৯
এক বৎসরের মধ্যেই চক্রবর্তী-বাড়ির অবস্থা হইয়া গেল বজ্রাহত তালগাছের মত। তালগাছের মাথায় বজ্রাঘাত হইলে সঙ্গে সঙ্গেই সে জ্বালিয়া পুড়িয়া ভস্মীভূত হইয়া যায় না। দিন কয়েকের মধ্যেই পাতাগুলি শুকাইয়া যায়, তারপর শুষ্ক পাতাগুলি গোড়া হইতে ভাঙিয়া ঝুলিয়া পড়ে, ক্রমে সেগুলি খসিয়া যায়, অক্ষত-বহিরঙ্গ সুদীর্ঘ কাণ্ডটা ছিন্নকণ্ঠ হইয়া পুরাকীর্তির স্তম্ভের মত দাঁড়াইয়া থাকে। চক্রবর্তী-বাড়ির অবস্থাও হইল সেইরূপ। মহীন্দ্রের মামলাতেই চক্রবর্তী-বাড়ির বিষয়-সম্পত্তি প্রায় শেষ হইয়া গেল। থাকিবার মধ্যে থাকিল বজ্রাহত তালকাণ্ডের মত প্রকাণ্ড বাড়িখানা, সেও সংস্কার-অভাবে জীর্ণ, শ্রীহীনতায় রুক্ষ কালো। ইহারই মধ্যে বাড়িটার অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসিয়া গিয়াছে, চুনকামের অভাবে শেওলায় ছাইয়া কালো হইয়া উঠিয়াছে। মহীন্দ্রের মামলায় দুই হাজারের স্থলে খরচ হইয়া গেল পাঁচ হাজার টাকা। মজুমদারের বন্দোবস্তে টাকার অভাব হয় নাই, হ্যাণ্ডনোটেই টাকা পাওয়া গিয়াছিল। কিন্তু টাকা থাকিতেও বাকি রাজস্বের দায়ে একদিন সম্পত্তিও নিলাম হইয়া গেল। ভাগ্যের এমনি বন্দোবস্ত যে নীলামটা হইল যেদিন মহীন্দ্রের মামলায় রায় বাহির হইল সেই দিনই। মামলার এই চরম উত্তেজনাময় সঙ্কটের দিনেই ছিল নীলামের দিন, মজুমদারের মত লোকও একথা বিস্মৃত হইয়া গেল। যখন খেয়ালে আসিল, তখন যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়া গিয়াছে। রায়-বাড়ির অনেকে মনে মনে পুলকিত হইয়া উঠিলেও চক্রবর্তী-বাড়িতে এজন্য আক্ষেপ উঠিল না। বিদ্যুৎ-স্পৃষ্টের তো বজ্রনাদে শিহরিয়া উঠিবার অবকাশ হয় না। মামলায় মহীন্দ্রের দশ বৎসর দ্বীপান্তরের আদেশ হইয়া গিয়াছে, সেই আঘাতে চক্রবর্তী-বাড়ি তখন নিস্পন্দ হইয়া গিয়াছে।
সকলেই আশা করিয়াছিল, মহীন্দ্রের গুরুতর শাস্তি কিছু হইবে না। সমাজের নিকট মহীন্দ্রের অপরাধ, ননী পালের অন্যায়ের হেতুতে, মার্জনার অতীত বলিয়া বোধ হয় নাই; কিন্তু বিচারালয়ে সরকারী উকিলের নিপুণ পরিচালনায় সে অপরাধ অমার্জনীয় বলিয়াই প্রমাণিত হইয়া গেল। মায়ের অপমানে সন্তানের আত্মহারা অবস্থার অন্তরালে তিনি বিচারক ও জুরীগণকে দেখাইয়া দিলেন, জমিদার ও প্রজায় চিরকালের বিরোধ। সওয়ালের সময় তিনি ঈশপের নেকড়ে ও মেষশাবকের গল্পটির উল্লেখ করিয়া বলিলেন, এই অপরাধ যদি ওই অপমানসূচক কয়টি কথার ভারে লঘু হইয়া যায়, তবে ঈশপের নেকড়েরও মেষশাবক-হত্যার জন্য বিন্দুমাত্র অপরাধ হয় নাই। নেকড়েরও অভিযোগ ছিল যে, মেষশাবক নেকড়ের বাপকে গালিগালাজ করিয়াছিল। ওই অপমানের কথাটা ঈশপের গল্পের মত দুরাত্মার একটা ছল মাত্র; আসল সত্য হইল, উদ্ধত জমিদারপুত্র ওই হতভাগ্য তেজস্বী প্রজাটিকে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে হত্যা করিয়াছে এবং সে-কথা আমি যথাযথরূপে প্রমাণ করিয়াছি বলিয়াই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর যে কথা কয়টিকে মর্মান্তিক অপমানসূচক বলিয়া চরম উত্তেজনার কারণস্বরূপ ধরা হইতেছে, সে-কথাও মিথ্যা নয়, সে-কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আসামীর-
কেন আপনি মিথ্যা বকছেন?-উকিলের সওয়ালে বাধা দিয়া মহীন্দ্র বলিয়া উঠিল। সে কাঠগড়ায় রেলিঙের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। উকিলের বক্তব্যের প্রারম্ভ শুনিয়াই সে তৈলহীন রুক্ষ পিঙ্গল-কেশ আসামী পিঙ্গল চোখে তীব্র দৃষ্টি লইয়া মূর্তিমান উগ্রতার মত বলিয়া উঠিল, কেন আপনি মিথ্যা বকছেন? হ্যাঁ, উদ্ধত প্রজা হিসেবেই ওকে আমি গুলি করে মেরেছি।
সরকারি উকিল বলিলেন, দেখুন দেখুন, আসামীর মূর্তির দিকে চেয়ে দেখুন। প্রাচীন আমলের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের জ্বলন্ত নিদর্শন।
ইহার পর চরম শাস্তি হওয়াই ছিল আইনসঙ্গত বিধান। কিন্তু বিচারক ওই অপমানের কথাটাকে আশ্রয় করিয়া এবং অল্প বয়সের কথাটা বিবেচনা করিয়া সে শাস্তি বিধানের হাত হইতে মহীকে অব্যাহতি দিলেন। ওদিকে সম্পত্তি তখন নিলামে বসিয়াছে। ডাকিয়াছেন চক্রবর্তী-বাড়ির মহাজন -মজুমদার মশায়েরই শ্যালক। লোকে কিন্তু বলিল, শ্যালক মজুমদারের বেনামদার।
মহীন্দ্র অবিচলিত ভাবেই দণ্ডাজ্ঞা গ্রহণ করিল। সকলে বিস্মিত হইয়া দেখিল। রায় দিয়া এজলাস ভাঙিয়া বিচারক বলিলেন, I admire his boldness! সাহসের প্রশংসা করতে হয়।
সরকারি উকিল হাসিয়া বলিলেন, Yes Sir! এর পিতামহ সাঁওতাল-হাঙ্গামার সময় সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই ক’রে মরেছিল। সামন্তবংশের খাঁটি রক্ত ওদের শরীরে- true blood!
মহীন্দ্র সম্পত্তি নিলামের কথা শোনে নাই। সে শুধু আপন দণ্ডাজ্ঞাটাকেই তাহাদের সংসারের একমাত্র দুর্ভাগ্য বিবেচনা করিয়া মজুমদারকে ডাকিয়া বলিল, দুঃখ করবেন না। আপীল করবার প্রয়োজন নেই। আমি নিজে যেখানে স্বীকার করেছি, তখন আপীলে ফল হবে না। আর সর্বস্বান্ত হয়ে মুক্তি পেয়ে কি হবে? শেষে কি রায়-বাড়িতে ভিক্ষে ক’রে খেতে হবে?
কোর্টের জনতার মধ্যে একখানা চেয়ারে স্তম্ভিতের মত বসিয়া ছিলেন ইন্দ্র রায়। মহীন্দ্র শেষ কথাটা তাঁহারই দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিল। কথাটা রায়ের কানেও গেল, কিন্তু কোনমতেই মাথা তুলিয়া তিনি চাহিতে পারিলেন না।
মহীন্দ্র আবার বলিল, পারেন তো বাবার কাছে খবরটা চেপে রাখবেন। মাকে কাঁদতে বারণ করবেন। বাবার ভার এখন সম্পূর্ণ তাঁর ওপর। আর অহিকে যেন পড়ানো হয়, যতদূর সে পড়তে চাইবে।
মাথা উঁচু করিয়া হাতকড়ি পরিয়া সে কন্স্টেব্লের সঙ্গে চলিয়া গেল। সকলের শেষে ইন্দ্র রায় মাথা হেঁট করিয়া কোর্ট হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। বাড়ি ফিরিয়া একেবারে অন্দরে গিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া হেমাঙ্গিনী শিহরিয়া উঠিলেন, অত্যন্ত কুণ্ঠিত এবং শঙ্কিত ভাবে প্রশ্ন করিলেন, কি হ’ল?
ইন্দ্র রায় কথার উত্তর দিলেন না।
* * *
সুনীতি সব সংবাদই শুনিলেন। মহীন্দ্রের সংবাদ শুনিলেন সেই দিনই তবে এ-সংবাদটা শুনিলেন দিন দুই পর-অপরের নিকট; গ্রামে তখন গুজব রটিয়া গিয়াছিল। সুনীতি এই দুঃসহ দুঃখের মধ্যেও উদাসীন হইয়া থাকিতে পারিলেন না, তিনি মজুমদারকে ডাকিয়া বলিলেন, ঠাকুরপো, এ কি সত্যি?
মজুমদার নিরুত্তর হইয়া অপরাধীর মত দাঁড়াইয়া রহিল।
সুনীতি বলিলেন, বল ঠাকুরপো বল। ভিক্ষে করতেই যদি হয় তবে বুক আগে থেকেই বেঁধে রাখি, আর গোপন ক’রে রেখো না, বল।
মজুমদার এবার বলিল, কি বলব বউঠাকরুন, আমি তখন মহীর মামলার রায় শুনে-
সুনীতি অসহিষ্ণু হইয়া কথার মাঝখানেই প্রশ্ন করিলেন, সব গেছে?
চোখ মুছিয়া মজুমদার বলিল, আজ্ঞে না, দেবোত্তর সম্পত্তি, আমাদের লাখেরাজ, এই গ্রাম, তারপর চক আফজলপুর, তারপর জমিজেরাত-এসব রইল।
সুনীতি চুপ করিয়া রহিলেন, আর তাঁহার জানিবার কিছু ছিল না। মজুমদার একটু নীরব থাকিয়া বলিল, একটা কাজ করলে একবার চেষ্টা ক’রে দেখা যায়। বিষয় হয়তো ফিরতেও পারে। ওই চরটার জন্য অনেক দিন থেকে একজন ধরাধরি করছে, ওটা বিক্রি ক’রে মামলা করে দেখতে হয়, বিষয়টা যদি ফেরে।
সুনীতি বলিলেন, না ঠাকুরপো, ও চরটা থাক। ওই চরের জন্যেই মহী আমার দ্বীপান্তর গেল, ও চর মহী না ফেরা পর্যন্ত প’ড়েই থাক।
মজুমদার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তবে থাক। তা হ’লেও আমি ছাড়ব না, যাব একবার আমি রবি ঘোষালের কাছে। টাকা নিয়ে সে সম্পত্তি ফিরে দিক।
সুনীতি হাসিলেন, বলিলেন, তিনিও তো অনেক টাকা পাবেন; সে টাকাই বা কোথা থেকে দেবে বল? তুমি তো সবই জান।
মজুমদার আর কিছু বলিল না। যাইবার জন্যই উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু সুনীতি বাধা দিয়া বলিলেন, আর একটু দাঁড়াও ঠাকুরপো। কথাটা কিছুদিন থেকেই বলব ভাবছি, কিন্তু পারছি না। বলছিলাম, তুমি তো সবই বুঝছ; যে অবস্থায় ভগবান ফেললেন, তাতে ঝি, চাকর, রাঁধুনী সবাইকে জবাব দিতে হবে। তোমার সম্মানই বা মাসে মাসে কি দিয়ে করব ঠাকুরপো?
মজুমদার তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, তা বেশ তো বউঠাকরুন, আর কাজই বা এমন কি রইল এখন? লোকের দরকারই বা কি? তবে যখন যা দরকার পড়বে, আমি ক’রে দিয়ে যাব। যে আদায়টুকু আছে, সেও আমি না হয় গোমস্তা হিসেবে ক’রে দেব। সরঞ্জামি কেবল নগ্দীর মাইনেটাই দেবেন।
সুনীতি আর কোন কথাই বলিলেন না, মজুমদার ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। সেই দিনই সুনীতি মানদা, বামুনঠাকরুন, এমন কি চাকরটিকে পর্যন্ত জবাব দিলেন। কিন্তু জবাব দেওয়া সত্ত্বেও গেল না শুধু মানদা। সে বলিল, আমি যাব না। আজ পঁচিশ বছর এখানে রয়েছি, চোখও বুজব এই বাড়িতে। বাড়ি নাই, ঘর নাই, আমি কোথায় যাব? তা ঝাঁটাই মার আর জুতোই মার! হ্যাঁ!
ইন্দ্র রায় সেই যে কোর্ট হইতে আসিয়া বাড়ি ঢুকিয়াছিলেন, দুই তিন ধরিয়া আর তিনি বাহির হন নাই। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঘরের মধ্যেই ঘুরিয়া বেড়ান, কাহাকেও কোন কথা বলেন না, এমন কি দিনের মধ্যে তামাক দিতেও কাহাকেও ডাকেন না। তাহার সে মুখ দেখিয়া চাকরবাকর দূরের কথা আদরিণী মেয়ে উমা পর্যন্ত সম্মুখে আসে না। সেদিন হেমাঙ্গিনী আসিয়া কুণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইলেন। রায় তাঁহার দিকে চাহিয়া দেখিয়া চিন্তাকুল গম্ভীর মুখেই ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, অ্যাঁ?
হেমাঙ্গিনী কুণ্ঠিত মৃদুস্বরে বলিলেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।
রায়ের মাথাটা আরও একটু ঝুঁকিয়া পড়িল।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, শরীর কি তোমার-
কথার মাঝখানেই রায় মাথা তুলিয়া উদ্ভ্রান্তস্বরে ডাকিয়া উঠিলেন, তারা-তারা মা!
হেমাঙ্গিনী দেখিলেন, রায়ের চোখ দুইটায় জল টলমল করিতেছে। হেমাঙ্গিনী মাথা নীচু করিলেন। রায় বলিলেন, লজ্জার বোঝা-শুধু লজ্জার বোঝা নয় হেম, এ আমার অপরাধের বোঝা-মাথায় নিয়ে মাথা আমি তুলতে পারছি না। রামেশ্বরের বড় ছেলে আমার মাথাটা ধুলোয় নামিয়ে দিয়ে গেল। তারা-তারা মা! আবার বার কয়েক অস্থিরভাবে ঘুরিয়া রায় বলিলেন, হেমাঙ্গিনী, আমি নিযুক্ত করেছিলাম ননী পালকে। শুধু চর দখল করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল না। ননীকে আমি বলেছিলাম, চক্রবর্তীদের যদি প্রকাশ্যভাবে অপমান করতে পারিস, তবে আমি তোকে বকশিশ দেব। ননী অপমান করলে রাধারাণীর-আমার সহোদরার।
হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়া অশ্রুর বন্যা নামিয়া আসিল।
রায় আবেগভরে বলিতে বলিতে শিহরিয়া উঠিলেন, উঃ, আদালতে মহীন কি বললে জান? সরকারী উকিল বললেন, মৃত ননী পাল যার অপমান করেছিল, সে আসামীর সৎমা।মহীন তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ ক’রে উঠল, যার নয়-বলুন যাঁর, -সে নয়-বলুন তিনি, সৎমা নয়-মা, আমার বড় মা।
গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া হেমাঙ্গিনী উদাস কণ্ঠে বলিলেন, দ্বীপান্তর হয়ে গেল?
দশ বৎসর! বার কয়েক ঘুরিয়া রায় অকস্মাৎ হেমাঙ্গিনীর হাত ধরিয়া বলিলেন, তুমি একবার মহীনের মায়ের কাছে যাবে হেম?
হেমাঙ্গিনী স্বামীর মুখের দিকে চাহিলেন।
রায় বলিলেন,আমার অনুরোধ! আমাকে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে হেম। রামেশ্বরের স্ত্রীপুত্রকে রক্ষা করতে হবে।
হেমাঙ্গিনী এবার কাতর স্বরে বলিলেন, ওগো, কোন্ মুখে আমি গিয়ে দাঁড়াব? কি বলব?
রায় আবার মাথা নীচু করিয়া পদচারণ আরম্ভ করিলেন। হেমাঙ্গিনীর কথার জবাব তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না। কিছুক্ষণ পর হেমাঙ্গিনী আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, উমাকে সঙ্গে নিয়ে যাই।
রায় বলিলেন, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি হেমাঙ্গিনী, এ কথাটা গোপন ক’রো। তুমি যেন আপনি –আমাকে লুকিয়ে গেছ। মহীনের মা যদি ফিরিয়ে দেন। মাথা নত করিয়া আবার বলিলেন- বলবে, যোগেশ মজুমদারকে যেন জবাব দেন আর চরের খাজনা আদায় ক’রে নিন ওঁরা।
হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলেন। রায় এতক্ষণ অন্দর হইতে কাছারিতে আসিয়া একজন পাইককে বলিলেন, যোগেশ মজুমদারকে একবার ডাক দেখি। বলবি, জরুরি কাজ। সঙ্গে নিয়ে আসবি, বুঝলি?
মজুমদার তাঁহার কাছারির ফটকে প্রবেশ করিবামাত্র তিনি সাগ্রহে সম্ভাষণ জানাইয়া বলিলেন, আরে, এস, এস, মজুমদার মশায়, এস!
মজুমদার প্রণাম করিয়া বলিল, আজ্ঞে বাবু, আশয়হীন লোককে মহাশয় বললে গাল দেওয়া হয়। আমি আপনাদের চাকর।
হাসিয়া রায় বলিলেন, বিষয় হ’লে আশয় হতে কতক্ষণ মজুমদার, এক দিনে এক মুহূর্তে জন্মে যায়।
মজুমদার চুপ করিয়া রায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। রায় বলিলেন, জান মজুমদার, আজকাল বড় বড় লোকের মাথা বিক্রি হয়, মৃত্যুর পর তাদের মাথা নিয়ে দেখে, সাধারণ লোকের সঙ্গে তাদের মস্তিষ্কের কি তফাৎ। তা আমি তোমার খান-দুয়েক হাড় কিনে রাখতে চাই, পাশা তৈরি করাব।
মজুমদারের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল কিন্তু মুখে কিছু বলিতে পারিল না। রায় আবার বলিলেন, রহস্য করলাম, রাগ ক’রো না। এখন একটা কাজ আমার করে দাও। চরটা আমাকে ব’লে ক’রে বিক্রি করিয়ে দাও। ওটার জন্য আমার মাথা আজও হেট হয়ে রয়েছে
গ্রামে।
মজুমদার এবার গলা পরিস্কার করিয়া লইয়া বলিল, ওঁরা বিক্রি করবেন না রায় মশায়।
ওঁরা? ওঁরা কে হে? তুমিই তো এখন মালিক।
আমার জবাব হয়ে গেছে।
জবাব হয়ে গেছে! কে জবাব দিল? রামেশ্বরের এখন এদিকে দৃষ্টি আছে নাকি?
আজ্ঞে না। তিনি একেবারেই কাজের বাইরে গিয়েছেন। জবাব দিলেন গিন্নীঠাকরুণ।
রায় অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, মেয়েটি শুনেছি বড় ভাল, সাবিত্রীর মত সেবা করেন রামেশ্বরের। এদিকে বুদ্ধিমতী ব’লেও তো বোধ হচ্ছে। না হ’লে তুমি তো বাকিটুকু অবশিষ্ট রাখতে না। বাঘে খানিকটা খেয়ে ইচ্ছে না হ’লে ফেলে যায়, কিন্তু সাপের তো উপায় নেই, গিলতে আরম্ভ করলে শেষ তাকে করতেই হয়। কিন্তু কাজটা তুমি ভাল করলে না মজুমদার।
এইবার মজুমদার বলিল, আজ্ঞে বাবু টাকাও তো আমি পাঁচ হাজার দিয়েছি।
তা দিয়েছ; কিন্তু মামলা- খরচের অজুহাতে তার অর্ধেকই তো তোমার ঘরেই ঢুকেছে মজুমদার। আমি তো সবই জানি হে। আমার দুঃখটা থেকে গেল, চক্রবর্তীদের আমি ধ্বংস করতে পারলাম না।
মজুমদার জবাব দিল, আজ্ঞে, পনের আনা তিন পয়সাই আপনার করা বাবু, ননী পালকে তো আপনিই খাড়া করেছিলেন।
রায় একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ও কাজটাতে আমি সুখী হ’তে পারি নি যোগেশ। এত খানি খাটো জীবনে হই নি। রামেশ্বরের বড়ছেলে আমার গালে চুনকালি মাখিয়ে দিয়ে গেছে। সেই কালি আমাকে মুছতে হবে। সেই কথাটা তোমাকে বলবার জন্যেই আমি তোমাকে ডেকেছিলাম। আর লোভ তুমি ক’রো না। ওই চরের দিকে হাত বাড়িও না, ওগুলো রামেশ্বরের ছেলেদের থাক। ওরা না জানুক, তুমি জেনে রাখ, রক্ষক হয়ে রইলাম আমি।
মজুমদারের বাক্যস্ফুর্তি হইল না; সে আপনার করতলের রেখাগুলির দিকে চাহিয়া বোধ করি আপনার ভাগ্যলিপি অনুধাবনের চেষ্টা করিতে লাগিল। রায় সহসা বলিলেন, সাইকেলে ওটি-রামেশ্বরের ছোট ছেলে নয়?
সম্মুখ পথে কে একজন অতি দ্রুত সাইকেল চালাইয়া চলিয়াছিল, গতির দ্রুততা হেতু মানুষটিকে সঠিক চিনিতে না পারিলেও এ ক্ষেত্রে ভুল হইবার উপায় ছিল না। আরোহীর উগ্র-গৌর দেহবর্ণ, তাহার মাথার উপর পিঙ্গলবর্ণ দীর্ঘ চুলগুলো বাতাসে চঞ্চল হইয়া নাচিতেছে চক্রবর্তীদের বংশপতাকার মত। মজুমদার দেখিয়া বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের অহীন্দ্রই বটে।
রায় বলিলেন, ডাক তো, ডাক তো ওকে। এত ব্যস্তভাবে কোথা থেকে আসছে ও?
মজুমদারও চঞ্চল হইয়া উঠিল, সে বার বার ডাকিল, অহি! অহি! শোন, শোন।
গতিশীল গাড়ির উপর হইতেই সে মুখ ফিরাইয়া দেখিয়া একটা হাত তুলিয়া বলিল, আসছি। পরমুহূর্তেই সে পথে মোড় ফিরয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। মজুমদার ব্যস্ত হইয়া বলিল, আমি যাই তা হ’লে বাবু। দেখি, অহি অমন করে কোথা থেকে এল, খবরটা কি আমি জেনে আসি।
আমার খবরটা জানিও যেন মজুমদার।
* * *
দ্রুতবেগে গাড়িখানা চালাইয়া বাড়ির দুয়ারে আসিয়া অহীন্দ্র একরূপ লাফ দিয়া নামিয়া পড়িল। গাড়ি হইতে নামিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্যও সে ছুটিয়া চলিয়াছিল। কিন্তু স্তব্ধ বাড়িখানার ভিতর হইতে একটি অতি মৃদু ক্রন্দনের সুর তাহার কানে আসিতেই তাহার গতি মন্থর এবং সকল উত্তেজনা ম্রিয়মাণ হইয়া গেল। ধীরে ধীরে বাড়িতে প্রবেশ করিয়া সে ডাকিল, মা।
দ্বিপ্রহরের নির্জন অবকাশে সুনীতি আপনার বেদনার লাঘব করিতেছিলেন, মৃদু মৃদু বিলাপ করিয়া কাঁদিতেছিলেন। অহির ডাক শুনিয়া তিনি চোখ মুছিয়া বাহিরে আসিলেন, বলিলেন, দেরি করলি যে অহি? কালই ফিরে আসবি ব’লে গেলি! কণ্ঠস্বরে তাঁহার শঙ্কার আভাস।
অহি বলিল, হেডমাস্টার মশায় কাল ফিরে আসেন নি মা, আজ সকাল নটায় এলেন ফিরে।
পরীক্ষার খবর বেরিয়েছে?
হ্যাঁ মা।
তোর খবর?
পাস হয়েছি মা।
তবে বলছিস না যে? সুনীতির ম্লান মুখ এবার ঈষৎ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
বলতে ভাল লাগছে না মা। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অহি বলিল, দাদা আমায় বলেছিলেন, ভাল ক’রে পাস করলে একটা ঘড়ি কিনে দেবেন-একটা রিস্টওয়াচ।
সুনীতির চোখ দিয়া আবার জল ঝরিতে আরম্ভ করিল।
অহি বলিল, আমি বড় অকৃতজ্ঞ মা। মাস্টার মশায় বললেন, কম্পিট তুমি করতে পার নি, তবে ডিভিশনাল স্কলারশিপ তুমি পাবেই। যে কলেজেই যাবে, সুবিধে অনেক পাবে। কোথায় পড়বে ঠিক ক’রে ফেল। আমি শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে এলাম। সমস্ত পথটার মধ্যে দাদার কথা একবারও মনে পড়ে নি মা; বাড়িতে এসে ঢুকতেই তোমার কান্নার আওয়াজে আমার স্মরণ হ’ল, দাদাকে মনে পড়ে গেল।
সুনীতি ছেলেকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, তুই ভাল করে পড়ে টপ-টপ করে পাস করে নে। তারপর তুই জজ হবি অহি। দেখবি এমন ধারার অবিচার যেন কারও ওপর না হয়। ততদিনে মহী ফিরে আসবে। সে বাড়িতে বসে ঘর-সংসার দেখবে, তুই সেখান থেকে টাকা পাঠাবি।
অহি বলিল, একটা খবর নিলাম মা এবার। দশ বছর দাদাকে থাকতে হবে না। মাসে মাসে চার পাঁচ দিন করে মাফ হয়। বছরের দু মাস তিন মাসও হয় ভাল ব্যবহার করলে। তা হলে তিন দশে তিরিশ মাস আড়াই বছর বাদ যাবে, দশ বছর থেকে। সাড়ে সাত বছর থাকতে হবে। আর দ্বীপান্তর লিখলেও আজকাল সকলকে আন্দামানে পাঠায় না। দেশেই জেলে রেখে দেয়।
উপরে রামেশ্বর গলা ঝাড়িয়া পরিস্কার করিয়া লইলেন। শব্দ শুনিয়া সচকিত হইয়া সুনীতি বলিলেন, বাবুকে প্রণাম করবি আয়
অহি। ওঁকে খবর দিয়ে আসি, ওঁর কথাই আমরা সবাই ভুলে যাই।
মাটির পুতুলের মত একইভাবে রামেশ্বরের সেই খাটের উপর বসিয়া ছিলেন। সুনীতি সত্য সত্যই একটু আনন্দের হাসি হাসিয়া বলিলেন, ওগো অহি তোমার পাস করেছে, স্কলারশিপ পেয়েছে।
অহি রামেশ্বরকে প্রণাম করিল। রামেশ্বর হাত বাড়াইয়া তাহাকে কাছে বসাইয়া বলিলেন, পাস করেছ, স্কলারশিপ পেয়েছ?
হ্যাঁ, ওকে আশীর্বাদ কর।
হ্যাঁ হ্যাঁ।
ও এবার কলেজে পড়তে যাবে। যে কলেজেই যাবে সেখানে ওকে অনেক সুবিধে দেবে।
বাঃ বাঃ, রাজা দিলীপের পুত্র রঘু-সমস্ত বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন, তাঁরই নামে বংশের পর্যন্ত নাম হয়ে গেল রঘুবংশ। তুমি রঘুবংশ পড়েছ অহি, মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশ? “বাগর্থাবিব সম্পৃক্তৌ বাগর্থপ্রতিপত্তরে-জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতীপরমেশ্বরৌ। ”
অহি এবার বলিল, স্কুলে তো এ-সব মহাকাব্য পড়ানো হয় না, এইবার কলেজে পড়ব।
ইংরেজদের এক মহাকবি আছেন, তাঁর নাম শেক্সপীয়ার। সে-সবও পড়ো।
হ্যাঁ, শেক্সপীয়ার পড়তে হবে বি.এ-তে।
এ কথার উত্তরে রামেশ্বর আর কথা বলিলেন না। সহসা তিনি গম্ভীর হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, যাও, তুমি এখন বেড়িয়ে এস।
সুনীতি বলিলেন, না না, ও এখনও খায় নি। তুই এখানেই ব’স্ অহি, আমি খাবার এখানেই নিয়ে আসি।
রামেশ্বর তিক্তস্বরে বলিলেন, না না। যাও অহি, ভাল করে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধূয়ে ফেল, স্নানই বরং কর। তারপর খাবে।
পিতার অনিচ্ছা অহীন্দ্র বুঝিল, সে তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সুনীতি জলভরা চোখে বলিলেন, কেন তুমি ওকে এমন করে তাড়িয়ে দিলে? এর জন্যেই —
বাধা দিয়া রামেশ্বর আপনার দুই হাত মেলিয়া বলিলেন, ছোঁয়াচে, ছোঁয়াচে কুষ্টরোগ-
সুনীতি আজ তারস্বরে প্রতিবাদ করিলেন, না না। কবরেজ বলেছেন, ডাক্তার বলেছেন, রক্তপরীক্ষা করে দেখেছেন, ও-রোগ তোমার নয়।
জানে না, ওরা কিছুই জানে না। বাইরের সিঁড়িতে পদশব্দ শুনিয়া রামেশ্বর নীরব হইলেন। দরজায় মৃদু আঘাত করিয়া অহীন্দ্র ডাকিল, মা!
যাই আমি অহি।-সুনীতি অভিমানভরেই চলিয়া যাইতেছিলেন, কিন্তু অহীন্দ্রই দরজা খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার পিছনে রায়গিন্নী হেমাঙ্গিনী-ইন্দ্র রায়ের স্ত্রী।