কালীঘাটের পাখা
‘এসি পাখা ডিসি পাখা আকাশের কানে কানে
শিশি বোতল রেগুলেটার সরু সরু গানে গানে’
কোনও পণ্ডিত পাঠক যাতে মনে না করেন যে এই অসামান্য পঙ্ক্তি দুটি এই ব্যর্থ কবির রচনা, সেই জন্যে প্রথমেই তাঁর ভ্রম নিরসন করা দরকার। এই শ্লোকটি মূলত সুকুমার রায়ের এবং প্রয়োজনবোধে এর কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন আমার স্বর্গীয় অগ্রজ। আমার দাদা সাত বছর পরলোকে গিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে রসিকতা করব না, কিন্তু ঘটনাটা একটু বলি।
অনেকদিন কবিতা লেখা হয়নি। একটি কবিতা লেখার খুব চেষ্টা করছিলাম, কলম দিয়ে ঝলমল করে বেরিয়ে এল।
‘এসি পাখা ডিসি পাখা আকাশের কানে কানে…’
একটু পরে হৃদয়ঙ্গম হল লিখনদেবী চান না যে আমি কবিতা লিখি, সুতরাং আবার কাণ্ডজ্ঞান।
এসি পাখা আজকাল সব বাড়িতেই আছে, কিন্তু এই শ্লোকের ডিসি পাখাটি ছিল আমাদের কালীঘাট বাড়িতে। এই পাখাটিকে অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছে, এই কলকাতা শহরের বহু নামকরা লোক আছেন যাঁরা এই পাখাটির হাওয়া খেয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনও চোখ বুজে একটু চেষ্টা করলেই পাখাটিকে স্পষ্ট দেখতে পান বনবন করে ঘুরছে।
কোনও সাধারণ জিনিস ছিল না আমাদের এই পাখাটি। অন্য পাখায় যেখানে তিনটি ব্লেড থাকে, এর ছিল চারটি। প্রত্যেকটি এক সমকোণে নব্বুই ডিগ্রিতে পাশেরটির লম্ব। তিনটি ব্লেড ছিল টিন বা ওই জাতীয় কোনও ধাতুজ দ্রব্যের। কয়েক বছর পর পর একেকবার একেক রকম রং করতে করতে পাখাটি শেষ পর্যন্ত একটা ঝাপসা কালো রঙের চেহারা ধারণ করেছিল। সম্পূর্ণ কালো নয়, যখন অন্ধকারে চলত তখনও ঝাপসা ভাবটা দেখা যেত।
এর অবশ্য অন্য একটি কারণ ছিল। ওই পাখাটির চতুর্থ ব্লেডটি ছিল কাঠের এবং সেটা কী কাঠ ছিল, ভগবান জানেন, তাতে বিশেষ কোনও রং ধরত না। তা ছাড়া একবার সামান্য হালকা রং করার পরই কাঠের ব্লেডটি একটু বেঁকে যায়, তারপর থেকে রং করার সময় ওটাকে বাদ দিয়েই রং করা হত।
পাখাটির গায়ে অর্ধস্পষ্ট ইংরেজি হরফে লেখা ছিল, Government of Bengal, Excise Department, তার নীচে (98), ব্র্যাকেটেই।
আমাদের কোনও কোনও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ধারণা ছিল পাখাটি আমরা গভর্মেন্টের কোথাও থেকে চুরি করেছি। এক নীতিবাগীশ মাস্টারমশাই আমার ছোটভাই বিজনকে পড়াতেন, ওই পাখাটাই ছিল পড়ার জায়গায়, তিনি ওটার হাওয়া কিছুতেই খেতে চাইতেন না, এদিকে বিজনের গরমে লেখাপড়া হত না, শেষ পর্যন্ত বিজনের লেখাপড়াটাই বরবাদ হয়ে গেল।
অন্য কারও কারও বিশ্বাস ছিল যে আমার পূর্বপুরুষেরা প্রচুর মদ-গাঁজা খেতেন, এই বাবদ সরকারের আবগারি বিভাগের প্রচুর আয় হত এবং এই সব বিবেচনা করে এই ইলেকট্রিক পাখাটি সদাশয় সরকার বাহাদুর আমাদের পরিবারকে উপহার দিয়েছিলেন।
এসব কোনও কথাই সত্য নয়। আমার আগের চৌদ্দ পুরুষে কারও সরকারের সঙ্গে কোনও সম্বন্ধই ছিল না। সরকারের ঘর থেকে পাখা চুরি করে আনা কিংবা সরকারের কাছ থেকে পাখা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা আমাদের বংশের ছিল না।
রহস্যটা এই যে, সরকারি ডিসপোজাল থেকে আমার দাদাবাবু এই পাখাটি এগারো টাকা আট অনা দিয়ে নিলামে কিনেছিলেন, সেও অনন্তকাল আগে।
রডটা কখনও রং করা হয়নি, বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সরকারি হরফগুলি পাঠ করা যেত। এমনিতে কৌতূহলী লোকদের বোঝালে বুঝত, কিন্তু মুশকিল ছিল ওই নাইনটি-এইট সংখ্যাটি নিয়ে।
পাখাটি কি আটানব্বুই সালের, তার মানে আঠারোশো আটানব্বুই! তার মাত্র কয়েক বছর আগে ইডেন গার্ডেনে কলকাতার প্রথম ইলেকট্রিক আলো এসেছে, কলকাতার লোকে দল বেঁধে সন্ধ্যাবেলা সেই আলো দেখতে যেত। সেই অর্থে পাখাটি যথেষ্ট প্রাচীন। তা হতেও পারে। আবার এমনও হতে পারে যে পাখাটি এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টের আটানব্বুই নম্বর পাখা ছিল। সে আমলে আবগারি বিভাগ কত বড় ছিল, তাদের এই আটানব্বুইটা কিংবা ততোধিক পাখা কীভাবে ব্যবহৃত হত, তাদের শরীর বা মাথা এত গরম হত কেন, এসব প্রশ্নও সঙ্গে সঙ্গে এসে যায়।
এসব তাত্ত্বিক প্রশ্ন না তুলে পাখাটির আগাগোড়া, যতটুকু এখনও মনে আছে, বর্ণনা করছি।
আমাদের ওই পাখাটির সবচেয়ে বিচিত্র অংশটি ছিল এর রেগুলেটার এবং সেই জন্যই বোধহয় আমার দাদা এসি পাখা ডিসি পাখার গানে রেগুলেটার শব্দটি ঢুকিয়েছিলেন।
আটাত্তর আর পি এম-এর গ্রামোফোন রেকর্ডের বাক্সের মতো আকারের কালো চৌকো রেগুলেটার, তার উপরের দিকে একটি সিংহের ছবি আঁকা, যার থাবার নীচে একটি মরা মোষ কিংবা গোরু পড়ে রয়েছে।
রেগুলেটারটির আটটি ঘর, কিন্তু এক থেকে আট সব ঘরেই সমান গতিতে চলত এবং সে সাংঘাতিক গতি। দু’ মিনিট-আড়াই মিনিট পর পর রেগুলেটারটি একটু কেঁপে উঠত, তখন পাখাটা একটু কমে যেত।
আধঘণ্টা পাখা চললে রেগুলেটার গনগনে গরম হয়ে যেত। এ সময় অনেক লোক না বুঝে হাত দিয়ে লাফিয়ে উঠেছে, রেগুলেটারের ছোঁয়ায় হাতে ফোসকা পড়ে গেছে।
আমাদের কিন্তু খুবই সুবিধে হয়েছিল। আমরা ওই রেগুলেটারের গায়ে ধরে পাঁউরুটি টোস্ট করে নিতাম। রেগুলেটারের উপর দিকে টিনের কৌটোয় বসিয়ে আমার দিদিমা তাঁর দোক্তার ধনে মৌরি ভেজে নিতেন।
খুবই কাজের ছিল ওই রেগুলেটার কিন্তু শেষের দিকে পাখাটা বিরুদ্ধাচরণ শুরু করল। পাখাটা খুললেই গোঁ গোঁ করে বুনো ষাঁড়ের মতো করতে থাকত। পুরো পাড়া থরথর করে কাঁপতে থাকত। অনেক বাড়ির কম পাওয়ারের বালব পুট করে ফেটে চৌচির হয়ে যেত। অনেকের রেডিয়োতে এক সঙ্গে তিন-চারটে সেন্টার চলে আসত।
আমাদের কোনও অসুবিধা হত না। অন্তিম পর্বে পাখাটা চালানোর একটু আগেই দেখে নিতাম আমাদের নিজেদের জিনিসপত্র, আলো-পাখা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সব বন্ধ আছে কি না। বন্ধ না থাকলে সব বন্ধ করে নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর পাখাটা চালু করতাম।
সবচেয়ে সুবিধে ছিল রাতের বেলায়। পাখাটা চালালে আর অন্ধকার ঘরে আলোর দরকার হত না। পাখাটার ভিতর থেকে আলো ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসত, শুধু আমাদের ঘরে নয়, জানলা দরজা খোলা থাকলে আশপাশের ঘরবাড়ি আলোয় আলোময় হয়ে যেত।
পাড়ার লোকেরা অনেক চেষ্টা করেছিল, থানা-পুলিশ, আইন আদালত। কিন্তু কেউ তাদের পাত্তা দেয়নি। এই বিচিত্র পাখার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। অবশ্য আমরা খুব নির্দয় ছিলাম না। একবার এক প্রতিবেশী নবদম্পতির অনুরোধে তাদের ফুলশয্যার সময় দুই সপ্তাহ আমরা পাখাটি বন্ধ রেখেছিলাম।
আরেকবার পাশের বাড়ির ছাদে পাড়ার ছেলেরা রবীন্দ্রজয়ন্তী করেছিল, ছাদে ইলেকট্রিক ছিল না, তাদের আলো পাওয়ার জন্য আমরা পাখাটি আমাদের বিনা প্রয়োজনেই চালিয়ে ছিলাম।
অবশেষে আমাদের প্রকৃত ক্ষতি হয় চিন-যুদ্ধের সময় বাষট্টি সালে। ব্ল্যাকআউট আইন ভঙ্গ করার অপরাধে একদিন সরেজমিন তদন্ত করে সিভিল ডিফেন্স দফতর আমাদের পাখাটি বাজেয়াপ্ত করে।
তারপর আর পাখাটির কোনও খোঁজ পাইনি। আজ যখন চারদিকে অন্ধকার, অঘোষিত ব্ল্যাকআউট, সেই পাখাটির কথা কখনও কখনও মনে পড়ে।