কালীগঞ্জের প্যাকাটি – শিশির বিশ্বাস

কালীগঞ্জের প্যাকাটি – শিশির বিশ্বাস

ল্যাপটপ খুলে কাজ করেছিলেন দিবাকর রায়। রাত হয়েছে বেশ। ছোটো মফসসল শহর কালীগঞ্জ প্রায় নিঝুম। কালীগঞ্জের এই বাড়িটা অবশ্য বন্ধু রাজীবের। চাকরি নিয়ে বছর কয়েক হল আছেন এখানে। দিবাকরের মতোই এখনও বিয়ে-থা করেননি। তবে গোছানো মানুষ। সস্তায় পেয়ে অল্পদিন হল কিনে ফেলেছেন একতলা ছোটো বাড়িটা। একাই থাকেন। অফিসের কাজে দিনকয়েকের জন্য টুরে বেরিয়েছেন। বাড়িটা খালিই পড়ে ছিল। খবরটা পেয়ে দিবাকর আর সময় নষ্ট করেননি। কলকাতায় এক স্কুলে পড়ান। সম্প্রতি পিএইচ-ডি করছেন। থিসিস লেখার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দরকার ছিল দিনকয়েকের জন্য একটু নিরিবিলি ব্যবস্থা। তাই চলে এসেছেন এখানে। যাবতীয় দরকারি নোটস ভরে নিয়েছেন ল্যাপটপে। এ ছাড়া প্রয়োজনে ডেটা কার্ড আর ওয়েবসাইট তো রয়েছেই। জায়গাটাও মন্দ নয়। ছোটো শহর হলেও কলকাতা থেকে তেমন দূরে নয়। সব সুবিধেই রয়েছে। অথচ বেশ নিরিবিলি। সমস্যা একটাই, ভয়ানক সমস্যা। কালীগঞ্জে পা দিয়েই সেটা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছেন। চারপাশে পানাপুকুর, খোলা নর্দমা। তাই অসম্ভব মশার উপদ্রব। দিনেরবেলা তবু একরকম। সন্ধে নামলে আর রেহাই নেই। রাজীব অবশ্য আগেই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। দিনকালও ভালো নয়। দিবাকর তাই সন্ধে হলেই মশারি খাটিয়ে ল্যাপটপ আর খাতাপত্র নিয়ে ঢুকে পড়েন বিছানায়। এভাবে কাজ করতে অসুবিধে হয় খুবই। ভয়ানক অস্বস্তিকর। কিন্তু উপায় নেই। দিন দুয়েকের কাজ বাকি। তারপরেই পাততাড়ি গোটাবেন। শেষমুহূর্তে তাই বুঁদ হয়ে কাজ করছিলেন। হঠাৎ দেওয়াল ঘড়িতে টুং-টাং শব্দে সুরেলা আওয়াজ শুরু হল। রাত একটা।

ঘড়ির আওয়াজ তখনও শেষ হয়নি। হঠাৎ চটাত করে হালকা একটা শব্দ। খুব কাছেই। মুহূর্তে ভুরু কুঁচকে উঠল দিবাকরের। খেয়াল হল, ঠিক একঘন্টা আগে বারোটা বাজার সময়ও একবার আওয়াজটা শুনেছিলেন। তখন তেমন গ্রাহ্য করেননি। কিন্তু এবার আর তা সম্ভব নয়। কলকাতার নামি স্কুলের শিক্ষক। ছাত্র এবং সহকর্মীদের মহলে সুনাম রয়েছে যথেষ্ট। তবে নিজে ছাত্রজীবনে একেবারেই অন্য প্রকৃতির ছিলেন। ভয়ানক ডানপিটে। স্কুলে ভালো ছেলে বলে সুনাম ছিল। কিন্তু দুষ্টুমিতেও ছিলেন সেরা। এজন্য শাস্তিও কম পেতে হয়নি।

দিবাকর মশারির ভিতর থেকে সন্তর্পণে চোখ ঘোরলেন চারপাশে। সন্দেহজনক তেমন কিছুই নজরে পড়ল না। একা মানুষ রাজীব। ঘরে তেমন কিছুই নেই। বড়োসড়ো ঘরটা প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। ঘড়ির আওয়াজ থেমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। চারপাশ ফের নিস্তব্ধ। পিন পড়লেও শোনা যায়। একবার ভাবলেন শোনার ভুল বুঝি। কিন্তু নড়েচড়ে উঠলেন তারপরেই। রীতিমতো ঝাঁজালো গলায় হাঁকলেন, ‘খাটের তলায় কে রে?’

আওয়াজ উঁচু পরদায় না-হলেও ঝাঁজ ছিল যথেষ্ট। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। দিবাকর ফের হাঁকবেন কিনা ভাবছেন, হঠাৎ খাটের তলা থেকে চিঁ চিঁ আওয়াজ, ‘এজ্ঞে, আমি প্যাকাটি তিন। বড্ড মশা।’

সন্দেহ হয়েছিল ঠিকই। তাই বলে এতটা আশা করেননি। ততক্ষণে মশারির ভিতর থেকে বাইরে বের হয়ে এসেছেন। সামান্য হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘প্যাকাটি তিন! তার মানে?’

‘বললাম তো প্যাকাটি তিন। অধমের নাম।’ রীতিমতো অসহিষ্ণু গলায় জবাব এল খাটের তলা থেকে। তারপর মুহূর্তে গুঁড়ি মেরে বের হয়ে এল রোগা লিকলিকে চেহারার একটা মানুষ। পরনে মিশকালো ঝুলো হাফপ্যান্ট। গায়ে ওই রঙের ঢলঢলে একটা গেঞ্জি।

দিবাকর তাকিয়ে ছিলেন হাঁ করে। খাঁড়ার মতো নাকের দু-পাশে কুতকুতে চোখ দুটো ঝিলিক দিয়ে উঠল লোকটার, ‘এজ্ঞে, প্যাকাটির মতো চেহারা কিনা, তাই ওই নামেই ডাকে সকলে। আর তিন হল নম্বর। দলে ওই নামে আরও জনাকয়েক রয়েছে তো! কঙ্কাল নামও আছে কয়েকজনের। হেঁ হে!’ একরাশ দাঁত বের করে হাসল লোকটা।

‘তাহলে চুরির মতলবে ঢুকেছিল ঘরে?’

‘হেঁ হেঁ, সে আর বলতে।’ ফের দাঁত বের করে হাত কচলাল লোকটা।

‘তা, খাটের তলায় কতক্ষণ ছিলি বল দেখি? বুঝতেই পারিনি!’

‘হেঁ হেঁ, প্যাকাটি খাটের তলায়, আলমারির পিছনে ঘাপটি মেরে থাকবে আর গেরস্ত বুঝে ফেলবে, তাই হয় নাকি! গুরুর টেরেনিং কি মিছে? শুধু ওই বজ্জাত মশা মাটি করল আজ।’ বলতে বলতে প্রায় খেপে গিয়ে সবে নাকের উপর ল্যান্ড করা একটা মশাকে বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় কষিয়ে ‘ওফ’ করে ককিয়ে উঠল সামান্য।

দেখে ফিক করে হেসে ফেললেন দিবাকর রায়। বললেন, ‘তা এত গুণ তোর আর সামান্য খোঁজখবরটুকু না-করেই হানা দিলি এখানে? ঝাড়া হাত-পা মানুষ আমি, বাড়ির মালিক রাজীবও তাই। ঘরে আছেটা কী যে চুরি করবি?’

‘কেন? আপনার ওই লেপ-তোশক! ওটা বাগাবার জন্যই তো এত মেহনত।’ বলতে গিয়ে চোখ দুটো ফের ঝিলিক দিয়ে উঠল প্যাকাটির।

‘বলিস কী! স্রেফ লেপ-তোশক চুরির জন্য এই মশার ভিতর খাটের তলায় পড়ে রয়েছিস?’ দিবাকর প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন।

‘অ্যাঁ! তাই বলেছি বুঝি?’ জিভ কেটে নাক-কান মলল লোকটা, ‘ভুল হয়ে গিয়েছে ছার। মুখ্যু মানুষ কিনা। এজ্ঞে, লেপ-তোশক নয়। আপনার ওই লেপটেপ।’

শুনে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠল দিবাকরের। এবার আর ভুল হয়নি বুঝতে। কী সর্বনাশ! হতভাগার টার্গেট তাহলে ওঁর ল্যাপটপ! যথেষ্ট দামিই শুধু নয়, এতদিনের যাবতীয় পরিশ্রমের ফসল ভরা আছে ওর ভিতর। চুরি গেলে সবকিছু শুরু করতে হবে নতুন করে। যথাসময়ে থিসিস জমা দেওয়াও সম্ভব হবে না। মাত্র দিনসাতেক হল এসেছেন। এর মদ্যে ফিল্ড ওয়ার্কটা ভালোই সেরে ফেলেছে শয়তানটা। কিন্তু লোকটা কখন যে ঘরে ঢুকল, অনেক ভেবেও সুরাহা করতে পারলেন না। বিকেলে রাতের খাবার কিনতে বাজারের দিকে গিয়েছিলেন। তারপর সারা- সময় ঘরেই রয়েছেন। একটু ঢোক গিলে বললেন, ‘তা বাপু, কী করে ঘরে ঢুকলি বল দেখি?’

‘বললাম না, সব গুরুর কৃপা। অনেক মেহনত করে শিখতে হয়েছে তাঁর কাছে। তারপরেই না দলে জায়গা। রাতে খাওয়ার পরে একটু বাইরে বের হয়েছিলেন মনে নেই? কাজ সেরে ফেলেছি সেই ফাঁকে।’ ফের খিক করে হাসল লোকটা।

রাতের খাওয়াটা দিবাকর আজ একটু তাড়াতাড়িই সেরে ফেলেছিলেন। চৌরাস্তার মোড়ে ফাস্ট ফুডের দোকান আছে। সন্ধের সময় কিছু একটা নিয়ে আসেন সেখান থেকে। আজও গিয়েছিলেন। পাশেই রসময়ের মিষ্টির দোকান। রাজীবের কাছেই শোনা, এদের ল্যাংচা আর পান্তুয়ার নাকি নামডাক খুব। মিষ্টিটা ওর পছন্দের তালিকায় পয়লা নম্বরে হলেও কাজের চাপে আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি। বড়োজোর দিন দুয়েক আর থাকতে হবে হয়তো। তাই মনস্থির করে কিনে ফেলেছিলেন একটু বেশি করেই। রাতের খাওয়া আজ তাই একটু তাড়াতাড়িই সেরে নিয়েছিলেন। তাও সেই ন-টা নাগাদ। মুখ-হাত ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন মিনিট কয়েক। হতভাগা সেই সময়েই ঢুকেছে ভিতরে তাঁর পাশ দিয়েই। অথচ টেরটিও পাননি। চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘সে তো অনেকক্ষণ রে!’

‘এ আর এমন কী ছার! গুরুর তালিমে ওসব অভ্যেস আছে প্যাকাটির। শুধু একটাই সমস্যা, শরীরের বারো আনা রক্ত হতচ্ছাড়া মশার পেটেই চলে যায়। ওই জন্যই তো গায়ে আর গত্তি লাগল না। আপনাদের আর কী! সন্ধে হতেই দিব্যি মশারির ভিতর ঢুকে পড়েছেন!’

লোকটার কথার ধরনে দিবাকর হেসে ফেললেন আবার। বললেন, ‘তা রাতের খাওয়া হয়েছে তো?’

খিক করে হাসল প্যাকাটি, ‘খাওয়াদাওয়া করে কেউ চুরি করতে বের হয় নাকি? আপনি দেখছি কিচ্ছু জানেন না। লেখাপড়াই শিখেছেন শুধু।’

‘কেন রে?’

‘গুরুর বারণ।’ চোখ নাচাল প্যাকাটি। ‘আমাদের হেবো সেবার গুরুর মানা শোনেনি। ব্যাস, গেরস্তের ঘরে ঢোকাই সার হল। ভরপেটে খাটের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল বেঘোরে। শেষে নাকডাকা শুরু হতেই হাতেনাতে পাকড়াও হয়ে গেল। খেপে গিয়ে গুরু দল থেকেই দূর করে দিল তাকে।’ বলতে-বলতে আস্তিনে চোখ মুছল লোকটা। বোধ হয় হেবোর দুর্গতির কথা ভেবেই।

‘তা, আজ তুইও তো ধরা পড়ে গেলি?’

‘সে তো ওই মশার জন্য। আর আপনিও যে এত রাত পর্যন্ত মশারির তলায় লেপ-তোশক, থুড়ি, লেপটেপ নিয়ে পড়ে থাকেন তা জানব কেমন করে?’

‘এঃ! শেষে মশার কাছে কাত হয়ে গেলি?’ দিবাকর জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন।

‘তা, কতক্ষণ আর কামড় সহ্য করা যায় বলুন দেখি?’ প্যাকাটি খিঁচিয়ে উঠল এবার, ‘হতচ্ছাড়াগুলো সারাশরীরে প্রায় চাষ করে ফেলেছে। আর আপনাকেও বলিহারি, জেগেই যখন রয়েছেন, মশারির তলায় না-ঢুকে মশার ধূপও তো জ্বালাতে পারতেন! ওফ, প্রায় এক লিটার রক্ত খেয়ে নিয়েছে।’

‘শুধু এক লিটার রক্ত!’ সামান্য নড়ে বসে দিবাকর চোখ নাচালেন, ‘আর কিছু নয়?’

‘কী?’ দিবাকরের কথার ধরনে হঠাৎ যেন থতোমতো খেল প্যাকাটি। তারপর একগাল হেসে বলল, ‘ও, ম্যালেরিয়া? এজ্ঞে, ওসব ছেলেবেলায় হত একসময়। এখন আর সুবিধে করতে পারে না।’

‘আরে সে ম্যালেরিয়া নয় রে, কাগজে…। তা একটু-আধটু পড়তে পারিস তো? নাকি ওসবে লবডঙ্কা!’

দিবাকরের কথায় যেন আঁতে ঘা লাগল প্যাকাটির। মুখ ঝামটে বলল, ‘কেন, রাতে সিঁধ কাটি বলে কি ফেলনা? তবে কাগজ পড়ার সময় কোথায় ছার? রাতভর খাটাখাটনির পর ঘুম ভাঙতে সেই বিকেল। তখন কে পড়ে ওসব?’

‘খুব খারাপ। খুব খারাপ।’ মাস্টারি কায়দায় দিবাকর মাথা নাড়লেন বারকয়েক। ‘তোদের গুরুদেবের এদিকেও একটু নজর দেওয়া উচিত ছিল রে।’

‘ক-কেন বলুন দেখি।’ ফের থতোমতো খেল প্যাকাটি।

‘কেন বলুন দেখি?’ দিবাকর প্রায় ভেংচে উঠলেন এবার, ‘রোজকার কাগজে একটু নজর দিলেই বুঝতে পারতিস। আরে বাপু, এখন সেই মামুলি ম্যালেরিয়ার দিন আর নেই। পালটে গিয়েছে বেমালুম। ম্যালেরিয়ার ওষুধ তো ছার, আরও ভারী-ভারী ওষুধেও হচ্ছে না কিছু।’

‘বলেন কী।’ প্রায় আকাশ থেকে পড়ল প্যাকাটি।

‘হ্যাঁ রে। আর কী ওজনদার নাম তাদের। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া, হেমারেজিক ডেঙ্গি, এনকেফেলাইটিস, চিকুন…।’

‘অ্যাঁ। এসব কী?’ দিবাকরের কথার মাঝেই চোখ কপালে তুলে হাঁ-হাঁ করে উঠল প্যাকাটি।

‘এসব মশার আমদানি করা রোগ। ধরলে আর রেহাই নেই। পড়তে যখন পারিস, নিজের চোখেই দ্যাখ তাহলে।’ বলতে-বলতে ওয়েবসাইট থেকে দিবাকর সেদিনের এক বাংলা কাগজের প্রথম পাতা ল্যাপটপে খুলে ফেললেন।

আগ্রহে ঝুঁকে পড়লেও খানিক চোখ বুলিয়ে প্যাকাটি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘চশমাটা সঙ্গে নেই। পড়েই শোনান বরং।’

‘পড়ে আর কী শোনাব? সকালেই দেখা হয়ে গিয়েছে আমার।’ দিবাকর রায় হাসলেন একটু, ‘গতকাল কলকাতায় তিন-তিনজন মারা গিয়েছে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায়। জনাকয়েক হাসপাতালে। চিকুনগুনিয়ায় মারা গিয়েছে আরও চারজন। এনকেফেলাইটিসে…।’

‘বাপ রে!’ প্রায় আঁতকে উঠল প্যাকাটি, ‘শুনিনি তো!’

‘দিনভর পড়ে ঘুমোলে কী আর এসব শোনা যায় রে! এ তো শুধু কলকাতার কথা। কলকাতার বাইরের অবস্থা আরও ভয়ানক। দাঁড়া, আর-একটা কাগজ খুলছি। কী লিখেছে দ্যাখ।’

দিবাকর আর-একটা ওয়েবসাইট খুলতে যাচ্ছিলেন। প্যাকাটি ব্যাজার মুখে বলল, ‘রাতটাই মাটি করে দিলেন আজ। মনে হচ্ছে জাত ব্যাবসাটা ছেড়েই দিতে হবে এবার।’

‘ছেড়ে দিবি?’ দিবাকর চোখ নাচালেন একটু, ‘এটা মন্দ বলিসনি!’

প্যাকাটির চোখ দুটো হঠাৎ দুলে উঠল সন্দেহে, ‘আপনার মতলবটা কী বলুন দেখি? সেই থেকে খেলিয়ে যাচ্ছেন শুধু!’

‘মতলব আর কী?’ নির্লিপ্ত গলায়, দিবাকর বললেন, ‘রাতদুপুরে গেরস্তের ঘরে চুরি করতে ঢুকে ধরা পড়েছিস। কিছু একটা তো করতেই হবে।’

‘তাই বলুন!’ আরামে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল প্যাকাটি, ‘এই মতলব! তা ডাকুন পুলিশ। জেল-হাজতে দিনকয়েক একটু বিশ্রাম নিয়ে আসি।’

‘তাই কি বলেছি আমি?’

‘তাহলে?’ কুতকুতে চোখ দুটো ফের কুঁচকে উঠল প্যাকাটির।

‘হাজার হোক, রাতদুপুরের কুটুম তুই। শুধু হাতে ফিরে যাবি, তাই কি হয়? টেবিলে ঢাকা দেওয়া হাঁড়িতে মিষ্টি রয়েছে।

 একটু মিষ্টিমুখ করে যা। রাতও তো কম হয়নি।’

‘অ্যাঁ!’ এই এতক্ষণে প্যাকাটির ঠোঁটটা ঝুলে পড়ল একটু।

‘হ্যাঁ রে! কলকাতার এক স্কুলের মাস্টারমশাই আমি। ছেলেদের গায়ে হাত তুলিনি কোনোদিন। তোকেই বা পুলিশে দিই কী করে?’

পাশেই টেবিলের উপর মিষ্টির হাঁড়ি। সেদিকে সামান্য ঘাড় ফিরিয়ে চোখ দুটো হঠাৎ জুলজুল করে উঠল প্যাকাটির, ‘এ যে অ্যাটম বোমা গো কত্তা! গন্ধ পাচ্ছি!’

ব্যাপারটা জানা ছিল দিবাকরের। ছোটো হলেও কালীগঞ্জ অনেক দিনের পুরোনো শহর। সেই যুদ্ধের সময় জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতার মানুষ পিলপিল করে ভিড় করেছে কালীগঞ্জে। রসময় ময়রা তখন বেঁচে। মাথা খাটিয়ে সরেস ছানা আর ক্ষীর দিয়ে তৈরি খাঁটি গাওয়া গিয়ে ভাজা একপোয়া ওজনের বিশাল আকারের পান্তুয়া গড়ে নাম দিয়েছিলেন ‘অ্যাটম বোমা’। সাইজ আর সেই আগের মতো নেই বটে, তবু ওই নামেই এখনও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তাহলে আর দেরি করিসনে বাপু!’

প্যাকাটিও দেরি করল না এরপর। মুহূর্তে প্রায় হামলে পড়ল হাঁড়ির উপর। খেতে-খেতেই বলল, ‘রাতের কুটুমের খাতিরে ব্যবস্থাটা ভালোই করলেন কত্তা! কিন্তু মুশকিলেও ফেলে দিলেন একটু।’

‘কেন রে?’

‘গুরুর বারণ গো। কিন্তু রসময়ের অ্যাটম বোমা বলে কথা! মাথা ঠিক রাখা যায়? আপনিই বলুন?’

‘গুরুর কথা রাখ এবার।’ মোলায়েম গলায় দিবাকর বললেন, ‘বরং এই অধমের কথাটা পারলে মনে রাখিস একটু। নইলে স্রেফ মশার হাতেই মারা পড়বি একদিন। ছার’ই বল আর কত্তা, কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

‘আপনি তো বলেই খালাস কত্তা। জাত ব্যাবসা ছাড়া কি সহজ কাজ?’ মিষ্টির হাঁড়ি শেষ করে হাত চাটতে-চাটতে ব্যাজার হয়ে বলল প্যাকাটি। তারপর হাঁড়ি নামিয়ে ঝুপ করে দিবাকরের পায়ে একটা প্রণাম ঠুকেই দরজা খুলে ঝাঁ করে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। নিমেষে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

দরজা বন্ধ করে দিবাকরও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এরপর। পরদিন সকালে উঠে আবিষ্কার করলেন, টেবিলের উপর মিষ্টির খালি হাঁড়ির তলায় ভাঁজ করা দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট। কিন্তু আসল ব্যাপারটা জানতে পারলেন আরও দিন কয়েক পরে। থিসিস শেষ করে তখন ফিরে এসেছেন কলকাতায়। বন্ধু রাজীবের ফোন এল একদিন। প্রায় মিরাকেল ব্যাপার ঘটে গিয়েছে কালীগঞ্জে। একদল মানুষ হঠাৎ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে শহরের সব পানাপুকুর সাফ করে ফেলেছে একে-একে। ব্যাপার দেখে চক্ষুলজ্জার খাতিরে নড়েচড়ে বসেছে মিউনিসিপ্যালিটিও। নোংরা নর্দমা, ডোবা, পানাপুকুর সব এখন ঝকঝকে। মশার উৎপাতও উধাও। কালীগঞ্জ আর সেই কালীগঞ্জ নেই। পালটে গিয়েছে একদম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *