কালিন্দী – ২৩

২৩

মাস ছয়েক পর।

শীত-জর্জর শেষ-হেমন্তের প্রভাতটি কুয়াশা ও ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। চরটার কিছুই দেখা যায় না। শেষরাত্রি হইতেই গাঢ় কুয়াশা নামিয়াছে। তাহার উপর লক্ষ লক্ষ ইট পুড়িতেছে, সেই সব ভাঁটায় ধোঁয়া ঘন বায়ুস্তরের চাপে অবনমিত হইয়া সাদা কুয়াশার মধ্যে কালো কুণ্ডলী পাকাইয়া নিথর হইয়া ভাসিতেছে। বিপুলবিস্তার দুধে-খোয়া পাতলা একখানি চাদরের উপরে কে যেন খানিকটা কালি ফেলিয়া দিয়াছে। হিমশীতল কুয়াশার কণাগুলি মানুষের মুখে চোখের পাতায়, চুলের উপর আসিয়া লাগিতেছে, তাহার অঙ্গে অতি সূক্ষ্ম বালির মত কয়লার কুচি। কয়লার ধোঁয়ার গন্ধে ভিজা বাতাস আরও যেন ভারী বোধ হইতেছে।

ইহার মধ্যেই বিমলবাবু, কলিকাতার কলওয়ালা মহাজন, চরের উপর একটি বাংলো তৈয়ারি করিয়া বাসা গাড়িয়া বসিয়াছেন। কল তৈয়ারি আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। কাজ খুব দ্রুতবেগে চলিতেছে। এখানকার লোকে কাজের গতি দেখিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া পড়িয়াছে। এমন দ্রুতগতিতে যে কাজ হইতে পারে-এ ধারনাই তাহারা করিতে পারে না; এ যেন বিশ্বকর্মার কাণ্ড, এক রাত্রে প্রান্তরের উপর প্রকাণ্ড নগর গড়িয়া উঠার মত ব্যাপার।

বিমলবাবু বাংলোর বারান্দায় একখানা ইজি-চেয়ারের উপর বসিয়া চা পান করিতেছিলেন এবং কুয়াশার দিকে চাহিয়া ছিলেন। কুয়াশার মধ্যে কোথা হইতে বাস্পের জোরে বাজানো বয়লারের বাঁশী ভোঁ-ভোঁ শব্দে বাজিয়া উঠিল। একটি ভার্টিকাল বয়লারও ইহার মধ্যেই বসানো হইয়াছে; বয়লারের জোরে নদীর গর্ভে একাটা পাম্প চলিতেছে। সেই পাম্পে ইঁট তৈয়ারির কাজে প্রয়োজনমত জল সরবরাহ হইতেছে। জলের পাইপ বিমলবাবুর বাংলোয় চলিয়া আসিয়াছে এবং প্রয়োজনমত এখানে কলের মুখ লাগাইয়া যখন যেখানে ইচ্ছা জল লইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। বাংলোর সম্মুখেই একটা পাকা ইঁদারাও হইয়া গিয়াছে। ইঁদারাটার চারিপাশে বাগানের নানা রকমের মরসুমী ফুল ও তরিতরকারির গাছ। বারান্দার ধারেই একটা জলের কলের মুখ, সেখানে একটি প্রশস্ত সান-বাঁধানো চাতাল ও একটি চৌবাচ্চা। সেই চাতালে বসিয়া সারী, সাঁওতালদের সেই দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি, বাসন মাজিতেছে। বিমলবাবুর বাসায় সারী এখন ঝিয়ের কাজ করে। কুয়াশা এত ঘন যে, বিমলবাবু সারীকেও স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছেন না। সাদা কাপড় পরিহিত সারীকে দেখিয়া মনে হয়, কুয়াশার একটা পুঞ্জ মেঘ ওখানে জমিয়া আছে। এই কুয়াশার মধ্যে কোথাও শূণ্যমার্গে অবিরাম কর্ণিকের ও ইঁটের ঠুং ঠুং শব্দ উঠিতেছে। আর উঠিতেছে লোহার উপর লোহার প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ, চারিদিকের মুক্ত প্রান্তর বাহিয়া শব্দটা শনশন শব্দে ছুটিয়া চলিয়া দিগন্তে বিপুল শব্দে প্রতিধ্বনিত হইয়া আবার ফিরিয়া আসিতেছে।

বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটিতেছিল। কয়লার ধোঁয়া মাটির বুক হইতে শূন্যমণ্ডলে উপরে উঠিতে আরম্ভ করিল। বিমলবাবু সারীর দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিলেন, সারীর মাথায় মরসুমী ফুলের সারি, ইহারই মধ্যে সে কখন ফুল তুলিয়া চুলে পরিয়াছে। বিমলবাবু রাগের ছলনা করিয়া বলিলেন, আবার তুই ফুল তুলেছিস!

সারী শঙ্কিত মুখে বিমলবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সারীর মত উচ্ছ্বল চঞ্চল বর্বররাও বিমলবাবুকে ভয় করে, অজগরের মুখের অদূরবর্তী জীবের মত যেন অসাড় হইয়া যায়। এই চর ব্যাপিয়া বিপুল এবং অতিকায় কর্মসামাবেশের সমগ্রটাই যেন বিমলবাবুর কায়ার মত, মানুষের দেহ লইয়া তিনি যেন তাহার জীবাত্মা। তাঁহার সম্পদ, কর্মদক্ষতা, গাম্ভীর্য, তৎপরতা সব লইয়া বিমলবাবুর একটা ভয়াল রূপ তাহারা মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করে এবং ভয়ে স্তব্ধ হইয়া যায়।

সারীর ভয় দেখিয়া বিমলবাবু একটু হাসিলেন, তারপর পাশের টিপয়ের উপর ফুলদানি হইতে এক গোছা মরসুমী ফুল লইয়া সারীকে ছুঁড়িয়া মারিলেন, বলিলেন, এই নে।

সারী ফুলের গোছাটি কুড়াইয়া লইয়া শঙ্কার সহিত একটু হাসিল, তারপর বলিল, সেই কাপড়টা তুমি কিনে দিবি না?

দেব, দেব।

কোবে দিবি গো?

আচ্ছা, আজই দেব। তুই এখন ভেতরে গিয়ে সব পরিস্কার করে ফেল্‌, ওই সরকারবাবু আসছে।

কুয়শা এখন প্রায় কাটিয়া আসিয়াছে; বাংলোর মুখ হইতে সোজা একটা পাকা প্রশস্ত রাস্তা কারখানার দিকে সোজা চলিয়া গিয়াছে, সেই রাস্তা ধরিয়া আসিতেছিল শূলপাণি রায়, রায়-বংশের সেই গঞ্জিকাসেবী উগ্রমেজাজী লোকটি। শূলপাণির সঙ্গে জনকয়েক চাপরাসী। শূলপাণি আস্ফালন করিতেছিল প্রচুর। শূলপাণিই বিমলবাবুর সরকার। তাহার উগ্র মেজাজ ও বিক্রম দেখিয়া তিনি তাহাকে ‘লেবার-সুপারভাইজার’- বাংলা মতে কুলী-সরকার নিযুক্ত করিয়াছেন। শূলপাণি কুলিদের হাজরি রাখে, তাহাদের খাটায়, শাসন করে; মাসিক বেতন বারো টাকা।

শুধু শূলপাণিই নয়, রায়হাটের অনেকেই এখানে চাকরি পাইয়াছেন। ইন্দ্র রায় বিমলবাবুর কৌশল দেখিয়া হাসিয়াছিলেন, মুগ্ধ হইয়া হাসিয়াছিলেন। মামলা-মকর্দমার সমস্ত সম্ভাবনা চাকরির খাঁচায় বন্ধ করিয়া ফেলিলেন, এই বিচক্ষণ ব্যবসায়ীটি। মজুমদার এখন বিমলবাবুর ম্যানেজার, অচিন্ত্যবাবু অ্যাকাউন্ট্যান্ট, হরিশ রায় গোমস্তা। আরও কয়েকজন রায়-বংশীয় এখানে কাজ পাইয়াছে। ইন্দ্র রায়ের নায়েব মিত্তিরের ছেলেও এখানে কাজ করিতেছিল, ইন্দ্র রায় নিজেই তাহার জন্য অনুরোধ জানাইয়াছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি বিমলবাবু দুঃখের সহিত তাহাকে নোটিশ দিয়াছেন, কাজ তাহার সন্তোষজনক হইতেছে না।

শূলপাণি চিৎকার করিতে করিতেই আসিতেছিল, হারামজাদা বেটারা সব শূয়ারকি বাচ্ছা-

বিমলবাবুর কপালে বিরক্তির রেখা ফুটিয়া উঠিল, বলিলেন, আস্তে। তারা তো এখানে কেউ নাই।

শূলপাণি অর্ধদমিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে না। ওই বেটা সাঁওতালরা-

হ্যাঁ, বেটারা হারামজাদাই বটে। কিন্তু হয়েছে কি! ব্যাপারটা কি, আস্তে আস্তে বল!

শূলপাণি এবার সম্পূর্ণ দমিয়া গিয়া অনুযোগের স্বরে বলিল, আজ্ঞে, আজ কেউ আসে নাই।

আসে নি?

আজ্ঞে না।

হুঁ। বিমলবাবুর ভ্রুযুগল ও কপাল আবার কুঞ্চিত হইয়া উঠিল।

শূলপাণি উৎসাহিত হইয়া বলিয়া উঠিল, হুকুম দেন, গলায় গামছা দিয়ে ধরে আনুক সব।

বিমলবাবু ব্যাঙ্গের হাসি হাসিয়া বলিলেন, রায় সাহেব, এটা তোমার পৈতৃক জমিদারী নয়, এটা হল ব্যবসা। এতে গলায় গামছা চলবে না। না এসেছে, নেই। কাজ আজ বন্ধ থাক। বিকেলবেলা সবাইকে ডাকবে এখানে-আমার কাছে। একবার শ্রীবাস দোকানীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে, জরুরী দরকার। আর হ্যাঁ, কাল রাত্রে লোহাগুলি সব এসে পৌঁছেছে?

আজ্ঞে না। এখনও দু বার লরি যাবে, তবে শেষ হবে। লরি তো জোরে যেতে পারছে না। ইস্টিশানের রাস্তায় ধূলো হয়েছে একহাঁটু আর মাঝে মাঝে এমন গর্ত-

মেরামত করাও নিজেদের লোক দিয়ে, জলদি মেরামত করিয়ে নাও। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মুখ চেয়ে থাকলে চলবে না। তাদের সেই বছরে একবার মেরামত, তাও হরির লুঠের মত মাটি কাঁকর ছিটিয়ে দিয়ে। লরি যখন স্টেশনে যাবে, তখন ইঁটের কুচি বোঝাই দিয়ে দাও। যেখানে যেখানে গচকা পড়েছে ঢেলে দিক সেখানে। তারপর কয়েক লরি কাঁকর দিয়ে মেরামত করাই। বুঝলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আচ্ছা যাও তুমি এখন।

শূলপাণি একটি নমস্কার করিয়া শান্তশিষ্ট ব্যক্তির মতই চলিয়া গেল। তাহার মত গঞ্জিকাসেবীর আজন্ম-অভ্যস্ত উগ্র মেজাজের কড়া তারও কেমন করিয়া বিমলবাবুর সম্মুখে শিথিল মৃদু হইয়া যায়। আসে সে আস্ফালন করিতে করিতে, কিন্তু যায় যেন দম-দেওয়া যান্ত্রিক পুতুল-মানুষের মত।

বিমলবাবু ডাকিলেন, সারী!

সারী আসিয়া নীরবে চকিত দৃষ্টি তুলিয়া দাঁড়াইল। পরিপূর্ণ আলোকে দেখা যায়, সারীর নিটোল স্বাস্থ্যভরা দীর্ঘ দেহখানি আর সে তৈলাক্ত অতি মসৃনতায় প্রসাধিত নয়, রুক্ষ প্রসাধনের একটি ধূসর দীপ্তি সর্বাঙ্গে সুপরিস্ফুট। পরনে তাহার সাঁওতালী মোটা শাড়ি নাই, একখানা ফুলপাড় মিলের শাড়ি সে পরিয়া আছে। বর্ষার আদিম জাতির দেহে অপরিচ্ছন্নতার একটা অরণ্য কটু গন্ধ থাকে, কিন্তু সারী আসিয়া নিকটে দাঁড়াইলে সে গন্ধ আর পাওয়া গেল না।

বিমলবাবু বলিলেন, আবার সব তোদের পাড়ার লোক গোলমাল করছে নাকি?

সারী শঙ্কিত হইয়া উঠিল, বলিল, আমি সি জানি না গো। উয়ারা তো বললে না আমাকে।

তবে সব খাটতে এল না যে?

সারীর মুখে এবার সঙ্কুচিত একটি হাসি ফুটিয়া উঠিল, আশ্বস্ত কণ্ঠে সে বলিল, কাল আমাদের জমিদারবাবু, উই যে রাঙাবাবু, উয়ার শ্বশুর হবে যি ওই রায়বাবু, সিপাই পাঠালে যি। বুললে, জমিগুলা চষতে হবে, কলাই বুনবে, সরষা বুনবে, আলু লাগাবে, আর ধানগুলা কাটতে হবে।

বিমলবাবুর ভ্রু কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, আপন মনেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, ড্রোন্‌স অব্‌ কানট্রি! ইডিয়টস! দিজ জমিণ্ডার্‌স।

সারী শঙ্কিত হইয়া উঠিল, তাহার কালো মুখে সাদা চোখ দুইটিতে শঙ্কার ছায়া ঘনাইয়া আসিল, রাত্রির আকাশের চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়ার মত। বিমলবাবু কি বলিলেন, সে যে তাহা বুঝিতে পারিতেছে না! তবু ভাল যে সম্মুখে এখন ‘হাড়িয়া’র বোতলটা নাই।

বিমলবাবু বলিলেন, সকলে তো চাষ করে না, তারা এল না কেন?

উয়াদিকে ধান কাটতে লাগালে। সারীর কণ্ঠস্বর ভীত শিশুর মত।

ধানা কাটতে লাগালে? পয়সা দেবে, না, দেবে না?

না, বেগার লিলে। উয়ারা যে জমিদার বটে, রাজা বটে।

হু। বিমলবাবু গম্ভীর হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর উঠিয়া মোটা চেস্টার্‌ফিল্ড কোটটা গায়ে দিয়া বলিলেন, ছড়িটা নিয়ে আয়।

সারী তাড়াতাড়ি ছড়িটা আনিয়া বিমলবাবুর হাতে দিল, বিমলবাবু এবার প্রসন্ন হাসি হাসিয়া সারীর কপালে আঙুলের একটা টোকা দিয়া ক্ষিপ্রপদে রাস্তার উপর নামিয়া পড়িলেন।

কুয়াশা কাটিয়া এখন রৌদ্র ফুটিয়া উঠিয়াছে। চরখানাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। সর্বাগ্রে চোখে পড়িল আকাশলোকের দিকে উদ্ধত ভঙ্গিমায় উদ্যত একটা অর্ধসমাপ্ত ইঁটের গড়া চিমনি। সেইখানে কর্নিকের ঠুংঠাং শব্দ উঠিতেছে। ও-দিকে আরও একখানা সুসমাপ্ত বাংলো। ওটা আপিস-ঘর। পাশে একটা লোহার ফ্রেমে -গড়া আচ্ছাদনহীন শেড।

এতক্ষণে সারীর মুখখানি ঈষৎ দীপ্ত হইয়া উঠিল; বিমলবাবু খানিকটা অগ্রসর হইয়া গেলে সে স্বচ্ছন্দে সহজ হইয়া গ্রীষ্ম-সন্ধ্যার জলসিক্ত অঙ্কুরের মত জাগিয়া উঠিল। কাজ করিতে করিতে সে এবার গুন গুন করিয়া গান আরম্ভ করিল, নিজেদের ভাষায় গান-

“ উঃ বাবা গো, এই জঙ্গলের ভিতর কি আঁধার আর কত গাছ। এখানে সাপও চলিতে পারে না। এই জঙ্গলের পরেই নাকি ‘রামচারের’, সে সূর্যঠাকুরের শোবার ঘর পর্যন্ত লম্বা ডাঙা, সেখানে বসতি নাই, পাখী নাই। তুমি আমাকে এখানে ফেলিয়া যাইও না, ওগো ভালবাসার লোক!”

সারী এখন বিমলবাবুর বাংলোয় কাজ করে, এখানেই সে বাসও করিতেছে। কয়টা মাসের মধ্যে ঘটিয়া গিয়াছে অনেক।

বিমলবাবু এখানে আসার কিছু দিনের মধ্যেই সারী অনুভব করিল, অজগরের সম্মুখস্থ শিকারের সর্বাঙ্গ যেমন অবশ হইয়া যায়, সেও যেন তেমনি অবশ হইয়া পড়িতেছে। চীৎকার করিয়া আপন জনকে ডাকিয়া সাহায্য চাহিবার শক্তি পর্যন্ত তাহার হইল না, সম্পদ গাম্ভীর্য কর্মক্ষমতা, প্রভুত্ববিস্তারের শক্তি, তৎপরতা প্রভৃতিতে বিচিত্র সুদীর্ঘকায় অজগরের মতই ভয়াল দৃষ্টির সম্মুখে কাহারও প্রতিবাদ করিবার সাহসও হইল না। আরও একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটিয়া গেল, সাঁওতাল-পল্লীর সকলেই এক দিক হইয়া সর্দার কমল মাঝি ও সারীর স্বামীকে একঘরে করিল; অথচ তাহারাই রহিল বিমলবাবুর একান্ত অনুগত। কিছুদিনের মধ্যেই সারীই নিজে পঞ্চজনের কাছে ‘সামকচারী’র অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদের প্রার্থনা করিল। সামাজিক আইনমত তাহারই জরিমানা দিবার নিয়ম; চাহিবার পূর্বেই সে একশত টাকা ‘পঞ্চে’র সম্মুখে নামাইয়া দিল।

কয়েক দিনের মধ্যেই একদিন সকালে দেখা গেল, বুড়া কমল মাঝি, তাহার বৃদ্ধা স্ত্রী এবং সারীর স্বামী রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে।

সাঁওতাল পাড়ার সর্দার এখন চূড়া মাঝি, সেই কাঠের পুতুলের ওস্তাদ। সর্দার মাঝির জমি শ্রীবাস পাল দখল করিয়া লইল, তাহার নাকি বন্ধকী দলিল আছে।

সারী এখন বিমলবাবুর বাংলোয় কাজ করে, বাংলোর সীমানার মধ্যেই আউট-হাউসে থাকে। তাহার বেশভূষার প্রাচুর্য দেখিয়া সারীর সখীরা বিস্মিত হইয়া যায়।

এক একদিন দেখা যায় গভীর রাত্রে সারী ভয়ত্রস্তা হরিণীর মত ছুটিয়া পালাইতেছে, তাহার পিছনে ছুটিয়াছেন বিমলবাবু, হাতে একটা হান্টার।

গান গাহিতে গাহিতে সারী কাজ করিতেছিল; ঘরের দেওয়ালের গায়ে টাঙানো প্রকাণ্ড আয়নার কাছে আসিয়া সে কাজ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইল, চুলটা একবার ঠিক করিয়া লইল, একবার হাসিল, তারপর দেহখানি দোলাইয়া হিল্লোল তুলিয়া সে নাচিতে আরম্ভ করিল। “জঙ্গলের ভিতর আঁধার, আর কি ঘন গাছ! …আমাকে ফেলিয়া যাইও না, ওগো ভালবাসার লোক!”

* * *

বাংলোর সম্মুখ দিয়া পথটা সোজা চলিয়া গিয়াছে। সুগঠিত পথ, ইঁটের কুচি ও লাল কাঁকর দিয়া গড়িয়া তোলা হইয়াছে। সরল রেখার মত সোজা, তেমনি প্রশস্থ, অন্তত তিনখানা গাড়ি পাশাপাশি চলিতে পারে। কুয়াশায় অল্প ভিজিয়া রাঙা পথখানির রক্তাভা আরও গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে।

বাংলো হইতে খানিকটা আসিয়াই পথের দুই পাশে আরম্ভ হইল সারি সারি খড়ের তৈয়ারী কুঁড়েঘর। অনেক বিদেশী কুলী আনিতে হইয়াছে। বাক্স-ফর্মায় ইঁট পাড়া, ইঁটের ভাটি দেওয়া, কলের লোহা-লক্কড়ের কাজ এদেশের অনভিজ্ঞ অপটু মজুর দিয়া হয় না। ওই কুলীদেরই সাময়িক আশ্রয় হিসাবে ঘরগুলি তৈয়ারী হইয়াছে। ও পাশে ইহার মধ্যেই কুলীদের স্থায়ী বসস্থান প্রায় তৈয়ারী হইয়া আসিল, পাকা ইঁটের লম্বা একটা ব্যারাক, ছোট ছোট খুপরি-ঘর, সামনে এক টুকরা বারান্দা।

কুলীদের কুটিরগুলি এখন জনবিরল, বয়লারের ভোঁ বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই প্রায় কাজে চলিয়া গিয়াছে, থাকিবার মধ্যে কয়েকটি প্রায়-অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর উলঙ্গ অর্ধ-উলঙ্গ ছেলের পাল। বৃদ্ধ মাত্র কয়েকজন, তাহারা উবু হইয়া ঘোলাটে চোখে অলস অর্থহীন স্তিমিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া আছে। বৃদ্ধা কয়েকজন জটলা পাকাইয়া রৌদ্রের আশায় বসিয়া পরস্পরের অপরিচ্ছন্ন মাথা থেকে উকুন বাছিয়া নখের উপর রাখিয়া নখ দিয়া টিপিয়া মারিতেছে, আর মুখে করিতেছে ‘হুঁ’। ওই ‘হুঁ’ না করিলে নাকি উকুনের স্বর্গবাস হয় না। মধ্যে মধ্যে দুর্দান্ত চীৎকার করিয়া ছেলের দলকে গাল দিয়া ধমকাইতেছে-

আরে বদমাশে হারামজাদে, তেরি কুচ না করে হাম-

ই, হারামজাদী বুঢ্‌ঢী, তেরি দাত তোড় দেঙ্গে হাম।- বলিয়া ছেলের দল দাঁত বাহির করিয়া ভেংচাইয়া দিতেছে। একটা বুড়ী একটি ক্রন্দমানা শিশুকন্যাকে আদর করিতেছে-

“এ আমার বেটী রানী, সাতপরানী, বেটা লাঙার, পুতা কানি,-বেটী আমার ভাগ্‌মানী! এ-এ-এ।” অর্থাৎ ও আমার রাণী মেয়ে, সংসারে তাহার সাতটি প্রাণী, তাহার মধ্যে পুত্রটি খোঁড়া, পৌত্রটি কানা; আহা আমার বেটি বড় ভাগ্যবতী।

বিমলবাবু তাহার আদরের ছড়া শুনিয়া হাসিলেন। বৃদ্ধা মেয়েটিকে বলিল, আরে আরে চুপ হো যাও বিটিয়া, মালেক যাতা হ্যায়, মালেক। আরে বাপ রে।

বয়স্ক ছেলেগুলি বিমলবাবুকে দেখিয়া শান্ত হইয়া দাঁড়াইল, ছোটগুলি হাত তুলিয়া সেলাম করিয়া বলিল, সেলাম মালেক।

বিমলবাবু ছোট্ট একটি টুকরা হাসি হাসিয়া কেবল ঘাড় নাড়িলেন। কয়টা অল্পবয়স্ক শিশু পরম আনন্দভরে এ উহার মাথায় পায়ের ধূলা ঢালিয়াই চলিয়াছে। একটা অপেক্ষাকৃত বয়স্ক শিশু বিচিত্র খেয়ালে পথের ধূলার উপর শুইয়া ধপাধপ করিয়া ধূলোর উপর পিঠ আছড়াইয়া ধূলার রাশি উড়াইয়া আপন মনে হাসিতেছিল। ধূলার জন্য বিরক্ত হইয়া হাতের ছড়িটা দিয়া বিমলবাবু তাহাকে একটা খোঁচা দিয়া বলিলেন, এই!

ছেলেটা তড়াক্‌ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল সেলাম করিয়া বলিল, সেলাম মালেক।

হাসিয়া বিমলবাবু অগ্রসর হইয়া গেলেন। বিমলবাবু পিছন ফিরিতেই ছেলেটা জিভ কাটিয়া দাঁত বাহির করিয়া কদর্য ভঙ্গিতে তাঁহাকে ভেংচাইয়া উঠিল, তারপর আবার লাফ দিয়া পথের ধূলায় পড়িয়া ধূলার উপর পিঠ ঠুকিতে ঠুকিতে বলিল, আল্‌বৎ করেঙ্গে, ইঁ-ইঁ-ইঁ-। -বলিয়া আবার একবার ভেংচাইয়া উঠিল।

কুলী-বস্তি পার হইয়াই কারখানার পত্তন আরম্ভ হইয়াছে।

এ-দিকের চরটাকে আর চর বলিয়া চেনাই যায় না। সে বেনোঘাসের জঙ্গল আর নাই, চরের এ-দিকটা একেবারে খুঁড়িয়া ফেলিয়া আবার সমান করিয়া ফেলা হইয়াছে, লালচে পলিমাটি এখন তকতক করিতেছে, মধ্যে মধ্যে এখানে ওখানে দূর্বা ও মুথো ঘাসের পাতলা আস্তরণ টুকরা টুকরা সবুজ ছাপের মত ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাহারই মধ্যে বড় বড় চতুর্ভুজ ছকিয়া লাল কাঁকরের অনেকগুলি রাস্তা এদিক ওদিক চলিয়া গিয়াছে। বড় রাস্তাটা এখানে আসিয়া সুদীর্ঘ দেবদারু গাছের মত যেন চারিদিকে সোজা শাখা-প্রশাখা মেলিয়াছে।

এমনি একটা চতুস্কোণ ক্ষেত্রের উপর প্রকাণ্ড বড় টিনের শেডটা তৈয়ার হইতেছে। মোটা মোটা লোহার কড়ি ও বরগায় ছাঁদিয়া বাঁধিয়া কঙ্কালটা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। শেডের উপর কুলীরা কাজ করিতেছে। লোহার উপর প্রকাণ্ড হাতুড়ির ঘা দিতেছে সেই উপরে দাঁড়াইয়া অবলীলাক্রমে। লোহার উপর প্রকাণ্ড হাতুড়ির প্রচণ্ড শব্দ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়া দুই-তিন দিক হইতে প্রতিধ্বনিতে আবার ফিরিয়া আসিতেছে।

একটা লরি হইতে লোহার কড়ি-বরগা নামানো হইতেছিল। স্টেশন হইতে লোহালক্কড় এই লরিতেই আসিতেছে। লোহার একটা স্তুপ হইয়া উঠিয়াছে। যন্ত্রপাতিও অনেক আসিয়া গিয়াছে, নানা আকারের যন্ত্রাদি পৃথক পৃথক করিয়া রাখা হইতেছে। এক পাশে পড়িয়া আছে দুইটা বিপুলকায় ল্যাঙ্কাশায়ার বয়লার-নিদ্রিত কুম্ভকর্ণের মত। এই সব লোহালক্কড় ও যন্ত্রপাতিগুলিকে মুক্ত রোদ-বাতাসের হাত হইতে বাঁচাইবার জন্যই ওই টিনের শেডটা তৈয়ারি হইতেছে। একেবারে মধ্যস্থলে একটা বৃহৎ চতুস্কোন জমির উপর কলের বনিয়াদ খোঁড়া হইয়াছে। ঠিক তাহারই মধ্যস্থলে চিমনিটা উঠিতেছে। একেবারে ও-পাশে লাল ইটের লম্বা কুলী-ব্যারাক। ব্যারাকটার ছাদ পিটিতে পিটিতে এ দেশেরই কামিনেরা পিট্‌নে কোপার আঘাতে তাল রাখিয়া একসঙ্গে গান গাহিতেছে।

বিমলবাবু একের পর একটি করিয়া কাজের তদারক করিয়া ফিরিলেন। ফিরিবার পথে বাংলোয় না আসিয়া ও-দিকে শ্রীবাসের দোকানের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। শ্রীবাসের ছেলে গণেশকে আর সে-গণেশ বলিয়া চেনা যায় না। চৌকা ঘর-কাটা রঙিন লুঙ্গি পরিয়া, ঘাড় একেবারে কামাইয়া চৌদ্দআনা দুইআনা ফ্যাশনে চুল ছাঁটিয়া, গায়ে একটা পুল-ওভার চড়াইয়া গণেশ একেবারে ভোল পাল্টাইয়া ফেলিয়াছে। দোকানেরও আর সে চেহারা নাই। পাকা মেঝে, পাকা বারান্দা, দোকানে হরেক রকমের জিনিস। লোহার তারের বাণ্ডিল। পেরেক, গজাল, গরুর গাড়ির চাকার হালের জন্য লোহার পেটি, লোহার শলি, গরুর গলায় দড়ির পরিবর্তে লোহার শিকল, জানলায় দিবার জন্য লোহার শিক, মোট কথা লোহার কারবারই বেশি। অদূরে একটা গাছের তলায় একজন পশ্চিম-দেশীয় মুসলমান একটা গরুকে দড়ি বাঁধিয়া ফেলিয়া পায়ের নাল বাঁধিয়া ঠুকিতেছে। কয়েকজন গাড়োয়ান তাহাদের গরুগুলি লইয়া অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। রাস্তার ধারে এক একটা ইঁট পাতিয়া কয়েকজন পশ্চিম-দেশীয় নাপিত চুল ছাঁটিতে বসিয়াছে। গণেশ বেচিতেছিল লোহার তার, কিনিতেছে একটি সাঁওতাল মেয়ে। গণেশ বলিতেছে, আরে বাপু, আলনা করার জন্যে যে নিবি, তা ক হাত চাই সে–মাপ এনেছিস?

মেয়েটি বুঝিতে পারিতেছে না, বলিতেছে, মাপ কি বুলছিস গো?

কি বিপদ! ছোট হলে তখন করবি কি। এসে তখন আবার কাঁউমাউ করবি যে।

হুঁ। কি কাঁউমাউ করলম গো?

কি বিপদ! কাপড় টাঙাবার জন্য আলনা করবি তো?

হুঁ।

ঠিক এই সময়েই বিমলবাবু আসিয়া দাঁড়াইলেন। গণেশ ব্যস্ত হইয়া তার ফেলিয়া আসিয়া নমস্কার করিল, বলিল, হুজুর! তাড়াতাড়ি সে একখানা লোহার চেয়ার আনিয়া পাতিয়া দিল; বিমলবাবু বসিলেন না, চেয়ারখানার উপর একখানা পা তুলিয়া দিলেন, বলিলেন, শ্রীবাস কোথায়?

আজ্ঞে, বাবা এখনও আসেন নি। কাল ও-পারে বাড়ি-

হুঁ। তুমি শোন তা হলে। মাঝি বেটারা আবার গোলমাল করতে আরম্ভ করেছে। ভেতরের ব্যাপারটা একটু খোঁজ নাও দেখি। শুনছি, ইন্দ্র রায় নাকি সব বেগার ধরেছেন। আসল কথাটা আমাকে জানিয়ে আসবে।

বিমলবাবু ফিরলেন।

আপিসে বসিয়া বিমলবাবু ডাকিলেন, যোগেশবাবু!

যোগেশ মজুমদার আসিয়া দাঁড়াইল, বিমলবাবু বলিলেন, শ্রীবাসের হ্যাণ্ডনোটটা- আপনার দরুন যেটা, সেটার বোধ হয় তিন বছর পূর্ণ হয়ে এল, না?

যোগেশ মজুমদার ফৌজদারী মামলার সময় শ্রীবাসকে ঋণ দিয়াছিল, তাহার দরুণ হ্যাণ্ডনোটটা বিমলবাবু কিনিয়াছেন।

মজুমদার বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, এবার তামাদির সময় হয়ে এল। তা ছাড়া আপনার নিজেরও দুখানা হ্যণ্ডনোট-

সে থাক। এখন এইটের জন্যেই একটা উকিলের নোটিশ দিয়ে দিন।

বিমলবাবু নিজেও শ্রীবাসকে ঋণ দিয়েছেন দুইবার। মজুমদার বলিল, ওকে ডেকে-

বাধা দিয়া বিমলবাবু বলিলেন, না। ঠিক প্রণালীমত কাজ করে যান। এর পর যা কথা হবে, সে উকিলের মারফতেই হবে। উকিল আমাদের শর্তটা জানিয়ে দেবেন, চরের একশ বিঘে জমিটা ন্যায্য মূল্যেই আমি পেতে চাই।

মজুমদার বলিল, যে আজ্ঞে।

বিমলবাবু বলিলেন, আর এক কথা। একবার ইন্দ্র রায়ের কাছে আপনি যান। তাঁকে বলুন যে, আমার শরীর খারাপ বলেই আমি আসতে পারলাম না। কিন্তু তিনি যে জমিদার স্বরূপে সাঁওতালদের বেগার ধরেছেন, এতে আমার আপত্তি আছে। ওরা আমাদের দাদন খেয়ে রেখেছে। আমার দাদন-দেওয়া কুলী বেগার ধরলে আমার কাজের ক্ষতি হয়। বুঝলেন? সে আমি সহ্য করব না। আচ্ছা, তা হলে আপনি যান ওঁর কাছে।

মজুমদার চলিয়া গেল। বিমলবাবু কাগজ-কলম লইয়া বসিলেন। কিছুক্ষণ পরেই একজন চাপরাসী আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল, বলিল এসেছে।

মুখ না তুলিয়াই বিমলবাবু বলিলেন, নিয়ে আয়।

আসিয়া প্রবেশ করিল যে ব্যক্তি, সে এখানকার নূতন মদের দোকানের ভেণ্ডার। লোকটি ঘরে ঢুকিয়া একটি প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। বিমলবাবু চাপরাসীটাকে বলিলেন, যা তুই এখান থেকে।

চাপরাসীটা চলিয়া গেল। বিমলবাবু বলিলেন, দেখ আমার জন্যেই তোমার এ দোকান।

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বিনয় কৃতজ্ঞতার শতমুখ হইয়া বলিয়া উঠিল, দেখেন দেখি, দেখেন দেখি, হুজুরই আমার মা-বাপ-

হ্যাঁ। বাধা দিয়া বিমলবাবু বলিলেন, হ্যাঁ। একটি কাজ তোমাকে করতে হচ্ছে। সাঁওতালদের মাথায় একটা কথা তোমাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে-কৌশলে। বুঝেছ? দরজাটা ভেজিয়ে দাও। জমিদার বেগার ধরলে ওরা যেন না যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *