৭
মহীন্দ্র যোগেশ মজুমদারকে সঙ্গে লইয়া, পূর্বদিন রাত্রেই আসিয়া পৌঁছাইয়াছিল। বার্তা নাকি বায়ুর আগে পৌঁছিয়া থাকে- এ কথাটা সম্পূর্ণ সত্য না হইলেও মিথ্যা বলিয়া একেবারেই অস্বীকার করা চলে না। পঞ্চাশ মাইল দূরে বর্হিজগতের সহিত ঘনিষ্ঠসম্পর্কহীন একখানি পল্লীগ্রামেও কেমন করিয়া কথাটা গিয়া পৌঁছিল, তাহা ভাবিলে সত্যই বিস্মিত হইতে হয়। সুনীতির পত্রও তখন গিয়া পৌঁছে নাই। সরীসৃপ-সঙ্কুল জঙ্গলে পরিপূর্ণ চরটায় নাকি সাঁওতালরা আসিয়া সব সাফ করিয়া ফেলিয়াছে, আশেপাশের চাষীরা নাকি চরের মাটি দেখিয়া বন্দোবস্ত লইবার জন্য পাগল হইয়া উঠিয়াছে; এমন কি শহর-বাজার হইতে সঙ্গতিপন্ন লোকেও চরের জমি বন্দোবস্ত পাইবার জন্য প্রচুর সেলাম দিতে চাহিতেছে-এমনিধারা স্ফীত-কলেবর অনেক সংবাদ। শেষ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুতর সংবাদ-চর দখল করিবার জন্য রায়-বংশীয়েরা কৌরবের মত একাদশ অক্ষৌহিনী সমাবেশের আয়োজন করিতেছে; চক্রবর্তী-বাড়ির কাহাকেও নাকি ও-চরের মাটিতে পদার্পণ করিবার পর্যন্ত অধিকার দেওয়া হইবে না।
উত্তেজনায় মহীন্দ্র উৎসাহিত হইয়া উঠিল। এই ধরনের উত্তেজনায় মহীন্দ্রের যেন একটা অধীরতা জাগিয়া উঠে। সে মজুমদারকে বলিল, থাক এখানকার কাজ এখন। চলুন আজই বাড়ি যাব।
মজুমদার বলিল, সেখান থেকে একটা সংবাদ আসুক, সেখানে যখন মা রয়েছেন-
মহীন্দ্র বিরক্ত হইয়া বলিল, মা কখনও সংবাদ দেবেন না, তিনি এসব বোঝেনই না, তা ছাড়া তাঁর একটা ভয়ঙ্কর ভয়-বিবাদ হবে। চরে একবার খানকয়েক লাঙল ফেরাতে পারলেই আমাদের কঠিন মামলায় পড়তে হবে। তখন সেই টাইটেল সুটে যেতে হবে।
মজুমদার আর আপত্তি করিতে পারিল না, সেই দিনই তাহারা রওনা হইয়া প্রায় শেষরাত্রে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। অহীন্দ্র এবং সুনীতির কাছে চরের বৃত্তান্ত শুনিয়া মহীন্দ্র খুশী হইয়া উঠিল। মজুমদার হাসিয়া বলিল, তবে তো ও আমাদের হয়েই গিয়েছে; সাঁওতালরা যখন রাঙাবাবুকে ছাড়া খাজনা দেবে না বলেছে, তখন তো দখল হয়েই গেল। চরটার নাম দিতে হবে কিন্তু রাঙাবাবুর চর, সেরেস্তাতে আমরা ওই বলেই পত্তন করব।
মহীন্দ্র বলিল, না, ঠাকুরদার নামেই হোক-রাঙাঠাকুরের চর। আর কাল সকালেই চাপরাসী নিয়ে যান ওখানে, বলে দিন সাঁওতালদের, কেউ যেন রায়েদের ডাকে না যায়। যে যাবে তার জরিমানা হবে, তাতে রায়েরা জোর করে, আমরা তার প্রতিকার করব।
অহীন্দ্র এবার বলিল, না, সে হবে না দাদা। মহীন্দ্রকে সে ভয় করে, কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না।
মহীন্দ্র রুক্ষদৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, কেন?
আমি ও-বাড়ির মামার কাছে কথা দিয়েছি-
ও-বাড়ির মামা? কে ও-বাড়ির মামা? ইন্দ্র রায় বুঝি? সম্বন্ধটা পাতিয়ে দিয়েছেন বুঝি মা? বাঃ চমৎকার!
সুনীতি অহীন্দ্র দুজনেই নীরব হইয়া এ তিরস্কার সহ্য করিলেন। মহীন্দ্র আবার বলিল, তারপর-কথাই বা কিসের? আমাদের ন্যায্য সম্পত্তি, তিনি আমার অনুপস্থিতিতে সাঁওতালদের হুমকি দিয়ে দখল ক’রে নেবেন, আর তুমি একটা দুগ্ধপোষ্য বালক, তুমি না জেনে কথা দিয়েছ, সে কথা আমায় মানতে হবে?
অহীন্দ্র আবার সবিনয়ে বলিল, ওঁরাও তো বলেছেন, চর আমাদের।
ওঁরা যদি কাল এসে বলেন, এই বাড়িখানা আমাদের-
অহীন্দ্র এ কথার জবাব দিতে পারিল না। সুনীতি অন্তরে অন্তরে অহীন্দ্রকে সমর্থন করিলেও মুখ ফুটিয়া মহীন্দ্রের কথার প্রতিবাদ করিতে পারিলেন না। মজুমদার কৌশলী ব্যক্তি, সে অহীন্দ্রের মুখ দেখিয়া সুকৌশলে একটা মিমাংসা করিয়া দিল, বেশ তো গো, অহিবাবু যখন কথাই দিয়েছেন, তখন কথা আমরা রাখব। ছোট রায় মশায় তলব পাঠালে আমি নিজে সাঁওতালদের নিয়ে যাব। দেখিই না, তিনি কি করতে পারেন।
মহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল; কথাটা সুসংগত এবং যুক্তির দিক দিয়াও সুযুক্তিপূর্ণ, তবু তাহার মন ইহাতে ভাল করিয়া সায় দিল না।
মজুমদার বলিল, তা ছাড়া মুখোমুখি কথা ক’য়েই দেখি না, কোন মুখে চরটা তিনি আপনার ব’লে ‘কেলেম’ (claim) করেন।
সুনীতি বলিলেন, এটা খুবই ভাল কথা মহীন, এতে আর তুমি আপত্তি ক’রো না।
মহীন্দ্র এবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলিল, তাই হবে। কিন্তু অহী কালই চলে যাক স্কুলে, ওর এ-ব্যাপারে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। আর একটা কথা, ওরকম-ধারার সম্বন্ধ পাতাবার চেষ্টা যেন আর করা না হয়; তিন পুরুষ ধ’রে ওরা আমাদের শত্রুতা ক’রে আসছেন।
তাহাই হইল, অহীন্দ্র ভোরে উঠিয়া স্কুলে চলিয়া গেল। সকালেই মজুমদার সাঁওতালদের সঙ্গে লইয়া ইন্দ্র রায়ের কাছারিতে উপস্থিত হইল; এবং শেষ পর্যন্ত ইন্দ্র রায়ের দ্বন্দঘোষণা মর্যাদার সহিত গ্রহন করিয়া ফিরিয়া আসিল।
মজুমদারের মুখে সমস্ত শুনিয়া মহীন্দ্র প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, বলিল, খুব ভাল ব’লে এসেছেন। মায়ের যেমন, তিনি ভাবেন, দুনিয়াভোর মানুষের অন্তর বুঝি তাঁর মতন। ব’লে আসুন তাঁকে, তাঁর ও-বাড়ির দাদার কথাটা ব’লে আসুন।
মজুমদার বলিল, না না মহীবাবু, ও-কথা মাকে ব’লো না; তিনি আপনাদের ভালর জন্যই বলেন, আর ঝগড়া-বিবাদে তাঁর ভয়ও হয় তো।
মহীন্দ্র বলিল, সেটা ঠিক কথা। ভয়টা তাঁর খুবই বেশী, জমিদারি ব্যাপারটাই হ’ল ওঁর ভয়ের কথা, ওঁর বাপেদের তিন পুরুষ হ’ল চাকরে।
মজুমদার এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াইল না। মহীন্দ্রকে সে ভাল করিয়াই জানে। প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করিয়া সে বলিল, বাবুর সঙ্গে একবার পরামর্শ করা দরকার।
এবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মহীন্দ্র বলিল, আজ সকালে আমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলাম, তাঁকে দেখে আমার বুক ফেটে গেল মজুমদার-কাকা, তিনি বোধ হয় সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছেন।
মজুমদার স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল, মহীন্দ্রও নীরব। এই স্তব্ধ অবসরের মধ্যে কলরব করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হইল একদল সাঁওতালদের ছেলেমেয়ে। হাতে তীর ও ধনুক, একজনের ধনুকের প্রান্তে দুইটা সদ্যনিহত ছোট জন্তু ঝুলিতেছিল। এখনও জন্তু দুইটার ক্ষতস্থান হইতে রক্ত ঝরিতেছে। ছেলেদের পিছনে কয়টি তরুণী মেয়ে; মেয়েদের মধ্যে কমল মাঝির নাতনী, সেই দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটি ছিল সকলের আগে। সমগ্র দলটি মহীন্দ্র ও মজুমদারকে দেখিয়া অকস্মাৎ যেন স্তব্ধ হইয়া গেল।
মজুমদার ও মহীন্দ্র একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিল, ইহাদের আকস্মিক আগমনে তাহাদের মনে হইল, ইন্দ্র রায় আবার কোনও গোলমাল বাধাইয়া তুলিয়াছেন। মহীন্দ্র মজুমদারকেই প্রশ্ন করিল, আবার কি হ’ল? রায়েরা আবার কোনও গোলমাল বাধিয়েছে নিশ্চয়।
মজুমদার প্রশ্ন করিল সমগ্র দলটিকে লক্ষ্য করিয়া, কি রে, কি বলছিস তোরা?
সমগ্র দলটি আপনাদের ভাষায় আপনাদেরই মধ্যে কি বলিয়া উঠিল। মজুমদার আবার বলিল, কি বলছিস, বাঙালী কথায় বল কেনে?
দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটি বলিল, বুলছি, আমাদের বাবুটি কুথা গো?
হাসিয়া মজুমদার বলিল, এই যে বড়বাবু রয়েছেন। বল না, কি বল্ছিলি?
উ কেনে হবে গো? সি আমাদের রাঙাবাবু, সি বাবুটি কুথা গো?
তিনি পড়তে চ’লে গেছেন ইস্কুলে, সেই শহরে। ইনি হলেন বড়বাবু, ইনি হলেন মালিক -মরংবাবু।
কেনে, তা কেনে হবে?
মজুমদার হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা একগুঁয়ে বোকা জাত! যা ধরবে, তা আর ছাড়বে না। তা কেনে হবে? তাই হয় রে, তাই হয়। ইনি বড় ভাই, তিনি ছোট ভাই। বুঝলি?
হুঁ, সিটি তো আমরা দেখছি। ইটিও সেই তেমুনি, সিটির পারা বটে। তা সিটিই তো আমাদের রাঙাবাবু। উয়ার লেগে আমরা সুসুরে মেরে এনেছি।
মহীন্দ্র উৎসাহিত হইয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল, সুসুরে-খরগোশ! কই, দেখি দেখি!
তাহারা এবার খরগোশ দুইটা আনিয়া কাছারির বারান্দায় নামাইয়া দিল। ধূসর রঙের বন্য খরগোশ-সাধারণ পোষা খরগোশ হইতে আকারে অনেকটা বড়। মহীন্দ্র বলিল, বাঃ, এ যে অনেক বড়, এদের রঙটাও মাটির মত। এ পেলি কোথায় তোরা? সেই মেয়েটি বলিল, কেনে, আমাদের ওই নদীর চরে, মেলাই আছে। শিয়াল আছে, খটাস খেঁকশিয়াল আছে, সুসুরে আছে, তিতির আছে, আমরা মারি, পুড়িয়ে খাই।
মহীন্দ্র আরও বেশী উৎসাহিত হইয়া উঠিল, শিকারে তাহার প্রবল আসক্তি, নেশা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সে বলিল তা হ’লে চলুন মজুমদার-কাকা, আজ বিকেলে যাব শিকার করতে; চরটাও দেখা হবে, শিকারও হবে, কি বলেন?
বেশ তো
মেয়েটি বলিল, তু যাবি? বন্দুক নিয়ে যাবি? মারতে পারবি? খুঁজে বার করতে পারবি?
হাসিয়া মহীন্দ্র বলিল, আচ্ছা, সে তখন দেখবি তোরা। যা তোরা, সর্দার-মাঝিকে বলবি, আমরা বিকেলে যাব।
সে আমাদের রাঙাবাবুটি? তাকে নিয়ে যাবি না?
সে যে নেই এখানে।
কেনে, সে আসবে না কেনে? তুরা তাকে নিয়ে যাবি না কেনে?
মজুমদার হাসিয়া ফেলিলেন, কি আপদ!
কেন, কি করলাম আমরা? উ কেনে বলছিস তু?
আচ্ছা, বাবু এলে তাকে নিয়ে যাব। তোরা যা এখন।
এবার তারা আশ্বাস পাইয়া সোৎসাহে আপন ভাষায় কলরব করিয়া উঠিল। মেয়েটিই দলের নেত্রী, সে বলিয়া উঠিল, দেলা-দেলা বোঁ! অর্থাৎ -চল্ চল্ চল্।
মহীন্দ্র কাছারি-ঘরে ঢুকিয়া বন্দুকটা বাহির করিয়া আনিল। নলের মুখটা ভাঁজিয়া ভিতর দেখিয়া বলিল, বড্ড অপরিষ্কার হয়ে আছে। সে বন্দুকের বাক্সটা বাহির করিয়া আনিয়া বন্দুকের পরিচর্যায় নিযুক্ত হইল।
ইন্দ্র রায়ের এই কাজটি অচিন্ত্যবাবুর মনঃপূত হয় নাই; তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই প্রাতঃকালে পর্যন্ত তিনি গাছ-গাছড়া চালানের লাভক্ষতি কষিয়া রায়কে বুঝাইয়াছেন, রায়ও আপত্তি করেন নাই, বরং উৎসাহই প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু সেই লাভকে উপেক্ষা করিয়া অকস্মাৎ তিনি কেন যে চর বন্দোবস্ত করিলেন, তাহার কারণ তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না।
আর ননী পালের মত দুর্দান্ত ব্যক্তিকে বিনা পণে চর বন্দোবস্ত করিয়া প্রশ্রয় দেওয়ার হেতুও তিনি বুঝিতে পারিলেন না। ওই লোকটার জন্য সমগ্র চরটা দুর্গম হইয়া উঠিল, কে উহার সহিত ঝগড়া করিতে যাইবে? তাহার সীমানা বাদ দিয়া চরে পদার্পণ করিলেও ননী বিবাদ করিবেই। সেই বিক্ষোভ প্রকাশ করিতে করিতেই তিনি পথ দিয়া চলিয়াছেন।
হ’ল, বেশই হ’ল, উত্তম হ’ল, খুব ভাল করলেন। ওখানে আর কেউ যাবে? থাকল ওই জায়গা প’ড়ে। গেলেই, ও গোয়ার চপেটাঘাত না ক’রে ছাড়বে না। বাব্বাঃ, আমি আর যাই! সর্বনাশ কোনদিন পাষণ্ড আমাকে একেবারে এক চড়ে খুনই করে ফেলবে। এক মনেই বকিতে বকিতে তিনি চলিয়াছিলেন। চক্রবর্তীবাবুদের কাছারির বারান্দায় মজুমদার হাসিয়া তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেন, কি হ’ল অচিন্ত্যবাবু, হঠাৎ চটে উঠলেন কেন মশায়?
হঠাৎ? অচিন্ত্যবাবু যেন ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন, হঠাৎ? বলেন কি মশায়, আজ তিন দিন তিন রাত্রি ধরে, হিসেব ক’ষে লাভ-লোকসান দেখলাম, টু হান্ড্রেড পারসেন্ট লাভ। কলকাতার সাত-আটটা ফার্মকে চিঠি লিখলাম সাত-আট আনা খরচ করে; আর আপনি বলেন হঠাৎ?
মজুমদার বলিলেন, সে-সব আমরা কেমন ক’রে-
বাধা দিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, ঠিক কথা, আমারই ভুল, কেমন ক’রে জানবেন আপনারা। তবে শুনুন, আপনাদের এই ইন্দ্র রায় মশায় একটা ‘ডেঞ্জারাস গেমে’ হাত দিয়েছেন বাঘ নিয়ে খেলা, ননী পাল সাক্ষাৎ একটি ব্যাঘ্র। -বলিয়া সবিস্তারে সমস্ত ঘটনাটা বর্ণনা করিয়া পরিশেষে ক্ষোভে দুঃখে ভদ্রলোক প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন-মশায়, তিনটি রাত্রি আমি ঘুমই নি। দশ রকম ক’রে দশবার আমি লাভ-লোকসান ক’ষে দেখেছি। বেশ ছিলাম, বদহজম অনেকটা ক’মে এসেছিল, এই তিন রাত্রি জেগে আমার বদহজম আবার বেড়ে গেল। -কথা বলিতে বলিতেই যেন রোগটা তাঁহার বাড়িয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে গোটা কয়েক ঢেকুর তুলিয়া তিনি বলিলেন, ভাস্কর লবণ খানিক না খেলে এইবার গ্যাস হবে। যাই, তাই খানিকটা খাইগে। গ্যাসে হার্টফেল হওয়া বিচিত্র নয়। ভদ্রলোক উঠিয়া পড়িলেন এবং ক্রমাগত উদগার তুলিতে তুলিতে চলিয়া গেলেন।
মহীন্দ্র বন্দুক ফেলিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, চাপরাসীদের ব’লে দিন-ননী পাল রায়েদের কাছারি থেকে বেরুলেই যেন ধ’রে নিয়ে আসে।
* * *
মজুমদার খুব ভাল করিয়াই বলিলেন- আদেশের সুরে নয়, অনুরোধ জানাইয়াই বলিলেন, দেখ ননী, এ-কাজটা করা তোমার উচিত হবে না। এ আমাদের শরিকে শরিকে বিরোধ, এর মধ্যে তোমার যোগ দেওয়া কি ভাল?
ননী নখ দিয়া নখ খুঁটিতে খুঁটিতে বলিল, তা মশায়, ইয়ের ভালমন্দ কি? সম্পত্তি রাখতে গেলেও ঝগড়া, সম্পত্তি করতে গেলেও ঝগড়া। সে ভেবে সম্পত্তি কে আর ছেড়ে দেয় বলুন?
মহীন্দ্র গম্ভীর স্বরে বলিল, দেখ ননী, ও সম্পত্তি হ’ল আমার, ওটা ইন্দ্র রায়ের নয়। তোমাকে আমি বারণ করছি, তুমি এর মধ্যে এসো না।
মহীন্দ্রের স্বরগাম্ভীর্যে ননী রুক্ষ হইয়া উঠিল, সে বলিল, সম্পত্তি আপনার, তারই বা ঠিক কি?
আমি বলছি।
সে তো রায় মশায়ও বলছেন, সম্পত্তি তেনার।
তিনি মিথ্যা কথা বলছেন।
আর আপনি সত্যি বলছেন!-ব্যঙ্গভরে ননী বলিয়া উঠিল।
মহীন্দ্র বলিল, চক্রবর্তী-বংশ তেমন নীচ নয়, তারা মিথ্যে কথা বলে না, বুঝলে?
ননী পাল প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিল, ইন্দ্র রায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মহীন্দ্রকে অপমান করিবার সঙ্কল্প লইয়াই ডাকিবামাত্র সে এখানে প্রবেশ করিয়াছিল। সে এবার বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সে সব আমরা খুব জানি, চাকলাটার লোকই জানে; চক্রবর্তী-গুষ্ঠির কথা আবার জানে না কে?
মহীন্দ্র রাগে আরক্তিম হইয়া বলিল, কি? কি বলছিস তুই?
মুখভঙ্গী করিয়া ননী বলিল, বলছি তোমার সৎমায়ের কথা হে বাপু, বলি, যার মা চ’লে যায়-
মুহূর্তে এক প্রলয় ঘটিয়া গেল। অশনীয় ক্রোধে মহীন্দ্র আত্মহারা হইয়া অভ্যস্ত হাতে ক্ষিপ্রতার সহিত বন্দুকটা লইয়া টোটা পুরিয়া ঘোড়াটা টানিয়া দিল। ননী পালের মুখের কথা মুখেই থাকিয়া গেল, রক্তাপ্লুত দেহে মুখ গুঁজিয়া সে মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। বন্দুকের শব্দে, বারুদের গন্ধে, ধোঁয়ায়, রক্তে, সমস্ত কিছু লইয়া সে এক ভীষণ দৃশ্য। মজুমদার যেন নির্বাক মূক হইয়া গেল, থরথর করিয়া সে
কাঁপিতেছিল। মহীন্দ্রও নীরব, কিন্তু সে-ই প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বন্দুকটা হাতে লইয়াই উঠিয়া বলিল, আমি চললাম কাকা, থানায় সারেণ্ডার করতে।
মজুমদার একটা কিছু বলিবার চেষ্টায় বার কয়েক হাত তুলিল, কিন্তু মুখে ভাষা বাহির হইল না। মহীন্দ্র মায়ের সঙ্গে পর্যন্ত দেখা করিল না; চৈত্রের উত্তপ্ত অপরাহ্নে সে দৃঢ় পদক্ষেপেই ছয় মাইল দূরবর্তী থানায় আসিয়া বলিল, আমি ননী পাল বলে একটা লোককে গুলি করে মেরেছি।
আহা! বড়ো মধুর অনুভুতিতে হৃদয়টা আচ্ছন্ন হইল। বানান ভুলও কমিয়া আসিয়াছে। বই খানা পড়িয়া খুবই সুখী হইলাম।
পড়লাম