৪
সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়া লক্ষ্মীর ঘরে গৃহলক্ষ্মীর সিংহাসনের সম্মুখে পিলসুজের উপর প্রদীপটা রাখিয়া সুনীতি গলায় আঁচল জড়াইয়া প্রণাম করিলেন। গনগনে আগুন ভরিয়া ঝি ধুপদানি হাতে ঘরের বাহিরে দাঁড়াইয়া ছিল। ধুপদানিটি তাহার হাত হইতে লইয়া সুনীতি আগুনের উপর ধুপ ছিটাইয়া দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ধুপগন্ধে ঘরখানি ভরিয়া উঠিল।
ঘরের দরজা বন্ধ করিতে করিতে সুনীতি বলিলেন, তুলসীমন্দিরে আর ঠাকুরবাড়িতে প্রদীপ আজ বামুনঠাকরুনকে দিতে বল্ মানদা। আমার বড্ড দেরি হয়ে গেল, বাবু হয়ত এখুনি রেগে উঠবেন।
তাড়াতাড়ি তিলের তেলের বোতলটি লইয়া তিনি উপরে রামেশ্বরের ঘরের দিকে চলিয়া গেলেন। রামেশ্বরের দরজা জানলা অহরহ বন্ধ থাকে, দিনরাত্রিই ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলে, সে প্রদীপে পোড়ে তিলের তেল। উজ্জ্বল আলো তাঁহার চোখে একেবারে সহ্য হয় না। আলোর মধ্যে তিনি নাকি একেবারে দেখিতে পান না। অন্ধকারে বরং পান। তেলের বোতল হাতে সুনীতি সন্তর্পণে দরজা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। প্রকাণ্ড বড় ঘরখানির মধ্যে ক্ষীণ শিখার একটি মাত্র প্রদীপের আলো জ্বলিতেছে। এত বড় ঘরের সর্বাংশে তাহার জ্যোতি প্রসারিত হইতে পারে নাই, চারি কোণের অন্ধকার অসীমের মত সীমাবদ্ধ জ্যোতির্মণ্ডলকে যেন ঘিরিয়া রহিয়াছে। আলো-অন্ধকারে সে যেন এক রহস্যলোকের সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারই মধ্যে ঘরের মধ্যস্থলে সে-আমলের প্রকাণ্ড পালঙ্কের উপর নিস্তব্ধ হইয়া রামেশ্বর বসিয়া আছেন।
ঘরের দরজা খুলিতেই রামেশ্বর অতি ধীরে মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিলেন, সুনীতি?
ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিতে দিতে সুনীতি বলিলেন, হ্যাঁ আমি। তেল দিয়ে দিই প্রদীপে। জানলাগুলি খুলে দিই, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
দাও।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিলে ঘরের জানলা খোলা হয়। কখনও কখনও রামেশ্বর তখন খোলা জানলার ধারে দাঁড়াইয়া বহির্জগতের সহিত পরিচয় করেন। জানলা খুলিয়া দিতেই বন্ধ ঘরে বাহিরের বাতাস অপেক্ষাকৃত জোরেই প্রবেশ করিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপটি নিভিয়া গেল। রামেশ্বর বাহিরের নির্মল শীতল বাতাস বুক ভরিয়া নিঃশ্বাস লইয়া বলিলেন, আঃ!
সুনীতি বলিলেন, আলোটা নিবে গেল যে।
রামেশ্বর বলিলেন, বাতাসে চমৎকার ফুলের গন্ধ আসছে। এটা কি মাস বল তো?
চৈত্র মাস। তারপর চিন্তিতভাবে সুনীতি আবার বলিলেন, প্রদীপ তো এ বাতাসে থাকবে না।
রামেশ্বর বলিতেছেন, ‘ললিত-লবঙ্গ-লতা-পরিশীলন-কোমল-মলয়-সমীরে।’
বাতি দিয়ে একটা শেজ জ্বেলে দেব?
শেজ?
হ্যাঁ, বাতির আলোও তো ঠাণ্ডা। এ বাতাসে প্রদীপ থাকবে না।
তাই দাও।- বলিয়া আবার আপন মনে আবৃত্তি করিলেন, ‘মধুকরনিকর-করম্বিত-কোকিল-কূজিত-কুঞ্জ-কুটীরে।’
ঘরে শেজ ও বাতি ঠিক করাই থাকে, মধ্যে মধ্যে জ্বালিতে হয়। বাতাসের জন্যও হয়, আবার মধ্যে মধ্যে রামেশ্বরের ইচ্ছাও হয়। সুনীতি বাতি জ্বালিয়া, শেজের মধ্যে বসাইয়া দিলেন, তারপর কতকগুলি ধুপশলা জ্বালিয়া দিয়া বলিলেন, কাপড় ছাড়, সন্ধ্যের জায়গা ক’রে দিই।
হুঁ। করতে হবে বৈকি। না করলেই পাপ। করলে কিছুই না-কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, কিচ্ছু না।
সুনীতি বাধা দিয়া বলিলেন, ও কি বলছ? রামেশ্বর মধ্যে মধ্যে এমনই করিয়া বকিতে আরম্ভ করেন, তখন বাধা দিতে হয়। অন্যথায় সেই একটা কথাই তিনি কিছুক্ষণ ধরিয়া এমনই করিয়া বকিয়া যান।
বাধা পাইয়া রামেশ্বর চুপ করিলেন। সুনীতি আবার বলিলেন, কাপড় ছাড়, সন্ধ্যে কর। আর অমন করে বকছ কেন?
না না না, আমি বকি নি তো। বকব কেন? কই, কাপড় দাও। রামেশ্বর অতি সন্তর্পণে বিছানা হইতে নামিয়া আসিলেন। স্বামীকে সন্ধ্যা করিতে বসাইয়া সিয়া সুনীতি বলিলেন, সন্ধ্যে করে ফেল আমি দুধ গরম করে নিয়ে আসি।
সুনীতি ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন, রামেশ্বর সন্ধ্যে শেষ করিয়া জানলার ধারে দাঁড়াইয়া আছেন। সুনীতিকে দেখিবামাত্র তিনি বলিলেন, কি বাজছে বল তো?
দূরে ওই চরটার উপর তখন অহীন্দ্রকে ঘিরিয়া সাঁওতালেরা মাদল ও বাশী বাজাইতেছিল, মেয়েরা নাচিতেছিল-তাহারই শব্দ। সুনীতি বলিলেন সাঁওতালেরা মাদল বাজাচ্ছে।
বাঁশী শুনছ, বাঁশী?
হ্যাঁ। সন্ধ্যার সময় তো। মাঝিরা মাদল বাজাচ্ছে, বাঁশী বাজাচ্ছে, মেয়েরা নাচছে। ওদের ওই আনন্দ।
তুমি কবিরাজগোস্বামী শ্রীজয়দেবের গীতগোবিন্দ পড়েছ?-
“করতলতালতরলবলয়াবলি-কলিত কলস্বন বংশে।
রাসরসে সহনৃত্যপরা হরিণা যুবতিঃ প্রশংসে।”
যমুনাপুলিনে বংশীধ্বনির সঙ্গে তাল দিয়ে গোপবালারাও একদিন নাচত। গীতগোবিন্দ তুমি পড় নি?
স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তুমি কখনও পড়ে শোনাও নি, আমি নিজে তো সংস্কৃত জানি না।
আজ তোমাকে শোনাব, আমার মুখস্থ আছে।
বেশ, এখন দুধটা খেয়ে নাও দেখি। বলিয়া সম্মুখে দুধের বাটি আগাইয়া দিলেন। পান করিয়া বাটি সুনীতির হাতে দিতেই সুনীতি জলের গ্লাস ও গামছা স্বামীর সম্মুখে ধরিলেন। হাতমুখ ধুইয়া রামেশ্বর আবার বলিলেন, কবিরাজগোস্বামী বলেছেন কি জান?-
“যদি হরি-স্মরণে সরসং মনো যদি বিলাস কলাসু কুতূহলং।
মধুর কোমল কান্ত পদাবলীং শৃণু তদা জয়দেব সরস্বতীম্।।”
শোনাব, তোমাকে আজ শোনাব।
আনন্দে সুনীতির বুকখানা যেন ভরিয়া উঠিল, তিনি বলিলেন, তা’হলে তাড়াতাড়ি আমি কাজগুলো সেরে আসি। পরমুহূর্তেই আবার যেন স্তিমিত হইয়া গেলেন- কতক্ষণ, এ রূপ কতক্ষণের জন্য?
হ্যাঁ, এস। বাতাস আজ বড় মিষ্টি বইছে। বসন্তকাল কিনা। আচ্ছা সুনীতি, দোল পূর্ণিমা চলে গেছে?
হ্যাঁ। আজ কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী।
কই, আমাকে তো আবীর দিলে না?
সুনীতি অপরাধীর মত নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
এনো, এনো, আবীর থাকে তো নিয়ে এস এক মুঠো আজ।
সুনীতি এ কথারও উত্তর দিলেন না, শুধু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন।
আর শোন। জয়দেব সরস্বতীর পদাবলী যদি শুনবে, তবে অতি সুন্দর একখানি কাপড় পরবে। সুন্দর করে বেণী রচনা করবে। তার পর রসরাজের মূর্তি হৃদয়ে স্মরণ করে লীলাবিভোর মন নিয়ে শুনতে হবে।
সুনীতি ভাল করিয়া জানেন যে, ফিরিয়া আসিতে আসিতে স্বামীর এ রূপ আর থাকিবে না। কিন্তু তিনি কখনও স্বামীর কথার প্রতিবাদ করেন না, ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন, তাই আসব।
চুলটা যেন বেঁধে ফেলো।
বাঁধব।
হ্যাঁ। ঘরে আতর নেই-আতর
আছে, তাও আনব।
আমায় এখুনি একটু দিতে পার?
দিচ্ছি,। সুনীতি সঙ্গে সঙ্গে বাক্স খুলিয়া একটি সুদৃশ্য আতরদান বাহির করিলেন। তুলায় আতর মাখাইয়া স্বামীর হাতে দিয়া ঘর হইতে বাহির হইবার জন্য ফিরিলেন। কিন্তু রামেশ্বর ডাকিলেন, শোন।
সুনীতি বলিলেন, বল।
ওই আলোর সম্মুখে তুমি একবার দাঁড়াও তো। অন্ধকারের মধ্যে আমার বাস, অনেক দিন তোমাকে যেন আমি ভাল করে
দেখিনি।
সুনীতি স্থিরভাবে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইলেন। রামেশ্বর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, দৃষ্টি যাওয়ার চেয়ে মানুষের বড় দুঃখ আর নেই। ভীষণ পাপে, অভিসম্পাত না হ’লে মানুষের চোখ যায় না।
সুনীতি ব্যথিত কণ্ঠে বলিলেন, কিন্তু চোখ তো তোমার খারাপ হয় নি, তিন-চার বার ডাক্তার দেখানো হ’ল, তাঁরা তো তা বলেন না।
তারস্বরে প্রতিবাদ করিয়া রামেশ্বর বলিলেন, জানে না, তারা কিছুই জানে না, তুমিও জান না। দিনের আলোর মধ্যে চোখ আমার আপনি বন্ধ হয়ে যায়, কে যেন ধরে চোখে ছুঁচ ফুটিয়ে দেয়। নিবিয়ে দাও সুনীতি, ও আলোটা নিবিয়ে দাও, নয় আড়ালে সরিয়ে দাও।
আঃ।
আলোটা অন্তরালে সরাইয়া দিয়া সুনীতি নীরবে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
সে আমলের চকমিলানো বাড়ি, নীচের তলায় চারিদিকেই ঘর, একেবারে অবরুদ্ধ বলিলেই হয়। বাহিরের এমন মিষ্ট বাতাস, অথচ এ-বাড়ির নীচের তলায় বেশ গরম পড়িয়া গিয়াছে। স্বামীর জন্য খাবার সুনীতি নিজের হাতেই প্রস্তুত করেন, খাবার প্রস্তুত করিতে করিতে তিনি ঘামিয়া যেন স্নান করিয়া উঠিলেন।
পাচিকা বলিল, ওরে বাপ রে, মা যেন ঘেমে নেয়ে উঠলেন একেবারে! আমি যে এতক্ষণ আগুনের আঁচে রয়েছি, আমি তো এত ঘামি নি!
মানদা ঝি বলিল, পাখাটা নিয়ে আসি আমি।
অত্যন্ত লজ্জিত এবং কুণ্ঠিতভাবে সুনীতি বলিলেন, না রে, না, থাক। এই তো হয়ে গেছে আমার। এমন ভাবে ঘামিয়া ওঠাটা তাঁদের কাছেও অত্যন্ত অস্বাভাবিক বলিয়া মনে হইতে ছিল। তাঁহার খাবার তৈয়ারিও শেষ হইয়াছিল, তিনি খাবারগুলি গুছাইয়া উঠিয়া পড়িলেন। খাবার রাখিয়া দিয়া বলিলেন, দু-বালতি জল তুলে দে তো মানদা, গা ধুয়ে ফেলি একটু।
মানদা পুরানো ঝি, সে বলিল, এই যে সন্ধ্যায় গা ধুলেন মা। আবার গা ধোবেন কি গো, এই দো-রসার সময়? ভিজে গামছা দিয়ে গা মুছে ফেলুন বরং।
না রে, সমস্ত শরীর যেন ঘিনঘিন করছে আমার। তার পর ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, আমার কি কখনও মরণ হয় রে মানী, তাহ’লে সংসারে ভুগবে কে?
মানদা আর কথা না বলিয়া তাড়াতাড়ি জল তুলিয়া গামছা আনিয়া সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করিয়া দিল। আপনার হাত দুইখানি নাকের কাছে আনিয়া শুঁকিয়া সুনীতি বলিলেন, নাঃ, ধোঁয়ার গন্ধ, সাবান না দিলে যাবে না। তুই কার কাছে ঘুঁটে নিস মানদা? ঘুঁটে ভিজে থাকে।
বলিতে বলিতে তিনি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া সাবান বাহির করিয়া লইয়াও চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। তোলা কাপড় একখানা বাহির করিলে হয়, কিন্তু-। আবার তিনি এক গা ঘামিয়া উঠিলেন। মনের মধ্যে একটা দারুণ সঙ্কোচ তাঁহাকে পীড়িত করিতেছিল।
মানদা ডাকিল, মা আসুন।
সুনীতি তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া হাসিয়া বলিলেন, বাক্স খুলে দেখলাম, কাপড়গুলো সব পুরনো হয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম, কি হবে রেখে, পরে ফেলি। কিন্তু তোরা হাসবি ব’লে আর পারলাম না।
মানদা ও পাচিকা একসঙ্গে দুইজনেই হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল, না মা, না, আপনি পরুন, একটু ভাল কাপড় পরলে আপনাকে যা সুন্দর লাগে দেখতে। পরুন মা পরুন।
পরব?
হ্যাঁ মা পরুন, পরবেন বৈকি।
বুড়ো মেয়ের শখ দেখে তোরা হাসবি তো?
হেই মা, তাই হাসতে পারি? আর আপনি বুড়ো হলেন কি করে মা? বড় দাদাবাবু এই আঠারোতে পড়লেন; আমি তো জানি, আপনার পনেরো বছরে দাদাবাবু কোলে আসে। তা হ’লে কত হয়-এই তো মোটে তেত্রিশ বছর বয়েস আপনার।
সুনীতির সকল সঙ্কোচ কাটিয়া গেল। তিনি আবার বাক্স খুলিয়া বাছিয়া একখানি ঢাকাই শাড়ি বাহির করিয়া আনিলেন। গা ধুইতে ধুইতে বলিলেন, গরমের দিন এল, আর আমার এই চুলের বোঝা নিয়ে হ’ল মরণ।
মানদা বলিল, উঠুন আপনি গা ধুয়ে, আপনার চুলটা বেঁধে দেব আজ। চুল বাঁধতে বললেই আপনি বলেন, ছেলে বড় হয়েছে, বুড়ো হয়েছি, কত কি। দেখুন গিয়ে ছোট তরফের রায়গিন্নীকে, আপনার চেয়ে কত বড়, চুলে পাক ধরেছে, তবু রোজ চুল বাঁধবেন।
হাত মুখে সাবান দিয়ে গা ধোয়া শেষ করিয়া সুনীতি বলিলেন, দে তাই, চুলগুলো বিনুনি ক’রে দে তো। এলোচুল খুলে পিঠে পড়ে এমন সুড়সুড় করে পিঠ!
সুনীতির চুলগুলো ভ্রমরের মত কালো আর কোঁকড়ানো। হাতের মুঠিতে চুলগুলি ধরিয়া মানদা বলিল, বাহারের চুল বটে মা। আ-হা-হা, কি নরম! ছোট দাদাবাবু ঠিক তোমার মত দেখতে, কিন্তু চুলগুলিনও পায় নাই, এমন বাহারের চোখও পায় নাই।
সুনীতি চমকিয়া উঠিলেন, কই, অহীন্দ্র তো এখনও ফিরল না? তিনি উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিলেন, তাই তো রে, অহি তো এখনও ফিরল না? বেরিয়েছে, সেই কখন?
মানদা বলিল, বেশ, দেখুন গিয়ে তিনি বসে বসে রংলাল মোড়লের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি দেখে এসেছি তাঁদের দুজনকে জল আনতে গিয়ে নদীর ধারে। মোড়ল একবার এই হাত ছুঁড়ছে, একবার ওই হাত ছুঁড়ছে যেন বক্তৃতা করছে।
সুনীতি বলিলেন, ওই ওর এক নেশা। যত চাষীভূষির সঙ্গে ব’সে গল্প করবে। রায়েরা নিন্দে করে, মহী তো আমার ওপরেই তাল ঝাড়বে। তবু তো বাবুর কানে ওঠে না।
মানদা বলিল, রায়েদের কথা ছাড়ান দেন মা, ওরা এ-বাড়ির নিন্দে পেলে আর কিছু চায় না। আর ছোট দাদাবাবুর মত ছেলে তোমার হাজারে একটা নাই। আমি তো দেখি নাই! দেখে এস গিয়ে রায়বাড়ির ছেলেদিগে, কথা কি সব, যেন ছূঁচ বিঁধছে। তুই-তোকারি, চোপরাও, হারামজাদা-হারামজাদী তো ঠোঁতে লেগে আছে। -নেন মা, এইবার সিঁথিতে সিঁদুর নেন। কপালেও নেবেন, নিতে হয়।
সুনীতি স্থিরদৃষ্টিতে পশ্চিম দিকে একতলার ছাদের উপর দিয়া ওপারের শূণ্যমণ্ডলের দিকে চাহিয়া ছিলেন। ওপাশে কাছারি-বাড়ির প্রাঙ্গণে এত আলো কিসের? শূণ্যমণ্ডলটা পর্যন্ত আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে। তিনি শঙ্কিত হইয়া বলিলেন, দেখ্ তো বেরিয়ে মানদা, বাইরে এত আলো কিসের?
মানদা সশঙ্কচিত্তে সন্তর্পণে বাহির হইয়া গিয়া কিছুক্ষণ পরেই ছুটিয়া ফিরিয়া আসিল। -ওগো মা, একদল সাঁওতাল, এ-ই সব মশাল জ্বেলে দাদাবাবুকে পৌঁছে দিতে এসেছে। এ-ই সব ঠকাঠক পেনাম করছে। দাদাবাবুকে বলছে ‘রাঙাবাবু’।
রাঙাবাবু! সুনীতি শিহরিয়া উঠিলেন। সাঁওতালদের রাঙাঠাকুর-তাঁহার শ্বশুরের কাহিনী তিনি বহুবার শুনিয়াছেন। পরক্ষণেই আবার তাঁহার মন তাঁহার শ্বশুরকুলের গৌরবে ভরিয়া উঠিল। আর ওই আদিম বর্বর মানুষদের সকৃতজ্ঞ আনুগত্যের কথা স্মরণ করিয়া তাহাদের প্রতিও মমতার সীমা রহিল না। এ-বাড়িকে সাঁওতালরা কোনদিন ভোলে নাই, সরকারের সহিত মকদ্দমার পর হইতে এই বাড়িই সযত্নে সাঁওতালদের সহিত সংস্রব পরিহার করিয়া চলিয়াছে। বহু দিন ধরিয়া সরকার-পক্ষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন তাঁহার স্বামীর উপর।
হাসিতে হাসিতে বাড়িতে প্রবেশ করিল অহীন্দ্র, তাহার পিছনে পিছনে রংলাল আসিয়া বাড়ির দরজায় দাঁড়াইল।
আজ ওই চরটা দেখে এলাম মা। সাঁওতালেরা যা খাতির করল। আমার নাম দিয়েছে রাঙাবাবু। একটা যা অজগর চিতি ওরা মেরেছে-প্রকাণ্ড বড়। অহীন্দ্রের ইচ্ছা হইতেছিল, একেবারে সকল কথা এক মুহূর্তে সব জানাইয়া দেয়।
মা বলিলেন, ওই সাপখোপ-ভরা চর, ওখানে তুমি কেন গিয়েছিলে?
অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি’। গেলাম তো হ’ল কি? ভয় কিসের?
বাহির-দরজায় রংলাল দাঁড়াইয়া ছিল, সে ডাকিল, দাদাবাবু! তাহার গামছায় ছিল সেই ফুলগুলি।
সুনীতি চকিত হইয়া মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিয়া বলিলেন, মাঝিরা চলে গেল নাকি? মানদা দাঁড়াতে বল্ তো মাঝিদের। মুড়কি আর নাড়ু দিতে হবে ওদের।
রংলাল বলিল, ওগো মানদা, এইগুলো বরং নাও তুমি, আমি যাই মাঝিদের আটক করি। যে বোঙা জাত, হয়ত তোমার কথাই বুঝবেই না।
মানদা ফুলগুলি আনিয়া ঢালিয়া দিয়া বলিল, তাই বলি, দাদাবাবু এলেন আর এমন গন্ধ কোথা থেকে উঠল! আহা-হা, এ কি ফুল গো? কি ফুল দাদাবাবু?
ফুলের গন্ধ ও কদম্বফুলের মত পুস্পগুচ্ছগুলির গঠন-ভঙ্গি দেখিয়া সুনীতিও আকৃষ্ট হইলেন, তিনিও কয়েকটি পুস্পগুচ্ছ তুলিয়া লইয়া বলিলেন, ভারী সুন্দর ফুল তো?
উচ্ছ্বসিত হইয়া অহীন্দ্র বলিল, ওই ফুলের গন্ধেই তো চরের ভেতর গেলাম। রংলাল বললে, মাঝিরা ঠিক সন্ধান জানে। গেলাম যদি তো, আমাকে দেখেই কমল মাঝি, ওদের মোড়ল- উঃ, কি চেহারা তার মা, ঠিক যেন একটা পাহাড়ের মত-আমাকে দেখেই ঠিক চিনে ফেললে, বললে, হুঁ, ঠিক তেমনি পারা, তেমনি আগুনের মত রঙ, তেমনি চোখ, তেমনি চুল; ঠিক আমাদের রাঙাঠাকুরের লাতি! সেখানে মেয়েরা সব গোছায় গোছায় এই ফুল খোঁপায় পরে আছে। সেই মেয়েরা এনে দিলে এত ফুল। সবাই নিয়ে এল এক এক আঁচল ভরে। যার না নিই, সেই রাগ করে। রংলাল বললে, সবারই নোব দাদাবাবু, চলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি।
সুনীতি বলিলেন, যা তুই কতকগুলো নিয়ে বাবুর ঘরে দিয়ে আয়। ভারী খুশি হবেন উনি। শুনেছিস তো, উনি নাকি সেকালে রোজ সন্ধ্যেতে ফুলের মালা পরতেন। যা নিয়ে যা।
অহীন্দ্র বলিল, না, তুমি গিয়ে দিয়ে এস।
সে কি? এবার এসে একবারও তো তুই বাবুর সঙ্গে দেখা করিস নি। না না, এ তো ভাল নয় অহি।
আমার বড় কষ্ট হয় মা। তিনি কেমন হয়ে গেছেন। অথচ এত বড় পণ্ডিত, কি সুন্দর সংস্কৃত বলেন! আমার কান্না পায়।
সুনীতির চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নিজেই ফুল লইয়া উঠিলেন। বলিলেন, কি করব বল্, তোদের অদৃষ্ট আর আমার পোড়া কপাল! আচ্ছা, আমিই দিয়ে আসছি। যাইতে যাইতে আবার ফিরিয়া আসিয়া বসিলেন, ওগো বামুন-মেয়ে, মাঝিদের মুড়কি আর নাড়ু দিও সকলকে।
এতক্ষণে অহীন্দ্র মাকে দেখিয়া বলিল, বাঃ, বড় সুন্দর লাগছে মা তোমাকে আজ! অথচ কেন তুমি চব্বিশ ঘণ্টা এমন গরিব-গরিব সেজে থাক?
সুনীতি লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিলেন, তবু চট করিয়া আপন লজ্জা ঢাকিয়া বলিলেন, আজ আমি রাঙাবাবুর মা হয়েছি কিনা, তাই। আর বেয়াই আসবে বলে সেজেছি এমন, তোর সাঁওতালদের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেব।
ছেলে লজ্জিত হইয়া পড়িল, মাও দ্রুতপদে উপরে উঠিয়া গেলেন। অতি অল্পক্ষণ পরেই মাঝিদের লইয়া রংলাল আসিয়া অন্দরের বহির্দ্বারে দাঁড়াইয়া ডাকিল, দাদাবাবু!
মানদা বলিল, এস মোড়ল, ভেতরে নিয়ে এস ওদের, মা ওপরে আছেন।
* * *
সুনীতি দরজা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, ঘর অন্ধকার, বাতিটা বোধ হয় নিভিয়া গিয়াছে। তিনি দরজাটা আবার খুলিয়া অহিকে লক্ষ্য করিয়া বলেলেন, একটা প্রদীপ নিয়ে আয় তো অহি।
অন্ধকার কক্ষের মধ্য হইতে রামেশ্বর বলিলেন, কে, সুনীতি? তাহার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত উত্তেজিত এবং মৃদু চাপা ভঙ্গির মধ্যে আশঙ্কার আভাস সুপরিস্ফুট।
সুনীতি বুঝিলেন, আলো নিভিয়া যাওয়ায় রামেশ্বর উত্তেজিত হইয়াছেন। চোখে তাঁহার আলো সহ্য হয় না, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একা থাকিতেও তিনি আতঙ্কিত হইয়া ওঠেন। সুনীতি বলিলেন, এই এক্ষুনি আলো নিয়ে আসছে। কিন্তু আমি কি এনেছি বল তো? খুব একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছ?
সুনীতির কথার উত্তর তিনি দেলেন না, উত্তেজিতভাবেই তেমনি চাপা গলায় বলিলেন, এত আলো কেন কাছারি-বাড়িতে সুনীতি? এত লোক? আমাকে কি ওরা ধরে নিয়ে যাবে? তাই আলোটা নিবিয়ে দিয়েছি।
সুনীতির সকল আনন্দ ম্লান হইয়া গেল, তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, না না। ওরা সব সাঁওতাল, অহিকে পৌঁছে দিতে এসেছিল।
অহিকে পৌঁছে দিতে এসেছিল? সাঁওতাল?
হ্যাঁ, কালীর ওপারে যে চরটা উঠেছে, অহি আজ সেই চরে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে সাঁওতালেরা এসে বাস করছে; রাত্রি হ’তে তারা সব মশাল জ্বেলে অহিকে পৌঁছে দিয়ে গেল। অহি তোমার জন্য খুব চমৎকার ফুল এনেছে, গন্ধ পাচ্ছ না?
ফুল? তাই তো, চমৎকার গন্ধ উঠেছে তো! অহি এনেছে? আমার জন্য?
হ্যাঁ।
অহি আলো লইয়া দরজা ঠেলিয়া প্রবেশ করিল। সুনীতি আলোর ছটায় ফুলের স্তবকটি রামেশ্বরের সম্মুখে ধরিলেন। রামেশ্বর মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে বলিলেন, কুটজ কুসুম। বনবালারা, পর্বতদুহিতারা সেকালে কানে চুলে আভরণস্বরূপ ব্যবহার করতেন। আমরা বলি কুর্চি ফুল।
অহি বলিয়া উঠিল, সাঁওতালদের মেয়েরা দেখলাম থরে থরে সাজিয়ে খোঁপায় পরেছে।
সুনীতি বলিলেন, অহিকে নাকি সাঁওতালরা দেবতার মত খাতির করেছে, শ্বশুরের নাম ক’রে বলেছে, তুই বাবু আমাদের রাঙাঠাকুরের নাতি, দেখতেও ঠিক তেমনি। এক বুড়ো সাঁওতাল তাঁকে দেখেছিল, সে বলেছে, অহি নাকি ঠিক আমার শ্বশুরের মত
দেখতে। ওর নাম দিয়েছে রাঙাবাবু।
রামেশ্বর স্তব্ধ হইয়া অহির মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, তোল তো, আলোটা তোল তো সুনীতি, দেখি।
সুনীতি আলো তুলিয়া অহীন্দ্রের মুখের পাশে ধরিলেন। দেখিতে দেখিতে সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে তিনি বলিলেন, হুঁ। কণ্ঠস্বরে একটি সকরুণ বিষন্ন সুর সুনীতি ও অহীন্দ্র দুজনকেই স্পর্শ করিল। হয়ত কোনও অবান্তর অসম্ভব কথা এইবার তিনি বলিয়া উঠিবেন আশঙ্কা করিয়া সুনীতি বলিলেন, অহি, যা বাবা, তুই খেয়ে নিগে। আমি আলোটা জ্বেলে দিয়ে আসছি।
অহি চলিয়া গেল। সুনীতি আলোটা জ্বালিয়া দিয়া একটি শ্বেতপাথরের গ্লাসে ফুলগুলি সাজাইয়া দিয়া বলিলেন, এই দেখ, খুব সুন্দর কাপড় পরেছি আজ, চুলও বেঁধেছি; গীতগোবিন্দ শোনাবে তো?
রামেশ্বরের কানে সে কথা প্রবেশই করিল না, তিনি যেন কোন গভীর চিন্তার মধ্যে আত্মহারার মত মগ্ন হইয়া গিয়াছেন। সুনীতি তাঁহার অঙ্গ স্পর্শ করিয়া ডাকিয়া বলিলেন, কি ভাবছ?
ভাবছি, অহি যদি সাঁওতালদের নিয়ে গভর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে হাঙ্গামা করে!
না না না, অহি সে-রকম ছেলে নয়; খুব ভাল ছেলে, প্রত্যেকবার স্কুলে ফার্স্ট হয়। তুমি তো ডেকে কথাবার্তা বল না; কথা বলে দেখো, ভাল সংস্কৃত শিখেছে, কত দেশ-বিদেশের গল্প বলে!
রামেশ্বরের দুর্ভাবনা ইহাতেও গেল না, তিনি বার বার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, সাঁওতালেরা চিনেছে যে! আবার নাম দিয়েছে বলছ- রাঙাবাবু, আর ঠিক সেই রকম দেখতে!
সুনীতির এক এক সময় ইচ্ছা হয়, কঠিন একটা পাথরের নিষ্ঠুর আঘাতে আপনার কপালখানাকে ভাঙিয়া ললাটলিপিকে ধুলার মধ্যে বিলুপ্ত করিয়া দেন। তিনি ঘর হইতে বাহির হইয়া চলিয়া আসিলেন। নীচে মানদা ও বামুন-ঠাকুরন বসিয়া সাঁওতালদের কথা আলোচনা করিতেছিল, মানদা বলিতেছিল, আমার সবচেয়ে ভাল লাগে ওদের বাঁশী। শুনছ, বাড়ি ফিরতে ফিরতে বাঁশী বাজাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ?
সুনীতি ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, এখনও তোমাদের গল্প হচ্ছে মা? ছি!