কালী সাধনায় : সাধক কমলাকান্ত
কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন।।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন,
কালী পদ্মবনে হংস সনে হংসীরূপে করে রমণ।।
আত্মারামে আত্মাকালী, প্রমাণ প্রণবের মতন
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।।
মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড-ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জানো কেমন,
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম অন্য কেবা জানে তেমন।।
প্রসাদ ভাসে লোকে হাসে সন্তরণে সিন্ধু তরণ
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন।।’
তন্ময় হয়ে প্রসাদের এই গানটি বারবার গায় বালক কমলাকান্ত। কমলাকান্তদের বড় অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবু মা মহামায়া দেবী ছেলের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন টোলে। ব্রাহ্মণের ছেলে আকাট মূর্খ হয়ে থাকলে তো আর সংসার চলবে না। তার উপর স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সংসারের অভাব অনটন বেড়েছে বই কমেনি। মহা চিন্তায় পড়েছেন মা মহামায়া দেবী। শিশু পুত্রদের নিয়ে এই অভাবের সংসার আর চলে না। তার চেয়ে পিতৃগৃহে ছেলেদের নিয়ে যাত্রা করাই শ্রেয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মা মহামায়া দেবী কমলাকান্তকে নিয়ে পিত্রালয়ে চাল্লাগ্রামেই (বর্ধমান জেলার) উপস্থিত হলেন। দিন যায়, রাত আসে। দেখতে দেখতে সংসার প্রবাহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল।
এখন ছেলের বেশ বয়স হয়েছে। যৌবনে উপনীত। কিন্তু সংসার কর্মে নব যুবকের কোনো মতিগতি নেই। কেবল সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। তাল-লয় বোধ যথেষ্ট পাকা। আপন গ্রামের সকলে তার কিন্নর কণ্ঠের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই গ্রামের পাশের গ্রাম হল চাল্লাগ্রাম। কমলাকান্তের মামার বাড়ি। বিশালাক্ষীর মন্দির এখানে রয়েছে। দেবী বড় জাগ্রতা। স্থানটি অরণ্যঘেরা নির্জন। পাখপক্ষীর কিচিরমিচির সর্বদা শোনা যায়। বিশুদ্ধ বাতাস। জায়গাটা কেমন যেন আলাদা। অনন্তের হাতছানি যে কেউ এখানে মনে-প্রাণে অনুভব করে। কমলাকান্তের শুদ্ধ চিত্ত। কাজেই বারবার তার এখানে আসা চাই-ই।
দেবী বিশালাক্ষী। যুবা ভাবে—কে ইনি? মা বিশালাক্ষী? ইনি-ই কি আদ্যাশক্তি মা কালী? দেবীর পূর্ণ অবয়ব মূর্তি নেই। তাই কমলাকান্তের মন ভরছে না। তবু তো তিনি দেবী। বিশ্বের সমস্ত কিছু তাঁর লক্ষ্যে ঘটছে। এমন কিছু নেই যা দেবী দেখছেন না। সমস্ত মানুষের কর্ম, কর্মফল, পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে দেবী সর্বদা সচেতন। তাঁর সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কিছু করার জো নেই কারোর। এমনই বিশ্বাস এখানকার সব মানুষের মনে।
মন্দিরে গান গাইতে গাইতে কমলাকান্ত এ কি অনুভব করেন! বিশালাক্ষী মায়ের মূর্তি ভেদ করে ভাব জগতে তিনি দেখলেন মা কালী। কণ্ঠদেশে মুণ্ডমালাধারিণী, বরাভয়া, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষদায়িনী জগন্মাতা শ্যামা। আর সাধককে পায় কে! রাতদিন বিশালাক্ষীর সামনে বসে গানই গেয়ে চলেছেন। নিজেই রচনা করছেন সে গান। সুরও দিচ্ছেন রচনার সঙ্গে সঙ্গে। ভাববিহ্বল চিত্তে অবলীলাক্রমে গেয়ে চলেছেন নবীন সাধক সুধাকণ্ঠে—
সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী।
তুমি আপনি নাচ, আপনি গাও, আপনি দাও মা করতালি।।
আদিভূতা সনাতনী, শূন্যরূপা শশীভালী।
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি।।
সবে মাত্র তুমি যন্ত্রী, আমরা তোমার তন্ত্রে চলি।
যেমন রাখ তেমনি থাকি মা, যেমন বলাও তেমনি বলি,
অশান্ত কমলাকান্ত দিয়ে বলে গালাগালি।
এবার সর্বনাশী ধরে অসি ধর্মাধর্ম দুটো খেলি।।
ছেলে নিত্য নতুন গান লেখে। আর গায়। কখনো কখনো গান গেয়ে অশ্রুতে চক্ষুযুগল প্লাবিত হয়। মন একেবারে উদাসীন। মা মায়াদেবীর মতো সকলে ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছিলেন। না জানি ছেলে আবার সন্ন্যাসী না হয়ে যায়! অন্যের পরামর্শে মা আর ছেলের বিয়ে দিতে দেরি করলেন না। কমলাকান্ত বিয়েতে অমত করলেন না। কিন্তু কপালে তাঁর সংসার সুখ নেই। অল্প কয়েকমাসের মধ্যেই তাঁর সহধর্মিণী এক রোগভোগে পরলোকে পাড়ি দিলেন। বড় ব্যথায় বেজে উঠল কমলের হৃদয়। চোখের সামনে ভালোবাসা ভরা মুখখানি লাল আগুনে কোথায় মিলিয়ে গেল। আহা! কোথায় গেল সে—প্রশ্ন করে নিজেকে—তাহলে সংসারে সত্যি কি? হাহাকার করে উঠল প্রেমিকের হৃদয়। বেদনাভরা কণ্ঠে মুখ থেকে বেরিয়ে এল এক স্বরমাধুর্য—
ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয় মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে
ভুল না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে …
প্রাণপ্রিয় স্ত্রী বিয়োগের পর কমলাকান্ত বর্ধমানের এই চাল্লাগ্রামের পথে-প্রান্তরে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আর রাতে গ্রামের পাশে খড়েগশ্বরী নদীর তীরে মহাশ্মশানে মায়ের নাম-গান করতে থাকলেন।
এমনভাবেই তাঁর দিন কেটে যায়। সর্বদা আচ্ছন্ন ভাব। কণ্ঠে কেবল মাতৃনাম। একদিকে সংসারে দারিদ্র্য, স্ত্রী বিয়োগ, বেদনা—তার উপর মায়ের এবং অন্যান্য ভাইদের ভরণপোষণের দায়িত্ব। তাই মনে তাঁর অন্তহীন চঞ্চলতা, প্রাণে লাগে হতাশার দোলা। এই ভীষণ সংসার দাবানলে মা-ই তাঁর একমাত্র আশা-ভরসা, ভালোবাসা, প্রাণজুড়ানোর জায়গা হয়ে উঠল। তাঁর আর কিছুই ভালো লাগে না—কেবল মা, আর মা—কোথায় মা—তবু একলা মনকে প্রবোধ দিয়ে কমলাকান্ত আপনমনেই গেয়ে ওঠে—
শ্যামাধন কি সবাই পায়
অবোধ মন বোঝে না এ কী দায়।
শিবেরই অসাধ্য সাধন মন মজানো রাঙ্গা পায়।
ইন্দ্রাদি সম্পদ তুচ্ছ হয় যে তাকে পায়
সদানন্দে সুখে ভাসে শ্যামা যদি ফিরে চায়।।
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ইন্দ্র যে চরণ ধ্যানে না পায়
নির্গুণ কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়।।
গায়ক কমলাকান্ত গুরুকরণের জন্য এবার সচেষ্ট হলেন। অচিরেই সে আশা তাঁর পূর্ণ হল। বর্ধমানেই মানকরে পেয়ে গেলেন মহা তন্ত্রসাধক কেনারাম চট্টোপাধ্যায়কে। শুদ্ধ চিত্ত কমলাকান্তকে দেখেই গুরু তন্ত্রমতে তাঁকে দীক্ষিত করলেন। বাঁধলেন মনের গভীর প্রেমবন্ধনে। আত্মলোকের সব দ্বার উদঘাটন করে দিতে হলেন সচেষ্ট। কমলাকান্ত ধীরে ধীরে সমস্ত সাধন পদ্ধতি শিখে নিলেন। মনে ভাবলেন এবার থেকে কেবল শ্যামা মায়ের চরণ সেবা করেই কাটাবেন। এই আশা করেই চাল্লাগ্রামে ফিরে এলেন। কিন্তু সংসার খাঁ-খাঁ করছে দেখে মা মহামায়া তাঁকে আবার বিয়ে করার জন্য কেবল অনুনয় করতে লাগলেন। ইতিপূর্বে গুরু কেনারামও তাঁকে সংসারে থেকেই সাধনভজন করতে বলেছেন। এটা দৈবী ইচ্ছা ধরে নিয়ে কমলাকান্ত দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করলেন। কিন্তু সংসারে তেমন আকর্ষণ বোধ করলেন না বরং শক্তিকে কাছে রেখে মনের সমস্ত কামনাকে তপস্যার অগ্নিতে আহুতি দিতে মনস্থির করলেন। ফলে বিশালাক্ষীর মন্দিরের কাছেই শিমূলতলায় স্থাপন করলেন পঞ্চমুণ্ডীর আসন। গুরু কেনারাম একদিন এসে শিষ্যকে সযত্নে আসনের উপর বসিয়ে দিয়ে গেলেন।
বিশ্ব সংসারের ত্রাণকর্ত্রী জগন্মাতার ইচ্ছা বোঝা বড়ই ভার। সাধক কমলাকান্ত যতই সংসার থেকে মনটা পালিয়ে নিয়ে বেড়ান ততই মা শ্যামা যেন তাঁকে সংসারী করে তুলতে চান। দরিদ্রের অভাবের সংসার। কোনোরকমে অন্ন সংস্থান হয়। তার উপর বছর না ঘুরতেই এক কন্যার মুখ দেখা গেল সংসারে। মা মহামায়া বড় চিন্তিত হলেন। ছেলে উদাসীন। সংসার বাড়ছে। ভরণপোষণের কি হবে! এদিকে ছেলে সারাক্ষণ সাধনে ডুবে আছেন। কোনোরকমে দিন যায়। মেয়েটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে।
ক্রমে ক্রমে বর্ষা পেরিয়ে হেমন্ত কাটল। শীতও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বসন্তের মধুর আহ্বান বৃক্ষে শাখায় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সংসার চালানো যেন বড়ই দায় হয়ে উঠছে কমলাকান্তের মায়ের। কেবল চিন্তা কোনো একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। এদিকে গত সন্ধ্যায় কমলাকান্ত মা বিশালাক্ষীর মন্দির সংলগ্ন আসনে বসে ধ্যানস্থ হয়েছে। আজ অনেকটা বেলা হল। তখনো ফিরল না। বাড়িতে যে আজ চাল বাড়ন্ত। বউমা, ছোট্ট কন্যা খাবে কি—কমল যে এখনও ফিরল না। গালে হাত পড়ল মা মহামায়ার। কত আর ধার করে আনা যায়। চক্ষু ছলছল। বিষণ্ণ মুখে বউমা ও শাশুড়ি দাওয়ায় বসে আছেন। রৌদ্রস্নাত দুপুর। নির্মল আকাশ। অভুক্তের মনব্যথায় নড়েচড়ে উঠলেন জগন্মাতা মা কালী। ভাবলেন—তাই তো, ছেলে পঞ্চমুণ্ড আসন ছেড়ে বাড়ি গিয়ে খাবে কী? না, আর থাকা যায় না। চলো সখী, এসো …
হঠাৎ গোটা বাড়ি সুগন্ধে ভরে উঠল। মা মহামায়া দেবী তখনও দাওয়ায় বসে অন্নচিন্তা করছেন। বউমা ঘরে টুকিটাকি কাজ করছেন। এমন সময় বাড়িতে হাজির হল শ্যামবর্ণা এক টুকটুকে কিশোরী। বয়স পনেরো-ষোল হবে। পরনে লাল পেড়ে শাড়ি। এলো চুল। চক্ষুযুগল প্রেম ও করুণা ভরা। পায়ে রূপোর মল। নাকে সোনার নথ। সারা গা লাবণ্যে ঝলমল করছে। ঝমঝম করে মল বাজিয়ে মেয়েটি সোজা গিয়ে মহামায়াদেবীর কাছে এসে দাঁড়াল। শব্দ শুনে বাড়ির বউমা দাওয়ায় এল। উভয়েই মেয়ের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মুখে যেন বাক্য স্ফূর্তি হল না। ইতিমধ্যে দু’জন মালবাহক মাথায় ঝুড়ি নিয়ে দাওয়ার কাছে এসে হাজির হল এবং মেয়েটির নির্দেশে ঝুড়িগুলি দাওয়ায় রেখে দিল। ঝুড়ি দুটিতে খাদ্যবস্তু উপচে পড়ছে। চাল, ডাল, সবজি, মশলাপাতি আরো বহুরকম জিনিসে পূর্ণ। এমন অপ্রত্যাশিত কাণ্ড দেখে মহামায়াদেবী চমকে উঠলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি কাদের মেয়ে গা? এতসব জিনিসপত্র কে পাঠালে?
মেয়েটি মুখে স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে উত্তর দিলে—”আমি—এই দূরের গাঁয়ের এক মেয়ে। এগুলি মা পাঠিয়ে দিয়েছে। রেখে দাও।”
এই বলে কন্যাটি ব্যস্তসম্মতভাবে বাড়ির দরজার দিকে মুখ ফেরাতেই মহামায়াদেবী আরো কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইলেন। কিন্তু বাহকরা ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছে। মেয়েও দ্রুত অন্তর্হিত হল। কে বা কারা এইসব মালপত্র পাঠাল তার কেউই কূলকিনারা করতে পারল না। বিস্ময়ে দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে রইল।
বেলা যায় দেখে মহামায়াদেবী বউমাকে দিয়ে নানারকম রান্না করে রাখলেন। কমলাকান্ত ফিরলে খাবেন। অবশেষে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার সময় সাধক প্রবর ফিরলেন। পেটে দারুণ ক্ষুধা। তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে খেতে দিতে বললেন।
কিন্তু নানাবিধ ব্যঞ্জনসহ ভাতের থালা দেখে চমকে উঠলেন কমলাকান্ত। স্ত্রীর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনলেন। বউ বললে—”অপরূপ শ্যামবর্ণা মেয়েটি দু’জনকে সঙ্গে এনে সব দিয়ে গেল। আমি আর মা তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করার আগেই মেয়েটি মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। তাদের আর খোঁজ পেলাম না।”
কমলাকান্ত বিস্ময়ে আবেগ ভরে বলে দিলেন—বুঝেছি এ আমার মা-বেটির কাজ। মা—আমার মা এসব পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি এমন অভাগা মা-র দেখা পেলাম না। ‘জগজ্জননী শ্যামা—মা আমার!’ … চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রুধারা। অন্তরে কেবল মা! মা! ধ্বনি। ভাতগুলি আর যেন খেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে তাঁর সমগ্র সত্তা ধরে কে যেন অসীম অতল লোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে দাওয়ায় বসলেন কমলাকান্ত। মুখে তখন স্মিত হাস্য। উৎফুল্ল বদন। সুধা কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন—
মজলো আমার মন ভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে,
শ্যামাপদ নীলকমলে,—কালীপদ নীলকমলে।
যত বিষয় মধু তুচ্ছ হল, কামাদি কুসুম সকলে
চরণ কালো ভ্রমর কালো, কালোয় কালো মিশে গেল,
তায় পঞ্চতত্ব, প্রধান মত্ত, রঙ্গ দেখে ভঙ্গ দিলে
কমলাকান্তের মনে, আশা পূর্ণ এত দিনে,
সুখ-দুঃখ সমান হলো, আনন্দ সাগর উথলে।।