১৮
আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহে আবার কালীন্দির বুকে বান আসিয়া পড়িল।
এক দিকে রায়হাট, অন্য দিকে সাঁওতালদের ‘রাঙাঠাকুরের চর’-এই উভয়ের মাঝে রাঙা জলের ফেনিল আবর্ত ফুলিয়া ফুলিয়া খরস্রোতে ছুটিয়া চলিয়াছে। আবর্তের মধ্যে কলকল শব্দ শুনিয়া মনে হয়, সত্য সত্যই কালী যেন খলখল করিয়া হাসিতেছে। কালী এবার ভয়ঙ্করী হইয়া উঠিয়াছে।
গত কয়েক বৎসর কালীন্দির বন্যা তেমন প্রবল কিছু হয় নাই,এবার আষাঢ়ের প্রথমেই ভীষণ বন্যায় কালী ফাঁপিয়া ফুলিয়া রাক্ষসীর মত হইয়া উঠিল। বর্ষাও নামিয়াছে এবার আষাঢ়ের প্রথমেই। জৈষ্ঠ-সংক্রান্তির দিনই আকাশে ভ্রাম্যমাণ মেঘপুঞ্জ ঘোরঘটা করিয়া আকাশ জুড়িয়া বসিল। বর্ষণ আরম্ভ হইল অপরাহ্ন হইতেই। পরদিন সকাল-অর্থাৎ পয়লা আষাঢ়ের প্রাতঃকালে দেখা গেল, মাঠঘাট জলে থৈ-থৈ করিতেছে। ধান চাষের ‘কাড়ান’ লাগিয়া গিয়াছে। ইহাতেই কিন্তু মেঘ ক্ষান্ত হইল না, তিন-চার দিন ধরিয়া প্রায় বিরামহীন বর্ষণ করিয়া গেল। কখনও প্রবল ধারায়, কখনও রিমিঝিমি, কখনও মৃদু ফিনকির মত বৃষ্টির ধারাগুলি বাতাসের বেগে কুয়াশার বিন্দুর মত ভাসিয়া যাইতেছিল। অনেককালের লোকও বলিল, এমন সৃষ্টিছাড়া বর্ষা তাহারা জীবনে দেখে নাই। এ বর্ষাটির না আছে সময়জ্ঞান, না আছে মাত্রাজ্ঞান।
দেখিতে দেখিতে কালীর বুকেও বন্যা আসিয়া গেল দুর্দান্ত ঝড়ো হাওয়ার মত। এ-বেলা ও-বেলা বান বাড়িতে বাড়িতে রায়হাটের তালগাছপ্রমাণ উঁচু, ভাঙা কূলের কানায় কানায় হইয়া উঠিল; ভাঙা তটের কোলে কোলে কালির লাল জল সূর্যের আলোয় রক্তাক্ত ছুরির মত ঝিলিক হানিয়া তীরের গতিতে ছুটিয়া চলিয়াছে। মধ্যে মধ্যে খানিকটা করিয়া রায়হাটের কূল কাটিয়া ঝুপঝুপ শব্দে খসিয়া পড়িতেছে।
রায়হাটের চাষীরা বলে, কালী জিভ চাটছে রাক্ষসীর মত, ভাগ্যে আমাদের কাঁকুড়ে মাটি!
সত্য কথা। রায়হাটের ভাগ্য ভাল যে, রায়হাটের বুক সাঁওতাল পরগণার মত কঠিন রাঙা মাটি ও কাঁকড় দিয়ে গড়া। নরম পলিমাটিতে গঠিত হইলে কালীর শাণিত জিহ্বার লেহনে কোমল মাটির তটভূমি হইতে বিস্তৃত ধস, কোমল দেহের মাংসপিণ্ডের মত খসিয়া পড়িত। রায়হাট ইহারই মধ্যে কঙ্কালসার হইয়া উঠিত। দুই-তিন বৎসরে কালী মাত্র হাত-পাঁচেক পরিমিত কূল রায়হাটের কোলে কোলে খসাইয়াছে। এবার কিন্তু বন্যাতেই ইহার মধ্যে হাত দুয়েক খাইয়া ফেলিয়াছে, এখনও পূর্ণ ক্ষুধায় লেহন করিয়া চলিয়াছে। ওপারে চরটাও এবার প্রায় চারদিক বন্যায় ডুবিয়া ছোট একটি দ্বীপের মত কোনমতে জাগিয়া আছে। চরের উপরেই এখন কালীনদীর ও-পারের খেয়ার ঘাট, ঘাট হইতে একটা কাঁচা পথ চলিয়া গিয়াছে চরের ও-দিকের গ্রাম পর্যন্ত। সেই পথটা মাত্র ও-দিকে একটা যোজকের মত জাগিয়া আছে।
চরের ওপর শ্রীবাস পাল যে দোকানটা করিয়াছে, সেই দোকানের দাওয়ায় সাঁওতালদের কয়েকজন মাতব্বর বসিয়া অলস দৃষ্টিতে এই দুর্যোগের আকাশের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। কমল মাঝি, সেই রহস্যপ্রবণ কাঠের মিস্ত্রী চূড়াও বসিয়া আছে। আরও জন দুয়েক নীরবে ‘চুটি’ টানিতেছিল। শালপাতা জড়ানো কড়া তামাকের বিড়ি উহারা নিজেরাই তৈয়ারি করে, তাহার নাম ‘চুটি’। কড়া তামাকের কটু গন্ধে জলসিক্ত ভারী বাতাস আরও ভারী হইয়া উঠিয়াছে। মধ্যে মধ্যে দুই চারিজন রাহী খেয়াঘাটে যাইতেছে বা খেয়াঘাট হইতে আসিতেছে।
দোকানের তক্তপোশের উপর শ্রীবাস নিজে একখানা খাতা খুলিয়া গম্ভীরভাবে বসিয়া আছে। ও-পাশে শ্রীবাসের ছোট ছেলে একখানা চাটাই বিছাইয়া দোকান পাতিয়া বসিয়াছে, তাহার কোলের কাছে একটা কাঠের বাক্স, একপাশে একটা তরাজু, ওজনের বাটখারাগুলি-সেরের উপর আধসের, তাহার উপর একপোয়া-এমনি ভাবে আধ-ছটাকটি চূড়ায় রাখিয়া মন্দিরের আকারে সাজাইয়া রাখিয়াছে। সহসা এই নীরবতা ভঙ্গ করিয়া শ্রীবাস বলিল, কি রে, সবাই যে তোরা ‘থম্ভ’ মেরে গেলি! কি বলছিস বল্, আমার কথার জবাব দে!
কমল নির্লিপ্তের মত উত্তর দিল, কি বুলব গো? আপুনি যি যা-তা বুলছিস!
শ্রীবাসের কপাল একেবারে প্রশস্ত টাকের প্রান্তদেশ পর্যন্ত কুচকাইয়া উঠিল; বিস্ময়ের সুরে বলিয়া উঠিল, আমি যা-তা বলছি! আপনার পাওনাগণ্ডা চাইলেই সংসারে যা-তা বলাই হয় যে, তার আর তোদের দোষ কি, বল্?
সাঁওতালদের কেহ কোন উত্তর দিল না, শ্রীবাসই আবার বলিল, বাকি তো এক বছরের নয়, বাকি ধর্ গা যেঁয়ে-তোর তিন বছরের। যে বছর দাঙ্গা হল সেই বছর থেকে তোরা ধান নিতে লেগেছিস। দেখ কেনে হিসেব করে। দাঙ্গা হল, মামলা হল, মামলাই চলেছে দু বছর, তারপর লবীনের ধর্ গা যেঁয়ে-এক বছর করে জেল খাটা হয়ে গেল। বটে কি না?
কমল সে কথা অস্বীকার করিল না, বলিল, হুঁ, সি তো বটে গো-ধান তো তিনটে হল, ইবার তুর চারটে হবে।
তবে?
মাঝি এ ‘তবে’র উত্তর খুঁজিয়া পাইল না। আবার চুপ করিয়া ভাবিতে বসিল। সাঁওতালদের সহিত শ্রীবাসের একটা গোল বাঁধিয়া উঠিয়াছে। দাঙ্গার বৎসর হইতে শ্রীবাস সাঁওতালদের ধান্য-ঋণ দাদন আরম্ভ করিয়াছে। বর্ষার সময় যখন তাহারা জমিতে চাষের কাজে লিপ্ত থাকে, তখন তাহাদের দিনমজুরির উপার্জন থাকে না। সেই সময় তাহারা স্থানীয় ধানের মহাজনের নিকট সুদে ধান লইয়া থাকে এবং মাঘ-ফাল্গুনে ধান মাড়াই করিয়া সুদে আসলে ঋণ শোধ দিয়া আসে। এবার অকস্মাৎ এই বর্ষা নামিয়া পড়ায় ইহারই মধ্যে সাঁওতালদের অনটন আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। অন্য দিক দিয়া চাষও আসন্ন হইয়া আসিয়াছে। তাহারা শ্রীবাসের কাছে ধান ধার করিতে আসিয়াছে। কিন্তু শ্রীবাস বলিতেছে, তাহাদের পূর্বের ধার শোধ হয় নাই। সেই ধারের একটা ব্যবস্থা আগে না করিয়া দিলে আবার নূতন ঋণ সে কেমন করিয়া দিবে? কিন্তু কথাটা তাহারা বেশ বুঝিতে পারিতেছে না, অস্বীকারও করিতে পারিতেছে না। তাহারা চুপ করিয়া বসিয়া শুধু ভাবিতেছে।
কতকগুলি দশ-বারো বছরের উলঙ্গ ছেলে কলরব করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল-মারাং গাডো, মারাং গাডো। খিক্ড়ী! অর্থাৎ বড় ইঁদুর, বড় ইঁদুর, খেঁকশিয়াল! কথা বলিতে বলিতে উত্তেজনায় আনন্দে তাহাদের চোখ বিস্ফারিত হইয়া উঠিতেছে; কালো কালো মূর্তিগুলির বিস্ফারিত চোখের সাদা ক্ষেতের মধ্যে ছোট ছোট কালো তারাগুলি উত্তেজনায় থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।
কাঠের ওস্তাদ সর্বাগ্রে ব্যগ্রতায় চঞ্চল হইয়া উঠিল, সে বলিল, ও-কারে? কুথাকে?
বনের জঙ্গলের ধারে গো! ভূঁয়ের ভিতর থেকে গুল গুল করে বার হছে গো।
দুই-তিনজন কলরব করিয়া উঠিল, গোড়া ভুগ্যারে-কো চোঁ-চোঁয়াতে। অর্থাৎ গর্তের ভিতর সব চোঁ-চোঁ করছে।
এইবার সকলেই আপানাদের ভাষায় কমলের সহিত কি বলা-কওয়া করিয়া উঠিয়া পড়িল। শ্রীবাস রুষ্ট হইয়া বলিল, লাফিয়ে উঠলি যে ইঁদুরের নাম শুনে? আমার ধানের কি করবি, করে যা।
ওস্তাদ বলিল, আমরা কি বুলব গো? উই মোড়ল বুলবে আমাদের। আর যাব না তো খাব কি আমরা? তু ধান দিবি না বুলছিস। ঘরে চাল নাই, ছেলেপিলে সব খাবে কি? ওইগুলা সব পুঁড়ায়ে খাব।
পাড়ার ভিতর হইতে তখন সার বাঁধিয়া জোয়ান ছেলে ও তরুণীর দল বর্ষণ মাথায় করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছে-ইঁদুর-খেঁকশিয়ালের সন্ধানে। ছেলের দল আরও চঞ্চল হইয়া উঠিল, সমস্বরেই বলিয়া উঠিল, দেলা-দেলা! চল চল!
বুড়ার দলও ছেলেদের পিছনে পিছনে তাহাদেরই মত নাচিতে নাচিতে চলিয়া গেল।
শ্রীবাস অকস্মাৎ লোলুপ হইয়া উঠিল; সে কমলকে বলিল, মোড়ল বল্ কেনে ওদের, খরগোশ পেলে আমাকে যেন একটা দেয়।
আসল ব্যাপারটা খুবই সোজা, সাঁওতালেরা সেটা বেশ বুঝতে পারে; কিন্তু আসল সত্যের উপরে জাল বুনিয়া শ্রীবাস যে আবরণ রচনা করিয়াছে, সেটা খুবই জটিল-তাহার জট ছাড়াইতে উহারা কিছুতেই পারিতেছে না। শ্রীবাস চায় সাঁওতালদের প্রাণান্তকর পরিশ্রমে গড়িয়া তোলা জমিগুলি। সে কথা তাহারা মনে মনে বেশ অনুভব করিতেছে; কিন্তু ঋণ ও সুদের হিসাবের আদি-অন্ত তাহারা কোনমতেই খুঁজিয়া পাইতেছে না। তিন বৎসরের মধ্যেই তাহাদের জমিগুলিকে প্রথম শ্রেণীর জমিতে তাহারা পরিণত করিয়া তুলিয়াছে। জমির ক্ষেত্রে সুসমতল করিয়াছে, চারিদিকের আইল সুগঠিত করিয়া কালীর পলিমাটিতে গড়া জমিকে চষিয়া খুঁড়িয়া সার দিয়া তাহাকে করিয়া তুলিয়াছে স্বর্ণপ্রসবিনী। চরের প্রান্তভাগ যে-জমিটা চক্রবর্তী-বাড়ি খাসে রাখিয়া তাহাদের ভাগে বিলি করিয়াছে, সেগুলিকে পর্যন্ত পরিপূর্ণ জমির আকার দিয়া গড়িয়া ফেলিয়াছে। শ্রীবাসের জমি তাহারাই ভাগে করিতেছে, সে-জমিও প্রায় তৈয়ারী হইয়া আসিল। বে বন্দোবস্তী বাকী চরটার জঙ্গল হইতে তাহারা জ্বালানির জন্য আগাছা ও ঘর ছাওয়াইবার উদ্দেশ্যে বেনা-ঘাস কাটিয়া প্রায় পরিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। তাহাদের নিজেদের পল্লীর পাশে পাশে আম কাঁঠাল মহুয়া প্রভৃতি চারাগুলি মানুষের মাথা ছাড়াইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে, শজিনাডালের কলমগুলিতে তো গত বৎসর হইতেই ফুল দেখা দিয়াছে। বাঁশের ঝাড়্গুলিতে চার-পাঁচটি করিয়া বাঁশ গজাইয়াছে, শ্রীবাস হিসাব করিয়াছে, এক-একটি বাঁশ হইতে যদি তিনটি করিয়াও নূতন বাঁশ গজায় তবে এই বর্ষাতেই প্রত্যেক ঝাড়ে পনেরো-কুড়িটি করিয়া নূতন বাঁশ হইবে।
জায়গাটিও আর পূর্বের মত দুর্গম নয়, শ্রীবাসের দোকানের সম্মুখ দিয়া যে রাস্তাটা গাড়ির দাগে দাগে চিহ্নিত হইয়াছিল, সেটি এখনও সুগঠিত পরিচ্ছন্ন একটি সাধারণের ব্যবহার্য রাস্তায় পরিণত হইয়াছে। রাস্তাটা সোজা সাঁওতাল-পল্লীর ভিতর দিয়া নদীর বুকে যেখানে নামিয়াছে, সেইখানেই এখন খেয়ার নৌকা ভিড়িয়া থাকে, এইটাই এখন এ-পারের খেয়াঘাট। খেয়ার যাত্রীদের দল এখন এইদিকেই যায় আসে। গাড়িগুলিও এই পথে চলে। রাস্তার এ-প্রান্তটা সেই গাড়ির চাকার দাগে দাগে একেবারে এ-পাড়ের চক আফজলপুরের পাকা সড়কের সঙ্গে গিয়া মিশিয়াছে। ওই পাকা সড়কে যাইতে যাইতে মুরশিদাবাদের ব্যাপারীদের কলাই, লঙ্কা প্রভৃতির গাড়ি এখানে আসিতে শুরু করিয়াছে। তাহারা কলাই, লঙ্কা বিক্রয় করে ধানের বিনিময়ে। এখানে কলাই, লঙ্কা বেচিবার সুবিধা করিতে পারে না, তবে সাঁওতালদের অল্প দর দিয়া ধান কিছু কিছু কিনিয়া লইয়া যায়। গরু-ছাগল কিনিবার জন্য মুসলমান পাইকারদের তো আসা-যাওয়ার বিরাম নাই। দুই-চারি ঘর গৃহস্থেরও এ-পারে আসিয়া বাস করিবার সঙ্কল্পের কথা শ্রীবাসের কানে আসিতেছে। সে-বন্দোবস্তি ও-দিকের ওই চরটার উপর তাহাদের দৃষ্টি পড়িয়াছে। ঘাস ও কাঠ কাটিয়া সাঁওতালরাই ও-দিকটাকে এমন চোখে পড়িবার মত করিয়া তুলিল। আবার ইহাদের গরুর পায়ে পায়ে এবং ঘাস ও কাঠবাহী গাড়ির চলাচলে ওই জঙ্গলের মধ্যেও একটা পথ গড়িয়া উঠিতে আর দেরি নাই। নবীন ও রংলালের সহিত দাঙ্গা করার জন্য শ্রীবাস এখন মনে মনে আফসোস করে। এত টাকা খরচ করিয়া একশত বিঘা জমি লইয়া তাহার আর কি লাভ হইয়াছে? লাভের তুলনায় ক্ষতিই হইয়াছে বেশি। আজ চক্রবর্তী বাড়িতে গিয়া জমি বন্দোবস্ত লইবার পথ চিরদিনের মত রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। মামলার খরচে তাহার সঞ্চয় ব্যয়িত হইয়া অবশেষে মজুমদারের ঋণ তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। মামলা না করিয়া বাকি চরটা সে যদি বন্দোবস্ত লইত, তবে সে কেমন হইত? আর গোপনে দখল করিবারও উপায় নাই, ছোট রায়-ইন্দ্র রায়ের শ্যেনদৃষ্টি এখন এখানে নিবদ্ধ হইয়া আছে। রায় এখন চক্রবর্তীদের বিষয়-বন্দোবস্তের কর্তা। সে দৃষ্টি, সে নখরের আঘাতের সম্মুখিন হইতে শ্রীবাসের সাহস হয় নাই। সেদিনের সেই সর্বরক্ষাতলার বলির কথা মনে করিয়া বুক এখনও হিম হইয়া যায়। এখন একমাত্র পথ আছে, ওই সাঁওতালদের উঠাইয়া ওই দিকে ঠেলিয়া দিয়া এদিকটা যদি কোনরূপে গ্রাস করিতে পারা যায়। জমি-বাগান-বাঁশ লইয়া এ দিকটা পরিমাণে কম হইলেও এটুকু নিখাদ সোনা।
ভাবিয়া চিন্তিয়া শ্রীবাস জাল রচনা করিয়াছে। মাকড়সা যেমন জাল রচনা করে, তেমনি ভাবেই হিসাবের খাতায় কলমের ডগার কালির সূত্র টানিয়া যোগ দিয়া গুণ দিয়া জালখানিকে সে সম্পূর্ণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাই সে বলিতেছে, আমার খাতায় টিপছাপ দিয়ে বকেয়ার একটি আধার করে দে। তারপর আবার ধান লে কেনে?
একা বসিয়া অনেক ভাবিয়া কমল বলিল, হা পাল মশায়, ইটী কি করে হল গো? আমরা বছর বছর ধান দিলম যি! তুর ছেলে লিলে!
হাসিয়া পাল বলিল, দিস নাই এমন কথা বলেছি আমি?
তবে? বাকিটো তবে কি করে বুলছিস গো?
এই দেখ, বোঙাজাতকে কি করে সমঝাই, বল দেখি? আচ্ছা শোন্, ভাল করে বুঝে দেখ্। যে ধানটো তোরা নিলি, এই তোর হিসেবই খুলছি আমি। এই দেখ্ পহিল সালে তু নিলি তিন বিশ ধান। তিন বিশের বাড়ি, মানে সুদ ধর্ গা যেঁয়ে-দেড় বিশ। হল গা যেঁয়ে-সাড়ে চার বিশ! বটে তো?
কমল হিসেব নিকাশের মধ্যে ভাল ঠাওর পাইল না, বলিল, হুঁ, সি তো হল।
পাল আবার আরম্ভ করিল, তারপর তু দিলি সে বছর তিন বিশ আটি আড়ি পাঁচ সের। বাকি থাকল বাইশ আড়ি পাঁচ সের-মানে, এক বিশ দু আড়ি পাঁচ সের। তার ফিরে বছর তুই নিয়েছিস তিন বিশ চোদ্দ আড়ি। আর গত বছরের বাকি এক বিশ দু আড়ি পাঁচ সের। আর সুদ ধর দু বিশ তিন আড়ি আড়াই সের।
কমল দিশা হারাইয়া বলিল, হুঁ।
পাল হাসিয়া বলিল, তবে? তবে যে বলছিস, কি করে হল গো? ন্যাকা সাজছিস্?
কমল চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। শ্রীবাস ছেলেকে বলিল, সাজ তো বাবা, কড়া দেখে এক কল্কে তামুক। বাদলে-বাতাসে শীত ধরে গেল। কি বলে রে মাঝি, শীত-শীত করছে, তোদের কথায় কি বলে?
কমল কোন উত্তর দিল না, পালের ছেলে তামাক সাজিতে সাজিতে হাসিয়া বলিল, রবাং হো রাবাং কানা, নয় রে মাঝি?
পাল কৃত্রিম আনন্দিত-বিস্ময়ের ভঙ্গীতে বলিল, তুই শিখেছিস নাকি রে? শিখিস শিখিস। বুঝলি মোড়ল, ওকে শিখিয়ে দিস তোদের ভাষা।
কিন্তু কমল ইহাতে খুশি হইল না। সে গভীর চিন্তায় নীরব হইয়া বসিয়া রহিল। পালের ছেলে তামাক সাজিয়া একটু আড়ালে নিজে কয়েক টান টানিয়া হুঁকাটি বাপের হাতে দিল; পাল দেওয়ালে ঠেস দিয়া ফড়াৎ ফড়াৎ শব্দে হুঁকায় টান দিতে আরম্ভ করিল। দূরে চরের প্রান্তভাগে বন্যার কিনারায় কিনারায় উত্তেজনায় আত্মহারা সাঁওতালদের আনন্দন্মত্ত কোলাহল উঠিতেছে। সে কোলাহলের মধ্যে নদীর ডাকও ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে। আকাশে সীসার আস্তরণের মত দিগন্ত বিস্তৃত মেঘের কোলে কোলে ছিন্ন ছিন্ন খণ্ড কালো মেঘ অতিকায় পাখীর মত দল বাঁধিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। শ্রীবাস বাহ্য উদাসীনতার আবরণের মধ্যে থাকিয়া উৎকণ্ঠিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কমলের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। কমলকে আপ্যায়িত করিবার নানা কৌশল একটার পর একটা আবিষ্কার করিয়া আবার সেটাকে নাকচ করিতেছিল, পাছে কমল তাহার দুর্বলতা ধরিয়া ফেলে। সহসা সে একটা কৌশল আবিষ্কার করিয়া খুশী হইয়া উঠিল এবং কৃত্রিম ক্রোধে ছেলে ধমকাইয়া উঠিল, বলি গনেশ, তোর আক্কেলটা কেমন, বল দেখি? মোড়ল মাঝি বসে রয়েছে কখন থেকে, বর্ষা-বাদলের দিন, এইটুকু তামাকের পাতা, একটু চুন তো দিতে হয়! সাঁওতাল হলেও মোড়ল হল মান্যের লোক।
গনেশ ব্যস্ত হইয়া তামাকের পাতা ও একটা কাঠের চামচে করিয়া চুন আনিয়া মোড়লের কাছে নামাইয়া দিল। মোড়ল চুন ও তামাকপাতা লইয়া খইনি তৈয়ার করিতে আরম্ভ করিল। এতক্ষণে সে যেন খানিকটা চেতন ফিরিয়া পাইল, বলিল, ধান যখন নিলম আপনার ঠেঞে, তখন সিটি দিব না, কি করে বুলব গো মোড়ল?
পাল হাসিয়া বলিল, এই! মাঝি, সব বেচে মানুষ খায়, কিন্তু ধরম বেচে খেতে নাই। তোরা দিবি না-এ ভাবনা আমার এক দিনও হয় নাই। তোর সঙ্গে কারবার করছি এতদিন,তোকে আমি খুব জানি। তবে কি জানিস, এই মামলা-মোকদ্দমায় পড়ে আমি নিজে কিছু দেখতে পারলাম না। ছেলেগুলো সব বোকা, ছেলেমানুষ তো। বছর বছর হিসেব করে যদি বলে দিত যে, মাঝি এই তোদের সব বাকি থাকল, তবে তো এই গোলটি হত না। আমি এবার খাতা খুলে দেখে তো একেবারে অবাক!
কমল খানিকটা খইনি ঠোঁটের ফাকে পুরিয়া বলিল, হুঁ, আমরাও তো তাই হলাম গো।
শ্রীবাস ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলিয়া উঠিল, তার জন্য ছেলেগুলোকে আমি মারতে শুধু বাকি রেখেছি। আবার ক্ষণিক নীরবতার পর বলিল, এবার থেকে সূক্ষ্ম হিসাব করে আমি নিজে বসে তোদের ঝঞ্ঝাট মেরে দোব, কিছু ভাবিস না তোরা।
কমল বলিল, হুঁ, সেইটি তু করে দিবি মোড়ল।
নিশ্চয়। এখন এক কাজ কর্, তোরা বাপু খাতাতে যে বাকি আছে, সেই বাকির হিসেবে একটা টিপছাপ দে। আর কার কি ধান চাই বল্, আমি জুড়ে দেখি, কত ধান লাগবে মোটমাট। তারপর লে কেনে ধান কালই।
কমল টিপছাপের নামে আবার চুপ করিয়া গেল। টিপসহিকে উহাদের বড় ভয়। ওই অজানা কালো কালো দাগের মধ্যে যেন নিয়তির দুর্বার শক্তি তাহারা অনুভব করে। খত শোধ করিতে না পারিলে শুধু তো এখানেই শাস্তি হইয়া শেষ হইবে না! আরও, খত কেমন করিয়া সর্বস্ব গ্রাস করে, সে তো এই বয়েসে কত বার দেখিয়াছে। কালো দাগগুলো যেন কালো ঘোড়ার মত ছুটিয়া চলে।
শ্রীবাস বলিল, তোদের তো আবার পূজো-আচ্চা আছে, ধান পোঁতার আগে সেই সব পূজোটুজো না করে তো চাষে লাগতে পারবি না?
আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কমল বলিল, হুঁ।
কি পরব বলে রে একে, নাম কি পরবের?
নাম বটে ‘বাতুলি’ পরব। আবার ‘কদ্লেতা’ পরবও বুলছে। ‘রোওয়া’ পরবও বলে। ‘বাইন’ পরবও বুলছে। যারা যেমন মনে করে, বুলে।
পরব কি হবে তুদের?
কমল এবার খানিকটা উৎসাহিত হইয়া উঠিল, ‘জাহর সারনে’ -আমাদের দেবতার থানে গো, পূজা হবে। ‘এডিয়াসিম’-আমাদের মোরগাকে বলে ‘এডিয়াসিম’, ওই মোরগা কাটা হবে, পচুই মদ দিব দেবতাকে, শাক দিব দু-তিন রকম। তারপর রাঁধা-বাড়া হবে উই দেবতা থানে, লিয়ে খেঁয়ে-দেয়ে সব লাচগান করব।
তবে তো অনেক ব্যাপার রে! তা আমাদিগে নেমন্তন্ন করবি না?
কমল বড় বড় দাঁত মেলিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল, কৌতুক করিয়া বলিল, আপুনি আমাদের হাঁড়ি মদ খাবি মোড়ল?
শ্রীবাস বলিল, তা আমাকে না হয় দোকান থেকে ‘পাকিমদ’ এনে দিবি!
কমল পশ্চাদপদ হইল না, বলিল হুঁ, তা দিব।
হা-হা করিয়া হাসিয়া শ্রীবাস বলিল, না না, ও আমি ঠাট্টা করছিলাম।
কমল মাথা নাড়িয়া বলিল, উঁ-হুঁ, সি হবে না। আমি যখুন নেওতা দিলম, তখুন তুকে উটি লিতে হবে।
বেশ, তা দিস্। সে হবে কবে তোদের?
জল তো হয়েই গেল গো। এই ধানটি হলেই পূজো করব। তারপরে চাষে লেগে যাব। তা আপুনি ধান দিবি তবে তো হবে।
বেশ। সবাইকে নিয়ে আয়, এসে টিপছাপ দিয়ে দে, পরশু নিয়ে নে ধান। ধান তো আমার এখানেই আছে।
কমল ম্লানমুখে বলিল, তাই দিবে সব কাল।
গনেশ বলিল, মোড়ল ধান নিতে দোকানে সব সকালে সকালে পাঠিয়ে দিস একটু। আজ তো আবার তোদের অনেক কিছু চাই রে; ইঁদুর, খরগোশ খেঁকশিয়াল মারলি, মসলাপাতি চাই তো?
কমল হাসিয়া বলিল, হুঁ। বলিতে বলিতে অকস্মাৎ যেন একটা অতি প্রয়োজনীয় কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল, বলিল, ‘ডিবিয়া সুনুম’ এনেছিস গো? করঙ্গা সুনুম জ্বলছে না ভাল বাতাসে।
হ্যাঁ, এক টিন কেরোসিন তেল এনেছি, বলে দিস সব ডিবিয়াও এনেছি। তোর নাতনীর হাতে একটা লণ্ঠন দেখেছিলাম মাঝি, ওটা কোথা কিনলি রে?
কমল বলিল, উ উয়াকে রাঙাবাবুর মা দিয়েছে। ভাগে জমি করেছে জামাইটো, মেয়েটা উনিদের পাটকাম করছে কিনা।
শ্রীবাসের হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, বলিল, আচ্ছা, তোর নাত-জামাই তো কই ধান নেয় না মোড়ল? আবার তোর সঙ্গে পৃথকও তো বটে।
কমল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বিয়া দিলেই বেটী পর হয়ে যায় গো! আর জামাইটো হল পরের ছেলে। আমরা বুলছি কি জানিস, এটাঃ হপন বীর, সিম বাকো আপনারোয়াঃ-মানে বুলছে জামাইটো পরের ছেলে, বনের মুরগীর মত উ পোষ মানে না।
ও দিক হইতে কলরব করিতে করিতে শিকার সমাধা করিয়া সাঁওতালদের দল ফিরিতেছিল। পুরুষ নারী ছেলে-বাদ বড় কেহ ছিল না। অধিকাংশের হাতেই ছোট লাঠি, জন-কয়েকের কাঁধে ধনুক, হাতে তীর, খালি হাত যাহাদের তাহারাও রাশীকৃত মরা ইঁদুর, গোটাকয়েক খেঁকশিয়াল, গোটা-চারেক বুনো খরগোশ লেজে দড়ি ঝুলাইয়া লইয়া চলিয়াছে। সেই দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটির হাতে ছিল দুইটা খরগোশ, সে অভ্যাসমত দর্পিত উচ্ছল ভঙ্গীতে আসিয়া কমলকে আপনাদের ভাষায় বলিল, এ-দুটা রাঙাবাবুকে দিতে হইবে। তুমি বল ইহাদের, ইহারা বলিতেছে, দিসে না। রাঙাবাবু ও-পারের ঘাটে বসিয়া আছে, আমি তাকে দেখিয়াছি।
দলের তরুণীগুলি সকলেই সমস্বরে সায় দিয়া উঠিল, হ্যাঁ হ্যাঁ। হুই লদীর উ পারে বসে রইছে। আমরা দেখলাম। আমাদের রাঙাবাবু।
শ্রীবাসের খরগোশ মাংসের উপর প্রলোভন ছিল, সে তাড়াতাড়ি বলিল, হ্যাঁ মাঝি, আমি যে বললাম একটা খরগোশের জন্য, আমাকে একটা দে।
কমলের নাতনীই শ্রীবাসকে জবাব দিল। কেহ কিছু বলিবার পূর্বেই সে বলিল, কেনে, তুকে দিব কেনে? তুকে দিব তো আমরা কি খাব?
শ্রীবাস ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিল, এ তো আচ্ছা মেয়ে রে বাবা। ওই তো তোরা দিতে যাচ্ছিস রাঙাবাবুকে। তা আমাকে দিবি না কেনে?
কমলের নাতনী পরম বিস্ময়ের সহিত একটা আঙুল শ্রীবাসের দিকে দেখাইয়া আপনাদের ভাষায় বলিয়া উঠিল, এ লোকটা পাগল, না খ্যাপা?
মেয়ের দল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। শ্রীবাসের ছেলে গনেশ সাঁওতালী ভাষা বুঝিতে পারে; তাহার মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিল, সে কঠিন স্বরেই বলিয়া উঠিল, এই সারী, যা-তা বলিস না বলছি।
কমলের ওই নাতনীর নাম সারী; শুক-সারীর সারী নয়-উহাদের ভাষায় সারীর অর্থ উত্তম ভাল। সারী বলিল, কেনে বুলবে না? ই কথা উ বলছে কেনে? রাঙাবাবুর সাথে সাথ করছে কেনে? উ আমাদের জমিদার, আমাদিগে জমি দিলে, আমাদিকে ধান দেয়; তুদের মত সুদ লেয় না।
সারীর কথার ভঙ্গিতে কমলও এবার লজ্জিত হল, সে যথাসম্ভব মোলায়েম করিয়া বলিল, উনিকে সবাই খুব ভালবাসে মোড়ল, উনি আমাদের রাঙাঠাকুরের লাতি।
মেয়েগুলো মুগ্ধ বিস্ময়ের সুরে বলিয়া উঠিল আপনাদের ভাষায়, তিমুনি আগুনের পারা রং!-আঃ য়-গো! বিস্ময়সূচক ‘আয়-গো’ শব্দটির দীর্ঘায়িত ধ্বনির সুর তাহাদের কণ্ঠে সঙ্গীতধ্বনির মতই বাজিয়া উঠিল।