কালিন্দীর কূলে বাঁশি বাজে
কালিন্দীর কূলে বাঁশি বেজে উঠলো। বাঁশি বেজে উঠলো গোঠ গোকুলে। তার সুরে কেঁদে উঠলো একটি মেয়ে। রাধা। সে তীনভুবনজনমোহিনী। শিরীষকুসুমকোআলী। অদ্ভুত কনকপুতলী। তার রূপে মুগ্ধ হয় তিন ভুবনের অধিবাসীরা। শিরীষকুসুমের মতো কোমল সে। রাধা এক অদ্ভুত—আগে কখনো দেখা যায় নি এমন—সোনার প্রতিমা। সে-রাধার কান্নার সুরে বাঁধা প’ড়ে আছে মধ্যযুগের প্রথম দিকের বাঙলা ভাষা।
যেমন আদি বাঙলা ভাষার রূপের কথা কেউ জানতো না মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর “চর্যাপদ” আবিষ্কারের আগে, তেমনি মধ্যযুগের শুরুতে কেমন রূপ ছিলো বাঙলা ভাষার, তাও জানতো না কেউ “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” নামের একটি পুথি আবিষ্কারের আগে। পুথিখানি ছিলো বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। বহু শতাব্দী ধ’রে অনাদরে চোখের আড়ালে প’ড়ে ছিলো সোনার স্তূপের চেয়েও দামি এ-পুথিটি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ওই বাড়িতে উদ্দেশ পান পুথিটির। বলা যেতে পারে আবিষ্কার করেন তিনি পুথিটি। এর দু-বছর আগে বাঙলা ভাষার পুরোনো রূপ নেপালে আবিষ্কার করেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। বসন্তরঞ্জন রায় আবিষ্কার করেন বাঙলা ভাষার মধ্যযুগের সূচনাকালের রূপ। তাই অমরতা জুটেছে তাঁরও ভাগ্যে।
বাঙলা ভাষার ইতিহাসে ১৯১৬ একটি সোনার বছর। ওই বছরই বেরোয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত হাজার বছরের পূরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা, অর্থাৎ “চর্যাপদ”। বাঙালি দেখতে পায় তার মাতৃভাষার আদি চেহারা। আর ওই বছরেই বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” বহু কবির লেখা কাব্য নয়। এটি একজন কবির লেখা একটি বড়ো কাহিনীকাব্য। কবির নাম বড়ু চণ্ডীদাস। কাব্যটির “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” নাম কবি দেন নি, দিয়েছেন সম্পাদক। কাব্য হিশেবে অতুলনীয় ও অসামান্য “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”। কবি বড়ু চণ্ডীদাস বাঙলা ভাষার প্রথম মহাকবি।
কখন জীবিত ছিলেন মহাকবি বড়ু চণ্ডীদাস? কখন লিখেছিলেন তিনি এ-কাব্য? কবি ও কাব্যের কাল সম্পর্কে বিতর্ক হয়েছে অনেক। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন লিপিবিদ। তিনি পুথিটির লিপি পরীক্ষা ক’রে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন যে কাব্যটি ১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দের আগে—সম্ভবত চতুৰ্দশ শতকের প্রথমার্ধে—রচিত হয়েছিলো। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে চতুর্দশ শতকের শেষভাগে রচিত হয়েছিলো বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও এমনই মনে করেন। তিনি মনে করেন পঞ্চদশ শতকের সূচনার আগেই, অর্থাৎ চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে রচিত হয়েছিলো কাব্যটি। এখন মনে করা হয় ১৩৫০ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এটি রচিত হয়েছিলো। এটির ভাষায় ওই কালের চিহ্ন আছে। তাই “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই মধ্যযুগের সূ চনাকালের বাঙলা ভাষার রূপ। বাঙলা ভাষার ওই কালের এমন বিশ্বস্ত রূপ আর কোনো রচনায় পাওয়া যায় না।
“চর্যাপদ”-এ পাই দশম থেকে দ্বাদশ শতকের বাঙলা ভাষা। শৈশবের বাঙলা ভাষা। জন্মকালের বাঙলা ভাষা। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই চোদ্দ শতকের শেষ দিকের বাঙলা ভাষা। মধ্যযুগের শুরুর কালের বাঙলা ভাষা। কিন্তু এর মাঝে যে কেটে গেছে দেড় শো বছর, ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টীয় অব্দ। কোথায় গেল ওই দেড় শো বছরের বাঙলা ভাষা? এক নয়, দুই নয়, দশ নয়, দেড় শো বছর। ওই সময় কি ছিলো না বাঙলা ভাষা? তা তো হ’তে পারে না। আগে আছে, পরেও আছে, মাঝখানে ভাষার এ-ফাঁক তো বিস্ময়কর। এ নিয়ে বিস্মিত থাকতে হবে বাঙালিকে চিরকাল। ওই সময় বাঙালি ছিলো, ছিলো বাঙলা ভাষা। কিন্তু তা মিশে গেছে আকাশেবাতাসে। তার লিখিত নমুনা নষ্ট হয়ে গেছে। এ-জন্যে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে এ-সময়টাকে, ১২০০ থেকে ১৩৫০-এর কালকে, বলা হয় অন্ধকার যুগ। কখনো বলা হয় ক্রান্তিকাল। ওই সময়ে বাঙলা ভাষার বিশ্বস্ত নমুনা পাই না। তাই যেই পাই “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”, উৎফুল্ল হয়ে উঠি আনন্দে। কেননা “চর্যাপদ”-এর ভাষার দেড় শো বছর পরের বাঙলা ভাষার রূপ এতে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ওই ফাঁকটা পুরবে না কখনো, বুঝতে পারবো না কীভাবে দেড় শো বছর ধ’রে বদলিয়েছিলো বাঙলা। কিন্তু যেই “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” পাই, বুঝি বদলে গেছে বাঙলা ভাষা। রক্তের সম্পর্ক আছে তার সাথে “চর্যাপদ”-এর ভাষার, আছে রূপের সম্বন্ধ। কিন্তু তা বেশ দূরের।
নদীর পারে বাঁশির সুরের মতো নরম, বুক থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের মতো কোমল “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর ভাষা। সোনার প্রতিমা রাধা এ-কাব্যে অনেক কেঁদেছে। তার চোখের জলের দাগ লেগে আছে এর ভাষায়। রাধা যেমন শিরীষ ফুলের মতো, এর ভাষাও তেমনি। আজকাল এর বেশকিছু শব্দ অচেনা হয়ে গেছে আমাদের কাছে, কিন্তু তা আমাদের বেশি কষ্ট দেয় না। “চর্যাপদ”-এর ধাঁধা আর প্রহেলিকা নেই, নেই কর্কশতা। “চর্যাপদ”-এর কবিরা ‘এবংকার দিঢ় বাখোড় মোড়িউ’ ব’লে গর্জন করেন, “বিবিহ বিআপক বান্ধণ তোড়িউ’ ব’লে ভেঙেচুরে ফেলেন সব বাধা। অনেক কষ্ট ক’রে বুঝি যে কবি ভেঙে ফেলেছেন দিনরাত্রির বন্ধনস্তম্ভ, চুরমার করেছেন বিবিধ ব্যাপক শৃ খল। তাঁর ওই ভাষা না বুঝে শুধু ধ্বনি শুনেই বুঝি যে চিৎকার ক’রে উঠেছেন এক কর্কশ তান্ত্রিক। ভয় লাগে ওই তান্ত্রিকের চেহারা ভেবে। মন কেঁপে ওঠে তাঁর কথা শুনে। কিন্তু “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ কোথাও ওড়ে রাধার নীল শাড়ি, কোথাও মুক্তোর মতো ঝিলিক দেয় তার অশ্রু। কোথাও তার নিশ্বাসে ভিজে ওঠে মাঠঘাট। তার কান্নায় কেঁদে ওঠে নীল হয়ে যমুনার ঢেউ। “চর্যাপদ”-এর ভাষা পদ্মার গর্জন। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর ভাষা যমুনার কলতান।
বুঝতে খুব কষ্ট হয় না এ-ভাষা। রাধা যখন বলে, ‘আল বড়ায়ি। এগার বৎসরের বালী। যেহ্ন নলিনীদল কোঅলী।’ তখন গুণগুণ সুর শুনি। বুঝি সে বলছে, ‘ওগো বড়ায়ি, আমি এগারো বছরের বালিকা। যেনো পদ্মদলের মতো কোমল।’ কৃষ্ণ যখন বলে, ‘মুখ তোর আল রাধা বিকচ কমলে। নয়ন তোর নীল উপলে। মাণিক জিণিআঁ তোর দশনের যুতী।’ তখন বুঝি কৃষ্ণ খুব মুগ্ধ হয়েছে রাধার সৌন্দর্যে। কেননা মুখ তার ফোটা পদ্ম। মাণিক্যের চেয়েও সুন্দর তার দন্তপংক্তি। কৃষ্ণ বলে, ‘রাধাকে না পাআঁ বেআকুল মনে।’ এ-কাব্যে ‘এবেঁ মলয় পবন ধীরে বহে’। ‘সুগন্ধি কুসুমগণ বিকসএ।’ কৃষ্ণ চ’লে যাওয়ার পর রাধাকে ‘দিনের সূরুজ পোড়াআঁ মারে রাতিহো এ দুখ চান্দে।’ দিনের সূর্য তাকে দহন করে, রাতে দুঃখ দেয় চাঁদ। তারপর আসে ‘মেঘ আন্ধারী অতি ভয়ঙ্কর নিশি’। মেঘে অন্ধকার ভয়ঙ্কর রাত। একা কদমতলায় ব’সে কাঁদে রাধা। ‘একসরী ঝুরো মো কদমতলে বসী।’ আর তখন ‘মলয় পবন বহে বসন্ত সমএ। বিকসিত ফুলগন্ধ বহু দূর জাএ। ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দূরে। কিন্তু কাঁদে রাধা। তার কান্নার সুরে তার চোখের জলে টলমল করতে থাকে মধ্যযুগের শুরুর সময়ের কোমল-মধুর বাঙলা ভাষা। এ-কাব্যের একটি আকুলব্যাকুল পদ এমন :
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে॥
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন ॥১॥
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা ॥
ধ্রু॥ কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পায়ে বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোণ দোষে।
অঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী ॥২॥
আকুল করিতে কিবা আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন ॥
পাখি নহোঁ তার ঠাঁই উড়ী পড়ি জাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ ॥৩॥
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী।
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী।
আন্তর সুখাএ মোর কাহ্ন অভিলাসে।
বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে ॥৪॥
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর একটি সর্গের নাম ‘বংশীখণ্ড’। এটি ‘বংশীখণ্ড’-এর দ্বিতীয় পদ। ভাষা এর কঠিন নয়। এখানে সেখানে একটুআধটু বদল করলে, বানান আধুনিক করলে এ-ভাষা আমাদের কালের ভাষা হয়ে ওঠে। এর কান্নায়, এর বেদনায় সহজেই সাড়া দেয় আমাদের চিত্ত। আধুনিক বাঙলায় এ-পদটি হবে এমন :
কে বাঁশি বাজায় বড়ায়ি কালিন্দী (যমুনা) নদীর কূলে?
কে বাঁশি বাজায় বড়ায়ি এ-গোঠ গোকুলে (যমুনা পারের গ্রামে)?
আমার শরীর আকুল আর মন ব্যাকুল।
বাঁশির সুরে আমি রান্না এলোমেলো ক’রে ফেললাম।
কে বাঁশি বাজায় বড়ায়ি, কে সে জন?
দাসী হ’য়ে তার পায়ে নিজেকে সঁপে দেবো।
কে বাঁশি বাজায়, বড়ায়ি, মনের আনন্দে?
তার কাছে, বড়ায়ি, আমি কী দোষ করেছি?
আমার চোখের পানি ঝরে অজস্র ধারায়।
বাঁশির সুরে আমি প্রাণ হারালাম।
আমার মন আকুল করার জন্যে কি
মধুর সুরের বাঁশি বাজাচ্ছে কৃষ্ণ?
আমি পাখি নই যে তার কাছে উড়ে যাবো।
মাটি দু-ভাগ হও, আমি প্রবেশ ক’রে লুকোবো।
আগুনে বন পুড়লে বড়ায়ি সকলেই জানে।
আমার মন পোড়ে কুমোরের পোআনের মতো।
কৃষ্ণের অনুরাগে আমার মন সুখ পায়।
বাশলীর বন্দনা ক’রে গাইল চণ্ডীদাস
এ-অনুবাদে অর্থ হয়তো কিছুটা বেশি স্পষ্ট হয়েছে, কিন্তু মুছে গেছে রাধার অশ্রু, থেমে গেছে বাঁশির সুর, স্তব্ধ হ’য়ে গেছে যমুনার পার ব্যাকুল-করা রাধার আকুলতা।
“চর্যাপদ”-এর ভাষা নিয়ে বিতর্ক আছে। অন্যরাও—যেমন হিন্দি, মৈথিলি, ওড়িয়াভাষীরা—দাবি করেছেন “চর্যাপদ”-এর ভাষাকে নিজেদের ভাষা ব’লে। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” নিয়ে অমন তর্কের সুযোগই নেই। এর ভাষা বাঙলা; এবং শুধুই বাঙলা। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর অধিকাংশ শব্দই প্রাকৃত ও প্রাকৃতজাত। ওই শব্দরাশির একটি বড়ো অংশ এখনো বাঙলা ভাষায় চলে। প্রচুর ‘ণ’ ব্যবহৃত হয়েছে এর বানানে, আর চন্দ্রবিন্দু ( ) পাওয়া যায় এখানেসেখানে। এতে বেশকিছু অনার্য শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো সংস্কৃত শব্দের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে অনেক শতক ধ’রে আছে ব’লে সেগুলোকে সংস্কৃত শব্দ ব’লেই মনে হয়। নীর, পূজা, মলয়, মীন, মুকুট, কদলী, গঙ্গা, ডুমুর, তাম্বল, নারিকেল প্রভৃতি এমন শব্দ। বইটিতে কয়েকটি আরবিফারসি শব্দও পাওয়া গেছে। যেমন : কামান, মজুরি, মজুরিআ, খুরমূজা, বাকী, মিনতি প্রভৃতি শব্দ।
আধুনিক বাঙলায় বাক্যের কর্তা পুরুষ বা স্ত্রী, যাই হোক, তাতে ক্রিয়ার রূপে কোনো পার্থক্য ঘটে না। আমরা বলি, ‘ছেলেটি গেলো’, ‘মেয়েটি গেলো’। দু-বাক্যই ‘গেলো”। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ অনেক জায়গায় দেখা যায় বাক্যের কর্তা যদি স্ত্রী হয়, তাহলে ক্রিয়াও স্ত্রী-রূপ ধরে। পাওয়া যায় ‘গেলী রাহী’, ‘বড়ায়ি চলিলী’, ‘কোপে গরজিলী রাধা’র মতো প্রয়োগ।
আধুনিক বাঙলায় বহুবচন করা হয় সাধারণত ‘রা’, ‘এরা’, ‘দেৱ’, ‘গুলো’ প্রভৃতি যোগ ক’রে। বহুবচনের চিহ্নরূপে ‘রা’র প্রয়োগ ঘটে “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এই প্রথম। পাওয়া যায় ‘আজি হৈতেঁ আহ্মারা হৈলাহোঁ একমতী’, ‘পুছিল তোহ্মারা কেহ্নে’র মতো প্রয়োগ। তবে “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” —এ সমষ্টিবাচক শব্দ—’সব’, ‘গণ’, ‘জন’ প্রভৃতি দিয়েই বহুবচন প্ৰকাশ করা হয়েছে বেশি। যেমন : ‘তোহ্মে সব’, ‘যত নানা ফুল পান করপুর সব পেলাইল পাএ’, ‘এসব গোপবধূজন লআঁ কথা না যাসি বড়ায়ি’, ‘আর যত বাদ্যগণ আছের কাহ্নাঞিঁ।
ক্রিয়ার খুব মজার মজার রূপ পাওয়া যায় এ-কাব্যে। এখন আমরা শুধু ক্রিয়ার সাথে ‘ই’ যোগ ক’রে যা কিছু বোঝাই, এ-কাব্যে তা বোঝানোর জন্যে ক্রিয়ার সাথে কখনো কখনো ‘অওঁ, কখনো ‘ও’, বা ‘ওঁ’, কখনো ‘ই’ বা ‘ঈ’, কখনো ‘ইএ’ যোগ করা হতো। যেমন : ‘যবে আন করো’, ‘নাহি হেন ডাল যাত করো বিসরামে’, ‘আহ্মে জাইএ দধি বিকে’, আহ্মে করিবাক পারী’।
এখন বাঙলায় যেখানে ‘লাম’ বসে এ-কাব্যে সেখানে পাওয়া যায় ‘লোঁ’ বা ‘লো’, কখনো ‘লাহোঁ, কখনো ‘ল’, কখনো ‘ই’। কৃষ্ণ বলছে, ‘হাথে তুলী মোঁ খাইলোঁ বীষে’, ‘অর্থাৎ হাতে তুলে আমি বিষ খেলাম’। রাধা বলছে, পুনরপি পড়িলাহোঁ তাহান হাথে’, অর্থাৎ ‘আবার তার হাতে পড়লাম’। কৃষ্ণ গর্ব করছে এমনভাবে : ‘মেদনী ধরিল আহ্মে দশনের আগে’, অর্থাৎ ‘দাঁত দিয়ে আমি পৃথিবীকে ধরলাম’। এখন ভবিষ্যৎ বোঝানোর জন্যে যেখানে ‘বো’ ব্যবহার করি, এ-কাব্যে সেখানে বসেছে ‘বোঁ’, কখনো ‘বওঁ, কখনো ‘ব’, কখনো ‘মো’। রাগেঅভিমানে যখন রাধা বাহুর বলয় চূর্ণবিচূর্ণ করতে চায়, তখন সে বলে, ‘বাহুর বলয়া মো করিবোঁ শংখচুর।’ বাহুর বলয় আমি চূর্ণবিচূর্ণ করবো। অভিমানে অপমানে যখন আর বেঁচে থাকতেও চায় না, তখন রাধা বলে : ‘দিবওঁ পরাণ মোঁ করিব আত্মঘাতী।’ আমি প্ৰাণ দেবো, আত্মহত্যা করবো।
কালিন্দীর কূলে বাঁশি বেজে উঠেছিলো ছ-শো বছর আগে। সে-বাঁশির সুর “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”। তাতে চিরকালের জন্যে বাঁধা প’ড়ে আছে বাঙলা ভাষার মধ্যযুগের সূচনাকালের রূপ।