কালীবাবু ও কালু
কালীবাবু সস্ত্রীক ইন্দ্রপুরী হাউসিং এস্টেটে গিয়েছিলেন কমরেড কানাই ঘোষালের ফ্ল্যাটে। অটোমেটিক লিফ্ট-এ সাত নম্বর বোতাম টিপতেই লিফ্ট চলছে সেভেন্থ ফ্লোরে। কী হাওয়া, ‘আরে এসো এসো।’ হাওয়ায় র-সিল্কের পর্দার উচ্ছ্বাস! হাওয়ায় লেনিনের ছবি দেওয়ালে দুলছে, ছৌ মুখোশ দুলছে, ‘বোসো, বোসো’, কালীবাবুর ডান হাত সোফার দিকে, সোফার কুশনে কোথাকার যেন ফোক আর্ট। ‘ওগো দেখে যাও, কালীপদ এসেছে সস্ত্রীক।’কালীবাবু বসলেন, বিড়ি ধরালেন। কানাই ঘোষাল লুঙ্গি ও গেঞ্জিতে ছিলেন। কানাইবাবুর স্ত্রী খদ্দরের পাঞ্জাবিটা কানাইবাবুকে এবং টেরাকোটা অ্যাশট্রে কালীপদকে এগিয়ে দিয়ে কালীপদর স্ত্রীর দিকে চেয়ে হাসলেন। ‘তবে এসেছ, বাব্বাঃ, শেষ কবে দেখা হয়েছিল য্যানো, মার্কাস স্কোয়ারে, সলিল চৌধুরির ফাংশনে, মনে আছে?’
ম্যাক্সি পরা একটি মেয়ে উঁকি দিতেই কানাইবাবু ওকে ডাকলেন। ‘শ্রেয়া আমার পুত্রবধূ। বিয়েতে তোমাদের বলেছিলাম তো, এলে না।’
তখন চৌধুরি কেমিক্যালস-এ স্ট্রাইক চলছিল না! সে সময় খুব ঝামেলা চলছিল। তোমার ছেলে ফিরবে কখন, বহু বছর দেখিনি।
এখানে নেই তো, কোম্পানি ট্রেনিং-এ পাঠিয়েছে—বুদাপেস্ট।
বুদাপেস্ট? বাঃ আরও প্রমোশন হল বুঝি?
হ্যাঁ, এবার প্রজেক্ট ম্যানেজার হয়েছে।
কালীবাবু এবার তৈরি হয়ে নেন অবশ্যম্ভাবী পরের বাক্যটার জন্য… ‘এই ছেলে যখন জন্মাল, আমি তখন জেলে, পার্টি ব্যান। ছ’ বছর পর বেরিয়ে এসে দেখি রেখা কঙ্কাল হয়ে গেছে… জীবনে কম স্যাক্রিফাইস করিনি।’
রেখা, মানে, কালীপদবাবুর স্ত্রী। ভারতীকে পারিবারিক অ্যালবাম দেখাচ্ছিলেন। কালীবাবু ও কানাইবাবু ভাল চা আর খারাপ সমস্যায় জড়িত হয়েছিলেন। পেইন্ট কোম্পানিগুলোতে ধর্মঘট চলছে। কালীবাবু পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিস শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। পেইন্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনেকগুলি মালটিন্যাশনাল কোম্পানি আছে। ভারতে একাধিক ফ্যাক্টারি। ওরা অন্য প্রদেশের ফ্যাক্টরির প্রডাকশনে মার্কেট রেখে দিয়েছে। ওদের লেবাররা মোটামুটি ভাল বেতন পাচ্ছে। ওরা ধর্মঘট চালাবার বিপক্ষে। ছোট কোম্পানির লেবাররা জঙ্গি! ওরা মালিকের শর্তে স্ট্রাইক উইথড্র করতে রাজি নয়। দুটো বাইপারটাইট হয়ে গেছে, ট্রাইপারটাইট হবে। মিনিস্ট্রি থেকে চাপ আসছে উইথড্র করার জন্য। লেবার ইন্ডাস্ট্রির কোনও পোর্টফোলিয়োই কালীবাবুদের পার্টির মিনিস্টারদের হাতে নেই। এখন কালীবাবুর কী স্ট্যান্ড নেওয়া উচিত, আগামী মিটিং-এ এটা উঠবে, তার আগেই আলোচনার জন্য এই হাই লেভেলে আসা।
জানালায় কী হাওয়া—হাওয়া। নীচে কলকাতা শহর যেন ঝুলন সাজানো।
অ্যালবাম খুলে রেখা বলে যায়… এটা ১৯৪২-এর ভারত ছাড়োর সময়ের। এই যে ৫৫-তে জেল থেকে ছাড়া পাবার। মুখভরতি দাড়ি। ৬৭-তে বিধানসভায় প্রথম ঢোকা। ৬৯ সালে নির্বাচন জয়ের পর এই যে, ছেলে-বৌমার সঙ্গে আমাদের রঙিন ছবি ৮০-তে। এই যে ডেলিগেশনে মস্কো। ৮১-তে, তাই না? …ওই দ্যাখো…সেই মস্কোর বিখ্যাত ঘণ্টা। রেডস্কোয়ার কী সুন্দর না। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে করমর্দনরত। মিসেস গান্ধীর বেগুনি শাড়ি রুদ্রাক্ষের মালা সব স্পষ্ট। এবার ছেলের বিয়ের ছবিগুলো দ্যাখো…
৮২-র নির্বাচনে কলকাতার একটি কেন্দ্র থেকে পরাজিত হয়েছিলেন কমরেড কানাই ঘোষাল। এখন পার্টি সংগঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।
খুব হাওয়া। কোথেকে একটা অশ্বথপাতা জানালা দিয়ে ঢুকল।
আপনার ফ্ল্যাটটা সত্যিই খুব সুন্দর কানাইদা, কালীপদর স্ত্রী বলল।
আমার ফ্ল্যাটটা বলছ কেন ভারতী, আমার কি এসব পোষায়? ছেলে অফিস লোনের টাকায় ফ্ল্যাটটা কিনেছে, আমার ঘরে দ্যাখো গে যাও তক্তপোশেই শুচ্ছি… সেই বিড়িই খাচ্ছি।
গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল কানাইবাবু। প্রাচীরের গায়ে গেঞ্জি ও জিন্স পরা টিন এজার। গেটের সামনে ইউক্যালিপটাস ও দারোয়ান।
গেট থেকে বেরিয়েই কালীবাবুর স্ত্রীর প্রথম কথাটিই হল— ন্যাকামি… ছেলের লোনে কেনা…।
কালীপদ বলে থামোঃ।
ভারতী বলে যায়— তখন মিনিস্টার ছিল বলেই ছেলের ওই চাকরি, ফ্ল্যাট… যেন কেউ কিছু বোঝে না।
মিনিবাসে বসার জায়গা পেয়ে স্ত্রীর পাশে বসে কালীবাবু হাতে মৃদু খামচি সমেত শোনেন— ‘আমাদের একটা ফ্ল্যাট হয় না?—এত ভাল দরকার নেই, নিজেদের একটা ফ্ল্যাট হলে বেশ ইয়ে হয়।’
মিনিবাসে চোখ বুজে কালীবাবু নিজেকে একটা ফ্ল্যাটে কল্পনা করছিলেন, …আঃ, কেমন যেন লাগবে। কী কালীবাবু, কোথায় থাকেন? না—ইন্দ্রপুরী অ্যাপার্টমেন্ট বালিগঞ্জ, অ্যাঃ, এইসব ফ্ল্যাটে, গুড মর্নিং, সি ইউ-ইম্পসিবল।
মহিম হালদার লেনের বাসাবাড়িতে ঢুকেই প্রথমেই সোঁদা গন্ধটা পেয়ে যায়। গত বাইশ বছরের চেনা গন্ধ। উঠানে উচ্ছিষ্ট। সিঁড়ির মুখেই কমন বাথরুমটা।
বহু বছরের আত্মীয় গন্ধগুলিকে আজ ভারতীর দুর্গন্ধ মনে হয়, নোংরা মনে হয় আজ, খারাপ লাগে।
আচ্ছা, তুমি লোন পেতে পারো না?
শোধ করব কী করে?
আচ্ছা, আমাদের কত জমানো আছে একটু হিসেব করে দ্যাখো না—
ধুস।
দ্যাখোই না—
পুঁজিবাদের সংকট ও এ বছরের বাজেট’। বুকলেটটার প্রচ্ছদের পিছনে কীসব আঁকিবুকি কাটল, কালীপদ। আমার চার হাজারও যোগ করে নাও, ভারতী বলল। কালীপদ ভারতীর দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল— একটা ফ্ল্যাট কেনার ওয়ান টেন্থও নেই।
দেশের জমিটা বেচে দিলে?
কালীবাবুদের কিছুটা, পৈতৃক ধানী জমি আছে। জমিটা বর্গা দেওয়া আছে। বর্গা রেকর্ডিংও হয়েছে। কালীবাবু নিজে সামনে দাড়িয়ে থেকে বর্গা রেকর্ডিং করিয়েছিলেন, যে কারণে গ্রামপঞ্চায়েত কমরেড কালীবাবু জিন্দাবাদ পোস্টার মেরেছিল।
কালীবাবুর জমিতে যার বর্গা ছিল তার নাম কালীচরণ। সে কালীবাবুর চরণে হাত দিয়ে বলেছিল, আপনার কেনা গোলাম হয়ে রইলাম। কালীবাবু ওর দু’হাত টেনে ওঠালেন।
ছিঃ গোলাম-টোলাম এসব কি বলছিস কালু… আমরা সবাই সমান।
কালীবাবু এখন জমিটা বিক্রি করতে চাইলে—বর্গা সমেত বিক্রি করতে হবে। ফলে জমির দাম অনেক কমে যায়। বর্গা না থাকলে দামটা পাওয়া যেত। কিন্তু বর্গা উচ্ছেদ করা কালীবাবুর পক্ষে কি সম্ভব?
ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে মালিক পক্ষ বলেন— ওয়াশিং অ্যালাউন্স বাবদ সামান্য কিছু এবং যৎসামান্য দুর্মূল্যভাতা বাড়াতে রাজি। সরকারের প্রতিনিধি দুর্মূল্যভাতা আরও কিছু বাড়াবার জন্য অনুরোধ করে জরুরি কাজে বাইরে গেলেন। কালীবাবু বললেন— আমাদের আসল ডিমান্ড হল হেল্থ সিকিউরিটি। রং কারখানার খারাপ পরিবেশে কাজ করতে হয়। ফ্রি মেডিক্যাল এবং কমপেনসেটরি ফুড অ্যালাউন্সের ডিমান্ড থেকে আমরা এক চুলও নড়ছি না।
মালিকপক্ষের একজন কালীবাবুর চেয়ারের পাশে এসে বসলেন। বললেন— অন্য প্রভিনসের মাল বাজার দখল করে ফেলেছে। ধর্মঘট চলতে দিলে ছোট এবং মাঝারি কোম্পানিগুলো রুইন্ড হয়ে যাবে। এখন ধর্মঘট তুলে নিন, পরে আলাপ আলোচনা করা যাবে। এ ব্যাপারে, ডোন্ট মাইন্ড, আপনাদের জন্য টেন থাউজ্যান্ড খরচ করতে রাজি আছি। ভেবে দেখুন।
কালীপদ সোজা দাঁড়িয়ে ওঠে। বলে— লাল ঝান্ডার ইউনিয়ন করি, কথাবার্তা ঠিক করে বলবেন।
কিছুদিন হয় কালীপদর স্ত্রীর কাছে মহিম হালদার লেনের এই বাসা নরকের মতো মনে হচ্ছে। বাথরুম গেলে বমি বমি লাগছে।
কালীবাবুকে ভারতী আজ নালিশ করল— আজ সকালে সিঁড়ির কোনায় ঘুঁটে রাখা নিয়ে মল্লিকবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে ভারতীর ঝগড়া হয়েছে। মল্লিকবাবুর স্ত্রী যখন মুখ ঝামটি মেরে বলেছে— কত গল্প মারাও… সব মন্ত্রীই আমার কর্তার বন্ধু, কত শুনি, তা যাও না, সল্টলেকের ফ্ল্যাটে যাও। ভারতী বলেছে— যাবই তো, তোমাদের মতো ছোটলোকদের সঙ্গে আর থাকব না, মরে গেলেও না। আজ আমাদের কেয়াকে কী করেছে জানো? কেয়া যখন বাথরুম ছিল, ভজহরিবাবু উঁকি দিয়েছে।
ভারতের ৮৯ শতাংশ পরিবার পাকাবাড়িতে থাকে না, যারা পাকাবাড়িতে থাকতে পায়, তাদের ৭৪ শতাংশের পৃথক জলকল নেই। এটা অবশ্য স্ত্রীকে বললেন না কালীপদবাবু, তেমনি এটাও বললেন না গত দু’ বছরে কালীবাবুর বন্ধুস্থানীয়দের মধ্যে বেশ কয়েকজন তো ফ্ল্যাট বাড়ি ম্যানিজ করেছেন, কয়েকজন মিনিবাস, দু-একজন রেশনের দোকান।
কানাইবাবু ডেকে পাঠালেন। কালীবাবু সাততলার ফ্ল্যাটে কলিংবেল টিপতেই হাওয়া। হাওয়ায় চুরুটের গন্ধ। সোফায় মন্ত্রী। বড় পার্টির মন্ত্রী। কালীপদ জানে সরকারি ফ্ল্যাট বিলির ব্যাপারে এনার কতটা ক্ষমতা।
কানাইবাবু বললেন— শিল্পে একটা পিসফুল অ্যাটমোসফিয়ার তৈরি করার ব্যাপারে আমাদের পার্টি নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে। মন্ত্রী চা কেড়ে নিয়ে বললেন— বিচ্ছিন্নভাবে এই ধরনের আন্দোলন শিল্প পরিবেশকে ডিসটার্ব করে। আমরা যৌথ উদ্যোগ যখন স্কিম হিসেবেই নিয়েছি, তখন আমাদের এই রাজ্যে এমন কিছু করা উচিত হবে না…
কালীপদ বুঝতে পারে না— কার মুখ থেকে এই কথা শুনছে— চেম্বার অফ কমার্সের কোনও চাঁই নয়, কমরেড বিকাশ মজুমদার, যার কথা শুনে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ তুচ্ছ করে…
কালীপদ বলে, পার্টির যা ডিসিশন হবে, আমি তাই করব।
কানাইবাবু বললেন, তুমি যা ডিসিশন নেবে, পাটি তাই মেনে নেবে।
কালীপদ মাথা চুলকায়।
বুকের ভিতর জেট প্লেনের শব্দ, ফ্যান দাও, আল্লাহ আকবর—বন্দেমাতরম— ইয়ে আজাদি ঝুটা হায়— সব একাকার হয়ে যায়।
কানাই বললেন, বাই দি বাই, তুমি সেদিন ফোনে ফ্ল্যাটের কথা বলেছিলে না, ফ্ল্যাটের মালিককেই বলো।
মন্ত্রী বললেন— কানাইবাবু বলেছিলেন। পলিটিক্যাল সাফারারের কোটায় কয়েকটা ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে। সিক্সটি পার্সেন্ট ইনস্টলমেন্টের ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। এই চিঠিটা নিয়ে ইমিডিয়েট দপ্তরে গিয়ে…
শুনুন কালীপদবাবু, একটা মালটিন্যাশনাল কোম্পানি নৈহাটিতে একটা পেইন্ট ফ্যাক্টরি করবে বলে জমি কিনেছে। এখন বলছে করবে না। আমরা বোঝাচ্ছি এই সময় স্ট্রাইকটা হঠকারিতা হবে। ‘বুঝলেন না?’…
‘বুঝলেন না’ শব্দটার মধ্যে একটা স্ট্রেস পড়াতে কালীপদর কাছে ওটা একটা মাইল্ড হুমকির মতো লাগল।
পেইন্ট শ্রমিক ধর্মঘট মিটল। মূল দাবি মিটল না। খুচরো কয়েকটা কনসেশন শ্রমিকরা পেল।
কালীবাবুদের পার্টির কাগজে এটাকে শ্রমিক-শ্রেণির বিরাট জয়লাভ হেডিং-এ খবর ছাপা হল।
কালীপদবাবু ইতিমধ্যে আবাসন দপ্তরে এসেছেন। পলিটিক্যাল সাফারারের কোটায় ফ্ল্যাট হয়ে যেতে পারে। জেল খাটার ডকুমেন্টটা খুঁজতে থাকেন। জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা।
কালীবাবু হিসাব কষে ফেলেছেন। ফর্টি পার্সেন্ট ক্যাশ ডাউন করতে হলেও আরও হাজার বিশেক দরকার। গ্রামের জমিটা…
আবাসন দপ্তরের অফিসারটি বলেন— যা করার তাড়াতাড়ি করুন। আপনার ফ্ল্যাটটা আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারব না বোধহয়।
কালীপদবাবু দেশে গেলেন। সোজা কালীচরণের ঘরে। কালীপদবাবু বললেন— বড় বিপদে পড়ে তোর কাছে এসেছিলুম কালু। আমাকে বাঁচা—।
কেনে কী হিছে কমরেট?
কালীপদবাবু কমরেড কথাটা শুনে প্রবল আশ্চর্যান্বিত হল।
কালীপদ বলল— ভীষণ বিপদ রে, কলকাতার বাসাটা ভেঙে দিচ্ছে কর্পোরেশন। নতুন ফ্ল্যাট কিনতে হলে অনেক টাকা চাই। তুই স্বেচ্ছায় বর্গাস্বত্ব ছেড়ে দিলে তোকে কিছু টাকা দেব। তা ছাড়া, যদি চাস, একটা কারখানায় চাকরির ব্যবস্থাও চেষ্টা করে ফেলব। জমিটা ছেড়ে দে।
কালু এতক্ষণ চিন্তা করে। বলে— অন্য কমরেটদের জিজ্ঞাস জেনে নিয়ে বলব।
ব্যাপারটা কালীবাবুর খুব খারাপ লাগে না। গ্রামে বেশ চেতনা এসেছে, তা হলে এতদিনের আন্দোলন একেবারে বিফলে যায়নি।
কালু যদি আলটিমেটলি রিফিউজ করে, তবে তো ব্যাপারটা মিটেই গেল। ওকে তো আর জোর জবরদস্তি করবে না, মনের দিক থেকেও কালীবাবু খালাস। সরকার ক্ষমতায় আছে, অনেকেই গুছিয়ে নিচ্ছে। কালীপদ পারল না। তাতে কী হয়েছে? মহিম হালদার লেনের বাসাবাড়িই বা মন্দ কী? ভারতবর্ষে ৮৯ শতাংশ মানুষ কাচাবাড়িতে…।
পঞ্চায়েতের প্রধানের সঙ্গে দ্যাখা। উনি আবার প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। ১৬ বিঘে ধানী জমি, হালে ছেলের একটা রেশন দোকান হয়েছে। উনি কালীবাবুকে খাতির-যত্ন করলেন। দুধমারা ক্ষীরের সন্দেশ খাওয়ালেন। সমস্যার কথা শুনলেন। বললেন— কালই করে দিচ্ছি।
পঞ্চায়েত প্রধান কালুকে ডাকা করালেন। বললেন—তুই হলি একটা বোকা হাঁদা, তুই তোত্ড়া বটিস। এ সুযোগ হারালে তোর ছেইল্যা তোকে বাখান কইরবে। জমিটা যে দামে বিক্রি হবে, তার দু’আনা তোর নামে ব্যাংকে রাখা করিয়ে দুব। ষোলো হাজার হলে দু’হাজার তোর, তা ছাড়া চাকরি পাচ্ছিস। কোথায়— না কলকাতা শহরে— মিছিলে কলকাতা গেলে তো হাঁ করে শহর দেখিস। কোটা দালান, বাইস্কোপ ঘর দেখিস, সেই শহরে থাকবি তুই, আর এই কাঁকইড়া জমিতে পাছিসটা কী তুই? না দিছিস সার জল, না পাছিস ফসল।
কালুর সঙ্গে আসা খাড়া চুলের তেড়িয়া ছেলেটা বলল— বুঝি, বুঝি। কমরেটই হন আর যেই হন, বাবু বাবু ভাই ভাই।
ওই ছেলেটির দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকল কালীপদ। কালীপদর বুকের ভিতর থেকে একটা হাত জন্ম দিল তখন। ওই অদৃশ্য হাত ছেলেটির পিঠে প্রশ্রয়ের মৃদু চাপড় মারতে থাকল। একেই তো চেতনা বলে। এতদিনের বামপন্থী আন্দোলন কিছুতেই মিছিমিছি নয়। কালীপদ কিন্তু আসলে স্থাণুই থাকে মাথা নিচু করে। এবং নিজেকে ঢেকে রাখবার জন্য একটা অলৌকিক আচ্ছাদন কামনা করতে থাকে।
কালু তখন বলে— শহরে তবে কাজ হব্যে বলতেছেন…
কালীবাবু মৃদু মাথা নাড়ে।
আড়াই হাজার লগদ বলতেছেন…
কালীবাবু মৃদু মাথা নাড়ে।
ঠিক আছে তবে, বর্গা ছেড়ে দুব কেনে…
কালুর মুখখানা তখন কাঁচাধানের শিষ চুরি হওয়া ধানমাঠের মতো।
পঞ্চায়েতের প্রধান বলেন, শ’ পাঁচেক ট্যাকা ওর হাতে দিয়ে দেন কালীবাবু। কালীবাবু দেয়। শুকনো শীর্ণ হাতে কালু টাকা ক’টা নেয়। মুঠো করে দলামোচড়া করে। তারপর ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রধান বলেন বিকেলে আসিস রে কালু। কাগজ তৈরি করাচ্ছি। ছাপ দিবি। কালু চলে যায়।
প্রধান কালীবাবুর কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়ে বলেন, জমিটা কিন্তু আমার শালাকেই দিবেন। শালার জমিটা ওর লাগোয়া।
বিকেলে কালু আসে, টিপ ছাপ দেবে। কালুর কপালে মাটি; গায়ে, হাতে, পায়ে, কাদামাটির চিহ্ন, শুকিয়ে যাওয়া রক্তবিন্দু। কানের গহ্বরে শুকনো দুব্বো ঘাস। চোখ লাল।
এতক্ষণ তুই লুটিয়েছিলি বুঝি, গড়াগড়ি দিয়েছিলি তোর ওই ভুঁয়ে? জড়িয়ে ধরেছিলি বুঝি জে এল নম্বর তিনশো বারোর ওই মনভাসানি মৌজার সাঁইতিরিশ আর আটতিরিশ নম্বর দাগ? বিদায় জড়ানো। আর তখন ওই মাঠের আল, ঝরা ধান, ইঁদুর গর্ত, জমা জল, কাঁটানটে, উচ্চিংড়ে, আর কেঁচো কেন্নোর তাবৎ ইতিহাস, জল্পকথা আর মর্মবৃত্তান্ত বয়ে নিয়ে তোর চোখে বয়ে গেছে জল। রাগ হয়নি তোর? ক্ষোভ?
কালীপদর দু’হাত নড়ে ওঠে। সামনে এগোয়, বিস্তৃত হয়। কালুর দু’কাঁধ স্পর্শ করে। বলে— না।
কালীপদ পারল না। না পারার তুমুল আনন্দ নিয়ে ফিরে গেল মহিম হালদার লেনের বাসাবাড়িতে, নোংরা জল মাড়িয়ে মাড়িয়ে।
ভারতবর্ষের ৮৯ শতাংশ মানুষ পাকাবাড়িতে থাকে না, যারা থাকে তাদের ৭৪ শতাংশের…
এবং এ সময়, ১৯৮৫