কালিন্দী – ২০

২০

সেদিন অপরাহ্নে দুর্যোগটা সম্পূর্ণ না কাটিলেও স্তিমিত হইয়া আসিল। বর্ষণ ক্ষান্ত হইয়াছে, পশ্চিমের বাতাস স্তব্ধ হইয়া দক্ষিণ দিক হইতে মৃদু বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। সেই বাতাস আকাশের মেঘগুলির দিক্‌পরিবর্তন করিয়া উত্তর দিকে চলিয়াছে।

ইন্দ্র রায় কাছারির সামনের বারান্দায় মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া এ-প্রান্ত হইতে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিতেছিলেন; হাত দুইটি পিছনের দিকে পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ। একটা কলরব তুলিয়া অচিন্ত্যবাবু বাগানের ফটক খুলিয়া প্রবেশ করিলেন, গেল, এবার পাষণ্ড মেঘ গেল। বাপ রে, বাপ রে, বাপ রে। আজ ছদিন ধরে বিরাম নেই জলের। আর কি বাতাস! উঃ, ঠাণ্ডায় বাত ধরে গেল মশায়! তিনি আকাশের মেঘের দিকে মুখ তুলিয়া বলিলেন, এইবার? এইবার কি করবে বাছাধন? যেতে তো হল। ‘বামুন বাদল বান, দক্ষিণে পেলেই যান’-দক্ষিণে বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে, যাও, এইবার যাও কোথায় যাবে।

রায় ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, কি ব্যাপার? অনেক কাল পরে যে।

অচিন্ত্যবাবু সপ্রতিভভাবে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, অনেক দিন পরেই বটে। শরীর সুস্থ না থাকলে কি করি বলুন? অবশেষে কলকাতায় গিয়ে-। অকস্মাৎ অকারণে হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, বলুন তো কি ব্যাপার?

হাসিতে হাসিতেই অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, দেখুন ভাল করে দেখুন, দেখে বলুন। হেঁ হেঁ, পারলেন না তো?-বলিয়া আপনার দাঁতের উপর আঙুল রাখিয়া বলিলেন, দাঁত-দাঁত। পার্ল-লাইক টীথ, এই রকম মুক্তোর পাঁতির মত দাঁত ছিল আমার? পোকাখেকো কালো কালো দাঁত, মনে আছে?

এইবার ইন্দ্র রায়ের মন কৌতুকবোধে সচেতন হইয়া উঠিল। তিনি হাসিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, তাই তো মশায়, সত্যিই এ যে মুক্তোর পাঁতির মত দাঁত!

সগর্বে অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, তুলিয়ে ফেললাম। ডাক্তার বললে কি জানেন? বললে, ওই দাঁতই তোমার ডিসপেপ্‌সিয়ার কারণ। এখন আপনার পাথর খেলে হজম হয়ে যাবে।

বলেন কি?

নি-শ্চ-য়। দেখুন না, ছ মাসের মধ্যে কি রকম বিশালকায় হয়ে উঠি। একেবারে যাকে বলে-ইয়ংম্যান। পরমুহূর্তে অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি জানেন? খাবারদাবার, মানে যাকে বলে পুষ্টিকর খাদ্য, সে তো এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।

রায় বলিলেন, এটা আপনি অযথা নিন্দে করছেন আমাদের দেশের। দুধ-ঘি এসব তো প্রচুর পাওয়া যায় আমাদের এখানে।

বিষম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দুধ ও ঘিকে তুচ্ছ করিয়া দিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, আরে মশায়, কি যে বলেন আপনি, বিশেষ করে নিজে তান্ত্রিক হয়ে, তার ঠিক নেই। দুধ-ঘিই যদি পুষ্টিকর খাদ্য হত, তবে গরুই হত পশুরাজ। মাংস–মাংস খেতে হবে, তবে দেহে বল হবে। দুধ-ঘি খেয়ে বড় জোর চর্বিতে ফুলে ষণ্ড হওয়া চলে, বুঝলেন?

রায় হাসিয়া বলিলেন, তা বটে, দুধ-ঘি খেয়ে ষণ্ড হওয়া চলে, পাষণ্ড হওয়া চলে না, এটা আপনি ঠিক বলেছেন।

অচিন্ত্যবাবু একটু অপ্রস্তুত হইয়া গেলেন। অপ্রতিভভাবে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বিরক্তিভাবে বলিলেন, আমিই বোকামি করলাম, আরও কিছুদিন কলকাতায় থাকলেই হত। তা একটা সাহেব কোম্পানির তাড়ায় এলাম চলে। ভাবলাম সাঁওতালদের একটা দুটো পয়সা দিয়ে একটা করে হরিয়াল, কি তিতির, নিদেন ঘুঘু মারার ব্যবস্থা করে নেব। তা ছাড়া এখানে বন্য শশকও তো প্রচুর পাওয়া যায়, সে পেলে না হয় দু গণ্ডা তিন গণ্ডা পয়সাই দেওয়া যাবে। শশক-মাংস নাকি অতি উপাদেয় অতি পুষ্টিকর। মানে, ওরা খায় যে একেবারে ফার্স্টক্লাস ভিটামিন-ছোলা, মসুর, এই সবের ডগা খেয়েই তো ওদের দেহ তৈরী।

রায় বলিলেন, আজ আমি আপনাকে শশক-মাংস খাওয়াব, আমার এখানেই রাত্রে খাবেন, নেমন্তন্ন করলাম। চরের সাঁওতালরা আজ দুটো খরগোশ দিয়ে গেছে।

অচিন্ত্যবাবু হাসিয়া বলিলেন, সে আমি শুনেছি মশায়, বাড়িতে বসেই তার গন্ধ পেয়েছি।

রায় হাসিয়া উত্তর দিলেন, তা হলে সিংহ ব্যাঘ্র না হতে পারলেও ইতিমধ্যেই আপনি অন্তত শৃগাল হয়ে উঠেছেন দেখছি। ঘ্রাণশক্তি অনেকটা বেড়েছে।

অচিন্ত্যবাবু অপ্রস্তুত হইয়া ঠোঁটের উপর খানিকটা হাসি টানিয়া বসিয়া রহিলেন। রায় বলিলেন, আসবেন তা হলে রাত্রে!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, বেশ। আবার এখন এই ভিজে মাটিতে ট্যাংট্যাং করে যাচ্ছে কে, তাই আসব! সেই একেবারে খেয়ে-দেয়ে যাব। অম্বল ভাল হল তো সর্দি টেনে আনব নাকি? তা ছাড়া আসল কথাই তো আপনাকে এখনো বলা হয় নি। এক্ষুনি বললাম না, সায়েব কোম্পানির কথা? এবার যা একটা ব্যবসার কথা কয়ে এসেছি, কি বলব আপনাকে, একেবারে তিনশ পারসেন্ট লাভ, দুশ পয়েন্টের আর মার নেই।

সকৌতুক ভ্রূ দুইটি ঈষৎ টানিয়া তুলিয়া রায় বলিলেন, বলেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। খসখস চালান দিতে হবে, খসখস বোঝেন তো?

তা বুঝি, বেনাঘাসের মূল।

অচিন্ত্যবাবু পরম সন্তুষ্ট হইয়া দীর্ঘস্বরে বলিলেন, হ্যাঁ। সাঁওতাল ব্যাটারা চর থেকে তুলে ফেলে দেয়, সেইগুলো নিয়ে আমরা সাপ্লাই করব। দেখুন হিসেব করে, লাভ কত হয়।

রায় জবাব দিলেন না, খানিকটা হাসিলেন মাত্র। অন্দরের ভিতর হইতে শাঁখ বাজিয়া উঠিল, ঈষৎ চকিত হইয়া রায় চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে, পশ্চিমদিগন্তে অল্পমাত্রায় রক্তসন্ধ্যার আভাস থাকায় অন্ধকার তেমন ঘন হইয়া উঠিতে পারে নাই। গভীরস্বরে তিনি ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করিলেন, তারা তারা! তারপর অচিন্ত্যবাবুকে বলিলেন, তা হলে আপনি একটু নায়েবের সঙ্গে বসে গল্প করুন, আমি সান্ধ্যকৃত্য শেষ করে নিই।

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, একটি গোপন কথা বলে নিই। মানে মাংস হলেও একটুও দুধের ব্যবস্থা আমার চাই কিন্তু, ব্যাপারটা হয়েছে কি জানেন, দাঁত তুলে দিয়ে ডাক্তারেরা বলেন বটে, আর হজমের গোলমাল হবে না, আমি কিন্তু মশায়, অধিকন্তু না দোষায় ভেবে আফিং খানিকটা করে আরম্ভ করেছি। বুঝলেন, তাতেই হয়েছে কি, ওই গব্যরস একটু না হলে আবার ঘুম আসছে না।

রায় মৃদু হাসিয়া অন্দরের দিকে চলিয়া গেলেন। একজন চাকর প্রদীপ ও প্রধূমিত ধূপদানি লইয়া কাছারির দুয়ারে দুয়ারে সন্ধ্যা দেখাইয়া ফিরিতেছিল, অন্য একজন চাকর দুই-তিনটা লণ্ঠন আনিয়া ঘরে বাহিরে ছোট ছোট তেপেয়াগুলির উপর রাখিয়া দিল।

সমৃদ্ধ রায় বংশের ইতিহাস আরম্ভ হইয়াছে অন্ততঃ দুইশ বৎসর পূর্বে, হয়তো দশ-বিশ বৎসর বেশীই হইবে, কম হইবে না। তাহার পূর্বকাল হইতেই রায়েরা তান্ত্রিক দীক্ষায় পুরুষানুক্রমে দীক্ষিত হইয়া আসিতেছেন। ছোট রায়ের প্রপিতামহ অবধি তন্ত্রের একটা মোহময় প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন; আজও গল্প শোনা যায়, আমাবস্যা অষ্টমী প্রভৃতি পঞ্চ পর্বে তাঁহারা শ্মশানে গিয়া জপতপ করিতেন। তাহারাও পুর্বে কেহ একজন নাকি লতাসাধনে সিদ্ধ হইয়া ছিলেন। যুগের প্রভাবে তন্ত্রের সেই মোহময় প্রভাব এখন আর নাই। কিন্তু তবুও তন্ত্রকে একেবারে তাঁহারা পরিত্যাগ করিতে করেন নাই। ইন্দ্র রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় তন্ত্রমতে সায়ংসন্ধ্যায় বসেন, তখন গলায় থাকে রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধের উপর থাকে কালী-নামাবলী, সম্মুখে থাকে নারিকেলের খোলায় একটি পাত্র আর থাকে মদের বোতল ও কিছু খাদ্য-মৎস্য বা মাংস। এক-একবার নারিকেলের মালার পাত্রটি পরিপূর্ণ করিয়া জপতপ ও নানা মুদ্রাভঙ্গিতে তাহা শোধন করিয়া লইয়া পান করেন, তাহার পর আবার আরম্ভ করেন ধ্যান ও জপ; একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জপ শেষ করিয়া আবার দ্বিতীয় বার পাত্র পূরণ করিয়া ওই ক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি করেন। এমনি ভাবে তিন বারে তৃতীয় পাত্র শেষ করিয়া তিনি সান্ধ্যকৃত্য শেষ করেন, কিন্তু ইহাতেও তাঁহার দেড় ঘন্টা হইতে দুই ঘন্টা কাটিয়া যায়, তিন পাত্রের অধিক তিনি সাধারণত পান করেন না।

হেমাঙ্গিনী স্বামীর সান্ধ্যকৃত্যের আয়োজন করিয়াই রাখিয়াছিলেন, ইন্দ্র রায় কাপড় বদলাইয়া আসন গ্রহণ করিতেই তিনি গৃহদেবী কালীমায়ের প্রসাদী কিছু মাছ আনিয়া নামাইয়া দিলেন। রায় বলিলেন, দেখ, অচিন্ত্যবাবুকে আজ নেমন্তন্ন করেছি, তাঁর দুধ একটু ঘন করেই জ্বাল দিয়ে রেখো। ভদ্রলোক আফিং ধরেছেন, ঘন দুধ না হলে তৃপ্তি হবে না।

হাসিয়া হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বেশ। কিন্তু আর কাউকে নেমন্তন্ন কর নি তো? তোমার তো আবার নারদের নেমন্তন্ন!

না! রায় একটু হাসিলেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, আজ তুমি কি এত ভাবছ বল তো?

নাঃ, ভাবি নি কিছু।

রায়ের কথার সুরের মধ্যে একটা ক্ষীণ ক্লান্তির আভাস ফুটিয়া উঠিল বলিয়া হেমাঙ্গিনীর মনে হইল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কুণ্ঠিতভাবে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অমল ছেলেমানুষ, সে কাজটা ছেলেমানুষি করেই করেছে, সেটা-

এইভাবে বাধা দিয়ে রায় বলিলেন, ও-কথা উচ্চারণ করো না হেম; তুমি কি আমাকে এমন সঙ্কীর্ণ ভাব? এই সন্ধ্যা করবার আসনে বসেই বলছি হেম, সত্যিই আমার আর কোন বিদ্বেষ নেই রামেশ্বর বা তার ছেলেদের ওপর। সুনীতির বড়ছেলে রাধারাণীর মর্যাদা রাখতে যা করেছে, তাতে রাধুর গর্ভের সন্তানের সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য আর থাকতে দেয় নি।

হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন, কোন উত্তর দিতে মন যেন তাঁহার সায় দিল না। রায় হাসিয়া বলিলেন, তা হলে আমি সন্ধ্যাটা সেরে নিই, তুমি নিজে দাঁড়িয়ে রান্নাবান্নাটা দেখে দাও বরং ততক্ষণ

হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলেন।

রায় একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ইষ্টদেবীকে পরম আন্তরিকতার সহিত স্মরণ করিয়া ডাকিয়া উঠিলেন, তারা, তারা। সবই তোমার ইচ্ছা মা। তারপর তিনি শাস্ত্রবিধান-অনুযায়ী ভঙ্গিতে আসন করিয়া সান্ধ্যকৃত্য আরম্ভ করিলেন।

হেমাঙ্গিনীর ভুল হইবার কথা নয়। দুর্দান্ত কৌশলী হইলেও ইন্দ্র রায় হেমাঙ্গিনীর নিকট ছিলেন শান্ত সরল উদার। একবিন্দু কপটতার ছায়া কোনদিন তাঁহার মনোতল ছায়াবৃত করিয়া হেমাঙ্গিনীর দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত বা প্রতারিত করে নাই। অমল অহীন্দ্রকে নিমন্ত্রণ করিয়াছে, এ সংবাদ শুনিবামাত্র রায়ের ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিয়া সামাজিক নিমন্ত্রণ-ব্যবহার বন্ধ না হইলেও, ছোট রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির মধ্যে আহার-ব্যবহারটা রাধারাণীর নিরুদ্দেশের পর হইতে প্রকৃতপক্ষে বন্ধই ছিল। সামাজিক ক্রিয়াকলাপে দুই বাড়িই ব্রাহ্মণ কর্মচারী বা আপন আপন পূজক ব্রাহ্মণ পাঠাইয়া সামাজিক দায়িত্ব রক্ষা করিতেন।

তাহার পর অকস্মাৎ যেদিন ইন্দ্র রায়েরই নিয়োজিত ননী পাল চক্রবর্তীদের অপমান করিতে গিয়া রায়-বংশেরই কন্যার অপমান করিয়া বসিল এবং সে অপমানের প্রতিশোধে চক্রবর্তী-বংশের সন্তান মহীন্দ্র তাহাকে হত্যা করিয়া ফাঁসী বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত হইল, সেদিন হইতে ইন্দ্র রায় যা-কিছু করিয়া আসিতেছেন, সে সমস্ত দানের প্রতিদান হিসাবেই করিয়া আসিতেছেন, অন্তত তাহার মনে সেই ধারনাই ছিল। অহীন্দ্র এখানে আসিলে জল খাইয়া যাইত বা অমল অহীন্দ্রের বাড়িতে কিছু খাইয়া আসিত, তাহার অতি অল্পই তিনি জানিতেন, বেশির ভাগই ছিল তাহার অজ্ঞাত। যেটুকু জানিতেন, সেইটুকুকে শুষ্ক শিষ্টাচার বলিয়াই গন্য করিতেন। দানের প্রতিদানে, তাহার দিকের প্রতিদানের ওজনটাই ভারী করিবার ব্যগ্রতায় তিনি চলিয়াছিলেন। আজ যে তিনি সহসা অনুভব করিলেন যে, এই চলার বেগটা তাঁহার স্বেচ্ছা-আরোপিত বেগ নয়, নিজের ইচ্ছায় নিজের বেগেই তিনি চলিতেছেন না। অপরের চালনায় তিনি চালিত হইয়া চলিয়াছেন। আপনার সমস্ত চৈতন্যকে সতর্ক করিয়া রায় চারিটি দিক চাহিয়া দেখিলেন, তারপর চাহিয়া দেখিলেন সম্মুখের দিকে। অদৃষ্টবাদী হিন্দুর মন তাঁহার, তিনি চারিদিকে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না, কিন্তু কিছু যেন অনুভব করিলেন এবং সম্মুখের সমস্ত পথটা দেখিলেন এক রহস্যময় অন্ধকারের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য। তিনি পিছন ফিরিয়া পশ্চাতের পথের আকৃতি দেখিয়া সম্মুখের এই অন্ধকারাবৃত পথের প্রকৃতি অনুমান করিতে গিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। চক্রবর্তী-বাড়ির জীবন-পথ যেখানেই রায়-বাড়ির জীবন-পথের সহিত মিলিত হইতে আসিয়াছে, সেইখানেই একটা করিয়া ভাঙনের অন্ধকারময় খাত অতল অন্ধকূপের মত জাগিয়া রহিয়াছে।

কিন্তু উপায় কোথায়? দিক পরিবর্তন করিয়া চলিবার কথা মনে হইয়াছে; কিন্তু সেও পরম লজ্জার কথা। মনের ওজনে দান-প্রতিদানের পাল্লার দিকে চাহিয়া তিনি যে স্পষ্ট দেখিতেছেন, চক্রবর্তী-বাড়ির দানের পাল্লা এখনও মাটির উপর অনড় হইয়া বসিয়া রহিয়াছে, সন্তান সম্পদ সব যে চক্রবর্তী-বাড়ির পাল্লাটার উপর চাপাইয়াছে। সুনীতি অহীন্দ্র গভীর বিশ্বাসের সহিত সকরুণ দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে তাহাদের পাওনা পাইবার প্রত্যাশায়।

জপ করিয়া শোধন-করা সূরাপূর্ণ পানপাত্র তুলিয়া পান করিয়া রায় গভীরস্বরে আবার ডাকিলেন, কালী! কালী! মা! তারপর আবার তিনি জপে বসিলেন। কিন্তু কাছারিবাড়ি হইতে অচিন্ত্যবাবুর চিলের মত তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর আসিতেছে; লোকটা কাহারও সহিত চীৎকার করিয়া ঝগড়া বা তর্ক করিতেছে। তাঁহার ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, পরক্ষণেই আপনাকে সংযত করিয়া প্রাগাঢ়তর নিষ্ঠার সহিত সকল ইন্দ্রিয়কে রুদ্ধ করিয়া তিনি ইষ্টদেবীকে স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন।

অচিন্ত্যবাবু ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন অমল ও অহীন্দ্রের উপর। সন্ধ্যার পর তাহারা দুইজনে বেড়াইয়া আসিয়া চা পান করিতে করিতে পলিটিক্‌সের আলোচনা করিতেছিল। অচিন্ত্যবাবু নায়েবের কাছে বসিয়া অনর্গল বকিতেছিলেন, সহসা চায়ের পেয়ালা পিরিচের ঠুং ঠাং শব্দ শুনিবামাত্র তিনি সে-ঘর হইতে উঠিয়া অমলদের আসরে জাঁকিয়া বসিলেন। অমল তীব্রভাবে ইংরেজ-রাজত্বের শোষণ-নীতির সমালোচনা করিতেছিল।

অহীন্দ্র বলিল, পরাধীন জাতির এই অদৃষ্ট অমল, পরাধীনতা থেকে মুক্ত না হলে এ শোষণ থেকে অব্যাহতির উপায় নেই।

পুতুলনাচের পুতুলের মত অচিন্ত্যবাবুর মুখ চায়ের কাপ হইতে অহীন্দ্রের দিকে ফিরিয়া গেল, সবিস্ময়ে অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া তিনি বলিলেন, কি? ইংরেজ-রাজত্ব তুমি উলটে দিতে চাও?

ঈষৎ হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, চাইলেও সে ক্ষমতা আমার নেই, তবে অন্তরে অন্তরে সকলেই স্বাধীনতা চায়, এটা সার্বজনীন সত্য।

তক্তপোশের উপর একটা চাপড় মারিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, নো, নো, নো-। বলিতে বলিতে উত্তেজনার চাঞ্চল্যে খানিকটা গরম চা তাঁহার কাপড়ে পড়িয়া গেল, ফলে তাঁহার বক্তব্য আর শেষ হইল না, চায়ের কাপ সামলাইতে তিনি ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন।

অমল বলিল, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, উত্তেজিত হব না? সাহেবদের তাড়িয়ে কি রাজত্ব করবে তোমরা বাপু? বলে, হেলে ধরতে পারে না, কেউটে ধরতে চায়। এমন বিচার করবার তোমাদের ক্ষমতা আছে? তোমরা আজ চাকর রাখবে, কাল তাড়াবে কুকুরের মত। কই, গভর্নমেন্টের একটা পিওনের চাকরি সহজে যাক তো দেখি! তারপর বুড়ো হলো তো পেনশান। আছে এ বিবেচনা তোমাদের?

অমল ও অহীন্দ্র এবার হাসিয়া ফেলিল।

অচিন্ত্যবাবু চটিয়া উঠিলেন, বলিলেন, হেসো না, বুঝলে, হেসো না। এই হল তোমাদের জাতের স্বভাব-বড়কে ছোট করে হাসা আর ভায়ে ভায়ে লাঠালাঠি করা। ইংরেজ হল আমাদের ভাই, তাদের লাঠি মেরে তাড়িয়ে নিজেরা রাজত্ব করবে? বাঃ, বেশ!

অমল ও অহীন্দ্র উভয়েই হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। অচিন্ত্যবাবু এবার অত্যন্ত চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, তোমরা তো অত্যন্ত ফাজিল ছেলে হে! বলি, এমন ফ্যাকফ্যাক করে হাসছ কেন শুনি?

অমল বলিল, ইংরেজ আমাদের ভাই?

তক্তপোশের উপর প্রাণপণ শক্তিতে আবার একটা চাপড় মারিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, নিশ্চয়, সার্টেন্‌লি। ইংরেজ আমাদের ভাই, জ্ঞাতি, এক বংশ। পড়নি ইতিহাস! ওরাও আর্য, আমরাও আর্য। আরও প্রমাণ চাও? ভাষার কথা ভেবে দেখ। আমরা বাবাকে প্রাচীন ভাষায় বলি, পিতা পিতর্‌, ওরা বলে ফাদার। মাতর্‌ মাদার, বাবা, পাপা। ভ্রাতা ব্রাদার। তফাত কোনখানে হে বাবু? আমরা ভয় পেলে বলি হরি-বোল হরি-বোল, ওরা বলে হরি্‌বল্‌ হরি্‌বল্‌। চামড়ার তফাতটা তো বাইরের তফাত হে, সেটা কেবল দেশভেদে, জলবাতাস ভেদে হয়েছে।

তর্কটা আর অগ্রসর হইতে পারিল না, নায়েব আসিয়া বাধা দিল। বলিল, অচিন্ত্যবাবু আপনি একটি থামুন মশায়, একটি বাইরের ভদ্রলোক এসেছেন, ধনী মহাজন লোক; কি ভাববেন বলুন তো?

অচিন্ত্যবাবু মুহূর্তে তর্ক থামাইয়া দিয়া ভদ্রলোক সম্বন্ধে উৎসুক হইয়া উঠিলেন, এ-ঘর ছাড়িয়া ও-ঘরে ভদ্রলোকটির সম্মুখে গিয়া চাপিয়া বসিয়া বলিলেন, নমস্কার, মহাশয়ের নিবাসটি জানতে পারি কি?

প্রতি নমস্কার করিয়া ভদ্রলোক বলিলেন, আমার বাড়ি অবশ্য কলকাতায়, তবে কর্মস্থল আমার এখন এই জেলাতেই। সদর থেকেই আমি এসেছি।

এখানে-মানে, কি উদ্দেশ্যে-যদি অবশ্য-

আমি এখানে একটা চিনির কল করতে চাই। শুনেছি নদীর ও-পারে একটা চর উঠেছে, সেখানে আখের চাষ ভাল হতে পারে, তাই দেখতে এসেছি জায়গাটা।

অচিন্ত্যবাবু গম্ভীর হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বেনার মূলের ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা অনুভব করিয়া নীরবে গম্ভীর মুখে বসিয়া রহিলেন। নায়েব বলিল, আপনি বসুন একটু, আমি দেখি, কর্তাবাবুর সন্ধ্যা শেষ হয়েছে কিনা।

নায়েব বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন, মা!

হেমাঙ্গিনী মাথার ঘোমটা অল্প বাড়াইয়া দিয়া ঘর হইতে বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, কিছু বলছেন?

আজ্ঞে, কর্তাবাবুর সন্ধ্যা শেষ হয়েছে?

তা হয়ে থাকবে বৈকি। কোনও দরকার আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, একটি ভদ্রলোক এসেছেন, চক্রবর্তী-বাড়ির ওই চরটা দেখবেন। তিনি একটা চিনির কল বসাবেন। আমাদের এখানে এসে উঠেছেন।

ও। আচ্ছা, আমি খবর দিচ্ছি, আপনি যান। চা জলখাবারও পাঠিয়ে দিচ্ছি।

নায়েব চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী চায়ের জল বসাইয়া দিতে বলিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন। অর্ধেকটা সিঁড়ি উঠিয়াই তিনি শুনিতে পাইলেন মৃদুস্বরে রায় আজ গান গাহিতেছেন- “সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।” তিনি একটু বিস্মিত হইয়া গেলেন, গান তো রায় বড় একটা গান না। অভ্যাসমত তিন পাত্র ‘কারণ’ পান করিলে তিনি কখনও এতটুকু অস্বাভাবিক হন না। পর্ব বা বিশেষ কারণে তিন পাত্রের অধিক পান করিলে কখনও কখনও গান গাহিয়া থাকেন। হেমাঙ্গিনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, সম্মুখে সুরাপূর্ণ পাত্র রাখিয়া রায় মৃদুস্বরে গান গাহিতেছেন। তিনি বেশ বুঝিলেন, সন্ধ্যা শেষ হইয়া গিয়াছে, রায় আজ নিয়মের অতিরিক্ত পান করিতেছেন। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, এ কি? সন্ধ্যে তো হয়ে গেছে, তবে যে আবার নিয়ে বসেছ?

মত্ততার আবেশমাখা মৃদু হাসি হাসিয়া রায় হাত দিয়া পাশেই স্থান নির্দেশ করিয়া দিয়া বলিলেন, বস বস। মাকে ডাকছি আমার। আমার সদানন্দময়ী মা। তিনি আবার পূর্ণপাত্র তুলিয়া লইলেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওই শেষ কর। আর খেতে পাবে না।

রায় বলিলেন, আজ আনন্দের দিন। চক্রবর্তী-বাড়ি আর রায়-বাড়ির বিরোধের শেষ কাঁটাও আজ মা তুলে দিলেন। আনন্দ করব না? পাঁচ হয়েছে সাত শেষ করব হেম, সাত-পাঁচ ভাবা আজ শেষ করে দিলাম।

বলিয়া হেমাঙ্গিনীর মুখের সম্মুখে হাত নাড়িয়া আবার গান ধরিলেন, “সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *