কালোঘোড়া – ১৬

ষোল

শ্রীমন্তর বাইরের দিকের বারান্দায় চায়ের মজলিস বসেছে। আছে সুমিত্রা আর হেনরি।

হেনরি বললে, যুদ্ধের চাকা এবার আমাদের দিকে ঘুরতে শুরু করবে দেখো।

সুমিত্রা বললে, এই কথা তুমি আমাদের বিশ্বাস করতে বলো? কালকেও জার্মানদের উত্তর ককেসাসে তড়িৎ অভিযানের সাফল্যের খবর পাওয়া গেছে। তারা ভল্গা আর ককেসাসের দিকে এগিয়ে চলেছে। দশ দিন আগেও খবর পাওয়া গেছে, সোভিয়েট বাহিনী রস্টোভ ছেড়ে পালিয়েছে। দু’মাস আগেও জাপানীরা এলিউসিয়ান দ্বীপে নেমেছে এর মধ্যে চাকা ঘুরে যাবে!

হেনরি হেসে বললে, সুমি, চাকা সে কখন ঘোরে কেউ বলতে পারে না। মুহূর্তের ভুলে যুদ্ধের চাকা অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে যায়।

শ্রীমন্ত হেসে বললে, কিন্তু সেটা তখনই-তখনই বিশ্বাস করা কঠিন হয়।

হেনরি হেসে বললে, কিন্তু তোমাদের কিংবা আমাদের পক্ষে নয়।

—কেন?

—আশার কথা মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে। এ যুদ্ধ থেমে গেলে তোমরাও বাঁচো, আমরাও বাঁচি। নয় কি না বলো?

হেনরি হাসতে লাগলো।

শ্রীমন্ত বললে, সে কথা যদি বলো হেনরি, তাহলে শোনো, এ যুদ্ধ থামলে সুমিত্রা কিংবা আমি বাঁচি না।

হেনরি সবিস্ময়ে বললে, কেন?

—কারণ, যুদ্ধ থেমে গেলে আমরা বেকার হয়ে যাব। এই যুদ্ধে যারা না খেয়ে মরছে, কিংবা জিনিসপত্রের দাম চড়ে যাওয়ায় যারা অশেষ দুঃখ ভোগ করছে তারা বাঁচবে। কিন্তু আমাদের মতো যাদের যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে চাকরি যাবে, কিংবা ঘুষে, ব্ল্যাকমার্কেটে অথবা মিলিটারী কন্ট্রাক্ট নিয়ে যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, তারা বাঁচবে একথা মনে করছ কেন?

—বুঝলাম।–হেনরি হাসতে লাগলো।

শ্রীমন্তও হাসলে। বললে, ভালো-মন্দ সব নিজের স্বার্থের দিক দিয়ে, কি বলো?

—নিশ্চয়? 

সুমিত্রা বলল, তোমাদের স্বাধীন দেশ। যুদ্ধ শেষে যে সব সমস্যা তোমাদের দেশে দেখা দেবে, তোমাদের গবর্নমেন্ট তার সমাধানের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করবেন। আমাদের তো স্বাধীন দেশ নয়। এখানে সমস্যার সমাধান হয় না। আমরা বড় দুঃখের চাপে ছোট দুঃখকে ভুলতে চেষ্টা করি, এই মাত্র! সৌভাগ্য এই যে, ছোট দুঃখকে ভোলবার জন্যে বড় দুঃখের অভাব কখনও হয় না। 

সবাই হাসলো। 

হেনরি বললে, তোমাদের কথা আমি জানতে চাই। একটা প্রশ্নের জবাব দেবে, তোমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানে এত বিরোধ কেন? 

সুমিত্রা চট করে বললে, মিথ্যা কথা। 

শান্তভাবে শ্রীমন্ত বললে, না সুমিত্রা, একেবারে মিথ্যা নয়। বিরোধ একটু আছে। স্বার্থের বিরোধ। 

বিস্ময়ের সঙ্গে হেনরি বললে, দেশের চেয়ে বড় সেই স্বার্থ? 

—সেই রকমই দাঁড়িয়েছে। তোমাদের বুঝতে কষ্ট হবে। কি রকম জানো? তোমাদের দেশে আইনসভার আসন যদি ধর্ম হিসাবে ভাগ করে দেওয়া হত, যদি শতকরা এতটি আসন প্রোটেস্ট্যান্টের, এতটি রোমান ক্যাথলিকের, এতটি ইহুদীর জন্যে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হত—তাহলে তোমাদের দেশেও ঠিক এই রকম হত। আমেরিকায় এমন একটা ব্যবস্থার কথা তুমি কল্পনা করতে পারো? 

হেনরি সভয়ে বললে, সর্বনাশ! 

—এদেশে সেই ব্যবস্থাই চলছে। দেশের স্বার্থ যে সব চেয়ে বড়, একথা গোঁড়া সাম্প্রদায়িকও জানে। কিন্তু সম্প্রদায়ের ছোট স্বার্থ সব সময় এমন করে তার চোখের সামনে ঝুলছে যে, তাকে ভোলা অসম্ভব। 

হেনরি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। 

তারপর বললে, তাহালে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? 

—একটি জটিল দুষ্টচক্র। স্বাধীনতা পেলেও এর হাত থেকে মুক্ত হতে অনেক সময় নেবে। 

হেনরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে। বললে, আজকে উঠলাম মন্টি। ডিউটি আছে। তোমাকে কি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে সুমি? 

শ্রীমন্ত ইঙ্গিতে সুমিত্রাকে নিষেধ করলে। 

সুমিত্রা বললে, না। ধন্যবাদ। 

হেনরি চলে গেল। 

.

হেনরি চলে যাবার পরে ওরা দু’জনে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। শ্রীমন্ত ওর একখানা হাত নিজের দুই হাতে তুলে নিলে। 

বললে, হেনরির সম্বন্ধে আমি যেন ক্রমশ ‘জেলাস’ হচ্ছি সুমিত্রা। এ দুর্বলতা তো ছিল না। 

সুমিত্রা হেসে বললে, সুলক্ষণ সন্দেহ নেই। কিন্তু কি জন্যে আটকালে বলো। -তোমার কাছে একটা পরামর্শ চাই। 

—আমার কাছে? পরামর্শ? তুমি যে ক্রমশ হেঁয়ালি হয়ে উঠছ মন্টি। 

—সত্যি। পরামর্শ চাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। কিন্তু এ ব্যাপারটা আমার গণ্ডীর বাইরে। -কি রকম ব্যাপার শুনি? বৈষয়িক? 

—না। বৈবাহিক। 

—সর্বনাশ! 

সুমিত্রা ব্যাপারটা শোনবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। 

একটুক্ষণ দ্বিধা করে শ্রীমন্ত বললে, দেখ সুমিত্রা অবিলম্বে আমার একটা বিবাহ করা প্রয়োজন। 

—তাতে বাধা হচ্ছে কোথায়? 

—পাত্রীর। 

—বলো কি! বাঙলা দেশে পাত্রীর অভাব! 

—সকলের নয়, আমার। আমি এমন একটি পাত্রী চাই, যে আমাকে ঘৃণা করবে না। তুমি রাজি হলে সব চেয়ে ভালো হত। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমার প্রার্থনা তুমি হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছ! 

 একটু চিন্তা করে সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলে, হঠাৎ আমাকে তোমার এত পছন্দ হোল কেন?

—পছন্দ! আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, তোমাকে বোধ হয় একটু ভালোবেসেই ফেলেছি! 

সুমিত্রা হেসে ফেললে। বললে, এরকম দুর্ঘটনা তোমার জীবনে কি এই প্রথম?

-–ও প্রশ্ন কোরো না সুমিত্রা। ওর জবাব দিতে পারব না। মানুষ যে তার নিজের মন নিজেও জানে না, এ অভিজ্ঞতা সম্প্রতি আমার হয়েছে। 

—কবে থেকে হয়েছে? হৈমন্তীর আগুন যেদিন থেকে তোমার বুকে এসে লেগেছে সেদিন থেকে? 

হৈমন্তীর প্রসঙ্গে শ্রীমন্ত কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে। বললে, বিচিত্র নয়। কিন্তু তোমাকে যা বললাম, তার কি করছ? 

—আমাকে তুমি কিছুই বলোনি তো! 

—বললাম না? আমার বিয়ের একটা ব্যবস্থা করে দাও। 

—আমি ব্যবস্থা করে দোব? আমি কি প্রজাপতি অফিস? 

সুমিত্রা খিল খিল করে হেসে উঠলো। 

শ্ৰীমন্ত কিছুমাত্র অপ্রস্তুত হোল না। বললে, না। তুমি প্রজাপতি স্বয়ং। এখন রঙিন ডানা বন্ধ করে আমার একটা ব্যবস্থা করো। 

শ্রীমন্ত হাত জোড় করলে। 

সুমিত্রা হেসে উঠে ওর বাহুতে একটা মৃদু চপেটাঘাত করলে। তারপর গম্ভীরভাবে বললে, পাত্রী একটি আছে,-মিসেস পিঠাবালা। আমাদের সেকশনে কাজ করে। তুমি চেনো বোধ হয়। 

—অল্প-অল্প চিনি। পিঠার উপর আমার আকর্ষণও আছে। কিন্তু মিসেস? 

—তাতে কি? ঠিক হয়ে গেছে, ও স্বামীকে ডাইভোর্স করবে। 

—না, না। মিসেস চলবে না সুমিত্রা। মামলা-মোকদ্দমা…তারপর হয়তো এক দল ছেলেপুলে নিয়ে আসবেন। তুমি মিস-এর খবর দাও। 

–মিস?—চিন্তায় ভ্রুকুঞ্চিত করে সুমিত্রা বললে, তাও আছে কতকগুলো। কিন্তু…

–তাদের নাম-ঠিকানা মনে করতে হবে… তারপরে… 

—হ্যাঁ। একটু ভাবতে হবে বই কি। 

—বেশ তো। তুমি ভাবো, তাদের নাম-ঠিকানা মনে করো! ইতিমধ্যে আমাদের একটা Interim বিবাহ হয় যাক। কি বলো? 

কথা শেষ করার আগেই সে সুমিত্রাকে বাহুর বন্ধনে বেঁধে ফেললে। 

প্রথম ধাক্কায় সুমিত্রা এমনই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে একটা কথাও বলতে পারেনি। কোথা থেকে রাজ্যের লজ্জা এসে যেন তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সে শক্ত মেয়ে। তার সামলাতে দেরী হোল না। 

ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে শ্রীমন্তকে বললে, তোমার কথা শুনলাম, এবার আমার কথার জবাব দাও : আমাকে কি তুমি বিশ্বাস করতে পারবে? 

শ্রীমন্ত উত্তর দিলে, এ সংসারে সবাই নিজের নিজের স্বার্থের চিন্তায় মগ্ন। কেউ কাউকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে না। আমার মনে হয়, আমরা যদি পরস্পরকে লাভের অংশ দিই, তাহলে স্বার্থের বিরোধ ঘটবে না। 

—কিন্তু তাতেই কি পরস্পরের উপর শ্রদ্ধা জাগে? 

—জানি না। না জাগলেই বা কি? সুমিত্রা, আমরা শ্রদ্ধা-প্রীতি-প্রেম নিয়ে ভণ্ডামী করবই না। শুধু একটি জায়গায় খাঁটি থাকবার চেষ্টা করব : আমরা সতর্ক থাকব যেন কিছুতেই কেউ কাউকে ঘৃণা না করি। 

—তুমি শ্রদ্ধা-প্রীতি-প্রেমে বিশ্বাস করো না? 

—না। আমার মনে হয় কেউই করে না। সবাই বিশ্বাস করার ভান করে। 

সুমিত্রা এতদূর যেতে প্রস্তুত নয়। সে দ্বিধা করতে লাগলো। 

লক্ষ্য করে শ্রীমন্ত বললে, এত বড় নিষ্ঠুর সত্য তোমার মেনে নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু চেয়ে দেখ পশ্চিমের দিকে যেখানে প্রেমের ছড়াছড়ি সব চেয়ে বেশী, ডাইভোর্স কি সেইখানেই সব চেয়ে বেশী নয়? 

—কিন্তু এদেশে? 

—এদেশে ডাইভোর্সের ব্যবস্থা নেই বললেই হয়। লাঠালাঠি, মারামারি, সন্দেহ, অবিশ্বাস করেও একই শয্যায় তারা জীবন কাটায়। আমার কি মনে হয় জানো? জলের মতো মানুষের মনের প্রবণতাও নিচের দিকে। সেই স্বাভাবিক প্রবণতার অভাবই হচ্ছে মহত্ত্ব। ওটা একটা negative virtue. এই সত্য উপলব্ধি করতে পারলেই পথ-চলা সহজ হয়। 

সুমিত্রা তবু দ্বিধা করতে লাগলো। 

শ্রীমন্ত ওকে আশ্বাস দিয়ে বললে, তুমি দ্বিধা কোরো না সুমিত্রা। আমি তোমাকে দুদিনে আদিম মানুষে পরিণত করব। আসলে বিবাহ বলতে আমি কি বুঝি জানো? আপোস। তোমার স্বার্থ আমি ক্ষুণ্ণ করব না। আমার স্বার্থ তুমি ক্ষুণ্ন কোরো না। ব্যস্। এরই নাম অনাবিল স্বর্গীয় প্রেম। 

—তুমি স্বর্গ মানো? 

–মানি। স্বর্গ মানে সেই দেশ যেখানে কেউ কোনো দিন যেতে পারে না।

–কেন পারে না? 

—সে দেশ কোথাও নেই বলে। 

সুমিত্রা হেসে উঠলো। বললে, উত্তম। স্বর্গে যাবার আশঙ্কা যখন তোমার কিংবা 

আমার কারো নেই, তখন এই পৃথিবীতেই আমরা যথাসাধ্য ভদ্রভাবে বাস করবার চেষ্টা করব, তার মানে কেউ কারও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করব না। কি বলো! 

—হ্যাঁ। তাহলে তুমি রাজি? 

—এত বড় যুক্তির পরে রাজি না হয়ে উপায় কি? 

সুমিত্রা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমন্তও প্রাণ খুলে হাসতে লাগলো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *