কালিন্দী – ১১

১১

ভোরবেলাতেই রংলাল সদলে আসিয়া ডাকাডাকি শুরু করিল। অতি প্রত্যুষে উঠিয়া কাজ করার অভ্যাস মানদার চিরদিনের; সে কাজ করিতে করিতেই বিরক্ত হইয়া উত্তর দিল, কে গো তুমি? তুমি তো আচ্ছা নোক! এই ভোরবেলাতে কি ভদ্দর নোকে ওঠে নাকি? এ কি চাষার ঘর পেয়েছ নাকি?

রংলাল বিরক্ত হইয়া উঠিল, কণ্ঠস্বরের মধ্যে যথাসাধ্য গাম্ভীর্যের সঞ্চার করিয়া সে বলিল, ডেকে দাও, ছোটদাদাবাবুকে ডেকে

দাও। জরুরী কাজ আছে।

কি, কাজ কি?

তুমি মেয়েছেলে নোক, তুমি সে বুঝবে না। জরুরী কাজ।

মানদার স্বর এবার রুক্ষ হইয়া উঠিল, সে বলিল, জরুরী কাজ আছে, তোমার আছে। আমার কি দায় পড়েছে যে, এই ভোরবেলাতে ঘুম ভাঙাতে গিয়ে বকুনি খাব? আর তুমি এমন করে চেঁচিও না বলছি, ঘুম ভেঙে গেলে আমাকে বকুনি খেতে হবে।

রংলাল বুঝিল, মানদা মিথ্যা কথা বলিতেছে, একটু মাতব্বরি করিবার চেষ্টা করিতেছে। অহীন্দ্রকে সে ভাল করিয়াই জানে, তিনি নিজেই তাহাকে ভোরবেলা ডাকিবার জন্য বলিয়া রাখিয়াছেন। মনে মনে সে একটু হাসিয়া সে কণ্ঠস্বর উচ্চ করিয়া ডাকিল, ছোটদাদাবাবু! ছোটদাদাবাবু! ছোটবাবু!

দোতলার উপর হইতে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং রুক্ষ স্বরে কে উত্তর দিল, কে? কে তুমি?

সে কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যে ও রুক্ষতায় রংলাল চমকিয়া উঠিল, বুঝিল, কর্তা রামেশ্বর অকস্মাৎ জাগিয়া উঠিয়াছেন; ভয়ে সে শুকাইয়া গেল। তাহার সঙ্গে আরও যে কয়েকজন আসিয়াছিল, তাহারাও সভয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বাড়ির ভিতরে উঠান হইতে উত্তর দিল মানদা, বলিল, আমি বার বার বারণ করলাম দাদাবাবু, তা কিছুতেই শুনলে না। বলে, তুমি মেয়েছেলে নোক, বুঝবে না, জরুরী কাজ।

এবার অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বর বেশ বোঝা গেল, সে কণ্ঠস্বরে এখনও ঈষৎ অপ্রসন্নতার আভাস ছিল, অহীন্দ্র বলিল, ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। রংলাল বুঝি? হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই তো আসতে বলেছিলাম।

রংলাল বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গিয়াছিল, সে তখনও ভাবিতেছিল, সে কণ্ঠস্বর ছোটদাদাবাবুর? অহীন্দ্রের এই পরিবর্তিত স্বাভাবিক কথার কোন উত্তর দিতে পারিল না।

অহীন্দ্র আবার বলিল,এই আমি এলাম বলে রংলাল। একটু অপেক্ষা কর।

কিছুক্ষণ পরেই হাসিমুখে সে ভিতর হইতে কাছারির দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া আসিল। বারান্দায় একা রংলাল নয়, তাহাদের পুরানো নগদী নবীন লোহার ও আরও দুই-তিনজন রংলালের অন্তরঙ্গ চাষী অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। নবীনের হাতে হাত-চারেক লম্বা খান-চারেক বাখারি, রংলালের হাতে এক আঁটি বাবুইদড়ি, অন্য একজনের হাতে গোটাচারেক লাল কাপড়ের পতাকা।

অহীন্দ্র দলটিকে দেখিয়া হাসিমুখে বলিল, ওঃ, তোমরা তো খুব ভোরে এসেছ রংলাল? আমি আবার ভোরে উঠতে পারি না। কিন্তু, ও লাল পতাকা কি হবে নবীন?

রংলাল একটু আহত হইয়াছিল, সে কোন উত্তর দিল না। উত্তর দিল নবীন লোহার, তাহাদের পুরানো নগদী, আজ্ঞে, আজ আমাদের কায়েমী দখল হবে কিনা, তাই চার কোণে পুঁতে দিতে হবে।

কল্পনাটা অহীন্দ্রের খুব ভাল লাগিল, সে বলিল, বাঃ, সে বেশ হবে। চল এখন, বেলা হয়ে যাচ্ছে।

রংলাল ক্ষুণ্ণস্বরে বলিল, ঘুমটা আপনার এই সকালে ভাঙিয়ে দিলাম দাদাবাবু! ভারি ভুল হয়ে গেল মশাই, টুকচে পড়ে ডাকলেই হত।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, না না, সে ভালই হয়েছে রংলাল। হঠাৎ ঘুম ভাঙলেই আমার মেজাজ বড় খারাপ হয়ে যায়। তোমাদের কিছু বলি নি তো রংলাল?

রংলাল এইটুকুতেই যেন জল হইয়া গেল, বলিল, আজ্ঞে না। সে আমরা কিছু মনে করি নাই। এখন চলুন, রোদ উঠলে তখন আবার ভারি কষ্ট হবে আপনার।

ক্ষুদ্র বাহিনীটি বাহির হইয়া পড়িল। রংলাল কিন্তু উসখুস করিতেছিল, তাহার কয়েকটা কথা এখনও বলা হয় নাই। কাল হইতেই কথাটা বলিবার সঙ্কল্প তাহার ছিল, কিন্তু অহীন্দ্রের রুক্ষতার আঘাতে সমস্তই কেমন উল্টাইয়া গেল। পথ চলিতে চলিতে অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া কথাটার ভূমিকা রূপেই সে হাসিয়া বলিল, বুঝলে লবীন এই যে কথায় বলে,বাঘের প্যাটে বাঘ হয়, সিংগীর প্যাটে সিংগী হয়, এ কিন্তু মিথ্যে লয়।

নবীন অর্থও বুঝিল না, উদ্দেশ্যও বুঝিল না, কিন্তু গম্ভীরভাবে কথাটাকে সমর্থন করিয়া বলিল, নিচ্চয়।

অহীন্দ্র কৌতুকে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

রংলাল বলিল, হাসবেন না দাদাবাবু, হাসির কথা লয়। আমার পিলুই বলে চমকে উঠেছিল! বুঝলে লবীন, দাদাবাবু হাঁকলেন, কে, কে তুমি? বললে না পেত্যয় যাবে ভাই, আমার ঠিক মনে হল কর্তাবাবু উঠে পড়েছেন- একেবারে অবিকল।

নবীন বলিল, ইটি তুমি ঠিক বলেছ মোড়ল, অবিকল। আমিও ভেবেছিলাম ঠিক তাই। রংলাল উৎসাহিত হইয়া বলিল, তাই তো বলছি হে, বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়। আমি এক এক সময় ভাবতাম, আঃ, দাদাবাবু কি করে আমাদের জমিদার সেজে বসবে? তা সে ভাবনা আজ আমার গেল।

অহীন্দ্র গম্ভীরভাবে মাথাটি অল্প নীচু করিয়া নীরবে চলিতেছিল, মনে মনে লজ্জা অনুভব না করিয়া সে পারিতেছিল না। তাহার মনে হইতেছিল দেশ-বিদেশের কত মহাপুরুষের কথা। তাঁহাদের আদর্শের তুলনায় জমিদার! ছিঃ!

রংলাল আবার বলিল, সাঁওতালদের জমি আমি দেখেছি, মোটমাট তা তোমার বিঘে পঞ্চাশেক, তার বেশি হবে না। আর ধর আমাদের পাঁচজনের দশ বিঘে করে পঞ্চাশ বিঘে, এই পঞ্চাশ বিঘে মাপতে আর কতক্ষণ লাগবে? পহরখানেক বেলা না হতেই হয়ে যাবে। অ্যাঁ, ও লবীন?

নবিন বলিল, তা বইকি। আমি তোমার চারখানা দাঁড়া নিয়ে এসেছি। চারজনাতে মাপলে কতক্ষণ?

রংলাল বলিল, বুঝলেন দাদাবাবু, আমরা পাঁচজনায় জমি নেবার খবর একবার ছড়ালে হয়; দেখবেন, গাঁয়ের যত চাষী সব একেবারে হত্যে দিয়ে পড়বে।

অহীন্দ্র বিস্মিত হইয়া বলিল, তোমরাও জমি নেবে নাকি? কই, সে কথা তো বল নি?

রংলাল বলিল, এই দেখেন, ইয়ের মধ্যে ভুলে গিয়েছেন দাদাবাবু? সেই দেখেন, পেথম দিনই কাছারিতে আপনার সঙ্গে দেখা, আপুনি নিয়ে গেলেন বাড়িতে, গিন্নীমায়ের কাছে। আমাদের চাষীরা সব রব তুলেছিল, জমি আমাদের, জমি আমাদের। আমিই তো আজ্ঞে বলে দিলাম, চক আফজলপুরের সঙ্গে লাগাড় হয়ে যখন চর উঠেছে, তখন আজ্ঞে, ও চর আপনাদের। ই আইন আমার বেশ ভাল করে জানা আছে। তবে হ্যাঁ, ধর্ম যদি ধরেন, ধরে না তো কেউ আজকাল, তা হলে অবশ্যি আমরাও পাই। গিন্নীমাও কথা দিয়েছিলেন, মনে করে দেখেন।

অহীন্দ্র অনেক কিছু ভাবিতেছিল। ইহারা যাহা বলিতেছে তাহা সত্য, এ সত্য সে অস্বীকার করিতেও চাহে নাই। সে বলিতে চাহিতেছিল, আজই যে সেই কথা অনুযায়ী বিলি-বন্দোবস্ত করা হইবে, এ কথা তো হয় নাই। ইহার মধ্যে অনেক কথা আছে যে-সেলামী, খাজনা, পাট্টা, কবুলতি, অনেক কথা। সাঁওতালদের কথা স্বতন্ত্র। আজ তাহারা বসিয়াছে, দশ বৎসর, পনেরো বৎসর বা বিশ বৎসর পরে হয়তো তাহারা চলিয়া যাইবে। তাহাদের জমি জমিদারের খাসে আসিবে। আর ইহাদের স্বত্ব, বংশানুক্রমে দান বিক্রয় সকল রকমের অধিকার ইহারা কায়েমী করিয়া লইবে। তা ছাড়া, সাঁওতালরাই ওই চরকে পরিস্কার করিয়া ফলপ্রসবিনী করিয়াছে। তাহাদের দাবির সহিত কাহারও দাবি সমান হইতে পারে না।

রংলাল বলিল, জুতো খুলতে হবে না দাদাবাবু, আসুন, কাঁধে করে আমি পার করে দিই।

কালীন্দির ঘাটে সকলে আসিয়া পড়িয়াছিল। অহীন্দ্র রংলালকে নিরস্ত করিয়া বলিল, থাক। -বলিয়া জুতা জোড়াটি খুলিয়া নিজেই তুলিয়া লইতেছিল।

কিন্তু তাহার পূর্বেই রংলাল খপ করিয়া তুলিয়া লইয়া একরূপ মাথার উপর ধরিয়া বলিল, বাবা রে, আমরা থাকতে আপনি জুতো বয়ে নিয়ে যাবেন! সর্বনাশ!

নদীর ওপারে চরের প্রবেশ-পথে সাঁওতালেরা দল বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তাহারাও সাগ্রহে প্রতীক্ষা করিয়া আছে। কিশোরবয়স্ক ছেলেগুলি পর্যন্ত আজ গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া চরাইতে যায় নাই।

রংলাল বলিল, ওঃ, ই যি ছা-ছামুড়ি পর্যন্ত হাজির রে সব। আজ তোদের ভারী ধুম, না কি রে মাঝি?

কমল মাঝি গম্ভীরভাবে বলিল, তা বেটে বৈকি গো। জমিগুলা আজ সব আমাদের হবে। রাজাকে সব খাজনা দিব, বোঙাকে পূজা দিব।

নবীন রংলালের দিকে চাহিয়া বলিল, দেখ, আমরা বলি সব বুনো বোঙার জাত। তা দেখ, বুদ্ধি দেখ। লক্ষণ-কল্যাণগুলি তো সব বোঝে ওরা!

মোড়ল মাঝি আবার বলিল, হুঁ, বুদ্ধি আছে বৈকি গো। লইলে ধরমটি আমাদের থাকবে কেনে? পাপ হবে যি।

নদীর জলে মুখ ধুইবার জন্য অহীন্দ্র একটু পিছাইয়া পড়িয়াছিল, সে আসিয়া উপস্থিত হইতেই আলোচনাটা বন্ধ হইয়া গেল, অহীন্দ্র ব্যস্ত হইয়া বলিল, তা হলে তাড়াতাড়ি কাজ আরম্ভ কর, নইলে রোদ্দুর হবে।

মোড়ল মাঝি আপন ভাষায় কি বলিল। মিনিট দূয়েকের মধ্যেই একটা ছেলে প্রকাণ্ড একটা ছাতা আনিয়া হাজির করিল। বাঁশের বাখারি ও শলা দিয়ে তৈয়ারি কাঠামোর উপরে নিপুণ করিয়া গাঁথা শালপাতার ছাউনি; ছাউনির উপরে কোন গাছের বল্কলের সুতায় আলপনার মত কারুকার্য; অহীন্দ্র ছাতাটি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল।

বলিল, বাঃ, ভারী সুন্দর ছাতা তো মাঝি। তোমরা তৈরী করেছ?

হুঁ গো। আমরা সব করতে পারি গো বাবু। অ্যানে- ক পারি। ই ছাতাটি তুর করলে যেঁয়ে আমাদের মাঝিন। আমি খুব বড়মানুষ কিনা, তাথেও ইটিও করলে এ-ত ব-ড়!

* * *

প্রথমেই নবীন চরের চারটি কোণ বাছিয়া চার কোণে লাল পতাকা চারিটা পুঁতিয়া দিয়া আসিল। তারপরই আরম্ভ হইল জরিপ। দেশীয় মতে চার হাত লম্বা বাঁশের দাঁড়া দিয়া মাপ আরম্ভ হইল।

রংলাল বলিল, মাঝি, তু নাম বলে যা; দাদাবাবু, আপুনি নিখে নিয়ে যান। শেষকালে যার যত হিসাব করে জমিজমা ঠিক করা

যাবে।

কমল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, সি কেনে গো, ইয়ার নাম উয়ার নাম, সি তুরা লিখে কি করবি? একেবারে লিখে লে কেনে।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, তা হলে কাকে কত খাজনা লাগবে, কার কত জমি, সে সব কেমন করে ঠিক হবে মাঝি?

কমল বলিল, সি সব আবার আমরা ঠিক করে লিব গো। আপন আপন মেপে ঠিক করে লিব। তুদের হিসাব আমরা সি বুঝতে লারব।

রংলাল, নবীন ও তাহাদের সঙ্গীরা উৎসাহিত হইয়া উঠিল, কাজ তাহাদের অনেক সহজ হইয়া যাইবে, টুকরো টুকরো জমি মাপিবার প্রয়োজন হইবে না, একেবারে সাঁওতালদের অধিকৃত জায়গাটা মাপিয়া লইলেই খালাস। সে মাপ শেষ হইলেই তখন তাহারা আপন আপন জমি মাপিয়া ঠিক করিয়া লইতে পারিবে। এইটুকুর জন্য অকারণে তাহাদের মনে যে উদ্বেগ জমিয়া রহিয়াছে। রংলাল বলিল, সেই ভাল দাদাবাবু, ওদের ভাগ ওরা আপনারা আপনারা করে লেবে। আপনার ইস্টেটে থাকুক এক নামে একটা জমা হয়ে। সি আপনার ভাল হবে।

কাঠের পুতুল নাচের ওস্তাদ আসিয়া মোড়ল মাঝিকে কি বলিতেছিল। তাহার বক্তব্য শেষ হইতে না হইতেই কমল মাঝি যেন ফুলিয়া আয়তনে বড় হইয়া উঠিল, দেহচর্মে বার্ধক্য জনিত যে ঈষৎ কুঞ্চন দেখা দিয়াছিল, দেহ-স্ফীতির আকর্ষণে সে কুঞ্চন যেন মিলাইয়া গেল। ওস্তাদের কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই কমল তাহার গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় বসাইয়া দিল। মুখে বলিল, সামান্য দুইটি কথা, সে কথা দুইটার মধ্যেও দুর্দান্ত ক্রোধের সুর রনরন করিতেছিল। লোকটা চড় খাইয়া বসিয়া পড়িল, সমবেত সাঁওতালদের মুখ দেখিয়া মনে হইল, ভীষণ ভয়ে তাহারা সঙ্কুচিত স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। কমল মাঝি তখনও ক্রোধে ফুলিতেছিল। আকস্মিক এমন পরিণতিতে স্তম্ভিত হইয়া অহীন্দ্র নীরবেই কারণ অনুসন্ধানের জন্য চারিদিক একবার চাহিয়া দেখিল, কিন্তু কমল মাঝির ভয়ঙ্কর রূপ আর চারিদিকে সকলের মুখে ভয়ের সুস্পষ্ট ছাপ ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাইল না। রংলাল, নবীন ও তাহাদের সঙ্গের লোকগুলি পর্যন্ত ভয় পাইয়াছে। অহীন্দ্র কমল মাঝির দিকেই চাহিয়া প্রশ্ন করিল, কি কমল, হল কি? ওকে মারলে কেন?

এই মূর্তিতেও কমল যথাসাধ্য বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল, আজ্ঞে রাজাবাবু, মানুষটা দুষ্টু করছে। বুললে, আমি মোড়ল-টোড়ল মানি না।

সবিস্ময়ে অহীন্দ্র বলিল, কেন?

এবার প্রহৃত ওস্তাদ হাতজোড় করিয়া করুণ কণ্ঠে সভয়ে বলিল, আজ্ঞে রাজাবাবু, দোষ আমার হইছে, দোষটি আমার হইছে। আমি বুললাম, জমি সব আলাদা আলাদা করে দিতে। আমরা সব চ্যাঁকলিব্ব্যাধি আলাদা আলাদা করে লিব বুললাম। তাথেই আমি মোড়লের মনটি খারাপ করলাম। দোষটি আমার হল।

কমল আপন ভাষায় গজগজ করিয়া অনেক কথা বলিয়া গেল, সুরে বোঝা গেল সে ঐ ওস্তাদকে তিরস্কার করিতেছে। কিন্তু তবুও সে দুর্দান্ত কমল আর নাই। কমলের কথা শেষ হইতেই চারিপাশের মেয়ের দল কলকল করিয়া বকিতে আরম্ভ করিল, সেও ঐ লোকটিকে তিরস্কার করিয়া, মোড়লকে সমর্থন করিয়া।

অহীন্দ্র বলিল, তা হলে তোমাদের সমস্ত জমি একসঙ্গে জরিপ হবে তো?

হুঁ, আমার নামে লিখে লে কাগজে, টিপছাপ লিয়ে লে আগে। বুলে দে, খাজনা কত হবে, আমরা সব মিটায়ে দিব। তবে ঐ যে আপনার কি বুলিস গো, সালামী না কি উ আমরা লারব দিতে। আমি সব ইয়াদের কাছে আদায় করে খাজনা আপনার কাছারিতে দিয়ে

আসব।

নবীন এতক্ষণে সাহস পাইয়া হাসিয়া বলিল, তু তা হলে এদের জমিদার হলি, তোর আবার জমিদার হল আমাদের দাদাবাবু–না কি?

উ-হুঁ। আমি মোড়ল হলাম, রাজা বেটে-জমিদার বেটে আমাদের রাঙাবাবু।

মাপ আরম্ভ হইল, রাম দুই তিন চার-আড়ে হল গা একশ চল্লিশ দাঁড়া।

নবীন ও রংলাল দুইজনে মিলিয়া জমিটার কালি করিয়া পরিমাণ খাড়া করিল, চল্লিশ বিঘা কয়েক কাঠা হইল। অহীন্দ্র বিশেষ মনযোগ দিয়া হিসাবের পদ্ধতিটা দেখিতেছিল। ছেলেবেলায় পাঠশালায় পড়া বিঘাকালি আর্যার সুরটাই যেন অস্পষ্টভাবে কানে বাজিয়া উঠিল, ‘কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিজ্যে, কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্যে।’

রংলাল বলিল, তা হলে তোদের এখন এই জমি হল মাঝি, চল্লিশ বিঘে, ক কাঠা না হয় ছেড়েই দিলাম। লে, এখন দাদাবাবুর সঙ্গে খাজনা ঠিক করে লে।

কমল অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, হাঁ রাঙাবাবু, আপুনি এবার হিসাব জুড়ে দেখ্‌।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, ঠিক আছে মাঝি।

না, আপুনি একবার দেখ্‌।

দেখেছি।

না, আপনি একবার নিজে দেখ।

অগত্যা অহীন্দ্রকে কাগজ কলম লইয়া বসিতে হইল। তাহার চারিপাশে সাঁওতালরা গম্ভীর হইয়া বসিল, সকলের উদ্‌গ্রীব দৃষ্টি অহীন্দ্রের উপর। ছেলেমেয়েরা কথা বলিতেছিল, মোড়ল মাঝি গম্ভীরভাবে আপন ভাষায় আদেশ করিল, চুপ, চুপ সব, চুপ। রাঙাবাবু হিসাব করিতেছেন, মাটির হিসাব, জরিপের হিসাব।

পাড়ার মধ্যে কয়েকটি তরুণী আঙিনায় বসিয়া মৃদুস্বরে গুনগুন করিয়া গান করিতেছিল-

চেতন দিশ্‌ মরণ্‌ আমিন্‌ বাবু

লতার দিশম্‌রে আড়গুএনা,

জমি-কিন্‌ সংইদা-

জমা কিন্‌ চ্যাপাওইদা

গরিব হড় ও কারে অ্যাম-আঃ।

অর্থাৎ পাহাড়ের উপর হইতে আমিনবাবু আসিয়াছেন, জমি মাপ করিতেছেন, জমা বাড়াইয়া দিতেছেন, কিন্তু আমরা গরিব লোক, আমরা কোথায় পাইব?

একটি মেয়ে বলিল, ই গান বুলতে হবে রাঙাবাবুকে।

কমলের নাতনী বলিল, হুঁ বুলব। বেশী করে খাজনা লিবে কেনে রাঙাবাবু? যাব আমরা উয়ার কাছে।

এখুনি?

উ-হুঁ, মোড়ল মাঝি ক্ষেপে যাবে। বাবা রে!

তবে?

বিকালে আমরা ডাকব বাবুকে। হাঁড়িয়া জম করব, লাচব। উয়াকে ডেকে আনব।

নিতান্ত আকস্মিকভাবেই একটা মেয়ে বিস্ময়মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, কেমন বরন বল্‌ দেখি রাঙাবাবুর? রাঙা লালা ঝক ঝক করছে!

কমলের নাতনী বলিল, -আগুনে-র পারা! রাঙাঠাকুরের লাতি, উ ঠাকুর বেটে।

একটি মেয়ে কি উত্তর দিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিল, কিন্তু আবার মোড়ল মাঝির ক্রুদ্ধ চীৎকারে তাহারা চমকিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজনের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

এবার বচসা হইতেছিল কমল মাঝির সহিত রংলাল এবং নবীনের দলের। সাঁওতালদের জমির পরই পূর্ব দিকে প্রায় বিঘা পঞ্চাশেক চর পড়িয়া আছে, সেই জমিটা পছন্দ করিয়া রংলাল এবং নবীন মাপিতে উদ্যত হইল। কমল মাঝি বলিল, উ জমি তুরা লিবি না মোড়ল, উ আমি দিব না।

রংলাল বিরক্তির সহিত বলিল, দিবি না? কেন?

আমরা তবে আর জমি কুথাকে পাব? আমাদের ছেলেগুলা কি করবে?

তাদের আবার ছেলে হবে, তাদের ছেলে হবে, তাই বলে গোটা চরটাই তোরা আগলে থাকবি নাকি? মাপ হে, মাপ নবীন, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?

নবীন মাপিতে উদ্যত হইবামাত্র কমল তাহার হাতের দাঁড়া চাপিয়া ধরিয়া ক্রুদ্ধ উচ্চ চীৎকারে চীৎকারে বলিয়া উঠিল না, দিব না।

রংলালও এবার যেন ক্ষেপিয়া উঠিল। এই পূর্ব দিকের চরের মাটি সকল দিকের মাটি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, ভাঙিলে ভুরার মত গুঁড়া হইয়া যায়, ভিতরের বালির ভাগ ময়দার মত মিহি, আলু ও আখের উপযোগী এমন মাটি আর বুঝি হয় না। সে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, এই দেখ্‌ মাঝি, ফাটাফাটি হয়ে যাবে বলছি! খবরদার তুই দাঁড়া ধরিস না, বললাম।

একটা ভয়াল হিংস্র হাসি হাসিয়া কমল বলিল, তুকে ধরে আমি মাটিতে পুঁতে দিব।

বারা বার এমন অবাঞ্ছনীয় ঘটনার উদ্ভব হওয়ার জন্য অহীন্দ্রের মনে আর বিরক্তির সীমা রহিল না। সে তাহার কিশোর কণ্ঠের তীক্ষ্ণ কঠিন স্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল, ছাড়, ছাড় বলছি, ছাড়।

কমল এবং রংলাল দুইজনেই এবার সরিয়া দাঁড়াইল।

অহীন্দ্র বলিল, অন্যদিকে জমি পছন্দ করে মেপে নাও নবীন। এ জমি তোমরাও পাবে না, সাঁওতালরাও পাবে না। এদিকটা আমাদের খাসে থাকবে। খাসে চাষ হবে আমার।

জমির মাপ-জোক শেষ করিয়া অহীন্দ্র ফিরিবার সময় বলিল, দেখো, আর যেন ঝগড়া করো না।

একজন মাঝি ছাতাটা লইয়া তাহার সঙ্গে গেল, জৈষ্ঠের রৌদ্রে তখন আগুন ঝরিতে শুরু করিয়াছে। সেই রৌদ্রের মধ্যেই রংলাল, নবীন এবং তাহার সঙ্গী কয়েকজন আপন আপন সীমানা চিহ্নিত করিয়া চারি কোণে চারিটা মাটির ঢিপি বাঁধিতে শুরু করিয়া দিল। সাঁওতালেরা আবার দল বাঁধিয়া আপনাদের হিসাবমত জমি ভাগ করিতে আরম্ভ করিল।

প্রশণ্ড শক্তি প্রয়োগ করিয়া জলহীন কঠিন মাটিতে কোপ মারিতে মারিতে রংলাল বলিল,থাক শালারা, কদিন তোরা এখানে থাকিস, সেও তো আমি দেখছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *