কালিন্দী – ১

নদীর ও-পারে একটা চর দেখা দিয়াছে।

রায়হাট গ্রামের প্রান্তেই ব্রাহ্মণী নদী–ব্রাহ্মণীর স্থানীয় নাম কালিন্দী, লোকে বলে কালী নদী; এই কালী নদীর ও-পারের চর জাগিয়াছে। এখন যেখানে চর উঠিয়াছে, পূর্বে ওইখানেই ছিল কালী নদীর গর্ভভূমি। এখন কালী রায়হাটের একাংশ গ্রাস করিয়া গ্রামের কোলে কোলে বহিয়া চলিয়াছে। গ্রামের লোককে এখন বিশ হাত উঁচু ভাঙন ভাঙ্গিয়া নদীগর্ভে নামিতে হয়।

ওই চরটা লইয়া বিবাদ বাধিয়া উঠিল। রায়হাট প্রাচীন গ্রাম এখানকার প্রাচীন জমিদার-বংশ রায়েরা শাখা-প্রশাখায় বহুধা বিভক্ত। এই বহুবিভক্ত রায়-বংশের প্রায় সকল শরিকই চরটার স্বামীত্ব লাভ করিবার নিমিত্ত এক হাতে লাঠি ও অপর হাতে কাগজ লইয়া অগ্রসর হইলেন। ইঁহাদের মধ্যে আবার মাথা গলাইয়া আসিয়া প্রবেশ করিল জন দুয়েক মহাজন এবং জন কয়েক চাষীপ্রজা। সমস্ত লইয়া বিবদমান পক্ষের সংখ্যা এক শত পনেরোয় গিয়া দাঁড়াইয়াছে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরোধী। জমিদারগণের প্রত্যেকের দাবি–চর তাঁহার সীমানায় উঠিয়াছে, সুতরাং সেটা তাঁহারই খাস-দখলে প্রাপ্য। মহাজন দুইজনের প্রত্যেকের দাবি,–তাঁহার নিকট ‘অবাদ্ধীয়’, জমির সংলগ্ন হইয়া চর উঠিয়াছে, সুতরাং চর তাঁহার নিকট ‘অবাদ্ধীয়’ সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হওয়া উচিত এবং নাকি তাহাই হইতে হইবে। প্রজা কয়েক জনের দাবি–কালীর গ্রাসে এপারে তাহাদের জমি গিয়াছে, সুতরাং ওপারে যে ক্ষতিপূরণ কালী দিয়াছে সে প্রাপ্য তাহাদের।

রায়-বংশের বর্তমানে এক শত পাঁচ জন শরিক, বাকী খাজনার মকদ্দমায় জমিদারপক্ষীয়গণের নাম লিখিতে তিন পৃষ্ঠা কাগজ পূর্ণ হইয়া যায়। ইহাদের মধ্যে যোগ দিয়াছেন এক শত দুই জন। বাকী তিন পক্ষের মধ্যে এক পক্ষের মালিক নিতান্তই সঙ্গতিহীন নাবালক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পক্ষ কিন্তু এখানকার বহুকালের দুইটি বিবাদমান পক্ষ। এক পক্ষ রায়-বংশের দৌহিত্র বংশ, অপর পক্ষ রায়-বংশেরই সর্বাপেক্ষা ধুরন্ধর ব্যক্তি কুট-কৌশলী ইন্দ্র রায়। ইন্দ্র রায়ের হাত গরুড়ের তীক্ষ্ণ নখরের মত প্রসারিত হইলে কখনও শূন্য মুষ্টিতে ফেরে না, ভূখণ্ডও বোধ করি উপড়াইয়া উঠিয়া আসে। এই ইন্দ্র রায়ের অপেক্ষাতেই বিবদমান পক্ষ সকলেরই উদ্যত হস্ত এখনও স্তব্ধ হইয়া আছে, অন্যথায় এতদিন একটা বিপর্যয় ঘটিয়া যাইত।

অপর পক্ষ-ইন্দ্র রায়ের বংশানুক্রমিক প্রতিপক্ষ রামেশ্বর চক্রবর্তী। তিনিও এক কালে ইন্দ্র রায়ের সমকক্ষ ব্যক্তি ছিলেন; কূট বুদ্ধি অপেক্ষা ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁহার বড়; দাম্ভিকতার প্রতিমূর্তি। ইন্দ্র রায়ের সহিত দ্বন্দ্বে ইন্দ্র রায়কেই অস্ত্রস্বরূপ ব্যবহার করিতেন; প্রতি ক্ষেত্রে তিনি সাক্ষী মানিতেন ইন্দ্র রায়কে। ইন্দ্র রায় মিথ্যা বলিলে তিনি হাসিয়া তাঁহার দাবি প্রত্যাহার করিয়া বলিতেন, ‘তোমার সাক্ষী দেওয়ার ফী দিলাম ইন্দ্র। মিছেই খরচ করে সাক্ষীদের তুমি জুতো কিনে দিলে।’ বাড়ি ফিরিয়া তিনি গ্রামে একটা বড় খাওয়া-দাওয়া জুড়িয়া দিতেন।

কিন্তু যে কালের গতিতে যদুপতি যান, তাঁহার মথুরাপুরীও গৌরব হারায়, সেই কালের প্রভাবেই বোধ করি সে রামেশ্বর আজ আর নাই। তিনি নাকি দৃষ্টিহীন হইয়া অন্ধকার ঘরে বিছানায় পড়িয়া আছেন ভূমিশায়ী জীর্ণ জয়স্তম্ভের মত। চোখে নাকি আলো একেবারে সহ্য হয় না, আর মস্তিষ্কও নাকি বিকৃত হইয়া গিয়াছে। সম্পত্তি পরিচালনা করে প্রাচীন নায়েব যোগেশ মজুমদার; যোগেশ মজুমদারের অন্তরালে আছেন শান্ত বিষাদপ্রতিমার মত একটি নারীমূর্তি–রামেশ্বরের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনীতি দেবী। দুইটি পুত্র–বড়টির বয়স আঠারো, ছোটটি সবে পনেরোয় পা দিয়েছে; সম্প্রতি মজুমদার সুনীতি দেবীকে অনেক বলিয়া কহিয়া বড়টিকে পড়া ছাড়াইয়া বিষয়কর্মে লিপ্ত করিয়াছেন। অবশ্য লেখাপড়াতেও তাহার অনুরাগ বলিয়া কিছু ছিল না। এই বিবাদ আরম্ভ হইবার পূর্ব হইতেই মজুমদার এবং রামেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহীন্দ্র এখানে নাই–তাহারা দূর মহালে গিয়াছে মহাল পরিদর্শনে। লোকে বুঝিল, হয় ইন্দ্র রায় প্রতিদ্বন্দ্বীর অপেক্ষায় আছেন, নয় সুযোগের প্রতীক্ষা করিতেছেন, উপযুক্ত সময়ে ছোঁ মারিয়া বসিবেন।

চাষী প্রজারা এতটা বোঝে নাই, তাহারা সেদিন আসিয়া ইন্দ্র রায়কেই ধরিয়া বসিল, হুজুর, আপনি একটা বিচার করে দ্যান।

অতি মৃদু হাস্যের সহিত অল্প একটু ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া তিনি বলিলেন, কিসের রে?–যেন তিনি কিছুই জানেন না।- কার সঙ্গে ঝগড়া হল তোদের?

উৎসাহিত হইয়া প্রজারা বলিল, আজ্ঞে, ওই লদীর উ-পারের চরটার কথা বলছি। ই-পারে আমাদের জমি খেয়ে তবে তো লদী উ-পারে উগ্‌রেছে; আমাদের জমি যে পয়োস্তি হল–তার খাজনা তো আমরা কমি পাই নাই, আমরা তো বছর বছর লোকসান গুনে যাচ্ছি।

বাঁ হাতে গোঁফে তা দিতে দিতে রায় বলিলেন, বেশ তো। লোকসান দিয়ে দরকার কি তোদের? লোকসানী জমা ইস্তাফা দিলেই পারিস। বাঁ হাতে গোঁফে তা দেওয়া রায়ের একটা অভ্যাস। লোকে বলে, ওই সঙ্গে তিনি মনে মনে বুদ্ধিতে পাক মারেন।

প্রজারা হতভম্বের মত মত রায়ের মুখের দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আজ্ঞে, ই তা হলে বিচার কি করলেন আপনি?

হাসিয়া ইন্দ্র রায় বলিলেন, তোরা যা বলবি, তাতে সায় দেওয়ার নামই তো বিচার নয় রে! বিচারের তো একটা আইন আছে, সেই আইনমতেই তো জজকে রায় দিতে হয়।

প্রজারা হতাশ হইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। যাইবার পথে তাহারা পরামর্শ করিয়া উঠিল গিয়া রামেশ্বরবাবুর বাড়ি। কাছারিতে মালিক কেহ নাই, চাকরটা বলিল, বড়বাবুও নাই, নায়েববাবুও নাই, কর্তাবাবুর সঙ্গে তো দেখা হবেই না।

প্রজারা গ্রামেরই লোক, তাহারা সকল সংবাদই রাখে, তাহারা জানে, এখন এ-বাড়ির সর্ব কর্মের অন্তরালে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করে, পরমাশক্তির মত তিনিও নারীরূপিণী। তাহারা বলিল, আমরা মায়ের সঙ্গে দেখা করব।

চাকরটা অবাক হইয়া গেল, এমন ধারার কথা সে কখনও শোনে নাই। সে বলিল, তোমরা কি ক্ষেপেছ নাকি?

রামেশ্বরবাবুর ছোট ছেলে অহীন্দ্র পাশেই একখানা ঘরে পড়িতেছিল, সে এবার বাহির হইয়া আসিল। খাপখোলা তলোয়ারের মত রূপ-ঈষৎ দীর্ঘ পাতলা দেহ, উগ্রগৌর দেহবর্ণ। পিঙ্গল চোখ, মাথার চুল পর্যন্ত পিঙ্গলাভ। তাহাকে দেখিয়া প্রজারা উৎসাহিত হইয়া উঠিল। এ-বাড়ির বড় ছেলে মহীন্দ্রকে দেখিয়া তাহাদের ভয় হয়, দশটা কথার পর মহীন্দ্র একটা জবাব দেয়, তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া পর্যন্ত সে কখনও কথা বলে না। আর এই ছোটদাদা বাবুটির রূপ যতই উগ্র হউক না কেন, এমন নিঃসঙ্কোচ স্বচ্ছন্দ ব্যবহার, এমন মধুমাখা মিষ্ট কথা তাহারা কাহারও কাছে পায় না। গল্প লইয়া তাহাদের সহিত তাহার মিলনক্ষেত্র গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রাচীন চাষীদের কাছে সাঁওতাল-বিদ্রোহের গল্প শুনিতে যায়, সে নিজে বলে দেশ বিদেশের কত গল্প। সমুদ্রের ধারে সোমনাথ শিব মন্দির লুঠের কথা, আমেরিকার সাহেবদের সঙ্গে বিলাতের সাহেবদের লড়াইয়ের কথা। তাহারা বিস্ময়বিমুগ্ধ হইয়া শোনে, অহীন্দ্রকে দেখিয়া তাহারা পরম উৎসাহের সহিত বলিল, ছোটদাদাবাবু কবে এলেন?

অহীন্দ্র এখান হইতে দশ মাইল দূরে শহরের স্কুলে পড়ে। অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছি, চারদিন ছুটি আছে। তারপর, তোমরা এসেছ কোথায়? দাদাও বাড়ি নেই, নায়েব-কাকাও নেই।

তাহারা বলিল, আপনি তো আছেন দাদাবাবু, আপনি আমাদের বিচার করে দ্যান।

খিলখিল করিয়া হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, আমি বিচার করতে পারি নাকি, দূর দূর!

তাহারা ধরিয়া বসিল, না দাদাবাবু, আপনাকে আমাদের এ দুঃখের কথা শুনতেই হবে। না শুনলে আমরা দাঁড়াব কার কাছে? নইলে নিয়ে চলুন আমাদের মায়ের দরবারে আমরা না খেয়ে পড়ে থাকব এইখানে।

অহীন্দ্র মায়ের কাছে গেল। সুনীতি স্বামীর জন্য আহার প্রস্তুত করিতেছিলেন। অহীন্দ্র আসিয়া দাঁড়াইতে বলিলেন, কি রে অহী?

মা ও ছেলের এক রূপ, তফাৎ শুধু চুল ও চোখের। মুখ, রং ও দেহের গঠনে অহি যেন মায়ের প্রতিবিম্ব-কেবল পিঙ্গল চুল ও চোখ তাহার পিতৃবংশের বৈশিষ্ট্য। সুনীতির বড় বড় কালো চোখ, চুলও ঘন কৃষ্ণবর্ণ। তাহার বড় ছেলে মহীর সহিত তাঁহার কোন সাদৃশ্যই নাই, সর্ব অবয়বে সে তাহার পিতার অনুরূপ।

অহি সকল কথা মাকে বলিয়া বলিল, ওরা একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে মা। কি বলব ওদের? ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া মা ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, সে কখনও হয় অহি? আমি কেন দেখা করব ওদের সঙ্গে? তুই একথা বলতে এলি কি বলে?

অহি সঙ্গে ফিরিল। মা হাসিয়া পিছন হইতে ডাকিয়া বলিলেন, অমনি চললি যে?

অহি পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বলি গে ওদের সেই কথা।

কই, একবার মুখখানা দেখি।

ছেলে ফিরিয়া দাঁড়াইল, মা তাহার চিবুকখানা স্পর্শ করিয়া বলিলেন, এমন ‘ফুলটুস’ ছেলে আমি কোথাও দেখি নি। একেবারে ফুলের ঘায়েও রাগ হয়ে যায়।

সত্যি কথা, মায়ের সামান্য কথাতেই অহির অভিমান হইয়া যায়। এ সংসারে তাহার সকল আব্‌দার একমাত্র মায়ের উপর। শৈশব হইতেই সে বাপের কাছে বড় ঘেঁষে না, তাহার বড় ভাই মহীন্দ্র বরং পিতার কাছে কাছে ফিরিয়া থাকে। দুই ভাই প্রকৃতিতে যেন বিপরীত। মহীন্দ্র অভিমান জানে না, সে জানে দুর্দান্ত ক্রোধে আত্মহারা হইয়া আঘাত করিতে, শক্তিবলে আপনার ইপ্সিত বস্তু মানুষের কাছ হইতে আদায় করিয়া লইতে। ইস্পাতের মত সে ভাঙিয়া পড়ে, তবু কোনমতেই নত হয় না। আর অহি খাঁটি সোনার মত নমনীয়–আঘাতে ভাঙে না, অভিমানে বাঁকিয়া যায়।

মা আবার প্রশ্ন করিলেন, রাগ হল তো অমনি?

না।

না কেন? আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তুই বুঝি ওদের বলেছিস, মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিবি?

অহি বলিল, বলি নি, কিন্তু দেখা করতে ক্ষতি কি?

ক্ষতি নেই, বলিস কি তুই? রায়-বাবুরা যে হাসবে, বলবে, বাড়ির বউ হয়ে চাষা প্রজাদের সঙ্গে কথা কইলে !

বলুক গে। তাই বলে ওরা ওদের দুঃখের কথা বলতে এলে শুনবে না? আর, এমনধারা মুসলমান নবাববাড়ির মত পর্দার দরকারই বা কি? আজকাল মেয়েরা দেশের কাজ করছে ! ইউরোপে– এই যুদ্ধে –

বাধা দিয়ে মা হাসিয়া বলিলেন, তোর মাস্টারিতে আর আমি পারি নে অহি। তা তুই নিজে শুনে যা বলতে হয় বল না; সেইটেই আমার বলা হবে ! আমি মহীকে বলব, আমিই বলেছি এ কথা।

ছেলে জিদ ধরিল, না, সে হবে না, তোমাকেই শুনতে হবে। আমি বরং দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব। ওরা বাইরে থাকবে, তুমি ঘরে থাকবে।

শেষে তাহাই হইল। অহীন্দ্রকে মধ্যে রাখিয়া সুনীতি প্রজাদের অভিযোগ শুনিতে বসিলেন। তাহারা আপনাদের যুক্তিমত দাবি জানাইয়া সমস্ত নিবেদন করিল, প্রকাশ করিল না শুধু ইন্দ্র রায়ের নিকট শরণ লইতে যাওয়ার কথা এবং রায়-মহাশয়ের সুকৌশলে প্রত্যাখ্যানের কথা। তাহারা বক্তব্য শেষ করিয়া বলিল, আপনার চরণে আমরা আশ্রয় নিলাম মা, আপনি ইয়ের ধর্মবিচার করে দ্যান।কালীর গেরাসে আমাদের সবই গিয়েছে মা,আমাদের আলু লাগাবার জমি নাই, আখ লাগাবার জায়গা নাই, আর কি বলব মা, -চাষীর বাড়িতে ছোলার ঝাড় ওঠে না গম ওঠে না। আমরা তবু তো কখনও খাজনা না-দেওয়া হই নাই।

সুনীতি বলিলেন, তোমরা বরং ও-বাড়ির দাদার কাছে যাও। অহিকে তোমাদের সঙ্গে দিচ্ছি। ও-বাড়ির দাদা অর্থে ইন্দ্র রায় মহাশয়। প্রজারা ইন্দ্র রায়ের নাম শুনিয়া নীরব হইয়া গেল। রংলাল চট করিয়া বুদ্ধি করিয়া বলিল, আজ্ঞে না মা, উনি জমিদার বটেন; কিন্তু বুদ্ধিতে উনি জেলাপির পাক। যা করতে হয় আপুনি করে দ্যান !

সুনীতি বলিলেন, ছি বাবা, এমন কথা কি বলতে হয়। তিনিই হলেন এখন গ্রামের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এ বাড়ির মালিকের অসুখের কথা তোমরা তো জান ! মহী হাজার হলেও ছেলেমানুষ। আমি স্ত্রীলোক। সমস্ত গ্রামের জমিদার নিয়ে যে বিবাদ, তার মীমাংসা কি আমার দ্বারা হয় বাবা? যদি কখনও ভগবান মুখ তুলে চান, মহী অহি উপযুক্ত হয়, তবেই আবার তোমাদের অভাব-অভিযোগের বিচার এ-বাড়িতে হতে পারবে। এখন তোমরা ও-বাড়ির দাদার কাছেই যাও। অহি তো তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছে।

প্রজাদের মধ্যে রংলালই আবার বলিল, আজ্ঞে মা, তিনিও খামচ তুলেছেন। সেই তো আমাদের ভয়, নইলে অন্য জমিদারের সঙ্গে লড়তে আমাদের সাহস আছে। না হয় দশ টাকা খরচ হবে।

সুনীতি বলিলেন, তিনিও কি চরটা দাবি করেছেন নাকি?

মুখে বলেন নাই, কিন্তু ভঙ্গী সেই রকমই বটে। গাঁসুদ্ধ জমিদারই দাবি করেছে মা, আমরাও দাবি করছি, আবার মহাজনেরাও এসে জুটেছে। দাবি করেন নাই শুধু আপনারা। অথচ-

অথচ কি মোড়ল? ওতে কি আমাদেরও অংশ আছে?

বার বার হতাশার ভঙ্গীতে মাথা নাড়িয়া রংলাল বলিল, কি আর বলি মা? আর বলবই বা কাকে? আইনে তো বলছে, চর যে-গাঁয়ের লাগাড় হয়ে উঠবে, সেই গাঁয়ের মালিক পাবে। তা চরখানি তো রায়হাটের সঙ্গে লেগে নাই। লেগে আছে উ-পারের চক আফজলপুরের সঙ্গে। তা আফজলপুর তো আপনাদেরই ষোল আনা। আর ই-পারের হলেও তারও আপনারা তিন আনা চার গণ্ডার মালিক।

অন্য প্রজারা রংলালের কথায় চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিল। মানুষ বৃদ্ধ হইলে ভীমরতি হয়, নাহিলে দাবি জানাইতে আসিয়া এ কি বলিতেছে বুড়া! সুনীতি একটু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, দেখ বাবা, তোমার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমরা দাবি করছ চর তোমাদের প্রাপ্য, এপারে কালী নদীতে জমি তোমাদের গেছে, ওপারের চরে সেটা তোমাদের পেতে হবে। আবার-

মধ্যপথেই বাধা দিয়ে লজ্জিতভাবে রংলাল বলিল, বলছি বৈকি মা, সেটা হল ধর্মবিচারের কথা। আপনি বলেন, ধম্ম অনুসারে আমাদের পাওনা বটে কি না?

সুনীতি নীরবেই কথাটা ভাবিতেছিলেন, পাওয়া উচিত বৈকি। দরিদ্র চাষী প্রজা-আহা-হা!

রংলাল আবার বলিল, আর আমি যা বলছি- ই হল আইনের কথা। আইন তো আর ধম্মের ধার ধারে না। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোই হল আইনের কাজ।

সুনীতি ধীরভাবে চিন্তা করিয়া শেষে বলিলেন, আচ্ছা, আজই আমি মহীকে আর মজুমদার ঠাকুরপোকে আসতে চিঠি লিখে দিচ্ছি। তাঁরা এখানে আসুন; তারপর তোমরা এস। তবে একথা ঠিক, তোমাদের উপর কোন অবিচার হবে না।

রংলাল আবার বলিল, শুধু যেন আইনই দেখবেন না মা, ধম্মপানেও একটুকুন তাকাবেন।

সুনীতি বলিলেন, ধম্মকে বাদ দিয়ে কিছু করা যায় বাবা? কোন ভয় নেই তোমাদের।

প্রজারা কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া চলিয়া গেল।

সুনীতি বলিলেন, তুই ওবেলা একবার ও-বাড়ির দাদার কাছে যাবি অহি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *