কালী সাধনায় : সাধক রামপ্রসাদ

কালী সাধনায় : সাধক রামপ্রসাদ

রামপ্রসাদের তখন আঠারো বছর বয়স। দেখতে সুন্দর, সদা নির্জনতা প্রিয়। সংসারের প্রতি তেমন আকর্ষণ নেই। পিতা রামরাম সেন কিন্তু এ-বয়সেই পুত্রের বিবাহ দিয়েছেন। ইচ্ছা না থাকা সত্বেও রামপ্রসাদকে বিবাহ করতে হল। কিন্তু সংসারজীবনে মনের দুঃখ-বেদনা মেটে না। বরং বেড়েই চলে। পিতার সঙ্গে সংসারের শ্রীবৃদ্ধির জন্য কাজকর্ম করেন। ছেলের দেবদ্বিজে ভক্তি, ধর্মপ্রবণ মন দেখে পিতাও খুব খুশি হন। অপরদিকে পুত্রবধূ সর্বাণীও খুব ভক্তিমতি মেয়ে। ছেলের যোগ্য সহধর্মিণী।

রামপ্রসাদ স্ত্রী নিয়ে সংসার করছেন। কিন্তু মনের পূর্ণ ভালোবাসা বধূকে নিবেদন করতে পারছেন না। তাঁর অন্তর যেন কার নিরন্তর খোঁজ করে—সেই মুণ্ডমালাধারিণী মা’ই যেন তাঁকে আকর্ষণ করে বেশি—রূপ থেকে অরূপের রাজ্যে ডুব দিতে চায় মন। সাধনার মধ্যে মাকে পাওয়ার অভিলাষ যুবক রামপ্রসাদের মনে চেপে বসে।

হালিশহরের এই জায়গাটি ভারী সুন্দর। জঙ্গলঘেরা নির্জনতায় প্রাণমন সহজেই উদাস হয়ে যায়। তদুপরি জাহ্নবী আপন মনে বহে যায়। এই উদাসী প্রকৃতির কোলে আপন ব্যথা-বেদনাকে ব্যক্ত করে রামপ্রসাদ সঙ্গীতের মাধ্যমে—সঙ্গীত তাঁর কণ্ঠে, তাঁর হৃদয়ে—সহজ-সরলভাবেই হয় তার আত্মপ্রকাশ—যা মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিবেদিত হয়।

নিজেদের কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নিলেন রামপ্রসাদ। মাতৃনামের মহাদীক্ষা। অন্তরে তাঁর মায়ের রূপ, কণ্ঠে অবিরাম মাতৃনাম, চক্ষে অশ্রুধারা—মায়ার রাজ্যে থেকেও মায়াতীত হওয়ার সাধনা যেন তার জন্মগত—দীক্ষা নিয়েই রামপ্রসাদ এসব বুঝতে পারে। ফলে অস্থির হয়ে ওঠে তার মন। এমন মানবজনম পেয়েও কি বিফলে যাবে জীবনটা—নিজেকেই প্রশ্ন করে গেয়ে ওঠে নবীন ভক্ত—

মনরে কৃষিকাজ জানো না।

এমন মানবজমি রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।।

কালী নামে দাওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না।

সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া, তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।।

অদ্য শতান্তে কিংবা বাজাপ্ত হবে জান না।

আছে একতারে মন এইবেলা, তুই চুটিয়ে ফসল কেটে নে না।।

গুরুদত্ত বীজ রোপণ ক’রে, ভক্তিবারি তায় সেচ না।

ওরে একা যদি না পারিস্ মন, রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না।।

গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নিয়ে মায়ের নাম-গানে বিভোর থাকে রামপ্রসাদ। সংসারের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশার মধ্যে জীবন তাঁর অতিবাহিত হয়। কিন্তু হঠাৎই একদিন তাঁর মন দুঃখে কেঁদে উঠল। যে গুরু তাঁকে এত ভালোবাসতেন তিনিই সংসার ছেড়ে অকস্মাৎ চলে গেলেন। রামপ্রসাদ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন—এখন কে তাঁকে পথ দেখাবে? কার শুভ ইচ্ছার পূর্ণরূপ তিনি নিজ অন্তরে উপলব্ধি করবেন?

কথায় বলে যে খায় চিনি তাকে জোগায় চিন্তামণি। যেমন ভাব তেমন লাভ। রামপ্রসাদ জন্ম থেকেই মাতৃভক্ত। সুতরাং রামপ্রসাদকে আপন ক্রোড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখার দায়িত্বই তো তাঁরই। তাই মা নবদ্বীপের মহা মাতৃসাধক তান্ত্রিকশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণচন্দ্র আগমবাগীশ মহাশয়কে হালিশহরে পাঠিয়ে দিলেন। হালিশহরে সাধকপ্রবর আসতেই দারুণ কলরব তৈরি হল। তাঁর আগমনের সংবাদ পৌঁছাল যুবক রামপ্রসাদের কানেও। খবর পেয়েই একদিন নির্জনে রামপ্রসাদ দেখা করলেন আগমবাগীশ মহাশয়ের সঙ্গে। যুবককে দেখেই তান্ত্রিকাচার্য আগমবাগীশ মহাশয় চিনতে পারলেন। বুঝলেন এ যুবক সামান্য নয়। এঁর শরীরের স্পষ্ট মহাসাধকের লক্ষণ বর্তমান। অল্প আলাপেই উভয়ের মধ্যে দারুণ ভাব জমে গেল। সাধকপ্রবর রামপ্রসাদকে তন্ত্র সাধনার জন্য নানাভাবে নির্দেশ দিতে লাগলেন এবং তন্ত্রের মাধ্যমে মাতৃদর্শনের সহজলভ্যতার কথা বললেন।

এমন নানা কথা বলে আগমবাগীশ মহাশয় ফিরে গেলেন। আর রামপ্রসাদ মাতৃমূর্তি নির্মাণ করে আসন পেতে সাধনার গভীরে ডুবে যেতে সচেষ্ট হলেন। পিতা দেখলেন ছেলেটার সাংসারিক বিষয়ে কোনো মনই নেই। অথচ একটি কন্যা সন্তানও সে জন্ম দিয়েছে। এখন তার ভার কে লবে? দরিদ্রের সংসার। চারিদিকে অভাব। তবে আনন্দময়ীর কৃপায় সেসব অনুভবে ধরা পড়ে না। কিন্তু সংসারের গতি তো সমান থাকে না। হেথায় সুখের পর দুঃখ, দুঃখের পর সুখ চক্রাকারে ঘোরে এবং মানুষকে নানা কর্মবিপাকে ফেলে পরমেশ্বরী তিলে তিলে তাঁর স্নেহাঞ্চলে বাঁধার জন্য নিয়ে যায়।

দেখতে দেখতে প্রকৃতি দেবী চঞ্চলা হয়ে উঠল। তিনি পিতা রামরাম সেনকে জগৎ থেকে সরিয়ে দিলেন। নবীন সাধকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি সংসারের কথা চিন্তা করে চোখে অন্ধকার দেখলেন। এখন উপার্জনের কী হবে? কীভাবে সংসার নির্বাহ করবেন? কেমনভাবে স্নেহময়ী জননী, স্ত্রী, পুত্রী, ভগিনী প্রভৃতি সকলের মুখে আহারের সংস্থান করবেন? কোনো উপায় রামপ্রসাদের চক্ষে প্রতিভাত হল না। উপায়ন্তর না দেখে আদ্যাশক্তি জগজ্জননী মায়ের কাছেই রামপ্রসাদ প্রার্থনা জানালেন। কেঁদে কেঁদে মাতৃচরণে নিবেদিত হল—

আমি তাই অভিমান করি।

আমায় করেছ যে মা সংসারী।।

অর্থ বিনা ব্যর্থ যে এই সংসার সবারি।

ওমা তুমিও কোন্দল করেছ, বলিয়ে শিবভিখারী।।

জ্ঞান ধর্ম শ্রেষ্ঠ বটে, দানধর্ম তদুপরি।

ওমা বিনা দানে মথুরাপারে, যাননি সেই ব্রজেশ্বরী।।

নাতোয়ানি কাচ কাচ মা, অঙ্গে ভস্মভূষণ পরি।

ওমা কোথায় লুকাবে বল, তোমার কুবের ভাণ্ডারী।।

প্রসাদে প্রসাদ দিতে মা, এত কেন হলে ভারি।

যদি রাখ পদে, থেকে পদে, পদে পদে বিপদ সারি।।

মায়ের কৃপায় বিশ্বচরাচর যেখানে প্রাণবন্ত হয়ে রয়েছে সেখানে ভক্তের উপর ভগবানের করুণা হবে না—তাই হয়? তাই মাতৃ আকর্ষণেই যেন যুবক রামপ্রসাদ চাকরি করার মানসে কলিকাতায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। আর কিছুদিন চেষ্টার পরই দুর্গাচরণ মিত্রের বাড়িতে হিসাবের খাতা লেখার কেরানিগিরির কাজ জুটে গেল। মাইনে তিরিশ টাকা। তখন ১৭৪০/৪৫ সাল। কাজেই মাসে ত্রিশ টাকা বেতনের মাইনে কম কিছু নয়। এতে অন্তত সংসারের দারিদ্রতার কিছুটা অবসান ঘটবে। কৃতজ্ঞতায় সাধকের চোখে জল এল। কিন্তু হিসাব করতে গিয়ে মন তার ঘুলিয়ে যায়। মাথা ঝিমঝিম করে। আদ্যাশক্তির চিন্তায় বিভোর মাতৃসাধকের জীবনের হিসেব কিছুই স্থির থাকে না। তাই বিষয়ের খাতাতেই সর্বদা দুর্গানাম, কালীনাম, তারানাম লিখে খাতা ভর্তি করে রাখেন। আবার খাতার এখানে সেখানে লেখা হয়েছে গান। পাশের কর্মচারীরা এসব অদ্ভুত কাণ্ড দেখে মনিবকে খবর দেয়। কিন্তু দয়ালু মনিব প্রথম প্রথম কিছুই বলতেন না। অবশেষে কর্মের নানা ব্যাঘাত ঘটছে এই বলে সকলে মিলে মিত্র মহাশয়ের কাছে জোরালো নালিশ করলেন। মিত্র মহাশয় তখনই রামপ্রসাদ এবং হিসেবের খাতা দুটোকেই তাঁর সামনে হাজির করতে আদশে দিলেন। হিসাবের খাতাখানি হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে মিত্র মহাশয়ের চক্ষুস্থির হয়ে গেল। খাতা জুড়ে শুধুই দুর্গানাম, কালীনাম লেখা! আবার গানও লেখা হয়েছে—মনোযোগ দিতেই প্রথম গানটিতে গেল তাঁর চোখ আটকে—তিনি পড়ে চললেন—

আমায় দাও মা তবিলদারি

আমি নিমকহারাম নই, শঙ্করী।।

পদরত্ন ভাণ্ডার সবাই লুটে, ইহা আমি সহিতে নারি।

ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা, সে যে ভোলা ত্রিপুরারি।।

শিব আশুতোষ স্বভাব দাতা, তবু জিম্মা রাখ তাঁরি।

অর্ধ অঙ্গ জায়গীর, তবু শিবের মাইনে ভারি।।

আমি বিনা মাহিনার চাকর, কেবল চরণ-ধূলার অধিকারী।

যদি তোমার বাপের ধারা ধর, তবে বটে আমি হারি।।

যদি আমার বাপের ধারা ধর, তবে তোমা পেতে পারি।

প্রসাদ বলে এমন পদের বালাই লয়ে আমি মরি।

ও পদের মতো পদ পাইতো সে পদ ল’য়ে বিপদ সারি।।

মিত্র মহাশয় পরপর তিনবার গানটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। চোখ দুটি তাঁর ছলছল করে উঠল। সস্নেহে রামপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে তিনি সহসা বলে উঠলেন, ”রামপ্রসাদ, তুমি তুচ্ছ সংসারের কাজের জন্য জন্মগ্রহণ করনি। তুমি তবিলদারি চেয়েছো। সময় হলেই পাবে। এখন বাড়িতে ফিরে যাও।” এই বলে মিত্র মহাশয় অনেক বকশিশ দিয়ে রামপ্রসাদকে আপন গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন।

রামপ্রসাদ ফিরে এলেন হালিশহরে। এখন কর্ম নেই। অথচ সংসারে টাকা ঠিক এসে যাচ্ছে। এতে কিছুটা ভারমুক্ত হল তাঁর মন। ফলে প্রকৃতির কোলে মাতৃপ্রেমে বিভোর হয়ে উঠলেন। নিত্যনতুন গান রচনা করে তা গাইতে লাগলেন। আর নিত্য গঙ্গাস্নানে গিয়ে আকণ্ঠ জলে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে মায়ের নাম করা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। গঙ্গাবক্ষের সেই প্রাণমাতানো গানের সুর দূরে অপরূপ ভাবে ভেসে যেতে লাগল। এতে বহু লোক, নৌকার মাঝি, আরোহী আকৃষ্ট হয়ে গান শুনে মোহিত হয়ে যেতেন।

একবার হল কি নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নৌকা ভ্রমণ করতে এসে হালিশহরে ঘাটে সাধকের অপরূপ গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি প্রাণমন দিয়ে গান শুনে ঘাটে নৌকা ভিড়ালেন এবং নৌকা থেকে নেমে দেখলেন যে এক নবীন সাধক মাতৃনামে মাতোয়ারা এবং চক্ষু দুটি মাতৃনামের করুণাধারায় দারুণ বিগলিত হয়ে উঠেছে। মহারাজ রামপ্রসাদের সঙ্গে আলাপ করে বড়োই প্রীতিলাভ করলেন এবং তাঁকে নবদ্বীপে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। প্রথমে তিনি সেখানে যেতে অস্বীকার করলেও পরে গিয়েছিলেন, তবে কোনো চাকরি স্বীকার করলেন না। প্রসাদের এহেন বৈরাগ্য দর্শন করে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র খুবই খুশি হলেন এবং তিনি রামপ্রসাদকে একশত বিঘা নিষ্কর জমি পুত্র-পৌত্রাদি ক্রমে যাতে রামপ্রসাদ ভোগ করতে পারেন তারই ব্যবস্থা করে দিলেন। আর রামপ্রসাদের লেখনীতে খুশি হয়ে তাঁকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি প্রদান করলেন। শোনা যায়, সেসময় সিরাজদ্দৌলাও নাকি গঙ্গাবক্ষে প্রসাদের গান শুনে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন।

যাহোক, মহারাজের কৃপায় রামপ্রসাদের অন্নকষ্ট চিরতরে দূর হল। তিনি এখন থেকে মহা উদ্যমে সাধনা করতে ব্রতী হলেন। ফলে বাড়ির কাছেই নিকটবর্তী জঙ্গলে পঞ্চবটী রোপণ করলেন এবং সেখানে একটি পঞ্চমুণ্ডী আসন স্থাপন করে দিবারাত্র জপ-ধ্যান করতে লাগলেন। এ-সময়ে তাঁর লোকসঙ্গ একদম ভালো লাগত না। সর্বদা নির্জনতাপ্রিয় রামপ্রসাদ কেবল দু’বেলা আহারের সময়ই বাড়িতে যেতেন। অন্য সময়ে কেবল মাতৃনাম করতেন। তিনি একটি সুন্দর মাকালীর মূর্তি নির্মাণ করালেন এবং সেই মায়ের পূজা, হোম, যজ্ঞ, তপস্যা করেই সময় কাটাতে লাগলেন। দেখতে দেখতে মন তাঁর সংসারশূন্য হয়ে গেল। দেহে-মনে দিব্যভাব লক্ষ করা গেল। বার, তিথি, নক্ষত্র সবই তিনি ভুলে গেলেন। দিন আসে, চলে যায়, রাত্রি আসে, আবার দিনের উদয় হয়। কিন্তু রামপ্রসাদের কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সাধনার রাজ্যে তাঁর মন ক্রমশ দারুণ অন্তর্মুখী হয়ে গেল। জগৎ সংসারের সঙ্গে সম্পর্কহীন রামপ্রসাদ এখন একবারে মাতৃময় হয়ে উঠলেন। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, অষ্টমী, একাদশী তিথি এবং শনি ও মঙ্গলবারে তিনি আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে সর্বদা মায়ের নাম ও ধ্যানে পাগলপারা হয়ে উঠতেন। তখন চক্ষু দিয়ে তাঁর অবিরল ধারা নির্গত হত এবং কণ্ঠভরে গাইতেন নির্ঝরিণী মধুরমাতৃসঙ্গীত যা আকাশ-বাতাস মথিত করে দিগদিগন্তরে ছড়িয়ে পড়ত—

ডুব দেরে মন কালী বলে

হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে

রত্নাকর নয় শূন্য কখন—দু-চার ডুবে ধন না পেলে

তুমি দম সামর্থ্যে এক ডুবে যাও, কুলকুণ্ডলিনীর কূলে।।

জ্ঞান সমুদ্রের মাঝেরে মন শক্তিরূপা মুক্তা ফলে

তুমি ভক্তি কর কুড়ায়ে পাবে, শিববুদ্ধি মতন নিলে।। …

গানের সঙ্গে সঙ্গেই ‘মা দেখা দাও—মা দেখা দাও’ বলে দিনরাত ব্যাকুলভাবে তিনি জগজ্জননীর কাছে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর ব্যাকুলতা হল লাগামছাড়া। শ্যামা মায়ের দর্শন আজই তাঁর চাই-ই চাই। মনের সমস্ত ভয়, ভাবনা, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব মুছে দিয়ে রামপ্রসাদ এখন থেকে সমস্ত রাত্রি পঞ্চমুণ্ডী আসনে বসে ধ্যান করতে লাগলেন। আনন্দময়ী শ্যামাকে তাঁর চাই। মার কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত সাধকের মন আর মানতে চায় না। চাই সাক্ষ্য দর্শন। হবে মায়ে-পোয়ে কথা। আদান-প্রদান, প্রেম-ভালোবাসা, রাগ-অনুরাগ, মিলন-বিরহ। তাই দিবানিশি মাকে ডেকেই চলেন। বিচারবুদ্ধি সব চলে গেল রামপ্রসাদের। তিনি একেবারে মাতৃ শরণাগত শিশুটির মতো হয়ে গেলেন। একদিন ছদ্মবেশে মা কালী তাঁকে দেখা দিলেন। তবে মেয়ের রূপ ধরে। বেড়া বাঁধার ছলে। কিন্তু রামপ্রসাদের এতে মন ভরল না। তিনি চান সাক্ষাৎ মায়ের দর্শন, স্পর্শন এবং আলিঙ্গন—মা সন্তানকে বুকে নিয়ে আদর করবে এটা বড় কি কথা! তাই অভিমান ভরে কত কথা কয় মায়ের সঙ্গে, কত গান গায়, কান্নাকাটি করে …।

দেখতে দেখতে একদিন সত্যিই শ্যামা মায়ের মন গেল টলে। তিনি আর থাকতে পারলেন না। চাক্ষুষ হয়ে গেলেন। সেদিন ছিল অমাবস্যা রাত্রি। চারিদিকে ঘনঘটা অন্ধকার। অসীম ধৈর্য ও মনোবল নিয়ে সাধক সন্ধ্যা থেকেই পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসলেন। শ্যামা মায়ের চিন্ময়ী মূর্তি চিন্তা করতে করতে একটি সময়ে দেহ রোমাঞ্চ হতে লাগল প্রসাদের। তখন মধ্যরাত্রি। চতুর্দিক নির্জন, নিস্তব্ধ। থেকে থেকে দু-একটি পাখির আর্ত চিৎকার। হঠাৎ সাধকের সম্মুখে ফুটে উঠল একটি অপরূপ জ্যোতি। ক্রমশ তা অনেকটা জায়গা জুড়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে গেল। সেই দিব্যজ্যোতি পুঞ্জের মাঝে এক দিব্য নারীমূর্তি দেখে প্রসাদের নেত্র বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। তিনি আবেগে আত্মহারা হলেন। চোখে অপার করুণা মায়ের—অসম্ভব সুন্দরী এবং অপরূপ হাস্য-মিশ্রিত মুখখানির টানে বিহ্বল রামপ্রসাদ ‘মা’ ‘মা’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। নিজেকে আর সংযত করতে পারলেন না। ‘আমার মা—মা—আনন্দময়ী শ্যামা, তুমি এসেছো’ বলে সাষ্টাঙ্গে মাকে প্রণাম জানালেন। অপরূপা জ্যোতির্ময়ী মায়ের সকরুণ হাতের স্পর্শেই মহানন্দে সেই মুহূর্তেই সংজ্ঞা হারালেন মাতৃসাধক। চলে গেলেন এক পরমানন্দধামে—যেখানে শুধুই আনন্দ এবং প্রেমের স্বর্গরাজ্য। মাতৃদর্শনে তৃপ্ত হল রামপ্রসাদ, ধন্য হল তাঁর মানবজীবন। পরদিন আনন্দে গেয়ে উঠলেন প্রসাদ—

আমার অন্তরে আনন্দময়ী সদা করিতেছেন কেলি।

আমি যেভাবে সেভাবে থাকি নামটি কভু নাহি ভুলি।

আবার দু’ আঁখি মুদিলে দেখি, অন্তস্থিত মুণ্ডমালী।।

বিষয়-বুদ্ধি হইল হত, আমায় পাগল বলে সকলি।

আমায় যা বলে তাই বলুক তারা, অন্তে যেন পাটপাই পাগলী।।

শ্রীরামপ্রসাদে বলে, মা বিরাজে শতদলে।

আমি শরণ নিলাম চরণতলে, অন্তে না ফেলিও ঠেলি।

আর একদিনের ঘটনা। রামপ্রসাদ পঞ্চমুণ্ডী আসনে বসে ধ্যান করছেন। শীতের সময়। নিঃস্তব্ধ প্রকৃতি। গভীর রাত্রি। হঠাৎ চিন্ময়ী শ্যামা মার আবির্ভাব হল। আগের মতোই। জ্যোতিঃ সমুদ্রের মধ্যে মায়ের প্রাণবন্ত রূপ। মুখে উৎফুল্ল হাসি। চোখে প্রেমের পূর্ণতা। আনন্দময়ীর এহেন প্রসন্নমুখ দর্শনে রামপ্রসাদ রোমাঞ্চে ভরপুর হয়ে গেলেন। তাঁর বাসনা হল মায়ের চরণে জবাফুল দিয়ে অঞ্জলি দেবেন। কিন্তু এত রাতে ফুল পাবেন কোথায়? গাছেও কোনো রক্তজবা দেখা যাচ্ছে না। ফিরে এলেন ভজন কুটিরে। সেখানেও ডালি শূন্য। ভগ্ন মনোরথে রামপ্রসাদ চেয়ে রইলেন মায়ের দিকে। অকস্মাৎ এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল। পঞ্চমুণ্ডীর আসনের পাশেই একটি চারা বেলগাছ। সেদিকে প্রসাদের দৃষ্টি পড়ল এবং বিস্ময়ে শিহরিত হল তাঁর দেহ ও মন। তিনি দেখলেন কি—সদ্য চারটি রক্তজবা বেলপত্রের মধ্যে মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়ে রয়েছে—একটু আগেই ফুটেছে—মনের আনন্দে ভাবে বিহ্বল হয়ে প্রসাদ আলতোভাবে রক্তজবা চারটি তুলে নিলেন এবং ভক্তিভরে মায়ের শ্রীচরণে অর্ঘ্য নিবেদন করে গেয়ে উঠলেন—

মন কেন তোর ভ্রম গেল না, গেল না।

কালী কেমন তাই চেয়ে দেখলি না।। …

দিনে দিনে রামপ্রসাদ আরও বেশি বেশি করে মাতৃপ্রেমে স্নাত হতে লাগল। এখন থেকে মা-ই তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন হল যা মৃত্যুদিন পর্যন্ত সমানে বজায় ছিল—বলতে কি মায়ের ভাবনা ভাবতে ভাবতে অশ্রুভরা প্রসাদের কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল কেবল গান আর গান—

কৃপাময়ী মা কালী

ভাব কি ভেবে পরান গেল

যার নামে হয়ে কাল, পদে মহাকাল

তার কেন কাল রূপ হল।

কালরূপ অনেক আছে, এ বড় আশ্চর্য কালো।

যাকে হৃদমাঝারে রাখলে পরে হৃদয়পদ্ম করে আলো।।

রূপ কালী নামে কালী কাল হতে অধিক কালো।

ও রূপ যে দেখেছে সেই মজেছে অন্য রূপ লাগে না ভালো।। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *