কালিন্দী – ২১

২১

চিনির কল ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটির নাম বিমলবাবু। বিমলবাবু পরদিন সকালে গিয়া চর দেখিয়া আসিলেন। রাত্রের মধ্যে বান অনেক কমিয়াছে, তবুও চরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখনও জলমগ্ন; সেই অবস্থাতেই তিনি চরটি দেখিয়া খুশি হইয়া উঠিলেন। সকলের চেয়ে বেশী খুশি হইলেন তিনি সাঁওতালদের দেখিয়া। ছোট রায়-বাড়ির নায়েব মিত্তির ছিল তাঁহার সঙ্গে, বিমলবাবু মিত্তিরকে বলিলেন, অদ্ভুত জাত মশায় এরা, যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি কি খাটে! আমাদের দেশী লোকের মত নয়, ফাঁকি দেয় না।

মিত্তির মৃদু হাসিয়া বিমলবাবু অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়া বলিল, তাও অনেক ফাঁকি দিতে শিখেছে মশায়, আজকাল। ধীরে ধীরে শিখছে, বুঝলেন না? যখন ওরা প্রথম এল এখানে, তখন একটা লোকে যা কাজ করত, এখন সেই কাজ করে দুটো লোকে; দেড়টা লোক তো লাগেই।

বিমলবাবু ব্যবসায়ী লোক, কয়েকটি কলের মালিক, শ্রমিক মজুরদের সম্বন্ধে তাঁহার অভিজ্ঞতা প্রচুর। তাহার উপর তিনি উচ্চশিক্ষিত বৈজ্ঞানিক; মিত্তিরের কথা শুনিয়া তিনি একটু হাসিলেন, বলিলেন, কিন্তু এখনও ওরা একজন যা করে, সে-কাজ করতে আমাদের দেশী লোক অন্তত দেড়টা লাগে। দুটোই বলতাম, তা আপনার ভয়ে দেড়টাই বলছি।

মিত্তির আবার সন্তোষের হাসি হাসিল। বিমলবাবু তাহাকে ভয় করিয়া কথা বলিতেছেন, এইটুকু তার বেশ ভালই লাগিল। হাসিয়া বিমলবাবুর কথা মানিয়া লইয়া সে এবার বলিল, তা বটে।

বিমলবাবু বলিলেন, চলুন, একবার ওদের পাড়ার মধ্যে যাওয়া যাক। একটু আলাপ করে রাখা যাক। কল চালাতে হলে ওদের না হলে তো চলবে না।

শ্রীবাসের দোকানের সম্মুখ দিয়াই পথ, দোকানের সম্মুখে আসিয়াই মিত্তির বলিল, ওরে বাপ রে। এখানেই যে সব ভিড় লাগিয়ে রয়েছিস মাঝিরা! কি করছিস সব এখানে?

শ্রীবাসের দোকানে বসিয়া মাঝিরা বাকির খাতায় টিপ-সহি দিতেছিল। শ্রীবাস একটি হুঁকা হাতে বসিয়া সমস্ত দেখিয়া লইতেছিল। মিত্তির ও অপরিচিত বিমলবাবুকে দেখিয়া সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি হুঁকাটি রাখিয়া উঠানের পথে নামিয়া আসিল, অর্ধনত হইয়া একটি নমস্কার করিয়া বলিল, পেনাম। তারপর, মিত্তির মশায়, কোন দিকে? এই বনের মধ্যে? আর এই বাবুটি?

মিত্তির হাসিয়া বলিল, ইনি হলেন কলকাতার লোক, এসেছেন চর দেখতে। এখানে একটা চিনির কল করবেন। তাই এসেছিলাম ওঁকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর তোমার এখানে এত ভিড় কিসের?

চিনির কল করবেন? বিস্ময়ে শ্রীবাসের চোখ দুইটা বিস্ফারিত হইয়া উঠিল।

চিনির কলও হবে, সঙ্গে সঙ্গে আখের চাষও হবে। কিন্তু আপনার নামটা কি? দোকানটি আপনার? বিমলবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শ্রীবাসের মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন।

শ্রীবাসের মুখ কঠিন অসন্তোষে শুষ্ক হইয়া উঠিল, সে বলিল, কল কি এখানে চলবে আপনার? এত আখ পাবেন কোথা?

বিমলবাবু হাসিয়া বলিলেন, কল হলেই চারিদিকে আখের চাষ বেড়ে উঠবে। দোকান আপনার খুব ভাল চলবে দেখবেন। তার ওপর জমিও বোধ হয় আছে আপনার এখানে, তাতেও আরম্ভ করুন আখের চাষ। কল আপনাদের অনিষ্ট করবে না, ভালই করবে। ভাল কথা, এখানে এবারেই আমার পনেরো লাখ ইট হবে। আপনার তো দোকান এই চরের ওপরেই? আমার অনেক কুলী আসবে শহর থেকে ইট তৈরী করবার জন্যে, দু মাসের মধ্যেই এসে পড়বে, দোকান আপনি বাড়িয়ে ফেলুন।

শ্রীবাসের মুখ ধীরে ধীরে কোমল ও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সে এবার বলিল, তা আপানাদের মত ধনী যেখানে আসবে, সেখানে তো দশের অবস্থা ভালই হবে। দোকান আমি হুকুম হলেই বাড়াব। আর দেখতে শুনতে যা-হয় আমিই সব দেখে-শুনে দেব। এই দেখুন এইসব সাঁওতাল বেবাক আমার তাঁবে। আমার কাছেই ধান খায় বছর বছর। এক নেয়, এক দেয়। ওদের সঙ্গে খুব সুখ আমার। লোকজন যা দরকার হবে, সব আমি ঠিক করে দেব।

মিত্তির বলিল, আজকে এত ভিড় কিসের হে?

আজ্ঞে আজ ওদের ‘রোয়া’ পরব। মানে, চাষের জল তো লেগে গেল, তা ধান রুইবার আগে ওরা পূজো-টুজো দেবে। তারপর চাষে লাগবে। তাই সব জিনিসপত্তর নিচ্ছে, আর খোরাকির ধানও নিচ্ছে।

বিমলবাবু বলিলেন, তাই নাকি, আজ ওদের পর্ব? তা হলে বড় ভাল দিনে এসে পড়েছি। বাঃ! কই ওদের সর্দার কই?

সাঁওতালদের সমস্ত দলটি নীরবে বসিয়া এক বিচিত্র দৃষ্টিতে বিমলবাবুকে দেখিতেছিল, বিস্ময়, ভয়, শ্রদ্ধা, সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু সে দৃষ্টির মধ্যে প্রকাশ পাইতেছিল। বিমলবাবুর আহ্বানেও কমল সাড়া দিল না, তাহার প্রকাণ্ড দেহ লইয়া সে বিমলবাবুকে দেখিয়া খানিকটা নড়িয়া চড়িয়া বসিল মাত্র, শ্রীবাস ব্যস্ত হইয়া উঠিল, সম্ভ্রম ও সাঁওতালদের উপর আধিপত্য দুইই একসঙ্গে দেখাইয়া বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বরে বলিল, কমল মাঝি, কানে তোর ঢুকছে না, না কি? এইদিকে আয়। কত বড়লোক ডাকছেন, দেখছিস্‌ না?

কমল এবার উঠিয়া ধীরে ধীরে আসিয়া নত হইয়া প্রণাম জানাইয়া বলিল, কি বলছিস আপুনি?

হাসিয়া বিমলবাবু পরিষ্কার সাঁওতালী ভাষায় বলিলেন, তুমি এখানকার সর্দার?

উপবিষ্ট সাঁওতালদের বিস্ময়ের সীমা রহিল না, তাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠিল, এই, এই, বাবু আমাদের কথা বুলছে, আমাদের কথা বুলছে! উ বাবা রে!

বিমলবাবু সাঁওতালীতেই বলিলেন, হ্যাঁ, তোমাদের ভাষাতেই কথা বলছি আমি।

কমল ভাঙা ভাঙা বাংলাতেই প্রশ্ন করিল, আমাদের ভাষা আপুনি কি করে জানলিন বাবু?

আমার কাছে অনেক সাঁওতাল কাজ করে। আমার তিনটে কল আছে। কল বুঝিস তো?

হঁ হঁ। আপুনি চলে, খুব ধুঁয়া উঠে হিসহিস করে। একটো এই মোটা, এই বড় লোহার চোঙা থেকে ধুঁয়া উঠে, গুমগুম শব্দ উঠে। বয়লা চলে, রিঞ্জি চলে-

হ্যাঁ। বয়লার-এঞ্জিনে কাজ হয় কলে। এখানেও একটা কল করব আমি। তোরা সব কাজ করবি। তারপর, আজ তোদের রোয়া পরব বটে, নয়?

কমলের বড় বড় হলুদ রঙের দাঁতগুলি বাহির হইয়া পড়িল, বলিল, তাই তো করছি গো। জল তো অনেক হয়ে গেল। বীজ চারা-গুলান বড় হইছে, আর বসে থেকে কি হবে?

ঠিক ঠিক। তা, চিত কোপে জম ঞঃয়া? আজ কি খাওয়া -দাওয়া হবে রে, অ্যাঁ?

হাসিয়া কমল এবার নিজের ভাষাতেই বলিল, জেল, দাকা, হাণ্ডি।

ওঃ তা হলে তো আজ ভোজ রে তোদের। মাংস, ভাত, পচুই-অনেক ব্যাপার যে! কত হাণ্ডি করেছিস?

সলজ্জভাবে কমল বলিল, করলম, তা মেলাই হবে গো। মেয়েগুলো খাবে, আমরা খাব, তবে তো আমোদ হবে।

ঠিক ঠিক। তা বেশ! এই নে, আজ তোদের পরবের দিন, খাওয়া-দাওয়া করবি।–বলিয়া মানিব্যাগ বাহির করিয়া ব্যাগ হইতে একখানি নোট বাহির করিয়া কমলের হাতে দিলেন। কমল সন্তর্পণে নোটখানির দুই প্রান্ত দুই হাতের আঙুল দিয়া ধরিয়া সবিস্ময়ে নোট খানার ছাপের দিকে চাহিয়া রহিল।

বিমলবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘গেল্‌ টাকা, দশ টাকা পাবি ওটা দিলে।

সমস্ত দলটি সবিস্ময়ে কলরব করিয়া উঠিল।

বিমলবাবু হাসিয়া মিত্তিরকে বলিলেন, চলুন তা হলে এবার। আসি এখন দোকানী মশায়। চললাম রে মাঝি।

কমল বলিল, হঁ হঁ, আসুন গা আপনি। খাটব, আপোনার কলে আমরা খাটব।

সাঁওতাল পল্লীর মাঝখান দিয়া পরিচ্ছন্ন মেটে পথটি এই কয় দিনের প্রচণ্ড বর্ষণে ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার হইয়াই ছিল; তাহার উপর পর্ব উপলক্ষে মেয়েরা পথের উপর ঝাঁটা বুলাইয়েছে প্রত্যেক বাড়ির দুয়ারে মুখে মুখে একটি করিয়া মাড়ুলি দিয়াছে। আপনাদের উঠানে মেয়েগুলি আজ খুব ব্যস্ত। তৎপরতার সহিত কাজ করিয়া ফিরিতেছে। ছোট ছোট মেয়েগুলি আঁচলে ভরিয়া শাক সংগ্রহ করিয়া বেড়াইতেছে। আজিকার পর্বে শাক একটা প্রধান উপকরণ।

চলিতে চলিতে মিত্তির বিকৃত মুখে বার বার জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানিতে টানিতে বলিল, উঃ, মদে আজ ব্যাটারা বান ডাকিয়ে দেবে। পচুইয়ের গন্ধ উঠছে দেখুন দেখি।

বিমলবাবু বলিলেন, প্রত্যেক বাড়িতে মদ তৈরি হচ্ছে আজ। পরব কিনা। পরবে ওরা কখনও দোকানের মদ কিনে খায় না; দোকানের মদ হল অপবিত্র। আর তা ছাড়া পয়সাও লাগবে বেশি। মদের কথা বলিতে বলিতেই বিমলবাবুর যেন একটা জরুরী কথা মনে পড়িয়া গেল। কথার স্বরে ও ভঙ্গিমায় গুরুত্ব আরোপ করিয়া তিনি বলিলেন, ভাল কথা, এখানে পচুইয়ের দোকান সবচেয়ে কাছে কোথায় বলুন তো?

মিত্তির বিস্ময় বোধ করিয়াও না হাসিয়া পারিল না। হাসিয়া বলিল, হঠাৎ পচুইয়ের দোকানের খোঁজ? -বলিয়াই হঠাৎ মিত্তির বিমলবাবুর মতলবটা অনুমান করিয়া লইল, বলিল, বুঝেছি, মেয়া চাই। মাছধরার বাতিক কি কলকাতার বাবুদেরই সবারই মশায়? তা আমার বাবুর পুকুরে খুব বড় বড় মাছ, এক-একটা আঠারো সের, বিশ সের, বাইশ সের।

বিমলবাবু বলিলেন, না, মাছ ধরবার জন্য নয়। আমার কুলী আসবে এখানে। পগমিল, বক্‌স মোল্ডিঙের লোক তো এখানে মিলবে না। অন্তত ষাট-সত্তরজন কুলী আসবে। পচুইয়ের দোকান কাছে না থাকলে তো অসুবিধা হবে।

বার বার ঘাড় নাড়িয়া ব্যাপারটা উপলব্ধি করিয়া মিত্তির বলিল, অ্যাই দেখুন, এই নইলে কি পাকা ব্যবসাদার হওয়া যায়? বটে, মশায় বটে! দৃষ্টি রাখতে হবে চারিদিকে। তা, পচুইয়ের দোকান একটু দূরেই হবে। ক্রোশ দুয়ের কম নয়।

বিমলবাবু পকেট হইতে নোটবই বাহির করিয়া সেইখানে দাঁড়াইয়াই কথাটি নোট করিয়া লইলেন এবং তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, একটা দোকান স্যাংশন করিয়ে নেব এইখানেই। কল হলে তো চাই-ই। তা, আগে থেকেই ব্যবস্থা করে নেব।

পথের ধারেই একটি ঘনপল্লব কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায় কতকগুলি সাঁওতালদের মেয়ে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। গাছটির গোড়ায় সুন্দর একটা মাটির বেদী ও বেদীর চারিপাশে খানিকটা জায়গা গোবর ও মাটি দিয়া অপূর্ব পরিচ্ছন্নতার সহিত নিকানো; বেদীটির চারিদিক খড়ি-মাটির আলপনা দিয়া চিত্রিত করিয়া তোলা। মেয়েগুলো তখনও সম্মুখের নিকানো জায়গাটির উপর খড়িমাটির গোলা দিয়ে আলপনার ছবি আঁকিতেছিল-পাখী ও পশুর ছবি, তাহার পাশে পাশে খেজুরগাছের ডালপালা, ধানগাছের ছবি; একটি মেয়ে আলপনার সাদা রেখার মধ্যে মধ্যে সিঁদুরের লাল টোপা দিতেছিল। দিতে দিতে মৃদুস্বরে সকলে মিলিয়া পর্বের কল্যাণী-গান গাহিতেছিল-

ঠাকুরাহি সিরিজিলা ইনা পিরথিমা হো,

ঠাকুরাহি সিরিজিলা গাইয়া জো ইয়ারে,

পুরুবাহি ডাহারালি গাইয়া জো ইয়ারে,

পুরুবাহি ডাহারালি-গাইয়া জো-

বিমলবাবু মৃদু হাসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; তাহাদের আলোচনা বন্ধ হইয়া গেল। মেয়েদের দলও সবিস্ময়ে তাহাদের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহাদেরও গান মৃদু হইতে মৃদুতর হইয়া আসিয়া ছিল। বেশির ভাগ মেয়েরাই গান বন্ধ করিয়া দিয়াছিল, গাহিতেছিল কেবল দুই-একজন প্রবীণা। মাঙ্গলিক গান তাহারা বন্ধ করিবে কি করিয়া?

মিত্তির বলিল, চলুন, চলুন।

মেয়েদের দল হইতে সেই দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি, কমল মাঝির নাতনী সারী, আগাইয়া আসিয়া বলিল, একটি ধার দিয়ে যা গো বাবুরা। ই-ঠিনে আমাদের পূজো হবে।

কতকগুলো ছেলে মাথায় ফুলওয়ালা। গোটাকয়েক লালরঙের মোরগের পায়ে দড়ি বাঁধিয়া ধরিয়া বসিয়া আছে। মহা উৎসাহ তাহাদের; আপনাদের ভাষায় অতিমাত্রায় মুখর পাখীর মত একসঙ্গে পাখীর মত কলরব করিয়া বকিয়া চলিয়াছে। মিত্তির বলিল, ওরে বাপ রে। এতগুলো মুরগী আজ তোরা খাবি নাকি?

সারী বলিল, কেনে, উ কথা বুলছিস কেনে? তুর লোভ হচ্ছে নাকি?

মিত্তির বৈষ্ণব মানুষ, সে ঘৃণায় থুথু ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, রাম রাম রাম। অ্যাঁ, ই হারামাজাদা মেয়ে বলে কি গো?

সারী বলিল, তবে তু খাবার কথা বুলছিস কেনে? উ আমরা দেবতাকে দিব। কাটব এই দেবতা-থানে। তারপর কুটিকুটি করে একটি মাটিতে পুঁতব, আর সবগুলা বাঁধব। আগে থেকে খাবার কথা তু বুলছিস কেনে?

মিত্তির মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, চলুন মশায়, চলুন, আমার গা ঘিন-ঘিন করছে।

বিমলবাবু দেখিতেছিলেন সারীকে। চলিবার জন্য পা বাড়াইয়া তিনি বলিলেন, বাঃ, মেয়েটির দেহখানি চমৎকার, tall, graceful, -youth personified.

সারী ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, কি বুলছিস তু উ-সব?

মৃদু হাসিয়া বিমলবাবু অগ্রসর হইয়া গেলেন, কথার কোন উত্তর দিলেন না। নদীর পারঘাটের পাশেই অপেক্ষাকৃত বড় বড় সাঁওতাল ছেলেগুলি গরু-মহিষগুলিকে পরিপাটি করিয়া স্নান করাইতেছিল। কয়টা ছেলে আজও লম্বা লাঠি লইয়া জলের ধারের গর্তগুলিতে খোঁচা দিয়া শিকারের সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে।

* * *

মিত্তির ও বিমলবাবু চলিয়া যাইতেই শ্রীবাস গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে দোকানের সামনে ঘুরিতে আরম্ভ করিল। এখানে চিনির কল হইবে। চরখানা বাড়িঘর লোকজনে ভরিয়া যাইবে। হ্যাঁ, দোকানটা বড় করিতেই হইবে। বর্ষার শেষেই একখানা লম্বা তিনকুঠারী ঘর আরম্ভ করিয়া দেওয়া চাইই। ঘরের বনিয়াদ ও মেঝেটা পাকা করিলেই ভাল হয়। যে ইঁদুরের উপদ্রব! ওই বাবুর ইট তো অনেক হইবে, পনেরো লাখ। তাহা হইতে ভাঙা চোরা যাহা পড়িয়া থাকিবে, তাহাতেই তো একটা প্রকাণ্ড দালান তৈয়ারি হইতে পারিবে। আর লোকজনের সঙ্গে একটু যাহাকে বলে সুখ, সেই সুখ থাকিলে-। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীবাসের ঠোঁটের ডগায় অতি মৃদু একটি হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিল। পরমুহূর্তেই আবার সে গম্ভীর হইয়া পড়িল। আঃ, আরও খানিকটা জমি যদি সে দখল করিয়া রাখিত! জমির দাম হু-হু করিয়া বাড়িয়া যাইবে। দুই শ আড়াই শ টাকা বিঘে তো কথাই নাই!

সাঁওতালদের দল শ্রীবাসের অপেক্ষাতেই বসিয়াছিল, তাহাদের কাজ-কর্ম বন্ধ হইয়া রহিয়াছে। হিসাবের খাতায় টিপছাপ দিবার পর ধান মাপা হইবে। ওদিকে ‘রোয়া’ পর্বের সমারোহ তাহাদের বর্বর মনকে মুহুর্মুহু আকর্ষণ করিতেছে। তাহারা ক্রমাগত নড়িয়া চড়িয়া বসিতেছিল, আর ব্যাগ্রদৃষ্টিতে শ্রীবাসকে লক্ষ্য করিতেছিল। তাহার উপর এই আকস্মিক টাকা প্রাপ্তিতে পর্বটা আরও রঙিন হইয়া উঠিয়াছে। চূড়া, সেই কাঠের পুতুলের ওস্তাদ রসিক সাঁওতালটি, দেখিয়া শুনিয়া বলিয়া উঠিল, এ বাবা গো! মোড়লের আমাদের হল কি? ডাঁশ কামড়াচ্ছে নাকি গো? এমন করে ঘুরছে কেনে? ও সর্দার! তোমার মুখ কি কেউ সেলাই করে দিলে নাকি?

কমল এবার ডাকিল, মোড়ল মশায় গো!

শ্রীবাস ঈষৎ চকিত হইয়া বলিল, কি? ও যাই। সে ফিরিয়া তক্তাপোশের উপর বসিল। কমল বলিল, লেন গো, টিপছাপগুলা লিয়ে লেন গো। ইয়ার বাদে আবার ধান মাপতে হবে।

হুঁ। হিসাবের খাতাটা কোলের কাছে টানিয়াই শ্রীবাসের মাথার মধ্যে একটা কথা বিদ্যুৎ চমকের মত খেলিয়া গেল। জমির দাম বাড়িবে। টিপছাপ খাতায় না লইয়া একেবারে বন্ধকী দলিল করিয়া লইলে ;–কিন্তু বর্বরের দল বড় সন্দিগ্ধ। আবার একটা গোঁ ধরিয়া অবুঝের মত বলিবে, কেনে গো, উটিতে ছাপ কেনে দিব গো? তু যে বুললি, খাতাতে ছাপ দিতে হবে। পরমুহূর্তেই সে দোয়াতটা খাতার উপর উল্‌টাইয়া ফেলিল এবং আঁতকাইয়া বলিয়া উঠিল, যা সর্বনাশ হল।

সাঁওতালদের দলও অপরিসীম উদ্বিগ্ন হইয়া বলিয়া উঠিল, যাঃ।

শ্রীবাসের ছেলে বাপকে তিরস্কার করিয়া বলিল, কি করলে বল তো? হল তো! যাক্‌, ও পাতাখানা বাদ-

বাধা দিয়া শ্রীবাস অত্যন্ত দুঃখিত ভঙ্গিতে বলিল, উহুঁ। এক কাজ কর, বোঁ করে ও-পারে ভেণ্ডারের কাছ থেকে ডেমি নিয়ে আয় খান-পঁচিশেক। তারপর খাতা বেঁধে নিলেই হবে।

শ্রীবাসের ছেলে গনেশ এবার ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি ক্ষেপেছ নাকি? ডেমিতে কে কোন্‌কালে খাতা করে, শুনি?

দুরন্ত ক্রোধে অদ্ভুত দৃষ্টিতে বিকৃত মুখে শ্রীবাস গণেশের দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল, তোকে যা করতে বলছি, তাই কর্‌। যা, এখুনি যা, যাবি আর আসবি। -বলিয়া বাক্স খুলিয়া টাকা বাহির করিয়া ফেলিয়া দিল।

সাঁওতালেরা বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া শ্রীবাসের মুখের দিকে চাহিয়া ছিল, শ্রীবাস গম্ভীরমুখে উঠিয়া বলিল, টিপছাপ পরে হবে মাঝি, গণেশ কাগজ নিয়ে আসুক। ততক্ষণে তোরা আয়, বাখার ভেঙে ধানটা মেপে ঠিক করে রাখ। তোদের সব আজ আবার পরব আছে।

সাঁওতালেরা এ কথায় খুশি হইয়া উঠিল। কমল বলিল, নাঃ, মোড়ল বড় ভাল লোক, বিবেচনা আছে মোড়লের।

চূড়া মাঝি ভ্রূ নাচাইয়া বলিল, কিন্তু ভারি বেকুব হয়ে গিয়েছে মোড়ল কালিটা ফেলে। ছেলের উপর রাগ দেখলি না।

চূড়ার ব্যাখ্যায় সকলেই ব্যাপারটা সকৌতুকে উপভোগ করিয়া খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। সত্যিই মোড়ল বড় বেকুব হইয়া গিয়াছে।

দেখিতে দেখিতে খড়ের তৈয়ারী মোটা দড়া জড়াইয়া বাঁধা বাখারটা ভাঙিয়া স্তূপাকার করিয়া ধান ঢালা হইল। হুস-হাস করিয়া টিন-ভর্তি ধান মাপিয়া মাপিয়া ফেলা হইতে লাগিল। শ্রীবাস ধানের মাপের সঙ্গে হাঁকিতে আরম্ভ করিল- রাম-রাম, রাম-রাম, রাম-রামে দুই-দুই, দুই-রামে-তিন -তিন।

চূড়া এক পাশে বসিয়া একটা কাঠি লইয়া মাপের সঙ্গে সঙ্গে একটা করিয়া দাগ দিয়া সাঁওতালদের তরফ হইতে হিসাব করিয়া যাইতেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *