কালীকল্প তরুমূলে

কালীকল্প তরুমূলে

 আমরা সকলেই মা কালীর কোলে বসে আছি। আমাদের দেহ, মন, ইন্দ্রিয় এবং জীবনের সমস্তরকম সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ঘৃণা-ভালবাসার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্যই।

হ্যাঁ, বিশ্বাস কর এই গভীর সত্য অথচ মর্মস্পর্শী কথাটি। মনে রেখ কথাটি তোমাকেই বলছি। তুমি মানে যে এই মুহূর্তে বইটি পড়ছ। সেই তোমার অন্তরের চিন্তারাশিকে লক্ষ্য করেই বলছি।

কে তুমি বল তো? কোথায় বসে আছ তুমি?

—কেন? কলকাতায়, বর্ধমানে, বীরভূমে বসে আছি। না—না—আমি আসামে, আমি মহারাষ্ট্রে, আমি দিল্লিতে বসে বইটি পড়ছি।

—দাঁড়াও! আসলে তোমরা সবাই পৃথিবী গ্রহে বসে আছ। অনন্ত নক্ষত্রমণ্ডলের মাঝে বসে আছ, কিংবা সত্যিই কি বসে আছ?

—না, মানে আমরা আপেক্ষিক সত্যের কথা বলছিলাম।

—শোন, আমি আপেক্ষিক-টাপেক্ষিক চাই না। সরাসরি যা সত্য তাই বলতে চাই। যা শুনলে মন অনন্তে প্রসারিত হয়, বুদ্ধি মার্জিত হয়, প্রাণ সর্বপ্রাণের সঙ্গে একাত্ম লাভ করে এবং ক্ষুদ্র চেতনা বিলুপ্ত হয়ে সর্বাত্মা পরম ব্রহ্মে একীভূত হয়ে যায় তাই-ই বলব। সেই চরম সত্যের কিঞ্চিৎ ধারণা হলেই তোমাদের জীবন ধন্য হয়ে যাবে।

—আচ্ছা! ঠিক আছে—এবার আপনি বলুন। আমরা বসে বসে শুনছি।

—কী বললে? তোমরা বসে বসে শুনছ! হাসালে—তোমরা কোনও কালেই বসে নেই। কোনওদিন বসে ছিলে না। এখনও নয়। কখনও থাকবে না। শক্তিময়ীর অঙ্কে তোমরা শায়িত আছ, ছটফট করছ। বিশ্বাস হচ্ছে না? এখনও অবিশ্বাস!

তাহলে এবার বলি—এই যে তোমরা—মানে তোমাদের মানবীয় অস্তিত্বটি সারাদিন তোমাদের চেতনায় রয়েছে একজন নর কিংবা নারী হয়ে—যে নরনারী কাজকর্ম করছে, পড়াশোনা করছে, খেলছে কিংবা যাই করুক না কেন ‘আমি’ বোধে সংপৃক্ত হয়ে একটি দেহের নানা ক্রিয়া চলছে। সেই দেহমনই তো তোমরা।

আমি এই মুহূর্তে তোমাদের পার্থিব নামরূপ পরিচয় মুছে দিয়ে মাত্র এক-একটি দেহ-মন রূপেই তোমাদের ভাবছি। কে ভাবছে? তোমাদের মা আমি। ‘আমি’ মানে বেদময়ী মা কালী, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী রূপেই এ যুগে বেশি প্রকাশিত হয়ে রয়েছি—সেই ‘আমিই’ পরমাপ্রকৃতি জগৎপ্রসবিনী স্নেহময়ী মাতারূপে তোমাদের সব নরনারী পরিচয় এবং পৃথিবীর সঙ্গে যাবতীয় কাল্পনিক সম্পর্ক এক্ষণে মুছে দিলাম। এবার আমার প্রকৃত সত্তার মধ্যেই তোমরা কেমন বসে আছ, স্নেহশীলা জননীর কোলে বসে যুগযুগান্তর ধরে কেমন স্তন্যসুধা পান করে আসছ তাই একটু বলব।

শোন, তোমরা সবাই আমার কোলেই বসে আছ। তবে শুনতে যখন চেয়েছ আর একটু সত্য কথাই বলি। তোমরা নেই, না—তোমরা কোথাও বসে নেই। আমিই আছি, চিরকাল। সমুদ্রের ‘ঢেউ’ কি কখনও পৃথক থাকে? সমুদ্রেই ঢেউয়ের আবির্ভাব, সমুদ্রেই লয়। ঠিক তেমনি আমার অষ্টপ্রকৃতির (আকাশ, বাতাস, তাপ, জল, মাটি, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার) মধ্যেই তোমাদের উদ্ভব এবং বিলয়। তবে তোমাদের অনুভবে তা নেই। আমিই মায়াশক্তি দিয়ে জগতের দিকে তোমাদের মুগ্ধ করে রেখেছি। কেবল ‘মা’, ‘মা’, ‘মা’ বলে কাঁদলেই আবার তোমাদের অনুভবে ধরা পড়বে যে, আমার কোলেই শিশুরূপে তোমরা চিরকালই বসে আছ।

তোমরা তোমাদের শরীরটার দিকে লক্ষ রেখেছ—যা বসে আছে বলে তোমরা মনে কর। দেখ, পৃথিবীর মাটির উপর তোমাদের শরীরটা কী অবস্থা করে রেখেছি। ওইটার ভেতর কতরকম যন্ত্র যে আমি বসিয়েছি তা ভেবেছ কি? কেমন হৃদযন্ত্র স্থাপন করেছি, চোখ দুটি বসিয়েছি, নাক দুটি স্থাপন করেছি, রক্তের প্রবাহ সারা শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছি তা অনুভব করেছ কি? না—তোমাদের শরীরটা কোনও কালে বসে নেই। প্রতি মুহূর্তে তার মধ্যে গতি রয়েছে। ক্ষণে ক্ষণেই পরিবর্তন। কোষের ক্ষয়-বৃদ্ধি। কৈশোর-যৌবন চলে যাচ্ছে, যৌবন জরায়—এভাবে শরীরটা আবার আমার আদিম পঞ্চভূতেই লয় পাবে একদিন। তারপর আবার সৃষ্টি করব। আর তোমাদের মনটাকে দেখ। কোনও সময় স্থির নেই। হাজারো চিন্তা, ভাবনা, সমস্যা, উদ্বেগ দিয়ে ভরিয়ে রেখে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে সুখ, আনন্দ দিচ্ছি মনটাকে। আবার সময় বুঝে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছি। ক্ষণে ক্ষণে তোমাদের মঙ্গলের জন্য রোগ-শোক-যন্ত্রণা দিচ্ছি। এসব না দিলে তোমাদের পশুভাব কমবে না জানবে, দেবভাব আসবে না। কে আর পার্থিব সুখের সাগরে ভেসে আমাকে কোন কালে অন্তরের সঙ্গে ডেকে গেছে বল?

তাই সবরকম ব্যবস্থাই আমাকে করতে হয়েছে। হ্যাঁ—আমি তোমারও মনের কথা বুঝি। তোমার মনটা মাঝে মাঝে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। কখনও সুখের আহ্লাদে ভরে ওঠে, কখনও দুঃখে নিজেকে ধিক্কার দাও—মনের গোপন, একান্ত গোপন অভিসারে নিজেকেই শেষ করে দিতে চাও তুমি। কিন্তু জগৎ মায়ার মাঝে পড়ে ফিরে আসে, কেউ কেউ তো নিজেকে শেষ করেই ছাড়ে ….

আহা! বাছা, বড়ই বেদনা তোমার বুকে!

আমি জানি এসব। তোমার মনের গোপন অভিসার আমি সবসময় কান পেতে শুনি। কেন এত একা একা ফিসফিসানি তোমার? হ্যাঁ—বাবা, তুমি জন্ম থেকেই বিদ্রোহী। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছ নিজের মনের বিরুদ্ধে, স্ব-জাতির বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে। মানুষের সমাজে চিরবিপ্লবী হয়ে থাকতেই তোমার পছন্দ। কিন্তু কেউ তোমাকে বুঝছে না। বুঝছে না কারণ তুমি নিজেকেই নিজে বোঝনি বলে। যাক, দেখলে তোমার দেহ, মন কেমন গতি সম্পন্ন। তুমি একটি শক্তির আধার। তোমার যে প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয় সব আমি সৃষ্টি করেছি তা ‘আমার’ সঙ্গে—’আ-মার’ মানে তোমার ‘মায়ের’ সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হবে বলে।

আমার দেহ, মন এবং সত্তা সম্বন্ধে তোমার কোনও ধারণা নেই। অথচ তুমি যে তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় এবং মন দিয়ে আমার স্তন্যসুধা নিয়ত পান করছ তা বুঝতে পারছ না। কোনও সময়েই তুমি স্তন্যসুধা পান থেকে বঞ্চিত হওনি। আমার কোলেই তুমি চিরকাল বসে আছ। বসে বসে মাতৃদুগ্ধ পান করছ। তোমাকে আমিই—পরমাপ্রকৃতি মা রূপে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। তুমি আমার স্নিগ্ধ কোলে মাথা রেখেই সকালবেলায় দু’চোখ মেলে জেগে ওঠ, সারাদিন কাজকর্ম কর, হাস-খেল-নাচ-গাও, আরও কত কী কর। এত কাজ করে ক্লান্ত হও, আবার বিশ্রাম নাও—নিদ্রায় আমার কোলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়। তারপর স্বপ্ন রূপে তোমার মধ্যে আমি খেলা করি, তোমাকে ভয় দেখাই। এভাবে তোমার আমার নানা মজার খেলা শেষ হলে গভীর ঘুমে তোমাকে টেনে নিয়ে যাই। আমি কিন্তু তখনও প্রাণশক্তি রূপে তোমার মধ্যে জেগে থাকি। আর আমি জেগে থাকি বলেই না তুমি সকালবেলায় আমার কোলে মাথা রেখেই জেগে ওঠ। তখন চারধার কী সুন্দর শান্ত, সতেজ! ভোরের পাখিরা কলকল করে। মিষ্টি মিষ্টি বাতাস বয়। ফুলগুলি গন্ধ বিতরণ করে। চারিদিকের ভাব কত সাত্বিক! এমন কত সকালই না পৃথিবীর উপরে আছড়ে পড়েছে, কে তার হিসাব রাখে বল?

এমন সুন্দর সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলে তুমি প্রথমে তোমার মনটাকে দেখ, তারপর দেহ, তারপর অন্য দেহ—জগৎ জীবন। এরপর মানবীয় সম্পর্ক সব তোমার স্মৃতির মধ্যে এসে হাজির হয়। তুমি নিজে মনে মনে পুরনো সব সম্পর্কগুলি পর্যালোচনা করে আবার নিত্যদিনের সংসারের খেলায় মেতে ওঠ। এভাবে যুগ থেকে যুগান্তর ধরে তোমার ও আমার লীলাখেলা চলছে। তুমি বাছা এসব জানো না। তাই তো তোমাকে একটু একটু করে জানাব আমি। বিষয়রস পান করে তুমি মাতাল হয়ে রয়েছ। হুঁশ নেই। এবার ‘মান-হুঁশ’ হবে। মানুষের মতো মানুষ।

তাহলেই দেখ, আমার চেতনাতে তুমি সর্বক্ষণ রয়েছ, অথচ তোমার চেতনাতে আমি নেই। মা-হীন তোমার এই বেঁচে থাকা কত যে পাপের তা চিন্তা করেছ কী? অথচ তোমাকে—হ্যাঁ—তোমাদের মতো অসংখ্য নরনারী-পশুপাখিকে চিন্তা করে বাস্তবে রূপ দিতে আমাকে কত যুগ যুগ ধরে পরিশ্রম করতে হয়েছে। সেই সমুদ্র জলে অ্যামিবা সৃষ্টির মধ্যেই আমি প্রথম প্রাণের প্রকাশ এনেছিলাম। তারপর তো ইতিহাস—জীবনের ইতিহাস—জীবন সংগ্রামের ইতিহাস। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, এই পৃথিবী গ্রহে কত অসংখ্য জীব সৃষ্টিই না করেছি—তাদের আকৃতি, প্রকৃতি এবং ব্যবহারিক বৈচিত্র্য নিয়ে এক আশ্চর্যতম জগৎ আমি তৈরি করেছি। তোমরা যাকে বিবর্তন বল—সে তো শক্তির খেলা—শক্তির নানা বিবর্তিত রূপ তা এখন অবশ্য বুঝতে পারছো। মহাশূন্যের বুকে এমন সুন্দরভাবে তোমাদের সাজাতে কত কত বছর যে লেগে গেল! আমার এমন সুন্দর সাজানো সংসারে তোমরা পরস্পর স্বার্থসংঘাতে মেতে উঠেছ। একে ধ্বংস করে দিতে চাইছ—এর চেয়ে মনোকষ্টের কি আছে!

যাক, তুমি এবং আমি দু’জনেই প্রকৃতি। আমাদের একই অবস্থা। রূপ থেকে রূপান্তরে চলে যাওয়া। তারপর একদিন অরূপে হারিয়ে যাওয়া। এই দেখ না তোমার দৈহিক শক্তি একদিন শূন্যে গিয়ে ঠেকবে। তখন তুমি নিজে না পারবে হাঁটতে, চলতে, বসতে। কেবল শুয়ে থাকবে। চুলগুলি পেকে সাদা হয়ে যাবে। চামড়া কুঁচকে যাবে। চোখগুলি দৃষ্টিশক্তি হারাবে। তুমি বধির হবে, বিকল হবে, জড়পিণ্ড হবে। শেষে হাড় জিরজিরে এক পিণ্ড মাংস। তাও আবার লয় পাবে। তুমি পঞ্চভূতে মিশে যাবে। তোমার পার্থিব পরিচয় চলে যাবে। তুমি যে একদিন কারও বাবা হয়েছিলে, কারও মা, কারও মামা, কারও ভাই, কারও পত্নী—এ সবের সংস্কার পর্যন্ত থাকবে না। এই ভুবনে এমনই হয়ে আসছে, হবেও এমনই। সুতরাং কীসের তোমার অহঙ্কার এই দুদিনের জন্য? কোন অব্যক্ত ক্ষেত্র থেকে দু’দিনের জন্য এসেছ আবার সেখানেই ফিরে যাবে। তাই তো গীতামুখে তোমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছি—

অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।

অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।। ২৮/২

অর্থাৎ, হে ভারত, জীবগণের শরীর উৎপত্তির আগে অপ্রকাশিত থাকে (অব্যক্ত লীন থাকে), মধ্যকালে বা স্থিতিকালে প্রকাশিত থাকে (দৃষ্টিগোচর হয়) এবং বিনাশের পরেও অব্যক্তে চলে যায়। এমন যখন অবস্থা তখন শোক কী?

বলতে কি তোমাদের সমস্ত বোধজ্ঞান ভাসা ভাসা অবস্থায় রয়েছে। আমি কিন্তু ব্যক্ত, অব্যক্ত এবং তারপরেও যা আছে সেসব নিয়ে চিন্তা করি।

এককথায় আমার স্বরূপের দুটি খেলা—বহির্মুখী এবং অন্তর্মুখী। আগে আমার অন্তঃপ্রকৃতির বিকাশ। মহৎ মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার তৈরি করেই পরে জগৎ রূপে প্রকাশিত হয়েছি। তোমাদের এমন ধারণা হবার জো নেই। তবে জেনো এই অন্তর্মুখী শক্তিতেই তুমি নিজেকে নিজে মহত্তম রূপে গড়ে তুলতে পার। তোমরা মহৎ হও কীভাবে তা জান? তোমরা মহৎ হও ভাব দ্বারা। বড় বড় ভাবনাগুলি দিবারাত্র চিন্তা করেই তোমরা নিজেদের অন্তঃপ্রকৃতিতে প্রথমে পরিবর্তন আন। তারপর আমার অব্যক্ত ক্ষেত্র থেকে বাইরে তা প্রকাশিত হয়। কাজেই নিজেদের অন্তর্নিহিত বোধকে (চেতনাকে) বারবার উন্নত আদর্শবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত করার মধ্যেই তোমরা সত্যস্বরূপ, পবিত্রস্বরূপ এবং প্রেমস্বরূপ হয়ে ওঠ। মানুষ তার আপন চেতনা কেন্দ্রকে এই মহৎ ভাবগুলিতে সচেতনভাবে সংযোগ স্থাপন করলেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। উন্নতমনস্ক হয়। তাই তো বলি নিজের বোধ, নিজের জগৎ, নিজের সমস্ত ‘নিজত্ব’কে পরমবোধ তথা আত্মবোধের সঙ্গে সময় থাকতে থাকতে মিশিয়ে নাও। তাহলে আমার কোলেই বসে যে তোমাদের সব ব্যবহার চলছে তা বুঝতে পারবে।

আমি আর কে—বেদময়ী মা কালী। বেদ জ্ঞান হল আমার সন্তান। আমার এই সন্তানের স্বরূপ তোমার জানা আছে? ‘বেদ জ্ঞান’ মানে হল সর্ব পদার্থের একত্ব জ্ঞান। সবকিছুই তুমি হয়ে রয়েছ এই বোধটি যত পাকা হবে ততই বেদ জ্ঞানের মাধুর্য অন্তঃকরণে ফুটে উঠবে।

আমার অঘটন-ঘটন পটীয়সী মায়া দ্বারা জগতের প্রাণীসকল অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তার ফলে সকলেই কমবেশি মিথ্যার আশ্রয় নেয়, হিংসার আচরণ করে, নয়তো অহঙ্কারের ভারে আসুরিক স্বভাবপ্রাপ্ত হয়। এই অহং-এর জন্যই তোমরা ‘নিজ বোধ এবং জগতের মধ্যে’ বিরাট পার্থক্য উপলব্ধি কর। ভোক্তা এবং ভোগ্যরূপে আপন অখণ্ড চেতনাতেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাও। কিন্তু ভোক্তা এবং ভোগ্য কিংবা দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দর্শন যে একই জিনিসের এপিঠ-ওপিঠ তা বুঝতে পার না। এখন প্রশ্ন হল—একই জিনিসটা কী? সেটি হল ‘আত্মবোধ’। আপন বোধটা সর্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত করে স্ব-স্বরূপ অনুভব করা।

কিন্তু তোমরা কর এর উলটো। বিচ্ছিন্নভাবে দেখাতেই তোমাদের আনন্দ। খণ্ড খণ্ড রূপে সবকিছু দেখা বা অনুভব হল অসুরের লক্ষণ। আর সমস্ত কিছু এক পরমাত্মাতে স্থিত হয়ে আছে এই বোধে উদ্দীপ্ত হলেই তোমরা ক্রমশ দেবভাব প্রাপ্ত হও, দেবতা হও। কথা হল মনের বাসনা-কামনা ক্ষয় হলে—চিত্ত শুদ্ধ হলে—এই দেহ-মন-ইন্দ্রিয় নিয়ে শরীরী অস্তিত্বটা যে ভগবানে চিরন্তন গ্রথিত হয়ে আছে তার উপলব্ধি হয়ে যায়।

যখন তোমরা নিজ নিজ দেহকে দেখ তখন দেহের উপাদান কারণের দিকে নজর দাও না, যখন নিজ নিজ মনকে দেখ তখন মনের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর সংস্কারগুলির কারণের দিকে লক্ষ্য দাও না, যখন বুদ্ধি দিয়ে বিচার কর তখন বুদ্ধির নিশ্চয়াত্মিকা ভাবের প্রতিও লক্ষ্য রাখ না। এই যে অসতর্কতা—এটাই হল অজ্ঞান। মায়ারূপ জীব ভাব। সতর্কতা অবলম্বন করলেই সাধকভাব। সাধক ভাব থেকে আসে দেবভাব। অন্তরে দেবভাব এলেই আমার স্বরূপের কথা তোমাদের মনে পড়ে যায়। তখন জানতে ইচ্ছা করে তোমাদের—মায়ের চার হাত কেন? কেন আমি বিবস্ত্রা হয়ে রয়েছি? কেন মুণ্ডমালা গলায় পরেছি? কেন গায়ের রঙ কালো? ইত্যাদি। আসলে তোমরা সব মোহের গর্তে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছ। আত্মচেতনার ভাব হারানোর নামই মোহ। আর সমগ্র জগৎকে আপন অধিকারে পেতে গিয়ে তোমরা বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছ। তাই আমার স্বরূপের ধারণা করতে পারছ না। তোমাদের অহং বোধ মুছে গেলে তোমরাই যে মা কালী হবে অর্থাৎ আমার স্বধর্ম প্রাপ্ত হয়ে যাবে তা কি অনুভব করতে পারছ না? আর এসব গভীর তত্বকথা প্রকাশ করাও শক্ত। তাই না আমার প্রসাদ লিখে গেছে—

কে জানেরে কালী কেমন ষড়দর্শনে না পায় দরশন্

মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন

কালী পদ্মবনে হংস সনে, হংসীরূপে করে রমণ।

আত্মারামের আত্মা কালী, প্রমাণ প্রণবের মতন,

তারা ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।

কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড-ভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা জান কেমন,

মহাকাল জেনেছে কালীর মর্ম, অন্যে কেবা জানে তেমন।

প্রসাদ ভাসে লোক হাসে, সন্তরণে সিন্ধুতরণ

আর মন বুঝেছে প্রাণ বোঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন।

 —রামপ্রসাদ

আসলে জানার বিষয় হলে তো তোমরা আমাকে জানবে। যে জানতে যাবে সেই তাতে মিশে যাবে। ‘নিজত্ব’ না হারিয়ে আমাকে পাওয়া যায় না। যখন নিজ অহং তোমরা আমার কৃপায় মুছে দিতে পারবে তখনই উপলব্ধি করবে—আমি কেমন, কোথায় থাকি, কীভাবে তোমাদের নিয়ে নিরন্তর লীলা খেলা খেলছি। আমার অতি প্রিয় সন্তান শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ তোমাদের মনে নেই? শোন—সে আমার স্বরূপের কথা অতি সুন্দরভাবে বলেছে—’কালী কি কালো? দূরে তাই কালো, জানতে পারলে কালো নয়। আকাশ দূর থেকে নীলবর্ণ। কাছে দেখ, কোনও রঙ নাই। সমুদ্রের জল দূর থেকে নীল, কাছে গিয়ে হাতে তুলে দেখ, কোন রাঙ নাই।’ আবার বলেছে—’বন্ধন আর মুক্তি—দুয়ের কর্তাই তিনি। তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কামিনী কাঞ্চনে বদ্ধ, আবার তাঁর দয়া হলেই মুক্ত। তিনি ‘ভব বন্ধনের বন্ধনহারিণী তারিণী’। ‘তিনি লীলাময়ী। এ সংসার তাঁর লীলা। তিনি ইচ্ছাময়ী, আনন্দময়ী। লক্ষের মধ্যে একজনকে মুক্তি দেন। … মনের কি দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়।’ (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত)

তোমরা তো জানই আমার কথা বলতে বলতে শ্রীরামকৃষ্ণ পাগলপারা হয়ে যেত। শ্রীরামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, বামাক্ষ্যাপা আমরা কথা ভাবতে গিয়ে সব কখন হাসত, কখন কাঁদত, কখন সমাধিমগ্ন হয়ে যেত। ওদের সব ছোট্ট শিশু করে আমার কোলে রেখে দিয়েছিনু। তোমরাও সব আমার কোলেই রয়েছ, কিন্তু অহং জ্ঞানে আচ্ছন্ন হয়ে আছ বলেই তোমাদের সেই বোধ নেই। আসলে তোমরা সেয়ানে পাগল। মনে বিষয় বাসনা, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, ধন, মান, যশ সব বাইরে আবার আমাকেও পাবার বাসনা করবে। এক মনে তোমাদের এত কামনা-বাসনা। সেখানে গিয়ে বসব কোথায়? তোমরা নানারকম স্বার্থসাধন করে নিজ নিজ তৃপ্তির জাহির কর, কিন্তু মনের শূন্যতায় যে তোমরা হাহাকার করছ তা কি আমি বুঝি না? হায়রে আমার সন্তানগণ! তোমরা চোখ মেলে জগৎরূপে প্রকাশিতা আমাকে একবার ভাল করে দেখ। যা কিছু রূপ তুমি চোখ মেলে দেখ সবই আমার রূপ বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করো। এই বিশ্বজগৎই আমি। পরমেশ্বরী প্রত্যক্ষ ঈশ্বরী। মহাকাশ হল আমার আলুলায়িত কেশরাজির প্রতীক। অনন্ত কোটি নক্ষত্রমণ্ডল হল গলায় কাটা মুণ্ডর প্রতীক। আমার ত্রিনেত্র হল—চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী। মধ্য চক্ষু হল সূর্য। জ্ঞান নেত্র। জ্ঞান মানে প্রকাশ। উদ্ভাসিত। সূর্যের প্রকাশ না থাকলে জগতে বেদ জ্ঞানের প্রকট হত না। সূর্যই তাই স্রষ্টার চরমতম কাছের জিনিস। সূর্যের অপর বৈশিষ্ট্য হল তিনি জ্যোতিস্বরূপ। সেই পরমজ্যোতি পরমাত্মা আকাশে সূর্য তারা রূপে জ্বলজ্বল করছে, আবার তোমাদের হৃদয় গুহাতে তিনি চিৎ-স্বরূপ দ্রষ্টারূপে শোভা পাচ্ছে। আমার স্বরূপকে স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ—এই তিনভাগে ভাগ করে সমগ্র বিশ্ব সংসার রচনা করে আমিই একমাত্র বিরাজ করছি। তোমরা সর্বদাই আমার কোলে রয়েছ। স্নেহ স্তন্য সুধা পান করে চলেছ। কোনও বিরাম নেই তার। একবার মনে করে নাও ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ গ্রন্থের ‘দেবীসূক্তে’ আমি কী বলেছি—

‘অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্।

তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পূরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্।।’৩

অর্থাৎ আমিই (মা কালী বা শ্রীশ্রীচণ্ডী) সমগ্র জগতের ঈশ্বরী। সকাম উপাসকগণের ধনপ্রদাত্রী। পরব্রহ্মকে আত্মা হতে একইভাবে সাক্ষাৎকারিণী। আমি বিশ্বজগৎ রূপে বহুভাবে অবস্থিতা এবং সর্বভূতে জীবাত্মারূপে প্রবিষ্ট। আমাকেই সব দেশের দেবতা, অসুর ও নরেশ বিভিন্নভাবে আরাধনা করে।

‘ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্।

অমন্তবো মাং ত উপক্ষিয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি।।’ ৪

অর্থাৎ আমারই শক্তিতে সকলে আহার ও দর্শন করে, নিঃশ্বাস নেয় এবং বিভিন্ন বিষয় কানে শোনে। যারা আমাকে জানে না সংসারে তারা হীনদশা বা ক্লেশ প্রাপ্ত হয়।

‘অহমেব স্বয়মিদং বদামি জুষ্টং দেবেভিরুত মানুষেভিঃ।

যং যং কাময়ে তং তমুগ্রং কৃণোমি তং ব্রহ্মাণং তমৃষিং তং সুমেধাম্।।’ ৫

অর্থাৎ দেবতা এবং মানুষের প্রার্থিত ব্রহ্মজ্ঞান আমি স্বয়ং উপদেশ করে থাকি। আমি নিজেই ব্রহ্মস্বরূপিণী। আমি যাকে ইচ্ছা করি তাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ করি। আমি কাউকে ব্রহ্মা করি, কাউকে ঋষি করি এবং কাউকে বা অতি ব্রহ্মমেধাবান করি।’ দেখলে তো। আবার বলেছি, ‘তাবতী মহিনা সংবভূব’ অর্থাৎ নিজ মহিমায় আমি স্বয়ংই জগৎ রূপ ধারণ করে রয়েছি।

আমার এসব কথা বিশ্বাস কর। তাহলেই আমাকে লাভ করবে। শোন, আমার আদরের দুলাল শ্রীরামকৃষ্ণ যুবককে উপলক্ষ্য করে তোমাদের কি বলেছেন—

শ্রীরামকৃষ্ণ (যুবকের প্রতি) — তুমি জ্ঞানচর্চা ছাড়ো—ভক্তি নাও—ভক্তিই সার। —আজ তোমার কি তিন দিন হল?

ব্রাহ্মণ যুবক (হাতজোড় করিয়া) — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ—বিশ্বাস করো—নির্ভর করো—তাহলে নিজের কিছু করতে হবে না। মা-কালী সব করবেন। (শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত)

তাই বলছি আমাকে সহজে উপলব্ধি করতে হলে, আমার বুকেই যে তোমাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় হচ্ছে এটি বোধগম্য করতে গেলে, সর্বদা আমাকে ‘মা’ ‘মা’ ‘মা’ বলে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে হবে। তুমি নিজেকে আমার হাতে সঁপে দাও। আমি তোমার সব ভার নেব। নিজের চেতনাকে আমার ভাবে মিশিয়ে নাও। তুমি নিজেকে শুদ্ধচিন্তা রূপে পরিবর্তিত কর প্রথমে। চিন্তারূপে উড়ে যাও মহাশূন্যে দূর গগনে, তারায় তারায় তোমার চিন্তার স্পর্শ ছড়িয়ে দাও, সূর্যকে ধরে চুমো খাও, চাঁদকে আলিঙ্গন কর, বায়ুকে সচেতনভাবে গায়ে মেখে নাও, তাপকে বন্ধুভাবে আদর কর, জলকে প্রিয়তমা বলে দেহে গ্রহণ কর। দেখবে সকলের সঙ্গে তোমার কেমন আত্মীয়তা হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী তোমার মরমী অনুভূতি কেমন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। মুছে যাচ্ছে পার্থক্য বোধ। তুমি হয়ে যাচ্ছ ‘আমি’ময়—পরমাপ্রকৃতি ত্রিগুণধারিণী ‘তারা’ময়। সেজন্যই না আমার প্রসাদ গান বেঁধেছে—

‘জ্ঞান সমুদ্রের মাঝেরে মন, শান্তিরূপা মুক্তা ফলে।

তুমি ভক্তি করে কুড়ায়ে পাবে, শিবযুক্তি মত চাইলে। …

ডুব দেরে মন কালী বলে, হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।’

তোমাদের আর কি বলব—আমার প্রসাদের গানগুলি, শ্রীরামকৃষ্ণের কথাগুলি নিয়েই পড়া যাক। তাহলেই আমাকে বুঝে যাবে।

শোন, তোমাদের একটা অতি গূঢ় কথা বলি। যে বাতাস রূপে আমি জগতে বইছি, সেই বাতাসই তো ক্রমাগত তোমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস রূপে কাজে লেগে তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আহার-বিহার-চিন্তা-ভাবনা নানারকম কাজকর্ম করিয়ে নিচ্ছে। এমন যে বাতাস-জল-মাটি-আকাশ তা কি আমার স্বরূপ নয়? স্বয়ং আমি নই? কবে যে আমি পঞ্চভূত, পঞ্চইন্দ্রিয়, মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহঙ্কার রূপে ফুটে উঠেছিলাম, তোমাদের চেতন সত্তায় ধরা পড়েছিলাম তা এখন মনে করতে পারি না। তবে তোমরা যে স্বয়ং ‘আমিই’—’আমিই’ স্বয়ং নরনারী রূপ ধরে পৃথিবীলোকে ঘুরে বেড়াচ্ছি এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

বাছা! একবার পার্থিব পরিচয় ভুলে যাও। জাগতিক নামরূপের জগৎ থেকে মনকে সরিয়ে দাও, তাহলেই ধারণা হয়ে যাবে কেমন করে তুমি আমার কোলে বসে আছ, জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে স্নেহের স্তন্যসুধা পান করে চলেছ। আমার কোলে বসেই সংসারে তোমার পিতারূপে, মাতারূপে, সন্তানরূপে, পত্নীরূপে নিত্য অভিনয়লীলা চলছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে। এই অভিনয়ে ভুলে গেছ মাকে। আর তাই আমার মনবেদনা। এ যে কত বড় কষ্ট, কত দুঃখ, যন্ত্রণা তোমার জন্য—তা তুমি উপলব্ধি করতে পারছ না, বাছা?

আর বেশি সময় নেই। এখনই দক্ষিণেশ্বরে ফিরতে হবে। তাই আবার বলে যাই—তোমার ‘অহং’কে সাধনা দিয়ে শূন্য কর। তাহলেই দেখবে ‘কলকাতাতে’ বসে থাকলেও উপলব্ধি হবে তোমার অস্তিত্ব বিশ্বজোড়া। তোমার মনই বিশ্বমন। তোমারই অহংই বিশ্ব অহং। আর আমি বিশ্বময়ী তুমি বিশ্বময়। তোমার আমার প্রেমেই সমস্ত কিছু পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। তুমি পূর্ণ, তোমার দেহ-মন-ইন্দ্রিয়-বোধ সবই পূর্ণ। আমার আদিম শরীর পঞ্চভূতই তোমার দেহের উপাদান, আমার সর্বব্যাপী মন নিয়েই তোমার ক্ষুদ্র মন—আমি সমুদ্র, তুমি ঢেউ; আমি সোনা, তুমি আংটি, আমি না থাকলে তুমি নেই। সমুদ্রের জল না থাকলে ঢেউ কোথায়? সোনা না থাকলে আংটি কই? তাই আমার মধ্যেই তুমি আছ, আমার কোলেই তোমার থাকা, খাওয়া, বলা, বোঝা, চলে যাওয়া … বেদময়ী মা কালী আমি। একবার ‘মা’ বল। কোলে তুলে নেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *