কালিফোর্নিয়াবাসীর কাহিনী

কালিফোর্নিয়াবাসীর কাহিনী
 The Californians Tale

পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি স্বর্ণ-সন্ধনে বেরিয়েছিলাম স্টেনিসলস্ আঞ্চলে। গাঁইতি, কড়াই ও শিঙা সঙ্গে নিয়ে সারা দিন ঘুরে বেড়াই; এখানে-ওখানে টুপি-ভর্তি নোংরা ধূলোবালি ধুই, প্রতিবারই আশা করি একটা দাঁও মারব, কিন্তু কখনই তা হয় না। জায়গাটা চমৎকার,-গাছপালা ভর্তি, সুরভিত, রুচি কর; বহু বছর আগে এক সময় এখানে লোকবসতি ছিল, কিন্তু এখন সে লোকজনরা উধাও হয়ে গেছে; এ মনোরম স্বর্গভূমি আজ একান্ত নির্জন! মাটির উপরে খননের কাজ চলার সময়ই তারা চলে গিয়েছিল। একটা জায়গায় একসময় ছিল জমজমাট ছোট শহর,-ব্যাংক ছিল, খবরের কাগজ ছিল, অগ্নিনির্বাপক কোম্পানি ছিল, একজন মেয়র ছিল, অল্ডারম্যান ছিল; কিন্তু আজ জায়গাটা দূর-বিস্তার মরকত-বর্ণের ঘাসে-ঢাকা একটা প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়; একসময় যে এখানে মানুষের বাস ছিল তার চিহ্নমাত্র ও নেই। টাটটাউন পর্যন্ত এই একই অবস্থা। আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে ধূলোভর্তি রাস্তার দুপাশে কিছু দূরে দূরে এখনও চোখে পড়ে ছোট ছোট আরামদায়ক সুন্দর ঘর-বাড়ি; ইতস্তত গোলাপ ফুল ছিটনো দ্রাক্ষালতার জালে বাড়িগুলো এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো যে দরজা-জানালাগুলো চোখেই পড়ে না-তা থেকেই বোঝা যায় যে পরাজিত ও হতাশ পরিবারগুলো বাড়িঘর বিক্রি করতে না পেরে অনেক বছর হল সব ছেড়েছুডেই চলে গেছে। আধ ঘণ্টা পর পরই যে নির্জন কাঠের বাড়িগুলি চোখে পড়ে সেগুলো সোনার খনির কাজ চলবার একেবারে প্রথম সময়কার; ঐ সব বাড়িঘর যারা তৈরি করেছিল তাদেরও আগে যে সব। স্বর্ণ-সন্ধানী এখানে এসেছিল এই কাঠের বাড়িগুলো তারাই বানিয়েছিল। দুএকটা কাঠের বাড়িতে এখনও অধিবাসীই সর্ব প্রথম এখানে এসে বাড়িটি তৈরি করেছিল; আপনি আরও ধরে নিতে পারেন যে-এক সময় প্রচুর বিত্তবান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার সুযোগ সে পেয়েছিল, কিন্তু ফিরে যায় নি; তারপর অর্থবিত্ত সব হারিয়ে মনের দুঃখে দেশের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের কাছে মৃতবৎ হয়ে থাকাই স্থির করেছে। সেকালে কালিফোর্নিয়ার চারপাশে এরকম অনেক জীয়ন্তে মরা মানুষ ছড়িয়ে। ছিটিয়ে ছিল-ভগ্যের হাতে মারখাওয়া কতকগুলি অসহায় মানুষ; চল্লিশেই বুড়িয়ে গেছে; মনের সব গোপন চিন্তার মূল কথাই এখন শুধু অনুতাপ করে আশা-অনুতাপ ব্যর্থ জীবনের জন্য, আর আশা এই সংগ্রাম থেকে উত্তরণের জন্য।

নির্জন প্রান্তর। ঘাস ও গাছপালায় ঢাকা সেই শান্ত বিস্তারের মধ্যে শুধু কীট-পতঙ্গের ঘুম পাড়ানিয়া ও গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই; কোন মানুষ বা পশু ও চোখে পড়ে না; মনটাকে সতেজ রাখবার বা জীবনকে সুখী রাখবার মত কোন কিছুই নেই। আর তাই শেষ পর্যন্ত অপরাহ্নের গোড়ার দিকে যখন একটি মনুষ্যমূর্তি দৃষ্টিগোচর হল তখন মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। লোকটির বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ; যে ধরনের গোলাপে-ঢাকা আরামদায়ক ছোট বাড়ির কথা আগেই বলেছি তেমনই একটা বাড়ি ফ ট কে সে দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য এ লোকটিকে দেখে সর্বহারা বলে মনে হয় না, মনে হয়, এর জীবনে রস আছে, একে আদর করবার, সেবাযত্ন করবার লোক আছে; সামনেকার উঠোনটার চেহারাও তাই বলে; প্রচুর ফুলে-ফুলে বাগানটা যেন হাসছে। সে আমন্ত্রণ করে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল, সব রকম আরামের ব্যবস্থা করে দিল-গ্রামাঞ্চলের এটাই রীতি।

অনেক সপ্তাহ ধরে প্রতি দিন প্রতি রাত্রি কাটিয়েছি খনির লোকদের ঘরে-তার মানেই সেই নোংরা মেঝে, অগোছালো বিছানা, টিনের কাপপ্লেট, নোনা শূকর-মাংস, শুটি ও কালো কফি, আর ঘরের অলংকরণ বলতে কাঠের দেওয়ালে সেঁটে দেওয়া প্রাচ্যদেশীয় সচিত্র সংবাদপত্র থেকে কেটে নেওয়া যুদ্ধের ছবি। তাই আজ এ রকম একটা জায়গা দেখে মন আনন্দে ভরে উঠল। সে সবই ছিল কঠিন, নিরানন্দ, মরুভূমিসদৃশ, কিন্তু এখানে এমন কিছু আছে যা শ্রান্ত চোখকে শান্তি দেয়, দীর্ঘ ক্ষুধার্তকে দেয় পুষ্টি। একটা মোটা কার্পেট যে এত নয়নলোভন হতে পারে, দেয়াল-কাগজ আর বাঁধানো ছবি, উজ্জ্বল রঙের পর্দা আর আলোর ঢাকনা, উইণ্ডসোর চেয়ার, বার্নিশ-করা তাক, তার উপর সাজানো সামুদ্রিক ঝিনুক, বই ও চীনামাটির পাত্র, এক কথায় একটি নারীর হাতে ঘর-সংসার যে মনকে এমনভাবে ভরে দিতে পারে, সে কথা আমি আগে বিশ্বাস করতাম না। আমার মনের এই উল্লাস আমার মুখেও ফুটে উঠে ছিল; তাই লোকটি তা দেখতে পেল আর দেখে খুসিই হল।

ভাব-গদগদ স্বরে সে বলল, এ সবই আমার স্ত্রীর হাতে করা; প্রতিটি কাজই সে নিজে করেছে। একটা ছবির ফ্রেমের উপরকার জাপানী নরম কাপড়ের ঝালরটা একটু বেঁকে গিয়েছিল। বেশ যত্ন করে লোকটি ঝালরটাকে ঠিক করে দিল, পিছিয়ে এসে বারকয়েক সেটাকে ভাল করে দেখে নিয়ে আবার ঠিক করে তবে শান্ত হল। বলল: আমার স্ত্রীও এই রকম করে। কি যে অভাব আছে বোঝা যায় না, অথচ একটা অভাব যে আছে তা বোঝা যায় এবং সেটা ঠিক করা হলে তখন বোঝা যায় অভাবটা কি ছিল। এর কোন ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। মা যেমন ছেলের চুল আঁচড়ে দেবার পরে একটু ঠিকঠাক করে দেয়, এও অনেকটা সেই রকম।

হাত-মুখ ধোবার জন্য সে আমাকে একটা শোবার ঘরে নিয়ে গেল। অনেক বছর এত সুন্দর শোবার ঘর আমি দেখি নিঃ সাদা বিছানার চাদর, সাদা বালিশ, কার্পেট–ঢাকা মেঝে, কাগজ-আঁটা দেয়াল, ছবি, ড্রেসিং-টেবিল, আয়না, পিন-কুশন ও সাজের জিনিসপত্র; এক কোণে মুখ ধোবার জায়গা; তাতে আসল চিনে মাটির গামলা ও কুজো, চীনা মাটির পাত্রে সাবান, তাকের উপর এক ড জনের বেশী তোয়ালে-তোয়ালে গুলো এত পরিচ্ছ্বর ও সাদা যে হাত দিতে সংকোচ হয়। মনের ভাব আবারও আমার মুখে ফুটে উঠল, আর সেও আত্মতুষ্টির সঙ্গে বলে উঠলঃ

এ সবই তার কাজ নিজেই করেছে প্রতিটি কাজ। এখানে এমন কিছু নেই যাতে তার হাতের ছোঁয়া না লেগেছে। আপনি হয়তো ভাবছেন-কিন্তু আমি বড়ই বকবক করছি।

হাত ধুতে ধুতে আমি যখন ঘরের চারদিকের সব কিছু দেখছিলাম, নতুন জায়গায় এলে সবাই তাই করে থাকে, তখন আমার মনে হল সে যেন চাইছে যে এ ঘরের কোন একটা জিনিস যেন আমি নিজে থেকেই আবিষ্কার করতে পারি। চোখের আকারে-ইঙ্গিতে সে আমাকে জিনিসটার একটা আভাষ দিতেও চেষ্টা করছিল। বারকয়েক এদিক ওদিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত আমার দৃষ্টি গিয়ে ঠিক জায়গাটিতে পড়ল। খুসিতে হেসে উঠে দুই হাত ঘসতে ঘসতে সে বলল:

ঠিক ধরেছেন! ঐটেই বটে! আমি জানতাম আপনি পারবেন। তার ছবি।

দেয়ালের এক কোণে রাখা কালো আখরোট কাঠের একটা ছোট ব্র্যাকেট, আর সেখানেই রয়েছে সেই জিনিসটি যা আমি আগে লক্ষ্য করি নি-তামার উপর মিনে-করা একটা ছবি। একখানি মিষ্টি মেয়েলি মুখ; এত সুন্দর যে মনে হল এরকম মুখ আগে কখনও দেখি নি। আমার মুখের সবিস্ময় প্রশংসাটুকু যেন সে আকণ্ঠ পান করে তৃপ্ত হল।

বলল, উনিশে তার বিগত জন্ম দিন গেছে, আর সেই দিনই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। যখন তাকে দেখবেন-একটু পরেই দেখতে পাবেন

তিনি কোথায়? কখন আসবেন?

এখন এখানে নেই। আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে গেছে। এখান থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ মাইল দূরে তাঁরা থাকেন। আজ দুসপ্তাহ হল সে গেছে।

তিনি কবে ফিরবেন বলে আশা করছেন?

আজ বুধবার। শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ সে ফিরবে-হয় তো নটা হবে।

আমি নিরাশার বেদনা অনুভব করলাম।

কিছুটা অনুতাপের সুরেই বললাম, দুঃখের কথা, তখন আমাকে চলে যেতে হবে।

চলে যাবেন? না, না,-যাবেন কেন? যাবেন না। তাহলে সেও খুব হতাশ হবে।

সে হতাশ হবে-সেই সুন্দর মানুষটি! কথাগুলি যদি সেই নারী নিজের মুখে বলত তাহলেও এর চাইতে মনোরম হত না। তাকে চোখে দেখবার একটু গভীর, উগ্র কামনা অনুভব করতে লাগলাম-সে কামনা এতই সকাতর ও সনির্বন্ধ যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। নিজেকে বললাম: মনের শান্তির জন্যই অবিলম্বে এখান থেকে চলে যাব।

কি জানেন, লোকজন এখানে এসে থাকুক, সেটা সে খুব পছন্দ করে-বিশেষ করে যারা বেশ জানে-শোনে, কথা বলতে পারে-এই আপনার মত। এতে তার খুব আনন্দ; কারণ সেও জানে-শোনে-প্রায় সব কিছুই জানে, কথা বলতে পারে একেবারে পাখির মত-আর পুথিপত্র যা পড়ে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। যাবেন না; মাত্র কটা তো দিন; নইলে সে বড়ই হতাশ হবে।

কথাগুলি শুনলাম, কিন্তু খেয়াল করলাম না; নিজের চিন্তায় ও দ্বন্দ্বে একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম। সে বাইরে গেল; তাও খেয়াল করি নি। ইতিমধ্যে একটা ছবির এলবাম হাতে নিয়ে ফিরে এসে সেটা আমার সামনে খুলে ধরল। বলল:

এই নিন, এবার তার মুখের সামনে বলুন যে তাকে দেখবার জন্য আপনি থাকতে পারতেন, কিন্তু থাকবেন না।

দ্বিতীয়বার চোখ ফেলতেই আমার সংকল্প ভেঙে গেল। ঝুঁকি নিয়েই আমি থেকে যাব। সে রাতে আমরা শান্তিতে পাইপ টানলাম, নানা বিষয়ে বিশেষ করে তার বিষয়ে-অনেক রাত অবধি কথা বললাম; সত্যি, অনেক দিন পরে বড় সুখে সময়টা কাটল। বৃহস্পতিবার এল এবং বেশ আরামের মধ্যেই চলে গেল। সন্ধার দিকে একজন বড়সড় খনির লোক মাইল তিনেক দূর থেকে এসে হাজির হল-সেই ধূসর চুল, ভাগ্যবিতাড়িত অগ্রপথিকদের একজন-আমাদের সাদর অভিবাদন জানাল এবং গম্ভীর, বিচু ক্ষণ ভাষায় কথা বলল:

ছোট ম্যাডামের খবর জানবার জন্যই নেমে পড়লাম। কখন আসছে? কোন সংবাদ পেয়েছ কি?

হ্যাঁ, চিঠি পেয়েছি। পড়ে শোনাব নাকি টম?

তোমার আপত্তি না থাকলে শুনতেই তো চাই হেনরি।

থলে থেকে একটা চিঠি বের করে বলল, কিছু কিছু কথা বাদ দিয়ে সে পড়তে চায়; তারপরই চিঠি টা পড়তে লাগল; একখানি নিরুচ্ছাস ভালবাসার চিঠি, সুন্দর ভাষায় লেখা; পুনশ্চ অংশে টম, জো, চার্লি ও অন্যান্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশীদের প্রতি সাদর সম্ভাষণ ও তাদের কথার উল্লেখ করা হয়েছে।

পড়া শেষ করে টমের দিকে তাকিয়েই সে বলে উঠল:

আহা, আবার তাই করছ! হাত সরাও, তোমার চোখ দেখতে দাও। যখনই তার চিঠি পড়ি তখনই তুমি এই কাণ্ড কর। চিঠি লিখে সব তাকে জানিয়ে দেব।

না, না, তা করো না হেনরি। তুমি তো বোঝ, আমি বুড়ো হয়েছি, সামান্য হতাশায়ই আমার কান্না পায়। ভেবছিলাম, এখানে এলে তাকেই দেখতে পাব; তার বদলে এসেছে শুধু একটা চিঠি।

আরে, এটা আবার তোমার মাথায় কে ঢোকাল? সকলেই তো জানে, শনিবারের আগে সে আসছে না।

শনিবার! তাই তো! আমিও তো জানতাম। আজকাল আমার কী যে হয়েছে ভাবলে অবাক লাগে। সত্যি তো, কথাটা তো আমিও জানতাম। ঠিক আছে, আমি তাহলে যাচ্ছি। সে এলে আবার এসে হাজির হব হে!

শুক্রবার বিকালে মাইলখানেক দূরের বাড়ি থেকে আর একজন পাকা চুল বুড়ো এসে বলল, হেনরি যদি মনে করে যে মহিলাটি পথশ্রমে খুব বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়বে না, তাহলে শনিবার রাতে ছেলেরা একটু আমোদ-আহ্লাদ করতে চায়।

ক্লান্ত! সে হবে ক্লান্ত! শোন কথা! আরে জো, তুমি তো জান, তোমাদের খুসি করতে সে ছসপ্তাহ বসে কাটাতে পারে!

চিঠি এসেছে শুনে সেও চিঠিটা শুনতে চাইল, আর তাতে তার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা থাকায় বুড়ো লোকটি একেবারেই ভেঙে পড়ল; বলল, সে তো একটা বুড়ো হাবড়া, কাজেই চিঠিতে শুধু তার নামটা থাকলেই তার এই অবস্থা হত। হায় প্রভু, সে না থাকলে এত খারাপ লাগে! সে বলল।

শনিবার বিকেল হতেই আমি বারবার ঘড়ি দেখতে লাগলাম। সেটা লক্ষ্য করে বিস্মিত চোখে হেনরি বলল:

আপনি কি ভাবছেন সে এত তাড়াতাড়ি এসে পড়বে?

ধরা পড়ে একটু বিব্রত বোধ করলাম; কিন্তু হেসে বললাম, কোন রকম প্রত্যাশায় থাকলে ও রকম করাটা আমার অভ্যাস। কিন্তু এতে। সে খুব তুষ্ট হল না; তখন থেকেই তার মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। চারবার আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে এমন জায়গায় গেল যেখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়; সেখানে দাঁড়িয়ে চোখের উপরে হাত রেখে তাকিয়ে দেখল। বারকয়েক বলল:

আমার চিন্তা হচ্ছে; খুবই চিন্তা হচ্ছে। আমি জানি, নটার আগে তার আসার কথা নয়, তবু কে যেন বলছে যে একটা কিছু ঘটেছে। আপনারও কি তাই মনে হচ্ছে না কি?

তার এই ছেলেমানুষী কথা শুনে আমারই লজ্জা করতে লাগল; শেষ পর্যন্ত ঐ একই প্রশ্ন যখন সে আরও একবার করে বসল, তখন। আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম, কিছুটা নিষ্ঠুরভাবেই তার কথার জবাব দিলাম। সে কুঁকড়ে মাথা নীচু করল; আমার কথায় সে এতই আহত ও অপমানিত বোধ করল যে অকারণে নিষ্ঠুর কথাগুলি বলার জন্য আমারই কষ্ট হতে লাগল। যাই হোক, সন্ধার দিকে আর এক বুড়ো চার্লি এসে যখন আসর জমিয়ে বসল, মহিলাটি কে স্বাগত জানাবার উদ্যোগ-আয়োজনের কথা বলতে লাগল, তখন আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। চার্লি একটার পর একটা মজার কথা বলে বন্ধুর মন থেকে সব দুশ্চিন্তা ও আশংকা দূর করে দিল।

তার একটা কিছু ঘটে ছে? আরে হেনরি, এটা স্রেফ বাজে কথা। তার কিছুই ঘটতে পারে না; সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। চিঠিতে কি লেখা আছে? লেখা আছে, সে ভাল আছে, তাই নয় কি? লেখা আছে, নটা নাগাদ সে এখানে পৌঁছবে, তাই নয় কি? তাকে কি কখনও কথার খেলাপ করতে দেখেছে? তা দেখ নি। কাজেই মন খারাপ করো না; সে এসে পড়বে, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই; তোমার জন্ম যেমন সত্য, এটাও তেমনই সত্য। এখন এস, একটু সাজানো-গোছানো যাক-হাতে তো বেশী সময় নেই।

অচিরেই টম ও জো-ও এসে পড়ল। সকলে মিলে বাড়িটাকে ফুল দিয়ে সাজাতে লাগল নটা নাগাদ তিন বুড়ো বলল, তারা তো বাদ্যযন্ত্র সঙ্গে নিয়েই এসেছে, কাজেই এখনই বাজনা শুরু করা যেতে পারে; এর পরেই তো ছেলেমেয়েরা এসে পড়বে হৈ-হুঁল্লোড় করতে। একটা বেহালা, একটা ব্যাঞ্জো ও একটা ক্লারিওনেট–বাজনার মধ্যে এই তিনটি। তিন মূর্তি পাশাপাশি বসে নাচের হাল্কা সুর বাজাতে বুট দিয়ে তাল ঠুকতে লাগল।

নটা বাজতে চলল। রাস্তার দিকে চোখ রেখে হেনরি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মানসিক যন্ত্রণায় শরীরটা দুলছে। স্ত্রীর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কামনা করে বারকয়েক তাকে মদ খাওয়ানো হয়েছে। এবার ট ম চেঁচিয়ে বলল:

সকলে উটে দাঁড়াও! আর এক গ্লাস করে চলুক। সে এল বলে!

জো গ্লাসগুলি এগিয়ে দিল। অবশিষ্ট দুটোর একটার জন্য আমি হাত বাড়ালাম, কিন্তু জো চাপা গলায় গর্জে উঠল;

ওটা ছেড়ে দিন! অপরটা নিন।

তাই করলাম। সকলের শেষে দেওয়া হল হেনরিকে। পানীয় গলা দিয়ে নামবার আগেই ঘড়িটা বেজে উঠল। শেষ পর্যন্ত শুনে তার মুখটা ক্রমেই কালো হয়ে উঠল; বলল:

শোন হে, ভয়ে আমার অস্থির লাগছে। আমাকে ধর-আমি শুয়ে পড়ব।

সকলে ধরাধরি করে তাকে সোফায় নিয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে থেকে সে তন্দ্রায় ঢলে পড়ল। একসময়ে ঘুমের মধ্যেই বলে উঠল: ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনলাম যেন? তারা কি এসেছে?

এক বুড়ো তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, জিমি প্যারিশ এসে জানিয়ে গেল, পথে তাদের দেরী হয়েছে; তবে তারা বড় রাস্তা ধরে আসছে। মাদামের ঘোড়াটা আবার খোঁড়া; তবু আধ ঘণ্টার মধ্যেই সে এসে পড়বে।

আঃ, ভাগ্য ভাল যে কিছু ঘটে নি।

কথাগুলো বলার সাথে সাথেই সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। লোকজনরা তার পোশাক খুলে ফেলে তাকে তার ঘরের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর দরজাটা বন্ধ করে ফিরে এল। তারপরই তারা চলে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল। আমি বললাম: দয়া করে আপনারা যাবেন না। মহিলাটি আমাকে চিনতে পারবেন না; আমি তো নবাগত।

তারা পরস্পরের দিকে তাকাল। জো বলল:

সে? বেচারি, উনিশ বছর হল সে মারা গেছে!

মারা গেছেন?

তার চাইতেও শোচনীয়। বিয়ের ছ মাস পরে সে আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে গিয়েছিল; শনিবার সন্ধায় ফিরবার পথে এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে ইণ্ডিয়ানরা তাকে পাকড়াও করে; সেই থেকে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।

আর তার ফলেই তার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে?

এক ঘন্টা আগেও খারাপ ছিল না। কিন্তু বছরের এই সময়টা যখনই ঘুরে আসে তখনই অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। তখনই তার ফি রবার তিন দিন আগে থেকেই আমরা এখানে আসতে শুরু করি, তাকে উৎসাহ দেই, স্ত্রীর কাছে থেকে কোন চিঠি এসেছে কিনা জিজ্ঞাসা করি, এবং শনিবার এলেই আমরা সকলে এসে হাজির হই, বাড়িটাকে ফুল দিয়ে সাজাই, এবং একটা নাচের আসরের সব ব্যবস্থা করে ফেলি। উনিশ বছর ধরে প্রতি বছরই আমরা এই করে আসছি। প্রথম শনিবারে মেয়েদের বাদ দিয়েই আমরা ছিলাম সাতাশ জন; আজ তিন জনে এসে ঠেকেছি; মেয়েরা সকলেই চলে গেছে। একটা ওষুধ খাইয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখি, নইলে উন্মুক্ত হয়ে ওঠে; তারপর আবার এক বছরের জন্য সে সুস্থ হয়ে ওঠে–মনে করে শেষের তিন-চারটে দিন ছাড়া সে তার কাছেই আছে; তারপরেই সে তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, পুরনো চিঠিটা বের করে এবং আমরা এসে তাকে চিঠিটা পড়ে শোনাতে বলি। হায় প্রভু, বড় ভাল মেয়ে ছিল!

[১৮৯৩]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *