কালীমন্দিরের যখ

কালীমন্দিরের যখ

(এক)

সন্ধে একটু গাঢ় হতেই পুরনো কালীমন্দিরের সামনের ভাঙা চাতালে লোক জড়ো হতে শুরু করেছিল, এখন চাতাল থেকে একটু দূরে জনা পঁচিশেকের একটা ভিড় তৈরি হয়েছে৷ আনন্দের উপর দায়িত্ব পড়েছে তাদের সামলানোর৷ থেকে থেকে তার ধমক কানে আসছে৷

আজ সকালে মন্দিরের চারপাশ থেকে ঘাস কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে জায়গাটা৷ তারপর থেকেই গ্রামের লোকজন কাউকে আসতে দেওয়া হয়নি কাছাকাছি৷ মন্দিরের বিরাট দরজা থেকে মিটারদুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে পুরোহিত শ্যামাপদ চক্রবর্তী, সুবর্ণ লাহিড়ী আর দশাসই চেহারার ভবেন৷ ভবেনের হাতে একটা সার্কুলার৷ এই যন্ত্রটা দিয়ে একটু পরেই দরজার লোহার সিল কাটা হবে৷

‘পঞ্চাশ বছর খোলা হয়নি দরজাটা, তাই না?’ পাশে দাঁড়ানো কলির কাঁধে একটা হাত রেখে বলে পায়েল৷

‘যতদূর শুনেছি শেষ খোলা হয়েছিল সিক্সটি ফাইভে, মানে দাঁড়াচ্ছে চুয়ান্ন বছর৷’ ল্যাঙ বাড়িয়ে মন্দিরের দরজার দিকে তাকায় কলি৷

‘তোর কী মনে হয়, ভিতরে কী আছে?’

‘অশ্বডিম্ব আছে, সামান্য একটু গোলমরিচ আর নুন দিয়ে জমে যাবে৷’

‘এই দুশো বছরে যখ অশ্বডিম্ব ফেলে রাখেনি তোর জন্য৷’ পায়েলের মুখে হাসি খেলে যায়৷

‘তুই ওইটা বিশ্বাস করছিস! যখের ব্যাপারটা?’

পায়েল আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল৷ এমন সময় চাতাল ছাড়িয়ে উদগ্রীব হয়ে থাকা জনতার দিকে এগিয়ে আসেন সুবর্ণ লাহিড়ী, একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলেন, ‘আপনারা আজ সন্ধ্যায় এখানে এসেছেন এর জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ৷ তবে এ কথাও ঠিক যে ঘটনা আপনারা দেখতে চলেছেন তা দেখার সৌভাগ্য হওয়াটাও বড় কম কথা নয়…’

আর একটু জনতার মাঝে ঢুকে এসে আবার বলতে থাকেন তিনি, ‘আপনারা জানেন এই কালীমন্দির কেবল নামেই মন্দির৷ এর ভিতরে কোনও বিগ্রহ নেই৷ কথিত আছে, আজ থেকে দুশো বছর আগে এ বাড়ির মালিক, অর্থাৎ সুবীর চৌধুরীর পূর্বপুরুষ জমিদার মাধবচন্দ্র মারা যাবার আগে তার সমস্ত সম্পত্তি এই মন্দিরের ভিতরে গচ্ছিত রেখে মন্দিরটি সিল করে দেন৷

সেকালের বিশ্বাস অনুযায়ী গ্রামেরই একটি বছর পনেরোর ছেলেকে তুলে এনে তাকে জীবন্ত এই মন্দিরের ভিতরে ধনসম্পত্তির সঙ্গেই আটকে দেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন, এইভাবে বদ্ধ ঘরে মৃত্যুর পর ছেলেটি যক্ষ হয়ে ওই ধনসম্পত্তির দেখভাল করবে৷ গুজব রটে ছেলেটি নাকি ছিল সাক্ষাৎ শয়তানের অবতার৷

তারপর দেড়শো বছর ধরে মন্দিরটি তার সমস্ত লুকানো সম্পত্তি নিয়ে এভাবেই পড়েছিল৷ পঞ্চাশ বছর আগে চৌধুরীদের জমিদারি ক্রমশ অর্থাভাবে শেষ হয়ে আসতে থাকে৷ উপায়ন্তর না দেখে তারা দেড়শো বছর ধরে বন্ধ থাকা মন্দিরটি সম্পত্তি উদ্ধারের আশায় খুলতে বাধ্য হন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মন্দিরের ভিতরে কিছুই পাওয়া যায় না৷ সম্ভবত গ্রামের মানুষের চোখে জমিদারির গুরুত্ব অটুট রাখতে এই অলৌকিক গিমিকটি রচনা করে গেছিলেন মাধবচন্দ্র৷ কিন্তু মন্দির খোলার পর থেকেই গ্রামে অদ্ভুত এক রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় সে সময়ে আবার যাগযজ্ঞ করে লোহার সিল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মন্দিরটি৷

এক সপ্তাহ আগে, একদিন রাতে মন্দিরের দিক থেকে মৃদু গোঙানির শব্দ কানে আসে আমাদের চৌধুরী বাড়ির কিছু সদস্যের৷ প্রথমে আমরা গুরুত্ব দিইনি, কিন্তু সকালে উঠে ভবেন আবিষ্কার করে যে মন্দিরের ঠিক বাইরে পড়ে আছে একটা মরা বিড়ালের দেহ৷ দেখে মনে হয় যেন তার সমস্ত শরীর থেকে রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ৷ এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মন্দিরের দিক থেকে একটি মানবশিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে, অগত্যা আমরা পঞ্চাশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে থাকা এই ঘরটি খোলার সিদ্ধান্ত নিই… আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এর সিল কেটে দরজা খুলে ফেলব আমরা…’

‘তোরা এভাবে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিস কেন? সামনে গিয়ে দাঁড়া৷’ পিছনে তাকিয়ে বাবাকে দেখতে পায় কলি৷ তাকে দেখতে পেয়ে আনন্দ এগিয়ে আসে, ‘এই তো সুবীরদা এসে গেছেন, ভবেন, শুরু করো৷’

বনবন করে একটা যান্ত্রিক শব্দ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে৷ চারটে হ্যারিকেন আর দুটো টর্চের আলোয় ভরে উঠেছে মন্দিরের দরজার সামনেটা৷ দরজাটা অন্তত দেড়মিটার চওড়া৷ লম্বায় সাত ফুট৷

এবার তার দুটো পাল্লার মাঝে সিলের উপরে গিয়ে বসছে সার্কুলার স৷ কাটতে থাকা লোহার শব্দে ভরে উঠেছে জায়গাটা৷

কলির কাঁধে একটা হাত রাখে পায়েল, ‘দুশো বছর পরে যখের আবার কান্নাকাটির ধুম পড়ল কেন বলতো?’

‘যখ না হাতি, পাড়ার ছেলে-ছোকরারা মাজাকি নিচ্ছে আর আমার বাপ-কাকারাও জুজু দেখছে… সুপারস্টিশান এদের মিডল নেম….’

‘It is the glory of God to conceal things, but the glory of kings is to search things out’ বিড়বিড় করে পায়েল৷

‘সেটা কী?’

‘বাইবেল৷ আয় আমার সঙ্গে…!’

পায়েল আর কলি এগিয়ে যায় মন্দিরের দিকে৷ দরজা থেকে মিটার দশেক দুরে জনাকুড়ি উৎসুক জনতা উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে আছে দরজার সিলের দিকে৷ মন্দিরের ভিতরে কিছুই নেই সবার জানা, অথচ চোখ ফেরাতে পারছে না কেউ৷ দরজার সামনে দাঁড়ানো চারটে মানুষের চোখও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিলের দিকে৷ এই পঞ্চাশ বছরে একবারও খোলা হয়নি ওটা৷

কান ফাটানো একটা শব্দ করে খুলে পড়ে কেটে যাওয়া প্রায় দু’ইঞ্চি মোটা ধাতব পাতটা৷ চাতালে দাঁড়িয়ে থাকা চারটে মানুষই এক পা পিছিয়ে আসে৷

ভবেন দু’হাতে ঠেলা দেয় দরজার দুটো পাল্লায়৷ পঞ্চাশ বছরের ঘুম ভেঙে সুদীর্ঘ একটা শব্দ করে খুলে যায় দরজাটা৷ ভিতরের প্রাচীন অন্ধকারের কিছুটা অংশ আলোকিত হয়৷ ওপাশে কিছুই দেখা যায় না৷

‘টর্চটা…’ পেছন ফিরে আনন্দের দিকে টর্চ চাইলেন সুবীর চৌধুরী, ‘তোমার কাছেই তো ছিল টর্চটা!’

আনন্দ থতমত খায়, ‘আমি কার হাতে যেন দিলাম…’

ভিড়ের মধ্যে খোঁজাখুঁজি পড়ল৷ মিনিট খানেকের মধ্যে টর্চ হাজির হল সুবীর চৌধুরীর হাতে৷

‘এখুনি ঢুকবেন না, ভিতরের হাওয়াটা বেরিয়ে যাক আগে৷’ ভিড়ের মধ্যে থেকে নির্দেশ ভেসে আসে৷

পায়েল আর কলি চাতালের একেবারে ধার অবধি এগিয়ে আসে৷ পঁচিশজন মানুষ মিনিট তিনেক নিস্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করে৷ পুরোহিত শ্যামাপদ কিছু একটা মন্ত্র জপছিলেন এতক্ষণ৷ এবার মন্ত্র থামিয়ে একপা একপা করে এগিয়ে যান তিনি৷ তার ঠিক সঙ্গে সঙ্গে সুবর্ণ লাহিড়ী, সুবীর চৌধুরী, আর ভবেন৷

পায়েল আর কলি এগিয়ে এসেছে দরজার কাছাকাছি৷ উঁকি মেরে ভিতরে কিছুটা সিমেন্টের মেঝে ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না তারা৷ আচমকা একটা সম্মিলিত চিৎকার ভেসে আসে ভিতর থেকে৷ পরক্ষণেই লাহিড়ীর গলা শোনা যায়, ‘ডাক্তার, একবার এদিকে এসো ডাক্তার…’

লাহিড়ীর গলার স্বরে উত্তেজনা ঠিকরে পড়ছে৷ ভিড়ের মধ্যে থেকে ডাক্তার উপল দেবনাথ ছুটে যান দরজার ভিতরে, সেই সঙ্গে জনতার একাংশ৷ পায়েল দৌড়ে ভিতরে ঢুকে আসে৷

অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে মাটির উপরে পড়ে আছে একটা বছর পনেরোর বাচ্চা ছেলে, তার গলার নলিটা উপড়ানো৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত মুখ আর মেঝে৷ পায়েল মুখ ঘুরিয়ে নেয়৷ আতঙ্কে চোখ বন্ধ হয়ে যায় তার৷

‘অন্তত কয়েকঘণ্টা আগে মারা গেছে৷’ দেহটা পরীক্ষা করে বলেন ডাক্তার উপল দেবনাথ৷

‘কিন্তু তা কী করে সম্ভব?’ চিৎকার করে ওঠেন সুবর্ণ লাহিড়ী৷

একটু আগের মন্ত্রটা আবার পড়তে শুরু করেছেন শ্যামাপদ৷ কলি ভয়ার্ত চোখে তাকায় পায়েলের দিকে, ‘মন্দিরটাতো পঞ্চাশ বছর খোলা হয়নি৷ তাহলে এই ছেলেটা এখানে…’

মনে মনে অস্ফুটে কিছু একটা বলছে পায়েল, কলি কান পেতে শুনতে পায়, ‘It is the glory of God to conceal things, but the glory of kings is to search things out…’

(দুই)

‘ছেলেটাকে আইডেন্টিফাই করা যায়নি?’ সুবীর চৌধুরী আরামকেদারায় পিঠ রেখে চিন্তায় ডুবে ছিলেন৷ এতক্ষণে প্রশ্ন করলেন তিনি৷

‘না৷ আমরা চেষ্টা করছি, খোঁজখবর চলছে৷ মিনহোয়াইল….’

চৌধুরীবাড়ির দোতলায় ঘের বারান্দায় জমা হয়েছে জনাদশেক লোক৷ পুলিশ বাড়ির সবাইকেই জেরা করেছে এতক্ষণে৷ ইন্সপেক্টর গোস্বামী কাল সারারাত দলবল নিয়ে মন্দিরের চারপাশটা চষে ফেলেছেন৷ তার মুখচোখ অবসন্ন৷ দেখে বোঝা যায় এ ধাঁধার উত্তর খুঁজে পাওয়া দূরের কথা, মনে মনে আরও গুলিয়ে গেছে সবটা৷ নিজের বুক পকেটে রাখা খুদে ভয়েজ রেকর্ডারটা দেখে নেন তিনি, ঠান্ডা মাথায় ভাবতে গেলে জিনিসটা কাজে লাগে৷

সামনের রেলিংয়ে রাখা জলের গ্লাস থেকে কিছুটা জল গলায় ঢেলে তিনি বললেন, ‘দেখুন খুন যখন হয়েছে তখন খুনিও একজন আছে৷ এবং একথাও স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে প্রায় অসম্ভব একটা খুন করে আমাদের তাক লাগিয়েছে দিয়েছে সে, ভালো কথা….’

একটু দূরে বসা সুবর্ণ লাহিড়ীর দিকে তাকান ইন্সপেক্টর, ‘কাল সন্ধ্যায় ঠিক ক’টা নাগাদ আপনারা দরজাটা খোলেন?’

‘সন্ধে সাড়ে আটটা৷’

‘সন্ধেবেলা কেন? মানে এসব কাজ দিনের বেলায় তো ভালো হয়৷’

‘সময়টা পাঁজি দেখে শ্যামাদাই বলেছিলেন৷ অথচ দেখুন কী ঘটে গেল৷’

‘শ্যামাদা?’ ভুরু কোঁচকান গোস্বামী৷

‘আমাদের কুলপুরোহিত৷ সকাল থেকে পুজোআচ্চা নিয়ে আছেন, উঠতে চাইছেন না৷ ওঁর মতে এটা খুন নয়, অপদেবতার রোষ!’

‘হুম, আপনারা চারজন প্রথমে ভিতরে ঢোকেন?’

‘হ্যাঁ, আমি শ্যামাদা, সুবীর, আর ভবেন৷’

ভবেন একটু দূরে মাটির উপরে বসেছিল৷ সে ঘাড় নাড়ায়৷

‘ঢোকার পর কী দেখলেন?’

‘প্রথমে কিছু দেখতে পাইনি তেমন৷ শ্যামাদাই আগে দেখেছিলেন৷ মাটির উপরে মনে হল একটা দেহ পড়ে আছে৷ আমরা চারজনেই প্রথমে ভয় পেয়ে যাই৷ বিশেষ করে দেহটা একটা বাচ্চা ছেলের বলে…’ বাকি কথাটা বলতে ইতস্তত করেন লাহিড়ী৷

‘হুম… যক্ষের ব্যাপারটা আমিও শুনেছি… তারপর কী হল?’

‘আমরা চারজনেই চিৎকার করে উঠি৷ আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি ছেলেটা মাটিতে পড়ে আছে, চতুর্দিক রক্তে ভেসে গেছে৷ আমি মৃতদেহ আগেও দেখেছি কিন্তু ওরকম গলার নলি উপড়ে খুন… ছেলেটা খুন হয়েছে বুঝতে পেরে আমিই ডাক্তারকে ডাকি৷’

‘ডাক্তার…’ বাকিদের মধ্যে থেকে উপল ঘাড় নাড়ায়, ‘আমি৷ ভিতরে ঢোকার সময় আমি ভেবেছিলাম ঘরের ভিতরে গিয়ে কেউ হয়তো উত্তেজনায় অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে গেছে৷ একটা ডেডবডি পড়ে থাকবে স্বপ্নেও ভাবিনি৷’

‘ডেডবডি যে বুঝলেন কী করে? মানে দেহটা যে মৃত…’

‘গলার নলিটা যেভাবে উপড়ানো ছিল তাতে মানুষের বেঁচে থাকার কথা নয়৷ রাইগার মরটিস সেট ইন করেছিল৷ রক্তটা অনেকদূর গড়িয়ে গেছিল৷ বুঝলাম অন্তত কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছে ছেলেটা৷’

‘বেশ, তারপর?’

‘লোকে বলছিল পুলিশ আসা অবধি বডিটা ওভাবেই ফেলে রাখতে কিন্তু শ্যামাদা সায় দেননি, একরকম জোর করেই বডিটা সরিয়ে ফেলতে বলেন৷’

‘কেন?’

‘জায়গাটা একসময়ে কালীমন্দির ছিল৷ আর যখের ব্যাপারটাও লোকজনের মুখে মুখে ঘোরে৷ শুভ-অশুভ বিচার করেই বোধহয় উনি…!’

‘আচ্ছা, আপনি বলতে থাকুন!’

‘আমি আর ভবেন মিলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে গিয়ে ধরাধরি করে বডিটা এ বাড়ির একতলায় ঠাকুরদালানে এনে রাখি৷ তারপর থেকে পুলিশ আসা অবধি ওখানেই পড়ে ছিল৷’

‘পুলিশ কখন আসে?’

সুবীর চৌধুরী উত্তর দেন, ‘ওই ধরুন রাত সাড়ে দশটা নাগাদ৷ এর মধ্যে আমরা তামাশা দেখতে আসা লোকজনকে সরিয়ে দিই৷’

ইন্সপেক্টর গোস্বামী এবার সুবীর চৌধুরীর দিকে ঘোরেন, ‘এ-বাড়ির মালিক তো আপনিই৷ ছেলেটিকে দেখেননি আগে?’

‘নাঃ৷’

‘মন্দির খোলার আইডিয়াটা আপনার?’

নাকের ডগা থেকে চশমাটা টেনে এনে চোখের কাছাকাছি বসিয়ে নেন চৌধুরী, ‘মন্দিরটা খোলার ইচ্ছা কারোরই ছিল না৷ আমার বাবার আমলে একবার খোলা হয়েছিল ঘরটা, সেসময়ে আমি এখানে ছিলাম না৷ কিন্তু মারা যাবার আগে বাবা কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন ঘরটা যেন কোনও পরিস্থিতিতেই না খোলা হয়৷ কিন্তু…’ পরের কথাটা শেষ করার আগেই থেমে যান চৌধুরী৷

লাহিড়ী বলেন, ‘শ্যামাদা বললেন মন্দিরে নাকি অপদেবতা এসে বাসা বেঁধেছে, উনি পুজোআচ্চা করে সেই দেবতা তাড়াবেন৷’

বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন গোস্বামী, ‘কবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দরজা খোলা হবে?’

‘দিন তিনেক আগে৷’

‘খোলা হবে সেকথা তখন থেকেই সবাই জানত?’

‘আমরা অত কানে ধরে জানাতে যাইনি কাউকে, তবে খবর রটে যায়৷’

ঘের বারান্দার নিচে ঠাকুর দালানটা এখন ফাঁকা পড়ে আছে৷ গোটা বাড়ির পেটের ভিতর ছোটছোট ঘরগুলো থেকে গুঞ্জনের শব্দ ভেসে আছে৷ সেটা শুনতে শুনতে প্রসঙ্গ বদলান গোস্বামী, ‘আপনাদের নতুন কোনও গেস্ট এসেছে এর মধ্যে? নতুন কোনও সদস্য?’

সুবীর মুখ তোলেন, ‘নতুন বলতে আমার মেয়ে, ও কলকাতায় থাকে, ছুটিতে বেড়াতে এসেছে এক বান্ধবীকে নিয়ে৷’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকেন ইন্সপেক্টর, কিছু একটা ভাবনায় ডুবে যান, শেষে মুখ তুলে বলেন, ‘কাল রাত থেকে আমরা মন্দিরের চারপাশটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি৷ ভেবেছিলাম কোথাও একটা ফাটল কি ভাঙাচোরা একটা খাঁজ থাকবে, বাট নাথিং৷ একটা ফুটো পর্যন্ত নেই৷ এমন অদ্ভুত, অলৌকিক খুন আমি এর আগে দেখিনি৷ আপনারা কেউ ধারণা দিতে পারেন কিছু?’

মিনিটখানেকের একটা নীরবতা গ্রাস করল বারান্দাটাকে৷ আর কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লেন গোস্বামী, উঠতে উঠতে বললেন, ‘বেশ আজ চলি, আপাতত আমাদের কাজ ছেলেটার আইডেন্টিফিকেশন৷ এর মধ্যে আপনাদের কারও আমাকে কিছু জানানোর থাকলে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন৷ সাবধানে থাকবেন সবাই, অযথা ভয় পাবেন না৷ আপনাদের ঠাকুর দালানটা একটু দেখতে চাই… কেউ একজন….’

‘হ্যাঁ আমি যাচ্ছি৷’ সুবর্ণ লাহিড়ী উঠে পড়েন৷ গোস্বামীকে নিয়ে একতলায় নেমে আসেন তিনি৷ এখানে ছোট একটা প্যাসেজ৷ সেটা ছাড়িয়ে কিছুটা এগোলেই ছোট দালানটা চোখে পড়ে৷ কাল রাতে পুলিশ আসা অবধি এখানেই রাখা ছিল মৃতদেহটা৷

‘সুবীরবাবু ছাড়া আপনারা সবাই এখানে ভাড়াটে, তাই তো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, উনি পৈতৃক সূত্রে পান বাড়িটা৷ ওনার পূর্বপুরুষ শুনেছি এ অঞ্চলের জমিদার ছিল৷’

‘বাবা! এটাই তাহলে জমিদারবাড়ি? কিন্তু প্রাসাদ-প্রাসাদ ফিলটা পাচ্ছি না যে৷’

‘পাবেনও না, মূল যে জমিদারবাড়ি ছিল সেটা গ্রামের অনেক ভিতরে৷ এ বাড়িটা সুবীরবাবুর দাদু নিজের টাকাপয়সা দিয়ে তৈরি করেন৷ বয়স মেরে কেটে একশোর বেশি হবে না৷ তাও সেকালের আর্কিটেকচার বলে জমিদারবাড়ির একটা আদল দেওয়ার চেষ্টা আছে৷ মানে ঘোড়ারও তো টাট্টু হয়, এ বাড়িটাও সেইরকম…’

‘সব মিলিয়ে কতজন থাকেন এখানে?’ দালানের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করেন গোস্বামী৷

‘এই ধরুন সুবীর ছাড়া আমি আর আমার স্ত্রী, আমার এক ছেলে সে কলকাতায় থাকে, ন-মাসে ছ-মাসে আসে, তাছাড়া ডাক্তার দেবনাথ, শ্যামাদা, আনন্দ আর ভবেন৷ ভবেন একা হাতে গোটা বাড়িটার কাজকর্ম সামলায়৷ ওকে সুবীরদাই রেখেছেন৷ আনন্দ…’

দালানের একেবারে মাঝামাঝি একটু কালচে রক্তের দাগ দেখতে পেলেন গোস্বামী৷ ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে ছেলেটির দেহ৷ তাদের বয়ান অনুযায়ী ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে গলার নলিটা৷ ছেলেটির পেটে কোনও খাবার-দাবার পাওয়া যায়নি৷ বোঝা যায় অন্তত একদিন অভুক্ত ছিল সে৷ শরীরে তেমন স্ট্রেগেলের চিহ্ন নেই৷ খুনটা হয়েছে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে৷

কথাগুলোতে আর আগ্রহ পেলেন না গোস্বামী, প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন, ‘কাল বিকেল তিনটে থেকে চারটের মধ্যে কী করছিলেন মনে আছে?’

একটু চিন্তিত দেখায় লাহিড়ীকে, ভেবেচিন্তে বলেন, ‘তাস খেলে ফিরি ধরুন ওই তিনটে নাগাদই হবে, তারপর একটু জিরিয়ে চান-টান করে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি৷ আমার আবার ওই বিকেলে একটু না ঘুমালে…’

‘তারপর আর বেরননি বাড়ি থেকে?’

‘আজ্ঞে না, পাড়ার ছেলেরা এসে ডাকাডাকি করতে একেবারে সাতটা নাগাদ মন্দিরের সামনেটায় যাই৷’

দালানের একপাশে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়েন গোস্বামী, সিঁড়ি দিয়ে ভবেনকে নেমে আসতে দেখা যায়, তার হাতে একটা ছোট প্লেট, তার উপরে দু-কাপ চা রাখা আছে৷ প্লেটটা গোস্বামীর দিকে বাড়িয়ে দেয় সে৷ তারপর সুবর্ণ লাহিড়ীর দিকে৷

ভবেন চলে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেন গোস্বামী, ‘ডেডবডিটা তো এখান অবধি তুমিই বয়ে নিয়ে আস? তাই না?’

‘আমি আর ডাক্তারবাবু, ওনার চেম্বারে একটা স্ট্রেচার থাকে, উনি আমাকে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেন৷ সবাই খুব ভয় পেয়েছিল, কেউ বডিতে হাত দিতে চাইছিল না৷ আমরা দু-জনেই ধরাধরি করে স্ট্রেচারে করে তুলে এখানে নিয়ে এসে শুইয়ে দিই… ওইটুকু ছেলের অত রক্ত, আমার গাটা কেমন করছিল, একটা চাদর এনে চাপা দিয়ে দিই… তারপর থেকে ওইভাবেই ছিল স্যার…’

‘হুম…’ চায়ে চুমুক দিয়ে মাথার উপরে খোলা আকাশের দিকে তাকান গোস্বামী৷ চোখ দুটো বুজে আসে৷ এখনও অবধি কয়েকটা প্রশ্ন খড়গের মতো ঝুলছে মাথার উপরে৷

ছেলেটা কে?

তাকে খুন করা হল কেন?

তার দেহটা খুনি যেকোনও মাঠের উপরে বা পুকুরে ফেলে আসতে পারত, তার বদলে একটা বন্ধ ঘরের ভিতরে রাখতে গেল কেন? আর রাখলই বা কেমন করে?

এবং যে রাখল, সে কে?

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়েই দালান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন গোস্বামী৷ এবং বেরোতেই একটা বছর বাইশের মেয়েকে চোখে পড়ল তার৷ মেয়েটার গায়ে একটা অ্যাকোয়া ব্লু রঙের স্ট্রেইপড টি-শার্ট আর জিনস৷ মাথার চুল এই মুহূর্তে খোলা৷ লক্ষ করলেন হাতে একটা সিগারেট জ্বলছে মেয়েটার৷ রোয়াকের একপ্রান্তে পিঠ রেখে বসে কিছু একটা ভেবে চলেছে যেন৷

ইচ্ছা করেই মাটির উপরে পা দিয়ে আওয়াজ করলেন গোস্বামী, মেয়েটা থতমত খেয়ে ট্যাপ করে ফেলল সিগারেটটা, গোস্বামীর দিকে ফিরে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, ইন্সপেক্টর হাতের ইশারা করে অভয় দিলেন তাকে, সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওটা বের করে নিন, হাতে ছ্যাঁকা লেগে যাবে৷’

লাজুক হাসে পায়েল, ‘আসলে রাতে ঘুম হয়নি ভালো, সকাল থেকে ব্যথা করছে মাথাটা৷’

‘ঘুম হয়নি কেন?’

সিগারেটটা বের করে ইতস্তত করেই একটা টান দেয় পায়েল, ‘কাল রাতে ওই গলাকাটা বডিটা দেখার পর থেকেই একটু নেমে আছি৷’

‘নেমে?’

‘মানে ওই ভয়-ভয় লাগছে আর কী…!’

‘ওঃ, আপনিই নতুন অতিথি এখানে?’

পায়েল উপরে নিচে ঘাড় নাড়ে৷

‘কবে এসেছেন?’

‘দু-দিন আগে৷ আসলে কলেজ ছুটি তো…!’

পায়েলের চোখে একবার চোখ বুলিয়ে নেন গোস্বামী৷ মুখ তুলে একটু গম্ভীর গলায় বলেন, ‘কাল রাতে দরজা খোলার আগে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছিল আপনার? মানে কারও অদ্ভুত আচরণ?’

সিগারেট থেকে ছাই ফেলে পায়েল, কব্জির উল্টোদিক দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলে, ‘গোটা ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক, এইসব যখ-টখের গল্প অ্যানাদার লেভেল অফ ওপিয়াম..’

‘সেটা বাদ দিয়ে আর কিছু?’

‘তখন ওই রক্তারক্তি দেখে একটু ভেবলে গেছিলাম, কিন্তু পরে একটা জিনিস মনে হল, জানেন?’

‘কী জিনিস?’

‘যে ছেলেটা খুন হয়েছে সে এই গরমেও ফুলহাতা জামা পরেছিল কেন বলুন তো?’

গোস্বামী ঠোঁটের ফাঁকে হাসে, ‘হুঁ, ওটা আমরাও খেয়াল করেছি৷ আর কিছু?’

কী যেন ভেবে একটু থেমে যায় পায়েল, তারপর আচমকাই সিগারেটটা ফেলে রোয়াক ছেড়ে উঠে পড়ে বলে, ‘আপনি একটু আসবেন আমার সঙ্গে? একটা জিনিস দেখানোর আছে৷’

এই প্রথম একটু থতমত খান ইন্সপেক্টর৷ কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সাধারণত পুলিশ দেখলে একটু ঘাবড়ে যায়৷ ভেবেছিলেন মেয়েটা কোনওরকমে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দায় সারবে৷ সময় নিয়ে বলেন, ‘বেশ, চলুন৷’

বাড়ি থেকে মন্দিরটা বেশ কিছুটা দূরে৷ মাঝে অনেকটা ঝোপঝাড় পেরিয়ে এদিকটায় আসতে হয়৷ মন্দির থেকে খানিকটা আগে একটা পুকুরের সীমারেখা শুরু হচ্ছে৷ পুকুরের ধার থেকেই ছোট গাছপালার একটা জঙ্গল৷ পুকুর আর জঙ্গলের মাঝে মিটারদেড়েক চওড়া মাটির রাস্তা ধরে হাঁটলে মন্দিরটা দেখা যায়৷

এখন সেটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা দু-জনে৷ মন্দিরের সামনে একসময় সিমেন্টের একটা চাতাল ছিল৷ এখন তার প্রায় পুরোটাই উঠে গেছে৷ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো কালীমন্দিরটা৷ এখন তার দরজা খোলা৷

উর্দিধারী কয়েকজন লোক ঘুরে দেখছে জায়গাটা৷ বাড়ির লোকজনকে আপাতত আসতে দেওয়া হচ্ছে না এদিকটায়৷ পায়েলের সঙ্গে গোস্বামীকে দেখে আর বাধা দিল না তারা৷

মাটির দিকে নির্দেশ করে পায়েল, ‘আমি কাল সকালেও দেখেছি মন্দিরটাকে ঘিরে হাঁটু অবধি ঝোপঝাড় ছিল, সকালেই লোক লাগিয়ে সাফ করা হয়েছে৷’

চারদিকটা দেখতে থাকে সে৷ কয়েক জায়গায় এখন মাটির উপর পুলিশের খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন, সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনারা কি ভেবেছেন খুনি মাটির তলায় সুড়ঙ্গ কেটে ভিতরে পৌঁছেছে?’

‘এই খুনটা আমাদের ভাবনাচিন্তার বাইরে ম্যাডাম৷ কোনও স্টোনই আনটার্নড রাখা হচ্ছে না৷’

‘তা পেলেন কিছু? সুড়ঙ্গ? হিডেন প্যাসেজ? স্লাইডিং প্যানেল?’

‘নাঃ, কিচ্ছু না৷ সব নিরেট সিমেন্ট, আর কিচ্ছু নেই৷’

‘হুম…’

মন্দিরের দরজার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে যায় পায়েল, গোস্বামী জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি বলছিলেন অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখেছেন৷’

‘একটা না, দুটো৷ তার মধ্যে প্রথমটা আমার পুরোপুরি মনে পড়ছে না৷’

‘মনে পড়ছে না মানে?’

পায়েল কপালে হাত ঘষতে ঘষতে বলে, ‘কাল রাতে ডেডবডিটা আবিষ্কার হওয়ার ঠিক আগে কিছু একটা ভাবনা মাথায় আসে আমার৷ পায়ের ছাপ নিয়ে কিছু একটা অসঙ্গতি…’

‘কেমন অসঙ্গতি?’

‘সেটাই আর এখন মনে পড়ছে না…’ পায়েলের গলায় আফসোস ঝরে পড়ে, ‘আসলে ডেডবডিটা দেখে মাথাটা এমন বসে গেল যে তার পর থেকেই সব গুলিয়ে গেছে৷ রাতে যখন শুতে যাই তখন আবার খেয়াল হয় ব্যাপারটা৷ কিন্তু ওই পায়ের ছাপ ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ে না…’

পা চালিয়ে মন্দিরের দরজার ভিতরে ঢুকে আসে ওরা৷ এখন দিনের আলোয় গোটা ঘরটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে৷ ঘরের দু-কোণে দুটো হ্যারিকেনও জ্বালা রয়েছে৷ তার আলো এসে পড়েছে চারদিকের দেওয়ালে৷

বাইরে থেকে যতটা মনে হয় ঘরটা তার তুলনায় বেশ বড়৷ চারকোনা, কোথাও কোনও আসবাব বা জঞ্জালের স্তূপ কিছু নেই৷ মেঝেটা সিমেন্টের৷ তার উপরে লাল রং করা৷ ঘরের একদিকের দেওয়ালের গায়ে অল্প একটু চাঙড় উঠে গেছে৷ বোঝা যায় সেখানে কয়েকশো বছর আগে বিগ্রহ ছিল৷

পায়েলকে তার উপর হাত বোলাতে দেখে গোস্বামী চাপা হাসি হেসে বলেন, ‘ওটার সঙ্গে বাকি দেওয়ালের পার্থক্য নেই কিছু৷ দরজা সিল করা থাকলে এ ঘরে চামচিকে অবধি ঢুকতে পারবে না৷ একটা গোটা মানুষ তো দূরের কথা৷’

‘এ ঘরে একটা নয়, দুটো মানুষ ঢুকেছিল৷’ পিছন ফিরে উঠে দাঁড়ায় পায়েল, ‘খুনটা যদি বাইরে হয়ে থাকে তাহলে ডেডবডি নিজে নিজে ঘরে ঢুকতে পারে না৷ কেউ তাকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে এবং তাকে রেখে বেরিয়ে যায়৷ আর যদি ভিতরে খুন হয় তাহলে দুটো মানুষ কোনওভাবে এই ঘরে ঢুকেছিল৷ যাদের মধ্যে একজন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়৷’

‘খুন ঘরের ভিতরেই হয়েছে৷’ দৃঢ় গলায় বলেন ইন্সপেক্টর গোস্বামী, ‘বডি ঘরের প্রায় মাঝামাঝি পড়েছিল৷ গলা কেটে যাকে খুন করা হয়েছে তাকে নিয়ে বেশি নড়াচড়া করতে গেলে মাটিতে রক্তের দাগ পড়বে, অথচ ছেলেটার গলার আশপাশে ছাড়া অন্য জায়গায় রক্ত ছিল না৷ সে যাই হোক, প্রশ্নটা রয়েই যায়৷ যে ঘর আজ পঞ্চাশ বছর হল খোলা হয়নি সেখানে দুটো মানুষ এসে ঢুকল কী করে?’

পায়েল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় বাইরে থেকে ঝগড়াঝাঁটির শব্দ ভেসে আসতে দু-জনেই তড়িঘড়ি বাইরে বেরিয়ে এল৷

পুরোহিত শ্যামাপদকে চোখে পড়ল৷ মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে চাইছেন তিনি! পুলিশের লোক বাধা দেওয়ায় রুষ্ট হয়েছেন৷

‘কী হয়েছে এখানে?’ গোস্বামী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন৷

‘উনি বলছেন ঘরের ভিতর কীসব পুজো-টুজো করবেন৷’ হাবিলদার বিরক্ত গলায় বলে ওঠে৷

‘আমি তো বলছি, আপনারা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকুন, আমি একটু ফুল বেলপাতা দিয়েই চলে যাব৷ মানুষের রক্ত পড়েছে ঘরটায়…!’

‘ওনাকে যেতে দাও…’ হাবিলদারকে নির্দেশ দিলেন গোস্বামী, তারপর শ্যামাপদর দিকে ফিরে বললেন, ‘আজ বিকেলে আমি আসব একবার৷ আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে৷ সময় হবে তো?’

ঘাড় নাড়েন শ্যামাপদ৷ তারপর এগিয়ে যান মন্দিরের ভিতরে৷ একটু যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন ভদ্রলোক৷ ইন্সপেক্টর গলা তুলে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি পড়ে গেছিলেন কোথাও?’

প্রশ্নটা কানে যায় না তার৷ খোঁড়াতে খোঁড়াতেই মন্দিরের ভিতরে ঢুকে যান৷

গোস্বামী পায়েলের দিকে ফিরে বলেন, ‘আর দ্বিতীয়টা?’

‘কিসের দ্বিতীয়?’ শ্যামাপদর পায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল পায়েল৷

‘ওই যে বললেন, দুটো অস্বাভাবিক ব্যাপার চোখে পড়েছে আপনার৷ প্রথমটা তো পায়ের ছাপ, দ্বিতীয়টা?’

‘মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ৷’ চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে পায়েল৷

‘কার?’

‘সবার…’ থেমে থেমে উচ্চারণ করে পায়েল, ‘এত সহজ একটা ব্যাপার সবার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিল অথচ কেউ খেয়াল করল না! এটা অস্বাভাবিক নয়?’

‘কী ব্যাপার?’

টুং-টুং করে পায়েলের ফোনটা বেজে ওঠে৷ সেটা ধরতে ধরতে বলে, ‘আপাতত মনে করুন আমি কিছু বলিনি, বিকেলে আবার আসবেন তো, তখন কথা হবে, এখন আসি৷’

তাড়াহুড়ো করে পিছনের পথে পা বাড়ায় পায়েল৷ গোস্বামী মনে মনে একটা ব্যাপার বুঝতে পারেন৷ এ মেয়ের জীবনে এই প্রথম খুন নয়৷ এর আগেও সে রক্ত দেখেছে৷ হয়তো অন্য কোথাও…

(তিন)

দুটো নাগাদ স্নান করে বেরিয়ে কলির মনে হল বাড়িটা সকালের থেকে একটু শান্ত হয়েছে৷ পুলিশের দৌরাত্ম্য খানিক কমেছে৷ সারা সকাল যে গুনগুন আওয়াজটা ভেসে আসছিল ঘরগুলো থেকে সেটা আপাতত থেমে গেছে৷ চুল আঁচড়ে ঘরে ঢুকে বাবাকে দেখতে পেল সে৷ বিছানার একপ্রান্তে পিঠ এলিয়ে সকালের কাগজটা নিয়ে কিছু একটা পড়ছেন মন দিয়ে৷ কলি ঘরে এসে ঢুকতে কাগজটা মুড়ে পাশে রেখে দিলেন তিনি, মুখ নামিয়ে বললেন, ‘খবরটা ছোট করে বেরিয়েছে৷ ডিটেলে লেখার সময় পায়নি৷’

‘কই দেখি…’ কাগজটা তুলে খবরটা খুঁজে নিয়ে পড়তে থাকে কলি, গ্রাম আর বাড়ির নামটা বেরিয়েছে৷ যদিও খবরটা এমন চকের গুঁড়োর মতো করে লেখা যে কারও চোখ আটকাবে না৷

‘তোর কথা ভেবেই খারাপ লাগছে৷’ থমথমে গলায় বলেন সুবীর চৌধুরী৷

‘আমার আবার কী হল?’

‘এই নিয়ে যদি বেশি মাতামাতি হয় কলেজে গিয়ে তোর মুখ দেখানো দুষ্কর হবে, এই বাড়িতে একটা খুন হয়ে গেছে….’

‘তোমার কোনও আইডিয়া নেই বাড়িতে একটা খুন হওয়া কতটা গ্ল্যামারাস, তার উপরে এমনি খুন নয়, লকড রুম মিস্ট্রে!’

‘সেটা আবার কী?’

‘মানে ওই যেধরনের খুনে বোঝা যায় না খুনটা কীভাবে হয়েছে৷

একটু বিরক্তই হন সুবীর, কাগজটা আবার তুলে নিয়ে সামনের পাতার বড় খবরে চোখ রেখে বলেন, ‘সে যে মিস্ট্রেই হোক, এসবের মধ্যে মাথা গলাতে যাস না৷ আর একা একা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো একদম না৷’

কলি ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে বেরতে যাচ্ছিল৷ কী মনে পড়তে থেমে যায়, ‘আচ্ছা বাবা, আমাদের পুরনো ফোটো অ্যালবামগুলো কোথায় আছে বলো তো?’

‘তোর মায়ের ঘরের ড্রয়ারে আছে৷ কী হবে?’

‘পায়েলকে আমার ছোটবেলার ছবি দেখাতাম৷’

‘ওঃ, ড্রয়ারে চাবি দেওয়া নেই৷ নিয়ে যা৷ হারিয়ে ফেলিস না কিন্তু, আমার কাছে নেগেটিভ নেই, বহু পুরনো ছবি সব৷’

ছুটে মায়ের ঘরে গিয়ে ড্রয়ারটা খুলে ধরে কলি৷ মায়ের ঘরটা এ বাড়ির বেশ ভিতরের দিকে৷ কলির যখন ন-বছর বয়স তখন মা মারা যায়৷ সেই থেকে ঘরটা এমন সাজিয়ে গুছিয়েই রাখা থাকে৷ দেওয়াল জুড়ে মহিলার একটা বুক অবধি ছবি টাঙানো আছে৷ সেটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনটে অ্যালবাম বের করে নেয় কলি৷

মোটা চামড়ায় বাঁধানো শক্তপোক্ত অ্যালবাম৷ ফিতে দিয়ে প্লাস করে বাঁধা৷ একসাথে ওজন কেজিপাঁচেকের কম নয়৷ সেগুলো হাতে ধরে গেস্টরুমের দিকে হাঁটা দেয় কলি৷

বিছানার উপরে বসে জানলা দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছিল পায়েল৷ এতটাই মগ্ন হয়েছিল যে কলি ভারী অ্যালবামটা বিছানার উপরে রাখতেও শব্দটা কানে যায় না তার৷ একটু খটকা লাগে কলির৷ এত মন দিয়ে কী দেখছে মেয়েটা৷ সে কাছে গিয়ে পায়েলের পিঠে একটা টোকা দেয়, ‘কী দেখছিস রে?’

পিছন ফিরে একগাল হাসে পায়েল, খোলা জানলাটা নির্দেশ করে বলে, ‘এখান থেকে আগে কালীমন্দিরটা দেখা যেত৷ এখন আর দেখা যায় না, দেখ…’

জানলা দিয়ে তাকিয়ে কলি বুঝতে পারে ব্যাপারটা৷ গেস্টরুমের জানলা থেকে সোজা তাকালে মন্দিরের চুড়োটা চোখে পড়ে বটে কিন্তু বাকিটা ঢাকা পড়ে যায় দুটো পাশাপাশি গজিয়ে ওঠা সবেদা গাছের ডালপালায়৷

‘তুই আমাকে একটু বলতে পারবি এ বাড়ির কোন কোন ঘর থেকে কালীমন্দিরটা স্পষ্ট দেখা যায়?’

কলি অল্প হাসে, ‘আমিও তোর মতো এখানে নতুন৷’ একটু থেমে বলে, মায়ের ঘর থেকে দেখা যায়৷’

‘মায়ের…’ কথাটা বলতে ইতস্তত করে পায়েল৷

‘হ্যাঁ, আগের মতো সাজিয়ে রাখা আছে, ঘরটায় খুব একটা কেউ যায় না৷’

‘কাল সকাল থেকে গেছিলি ঘরটায়?’

‘হ্যাঁ… একবার গেছিলাম, জানলাটা বন্ধ ছিল৷’

‘খোলার চেষ্টা করিসনি?’

‘করেছিলাম…’ ভেবে বলে কলি, ‘কিন্তু খোলেনি৷’

‘কেন?’

‘বুঝিসই তো, পুরনো কাঠের জানলা৷ খুব একটা খোলাটোলা হয় না৷ কলকব্জা কোথাও আটকে গেছে হয়তো৷’

‘হুম…’ কিছু একটা ভাবনার মধ্যে ডুবে যায় পায়েল৷ ভুরু দুটো অসম্ভব রকম কুঁচকে আছে তার৷ জানলা দিয়ে আসা আলো তার মুখ আর চুলের একপাশে এসে পড়েছে৷ নরম চামড়ার উপর একটা সোনালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা৷

‘অ্যালবাম দেখতে চেয়েছিলি, এই যে…’ টেবিলের উপরে রাখা অ্যালবামগুলো পায়েলের সামনে এগিয়ে দেয় কলি৷

মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে অ্যালবামগুলোর দিকে মন দেয় পায়েল, মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘ক্রোনোলজিক্যালি আছে তো?’

‘হ্যাঁ৷ একদম প্রথম ছবিটা হাতে আঁকা, দেড়শো বছর আগের…’

কয়েকটা পাতা উল্টে থেমে যায় পায়েল, বলে, ‘পঞ্চাশ বছর আগে যখন কালীমন্দিরটা খোলা হয় তখন কোনও ছবি তোলা হয়নি? মানে সেসময়ে তো বেশ বড় একটা ইভেন্ট হবার কথা৷ ট্রেজার হান্ট বলে কথা৷’

‘নাইন্টিন সিক্সটি ফাইভ…’ কলি দ্বিতীয় অ্যালবামটা তুলে নিয়ে বিশেষ একটা জায়গা খুলে এগিয়ে দেয় পায়েলের দিকে, ‘এই যে, পেয়েছি… পঞ্চাশ বছর আগের কালীমন্দির৷

অ্যালবামের খোলা পাতাটা রোদে ধরে ভালো করে দেখতে থাকে পায়েল! ছবিটা তোলা হয়েছে মন্দিরের সামনে থেকে৷ এই পঞ্চাশ বছরে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি৷ তবে জায়গাটায় ঝোপঝাড়ের পরিমাণ আর একটু কম৷ কয়েকটা পাথর বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে চারিদিকে, মন্দিরের একেবারে মাথায় একটা পতাকা উড়ছে৷ কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে পায়েল৷ তার চোখের মণিদুটো অস্থির হয়ে উঠেছে৷

‘তোর কিছু গোলমাল চোখে পড়ছে?’ কলির দিকে ফিরে অসহায় হয়ে প্রশ্ন করে সে৷

‘কীসের গোলমাল?’ বিছানা ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে থাকে পায়েল৷ একটা চাপা অস্থিরতা এসে গ্রাস করছে তাকে, একটানা বলে যেতে থাকে সে, ‘ইয়েস, গোলমাল, পঞ্চাশ বছর আগের এই মন্দিরটার সঙ্গে আমাদের কালকে রাতে দেখা মন্দিরটার একটা বিরাট বড় পার্থক্য আছে৷ কী সেটা?’

‘আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না৷ তবে মন্দিরের মাথায় পতাকাটা নেই৷’ ছবিটা দেখতে দেখতে বলে কলি৷

পিঠের উপরে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে বেঁধে নেয় পায়েল, ‘নাঃ, ডেডবডিটা দেখার পর থেকে মাথাটা কাজ করছে না একদম৷ চল একটু বেরোই৷’

‘কোথায় যাবি এই দুপুরে? তাছাড়া বাবা একা কোথাও যেতে বারণ করেছে৷’

‘একা কোথায়? আমি আছি তো৷’

কলি মুখ বেঁকায়, ‘আহা, তোর ওজন ছেচল্লিশ আমার চুয়াল্লিশ, দু-জনে মিলে একটা মানুষের সমানই হয়৷’

‘আচ্ছা বেশ, বাইরে যাব না৷ বাড়ির ভিতরটাই তো একটু ঘুরে দেখা যায়….’

আর আপত্তি করে না কলি৷ দু-জনে মিলে বাইরে বেরিয়ে আসে৷

কলিদের বাড়িটা তিনতলা৷ তবে প্রস্থে বেশ বড়সড়৷ তিনটে তলা মিলে মোট বারোটা ঘর৷ বাইরে থেকে দেখলে পুরনো দিনের বনেদি বাড়ি বলে মনে হয়৷ দুর্গাপুজো হয় এখানে৷ এখন অবশ্য শরৎ নয়, তাও ফাঁকা ঠাকুরদালানটায় চোখ যেতে পায়েলের মনের ভিতর ঢাকের বোল বেজে উঠল৷

‘এ বাড়ির ভাড়াটেরা সবাই পুরনো, তাই না?’ দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করে পায়েল৷

‘আমি তো জন্ম থেকেই দেখে আসছি৷ পুরোহিতমশাই বিয়ে-টিয়ে করেননি, উনি থাকেন দোতলায়৷ ওনার পাশের রুমেই ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন লাহিড়ী আঙ্কেল৷ গ্রামে জমিজমা আছে, সেসবই দেখাশোনা করেন, ধুরন্ধর লোক৷ ডাক্তারকাকার ঘর আর চেম্বার দুটোই একতলায়৷ গ্রামে জনাতিনেক ডাক্তার আছে, তার মধ্যে কাকার নামডাকই বেশি৷ আলাদা একটা চেম্বার খুলবেন বলছিলেন একবার তারপর কিছু কারণে আর খোলা হয়নি৷ আনন্দদা এখানেই একটা কারখানায় কাজ করে, বিয়ে হবে বলে শুনেছিলাম একসময়, তারপর কেন করেনি জানি না৷’

‘এরা সবাই ভাড়াটে?’

‘পুরোহিতমশাই নন৷ ওনার পূর্বপুরুষ নাকি এ বাড়ির কুলপুরোহিত ছিলেন৷ বাড়ির পুজোআচ্চার ব্যাপারটা উনিই সামলান৷ ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই, তাছাড়া এই বয়সে যাবেনই বা কোথায়, বাবা ওর থেকে টাকা নেন না৷’

‘বেশ, তিনজন হল, আর?’

‘আর ভবেনদা…’ কী যেন ভেবে একটু উদাস হয় কলি, ‘ভবেনের ব্যাপারটা নিয়ে একটু সমস্যা আছে বুঝলি৷ ছোট থেকে শুনে আসছি ও নাকি পুরোহিত মশাইয়ের বিধবা বোনের ছেলে৷ ওনার সঙ্গেই একবার এ বাড়িতে চলে আসে, আর ফেরত যায়নি, বাবা ওকে কাজে লাগিয়ে দেন৷ বড় হয়ে বুঝেছি অন্য কিছু ব্যাপার আছে৷’ চোখ টিপে বলে, ‘ফ্যামিলি সিক্রেট আর কী…’

সামনে তাকিয়ে ওরা থেমে যায়৷ ওরা যে প্যাসেজটা দিয়ে হাঁটছে তার ঠিক উল্টোমুখ থেকে হেঁটে আসছে আনন্দ৷ ওদের দেখতে পেয়ে একটা মিহি হাসি খেলে যায় তার মুখে, কলি হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

আনন্দ কাঁধ ঝাঁকায়, ‘আর বলো কেন, বড় মায়ের ঘরের জানলাটা কিছুতেই খুলছে না, বড়দা বললেন কাঠমিস্ত্রি ডেকে আনতে?’

‘তার মানে কাল তুই ছাড়া আরও কেউ খোলার চেষ্টা করেছিল ওটা৷’ বিড়বিড় করে বলে পায়েল, তারপর গলা তুলে বলে, ‘আমি একবার চেষ্টা করে দেখব?’

‘কী চেষ্টা করবে?’ আনন্দ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে৷

‘জানলাটা খোলার৷’

‘না না, ও জানলা ঠেলাঠেলি করেও খোলেনি কাল৷ মানুষের হাতের কম্ম নয়৷’

‘একবার চেষ্টা করতে দোষ কী, ঘরটা আমাকে দেখিয়ে দে তো কলি৷’

মিনিটখানেক পর বাইরের বারান্দা পেরিয়ে কলির মায়ের ঘরে এসে পড়ে ওরা তিনজনে! সুবীর চৌধুরী এখন তার চেয়ারে বসে নেই৷ কাগজটা টেবিলের উপরেই রাখা আছে৷

আনন্দই আগে এসে দাঁড়ায় জানলাটার সামনে৷ শক্ত হাতে দু-বার ধাক্কা মারে জানলার পাল্লায়, মচমচ করে আওয়াজ হয় বটে, কিন্তু খোলে না, ‘দেখ, এ একেবারে জ্যাম হয়ে গেছে৷’

মাথার চুল থেকে একটা ক্লিপ খুলে নেয় পায়েল৷ তারপর মেঝের উপর হাঁটু রেখে বসে চোখ রাখে জানলার নিচের সরু ফাঁক হয়ে থাকা প্যানেলে৷ ক্লিপটা সেখানে ঢুকিয়ে খানিক খোঁচাখুঁচি করে৷ তারপর আচমকাই সজোরে একটা ধাক্কা মেরে খুলে ফেলে জানলাটা৷ আনন্দ আর কলি হতবাক হয়ে তাকায় তার দিকে৷ সে হেসে বলে, ‘একটা কাঠপিঁপড়ের মতো ছোট ইটের টুকরো আটকে ছিল ফ্রেমের নিচে, তাই খুলছিল না৷’

আনন্দর গলায় কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে, যাক, সকালের খাটনিটা বেঁচে গেল আমার৷ কাঠমিস্ত্রির বাড়ি সেই মেলা দূর…

‘আচ্ছা আনন্দদা, তুমি যখের ব্যপারটা বিশ্বাস করো?’

পায়েলের আচমকা প্রশ্নটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না আনন্দ, সে একটু থতমত খেয়ে বলে ‘ঠিক করি না৷ তবে…’

‘তবে কী?’

পরের কথাগুলো বলতে গিয়ে আনন্দের গলা বেশ কয়েকবার কেঁপে যায়, ‘এই দিনতিনেক আগে কারখানা থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল, বারোটা কি একটা হবে৷ পুকুরের পাশের রাস্তাটা দিয়ে আসতে গিয়ে দেখি একটা বুনোলতার ঝোপ একটু নড়ছে, হাওয়ায় নয়, ঠিক যেন, মানুষে নাড়াচ্ছে৷’

‘সেতো চোখের ভুলও হতে পারে৷’

‘উঁহু…’ আনন্দ ভেবে বলে, ‘একদিন হলে হত, পরপর দু-দিন একই কাণ্ড হয়৷ আমি ঝোপের দিকে এগোলেই নড়া থেমে যায়৷ ঠিক যেন আমাকে আসতে দেখে কেউ সরে গেল ওখান থেকে৷ যখ কি না জানি না, কিন্তু কিছু একটা আছে এখানে৷’

‘স্পুকি…’ বিড়বিড় করে বলে পায়েল৷

‘তোমরা একটু সাবধানে থেকো দিদি৷’ থমথমে গলায় কথাগুলো বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আনন্দ৷ কলি একটু চাপা গলায় বলে, ‘আনন্দদা যা বলছে একেবারে খোলা মনে বিশ্বাস করিস না, ছেলেটার মনটা ভালো কিন্তু ওর একটা হিস্ট্রে আছে৷’

‘কেমন হিস্ট্রে?’

‘ছোটবেলায় অভাবের সংসার ছিল, চোখের সামনে নিজের মাকে খুন হতে দেখে, তারপর থেকে নাকি হ্যালুসিনেট করত খুব৷ স্ক্রিতজোফ্রেনিয়া টাইপের হয়ে গেছিল৷ তবে সেটা যে এখনও আছে তা জানতাম না৷’

‘হুম…’ কিছু একটা চিন্তায় ডুবে গেছে পায়েল৷

কলি জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কালীমন্দিরটা, সে পায়েলের মুখের দিকে চায়, ‘তুই কী করে জানলি পাল্লাটায় ইটের টুকরো আটকে গেছে?’

পায়েল মাথা নাড়ে, ‘জানতাম না, এটুকু শুধু জানতাম এই জানলাটা কেউ ভিতর থেকে জ্যাম করে দিয়েছে, নিজে থেকে হয়নি৷’

‘কিন্তু কালীমন্দিরে তো যে কেউ যখন খুশি যেতে পারে, বাড়ির একটা জানলা ঢেকে কী লাভ হবে?’

বাইরেটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে একটা সিগারেট ধরায় পায়েল, খোলা জানলা দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলে, ‘পৃথিবীতে যত সমস্যা আছে তার প্রায় সবকটাই একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সমাধান হয়ে যায়৷ কালকের ঘটনায় সেই দৃষ্টিকোণটা হল এই জানলাটা৷ খুনি সেটাকেই আটকে দিতে চেয়েছিল৷’

বিস্ময়ের ভাবটা কেটে একটা হতাশা এসে জমা হয় কলির মুখে, ‘এখন আর জানলা দিয়ে তাকিয়ে কী লাভ, আর তো কিছু বোঝা যাবে না৷’

পায়েল মুখ তুলে একটা চাপা হাসি হাসে, ‘কে বলেছে? এই জানলাটা থেকে একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে৷’

‘কী ব্যাপার?’

‘এ খুনটা করেছে এই বাড়ির কেউ৷ টু বি মোর প্রিসাইস, এমন কেউ যে মাঝে মধ্যেই এই ঘরে আসে৷’

আতঙ্কের ছায়া ঘনিয়ে আসে কলির মুখে, গায়ে একটা শিরশিরানি হাওয়া এসে লাগে তার৷ সেটা লক্ষ করে তার কাঁধে একটা হাত রাখে পায়েল, ‘লিসেন বাডি, ভয়ের কিছু নেই৷ আমরা জানি খুনটা বাড়ির কেউ করেছে৷ কিন্তু পুলিশ জানে না৷ ওদের চোখে জাস্ট একটা বন্ধ ঘরের ভিতরে একটা মার্ডার হয়েছে, যেটা দুর্ভাগ্যবশত এই বাড়ির পাশে৷ বাড়ির লোকজনকে বেশি ঘাঁটাবে না ওরা৷ কিন্তু কাল বিকেল তিনটে থেকে চারটের মধ্যে কে কোথায় ছিল সেটা জানতে চাইবে, কে কী বলল সেটা খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাতে পারবি?’

কলি মাথা নাড়ে, ‘একটু কাঠখড় পোড়াতে হবে৷ তাও পারব৷’

‘বেশ, আর ওই সময়ের মধ্যে কারা কারা মন্দিরের দিকে গেছিল সেটাও জানা দরকার৷’

‘ওটা চাপ হবে না৷ ভবেনদা বাইরেই বসে ছিল৷ জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে৷’

‘আর একটা কথা৷’

‘কী?’

‘পুরোহিত মশাই আজ সকাল থেকে খোঁড়াচ্ছেন, একটু জিজ্ঞেস করিস তো কী হয়েছে পায়ে?’

(চার)

‘তিনটে থেকে চারটে?’ ডাক্তার উপল দেবনাথকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়, সামলে নিয়ে বলেন, ‘মনে হয় রোগী দেখছিলাম৷’

সামনে রাখা সাদা পাতার উপরে একটা আঁক কাটেন গোস্বামী, গালে হাত ঘষতে ঘষতে বলেন, ‘একবারও ওঠেননি মাঝখানে?’

কয়েক সেকেন্ড সময় নেন ডাক্তার, ‘বাথরুমে গেছিলাম দু-তিনবার, সেটা যদি ধরেন…’

‘কত সময় লেগেছিল?’

উপল দেবনাথের গম্ভীর মুখে একটু হাসি ফোটে, ‘টয়লেট করতে গেছিলাম স্যার৷ ওই যতক্ষণ লাগে৷ দু-তিন মিনিট৷’

‘বেশ, কাল কতজন রোগী দেখেন মোট?’

‘আমার চেম্বার ওই ধরুন বারোটা থেকে ন-টা অবধি খোলা থাকে৷ কাল মন্দিরের দরজা খোলার ব্যাপারটা ছিল বলে আটটায় বন্ধ করে দিই৷ তার মধ্যে না হলেও জনা পঞ্চাশেক দেখেছি৷’

‘তারপর?’

‘তারপর উঠে ভবেনের সঙ্গে কালীমন্দিরের দিকে যাই৷’

একটু সময় নিয়ে পরের প্রশ্নটা করেন গোস্বামী, ‘তিনটে থেকে চারটের মধ্যে যেসব রোগী আপনার চেম্বারে এসেছিলেন তাঁদের নাম আছে আপনার কাছে৷’

‘ভবেনের কাছে থাকবে স্যার৷ রেজিস্ট্রে খাতা ওই সামলায়৷’

চেয়ারের ভিতরে আরও কিছুটা ঢুকে বসেন গোস্বামী, হাতদুটোকে ভাঁজ করে থুতনির সামনে নিয়ে আসেন, ‘ডেডবডিটা দেখার পর কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি?’

এই প্রথম একটু উদ্বিগ্ন দেখায় ডাক্তারকে, তার গলকণ্ঠটা একবার ওঠানামা করে, চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলেন, ‘ছেলেটাকে ওইভাবে রেখে কেউ আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল৷’

‘মানে?’ গোস্বামীর ভুরুটা কুঁচকে যায়৷

ডাক্তার আরও গলা নামিয়ে বলেন, ‘শ্যামাদার মুখে গল্প শুনেছি বাইরের কেউ যখের ধন খুঁজতে এলে যখেরা তাকে গলা কেটে খুন করে দেহটা ইংরেজি ক্রসের মতো ছড়িয়ে রাখে৷ মানে দুটো হাত আর দুটো পা দু-দিকে ছড়িয়ে৷ ওটাই নাকি ওদের ওয়ার্নিং—এখানে এসো না, এলে এই অবস্থা হবে৷ আমরা সবাই ছোট থেকে এসব গল্প শুনে আসছি৷ তাই ছেলেটাকে ওই বিশেষ ভঙ্গিতে দেখেই প্রথমে ভয় পেয়ে যাই৷’

‘আপনাদের ভয় আর শক ফ্যাক্টরটাকে কাজে লাগাতে চেয়েছে খুনি? তাই তো?’ বিড়বিড় করে বলেন গোস্বামী৷ কয়েক সেকেন্ড সেইভাবেই চুপ করে বসে থাকেন৷ মাথা তুলে বলেন, ‘বেশ, আপাতত আর কিছু জানার নেই৷ পরে দরকার পড়লে আবার বিরক্ত করব না হয়৷’

ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে গুম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন গোস্বামী৷ এতক্ষণে বিকেল নামতে চলেছে৷ একটা গোটা দিন পার হয়ে যাচ্ছে প্রায়৷ অথচ পুলিশ রুটিন প্রোটোকলের বাইরে একপাও এগোতে পারেনি৷ কোনওভাবে যদি ধরেও নেওয়া যায় ছেলেটা মাধবচন্দ্রের লুকানো ধনসম্পত্তির গল্প শুনে ঘরের ভিতরে ঢুকেছিল, তাহলেও বাইরে সিল করা দরজা দিয়ে সে ঢুকল কেমন করে? এবং আর একটা আস্ত মানুষ সেই ঘরে ঢুকে তাকে খুন করেই বা চলে গেল কী করে? তবে কি কিছুক্ষণের জন্যে ঘরের দরজা খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেছে? কিন্তু তাই বা কী করে হয়৷ পুলিশের তদন্তকারী টিম নিশ্চিতভাবে জানিয়েছে ওই সিল পঞ্চাশ বছরে খোলা হয়নি৷ মন্দিরের কোথাও কোনও হিডেন প্যাসেজ নেই৷ তাহলে?

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হেঁটে এসে আবার মন্দিরের দিকে তাকান গোস্বামী৷ পুকুরপাড়টা চোখে পড়ে তাঁর৷ পুকুরের ঘাটে একটা লোক বসে আছে৷ তাকে ঘিরে দু-দিকে দুটো অল্পবয়সি মেয়ে৷ কাছে এগিয়ে লোকটাকে চিনতে পারেন, পুরোহিত শ্যামাপদ চক্রবর্তী৷ সতর্ক চোখে ফাতনার দিকে চেয়ে আছেন শ্যামাপদ, ইন্সপেক্টরকে এগিয়ে আসতে দেখে পাশের একটা মেয়ে হালকা খোঁচা দেয় তাকে৷ অন্য মেয়েটি তার চেনা৷ সে স্মিত হাসে৷ গোস্বামী শ্যামাপদর পাশটায় বসতে বসতে বলেন,

‘সকালে দেখলাম আপনি খোঁড়াচ্ছিলেন, পড়ে গেছেন কোথাও?’

‘ওই রোয়াক থেকে নামতে গিয়ে পা হড়কে…’

‘ডাক্তার দেখিয়ে নিন, কোথা থেকে কী হয়ে যায়৷’

মিহি হাসেন শ্যামাপদ! মুখ দিয়ে অর্থহীন শব্দ করেন একটা৷ মাঝে মাঝে কয়েকটা বড়সড় মাছ পুকুরের জলে ঘাই মেরে যাচ্ছে৷ জলের কলকল শব্দ ভেসে আসছে, সেই সঙ্গে একটা ঠান্ডা জোলো হাওয়া৷ মাথাটা একটু শান্ত হয় গোস্বামীর৷

‘কাল বিকেলে কোথায় ছিলেন আপনি?’

শ্যামাপদর ছিপের ফাতনা নড়ে উঠল একবার, টান মারলেন না, ‘ঠাকুর ঘরে, পুজো করছিলাম৷’ জলের দিকে তাকিয়েই তিনি বলেন!

‘মাঝে ওঠেননি একবারও?’

দু-দিকে মাথা নাড়েন শ্যামাপদ, ‘পুজো করতে করতে উঠি না আমি৷ ওতে দেবতা রুষ্ট হন৷’

‘পুজো শেষ হয় কখন?’

‘সাড়ে সাতটায়৷’

‘তারপর মন্দিরের কাছে চলে যান?’

‘হ্যাঁ৷’

‘একা?’

‘আনন্দ আমার সঙ্গে ছিল৷’

‘আপনি যখন সেখানে পৌঁছন তখন কারা কারা ছিল সেখানে মনে আছে?’

এবার একটু সময় নেন শ্যামাপদ, ‘লাহিড়ী ছিল বলে মনে পড়ছে৷ ডাক্তার আর ভবেন তখনও আসেনি৷’ কলির দিকে দেখিয়ে বলেন, ‘ওর বাবার সঙ্গেও দেখা হয়, তবে সেটা একটু পরে৷’

‘ডেডবডিটা মনে হয় আপনিই প্রথমে দেখতে পান৷’

ছিপে একটা সটান টান মারেন শ্যামাপদ, নাঃ মাছ নেই৷ ফাতনাটা নড়েওনি, বোঝা যায় কিছু একটা কারণে উত্তেজিত হয়েছেন তিনি, এই প্রথম গোস্বামীর দিকে ঘুরে বসে ঝাঁঝালো স্বরে বলতে থাকেন, ‘সুবীরকে আমি আগেই বলেছিলাম, কৃষ্ণাদ্বাদশীতে যজ্ঞ করে অপদেবতার দোষ খণ্ডন করতে৷ তাতে মন্দিরটা খুলতেও হত না৷ কে শোনে কার কথা? এ বাড়িতে কিছুদিন হল অধর্ম হয়ে চলেছে৷ আমি জানতাম দরজা খুললে কিছু না কিছু অনিষ্ট ঘটবেই৷’

‘অধর্ম! কীরকম অধর্ম?’ প্রথম মুখ খোলে পায়েল৷

নিজের রাগটা একটু শান্ত করার চেষ্টা করেন শ্যামাপদ, ‘আজ এক সপ্তা হল আমার গোপালের গয়না চুরি হয়ে যাচ্ছে৷’

‘সেকি! সেগুলো তো প্রায় দেড়শো বছর আগেরকার!’ কলি অবাক হয়ে যায়৷

‘সে গয়না আমি সব ব্যাঙ্কের লকারে ফেলে রেখেছি প্রায় বছর পাঁচেক৷ যে গয়না ঠাকুরের গলায় পরা ছিল সেগুলো সোনার নয়৷ তার দামও বেশি নয়, তাও… ঠাকুরের গলা থেকে গয়না চুরি! ছিছিছি…

‘কখন হয় চুরিগুলো?’ আবার প্রশ্ন করে পায়েল৷ কিছু একটা কারণে তার ভুরু দুটো ভয়ানক কুঁচকে আছে৷ ‘রাতে… আমি বরাবর বারোটার মধ্যে দরজা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি৷ তিনদিন সকালে উঠে দেখেছি গোপালের গয়না নেই৷’

‘দরজা বন্ধ থাকলে চোর ঢোকে কোথা দিয়ে?’ কলি প্রশ্ন করে৷

দু-দিকে মাথা নাড়েন শ্যামাপদ, ‘জানি না৷ দরজা একবার বন্ধ করে দিলে আর বাইরে থেকে খোলা যাবে না৷ জানলা খুলে শুই বটে কিন্তু জানলায় তো গ্রিল দেওয়া৷ গ্রিলের ফাঁক ইঞ্চি চারেকের বেশি হবে না৷ তার মধ্যে দিয়ে ঢোকা জ্যান্ত মানুষের কম্ম নয়৷’

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল পায়েল, এমনসময় ওদের ঠিক পিছন দিকে ঝোপের মধ্যে থেকে একটা খসখস শব্দ ভেসে আসে৷ যেন একটা চারপেয়ে প্রাণী গাছের আড়ালে লুকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ওদের কথা শুনছিল৷ এবার অসাধানতায় শুকনো ডালের উপরে পা পড়েছে তার৷ ওরা তিনজনেই পিছন ফিরে তাকায়৷

গোস্বামীর মনে হয় একটা জমাট অন্ধকার গাছের ভিতর থেকে দ্রুত সরে গেল ভিতরের দিকে৷ ঝোপের উপরে পায়ের শব্দ হল, মুহূর্তে মিলিয়ে এল শব্দটা৷

‘কে, কে ওখানে?’ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই দ্রুত সেই দিকটা লক্ষ্য করে দৌড় দিলেন গোস্বামী, তার পিছু নিল পায়েল আর কলি৷ এই দিকটায় গাছের গুঁড়িগুলো বেশ চওড়া, কিছুদূর গিয়ে আরও ঘন হয়েছে গাছের সার৷ তার মধ্যে দিয়ে কিছুটা ছুটে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়লেন ইন্সপেক্টর গোস্বামী৷ হাঁটুর উপরে দুটো হাত রেখে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলেন তিনি৷ পায়েল আর কলি চারদিকটা দেখার চেষ্টা করল, নাঃ আর দৌড়ে লাভ নেই৷ কীসের পিছনে দৌড়াচ্ছে সেটাই জানা নেই, গাছের ফাঁক দিয়ে কেবল মাত্র পাতলা একটা অন্ধকারকে মিলিয়ে যেতে দেখেছে ওরা৷

ইন্সপেক্টর গোস্বামীর ফোনটা বেজে উঠেছে, হাঁপাতে হাঁপাতেই সেটা বের করে কানে চেপে ধরলেন, এপাশ থেকে একদিকের বয়ান শোনা গেল শুধু

—বলো সুজন…

—রিয়েলি!

—হোয়াট অ্যাবাউট হিজ প্যারেন্টস…?

চারদিকটা ভালো করে ঘুরে দেখছিল পায়েল৷ সবুজ ঘাস আর তার উপরে বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা গাছের ডাল সরিয়ে সে যেন কিছু খুঁজছে৷ কলি তার কাছে এগিয়ে এসে বলে, ‘খুঁজছিস কিছু?’

‘গন্ধ পাচ্ছিস একটা?’ পায়েলের চোখ অস্থির হয়ে উঠেছে৷

‘কীসের গন্ধ?’

‘কেরোসিনের৷’

দু-বার নাক টানে কলি৷ হ্যাঁ, খুব ক্ষীণ একটা গন্ধ আসছে৷ সেটা কেরোসিনের হতেই পারে! হঠাৎ পাশে তাকিয়ে পায়েলকে দেখতে পায় না সে৷ নিচে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়৷ মাটির উপরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কী যেন হাতে নিয়ে দেখছে মেয়েটা৷ কিছু কুড়িয়ে পেয়েছে নাকি?

উঁকি মেরে কলি দেখে পায়েলের হাতে কালচে রঙের ধুলো জাতীয় কিছু৷

ভালো করে দেখে সে বুঝতে পারে জিনিসটা আর কিছু নয়, ছাই৷

পায়েল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, ‘এখানে কিছু একটা জিনিস পুড়িয়েছিল কেউ, তারপর পোড়া ছাইটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে৷ গোটা জায়গাটা জুড়ে উড়ন্ত ছাই পড়ে আছে৷ দিস ইজ গেটিং স্পুকি৷’

ফোনটা এতক্ষণে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছেন গোস্বামী৷ তিনি মেয়েদুটোর দিকে এগিয়ে এসে বলেন, ‘তোমরা বাড়ি ফেরো তাড়াতাড়ি৷ বাকিদের ইন্টেরোগেট করার ছিল, হবে না৷ তাড়াতাড়ি থানায় যেতে হবে৷

‘কিছু হয়েছে স্যার?’ পায়েল জিজ্ঞেস করে৷

‘ছেলেটাকে আইডেন্টিফাই করা গেছে৷ সামনেই একটা বস্তিতে থাকত৷ মাথায় একটু ছিট ছিল, রাতবিরেতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনেবাদাড়ে পড়ে থাকত৷ দিন দুয়েক আগে এরকমই রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিসিং৷ বাড়ির লোক ডায়েরি করেনি৷’

‘মাথায় ছিট ছিল, তাই বোধহয় গরমকালেও ফুলহাতা জামা পরে ঘুরে বেড়াত…’ বিড়বিড় করে পায়েল৷

কথাগুলো বলতে বলতে ইন্সপেক্টরের গলার স্বর নেমে আসে, কিছুটা স্বগতোক্তির মতোই বলেন, ‘এমন অদ্ভুত খুন জীবনে দেখিনি আমি৷ কোনও মোটিভ নেই, কোনও লিড নেই, সবার স্পষ্ট এলিবাই আছে, এমনকী খুনটা করা অবধি সম্ভব নয়… অথচ খুনটা হয়ে গেল…’

‘সবার এলিবাই আছে কী করে বুঝলেন?’

কপাল থেকে ঘাম মোছেন গোস্বামী, ‘একটু আগে ভবেন বলে ছেলেটা জানিয়েছে দুপুরের পর থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাউকে বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখেনি সে৷ লাহিড়ীবাবু দুপুরে তাস খেলতে গেছিলেন, তিনটের আগেই বাড়ি ফেরেন, তারপর স্নানখাওয়া করে সাড়ে চারটে নাগাদ ঘুমোতে চলে যান, একাধিক সাক্ষী আছে ডাক্তারবাবু রোগী দেখছিলেন গোটা সময়টা৷ মাঝে মিনিট দুয়েকের জন্য বাথরুমে গেছিলেন৷ রোগীদের অবশ্য জিজ্ঞেস করা হয়নি, আর ঠাকুরমশাই তো বললেন পুজোয় বসেছিলেন৷’

‘আমার বাবা?’ কলি জিজ্ঞেস করে৷

গোস্বামীর মুখে একটা আলগা হাসি খেলে যায়, কলির মাথায় একটা হাত রেখে তিনি বলেন, ‘সেটা তুমি জিজ্ঞেস করে নিও না হয়৷ আমি খবর নিয়ে নিয়েছি৷ তবে আমার মনে হয় না সাধারণ কেউ এর সঙ্গে যুক্ত আছে বলে…’

‘আচ্ছা যে ছেলেটা খুন হয়েছে তার বাড়ির লোক কী বলছে?’

‘বাপ-মা থাকলে তো বলবে৷ অনাথ বাচ্চা৷ কাকার কাছে থাকত৷ গ্রামে খেলা-টেলা দেখিয়ে বেড়াত৷ ছোটখাটো হাত সাফাইয়ের খেল৷ একবার কোনও এক সার্কাস দলের সঙ্গে পালিয়েছিল৷ সেখান থেকেই শিখেছিল সেসব খেলা…’

‘এমন একটা ছেলেকে কার মারার দরকার পড়ল?’ নিজের মনেই বিড়বিড় করে পায়েল৷

ফেরার পথ ধরেন ইন্সপেক্টর৷ তার পিছন পিছন পায়েল আর কলিও বেরিয়ে আসে৷ শ্যামাপদ এর মধ্যে উঠে গেছেন৷ পুকুরের ধারে তাঁর ছিপটা গাঁথা আছে৷ সেটা পিছনে রেখে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে কলি বলে, আমার তো মনে হয় না খুনিকে ধরা যাবে বলে৷ খুন তো নয়, যেন স্টেজের উপর ম্যাজিক দেখছি…’

‘হুম… কিছু একটা গভীর চিন্তায় ডুবে আছে পায়েল৷

‘শুধু স্টেজের পিছনের গ্রিনরুমে কে আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না৷’

কথাটা বলে কয়েক পা এগিয়ে গেছিল কলি৷ পিছন ফিরে দেখে পায়েল থমকে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘দাঁড়িয়ে গেলি কেন রে?’

‘কী বললি তুই, আবার বল… থমথমে গলায় বলে পায়েল৷ একটা দুর্দান্ত ঝড় যেন ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তার গলায় আটকে গেছে৷

‘কী আবার বললাম,’ একটু ভেবে নেয় কলি, ‘বললাম গ্রিনরুমে কে আছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না… আরে আমি লিটারেচারের স্টুডেন্ট, একটু অ্যালিগোরি…’

‘অ্যান্ড দ্যাট অ্যালিগোরি জাস্ট সলভড দিস ক্রাইম৷’ এগিয়ে এসে কলির কাঁধটা খামচে ধরে পায়েল৷ তার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে৷ বিড়বিড় করে মন্ত্রের মতো কিছু উচ্চারণ করে চলেছে সে, ‘পায়ের ছাপ, ওই ছবিটা… সব মিলে যাচ্ছে.. ওঃ গড… কী ভীষণ চালাক!’

‘মানে! কে চালাক?’

‘যে লোকটা খুন করেছে…’ মুখ নামিয়ে বলে পায়েল৷

‘তুই জানিস কে খুন করেছে?’ কলি আঁতকে ওঠে৷

‘জানি৷’

‘কে?’

‘ম্যাজিশিয়ান…’ একটা মিহি হাসি হেসে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে পায়েল৷

(পাঁচ)

‘রাসেল সিলভার সিন্ড্রোম৷’ ছাদে হাঁটতে হাঁটতে বললেন ডাক্তার উপল দেবনাথ, জন্মগত রোগ, হাত-পায়ের বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না৷ শরীর সাংঘাতিক রোগা হয় এদের৷ তুমি যার কথা বলছ সে সম্ভবত এই রোগে ভুগছে৷ এ অঞ্চলে কারও ও রোগটা আছে বলে শুনিনি আমি৷ অবশ্য আরও দু-তিনজন ডাক্তার আছে, তবে তাদের কাছে গিয়ে লাভ নেই কিছু৷’

ভোরে উঠে ছাদে পায়চারি করাটা ডাক্তারের বহুদিনের অভ্যাস৷ দোতলায় সুবীর চৌধুরীর ঘর থেকে পুরনো বাংলা গানের সুর ভেসে আসছে৷ প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে৷ এখনও বাড়িটাকে ঘিরে কুয়াশার চাদর কাটেনি৷

‘কেন লাভ নেই?’

‘রাসেল সিলভার সিন্ড্রোম কেন হয় সেটাই এখনও বোঝা সম্ভব হয়নি, ভারি রেয়ার আর গোলমেলে রোগ৷’

এই প্রসঙ্গটাতেই আসতে চাইছিল পায়েল, ‘সিক্সটি ফাইভে দরজা খোলার পর যে রোগটা ছড়িয়ে পড়ে সেটার মতো?’

হাঁটা থামিয়ে এবার রেলিয়ের উপরে বসে পড়েন ডাক্তার৷ বলেন, ‘দেখ পঞ্চান্ন বছর আগে ঘরটা যখন খোলা হয় তখন আমাদের বেশিরভাগের জন্মই হয়নি, যাদের হয়েছিল তারাও বছর দশেকের তখন৷ ফলে ঘরটা খোলার সময় তাদের ধারে কাছে আসতে দেওয়া হয়নি৷ তখন ঘর খুলে কী পাওয়া গেছিল সেটা আজ কেউ জানে না, লোকে বলে ঘরের ভিতর লুকিয়ে থাকা যখ দরজা খোলায় কুপিত হয়৷ ফলে বাইরে বেরিয়ে এসে অবাধে লোক মারতে থাকে৷ এই যখের ব্যাপারটা বুলশিট হলেও সে সময়ে লোক যে মারা যাচ্ছিল সেটা হিস্টরিক্যাল ফ্যাক্ট৷ আমার যতদূর মনে হয় ঘরের ভিতর কোনও ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হয়েছিল৷ যারা ঘরে ঢোকে তারা সম্ভবত তাতে আক্রান্ত হয়েই… খানিকটা সেই তুতেন খামেনের সমাধির মতো…’

পায়েল কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে উদাস হয়ে, তারপর বলে, ‘গ্যাস? আচ্ছা এমন তো হতে পারে—দুশো বছর আগে একটি শিশু অজানা কোনও রোগে আক্রান্ত হয়, ধরে নিন ইউরোপে টিউবারকুলোসিসের মতো এখানে এই রোগটাকে নিয়েও কিছু কুসংস্কার চালু ছিল৷ ছেলেটিকে শয়তান-টয়তান কিছু একটা বলে এই ঘরের ভিতরে আটকে দেওয়া হয়৷ সে বদ্ধঘরে মারা যায়, এমনকী হতে পারে যে তার শরীরের জীবাণুটা দেড়শো বছর পরেও জীবিত ছিল?’

বেশ জোরে হেসে ওঠেন ডাক্তার, ‘সুপারফিশিয়াল, থিয়োরিটিক্যালি সম্ভব হলেও বাস্তবে হতে পারে না৷ শরীর ডিকম্পোজ হচ্ছে মানে কোটি কোটি ব্যাকটিরিয়া জমা হয়েছে সেখানে৷ তার দেড়শো বছর পরে একটা বিশেষ ব্যাকটিরিয়ার জেগে ওঠা শুধুমাত্র সায়েন্স ফিকশনেই সম্ভব৷ তবে যে রোগই হোক না কেন, মানুষ পিঁপড়ে না হয়ে গেলে কারও পক্ষে ও মন্দিরের দরজা না খুলে ভিতরে ঢোকা সম্ভব না৷’

‘মন্দির না, আমি ভাবছি পুরোহিতমশাইয়ের জানলার কথা৷ কাল বিকেলে জঙ্গলের ভিতর ছেলেটাকে এক পলকের জন্যে দেখেছিলাম, ছুটে পালিয়ে গেল৷ ছেলেটার যা চেহারা মনে হল গয়না চুরির ব্যাপারটা সে ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব না৷’ পায়েল চিন্তিত মুখে বলে৷

আচমকাই হাঁটা থামিয়ে দেন ডাক্তার, দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসেন পায়েলের দিকে, বলেন, ‘শ্যামাদা গয়না চুরির ব্যাপারটা আমাকেও বলেছিলেন কিন্তু, তখন অতটা কান দিইনি… জানলা-দরজা খুলেই শুই আমি… কাল রাতে…

‘কী হয়েছে কাল রাতে?’

‘আমার ফোনটা চুরি গেছে…’ ডাক্তারকে বিমর্ষ দেখায়, ‘দরকারি জিনিসপত্র ছিল ওতে৷’

‘সেকি! ঘরের ভিতর থেকে?’

‘হ্যাঁ, কাল দুপুরে টেবিলের উপরে রেখে স্নানে ঢুকেছিলাম… তখনই…’

‘কল করলে কী বলছে?’

‘সুইচড অফ, যে নিয়েছে সে কি আর খোলা রাখবে?’

তাকে আশ্বাস দেয় পায়েল, ‘চিন্তা করবেন না৷ ছেলেটার রোগটা যখন আইডেন্টিফাই করা গেছে তখন ফোনটা উদ্ধার হয়ে যাবে, অবশ্য এতদিনে যদি না বেচে দিয়ে থাকে….’

ফোনের হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় বেশ উদ্বিগ্ন দেখায় ডাক্তারকে৷ তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে চলে যান৷ পায়েলও ধীরে ধীরে নিচে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়৷

এখানে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালে গ্রামের বেশ কিছুটা অংশ চোখে পড়ে৷ কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া গরুর গাড়ি, বট গাছের নেমে আসা ঝুরিতে টায়ার বেঁধে দোল খাওয়া ছেলেমেয়ের দোল, উবু হয়ে বসে রোদ পোহানো বুড়ো, ভারি সরল জীবন৷ এদের জীবনে কুয়াশা কেবল ভোরটুকুর জন্যই স্থির হয়, একটু রোদ উঠলেই আবার ঝকঝক করে চারিদিক৷ পায়েলের মাথার ভিতরেই কুয়াশা কেটে গিয়েছে৷ পিছনে কলিদের ঘর থেকে ভেসে আসা গানের সুরে তার মনটা হালকা হয় যায়৷

দরজা খোলার শব্দে পিছনে ফিরে সে দেখে সুবীর চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে দেখে একগাল হাসি খেলে যায় ভদ্রলোকের মুখে, ‘এই বয়সে ভোরে ওঠার অভ্যাসটা আছে, বাঃ বাঃ…’

পায়েল হাসে, ‘না কাকু, আমি আটটার আগে বিছানা ছাড়ি না, আজ উঠেছিলাম কুয়াশা দেখব বলে৷ গ্রামের কুয়াশা আমার খুব ভালো লাগে৷’

‘বেশ, তা এখন তো কুয়াশা নেই আর, এসো, ঘরে এসো৷’

পায়েল ঘরে এসে ঢুকতে গানটা বন্ধ করে দেন চৌধুরী, পায়েল একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে বসতে বসতে বলে, ‘বেশ তো চলছিল, বন্ধ করলেন কেন?’

‘তোমাদের বয়সের ছেলেমেয়েরা তো এই গান শোনে না৷ তাই ভাবলাম… ভালো কথা, কাল আমাদের এখানে বড় হাট বসবে, ভবেনকে বলে দেব ও তোমাদের ঘুরে আসার ব্যবস্থা করে দেবে৷’

পায়েল করুণ হাসি হাসে, ‘আমি কাল সকালে চলে যাচ্ছি কাকু, ট্রেন আছে৷’

‘সেকি!’ বিমর্ষ দেখায় চৌধুরীকে, ‘তোমাকে তো ভালো করে আপ্যায়নই করা হল না, আসলে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল…. ‘

‘পরের ছুটিতে আবার আসব না হয়৷ ইন্সপেক্টর গোস্বামীর নম্বর আছে আপনার কাছে?’

শেষ প্রশ্নটার জন্যে তৈরি ছিলেন না চৌধুরী৷ তিনি একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘হ্যাঁ আছে, কিন্তু তুমি কী করবে?’

‘একটু দিন না, ক-টা কথা বলার আছে৷’ অনুরোধের স্বরেই কথাটা বলেছে পায়েল, তাও প্রচ্ছন্ন একটা দাবি মিশে ছিল তাতে৷ নিজের ফোনে গোস্বামীর নম্বরটা ডায়াল করে এগিয়ে দেন চৌধুরী৷ পায়েল হাসিমুখ ফোনটা নিয়ে ভিতরের ঘরের দিকে পা বাড়ায়, ওপাশ থেকে রিং হতে থাকে৷

কলির মায়ের ঘরে এসে দাঁড়ায় পায়েল৷ কালীমন্দিরের দিকের জানলাটা বন্ধ ছিল, সেটা খুলে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে গলার আওয়াজ শোনা যায়

—হ্যাঁ চৌধুরীদা, বলুন!

—বাচ্চা ছেলে, হাইট সাড়ে চারফুটের কাছাকাছি, ঘন কালো গায়ের রং, ভয়ানক রকম পাতলা শরীর, সম্ভবত রাসেল সিলভার সিন্ড্রোম নামের কোনও রোগে ভুগছে, এই গ্রামেই থাকে, খুঁজে বের করুন প্লিজ৷

—কে বলছেন আপনি?

ইন্সপেক্টরের গলায় স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ,

—আমার নাম পায়েল রায়চৌধুরী৷ ছেলেটিকে না পাওয়া গেলে আজ সন্ধের আগেই আর একটা খুন করবে সে৷

—মানে আপনি বলেছেন সেই খুন করেছে?

—প্লিজ হারি….

(ছয়)

রাত ঘন হয়ে আসছে৷ আনন্দ আর কলি বাইরের বাগানে দোলনাটার সামনে একটা চেয়ার পেতে বসেছিল৷ খানিক পরে সদর দরজা খুলে পায়েল বেরিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়৷ প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বের করতে করতে বলে, ‘তোদের এই বাড়িটা শালা পুরো বোর্ডিং স্কুলের মতো৷ এতগুলো ঘর, একটাতেও হুড়কো লাগিয়ে একটা সিগারেট খাওয়ার উপায় নেই৷’

কলি পায়েলকে চেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে দোলনায় গিয়ে বসে অল্প অল্প দুলতে শুরু করে৷ মিঠে হাওয়া ভেসে আসছে দূর থেকে৷ পায়েলের সিগারেটের ধোঁয়া সেই হাওয়ায় মিশে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে৷

আনন্দ মুখ নিচু করে বসেছিল চেয়ারে৷ মুখ না তুলেই বলে, ‘এ বাড়ির আর কিছুই আগের মতো নেই৷ চোখের সামনে লোকগুলো কেমন পাল্টে গেল৷’

‘কাউকে সন্দেহ হয় তোমার?’ কলিই প্রশ্ন করে৷

‘এলেন কোথা থেকে আমার ভজা গোয়েন্দা…’ মুখ বাঁকায় পায়েল৷ তারপর সিগারেটটা আনন্দের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘বিড়ির জাস্ট উপরের স্টেজ, চলবে তো?’

আনন্দ হেসে সিগারেটটা ঠোঁটে লাগায়, তারপর বড় করে ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘বাচ্চাটার হদিশ পাওয়া গেছে শুনলাম৷ বড় কাকা বলছিলেন…’

‘হু, দেখেছিলে তুমি আগে?’

‘তা ওই বারকয়েক৷ আমাদের বাড়ি এসেছিল খেলা দেখাতে৷ তাছাড়া ছেলেটা ভালো পাখি ধরতে পারত৷ তরতর করে গাছে উঠে যেত… আর গলা দিয়ে নানারকম প্রাণীর ডাক…’

‘ইন্টারেস্টিং, ধরে নেওয়া যায় মন্দিরের দিক থেকে যে ভূতপ্রেতের ডাকগুলো আসত সেগুলো এই ভদ্রলোকেরই কীর্তি৷ এখন হয় ও নিজেই ভয় দেখানোর জন্য এসব করত নাহয় কেউ লোভ দেখিয়ে ভাড়া করেছিল৷ আচ্ছা, মন্দিরটা খোলায় কার লাভ হতে পারে?’

আনন্দ হাসে, ‘মন্দিরে যে কিছু নেই সে সবাই জানত৷ কার আর কী লাভ হতে পারে…’

‘মানে নিছক ভয় দেখানো৷ কিন্তু ভয় দেখাতে গিয়ে বেচারা নিজেই শেষে যখের হাতে…’ হঠাৎ কী ভেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে পায়েল, তারপর বলে, ‘চলো, একবার মন্দিরটা দেখে আসি…’

‘এখন! এই রাতের বেলায়!’ কলি আঁতকে ওঠে৷

‘আ রে আমার বীর মারাঠা, দিনের বেলা যক্ষ তো তোমায় হামি দিতে আসবে না৷’

‘কিন্তু এখন গিয়ে লাভ কী? সেদিনই তো গেলাম সবাই মিলে…’

‘দ্যাটস দ্যা পয়েন্ট৷ একাকিত্ব মানুষকে ভাবার সুযোগ দেয়৷ আনন্দদা, তুমি এসো তো৷ ও এখানেই দুলুক…’

আনন্দ আপত্তি করে না৷ ওরা তিনজনেই সরু রাস্তাটা ধরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসে৷ আজ জায়গাটা আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ লাগছে৷ আকাশের গায়ে ঝলমলে চাঁদ উঠেছে৷ তার নরম রূপালি আলো মন্দিরের এবড়োখেবড়ো সিমেন্টের উপর যেন তরলের মতো শুয়ে আছে৷ তিনজোড়া পায়ের আওয়াজ শোনা যায় মাটির উপর৷

মন্দিরের দরজার দিকে এগোয় না পায়েল৷ বরঞ্চ দরজার সামনে পৌঁছে পেছন ফিরে বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে৷ একসময় চোখ খুলে আনন্দের দিকে চেয়ে বলে, ‘সেদিন তুমি এখানেই দাঁড়িয়েছিলে, তাই না আনন্দদা?’

আনন্দ একটু ভেবে নিয়ে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ ওখানটাতেই তো মনে হচ্ছে…’

‘আমি আর কলি দাঁড়িয়েছিলাম ওই দূরটায়, তাই তো? মন্দিরের একদম সোজাসুজি পেছনে চাঁদ উঠেছিল…’ শেষ কথাগুলো বিড়বিড় করে বলে পায়েল৷

‘দরজা খোলার পর কী হয়?’

‘কী আবার? সবাই মিলে ভিতরে ঢোকে…’

‘উঁহু, তার আগে একটা ছোট ঘটনা ঘটেছিল৷ কারও খেয়াল নেই মনে হয়৷’

‘কী?’

‘হ্যাঁ মনে পড়েছে…’ কলি বলে ওঠে, ‘টর্চ হারিয়ে গেছিল৷ আনন্দদার হাতে টর্চ ছিল কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিল…’

‘হ্যাঁ, আসলে…’ আনন্দ মনে করার চেষ্টা করে, ‘মনে হয় কেউ টর্চটা পেছন থেকে নিয়ে নিয়েছিল আমার হাত থেকে৷ অত দৌড়াদৌড়ির মধ্যে সামান্য একটা টর্চ কে নিচ্ছে আমি আর গা করিনি…’

‘তক্ষুনি পাওয়াও যায় টর্চটা…’

‘হুম…’ পায়েলের ভুরু দুটো আবার কুঁচকে গেছে, ‘মানে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলোর অভাবটা দরকার ছিল কারও…’

‘কিন্তু তাতে লাভ কী? দরজার সামনে আলো ছিল৷ অতগুলো লোক দাঁড়িয়েছিল দরজায়, বাইরে থেকে কেউ ভিতরে ঢোকেনি…’

‘অন্য আলোর সঙ্গে টর্চের আলোর একটা পার্থক্য আছে…’ কেমন যেন থমথমে গলায় বলে পায়েল৷

‘তুই কী করতে চাইছিস বল তো?’ কলি জিজ্ঞেস করে৷

‘ম্যাজিকটা কী করে দেখানো হল সেটাই ভাবছি…’ ঠোঁটের উপর আঙুল রাখে পায়েল৷ কথাটা বলেই দোতলার একটা ঘরের জানলার দিকে আঙুল তুলে দেখায় পায়েল, ‘এমন একটা ম্যাজিক যেটা তোর মায়ের ঘরের জানলা থেকে কেউ দেখলেই ফাঁস হয়ে যেত৷ অর্থাৎ ম্যাজিকটা ছিল কেবল মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার জন্য… মানে… কলি তুই জ্যামিতিতে চোতা সাপ্লাই করতিস না? তোর কী মনে হচ্ছে…’

‘কী মনে হবে আবার… এটুকু মনে হচ্ছে একটা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে…’

‘অ্যাঙ্গেল?’ কী যেন ভেবে একটু থতমত খায় পায়েল৷ ওর দু-চোখে অদ্ভুত একটা ঝিলিক খেলে যায়৷

‘তুই কি কিছু…’ কলি প্রশ্নটা করতে পারে না৷ তার আগেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে অদ্ভুত একটা ইশারা করে ওকে চুপ করতে বলে পায়েল৷ তারপর নিচু গলায় বলে, ‘মন্দিরের ভিতর থেকে একটা শব্দ এল না? শুনলি?’

‘শব্দ! কীসের শব্দ?’ কলি অবাক হয়ে তাকায়৷

‘কে যেন ডাকছে আমাদের… একটা বাচ্চা ছেলে…’ পায়েলের গলাটা অদ্ভুতরকম শীতল আর থমথমে শোনায়৷

‘এই বাজে ইয়ার্কি মারছিস তুই…’

‘কই আমি তো কোনও শব্দ…’ আনন্দ বলতে গিয়েও থেমে যায়৷ পায়েল ওর মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়েছে৷ তার ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বেলে আলোটা ফেলেছে মন্দিরের দরজার ভিতরে৷ ভিতরে কিছুই চোখে পড়ছে না৷ আলোটা সামনে ধরেই পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে৷ একসময়ে ভিতরের অন্ধকারে হারিয়ে যায় তার শরীর৷

কয়েক সেকেন্ড দম বন্ধ করে চেয়ে থাকে ওরা৷ পরমুহূর্তে ভিতর থেকে ভেসে আসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার ওদের পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়ে দেয়৷

দ্রুত কলি ছুটে যেতে চায় সেদিকে৷ কিন্তু আনন্দ তাকে থামিয়ে দেয়৷ এতক্ষণে বাড়ির ভিতর থেকে উপল আর সুবীরবাবু বেরিয়ে এসেছেন৷ ডাক্তার এক ছুটে মন্দিরের সামনে এসে পড়েন, ‘কী হয়েছে আনন্দ? কীসের চিৎকার?’

‘ওই দিদি ভিতরে গেলেন, বললেন কার যেন ডাক শুনতে পারছেন…’

‘এসো আমার সঙ্গে…’

আনন্দের সঙ্গে ডাক্তার দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢোকে৷ ঢুকতেই দেখে মেঝের উপরে পড়ে আছে পায়েল৷ তার শরীরটা অদ্ভুতভাবে বেঁকে আছে৷ ডানহাতে তখনও ধরা আছে মোবাইলটা৷ তার ফ্ল্যাশলাইট থেকে বেরিয়ে আসা আলোতেই উদ্ভাসিত হয়ে আছে মন্দিরের গর্ভগৃহ৷

‘ফিট হয়ে গেছে, সম্ভবত ভয় পেয়ে…’ এগিয়ে গিয়ে পায়েলের একটা হাতের কবজির কাছটা চেপে ধরে ডাক্তার৷ অন্য হাতটা ধরে আনন্দ ৷ মেয়েটার নাড়ি বোঝার চেষ্টা করে উপল৷ অস্বাভাবিকরকম বেড়ে গেছে নাড়ির গতি৷

‘বাড়ির ভিতরে নিয়ে চলো…’ আনন্দের দিকে চেয়ে নির্দেশ দেয় ডাক্তার৷ কিন্তু তার দরকার পড়ে না৷ তার আগেই পায়েলের মুখের রং ফিরতে শুরু করেছে৷ ধীরে ধীরে উঠে বসে সে৷ তারপর উঠে দাঁড়ায়৷

‘সেদিন কিছুটা এইভাবেই পড়েছিল বডিটা, তাই না?’

একটু হকচকিয়ে যান ডাক্তার উপল দেবনাথ, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তার মানে…’

‘আপনি আর ভবেন দু-জনে ঠিক এইভাবেই তুলে নিয়ে যান বডিটা?’

‘তুমি ভিতরে কী দেখেছিলে দিদি?’ আনন্দ থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করে৷

‘একটা ছেলে…’

এতক্ষণে কলিও ঘরের ভিতরে ঢুকে এসেছে৷ শেষ কথাটা তার কানেও গেছে, চাপা গলায় প্রশ্ন করে সে, ‘কিন্তু এ ঘরে কোনও ছেলে তো নেই…’

‘জানি, চলে গেছে…’

মেঝে থেকে উঠে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়ায় পায়েল৷ তার হাবভাব ভারি অদ্ভুত লাগে কলির৷ এর আগে কোনওদিন পায়েলকে এমন বিচিত্র আচরণ করতে দেখেনি সে৷

‘মনে হয় আদৌ কিছু দেখেনি…’ বিড়বিড় করে বলে আনন্দ ৷

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে… তাহলে কেন খামোখা…’

বাইরে এসে পায়েলের হাঁটার গতি আরও বেড়ে যায়৷ কলি দ্রুত পায়ে এগিয়ে ধরে ফেলে তাকে৷ তারপর শক্ত গলায় প্রশ্ন করে, ‘তুই সত্যি দেখেছিলি ছেলেটাকে?

‘হ্যাঁ…’ হাঁটতে হাঁটতেই উত্তর দেয় পায়েল৷

‘কী বলল সে তোকে?’

‘কে খুন করেছে, আর কেন খুন করেছে…’

সাত

দুপুর শেষ হয়ে আসছে এতক্ষণে৷ চৌধুরীবাড়ির ঠাকুরদালানে এসে জড়ো হয়েছে বাড়ির বাসিন্দারা৷ সেই সঙ্গে পুলিশের একটা ছোটখাটো দল দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে৷ বাড়ির সদর দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের একটা এসইউভি৷ তার ভিতরে কিছু আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না৷

পাশাপাশি বেঞ্চগুলোর বড়টাতে বসেছেন সুবীর চৌধুরী, ডাক্তার দেবনাথ আর আনন্দ, তার ঠিক পাশে ছোট বেঞ্চে সুবর্ণ লাহিড়ী ও শ্যামাপদ চক্রবর্তী৷ এদের থেকে খানিক দূরে একটা চেয়ারে বসেছে ভবেন৷ ঘনঘন কপালের ঘাম মুছছে সে!

দালানের একেবারে মাঝামাঝি হাঁটুদুটো মাটির উপরে রেখে বসেছিল পায়েল, তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে কলি৷ একটু আগে কিছু একটা বলছিলেন ইন্সপেক্টর গোস্বামী৷ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দলটাকে নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল তাঁকে৷ পায়েল পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷

‘খুনি কি গাড়িতে আছে?’ আনন্দ এসইউভির দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে লাহিড়ীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে৷

‘তুমিও যেখানে আমিও সেখানে!’

‘ছোকরার মুখটা দেখতে ইচ্ছা করছে৷’

‘ছুকরিও হতে পারে…’ গম্ভীর গলায় বলেন ডাক্তার দেবনাথ৷

ঘড়ির দিকে তাকালেন চক্রবর্তী৷ কিছু বললেন না৷

কিছুটা হেঁটে এদের সামনে এগিয়ে এল পায়েল, কবজির উল্টোদিক দিয়ে নাকটা ঘষে নিয়ে বলল, ‘সেকেন্ড ইয়ারে আমাদের কলেজে ভলতেয়ার পড়ানো হয়েছিল, তো সেটা পড়তে গিয়ে একটা কথা ভারি মনে লেগেছিল আমার—

‘It is forbidden to kill— therefore all murderers are punished unless they kill in large numbers and to the sound of trumpets.

মানে সব খুনিরাই শাস্তি পাবে, এক যদি না সে একসঙ্গে বহু মানুষকে খুন করে, আর দুই, খুনের শব্দকে শিঙে ফোঁকার আওয়াজে ঢেকে ফেলতে পারে৷ গত পরশু এ বাড়িতে যে খুনটা হয়ে গেছে তাতে খুনি এই দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করেছে৷’

‘কই আমরা তো তেমন আওয়াজ শুনতে পাইনি কিছু৷’ সুবীর চৌধুরী বলে ওঠেন৷

পায়েল হাসে, ‘ওটা তো অ্যালিগোরি, মানে খুনি কোনও একটা পদ্ধতিতে আপনার আমার চোখের সামনে একটা ইলিউশন তৈরি করেছে৷ আমরা ভাবছি আমরা খুনটাই দেখছি, অথচ খুনের বদলে দেখছি একটা ম্যাজিক-স্টেজ শো৷’

একটু আগে দালান জুড়ে একটা গুঞ্জন উঠেছিল, এবার সেটা থেমে গেল, পায়েল বলে চলল, ‘যেকোনও ভালো ম্যাজিশিয়ান প্রথমেই দর্শকের মনকে আছন্ন করে ফেলতে চান, যাতে সে তার পারিপার্শ্বিক নিয়ে সতর্ক না হতে পারে, কখনও সেটা মিউজিক, কখনও সুন্দরী নারী, এক্ষেত্রে উপস্থিত ছিল একটি শিশুর গলাকাটা দেহ৷ বলা বাহুল্য মন্দির খুলে সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পর আপনাদের কারও মাথাই ঠান্ডা থাকার কথা নয়, খুনি ঠিক এইটাই চেয়েছিল৷ ম্যাজিকের ফার্স্ট রুল, ডিস্ট্র্যাকশন৷ পঞ্চাশ বছর পরে খোলা একটা ঘরের মেঝেতে রক্তাক্ত বাচ্চার মৃতদেহ এত বেশি করে আতঙ্কিত করল আপনাদের যে একেবারে অপ্রয়োজনীয় কয়েকটা অসঙ্গতির কথা মাথাতেই ছিল না আপনাদের…

যেমন এক, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়েনি৷ কয়েক সেকেন্ড থম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সবাই৷ তার মধ্যেই অন্য কেউ ঢুকে পড়তে পারে ঘরে…’

‘ধুর…’ আনন্দ বিরক্ত গলায় বলে ওঠে, ‘তা কী করে ঢুকবে? ঘরে না ঢুকলেও অন্তত জনা পঞ্চাশেক লোক দরজার সামনেই দরজার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল… যথেষ্ট আলোও ছিল…’

‘আলো ছিল বাইরে৷ মন্দিরের দরজার ভিতরে কোনও আলো ছিল না তখন৷ থাকার সম্ভাবনা ছিল যদিও, তাও বিশেষ একটা কারণে থাকেনি৷ দরজা খোলার পরেই সবাই খেয়াল করে আনন্দদার হাতে টর্চ নেই৷ সম্ভবত মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য টর্চটা ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিয়েছিল কেউ৷ কিন্তু কেন? তিরিশ সেকেন্ডের এই উইন্ডোটায় মন্দিরের ভিতরে জমাট অন্ধকারটা কি সাহায্য করছিল খুনিকে? কী ঘটছিল সেখানে?’

পায়েল কপাল থেকে চুল সরিয়ে মৃদু হাসে, ‘আচ্ছা, সে কথায় পরে আসছি… আগে আমরা সবাই সেদিন যেটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সেটার দিকেই তাকাই… বাচ্চার রক্তাক্ত মৃতদেহ… শক ফ্যাক্টর…

একে পঞ্চাশ বছর পরে খোলা যক্ষের ঘর, তার উপরে রক্ত, তার উপরে বাচ্চা৷ ট্রিপল শক, বলা বাহুল্য যে কারও নার্ভ ঠান্ডা করে দেবে… ম্যাজিকের প্রথম ধাপ৷’

পিছিয়ে আসে পায়েল, নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলতে থাকে, ‘আসুন আমরা ফিরে যাই সেই ম্যাজিকের রাতে, যেদিন পঞ্চাশ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি ঘর খুলে আমরা আবিষ্কার করি কয়েক ঘণ্টা আগে মৃত একটি শিশুর দেহ, অসম্ভব, তাই না?

সেদিন রাতে দুটো জিনিসে খটকা লাগে আমার৷ প্রথম, পায়ের ছাপ৷ আপনারা খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন মন্দিরের চারপাশটা অল্প ঢালু, বর্ষাকালে চাতালে পড়া জল গড়িয়ে গিয়ে মন্দিরের আশপাশে জড়ো হয়৷ তারমানে ঘাস কাটার পর মন্দিরের লাগোয়া মাটি অন্য অংশের মাটির চেয়ে বেশি নরম হবার কথা৷ অথচ সেদিন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর যে পায়ের ছাপগুলো পড়েছিল সেগুলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি গ্রামবাসীদের পায়ের ছাপের থেকে কম গভীরতার, কেন?

দ্বিতীয় খটকাটা ভারি সহজ, আপনারা যে কেন সেটা ভাবেননি সেটাই প্রশ্ন, যে মৃতদেহটা আমরা দেখি তার গলা কেটে খুন করা হয়েছিল৷ রক্ত তার বুকে এমনকী পেটে লেগে থাকার কথা, কিন্তু তার গোটা মুখে রক্ত লেগে থাকবে কেন? তরলের ধর্ম উপর দিকে ওঠা নয়৷ তাহলে? খুনি ছেলেটিকে খুন করার পর তার মুখেও রক্ত মাখিয়েছিল? কী লাভ তাতে?

লাভ একটাই, কেউ তার মুখ আড়াল করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু কেন? মৃতদেহ ফরেনসিকে যাবে, মুখ আড়াল করে কী লাভ হবে খুনির? একটু ভাবতেই উত্তর মাথায় আসে আমার৷ ফরেনসিকে যাবার আগেই মৃতদেহ বদলে দিতে চায় খুনি৷ সে শুধু দরজা খোলার পর কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দর্শককে বোঝাতে চেয়েছিল যে মৃতদেহ কয়েক ঘণ্টা ধরে ওই ঘরেই পড়ে আছে৷ এরপর কোনও এক সময়ে মৃতদেহ বদলে দেয় সে…’

‘তাই যদি হয়…’ একটু চিন্তা করে বলে আনন্দ, ‘সেই মৃতদেহটাকেই বা সে ঘরে ঢোকাল কী করে?’

পায়েলের মুখে একটা চেরা হাসি ফুটে ওঠে, ‘যদি বলি মৃতদেহ ওই ঘরে একবারও ঢোকেনি? যে ঢুকেছিল এবং যাকে আপনারা স্ট্রেচারে করে দালানে এনে শুইয়ে দেন সে জীবিত মানুষ..’

‘কিন্তু তা কী করে হয়?’ ইন্সপেক্টর মুখ খোলেন এবার, ‘যতই অভিনয় করুক না কেন, শরীরে রাইগার মরটিস কী করে…’

আচমকা ইন্সপেক্টরের দিকে এগিয়ে আসে পায়েল, তার গলার ভিতর থেকে যেন আগুন উঠে আসতে চাইছে, ‘কে বলেছিল দেহে রাইগার মরটিস সেট ইন করেছে? একমাত্র কে স্পর্শ করে তাকে? কে তাকে দালান অবধি স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসে? একমাত্র কার কাছে সুযোগ ছিল মৃতদেহ পাল্টে দেওয়ার?’

‘ডাক্তার উপল দেবনাথ…’ শব্দটা বেরিয়ে আসে গোস্বামীর মুখ দিয়ে৷

পায়েল আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের সামনে এগিয়ে আসে, তিনি এতক্ষণে মুখ নিচু করে বসেছেন৷ হাত দুটো হাঁটুর উপরে স্থির৷

‘বাকি ঘটনা আপনিও বলতে পারেন, বলবেন নাকি ডাক্তারবাবু?’

‘কিন্তু ডাক্তার তো একা ছিলেন না বডির সঙ্গে, ভবেন ছিল তো৷’

‘ডাক্তার জানতেন মৃতদেহ আবিষ্কারের পর পুরোহিত, বৃদ্ধ, মাসলম্যানকে সরিয়ে তিনিই হর্তাকর্তা হয়ে উঠবেন৷ বাকি কাজ তাঁর নির্দেশেই হবে৷ হয়ও তাই… যাক গে, দ্বিতীয় অসঙ্গতি৷ আপনারা সবাই ভাবছিলেন বডি কখনও একা ছিল না৷ অন্তত দু-জন সারাক্ষণ গার্ড দিয়েছে তাকে, তাই তো? এটা শুনুন মন দিয়ে…’

পকেট থেকে ইন্সপেক্টরের ভয়েজ রেকর্ডারটা বের করে একটা বিশেষ অংশ চালিয়ে দেয় পায়েল, ভবেনের গলা ভেসে আসে, ‘আমরা দু-জনেই ধরাধরি করে স্ট্রেচারে করে তুলে এখানে নিয়ে এসে শুইয়ে দিই… ওইটুকু ছেলের অত রক্ত, আমার গাটা কেমন করছিল, একটা চাদর এনে চাপা দিয়ে দিই… তারপর থেকে ওইভাবেই ছিল স্যার…’

‘খেয়াল করুন, ভবেন মিনিট খানেকের জন্য হলেও যে মৃতদেহের সামনে ছিল না তা এই রেকর্ডিংয়ের মধ্যেই বলা আছে৷ সে সময়ে ঠাকুর দালানে কাউকে ভিড় করতে বারণ করেছিলেন ডাক্তার৷ তাছাড়া সবাই মন্দিরের কাছে ভিড় করায় দালানের আলোও জ্বলছিল না৷ মাত্র দু-মিনিটের উইন্ডো৷ আমার ধারণা চাদর আনতে যাওয়ার আইডিয়াটা ডাক্তারই ঢোকান ওর মাথার ভিতরে… ভবেনের চাদর আনতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃতদেহে প্রাণ ফিরে আসে, সে দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে ডাক্তারের ঘরে৷ ঘরের দরজার কাছে পড়ে থাকা সত্যিকারের মৃতদেহ কোলে করে তুলে এনে স্ট্রেচারে শুইয়ে দেন ডাক্তার, দু-মিনিট পরে ভবেন ফিরে এসে চাদর চাপা দেওয়ার সময় বুঝতেও পারে না এরমাঝে মৃতদেহ বদলে গেছে৷’

কয়েক সেকেন্ডের একটা নীরবতা গ্রাস করে দালানটাকে৷ পায়েল আবার বলতে থাকে, ‘এবার আসি এই নাটকের মঞ্চসজ্জায়, মানে খুনের দিন সকালের পর থেকে৷ আচ্ছা…’ পকেট থেকে একটা ছবি বের করে টেবিলের উপরে রাখে পায়েল, তারপর বলতে থাকে, ‘দেখুন তো এই ছবিটার সঙ্গে আপনাদের সেদিন রাতে দেখা মন্দিরের দরজার কোন তফাত আছে কি না?’

খুব একটা উৎসাহ দেখায় না কেউ, কলি এগিয়ে এসে ছবিটা হাতে নেয়৷ বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকেও কিছু বুঝতে পারে না সে৷ তারপর দরজার দিকে চোখ পড়তেই উত্তরটা খেলে যায় চোখের সামনে, ‘আগে দেখে চোখে পড়েনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছবিটায় দরজাটা একটু বড় দেখাচ্ছে৷’

‘এক্সাক্টলি, সেদিন রাতে দরজাটা যে স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট লাগছে সেটা আপনারা কেউ বুঝতে পারেননি৷ কারণ দরজার তলার দিকটা এই পঞ্চাশ বছরে আপনারা যতবারই দেখেছেন ততবারই বেড়ে ওঠা ঘাসে ঢাকা ছিল৷ অসঙ্গতিটা চোখে পড়ার কথা নয়৷

দরজার তলার সঙ্গে কিছু একটা কারসাজি যে আছে সেটা আমি বুঝতে পারি একটা ঘটনা থেকে, ঠাকুরমশাই, খুনের পরদিন একেবারে কাকভোরে পুলিশের চোখ এড়িয়ে আপনি মন্দিরে ঢুকতে যান৷ সম্ভবত মাধবচন্দ্রের সম্পত্তির লোভ বা নিছক কৌতূহল টেনে আনে আপনাকে, তখনই পা মচকে যায়, তাই তো?

শ্যামাপদ চক্রবর্তী মাথা নাড়েন, কথা ফোটে না তাঁর মুখে৷

‘পা মচকে যাওয়ার কারণ খুব সহজ৷ আগের দিন রাতে ঘরে ঢোকার সময় উনি জানতেন না ঘরের মেঝে চৌকাঠ থেকে কতটা নিচুতে৷ উনি সাবধানে পা রাখেন৷ ওনার অবচেতন মনের হিসেবে ধরা হয়ে যায় যে ঘরের মেঝে চৌকাঠ থেকে অন্তত ছ-ইঞ্চি নিচে৷ কিন্তু পরদিন সকালে ঘরের মেঝে কোন অলৌকিক উপায় পাঁচ ইঞ্চি উপরে উঠে এসেছে, উনি ভুলভাবে পা রাখতে যান ও স্বাভাবিকভাবে পা মচকে যায়৷’

কিন্তু তা কী করে হয়? ঘরের মেঝে উপরে উঠে আসতে পারে না৷ আমি বুঝতে পারি রাতে মন্দিরের দরজার ঠিক সামনেটায় এমন কিছু রাখা ছিল যেটা সকালের আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়৷ পায়ের ছাপের কথাটা মাথায় আসে আমার, বুঝতে পারি সে রাতে মন্দিরের দরজার সামনের জমিটা ছিল ফেক, সম্ভবত একটা বিশেষ ভাবে তৈরি শক্তিশালী প্লাইউড, আকার অনেকটা ইংরেজি সাত নম্বরটাকে শুইয়ে দিলে যেমন হয় সেইরকম৷ যার উপরে মাটি ও কাটা ঘাসপাতার প্রলেপ লাগানো ছিল, খেলার মাঠে পাতা অ্যাস্ট্রোটার্ফের মতো৷ কাল রাতে আবার মন্দিরের সামনে গিয়ে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয় আমার কাছে৷ একটা শব্দ মাথায় আসে আমার, অ্যাঙ্গেল৷

মাটির সঙ্গে খুব সূক্ষ্ম কোণে শোয়ানো সেভেন আকৃতির প্লাইউড পাতা থাকলে মাটিটা যে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠেছে সেটা প্লাইয়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ বুঝতে পারবে না৷ বোঝা যাবে কেবল অনেকটা উপর থেকে৷ ছায়ার পার্থক্য থেকে৷

ফলে প্লাইটা রাখা হয়েছিল ঢালের মতো করে, ঢালের উঁচু দিকটা দরজার ঠিক সামনেটায় উন্মুক্ত হয়, সরু দিকটা মাটির সঙ্গে মেশে৷ মন্দিরের সামনে বৈদ্যুতিক আলো নেই, ছিল ক-টা হ্যারিকেন আর টর্চ, আলো-আঁধারিতে কারও খটকা লাগে না৷ কই নিয়ে আসুন….’

পুলিশের দুটো লোক এসইউভি থেকে একটা বছর বারোর ছেলেকে নামিয়ে নিয়ে আসে৷ সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় সকলে৷ একটা মানুষের শরীর এত পাতলা হতে পারে! ঘন আবলুশ কাঠের মতো গায়ের রং৷

সে এগিয়ে আসতেই পায়েল তাকে দেখিয়ে বলে, ‘আপনারা বোধহয় বুঝতে পারছেন কেন সেদিন মৃতদেহকে ফুলহাতা জামা পরাতে হয়েছিল৷ যে ছেলেটি সত্যি খুন হয়েছে তার তুলনায় এই ছেলেটি প্রায় কয়েক গুণ রোগা৷ রক্ত দিয়ে মুখের আদল ঢেকে দিলেও সরু সরু হাত-পা ঢাকবে কী করে? তাই ফুলহাতা জামা… ফুলপ্যান্ট!’

ছেলেটিকে টেনে এনে দালানের এককোণে দাঁড় করানো হয়৷ সে সবার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নেয়৷ পায়েল তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার বলতে থাকে, ‘সেদিন দরজার সামনের সেই স্লোপটার নিচে এই ছেলেটিই লুকিয়ে ছিল৷ বলা বাহুল্য ওর চেহারাটা ইঞ্চি পাঁচেকের খোপের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া আশ্চর্য না৷

এবার মনে করুন সেদিনের কথা, ভবেনদা দরজা খুলে পাল্লা সরিয়ে ফেলার ঠিক পরে ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ চিৎকার করে বলেন কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ভিতরে ঢুকতে৷ আপনারা দরজা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়েন৷ টর্চ না পাওয়া ভিতরে আলোও ফেলা যায় না৷ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার৷

কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডেই ম্যাজিকের আসল ট্রিকটা ঘটে যায়৷ আপনাদের পায়ের ঠিক নিচে প্লাইউডের তলায় লুকিয়ে থাকা ছেলেটির সামনেও তখন দরজা খুলে গেছে৷ ও খোপের ভিতর থেকে নেমে আসে মেঝেতে৷ তারপর গুঁড়ি মেরে গিয়ে ঘরের ঠিক মাঝবরাবর শুয়ে পড়ে৷ গলা আর মুখের মেকআপটা দেওয়াই ছিল৷ দু-মিনিট পরে আপনারা ঘরে ঢুকে ভূত দেখেন, চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকেন৷ ডাক্তার জানতেন রক্ত দেখে আগে তাঁকেই ডাক দেবেন আপনারা৷ তিনি এসে রাইগার মরটিস ও আরও হাবিজাবি কিছু বলে একটি জীবন্ত শরীরকে মৃত ঘোষণা করেন৷’

‘কিন্তু ও তক্তার নিচে ঢুকল কখন?’

‘সম্ভবত বিকেলের একটু পরে, তখনও লোক আসা শুরু হয়নি, ফাঁকাই পড়ে ছিল চত্বরটা৷ প্লাইউডটা মন্দিরের পিছনেই রাখা ছিল হয়তো৷ ওকে থার্ড পারসন কেউ সাহায্যও করে থাকতে পারে৷’

‘তাহলে আসল খুনটা হয় কোথায়?’

‘এই বাড়িতেই৷’ পায়েল ডাক্তারের দিকে ফেরে, ‘যে ছেলেটি খুন হয়েছে তাকে আগের দিন রাতে অজ্ঞান অবস্থায় বাড়িতে ধরে আনেন ডাক্তার৷ সারাদিন অজ্ঞান হয়ে ডাক্তারের ঘরেই পড়েছিল সে৷ তিনটে থেকে চারটের মধ্যে রোগী দেখতে দেখতে দু-বার ওঠেন তিনি৷ ধারালো স্কাল্পেল দিয়ে অচৈতন্য শিশুর নলি কাটতে বেশি সময় লাগার কথা নয়৷ খুনটা করে ফিরে এসে তিনি আবার রোগী দেখতে থাকেন৷ আর ওদিকে মন্দিরের সামনে ম্যাজিকের স্টেজ সাজাতে থাকে এই ছেলেটি৷

সকাল থেকে আর একটা কাজ করেছিলেন ডাক্তার৷ লেট মিসেস চৌধুরীর ঘরে গিয়ে জানলাটা জ্যাম করে রেখে এসেছিলেন৷ কারণ মন্দিরের দরজার সামনের মাটি হঠাৎ স্লোপ হয়ে উপরে উঠেছে সেটা মাটিতে দাঁড়িয়ে বোঝা না গেলেও ওই অ্যাঙ্গেল থেকে সহজেই ধরা পড়ে৷

সেদিন মৃতদেহ উদ্ধারের পরে মন্দিরের সামনে থেকে লোকজন সরে যেতেই ছেলেটি কোন এক ফাঁকে ফিরে এসে প্লাইয়ের স্লোপ সরিয়ে নেয়, জঙ্গলের কোথাও টেনে নিয়ে গিয়ে সেটাকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে, ছাইটা বাতাসে উড়িয়ে দেয়৷’

‘কিন্তু ছেলেটার কী লাভ এতে?’ সুবীর চৌধুরী প্রথম মুখ খোলেন৷

পায়েল কাঁধ ঝাঁকায়, ‘বলা মুশকিল, রাতে ঠাকুরমশায়ের ঘরে চুরি করতে গিয়ে ডাক্তারের হাতে ধরা পড়ে সে৷ তার পাতলা চেহারার সুবিধাটা বুঝতে পেরেই ডাক্তারের মাথায় আসে আইডিয়াটা, কিসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জানি না৷ টাকাপয়সা মেবি, ওর রোগটা সারিয়ে দেবার লোভও দেখিয়ে থাকতে পারেন৷

কাল বিকেলে কলি আমাকে বলে এই সমস্ত ব্যাপারটা একটা নাটকের মতো, যার গ্রিনরুমে কে আছে আমরা জানি না৷ এই গ্রিনরুম শব্দটা শুনেই খুনের একমাত্র সম্ভাবনাটা মাথায় আসে, অনেক সময় ম্যাজিশিয়ানরা যে গ্রিনরুম ব্যবহার করেন সেটা থাকে স্টেজের নিচে৷ এক্ষেত্রেও ঠিক তাই ছিল৷

আমি এটা বুঝতে পারি যে সেই গ্রিনরুমে লুকিয়ে থাকার জন্য অসম্ভব রকম পাতলা শরীরের প্রয়োজন৷ মাথায় আসে, ঠাকুরমশায়ের জানলার ফাঁক গলে গয়না চুরি করে কেউ৷ আমি বুঝতে পারি এমন কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে ভয়ানক রোগা৷ কাল বিকেলে জঙ্গলের ভিতরে আমি কিছুই দেখতে পাইনি৷ আজ ভোরে মিথ্যে করেই ডাক্তারকে বলি একটা কিম্ভুত রোগা চেহারার ছেলেকে দেখেছিলাম আমি৷ ডাক্তারের মুখে ভয় ফুটে ওঠে৷ উনি ছেলেটিকে বাড়ির ধারেকাছেও আসতে বারণ করেছিলেন৷ আপনারা ওকে আগেভাবে খুঁজে বের না করলে ওকেও খুন করতেন ডাক্তার৷

ভালো কথা…!’

আবার ডাক্তারের দিকে এগিয়ে যায় পায়েল, ‘আপনার ফোনটা কিন্তু ও চুরি করেনি, করেছে অন্য একজন৷ সেও উপস্থিত আছে এখানে…’

‘কে?’ কলি প্রশ্ন করে৷

‘আমি৷’ পকেট থেকে ডাক্তারের ফোনটা বের করে দেখায় পায়েল৷

‘কিন্তু কেন?’

‘কেন? এই প্রশ্নটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল৷ কাল রাত অবধি উত্তর ছিল না আমার কাছে৷ মোটিভ কুয়াশার মতো ঢাকা পড়েছিল৷

জানি না কেন প্রথম থেকেই ডাক্তারের উপর সন্দেহ হয় আমার৷ একমাত্র উনিই মৃতদেহের সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও একা ছিলেন৷ পরশু রাতে ডাক্তারের ঘর থেকে ওর ফোনটা নিয়ে আসি আমি, একটা সন্দেহ কাজ করছিল আমার মাথায়, কাল সকালে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করি, ডাক্তার বলছেন দেড়শো বছর পরে ব্যাক্টিরিয়ার জেগে ওঠা বিজ্ঞানের ভাষায় অসম্ভব৷ অথচ কালীমন্দিরে পঞ্চাশ বছর আগে দরজা খোলার সময় ঠিক সেই ব্যাপারটাই ঘটেছিল, এদিকে ডাক্তারের একটুও অবাক লাগেনি তাতে?

আমি সিদ্ধান্তে আসি অবাক ডাক্তারের অনেকদিন আগেই লেগেছে, এবং সম্ভবত সেই কারণেই নিজের চেম্বার করার বদলে এখানে ভাড়া থাকেন তিনি৷ মাধবচন্দ্রের ধনদৌলত নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল না৷ গ্রাম্য জমিদার, কত সোনাদানাই বা রেখে যাবেন? ডাক্তার জানতেন ওই কালীমন্দিরের ভিতরে লুকিয়ে আছে তার থেকে অনেক বড় রত্নভাণ্ডার, এমন কোনও ব্যাকটিরিয়া যে জল বাতাসের অনুপস্থিতিতে কয়েকশো বছর হাইবারনেশনে থাকতে পারে৷’

কিন্তু তাই বলে একটা বাচ্চাকে খুন করবেন কেন ডাক্তার? আরও বেশি টাকার লোভ দেখালেই তো হত৷ এই হিসেবটা কিছুতেই মিলছিল না আমার কাছে৷ ফলে ডাক্তারের ফোনটা চুরি করতে হয় আমাকে৷ সেটা করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি, কিন্তু মুশকিল হয় ডাক্তারের ফোন পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড৷ খুলব কী করে? ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি খাটাই আমি৷

কাল রাতে মন্দিরের ভিতর থেকে আমার চিৎকার শুনে ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে আসেন৷ ডাক্তার আর আনন্দদা আমাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসেন৷ আমার ফিট ছাড়াতে আমার হাতের আঙুল চেপে ধরেন ডাক্তার৷ ঠিক এই জিনিসটার অপেক্ষাই করছিলাম আমি৷ পাসওয়ার্ড ছাড়া ডাক্তারের ফোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েও খোলা যায়৷ আমার হাতের উপরেই ডাক্তারের হাত৷ আঙুলগুলো নড়াচড়ার ফাঁকে ঠিক জায়গায় ঠেলে দিতেই ফোন আনলকড…’

‘তার মানে ওই ফোনটা…’

‘না, কাল রাতে যে ফোনে ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে আমি মন্দিরের ভিতরে ঢুকেছিলাম সেটা আসলে ডাক্তারের ফোন৷ শুধু ব্যাক কভারটা পালটে নিয়েছিলাম৷ আমার হাতে ধরা ফোনটা যে আসলে ওঁর নিজেরই চুরি যাওয়া ফোন সেটা ডাক্তার স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি…’

‘কিন্তু ফ্ল্যাশলাইটটা তুই…’

‘ফোনে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাতে গেলে পাসওয়ার্ড জানতে হয় না…’

এবার পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে টেবিলের উপরে রাখে পায়েল, কয়েকটা ছবি ফুটে ওঠে পাশাপাশি, ‘এগুলো সব ডাক্তারের ফোন থেকে পাওয়া৷ ছেলেটিকে দিনের পর দিন শারীরিকভাবে নিগ্রহ করতেন ডাক্তার৷ এই ছবিগুলো ওঁর নিজেরই তোলা… সে সামান্য কিছু খাবার কিংবা টাকাপয়সার লোভে আপত্তি করত না৷ শেষে একদিন সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে৷ তারপর অগত্যা…’

ডাক্তারের মুখ লাল হয়ে উঠেছে৷ নিঃশ্বাসের শব্দ সমস্ত ঘরে শোনা যায় এখন৷

ইন্সপেক্টরের দিকে ফোনটা এগিয়ে দেয় পায়েল, এই ফোনের মেলবক্স ঘাঁটলে দেখতে পাবেন বিদেশবাসী এক বন্ধুর সঙ্গে এই নিয়ে নিয়মিত কথা হত তাঁর৷ শুধুমাত্র মন্দিরের হদিশ দিলে ডাক্তারের ভাগ্যে কিছুই জুটবে না, তিনি গবেষণা করে ব্যাকটিরিয়ার সম্পূর্ণ তথ্য নিয়ে থিসিস লিখতে চান৷ কিন্তু ঘর না খুলে সেটা সম্ভব নয়… অগত্যা…’

সুবীর চৌধুরীর দিকে তাকায় পায়েল, ‘আপনারা ঘরটা খোলার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন কাকু? মন্দির থেকে ভেসে আসা গোঙানির আওয়াজ আর মরা বেড়ালের রক্তশূন্য শরীর, তাই তো? সেইসব কারসাজি এই ছেলেটিকে দিয়েই করাতেন ডাক্তার, নিজে হাতে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত টানতে শিখিয়েছিলেন৷ ভেবেছিলেন সে খানিক বোকাসোকা বলে ভুল বোঝাতে পারবেন তাকে, ডাক্তার তাকে বোঝান যে বাড়ির লোককে ভয় দেখানোর জন্যেই কাজটা করছেন তিনি৷ কিন্তু দু-দিন পরে ছেলেটি বুঝতে পারে ডাক্তারের অন্য কিছু উদ্দেশ্য আছে, যেটা নিছক ভয় দেখানোর মতো নিরীহ নয়৷ সে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করতে থাকে ডাক্তারকে৷ শেষে বাড়ির লোককে বলে দেওয়ার ভয় দেখায়৷ বলাই বাহুল্য সেটা হলে ডাক্তারের সামাজিক সম্মান আর হাইবারনেটিং ব্যাকটিরিয়া দুটোই হাতছাড়া হবে… অতএব তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না, কিন্তু খুনটা হবে কী করে?

ডাক্তার রোগী দেখে রাত করে ফিরতেন, ছেলেটি পুকুরের সামনে জঙ্গলের ভিতরে লুকিয়ে থাকত, ডাক্তারকে হেঁটে আসতে দেখলে বুনোলতার ঝোপ নাড়িয়ে সংকেত দিত যে সে এসেছে, দু-দিন সে আনন্দদাকে ডাক্তার ভেবে ভুল করে…

যাই হোক, ডাক্তার বোঝেন রাতে ফেরার পথে জঙ্গলের সামনের রাস্তাতেই ছেলেটিকে একমাত্র খুন করতে পারেন তিনি, কিন্তু সেটা করতে গেলে খুব সহজেই ধরা পড়ে যাবেন, লাশ নিয়ে বেশিদূর যেতে গেলে কারও দেখে নেওয়ার সম্ভাবনা, আবার লাশ বাড়ির সামনে ফেলে রাখলে তিনি শেষ ফিরেছেন বলে তাঁর উপরেই সন্দেহ গিয়ে পড়বে৷ মাথা খাটিয়ে একটা উপায় বের করলেন তিনি, এমন একটা অ্যালিবাই তৈরি করলেন যাতে শুধু তিনি কেন এ বাড়ির কারও উপরেই সন্দেহ পড়বে না, বাড়ি খানাতল্লাশিও হবে না৷

খুনের আগের দিন রাতে তাকে অজ্ঞান করে ঘরে নিয়ে আসেন ডাক্তার… বাকি ঘটনা আপনারা জানেন…..’

দালানের ভিতরের ভারী বাতাস থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে এবার৷ ডাক্তারের দিকে ফিরে তাকিয়েছে সবাই৷ তিনি যেন মুখ নিচু করে অনেকক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ পুলিশের দলটার মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে তাঁর কাঁধে একটা হাত রাখেন৷

পায়েল রুমাল দিয়ে চোখ-মুখ মুছে একটা বোতল তুলে নিয়ে কিছুটা জল খায়, বোঝা যায় এতক্ষণ কথা বলে গলা শুকিয়ে গেছে তার৷ জলটা শেষ করে গোস্বামীর কাছে এগিয়ে আসে সে, মুখ নামিয়ে চাপা স্বরে বলে, ‘বাচ্চা ছেলেটাকে দু’ঘা দিলেই গড়গড় করে স্বীকার করে নেবে, তবে যা চেহারা তিন ঘা দিলে খাল্লাস হয়ে যেতে পারে৷ আমার শুধু একটাই রিকোয়েস্ট আছে স্যার৷’

‘কী?’ সরু হাসি হেসে বলেন গোস্বামী৷

‘আমাকে কোর্টে টানাটানি করবেন না প্লিজ, বাবা জানতে পারলে ঠেঙিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে৷’

(আট)

মাটির রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে স্কুটিটা দাঁড় করাল পায়েল৷ পিচের রাস্তা শুরু হয়েছে৷ একটা ছোট বাসস্ট্যান্ড৷ এখানেই স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার বাস আসবে৷ পায়েল আর কলি দু-জনেই স্কুটি থেকে নেমে বাসস্টান্ডের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল৷

পায়েলের ব্যাগটা কলির কাঁধে ছিল, সেটা মাটিতে নামিয়ে বলল, ‘সবার প্রশ্নের উত্তর দিলি৷ তাও আমার মাথা থেকে একটা প্রশ্ন যাচ্ছে না৷’

‘কী প্রশ্ন?’

ডাক্তারকাকা ছোট থেকে আছেন এখানে৷ কারও খারাপ করেছেন বলে শুনিনি, কারও কারও বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন৷ সেই মানুষটার একটা বাচ্চা ছেলের নলি কাটতে গিয়ে হাত কাঁপল না?’

পায়েল হাতে ধরা সিগারেটে একটা টান দেয়, ভাবুক গলায় বলে, মনে হয় আমাদের সবার ভিতরেই একটা নিষ্পাপ শিশু থাকে, নিজেদের লোভ আর অ্যাম্বিশনের পিছনে ছুটতে গিয়ে সেই শিশুটাকে ঘরে বন্ধ করে মেরে ফেলি আমরা, তারপর সে যখ হয়ে সেই লোভ আর অ্যাম্বিশনগুলোকে আটকাতে থাকে শুধু…’

বাঁকা হাসে কলি, ‘মানে বলছিস, তোর ভিতরেও নিষ্পাপ শিশু আছে?’

‘নিষ্পাপ শিশু ইজ মাই মিডল নেম… তবে এই সেমেস্টারের শেষে শিশুটা যখ হতে চলেছে…’

‘কেন?’

‘পড়াশোনার যা হাল, চোতা ছাড়া গতি নেই৷’

দু-জনেই হেসে ওঠে৷ রাস্তার অপর প্রান্তে বাসের হর্ন শোনা যায়৷ পায়েলের বাস আসছে৷ মাটিতে পড়ে থাকা ব্যাগটা তুলে নিয়ে সে এগিয়ে যায়, ‘গুড বাই বাডি, ক-দিন পরেই কলেজে দেখা হচ্ছে, আসতা লা ভিসতা..!’

বাসের হর্নের শব্দে কলির কথা চাপা পড়ে যায়, তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একটা ছোট লাফে বাসে উঠে পড়ে পায়েল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *