৩২
ইহার পর বিরাট একটি মামলা-পর্ব।
সাঁওতালদের জমি এবং নদীর বাঁধ উপলক্ষ করিয়া কলওয়ালার সহিত ইন্দ্র রায় ও চক্রবর্তী-বাড়ির ছোট-বড় ফৌজদারী দেওয়ানী মামলা একটির পর একটি বাধিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।
সদর হইতে এস.ডি.ও আসিয়া তদন্ত করিয়া গেলেন। অমলের আনীত অভিযোগ তিনি প্রত্যক্ষ করিলেন, সাঁওতালরা ভূমিহীন হইয়া অধিকাংশই এখান থেকে চলিয়া গিয়াছে, যাহারা আছে তাহাদেরও জমিজমা নাই। কিন্তু ইহাদের মধ্যেও তিনি বে-আইনী কিছু দেখিলেন না। বিমলবাবু ঋণের দায়ে জমিগুলি খরিদ করিয়াছেন, সাঁওতালরাও স্বেচ্ছায় বিক্রয় করিয়াছে। চূড়া মাঝি ও তাহার অনুগত মাঝি কয়জন-যাহারা এখানে থাকিয়া গিয়াছে, তাহারাই সে কথা স্বীকার করিল। সারী-সম্পর্কিত অভিযোগের তদন্ত করিয়া তিনি যাহা দেখিলেন, সে কথা সত্যের খাতিরেও পুরোপুরি লেখা চলে না। -‘বর্বর জীবনের সঙ্গে লোভ এবং নীতিহীন উচ্ছৃঙ্খলতার সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ট; এক একটা জীবনে তাহা অত্যুগ্র হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বর্বর লোভপরবশ, উচ্ছৃঙ্খল মেয়েটির এই পরিণতি ভয়াবহরূপে দুঃখজনক হইলেও ইহা স্বাভাবিক। তাহার বর্তমান অবস্থা হইতে তাহা প্রত্যক্ষ, কিন্তু সে অবস্থার কথা লেখা চলে না।’
‘মোটামুটি অভিযোগের বিষয়গুলি বাহ্যত প্রত্যক্ষ হইলেও অন্তর্নিহিত সত্য ইহার মধ্যে কিছুই নাই; ইহার অন্তর্নিহিত সত্য হইতেছে জমিদারের সহিত কলের মালিকের প্রতিপত্তি লইয়া বিরোধ। কলের মালিক এখানে কল স্থাপন করিয়া সমগ্র অঞ্চলের একটি বিশেষ উপকার করিয়াছেন। দীনদরিদ্রের মজুরির সুবিধা হইয়াছে, আখের চাষের উন্নতির বিশেষ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; চারিদিকের পথঘাটের উন্নতি হইয়াছে, এবং এ-কথাও সত্য যে, জমিদারের প্রাপ্য ন্যায্য খাজনা বন্ধ করিয়া কলের মালিক আইন বাঁচাইয়াও যথেষ্ট অন্যায় করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে, কোন স্থানের প্রজারা সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া ধর্মঘট করিলে যে বিশৃঙ্খলা ঘটিত, এ-ক্ষেত্রে একক তিনি কৌশলে সেই বিশৃঙ্খলা ঘটাইয়াছেন।’
কিন্তু ইহাতেও কোন ফল হইল না।
উভয় পক্ষই একটির পর একটি নূতন বিবাদ বাধাইয়া চলিলেন। ইন্দ্র রায়ের স্বাভাবিক জীবন আর একরকম হইয়া উঠিল, তাঁহার গোঁফজোড়াটা পাক খাইয়া ভোজালির মত বাঁকা এবং তীক্ষ্ণাগ্র হইয়া উঠিয়াছে। জমিদারী কাগজপত্র ও ফৌজদারী দেওয়ানী আইনের বইয়ের মধ্যে তিনি ডুবিয়া আছেন। অন্দরমহল পর্যন্ত এ উত্তেজনা সঞ্চারিত হইয়া পড়িয়াছে। নিত্য প্রভাবে আজ আবার নূতন কি ঘটিবে, তাহারই আশঙ্কায় চিন্তায় সকলে কল্পনা-মুখর মস্তিষ্কে শয্যাত্যাগ করিয়া থাকেন।
অহীন্দ্র অমল কলিকাতায়। অমল ভালভাবেই আই.এ পাস করিয়া বি.এ পড়িতেছে; অহীন্দ্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। সে নাকি খাড়া সোজা হইয়া বিদ্যা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়া ডুবিয়াছে। অমল ইহার মধ্যে বারদুয়েক বাড়ি আসিল, কিন্তু অহীন্দ্র আসিল না।
হেমাঙ্গিনী অভিযোগ করিয়া বলিলেন, তাকে ধরে নিয়ে এলি নে কেন তুই?
অমল ভুরু কুঁচকাইয়া বলিল, সে হল বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন- হীরের টুকরো; আমার হলাম কয়লার কুচো। সম্বন্ধ ঘনিষ্ট হলেও তার স্থান হল সোনার গহনায়, আর আমাদের স্থান চুলোয়। তার নাগাল আমি পাব কেমন করে, বল?
হেমাঙ্গিনী একটু আহত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন। একটু নীরব থাকিয়া অমল আবার বলিল, জান মা, অহীন আজকাল আমার সঙ্গে ভাল করে মেশেই না। তার এখন সব নূতন সঙ্গী জুটেছে, অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে অহীনের।
হেমাঙ্গিনী দুঃখ অনুভব করিলেন, বলিলেন, অহীনের হয়তো দোষ আছে অমল, কিন্তু দোষ তোমারও আছে। ভগ্নিপতির সঙ্গে তোমাদের গুষ্টিরই কোনকালে বনে না। ভগ্নিপতির কাছে মাথা নীচু করতে তোমাদের যেন মাথা কাটা যায়।
অমলও একটু আহত হইল, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হাসিয়া বলিল, মায়েরা দেখছি ছেলের চেয়ে জামাইকে ভালবাসে বেশী। বাসো তাতে হিংসে আমি করছি না। কারণ আমারও তো বিয়ে হবে। কিন্তু আমার ওপর তুমি অবিচার করছ, অহীনের কাছে মাথা নীচ্চু করতে আমার লজ্জা নেই। মাথা নীচু করলেও সে আমাকে দেখতে পায় না। দুঃখ হয় আমার সেইখানে।
হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন। এমন কথার পর অমলকে তিনি দোষ দিতে পারিলেন না।
অমল আবার বলিল, অহীনের একটা ঘোর পরিবর্তন হয়ে গেছে। সঠিক কিছু বুঝতে পারি না, কিন্তু সে অহীন আর নেই। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব ছিল অহীনের; এখন সেটা যেন একেবারে মুছে গিয়েছে। এখন তার সব তাতেই বাঁকা ধারালো ঠাট্টা, আর এমন একটা অদ্ভুত হাসি হাসে।
হেমাঙ্গিনী বিস্মিত হইলেন, একটু চিন্তিত হইলেন।
ঠিক এই সময়েই হেমাঙ্গিনীর ডাক পড়িল; রায় মহাশয় নিজে ডাকিতেছিলেন।–একবার তোমার বেয়ানের কাছে যাও দেখিঃ বলে এস, পুরনো দলিলগুলি একবার দেখা দরকার। মানে, আমাদের রায়-বাড়ির মূল বণ্টননামায় চক্ আফজলপুরের কি চৌহদ্দি-
এত সব কথা তোমার আমিও বুঝি নে, সুনীতিও বুঝবে না। কি বলছ তাই বল। তোমাদের মামলা-মকদ্দমার হাঙ্গামায় আমাদের আহারনিদ্রা সুদ্ধ ঘুচে গেছে।
দলিলের বাক্সগুলো একবার দেখতে হবে। সেগুলো পাঠিয়ে-না থাক, বলে এস, আমিই যাব সন্ধ্যেবেলায়, সব দেখব। রামেশ্বরের ঘরেই যেন বাক্সগুলো বের করিয়ে রাখেন। হ্যাঁ, আরও বলো মঙ্গলবারে মা-সর্বরক্ষার পূজো হবে। কালিন্দীর বাঁধের মকদ্দমায় আমাদের একরকম জিতই হয়েছে। বাঁধ দিতে হলে বছর বছর একটা করে খাজনা দিতে হবে কলওয়ালাকে; তার অর্ধেক পাবে চক্রবর্তীরা-ওপারের চরের মালিক হিসাবে, আর অর্ধেক রায়হাটের মালিকরা পাবে। বর্ষা পড়লেই বাঁধ কেটে দিতে হবে।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, যাব; এখনই অমল এল, তাকে জল খাইয়ে তারপর যাব। ছেলে বাড়ি এল, তার খোঁজ করা নেই, মামলা নিয়েই মেতে আছ! ধন্য মানুষ তুমি!
রায় বললেন, আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে অমলের। তিনি হাসিলেন, সে হাসিটুকু একান্ত ভাবে দোষক্ষালনের জন্য অপ্রতিভের হাসি। তারপর তিনি বলিলেন, কই অমল কই? একখানা আইনের বইয়ের জন্য লিখেছিলাম-অমল! অমল! -বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন, পদক্ষেপে সিঁড়িটা যেন কাঁপিতেছিল।
হেমাঙ্গিনী সুনীতির কাছে আসিয়া উমার সহিত নির্জনে দেখা করিলেন। অমলের কথা শুনিয়া অবধি উমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করিবার জন্য তিনি ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিলেন।
উমা একটু বিস্মিত হইল-এমন নির্জনে মা কি বলবেন? হেমাঙ্গিনী বলিলেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব উমা। সত্যি বলবি তো? আমার কাছে লুকাবি নি তো?
কি মা?
হ্যারে অহীন তোকে চিঠিপত্র লেখে তো?
লজ্জিত হইয়া উমা সবিস্ময়ে বলিল, লেখে বৈকি মা।
বেশ ভাল করে লেখে তো?
উমা হাসিয়া ফেলিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অমল বলছিল, অহীন নাকি তার সঙ্গে ভাল করে মেশে না। তার নাকি অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
উমা গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, তিনি অনেক কথা ভাবেন মা। অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই জন্য বোধ হয়-
কন্যার গৌরব-বোধ দেখিয়া মা তৃপ্ত হইলেন। আর কোন প্রশ্ন করিলেন না।
* * *
হেমাঙ্গিনী তখনকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু পূজার ছুটিতে অহীন্দ্র বাড়ি আসিলে তাহাকে দেখিয়া তিনি মনে মনে শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। অহীন্দ্রের দেহ শীর্ণ হইয়া গিয়াছে, মাথার চুল বিশৃঙ্খল, শরীরের প্রতি অমনোযোগের চিহ্ন সুপরিস্ফুট, অমনোযোগ না বলিয়া অত্যাচার বলিলেও অন্যায় হয় না। তাহার শীর্ণ দেহের মধ্যে চোখ দুইটি শুধু জ্বলজ্বল করিতেছে, কৃষ্ণপক্ষের রক্তাভ যুগল মঙ্গল গ্রহের মত।
তিনি সস্নেহে অহীন্দ্রের মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, শরীর তোমার এত খারাপ কেন বাবা?
অল্প একটু হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, শরীর? তারপর আবার একটু হাসিল, আর কোন উত্তর দিল না, যেন হাসির মধ্যেই উত্তর দেওয়া হইয়া গিয়াছে।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, হাসির কথা নয় বাবা, শরীর বাঁচিয়েই সকল কাজ করতে হয়। এই গোটা সংসারটি তোমার মুখপানে তাকিয়ে আছে।
অহীন আবারও একটু হাসিল।
হেমাঙ্গিনী যাবার সময় কন্যাকে সতর্ক করিয়া দিলেন, উমা, তুই একটু যত্নটত্ন কর্ ভাল করে।
উমা মাথা হেঁট করিয়া নীরব হইয়া রহিল। হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, আমাদের কালের ঘোমটা দেওয়া কলাবৌ তো নস্। বেশ করে রাশ একটু বাগিয়ে ধরবি, তবে তো।
হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলে উমা মৃদু হাসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল, অহীন্দ্র বলিল, সুস্বাগত বাঙালিনী!
গুড আফ্টারনুন সায়েব। চমৎকার শরীরের অবস্থা কিন্তু সায়েবের!
বাঙালিনীর অভাবে সায়েবের এই অবস্থা। এখন তো কাছে পেয়েছ, এইবার বেশ গ্র্যামফেড মাটন করে তোল।
উমা হাসিয়া বলিল, উহু মাটন না, ওয়েল-ফেড হর্স। মা বলে গেলেন রাশ টেনে ধরতে। হাড়পাঁজরা ঝুরঝুরে আকাশে-ওড়া পক্ষিরাজকে মাটিতে নামতে হবে।
এবং নাদুসনুদুস হয়ে বাঙালিনীকে পিঠে নিয়ে থুপথুপ করে চলতে হবে।
ঘর পরিস্কার করিয়া বিছানা করিবার জন্য দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল মানদা। উমা একটু সারিয়া দাঁড়াইল। মানদা অহীন্দ্রকে দেখিয়া গালে হাত দিয়া বলিল, কি চেহারা হয়েছে দাদাবাবু!
সুনীতি কিছু বলিলেন না, কেবল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। কয়েক দিন পরেই উমাও যেন কেমন শুষ্ক বিশীর্ণ হইয়া উঠিল। সেও সুনীতি দেখিলেন।
অবশেষে একদিন রাত্রির অন্ধকারে মা আসিয়া ছেলের সম্মুখে দাঁড়াইলেন। কোজাগরী পূর্ণিমা পার হইয়া গিয়াছে, সম্মুখে অমাবস্যা আগাইয়া-আসিতেছে, সেই অন্ধকারের মধ্যে ছাদে অহীন্দ্র একা বসিয়া ছিল। এমনই করিয়া সে এখন একা অন্ধকারে বসিয়া থাকে। কাছারিপ্রাঙ্গনের নারিকেল-বৃক্ষশীর্ষগুলি ছাদের আলিসার অল্প দূরে শূণ্যলোকে জটাজূটময় অশরীরীবৃন্দের মত স্তব্ধ হইয়া-যেন সভা করিয়া বসিয়া আছে; ঝাউগাছ দুইটার শীর্ণ দীর্ঘতনুময় শীর্ষদেশ হইতে ছেদহীন কাতর দীর্ঘশ্বাস ঝরিয়া পড়িতেছে। তাহারই মধ্যে সুণিতি নিঃশব্দে অহীন্দ্রের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। অহীন্দ্র জানিতে পারিল না।
সুনীতি ডাকিলেন, অহীন!
চমকিত অহীন্দ্র মুখ ফিরাইয়া বলিল, মা?
হ্যাঁ, আমি।
এস মা, বস। কিছু বলছ?
বলব। অন্ধকারে অহীন্দ্র মায়ের মুখ দেখিতে পাইল না, কিন্তু কণ্ঠস্বরের সুরে সে বেশ অনুভব করিল যে, তাঁহার মুখে সেই বিচিত্র করুণ হাসি ফুটিয়া উঠিয়াছে, যে হাসি তাহার মা ছাড়া বোধহয় এ পৃথিবীতে কেহ হাসিতে পারে না।
সুনীতি ছেলের পাশে বসিলেন, তাহার মাথাটি আপনার কোলের উপর টানিয়া লইয়া রুক্ষ চুলগুলি সযত্নে বিন্যস্ত করিয়া দিয়া বলিলেন, তোর কি হয়েছে বাবা?
কিছুই তো হয় নি। অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বরে কপটতার লেশ ছিল না।
তবে?
কি মা?
তুই আমাদের কাছ থেকে এমন দূরে চলে যাচ্ছিস কেন বাবা?
দূরে চলে যাচ্ছি!-সবিস্ময়ে অহীন্দ্র প্রশ্ন করিল।
হ্যাঁ। মা বলিলেন, হ্যাঁ, দূরে চলে যাচ্ছিস, আমরা যেন তোর নাগাল পাচ্ছি নে।
অহীন্দ্র স্তব্ধ হইয়া রহিল। মা আবার বলিলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম, তুই বুঝি আমার কাছ থেকেই সরে গেছিস। বৌমা-। কণ্ঠস্বরে তাঁহার লজ্জার রেশ ফুটিয়া উঠিল, বলিলেন, বিয়ের পর বৌয়ের ওপর ছেলের একটা টান হয়, তখন মায়ের কাছ থেকে ছেলে একটু সরে যায়। আমি ভেবেছিলাম তাই। কিন্তু বৌমার মুখ দেখে বুঝলাম, তাও তো নয়। মাঝে মাঝে তার হাসিমুখ দেখি, কিন্তু আবার দেখি তার মুখ শুকনো। আমি বেশ লক্ষ্য করে দেখেছি অহীন, শুকনো মুখই তার বেশির ভাগ সময় চোখে পড়ে।
অহীন যেমন স্তব্ধ হইয়া ছিল, তেমনি স্তব্ধ হইয়া রহিল। কিছুক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া মা বলিলেন, উমা তো অপছন্দের মেয়ে নয় অহীন।
না মা, না। উমাকে নিয়ে আমি অসুখী নই তো। অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বরে আন্তরিক শ্রদ্ধার আভাস ফুটিয়া উঠিল।
তবে? মা প্রশ্ন করিলেন, তবে?
তবে? কি উত্তর আমি দেব মা? কথা শেষ করিয়া মুহূর্ত পরে সে সচকিত হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি কাঁদছ মা? তাহার কপালের উপর অশ্রুবিন্দুর উষ্ণ স্পর্শে সে চমকিয়া উঠিল।
মা বলিলেন, নিরুচ্ছ্বসিত অথচ উদাস কণ্ঠস্বরে, জানি নে তুই আমার কাছে লুকোচ্ছিস কি না, কিন্তু সমস্ত চেহারার মধ্যে এক নতুন মানুষ ফুটে উঠছে অহীন। তুই কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এর মধ্যে নিজেকে ভাল করে দেখিস নি? আমার সর্বশরীর শিউরে ওঠে মধ্যে মধ্যে তোর চোখের দৃষ্টি দেখে।
অহীন্দ্র বলিল, আমি আজকাল একটু বেশী চিন্তা করি। সে -কথা সত্যি। কিন্তু আমার দৃষ্টির কথা কিংবা আমি নাগালের বাইরে, এ-সব তোমার কল্পনা মা।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মা বলিলেন, কি জানি! কিন্তু আমার মন কেন এমন হয়ে উঠেছে অহীন? যেন আমার কত দুঃখ কত শোক! দুঃখ আমার অনেক, কিন্তু যাদের জন্য দুঃখ, তাদের মুখ তো মনে পড়ে না আমার। তোর মুখই কেন চোখের ওপরে ভেসে ওঠে?
জীবনে তুমি আঘাত পেয়েছ মা, সে আঘাতের বেদনা এখনও তুমি সহ্য করে উঠতে পার নি, ও-সব চিন্তা তারই ফল। তুমি কেঁদো না, তোমার কান্না আমি সইতে পারি নে।
কিন্তু তুই এত কি ভাবিস, আমায় বল্ দেখি?
ভাবি? অহীন্দ্র হাসিল, বলিল, তুমি যা ভাবতে শিখিয়েছ, তাই ভাবি। আর কি ভাবব? ভাবি, মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা। মানুষ মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার করে, সেই কথা ভাবি।
সুনীতি নীরব হইয়া বসিয়া রহিলেন। দুঃখ তাহার গেল না কিন্তু শোকের মধ্যে সান্তনার স্নেহস্পর্শের মত সন্তানগর্বের একটি নিরুচ্ছ্বসিত আনন্দ তাঁহার মনে জাগিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পর বলিলেন, আশীর্বাদ করি, তুই মানুষের দুঃখ দূর কর্।
আবার তাঁহার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল; কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছিয়া তিনি বলিলেন, সেই সঙ্গে মনে রাখিস বাবা, আমরা- আমি, উমা-
মা! মা রয়েছেন নাকি? আচ্ছা মানুষ বাপু আপনি। সুনীতির কথায় বাধা দিয়া মানদা ঝি ঝঙ্কার দিতে দিতে ছাদের দরজার মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কথার সুর ও ভঙ্গির মধ্যে বক্তব্যের স্বরূপের একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে, মানদার কথায় সুনীতি ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, কি রে মানদা?
বাবা! এই অন্ধকারে মায়ে-পোয়ে ছাদে বসে রয়েছেন, তা কি করে জানব বলুন? সারা বাড়ি খুঁজে হয়রান। দাদাবাবুর শ্বশুর এসেছেন, শাশুড়ী এসেছেন, খুঁজছেন আপনাকে। দাদাবাবুর সম্বন্ধী এসেছেন।
ব্যস্ত হইয়া সুনীতি বলিলেন, নীচে আয় অহীন;-বলিয়া তিনি অগ্রসর হইলেন, অহীন্দ্রও তাঁহার অনুসরণ করিল। কোথাও কিছু পড়িয়া আছে কিনা দেখিতে দেখিতে মানদা আপন মনেই বলিল, কথায় বলে ‘কাতির শিশিরে হাতি পড়ে’। কার্তিক মাসে শিশির মাথায় করে এই অন্ধকারে -আচ্ছা মানুষ বাবা।
* * *
রায় আসিয়াছিলেন বৈষয়িক প্রয়োজনে, মামলা পরিচালনা সম্পর্কে একটি বিশেষ পরামর্শ করিবার প্রয়োজন হইয়াছে। রামেশ্বরের ঘরে তিনি বসিয়া আছেন। ঘরের মধ্যে মৃদু প্রদীপের আলো তেমনি জ্বলিতেছে, রামেশ্বর খাটের উপর বসিয়া রহিয়াছেন। রায়ের অদূরে রামেশ্বরের খাটের সম্মুখে অতি নিকটেই বসিয়া আছেন হেমাঙ্গিনী; উমা ঘরের কোনে টেবিলের উপর বই গুছাইয়া রাখিতেছে। শ্বশুর ও পুত্রবধূতে মিলিয়া কাব্যলোচনা হইতেছিল। উমার কল্যাণে রামেশ্বর অল্প একটু সুস্থ হইয়া উঠিয়াছেন।
সুনীতি যখন ঘরে প্রবেশ করিলেন, তখন সদ্য কোন হাস্যপরিহাস শেষ হইয়াছে, সকলের মুখেই হাসির রেখা ফুটিয়া রহিয়াছে। হেমাঙ্গিনী অপ্রতিভ মুখে হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, কথায় আপনার সঙ্গে কেউ পারবে না। আমি হার মানছি।
রামেশ্বর হাসিয়া বলিলেন, তা হলে আপনার কাছে আমার মিষ্টান্ন প্রাপ্য হল।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, মিষ্টান্ন আমাকেই আপনার খাওয়ানো উচিত, কারন আপনি জিতেছেন।
রামেশ্বর হাসিয়া একটি কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আপানার কথায় বড়ই দুঃখ পেলাম দেবী। রায় হল রাজশব্দের অপভ্রংশ; রায়-গিন্নী আপনি, আপনি হলেন রাণী। মিষ্টান্ন বস্তুটা চিরদিন রাণী এবং রাজকূল কথায় পরাজিত হয়ে বয়স্যগণকে করস্বরূপ প্রদান করে এসেছেন। আজ সেই বস্তুর দিকে যদি আপনার হস্ত প্রসারিত হয়, তবে সে হস্তকে রাজহস্তে সমর্পণ করা ছাড়া তো গত্যন্তর দেখি না।
হেমাঙ্গিনী ঘরের মধ্যে উমার অস্তিত্ব স্মরণ করিয়া লজ্জিত হইয়া পড়িলেন, তাহাকে সরাইয়া দিবার জন্যই বলিলেন, উমা, অমল বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দেখ্ তো মা।
উমা চলিয়া গেল, উহার নাম উচ্চারণে রামেশ্বরও সংযত হইয়া উঠিলেন।
রায় হাসিতেছিলেন, তিনিও অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া কাজের কথা পাড়িয়া বসিলেন, এমনি একটা সুযোগের প্রতীক্ষাই যেন তিনি করিতেছিলেন। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া গলা ঝাড়িয়া লইয়া তিনি বলিলেন, রামেশ্বর, তোমার সঙ্গে কয়েকটি জরুরী বিষয় আলোচনার জন্য এসেছি।
গম্ভীরভাবেই রামেশ্বর হাসিলেন, বলিলেন, চক্ষুষ্মান পথভ্রান্ত হলে নিরুপায়ে অন্ধের কাছেও পথ জিজ্ঞাসা করে। কি বলছ, বল? দিক বলতে না পারি, সম্মুখ পশ্চাৎ দক্ষিণ বাম-এগুলো বলতে পারব। পথের পারিপার্শ্বিক চিহ্নের কথা বলতে পারব না, তবে বন্ধুরতার বিষয় বলতে পারব।
রায় বলিলেন, মানমর্যাদা নিয়ে মকদ্দমা, অথচ টাকার অভাব হয়ে পড়ল রামেশ্বর! আমার হাত পর্যন্ত শুকনো হয়ে এল। এ ক্ষেত্রে-
রামেশ্বর বলিলেন, অধর্মকে বর্জন করে সাক্ষাৎ নারায়ণরূপী রামের শরণাপন্ন হয়েও বিভীষণ অমর হয়ে কলঙ্ক বহন করেছেন। মামলা শেষ পর্যন্ত লড়তেই হবে ইন্দ্র। টাকা না থাকে ঋণের ব্যবস্থা কর।
না। রায় গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না। ঋণ করতে গেলে শেষ পর্যন্ত ওই কলওয়ালার কবলস্থ হতে হবে। লোকটা ধরাট দিয়েও সে-খত কিনবে। সুদখোরের মত ধূর্ত এবং লোভী এ সংসারে আমি তো কাউকে দেখি না, তারা অর্থের লোভে সব করতে পারে; এ খত তো তারা বিক্রি করবেই!
রামেশ্বর স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রায় বলিলেন, মহলে যে-সব খাস জোত আছে, তারই কিছু বন্দোবস্ত করে দেওয়াই কি ভাল নয়?
রামেশ্বর কোন উত্তর দিলেন না। তিনি চিন্তা করিতেছিলেন, কিছুক্ষণ পরেই তাঁহার দুর্বল মস্তিষ্কে সব যেন গোলমাল হইয়া গেল। শূণ্য অর্থ হীন স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া তিনি বসিয়া রহিলেন।
রায় তাহাকে ডাকিলেন, রামেশ্বর!
রামেশ্বর নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ইন্দ্র!
তা হলে তাই করি, কি বল?
অনেকক্ষণ ধরিয়া কথাটা স্মরণ করিয়া সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হ্যাঁ, সেই ভাল। ঋণ-না ভাল নয়। শেষ পর্যন্ত বডি ওয়ারেণ্ট করে।
বাতাসেরও কান আছে। জমি বন্দোবস্তের কথা প্রকাশ করিয়া জানাইতে হইল না। অথচ সমস্ত গ্রামময় কথাটা রটিয়া গেল।
দুই-তিন দিন পরেই গ্রামের চাষীরা ছুটিয়া আসিয়া পড়িল, ‘জমি যখন বন্দোবস্তই করবেন, তখন চরের ওই ভাগে-বিলি-করা জমিটা আমাদের বন্দোবস্ত করিয়া দিন। এক-শ বিঘা জমির বিঘা-পিছু ত্রিশ টাকা হিসাবে সেলামী এবং দুই টাকা হারে খাজনা দিতে আমরা প্রস্তুত।’ দলটির সর্বাগ্রে ছিল রংলাল।
রায় ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, এত টাকা তোরা পাবি কোথায়?
রংলাল বলিল, আজ্ঞে,আমরা তিরিশ জনায় লোব। জনাহি এক-শ টাকা আমরা যোগাড় কোনরকমে করব।
গভীর ব্যগ্রতায় সে রায়ের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিল, হেই হুজুর। নইলে এ চরণ আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।
রায় বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, এত বেশী টাকা অন্য মহলে জমি বন্দোবস্ত করিয়া পাওয়া যাইবে না। তা ছাড়া চাষীরাও গোলাম হইয়া থাকিবে।
যোগেশ মজুমদার আসিয়া পাঁচ হাজার টাকা সেলামী দিতে চাহিল, কিন্তু রায় হাসিয়া বলিলেন, না!