১৫
সর্বনাশা চর।
উহার বুকের মধ্যে কোথাও যেন লুকাইয়া আছে রক্তবিপ্লবের বীজ। দাঙ্গায় খুন হইয়া গেল একটা; তাহার উপর জখমের সংখ্যাও অনেক। চরের ঘাস বাহিয়া রক্তের ধারা মাটির বুকে গড়াইয়া পড়িল।
সুনীতি যেন দিশাহারার মত ভাঙিয়া পড়িলেন। রক্তাক্ত চরের কথা ভাবিতে গেলেই আরও খানিকটা রক্তাক্ত ভূমির কথা তাঁহার মনে জাগিয়া উঠে। চক্রবর্তী-বাড়ির কাছারির রক্তাক্ত প্রাঙ্গণ। হতভাগ্য ননী পাল। উঃ সে কি রক্ত! সেই রক্তের ধার কি ওপারের চরের দিকে গড়াইয়া চলিয়াছে? চরের রক্তের স্রোতের সঙ্গে কি ননীর রক্তের ধারা মিশিয়া গেল? নিরাশ্রয় দৃষ্টি মেলিয়া তিনি শূন্যলোকের নীলাভ মায়ার পরপারের আশ্রয় খুঁজিয়া ফেরেন।
ওদিকে ইহার পরে মামলা-মকদ্দমা আরম্ভ হইয়া গেল।
প্রথমে অবশ্য চালান গেল উভয় পক্ষই; শ্রীবাস ও তাহার পক্ষীয় কয়েকজন লাঠিয়াল এবং এ-পক্ষের রংলাল, নবীন ও আরও চার-পাঁচজন। কিন্তু মজুমদারের তদ্বীরে, শ্রীবাসের অর্থের প্রাচুর্য্যে, শ্রীবাসের পক্ষই আইনের চক্ষে নির্দোষ বলিয়া প্রতিপন্ন হইল। শ্রীবাসের ন্যায্য অধিকারের উপর চড়াও হইয়া নবীনের দল দাঙ্গা করিয়াছে, যাহার ফলে নরহত্যা পর্যন্ত হইয়া গিয়াছে-এই অপরাধে তাহারা দায়রা-সোপর্দ হইয়া গেল। রংলাল অনেকদিন পর্যন্ত দৃঢ় ছিল, কিন্তু শেষের দিকে সে ভাঙিয়া পড়িল। রাজসাক্ষীরূপে শ্রীবাসের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করিয়া সে নবীনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিল। তবু ঘরে মুখ লুকাইয়া সে কাঁদিত, বার বার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিত, ভগবান নবীনকে বাঁচাইয়া দাও। শ্রীবাসের অন্যায় তুমি প্রকাশ করিয়া দাও। কিন্তু ভগবান হয় বধির, নয় মূক।
সংবাদ শুনিয়া সুনীতি কাঁদিলেন। নবীনের জন্য তাঁহার মর্মান্তিক দুঃখ হইল। এই বাড়ির তিন পুরুষের চাকর এই নবীনের বংশ তাঁহাদের ছাড়ে নাই। নবীনই ছিল এ-বাড়ির শেষ বাহুবল। সেও চলিয়া যাইবে। নবীনকে যে যাইতে হইবে, তাহাতে তাঁহার সংশয় নাই। তাঁহার মন বার বার সেই কথা বলিতেছে। সর্বনাশা চর!
চরটার কথা ভাবিতে বসিয়া সুনীতি এক-এক সময় শিহরিয়া উঠেন। মনশ্চক্ষে তিনি যেন একটা নিষ্ঠুর চক্রান্তের ক্রুর চক্রবেগ চরখানাকে এই বাড়িটাকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হইতে দেখিতে পান। এ আবর্ত হইতে সরিয়া যাইবার যেন পথ নাই। মহীকে বলি দিয়াও সরিয়া যাওয়া গেল না। প্রাণপণ শক্তিতে সরিয়া যাইবার চেষ্টা করিলেও সরিয়া যাওয়া যায় না। সঙ্গে সঙ্গে যেন চক্রান্তের চক্র-পরিধি বিস্তৃত হইয়া যায়, বাড়ির সংশ্লিষ্ট জনকে আবর্তে ফেলিয়া সেই নিমজ্জমান জনের সহিত বন্ধনসূত্রের আকর্ষণে আবার টানিয়া এ-বাড়ির আবর্তের মধ্যে ফেলিয়া দেয়। নবীনের মামলায় সেটা সুনীতি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইতেছেন। দায়রার মামলায় তাঁহাকে পর্যন্ত টানিয়া প্রকাশ্য আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হইবে। অহীন্দ্রকেও সাক্ষ্য দিতে হইয়াছে। রামেশ্বরের অবস্থা সেই দিন হইতে অতি শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে, এখন তিনি প্রায় বদ্ধ পাগল। ভাবিতে ভাবিতে সুনীতি আর কূল কিনারা দেখিতে পান না, তাঁহার অন্তরাত্মা থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠে। ভবিষ্যতের একটা করাল ছায়া যেন ওই কল্পিত আবর্তের ভিতর হইতে সমুদ্রমন্থনের শেষ ফল গরল বাস্পের মত কুণ্ডলী পাকাইয়া পাকাইয়া উঠিতে থাকে। সে বিষবাস্পের উগ্র তিক্ত গন্ধের আভাস যেন তিনি প্রত্যক্ষ অনুভব করিতেছেন।
জীবনে তাহার স্মৃতির ভাণ্ডার-অক্ষয় ভাণ্ডার, কোনটি ভুলিবার উপায় নাই।
আদালতের পিয়ন একেবারে অন্দরে দরজার মুখে আসিয়া সমন জারি করিয়া গেল। মানদা দারুন ক্রোধে অগ্রসর হইয়া গিয়া সরকারী চাপরাসযুক্ত লোক দেখিয়া নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, এত বড় মুখরার মুখেও কথা সরিল না। পিয়নটাই বলিল, দায়রা-মামলার সাক্ষী মানা হয়েছে সুনীতি দেবীকে। সাত দিন পরে আঠারই আষাঢ় দিন আছে। হাজির না হলে ওয়ারেন্ট হবে।
লোকটা চলিয়া গেল। মানদা কয়েক মুহূর্ত পরেই আত্মসম্বরণ করিয়া দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল। তাহার অনুমান সত্য। বাড়ির ফটকের বাহিরে তখন লোকটি আরও দুইটি লোকের সহিত মিলিত হইয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহাদের একজন যোগেশ মজুমদার, অপর জন শ্রীবাস। সে প্রতিহিংসাপরায়ণা সাপিনীর মতই প্রতিপক্ষকে দংশন করিবার জন্য অন্ধকার রাত্রের মত একটি সুযোগ কামনা করিতে করিতে ফিরিল।
সাক্ষীর সমন পাইয়া সুনীতি বিহ্বল হইয়া পড়িলেন। তাঁহার অবস্থা হইল দুর্যোগভরা অন্ধকার রাত্রে দিগ্ভ্রান্ত পথিকের মত। এ কি করিবেন তিনি? কেমন করিয়া প্রকাশ্য আদালতে শত চক্ষুর সম্মুখে তিনি দাঁড়াইবেন? আপন অদৃষ্টের উপরে তাঁহার ধিক্কার জন্মিয়া গেল। এ যে লঙ্ঘন করিবার উপায় নাই। দায়রা-আদালতের সমন অগ্রাহ্য করিলে ওয়ারেন্ট হইবে; গ্রেপ্তার করিয়া হাজির করাই সেক্ষেত্রে বিধি। আদালতের পিয়নের কথা তাঁহার কানে যেন এখনও বাজিতেছে।
ছি ছি ছি! আপন অদৃষ্টের কথা ভাবিয়া তিনি ছি-ছি করিয়া সারা হইয়া গেলেন। ছিল, পথ ছিল-একমাত্র পথ। কিন্তু সেও তাঁহার পক্ষে রুদ্ধ। মরিয়া নিস্কৃতি পাইবারও যে উপায় তাঁহার নাই। অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ অসহায় স্বামীর কথা মনে করিয়া প্রতিদিন দেবতার সম্মুখে তাঁহাকে যে কামনা করিতে হয়, ঠাকুর, এ পোড়া অদৃষ্টে যেন বৈধব্যের বিধানই তুমি ক’রো। সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে কঙ্কণ নিয়ে মৃত্যুভাগ্য আমি চাই না, চাই না, চাই না। সে দুর্ভাগ্যের ভাগ্যই তাঁহার জীবনের যে একমাত্র কামনা।
মানদা ক্রোধে ক্রূর হইয়া ফিরিয়া আসিতেই তিনি দিশেহারার মত বলিলেন, আমি কি করব মানদা?
মানদা উত্তর দিতে পারিল না। মর্মান্তিক দুঃখ, অসহ্য রাগে সে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া ফেলিল। কিছুক্ষণ পরে সে চোখের জল মুছিয়া উপর দিকে মুখ তুলিয়া বলিল, মাথার পরে তুমি বজ্জাঘাত কর। নিব্বংশ কর। তবেই বুঝব তোমার বিচার; নইলে তুমি কানা-কানা-কানা।
সুনীতি এত দুঃখের মধ্যেও শিহরিয়া উঠিলেন, বলিলেন, ছি মা, আমার অদৃষ্ট। কেন পরকে মিথ্যে শাপ-শাপান্ত করছিস?
মিথ্যে? আমি তো আমার চোখের মাথা খাই নাই মা, মুখপোড়া ভগবানের মত। আমি যে নিজের চোখে দেখে এলাম!
মজুমদার আর শ্রীবাস চাষা। দুজনে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল গো। এ যে তাদের কীর্তি গো।
মজুমদার ঠাকুরপো! না না, এতখানি ছোট কি মানুষ হতে পারে?
মানদা ক্রোধে আত্মবিস্মৃত হইয়া গেল, সে দুই হাত নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, নাও, দু হাত তুলে আশীর্বাদ মজুমদারকে-কর। সে আবার অকস্মাৎ ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
সুনীতি মূর্তিমতি হতাশার মত উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সর্বনাশা চর!
অকস্মাৎ তাঁহার মনে হইল, ওদিকে ঠাকুর-বাড়ির দরজায় কে যেন আঘাত করিয়া ইঙ্গিতে আগমনের সাড়া জানাইতেছে। কোন মেয়েছেলে নিশ্চয়। এদিকের দুয়ার দিয়া যাওয়া-আসার অধিকার কেবল মহিলাদেরই। তিনি বলিলেন, দেখ্ তো মানদা, কে ডাকছেন।
মানদা শুনিয়াছিল, সে কিন্তু বেশ বুঝিয়াছিল, আসিয়াছেন রায়-বাড়ির কোন বধূ বা কন্যা। আজিকার ঘটনা লইয়া লজ্জা দিতে আসিয়াছেন। বলিল, ডাকবে আবার কে? রায়গুষ্টির কেউ এসেছে। তোমাকে বলতে এসেছে, ছি ছি ছি! তোমাকে আদালতে সাক্ষী মেনেছে! কি ঘেন্নার কথা! খুলব না আমি দরজা, চুপ করে থাক তুমি।
উত্তেজনায় মানদা এমন জ্ঞান হারাইয়াছিল যে, সুনীতিকে সে বার কয়েক ‘তুমি’ বলিয়া সম্ভাষণ করিয়া ফেলিল।
সুনীতি বলিলেন, না, দরজা খুলে দেখ্, কে এসেছেন। খবরদার, কোন কড়া কথা বলিস না যেন।
গজগজ করিতে করিতে গিয়া দরজা খুলিয়াই মানদা বিস্ময়ে সম্ভ্রমে সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। এই স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে তাহাদের দুয়ারে দাঁড়াইয়া ছোট রায়-বাড়ির গিন্নী হেমাঙ্গিনী, সঙ্গে তাঁহার বারো-তেরো বৎসরের মেয়ে উমা।
মানদা প্রসন্ন হইতে পারিল না। সুনীতি কিন্তু পরম আশ্বাসে আশ্বস্ত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, দিদি! মনে মনে যেন আপনাকেই আমি খুঁজছিলাম দিদি।
হেমাঙ্গিনী সুন্দর হাসি হাসিয়া বলিলেন, আমি কিন্তু কিছু জানতে পারি নি ভাই। দেবতা-টেবতা বলো না যেন। আজ আমি তোমার দাদার দূত হয়ে এসেছি। তিনিই পাঠালেন আমাকে।
সুনীতি ঈষৎ শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, কেন দিদি?
বলছি। আরে উমা গেল কোথায়? উমা! উমা!
উমা ততক্ষণে বাড়ির এদিক ওদিক সব দেখিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। কোথায় এক কোণ হইতে সে উত্তর দিল, কি?
হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, করছিস কি? এখানে এসে বস।
উত্তর আসিল, আমি সব দেখছি।
সুনীতি হাসিয়া বলিলেন, অ-উমা-মা, এখানে এস না, তোমায় একবার দেখি।
উমা আসিয়া দরজায় দুই হাত রাখিয়া দাঁড়াইল, বলিল, আমাকে ডাকছেন?
সুনীতি বলিলেন, বাঃ, উমা যে বড় চমৎকার দেখতে হয়েছে, অনেকটা বড় হয়ে গেছে এর মধ্যে! ওকে কলকাতায় আপনার বাপের বাড়িতে রেখেছেন, নয় দিদি?
হ্যাঁ ভাই, এখানকার শিক্ষা-দীক্ষার ওপর আমার মোটেই শ্রদ্ধা নেই। ছেলেকে অনেক দিন থেকেই সেখানে রেখেছি, মেয়েকেও পাঠিয়ে দিয়েছি এক বছরের ওপর। তারপর মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, উনি কিন্তু ভারী চঞ্চল আর ভারী আদুরে। সেখানে গিয়ে কেবল বাড়ি আসবার জন্যে ঝোঁক ধরেন। অমল কিন্তু আমার খুব ভাল ছেলে, সে এখানে আসতেই চায় না। বলে, ভাল লাগে না এখানে।
উমা ঘাড় নাড়িয়া নাড়িয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, তা লাগবে কেন তার? দিনরাত্রি সে কলকাতায় ঘুরছেই-ঘুরছেই। বন্ধু কত তার সেখানে। আর আমাকে একা মুখটি বন্ধ করে থাকতে হয়। সে বুঝি কারও ভাল লাগে?
সুনীতি হাসিলেন, বলিলেন, আপনি ভারী কঠিন দিদি, এই সব ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন কেমন করে? ছেলেকে অবশ্য পাঠাতেই হয়, কিন্তু এই দুধের মেয়ে, একেও পাঠিয়ে দিয়েছেন?
হেমাঙ্গিনী কোন উত্তর দিলেন না, শুধু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। মেয়েকে বলিলেন, যা তুই, দেখে আয়, এদের বাড়িটা ভারী সুন্দর, কিন্তু কাল দুপুরের মত বাইরে গিয়ে পড়িস নে যেন।
উমা চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী এতক্ষণে সুনীতিকে বলিলেন, জান সুনীতি, এই বাড়ির কথাই আমার মনে অহরহ জাগে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, ঠাকুরজামাইয়ের এই অবস্থার কারণ, এ-বাড়ির এই দুর্দশার একমাত্র কারণ হল রাধারাণী-ছোট রায় বংশের মেয়ে। এত বড় দাম্ভিক মুখরার বংশ আর আমি দেখি নি ভাই। আমার ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে মেয়েকে আমি এর হাত থেকে বাঁচতে চাই। রাধারাণীর অদৃষ্টের কথা ভাবি আর আমি শিউরে উঠি।
সুনীতি চুপ করিয়া রহিলেন, হেমাঙ্গিনী একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, তোমার দাদাই আমাকে পাঠালেন, তোমার কাছেই পাঠালেন।
সুনীতি ইন্দ্র রায়ের বক্তব্য শুনিবার জন্য উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে হেমাঙ্গানীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, হেমাঙ্গিনী বলিলেন, দায়রা মামলায় মজুমদারের চক্রান্তে যে তোমাকে সাক্ষী মানা হয়েছে, সে তিনি শুনেছেন।
মুহূর্তে সুনীতি কাঁদিয়া ফেলিলেন, সে কান্নায় কোন আক্ষেপ ছিল না, শুধু দুইটি চোখের কোণ বাহিয়া দুটি অশ্রুধারা গড়াইয়া পড়িল। হেমাঙ্গিনী সস্নেহে আপনার অঞ্চল দিয়া সুনীতির মুখ মুছাইয়া দিয়া বলিলেন, কাঁদছ কেন? সেই কথাই তো তোমার দাদা বলে পাঠালেন তোমাকে, সুনীতি যেন ভয় না পায়, কোন লজ্জা-সঙ্কোচ না করে। রাজার দরবারে ডাক পড়েছে, যেতে হবে, কিসের লজ্জা এতে?
আবার সুনীতির চোখের জলে মুখ ভাসিয়া গেল, তিনি নিজেই এবার আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, কিন্তু ওঁকে কার কাছে রেখে যাব দিদি? সেই যে আমার সকলের চেয়ে বড় ভাবনা। তারপর আমিই বা কার সঙ্গে সদরে যাব?
হেমাঙ্গিনী চিন্তাকুল মুখে বলিলেন, প্রথম কথাটাই আমরা ভাবি নি সুনীতি। শেষটার জন্যে তো আটকাচ্ছে না। সে তোমার ছেলেকে আসতে লিখলেই হবে, অহীনই তোমার সঙ্গে যাবে। কিন্তু-
সুনীতি বলিলেন, আরও কি ভাবছি জানেন? ওঁর ওই মাথার গোলমালের ওপর এই খবরটা কানে গেলে যে কি হবে, সেই আমার সকলের চেয়ে বড় ভাবনা। এই দাঙ্গার আগের দিন, মজুমদার ঠাকুরপো ওই শ্রীবাস পালকে সঙ্গে করে একেবারে বাড়ির মধ্যে চলে এলেন। আমি কি করব ভেবে না পেয়ে ছুটে গেলাম ওঁর কাছে। কথাটা বলেও ফেলেছিলাম। সেই শুনে কেমন যেন হয়ে গেলেন, বললেন, আমায় একটু জল দিতে পার সুনীতি? আমি বুঝলাম, বুঝে মাথা ধুয়ে দিলাম, বাতাস করলাম; কিন্তু তবুও সমস্ত রাত্রি ঘুমোলেন না। তাই ভাবছি, এই কথা কানে গেলে উনি কি তা সহ্য করতে পারবেন?
হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন, তিনি উপায় অনুসন্ধান করিতেছিলেন। কিছুক্ষন পর বলিলেন, তুমি বলে রাখ এখন থেকে, তুমি ব্রত করেছ, তোমায় গঙ্গাস্নানে যেতে হবে। ঠাকুরজামাইয়ের সেবাযত্নের ভার আমার ওপর নিশ্চিন্ত হয়ে দিতে পারবে তো তুমি?
সুনীতি বিস্ময়ে আনন্দে হতবাক হইয়া হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, আবার অজস্র ধারায় তাঁহার চোখ বাহিয়া জল ঝরিতে আরম্ভ করিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অহীনকে আসতে চিঠি লেখ। রাত্রে সে ওঁর কাছে থাকবে; আমি তা হলে এ-বাড়ি ও-বাড়ি দু বাড়িই দেখতে পারব। আর তোমার সঙ্গে আমার অমলকে পাঠিয়ে দেব। কেমন?
সুনীতির চোখে আবার অশ্রুধারা-প্রবাহের বিরাম ছিল না। হেমাঙ্গিনী আবার তাঁহার চোখ-মুখ সযত্নে মুছাইয়া দিয়া বলিলেন, কেঁদো না সুনীতি। আমিও যে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না। আরও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হেমাঙ্গিনী ডাকিলেন, উমা! উমা!
উমার সাড়া কিন্তু কোথাও মিলিল না। হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, বংশের স্বভাব কখনও যায় না। মুখপুড়ী কলকাতা থেকে এসে এমন বেড়াতে ধরেছে! বলে, দেখব না, কলকাতায় এমন মাঠ আছে? আকাশে মেঘ উঠেছে, এখুনি বৃষ্টি নামবে–মেয়ের সে খেয়াল নেই।
সুনীতি ডাকিলেন, মানদা! উমা-মা কোথায় গেল রে? দেখ্ তো। মানদারও সাড়া পাওয়া গেল না, সুনীতি ঘর হইতে বারান্দায় বাহির হইয়া আসিয়া দেখিলেন দিবানিদ্রার পরম আরামে মানদার নাক ডাকিতেছে। অকস্মাৎ তাঁহার মনে হইল, উপরে কোথায় যেন কলকণ্ঠে কেহ গান বা আবৃত্তি করিতেছে। হেমাঙ্গিনীও বাহির হইয়া আসিলেন, তাঁহারও কানে সুরটা প্রবেশ করিল, তিনি বলিলেন, ওই তো!
সুনীতি বলিলেন, ওঁর ঘরে।
সন্তর্পণে উভয়ে রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, উমা গম্ভীর একাগ্রতার সহিত ছন্দলীলায়িত ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া সুমধুর কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করিতেছে-
নয়নে আমার সজল মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে
নয়নে লেগেছে।
নবতৃণদলে ঘনবনছায়ে
হরষ আমার দিয়েছি বিছায়ে,
পুলকিত নীপ-নিকুঞ্জে আজি
বিকশিত প্রাণ জেগেছে।
নয়নে সজল স্নিগ্ধ মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে।।
সম্মুখে রামেশ্বর বিস্ফারিত বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে আবৃত্তিরতা স্বচ্ছন্দভঙ্গী উমার দিকে চাহিয়া আছেন। হেমাঙ্গিনী ও সুনীতি ঘরে প্রবেশ করিলেন; তিনি তাহা জানিতেও পারিলেন না। বালিকার কলকণ্ঠের ঝঙ্কারে, নিপুণ আবৃত্তির শব্দার্থে সৃজিত রূপস্বপ্নে, কবিতার ছন্দের অন্তর্নিহিত সঙ্গীত-মাধুর্যে, একটি অপূর্ব আনন্দময় ভাবাবেশে ঘরখানি বর্ষার সজল মেঘময় আকাশতলের শ্যামলস্নিগ্ধ ছায়াছন্ন কৃষিক্ষেত্রের মত পরিপূর্ণ হইয়া ভরিয়া উঠিয়াছে। তাঁহারাও নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিলেন। শ্লোকে শ্লোকে আবৃত্তি করিয়া উমা শেষ শ্লোক আবৃত্তি করিল-।
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মত নাচে রে
হৃদয় নাচে রে।
ঝরে ঘনধারা নব পল্লবে,
কাঁপিছে কানন ঝিল্লীর রবে,
তীর ছাপি’ নদী কল-কল্লোলে
এল পল্লীর কাছে রে।
হৃদয় আমার নাচে রে
ময়ূরের মত নাচে রে
হৃদয় নাচে রে।।
আবৃত্তি শেষ হইয়া গেল। ঘরের মধ্যে সেই আনন্দময় আবেশ তখনও যেন নীরবতার মধ্যে ছন্দে ছন্দে অনুভূত হইতেছিল। রামেশ্বর আপন মনেই বলিলেন, নাচে-নাচে-হৃদয় সত্যিই ময়ূরের মত নাচে!
হেমাঙ্গিনী এবার প্রীতিপূর্ণ কণ্ঠে বলিলেন, ভাল আছেন চক্রবর্তী মশায়?
কে? স্বপ্নোত্থিতের মত রামেশ্বর বলিলেন, কে? তারপর ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন, রায়-গিন্নী! আসুন আসুন, কি ভাগ্য আমার!
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ও রকম করে বললে যে লজ্জা পাই চক্রবর্তী মশায়। আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। তারপর কন্যাকে বলিলেন, তুমি প্রণাম করেছ উমা? নিশ্চয় কর নি! তোমার পিসেমশায়।
সবিস্ময়ে রামেশ্বর প্রশ্ন করিলেন, আপনার মেয়ে?
হ্যাঁ।
সাক্ষাৎ সরস্বতী। আহা, ‘ময়ূরের মত নাচে রে হৃদয় নাচে রে।’ কি মধুর!
উমা এই ফাঁকে টুপ করিয়া রামেশ্বরের পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিয়া লইল। পায়ে স্পর্শ অনুভব করিয়া দৃষ্টি ফিরাইয়া উমাকে প্রণাম করিতে দেখিয়া রামেশ্বর চমকিয়া উঠিলেন, আর্তস্বরে বলিলেন, না না, আমাকে প্রণাম করতে নেই। আমার হাত-
হেমাঙ্গিনী বাধা দিয়া সকরুণ মিনতিতে বলিয়া উঠিলেন, চক্রবর্তী মশায়, না না।
রামেশ্বর স্তব্ধ হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর ম্লান হাসিয়া বলিলেন, জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আকাশে মেঘ করেছে-দিক্হস্তীর মত কালো বিক্রমশালী জলভরা মেঘ। মহাকবি কালিদাসকে মনে পড়ে গেল। আপনার মনেই শ্লোক আবৃত্তি করছিলাম মেঘদূতের। এমন সময় আপনার মেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। আমার মনে হল কি জানেন? মনে হল চক্রবর্তী-বাড়ির লক্ষ্মী বুঝি চিরদিনের মত পরিত্যাগ করে যাবার আগে আমাকে একবার দেখা দিতে এসেছেন। আমি আবৃত্তি বন্ধ করলাম। আপনার মেয়ে-কি নাম বললেন?
হেমাঙ্গিনী উত্তর দিবার পূর্বে উমাই উত্তর দিল, উমা দেবী।
উমা দেবী। হ্যাঁ, তুমি উমাও বটে দেবীও বটে। উমা আমায় বললে, কিসের মন্ত্র বলছিলেন আপনি? আর একবার বলুন না। আমি বললুম মন্ত্র নয়, শ্লোক, সংস্কৃত কবিতা। কবি কালিদাস মেঘদূতে বর্ষার বর্ণনা করেছেন, তাই আবৃত্তি করছিলাম। উমা আমায় বললে, আপনি বাংলা কবিতা জানেন না? কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি কি পুরস্কার পেয়েছেন! তাঁর খুব ভাল কবিতা আছে। আমি বললাম, তুমি জান? ও আমায় কবিতা শোনালে। বড় সুন্দর কবিতা, বড় সুন্দর। বাংলায় এমন কাব্য রচিত হয়েছে! ভাগ্য, আমার ভাগ্য-পৃথিবীতে বঞ্চনাই আমার ভাগ্য। বাঃ, ‘নীল অঞ্জন লেগেছে নয়নে লেগেছে’!
সকলেই স্তব্ধ হইয়া রহিল। উমা কিন্তু চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিল, কয়েক মুহূর্ত কোনরূপে আত্মসম্বরণ করিয়া সে বলিল, আপনি কিন্তু সংস্কৃত শ্লোক আমায় শোনাবেন বলেছে!
রামেশ্বর হাসিয়া বলিলেন, তোমার মত সুন্দর করে কি বলতে আমি পারব মা?
উমা হাসিয়া বলিল, ওটা আমি আবৃত্তি-প্রতিযোগিতার জন্যে শিখেছিলাম কিনা। কিন্তু আপনিও তো খুব ভাল বলছিলেন, বলুন আপনি।
রামেশ্বর কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া লইয়া বলিলেন, বলি শোন-
তাং পার্বতীত্যাভিজনেন নাম্না বন্ধুপ্রিয়াং বন্ধুজনো জুহাব।
উমেতি মাত্রা তপসো নিষিদ্ধা পশ্চাদুমাখ্যাং সুমুখী জগাম।।
মহীভূতঃ পুত্রবতোহপি দৃষ্টান্তস্মিন্নপত্যে ন জগাম তৃপ্তিম্।
অনন্ত পুস্পস্য মধ্যোর্হি চুতে দ্বিরেফমালা সবিশেষসঙ্গা।।
এর মানে জান মা? পর্বতরাজ হিমালয়ের এক কন্যা হল, গোত্র ও উপাধি অনুসারে আত্মীয়বর্গ, বন্ধুজন প্রিয় সেই কন্যার নাম রেখেছিল পার্বতী। পরে হিমাদ্রী-গৃহিণী সেই কন্যাকে তপস্যপরায়ণা দেখে বললেন, উমা! অর্থাৎ-বৎসে, করো না, তপস্যা করো না। সেই থেকে সুমুখী কন্যার নাম হল উমা। তারপর কবি বলেছেন, পর্বতরাজের পুত্র-কন্যা আরও অনেকেই ছিল, কিন্তু বসন্তকালে অসংখ্যবিধ পুস্পের মধ্যে ভ্রমর যেমন সহকারপুস্পেই অনুরক্ত হয়, তেমনি পর্বতরাজের চোখ দুটি উমার মুখের পরেই আকৃষ্ট হত বেশি, সেইখানেই ছিল যেন পূর্ণ পরিতৃপ্তি। তুমি আমাদের সেই উমা। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি, তুমি প্রচুর বিদ্যাবতী হবে। আজ যা তুমি শোনালে-আহা! সেই উমারই মত বিদ্যা তোমার আপনি আয়ত্ত হবে।
তাং হংসমালাঃ শরদীব গঙ্গাং মহোষধিং নক্তমিবাত্মভাসঃ।
স্থিরোপদেশামুপদেশকালে প্রপেদিরে প্রাক্তনজন্মাবিদ্যাঃ।।
হেমাঙ্গিনী ও সুনীতির চোখ জলে ভরিয়া উঠিয়াছিল। এই এক মানুষ, আবার এই মানুষই ক্ষণপরে এমন অসহায় আত্মবিস্মৃত হইয়া পড়িবেন, নিজের প্রতি নিজেরই অহেতুক ঘৃণায় এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করিবেন যে, অন্যের ইচ্ছা হইবে আত্মহত্যা করিতে।
উমা বলিল, আমায় সংস্কৃত কবিতা শেখাবেন আপনি? এখানে যে কদিন আছি আমি রোজ আপনার কাছে আসব?
আসবে? তুমি আসবে মা?
হ্যাঁ। কিন্তু এমন করে ঘরের মধ্যে দরজা-জানলা বন্ধ করে থাকেন কেন আপনি? ওগুলো খুলে দিতে হবে কিন্তু।
মুহূর্তে রামেশ্বরের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, তিনি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিলেন, বহুকষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, রায়-গিন্নী, আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না?