙ্গিতে বসে শুধু তেমনি করে হাসতে লাগলো। 

—বলো না কেন হাসছ? 

–শুনবে? হৈমন্তীর চোখে আমিও আগুন দেখে এলাম। 

—আগুন? 

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আগুন। যে-আগুনে তুমি পুড়েছ, বোধ করি ‘দেবধাম’ও পুড়বে। সে কী সুন্দর! 

চায়ের পেয়ালা শ্রীমন্ত মুখে তুলেছিলো, আবার নামালে। বিস্ময়ের সঙ্গে বললে, মাঝে মাঝে তুমি কী যে হেঁয়ালি বলো সুমিত্রা, আমি খেই পাইনে। আগুন তুমি কাকে বলছ? 

—সে তুমি বুঝবে না। হৈমন্তীও বুঝতে পারেনি। হৈমন্তী জানে, তোমার কাছে সে হেরেছে। তুমি পাথরের, তুমি হৃদয়হীন, তুমি সাপের চেয়েও ক্রর। কিন্তু আমি জানি, সে হারেনি, জিতেছে। তুমি যে পাথরের সে আমিও জানি। কিন্তু আমি আরও জানি যে, এই পাথরও সে টলিয়েছে। তার চোখের আগুনের দিকে চেয়ে সাপও মুহূর্তকালের জন্যে মুগ্ধ হয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। 

—এসব কী কথা বলছ তুমি? -শ্রীমন্ত চীৎকার করে উঠলো। 

একটা হাত তুলে সুমিত্রা তাকে চুপ করতে ইঙ্গিত করলে। 

বললে, থামো। তোমার সব কথা আমি জানি। নেশার ঘোরে তোমার সমস্ত বেদনার কথাই আমাকে শুনিয়েছ। লজ্জা পাচ্ছ? তোমারও লজ্জা আছে? 

সুমিত্রা জোরে জোরে হেসে উঠলো। 

বললে, হৈমন্তীকে দেখলাম। নিজেকেও চিনি। যখন ভাবি আমাদের মতো মেয়ে কি করে তোমার মত হৃদয়হীন পাষণ্ডের মুঠোর মধ্যে গিয়ে পড়লাম, তখন আর কিনারা পাইনে। তুমি কি রাগ করছ? 

—না। অতি-প্রশংসায় ভিতরে ভিতরে বিগলিত হচ্ছি। কিন্তু তুমি একথা বলছ সুমিত্রা? 

—অর্থাৎ মন্দকে মন্দ বলার অধিকার শুধু তাদেরই আছে যারা নিষ্কলঙ্ক। এই কথা বলতে চাও তো? তাহলে শোনো, ভালো আমিও নই। আমাদের বর্তমান সমাজের ভালো- মন্দের বিচারে আমার স্থান যে অনেক নিচে, সে আমি জানি। তবু বলি, আমি তোমার মতো পাষণ্ড নই। আমার হৃদয় আছে। 

কঠিন কণ্ঠে শ্রীমন্ত বললে, এই নূতন সংবাদের জন্যে ধন্যবাদ সুমিত্রা। তোমার হৃদয়ের কথাটা জানা রইলো, ভালই হোল। 

সুমিত্রার সমস্ত মন আজ যেন একটা প্রচণ্ড শক্তিতে কাজ করছে। বিদ্রূপ শেষ হবার আগেই তার মন হৈমন্তীর দিক থেকে তেমনি প্রচণ্ড বেগে শঙ্করের দিকে ধাবিত হোল। শ্রীমন্তর কথা বোধ করি তার কানেই গেল না। 

বললো, হ্যাঁগো, শঙ্করকে ছাড়াবার কি করছ? 

বিস্ময়ে শ্রীমন্তর চোখ কপালে উঠলো : 

—তুমি কী পাগলের মতো বকতে আরম্ভ করলে আজ! স্নেহাংশু ঘোষের নাতি, হিমাংশু ঘোষের ছেলেকে ছাড়িয়ে আনব আমি? 

—হ্যাঁ তুমি। এ ব্যাপারে তোমার চেয়ে যোগ্য লোক আর কেউ নেই। মানুষের পায়ে হাত দিতেও যতক্ষণ, ঘাড়ে হাত দিতেও ততক্ষণ। বিশেষ তিনখানা কন্ট্রোলের দোকান তুমি চালাচ্ছ! বহু লোকের সঙ্গে তোমার ডান-হাত বাঁ-হাতের সম্পর্ক। এ কাজ তোমার মতো সহজে আর কেউ পারবে না। কালকেই তোমাকে চেষ্টা করতে হবে। করবে কি না বলো? 

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শ্রীমন্ত বললে, করবো চেষ্টা। কিন্তু সে কেন জেলে গেছে জানো? 

—শুনেছি। 

—যদি সে ছাড়া পেতে না চায়? 

—তবু তাকে ছাড়িয়ে আনতেই হবে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেমন করে হোক। বুঝলে?

–বুঝলাম? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *