৩৪
নিতান্ত বিস্মৃতিবশেই খান-দুই ইস্তাহার এবং একখানা পত্র সুটকেসের নীচে পাতা কাগজের তলায় রহিয়া গিয়াছিল; ঝাড়িয়া মুছিয়া গুছাইতে গিয়া উমা সেগুলি পাইয়াছিল। লাল অক্ষরে ছাপা ইস্তাহারখানা পড়িয়াই উমা ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, তারপর সেই পত্রখানা; তাহার মধ্যে সব সুস্পষ্ট-”মৃত্যু মাথায় করিয়া আমাদের এ অভিযান। প্রায় পৃথিবীব্যাপী বিরাট শক্তিগুলি ভরা রাইফেলের ব্যারেল উদ্যত করিয়া রাখিয়াছে। ফাঁসীর মঞ্চে দড়ির নেকটাই প্রস্তুত হইয়া ঝুলিতেছে। অন্যদিকে মানুষের আত্মঅজ্ঞাত স্বার্থবুদ্ধি-প্রণোদিত বিধানের ফলে অসংখ্য কোটি মানুষের অপমৃত্যু যুগ যুগ ধরিয়া ঘটিয়া আসিতেছে।” শেষের কয়টি লাইনের পাশে অহিন্দ্র দাগ দিয়া লিখিয়াছে, “আবছা অন্ধকারের মধ্যে সাঁওতালেরা চর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। আমি চোখে দেখিয়াছি।”
উমা বাস্পারুদ্ধ কণ্ঠে একে একে সমস্ত কথাই সুনীতিকে প্রকাশ করিয়া বলিল। বলিতে পারিল না কয়েকটি কথা; অহীন্দ্র ঠিক এই সময়েই আসিয়া পড়িয়াছিল, উমার হাতে কাগজ ও চিঠি দেখিয়া ছোঁ মারিয়া সেগুলি কাড়িয়া লইয়া বলিয়াছিল, এ তুমি কোথায় পেলে?
উমা যেমন ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া চিঠিখানা পড়িতেছিল, তেমন ভঙ্গিতেই দাঁড়াইয়া ছিল, ঠোঁট দুইটি কেবল থরথর করিয়া কাঁপিয়াছিল, উত্তর দিতে পারে নাই। অহীন্দ্র হাসিয়াছিল, হাসিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া বলিয়াছিল, “না জাগিলে হায় ভারতললনা, ভারত স্বাধীন হল না হল না।” এই নব জাগরণের ক্ষণে তুমি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির লেখাপড়া জানা মেয়ে কেঁদে ফেললে উমা? নাঃ, দেখছি তুমি নিতান্তই ‘বাঙালিনী’! তারপর সে তাহাকে বলিয়াছিল লেনিনের সহধর্মিণীর কথা, রাশিয়ার বিপ্লবের যুগের মেয়েদের কথা।
উমার তরুণ রক্তে আগুন ধরিয়া গিয়াছিল। স্বামীর সাধনমন্ত্র নিজের ইষ্টমন্ত্রের মত এতদিন সে গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু আজ একটি বিচলিত মুহূর্তে স্বামীর বেদনা-বিচলিত মায়ের কাছে সে আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, সব প্রকাশ করিয়া ফেলিল।
তিনি যেন পাথর হইয়া গেলেন। বজ্রগর্ভ মেঘের দিকে যে স্থির ভঙ্গিতে পাহাড়ের শৃঙ্গ চাহিয়া থাকে, সেই ভঙ্গিতে অপলক দৃষ্টিতে তিনি ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
* * *
মাস দুয়েক পর একদিন সে বজ্র নামিয়া আসিল।
উমার হাত ধরিয়া সুনীতি নিত্যই ইহার প্রতীক্ষা করিতেছিল। প্রতিকারের উপায় কিছু দেখিতে পান নাই। অহীন্দ্রকে বাড়ি আসিবার জন্য বার বার আদেশ অনুরোধ মিনতি জানাইয়া পত্র লিখিয়াছিলেন, অহীন্দ্র আসে নাই, কোন উত্তর পর্যন্ত দেয় নাই। অমল জানাইয়াছে, অহীন্দ্র কোথায় যে হঠাৎ গিয়াছে সন্ধান করিয়াও সে জানতে পারে নাই; ফিরিলেই সে খবর দিবে। কোন বন্ধুর সহিত সে কলিকাতার বাহিরে কোথাও গিয়াছে।
সুনীতি ও উমা নীরবে পরস্পরকে অবলম্বন করিয়া অবশ্যম্ভাবীর প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন। হেমাঙ্গিনী বা ইন্দ্র রায়ের নিকটেও গোপন করিয়া রাখিলেন। ও-দিকে ইন্দ্র রায় কাশীযাত্রার আয়োজনে সম্পূর্ণ ব্যস্ত, তাহা ছাড়া তিনি যেন বড় লজ্জিত, চক্রবর্তী বাড়ির অনেক অনিষ্ট রায় করিয়া দিয়াছেন। তিনি এ বাড়ি বড় একটা আসেন না। মাঝে মাঝে আসেন, কিন্তু ম্লানমৌন সুনীতির সম্মুখে তিনি বসিয়া থাকিতে পারেন না। মনে হয় এই ম্লান মুখে সুনীতি যেন বৈষয়িক ক্ষতির জন্য তাঁহাকে নিঃশব্দে তিরস্কার করিতেছেন। উমার ম্লানমুখ দেখিয়া ভাবেন বাপের লজ্জায়ই উমা এমন নতশির ম্লান হইয়া গিয়াছে। কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতেও তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসে।
সেদিন মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত্রি; রাত্রি প্রথম প্রহর শেষ হইয়া আসিয়াছে। চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহে একটা অকাল বর্ষা নামিয়াছিল; আকাশে সেই অকাল বর্ষার ঘনঘটাচ্ছন্ন মেঘ ; চারিদিকে জমাট অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে সচল দীর্ঘাকৃতি অন্ধকারপুঞ্জের মত কালিন্দীর বালি ভাঙিয়া চলিয়া আসিতেছে অহীন্দ্র। গায়ে একটা বর্ষাতি জামা, মাথায় বর্ষাতি টুপি। গভীর অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া এই দুর্যোগ মাথায় করিয়া সে মা ও উমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে। পুলিস তাহাদের ষড়যন্ত্রের সন্ধান পাইয়াছে।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মহাযুদ্ধের পর তখন ভারতের গণ আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় শেষ হইয়াছে। নূতন অধ্যায়ের সূচনায় রাশিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজতন্ত্রবাদী যুবকসম্প্রদায়ের এক ষড়যন্ত্র আবিস্কৃত হইয়া পড়িল। ভারতের নানা স্থানে খানাতল্লাসী এবং ধরপাকড় আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। অহীন্দ্র ছিল ইউ.পি-র কোন একটা শহরে; সেখান হইতে আত্মগোপন করিয়া চলিয়া আসিতেছে, আবার আজই, রাত্রির অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই বাহির হইয়া পড়িতে হইবে। দৃঢ় দীর্ঘ পদক্ষেপে বালি ভাঙিয়া কূলে আসিয়া উঠিল।
এ কি? এ তো রায়হাটের ঘাট নয়, এ যে চরের ঘাট! পাকা বাঁধানো রাস্তা, ওই তো অন্ধকারের মধ্যেও সুদীর্ঘ চিমনিটা, ওই বোধহয় বিমলবাবুর বাংলোয় একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছে। কুলীব্যারাকের সুদীর্ঘ ঘরখানার খুপরির মত ঘরে ঘরে স্থিমিত আলোর আভা। যেন স্তব্ধগতি ট্রেনের মত মনে হইতেছে। রায়হাট ও-পারে; ভুল করিয়া সে চরের উপর আসিয়া উঠিয়াছে। সে ফিরিল। কিন্তু আবার দাঁড়াইল। অনেক কথা মনে পড়িয়া গেল।
কাশ ও বেনাঘাসের জঙ্গলে ভরা সেই চরখানি, জনমানবহীন, যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। কতদিন নদীর ও-পার হইতে দাঁড়াইয়া সে দেখিয়াছে। তারপর একদিন এইখানেই সরু একটি পথের উপর দিয়া সারিবদ্ধ কালো মেয়ের দলকে বাহির হইতে দেখিয়াছিল, মাটির ঢিপির ভিতর হইতে যেমন পিপীলিকার সারি বাহির হয় তেমনি ভাবে। সত্য সত্যই উহারা মাটির কীট। মাটিতেই উহাদের জন্ম, মাটি লইয়াই কারবার, মাটিই উহাদের সব। সেদিন সঙ্গে ছিল রংলাল। সেই দলটির মধ্যে সারীও ছিল নিশ্চয়, মুকুটের মধ্যস্থলে কালো পাখীর দীর্ঘ পালকের মত। এই পথ দিয়াই সে চরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল-আদিম বর্বর জাতির বসতি মাটির কীটদের গড়া বাসস্থান। সচল পাহাড়ের মত কমল মাঝি, বৃদ্ধা মাঝিন, কালো পাথরে গড়া প্রায় উলঙ্গ মানুষের দল। চিত্রিত বিপুলদেহ মৃত অজগরের মাংসস্তুপ। রাশীকৃত কুর্চির ফুল, দীর্ঘাঙ্গী মুখরা সারী; সাঁওতাল মেয়েদের নাচ। মাটির উপর রংলালের প্রলোভন। নবীন বাগদীর দলকেও মনে পড়িল। জমিদারের অলস উদরের লোলুপ ক্ষুধা। মনে পড়িল তাহার দাদাকে। ননী পালের মৃত্যু। শ্রীবাস ও মজুমদারের ষড়যন্ত্র। দাঙ্গা, নবীনের দ্বীপান্তর। কলওয়ালা বিমলবাবু! তাহার চোখ জ্বলিয়া উঠিল, সরলা সাঁওতালদের মেয়ে সারীকে জোর করিয়া করায়ত্ত করিয়া তাহার সর্বনাশ করিয়াছে, সাঁওতালদের জমি আত্মসাৎ করিয়াছে। তাহারা নিজেরা- তাহার শ্বশুর, তাহার বাবা-বাকিটুকু কাড়িয়া লইয়াছেন। রাত্রিশেষের অস্পষ্ট আলোকময় অন্ধকারের মধ্যে কালো কালো মানুষের সারি, কাঁধে ভার, মাথায় বোঝা, সঙ্গে গরু ছাগল ভেড়ার পাল, বসতি ছাড়িয়া চলিয়া গেল, নিঃশেষে ভূমিহীন হইয়া চলিয়া গেল। যুগে যুগে এমনি করিয়াই উহারা স্থান হইতে স্থানান্তরে হাঁটিয়া কাল সমুদ্রের প্রায় কিনারার উপর আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
অহীন্দ্রের চোখ অন্ধকারের মধ্যে শ্বাপদের মত জ্বলিতেছিল। অই বিমলবাবুটাকে-। পকেট হইতে সে ছোট কালো ভারী একটা বস্তু বাহির করিল। ছয়টা চেম্বার বোঝাই করা রিভলবার। বিকারগ্রস্থ রোগীর মত অস্থির অধীর হইয়া উঠিল সে। একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিক চাহিয়া দেখিয়া লইল। আশেপাশের সম্মুখে চরখানা তেমনি, এখানে-ওখানে আলোকচ্ছটা বিকীর্ণ হইতেছে মাত্র, মানুষ দেখা যায় না; পিছনে কালিন্দীর গর্ভেও কেহ নাই। ও-পারে রায়হাট স্তব্ধ অন্ধকার, শুধু গাছপালার মাথার উপর একটা আলোর ছটা, একটা বাড়ির খোলা জানলার আলো। এ যে তাহাদেরই বাড়ি-হ্যাঁ, তাহাদের বাড়ির জানলার আলো। আলোকিত ঘরের মধ্যে দুইটি মানুষ, স্ত্রীলোক-মা আর উমা। সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মা আসিয়া জানলা ধরিয়া দাঁড়াইয়াছেন, স্পষ্ট মা। কিছুক্ষণ পর রিভলবারটি পকেটে পুরিয়া সে চরকে পিছনে ফেলিয়া রায়হাট অভিমুখে দ্রুত অগ্রসর হইল। পুরনো গ্রামের বৃক্ষছায়াচ্ছন্ন পথ অতিবাহন করিয়া সে সেই আলোকিত জানলার তলে আসিয়া দাঁড়াইল, অনুচ্চ অথচ স্পষ্ট স্বরে ডাকিল, মা!
কে? কে?-শঙ্কিত ব্যাগ্রকণ্ঠে সুনীতি প্রশ্ন করিলেন।
মা!
অহীন?…যাই যাই, দাঁড়া।
মাথার টুপিটা খুলিয়া ফেলিয়া রেন কোটের বোতাম খুলিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া অহীন্দ্র মৃদু হাসিল, ছলনা করিয়া মাকে ভুলাইবার জন্যই সে হাসিল।
সুনীতি অপলক চক্ষে অহীন্দ্রের দিকে চাহিয়া ছিলেন; চোখে জল ছিল না, কিন্তু ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল, অহীন্দ্রের হাসি দেখিয়া তাঁহার কম্পিত অধরেও একটি অস্পষ্ট বিচিত্র হাস্য রেখা ফুটিয়া উঠিল, মৃদুস্বরে বলিলেন, আমি সব শুনেছি অহীন।
অহীন্দ্র চমকিয়া উঠিল।
সুনীতি বলিলেন, বউমা আমাকে সব বলেছে।
ও-বাড়ির ওঁরা? তা হলে কি তোমরাই-? তাহার সন্দেহ হইল, হয়তো প্রাচীন জমিদারবংশ তাহাকে রক্ষার্থে রাজভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া পুলিসের শরণাপন্ন হইয়াছেন।
না, আর কেউ জানে না। আমাকে না বলে বউমা বাঁচবে কি করে বল? এত দুঃখ সে কি লুকিয়ে রাখতে পারে? কিন্তু এ তুই কি করলি বাবা?
কোটের শেষ বোতামটা খুলিয়া অহীন্দ্র মৃদু হাসিয়া বলিল, আজই রাত্রে আমাকে চলে যেতে হবে মা, পুলিস আমদের দলের সন্ধান পেয়ে গেছে।
সুনীতি সমস্ত শুনিয়াছেন জানিয়া সে আর ভূমিকা করিল না, সান্তনা দিবার চেষ্টা করিল না। একেবারে কঠিনতম দুঃসংবাদটা শুনাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইল। একবার শুধু হাস্যমুখে মুখ ফিরাইয়া উমার দিকে চাহিল। খাটের বাজু ধরিয়া উমা দাঁড়াইয়া আছে। সে তাহাকে বলিল, একটু চা খাওয়াও দেখি উমা। সঙ্গে কিছু খাবার-খিদে পেয়ে গেছে।
* * *
সুনীতি শুধু বলিলেন, তুই যদি বিয়ে না করতিস অহীন, আমার কোন আক্ষেপ থাকত না। অহীন্দ্র উত্তরে উমার দিকে চাহিল, উমার মুখে বেদনার্ত ম্লান হাসি; কিন্তু কোন অভিযোগ সেখানে ছিল না, তাহার জলভরা চোখে স্বচ্ছ জলতলে বাড়বহ্নিদীপ্তির মত তরুণ প্রাণের আত্মত্যাগের বাসনা জ্বলজ্বল করিতেছে। অহীন্দ্র মাকে বলিল, উমা কোনদিন সে-কথা বলবে না মা; উমা এ-যুগের মেয়ে।
সুনীতি একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, তারপর বলিলেন, একটু বিশ্রাম করে নে বাবা, আমি ঠিক ভোরবেলা তোকে জাগিয়ে দেব। তিনি উঠিয়া গেলেন; বধূকে বলিলেন, দরজা বন্ধ করে দাও বউমা।
উমা দরজা বন্ধ করিয়া অহীন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; অহীন্দ্র তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিল, কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিল না। তাহার ভয় হইতেছিল এখনই হয়তো উমা ভাঙিয়া পড়িবে।
কথা বলিল উমা নিজে। বলিল শুয়ে পড় এখন ঘুমিয়ে নাও।
অহীন্দ্র একান্ত অনুগতের মতই শুইয়া পড়িল। উমা তাহার মাথার চুলের মধ্যে আঙুল চালাইয়া যেন তাহাকে ঘুম পাড়াইতে বসিল।
ভোরবেলা, খানিকটা রাত্রি ছিল তখনও। সুনীতি আসিয়া ডাকিলেন, বউমা! বউমা!
উমা কখন ঘুমে ঢলিয়া অহীন্দ্রের পাশেই শুইয়া ঘুমাইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ঘুমের মধ্যেও তাহার উদ্বেগকাতর মন জাগিয়া ছিল, দুই বার ডাকিতেই তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল; তাড়াতাড়ি উঠিয়া সে অহীন্দ্রকে ডাকিয়া তুলিল। অহীন্দ্র উঠিয়া জানলা খুলিয়া একবার বাহিরটা দেখিয়া লইল, তারপর একবার গভীর আবেগে উমাকে বুকে টানিয়া লইয়া তাহার কম্পিত অধরে প্রগাঢ় একটি চুম্বন করিল; কিন্তু সে ওই মুহূর্তের জন্য, সে জামা পরিয়া জুতার ফিতা বাঁধিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। উমা দরজা খুলিয়া দিল, সুনীতি আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। অহীন্দ্র আর কাহারও মুখের দিকে চাহিল না, হেঁট হইয়া মায়ের পায়ে একটি প্রণাম করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল। সিঁড়ি অতিক্রম করিয়া দরজা খুলিয়া সে রাস্তায় বাহির হইয়া গেল, দরজায় দাঁড়াইয়া সুনীতি ও উমা দেখিলেন, রাত্রিশেষের তরল অন্ধকারের মধ্যে অহীন্দ্র যেন কোথায় মিশিয়া গেল।
বেলা দশটা হইতেই কিন্তু অহীন্দ্র আবার ফিরিয়া আসিল, তাহার সঙ্গে পুলিস। রেলস্টেশনে পুলিস তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। ইউ.পি হইতে পুলিস জেলা পুলিসকে টেলিগ্রাম করিয়া ছিল। পুলিস এখন বাড়ি ঘর খানা তল্লাস করিয়া দেখিবে।
অভিযোগ গুরুতর-রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং রাজকর্মচারী হত্যার ষড়যন্ত্র।
* * *
দশটা হইতে আরম্ভ করিয়া বেলা তিনটা পর্যন্ত খানাতল্লাসি করিয়া পুলিসের কাজ শেষ হইল। ইন্দ্র রায়ের বাড়িও খানাতল্লাস হইয়া গেল। বাড়ির আশেপাশে লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠিয়াছিল। কাহারও চোখই শুষ্ক ছিল না, হ্যাণ্ডকাপ দিয়া কোমরে দড়ি বাঁধিয়া অহীন্দ্রকে লইয়া যাইতে দেখিয়া সকলেরই চোখ সজল হইয়া উঠিল। তাহার মধ্যে অঝোরঝরে কাঁদিতেছিল কয়েকজন; মানদা, মতি বাগদিনী প্রিয়জন-বিয়োগের শোকার্তের মতই কাঁদিতে ছিল। আর কাঁদিতেছিলেন যোগেশ মজুমদার। লজ্জা আর অনুতাপে তাহার আর সীমা ছিল না। সমস্ত কিছুর জন্য সে অকারণে আপনাকে দায়ী করিয়া অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। এ-কান্না তাহার সাময়িক, হয়তো কালই সে কলের মালিকের ইঙ্গিতে চক্রবর্তী-বাড়ির অনিষ্ট সাধনে উঠিয়া পড়িয়া লাগিবে, কিন্তু তবু সে আজ কাঁদিতেছিল। অচিন্ত্যবাবুও একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া বেশ স্ফুটভাবেই ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছিলেন, এই মর্মন্তুদ দৃশ্য দুর্বল মানুষটি কোনমতেই সহ্য করিতে পারিতেছেন না। রংলালও কাঁদিতেছে। কেবল একটি মানুষ ক্রোধভরে আস্ফালন করিতেছিল, হুঁ হুঁ বাবা, এয়ারকি, গবরমেণ্টারের সঙ্গে চালাকি! সে শূলপাণি, সদ্য গাঁজা টানিয়া সে জ্ঞাতিশত্রু-নিপাতের তৃপ্তিতে আস্ফালন মুখর হইয়া উঠিয়াছে।
পুলিস অহীন্দ্রকে লইয়া চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী আছাড় খাইয়া পরিলেন, উমা নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, চোখভরা জল আঁচলে মুছিয়া সে মাকে ডাকিল, ওঠ মা। একদিন তো তিনি ফিরে আসবেন; কেঁদো না। হেমাঙ্গিনী মুখ তুলিয়া মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া অবাক হইয়া গেলেন।
ইন্দ্র রায় মাথা নীচু করিয়া পায়চারি করিতেছেন। রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির মিলিত জীবন-পথ আবার ভাঙিয়া গেল। পরমুহূর্তে মনে হইল, না না, ভাঙে নাই। বিপদ আসিয়াছে আঘাত আসিয়াছে সে আঘাত দুই বাড়িকেই সমানভাবে বেদনা দিয়াছে; কিন্তু বিচ্ছেদ হয় নাই, দুই বাড়ির বন্ধন ছিন্ন হয় নাই। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া তিনি ডাকিলেন ইষ্টদেবীকে, তারা, তারা মা! তারপর বলিলেন, ওঠ গিন্নী, ওঠ।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওগো আর নয়, তুমি কাশী যাবে বলছিলে, কাশী চল।
যাব। অহীন্দ্রের বিচার শেষ হোক। মা যে বাধা দিলেন। উমা, তোর শাশুড়ী কোথায় গেলেন, দেখ্ মা।
রামেশ্বরের ঘরে সুনীতি মাটির উপর মুখ গুঁজিয়া মাটির প্রতিমার মতই পড়িয়াছিলেন, মৃদু নিঃশ্বাসের স্পন্দন ছাড়া একটুকু আক্ষেপ সর্বাঙ্গের মধ্যে কোথাও ছিল না; মহী যেদিন আত্মসমর্পণ করে সেদিনও ঠিক এমনিভাবেই তিনি পড়িয়া ছিলেন।
খাটের উপর রামেশ্বর বসিয়া ছিলেন পাথরের মত।